অগ্রদূত [দ্য ফোররানার]

অগ্রদূত [দ্য ফোররানার] 
নীতিগর্ভ রূপক কাহিনী ও কবিতা 

অগ্রদূত 

তুমি হলে তোমার নিজস্ব অগ্রদূত এবং তুমি যে স্তম্ভ নির্মাণ করেছ সেটাই তোমার দৈত্যাকৃতি আত্মার ভিত্তি এবং ঐ আত্মাও হবে একটা ভিত্তিভূমি। 

এবং আমিও আমার নিজস্ব অগ্রদূত, কারণ যে দীর্ঘ ছায়া আমার সামনে বিস্তৃত হয়ে আছে, সূর্যোদয় সেই ছায়াকে মধ্যাহ্নে আমার পায়ের কাছে এনে জড়ো করবে, যদিও আমার সম্মুখে অন্য এক সূর্যোদয় অন্য এক ছায়ার ওপরে শুয়ে পড়বে এবং সেটাও একত্রিত হবে মধ্যাহ্নকালে। 

সবসময়ই আমাদের নিজস্ব অগ্রদূত আছে এবং সবসময় আমরা প্রত্যেকেই একত্রে থাকব। যা কিছু আমরা একত্রিত করেছি এবং যা একত্রিত করব সবই পরিণত হবে বীজে যদিও শস্যক্ষেত অকর্ষিত। আমরাই হলাম শস্যক্ষেত এবং ভূমিকর্ষণকারী, সংগৃহীত এবং সংগ্রহকারী। 

যখন তুমি ধোঁয়াশার ভেতরে ছিলে একটি বিস্ময়কর আকাঙ্ক্ষা, আমিও সেখানে ছিলাম, আরও একটি বিস্ময়কর আকাঙ্ক্ষা। তারপর আমরা সন্ধান করেছিলাম একে অন্যকে এবং আমাদের আগ্রহের ভেতর থেকে জন্ম নিয়েছিল স্বপ্ন। স্বপ্নগুলির সময় ছিল সীমাহীন এবং স্বপ্নগুলি ছিল পরিমাপহীন মহাশূন্যতা। 

যখন জীবনের শিহরিত ওষ্ঠের ওপর তুমি ছিলে নীরব শব্দাবলি, তখন আমিও সেখানে ছিলাম অন্য এক নীরব শব্দাবলি। তারপর জীবন আমাদেরকে উচ্চারণ করল, আমরা নেমে এলাম সেইসব বছরগুলির ওপর যার হৃদস্পন্দন গতকালের স্মৃতি এবং আগামীকালের আকাঙ্ক্ষায় ভরপুর, কারণ গতকাল ছিল মৃত্যুঞ্জয়ী এবং আগামীকাল ছিল জন্মের পেছনে তাড়া করা। 

বর্তমানে আমরা ঈশ্বরের হাতে। তার ডান হাতে তুমি হচ্ছ সূর্য এবং তার বাম হাতে আমি হলাম পৃথিবী এবং সবসময়ই আমরা হব শুরু। 

তুমি এবং তোমার নিজস্ব অগ্রদূত, তোমরা হলে আমার বাগানের প্রবেশপথ অতিক্রম করে যাওয়া আগন্তুক। 

আমিও আমার অগ্রদূত যদিও আমি বসে থাকি আমার বৃক্ষের ছায়ায় এবং এই বসে থাকাকে মনে হয় গতিহীনতা। 

.

ঈশ্বরের বোকামি 

বিশাল সারিয়া নগরে একবার মরুভূমি থেকে এক লোক এসেছিল। সে ছিল একজন স্বপ্নদর্শী এবং তার কিছুই ছিল না শুধু পোশাক ও একটা ছড়ি ছাড়া। 

রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় সে আতঙ্ক ও বিস্ময়ে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল মন্দির, স্মৃতিস্তম্ভ এবং রাজপ্রাসাদের দিকে। সে প্রায়ই কথা বলত পথচারীদের সাথে, প্রশ্ন করত তাদের শহর সম্পর্কে, কিন্তু তারা তার ভাষা বুঝত না এবং সেও বুঝত না শহরবাসীর ভাষা। দুপুরবেলায় সে একট বিশাল পান্থশালার সামনে থেমেছিল। পান্থশালাটি নির্মিত হয়েছিল হলুদ মার্বেল পাথরে এবং সেখানে লোকজনের ঢোকা ও বেরিয়ে আসার মোটেও বিলম্ব হত না। কিন্তু এই বিশাল গৌরবের কক্ষে নিজেকে খুঁজে পাওয়াটা ছিল তার কাছে বিস্ময় এবং বিপুল সংখ্যক নারী ও পুরুষ অসংখ্য টেবিল ঘিরে বসেছিল। তারা খাচ্ছিল, পান করছিল এবং গান শুনছিল। 

স্বপ্নদর্শী বলল, না, এটা কোনো প্রার্থনার অনুষ্ঠান নয়। এটা অবশ্যই জনগণের উদ্দেশ্যে দেওয়া রাজকুমারের ভোজ উৎসব—কোনো বিশাল উপলক্ষ উৎযাপন।’ 

সেই মুহূর্তে এক লোক যাকে সে রাজকুমারের দাস মনে করেছিল সে তার কাছে এগিয়ে এল এবং তাকে বসতে হুকুম করল এবং সেই লোক মাংস, মদ এবং অত্যন্ত চমৎকার মিষ্টি পরিবেশন করছিল। 

পরিতৃপ্ত হওয়ার পর স্বপ্নদর্শী চলে যেতে উদ্যত হয়। কিন্তু দরজার কাছে এক বিশাল লোক তাকে থামায়। লোকটার বেশভূষা চমৎকারভাবে বিন্যাস্ত। স্বপ্নদর্শী মনে মনে বলল, ‘নিশ্চিতভাবে এটাই রাজকুমার’ এবং সে অভিবাদন ও ধন্যবাদ জানাল। 

তারপর সেই বিশাল লোকটি শহরের লোকদের ভাষায় বলল : 

‘হে জনাব, আপনি আপনার নৈশভোজের জন্য কোনো অর্থ প্রদান করেননি’ এবং স্বপ্নদর্শী তা বুঝতে পারেন না এবং হৃদয় থেকে আবার তাকে ধন্যবাদ জানান। তারপর সেই বিশাল লোকটি কিছুক্ষণ স্বপ্নদর্শীর সম্পর্কে ভাবেন এবং খুব কাছে থেকে তাকে পর্যবেক্ষণ করেন এবং লক্ষ্য করেন যে, সে একজন আগন্তুক, কিন্তু পোশাক দরিদ্রের মতো এবং বস্তুতপক্ষে তার কাছে কোনো অর্থ ছিল না খাবারের দাম পরিশোধ করার। তারপর সেই বিশাল লোকটি হাততালি দিলেন এবং আহ্বান জানালেন এবং সেখানে শহরের চারজন নৈশপ্রহরী এল, তারা মনোযোগ দিয়ে বিশাল লোকটির কথা শুনল এবং তারপর তারা স্বপ্নদর্শীকে তাদের ভেতরে টেনে নিল—তার দুপাশে দুজন করে। স্বপ্নদর্শী তাদের পোশাক ও রীতিনীতির আনুষ্ঠানিকতার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা লিখল এবং আনন্দের সঙ্গে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকল। সে বলল, ‘এরাই হল সেইসব মানুষ যাদের স্বাতন্ত্র আছে।’ তারপর তারা প্রত্যেকেই হাঁটল, যতক্ষণ তারা বিচারকক্ষের সামনে না এল এবং তারপর তারা প্রবেশ করল। 

স্বপ্নদর্শী দেখল তার সামনে একটা সিংহাসনে উপবিষ্ট এক অসহায় লোক, যার মুখভর্তি সাবলীল দাড়ি এবং সে অপহৃত হয়েছিল রাজকীয়ভাবে। সে ভাবল সে-ই হচ্ছে রাজা। এবং সে আহ্লাদিত হল তাকে রাজার সামনে নেওয়ার কারণে। 

বর্তমানে বিচারের সঙ্গে সম্পর্কিত নৈশপ্রহরী হল সেই অসহায় লোকটি। বিচারক দুজন আইনজীবীকে নিয়োগ দেন— একজন অভিযোগ উপস্থাপন করবেন এবং অন্যজন আগন্তুককে রক্ষা করবেন। আইনজীবীরা একের-পর-এক উঠে দাঁড়ালেন এবং প্রত্যেকেই তার মতামত তুলে ধরলেন। স্বপ্নদর্শী মনে মনে ভাবল যে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করা শুনবেন এবং তার হৃদয় রাজা ও রাজকুমারের প্রতি কৃতজ্ঞতায় পূর্ণ হয়ে উঠল কারণ সবকিছুই করা হয়েছিল তার জন্য। 

তারপর স্বপ্নদর্শীকে দণ্ডাদেশ দেওয়া হল একটা লিপিফলক তার গলায় ঝুলিয়ে দেওয়ার জন্য। তার অপরাধের লিখিত বিবরণ থাকা উচিত এবং সে যেন একটা নগ্ন ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে সারা শহর ঘুরতে পারে একজন তুর্যবাদক ও একজন ঢোলবাদককে সামনে নিয়ে এবং দণ্ডাদেশ অবিলম্বে কার্যকর করা হয়েছিল। 

এখন স্বপ্নদর্শী নগ্ন ঘোড়ায় চড়ে সারা শহর ঘুরে বেড়াল তূর্যবাদক ও ঢোলবাদককে সামনে নিয়ে এবং এই শব্দ শুনে নগরবাসীরা দৌড়ে দৌড়ে সামনে এল এবং যখন তাকে দেখতে পেল প্রত্যেকেই হাসতে শুরু করল এবং রাস্তা থেকে রাস্তায় শিশুরা তার সঙ্গ পাওয়ার জন্য দৌড়াতে লাগল। স্বপ্নদর্শীর হৃদয় পরমানন্দে পূর্ণ হয়ে গেল, দৃষ্টি হয়ে উঠল উজ্জ্বল। কারণ তার কাছে সমাধিফলকে ছিল রাজার আশীর্বাদ এবং মিছিলের আয়োজন ছিল তারই সম্মানে। 

দেখা গেল জনাকীর্ণ কোলাহলের ভেতর দিয়ে তারই মতো একটা মানুষ যে মরুভূমি থেকে এসেছিল তার হৃদয় আনন্দে স্ফীত হয়ে উঠল এবং সে কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে বলল : 

‘হে বন্ধুরা, আমরা কোথায়? কোন্ সেই শহরের আকাঙ্ক্ষা এই হৃদয়ে? অমিতব্যয়ী নিমন্ত্রণকারীর প্রতিযোগিতা কাকে বলে?’- কে সেই অতিথি যে এই প্রাসাদের উৎসবের সুযোগ গ্রহণ করে, যার রাজকুমার তাকে সঙ্গ দেয়, যার রাজা একটা স্মৃতিফলক তার বুকের ওপর ঝুলিয়ে দেয় এবং উন্মোচন করে তার কাছে একটা শহরের আতিথেয়তা, যে শহরটা স্বর্গ থেকে অবতরণ করেছে। 

মরুভূমির লোকটা কোনো জবাব দিল না। সে শুধু হাসল এবং সামান্য মাথা ঝাঁকাল এবং মিছিলটা তাদেরকে অতিক্রম করে গেল। 

এবং স্বপ্নদর্শী তার মুখটা ওপরের দিকে তুলল এবং আলো তার দৃষ্টিশক্তির ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকল। 

.

প্ৰেম 

তারা শৃগাল ও ছুছুন্দরীকে* বলে,
অভিন্ন স্রোতোধারা থেকে পান করো
যেখানে সিংহ পান করতে আসে। 

এবং তারা বলে, ঈগল এবং শকুন
তাদের ঠোঁট দিয়ে একই মৃতদেহ খোঁড়ে
শান্তিতে এবং একে অন্যের সঙ্গে,
মৃত জিনিসের উপস্থিতিতে। 

হে প্রেম, কার ঐশ্বরিক হাত 
লাগাম টেনে ধরেছে আমার আকাঙ্ক্ষার, 
এবং জাগিয়ে তুলছে আমার ক্ষুধা ও তৃষ্ণা
মর্যাদা ও গর্বের প্রতি। 
তাকে আমার প্রতি কঠোর হতে দিও না এবং 
দিও না স্থির হতে। 
রুটি খাও এবং মদ্যপান করো, যা আমার
দুর্বল আত্মাকে প্রলুব্ধ করে। 

আমাকে বরং ক্ষুধাজনিত কারণে মৃত্যুমুখে
পতিত হতে দাও এবং আমার হৃদয়কে দাও
তৃষ্ণার সাথে সাথে শুকিয়ে যেতে, 
এবং আমাকে মরতে ও ক্ষয়প্রাপ্ত হতে দাও।
আমি আমার হাত প্রসারিত করি একটা কাপের দিকে
যা তুমি পূর্ণ করো নাই অথবা সেই পাত্রের দিকে
যাকে তুমি আশীর্বাদ করো নাই। 

[* ছুঁতো জাতীয় প্রাণী।]

.

তপস্বী রাজা 

তারা আমাকে বলেছিল পাহাড়ের মাঝখানে বনের ভেতরের নির্জনতায় বসবাস করে এক যুবক যে একসময় এক বিশাল রাজ্যের রাজা ছিল এবং এই রাজ্যটার অবস্থান ছিল দুই নদীর ওপরে এবং তারা আমাকে আরও বলেছিল যে, সে তার নিজের ইচ্ছায় সিংহাসন এবং তার মহিমান্বিত ভূমি পরিত্যাগ করেছিল এবং বসবাস করতে এসেছিল বন্যতার সঙ্গে। 

আমি বললাম : ‘আমি ঐ লোকটির সন্ধান করব এবং জানব তার হৃদয়ের গোপনীয়তা কারণ যে সিংহাসন পরিত্যাগ করে তার অবশ্যই প্রয়োজন সিংহাসনের চেয়ে বড় হওয়া।’ সেইদিন আমি বনে গিয়েছিলাম যেখানে সে বসবাস করে এবং আমি দেখতে পেলাম সে একটা সাদা সাইপ্রেস গাছের নিচে বসে আছে। তার হাতে একটি নলখাগড়া যেন এটা ছিল একটা রাজদণ্ড। আমি তাকে অভিবাদন জানালাম যেভাবে রাজাকে সবাই অভিবাদন জানায়। সে আমার দিকে ঘুরল এবং কোমল স্বরে বলল, ‘প্রশান্তির এই বনে তুমি কী করবে? সবুজ ছায়ায় অনুসন্ধান করো একটি হারানো আত্মা অথবা এটা হচ্ছে ঘরে ফেরা তোমাদের গোধূলিবেলায়?’ 

আমি উত্তরে বললাম, ‘আমি অনুসন্ধান করছিলাম কিন্তু তুমি—কেন তুমি বনের উদ্দেশ্যে সিংহাসন ত্যাগ করেছিলে?’ 

সে বলল, ‘আমার কাহিনী সংক্ষিপ্ত, কারণ বুদবুদের বিস্ফোরণ ছিল আকস্মিক। এটা এভাবে ঘটেছিল : একদিন যখন আমার প্রাসাদের জানালার ধারে বসেছিলাম, আমার প্রাসাদ সরকার ও অন্যভূমির এক বিশেষ বার্তাবাহক বাগানের ভেতরে হাঁটছিল। যখন তারা জানালার কাছাকাছি এল, প্রাসাদ সরকার তখন নিজের সম্পর্কে বলছিল এবং সে বলছে আমি শুনতে পেলাম : ‘আমি হলাম রাজার মতো এবং আমার তৃষ্ণা হচ্ছে কড়া মদের এবং ক্ষুধা হচ্ছে সুযোগের সবগুলি খেলা এবং আমার প্রভু, রাজার মতো আমারও মেজাজে ঝড় ওঠে।’ একথার পর প্রাসাদ সরকার এবং বিশেষ বার্তাবাহক গাছের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। কিন্তু কয়েক মিনিটের ভেতরেই তারা আবার ফিরে এল এবং এসময় প্রাসাদ সরকার আমার সম্পর্কে বলছিল এবং সে বলে : ‘আমার প্রভু, রাজা হল আমার মতো—একজন দক্ষ মার্কসম্যান* এবং আমার মতোই গান ভালোবাসেন এবং দিনে স্নান করেন তিনবার।’ 

এক মুহূর্ত পরই সে যোগ করে, ‘সেইদিন আমি প্রাসাদ পরিত্যাগ করলাম শুধু একটা পোশাকসহ, কারণ আমি আর তাদের শাসক হব না যারা আমার পাপগুলো অনুমান করে এবং আমার ওপর আরোপ করে তাদের সদগুণ।’ 

আমি বললাম, ‘বস্তুতপক্ষে এটা একটা বিস্ময় এবং বিস্ময়কর চলাচল।’ সে বলল, ‘না, বন্ধু আমার, তুমি টোকা দাও আমার নির্জনতার দরজায় এবং গ্রহণ করো সামান্য বিষয়। কারণ কে বনের উদ্দেশ্যে সিংহাসন ত্যাগ করবে না যেখানে ঋতুরা গান গায় এবং নৃত্য করে অন্তহীনভাবে? তাদের অনেকেই, যাদেরকে দেওয়া হয়েছে একাকিত্বের মিষ্টি সাহচর্য এবং নির্জনতার চেয়ে কম সাম্রাজ্য। ঈগলেরা হচ্ছে গণনাহীন, যারা উচ্চতার বাতাস থেকে অবতরণ করেছে ছুঁচোজাতীয় প্রাণীর সঙ্গে বসবাসের জন্য, তারা পৃথিবীর গোপনীয়তা জেনে থাকতে পারে। সেখানে আছে তারাই, যারা স্বপ্নের সাম্রাজ্য পরিত্যাগ করে, স্বপ্নহীনতা থেকে তাদেরকে খুব দূরবর্তী নাও মনে হতে পারে। আর যারা নগ্নতার সাম্রাজ্য পরিত্যাগ করে এবং তাদের আত্মা আবৃত করে যেন অন্যরা লজ্জিত না হয়, সত্যকে উন্মোচিত এবং সৌন্দর্যকে অবগুণ্ঠিত না করে এবং যদিও এই সবকিছুর চেয়ে বৃহত্তর হচ্ছে সে-ই, যে দুঃখের সাম্রাজ্য পরিত্যাগ করে যেন তাকে গর্বিত ও চরম আত্মবিশ্বাসী মনে না হয়।’ 

তারপর সে নলখাগড়ার ওপর হেলান দিয়ে বসল এবং বলল, ‘এখন আরও বড় শহরে যাও এবং তার দরজায় বসে থাকো এবং পর্যবেক্ষণ করো সেইসব যা এর ভেতরে প্রবেশ করে এবং যা বাইরে চলে যায় এবং দেখ, তুমি তাকে খুঁজে পাও, যদিও রাজ্য ছাড়া একজন রাজার জন্ম এবং যে তারপরও আত্মার শাসনে চলে মাংসের ভেতরে- যদিও এ-সম্পর্কে সে এবং তার বিষয়াবলি কিছুই জানে না।’ 

এসব বলার পর সে আমার দিকে তাকিয়ে হেসেছিল এবং তার ঠোঁটের ওপর ছিল অজস্র সকাল। তারপর সে ঘুরল এবং হাঁটতে শুরু করল হৃদয় থেকে বনভূমির দিকে। আমি শহরে ফিরলাম এবং এর প্রবেশপথে বসে থাকলাম পথচারীদের লক্ষ্য করতে যেভাবে সে আমাকে বলেছিল এবং সেইদিন থেকে এই সংখ্যাহীনতা হচ্ছে রাজা, যার ছায়া উপেক্ষা করেছে আমাকে এবং কিছু ছায়া উপেক্ষা করে তাকে, যাকে উপেক্ষা করেছে আমার ছায়া। 

[* গুলি ছোঁড়ায় দক্ষ ব্যক্তি।]

.

সিংহের কন্যা 

চারজন ক্রীতদাস বৃদ্ধা রানীকে বাতাস করছিল যিনি তার সিংহাসনের ওপর ঘুমন্ত অবস্থায় ছিলেন এবং তার নাক ডাকার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। রানীর কোলের ওপর শুয়ে একটা বিড়াল ঘড়ঘড় আওয়াজ করছিল এবং অলসভাবে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল ক্রীতদাসের দিকে। 

প্রথম ক্রীতদাস বলল, ‘এই বৃদ্ধা নারীকে ঘুমের ভিতরে কী কুৎসিত দেখায়। দ্যাখো তার মুখখানা বাঁকানো এবং তার নিশ্বাসের শব্দ শুনে মনে হয় কোনো দানব তার শ্বাসরোধ করেছিল।’ 

বিড়াল তখন ঘড়ঘড় করে বলল, ‘ঘুমের ভেতরে সে অর্ধেক কুৎসিতও নয় যতখানি কুৎসিত তোমাদের জাগ্ৰত দাসত্ব।’ 

এবং দ্বিতীয় ক্রীতদাস বলল, ‘তোমরা ভাবতে পার ঘুমের কারণে তার চামড়ার কুঞ্চিত ভাঁজ মসৃণ হবে তা আরও গভীর হওয়ার পরিবর্তে। সে অবশ্যই এখন কোনো খারাপ স্বপ্ন দেখছে।’ 

বিড়াল ঘড়ঘড় আওয়াজ করে বলল, ‘তোমরাও ঘুমিয়ে যেতে পারো এবং স্বপ্ন দেখতে পারো তোমাদের স্বাধীনতার।’ 

তৃতীয় ক্রীতদাস বলল, ‘সম্ভবত সে সেইসব লোকের মিছিল দেখছে যাদেরকে সে হত্যা করেছে।’ 

বিড়াল ঘড়ঘড় আওয়াজ করল এবং বলল, ‘হ্যাঁ, সে তোমাদের প্রপিতামহ ও তোমাদের বংশধরদের মিছিল দেখছে।’ 

চতুর্থ ক্রীতদাস বলল, ‘তার সম্পর্কে যা বলার বল, সবই ঠিক আছে। কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকা এবং বাতাস করার ক্ষেত্রে এসব কথা আমাকে মোটেও ক্লান্ত করেনি।’ 

বিড়াল ঘড়ঘড় করে বলে, ‘তোমরা সমস্ত অনন্তকালকে বাতাস করতে থাকবে, কারণ এটা যেমন একটা পৃথিবী তেমনি এটা একটা স্বর্গও।’ 

সেই মুহূর্তে বৃদ্ধা রানী ঘুমের ভেতরেই একটু নড়েচড়ে উঠলেন এবং তার রাজমুকুট মেঝেতে গড়িয়ে পড়ল। 

একজন ক্রীতদাস বলল, ‘একটা খারাপ মেয়েমানুষ।’ 

বিড়ালটি ঘড়ঘড় করে বলল, ‘একজনের কাছে যে খারাপ মেয়েমানুষ অন্যের কাছে সে ভালো মেয়েমানুষ।’

 দ্বিতীয় ক্রীতদাস বলল, ‘যদি সে জেগে যায় এবং দেখতে পায় তার রাজমুকুট মেঝেয় গড়াগড়ি খাচ্ছে তাহলে সে নিশ্চিতই আমাদেরকে খুন করবে।’ 

বিড়াল ঘড়ঘড় করে বলল, ‘প্রতিদিন জন্মমুহূর্তে সে তোমাদেরকে হত্যা করেছে এবং তোমরা তা জানো না।’ 

তৃতীয় ক্রীতদাস বলল, ‘হ্যাঁ, সে আমাদেরকে হত্যা করবে এবং সে এটাকে বলবে ঈশ্বরের উদ্দেশে উৎসর্গ।’ 

বিড়াল ঘড়ঘড় করে বলল, ‘শুধুমাত্র দুর্বলেরাই ঈশ্বরের উদ্দেশে উৎসর্গিত হয়।’ 

চতুর্থ ক্রীতদাস অন্যদেরকে চুপ করায় এবং নিঃশব্দে রাজমুকুটটা তুলে নেয় রানীকে না জানিয়ে এবং তার মাথায় তা পরিয়ে দেয়। 

বিড়াল বলল, ‘শুধুমাত্র একজন ক্রীতদাস রক্ষা করে একটা রাজমুকুট যা পতিত হয়েছে।’ কিছুক্ষণ পর বৃদ্ধা রানী জেগে উঠলেন, নিজেকে দেখলেন এবং হাই তুললেন। তারপর তিনি বললেন, ‘আমার মনে হয় আমি স্বপ্ন দেখছিলাম এবং দেখলাম, চারটে শুঁয়োপোকাকে ধাওয়া করছে একটা বৃশ্চিক একটা প্রাচীন ওকগাছের গুঁড়ির চারপাশে। আমি আমার স্বপ্নটা পছন্দ করি নাই।’ 

তারপর তিনি তার চোখ বন্ধ করলেন এবং আবার ঘুমাতে গেলেন এবং ঘুমের ভেতরে আবার তার নাক ডাকতে লাগল। আর চারজন ক্রীতদাস তাকে বাতাস করতে শুরু করল। 

বিড়ালটা ঘড়ঘড় করে বলল, ‘বাতাস করো, বাতাস করো নির্বোধেরা। তোমরা বাতাস করছ কিন্তু আগুন খেয়ে ফেলছে তোমাদেরকে।’ 

.

নিপীড়ন 

সমুদ্রের ধারে সাতটি গুহাকে পাহারা দেয় স্ত্রী-ড্রাগনটি এইভাবে গান গেয়ে : 

‘ঢেউয়ের ওপরে চড়ে আমার সঙ্গী আসবেই। তার বজ্রপাতের শব্দ ভয়ে পরিপূর্ণ করে তুলবে পৃথিবী এবং তার নাসারন্ধ্রের অগ্নিশিখা প্রজ্জ্বলিত করবে আকাশ। চন্দ্রগ্রহণের সময় আমাদের বিয়ে হবে এবং সূর্যগ্রহণের সময় আমি জন্ম দেব সিদ্ধপুরুষ জর্জকে, যে আমাকে হত্যা করবে।’ 

সমুদ্রের ধারে সাতটি গুহাকে পাহারা দেয় স্ত্রী-ড্রাগনটি এইভাবে গান গেয়ে। 

.

সিদ্ধপুরুষ 

আমার যৌবনে একবার আমি পাহাড়ের ওপরের এক কুঞ্জবনে এক সিদ্ধপুরুষকে পরিদর্শন করেছিলাম এবং আমরা যখন সদ্গুণের প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করছিলাম তখন এক দস্যু ক্লান্তভাবে খোঁড়াতে খোঁড়াতে এল পাহাড়ের ঢালু অংশের সংযোগস্থলে। কুঞ্জবনে পৌঁছে সে সিদ্ধপুরুষের সামনে হাঁটুগেড়ে বসল এবং বলল, ‘হে সিদ্ধপুরুষ আমি একটু শান্তি পেতে চাই। আমার পাপের ভার খুবই বেশি।’ 

সিদ্ধপুরুষ উত্তরে বললেন, ‘আমার পাপও আমার কাছে অত্যন্ত ভারী।’ 

দস্যু বলল, ‘কিন্তু আমি একজন চোর ও লুটেরা।’ 

সিদ্ধপুরুষ উত্তরে বললেন, ‘আমিও একজন চোর এবং একজন লুটেরা। 

দস্যু বলল, ‘কিন্তু আমি একজন খুনি এবং আমার কর্ণকুহরে বহু মানুষের রক্তের কান্না আমি শুনতে পাই।’ 

সিদ্ধপুরুষ উত্তর দেন, ‘আমিও একজন খুনি এবং আমার কর্ণকুহরে বহু মানুষের রক্তের কান্না আমি শুনতে পাই।’

দস্যু বলল, ‘আমি গণনাহীন অপরাধ করেছি।’ 

সিদ্ধপুরুষ উত্তর দেন, ‘আমিও সংখ্যাহীন অপরাধ করেছি।’ 

তারপর দস্যু উঠে দাঁড়াল এবং সিদ্ধপুরুষের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকাল এবং তার চোখে ছিল বিস্ময়কর এক দৃষ্টি এবং সে আমাদেরকে পরিত্যাগ করে লাফাতে লাফাতে পাহাড়ের নিচে নেমে গেল। 

আমি সিদ্ধপুরুষের দিকে ঘুরলাম এবং বললাম, ‘কী কারণে আপনি নিজেকে সেইসব অপরাধে অভিযুক্ত করলেন যা আপনার দ্বারা সংঘটিত হয়নি? আপনি কি লক্ষ্য করেছেন ঐ লোকটি আপনার কোনো কথাই বিশ্বাস করেনি?’ 

সিদ্ধপুরুষ উত্তরে বললেন, ‘এটা সত্য সে আমাকে বিশ্বাস করেনি। কিন্তু সে অনেক আনন্দের সাথে ফিরে গেছে।’ 

সেই মুহূর্তে আমরা শুনতে পেলাম সেই দস্যুর গান, দূরবর্তী অঞ্চল থেকে ভেসে আসছে এবং সেই গানের প্রতিধ্বনি উপত্যকাকে আনন্দে পরিপূর্ণ করে তুলেছে। 

.

ধনবান 

আমার বিস্ময়ের ভেতরে একবার আমি দেখতে পেলাম একটা দ্বীপের ওপর মানুষের মাথাওয়ালা এবং লোহার খুর লাগানো এক কিম্ভূতকিমাকার প্রাণী যে অবিশ্রান্তভাবে খাচ্ছিল পৃথিবী এবং পান করছিল সমুদ্রকে। বহুসময় ধরে আমি তা লক্ষ্য করলাম। তারপর কাছাকাছি গিয়ে বললাম, ‘তোমার খাবার কখনই যথেষ্ট হবে না, কখনও পরিতৃপ্ত হবে না তোমার ক্ষুধা এবং তোমার তৃষ্ণা কোনোদিন মিটবে না।’ 

সে উত্তরে বলল, ‘হ্যাঁ, আমি পরিতৃপ্ত নই, পানাহারের ব্যাপারে আমি ক্লান্ত, কিন্তু আমি ভীত যে, আগামীকাল কোনো পৃথিবীই থাকবে না খাবার জন্য এবং পান করার মতো কোনো সমুদ্রও থাকবে না।’ 

.

বৃহত্তর সত্তা 

এটা এইভাবে ঘটেছিল। বিবলজের রাজা নুফসিবাল-এর রাজ্যভিষেকের পর সে শয্যা গ্রহণ করল তার বিশেষ কক্ষে, যে কক্ষ তার জন্য নির্মাণ করেছিল পাহাড়ের তিনজন তপস্বী-বাজিকর। সে তার রাজমুকুট এবং রাজকীয় পোশাক খুলে ফেলল এবং কক্ষের মাঝখানে দাঁড়িয়ে মনে মনে চিন্তা করল, সে এখন বিবলজ-এর সর্বক্ষমতাসম্পন্ন রাজা। হঠাৎ সে ঘুরল এবং দেখতে পেল রুপার আয়নাটা তার দিকে দ্রুতগতিতে হেঁটে আসছে, যা তার মা তাকে দান করেছিল এবং এই আয়না থেকে একটা নগ্ন মানুষ বেরিয়ে এল। রাজা হঠাৎ ভয় পেয়ে চমকে উঠল এবং লোকটাকে দেখে কেঁদে ফেলল : ‘তুমি এখানে কী করছ?’ 

নগ্ন লোকটি উত্তরে বলল, ‘না, কিছুই না, কিন্তু রাজ্যের লোকেরা কেন আপনাকে রাজমুকুট পরাল? 

রাজা উত্তরে বললেন, ‘কারণ. আমি হলাম এই ভূমির সবচেয়ে সৎব্যক্তি’, 

নগ্ন লোকটি বলল, ‘যদি আপনি এখনও পর্যন্ত অধিক সৎ হয়ে থাকেন তাহলে আপনি রাজা হতে পারবেন না।’ 

তারপর রাজা মেঝেতে পড়ে তীব্রভাবে কাঁদতে লাগলেন। 

নগ্ন লোকটি এবার রাজার দিকে তাকাল। তারপর সে রাজমুকুটটা তুলে নিয়ে রাজার বাঁকা হয়ে থাকা মাথায় অত্যন্ত স্নেহের সঙ্গে পুনঃস্থাপন করল। 

এবং নগ্ন লোকটি ভালোবাসার সঙ্গে রাজার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতে আয়নার ভেতরে প্রবেশ করল। 

রাজা উদ্দীপিত হলেন এবং সরাসরি আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকেই শুধু রাজমুকুট পরা অবস্থায় দেখতে পেলেন। 

.

যুদ্ধ এবং ক্ষুদ্র জাতি 

একবার পশুচারণ ভূমি থেকে আরও উপরের উচ্চতায় এক মেষ এবং একটা মেষশাবক চড়ে বেড়াচ্ছিল। একটা ঈগল বৃত্তাকারে ঘুরছিল এবং ক্ষুধার্তভাবে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়েছিল মেষশাবকের ওপর। যখন সে তার শিকারকে জব্দ করার জন্য নেমে আসে, তখন অন্য এক ঈগল আবির্ভূতত হয় এবং মেষ ও তার শাবকের ওপর বাতাসে স্থির হয়ে ভাসতে থাকে। উদ্দেশ্য একই এবং তা হল ক্ষুধা। তখন দুই প্রতিপক্ষ যুদ্ধ শুরু করে এবং তাদের তীব্র আর্তনাদে আকাশ পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। মেষ আকাশের দিকে তাকিয়ে খুবই বিস্মিত হয় এবং তার শাবকের কাছে এসে বলে, 

‘হে বৎস, কী অদ্ভুত! এই দুটি মহৎ পাখির কি উচিত পরস্পরকে আক্রমণ করা? এই বিশাল আকাশ কি তাদের দুজনের জন্য যথেষ্ট বড় নয়? প্রিয় বৎস, প্রার্থনা করো, প্রার্থনা করো হৃদয় থেকে যেন ঈশ্বর তোমার পাখাযুক্ত ভ্রাতৃদ্বয়ের মাঝে শান্তি আনয়ন করেন।’ মেষশাবক হৃদয় থেকে প্রার্থনা করল। 

.

সমালোচক 

একদিন সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে এক লোক ঘোড়ায় চড়ে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে সমুদ্রের দিকে যাচ্ছে। যেতে যেতে সে রাস্তার পাশের একটা পান্থশালায় পৌঁছাল। 

সে ঘোড়া থেকে নামল এবং মানুষ ও রাত্রির প্রতি সে ছিল খুবই আস্থাশীল অন্যান্য ঘোড়সওয়ারের মতোই, যারা সমুদ্রের দিকে ভ্রমণে যায়। সে দরজার পাশের একটা গাছের সঙ্গে ঘোড়াটাকে বেঁধে রেখে পান্থশালায় প্রবেশ করল। 

মধ্যরাতে যখন সবাই ঘুমন্ত তখন এক চোর এই পর্যটকের ঘোড়া চুরি করে। 

সকালে লোকটা ঘুম থেকে জেগে আবিষ্কার করে যে, তার ঘোড়া চুরি হয়ে গেছে এবং সে ঘোড়ার জন্য খুবই বেদনা অনুভব করল। অবশ্য একজন মানুষ হৃদয় থেকে ঘোড়াটাকে চুরি করতে দেখেছিল। 

তারপর আস্তে আস্তে লোক জড়ো হল এবং সবাই তাকে ঘিরে দাঁড়াল এবং কথা বলতে শুরু করল। 

প্রথম লোকটি বলল, ‘কিরকম বোকা তুমি আস্তাবলের বাইরে ঘোড়া বেঁধে রেখেছ।’ দ্বিতীয় লোকটি বলল, ‘এখনও সে অধিক বোকা।’ 

এবং তৃতীয় লোকটি বলল, ‘সমুদ্র-অভিমুখে ঘোড়ায় চড়ে ভ্রমণে যাওয়া সবচেয়ে নির্বোধের কাজ।’ 

চতুর্থ লোকটি বলল, ‘শুধুমাত্র অলস এবং ধীরগতিসম্পন্ন পা-ই ঘোড়া ব্যবহার করে।’ 

পর্যটক তখন খুবই বিস্মিত হল। শেষপর্যন্ত সে কেঁদে ফেলল, ‘বন্ধুরা আমার, যেহেতু আমার ঘোড়া চুরি হয়ে গেছে এবং তোমরা প্রত্যেকেই দ্রুতগতিসম্পন্ন এবং সবাই আমাকে বলছ আমার ত্রুটি ও ব্যর্থতা সম্পর্কে, কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হল তোমরা সেই লোকটি সম্পর্কে একটা তিক্তকথাও উচ্চারণ করছ না যে আমার ঘোড়াটা চুরি করেছে। 

.

কবি 

চারজন কবি একটা মদের পাত্রকে ঘিরে বসেছিল এবং পাত্রটি দাঁড়িয়ে ছিল একটা টেবিলের ওপর। 

প্রথম কবি বলল, ‘আমি আমার তৃতীয় চোখ দিয়ে দেখতে পাচ্ছি এই মদের সৌরভ বাতাসে স্থির হয়ে ভেসে আছে মন্ত্রমুগ্ধ কুঞ্জবনের ভেতরে পাখির মেঘের মতো।’ দ্বিতীয় কবি তার মাথা তুলল এবং বলল, ‘আমি আমার ভেতরের শ্রবণইন্দ্রিয়ের সাহায্যে শুনতে পাই ঐসব ধোঁয়াশার পাখিরা গান গাইছে এবং সেই সব সুর ধরে রেখেছে আমার কান, যেভাবে সাদা গোলাপ তার পাপড়ির ভেতরে মৌমাছিদের বন্দি করে।’ 

তৃতীয় কবি চোখ বন্ধ করল এবং হাতদুটো ওপরে বিস্তৃত করে বলল, ‘আমি তাদেরকে হাত দিয়ে স্পর্শ করি। আমি অনুভব করি তাদের পাখা, পছন্দ করি তাদের ঘুমন্ত শ্বাস- প্রশ্বাস যা আমার আঙুলকে পরিষ্কার করে দিচ্ছে।’ 

তারপর চতুর্থ কবি মদের পাত্রটা ওপরে তুলল এবং বলল, ‘দুঃখিত বন্ধুরা! আমার দেখা, শোনা ও স্পর্শ করার ক্ষমতা খুবই ভোঁতা। আমি মদের সুরভি দেখতে পাইনা, শুনতে পাই না এর গান, অনুভব করতে পারিনা এর পাখার আঘাত। এখন আমাকে অবশ্যই পান করতে হবে, যা আমার চেতনাকে ধারালো করে তুলতে পারে এবং আমাকে তুলে নিতে পারে তোমাদের আশীর্বাদপুর্ণ উচ্চতার দিকে।’ সে পাত্রটা মুখের কাছে তুলে ধরল এবং শেষবিন্দু পর্যন্ত তা পান করল। 

তিন কবির মুখ হা হয়ে গেল। তারা চতুর্থ কবির দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকল। তারা সবাই তৃষ্ণার্ত ছিল, যদিও তাদের চোখে ছিল সেই ঘৃণা, যা গীতিধর্মী নয়। 

.

বাতাসের দিকনির্দেশক যন্ত্র 

বাতাসের দিকনির্দেশক যন্ত্র বাতাসকে বলল, ‘তুমি কী পরিমাণ ক্লান্তিকর এবং একঘেয়ে। তুমি কি অন্য কোনোভাবে আমার মুখে প্রবাহিত হতে পারো না? তুমি আমার ঈশ্বরপ্রদত্ত দৃঢ়তাকে বিরক্ত কোরো না।’ 

কিন্তু বাতাস কোনো উত্তর দিল না। সে কেবল শূন্যতায় হেসে উঠল। 

.

আরাদুসের রাজা 

একবার আরাদুস শহরের বয়স্ক মানুষেরা রাজার সামনে নিজেকে উপস্থাপন করল এবং অনুসন্ধান করল সেই আদেশ, যা শহরের ভেতরের মানুষের জন্য মদ এবং উন্মত্ততা তৈরি হয় এরকম যাবতীয় দ্রব্য নিষিদ্ধ করেছে। 

রাজা তারপর তাদের দিকে পেছন ফিরলেন এবং হাসতে হাসতে সেখান থেকে চলে গেলেন। 

হতাশামিশ্রিত অনুভূতি নিয়ে বয়স্করা প্রস্থান করে। রাজপ্রাসাদের দরজায় তারা রাজার প্রাসাদ সরকারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এবং প্রাসাদ সরকার লক্ষ্য করে যে তারা মারাত্মক সমস্যায় আছে এবং সে তাদের বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করে। 

তারপর সে বলল, ‘করুণা হয় তোমাদের জন্য বন্ধুরা। তোমরা কি রাজাকে মাতাল অবস্থায় দেখেছিলে? তাহলে তিনি অবশ্যই তোমাদের আবেদন মঞ্জুর করবেন।’ 

.

আমার হৃদয়ের গভীরতার বাইরে 

আমার হৃদয়ের গভীরতা থেকে বেরিয়ে গিয়ে একটা পাখি বেড়ে উঠল এবং আকাশের দিকে উড়ে গেল। 

পাখিটা উঁচু থেকে আরও উচ্চতায় উঠে গেল এবং তা বাড়তে বাড়তে বিশাল আকারে পরিণত হল। 

প্রথমে ছিল এটা একটা ছোট্ট সোয়ালো পাখির মতো, তারপর তা পরিণত হল একটা ভরতপাখিতে, তারপর ঈগলে, তারপর তা পরিণত হল একটা বসন্তমেঘে এবং তারপর পূর্ণ করে তুলল একটা নক্ষত্রখচিত স্বর্গ। 

আমার হৃদয়ের গভীরতা থেকে বেরিয়ে গিয়ে একটা পাখি আকাশের দিকে উড়ে গেল এবং উড়তে উড়তে তা আরও বড় হয়ে গেল, যদিও সে আমার হৃদয় পরিত্যাগ করল না। হে আমার বিশ্বাস, আমার আনুগত্যহীন প্রতিজ্ঞা, কীভাবে আমি তোমার উচ্চতায় উড়ে যাব এবং তোমার সঙ্গে একত্রে দেখব বৃহত্তর আত্মা, যা আকাশের ওপরে পেন্সিল দিয়ে আঁকা হয়েছে? 

কীভাবে আমি আমার ভেতরে এই সমুদ্রকে ঘোরাব ধোঁয়াশার দিকে এবং তোমার সঙ্গে চলাচল করব পরিমাপহীন শূন্যতার ভেতরে। কীভাবে একজন বন্দি মন্দিরের ভেতরে বসে এর সোনালি গম্বুজ দেখতে পাবে? 

কীভাবে একটা ফলের হৃদয় বিস্তৃত হবে ফলটিকে ঢেকে ফেলতে? হে আমার বিশ্বাস, এইসব রুপা ও আবলুস কাঠের খণ্ডের পেছনে আমি শৃঙ্খলিত অবস্থায় আছি। 

যদিও আমার হৃদয়ের বাইরে তুমি বেড়ে উঠেছ আকাশের দিকে এবং এটা হল আমার হৃদয় যা তোমাকে ধরে রেখেছে এবং আমি পরিতৃপ্ত হব। 

.

রাজবংশ 

ইছহানার রানীর প্রসববেদনা উঠেছিল এবং পাখাযুক্ত ষাঁড়ের বিশাল কক্ষে রাজা ও তার বিচারালয়ের পারাক্রমশালী লোকেরা এমন দুশ্চিন্তায় ছিলেন যে কারও নিশ্বাস পর্যন্ত পড়ছিল না। 

সন্ধ্যাবেলায় সেখানে এক বার্তাবাহক এল অত্যন্ত দ্রুতগতিতে এবং রাজার সম্মুখে গভীর শ্রদ্ধা প্রকাশ করে বলল, ‘আমি একটা চমৎকার সংবাদ নিয়ে এসেছি আমার অধিপতি রাজা, তার সাম্রাজ্য এবং তার ক্রীতদাসদের জন্য এবং তা হল, বেথ্রোউন –এর রাজা, আপনার আমৃত্যু শত্রু নিষ্ঠুর মিহরাব এখন মৃত।’ 

রাজা এবং তার পরাক্রমশালী লোকেরা এই সংবাদ শুনে আনন্দে চিৎকার করে উঠল, কারণ শক্তিশালী মিরহাব বহুদিন বেঁচেছিল, পরাভূত করেছিল ইছহানাকে এবং এর অধিবাসীদেরকে বন্দি করেছিল। 

সেই মুহূর্তে পাখাযুক্ত ষাঁড়ের কক্ষে প্রবেশ করল বিচারালয়ের চিকিৎসক এবং তার পেছনে পেছনে এল রাজকীয় সেবিকা। চিকিৎসক রাজাকে কুর্নিশ করল এবং বলল, ‘রাজা, হে আমার প্রভু, আপনি চিরকাল বেঁচে থাকবেন এবং গণনাহীন প্রজন্মের ভেতরে দিয়ে ইছহানার লোকজনকে আপনি শাসন করবেন। কারণ, হে রাজা, যদি এই বিশেষ মুহূর্তে একটি পুত্রের জন্ম হয় তাহলে সে-ই হবে আপনার উত্তরাধিকারী।’ 

বস্তুতপক্ষে রাজার হৃদয় ছিল আনন্দে উন্মত্ত, একই মুহূর্তে তার শত্রু মারা গেছে এবং রাজকীয় আধিপত্য এখন প্ৰতিষ্ঠিত 

সেকালে ইছহানা শহরে এক সত্য নবী বসবাস করতেন। তিনি ছিলেন যুবক এবং উদ্দীপনার ক্ষেত্রে সাহসী। সেই রাতেই রাজা আদেশ দিলেন নবীকে তার সামনে নিয়ে আসতে। 

নবীকে সামনে আনার পর রাজা তাকে বললেন, ‘এখন ভবিষ্যৎ বাণী করুন এবং আমার সন্তানের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বলুন। এই সাম্রাজ্যে আজ কার জন্ম হয়েছে?’ 

নবী দ্বিধাহীনভাবে বললেন, ‘শ্রবণ করুন হে রাজা, আমি আপনার ছেলের ভবিষ্যৎবাণী করব, যার আজ জন্ম হয়েছে। আপনার শত্রুর আত্মা, এমনকি রাজা মিহরাব-এর আত্মা, যে গতকাল মারা গেছে কিন্তু তা স্থায়ী হয়ে আছে বাতাসের ওপর, এখন সে শরীর অনুসন্ধান করবে তাতে প্রবেশ করতে এবং যে শরীরে প্রবেশ করে বিশেষ মুহূর্তে সে জন্ম নিয়েছে সেই শরীর হচ্ছে আপনার পুত্রের।’ 

রাজা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন এবং তরবারি দিয়ে নবীকে হত্যা করলেন এবং সেইদিন থেকে আজ পর্যন্ত ইছহানার বিচক্ষণ ব্যক্তিরা গোপনে একজন অন্যজনকে বলেন, ‘এটা অজানা নয় এবং এটা কখনও বলাও হয় না যে ইছহানা শত্রুর দ্বারা শাসিত একটি রাজ্য।’ 

.

জ্ঞান এবং অর্ধ-জ্ঞান 

একটা কাঠের গুঁড়ির ওপর চারটে ব্যাঙ বসেছিল এবং গুঁড়িটা নদীর কিনারা দিয়ে ধীর গতিতে ভেসে যাচ্ছিল। হঠাৎ স্রোতের কবলে পড়ে কাঠের গুঁড়িটি ভাটির দিকে ভেসে গেল। ব্যাঙেরা উৎফুল্ল হয়ে ওঠে, কারণ তারা আগে কখনও এরকম পাল তুলে চলাচল করেনি। 

অবশেষে প্রথম ব্যাঙ বলল, ‘বস্তুতপক্ষে এটা একটা সবচেয়ে চমৎকার গাছের গুঁড়ি। এর চলাচল দেখে মনে হয় এটা জীবন্ত। এর আগে কখনও এরকম কাঠের গুঁড়ি সম্পর্কে জানতাম না।’ 

এবার দ্বিতীয় ব্যাঙ বলল, ‘না, বন্ধু আমার, কাঠের গুঁড়ি, অন্যান্য কাঠের গুঁড়ির মতোই এবং তা চলাচল করে না। এটা হচ্ছে নদী, যা সমুদ্রের দিকে চলেছে এবং কাঠের গুঁড়ির সঙ্গে আমাদেরকেও বহন করছে। 

তৃতীয় ব্যাঙ এবার বলল, ‘যা চলাচল করে তা নদীও নয়, কাঠের গুঁড়িও নয়। চলাচল করছে আমাদের চিন্তা, কারণ চিন্তা ছাড়া কোনোকিছুই চলাচল করে না।’ 

এবং তিন ব্যাঙ উচ্চস্বরে ঝগড়া শুরু করল প্রকৃতপক্ষে কী চলাচল করে তাই নিয়ে। তাদের ঝগড়া উত্তপ্ত হয়ে উঠল এবং ক্রমশ তা চিৎকার ও চেঁচামেচিতে পরিণত হল কিন্তু তারা একমত হতে পারল না। 

তারপর তারা চতুর্থ ব্যাঙের দিকে ঘুরল, যে এতক্ষণ পর্যন্ত মনোযোগ দিয়ে তাদের কথা শুনছিল, কিন্তু সে শান্তি ভঙ্গ করেনি এবং তারা তারই মতামত জানতে চাইল। 

চতুর্থ ব্যাঙ বলল, ‘তোমরা প্রত্যেকেই সঠিক এবং তোমাদের কারও কোনো ভুল নেই। এখানে গতিশীল হচ্ছে কাঠের গুঁড়ি এবং পানি এবং আমাদের চিন্তাও।’ 

তিন ব্যাঙ খুবই ক্রুব্ধ হল, কারণ তাদের কেউই স্বীকার করতে রাজি ছিল না যে, কেউই পুরোপুরি সত্য নয় এবং অন্য দুজন পুরোপুরি ভ্রান্তও নয়। 

তারপর সেই অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। তিন ব্যাঙ একত্রিত হয়ে চতুর্থ ব্যাঙকে কাঠের গুঁড়ি থেকে নদীতে ফেলে দিল। 

.

একখণ্ড বরফ-সাদা কাগজ বলল 

একখণ্ড বরফ-সাদা কাগজ বলল, ‘আমি বিশুদ্ধতা সৃষ্টি করেছিলাম এবং আমি চিরকাল বিশুদ্ধ থাকব। বরং আমি পুড়ে যাব এবং অন্ধকার আমাকে স্পর্শ করার অথবা অপবিত্রতা আমার কাছাকাছি আসার চেয়ে পরিণত হব সাদা ছাইয়ে।’ 

কালির দোয়াত শুনতে পায় কাগজ কী বলছিল এবং সে তার অন্ধকার হৃদয়ের ভেতরে হেসে উঠল, কিন্তু সাহস হল না কখনও তার কাছে যাবার এবং বহুবর্ণের পেন্সিলগুলি তার কথা শুনল এবং তারাও কখনও তার কাছে এল না। 

বরফ-সাদা কাগজের খণ্ডটি থাকল শুদ্ধ এবং সদ্গুণসম্পন্ন চিরকালের জন্য- শুদ্ধ ও সদ্গুণসম্পন্ন এবং শূন্য। 

.

পণ্ডিত এবং কবি 

সাপ ভরতপাখিকে বলল, ‘তুমি তো বেশ উড়তে পারো, যদিও তুমি পৃথিবীর সেই গুপ্তস্থান পরিদর্শন করতে পারো না যেখানে যথাযথ নীরবতার ভেতরে জীবনের প্রাণরস চলাচল করে।’ 

উত্তরে ভরতপাখি বলল, ‘হ্যাঁ, তুমি এ ব্যাপারে অনেক বেশিই জানো। তোমার সৌন্দর্য প্রকাশের ক্ষমতা যাবতীয় জ্ঞানী বস্তুর চেয়ে অধিকতর জ্ঞানী নয়- করুণা হয় তোমার জন্য যে তুমি উড়তে পারো না।’ 

যেন শুনতে পায়নি এরকমভাবে সাপটি বলল, ‘তুমি যেমন গভীর গোপনীয়তাকে দেখতে পারো না, পারো না সম্রাজ্যের লুকানো গুপ্তধনের ভেতর দিয়ে চলাচল করতে। এটা সত্যি, কিন্তু গতকাল আমি একটা রুবি (রত্নবিশেষ)-র গুহায় শুয়েছিলাম এবং তার মূর্ছা যাওয়ার মতো আলোকরশ্মি পরিণত হল একটা অগ্নিশিখার গোলাপে। এ-ধরনের বিস্ময় একমাত্র আমি ছাড়া আর কে পর্যবেক্ষণ করতে পারে? 

ভরতপাখি বলল, ‘না কেউ পারে না, কিন্তু একমাত্র তুমিই পারো শুয়ে পড়তে ঘটনাচক্রের স্বচ্ছ স্মৃতির ভেতরে : করুণা হয় তোমার জন্য যে তুমি গান গাইতে পারো না।’ 

সাপ বলল, ‘আমি জানি একটা চারাগাছ যার শিকড় অবতরণ করে পৃথিবীর পাত্রগুলিতে এবং এটা হচ্ছে সে-ই যে এই শিকড় খেয়ে এ্যাসতারতে*-এর চেয়ে অধিকতর সুন্দর হয়ে ওঠে।’ 

ভরতপাখি বলল, ‘কেউ না, কেউ না, কেবল তুমিই পারো পৃথিবীর এই মন্ত্রমুগ্ধ চিন্তার অবগুণ্ঠন উন্মোচন করতে- করুণা হয় তোমার জন্য তুমি উড়তে পারো না বলে।’ সাপ বলল, ‘ওখানে একটা রক্তবর্ণ স্রোতপ্রবাহ আছে যা প্রবাহিত হচ্ছে একটা পাহাড়ের তলদেশ দিয়ে এবং যে এই পানি পান করবে সে-ই অমর হবে। ঈশ্বরের মতো আমি নিশ্চিত যে, কোনো পাখি অথবা পশু এই রক্তবর্ণ স্রোতপ্রবাহকে আবিষ্কার করতে পারবে না।’ 

ভরতপাখি উত্তরে বলল, ‘তুমি ইচ্ছা করলেই ঈশ্বরের মতো মৃত্যুহীন হতে পার না- করুণা হয় তোমার জন্য তুমি গান গাইতে পারো না।’ 

সাপ বলল, ‘আমি একটা সমাধিমন্দির চিনি, যা আমি একবার জোছনালোকে পরিদর্শন করেছিলাম : এটা নির্মিত হয়েছিল ভুলে যাওয়া দানব প্রজাতির দ্বারা এবং এর দেয়ালের ওপরে খোদাই করা রয়েছে সময় এবং শূন্যতার গোপনীয়তা এবং যে ওগুলি পড়ে বুঝবে, সে-ই জানবে কী অতিক্রম করে গেছে সমস্ত উপলব্ধিকে।’ 

ভরতপাখি বলল, ‘যথার্থই তোমার আকাঙ্ক্ষা যদি প্রবল হয় তাহলেও তুমি বৃত্তাবদ্ধ হতে পারো না, সময় ও মহাশূন্য সম্পর্কিত জ্ঞানের সমতল শরীরের সঙ্গে—করুণা হয় তুমি উড়তে পারো না বলে।’ 

তখন সাপ খুবই বিরক্ত হল এবং সে ঘুরে বিড়বিড় করতে করতে গর্তে প্রবেশ করল, ‘নির্বোধ গায়ক।’ 

এবং ভরতপাখি গান গাইতে গাইতে উড়ে গেল, ‘করুণা হয় তুমি গান গাইতে পারো না। করুণা হয়, করুণা হয়, হে বিচক্ষণ, তুমি উড়তে পারো না।’ 

[* প্রাচীন ফিনিসীয়দের প্রেম ও সৌন্দর্যের ঈশ্বরী। টাইরি, সিডোন, বিবলজ ও বালবেকে তার পূজা করা হত।]

.

মূল্য 

একবার এক লোক তার শস্যক্ষেতে মর্মরপাথরের সুন্দর এক বিশাল মূর্তি আবিষ্কার করে এবং তা সে এক সংগ্রাহকের কাছে নিয়ে যায়, যে যাবতীয় সুন্দর জিনিস ভালোবাসে এবং তাকেই লোকটা প্রস্তাব দেয় মূর্তিটা বিক্রি করার। সেই সংগ্রাহক তাকে উচ্চমূল্য প্রদান করে এবং তারপর তারা আলাদা হয়ে যায়। 

লোকটা টাকা নিয়ে বাড়ির দিকে যেতে যেতে ভাবে এবং নিজেকে বলে, ‘এই টাকা পয়সার জীবন ক’দিনের। কীভাবে একজন মানুষ অর্থ প্রদান করে খোদাইকৃত মৃত পাথরের বিনিময়ে যা সমাহিত হয়েছিল অথবা যা হাজার বছর পৃথিবীতে স্বপ্নহীন কাটায়?’ একই সময়ে সংগ্রাহক মূর্তিটার দিকে তাকিয়েছিলেন এবং ভাবছিলেন। একসময় নিজেকে বললেন, ‘সৌন্দর্য কী! জীবন কী! আত্মা কী! তার স্বপ্ন এবং হাজার বছরের তরতাজা মিষ্টি ঘুম। টাকার বিনিময়ে কিভাবে একজন এই সবকিছুই প্রদান করতে পারে, যা মৃত এবং স্বপ্নহীন।’ 

.

অন্য সমুদ্র 

একটা মাছ আরেকটা মাছকে বলল, ‘আমাদের এই সমুদ্রের ওপরে আরও একটা সমুদ্র আছে। বিভিন্ন প্রাণী সেখানে সাঁতার কাটছে এবং সেখানে তারা বেঁচে থাকে যেমন আমরা এখানে বেঁচে আছি।’ 

মাছটি উত্তরে বলল, ‘বিশুদ্ধ কল্পনা! বিশুদ্ধ কল্পনা! তুমি যখন জানো, যাকিছু আমাদের সমুদ্রকে পরিত্যাগ করে এবং সমুদ্রের বাইরে অবস্থান করে তারা মারা যায়, অন্য সমুদ্রের অন্য জীবন সম্পর্কে তুমি কী প্রমাণ করবে?’ 

.

অনুশোচনা 

জোছনাপ্লাবিত এক রাতে এক লোক তার প্রতিবেশীর বাগানে প্রবেশ করল এবং তার খুঁজে পাওয়া সবচেয়ে বড় তরমুজটি চুরি করে বাড়ি নিয়ে গেল। 

সে তরমুজটি কেটে দেখল এটা এখনও কাঁচা 

সে বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকল। 

তারপর লোকটার বিবেক জেগে উঠল এবং সে অনুশোচনায় দগ্ধ হল তরমুজটি চুরি করার জন্য। 

.

মুমূর্ষু মানুষ এবং শকুন 

অপেক্ষা করো, অপেক্ষা করো কিছুক্ষণ, আমার উৎসুক বন্ধু। 
আমি প্রাকৃতিক রীতিতে উৎপন্ন হব কিন্তু তার চেয়েও দ্রুত 
এইসব বর্জ্যপদার্থ, যার মর্মবেদনা অতিমাত্রায় 
উত্তেজিত এবং অর্থহীন এবং তোমার ধৈর্যকে নিঃশেষ করে ফেলে। 
আমি হব না তোমার অকৃত্রিম ক্ষুধা, 
অপেক্ষা করো এই মুহূর্তের ওপর: 
কিন্তু এই শৃঙ্খল যদিও শ্বাসপ্রশ্বাস দিয়ে তৈরি, 
এটা ভেঙে ফেলা খুব কঠিন।
এবং মারা যাবার ইচ্ছা সমস্ত শক্তিশালী জিনিসের চেয়ে অধিক শক্তিশালী, 
টিকে থাকে বেঁচে থাকার একটা আকাঙ্ক্ষার মাধ্যমে, 
দুর্বল সমস্ত জিনিসের চেয়ে অধিকতর দুর্বল।
আমাকে ক্ষমা করো কমরেড; 
এটা হচ্ছে স্মৃতি যা আমার সাহসিকতাকে ধরে রাখে,
যেমন দূরবর্তী দিনগুলির একটি মিছিল; 
স্বপ্নের ভেতরে ব্যয় হয়ে যাওয়া যৌবনের একটি কল্পনাশক্তি,
একটি মুখমণ্ডল যা আমার চোখের পাতাকে না ঘুমানোর
আমন্ত্রণ জানায়, 
একটি কণ্ঠস্বর যা আমার কর্ণকুহরে প্রবেশ করতে বিলম্বিত হয়,
একটি হাত যা আমার হাত স্পর্শ করে। 
আমাকে ক্ষমা করো কারণ তুমি দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেছ।
এখন এটা শেষ এবং সবকিছুই এখন বিবর্ণ : 
মুখমণ্ডল, কণ্ঠস্বর, হাত এবং ধোঁয়াশা তাকে বহন করে 
এখানে এনেছে। 
সুতোটা বাঁধা হয়নি। 
স্বরতন্ত্রী ফেটে গেছে। 
এবং সে-কারণে না খাবার, না পানীয় কিছুই তুলে নেওয়া হয়নি। 
হে আমার ক্ষুধার্ত কমরেড, প্রস্তাব করো, 
খাবার প্রস্তুত এবং খাবার, মিতব্যয়িতা এবং করুণা 
প্রদান করা হয়েছে ভালোবাসার সঙ্গে। 
এসো এবং তোমার ঠোঁট দিয়ে এখানে খোঁড়ো, এই বামদিকে, 
এবং এই ক্ষুদ্রতর পাখির খাঁচা থেকে অশ্রু ঝরে পড়ে, যার পাখা 
কোনো আঘাত করতে পারে না : 
আমি দেখব এটা তোমার সঙ্গে আকাশে পাখা না নাড়িয়ে 
ভেসে থাকবে। 
এখন এসো, হে বন্ধু আমার, আজ রাতে আমি তোমার নিমন্ত্রণকারী
এবং তুমি আমার সাদরে গৃহীত অতিথি। 

.

আমার নির্জনতার ওপরে 

আমার নির্জনতার ওপরে অন্য এক নির্জনতা আছে এবং সেই নির্জনতার ভেতরে বসবাস করে আমার কোলাহলমুখর বাজার এলাকার একাকিত্ব এবং আমার নির্জনতা হচ্ছে দ্বিধান্বিত শব্দাবলি। 

আমি খুবই যুবক এবং ক্লান্তিহীন ওপরের নির্জনতা অনুসন্ধান করতে। উপত্যকার শব্দাবলী এখনও পর্যন্ত আমার কর্ণকুহর ধরে রেখেছে এবং এর ছায়া আমার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় এবং আমি যেতে পারি না। 

এই পাহাড়ের ওপরে একটা জাদুর কুঞ্জবন আছে এবং যেখানে বসবাস করে আমার শান্তি ছাড়াও ঘূর্ণায়মান বাতাস এবং আমার ঐশ্বরিক কুঞ্জবন অনুসন্ধান করার ক্ষেত্রে আমি খুবই যুবক এবং খুবই বন্য। রক্তের স্বাদ আমার মুখে লেগে থাকে এবং আমার পিতার তীর ও ধনুক যদিও আমার হাতে সক্রিয় হতে বিলম্বিত হয় এবং আমি যেতে পারি না। 

আমার বোঝা বহনকৃত আত্মার ওপরে বসবাস করে আমার অধিকতর স্বাধীন আত্মা এবং তার কাছে আমার স্বপ্নগুলি হচ্ছে একটি যুদ্ধ, যা গোধূলিবেলায় সংঘটিত হয় এবং আমার আকাঙ্ক্ষাগুলি হচ্ছে হাড়ের দ্রুতগামিতা। 

আমার অধিকতর স্বাধীন আত্মা হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে আমি খুবই যুবক এবং নিষ্ঠুর, 

এবং কীভাবে আমি অধিকতর স্বাধীন আত্মার পরিণত হব যদি আমার বোঝা বহনকৃত আত্মাকে হত্যা না করি অথবা যদি না প্রতিটি মানুষ স্বাধীন হয়? 

কীভাবে আমার পাতারা বাতাসের ওপরে গান গাইবে যদি আমার শিকড়গুলি অন্ধকারে শুকিয়ে না যায়? 

কীভাবে ঈগলটা আমার ভেতরে পাখা না নাড়িয়ে আকাশে ভেসে থাকবে সূর্যের মুখোমুখি যতক্ষণ আমার অনভিজ্ঞতা বাসা পরিত্যাগ না করে, যা আমি আমার নিজের ঠোঁটে নিৰ্মাণ করেছি তাদের জন্য? 

.

অন্তিম পর্যবেক্ষণ 

রাত্রিম জোয়ারের সময় যখন ভোরের প্রথম শ্বাসপ্রশ্বাস বাতাসের ওপর উঠে এল, তখন অগ্রদূত অশ্রুত শব্দের প্রতিধ্বনিতে নিজেকে আহ্বান জানাল। সে বিছানা ছেড়ে উঠল এবং নেমে এল তার ছাদের ওপর। বহু সময় সে দাঁড়িয়ে থাকল এবং তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল সুখনিদ্রামগ্ন শহরকে। তারপর সে মাথা তুলল এবং দেখল যেন ঐসব ঘুমন্তের নিদ্রাহীন আত্মাগুলি তার চারপাশে জড়ো হয়েছিল। সে তার ঠোঁট খুলল এবং বলল :

‘আমার বন্ধু এবং প্রতিবেশীরা, যারা প্রতিদিন আমার দরজা অতিক্রম করে যাও, আমি তোমাদের ঘুমের ভেতরে কথা বলব তোমাদের সঙ্গে এবং তোমাদের স্বপ্নের উপত্যকায় আমি হেঁটে বেড়াব নগ্ন ও উচ্ছৃঙ্খল অবস্থায়। তোমরা হচ্ছ মনোযোগহীন তোমাদের জেগে ওঠার সময় এবং বধির তোমাদের শব্দভারাক্রান্ত কান। 

দীর্ঘদিন এবং অতিমাত্রায় আমি তোমাদেরকে ভালোবেসেছিলাম। 

তোমাদের ভেতরে আমি একজনকে ভালোবাসি, যেন সে-ই ছিল সবকিছু অর্থাৎ তোমরা ছিলে একজন। আমার হৃদয়ের বসন্তকালে আমি তোমাদের বাগানে গান গেয়েছিলাম এবং আমার হৃদয়ের গ্রীষ্মকালে আমি পর্যবেক্ষণ করেছিলাম তোমাদের মাড়াইখানা। ‘হ্যাঁ, আমি তোমাদের প্রত্যেককে ভালোবাসি, দৈত্যাকৃতি এবং পিগমী, কুষ্ঠরোগী এবং অন্ধকারে যারা হাতড়ে বেড়ায় তাদের, এমনকি যারা পাহাড়ের ওপর নিজের দিনগুলিতে নৃত্য করে। 

‘তুমি শক্তিশালী, আমি তোমাকে ভালোবেসেছি, যদিও তোমার লোহার খুরের চিহ্ন এখনও আমার মাংসের ওপর এবং তুমি দুর্বল, যদিও তুমি বিশ্বাসে চিড় ধরিয়েছে এবং নষ্ট করেছ আমার ধৈর্য।

‘তুমি ধনী, তোমাকেও ভালোবেসেছি, যখন তোমার মধু আমার মুখে তিক্ত মনে হয়েছে। এবং তুমি দরিদ্র, যদিও তুমি জেনেছিলে আমার শূন্য হাতের লজ্জাকে। 

‘সুরহীন বীণা এবং অন্ধ আঙুলসহ তুমি হলে একজন কবি, আমি তোমাকে ভালোবেসেছি আত্মপ্রশ্রয়ের ভেতরে এবং তুমি পণ্ডিত, কুমোরের মাঠে সবসময় যে ক্ষয়প্রাপ্ত কাফনের সাথে জড়ো হয়। 

‘তুমি হলে যাজক, আমি তোমাকেও ভালোবেসেছি, যে গতকালের নির্জনতার ভেতরে বসে থাকে এবং আমার আগামীকালের নিয়তি সম্পর্কে জানতে চায় এবং তুমি হলে ঈশ্বর-পূজারী, তোমার নিজস্ব আকাঙ্ক্ষার প্রতিমূর্তি। 

তুমি হলে সেই তৃষ্ণার্ত নারী যার কাপ সবসময়ই পরিপূর্ণ, উপলব্ধির ভেতরে আমি ভালোবেসেছি এবং তুমি হলে ক্লান্তিহীন রাত্রির নারী, আমি তোমাকেও ভালোবেসেছি করুণার ভেতরে। 

‘তুমি বাচাল, আমি তোমাকেও ভালোবেসেছি এই বলে, ‘জীবনের অনেককিছু বলার আছে,’ এবং তুমি হলে বাকশক্তিহীন, আমি তোমাকেও ভালোবেসেছি এবং নিজেকে ফিসফিস করে বলেছি, ‘নির্জনতার ভেতরে সে কথা বলে না, তার কথা শুনলে আমি মূর্ছা যাব।’ 

‘এবং তুমি হলে বিচারক ও সমালোচক, আমি তোমাকেও ভালোবেসেছি যদিও আমাকে যখন ক্রুশবিদ্ধ করা হয় তখন তুমি বলেছিলে, ‘সে ছন্দোময়ভাবে রক্ত ঝরায় এবং যে রীতিতে তার রক্ত সাদা চামড়াকে চিত্রিত করে তোলে তা দেখতে খুবই সুন্দর।’ ‘হ্যাঁ, আমি তোমাদের প্রত্যেককে ভালোবেসেছি, যুবক এবং বৃদ্ধ, শিহরিত নলখাগড়া এবং ওক বৃক্ষকে 

‘কিন্তু হায়! এটা ছিল আমার হৃদয়ের অতিপ্রাচুর্য যা তোমাদেরকে আমার দিক থেকে অন্যদিকে ফেরাল। তোমরা একটা পাত্র থেকে পান করবে ভালোবাসা কিন্তু তরঙ্গিত নদী থেকে নয়। তোমরা ভালোবাসার মূর্ছিত ফিসফিসানি শুনবে, কিন্তু যখন ভালোবাসা চিৎকার করবে, তখন তোমরা ঢেকে ফেলবে তোমাদের কান। 

এবং আমি তোমাদের প্রত্যেকেই ভালোসেসেছি, কারণ তোমরা বলেছিলে ‘তার হৃদয় খুবই কোমল এবং প্রাকৃতিক রীতিতে উৎপাদনশীল এবং তার পথ প্রাজ্ঞতাহীনতায় ভরপুর। এটা হচ্ছে ভালোবাসা যার খুব প্রয়োজন, যে তুলে নেয় শুকনো খাবারের টুকরো, যেমন সে রাজকীয় ভোজে বসে যায়। এবং এটা হচ্ছে দুর্বল মানুষের ভালোবাসা, কারণ শক্তিশালী শুধুমাত্র শক্তিশালীকেই ভালোবাসে।’ 

‘এবং আমি তোমাদেরকে অতিমাত্রায় ভালোবেসেছি, কারণ তোমরা বলেছ, ‘এটা একজন অন্ধমানুষের ভালোবাসা, যে একজনের সৌন্দর্য সম্পর্কে জানে না, জানে না অন্যজনের কদর্যতা সম্পর্কে। এবং এটা হচ্ছে স্বাদহীন মানুষের ভালোবাসা, যে মদের পরিবর্তে ভিনেগার পান করে। এটা হচ্ছে অবিনয়ী এবং দাম্ভিক মানুষের ভালোবাসা, কারণ কোন সেই আগন্তুক হতে পারে আমাদের মাতা, পিতা, বোন এবং ভাই?’ 

তোমরা এইসব এবং আরও অনেককিছু বলেছ, কারণ প্রায়ই বাজার-এলাকায় তোমরা আমার দিকে আঙুল তুলে উপহাস করে বলেছ, ‘বয়সহীন এবং ঋতুহীন এক মানুষ, যে দুপুরবেলায় আমাদের শিশুর সঙ্গে খেলা করে এবং সন্ধ্যায় বসে থাকে আমাদের বয়স্কদের সঙ্গে এবং অনুমান করে স্বাধীনতা এবং উপলব্ধি।’ 

‘এবং আমি বলেছিলাম, আমি তাদেরকে আরও ভালোবাসব। হ্যাঁ আরও ভালোবাসাব। আমি গোপন করব আমার ভালোবাসা ঘৃণা মনে করে এবং একটা কোমলতাকে পরাব তিক্ততার ছদ্মবেশ। আমি পরিধান করব একটা লোহার মুখোশ এবং শুধুমাত্র যখন আমি অস্ত্রসজ্জিত হব এবং পরিধান করব বর্ম তখনই অনুসন্ধান করব তাদের। 

‘তারপর আমি আমার ভারী হাত রাখব তোমাদের কালশিরে পড়া চামড়ার ওপরে এবং রাত্রিবেলায় প্রচণ্ড ঝড়ের মতো তোমাদের কান ভরে তুলব বজ্রপাতের শব্দে। 

‘বাড়ির ছাদ থেকে আমি ঘোষণা করেছিলাম যে তোমরা ভণ্ড, ধোঁকাবাজ, মিথ্যুক এবং মাটি থেকে উদ্ভূত শূন্য বুদ্বুদ। 

‘তোমাদের ভেতরে যারা চোখে কম দেখে তাদেরকে অভিশাপ দিয়েছিলাম, কারণ তারা ছিটগ্রস্ত এবং অন্ধ এবং তারা পৃথিবীর আরও কাছাকাছি আত্মাহীন ছুঁচোজাতীয় প্রাণীর তুলনায়। 

‘আমি ঘোষণা করেছিলাম বাকপটুদের জিভ হচ্ছে কাঁটাওয়ালা, নীরব, পাথরের মতো এবং শুকনো এবং আমি আহ্বান জানিয়েছিলাম সাধারণ ও শিল্পহীনতাকে। মৃত কখনও মৃত্যুর ব্যাপারে ক্লান্ত হয় না। 

‘বিশ্বজ্ঞান অনুসন্ধানকারীদের আমি নিন্দা করি পবিত্র আত্মার আইন অমান্যকারী হিসেবে এবং ছায়াশিকারি হিসেবে আমি যে আত্মাকে কলঙ্কের চিহ্ন দিয়েছি, সে-ই জড়ো করবে তাদের জ্বাল স্রোতহীন পানিতে এবং ধরে রাখবে তদের নিজস্ব প্রতিমূর্তি। 

‘এইভাবে আমি আমার ওষ্ঠ দিয়ে তোমাদেরকে অভিযুক্ত করেছি, যখন আমার আত্মা আমার ভেতরে রক্ত ঝরিয়েছে তোমাদের মধুর নাম ধরে ডেকে ডেকে। 

এটা ছিল ভালোবাসা যাকে আঘাত করেছিল তারই নিজস্ব সত্বা, যে কথা বলেছিল। এটা ছিল অর্ধেক খুন করার গর্ব, যা ধুলোর ভেতরে ধড়ফড় করেছিল। এটা ছিল আমার ক্ষুধা তোমাদের ভালোবাসার জন্য যা বাড়ির ছাদ থেকে ক্রোধে উন্মত্ত হয়েছিল, যখন আমার নিজস্ব ভালোবাসা নীরবতায় হাঁটু গেড়ে বসেছিল এবং প্রার্থনা করেছিল তোমার ক্ষমা। ‘কিন্তু লক্ষ্য করো একটি অলৌকিক ঘটনা। 

‘এটা ছিল আমার ছদ্মবেশ যা তোমাদের চোখ খুলে দিয়েছিল এবং আমার মনে হয়েছিল তোমাদের হৃদয়ের জাগরণকে ঘৃণা করতে। 

‘এবং এখন তোমরা আমাকে ভালোবাসো। 

‘তোমরা ভালোবাসো সেই তরবারি যা তোমাদেরকে আঘাত করে এবং সেই তীর যা ব্যাকুলভাবে কামনা করে তোমাদের বক্ষস্থল। কারণ এটা তোমাকে আহত হতে আয়েশ দেবে এবং যখন তোমরা তোমাদের নিজের রক্ত পান করবে শুধুমাত্র তখনই তোমরা নেশায় উন্মত্ত হয়ে উঠতে পারো। 

‘আলোর প্রতি আকৃষ্ট পতঙ্গ, যারা অগ্নিশিখার ধ্বংস অনুসন্ধান করে তাদেরকেই প্রতিদিন তোমাদের বাগানে জড়ো করো : এবং মুখমণ্ডল উন্নীত এবং দৃষ্টিতে মন্ত্রমুগ্ধতা সৃষ্টি করে তোমরা আমাকে পর্যবেক্ষণ করো এবং তোমাদের অশ্রু তোমাদের পোশাক ভেজায়। 

তোমরা ফিসফিস করে একে অন্যকে বলো: ‘ঈশ্বরের আলোতে সে দেখতে পায়। সে কথা বলে প্রাচীনকালের নবীদের মতো। সে উন্মোচন করে আমাদের আত্মাগুলি এবং হৃদয়গুলির তালা খুলে দেয় এবং পছন্দ করে ঈগল পাখি, যা শেয়ালদের পথ চেনে এবং শেয়ালরা চেনে আমাদের পথ। 

‘হ্যাঁ, সত্যের ভেতরে, আমি চিনি তোমাদের পথ, কিন্তু শুধুমাত্র ঈগল হিসেবে সে চেনে সেইসব পাখিদের পথ যারা মাত্র উড়তে শিখেছে এবং আমি আমার গোপনীয়তা উন্মোচন করতে গিয়ে মূর্ছা যাব। যদিও তোমাদের নিকটবর্তী হওয়ার জন্য আমার প্রয়োজনের ভেতরে দূরবর্তিতা উদ্ভাবন করি এবং তোমার ভালোবাসার ভাটার আতঙ্কের ভেতরে আমি আমার ভালোবাসার প্রবেশ ও বহির্গমনের দরজা পাহারা দিই।’ 

এসব কথা বলার পর অগ্রদূত তার মুখ ঢেকে ফেলল হাত দিয়ে এবং কাঁদতে লাগল তীব্রভাবে। কারণ সে জানত তার হৃদয়ে যে ভালোবাসা, তা নগ্নতার ভেতরে লজ্জিত হয় এবং এই লজ্জা সেই ভালোবাসার চেয়ে বৃহত্তর যা ছদ্মবেশে বিজয়োল্লাস অনুসন্ধান করে এবং সে লজ্জিত হয়েছিল। 

কিন্তু হঠাৎ সে তার মাথা তুলল এবং ঘুম থেকে জেগে উঠল। সে প্রসারিত করল তার হাত এবং বলল, ‘রাত্রি শেষ এবং আমরা, রাত্রির শিশুরা, আমাদেরকে অবশ্যই মারা যেতে হবে যখন ভোরবেলা পাহাড়ের ওপর থেকে লাফ দিয়ে সামনে এসে দাঁড়াবে এবং আমাদের ছাইয়ের ভেতর থেকে অধিক পরাক্রমশালী এক ভালোবাসা বেড়ে উঠবে এবং সূর্যালোকে সেই ভালোবাসা হাসতে থাকবে এবং তা হবে মৃত্যুহীন। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *