অগ্রদানী

অগ্রদানী

একটা ছয় ফুট সাড়ে ছয় ফুট লম্বা কাঠিকে মাঝামাঝি মচকাইয়া নোয়াইয়া দিলে যেমন হয়, দীর্ঘ শীর্ণ পূর্ণ চক্রবর্তীর অবস্থাও এখন তেমনই। কিন্তু ত্রিশ বৎসর পূর্বে সে এমন ছিল না, তখন সে বত্রিশ বৎসরের জোয়ান, খাড়া সোজা। লোকে বলিত, মই আসছে—মই আসছে? কিন্তু ছোট ছেলেদের সে ছিল মহা প্রিয়পাত্র।

বয়স্ক ব্যক্তিদের হাসি দেখিয়া সে গম্ভীরভাবে প্রশ্ন করিত, হুঁ। কী রকম, হাসছে যে?

এই দাদা, একটা রসের কথা হচ্ছিল।

হুঁ। তা বটে, তা তোমার রসের কথা—তোমার রস খাওয়ারই সমান।

একজন হয়তো বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া বলিয়া দিত, না দাদা, তোমাকে দেখেই সব হাসছিল, বলছিল—মই আসছে।

চক্রবর্তীর আকর্ণ দাঁত মেলিয়া হাসিয়া উত্তর দিত, হুঁ, তা বটে। কাঁধে চড়লে স্বগগে যাওয়া যায়। বেশ পেট ভরে খাইয়ে দিলেই, বাস, স্বগগে পাঠিয়ে দোব।

আর পতনে রসাতল, কী বল দাদা?

চক্রবর্তী মনে মনে উত্তর খুঁজিত। কিন্তু তাহার পূর্বেই চক্রবর্তীর নজরে পড়িত, অল্পদূরে একটা গলির মুখে ছেলের দল তাহাকে ইশারা করিয়া ডাকিতেছে। আর চক্রবর্তীর উত্তর দেওয়া হইত না। সে কাজের ছুতা করিয়া সরিয়া পড়িত।

কোনো দিন রায়েদের বাগানে, কোনো দিন মিঞাদের বাগানে ছেলেদের দলের সঙ্গে গিয়া হাজির হইয়া আম জাম পেয়ারা আহরণে মত্ত থাকিত। সরস পরিপক্ক ফলগুলির মিষ্ট গন্ধে সমবেত মৌমাছি বোলতারা ঝাঁক বাঁধিয়া চারিদিক হইতে আক্রমণের ভয় দেখাইলেও সে নিরস্ত হইত না; টুপটাপ করিয়া মুখে ফেলিয়া চোখ বুঁজিয়া রসাস্বাদনে নিযুক্ত থাকিত।

ছেলেরা কলরব করিত, ওই, অ্যাঁ—তুমি যে সব খেয়ে নিলে, অ্যাঁ! সে তাড়াতাড়ি ডালটা নাড়া দিয়া কতকগুলো ঝরাইয়া দিয়া আবার গোটা দুই মুখে পুরিয়া বলিত, আঃ।

কেহ হয়তো বলিত, বাঃ পুন্নকাকা, তুমি যে খেতে লেগেছ? ঠাকুর পুজো করবে না?

পূর্ণ উত্তর দিত, ফল ফল, ভাত মুড়ি তো নয়, ফল ফল।

ত্রিশ বৎসর পূর্বে যেদিন এ কাহিনীর আরম্ভ, সেদিন স্থানীয় ধনী শ্যামাদাসবাবুর বাড়িতে এক বিরাট শান্তি-স্বস্তয়ন উপলক্ষ্যে ছিল ব্রাহ্মণ ভোজন। শ্যামাদাসবাবু সন্তানহীন, একে একে পাঁচ-পাঁচটি সন্তান ভূমিষ্ঠ হইয়া মারা গিয়াছে। ইহার পূর্বে বহু অনুষ্ঠান হইয়া গিয়াছে, কিন্তু কোনো ফল হয় নাই। এবার শ্যামাদাসবাবু বিবাহ করিতে উদ্যত হইয়াছিলেন; কিন্তু স্ত্রী শিবরাণী সজল চক্ষে অনুরোধ করিল, আর কিছুদিন অপেক্ষা করে দেখ; তারপর আমি বারণ করব না, নিজে আমি তোমার বিয়ে দিয়ে দেব।

শিবরাণী তখন আবার সন্তানসম্ভবা। শ্যামাদাসবাবু সে অনুরোধ রক্ষা করিলেন। শুধু তাই নয়, এবার তিনি এমন ধারা ব্যবস্থা করিলেন যে সে ব্যবস্থা যদি নিষ্ফল হয় তবে যেন শিবরাণীর পুনরায় অনুরোধের উপায় আর না থাকে। কাশী বৈদ্যনাথ তারকেশ্বর এবং স্বগৃহে একসঙ্গে স্বস্ত্ব্যয়ন আরম্ভ হইল। স্বস্ত্ব্যয়ন বলিলে ঠিক বলা হয় না, পুত্রেষ্টিযজ্ঞই বোধ হয় বলা উচিত।

ব্রাহ্মণ ভোজনের আয়োজন বিপুল। শ্যামাদাসবাবু গলবস্ত্র হইয়া প্রতি পংক্তির প্রত্যেক ব্রাহ্মণটির নিকট গিয়া দেখিতেছেন—কী নাই, কী চাই। একপাশে পূর্ণ চক্রবর্তীও বসিয়া গিয়াছে, সঙ্গে তাহার তিন ছেলে! কিন্তু পাতা অধিকার করিয়া আছে পাঁচটি। বাড়তি পাতাটিতে অন্ন ব্যঞ্জন মাছ স্তূপীকৃত হইয়া আছে বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। পাতাটি তাহার ছাঁদা; তাহার নাকি এটিতে দাবী আছে। সেই শ্যামাদাসবাবুর প্রতিনিধি হইয়া ব্রাহ্মণদিগকে নিমন্ত্রণ জানাইয়া আসিয়াছে। আবার আহারের সময় আহ্বান জানাইয়াও আসিয়াছে। তাহারই পারিশ্রমিক এটি। শুধু শ্যামাদাসবাবুর বাড়িতে এবং এই ক্ষেত্র-বিশেষটিতে নয়, এই কাজটি তাহার যেন নির্দিষ্ট কাজ, এখানে পঞ্চগ্রামের মধ্যে যেখানে যে বাড়িতেই হউক এবং যত সামান্য আয়োজনের ব্রাহ্মণ-ভোজন হউক না কেন, পূর্ণ চক্রবর্তী আপনিই সেখানে গিয়া হাজির হয়; হাঁটু পর্য্যন্ত কোনোরূপে ঢাকে এমনই বহরের তাহার পোশাকী কাপড়খানি পরিয়া এবং বাপ পিতামহের আমলে রেশমের একখানি কালী নামাবলী গায়ে দিয়া হাজির হইয়া বলে, হুঁ, তা কর্তা কই গো, নেমন্তন্ন কী রকম হবে একবার বলে দেন? ওঃ, মাছগুলো বেশ তেলুল-তেলুল ঠেকছে! হুই হুই! নিয়েছিল এক্ষুনি চিলে।

