অজু
অজু আর আমি এক ক্লাসে পড়তাম। রোগা, সাদা, শিটকে চেহারা ছিল অজুর। হনুসর্বস্ব মুখ, কণ্ঠমণির ওঠানামা দেখতে পাওয়া যেত। হাত আর পায়ে চামড়ার নীচে নীল শিরা অবধি দেখা যেত। বারো মাস ম্যালেরিয়া আর আমাশায় ভুগত সে। স্কুলে কামাই হত আর ছুটির দরখাস্ত জমা পড়ত তার। ক্লাসটিচার বঙ্কিমবাবু বলতেন, এত কামাই করলে কি পরীক্ষায় পাশ হবি রে?
রতন নামে একটা গুন্ডা ছেলে ছিল ক্লাসে। সে ছিল যত দুবলা আর ভিতু ছেলের শত্রু। ফাঁক পেলেই কাউকে পিছন থেকে ল্যাং মেরে ফেলে দিত বা পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় চটাস করে মাথায় একটা চাঁটি মেরে চলে যেত নয়তো হঠাৎ মুখোমুখি এসে দুম করে বুকে বুক দিয়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দিত। তার অত্যাচারে অনেকেরই হাঁটু ছড়ে গেছে, কনুই কেটেছে, কপালে কালশিটে পড়েছে। কিন্তু রতনের গায়ে ভীষণ জোর। কেউ আমরা তাকে কিছু বলার সাহস পেতাম না। বেচারা অজু প্রায়ই তার শিকার হত। আর আমার কাছে নালিশ করত, জানিস, রতন আজ আমার চুল টেনেছে। কিংবা, আজ রতন ইচ্ছে করে কনুই দিয়ে আমার পাঁজরে এমন গুঁতো মেরেছে যে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। আমি শুনতাম, কিন্তু কিছু করার সাধ্য ছিল না।
এক বার দিন দশেক জ্বরে ভুগে অজু স্কুলে এসে আমাকে বলল, জানিস, এ বার যখন খুব জ্বর হল, এক দিন দুপুরে একটা ঘুঘুপাখি আমাদের আমগাছটায় এসে বসেছিল। আমি ভাবলাম, পাখিটা যদি আমগাছ থেকে উড়ে পেয়ারাগাছটায় এসে বসে, তা হলে ঠিক আমার জ্বর সেরে যাবে।
আমি বললাম, বসল?
না রে। অনেক ক্ষণ ভগবানকে ডাকলাম, ঠাকুর পাখিটা এসে পেয়ারাগাছটায় একটু বসুক। কিন্তু বসল না। আমগাছ থেকে উড়ে শিমুলগাছে গিয়ে বসল। মনটা এত খারাপ হয়ে গেল!
সে বার এক জ্যোতিষী এসেছিল ওদের বাড়িতে। অজুর মা ছেলেকে তার সামনে নিয়ে বললেন, বাবা, ছেলেটা আমার বড্ড ভোগে। ওর একটা ব্যবস্থা করে দিন। জ্যোতিষী হাত-টাত দেখে অনেক আঁক কষে বললেন, খারাপ সময় যাচ্ছে মা। একটা মাদুলি নিতে হবে।
কিন্তু মাদুলির দাম চোদ্দো টাকা শুনে মায়ের মূর্ছা যাওয়ার জোগাড়। তখনকার চোদ্দো টাকা মানে অনেক, অনেক টাকা। আমাদের বয়সি ছেলেদের প্রায় কেউই তখন জুতো পরত না। কারণ এক জোড়া জুতোর দাম আড়াই বা তিন টাকা। আমাদের স্কুলব্যাগ বলতে কিছুই ছিল না, ছাতা ছিল না। বইখাতা কাঁধে নিয়ে স্কুলে যেতাম। বৃষ্টি হলে বই বাঁচাতে জামার তলায় ঢাকা দিতাম। সেই আমলের চোদ্দো টাকা অজুরা কোথায় পাবে?
এক দিন অজু স্কুল থেকে ফেরার পথে দুঃখ করে গেল, জানিস, আমি আর বাঁচব না। কাল মা পাশের বাড়ির মিনতিমাসিকে বলছিল, আমার অজুটা যা ভুগছে, ও কি বাঁচবে দিদি?
আমাদের ভয়ের সময় ছিল স্কুলের টিফিন পিরিয়ড আর ছুটির পর। ওই সময়েই রতন আর তার সঙ্গে আরও কয়েকটা পাজি ছেলে হামলা করত। অজু ভয়ে আমার জামা খামচে ধরে পায়ের সঙ্গে লেগে থাকত তখন। যদিও আমি মোটেই বীর নই।
তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। ট্রেন ভর্তি গোরা সেপাইরা যেন কোথা থেকে আসে, আর কোথায় চলে যায়। তাদের ভারী বুটে ঠনাঠন শব্দে আমাদের বুকের ভিতর গুড়গুড় করে। তারা অবশ্য আমাদের দিকে ফিরেও তাকায় না। কিন্তু আমরা তাদের দিকে তাকিয়ে ভারী হিংসে করি। আমরা কেন যে ওদের মতো নই!
