অজাতশত্রু
ওই মাননীয় মহোদয় যেবার আমাদের শহরে শুভাগমন করেন ওঁর গুণমুগ্ধরা একটি প্রীতিভোজ দেন। আমন্ত্রিতরা সকলেই পুরুষ, দু-চারজন আবার রাজপুরুষ।
এ ধরনের পার্টিকে বলে স্ট্যাগ পার্টি। মাঝে মাঝে স্ট্যাগ পার্টিতে যেতে বেশ লাগে। মহিলারা অনুপস্থিত থাকায় প্রাণ খুলে হাসি মশকরা করা যায়। অনেকের অনেক গুণপনা প্রকাশ হয়ে পড়ে। আমাদের ম্যাজিস্ট্রেট গুপ্ত সাহেব যে মদের সঙ্গে মদ মেশাতে জানেন এ বিদ্যা এতদিন গুপ্ত ছিল। তিনি নিলেন ককটেল বিভাগের ভার।
খানা টেবিলে বসে পিনায় চুমুক দিতে দিতে সাফল্যের প্রসঙ্গ উঠল—জীবনের সাফল্য। আমাদের ডাক্তারসাহেব মেজর দাস বললেন, ‘আমার বন্ধু বাগচির secret of success কী জানেন? বাগচি যে আজ এতদূর উন্নতি করেছেন তার সিক্রেট আর কিছু নয়, একটি কথা।’
সেই কথাটি কী কথা তা তিনি একটু একটু করে বললেন। বাগচির নাম আমরা শুনেছিলুম, কিন্তু জীবনী এই প্রথম শুনলুম। বাস্তবিক বাগচির মতো ভাগ্যবান পুরুষ ভাগ্যবানদের মধ্যেও বিরল। ছেলেবেলায় পড়েছিলুম, ‘উদ্যোগীনং পুরুষসিংহম্ উপৈতি লক্ষ্মী’। কিন্তু কই, উদ্যোগী লোকের তো অভাব নেই, তবু কেন বাগচির মতো লোক এত কম দেখা যায়!
আমরা খাওয়া ছেড়ে শোনায় মন দিলুম। কে জানে হয়তো আমরাও এক একজন বাগচি হয়ে নরজন্ম সার্থক করব, যদি জেনে রাখি বাগচি হওয়ার সিক্রেট।
বাগচির গল্প যখন শেষ হল তখন সাফল্যের নেশা আমাদের মাথায় চড়েছে। অবশ্য নিছক সাফল্যের নেশা নয়, আর এক নেশাও। নেশার ঘোরে কে একজন গুণমুগ্ধ ফস করে বলে বসলেন, ‘অতদূর যেতে হবে না। এই তো আমাদের সম্মুখেই বিরাজ করছেন সাফল্যের প্রতিমূর্তি আমাদের মহামান্য অতিথি। বাংলা দেশে বাগচি জন্মায় যখন-তখন, কিন্তু ইনি হলেন ক্ষণজন্মা। বাগচি, রেখে দিন আপনার বাগচী।’
তখন আমরা সকলে চেপে ধরলুম, ‘স্যার, আপনার সাফল্যের সিক্রেট কী আজ আমাদের শোনাতেই হবে।’
ক্ষণজন্মা তা শুনে মৃদুমধুর হাসলেন। তাঁর দাড়ির উপর দিয়ে তরল হাসির ঢেউ খেলে গেল। দাড়িটি ফরাসি ধরনে ছাঁটা, যদিও তাঁর সব ক-টি চুল সাদা। মাননীয়ের বয়স ষাটের উপর। কিন্তু প্রসাধনের পারিপাট্য তা বুঝতে দেয় না।
সেদিন আমাদের পীড়াপীড়িতে তাঁর মাননীয়তার মুখোশ খসে পড়ল। তিনি আমাদের সঙ্গে সমান হয়ে বললেন, ‘হা হা, আমার তো secret of success নয়, আমার হচ্ছে secret of unsuccess; সেকি আপনাদের শুনতে ভালো লাগবে?’