চিলটা উড়িতেছিল আকাশের গায়ে, পূর্ণ চক্রবর্তী সেটাকেই তাড়াইয়া গৃহস্থের হিতাকাঙ্ক্ষীর পরিচয় দেয়। দুর্দান্ত শীতের গভীর রাত্রে পর্য্যন্ত গ্রাম হইতে গ্রামান্তরে ফিরিয়া সে সকলকে নিমন্ত্রণ করিয়া ফেরে; প্রচণ্ড গ্রীষ্মের দ্বি-প্রহরেও আহারের আহ্বান জানাইতে চক্রবর্তী ছেঁড়া চটি পায়ে, মাথায় ভিজা গামছাখানি চাপাইয়া কর্তব্য সারিয়া আসে; সেই কর্মের বিনিময়ে এটি তাহার পারিশ্রমিক! যাক।

শ্যামাদাসবাবু আসিয়া পূর্ণকে বলিলেন, আর কয়েকখানা মাছ দিক চক্রবর্তী।

চক্রবর্তীর তখন খান-বিশেক মাছ শেষ হইয়া গিয়াছে। সে একটা মাছের কাঁটা চুষিতেছিল, বলিল, আজ্ঞে না, মিষ্টি-টিষ্টি আবার আছে তো! হরে ময়রার রসের কড়াইয়ে ইয়া ইয়া ছানাবড়া ভাসছে, আমি দেখে এসেছি।

শ্যামাদাসবাবু বলিলেন, সে তো হবেই, একটা মাছের মুড়ো?

পূর্ণ পাতাখানা পরিষ্কার করিতে করিতে বলিল, ছোট দেখে।

মাছের মুড়াটা শেষ করিতে করিতে ও-পাশে তখন মিষ্টি আসিয়া পড়িল।

চক্রবর্তী ছেলেদের বলিল, হুঁ, বেশ করে পাতা পরিষ্কার কর, হুঁ। নইলে নোন্তা ঝোল লেগে খারাপ লাগবে খেতে। এঃ, তুই যে কিছুই খেতে পারলি না, মাছসুদ্ধ পড়ে আছে।—বলিয়া ছোট ছেলেটার পাতের আধখানা মাছও সে নিজের পাতে উঠাইয়া লইল! মাছখানা শেষ করিয়া সে গলাটা উঁচু করিয়া মিষ্টি পরিবেশনের দিকে চাহিয়া রহিল। মধ্যে মধ্যে হাঁকিতেছিল, এই দিকে!

ওপাশে সকলে তাহাকে দেখিয়া চোখ টেপাটেপি করিয়া হাসিতেছিল। একজন বলিল, চোখ দুটো দেখ, চোখ দুটো দেখ—

উঃ, যেন চোখ দিয়ে গিলছে!

আমি তো ভাই, কখনও ওর পাশে খেতে বসি না। উঃ, কী দৃষ্টি!

ততক্ষণে মিষ্টান্ন চক্রবর্তীর পাতার সম্মুখে গিয়া হাজির হইয়াছে!

চক্রবর্তী মিষ্টান্ন পরিবেশকের সহিত ঝগড়া আরম্ভ করিয়া দিল, ছাঁদার পাতে আমি আটটা মিষ্টি পাব।

বাঃ, সে তো চারটে করে মিষ্টি পান মশায়!

সে দুটো করে যদি পাতে পড়ে, তবে চারটে। আর চারটে যখন পাতে পড়ছে, তখন আটটা পাব না, বাঃ!

শ্যামাদাসবাবু আসিয়া বলিলেন, ষোলটা দাও ওর ছাঁদার পাতে। ভদ্রলোক বিনা মাইনেতে নেমন্তন্ন করে আসেন; দাও দাও, ষোলটা দাও।

পূর্ণ চক্রবর্তী আঁচল খুলিতে খুলিতে বলিল, আঁচলে দাও, আমার আঁচলে দাও।

শ্যামাদাসবাবু বলিলেন, চক্রবর্তী, কাল সকালে একবার আসবে তো। কেমন, এখানে এসেই জল খাবে?

যে আজ্ঞা, তা আসব।

ওপাশ হইতে কে বলিল, চক্রবর্তী, বাবুকে ধরে পড়ে তুমি বিদূষক হয়ে যাও—আগেকার রাজাদের যেমন বিদূষক থাকত।

চক্রবর্তী গামছায় ছাঁদার পাতাটা বাঁধিতে বাঁধিতে বলিল, হুঁ। তা তোমার হলে তো ভালই হয়; আর তোমার, ব্রাহ্মণের লজ্জাই বা কী? রাজা-জমিদারের বিদূষক হয়ে যদি ভাল-মন্দটা—

বলিতে বলিতেই সে হাসিয়া উঠিল।

বাড়িতে আসিয়া ছাঁদা-বাঁধা গামছাটা বড় ছেলের হাতে দিয়া চক্রবর্তী বলিল, যা, বাড়িতে দিগে যা।

ছেলেটা গামছা হাতে লইতেই মেজো মেয়েটা বলিল, মিষ্টিগুলো?

সে আমি নিয়ে যাচ্ছি, যা।

অ্যাঁ, তুমি লুকিয়ে রাখবে। ষোলটা মিষ্টি কিন্তু গুনে নোব, হ্যাঁ।

আরে আরে, এ বলছে কী? ষোলটা কোথা রে বাপু। দিলে তো আটটা, তাও কত ঝগড়া করে।

মা, মা, দেখ বাবা মিষ্টিগুলো লুকিয়ে রেখেছে, অ্যাঁ।

চক্রবর্তী গৃহিনী যাহাকে বলে রূপসী। দারিদ্রের শতমুখী আক্রমণেও সে রূপকে জীর্ণ করিতে পারে নাই। দেহ শীর্ণ, চুল রুক্ষ, পরিধানে ছিন্ন মলিন বস্ত্র, তবুও হৈমবতী যেন সত্যিই হৈমবতী। কাঞ্চননিভ দেহবর্ণ দেখিয়া সোনার প্রতিমা বলিতেই ইচ্ছা করে। চোখ দুইটি আয়ত সুন্দর, কিন্তু দৃষ্টি তাহার নিষ্ঠুর মায়াহীন। মায়াহীন অন্তর ও রূপময় কায়া লইয়া হৈম যেন উজ্জ্বল বালুস্তরময়ী মরুভূমি, প্রভাতের পর হইতেই দিবসের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মরুর মতোই প্রখর হইতে প্রখরতম হইয়া উঠে।

হৈমবতী আসিয়া দাঁড়াইতেই চক্রবর্তী সভয়ে মেয়েকে বলিল, বলছি, তুই নিয়ে যেতে পারবি না। না, মেয়ে চেঁচাতে—

হৈমবতী কঠোর স্বরে বলিল, দাও!