সেই সময়ে দুর্ভিক্ষ চলছে। সারা দিন পালে পালে ভিখিরিরা ‘ফ্যান দাও, ভাত দাও’ বলে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। এখানে সেখানে দু’একটা করে কঙ্কালসার দেহ পড়ে থাকতেও দেখা যায়, যাদের ধাঙড়রা তুলে বাঁশে ঝুলিয়ে কোথায় যেন নিয়ে যেত।
সেই সময়ে এক দিন রেলব্রিজের নিচে একটা দু’আনি কুড়িয়ে পেয়ে সে কী আনন্দ অজুর! আস্ত একটা দু’আনি, একটা দু’আনির ক্রয়ক্ষমতা তো কম নয়! বোধহয় কোনও সাহেব মিলিটারি ভিখিরির উদ্দেশে ছুড়ে দিয়েছিল, সেটাই গড়িয়ে এসেছে। আমাকে চুপি চুপি বলল, এটা বাবাকে দেব, আমাদের তো খুব অভাব!
বার্ষিক পরীক্ষার আগে অজুর হল টাইফয়েড। সে কী জ্বর! এক দিন দেখতে গিয়েছিলাম, ঘোর লাগা চোখে চেয়ে দেখল আমাকে, চিনতে পারল না। ওর মা মুখ চুন করে বলল, কী যে করি বাবা, জ্বরে জ্বরে ছেলেটা শেষ হয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, বাহান্ন দিন ভুগে অজুর জ্বর সারল। এত রোগা হয়ে গেল যে জামাপ্যান্ট সব ঢলঢল করে। তখন তো কোমরে বেল্ট জুটত না আমাদের। মায়ের পুরনো শাড়ির পাড় দিয়ে কোমরে প্যান্ট এঁটে স্কুলে আসত অজু। আরও দুর্বল, আরও সাদা। বঙ্কিমবাবু বললেন, পাশ করবি কী করে বল তো? জুলজুল করে চেয়ে রইল শুধু। কী বলবে? জ্বরের সঙ্গে সে আর কত লড়াই করতে পারে?
আমি আর অজু স্কুল থেকে ফিরছি। হঠাৎ কোথা থেকে রতন উদয় হল। সে আমাদের আগে আগে রাস্তা জুড়ে এক বার বাঁ দিক এক বার ডান দিকে সরে হাঁটতে লাগল। ছুতোনাতায় ঝগড়া পাকিয়ে পেটানোর মতলব। অজু ভয়ে আমার জামা খামচে ধরে ছিল। আমাকে বলল, ও অমন রাস্তা জুড়ে হাঁটছে কেন? রতন মুখ ফিরিয়ে বলল, বেশ করছি হাঁটছি, এটা কি তোর বাবার রাস্তা?
তখন ওই বয়সে আমাদের কাছে মা-বাবার চেয়ে প্রিয় মানুষ নেই। প্রত্যেকেরই মনে হত, আমার বাবা-ই সেরা বাবা, আমার মা-ই সেরা মা। তাই মা-বাপ তুলে কেউ কথা বললে বড্ড গায়ে লাগত। তবু সত্যি কথা কবুল করি, কথাটা রতন আমাকে বললে আমি হয়তো অপমানটা হজম করে নিতাম। মার খাওয়ার ভয়েই।
কিন্তু কোন কথা যে কার কোথায় গিয়ে লাগে! আচমকাই আমাকে ছেড়ে দিল অজু। একটা দুর্বোধ্য জান্তব শব্দ বেরলো তার মুখ দিয়ে, তার পরই পাগলের মতো ছুটে গিয়ে সে পড়ল রতনের ওপর। অবিশ্বাস্য! রোগাপটকা, সাদা শিটকে চেহারার অজু যেন তার সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে রতনকে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলছিল। না, একতরফা নয়, রতন গুন্ডা ছেলে, ছাড়বে কেন? উলটে সেও মারছিল অজুকে। কিন্তু অজু তখন উন্মাদ। শুধু হাত-পা নয়, অজু তখন নিজেই যেন এক মারাত্মক অস্ত্র। এক সময়ে সে রতনকে রাস্তায় ফেলে তার বুকের ওপর হাঁটু গেড়ে বসে একটা ইট তুলে বলল, আর বলবি? রতন প্রাণভয়ে বলল, না বলব না। ছেড়ে দে।
আমার দৃশ্যটা দেখে মনে হল, আরোগ্য! মনে হল, বিজয়। মনে হল একটা ছেলে নিজের ধ্বংসস্তূপ থেকে ফের ওই উঠে দাঁড়াল!