আমরা বিস্মিত হলুম। বিশ্বাস করলুম না। ভাবলুম ইনি কেবল সাফল্যের প্রতিমূর্তি নন, বিনয়েরও অবতার।
গুপ্ত আমার কানে কানে বললেন, ‘মিথ্যে নয়। কয়েকটা কোম্পানি ফেল মেরেছে ওঁর ম্যানেজমেন্টে।’
সারকিট হাউসের ডাইনিং রুম থেকে আমরা সকলে ড্রইং রুমে এসে জমিয়ে বসলুম। কফি খেতে খেতে মান্যবরকে খোশামোদ করতে থাকলুম তাঁর সিক্রেটটুকু জানতে। তিনি কি সহজে বলতে চান!
তখন গুপ্ত প্রস্তাব করলেন, ‘স্যারকে কি এক পেয়ালা রাশিয়ান কফি দিতে পারি?’
রাশিয়ান চা কাকে বলে জানতুম, কিন্তু রাশিয়ান কফির কথা এই প্রথম শুনলুম। মাননীয় বললেন, ‘রাশিয়ান কফি! সে আবার কবে আমদানি হল?’
‘না, সেরকম কিছু নয়। রাশিয়ানরা কফির সঙ্গে এক ফোঁটা ব্র্যান্ডি মিশিয়ে খায় কিনা। বেশি নয়, এক ফোঁটা। এই যে।’
মাননীয় আবার মুখোশ এঁটে বললেন, ‘ব্যাস।’
তাতেই ফল হল। রাশিয়ান কফি গেল তাঁর উদরে, আর অমনি বেরিয়ে এল তাঁর ব্যর্থতার কাহিনি।
আমরা তাঁকে ধীরে ধীরে ঘিরে বসলুম।
আমার বড়োমেয়ের মুখে কবির এ দুটি লাইন কত বার শুনেছি—
বহুদিন মনে ছিল আশা
ধন নয় মান নয় কিছু ভালোবাসা…
হায়! আমার সে-মেয়ে আজ নেই; কোনো মেয়েই নেই, কোনো ছেলেই নেই, কেউ নেই। মানে, আছে সবাই কিন্তু আমার সঙ্গে সম্পর্ক নেই। ধন আছে মান আছে, নেই কেবল কিছু ভালোবাসা। এ বয়সে আর আশা করতে পারিনে। ক-টা দিন, আর কেন আশা।
কী করে যে কী হল, কী থেকে কী হয়ে দাঁড়াল, সে অনেক কথা। আপনাদের ভালো লাগবে না, লাগার কথা নয়। আপনারা জানতে চেয়েছেন এমন কোনো গোপনীয় কৌশল যার সাহায্যে আমি আজ ধনকুবের। আর আমি কিনা বাজে বকছি। বলছি, ধন নয় মান নয় কিছু ভালোবাসা। ক-টা দিন, আর কেন আশা!
কিন্তু দয়া করে শোনেন যদি তো আপনাদের সময় নষ্ট হবে না। যদি হয়ও তবু এমন কিছু পাবেন যা আপনাদের মনে থাকবে।
আমার জীবনের সবচেয়ে গর্বের দিন কোনটা বলব? যেদিন আমার ব্যাঙ্ক ব্যালান্স দশ লাখ অতিক্রম করল সেদিন নয়; যেদিন আমি নাইট উপাধি পেলুম সেদিন নয়; যেদিন আমি বাবার সঙ্গে সফর থেকে ফিরি, সাত বছর বয়সে। সেদিনকার দৃশ্য আমার আজও মনে আছে, প্রায় পঞ্চান্ন বছর পরে। ইতিমধ্যে কত ঘটনা ঘটল, কত দুর্ঘটনা, কত অঘটন। কিন্তু আমার সাত বছর বয়সের সেই ঘটনাটি যেমন জ্বলজ্বল করছে, তেমন আর কোনোটা নয়। আর সব ঝাপসা হয়ে আসছে।
সন্ধ্যা বেলা ফিরলুম গোরুর গাড়িতে। আর অমনি পাড়ার ছেলে-মেয়ের দল আমাকে লুট করে নিয়ে গেল খেলার জায়গায়। নিয়ে গিয়ে চাঁদের আলোয় আমার চারিদিকে ঘুরে ঘুরে নাচতে লাগল। সে-বয়সে আমার জানা ছিল না রাসলীলা কাকে বলে। ঠিক রাসলীলা না হলেও সেও ছিল সেইরকম। ওরা যে আমাকে এত ভালোবাসত তা কখনো কল্পনা করিনি। প্রত্যেকে বলে, আমার ভানু। প্রত্যেকে আমাকে কাছে টানে। আমি যে এতগুলি ছেলে-মেয়ের একান্ত ও একমাত্র, একথা সেই প্রথম শুনি সেই শেষ।
কিন্তু তখন থেকে আমার জীবনের সাধ, আমি সকলের প্রিয়পাত্র হব। আমি অজাতশত্রু, আমার কোনো শত্রু নেই। আমি নই কারও শত্রু। কিন্তু এমনই আমার কপাল, ভাবি এক হয়ে ওঠে আরেক।
ইস্কুলে ভরতি হয়ে দেখলুম সেখানে ছেলেতে ছেলেতে প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতা হলেই শত্রুতার সূত্রপাত হয়। আমি অজাতশত্রু, তাই প্রতিযোগিতার মধ্যে গেলুম না। যে যেদিন ডাকে সেদিন তার কাছে বসি। একদিন আমাদের ক্লাসের লাস্ট বয় মুরলী মুখুজ্যের কাছে বসেছি। এমনই আমার বরাত সেদিন মাস্টারমশাই এমন একটা প্রশ্ন করলেন যার উত্তর কেউ পারলে না দিতে। ফার্স্ট বয় থেকে লাস্ট বয় পর্যন্ত সব্বাইকে দাঁড় করিয়ে রাখা হল। মাস্টারমশাই ‘ইউ ইউ’ করে অবশেষে আমার দিকে চেয়ে বললেন, ‘ইউ’! আমার উচিত ছিল চুপ করে থাকা, কিন্তু জিহ্বাগ্রে ছিলেন দুষ্টা সরস্বতী। বলে দিলুম উত্তর। মাস্টার বললেন, ‘সাবাস। আজ থেকে তুমি সর্দার পোড়ো। যাও ফার্স্ট সিটে যাও, এক এক করে প্রত্যেকের কান মলতে মলতে যাও।’
এখনও মনে পড়ে সে-দৃশ্য। বেচারা মুরলী তার কান দুটি বাড়িয়ে দিয়ে চোখ বুজল। তার মুখে মুচকি হাসি। সে কিছু মনে করেনি। কিন্তু কয়েকটা ছেলে এমন কটমট করে তাকাল যে আমি তাদের কানে হাত দিতে ভয় খেলুম। যাকে বলে রোষকষায়িত লোচন। ফার্স্ট বয় বেচারার মাথা হেঁট। সে তো কেঁদেই ফেলল। কত ছেলেকে কাঁদিয়ে, কত ছেলেকে রাগিয়ে সেদিন আমি প্রথম আসনে বসলুম। ওরা যে একদিন শোধ তুলবে একথা ভেবে আমার শরীর কণ্টকিত হতে লাগল। পরের দিন সত্যি জ্বর এল।
ইস্কুলে অবশ্য যেতে হল আবার, কিন্তু বিদ্যা জাহির করা বন্ধ হল। পড়াশোনায় খারাপ ছিলুম না, অথচ বছরের শেষে পঞ্চম ষষ্ঠ কী সপ্তম হতুম। সেও আমার বিনা চেষ্টায়। পড়াশোনার চেয়ে খেলাধুলায় উৎসাহ ছিল বেশি। ফুটবল ক্রিকেট টেনিস তিনটেই ছিল আমার প্রিয়। সাঁতার আর গাছে ওঠা তো আমার নিত্যকর্ম। এর উপর ছিল চাঁদের আলোয় পাড়ার ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলা এবং আরও যতরকম বাঁদরামি। একথা আমি আপনাদের কাছে কবুল করছি যে, মেয়েরা কেউ আমাকে খুঁজতে এলে পাঁচ মিনিটের আগে ফিরত না। তারপরে আমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে বলত, ভানু চোর। আর আমি যখন চোর হয়ে মেয়েদের খোঁজে যেতুম তখনও পাঁচ মিনিট লাগত কোনো একজনকে খুঁজে বার করতে। কিন্তু তাকে ছেড়ে দিয়ে বলতুম, এই যা, পালিয়ে গেল। আমিই চোর হতুম আবার।
কিন্তু খেলাধুলার ক্ষেত্রেও দেখলুম দারুণ প্রতিযোগিতা। বার বার মারামারি করে অবসাদ এল। আমি যে অজাতশত্রু, আমার তো শত্রুতা করা সাজে না। টেনিস খেলতে গিয়ে বাঁ-চোখে লাগল বল। যিনি বল ছুড়ে মারলেন তিনি জানতেন না যে বল আমার চোখে লাগবে। ভাবলুম তিনি আমার শত্রু। সেই থেকে টেনিস খেলায় বৈরাগ্য জন্মায়। ফুটবল খেলতে গিয়ে বহুবার ডিগবাজি খাই। ফুটবল মনে করে আমাকেই কত ছেলে কিক করে যায়। ফুটবলে বিতৃষ্ণা এল। ক্রিকেট চালিয়েছিলুম অনেক কাল। বুড়ো বয়সেও সুযোগ পেলে ব্যাট করি আর ধরতে-না-ধরতেই আউট হই।
পড়াশোনায় মন নেই, খেলাধুলার শখ নেই। আমি তবে করি কী! করি হরিনাম সংকীর্তন। পাড়ায় কীর্তনের দল ছিল। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে পরম ধার্মিক বনে গেলুম। ছেলেবেলা থেকেই আমার মধ্যে ধর্মভাব ছিল কিছু বেশি। বাড়ির সকলে তা জানতেন। তাই আমার নগরকীর্তনে বাধা দেননি। অনেক রাত্রে নগরকীর্তন করে ফিরতুম, বাবা বকতেন না। কয়েক বছর এই করেই কাটল। পরীক্ষায় ফেল করতুম না, ওই অষ্টম-নবম হতুম। কাজেই মাস্টারমশাইদেরও আপত্তির কারণ ঘটত না।
আমি অজাতশত্রু। আমার একটিও শত্রু নেই। কীর্তন হচ্ছে এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে প্রতিযোগিতা থাকলেও অপ্রীতি নেই। আর প্রতিযোগিতা হচ্ছে খোলের সঙ্গে খোলের—কে কত ভালো বাজায়। কিংবা গায়েনের সঙ্গে গায়েনের—কে কত ভালো গায়। আমি ছিলুম নাচিয়ে। বাহু তুলে নাচতুম আর আবেশে ঢলে পড়তুম। আমার প্রতিযোগীরাও তাই করত। করুক, তাতে আমার কী? প্রসাদ তো সকলের ভাগেই সমান।
বেশ চলছিল। কিন্তু বিপদে পড়লুম যেদিন বাবা বললেন, ‘তোর বোধহয় কলেজে পড়া হবে না। সংসারের খরচ চালাতে পারছিনে, তোর পড়ার খরচ চালাব কী করে? যদি একটা বৃত্তিটিত্তি জোটাতে পারতিস…’
মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। বৃত্তি পায় কারা! যারা প্রতিযোগিতায় প্রথম, দ্বিতীয় হয়। আমি নগণ্য ছাত্র। আমি কেন বৃত্তি পাব! তাহলে কি বাবা বলতে চান যে আমাকেও আদা নুন খেয়ে স্কলারশিপের পড়া পড়তে হবে? তাহলেই হয়েছে আমার অজাতশত্রুতা! সুধাকান্ত আমার বিশেষ বন্ধু। বেচারার মুখের গ্রাসটি কেড়ে নেব, আর সে অন্তর থেকে ক্ষমা করবে? আর মনোরঞ্জন আমার ভাইয়ের মতো। সেকি আর আমার ভাইয়ের মতো থাকবে, যদি তার জলপানি কেড়ে খাই?
উপদেশ নিতে গেলুম হেডমাস্টারমশাইয়ের কাছে। তিনি বললেন, কলেজে পড়ার আর কী উপায় আছে জানিনে। টিউশনি করতে গেলে দেখবে সেক্ষেত্রেও তুমুল প্রতিযোগিতা। হ্যাঁ, একটি ক্ষেত্র আছে যেখানে প্রতিযোগিতা নেই। ঘরজামাই হতে রাজি আছ?’
মাস্টারমশাইয়ের এ প্রশ্নের উত্তরে আমি বলেছিলুম, ‘প্রাণ গেলেও না।’ তারপরে ভালোছেলের মতো স্কলারশিপের জন্যে পড়ি। সামান্য একটা বৃত্তি পাই। তাতে আমার কলেজের পড়া কায়ক্লেশে চলে দু-বছর। তারপরে মোটা গোছের বৃত্তি পাই। কলেজের পড়া অক্লেশে এগোয়। কিন্তু যাদের সঙ্গে আমার প্রতিযোগিতা তারা আমার সঙ্গে কথা কয় না। কথা কয় তো আমার সাফল্যের সিক্রেট জেনে নিতে। এ একপ্রকার প্রচ্ছন্ন শত্রুতা। মাফ করবেন, আপনাদের কারও প্রতি কটাক্ষ করছিনে। আপনারা আমার প্রতিযোগী নন, সুতরাং শত্রু নন। আপনাদের কৌতূহল অন্য জাতের।
আইনটা পাস করেছিলুম এমনি হাতের পাঁচ হিসাবে। কিন্তু বাবা বললেন, উকিল হতে হবে। তার চেয়ে কসাই হওয়া ঢের ভালো। কসাই তো মানুষেরও গলা কাটে না, গরিব বিধবার গলা কাটে না, বিপন্ন নাবালকদের গলা কাটে না। কী করি! একটা কিছু তো করতে হবে। যা-ই করি-না কেন পরের মুখের গ্রাস কেড়ে খাওয়ার কথা ওঠে। এমন কোন জীবিকা আছে যাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ শোষণ নেই! যদি থাকে তো সমাজের নীচের দিকে। মিস্ত্রির বা মেথরের কাজ, চাষির বা মজুরের কাজ সেসব। আমরা ভদ্রলোক বলে পরিচিত বটে, কিন্তু আমাদের মতো পরখাদক বা নরখাদক কি আর আছে!
আর একটু রাশিয়ান কফি? ধন্যবাদ মিস্টার গুপ্ত। এক ফোঁটা। এক ফোঁটা। থাক থাক, হয়েছে হয়েছে। থ্যাঙ্ক ইউ।
ইতিমধ্যে বাবা আমার বিয়ে দিয়েছিলেন। একরকম জোর করেই দিয়েছিলেন। না দিলে তাঁর ধারণা আমি ব্রাহ্মসমাজে বিয়ে করতুম। এর কারণ আমার স্বাভাবিক ধর্মভাব আমাকে ব্রাহ্মসমাজের প্রতি আকৃষ্ট করেছিল। রবিবারে রবিবারে ব্রাহ্মমন্দিরে গিয়ে চোখ বোজা আমার অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছিল। চোখ বুজে আমি নিরাকার ব্রহ্মের ধ্যান করতুম কি কোনো সাকার ব্রাহ্মিকার এ সম্বন্ধে আজ নীরব থাকাই সমীচীন, কারণ এখানে নিরাকারবাদীও রয়েছেন।
সে যা হোক, আমার শ্বশুরমশায়ের ছিল কয়লার খনি। বাবাকে বললুম, ব্যাবসাই যদি করতে হয় তবে আইনের ব্যাবসা কেন? তিনি রুষ্ট হলেন, কারণ তাঁর মতে আইনের ব্যাবসাতে ফেল করার সম্ভাবনা কম, কয়লার ব্যাবসাতে বেশি। এবং কপালে থাকলে রাসবিহারী ঘোষ হওয়া সোজা, রামদুলাল সরকার হওয়া শক্ত। ওদিকে শ্বশুরকন্যাও তুষ্ট হলেন না। তিনি চেয়েছিলেন আমি এক লম্ফে হাই কোর্টের জজ হয়ে অভিজাত সমাজে উন্নীত হই।
শ্বশুরমশাই বললেন, ‘ব্যাবসা মানেই প্রতিযোগিতা আর প্রতিযোগিতা মানেই শত্রুতা। ইংল্যাণ্ডের সঙ্গে ভারতের শত্রুতা কেন? এইজন্যেই। এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের যুদ্ধ বাঁধে কেন? এইজন্যেই। অতএব মনটাকে ইস্পাতের মতো কঠিন করতে হবে। ব্যাবসা হল যুদ্ধ। যুদ্ধে দয়ামায়ার স্থান নেই। দয়া করলে কী মরলে। দরকার হলে নিজের শ্বশুরের গলা কাটতে হবে, অবশ্য আক্ষরিক অর্থে নয়। কাটথ্রোট কম্পিটিশন। তাতে যদি জিতলে তো ঠাকুর, হারলে তো কুকুর। কেমন, জিতবে?’
উত্তর দিলুম, ‘আপনাদের আশীর্বাদে জিতব।’
একরকম বিনা মূলধনে আরম্ভ করলুম। মুরুব্বি ও জামিন হলেন শ্বশুরমশাই। আপনাদের আশীর্বাদে গোড়া থেকেই লাভ দেখলুম। কখনো দাঁও মারার চেষ্টা করিনি। কারও সঙ্গে অসাধুতা করিনি। শ্রম করতে কুন্ঠিত হইনি। অপমানে কাতর হইনি, অবিচারে হতাশ হইনি। বেগতিক দেখলে মিথ্যা বলেছি, খোশামোদ করেছি, ঘুস দিয়েছি। কিন্তু কাম, ক্রোধ বা লোভের বশবর্তী হইনি। ইস্পাতের মতো কঠিন হওয়াই আমার সাধনা। কিন্তু ইস্পাতের তলোয়ার থাকে ভেলভেটের খাপে। আমার ব্যবহার মখমলের মতো মোলায়েম। যে আমার কোম্পানিতে কাজ নিয়েছে সে আমার কোম্পানি ছাড়েনি, যতক্ষণ-না আমি নিজে তাকে ছাড়িয়ে দিয়েছি, ছাড়িয়ে দিতে বাধ্য হয়েছি। যেনতেন প্রকারেণ আশ্রিত পোষণ করা বা আত্মীয়পালন করা আমার নীতি নয়। এই আমার সাফল্যের সিক্রেট।
কিন্তু আমার ব্যর্থতার সিক্রেটও এই। মহাযুদ্ধের সময়—সে-বারকার মহাযুদ্ধে আমার মতো অনেকেরই আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়। হঠাৎ বড়োলোক হলে যা হয়, অনেকেই সে-টাকা দশরকম কারবারে খাটিয়ে যুদ্ধের পরে লালবাতি জ্বালেন। আমি কিন্তু হুঁশিয়ার থাকি। ফলে বাবার সঙ্গে, ভাইদের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটে। তাঁরা চেয়েছিলেন ও-টাকা আমার কাছ থেকে হাওলাত নিয়ে কারবার ফেঁদে রাতারাতি বড়োমানুষ হতে। আমি ও-টাকা যকের ধনের মতো আগলাই। কাউকে এক পয়সা দিইনে। অবশ্য না খেতে পেয়ে মরছে দেখলে মুক্তহস্তে দিই, চিকিৎসার জন্যে পড়াশোনার জন্যে দরাজ হাতে দিই। কিন্তু বাবুয়ানার জন্যে, বিবিয়ানার জন্যে, রাতারাতি লাল হবার জন্যে এক কপর্দকও দিইনে।
পিতৃকুলের সঙ্গে বিচ্ছেদের পরে সেই একই কারণে শ্বশুরকুলের সঙ্গেও বিচ্ছেদ। কেবল তাই হলে রক্ষা ছিল, মামলা বেঁধে গেল কোলিয়ারি নিয়ে। শ্বশুরমশাই সেকালের রাজপুত যোদ্ধা, জামাইকেও বাণ মারতে পরাঙ্খুখ নন। কিন্তু আমি যে আইন পড়ে ভুলে যাইনি, বরং ঘরে বসে আরও পড়েছি, এ তিনি জানতেন না। আমার মামলা আমি নিজেই তদবির করি। লোয়ার কোর্টে, হাই কোর্টে দুই কোর্টেই আমার জিত। উকিল ব্যারিস্টাররা বললেন, ‘আপনি হাই কোর্টে প্র্যাকটিস করলে আমাদের ভাত মারবেন দেখছি।’ আমি বললুম, ‘থাক আর শত্রুবৃদ্ধি করে কী হবে!’
শ্বশুরমশাই এর পরে যে-চাল চাললেন তা সাংঘাতিক! আমার ছেলেটার মাথা খেলেন। তাকে বোঝালেন, কয়লা অতি ময়লা জিনিস। যারা কয়লার কারবার করে তারা ছোটোলোক। বাপকে বল তোর নামে মোটরকারের এজেন্সি নিতে। ছেলে আমাকে তাই ভজালে। আমি তাকে বকে দিলুম। বললুম, বেঁচে থাকলে একদিন মোটরকার ম্যানুফ্যাকচার করব। এজেন্সি নিয়ে প্রতিযোগীর সুবিধে করে দেব কেন? পরে কি ওরা আমাকে মোটরের কারখানা খুলতে দেবে? ছেলেটা অবাধ্য। আমার কাছে চেয়ে বসল এক লাখ টাকা। আমি বললুম, এক পয়সাও না। তখন সে আমার বাড়ি থেকে আপনি বেরিয়ে গেল। তার মামারা রটালে, বাপ বার করে দিয়েছে। বাজারে আমার নাম খারাপ হয়ে গেল। পরে শুনলুম ও নাকি প্রাইভেট টিউশনি করে আইন পড়ছে, পৈত্রিক সম্পত্তিতে ওর যা প্রাপ্য তা একদিন আইনের সাহায্যে আদায় করবে। আমি কিছু টাকা পাঠিয়ে দিলুম পড়ার খরচ চালাতে। ফেরত এল।
কিছুদিন পরে দেখি মেজো ছেলেটাও বিগড়েছে। বলে, ‘দাদা আমার রাম, আমি তার লক্ষ্মণ। দাদা যদি বনবাসে গেল তো আমি কেন গৃহবাসে থাকব?’ চলে গেল একদিন আমাকে দাগা দিয়ে। শুনলুম দু-ভাই ছেলে পড়িয়ে বেড়াচ্ছে। খাচ্ছে মামাদের ওখানে। আবার কিছু টাকা পাঠিয়ে দিলুম, ওয়াপস এল।
এরপর বড়োমেয়ের পালা। বড়ো ভালোবাসতুম ওটাকে। কলেজে দিয়েছিলুম যাতে সত্যিকারের সুশিক্ষিতা হয়, তারপর ভালো দেখে বিয়ে দিতুম। কিন্তু ওর মামারা ওকে নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে বিয়ে দিলে। আমি দেখতে পেলুম না। ওর মাও ছিলেন এর মধ্যে। ওর মামাকে বললুম, ‘আমার মেয়ে, আমি সম্প্রদান করব, এই তো নিয়ম। এ তোমরা করলে কী! এরপরে আমি যদি ওকে বঞ্চিত করি?’
ওর মা বললেন, ‘মেয়ের বয়স তিন কাল গিয়ে এক কালে ঠেকেছে। উনিশ বছরের ধাড়ি মেয়ে এক বেম্ম বাড়িতেই দেখা যায়। হিঁদুর বাড়ি কেউ কোনোদিন দেখেছে? তুমি যে ওর বিয়ে দেবে না ত্রিশের আগে একথা ও নিজেই বলছিল একদিন মনের দুখে। কী করি, মেয়ের দুঃখু দেখতে পারিনে; সোমত্থ মেয়ে, কোনদিন কী দুর্গতি হয় কে জানে! আজকাল তো প্রায়ই নারীহরণের খবর কানে আসছে। মুসলমানরা কোনদিন না ধরে নিয়ে যায়। তাই হিঁদুর মেয়ের হিঁদুর সঙ্গেই বিয়ে দিয়েছি।’
এরপরে গিন্নির সঙ্গে আড়ি।
ওদিকে আমি একটার পর একটা কয়লার খনি কাঁচা আমের মতো কুড়িয়ে নিয়ে কোঁচড়ে পুরছি। কয়লার পর মাইকা, মাইকার পর ম্যাঙ্গানিজ, ম্যাঙ্গানিজের পর লোহা, যেখানে যা পাই ইজারা নিই। টাকা ঢালি, লোকসান যায়, তাও সই। কিন্তু আমার পলিসি হচ্ছে ভারতের খনিজ পদার্থ ভারতীয়দের হাতে আনা। বিদেশিদের হাতে পড়তে না দেওয়া। এর দরুন সাহেব মহলে আমার শত্রুর সংখ্যা নেই। তারা জানে যে আমি যদি বেঁচে থাকি তো একদিন জাহাজ নির্মাণ করব।
কিন্তু এদিকে আমার স্ত্রীর সঙ্গেই শত্রুতা। বাইরে শত্রু ঘরে শত্রু। বল মা তারা, দাঁড়াই কোথা! পাগলামির লক্ষণ দেখে আমি তাঁকে ভয়ে ভয়ে বললুম, চলো, আমরা কিছুদিন রাঁচিতে কাটিয়ে আসি। তিনি ফোঁস করে তেড়ে এলেন। বললেম, ‘বটে রে! আমি পাগল না তুই পাগল?’ তিনি রাগ করে তাঁর বাপের বাড়ি চলে গেলেন। সেখান থেকে আদালতে গিয়ে দরখাস্ত করলেন যে তাঁর স্বামী পাগল। পাগলের সম্পত্তি পাগল নিজে দেখাশোনা করতে অপারগ। অতএব আদালত থেকে উপযুক্ত ব্যক্তির ওপর ভার অর্পণ করা হোক। দরখাস্তের সঙ্গে দুজন বড়ো বড়ো ডাক্তারের সার্টিফিকেট দাখিল করা হল। হা ভগবান! এঁরা আমার ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান। আমার শিল আমার নোড়া আমারই ভাঙে দাঁতের গোড়া।
কী আর করি! পাঁচজন ভদ্রলোকের পরামর্শ নিয়ে স্ত্রী-পুত্রের নামে, কন্যাদের নামে, বিষয়সম্পত্তির অধিকাংশ লিখে দিই। ওরাই এখন কোম্পানিগুলোর মালিক। আমি ম্যানেজিং এজেন্ট। প্রতি মিটিং-এ আমার ওপর চোখ রাঙায়। আমিও তেমনি ঘুঘু। পাই-পয়সার হিসাব রাখি। বাজেখরচ করতে দিইনে। তাতে ওদের খুব যে সুবিধে হয়েছে তা নয়। তবে দু-বেলা হোটেলে খাচ্ছে, অনবরত মোটর হাঁকিয়ে বেড়াচ্ছে, দোকানে দোকানে ঘুরে যখন যা খুশি কিনছে, মাসোহারার টাকা এইভাবে উড়িয়ে দিচ্ছে। দেখলে চোখে জল আসে কিন্তু উপায় নেই। কী আর করি!
সবচেয়ে দুঃখ হয় যখন শুনি আমি ওদের শত্রু। হায় রে! আমি শত্রু, আমি ওদের শত্রু! যে আমি একদিন অজাতশত্রু ছিলুম সেই আমি আজ আমার পুত্র-কন্যার শত্রু! ওরা আমার মুখ দেখতে চায় না। দেখে যখন টাকার দরকার হয়। অথচ এই আমাকে দেখে আমার পাড়ার ছেলে-মেয়েরা লুট করে নিয়ে গেছে চাঁদের আলোয় হাত ধরে নাচতে। রাসলীলার কৃষ্ণ আমি, বৃন্দাবনে সর্বজনপ্রিয়। আর সেই আমি আজ দ্বারকার অধিপতি হয়েও সকলের অপ্রীতিভাজন, সকলের শত্রু। মুষলপর্বের শ্রীকৃষ্ণ আমি, স্বজনের আত্মঘাতী বুদ্ধি দেখেও অসহায়। জরাব্যাধ তো তির মেরেছে আমার সারা গায়ে, মরণেরও বেশি দেরি নেই।
মাননীয়ের কাহিনি শুনে আমাদের অন্তর আলোকিত হতে থাকল। আমাদেরও তো ওই একই সমস্যা। ছেলেরা বাবু, মেয়েরা বিবি, স্ত্রীরা বেপরোয়া খরচ করতে ওস্তাদ। ওরাও সুখী হবে না, আমাদেরও সুখী হতে দেবে না। সুখের পরিবর্তে সাফল্য নিয়ে আমরা কী করব, কার সঙ্গে ভাগ করব? তার মতো ব্যর্থতা আর কী হতে পারে?
‘কিন্তু,’ প্রশ্ন করলেন খাঁ বাহাদুর ফারোকি, ‘সব হল, আসল কথাই তো হল না। আপনার নিষ্ফলতার সিক্রেট কী? তা তো খুলে বললেন না।’
‘আর কত খোলসা করব!’ হাসলেন, হেসে বললেন মান্যবর। ‘আমার নিষ্ফলতার সিক্রেট আমার বিয়ে।’
‘উঁহু, হল না। হল না।’ বলে উঠলেন প্রিন্সিপাল দত্ত। আপনার নিষ্ফলতার সিক্রেট আপনার স্কলারশিপের পড়া।’
সেদিন আমরা কেউ কারও সঙ্গে একমত হতে পারিনি। তারপর থেকে ভাবছি মাননীয়ের সিক্রেটটা প্রকৃতপক্ষে কী? যাই হোক, এতে কোনো সন্দেহ নেই যে সফলতার সিক্রেট হচ্ছে বিফলতারও সিক্রেট।