ছেলেটা বলিল, বাবাকে আর দিও না মা। আজ যা খেয়েছে বাবা, উঃ? আবার কাল সকালে বাবু নেমতন্ন করেছে, বাবাকে মিষ্টি খাওয়াবে!

হৈম কঠিন স্বরে বলিল, বেরো বলছি আমার সুমুখ থেকে হতভাগা ছেলে। বাপের প্রতি ভক্তি দেখ! তোরা সব মরিস না কেন, আমি যে বাঁচি!

পূর্ণ এবার সাহস করিয়া বলিল, দেখ না ছেলের তরিবৎ যেন চাষার তরিবৎ।

হৈম বলিল, বাপ যে চামার, লোভী চামারের ছেলে চাষাও যে হয়েছে সেইটুকুও ভাগ্যি মেনো। লেখাপড়া শেখাবার পয়সা নেই, রোগে ওষুধ নেই, গায়ে জামা নেই, তবু মরে না ওরা। রাক্ষসের ঝাড়, অখণ্ড পেরমাই!

চক্রবর্তী চুপ করিয়া রহিল। হৈম যেন আগুন ছড়াইতে ছড়াইতে চলিয়া গেল। চক্রবর্তী ছেলেটাকে বলিল, দেখ দেখি রে; এক টুকরো হত্তকি, কী সুপুরি এক কুচি যদি পাস! তোর মার কাছে যেন চাস নি বাবা!

সন্ধ্যার পর চক্রবর্তী হৈমর কাছে বসিয়া ক্রমাগত তাহার তোষামোদ করিতে আরম্ভ করিল। হৈম কোলের ছেলেটাকে ঘুম পাড়াইতেছিল। চক্রবর্তী এবং ছেলেরা আজ নিমন্ত্রণ খাইয়াছে। রাত্রে আর রান্নার হাঙ্গামা নাই, যে ছাঁদাটা আসিয়াছে তাহাতে হৈম আর কোলের ছেলেটারও চলিয়া গিয়াছে।

বহু তোষামদেও হৈম যেন তেমন প্রসন্ন হইল না। অন্তত চক্রবর্তীর তাহাই মনে হইল; সে মনের কথা বলিতে সাহস পাইল না! তাহার একান্ত ইচ্ছা যে রাত্রে কয়েকটা ছানাবড়া সে খায়। তাহার তৃপ্তি হয় নাই, বুকের মধ্যে লালসা ক্রমবর্ধমান বহ্নিশিখার মতো জ্বলিতেছে।

ধীরে ধীরে হৈমবতী ঘুমাইয়া পড়ল। শীর্ণ দুর্বল, দেহ, তাহার উপর আবার সে সন্তানসম্ভবা, সন্ধ্যার পর শরীর যে ভাঙ্গিয়া পড়ে। চক্রবর্তী হৈমর দিকে ভাল করিয়া চাহিয়া দেখিল, হাঁ হৈম ঘুমাইতেছে! চক্রবর্তী আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিয়া হৈমর আঁচল হইতে দড়ি বাঁধা কয়টা চাবির গোছা খুলিয়া ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল।

পরদিন প্রভাতে উঠিয়াই ছেলেরা নাচিতে নাচিতে চিৎকার করিতে আরম্ভ করিল, ছানাবড়া খাব! বড় ছেলেটা ঘুর-ঘুর করিয়া বার বার মায়ের কাছে আসিয়া বলিতেছিল, আমাকে কিন্তু একটা গোটা দিতে হবে মা!

হৈম বিরক্ত হইয়া বলিল, সব—সবগুলো বের করে দিচ্ছি, একটা কেন?

সে চাবি খুলিয়া ঘরে ঢুকিয়াই একটা রূঢ় বিস্ময়ের আঘাতে স্তব্ধ ও নিশ্চল হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। যে শিকাতে মিষ্টিগুলি ঝুলান ছিল, সেটা কীসে কাটিয়া ফেলিয়াছে, মিষ্টান্নগুলি অধিকাংশই কীসে খাইয়া গিয়াছে, মাত্র গোটা তিন-চার মেঝের উপর পড়িয়া আছে। তাও সেগুলি রসহীন শুষ্ক, নিঃশেষে রস শোষণ করিয়া লইয়া ছাড়িয়াছে! ছেঁড়া শিকলটাকে সে একেবারে তুলিয়া ধরিয়া দেখিল, কাটা না, টানিয়া কীসে ছিঁড়িয়াছে। অতি নিষ্ঠুর কঠিন হাসি তাহার মুখে ফুটিয়া উঠিল!

বাবু বলিলেন, গিন্নীর একান্ত ইচ্ছে যে তুমি এবার তাঁর আঁতুড়দোরে থাকবে।

এখানকার প্রচলিত প্রথায় সূতিকা-গৃহের দুয়ারের সম্মুখে রাত্রে ব্রাহ্মণ রাখিতে হয়। চক্রবর্তী সন্তানদের মধ্যে সব কটিই জীবিত, চক্রবর্তী-গৃহিনী নিখুঁত প্রসূতি; তাহার সূতিকা-গৃহের দুয়ারে চক্রবর্তীই শুইয়া থাকে। তাই শিবরাণী এবার এই ইচ্ছা প্রকাশ করিয়াছে, কল্যাণের এমনই সহস্র খুঁটিনাটি লইয়া সে অহরহ ব্যস্ত। শ্যামাদাসবাবুও তাহার কোনো ইচ্ছা অপূর্ণ রাখিবেন না।

চক্রবর্তী বলিল, হাঁ, তা আজ্ঞে—

একজন মোসাহেব বলিয়া উঠিল, তা না না—কিছু নেই চক্রবর্তী। দিব্যি এখানে এসে রাজভোগ খাবে, ইয়া পুরু বিছানা, তোফা ভরা পেটে বুঝেছ? বলিয়া সে ঘড়ঘড় করিয়া নাক ডাকাইয়া ফেলিল।

আহার ও আরামের বর্ণনায় পুলকিত চক্রবর্তী হাসিয়া ফেলিল বলিল, হুঁ, তা হুজুর যখন বলছেন, তখন না পারলে হবে কেন?

