অঘটন আজও ঘটে
দুর্ঘটনা ব্যাপারটা আকস্মিক। বহু সাবধানতা সত্ত্বেও দুর্ঘটনা চিরদিনই ঘটে, ঘটে যায়। অসাবধানী ব্যক্তির জীবনে যেমন দুর্ঘটনা ঘটে, খুব সাবধানী ব্যক্তির ক্ষেত্রেও তা ঘটতে পারে। দুর্ঘটনার কোনও অঙ্ক নেই, তা কোনও হিসেবে আসে না। বাথরুমে পা পিছলে কোমর ভেঙে যেমন তিন মাস বিছানায় পড়ে থাকা সম্ভব, তেমনই সম্ভব লঞ্চে পিকনিক করতে গিয়ে গঙ্গায় পড়ে যাওয়া কিংবা দ্রুতগামী ট্রেনের সামনের কোচে শায়িত অবস্থায় মধ্য রাতে অন্য লাইনের মালগাড়ির মোকাবিলা করা।
তবু এরই মধ্যে তফাত আছে। দুর্ঘটনার রকমভেদ আছে। কিছু দুর্ঘটনা আছে যা এড়ানো যেত, আবার কিছু আছে যা এড়ানো যায় না।
একটি সাবেকি দুর্ঘটনার কাহিনী এই সূত্রে স্মরণ করা যেতে পারে। গল্পটি পুরনো, কাজির বিচারের আমলের।
রাস্তার ধারের একটা পুরনো বাড়ির ছাদের কার্নিশ সারাচ্ছিল এক রাজমিস্ত্রি। হঠাৎ সে পা ফসকিয়ে এক বৃদ্ধ পথচারীর ঘাড়ে পড়ে যায়। এই আকস্মিক দুর্ঘটনায় রাজমিস্ত্রিটির তেমন কিছু হল না, কিন্তু বৃদ্ধ পথিকটি মারা গেলেন।
এর পর বৃদ্ধের পুত্র কাজির আদালতে ওই রাজমিস্ত্রির বিরুদ্ধে নালিশ করল। কাজি সব কিছু শুনে বিচার বিবেচনা করে রাজমিস্ত্রিকে নির্দোষ সাব্যস্ত করলেন। কিন্তু মৃত ব্যক্তির পুত্র এতে সন্তুষ্ট হল না। সে জোরাজুরি করতে লাগল যে, ‘ন্যায়বিচার হল না, এই রাজমিস্ত্রি ঘাড়ে পড়ায় আমার বাবা মারা গেল, কিন্তু রাজমিস্ত্রির কোনও সাজা হল না। এ কেমন বিচার হল?’
লোকটি যখন নানারকম ওজর-আপত্তি করতে লাগল কাজি তাঁর আদেশ পালটাতে বাধ্য হলেন। তিনি পুনরাদেশ দিলেন যে বৃদ্ধ ব্যক্তিটি রাস্তার যেখান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল, রাজমিস্ত্রি ঠিক সেখান দিয়ে হেঁটে যাবে আর ছাদে যেখানে ওই রাজমিস্ত্রি মেরামত করছিল সেখান থেকে মৃত ব্যক্তির পুত্র অর্থাৎ অভিযোগকারী লাফ দিয়ে রাস্তায় রাজমিস্ত্রির ঘাড়ে পড়বে।
বলা বাহুল্য এর পরের ঘটনা জানা যায় না।
বেশ কিছু কাল আগের কথা—দূর মফস্বলের এক সাপ্তাহিক পত্রে এই রোমহর্ষক সংবাদটি ছাপা হয়েছিল,
‘দুর্ঘটনা হইতে রক্ষা—
গত শনিবার মধ্যরাত্রে স্থানীয় বিখ্যাত ব্যবসায়ী শ্ৰীযুক্ত মহেন্দ্র পোদ্দার একটি সাংঘাতিক দুর্ঘটনা হইতে ভাগ্যক্রমে রক্ষা পাইয়াছেন। এ অঞ্চলে সমাজবিরোধীদের উৎপাত বাড়িয়া যাওয়ায় পোদ্দার মহাশয় রাত্রিতে শোয়ার সময় মাথার নীচে পিস্তল লইয়া শয়ন করেন।
শনিবার মধ্যরাত্রে কীসের যেন শব্দে ঘুম ভাঙিয়া পোদ্দার মহাশয় দেখিতে পান জানালার পাশে অন্ধকারে কে যেন দাঁড়াইয়া আছে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বালিশের নীচ হইতে পিস্তল বাহির করিয়া গুলি চালান। গুলির শব্দে বাসাস্থ সকলে জাগিয়া ওঠে এবং আলো জ্বালাইয়া দেখা যায় পোদ্দার মহাশয় ভুল করিয়াছেন। জানালার পাশে তাঁহার নিজের ছাড়া পাঞ্জাবি ঝোলানো ছিল, তিনি ঘুমঘোরে অন্ধকারে তাহাই কোনও লোক ভাবিয়া গুলি করেন। দেখা যায় পাঞ্জাবিটির বুকের দুই দিক গুলিতে ছিন্ন হইয়াছে।
‘সবই ঈশ্বরের আশীর্বাদ। যদি গুলি চালনার সময় পোদ্দার মহাশয়ের গায়ে পাঞ্জাবিটি থাকিত তিনি অবশ্যই নিহত হইতেন। এই দুর্ঘটনা হইতে রক্ষা পাওয়ার জন্য আমরা অতঃপর তাঁহার দীর্ঘজীবন কামনা করি।’
এই বাজে সংবাদের পর একটি সত্য ঘটনায় যাই। লন্ডন শহরের মেট্রো রেলে যখন প্রথম এসকেলেটর চালু হয় যাত্রিসাধারণ কিছুতেই সেটা ব্যবহার করতে চাইতেন না। তাঁদের ভয় হয়েছিল তাঁরা যদি এসকেলেটরে পড়ে গিয়ে দুর্ঘটনায় আহত হন। অবশেষে যাত্রীদের মন থেকে ভয় দূর করার জন্যে মেট্রো কর্তৃপক্ষ এক খঞ্জ ব্যক্তিকে নিযুক্ত করলেন, যার কাজ হল ক্রাচে ভর দিয়ে সর্বজনসমক্ষে এসকেলেটরে ওঠানামা করা। এতে কিন্তু হিতে বিপরীত হল। ক্রাচে ভর করে খঞ্জ ব্যক্তির ওঠানামা দেখে যাত্রীদের এ ধারণা বদ্ধমূল হল যে ওই লোকটি তার পা হারিয়ে খোঁড়া হয়েছে ওই এসকেলেটরে চড়তে গিয়েই, সুতরাং তাঁরা এসকেলেটরকে আরও এড়িয়ে চললেন।
তবে সব দুর্ঘটনাই যে ঘটে তা নয়। কিছুদিন আগে এক সকালে থিয়েটার রোডের মোড়ে দেখা গিয়েছিল যে এক ভদ্রলোক, তাঁর জামার কলার ছেঁড়া, কপাল ফাটা এবং মাথায় ব্যান্ডেজ, রাস্তা থেকে একটা আধলা ইট কুড়িয়ে তাই দিয়ে নিজের গাড়ির হেডলাইট, কাচ এইসব ভাঙছেন, গাড়ির মাডগার্ড দুমড়িয়ে ফেলার চেষ্টা করছেন।
কিছুক্ষণের মধ্যে চারপাশে কৌতুহলী জনতার ভিড় জমে গেল। সকলের ধারণা, ভদ্রলোক উন্মাদ, না হলে নিজের গাড়ি কেউ এভাবে ভাঙে। ভাঙাচোরা শেষ করে কপালের ঘাম মুছে ভদ্রলোক বিস্মিত জনতাকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘না দাদারা, আমার মাথা খারাপ হয়নি। কাল রাতে মদ খেয়ে একটু মারামারি করেছিলুম। বাড়িতে বউকে ফোন করে বলেছিলাম গাড়ির অ্যাকসিডেন্ট করেছি, তাই গাড়িটাকে ভেঙে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি। দুর্ঘটনাটা প্রমাণ করতে হবে তো!’