অজেয় টারজন (টারজান দি ইনভিন্সিবল)
যে গল্পটা আমি বলতে যাচ্ছি সেটা যদি দুটি নির্দিষ্ট ইউরোপীয় রাষ্ট্রের সংবাদপত্রে প্রকাশিত হত তাহলে তার ফলে মহাযুদ্ধের চাইতেও ভয়ঙ্কর আর একটা যুদ্ধ বেধে যেতে পারত। কিন্তু তা নিয়ে আমার কোন রকম মাথা ব্যথা নেই। আমার কথা হচ্ছে, গল্পটা খুব ভাল আর এই কাহিনীর অনেকগুলো লোমহর্ষক অধ্যায়ের সঙ্গে অরণ্যরাজ টারজান খুবই ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।
আফ্রিকার জঙ্গলে পাকাঁপোক্তভাবে গড়া একটা ছোটখাট শিবির। অনেক কালো মানুষ গোমাঙ্গানি অর্থাৎ নিগ্রো আর কিছু সাদা মানুষ অর্থাৎ টারমাঙ্গানি সেখানে বাস করে। তারা বেশ কিছুদিন এখানে আছে। মনে হচ্ছে আরও কিছুদিন থাকবে। সাধা মানুষদের জন্য চারটে তাবু আর আরবদের জন্য ‘ব্যেট’গুলো বেশ সুন্দরভাবে শৃঙ্খলার সঙ্গে সাজানো; তার পিছনে আছে স্থানীয় গাছ-গাছালি দিয়ে তৈরি নিগ্রোদের চালাঘর।
একটা ‘ব্যেট’ এর সামনে খোলা জায়গায় বসে জনাকয় বেদুইন তাদের প্রিয় কফি খাচ্ছে; আর একটা তাবুর সামনে গাছের ছায়ায় বসে চারজন সাদা মানুষ তাস খেলছে; চালাঘরে একদল দীর্ঘদেহী গালা যোদ্ধা মিংকালা’ খেলছে; অন্য জাতির কালা মানুষরাও সেখানে আছে পূর্ব আফ্রিকার ও মধ্য আফ্রিকার মানুষদের সঙ্গে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে কিছু পূর্ব উপকূলের নিগ্রো অধিবাসী। তাদের সঙ্গে এত বেশি রাইফেল আছে যে মনে হয় বুঝি তাদের প্রত্যেকের জন্যই একটা করে রাইফেল আছে।
একটা পাগড়ি-বাঁধা কালো পূর্ব-ভারতীয় মানুষ তাঁবুর সামনে পা ভেঙে বসেছিল। তার চোখে রয়েছে কিছু দূরের আর একটা তাঁবুর দিকে। একটু পরেই একটা মেয়ে যখন সেই তাঁবু থেকে বেরিয়ে এল, তখনই রঘুনাথ জাফল উঠে তার দিকে এগিয়ে গেল। মিষ্টি হেসে তাকে কি যেন বলল। মেয়েটি উত্তর দিল, কিন্তু হাসল না। তারপরই যারা তাস খেলছিল মেয়েটি তাদের দিকে এগিয়ে গেল।
একটি পরিষ্কার মুখ বড়সড় লোক বলে উঠল, হেলো জোরা! ভাল ঘুম হয়েছে তো?
মেয়েটি বলল, তাতো হয়েছে কমরেড; কিন্তু ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে যে বিরক্তি ধরে গেল। এভাবে অকর্মার মত তো আর বসে থাকা যায় না।
যা বলেছ। আমরাও সেই দশা।
রঘুনাথ জাফর শুধাল, কমান্ডার জাভেরি মার্কিনী লোকটির জন্য তুমি আর কতদিন অপেক্ষা করবে?
বড় কর্তাটি কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, তাকে আমার দরকার। বংশজাত ধনী মার্কিনীটিকে আমাদের কাজের জন্য সক্রিয়ভাবে যুক্ত রাখার নৈতিক সুবিধার কথা চিন্তা করেই তার জন্য অপেক্ষা করাটা যুক্তিযুক্ত বলে মনে করছি।
মেক্সিকোবাসী কৃষ্ণকায় যুবক রোমেরো বলল, এই লোকগুলো সম্পর্কে আমি কিন্তু সর্বদাই সন্দিহান। পুঁজিবাদই তাদের একমাত্র ভরসা। মনে-প্রাণে তারা সর্বহারাদের ঘৃণা করে, ঠিক যেমন আমরা তাদের ঘৃণা করি।
জাভেরি তবু বলল, এ লোকটি একটু স্বতন্ত্র মিগুয়েল। সে পুরোপুরিভাবেই আমাদের দলে এসে গেছে।
যে লোকটি এখনও জমায়েতে হাজির হয়নি তার সম্পর্কে এইসব কথা শুনে জোরা ড্রিনের ঠোঁট ঈষৎ ঘৃণায় বেঁকে গেল।
বেলা গড়িয়ে এল।
আর একটা দলের আগে আগে হাঁটতে হাঁটতে একটি যুবক মাথাটা খাড়া করে কান পাতল। বলল, এত দূরে তো নয় টনি।
না স্যার, আরও অনেক কাছে, ফিলিপিনোটি উত্তর দিল।
যুবকটি বকুনির সুরে বলল, অন্য সকলের সঙ্গে দেখা হবার আগেই ওই ‘স্যার কথাটা তোমাকে ছাটাই করতে হবে টনি।
ফিলিপিনোটি মুচকি হেসে বলল, ঠিক আছে কমরেড। সকলকেই আমি স্যার’ বলি তো, তাই ওটা পাল্টানো একটু শক্ত।
তাহলে তো তুমি খুব সাচ্চা লাল হতে পারনি টনি।
ফিলিপিনোটি এবার জোর গলায় বলল, আমি নিশ্চয় সাচ্চা লাল। না হলে এখানে এসেছি কেন? তুমি কি মনে কর সিংহ, পিঁপড়ে, সাপ, মাছি ও মশায় ভর্তি এই নিষিদ্ধ দেশে আমি বেড়াতে এসেছি? না, আমি এসেছি ফিলিপিনের স্বাধীনতার জন্য জীবন দিতে।
অপরজন গম্ভীর গলায় বলল, কিন্তু তুমি এখানে আসায় ফিলিপিনের মানুষ স্বাধীন হবে কেমন করে?
এন্টনিও মোরি মাথা চুলকে বলল, তা জানি না; তবে এর ফলে আমেরিকার বিপদ হবে।
নতুন দিন দেখা দেবার সঙ্গে সঙ্গে শিবিরবাসীদের মধ্যেও দেখা দিল নতুন কর্মব্যস্ততা। একটা ফোল্ডিং ক্যাম্প-টেবিলে বসে জাভেরি সহকারীদের নির্দেশ দিচ্ছে; জোরা ও রঘুনাথ জাফরের সাহায্যে সারিবদ্ধ সশস্ত্র মানুষগুলোর হাতে গুলি-গোলা তুলে দিচ্ছে। শেখ আবু বতন তার রোদে-পোড়া সৈনিকদের নিয়ে দূরে বসে আছে।
জোরা বলল, শিবির পাহারা দেবার জন্য কতজনকে রেখে যাচ্ছ।
জাভেরি জবাব দিল, তুমি ও কমরেড জাফর এখানেই থেকে যাবে। শিবিরের রক্ষী হিসেবে তোমরা ছেলেরা থাকবে; তাছাড়া দশজন আস্কারিও এখানে থেকে যাবে।
মেয়েটি বলল, তাই যথেষ্ট। এখানে কোন বিপদ নেই।
জাভেরি বলল, না। এখন নেই, তবে সেই টারজান এসে পড়লে ব্যাপারটা অন্য রকম দাঁড়াবে। তবে আমি শুনেছি সে নাকি অনেক দিন এ দেশে নেই। আকাশ পথে কি একটা অভিযানে বেরিয়েছে। সেই। থেকে তার কোন খবর নেই। প্রায় নিশ্চিত যে সে মারাই গেছে।
শেষ কালো মানুষটির হাতে গুলি-গোলা পৌঁছে দেয়া হয়ে গেলে কিটেম্বো তার স্বজাতীয়দের কিছুটা দূরে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে নিচু গলায় কি যেন বোঝাতে লাগল। তারা সকলেই বাসোম্বা; তাই তাদের সর্দার কিটেম্বো তাদের ভাষাতেই কথা বলছে।
কিটেম্বো সব সাদা মানুষকেই ঘৃণা করে। স্মরণাতীতকাল থেকে ব্রিটিশরা এসে তাদের দেশকে অধিকার করেছে।
কিটেম্বো সর্দার অসভ্য, নিষ্ঠুর, বিশ্বাস হন্তা; তার কাছে সব সাদা মানুষই অভিশাপস্বরূপ। তবু জাভেরির সঙ্গে যোগাযোগটাকে সে ব্রিটিশদের উপর প্রতিশোধ নেবার একটা সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেছে। তাই সে তার স্বজাতিদের অনেককে এনে জাভেরির অভিযানে নাম লিখিয়েছে, কারণ জাভেরি। তাকে কথা দিয়েছে ব্রিটিশদের চিরদিনের মত এখান থেকে তাড়িয়ে দেবে এবং আবার কিটেম্বোকে সগৌরবে তার আসনে বসাবে।
আজকের এই মনোরম সকালে এমনি একটি দলই যাত্রা করেছে রহস্যময় ওপার-এর রত্ন- ভাণ্ডার লুট করার আশায়।
জোরা ড্রিনভ তাদের যাত্রার পথের দিকেই তাকিয়ে আছে। যতক্ষণ দেখা গেল ততক্ষণ জোরার দুটি সুন্দর চোখের তারা স্থিরনিবদ্ধ হয়ে রইল পিটার জাভেরির উপর। ধীরে ধীরে নদীর পথটা ধরে চলতে চলতে সে অন্ধকার বনের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।
জাভেরি দলবল নিয়ে চলেছে ওপার-এর পথে। ষড়যন্ত্রকারীদের মূল দলটার সঙ্গে তাড়াতাড়ি মিলিত হবার আশায় ওয়েনি কোল্ট তার লোকজনদের তাড়া দিচ্ছে দ্রুততর গতিতে অগ্রসর হতে। পাছে অধিক সংখ্যায় এক সঙ্গে আফ্রিকায় ঢুকলে সকলের মনোযোগ তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয় তাই প্রধান ষড়যন্ত্রকারীরা। ভিন্ন ভিন্ন পথে আফ্রিকায় ঢুকেছে। কোল্ট নেমেছে পশ্চিম উপকূলে। সেখান থেকে কিছুটা পথ ট্রেনে গিয়ে তারপর চলেছে পব্রজে। স্বভাবতই অন্য প্রধান ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে মিলিত হতে সে খুবই ইচ্ছুক হয়ে পড়েছে। কারণ একমাত্র পিটার জাভেরি ছাড়া আর কারও সঙ্গে তার পরিচয় নেই।
ইউরোপের শান্তিকে বিঘ্নিত করা এবং উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চলের উপর আধিপত্য বিস্তার করাই যাদের লক্ষ্য সে রকম একটি অভিযাত্রী দলের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করার মধ্যে যে প্রচণ্ড বিপদের ঝুঁকি আছে মার্কিন যুবকটি তা ভাল করেই জানে। তবু যৌবনের উৎসাহ দমিয়ে রাখতে পারেনি।
উপকূল থেকে একঘেয়ে দীর্ঘ যাত্রাপথে তার একমাত্র সঙ্গী ছেলে মানুষ টনি। ফিলিপিনের স্বাধীনতা সম্পর্কে তার ধারণা খুবই অস্পষ্ট। অর্থনৈতিক বিপ্লবের ফলে একদিন না একদিন ফোর্ড বা রকফেলারের সম্পত্তির অংশীদার হয়ে সেও ভাল ভাল পোশাকপত্র কিনতে পারবে এই স্বপ্নেই সে বিভোর।
কোল্টরা চলেছে তো চলেছে। তারা কিন্তু ঘুণাক্ষরেও জানতে পারে নি যে তাদের মাথার উপরকার বৃক্ষ-পথে চলেছে এক অরণ্য-দেবতা এপোলো, আর তার কাঁধে বসে অবিরাম কিচিরমিচির করছে একটা ছোট বানর। গাছের উপর দিয়ে চলতে চলতে হঠাৎ-ই এই সাদা মানুষটি টারজনের চোখে পড়ে যায়। তখনই তার মনে হয়, যে নবাগত মানুষদের মূল শিবিরের খোঁজে সে চলেছে এই যুবকটিও হয়তো সেই দিকেই যাচ্ছে; আর তাই ধৈর্যের সঙ্গে সে এই যুবকটিকে অনুসরণ করে চলেছে।
ওদিকে রঘুনাথ জাফর চলেছে জোরা ড্রিনভের তাঁবুর দিকে। মেয়েটি খাটিয়ায় শুয়ে বই পড়ছিল। জাফর দরজায় দাঁড়াতেই তার ছায়া পড়ল বইটার উপর। মেয়েটি চোখ তুলে তাকাল।
হিন্দুটির ঠোঁটে খোসামোদের হাসি। বলল, দেখতে এলাম তোমার মাথার ব্যথাটা কেমন আছে।
মেয়েটি ঠাণ্ডা গলায় বলল, ধন্যবাদ। কিন্তু কেউ আমার বিশ্রামের ব্যাঘাত না ঘটালেই আমি তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে যাব।
তবু জাফর ভিতরে ঢুকে একটা চেয়ারে বসল। বলল, সকলেই চলে যাওয়ায় বড় একা-একা লাগছে।
না। আমি একাই ভাল আছি। বিশ্রাম নিচ্ছি।
জাফর বলল, তোমার মাথা ব্যথাটা বড় তাড়াতাড়ি চাড়া দিয়ে উঠল। একটু আগেও তো তোমাকে বেশ তাজা ও হাসিখুশি দেখেছিলাম।
মেয়েটি কোন জবাব দিল না।
সম্ভবত তার মনের কথাটা আঁচ করেই রঘুনাথ জাফর বলল, ওয়ামালা আস্কারিদের সঙ্গে শিকারে গেছে।
আমি তো তাকে অনুমতি দেইনি, জোরা বলল।
অনুমতিটা আমিই দিয়েছি, জাফর বলল।
খাটিয়ায় উঠে বসে মেয়েটি সক্রোধে বলল, সে অধিকার তোমার নেই। তুমি বড় বেশি দূর এগিয়েছ। কমরেড জাফর।
হিন্দুটি সান্ত্বনার ভঙ্গীতে বলল, একটু অপেক্ষা কর লক্ষ্মীটি। ঝগড়া করো না। তুমি তো জান আমি তোমাকে ভালবাসি, আর ভিড়ের মধ্যে ভালবাসা জমে না।
মেয়েটি বলল, বটে, এতদূর! জাভেরি ফিরে আসুক, তারপর এর ফয়সালা হবে।
হিন্দুটি সাগ্রহে বলল, জাভেরি ফিরে আসার অনেক আগেই আমি তোমাকে শিখিয়ে দেব কেমন করে আমাকে ভালবাসতে হয়। বলেই সে পা বাড়াল। মেয়েটিও লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্রের খোঁজে চারদিকে তাকাল।
হিন্দুটি বলল, তুমি সম্পূর্ণ নিরস্ত্র। তাঁবুতে ঢুকেই আমি সব কিছু দেখে নিয়েছি।
তুমি একটা পশু, জোরা বলল।
কেন এত অবুঝ হচ্ছ জোরা? ভেবে দেখ
বেরিয়ে যাও! মেয়েটি আদেশ করল।
কিন্তু রঘুনাথ জাফর দ্রুত এগিয়ে গিয়ে মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরল।
ওয়েনি কোল্টের গাইড কিছুটা আগে আগেই চলছিল। হঠাৎ থেমে মুখটা হাসিতে ভরিয়ে সে পিছন ফিরে তাকাল। সামনে আঙুল বাড়িয়ে বিজয়গর্বে বলল, ঐ শিবির বাওয়ানা!
সেই রকমই দেখাচ্ছে। কোল্ট ঘাড় নাড়ল। চারদিকে ঘুরে একটু দেখাই যাক। টনিকে সঙ্গে নিয়ে কোল্ট তাঁবুগুলো পরীক্ষা করে দেখতে লাগল।
সঙ্গে সঙ্গে তার নজরে পড়ল, একটা তাঁবুর মধ্যে ধস্তাধস্তি চলছে।
তাঁবুর ভিতরকার কাণ্ড দেখে কোল্ট তো একেবারে হা–দুটি নর-নারী মেঝেতে পড়ে ধস্তাধস্তি করছে; পুরুষটি মেয়েটির গলা টিপে ধরেছে, আর মেয়েটি প্রাণপণে পুরুষটির মুখে কিল-গুতো মারছে।
কোল্ট জাফরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এক ঝটকায় তাকে এক পাশে ঠেলে ফেলে দিল। রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে জাফরও এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে মার্কিন যুবকটিকে আক্রমণ করতেই সে তাকে এমন এক ঘুষি চালাল যে জাফরের মাথাটা ঘুরে গেল। আবার আক্রমণ করতেই আর এক ঘুষি পড়ল তার মুখে। এবার জাফর মাটিতে পড়ে গেল। কোন রকমে উঠে দাঁড়াতেই কোল্ট তাকে সজোরে চেপে ধরে একপাক ঘুরিয়ে পাছায় লাথি মেরে তাবুর দরজা দিয়ে বাইরে ঠেলে দিল। ফিলিপিনো সঙ্গীকে বলল, ও যদি আবার তাঁবুতে ঢুকতে চেষ্টা করে তো গুলি করবে টনি। তারপর মেয়েটিকে তুলে নিয়ে খাটিয়ায় শুইয়ে দিয়ে কোল্ট বালতি থেকে জল এনে জোরার কপাল, গলা ও কব্জি ভাল করে মুছে দিল।
বাইরের গাছের ছায়ায় কুলি ও আস্কারিদের শুয়ে থাকতে দেখে রঘুনাথ জাফর গুটি গুটি নিজের তাঁবুর দিকে সরে পড়ল। তার বুকের মধ্যে ক্রোধ ও খুনের নেশা টগবগ করে ফুটছে।
জোরা ড্রিনভ চোখ মেলে তাকাল। তার মুখের উপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে ওয়েনি কোল্ট।
কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে জোরা ড্রিনভ বলল, নিশ্চয় তুমিই সেই মার্কিন যুবক।
কোল্ট জবাব দিল, আমি ওয়েনি কোল্ট। আর তুমি আমাকে চিনতে পেরেছ বলেই অনুমান করছি যে এটা কমরেড জাভেরির শিবির।
মেয়েটি মাথা নাড়ল। তুমি ঠিক সময়েই এসে পড়েছিলে কমরেড।
সেজন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ।
একটু পরে কোল্ট শুধাল, কমরেড জাভেরি কি শিবিরে নেই?
না; সে একটা ছোট অভিযানে বেরিয়েছে।
কোল্ট হেসে বলল, তাহলে তো আমাদের দু’জনকে পরিচয় করিয়ে দেবার মত কেউ এখানে নেই।
জোরা বলল, আমি ক্ষমা চাইছি। আমার নাম জোরা ড্রিনভ।
আর ও লোকটা কে?
রঘুনাথ জাফর, একজন হিন্দু।
ও কি আমাদের লোক?
হা; কিন্তু আর থাকবে না- পিটার জাভেরি ফিরে আসার পরে তো নয়ই।
তার মানে?
মানে পিটার ওকে খুন করবে।
কোল্ট কাঁধ ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, সেটাই ওর প্রাপ্য। হয়তো সে প্রাপ্যটা আমারই মিটিয়ে দেয়া উচিত ছিল।
মার্কিন যুবকটি তাঁবু থেকে বেরিয়ে গেল। চোখ দুটো অর্ধেক বুজে জোরা খাটিয়াতেই শুয়ে রইল।
গাছের উপর বসে টারজান সবই লক্ষ্য করছে। অপরিচিত যুবকটি ব্যক্তিত্বপূর্ণ আচরণ তার মনকে টেনেছে। ওদিকে রঘুনাথ জাফর যে একটা রাইফেল হাতে নিয়ে তাঁবু থেকে বেরিয়ে গেল সেটাও তার দৃষ্টি এড়ায়নি।
তাঁবু থেকে বেরিয়ে জাফর সোজা জঙ্গলে ঢুকে পড়ল। টারজানও গাছের উপর দিয়ে তার পিছু নিল। জঙ্গলের আড়ালে আড়ালে শিবিরের অর্ধেকটা ঘুরে জাফর থেমে গেল। সেখান থেকে গোটা শিবিরটাই সে অস্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, কিন্তু পাতার আড়ালের জন্য তাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না।
কোল্ট লোকজনের কাজকর্মের তদারক করছে। পথশ্রমে ক্লান্ত লোকগুলো চুপচাপ কাজ করে চলেছে। চারদিকে শান্ত নিস্তব্ধতা। হঠাৎ একটা আর্ত চীৎকার ও রাইফেলের গুলির শব্দ শুনে সে স্তব্ধতা খান্ খান্ হয়ে গেল। একটা বুলেট কোল্টের মাথার পাশ দিয়ে শাঁ করে বেরিয়ে গিয়ে পিছনে দাঁড়ানো লোকটির কানের নতি ছিঁড়ে দিয়ে চলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে হৈ-চৈ পড়ে গেল। কোন দিক থেকে গুলিটা এসেছে খুঁজতে গিয়েই কোল্টের চোখে পড়ল জঙ্গলের ভিতর থেকে এক ঝলক ধোঁয়া উঠছে।
ঐ তো ওখানে, বলে কোল্ট সেদিকেই ছুটে যাচ্ছিল, হঠাৎ থেমে আস্কারিদের সর্দারকে বলল, কিছু লোক সঙ্গে নিয়ে তুমি ডান দিক থেকে এগিয়ে যাও, আর বাকিদের নিয়ে এগোচ্ছি বাঁদিক থেকে।
ঠিক আছে বাওয়ানা, বলে সর্দার কিছু লোক নিয়ে এগিয়ে গেল।
কোল্টই প্রথম দেখতে পেল-শিবিরের কাছাকাছি পড়ে আছে রঘুনাথ জাফরের মৃতদেহ। তার ডান হাতে রাইফেলটা ধরাই আছে, বুকের উপর থেকে বেরিয়ে আছে একটা তীরের কাঠি।
হিন্দুটিকে কবর দেবার নির্দেশ দিয়ে ওয়েনি কোল্ট লোকজন নিয়ে তাঁবুতে ফিরে এল।
জোরা ড্রিনভ তার তাঁবুর দরজাতেই দাঁড়িয়ে ছিল। জিজ্ঞাসা করল, ব্যাপার কি? কি হয়েছে?
রঘুনাথ জাফর খুন হয়েছে।
সব বিবরণ শুনে জোরা বলল, তাহলে তীরটা কে ছুঁড়ল?
কোল্ট বলল, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। সবই যেন রহস্যে ঢাকা।
খাবার টেবিলে বসে কোল্ট বলল, আজ তোমার উপর দিয়ে একটা ঝড় বয়ে গেছে, অথচ তোমার তো কোনরকম ভাবান্তর দেখছি না।
জীবনে এ রকম অনেক ঝড় আমি কাটিয়ে এসেছি কমরেড কোল্ট, কাজেই আমার মধ্যে এখন স্নায়ু বলতে কিছু নেই।
কোল্ট এক দৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। বলল, তোমাকে দেখে মনে হয় জন্মসূত্রে তুমি প্রোলেতারিয়েত নও।
আমার বাবা ছিল শ্রমিক। জারের আমলে নির্বাসনে থাকতেই তার মৃত্যু হয়। তাই তো যা কিছু রাজকীয়, যা কিছু পুঁজিবাদ সংক্রান্ত সে সবেতেই আমার এত ঘৃণা। তাই তো কমরেড জাভেরির দলে যোগ দেবার প্রস্তাব যখন এল তখন প্রতিশোধ নেয়ার আর একটা ক্ষেত্র আমি খুঁজে পেলাম।
কোল্ট বলল, যুক্তরাষ্ট্রে জাভেরির সঙ্গে যখন আমার সর্বশেষ দেখা হয় তখন তার মাথায় এখনকার মত কোন পরিকল্পনা নিশ্চয় ছিল না, কারণ এ ধরনের কোন অভিযানের কথা সে তখন আমাকে বলেনি। এখানে এসে তার সঙ্গে যোগ দেবার নির্দেশ যখন পেলাম তখনও বিস্তারিত বিবরণ কিছুই আমাকে জানানো হয়নি। কাজেই তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমি এখন সম্পূর্ণ অন্ধকারেই আছি।
জোরা এবার বলল, অবশ্য মোটামুটি পরিকল্পনাটা আমাদের কারো কাছেই গোপনীয় কিছু নয়। মূল পরিকল্পনাটা হচ্ছে, পুঁজিবাদী শক্তিগুলোকে এমনভাবে যুদ্ধ ও বিপ্লবের মুখে ঠেলে দিতে হবে যাতে তারা আমাদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হতে না পারে। আমাদের প্রেরিত প্রতিনিধিরা দীর্ঘকাল ধরে ভারতবর্ষের বিপ্লবকে এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা করছে যাতে গ্রেট ব্রিটেনের মনোযোগ ও সামরিক শক্তি সেই দিকে আকৃষ্ট হতে বাধ্য হয়। কিন্তু ফিলিপিনে আমাদের ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল। চীনের অবস্থা তো তুমি ভালই জান। আমরা আশা করি, আমাদের সহায়তায় অচিরেই তারা জাপানের পক্ষে বিপদের কারণ হয়ে উঠবে। ইতালি একটি সাংঘাতিক শত্রু, আর প্রধানত সে দেশকে ফ্রান্সের সঙ্গে একটা যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলতেই আমরা এখানে এসেছি।
কোল্ট তবু প্রশ্ন করল, কিন্তু আফ্রিকার জঙ্গলে অভিযান চালিয়ে জাভেরি ইতালি ও ফ্রান্সের মধ্যে যুদ্ধ লাগাবে কেমন করে?
এই মুহূর্তে ফরাসী ও ইতালীয় কমরেডদের একটি প্রতিনিধিদল রোমে রয়েছে ঠিক এই কাজেরই জন্যে। ফরাসী সেনাবাহিনী কর্তৃক ইতালীয় সোমালিল্যান্ড অভিযানের পরিকল্পনা সমন্বিত কাগজপত্র তাদের সঙ্গে দেয়া হয়েছে।
যথাসময়ে কমরেড জাভেরির রোমস্থ জনৈক গুপ্ত সদস্য ফ্যাসিস্ট সরকারকে এই ষড়যন্ত্রের কথাটা। জানিয়ে দেবে; আর প্রায় সেই একই সময়ে আমাদের অভিযানের কিছু সাদা মানুষ ফরাসী সামরিক অফিসারের ইউনিফর্ম গায়ে চড়িয়ে আমাদেরই কালো মানুষদের ফরাসী স্থানীয় সৈনিক সাজিয়ে ইতালীয় সোমালিল্যান্ড আক্রমণ করবে।
কোল্ট সোসাহে বলে উঠল, পরিকল্পনাটি যেমন দুঃসাহসিক তেমনি বিরাট, কিন্তু এ রকম একটা পরিকল্পনাকে সফল করতে তো প্রচুর অর্থ ও জনবলের প্রয়োজন।
মেয়েটি বলল, আমি অবশ্য সব কথা জানি না, তবে এটুকু জানি যে প্রাথমিক পর্যায়ের কাজের জন্য এই যথেষ্ট অর্থ সে ইতোমধ্যেই সগ্রহ করতে পেরেছে; আর বাকি অর্থের জন্য এই অঞ্চল থেকে পাওয়া সোনার উপরেই সে নির্ভর করছে।
মাথার উপরে গাছের ডালের উপর টান-টান হয়ে শুয়ে টারজান কান খাড়া করে সবকিছুই শুনছে।
কোল্ট আবার বলল, আচ্ছা, কথাটা যদি খুবই গোপনীয় না হয় তাহলে বলতো এত বেশি পরিমাণ। সোনা কমরেড জাভেরি কোথায় পাবে বলে আশা করছে।
ওপার-এর বিখ্যাত রত্ন-ভাণ্ডারে। আশা করি তার কথা তুমিও শুনেছ।
তা শুনেছি, কিন্তু তাকে নিছক উপকথা ছাড়া আর কিছুই ভাবিনি। এ ধরনের রত্ন-ভাণ্ডারের কথা সারা বিশ্বের গ্রাম্য কাহিনীতে অনেক শোনা যায়।
কিন্তু ওপার উপকথা নয়।
মাথার উপরে টারজান নিঃশব্দে সেখান থেকে সরে গেল। যাবার আগে নকিমাকে কাঁধ থেকে নামিয়ে দিল।
কোল্ট ও জোরার কথাবার্তা বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে ঘুরতে লাগল। এক সময় টারজান আবার সেখানে ফিরে এল। এবার কিন্তু সে একা নয়।
জোরা বলল, জাফরকে কে যে মেরেছে তা হয়তো আমরা কোনদিনই জানতে পারব না।
তার কথা শেষ হবার আগেই তাদের মাথার উপরকার গাছের ডালে একটা সর-সর শব্দ হল, আর তারপরেই একটা ভারী দেহ ছিটকে পড়ল দু’জনের মাঝখানের টেবিলের উপরে। টেবিলটা ভেঙে চৌচির হয়ে গেল।
দু’জনেই লাফিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। কোল্ট চকিতে রিভলবারটা বের করল, আর জোরা পিছনে সরে গিয়ে উদগত চীৎকারটাকে চেপে দিল। কোল্টের মাথার চুল খাড়া হয়ে উঠল। তাদের দুজনের মাঝখানে চিৎ হয়ে পড়ে আছে রঘুনাথ জাফরের মৃতদেহ; মৃত চোখ দুটি তাকিয়ে আছে রাতের অন্ধকারের দিকে।
টারজান ও নকিমা পাহাড়ের চূড়াকে অতিক্রম করে নির্জন উপত্যকার পথে এগিয়ে চলেছে তাদের সামনেই দেখা যাচ্ছে প্রাচীন ওপার-এর দীর্ঘ প্রাচীর, সুউচ্চ গৃহশীর্ষ ও গম্বুজের সারি। আফ্রিকার উজ্জ্বল সূর্যকিরণে শহরের লাল ও সোনালী গম্বুজ ও মিনারগুলো ঝকঝক করছে।
টারজান ইতঃপূর্বেও আর একবার ওপারে এসেছিল। সেবারে প্রধান পুরোহিত কাড়জিকে পরাস্ত করে সে লা-কে তার প্রিয় প্রজাদের সিংহাসনে প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছিল। সেবারে ওপার-এর মানুষদের বন্ধুত্বের স্মৃতি নিয়েই সে ফিরে গিয়েছিল। তারপর বেশ কিছু বছর ধরে লা-কে সে বান্ধবী বলেই জানে। সেখানে বন্ধুর সমাদর পাবার আশা নিয়েই সে ওপার-এর পথে চলেছে।
কাজেই নির্ভয়ে ও নিঃশংকচিত্তে সে ওপারের নিরেট পাথরের বহিঃপ্রাচীরের ফাটলের ভিতর দিয়ে ঢুকে কয়েক ধাপ সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেল। সেখানে খানিকটা ভোলা জায়গার ওপারে আরও একটা সংকীর্ণ পথ পার হয়ে সে একটা প্রশস্ত রাজপথে গিয়ে পড়ল। তার বিপরীত দিকেই দাঁড়িয়ে আছে ওপার এর বিরাট মন্দিরের ধ্বংসস্তূপ।
নিঃশব্দে সে মন্দিরের দরজা পার হয়ে গেল। দুই পাশে সারি সারি স্তম্ভ দাঁড়িয়ে আছে। স্তম্ভের গায়ে নানা কিন্তু দর্শন পাখির মূর্তি খোদাই করা।
টারজান নির্ভয়ে দরজা ঠেলে ভিতরে পা রাখল। সঙ্গে সঙ্গে একটা পাকানো গদা সজোরে তার মাথায় এসে পড়ল। টারজান অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল।
জটা-বাঁধা চুল-দাড়িওয়ালা জনবিশেক লোক তাকে ঘিরে ফেলল। ছোট ছোট বাঁকানো পায়ে তারা এগিয়ে এল। তাদের পাট-করা দাড়ি লোমশ বুক পর্যন্ত নেমে এসেছে। দুর্বোধ্য ভাষায় কলরব করতে করতে তারা শক্ত বেড়ি দিয়ে টারজনের হাত-পা বেঁধে ফেলল। তারপর তাকে তুলে নিয়ে আর একটা বড় ঘরে ঢুকল। মেঝেতে কয়েক ফুট উঁচু বেদীর উপরকার মস্ত বড় সিংহাসনে বসে আছে একটি যুবতী নারী।
তার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল জট-বাঁধা চুল-দাড়িওয়ালা আর একটি লোক। তার হাতে-পায়ে সোনার তাগা বাঁধা, গলায় সাতনরী হার। নিচে মেঝের উপর অনেক নর-নারীর জটলা-তারা ওপার-এর অগ্নি দেবতার সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনী।
লোকগুলো টারজানকে এনে সিংহাসনের নিচে ফেলে দিল। ঠিক সেই মুহূর্তে চৈতন্য ফিরে আসায় টারজান চোখ মেলে চারদিকে তাকাল।
সিংহাসনের পাশে দাঁড়ানো লোকটিকে বলল, এ সবের অর্থ কি ডুথ? লা কোথায়? তোমাদের প্রধান সন্ন্যাসিনী কোথায়?
মেয়েটি ক্রুদ্ধ হয়ে সিংহাসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, জেনে রাখ হে বিদেশী, আমিই প্রধান সন্ন্যাসিনী। আমার নাম ওআ, অগ্নি-দেবতার প্রধান সন্ন্যাসিনী আমি।
তাকে উপেক্ষা করে টারজান আবার ডুথকে জিজ্ঞাসা করল, লা কোথায়?
ওআ রাগে জ্বলে উঠল। তার হাতের বলিদানের খড়ের রত্নখচিত হাতলভাঙ্গা ছাদের ফাটল দিয়ে আসা সূর্যকিরণে ঝিকমিকিয়ে উঠল। লাফ দিয়ে বেদীর শেষ প্রান্তে এসে সে চীৎকার করে বলে উঠল, সে মারা গেছে। ঠিক যেমন তুমি মারা যাবে যখন তোমার রক্ত দিয়ে আমরা অগ্নি-দেবতার পূজা করব। লা ছিল দুর্বল। সে তোমাকে ভালবেসেছিল। অথচ দেবতা তোমাকে বেছে নিয়েছিল বলি হিসেবে। কিন্তু ওআ শক্তিময়ী। টারজান ও লা তার কাছ থেকে ওপার-এর সিংহাসন চুরি করে নিয়েছিল। এবার সে তর প্রতিশোধ নেবে। ওকে নিয়ে যাও। বলির যূপকাষ্ঠে ফেলার আগে ওকে যেন আমাকে আর না দেখতে হয়।
টারজনের পায়ের বেড়ি কেটে দিয়ে তাকে নিয়ে চলল ওপার-এর অন্ধকার কারাকক্ষের দিকে। মশালের আলোয় পথ দেখে দেখে তাকে কারাকক্ষে রেখে লোকজনরা চলে গেল।
আগেও একবার টারজান এই কারাগারে ছিল; আর পালিয়েও গিয়েছিল। কাজেই এবারও সে সঙ্গে সঙ্গে পালাবার পথ খুঁজতে শুরু করে দিল।
সে বুঝতে পারল, ঘরের একমাত্র ঘুলঘুলির ওপারের বারান্দাটাতে কোন সন্ন্যাসী পাহারায় নেই। পালাবার এই তো সুযোগ।
ঘুলঘুলিটার লোহার শিক বেঁকিয়ে টারজান লাফিয়ে পড়ল নিচের অন্ধকার বারান্দায়। ঘরের পর ঘর পার হয়ে সে এগিয়ে চলল।
টারজনের সামনে কাঠের হুড়কো দেয়া একটা বড় দরজা। দ্রুত হাতে হুড়কোটা তুলে দরজা খুলে সে ভিতরে পা দিল।
শিবিরে আসবার পরদিন ওয়েনি কোল্ট সাংকেতিক ভাষায় একটা লম্বা চিঠি লিখে ছোকরা চাকরটাকে দিয়ে সেটা উপকূলে পাঠিয়ে দিল। নিজের তাঁবু থেকেই জোরা ড্রিনভ সেটা দেখতে পেল। কিছুক্ষণ পরে কোল্ট এসে হাজির হল জোরার তাঁবুর পাশে বড় গাছটার ছায়ায়।
জোরা বলল, কমরেড কোল্ট, আজ সকালেই তুমি একটি চিঠি পাঠিয়েছ।
দ্রুত চোখ তুলে কোল্ট বলল, হ্যাঁ।
তোমার জানা উচিত ছিল যে এই অভিযানে একমাত্র কমরেড জাভেরি ছাড়া আর কেউ চিঠি লিখতে পারে না।
কোল্ট বলল, আমি জানতাম না। আমি উপকূলে পৌঁছবার আগেই কিছু টাকা সেখানে এসে থাকার কথা ছিল। টাকাটা আসেনি। সেটার খোঁজ নিতেই ছোকরাকে পাঠিয়েছি।
ও, বলে জোরা চুপ করল।
বিকেলে দু’জন একসঙ্গে শিকারে বের হল। একসঙ্গে রাতের খাবার খেল। এইভাবে দিন কাটতে লাগল। তারপর একদিন উত্তেজিত কালা আদমি এসে খবর দিল, অভিযাত্রীরা ফিরে এসেছে। সকলেই বুঝল, ছোট দলটির পতাকায় জয়ের বার্তা লেখা হয়নি। নেতাদের মুখে পরাজয়ের হতাশা। জাভেরি জোরাও কোল্টের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করল।
রাতে খাবার টেবিলে বসে দু’পক্ষই তাদের অভিজ্ঞতার কথা শোনাল। রঘুনাথ জাফরের মৃত্যু, করে দেয়া ও তার ভৌতিক পুনরভ্যুত্থানের কাহিনী সকলকেই রোমাঞ্চিত কলে তুলল।
পরদিন সকাল থেকেই ওপার-এ অভিযান পরিচালনা নিয়ে একটা বৈঠক বসল। আলোচনায় স্থির হল, পুরো দলটাই ওপার-এর প্রাচীর পর্যন্ত যাবে; কিন্তু যোদ্ধাদের মধ্যে মাত্র দশজন সাদা মানুষদের সঙ্গে শহরে ঢুকবে।
নতুন অভিযানের উদ্যোগ-আয়োজনেই কয়েকটা দিন কেটে গেল। একদিন সকালে জাভেরি ও তার দলবল নতুন করে ওপার-এর পথে যাত্ৰ করল। জোরা ড্রিনভও তাদের সঙ্গে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু যেহেতু উত্তর আফ্রিকার অনেক এজেন্টের কাছ থেকে চিঠিপত্র আসার কথা আছে তাই তাকে শিবিরে রেখে যাওয়া হল। আবু বতনও তার সেনাদল ও কিছু চাকরবাকরসহ শিবির পাহারা দেয়ার জন্য রয়ে গেল।
ঘরের ভিতরে পা দিয়েই টারজান বুঝতে পারল, আবার সে বন্দী হয়েছে। এখন সে কি করবে? ভাবতে ভাবতেই ঘরের পিছন দিক থেকে চুপি চুপি পা ফেলার শব্দ তার কানে এল। খাপ থেকে ছুরি খুলে সে চকিতে ঘুরে দাঁড়াল। ও কার পায়ের শব্দ! নিঃশব্দে সে অপেক্ষা করতে লাগল।
কে তুমি? একটি নারী-কণ্ঠের প্রশ্ন।
তুমি কোথায়? টারজনের পাল্টা প্রশ্ন।
ঘরের পিছন দিকে, স্ত্রীলোকটি জবাব দিল।
তারপর বলল, আমি তোমাকে চিনতে পেরেছি। এ কণ্ঠস্বর আমার পরিচিত। তুমি তো অরণ্যরাজ টারজান।
টারজান সাগ্রহে জিজ্ঞেস করল, কি ব্যাপার বল তো? ওআ হয়েছে প্রধান সন্ন্যাসিনী, আর নিজের কারাগারে তুমি নিজেই বন্দী?
লা তার দুঃখের কাহিনী শোনাল। ওআ ডুথের সঙ্গে ভালবাসা করে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পাকিয়ে তোলে। টারজানকে ভালবাসার জন্য রাজ্যের জনসাধারণ এমনিতেই লার প্রতি অসন্তুষ্ট ছিল। এবার ওআর মিথ্যা প্রচারের ফলে সকলেই তার বিরুদ্ধে গেল। লাকে সিংহাসন থেকে নামিয়ে সেখানে বসাল ওআকে, আর লাকে করল বন্দিনী।
কাহিনী শেষ করে লা বলল, তুমি এসে পড়েছ, এবার আমাদের পালাতে হবে।
টারজান অসহায়ভাবে বলল, কোন পথে পালাব?
লা বলল, আমার ঘরের পিছনের দেয়ালে দীর্ঘকাল ধরে অব্যবহৃত একটা সুড়ঙ্গ আছে।
সেটাই আমাদের পালাবার একমাত্র পথ।
হাতে হাত ধরে দু’জন অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্যে পা বাড়াল।
অনেক কষ্টের পথ পার হয়ে এক সময় দু’জনই একটা নির্জন ঘরে এসে বিশ্রাম নিল। অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকল। প্রধান সন্ন্যাসিনীর দুটি সুন্দর চোখ অরণ্য-দেবতার সুন্দর শরীরের উপর নিবদ্ধ।
এক সময় লা ডাকল, টারজান!
চোখ তুলে টারজান বলল, বল লা।
আমি আজও তোমাকে ভালবাসি টারজান।
ও কথা এখন থাক।
না, আমাকে বলতে দাও। এ কথা বলতে আমার দুঃখই হয়, তবু এ যে এক মধুর দুঃখ-আমার জীবনের একমাত্র মধুস্বাদ।
তার কাঁধে হাত রেখে টারজান বলল, তুমি চিরদিনই আমার অন্তর অধিকার করে আছ লা। তাকে ভালবাসাও বলতে পার।
টারজান কোন জবাব দিল না। দু’জন চুপচাপ এখন শুধু রাত নামার অপেক্ষা, যাতে সকলের অলক্ষ্যে তারা শহরে নামতে পারে। টারজনের মনে একটিমাত্র চিন্তা-কেমন করে তাকে আবার সিংহাসনে বসানো যায়।
লা বলল, অগ্নি-দেবতা যখন রাতের বিশ্রাম নিতে যায় তার ঠিক আগে সব সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনীরা দরবার-কক্ষে সমবেত হয়। আজ রাতেই সেই সমাবেশ হবে। তখন আমরা শহরে নামতে পারব।
তারপর? টারজনের সাগ্রহ প্রশ্ন।
দরবার-কক্ষে যদি আমরা ওআকে খুন করতে পারি, সেই সঙ্গে ডুথকেও, তাহলে আর ওদের কোন নেতা থাকবে না। আর নেতাহীন হলেই ওরা শক্তিহীন।
বেলা পড়ে এল। সূর্য নেমে এল পশ্চিম আকাশে। ক্রমে সন্ধ্যা হল। সকলের অলক্ষ্যে প্রাঙ্গণ পেরিয়ে দু’জন পথে নামল। সন্ন্যাসীরা টের পেয়ে হৈ-হৈ করে তাদের পিছু নিল। টারজান এবার লাকে কাঁধে ফেলে দ্রুত ছুটতে লাগল।
বাইরের জগতের অন্ধকারে ওপার-এর মানুষরা অভ্যস্ত নয়। তাই আর না এগিয়ে তারা ফিরে গেল।
টারজান লা-কে মাটিতে নামিয়ে দিল। লা কিন্তু তবু তার গলা জড়িয়ে ধরেই রইল। তার বুকের মধ্যে মুখ রেখে কেঁদে উঠল।
টারজান বলল, কেঁদো না লা। আমরা আবার ওপার-এ ফিরে যাব; তোমাকে আবার সিংহাসনে বসাব।
লা বলল, আমি সেজন্য কাঁদছি না।
তাহলে?
কাঁদছি আনন্দে, কারণ এখন আমি অনেকটা সময় তোমার সঙ্গে একলা থাকতে পারব।
একটা গাছে চড়ে তারা রাতটা কাটাল।
ভোরে প্রথম ঘুম ভাঙ্গল টারজনের। আকাশ মেঘে ঢাকা। ঝড় উঠবে। অনেক সময় হয়ে গেল কোনরকম খাবার মুখে পড়েনি। আগের দিন সকাল থেকে লাও কিছু খায়নি। অতএব সকলের আগে চাই কিছু খাবার। আর এখানে খাবার মানেই শিকার। টারজান একবার ঘুমন্ত লা-র দিকে তাকিয়ে শিকারের সন্ধানে চলে গেল।
একটা শুয়োরের রাং কেটে নিয়ে টারজান ফিরে চলল সেই গাছটার দিকে যার উপরে সে ঘুমন্ত লা কে রেখে এসেছে। সেখানে পৌঁছে দেখল লা নেই। নাম ধরে ডাকল, সাড়া পেল না। কোথায় গেল লা? নিশ্চয় ওপার-এর দিকে ফিরে গেছে। সেটাই তো তার একমাত্র পরিচিত জায়গা। টারজান ভাবল, তার ফিরতে যত দেরিই হয়ে থাকুক, লা কোনমতেই তার আগে ওপার-এর পর্বত-প্রাচীরে পৌঁছতে পারবে না। পথেই সে তাকে ধরে ফেলতে পারবে। টারজান তাই ওপার-এর পথেই পা চালিয়ে দিল।
কিন্তু পর্বত প্রাচীরের সানুদেশে পৌঁছেও তাকে দেখতে না পেয়ে সে একটা পাহাড়ের চূড়ায় উঠল। সেখান থেকে অনেক দূরে ওপার-কে দেখা যায়। এখানে বৃষ্টি খুবই অল্পই হয়েছে। ফলে লা ও তার নেমে যাওয়ার পায়ের ছাপ বেশ স্পষ্টই চোখে পড়ছে। কিন্তু সে পথ বেয়ে উপরে ওঠার কোন পায়ের ছাপই তো দেখা যাচ্ছে না। তাহলে লা গেল কোথায়? তবে কি সে জঙ্গলের পথ ধরেই অন্য দিকে চলে গেছে?
দ্রুত পায়ে পাহাড় থেকে নেমে সে জঙ্গলের দিকে এগিয়ে গেল।
বনপথ ধরে কিছুদূর এগিয়েই নদীর তীরে সে একটা শিবির দেখতে পেল। তার মনে আশা জাগল, এখানে হয়তো লার দেখা মিলবে। কাঁটা গাছের বেড়া দেয়া জায়গাটার মাঝখানে কিছু সাদা মানুষদের তাঁবু; গাছের ছায়ায় বসে কুলিরা ঝিমুচ্ছে; একটা মাত্র আস্কারি রয়েছে পাহারায়; বাকিরা রাইফেল পাশে রেখে দিবান্দ্রিা দিচ্ছে। কিন্তু ওপার-এর লা-কে কোথাও দেখতে পাওয়া গেল না। তবে কি লা-কে কোথাও বন্দী করে রেখেছে? কিন্তু রাতের অন্ধকারে ছাড়া তো আর সন্ধান করা যাবে না। অতএব তাকে অপেক্ষা করতেই হবে। কাছেই একটা গাছের উপরে উঠে সে ঘুমিয়ে পড়ল।
সন্ধ্যাবেলা জোরার জন্য রান্না করতে করতে বাচ্চা চাকর ওয়ামালা বলল, এর আগে তোমাকে বাদামী বাওয়ানার কাছে রেখে গিয়েছিল; সে তোক ভাল ছিল না। শেখ আবু বতনকেও আমার বিশেষ ভাল মনে হচ্ছে না। এখন বাওয়ানা কোল্ট এসে পড়লে বাঁচি।
জোরা বলল, আমারও তাই মনে হয়। ওপার থেকে ফিরে আসার পর থেকেই আরবরা যেন কেমন হয়ে উঠেছে।
ওয়ামালা বলল, সারাদিন তারা সর্দারের তাঁবুতে বসে ফুসুর-ফুসুর করেছে, আর আবু বতন বারবার তোমার দিকে তাকিয়েছে।
জোরা বলল, ওটা তোমার কল্পনা ওয়ামালা। এত সাহস তার হবে না।
পরমুহূর্তেই সে হঠাৎ বলে উঠল, ওদিকে দেখ ওয়ামালা। ও কে?
কালো লোকটি সেই দিকে চোখ ফেরাল। শিবিরের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে। সুন্দরী যুবতীটি এক দৃষ্টিতে তাদের দিকেই তাকিয়েছিল।
ততক্ষণে কয়েকজন আরবও তাকে দেখতে পেয়ে তার দিকে ছুট গেল। তা দেখে জোরাও দ্রুত তার দিকে এগিয়ে গেল যাতে আরবরা তাকে ধরবার আগেই সে পৌঁছে যেতে পারে। তার মুখের হাসি দেখেই ওপার-এর লা তার মনের ভাব বুঝতে পারল।
জোরা শুধাল, তুমি কে? একা এই জঙ্গলে কি করছ?
লা মাথা নেড়ে যে ভাষায় জবাব দিল তার মাথামুণ্ডু কিছুই জোরা বুঝতে পারল না। জোরা ড্রিনভ অনেক ভাষা জানে, কিন্তু কোন ভাষাতেই কাজ হল না। আরবরা তাদের ভাষায় কথা বলল; ওয়ামালা তার ভাষায় কথা বলল। কিন্তু কোন ফল হল না। তখন জোরা তার গলা জড়িয়ে ধরে তাঁবুর মধ্যে নিয়ে গেল। লা ইশারায় জানাল সে স্নান করবে।
আহারাদি শেষ হলে ওয়ামালা জোরার তাঁবুতে লা-র জন্য আর একটা খাটিয়া পেতে দিল।
জোরা বলল, ওয়ামালা, আজ রাতে তুমি তাঁবুর বাইরেই শোবে। এই নাও একটা পিস্তল।
শেখ আবু বতন অনেক রাত পর্যন্ত তার তাঁবুতে বসে সর্দারদের সঙ্গে কথাবার্তার শেষে বলল, এই নতুন চিজুটির জন্য যে দাম পাওয়া যাবে তেমনটি আগে কখনো মেলেনি।
ঘুম ভাঙতেই টারজান আকাশের তারার দিকে তাকাল। অর্ধেক রাত পার হয়ে গেছে। উঠে। শরীরটাকে টান টান করে নিচে নেমে সে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
শিবিরের সকলেই ঘুমিয়ে পড়েছে। একটিমাত্র আঙ্কারি প্রহরী ধূনির পাশে বসে আছে। তার চোখের দৃষ্টিকে এড়িয়ে টারজান কুলিদের ঝুপড়ির পিছন দিয়ে ইউরোপীয়দের তাবুর কাছে পৌঁছে গেল। একটার পর একটা তাঁবুর পিছন দিকের দেয়াল কেটে ভিতরে ঢুকে সে লা-কে খুঁজতে লাগল। কিন্তু বৃথা চেষ্টা। লা-কে দেখতে পেল না।
অগত্যা টারজান আবার সেই গাছেই ফিরে গেল, রাতটা সেখানে কাটিয়ে সকাল হলে আবার বেরিয়ে পড়ল লা-র সন্ধানে।
এক সঙ্গে তৈরি হয়ে এসে দু’জন প্রাতরাশ খেতে বসল তাঁবুর বাইরে গাছের ছায়ায়। ওয়ামালা পরিবেশন করল। জোরার মনে হল, শেখদের ঘরগুলোতে যেন একটা কর্মব্যস্ততা চলেছে। ব্যাপারটাকে সে কোনরকম গুরুত্ব দিল না, কারণ মাঝে মাঝেই ওরা তাঁবুগুলোকে এক জায়গায় নিয়ে যায়।
প্রাতরাশের পরে জোরা তার রাইফেলটা তেল দিয়ে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে দুটো কালো কুলিকে সঙ্গে নিয়ে শিকারে বেরিয়ে গেল। লা তাদের চলে যেতে দেখল, কিন্তু ইচ্ছা থাকলেও জোরা তাকে ডাকল না বলে সে তাদের সঙ্গে গেল না।
আবু বতনের একই জাতির আর এক শেখের ছেলে ইব্ন দামু এই অভিযানে ইবন্ বতনের ডান হাত। দূর থেকে অনেকক্ষণ ধরেই সে মেয়ে দুটির উপর নজর রেখেছিল। একজন বন্দুকবহনকারী ও দু’জন কুলিকে নিয়ে জোরাকে বেরিয়ে যেতে দেখেই সে বুঝল যে ওরা শিকারে চলে গেছে।
সঙ্গী দুটিকে নিয়ে সে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। তারপর ওপার-এর লা-র তাঁবুর দিকে এগিয়ে গেল। তার সামনে পৌঁছে ইবন্ দামুক কি যেন বলল। উদ্ধত দৃষ্টিতে তাকিয়ে মাথাটা নেড়ে লা তাঁবুর, দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু ইবন্ দামুক আর একটু কাছে গিয়ে লা-র খোলা কাঁধে হাত রাখল।
লা-র দুই চোখে আগুন জ্বলে উঠল। লাফ দিয়ে সরে গিয়ে কোমরের ছুরির বাটটা চেপে ধরল। ইবন্ দামুক কয়েক পা পিছিয়ে গেল, কিন্তু তার এক সঙ্গী লাফিয়ে পড়ে তাকে ধরতে গেল।
লোকটা মহামূর্খ! লা বাঘিণীর মত তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। বন্ধুরা বাধা দেবার আগেই লার ছুরিটা পর পর তিনবার আমূল বিদ্ধ হল তার বুকে। মরণ-আর্তনাদের সঙ্গে সঙ্গে তার মৃতদেহটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
সে আর্তনাদ শুনে অন্য আরবরাও ছুটে এল। লা চীৎকার করে বলল, দূরে থাক। অগ্নি-দেবতার প্রধান সন্ন্যাসিনীর গায়ে কেউ হাত তুলতে চেষ্টা করে না।
তার কথাগুলো কেউ বুঝল না। কিন্তু বুঝল তার জ্বলন্ত চোখ ও রক্তাক্ত ছুরির অর্থ। সকলেই দূরে দাঁড়িয়ে হৈ-চৈ করতে লাগল। এ সবের অর্থ কি ইবন্ দামুক? আবু বতন প্রশ্ন করল।
লোকটা ওকে স্পর্শও করেনি, অথচ
আবু বতন বলল, সিংহিণী হলেও ওর কোন ক্ষতি করা চলবে না।
ইবন্ দামুক বলল, উল্লাহ! কিন্তু ওকে পোষ মানাতে তো হবে।
শেখ বলল, যে লোক ওর জন্য সবচাইতে বেশি স্বর্ণমুদ্র দেবে সে কাজের ভারটা সেই নেবে। আমাদের একমাত্র কাজ ওকে খাঁচায় বন্দী করা। শোন বাছারা, ওকে ঘিরে ধরে ছুরিটা কেড়ে নাও। ভাল করে পিঠমোড়া করে হাত বেঁধে ফেল। অন্য সকলে ফিরে আসার আগেই আমরা তাঁবু তুলে যাত্রার জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকব।
ডজনখানেক লোক একযোগে লা-র উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। সিংহিণীর মত সেও লড়তে লাগল। ছুরির আঘাতে রক্তাক্ত হল অনেকে। আরও একটি আরবের মৃতদেহ লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। তবু শেষ পর্যন্ত লাকে পরাজয় স্বীকার করতে হল। ছুরিটা কেড়ে নিয়ে তার দুই হাত শক্ত করে বেঁধে ফেলা হল।
দু’জন সৈনিককে পাহারায় রেখে আবু বতন অন্য চাকরদের সঙ্গে নিয়ে যাত্রার আয়োজন করতে লাগল। ইবন্ দামুকের উপর জিনিসপত্র ও খাবার-দাবার গুছিয়ে নেবার ভার দিয়ে সে নিজে গেল ইউরোপীয়দের তাঁবু লুট করতে। আর বিশেষ নজর জোরা ড্রিনভ ও জাভেরির তাঁবুর উপর। আশানুরূপ সোনাদানা না পেলেও জোরার তাঁবুতে একটা বাক্সের মধ্যে সে প্রচুর টাকা পেল। দূরদর্শী জাভেরি তার। অর্থ-ভাণ্ডারের বেশি অংশটাই তাঁবুর মেঝেতে মাটির নিচে লুকিয়ে রেখেছিল। তাই সেটার খোঁজ আবু বতন পেলই না।
জোরা খুব ভাল শিকার নিয়েই ফিরে এল। তার পিছনেই রাইফেল দুটো নিয়ে আসছে ওয়ামালা। কুলিরা চলেছে শিকারের ভারী বোঝা নিয়ে। কিন্তু শিবিরে পৌঁছবার আগেই পথের দু’পাশের ঝোপের ভিতর থেকে আরবরা তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। দু’জন ওয়ামালার হাত থেকে রাইফেল দুটো ছিনিয়ে নিল। বাকিরা চেপে ধরল জোরাকে। রিভলবারটা টেনে বের করেও সে এই আকস্মিক আক্রমণকে ঠেকাতে পারল না। অচিরেই তার দুই হাত পিটমোড়া করে বেঁধে ফেলা হল।
সে জোর গলায় বলল, এ সবের অর্থ কি? শেখ আবু বতন কোথায়?
লোকগুলো হো-হো করে হেসে উঠল।
আর একটু এগিয়ে শিবিরের অবস্থা দেখে সে তো স্তম্ভিত। সব তাঁবু খুলে ফেলা হয়েছে। আরবরা রাইফেল হাতে যাত্রার জন্য প্রস্তুত। তার ক্ষণপূর্বের অতিথিটিকেও হাত বেঁধে আটকে রেখেছে।
এসব কেন করেছ আবু বতন? জোরা প্রশ্ন করল।
শেখ বলল, আল্লাহর ইচ্ছায় আমাদের দেশকে আমরা নাসরানিদের হাতে তুলে দেব না। আমরা দেশে ফিরে যাচ্ছি।
এই নারী ও আমাকে নিয়ে কি করতে চাও?
কিছুটা পথ তোমাদের সঙ্গে করেই নিয়ে যাব। সেখানে একটি ধনী লোক বাস করে। সে তোমাদের দু’জনকেই ভাল বাড়িঘর দেবে।
তার মানে কোন কালা সুলতানের কাছে আমাদের বেচে দেবে?
শেখ কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, কথাটা সেভাবে আমি বলছি না। বরং বলতে চাই, আমরা চলে গেলে তোমরা যাতে এই জঙ্গলে শুকিয়ে না মর তাই একজন ভাল বন্ধুর কাছে তোমাদের উপহার-স্বরূপ রেখে যেতে চাই।
তীব্র ঘৃণায় ক্ষুব্ধ কণ্ঠে জোরা বলল, আবু বতন, তুমি ভণ্ড, বিশ্বাসঘাতক।
আবু বতন বলল, খুব হয়েছে। এস হে বাছারা, আমরা যাত্রা শুরু করি।
শিবিরে স্তূপীকৃত বাড়তি জিনিসপত্রে আগুন লাগিয়ে দিয়ে আরবরা দল বেঁধে চলে গেল পশ্চিমের দিকে।
সময় কাটাবার জন্য দুর্ভাগ্যের সঙ্গিনীটিকে জোরা একটু একটু করে ইংরেজি শেখাতে শুরু করল। প্রথমে ইশারায় নানা জিনিস দেখিয়ে তার নাম বলে বলে শুরু করল। এইভাবে কয়েকদিনের মধ্যেই তারা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলার মত একটা চলনসই ব্যবস্থা করে ফেলল।
প্রথম দিনের পর থেকেই বন্দিনীদের হাতের বাঁধন খুলে দেয়া হয়েছে। অবশ্য আরব রক্ষীরা সব সময়ই তাদের চোখে-চোখে রাখে।
তারা চলতে লাগল আবিসিনিয়ার গালা অঞ্চলের ভিতর দিয়ে। কিন্তু গালা অঞ্চলের একেবারে প্রান্তে পৌঁছে বন্যায় স্ফীত একটা নদীর তীরে তারা বাধা পেল। উত্তরে মূল আবিসিনিয়ায়ও যেতে পারল না, আবার দক্ষিণে যাবারও সাহস হল না। কাজেই তারা নদীর তীরেই অপেক্ষা করতে বাধ্য হল।
পিটার জাভেরি এসে দাঁড়াল ওপার-এর প্রাচীরের সামনে। দলের আগে আগে চলেছে মিগুয়েল রোমেরা; তার ঠিক পিছনে ওয়েনি কোল্ট আর বাকি সাদা মানুষরা রয়েছে সকলের পিছনে যাতে দরকার হলে তারা অবাধ্য কালা আদমিদের জোর করে এগিয়ে যেতে বাধ্য করতে পারে।
রোমেরো ও কোল্ট ভিতরের প্রাচীরের ওপারে অদৃশ্য হয়ে গেল। বাকি চারজন বাইরের প্রাচীরের ভিতর ঢুকতেই বিধ্বস্ত নগরের বিষণ্ণ নিস্তব্ধতাকে ভেঙে শোনা গেল আর্ত কণ্ঠস্বর।
উঠোনটা পার হয়ে ভিতরের প্রাচীরের দিকে এগোতেই দেয়ালের বিপরীত দিক থেকে তাদের কানে এল একটা নারকীয় হল্লা-বহুকণ্ঠের বীভৎস রণ-হুংকার আর দ্রুত পায়ের শব্দ। একটা গুলির শব্দ হল; তারপর আর একটা, আরও একটা।
রাইফেল উদ্যত করে তারা মন্দিরের দিকে পা বাড়াল। কিছুটা এগোতেই ছায়া-ঢাকা খিলান ও অসংখ্য দরজার পথে ছুটে বেরিয়ে এল একদল মানুষ। তাদের বীভৎস রণ-হুংকারে প্রাচীন নগরীর স্তব্ধতা ভেঙে খান খান হয়ে গেল।
শুরু হল লড়াই। দু’জনই গুলি ছুঁড়তে লাগল। প্রতিপক্ষের কয়েকজন আহত হল। একটা ছুটন্ত গুলি এসে কোল্টের মাথায় লাগল। ধপাস করে সে মাটিতে পড়ে গেল, আর মুহূর্তের মধ্যে ওপার-এর বেঁটে মানুষগুলো তার দেহটাকে ঘিরে ফেলল।
মিগুয়েল রোমেরো বুঝল তার সঙ্গীর অবস্থা শোচনীয়। তার পক্ষে একাকি সঙ্গীকে উদ্ধার করার আশা সুদূরপরাহত। তাই সে চেষ্টা না করে নিজের প্রাণ বাঁচাতে সে পিছু হটতে লাগল। দুটো প্রাচীর পার হয়ে আবার সে ভোলা মাঠে ফিরে এল।
প্রাচীরের ভিতর থেকে আবার শোনা গেল অসভ্যদের বিজয়-উল্লাস। জাভেরি বলল, আমিও একা ওপার দখল করতে পারব না। অতএব সকলকেই শিবিরে ফিরে যেতে হবে।
বেঁটে সন্ন্যাসীরা কোল্টকে ঘিরে ধরে অস্ত্রশস্ত্র কেড়ে নিয়ে তাকে পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলল। তারপর কাঁধে তুলে মন্দিরের ভিতরে নিয়ে গেল।
চেতনা ফিরে এলে কোল্ট দেখল সে একটা মস্ত বড় ঘরের মেঝেতে শুয়ে আছে। এটাই ওপার মন্দিরের দরবার-কক্ষ। কোল্টের চেতনা ফিরে আসতে দেখে রক্ষীরা, এক ঝটকায় তাকে দাঁড় করিয়ে ওআ-র সিংহাসনের বেদীর দিকে ঠেলে দিল।
সম্মুখে সুদৃশ্য সিংহাসনে বসে আছে অপরূপ সুন্দরী এক তরুণী। তাকে ঘিরে রয়েছে প্রাচীন সভ্যতার জৌলুষের প্রাচুর্য। কিন্তু চেহারার লোমশ পুরুষ ও সুন্দরী সখিদল পরিবৃত হয়ে উদ্ধত ভঙ্গীতে সে বসে আছে। চোখ দুটি নির্মম ও নিষ্ঠুর।
তরুণী সিংহাসনে উঠে দাঁড়াল। বন্দীর উপর স্থির দৃষ্টি রেখে কোমর থেকে ছুরি বের করে মাথার উপর তুলে হিংস্র দ্রুতকণ্ঠে কি যেন বলে গেল।
ওআ-র কথা শেষ হতেই রক্ষীরা কোল্টকে বাইরে নিয়ে গেল। বেচারা বুঝতেও পারল না। যে অগ্নি দেবতার প্রধান সন্ন্যাসিনী তাকে দিয়েছে মৃত্যুদণ্ড।
রক্ষীরা তাকে নিয়ে গেল সুড়ঙ্গের মুখে একটা গুহায়। লোহার গরাদ দেয়া দরজা ও জানালা দিয়ে প্রচুর আলো বাতাস সে ঘরে ঢুকছে। কব্জির বাঁধন খুলে দিলে রক্ষীরা তাকে সেই গুহার মধ্যে রেখে চলে গেল।
ওয়েনি কোল্ট জানালা দিয়ে তাকাতেই দেখতে পেল ওপার-এর সূর্য-মন্দির। যজ্ঞবেদির সিঁড়িতে অনেক রক্তের দাগ। প্রাঙ্গণে স্তূপীকৃত নর-কপাল। কোল্ট ভয়ে শিউরে উঠল। এতক্ষণে সে বুঝতে পারল, কি শাস্তি তার জন্য অপেক্ষা করে আছে।
হঠাৎ তার মনে হল, প্রাঙ্গণের যজ্ঞ-বেদীর দিক থেকে একটা অস্পষ্ট শব্দ যেন কানে এল। ভাল করে কান পাততেই বুঝতে পারল, সত্যি কে যেন আসছে। নিঃশব্দে উঠে জানালার কাছে গিয়ে বাইরে তাকাল। দূরাগত তারার আলোয় দেখল, প্রাঙ্গণ থেকে কে যেন তার গুহার দিকেই এগিয়ে আসছে; তবে সে মানুষ কি জন্তু তা সে ঠাহর করতে পারল না।
ওয়েনি কোল্ট তাকিয়েই আছে। মূর্তি তার গুহার দিকেই এগিয়ে আসছে। ও কি তার মৃত্যু দূত? তাকে যজ্ঞবেদীতে নিয়ে যেতে আসছে? কাছে আরও কাছে। সে এসে দাঁড়াল তার গুহার দরজার শিকের ওপারে। নরম গলায় ফিস্ ফিস্ করে কি যে বলল তার বিন্দু-বিসর্গও সে বুঝতে পারল না; শুধু বুঝতে পারল, যে এসেছে সে নারী।
কৌতূহলবশে সেও দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। একটা নরম হাত এসে তাকে স্পর্শ করল পরম আদরে। প্রাঙ্গণের মাথার উপরে খোলা আকাশ থেকে ভরা চাঁদের উজ্জ্বল জ্যোৎস্না এসে পড়েছে গুহার মুখে। শিকের ফাঁক দিয়ে মেয়েটি তাকে খাবার দিল। আর সেই সময় তার হাতটা টেনে নিয়ে তাতে ঠোঁট দুটো ছোঁয়াল।
ওয়েনি কোল্ট হতবাক। সে জানত যে এই তরুণী সন্ন্যাসিনীটি প্রথম দর্শনেই তার প্রেমে পড়েছে। ওপার-এর কিম্ভুতদর্শনে লোমশ পুরুষদের দেখে অভ্যস্ত তার চোখে ও মনে এই নবাগত পুরুষটি দেখা দিয়েছে দেবতার মহিমায়। তারপরই হঠাৎ তাকে ছেড়ে দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিঃশব্দ পায়ে মন্দিরের খিলানের অন্ধকার পথে অদৃশ্য হয়ে গেল।
মেয়েটির আনা খাবার খেয়ে কোল্ট শুয়ে শুয়ে কেবলই ভাবতে লাগল, কী এক দুর্নিরীক্ষ শক্তি মানুষের সব কর্মধারাকে পরিচালিত করে। ভাবতে ভাবতে এক সময় সে ঘুমিয়ে পড়ল।
কোল্ট ঘুমের মধ্যেই একবার নড়ে উঠে চমকে জেগে উঠল। অস্তগামী চাঁদের আলোয় দেখল, দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে সেই বাঞ্ছিতা নারী। চাবি ঘুরিয়ে তালা খুলে সে ভিতরে ঢুকল। কোল্ট লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। নাও হাত ধরে তাকে নিয়ে গেল ঘরের বাইরে।
অনেক অন্ধকার গলি-পথে ঘুরে ঘুরে ভিতরের প্রাচীরের কাছে এসে নাও আঙ্গুল বাড়িয়ে বলল, ঐ পথে চলে যাও। নাও-র হৃদয়কে নিয়ে যাও তোমার সঙ্গে। তোমাকে আর কোন দিন চোখে দেখতে পাবে না, তবু সারা জীবন এই মুহূর্তটির স্মৃতি আমি বুকের মধ্যে বয়ে বেড়াব।
নাও তার খাপ-শুদ্ধ ছুরিটা কোল্টের হাতে তুলে দিল। এই বিপদসংকুল পথে নিরস্ত্র যাত্রা সমীচিন নয়। ভিতরের প্রাচীরের কাছে পৌঁছে কোল্ট একবার পিছন ফিরে তাকাল। চাঁদের আবছা আলোয় প্রাচীন
ধ্বংসস্তূপের ছায়ায় ছোট্ট সন্ন্যাসিনী খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোল্ট হাত নাড়িয়ে নীরবে শেষ বিদায় সম্ভাষণ জানাল।
ইতালীয় সোমালিল্যান্ড অভিযানের চূড়ান্ত সাফল্যের ব্যাপারে যে আত্মবিশ্বাস পিটার জাভেরি একেবারেই হারিয়ে ফেলেছিল, ধীরে ধীরে সে আবার সেটা ফিরে পাচ্ছে। বিভিন্ন অঞ্চলের প্রতিনিধিদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সরবরাহ আসতে আরম্ভ করেছে; বিদ্রোহী নিগ্রোরাও অনেকটা শান্ত হয়েছে, আর। তার ফলে নতুন নতুন সংগ্রামী মানুষ এসে তার দলে যোগ দিচ্ছে। জাভেরির পরিকল্পনাটা এই রকমঃ দ্রুত ও আকস্মিক আক্রমণ চালিয়ে কিছু আদিবাসী গ্রাম ধ্বংস করে ও দু’একটা ফাঁড়ি দখল করে তড়িৎ গতিতে সীমান্ত পার হয়ে চলে আসবে, ফরাসী ইউনিফর্মগুলোকে ভবিষ্যৎ প্রয়োজনের জন্য বাক্সবন্দী করে রাখবে এবং আবিসিনিয়াতে রাস্তাকারিকে গদীচ্যুত করবে; সেখানকার দলীয় প্রতিনিধিরা আগেই জানিয়েছে যে সেখানে বিপ্লবের ভূমি সম্পূর্ণ প্রস্তুত। প্রতিনিধিরা আরও আশ্বাস দিয়েছে, একবার আবিসিনিয়া দখল করে সেখানে ঘাঁটি বানাতে পারলে সমগ্র উত্তর আফ্রিকার আদিম জাতিরা দলে দলে এসে তার পতাকাতলে সমবেত হবে।
ওদিকে মার্কিন পুঁজিপতিদের লোভের সুযোগ নিয়ে সুদূর বোখারোতে বহুবার, স্কাউট ও যোদ্ধা বিমানসহ দু-শ’ বিমানের একটা বহরকে হঠাৎ পারস্য ও আরবের আকাশপথে নিয়ে আসা হবে তার আবিসিনিয়ার ঘাঁটিতে। স্থানীয় লোকদের নিয়ে যে বিরাট বাহিনী সে গড়ে তুলেছে তার সঙ্গে এই সব শক্তি মিলিত হলে গোটা পরিস্থিতি আসবে তার অনুকূলে; তার সঙ্গে যোগ দেবে মিশরের বিদ্রোহী সেনাদল। এইভাবে, ইউরোপ একটা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে তার বিরুদ্ধে কোন সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হবে না। তার সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন সফল হবে, আর সে হবে চিরদিনের মত অজেয়।
হয়তো এটা একটা উন্মাদ স্বপ্ন; হয়তো পিটার জাভেরি সত্যি উন্মাদ- কিন্তু আজ পর্যন্ত কোন্ বিশ্ব বিজয়ী কিছুটা উন্মাদ ছিল না?
সে যেন দিব্য দৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছে তার সাম্রাজ্যের সীমান্ত একটু একটু করে দক্ষিণে প্রসারিত হচ্ছে। তারপর একদিন সে শাসন করবে একটা বিরাট মহাদেশ-সে হবে আফ্রিকার সম্রাট প্রথম পিটার।
একদিকে সমস্ত শিবির জুড়ে যখন চলেছে এই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার উদ্যোগ কর্মব্যস্ততা, তখন ওদিকে একশ’ কাল সৈনিক এগিয়ে আসছে জঙ্গলের পথে। তাদের গায়ের চামড়া মসৃণ, চকচকে; তাদের ঘুমন্ত মাংসপেশী ও সহজ পদক্ষেপ তাদের দৈহিক সক্ষমতার সাক্ষ্য বহন করছে। গোড়ালিতে ও কব্জিতে তামার বালা, গলায় সিংহ বা চিতার নখের মালা, এবং সিংহ বা চিতার চামড়ার এক ফালি কটি-বস্ত্র ছাড়া নগ্ন দেহ। প্রত্যেকের মাথায় সাদা পাখির পালক গোঁজা। কিন্তু তাদের আদিম সাজ-সজ্জার এখানেই ইতি, কারণ তাদের সকলেরই হাতে আধুনিক অস্ত্রের সম্ভার; স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, রিভলবার ও বুলেট ভর্তি চামড়ার বক্ষবন্ধনী। একটি দুর্ভেদ্য বাহিনী নিঃশব্দে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছে জঙ্গলের ভিতরে দিয়ে। তাদের দলপতির কাঁধের উপর বসে আছে একটা ছোট্ট বানর।
নদী তীরের অস্থায়ী শিবির থেকেই সুযোগমত আলাদা আলাদা ভাবে জোরা ড্রিনভ ও ওপায়ের লা আবু বতনের হাত থেকে পালিয়ে গেল। ঘটনাচক্রে এক সময় আকস্মিকভাবে দেখা হয়ে গেল। পথশ্রমে ক্লান্ত ওয়েনি কোল্ট ও লার সঙ্গে। ঠিক এই ভাবে একদিন জঙ্গলের মধ্যে জোরা’ড্রিনভের দেখা হয়ে গেল টারজনের সঙ্গে। দু’জন এক সঙ্গে চলতে লাগল। আর সেই অবস্থাতেই একদিন এক গুপ্ত আততায়ীর গুলিতে আহত হল টারজান। ফলে তারা দুজনেই ধরা পড়র জাভেরির দলের হাতে।
পরদিন খুব সকালে অভিযাত্রী দল সারি বেঁধে শিবির থেকে বেরিয়ে পড়ল। কালা আদমিরা গায়ে চড়িয়েছে ফরাসী উপনিবেশরক্ষী বাহিনীর উর্দি জাভেরি, রোমেরো, আইভিচ ও মোরির গায়ে ফরাসী অফিসারদের পোশাক। টারজনের সেবাশুশ্রূষার জন্য জোরা ড্রিন থেকে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু জাভেরির হুকুমে তাকেও দলের সঙ্গে চলতে হচ্ছে। বন্দীর দেখাশুনা এবং রেখে যাওয়া রসদ ও অস্ত্রশস্ত্র পাহারা দেবার জন্য অল্প কয়েকটি নিগ্রো ও ডরস্কিকে শিবিরে রেখে যাওয়া হয়েছে।
যাত্রার ঠিক পূর্বক্ষণে জাভেরি চুপিচুপি শেষ নির্দেশ শুনিয়ে দিল ডবৃস্কিকে। ব্যাপারটা সম্পূর্ণ তোমার হাতেই ছেড়ে দিয়ে যাচ্ছি। এমন ব্যবস্থা করবে যাতে মনে হবে যে সে পালিয়েছে অথবা কোন আকস্মিক দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়েছে।
ডরস্কি বলল, এ নিয়ে তোমাকে আর মাথা ঘামাতে হবে না কমরেড। তুমি ফিরে আসার অনেক আগেই বাছাধনকে ভবপারে পাঠিয়ে দেব।
আক্রমণকারীদের সামনে কষ্টকর দীর্ঘপথ। পাঁচশ মাইল বন্ধুর পথে দক্ষিণ-পূর্ব আবিসিনিয়ার ভিতর দিয়ে তাদের ঢুকতে হবে ইতালীয় সোমালিল্যান্ডে। জাভেরির মনোগত বাসনা ইতালীয় উপনিবেশে আক্রমণের একটা মহড়া শুধু দেবে। তাতেই ফরাসীদের বিরুদ্ধে ইতালীয়দের ক্রোধ জাগ্রত হবে, আর সেখানকার ফ্যাসিস্ত ডিক্টেটর সেই ওজুহাতে ইউরোপের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে।
জাভেরি হয়তো কিছুটা পাগল ছিল। এতদিন সে দেখেছে একটি সাম্রাজ্যের স্বপ্ন; এখন দেখছে দুটি সাম্রাজের স্বপ্ন। এক নতুন রোমক সম্রাট শাসন করবে ইউরোপ, আর সে নিজে হবে আফ্রিকার সম্রাট। তার চোখের সামনে ভাসছে দুই সোনার সিংহাসন–একটিতে আসীন সম্রাট প্রথম পিটার, আর অপরটিতে সাম্রাজ্ঞী জোরা। অভিযানের দীর্ঘ পথ এই স্বপ্ন দেখেই সে কাটাতে লাগল।
সকালে টারজনের জ্ঞান ফিরল। শরীর দুর্বল, রুগ্ন; মাথায় ভীষণ যন্ত্রণা। নড়বার চেষ্টা করতেই বুঝল, হাত-পা শক্ত করে বাঁধা। কি ঘটেছে, কোথায় আছে–কিছুই সে জানে না। তাঁবুর ক্যানভাসের দেয়ালে দেখে বুঝল, যে ভাবেই হোক শত্রুর হাতে সে ধরা পড়েছে। এখানে সে একা নয়; বাইরে লোকজনের গলা শোনা যাচ্ছে। তবে যতদূর মনে হয়, তারা সংখ্যায় বেশি নয়।
গভীর জঙ্গল থেকে ভেসে এল হাতির ডাক। অস্পষ্টভাবে কানে এল সিংহের গর্জন। মাথাটা ঘুরিয়ে তাঁবুর বাইরে তাকাল। তার ঠোঁট থেকে বের হল একটানা নিচু চীৎকার- বিপন্ন পশুর বুকফাটা ডাক।
ডরস্কি তার তাঁবুর সামনে একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে ঝিমুচ্ছিল। লাফ দিয়ে উর্ধ্বে দাঁড়াল।
ছোকরা নিগ্রো-চাকরটাকে সঙ্গে নিয়ে ভয়ে ভয়ে টারজনের তাঁবুর দিকে এগোতে লাগল। ডরস্কির হাতে উদ্যত রিভলবার।
ঘরে ঢুকে দেখল, টারজান যেখানে ছিল সেখানেই শুয়ে আছে। তবে তার চোখ দুটি খোলা। ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে সে ডরস্কির দিকে তাকাল। ডরস্কি কয়েকটা প্রশ্ন করল, কোন জবাব পেল না।
ডরস্কির ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল। চীৎকার করে বলল, বাঁটা গোরিলা, আমাকে বোকা বানাবার চেষ্টা করো না। আমি ভাল করেই জানি, এ লোকটার বকবকানি সব তুমি বুঝতে পেরেছ। তাছাড়া, তুমি একজন ইংরেজ, অবশ্যই ইংরেজি জান। তোমাকে পাঁচ মিনিট সময় দিয়ে গেলাম। ফিরে এসেও যদি দেখি তুমি কথা বলছ না, তাহলে তোমার কপালে অশেষ দুর্গতি আছে। বলেই সে তাঁবু থেকে সটান বেরিয়ে গেল।
ছোট্ট নকিমা অনেক পথ পার হয়ে গিয়েছিল। তার গলার শক্ত বেড়ি থেকে ঝুলছিল একটা চামড়ার থলে। তার মধ্যেই চিঠিটা ছিল। সেটা সে এনে দিয়েছিল ওয়াজিরিদের সেনাপতি মুভিরোকে। আর ওয়াজিরিরা যখন পথে নামল তখন নকিমা সগর্বে মুভিরোর কাঁধেই বসে পড়ল। অনেকটা সময় পর্যন্ত সে মুভিরোর কাঁধেই ছিল; তারপর মনের খেয়ালই হোক আর অন্য কোন প্ররোচনাতেই হোক সকলকে ছেড়ে সে নিজের কাজে চলে গেল।
বড় বড় গাছের ডালে ডালে ঝুলতে ঝুলতে সে চলতে লাগল। আপন খেয়াল খুশিতে একবার এদিকে ছোটে, একবার ওদিকে। আর তাতেই অনেক সময় নষ্ট হল।
এইভাবে নকিমা যখন বহুদূর জঙ্গলে অকারণে ছুটাছুটি করছে, ঠিক তখনই পাঁচ মিনিট পরে ডরস্কি আবার ঢুকল টারজনের তাবুতে। নিজস্ব মতলবটাকে মনে মনে ঠিক করে নিয়েই সে এসেছে।
বন্দীর মুখের ভাব বদলে গেছে। কান পেতে কি যেন শুনছে। ডরস্কিও কান পাতল। কিন্তু কিছুই শুনতে পেল না। টারজনের অন্তর কিন্তু খুশিতে ভরে উঠেছে।
ডরস্কি বলল, আমি এসেছি তোমাকে শেষ সুযোগ দিতে। ওপার-এর স্বর্ণ-ভাণ্ডারের সন্ধানে কমরেড জাভেরি দু’বার সেখানে অভিযান চালিয়েছে; দু’বারই ব্যর্থ হয়েছে। সকলেই জানে, ওপার-এর রত্ন ভাণ্ডার কোথায় আছে তা তুমি জান এবং আমাদের সেখানে নিয়ে যেতেও পার। কথা দাও, কমরেড জাভেরি ফিরে এলেই তুমি এ কাজ করবে, তাহলে তোমার কোনরকম ক্ষতি করা তো হবেই না, উপরন্তু যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমাকে মুক্তি দেয়া হবে। আমার প্রস্তাব না মানলে তুমি মরবে। কোমরের খাপ। থেকে লম্বা ছুরিটা টেনে বের করল।’
টারজান তবু পাথরের মত নিপ। ছুরির সরু ফলাটা তার চোখের সামনে এনে ডক্তি বলল, বেশ ভাল করে ভেবে দেখ। মনে রেখো, এই ফলাটা যখন তোমার পাঁজরের মধ্যে ঢুকিয়ে দেব তখন একটুও : শব্দ হবে না। ফলাটা তোমার হৃৎপিণ্ডে ঢুকে যাবে, আর রক্ত বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত সেখানেই থাকবে। তারপর ফলাটা বের করে ঘাটা জুড়ে দেব। বিকেলের দিকে দেখা যাবে তুমি মরে পড়ে আছ, আর নিগ্রোদের কাছে আমি জানাব যে হঠাৎ গুলি লেগে তুমি মারা গেছ। সত্য ঘটনা তোমার বন্ধুরা জানতেও পারবে না। তোমার মৃত্যুর প্রতিশোধও কেউ নেবে না। বৃথাই তোমার জীবনটা যাবে।
ছুরিটা টারজনের মুখের একেবারে কাছে এসে গেছে। হঠাৎ বন্য পশুর মত টারজানও গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল। ইস্পাতের কঠিন চোয়াল দিয়ে চেপে ধরল ডবৃস্কির কব্জি। সে ছিটকে সরে গেল। অবশ আঙ্গুলের ভিতর থেকে ছুরিটা মাটিতে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে টারজান তার আততায়ীকে লেঙ্গি মেরে মাটিতে ফেলে দিয়ে তার পিঠের উপর চেপে বসল।
চীৎকার করে লোকজনদের ডাকতে ডাকতে ডরস্কি বাঁ হাত দিয়ে কোমরের রিভলবারটা বের করতে চেষ্টা করল, কিন্তু অচিরেই বুঝতে পারল যে দেহের উপর থেকে টারজানকে সরাতে না পারলে সে কাজ করা যাবে না।
তার কানে এল, লোকজন সব হৈ-হৈ করে ছুটে আসছে। তারপরেই শুনতে পেল আতংকের চীৎকার। আর পরমুহূর্তেই মাথার উপর থেকে তাঁবুটা অদৃশ্য হয়ে গেল; ডরস্কি সভয়ে দেখতে পেল একটা প্রকাণ্ড হাতি তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
মুহূর্তের মধ্যে ডরস্কিকে ছেড়ে দিয়ে টারজান পাশ ফিরে সরে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ডরস্কিও রিভলবারে হাত দিল। টারজান চীৎকার করে বলল, মার ট্যান্টর, মার।
হাতির ঝোলানো শুড়টা এসে ডবৃস্কিকে পেঁচিয়ে ধরল। কর্কশ গলায় চীৎকার করতে করতে ডরস্কিকে মাথার উপর তুলে কয়েক পাক ঘুরিয়ে ছুঁড়ে দিল শিবিরের মধ্যে। আতংকিত নিগ্রোরা ছুটে জঙ্গলে পালিয়ে গেল। ট্যান্টর এগিয়ে গিয়ে দাঁত দিয়ে ডরস্কির দেহটাকে ক্ষতবিক্ষত করতে লাগল। শেষ পর্যন্ত এমনভাবে তাকে পায়ের নিচে পিষতে লাগল যে মাইকেল ডরস্কি একটা রক্তাক্ত পিণ্ডে পরিণত হল।
ধীরে ধীরে সে শান্ত হল। হেলে দুলে টারজনের পাশে এসে দাঁড়াল। তার কথামত টারজানকে পিঠের উপর তুলে নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে চলে গেল।
গভীর বনে ঢুকে ট্যান্টর নরম ঘাসের উপর টারজানকে শুইয়ে দিল।
সেই সময় গাছের ডালে ডালে ঝুলতে ঝুলতে ছোট্ট নকিমাও সেখানে এসে উপস্থিত হল।
তাকে দেখে টারজান বলল, নিচে নেমে এস নকিমা; আমার হাতের বেড়ি খুলে দাও।
নকিমা ছোট ছোট দাঁত দিয়ে চামড়ার বেড়ি কেটে দিল। এবার সে নিজের পায়ের বেড়ি কেটে ফেলল।
এবার ট্যান্টর টারজানকে পিঠে তুলে নিল। নকিমাও মনিবের দেখাদেখি লাফিয়ে উঠল প্রথমে ট্যান্ট বের পিঠে, তারপর সেখান থেকে টারজনের কাঁধে।
তিন বন্ধু নিঃশব্দে এগিয়ে চলল। গাছের ছায়া দীর্ঘতর হতে লাগল। বনের আড়ালে সূর্য অস্ত গেল।
এইভাবে দিন কাটে। অসহায় কোল্ট শয্যাশায়ী। জাভেরি এগিয়ে চলেছে ইতালীয় সোমালিল্যান্ডের দিকে। মাথার ক্ষত সেরে যাওয়ায় টারজান চলেছে তাদেরই পথ ধরে।
এক সময় জাভেরির অগ্রগামী বাহিনীকে সে ধরে ফেলল। তখন রাত। শ্রান্ত লোকজনরা শিবিরে বসে আমোদ-ফুর্তি করছে। ব্যাপারটা যে জানে না তার মনে হবে এটা বুঝি ফরাসী উপনিবেশ রক্ষীবাহিনীর শিবির।
গাছের উপর বসে টারজান সবই দেখল। ধনুকে একটা তীর জুড়ল। ছিলায় টংকার দিয়ে তীরটা ছুঁড়ে দিল। সেটা গিয়ে বিধল একটি শাস্ত্রীর পায়ের গুলিতে। বিস্ময়ে ও বেদনায় চীৎকার করে সে মাটিতে পড়ে গেল। লোকজন এসে তাকে ঘিরে দাঁড়াল। সেই ফাঁকে টারজান জঙ্গলের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
ওদিকে আর একটা সেনাদলও চলেছে সেই জঙ্গলের পথ ধরে। সারাদিন হেঁটে রাতে তাদের অস্থায়ী শিবির পড়ল। আহারাদি শেষ করে শ’খানেক কালো সৈনিক ধুনির চারপাশে ইতস্তত শুয়ে বসে গল্প শুরু করল।
এমন সময় মাথার উপরকার গাছের ডাল থেকে একটি মূর্তি এসে নামল তাদের ঠিক মাঝখানে।
সঙ্গে সঙ্গে একশ’ সৈনিক লাফ দিয়ে অস্ত্র হাতে নিল; কিন্তু পরমুহূর্তেই সহজভাবে থেমে গিয়ে গলা ছেড়ে বলে উঠল, বাওয়ানা! বাওয়ানা।
যে কোন সম্রাট বা দেবতার সামনে তারা সকলেই নতজানু হল; যারা কাছে ছিল তারা শ্রদ্ধার সঙ্গে তার হাত-পা স্পর্শ করল। ওয়াজিরিদের কাছে টারজান তো শুধু রাজা নয়, সে যে তাদের জীবন্ত দেবতা।
টারজান বলল, খুব ভাল কাজ করেছ বাছারা। নকিমাও ঠিক মতই কাজটা করেছে। আমার চিঠিটা তোমাদের পৌঁছে দিয়েছে, আর যেখানে তোমাদের দেখা পাব বলে ভেবেছিলাম ঠিক সেখানেই তোমাদের পেয়ে গেলাম।
মুভিরো বলল, সব সময় আমরা নবাগতদের চাইতে একদিনের পথ এগিয়ে থাকি বাওয়ানা। শিবির। ফেলি ওদের পথ থেকে বেশ কিছুটা দূরে, যাতে আমাদের শিবির ওদের চোখে না পড়ে।
টারজান বলল, আগামীকাল আমরা এখানেই তাদের জন্য অপেক্ষা করব। আজ রাতে টারজান তোমাদের বুঝিয়ে বলবে তার পরিকল্পনার কথা।
পরদিন সকালে জাভেরির দলবল আবার যাত্রা শুরু করল। ঘণ্টাখানেক নির্বিঘ্নে কেটে গেল। হঠাৎ মাথার উপর থেকে একটি ভৌতিক কণ্ঠস্বর। বান্টু ভাষায় ঘোষণা করলঃ মুলুব, সন্তানরা, ফিরে যাও। যদি বাঁচতে চাও তো ফিরে যাও। আর বিলম্ব না করে সাদা মানুষদের সঙ্গ ত্যাগ কর।
জাভেরি বলল, ওটা কে? কি বলল?
আমাদের সতর্ক করে দিয়ে ফিরে যেতে বলল, কিটেম্বো জবাব দিল।
জাভেরি চমকে উঠল, ফেরা হবে না। যাই ঘটুক, আমরা এগিয়ে যাবই।
বিষণ্ণ মনে সকলে যার যার জায়গায় থেকে চলতে লাগল। সামনে অনেক দূর থেকে ভেসে এল সেই ভৌতিক কণ্ঠস্বর; সাদা মানুষদের সঙ্গ ত্যাগ কর।
জাভেরি ও জোরা ড্রিনভ পাশাপাশি হাঁটছিল। চোখ-মুখ খিঁচিয়ে বলল, ওই লোকটাকে যদি হাতের কাছে পেতাম তো এক গুলিতে
তার কথা শেষ হবার আগেই দলের পিছন দিকে আকাশ থেকে ভেসে এল সেই কণ্ঠস্বর ও সাদা মানুষদের সঙ্গ ত্যাগ কর।
ইতোমধ্যে গোটা দল জঙ্গল পার হয়ে একটা খোলা জায়গায় পড়েছে। সেখানে তারা মাথা-সমান উঁচু ঘাসের ভিতর দিয়ে চলতে লাগল। মাঝামাঝি পৌঁছবার পরেই গর্জে উঠল একটা রাইফেল। আর একটা। আরও একটা।
গুলি কারও গায়ে লাগে নি। তবু সেনাদলের মধ্যে হৈ-চৈ পড়ে গেল। দেখা দিল বিশৃংখলা।
আবার সামনে শোনা গেল সেই সতর্কবাণীঃ ফিরে যাও! এই শেষ সতক-বাণী। অমান্য করলে মৃত্যু অনিবার্য।
দলে ভাঙন দেখা দিল। রোমেরো গুলি করার হুকুম দিল। প্রত্যুত্তরে সামনের ঘাসের ভিতর থেকে গুলি চলল। এবার ডজনখানেক লোক পড়ে গেল– কেউ নিহত, কেউ আহত হল।
জাভেরির দলবল অনেক কষ্টে তাদের শেষ শিবিরে পৌঁছে গেল। কিন্তু রাত পর্যন্ত হিসেব করে দেখা গেল শতকরা পঁচিশজন তখনও নিখোঁজ; তাদের মধ্যে জোরা ও রোমেরোও আছে। একে একে যারাই শিবিরে এল তাদের প্রত্যেককে জাভেরি মেয়েটির কথা জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু কেউ তাকে দেখেনি।
আরও একটু রাত হতেই দু’জন একসঙ্গে শিবিরে ঢুকল। তাদের দেখে জাভেরি যেমন স্বস্তি বোধ করল, তেমনি রাগও হল।
ধমক দিয়ে বলল, তোমরা আমার সঙ্গে থাকলে না কেন?
কারণ আমি তোমার মত ছুটতে পারি না, জোরা জবাব দিল। জাভেরি আর কিছুই বলল না।
শিবিরের উপরকার অন্ধকারের ভিতর থেকে ভেসে এল সেই পরিচিত সতর্কবাণী ও সাদা মানুষদের সঙ্গ ত্যাগ কর! তারপর দীর্ঘ নিস্তব্ধতা, মাঝে মাঝে কালা আদমিদের ফিসফিস্ আলোচনা। আবার সেই কণ্ঠস্বর ও তোমাদের দেশে ফিরে যাবার পথ সম্পূর্ণ বিপদমুক্ত, কিন্তু সাদা মানুষদের পিছনে হাঁটছে মৃত্যু। তোমাদের উর্দি ছুঁড়ে ফেলে দাও; সাদা মানুষদের ছেড়ে দাও জঙ্গলে ও আমার হাতে।
একটি কালা সৈনিক শরীর থেকে ফরাসী উর্দি খুলে ফেলে উনুনের আগুনে ছুঁড়ে ফেলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে অন্যরাও তাই করতে লাগল।
থাম! জাভেরি চীৎকার করে বলল।
চুপ কর সাদা মানুষ! পাল্টা গর্জে উঠল কিটেম্বো।
সাদাদের মেরে ফেল! জনৈক বাসেম্বো সৈনিক চীৎকার করে বলল।
সবাই ছুটল সাদা মানুষদের লক্ষ্য করে। উপর থেকে আবার ভেসে এল সতর্কবাণী ও সাদা মানুষরা আমার লোক। তাদের আমার হাতেই ছেড়ে দাও।
সঙ্গে সঙ্গে সৈনিকরা থেমে গেল। জাভেরি রাগে ঘরময় পায়চারি করতে লাগল। সব্বাইকে গালাগালি করে বলল, আমাকে কেউ সাহায্য করলে এ রকমটা ঘটত না। কিন্তু আমি একা তো সব কাজে করতে পারি না।
এ কাজটা তো তুমি একাই করেছ, রোমেরো বলল।
কি বলতে চাও তুমি?
আমি বলতে চাই, একটা উদ্ধত গাধার মত কাজ করে তুমি সব্বাইকে শক্ত করে তুলেছ। তবু তোমার সাহসের উপর ভরসা থাকলে তারা তোমার সঙ্গেই চলত। একটা ভীরুকে অনুসরণ করতে কেউ চায় না।
তোমার এতদূর স্পর্ধা! চীৎকার করে উঠে জাভেরি রিভলবারে হাত দিল।
জোরা বলে উঠল, এ সব কি পাগলামি হচ্ছে। একদল উচ্ছল কালা আদমির মধ্যে আমরা মাত্র পাঁচজন। কাল তারাও আমাদের ছেড়ে চলে যাবে। আমরা যদি প্রাণ নিয়ে আফ্রিকা থেকে ফিরে যেতে চাই তাহলে আমাদের একসঙ্গে চলতে হবে। নিজেদের ঝগড়া ভুলে যাও; সকলের মুক্তির জন্য একযোগে কাজ কর।
বাকি রাতটা সুখে না হোক নির্বিঘ্নেই কাটল। সকালে দেখা গেল, সব কালা আদমি গা থেকে ফরাসী উর্দি খুলে ফেলেছে। পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা অন্য একজনের সহাস্য চোখেও সে দৃশ্য দেখল। কোন কালো ছোকরা সাদা মানুষদের সেবা করতে এল না। তারা নিজেরাই প্রাতরাশ তৈরি করল।
কালা আদমিরা যার যার গাঠরি কাঁধে ফেলে শিবির থেকে বেরিয়ে পশ্চিম দিকে যাত্রা করল। তাদের যাত্রাপথের দিকে তাকিয়ে সাদা মানুষগুলো চুপচাপ বসে রইল।
পরদিন সকালে পাঁচ শ্বেতমূর্তি ফিরে চলল তাদের মূল শিবিরে।
আর ঠিক একদিনের পথ আগে থেকে অন্য এক সোজা পথে টারজান ও তার ওয়াজিরি সেনারা চলল। ওপার-এর দিকে।
টারজান মুভিরোকে বলল, লা হয়তো সেখানে নেই। কিন্তু ওআ ও ডুথকে আমি শান্তি দিতে চাই যাতে লা বেঁচে থাকলে একদিন না একদিন ওপার-এ ফিরে গিয়ে প্রধান সন্যাসিণীর গদিতে বসতে পারে।
বহু মাইল দূরে তাদের এই বন্ধুটি জঙ্গলের মধ্যে একটা ভোলা জায়গায় গিয়ে পৌঁছল। এক সময় সেখানে একটা বড় শিবির ছিল; এখন কয়েকটা ঝুপড়িতে কিছু কালা আদমি থাকে।
তার পাশাপাশি হাঁটছে ওয়েনি কোল্ট। এতদিনে সে বেশ সুস্থ হয়ে উঠেছে। তাদের পিছনে চলেছে সোনালী সিংহ জান্-বা-জা।
কোল্ট বলল, শেষ পর্যন্ত খুঁজে পেলাম। তোমাকে ধন্যবাদ।
লা বলল, ভালই হল। এবার তোমার কাছ থেকে বিদায় নেব। তার গলায় বেদনার সুর।
কোল্ট বলল, বিদায় কথাটা আমার ভাল লাগে না।
একটি নারী ও একটি পশু পাশাপাশি চলে গেল ওপার-এর পথে। সেদিকে তাকিয়ে কোল্টের গলায় কি যেন আটকে আসতে লাগল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে শিবিরে ফিরে গেল। কালো মানুষগুলো দুপুরের রোদেও ঘুমিয়ে আছে। তাদের ডেকে তুলল। কোল্টকে দেখে তারা তো হতবাক। তারা যে ধরেই নিয়েছিল সে মারা গেছে।
ওপার-এর প্রান্তরে বিধ্বস্ত নগরীর দিকে হাঁটছে একজন নারী ও একটা সিংহ। তাদের পিছনে খাড়ির। উঁচু মাথায় দাঁড়িয়ে তাদের দিকেই লক্ষ্য রেখেছে আর একজন মানুষ। তার পিছনে একশ’ সৈনিক পাহাড়ের উত্রাই বেয়ে উপরে উঠছে। তারা এসে পাশে দাঁড়াতেই দীর্ঘদেহ মানুষটি আঙ্গুল বাড়িয়ে বলল, লা!
আর নুমাও, মুভিরো বলল। সে পিছন পিছন হাঁটছে কী আশ্চর্য বাওয়ানা, সে কিন্তু আক্রমণ করছে না।
টারজান বলল, আক্রমণ করবে না। ও যে জাবাল-জা।
পিছনের হৈ-চৈ-এর শব্দ প্রথমে জাদু-বাল-জার কানেই ধরা পড়ল। থেমে সে মুখ ফেরাল। মাথাটা তুলল। কান খাড়া করল। নাক কুঁচকাল। তারপরই গাঁ-গাঁ করে ডেকে উঠল। লা দাঁড়িয়ে পিছন ফিরল। একটি অগ্রসরমান সেনাদলকে দেখে সে হতাশায় ভেঙে পড়ল।
দলটা এগিয়েই আসছে। হঠাৎ লা-র নজরে এল, যে লোকটি সকলের আগে আগে আসছে তার গায়ের রং ফর্সা। সে চিনতে পেরেছে। চীৎকার কলে বলল, ওই তো টারজান! জান্-বা-জা, ওই তো টারজান।
হয়তো জাদ-বাল-জাও মনিবকে চিনতে পারল। একছুটে এগিয়ে গেল। টারজনের সামনে গিয়ে খাড়া হয়ে দাঁড়াল। তার কাঁধে দুই থাবা রেখে আদর করে গালটা চাটতে লাগল। তাকে একপাশে সরিয়ে দিয়ে টারজান লা-র দিকে এগিয়ে গেল।
মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল, শেষ পর্যন্ত
লা বলল, হ্যাঁ, শেষ পর্যন্ত তুমি শিকার করে ফিরে এলে।
টারজান বলল, আমি তখনই ফিরেছিলাম, কিন্তু তুমিই চলে গিয়েছিলে।
তুমি ফিরে এসেছিলে? তা যদি জানতাম তাহলে তো আমি অনন্তকাল সেখানেই অপেক্ষা করে থাকতাম।
টারজান সস্নেহে লা-র কাঁধে হাত রাখল। অস্ফুট স্বরে বলল, সেই চিরকালের লা! তারপরই কি যেন মনে পড়তে ওপার-এর দিকে মুখ ফিরিয়ে বলে উঠল, চল। রানী এবার ফিরে যাবে তার সিংহাসনে।
ওপার-এর অদৃশ্য চোখগুলো অগ্রসরমান দলটিকে দেখতে পেল। লা, টারজান ও ওয়াজিরিদের তারা চিনতে পারল। অনেকে জান্-বা-জাকেও চিনল। ওআ ভয় পেল। ডুথ কাঁপতে লাগল। ছোট নাও এর বুক খুশিতে ভরে উঠল।
অভিযাত্রীরা বহিঃপ্রাচীরের প্রাঙ্গণে ঢুকল। একটি প্রাণীও তাদের বাধা দিল না। দরবার-কক্ষে ঢুকে যে দৃশ্য তাদের চোখে পড়ল তাতেই সব কিছু পরিষ্কার হয়ে গেল। রক্তাল্পত অবস্থায় পড়ে আছে ওআ ও ডুথ-এর মৃতদেহ; পাশেই ছ’টি সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীর মৃতদেহ। আর কেউ কোথাও নেই।
অগ্নি-দেবতার প্রধান সন্ন্যাসিনী লা আর একবার ওপার-এর রানী হয়ে সিংহাসনে বসল।
সেদিন রাতে অরণ্যরাজ টারজান ওপার-এর সোনার থালায় আহার্য গ্রহণ করল। সুন্দরী তরুণীরা। পরিবেশন করল মাংস, ফল ও অমৃতস্বাদ দ্রাক্ষারস।
পরদিন সকালে অরণ্যরাজ ফিরে চলল দলবল নিয়ে। তার কাঁধের উপর ছোট্ট নকিমা, পাশে সোনালী সিংহ, আর পিছনে একশ’ ওয়াজিরি সৈন্য।
দীর্ঘ একঘেয়ে পথ চলার পর সাদা মানুষদের ক্লান্ত অবসন্ন দলটা তাদের মূল শিবিরে ফিরে এল। সকলের আগেই জাভেরি ও আইভিচ, তাদের পিছনে জোরা ড্রিনভ, বেশ কিছুটা দূরে পাশাপাশি রোমেরা ও মোরি। এই ভাবেই দীর্ঘ পথ তারা পার হয়ে এসেছে।
তাদের আসতে দেখে কোল্ট এগিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে যেন জ্বলে উঠল জাভেরি। চীৎকার করে বলল, বিশ্বাসঘাতক! তোমাকে শেষ করাই আমার জীবনের শেষ কাজ। রিভলবার বের করে নিরস্ত্র কোল্টকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ল।
প্রথম গুলিটা কোল্টের গা ঘেসড়ে বেরিয়ে গেল। কিন্তু দ্বিতীয়বার গুলি করার সময় আর জাভেরি পেল না। তার পিছন থেকে গর্জে উঠল আর একটা আগ্নেয়াস্ত্র। পিটার জাভেরির হাত থেকে পিস্তলটা পড়ে গেল। এক হাতে পিঠ চেপে ধরে সে মাতালের মত টলতে লাগল।
আইভিচ বিদ্যুৎগতিতে ঘুরে দাঁড়াল। হা ভগবান, এ তুমি কী করলে জোরা?
জোরা বলল, যা করতে বারো বছর অপেক্ষা করেছিলাম। শৈশব পার হবার পর থেকেই যে কাজটি করার জন্য বেঁচে আছি।
ওয়েনি কোল্ট ছুটে গিয়ে জাভেরির রিভলবারটা মাটি থেকে তুলে নিল। ততক্ষণে রোমেরো ও মোরিও ছুটে এসেছে।
মাটিতে লুটিয়ে পড়ে জাভেরি হিংস্র চোখে চারদিক তাকাতে তাকাতে বলল, কে? কে আমাকে গুলি করল?
আমি, জোরা ড্রিনভ বলল।
তুমি! জাভেরি ঢোক গিলল।
হঠাৎ ওয়েনি কোল্টের দিকে ফিরে জোরা বলতে লাগল, সব কথা তোমার জানা দরকার। আমি কম্যুনিস্ট নই, কোনো দিন ছিলাম না। এই লোকটা আমার বাবাকে, মাকে আর দাদা ও দিদিকে খুন করেছে। আমার বাবা ছিল–কিন্তু সে কথা থাক। এতদিনে তার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিলাম। তীব্র দৃষ্টিতে জাভেরির দিকে তাকিয়ে বলল, গত কয়েক বছরে অনেকবারই তোমাকে মারতে পারতম, কিন্তু মারিনি। কারণ তোমার জীবনের চাইতেও বেশি কিছু আমি চেয়েছিলাম। গোটা বিশ্বের সুখ-শান্তিকে ধ্বংস করার যে জঘন্য পরিকল্পনা তুমি এবং তোমার মত লোকেরা করেছিল, আমি চেয়েছিলাম সেটাকে ব্যর্থ করার কাজে সাহায্য করতে।
পিটার জাভেরি উঠে বসল। বিস্ফারিত চোখ দুটি চকচক করছে। হঠাৎ সে খক- খক্ করে কাসল। মুখ দিয়ে ঝলকে ঝলকে রক্ত উঠতে লাগল। তার পরই সে ঢলে পড়ল মৃত্যুর কোলে।
খোলা জায়গাটার ওপারে জঙ্গলের প্রান্তে এসে দাঁড়াল একটি মূর্তি। নিঃশব্দে সে যেন আকাশ থেকে মেনে এসেছে। জোরা ড্রিনভই তাকে প্রথম দেখতে পেল। চিতার চামড়ার লেংটি-পরা একটি সাদা মানুষ এগিয়ে আসছে। তার চলনে সিংহের সাবলীল গতি-ভঙ্গী।
ও কে? কোল্ট প্রশ্ন করল।
জোরা বলল, কে তা জানি না, তবে এটুকু জানি যে জঙ্গলে পথ হারিয়ে ফেললে সেই আমার প্রাণরক্ষা করেছিল।
লোকটি সামনে এসে দাঁড়াল।
কে তুমি? ওয়েনি কোল্ট শুধাল।
আমি অরণ্যরাজ টারজান। এখানে যা কিছু ঘটেছে সব আমি দেখেছি, শুনেছি। জাভেরির মৃতদেহ দেখিয়ে বলল, ওই লোকটা যে মতলব কেঁদেছিল তা ভেস্তে গেছে, সেও মারা গেছে। এই মেয়েটি নিজেই বলেছে সে তোমাদের কেউ নয়। একে আমি সঙ্গে নিয়ে যাব; যে যাতে সভ্য জগতে ফিরে যেতে পারে তার ব্যবস্থা করব। তোমরা আর যারা আছ তাদের জন্য আমার কোন সহানুভূতি নেই। তোমরা জঙ্গল থেকে চলে যেতে পার। আমার কথা শেষ।
কিন্তু এই মার্কিন ভদ্রলোক ওদের সঙ্গে যাবে না, জোরা বলল।
যাবে না? কেন? টারজান জানতে চাইল।
কারণ সে যুক্তরাষ্ট্র সরকার কর্তৃক নিযুক্ত একজন স্পেশ্যাল এজেন্ট।
সকলেই সবিস্ময়ে জোরার দিকে তাকাল।
কোল্ট বলল, এ কথা তুমি কেমন করে জানলে?
শিবিরে এসে প্রথম যে চিঠিটা তুমি পাঠিয়েছিলে সেটা জাভেরির একজন লোকের হাতে পড়েছিল। এখন বুঝতে পারলে?
হা।
সেই জন্যই জাভেরি তোমাকে বিশ্বাসঘাতক ভেবে খুন করতে চেয়েছিল।
কালা আদমিরা এসে ভিড় করে দাঁড়িয়েছিল। তাদের ভাষায় টারজান বলল, তোমাদের দেশ আমি চিনি। উপকূলে যাবার রেল পথের শেষে সে দেশ অবস্থিত।
তাদের একজন বলল, ঠিক বলেছ হুজুর।
রেলপথের শেষ পর্যন্ত এই সাদা মানুষটিকে তোমার সঙ্গে নিয়ে যাও। আর খাবার ব্যবস্থা করে দিও। আর কোন রকম ক্ষতি করো না। তারপর তোমাদের দেশ থেকে তাকে চলে যেতে বলল। তারপর সাদা মানুষদের দিকে ফিরে বলল, আপাতত তোমরা আমার সঙ্গে শিবিরেই চুল।
সকলে ফিরে চলল। অন্যদের থেকে একটু পিছিয়ে পড়ে পাশাপাশি হাঁটতে লাগল জোরা ড্রিনভ ও ওয়েনি কোল্ট।
জোরা বলল, আমি তো ভেবেছিলাম তুমি মরে গেছ।
আমি তো ভাবছিলাম তুমি মরে গেছ, কোল্ট বলল।
জোরা আবার বলল, আর সবচাইতে দুঃসংবাদ কি জান, জীবিত বা মৃত কোন অবস্থাতেই আমার মনের কথাটি তোমাকে বলতে পারব না।
কোল্ট নিচু গলায় বলল, আর আমি ভেবেছিলাম, তোমার-আমার মধ্যে যে ব্যবধান তার একটা সেতু গড়ে তুলতে যে প্রশ্নটা তোমাকে করতে চাই তা কোন দিন করা হবে না।
জোরা ঘুরে দাঁড়াল। দুই চোখ জলে ভরা। ঠোঁট কাঁপছে। বলল, আর আমি ভাবছিলাম, জীবিত বা মৃত কোন অবস্থাতেই তোমার সে প্রশ্নের জবাবে কোন দিন হ্যাঁ বলতে পারব না।
একটা বাঁক ঘুরে তারা সকলের দৃষ্টির অন্তরালে চলে গেল।