শ্যামাদাসবাবু বলিলেন, বসো তুমি, আমি জল খেয়ে আসছি। তোমারও জলখাবার আসছে।—বলিয়া তিনি পাশের ঘরে চলিয়া গেলেন। একজন চাকর একখানা আসন পাতিয়া দিয়া মিষ্টান্ন পরিপূর্ণ একখানা থালা নামাইয়া দিল।

একজন বলিল, খাও চক্রবর্তী।

হুঁ। তা একটু জল, হাতটা ধুয়ে ফেলতে হবে।

আর একজন পারিষদ বলিল, গঙ্গাগঙ্গা বলে বসে পড় চক্রবর্তী। অপবিত্র পবিত্র বা, ওঁ বিষ্ণু স্মরণ করলেই—ব্যাস শুদ্ধ, বসে পড়!

গ্লাসের জলেই একটা কুলকুচা করিয়া খানিকটা হাতে বুলাইয়া লইয়া চক্রবর্তী লোলুপভাবে থালার সম্মুখে বসিয়া পড়িল।

পাশের ঘরে জলযোগ শেষ করিয়া আসিয়া শ্যামাদাসবাবু বলিলেন, পেট ভরল চক্রবর্তী?

চক্রবর্তীর মুখে তখন গোটা ছানাবড়া; একজন বলিয়া উঠিল আজ্ঞে কথা বলার অবসর নেই চক্রবর্তীর এখন।

সেটা শেষ করিয়া চক্রবর্তী বলিল, আজ্ঞে পরিপূর্ণ, তিল ধরাবার জায়গা নেই পেটে।

সে উঠিয়া পড়িল।

শ্যামাদাসবাবু বলিলেন তোমার কল্যাণে যদি মনস্কামনা আমার সিদ্ধ হয় চক্রবর্তী তবে দশ বিঘে জমি আমি তোমাকে দেব। আর আজীবন তুমি সিংহবাহিনীর একটা প্রসাদ পাবে। তা হলে তোমার কথা তো পাকা—কেমন?

সিংহবাহিনীর প্রসাদ কল্পনা করিয়া চক্রবর্তী পুলকিত হইয়া উঠিল। সিংহবাহিনীর ভোগের প্রসাদ—সে যে রাজভোগ!

হুঁ। তা পাকা বইকি, হুজুরের—

কথা অর্ধসমাপ্ত রাখিয়া সে বলিয়া উঠিল, দেখ দেখি, ওহে, দেখি।

চোখ তাহার যেন জ্বল জ্বল করিয়া উঠিল।

খানসামাটা শ্যামদাসবাবুর উচ্ছিষ্ট জলখাবারের থালাটা লইয়া সম্মুখ দিয়া পার হইয়া যাইতেছিল। একটা অভুক্ত ক্ষীরের সন্দেশ ও মালপোয়া থালাটার উপর পড়িয়া ছিল। চক্রবর্তীর লোলুপতা অকস্মাৎ যেন সাপের মতো বিবর হইতে ফণা বিস্তার করিয়া বাহির হইয়া বিষ উদগার করিল। চক্রবর্তী স্থানাকাল সমস্ত ভুলিয়া বলিয়া উঠিল, দেখি দেখি, ওহে দেখি।

শ্যামাদাসবাবু হাঁ-হাঁ করিয়া উঠিলেন, কর কী, এঁটো, ওটা এঁটো। নতুন এনে দিক?

চক্রবর্তী তখন থালাটা টানিয়া লইয়াছে। ক্ষীরের সন্দেশটা মুখে পুরিয়া বলিল, আজ্ঞে রাজার প্রসাদ।

আর সে বলিতে পারিল না, আপনার অন্যায়টা মুহূর্তে তাহার বোধগম্য হইয়া উঠিয়াছে। কিন্তু আর উপায় ছিল না, বাকিটাও আর ফেলিয়া রাখা চলে না। লজ্জায় মাথা হেঁট করিয়া সেটাও কোনোরূপে গলাধঃকরণ করিয়া তাড়াতাড়ি কাজের ছুতা করিয়া সে পালাইয়া আসিল।

বাড়িতে তখন মরুতে ঝড় বহিতেছে। হৈম মূর্ছিত হইয়া পড়িয়াছে, ছোট ছেলেগুলো কাঁদিতেছে। বড়টা কোথায় পালাইয়াছে।

মেজো মেয়েটা কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, মিষ্টিগুলো কীসে খেয়ে গিয়েছে, তাই দাদা ঝগড়া করে মাকে মেরে পালাল। মা পড়ে গিয়ে—

কথার শেষাংশ তাহার কান্নায় ঢাকিয়া গেল। চক্রবর্তীর চোখে জল আসিল। জলের ঘটি ও পাখা লইয়া সে হৈমর পাশে বসিয়া শুশ্রূষা করিতে করিতে সতৃষ্ণ দৃষ্টিতে হৈমর মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।

চেতনা হইতেই হৈম স্বামীকে দেখিয়া বলিয়া উঠিল, ছি ছি ছি! তোমাকে কী বলব আমি—ছিঃ।

চক্রবর্তী হৈমর পা জড়াইয়া ধরিয়া কী বলিতে গেল, কিন্তু হৈম চিৎকার করিয়া উঠিল, মাথা ঠুকে মরব আমি; ছাড় পা ছাড়।

সমস্ত দিন হৈম নির্জীবের মতো পড়িয়া রহিল। সন্ধ্যার দিকে সে সুস্থ হইয়া উঠিলে চক্রবর্তী সমস্ত কথা বলিয়া কহিল, তোমার বলছ, তোমার ওই সময়েই। তা না হয় কাল বলে দেব যে, পারব না আমি।

হৈম চিৎকার করিয়া উঠিল, না না না। মরুক মরুক, হয়ে মরুক এবার। আমি খালাস পাব। জমি পেলে অন্যগুলো তো বাঁচবে।

শ্রাবণ মাসের প্রথম সপ্তাহেই। সেদিন সন্ধ্যায় শ্যামদাসবাবুর লোক আসিয়া চক্রবর্তীকে ডাকিল, চলুন আপনি, গিন্নিমায়ের প্রসববেদনা উঠেছে।

চক্রবর্তী বিব্রত হইয়া উঠিল; হৈমরও শরীর আজ কেমন করিতেছে!

হৈম বলিল, যাও তুমি।

কিন্তু—

আমাকে আর জ্বালিও না বাপু, যাও। বাড়িতে বড় খোকা রয়েছে, যাও তুমি।

চক্রবর্তী দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বাহির হইয়া গেল। জমিদার-বাড়ি তখন লোকজনে ভরিয়া গিয়াছে। শ্যামাদাসবাবু বলিলেন, এস চক্রবর্তী, এস। আমি বড় ব্যস্ত এখন। তুমি রান্নাবাড়িতে গিয়ে খাওয়া-দাওয়া সেরে নিও।

চক্রবর্তী সটান গিয়ে তখনই রান্নাশালে উঠিল।

হুঁ, ঠাকুর কী রান্না হয়েছে আজ? বাঃ খোসবুই তো খুব উঠেছে। কী হে, ওটা মাছের কালিয়া, না মাংস?

মাংস। আজ মায়ের পুজো দিয়ে বলি দেওয়া হয়েছে কিনা।

হুঁ, তা তোমার রান্নাও খুব ভাল। তার ওপর তোমার বাদলার দিন। কতদূর, বলি দেরি কত? দাও না, দেখি একটু চেখে।

সে একখানা শালপাতা ছিঁড়িয়া ঠোঙা করিয়া একেবারে কড়াই ঘেঁসিয়া বসিয়া পড়িল। ঠাকুর বিরক্ত হইয়া বলিল, আচ্ছা লোভ তোমার চক্রবর্তী।

হুঁ, তা বলেছ ঠিক। তা একটু বেশি। তা বটে।

একটুখানি নীরব থাকিয়া বলিল, সিদ্ধ হতে দেরি আছে নাকি?

হাতাতে করিয়া খানিকটা অর্ধসিদ্ধ মাংস তাহার ঠোঙাতে দিয়া ঠাকুর বলিল, এই দেখ, বললে তো বিশ্বাস করবে না। নাও, হুঁ।

সেই গরম ঝোলই খানিকটা সড়াৎ করিয়া টানিয়া লইয়া চক্রবর্তী বলিল, হুঁ, বাঃ ঝোলটা বেড়ে হয়েছে। হুঁ, তা তোমার রান্না, যাকে বলে উৎকৃষ্ট।

ঠাকুর আপন মনেই কাজ করিতেছিল, সে কোনো উত্তর দিল না।

চক্রবর্তী বলিল, হুঁ। তা তোমার, এ চাকলায় তোমার জুড়ি দেখলাম না। মাংসটা সিদ্ধ এখনো হয় নি, তবে তোমার গিয়ে খাওয়া চলছে।

ঠাকুর বলিল, চক্রবর্তী, তুমি এখন যাও এখান থেকে। খাবার হলে খবর দেবে চাকররা। আমাকে কাজ করতে দাও। যাও, ওঠো।

চক্রবর্তী উঠিয়াছে কিনা সন্দেহ। কিন্তু এই সময়ে তাহার বড় ছেলেটা আসিয়া ডাকিল, বাবা!

চক্রবর্তী উঠিয়া আসিয়া প্রশ্ন করি, কী রে?

একবার বাড়ি এস। ছেলে হয়েছে!

তোর মা—তবে মা কেমন আছে?

ভালোই আছে গো। তবে দাই-টাই কেউ নেই, দাই এসেছে বাবুদের বাড়ি; নাড়ী কাটতে লোক চাই।

চক্রবর্তী তাড়াতাড়ি ছেলের সঙ্গে বাহির হইয়া গেল।

ভয় নেই, ভালই আছি। তুমি শুদ্দুরদের দাইকে ডাক দেখি, নাড়ী কেটে দিয়ে যাক। আমাদের দাইকে তো পাওয়া যাবে না।

তাহাই হইল। দাইটা নাড়ী কাটিয়া বলিল, সোন্দর খোকা হয়েছে বাপু, মা বাপ সোন্দর না হলে কি ছেলে সোন্দর হয়। মা কেমন—তা দেখতে হবে।

হৈম বলিল, যা যা, বকিস নি বাপু; কাজ হল তোর, তুই যা।

চক্রবর্তী বলিল, হুঁ, তা হলে, তাই তো। খোকা যাক, বলে আসুক বাবুকে, অন্য লোক দেখুন ওঁরা।

হৈম বলিল, দেখ জ্বালিও না আমাকে। যাও, বলছি, যাও।

চক্রবর্তী আবার অন্ধকারের মধ্যে বাবুদের বাড়ির দিকে চলিল।

মধ্যরাত্রে জমিদার-বাড়ি শঙ্খধ্বনিতে মুখরিত হইয়া উঠিল। শিবরাণী একটি পুত্রসন্তান প্রসব করিয়াছে।

পূর্ব হইতে ডাক্তার আসিয়া উপস্থিত ছিল, সে-ই যতদূর সম্ভব সাবধানতা অবলম্বন করিয়া নাড়ী কাটিল। গরম জলে শিশুর শরীরের ক্লেদাদি ধুইয়া মুছিয়া দাইয়ের কোলে শিশুটিকে সমর্পণ করিয়া সে যখন বিদায় হইল, তখন রাত্রি প্রায় শেষ হইয়াছে।

প্রভাতে চক্রবর্তী বাড়ি আসিতেই হৈম বলিল, ওগো ছেলেটার ভোররাত্রে যেন জ্বর হয়েছে মনে হচ্ছে।

চক্রবর্তী চমকিয়া উঠিল, বলিল, হুঁ, তা—

অবশেষে অনুযোগ করিয়া বলিল, বললাম তখন, যাব না আমি। তা তুমি একেবারে আগুন হয়ে উঠলে? কীসে যে কী হয়—হুঁ।

হৈম বলিল, ও কিছু না, আপনি সেরে যাবে। এখন পওয়া-টাকের সাবু কি দুধ যদি একটু পাও তো দেখ দেখি। আমাকে কাটলেও তো এক ফোঁটা দুধ বেরুবে না।

পয়সা ছিল না, চক্রবর্তী প্রাতকৃত্য সারিয়া বাবুদের বাড়ির দিকেই চলিল, দুধের জন্য। কাছারি-বাড়িতে ঘটি হাতে দাঁড়াইয়া সে বাবুকে খুঁজিতেছিল। বাবু ছিল না। লোকজন সব ব্যস্ত-সমস্ত হইয়া চলাফেরা করিতেছে। কেহ চক্রবর্তীকে লক্ষ্যই করিল না।

খানসামাটা বাড়ির ভিতর হইতে বাহির হইয়া কোথায় যাইতেছিল, সে চক্রবর্তীকে লক্ষ্য করিয়া বলিল, আজ আর পেসাদ-টেসাদ মিলবে না ঠাকুর; যাও, বাড়ি যাও।

চক্রবর্তী ম্লান মুখে ধীরে ধীরে বারান্দা হইতে নামিয়া আসিল। একজন নিম্নশ্রেণীর ভৃত্য একটা আড়াল দেখিয়া বসিয়া তামাক টানিতেছিল, চক্রবর্তী তাহাকেই জিজ্ঞাসা করিল, হ্যাঁ বাবা, ছেলের জন্যই গাই দোয়া হয়নি?

সে উত্তর দিল, কেন ঠাকুর, ধারসা খাবে নাকি? আচ্ছা পেটুক ঠাকুর যা হোক। না গাই দোয়া হয়নি, বাড়িতে ছেলের অসুখ; ওসব হবে না এখন, যাও।

শিশুর অসুখ বোধহয় শেষরাত্রেই আরম্ভ হইয়াছিল, কিন্তু বোঝা যায় নাই। সারা রাত্রিব্যাপী যন্ত্রণা ভোগ করিয়া শিবরাণীও এলাইয়া পড়িয়াছিল, রাত্রি জাগরণক্লিষ্টা দাইটাও ঘুমাইয়াছিল।

বেশ একটু বেলা হইলে শিবরাণী উঠিয়া বসিয়া ছেলে কোলে লইয়াই আশঙ্কায় চমকিয়া উঠিল। এ কী, ছেলে যে কেমন করছে! তাহার পূর্বের সন্তানগুলি তো এমন ভাবেই—। চোখের জলে শিবরাণীর বুক ভাসিয়া গেল। শিশুর শুভ্রপুষ্পতুল্য দেহবর্ণ যেন ঈষৎ বিবর্ণ হইয়া গিয়াছে।

শিবরাণী আর্তস্বরে ডাকিল, যমুনা, একবার বাবুকে ডেকে দে তো?

শ্যামাদাসবাবু আসিতেই সে বলিল, ডাক্তার ডাকাও, ছেলে কেমন হয়ে গেছে! সেই অসুখ।

শ্যামাদাসবাবু একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, দুর্গা, দুর্গা!

কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তিনি ডাক্তার আনিতে পাঠাইলেন। স্থানীয় ডাক্তার তৎক্ষণাৎ আসিল এবং তাহার পরামর্শমতো শহরেও লোক পাঠানো হইল বিচক্ষণ চিকিৎসকের জন্য। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল, শিবরাণীর আশঙ্কা সত্য; সত্যই শিশু অসুস্থ। ধীরে ধীরে শিশুর দেহবর্ণ হইতে আকৃতি পর্যন্ত যেন কেমন অস্বাভাবিক হইয়া আসিতেছে। এই সর্বনাশা রোগেই শিবরাণীর শিশুগুলি এমনই করিয়া সূতিকাগৃহে একে একে বিনষ্ট হইয়াছে।

অপরাহ্নে সদর হইতে বড় ডাক্তার আনিয়া শিশুকে কিছুক্ষণ দেখিয়া একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, চলুন আমার দেখা হয়েছে।

দাইটা বলিয়া উঠিল, ডাক্তারবাবু ছেলে—

তাহার প্রশ্ন শেষ হইবার পূর্বেই ডাক্তার বলিল, ওষুধ দিচ্ছি।

শ্যামাদাসবাবুর সঙ্গে ডাক্তার বাহির হইয়া গেল।

শ্যামাদাসবাবুর মাসীমা সূতিকাগৃহের সম্মুখে দাঁড়াইয়া দাইকে বলিলেন, কই ছেলে নিয়ে আয় তো দেখি।

ছেলের অবস্থা দেখিয়া তিনি একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, মা আমার কপাল রে! বলিয়া ললাটে করাঘাত করিলেন। ঘরের মধ্যে শিবরাণী ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিতেছিলেন।

মাসীমা আপন মনেই বলিলেন, আর ও বার করে দিতে হয়েছে। কী করেই বা বলি! আর পোয়াতীর কোলেই বা—

ডাক্তার শ্যামাদাসবাবুকে বলিল, কিছু মনে করবেন না শ্যামাদাসবাবু, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?

বলুন।

ডাক্তার শ্যামাদাসবাবুর যৌবনের ইতিহাস প্রশ্ন করিয়া বলিল, আমিও তাই ভেবেছিলাম। ওই হল আপনার সন্তানদের অকালমৃত্যুর কারণ।

তা হলে ছেলেটা কি—

না, আশা আমি দেখি না!—বলিয়া বিদায় লইল।

শ্যামাদাসবাবু বাড়ির মধ্যে আসিতেই মাসীমা আপনার মনের কথাটা ব্যক্ত করিয়া বলিলেন, নইলে কি পোয়াতীর কোলে ছেলে মরবে। সে যে দারুণ দোষ হবে বাবা। আচার-আচরণগুলো মানতে হবে তো—

আচার রক্ষা করিতে হইলে বিচার করার কোনো প্রয়োজন হয় না! এবং হিন্দুর সংসারে আচারের উপরেই নাকি ধর্ম প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং শিবরাণীর কোল শূন্য করিয়া দিয়া শিশুকে সূতিকাগৃহের বাহিরে বারান্দায় মৃত্যু-প্রতীক্ষায় শোয়াইয়া দেওয়া হইল। তাহার কাছে রহিল দাই এবং প্রহরায় রহিল ব্রাহ্মণ, আর মাথার শিয়রে রহিল দেবতার নির্মাল্যের রাশি। ঘরের মধ্যে পুত্রশোকাতুরা শিবরাণীর সেবা ও সান্ত্বনার জন্য রহিল যমুনা ঝি।

শ্রাবণের মেঘাচ্ছন্ন অন্ধকার রাত্রি। চক্রবর্তী বসিয়া ঘন ঘন তামাক খাইতেছিল। তাহাদের ঘরেও শিশুটি অসুস্থ! কিন্তু সে সারিয়া উঠিবে। চক্রবর্তী মধ্যে মধ্যে আপন মনেই বিদ্রুপের হাসি হাসিতেছিল। সে ভাবিতেছিল, বিধিলিপি! তাহার শিশুটা মরিয়া যদি এটি বাঁচিত, তবে চক্রবর্তী অন্তত বাঁচিত। দশ বিঘা জমি আর সিংহবাহিনীর প্রসাদ নিত্য এক থালা। ভাগ্যের চিকিৎসা কি আর ডাক্তার করিতে পারে!

শিশুটি মধ্যে মধ্যে ক্ষীণ কন্ঠে অসহ্য যন্ত্রণায় আর্তনাদ করিতেছে।

চক্রবর্তী দাইটাকে বলিল, একটু জল-টল মুখে দেবে বাপু!

নিদ্রাকাতার দাইটা বলিল, জল কি খাবে গো ঠাকুর? তা বলছ, দিই। সে উঠিয়া ফোঁটা দুই জল দিয়া শিশুর অধর ভিজাইয়া দিল। তারপর শুইতে শুইতে বলিল, ঘুমোও ঠাকুর, তোমার কি আর ঘুম টুম নাই?

চক্রবর্তীর চক্ষে সত্য সত্যই ঘুম নাই। সে বসিয়া আকাশজোড়া অন্ধকারের দিকে চাহিয়া আপন ভাগ্যের কথা ভাবিতেছিল। তাহার ভাগ্যাকাশও এমনই অন্ধকার। আঃ, ছেলেটা যদি যাদুমন্ত্রে বাঁচিয়া ওঠে? চক্রবর্তী পৈতা ধরিয়া শিশুর ললাটখানি একবার স্পর্শ করিল।

অকস্মাৎ সে শিহরিয়া উঠিল। ভয়ে সর্বাঙ্গ তাহার থরথর করিয়া কাঁপে।

না, না, সে হয় না; জানিতে পারিলে সর্বনাশ হইবে। দেখিতে দেখিতে তাহার সর্বাঙ্গ ভিজিয়া উঠিল। সে আবার তামাক খাইতে বসিল।

দাইটা নাক ডাকাইয়া ঘুমাইতেছে। ঘরের মধ্যেও শিবরাণীর মৃদু ক্রন্দনধ্বনি আর শোনা যায় না। কলিকার আগুনে ফুঁ দিতে দিতে চক্রবর্তী আবার চঞ্চল হইয়া উঠিল; জ্বলন্ত অঙ্গারের প্রভায় চোখের মধ্যেও যেন আগুন জ্বলিতেছে।

উঃ, চিরদিনের জন্য তাহার দুঃখ ঘুচিয়া যাইবে! এ শিশুর প্রভাত হইতেই বিকৃত মূর্তি, তাহার শিশুও কুৎসিত নয়, দরিদ্রের সন্তান হইলেও, জননীর কল্যাণে সে রূপ লইয়া জন্মিয়াছে। সমস্ত সম্পত্তি তাহার সন্তানের হইবে! উঃ।

পাপ যেন সম্মুখে অদৃশ্য কায়া লইয়া দাঁড়াইয়া তাহাকে ডাকিতেছিল। গভীর অন্ধকারের মধ্যেও আলোকিত উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ চক্রবর্তীর চোখের সম্মুখে ঝলমল করিতেছে। চক্রবর্তী উঠিয়া দাঁড়াইল। শিশুর নিকট আসিয়া কিন্তু আবার তাহার ভয় হইল। কিন্তু সে এক মুহূর্ত। পরমুহূর্তে সে মৃতপ্রায় শিশুকে বস্ত্রাবৃত করিয়া লইয়া খিড়কির দরজা দিয়া সন্তর্পণে বাহির হইয়া পড়িল।

অদ্ভুত, সে যেন চলিয়াছে অদৃশ্য বায়ুপ্রবাহের মতো—নিঃশব্দ, দ্রুতগতিতে। অন্ধকার পথেও আজ সরীসৃপ, কীট, পতঙ্গ, কেহ তাহার সম্মুখে দাঁড়াইতে সাহস করে না, তাহারও সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নাই। ভাঙা ঘর। চারিদিকে প্রাচীরও সর্বত্র নাই। হৈমের সূতিকাগৃহের দরজাও নাই, একটা আগড় দিয়া কোনোরূপে আগলানো আছে। হৈমও গাঢ় নিদ্রায় আচ্ছন্ন।

চক্রবর্তী আবার বাতাসের মতো লঘু ক্ষিপ্রগতিতে ফিরিল।

দাইটা তখনও নাক ডাকাইয়া ঘুমাইতেছে।

রোগগ্রস্ত শিশু, মৃত্যু-রোগগ্রস্ত নয়। সে থাকিতে থাকিতে অপেক্ষাকৃত সবল ক্রন্দনে আপনার অভিযোগ জানাইল। দাইটার কিন্তু ঘুম ভাঙ্গিল না। চক্রবর্তী ঘুমের ভান করিয়া কাঠ মারিয়া পড়িয়া রহিল।

শিশু আবার কাঁদিল।

ঘরের মধ্যে শিবরাণীর অস্ফুট ক্রন্দন এবার যেন শোনা গেল।

শিশু আবার কাঁদিল।

এবার যমুনা ঈষৎ দরজা খুলিয়া বলিল, দাই, ও দাই। ওমা নাক ডাকছে যে। ঠাকুরও দেখছি মড়ার মতো ঘুমিয়েছে। ও দাই!

দাইটা ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিল। যমুনা বলিল, এই বুঝি তোর ছেলে আগলানো! ছেলে যে কাতরাচ্ছে, মুখে একটু করে জল দে।

দাইটা তাড়াতাড়ি শিশুর মুখে জল দিল, শুষ্ক কণ্ঠে শিশু চাটিয়া জলটুকু পান করিয়া আবার যেন চাহিল। দাই আবার জল দিল।

এবার সে আগ্রহে বলিয়া উঠিল, ওগো জল খাচ্ছে গো ঠোঁট চেটে চেটে।

শিবরাণী দুর্বল দেহে উঠিয়া পড়িয়া বলিল, নিয়ে আয়, ঘরে নিয়ে আয় আমার ছেলে, কারও কথা আমি শুনব না।

প্রভাতে আবার লোক ছুটিল সদরে। এবার অন্য ডাক্তার আসিবে। মৃত্যুদ্বার হইতে শিশু ফিরিয়াছে। দেবতার দান, ব্রাহ্মণের প্রসাদ। চক্রবর্তী নাকি আপন শিশুর পরমায়ু রাজার শিশুকে দিয়াছে। হতভাগ্যের সন্তান মারা গিয়াছে।

প্রায়ান্ধকার সূতিকা-গৃহে শিবরাণীর জ্বর-কাতর শিশুকে কোলে করিয়া বসিয়া আছে। তাহার ভাগ্য-দেবতা, তাহার হারানো মাণিক!

দশ বিঘা জমি চক্রবর্তী পাইল। সিংহবাহিনীর প্রসাদ এক থালা করিয়া নিত্য সে পায়। হৈম অপেক্ষাকৃত শান্ত হইয়াছে। কিন্তু চক্রবর্তী সেই তেমনি করিয়াই বেড়ায়।

লোকে বলে, স্বভাব যায় না মলে।

চক্রবর্তী বলে, হুঁ, তা বটে। কিন্তু ছেলের দল দেখেছ, এক একটা ছেলে যে একটা হাতির সমান।

হৈম ছেলেগুলিকে ইস্কুলে দিয়াছে। বড় ছেলেটি এখন ইতরের মতো কথা বলে না, কিন্তু বড় বড় কথা বলে, বাবার ব্যবহারে ইস্কুলে আমার মুখ দেখানো ভার মা। ছেলেরা যা-তা বলে। কেউ বলে, ভাঁড়ের বেটা খুরি। তুমি বাপু বারণ করে দিও বাবাকে।

হৈম সে কথা বলিতেই চক্রবর্তী সহসা যেন আগুনের মতো জ্বলিয়া উঠিল। তাহার অস্বাভাবিক রূপ দেখিয়া হৈমও চমকিয়া উঠিল।

চক্রবর্তী বলিল, চলে যাব আমি সন্ন্যাসী হয়ে।

ব্যাপারটা আরও অগ্রসর হইত। কিন্তু বাহির হইতে কে ডাকিল, চক্রবর্তী?

কী?

বাঁড়ুজ্জেরা পাঠালে হে। ওদের মেয়ের বাড়ি তত্ব যাবে, তোমাকে সঙ্গে যেতে হবে; ওরা কেউ যেতে পারবে না। লাভ আছে হে, ভাল-মন্দ খাবে, বিদেয়টাও পাবে।

আচ্ছা, চল যাই।

চক্রবর্তী বাহির হইয়া পড়িল। বাঁড়ুজ্জেদের বাড়ি গিয়া যেখানে মিষ্টি তৈয়ারী হইতেছিল, সেখানে চাপিয়া বসিয়া বলিল, ব্রাহ্মণস্য ব্রাহ্মণং গতি। হুঁ, তা যেতে হবে বইকি। উনোনের আঁচটা একটু ঠেলে দিই, কী বল মোদক মশায়?

সে সতৃষ্ণ নয়নে কড়াইয়ের পাকের দিকে চাহিয়া রহিল।

বৎসর দশেক পর শিবরাণী হঠাৎ মারা গেল। লোকে বলিল, ভাগ্যবতী। স্বামীপুত্তুর রেখে ডঙ্কা মেরে চলে গেল।

শ্যামাদাসবাবু শ্রাদ্ধোপলক্ষে বিপুল আয়োজন আরম্ভ করিলেন। চক্রবর্তীর এখন ওইখানেই বাসা হইয়াছে। সকালবেলাতেই ঠুকঠুক করিয়া গিয়া হাজির হয়, বসিয়া বসিয়া আয়োজনের বিলি-বন্দোবস্ত দেখে, মধ্যে মধ্যে ব্রাহ্মণ-ভোজনের আয়োজন সম্বন্ধে দুই একটা কথা বলে।

সেদিন বলিল, হুঁ, ছাঁদা একটা করে তো দেওয়া হবে। তা তোমার লুচিই বা কখানা আর তোমার মিষ্টিই বা কী রকম হবে?

একজন উত্তর দিল, হবে হবে। একখানা করে লুচি, এই চালুনের মতো। আর মিষ্টি একটা করে, তোমার লেডিকেনি, এই পাশ-বালিশের মতো, বুঝলে!

সকলে মৃদু মৃদু হাসিতে আরম্ভ করিল। শ্যামাদাসবাবু ঈষৎ বিরক্ত হইয়া বলিলেন, একটু থাম তো সব। হ্যাঁ, কী হল, পাওয়া গেল না?

একজন কর্মচারীর সঙ্গে তিনি কথা কহিতেছিলেন। কর্মচারীটি বলিল, আজ্ঞে, তাদের বংশই নির্বংশ হয়ে গিয়েছে।

তা হলে অন্য জায়গায় লোক পাঠাও। অগ্রদানী না হলে তো শ্রাদ্ধ হয় না।

আচ্ছা, তাই দেখি। অগ্রদানী তো বড় বেশী নেই, দশ-বিশ ক্রোশ অন্তর একঘর আধঘর।

কে একজন বলিয়া উঠিল, তা আমাদের চক্রবর্তী রয়েছে। চক্রবর্তী, নাও না কেন দান, ক্ষতি কী? পতিত করে আর কে কী করবে তোমার?

শ্যামাদাসবাবুও ঈষৎ উৎসুক হইয়া বলিয়া উঠিলেন, মন্দ কী চক্রবর্তী, শুধু দান সামগ্রী নয়, ভূ-সম্পত্তিও কিছু পাবে, পঁচিশ বিঘে জমি দেব আমি, আর তুমি যদি রাজী হও, তবে বছরে পঞ্চাশ টাকা জমিদারী সম্পত্তির মুনাফা দেব আমি, দেখ।—বলিয়াই তিনি এদিক-ওদিক চাহিয়া চাকরকে ডাকিলেন, ওরে চক্রবর্তীকে জলখাবার এনে দে। কলকাতার মিষ্টি কী আছে নিয়ে আয়।

শ্রাদ্ধের দিন সকলে দেখিল, শ্যামাদাসবাবুর বংশধর শিবরাণীর শ্রাদ্ধ করিতেছে, আর তাহার সম্মুখে অগ্রদান গ্রহণ করিবার জন্য দীর্ঘ হস্ত প্রসারিত করিয়া বসিয়া আছে পূর্ণ চক্রবর্তী।

তারপর গোশালায় বসিয়া তাহারই হাত হইতে গ্রহণ করিয়া চক্রবর্তী গোগ্রাসে পিণ্ড ভোজন করিল।

গল্পের এখানেই শেষ, কিন্তু চক্রবর্তীর কাহিনী এখানে শেষ নয়। সেটুকু না বলিলে অসম্পূর্ণ থাকিয়া যাইবে।

লোভী, আহার-লোলুপ চক্রবর্তী আপন সন্তানের হাতে পিণ্ড ভোজন করিয়াও তৃপ্ত হয় নাই। লুব্ধ দৃষ্টি, লোলুপ রসনা লইয়া সে তেমনই করিয়া ফিরিতেছিল। এই শ্রাদ্ধের চৌদ্দ বছর পরে সে একদিন শ্যামাদাসবাবুর পায়ে আসিয়া গড়াইয়া পড়িল। শ্যামাদাসবাবু তাঁহার দুই বৎসরের পৌত্রকে কোলে লইয়া শুষ্ক অশ্বত্থ তরুর মতো দাঁড়াইয়া ছিলেন।

চক্রবর্তী তাঁহার পা দুইটি জড়াইয়া ধরিয়া বলিল, পারব না বাবু, আমি পারব না।

শ্যামাদাসবাবু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, না পারলে উপায় কী চক্রবর্তী? আমি বাপ হয়ে তার শ্রাদ্ধের আয়োজন করেছি, কচি মেয়ে—তার বিধবা স্ত্রী শ্রাদ্ধ করতে পারবে, আর তুমি পারবে না, বললে চলবে কেন, বল? দশ বিঘে জমি তুমি এতেও পাবে।

শ্যামাদাসবাবুর বংশধর শিশু-পুত্র ও পত্নী রাখিয়া মারা গিয়াছে, তাহারই শ্রাদ্ধ হইবে।

চক্রবর্তী নিরুপায় হইয়া চলিয়া আসিল।

শ্রাদ্ধের দিন গোশালায় বসিয়া বিধবা বধূ পিণ্ডপাত্র চক্রবর্তীর হাতে তুলিয়া দিল।

পুরোহিত বলিল, খাও, হে চক্রবর্তী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *