৭
দুটো লোকের মধ্যে হওয়া কথোপকথনের অডিয়ো ক্লিপিংটা যতক্ষণ চলছিল, সাদা ধুতি পরা ছেলেগুলো একমনে শুনছিল, মাঝে মাঝে তাকাচ্ছিল সামনের বিশাল স্ক্রিনের দিকে। রেকর্ডটা শেষ হতেই স্ক্রিনের ওপারের ফর্সা লোকটা কথা বলে উঠল, ‘কী বুঝলে তোমরা?’
কেউ কোনো উত্তর দিল না। নির্বাক চোখে তাকিয়ে রইল স্ক্রিনের ওপাশের গুরুর দিকে।
লোকটা বলল, ‘এটা তো বুঝতে পারছ যে এরা আগ্রা শহরে কোনো প্রাচীন মন্দির খুঁজছে?’
ছেলেগুলো এখনও চুপ।
ভিডিয়ো কনফারেন্স চলছে। বাইরে ২৪ জানুয়ারির মধ্যরাত। এই হল ঘরের পাশের জানলাগুলোর লাগোয়া গাছগুলোর পাতা মৃদুমন্দ দুলছে ঠান্ডা বাতাসের ছোঁয়ায়। একটা ছেলে সেদিকে আড়চোখে তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিল। গুরুজি, তা সে যত দূরেই থাকুন, কারুর অমনোযোগিতা পলকে ধরে ফেলেন। শুধু এই ঘরেই রয়েছে কম করে ত্রিশটা সি সি ক্যামেরা, সবার প্রতি মুহূর্তের হিসেব মনিটর করছে সেগুলো।
স্ক্রিনে গুরুজি এবার বললেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ কাবা শরিফ গেছ? সৌদি আরবের মক্কার কাবা মসজিদ? ইসলামের সবচেয়ে পবিত্র তীর্থস্থান?’
একটা ছেলে একটু ইতস্তত করে হাত তুলল, ‘ছোটোবেলায় আব্বাজানের সঙ্গে গিয়েছিলাম। হজ করতে।’
‘বেশ। তোমার নাম কী?’ গুরুজি স্ক্রিনে হাসিমুখে তাকালেন।
‘কা-কমল গুরুজি।’
গুরুজি প্রসন্নমুখে মাথা নাড়লেন ঈষৎ, ‘আগে কামাল ছিল, তাই না?’
কমল নামের বছর উনিশ-কুড়ির ছেলেটা মাথা নাড়ল।
‘কমল, তুমি কি জানো, মক্কার ওই কাবা মসজিদ আসলে একটা হিন্দু মন্দির ছিল?’ গুরুজি কমলের দিকে তাকালেন।
কমল বলে ছেলেটার চোখে একটা উন্নাসিকতার চিহ্ন ফুটে উঠেই নিভে গেল। পাশ থেকে ফিচকেমতো ছেলেটা ফিসফিস করে উঠল, ‘ওই শুরু হল আবার! নেহাত টাকার জন্য পড়ে আছি, না হলে বেটাকে লাথি মেরে…!’
কমল হিন্দু সন্তান দলের সর্বকনিষ্ঠ এবং সর্বশেষ সদস্য। তার নাম কামাল, না কমল, কাবা মন্দির ছিল না মসজিদ বা গির্জা, তাতে কি তার কিছু যায় আসে?
হিন্দু সন্তান দল প্রতি মাসেই কুড়ি পঁচিশটা করে ধর্ম পরিবর্তন করাচ্ছে, ওরা অবশ্য এটার নাম দিয়েছে ‘ঘর ওয়াপসি’। মানে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসছে আর কি!
কমল মুসলমান ছিল। কিন্তু গুরুজির কথা অনুযায়ী তারও কয়েকশো বছর আগে কমলের পূর্বপুরুষ নাকি হিন্দুই ছিল, তাদের জোর করে মুসলিম করা হয়েছিল। কমলকে অবশ্য জোর করে করানো হয়নি, নিদারুণ দারিদ্র্যে পাঁচ লক্ষ টাকা যেন এক আকাশ টাকা, কমলরা আনন্দের সঙ্গে হিন্দু হয়ে গেছে। এখন দলের কাজকর্ম করেও ভালো রোজগার হচ্ছে।
সামনের বছর বোনের বিয়েটা দিয়ে দিতে পারলেই… আরে ভাই, হিন্দু হও আর মুসলিম, পেটের জ্বালায় গরম চাপাটির খিদে একরকম!
‘কমল!’ গুরুজি আবার ডাকলেন।
‘হ্যাঁ, গুরুজি!’ কমল তড়িঘড়ি বাস্তবে ফিরে এল।
গুরুজি এবার সবার দিকে তাকালেন, ‘প্রাচীন যুগে সমস্ত সভ্যতার উন্মেষ এই ভারতবর্ষেই ঘটেছিল। সরস্বতী নদী ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাওয়ার ফলে তা ক্রমশ পৌঁছয় আরব, মেসোপটেমিয়ার দিয়ে। ঐ যে কথোপকথনের রেকর্ডটা শুনলে, উদ্দেশ্য ওদের যতই অসৎ হোক, কথাটা ঠিকই বলেছে, জ্যামিতির উপপাদ্য থেকে শুরু করে আধুনিক বিজ্ঞানের অনেক জটিল আবিষ্কারই হয়েছিল ভারতে। তেমনই ইসলামের আবির্ভাবের আগে কাবা ছিল হিন্দু মন্দির। কিছু বছর আগে রাজা বিক্রমাদিত্যের এক শিলালিপি সেখান থেকে উদ্ধার হয়েছিল বলে শুনেছি। রাজা বিক্রমাদিত্য আরব দখল করেছিলেন। কাবায় তিনশো পঞ্চাশটা মূর্তি আছে যেগুলো বছরের একেকটা দিনের প্রতীক। সেই মূর্তিগুলোর মধ্যে প্রধান হলেন চন্দ্রদেব হুবল। শিবের সঙ্গে এই দেবতার প্রচুর সাদৃশ্য। শিবের মতো হুবলদেবও মাথায় চাঁদকে ধারণ করেন। শিবের মাথা থেকে যেভাবে গঙ্গা নির্গত হয়েছে, তেমনই হুবলদেবের ক্ষেত্রে জমজমের পবিত্র জল নির্গত হয়েছে।’
কমলের পাশের লোকটা আবার চাপা গলায় বলল, ‘আষাঢ়ে গপ্পো যত!’
‘মানে, আপনি বলছেন এটাও মুসলিমরা দখল করেছিল?’ একটা ছেলে প্রশ্ন করল।
‘আমি কিছুই বলছি না। আমি শুধু সত্যগুলো তোমাদের জানাচ্ছি। সিদ্ধান্ত নেবে তোমরা নিজেরাই।’ গুরুজি হাসলেন, ‘কাবায় মুসলিমরা অনেক আচারবিচার করে থাকেন, যেগুলো পুরোপুরি হিন্দু ধর্মের আচার। যেমন, কাবার পবিত্র পাথরকে কেন্দ্র করে তাঁরা সাতবার প্রদক্ষিণ করেন, ঠিক যেমন হিন্দুরা অগ্নিকে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিণ করে থাকেন, কাবার হজযাত্রীরা সাদা পোশাক পরেন, এটাও হিন্দু সংস্কার। এমনকী…’ গুরুজি এক মুহূর্ত থামলেন, ‘আল্লাহ শব্দটাও এসেছে সংস্কৃত থেকে, মা দুর্গার এক নাম ইলা, সেই ইলা থেকেই আল্লাহ। পণ্ডিত শতভলেকর আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন, কোরানের একটা বাণী আর যজুর্বেদের একটা শ্লোকের হুবহু এক অর্থ।’
গুরুজি বক্তব্য শেষ করতে উদ্যত হলেন, ‘এভাবেই হাজার হাজার হিন্দু মন্দির পরিবর্তিত হয়েছে মসজিদ বা মুসলিম সৌধে। আমাদের সেইসব হৃদসম্পদ পুনরুদ্ধার করতে হবে। হ্যাঁ আমরা বাধা পাব, রক্তাক্ত হব। কিন্তু কোনোভাবেই লড়াই ছাড়ব না। হিন্দু সন্তানরা, তোমরা প্রস্তুত?’
সবাই মাথা নাড়ল সঙ্গেসঙ্গে। কমলও মাথা নাড়ল। পাশের সেই ফিচেল ছেলেটাও। এই মিশনে প্রচুর টাকা, সেইজন্য ঝাঁপাতে ওরা সত্যিই তৈরি। ও না থাকুক, ওঁর পরিবার তো দুটো খেয়েপরে বাঁচবে!
‘গুরুজি, রেকর্ডে যে আগ্রার মন্দিরের কথা বলা হচ্ছিল, সেটাই কি তাজমহল?’ এক অত্যুৎসাহী ছেলে প্রশ্ন করল।
গুরুজি হাসলেন, ডান হাতটাকে আশীর্বাদের ভঙ্গিতে তুললেন স্ক্রিনের মধ্যে, ‘সেই প্রশ্নের উত্তর তোমরা খুঁজলেই পাবে। আর তো মাত্র দুটো দিন। অপেক্ষা শুধু প্রফেসরের ওই শ্লোকের মর্মোদ্ধারের। সন্তান দল প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে। তোমরা নিজেদের নিংড়ে লড়াই কোরো। হর হর মহাদেব!’