2 of 8

অচলপত্র

অচলপত্র

ডাক্তার : অভিনন্দন রামবাবু। আপনি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেছেন।

রামবাবু : কিন্তু মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল।

ডাক্তার : মন খারাপ কেন? মাথা খারাপ সেরে গিয়ে মন খারাপ হল কেন?

রামবুবু : মন খারাপ হবে না? এতদিন নিজেকে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভাবতাম। এখন আবার সেই নিতান্ত রামবাবু হয়ে গেলাম।

* * *

তিরিশ বছরের পুরনো ‘অচলপত্রে’র উপরের কথোপকথনটি পেশ করলাম। তাও স্মৃতি থেকে।

কয়েক সপ্তাহ আগে ‘তামাক’ পর্বে পুরনো অচলপত্রের আরেকটি গল্প লিখেছিলাম এবং সেই সূত্রে অচলপত্র নামক অধুনালুপ্ত জনপ্রিয় পত্রিকা এবং সে পত্রিকার সম্পাদক স্বর্গীয় দীপ্তেন্দ্রকুমার সান্যালের কথা বলেছিলাম। একথা উল্লেখ করেছিলাম যে হাতের কাছে বা চেনাশোনা কোথাও ‘অচলপত্র’ পত্রিকা নেই, তা হলে অন্তত এক পর্ব অচলপত্র স্মৃতিচারণ করা যেত।

এক প্রাজ্ঞ পাঠক আমার সেই দুঃখ দূর করেছেন। বর্তমানের ঠিকানায় রেজিস্টার্ড বুকপোস্টে মেদিনীপুরের মহিষাদল থেকে তিনি আমারে পাঠিয়েছেন পঁচিশ বছর আগের এক বছরের বাঁধানো অচলপত্র।

ভদ্রলোক অনুরোধ করেছেন, ‘দয়া করে নামোল্লেখ করবেন না। ব্যবহার করেছেন দেখলেই আমার যোগ্য প্রাপ্তি ঘটবে।’

সুতরাং তাঁর নাম লিখে তাঁকে বিব্রত করব না, কিন্তু একথা স্বীকার করতে বাধা নেই একালে এ ধরনের পাঠক বিরল। সম্পূর্ণ অপরিচিত এই পাঠক কাগজের পৃষ্ঠায় লেখা পড়ে তাঁর পঁচিশ বছর আগের বাঁধানো পত্রিকা রেজিষ্ট্রি ডাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন —তাঁর প্রতি এই সামান্য লেখকের কৃতজ্ঞতা না জানালে অন্যায় হবে।

উনিশশো চৌষট্টি সালের বাঁধানো অচলপত্রের সেট এটা। অচলপত্রের সরসতা তখন অনেক কম। আয়ু প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। মাসিক অচলপত্র সাপ্তাহিক হয়েছে। রাজনীতির দিকেই ঝোঁক বেড়ে গেছে। মাসিক অচলপত্রের স্বর্ণযুগ গেছে পঞ্চাশের দশকে। সেটা ছিল রঙ্গব্যঙ্গের সরস সাহিত্য পত্রিকা। ষাটের দশকের রাজনৈতিক ঝাঁঝ ঢুকে যায় সাপ্তাহিক অচলপত্রে এবং সেই সঙ্গে যথেষ্ট পরিমাণ অনাবশ্যক রাগ ও তিক্ততা।

অচলপত্রের প্রসঙ্গে রাগ ও তিক্ততার কথা থাক, বরং দুয়েকটা সরস উদাহরণ দিই।

এই নিবন্ধের প্রথমে যে উদ্ধৃতি দিয়েছি সেটা স্মৃতি থেকে, রসিকতাটা মাসিক অচলপত্রের সময়কার। আর এর পরেরগুলি চৌষট্টি সালের সাপ্তাহিক অচলপত্র থেকে।

অচলপত্রের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিভাগ ছিল ‘সাহিত্য দুঃসংবাদ’ এবং চিঠিপত্তরের জঞ্জাল। ‘সাহিত্য দুঃসংবাদ’ জনপ্রিয় হয়েছিল প্রধানত নারায়ণ দাশশর্মার তির্যক, সরস ও মর্মান্তিক মন্তব্যের জন্যে। এ ছাড়াও সাহিত্য দুঃসংবাদ বী. না. ব. এবং সম্পাদক স্বয়ং লিখতেন।

যতদূর মনে পড়ছে চিঠিপত্তরের জঞ্জাল সম্পাদক সাধারণত নিজেই দেখতেন।

তখন কেনেডি সদ্য নিহত হয়েছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট হয়েছেন জনসন। চিঠিপত্তরের জঞ্জালে একজন প্রশ্ন করেছেন, ‘কেনেডির তুলনায় জনসন কেমন?’

দীপেন সান্যালের সরাসরি জবাব, ‘এখনও বেবি জনসন।’

আরেকটি প্রশ্ন। ‘পাঁঠার মাংস পাঁচ টাকা হয়ে গেল কি বরাবরের মতো?’

জবাব : ‘না আরও বাড়বে পাঁঠার দাম। চলচ্চিত্র থেকে সাহিত্য-সংগীত- শিক্ষা-রাজনীতি সব ক্ষেত্রেই পাঁঠার দাম বাড়তে থাকবে।’

আজ পঁচিশ বছর পরে যখন মাংসের দাম প্রায় পঞ্চাশ টাকা ছুঁয়ে দশগুণ হয়েছে দীপ্তেন্দ্রকুমার সান্যালের ভবিষ্যৎবাণী সফল হয়েছে বলেই বলা যায়। শুধু মাংসের পাঁঠা নয়, সব রকম পাঁঠার দামই বাড়ছে, বাড়বে।

এই সময়েই একটি রাজনৈতিক ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন, দীপ্তেন সান্যাল, নেহরু তখনও বেঁচে তবে অসুস্থতার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এক পাঠক প্রশ্ন করলেন, ‘জয়প্রকাশ নারায়ণ কি ভাবী পি-এম?’ দীপ্তেন সান্যালের জবাব, ‘ইন্দিরা থাকতে? সন্তান থাকতে অন্য কাউকে কেউ অ্যাডপট (Adopt) করে?’

ঠিক এই সময়েই পূর্ব পাকিস্তানে দাঙ্গা এবং সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রসঙ্গে তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদাসীনতা কটাক্ষ করে দীপ্তেন লেখেন, ‘মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেন মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করেছেন।’

রাজনীতির কচকচি থাক। অচলপত্রের একটা সিনেমা সংক্রান্ত মন্তব্যের কথা বলি। মন্তব্যটি এক এবং অদ্বিতীয় সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে।

এক পাঠক চিঠি দিয়েছিলেন অচলপত্রে, ‘সত্যজিৎ রায় রবীন্দ্রনাথের নষ্টনীড় গল্পের নাম পালটে চারুলতা করেছেন, জানেন?’

দীপ্তেন সান্যাল জবাব দিলেন, ‘এখন তো কলির সন্ধে রবীন্দ্রনাথের নাম পালটে দেননি, বাঙালির চৌদ্দ পুরুষের ভাগ্য ভাল…’

এ ধরনের তিক্ত ও তির্যক মন্তব্য হয়তো অনেকেরই এখন আর পছন্দ নয়। কিন্তু বয়েসের গুণেই হোক বা চরিত্র দোষেই হোক আমরা এসব পড়ে বেশ মজা পেতাম।

একবার দীপ্তেনবাবুকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘শুনছি, আপনি নাকি জেলে যাবেন এবার?’ তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমি কোথায় আছি বলে আপনার ধারণা?’

ঠিক এই রকম নয় তবে প্রায় সমজাতীয় একটা রসিকতাও ছাপা হয়েছিল অচলপত্রে, সেটা হুবহু তুলে দিচ্ছি…

জন্মান্তরে অবিশ্বাসী একজন জিজ্ঞেস করল তার জন্মান্তরে বিশ্বাসী এক বন্ধুকে যে, ‘তা হলে তুমি কি বলতে চাও যে আমি আসছে বার শুয়োর হয়েও জন্মাতে পারি।’

জন্মান্তরে বিশ্বাসী বন্ধু শুনে বলল, ‘না তা পারো না, দু’বার এক রূপ কেউ পরিগ্রহণ করে না।’

* * *

অচলপত্র প্রসঙ্গ শেষ করার আগে দুটি উল্লেখযোগ্য কথা জানিয়ে রাখি। এক, অচলপত্রের প্রচ্ছদে একটি এবড়ো-খেবড়ো ক্যাকটাস গাছের অর্থাৎ ফণি-মনসার ছবি ছাপা হত। এবং দুই, প্রচ্ছদের নীচে লেখা থাকত, সর্বাধিক কম বিকৃত সাপ্তাহিক।

অবশেষে একটি অচলপত্ৰীয় রসিকতার উদাহরণ দিয়ে এই স্মৃতিচারণা শেষ করি:-

রোগী : ডাক্তারবাবু, আমার কী হবে?

ডাক্তার : পোস্টমর্টেমের পর বলা যাবে।

পুনশ্চ : আরেকটি অচলপত্ৰীয় আখ্যান।

এক চিত্রকর বহুদিন ধরে একটি ছবি আঁকছিলেন। তাঁকে যখন সবাই জিজ্ঞেস করল কীসের ছবি আঁকছেন, তিনি বললেন, ‘ভগবানের ছবি আঁকছি।’

তখন সবাই বলল, ‘সে কী করে সম্ভব। কেউ জানেই না ভগবান কী রকম দেখতে।’

চিত্রকর গম্ভীর হয়ে জবাব দিলেন, ‘এবার থেকে এই ছবি দেখে জানতে পারবে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *