2 of 2

অগ্নিশুদ্ধ – বিমল কর

অগ্নিশুদ্ধ – বিমল কর

 রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে চায়ের স্টলে আলাপ। পর-পর দিন-তিনেক চোখাচুখি হওয়ার পর একদিন ভদ্রলোক বললেন, ‘বেড়াতে এসেছেন বুঝি?’

বললাম, ‘হ্যাঁ।’

‘কোন বাড়িতে উঠেছেন?’

‘সুষমা লজে। বিনোদবাবুর বাড়ি।’

‘বুঝেছি। দত্তরায়ের বাড়ি। তেঁতুলগাছগুলোর কাছাকাছি, এল টাইপের বাড়ি, তাই তো?’

মাথা নাড়লাম।

ভদ্রলোক বললেন, ‘আমার নাম প্রমথ বকশি। এখানকার লোক আমায় হাবুলদা বলে ডাকে। হাবুল আমার ডাকনাম। আমি এখানকার লোকাল লোক।’

এক-একজন মানুষ আছে যাদের দেখলে শিষ্ট ভদ্রজন বলে মনে হয়। প্রমথবাবুকে আমার সেইরকম লেগেছিল। বয়েস পঞ্চাশের ওপরেই হবে। পঞ্চান্নর তলায়। ছিপছিপে গড়ন। মাথার চুল বারোআনাই সাদা হয়ে গিয়েছে। এতটা সাদা না হলে পঞ্চাশের কাছাকাছি ফেলা যেত ভদ্রলোককে। মুখে বয়েসের তেমন কোনও ছাপ নেই। চোখে অবশ্য দোতলা চশমা।

‘একদিন আসুন না আমার বাড়ি,’ প্রমথবাবু বললেন।

‘যাব।’

‘যাব নয়, আসুন।…আমি থাকি আশ্রমের দিকে। আমার বাড়ির কোনও নাম নেই। আগে লোকে বকশিবাড়ি বলত, এখন বলে হাবুলবাবু কো কোঠি। চলে আসুন, কোনও অসুবিধে হবে না। আশ্রমের কাছে গিয়ে জিগ্যেস করবেন কাউকে, বলে দেবে। দেখবেন গেটের সামনে দুটো ইউকেলিপটাস গাছ আছে।’

আলাপ-পরিচয়ের প্রথম পর্ব সারা হয়ে গেলে আমরা দুজনে প্ল্যাটফর্মে খানিকটা পায়চারি করলাম। তখনই কথায়-কথায় জানালাম, আমি হাঁপানির রোগী। একসময় সেটা সেরে গিয়েছিল একরকম, বছর-দুই আগে আবার ভীষণ হয়ে দেখা দিল। তারপর মাঝে-মাঝেই ভোগাচ্ছে। ডাক্তাররা বলেছিল, কিছুদিন শুকনো জায়গায় বেড়িয়ে আসুন। পুজোর এই সময়টা ভালো।

তাই বিজয়া দশমী পর্যন্ত বাড়িতে কলকাতায় কাটিয়ে এখানে এসেছি, কালীপুজোর আগে-আগে ফিরব। সঙ্গে আমার স্ত্রী রয়েছেন। ছেলেমেয়ে দুজনই কলকাতায় তাদের ঠাকুমার সঙ্গে রয়েছে। মামারা দেখা-শোনা করছে সব।

প্রমথবাবু হেসে বললেন, ‘ছেলেমেয়েকে রেখে এলেন? ওরাই তো বেড়াবে।’

বললাম, ‘মেয়ে আসতে চেয়েছিল। ছেলে এল না। ছুটির পরই পরীক্ষা। তা ছাড়া মাকে একলা বাড়িতে রেখে আসি কেমন করে?’

‘তা ঠিক,’ প্রমথবাবু মাথা নাড়লেন।

আর খানিকটা পায়চারি সেরে প্রমথবাবু বিদায় নিলেন : ‘কালই আসুন। আসছেন তো? তাহলে সন্ধের চা আমার ওখানেই খাবেন। স্ত্রীকে নিয়ে আসবেন।’

সম্মতি জানালাম।

পরের দিন শেষ বিকালে বকশিবাড়িতে গিয়ে হাজির। তখন বিকেল বলে কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। চারদিক ঝাপসা। অন্ধকার হয়ে আসছিল তাড়াতাড়ি।

সঙ্গে পূর্ণিমা ছিল।

বাড়িটার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই পূর্ণিমা বলল, ‘এ কেমন বাড়ি গো?’

বাড়িটা অদ্ভুত নয়, কিন্তু তার ছাঁদ আলাদা। গোলমতন দেখতে। মাথায় খড়ের ছাউনি। পুরোনো হয়ে কালচে দাগ ধরেছে খড়ে। ঝাপসা অন্ধকারে কালোই দেখাচ্ছিল। সামনে, পাশে বাগান। কুয়োটাও দেখা যাচ্ছিল একপাশে।

একটা লোককে দেখতে পেয়ে বললাম, ‘বকশিবাবুকে বলো এক বাবু আর মা এসেছেন।’

লোকটা ভেতরে গিয়ে খবর দিতে-না-দিতেই প্রমথবাবু বেরিয়ে এলেন : ‘আসুন, কৃষ্ণবাবু। আপনাদের কথাই ভাবছিলাম। আসুন, মিসেস রায়।’

পূর্ণিমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলাম প্রমথবাবুর।

উনি তামাশার গলায় বললেন, ‘একজন কৃষ্ণ, অন্যজন পূর্ণিমা—! এ যে একেবারে উলটো ব্যাপার।’

আমি হেসে বললাম, ‘আমি কেন কৃষ্ণ বুঝতেই পারছেন। আমার গায়ের রং আর ছাতার কাপড়ের রং প্রায় একইরকম।’

পূর্ণিমা কিছু বলল না, কিন্তু বুঝলাম—সে আড়চোখে আমায় দেখল।

প্রমথবাবু হেসে উঠলেন। জোরে নয়। বললেন, ‘খানিকটা বাড়াবাড়ি হল। আসুন, বসবেন চলুন।’

গোল বাড়ির নকশাটা বেশ। মনে হয়, বাড়ির মাথার ওপর যেন মস্ত একটা শামিয়ানা চাপানো। মানে, ওইরকম দেখতে খানিকটা। বারান্দার সবটাই ঢাকা। রোদ আসার অবশ্য অসুবিধে হয় না। জল-বৃষ্টিও আসে নিশ্চয়। তবু মাঝামাঝি জায়গাটায় বোধহয় রোদ-জল আসতে পারে না। সেখানে বসার ব্যবস্থা রয়েছে। বেতের চেয়ার-টেবিল। আলো দেওয়ালের দিকে। খড়খড়ি আর কাচের পাল্লা দেওয়া তিনটে দরজা তিন ঘরের। বারান্দার একদিকে পাখির খাঁচা। অন্যদিকে একটা কুকুর বাঁধা আছে।

কুকুরটা বারদুয়েক নিচু গলায় ডেকে থেমে গেল। বোধহয় বুঝল, আমরা প্রমথবাবুর অতিথি। হাঁকডাকের দরকার নেই।

‘বসুন, মিসেস রায়। আপনি বসুন, কৃষ্ণবাবু।’

আমরা বসলাম।

বাতি জ্বালিয়ে দিলেন প্রমথবাবু, বললেন, ‘আলো জ্বালালাম। কিন্তু কতক্ষণ জ্বলবে বলতে পারছি না। আপনাদের কলকাতার চেয়েও খারাপ অবস্থা।’

কথাটা একরকম ঠিকই। এখানে ইলেকট্রিসিটি আসে আর যায়। কখন যে আসে, কখন যায়, বোঝাই যায় না। শুনেছি, জঙ্গল-টঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বিদ্যুতের তার এসেছে বলে ঝড়ে-জলে প্রায়ই তার গন্ডগোল হয়। সঠিক জানি না।

‘আপনি বসবেন না?’

‘বসব।…ভেতরে একবার খবর দিয়ে আসি।’

আমি পূর্ণিমার দিকে তাকালাম। অর্থাৎ, সে কি ভেতরে গিয়ে প্রমথবাবুর স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করতে চায়?

পূর্ণিমা কিছু বলল না।

প্রমথবাবু চলে গেলেন।

পূর্ণিমা বলল, ‘অনেক পুরোনো বাড়ি, তাই না?’

‘পুরোনো তো নিশ্চয়।’

‘কী করেন ভদ্রলোক?’

‘তা জানি না।’

‘অনেক গাছপালা রেখেছেন বাড়ির চারদিকে।’

‘এতটা জায়গা, ভালোই তো।’

‘ভদ্রলোককে অনেকটা আমাদের বিজয়দার মতন দেখতে।’

‘বিজয়দার সঙ্গে মুখের মিল আছে খানিকটা। তুমি ঠিক ধরেছ।’

আমরা আরও দু-চারটে কথা বলছিলাম, প্রমথবাবু ফিরে এলেন।

‘আমার স্ত্রী চায়ের ব্যবস্থা করে আসছেন,’ প্রমথবাবু বললেন। বলে বসলেন একটা চেয়ারে। পূর্ণিমার দিকে তাকালেন, ‘জায়গাটা কেমন লাগছে মিসেস রায়ের?’

পূর্ণিমা হাসির মুখ করল : ‘ভালো।’

‘ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আনলে পারতেন!’

‘এল না।’

‘শুনলাম কৃষ্ণবাবুর মুখে।’

সাধারণ দু-দশটা কথা বলতে-বলতে কখন সন্ধে হয়ে গিয়েছে। অন্ধকার। শীত নয়, তবু শিরশিরে এক ঠান্ডা ভাব হয়েছিল। প্রমথবাবু বাড়িটার কথা বলছিলেন। তাঁর বাবা শখ করে করিয়েছিলেন। তখন এদিকে ঘরবাড়ি ছিল না এরকম, দু-একটা মাত্র। তা বাড়িটা পঞ্চাশ বছর হতে চলল।

এমনসময় সেই লোকটা এসে কিছু বলল। প্রমথবাবু ভেতরে চলে গেলেন। পূর্ণিমা নিচু গলায় বলল, ‘একটা জিনিস লক্ষ করেছ?’

‘কী?’

‘ভদ্রলোক আমায় যেন কেমন করে দেখছেন।’

আমার মজা লাগল : ‘তোমায় বোধহয় পছন্দ হয়েছে।’

‘যাঃ! বুড়ি হয়ে গেলাম।’

‘ভদ্রলোকও তো প্রায় বুড়ো।’

পূর্ণিমা বলল, ‘আমার কিন্তু ভালো লাগছে না।’

‘কেন?’

‘কী জানি! …তুমি আরও একটা জিনিস নজর করে দেখো, ভদ্রলোক মাঝে-মাঝেই কেমন শব্দ করে উঠছেন জিভের।’

অবাক হলাম : ‘তাই নাকি?’

‘আমার মনে হয়, উনি কোনও ব্যাপারে চঞ্চল হয়ে আছেন।’

হেসে ফেললাম। মেয়েদের সবতাতেই বাড়াবাড়ি।

প্রমথবাবু আবার এলেন : ‘উনি আসছেন।’

দরজার দিকে তাকালাম। উনি কোথায়! সেই লোকটাই আসছিল—হাতে ট্রে। ট্রের ওপর খাবারের প্লেট।

বেতের টেবিলে ট্রে নামিয়ে রাখল লোকটা।

প্রমথবাবু বললেন, ‘এসবই বাড়িতে তৈরি। নিমকি, মিষ্টি, আলুর চপ…।’

আমি ঠাট্টা করে বললাম, ‘প্রমথবাবু, আমাদের কিন্তু শুধু চা খেতে আসার কথা ছিল। এ তো একেবারে…।’

‘আরে না-না, দুটো নিমকি তো মাত্র। আপনারা বাড়িতে এসেছেন। কেউ তো আসে না।’

‘ভুল করে,’ আমি তামাশার গলায় বললাম, ‘এমন সুখাদ্য…।’

কথা আমার শেষ হল না, দেখি মাঝ-দরজার সামনে এক মহিলা।

দেখামাত্র কেমন চমকে গেলাম। ভ্রম না অন্য কিছু? আশ্চর্য দৃশ্য! কালো পাতলা শাড়ি, কালো জামা পরা এক মহিলা। মাথার চুল ধবধবে সাদা। মেয়েদের তুলনায় অস্বাভাবিক লম্বা মাথায়। রোগা। বড় তীক্ষ্ন নাক-মুখ। চোখদুটো যেন সে তুলনায় নিষ্প্রভ।

পূর্ণিমার দিকে একবার তাকালাম। সে অবাক হয়ে মহিলাকে দেখছে।

প্রমথবাবু বললেন, ‘এসো লতিকা, তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দি। ইনি কৃষ্ণবাবু, আর উনি কৃষ্ণবাবুর স্ত্রী।’

আমরা দুজনেই হাত তুলে নমস্কার করলাম।

আমাদের নমস্কারের বদলে লতিকা হাত তুললেন না। ধীরে-ধীরে এগিয়ে এলেন।

কালো পোশাক, সাদা চুল, অমন তীক্ষ্ন চেহারা—আমার যেন কেমন অস্বস্তি লাগছিল। প্রমথবাবু লতিকাকে বসতে বললেন। বসলেন মহিলা। বসে কয়েক পলক আমাদের দুজনকে দেখলেন। তারপর হাত বাড়িয়ে খাবারের প্লেট তুলে দিলেন আমাদের।

ব্যাপারটা বুঝতে পারছিলাম না। মহিলার মাথায় সিঁদুর নেই, কোনও অলঙ্কার নেই হাতে। গলাও পরিষ্কার।

পূর্ণিমা যেন আতঙ্ক বোধ করছিল।

‘নিন, খান। বাড়ির তৈরি খাবার,’ প্রমথবাবু বললেন।

আমি ক’টা কুচো নিমকি মুখে দিলাম। লতিকাকে বড় রহস্যময় মনে হচ্ছিল। উনি কোনও কথাও বলছেন না। বললাম, ‘আপনাদের বাড়িটা বেশ দেখতে। নতুন ধরন। কতদিনের বাড়ি?’

‘পঞ্চাশ বছর প্রায়,’ প্রমথবাবু বললেন, ‘বাবা করেছিলেন। শৌখিন মানুষ ছিলেন। যখন বাড়ি করেন তখন এদিকে কোনও বাড়ি ছিল না।’

‘বাড়ির মাথা পাকা করেননি?’

‘না। …আমাদের বংশে দুটো জিনিস করতে নেই। বাড়ির মাথায় আমরা খড় ছাড়া অন্য কিছু দিতে পারি না। অন্য কিছুই নয়।’

‘অদ্ভুত তো!’

‘হ্যাঁ। পাকা বাড়ির তলায় আমাদের থাকা বারণ।’

‘থাকলে কী হয়?’

‘বললে বিশ্বাস করবেন না।’

এমনসময় চা এল।

চা রেখে লোকটা চলে যাওয়ার পর লতিকা আমাদের সকলকে চা ঢেলে দিলেন, কিন্তু কথা বললেন না।

‘কী হয়, শুনি,’ আমি বললাম।

প্রমথবাবু মাথা নাড়লেন : ‘কী হবে শুনে?’

‘না, ব্যাপারটা কেমন অদ্ভুত তো, তাই বলছি।’

‘অদ্ভুতের কতটুকু আপনি জানেন, কৃষ্ণবাবু! সংসারে অদ্ভুত অনেক কিছু হয়।’

‘তা হয়। কিন্তু পাকা বাড়ি আর এই বাড়িতে কী হতে পারে?’

প্রমথবাবু কী যেন ভাবলেন, তারপর তাঁর স্ত্রীকে বললেন, ‘তোমার হাতদুটো দেখি।’ বলে নিজের হাত বাড়ালেন।

লতিকা কালো শাড়ির তলা থেকে তাঁর একটা হাত বার করে দিলেন। সেই হাতের দিকে তাকিয়ে আমার সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল। এমন হাত আমি দেখিনি জীবনে। হাড়, শিরা, উপশিরা একেবারে স্পষ্ট। তারচেয়েও বড় কথা, চামড়াটা একেবারে আগুনে ঝলসানো।

প্রমথবাবু বললেন, ‘এই হয়।’

আমি কিছু বুঝলাম না। পূর্ণিমা আঁতকে উঠেছিল। তার আর গলায় উঠছিল না কোনও খাবার।

প্রমথবাবু বললেন, ‘যদি শুনতে চান, বলতে পারি সংক্ষেপে।’

‘বলুন।’

প্রমথবাবু সামান্য সময় চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন, ‘আমার বাবা যে শৌখিন ছিলেন, আপনাকে বলেছি। কিন্তু তিনি সংস্কার-বিশ্বাসী ছিলেন। আমি যখন সাবালক, তখন তিনি মারা যান। আমি সেসময় ফরেস্টে কাজ করতাম। ফরেস্ট অফিসার।

‘বাবার অবর্তমানেই আমি বিয়ে করি। এই লতিকাকেই। লতিকা পাটনার মেয়ে।

‘বিয়ের পর ও বেশিরভাগ সময় পাটনাতে ওর বাপের বাড়িতেই থাকত। আর আমি সরকারি কাজে আজ এখানে, কাল ওখানে। মাঝে-সাঝে লতিকাকে নিয়ে যেতাম। তবে সেসব কোয়ার্টারে স্থায়ীভাবে থাকা যায় না।

‘বছর-তিনেক এইভাবে কাটল। শেষে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এখানে ট্রান্সফার নিলাম। আপনি বোধহয় জানেন না, এই অঞ্চলে রিজার্ভ ফরেস্ট তদারকি করার জন্যে একটা অফিস রয়েছে সদরে। আমি সেখানে ট্রান্সফার নিয়ে এলাম।

‘এই বাড়িটা তখন মেরামতের দরকার হয়ে পড়ল। আমি ঠিক করেছিলাম, নিজের বাড়িতেই স্ত্রী নিয়ে থাকব, আর আমি যাব মোটরবাইকে বা জিপে। মাইল-সাতেক তো পথ।

‘বাড়িটা যখন মেরামতে হাত দিলাম, লতিকা তখন পাটনায়। ওর ইচ্ছে, আমি বাড়িটার মাথায় আজকালকার মতন ঢালাই করে নি। খড়ের বাড়ি ওর ভালো লাগে না। ওর কথাতেই বাড়ির মাথায় কড়ি-বরগা চাপালাম। ঢালাইয়ের অসুবিধে ছিল। পুরোনো কড়ি-বরগা দেওয়া বাড়ি আপনি নিশ্চয় দেখেছেন।

‘মাস-তিনেক লাগল বাড়ি মেরামত আর ছাদ নতুন করে করতে। তারপর লতিকাকে নিয়ে এলাম। যেদিন ও এল সেদিনই আমার বোঝা উচিত ছিল, আমি ভুল করেছি। বুঝিনি। গা করিনি। তিনদিনের মাথায় মাঝরাতে—আমরা যখন ঘুমোচ্ছি, কেমন করে যে ঘরে আগুন লাগল জানি না। কোনও কারণ ছিল না আগুন লাগার। সেই আগুনে লতিকা পুড়ল। তাকে আমি হাজার চেষ্টা করেও আগুনের হাত থেকে বাঁচাতে পারলাম না। তবে প্রাণে বাঁচালাম। সত্যি বলতে কী, কৃষ্ণবাবু, ওর মুখটুকু বাদ দিলে শরীরের আর এমন কোনও জায়গা নেই যেখানে না-ঝলসানোর দাগ আছে। পেটের কাছটা কোনওরকমে বেঁচে গিয়েছিল। নয়তো ও মারা যেত।

‘সাত-আটমাস পরে আবার ওকে এ-বাড়িতে নিয়ে এলাম। কিন্তু ততদিনে এই বাড়ির মাথার ওপর আবার খড় চেপেছে। আপনি হয়তো বলবেন, এটা আমার কুসংস্কার। হয়তো তাই! তবু আমি আর পাকা ছাদের বাড়ির তলায় থাকতে রাজি নই।’

আমাদের চা খাওয়া শেষ হয়েছিল। সিগারেট ধরালাম।

‘আপনি কি সত্যিই বিশ্বাস করেন, আগুনটা লাগার কোনও কারণ ছিল না?’

‘হ্যাঁ করি,’ প্রমথবাবু বললেন, ‘এখানে তখন ইলেকট্রিক ছিল না। আমরা কেরোসিনের বাতি ব্যবহার করতাম। ইলেকট্রিক লাইনের দোষে আগুন লাগবে—তা সম্ভব ছিল না। কোনও কেরোসিন-বাতি জ্বলছিল না আমাদের শোওয়ার ঘরে। আগুনটা কেমন করে লাগবে, বলুন?’

‘সিগারেট বা…।’

‘আমি সিগারেট খাই না।’

‘অন্য কেউ যদি লাগিয়ে দেয়?’

‘অসম্ভব। আমার কোনও শত্রু নেই।’

আমার মুখে অন্য কোনও কথা আসছিল না।

প্রমথবাবু নিজেই একসময় বললেন, ‘সেই আগুন লাগার পর থেকে লতিকা কথা বলতে পারে না। ইশারায় কথা বলে। খুব ধীরে একটু আওয়াজ করে। আপনারা ওর ইশারা বা ওই শব্দের অর্থ বুঝবেন না। আমরা বুঝি।’

লতিকা যে কেন চুপ করে আছেন, এতক্ষণে বুঝতে পারলাম।

খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে প্রমথবাবু আবার বললেন, ‘অবশ্য সেই আগুন লাগার পর থেকে ওর একটা সিক্সথ সেন্স দেখা দিয়েছে। ও অনেক কিছু যেন দেখতে পায়—যা আমরা পারি না। দেখবেন?’ বলে ভদ্রলোক স্ত্রীর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে কিছু যেন জিগ্যেস করলেন।

ভদ্রমহিলা চোখ বুজলেন অল্পের জন্যে। তারপর কেমন গোঙানির শব্দ করে হাতের ইশারা করে কিছু বললেন।

প্রমথবাবু পূ)র্ণিমার দিকে তাকালেন ‘মিসেস রায়, একটা দুঃসংবাদ দি। আপনার ছেলে কলকাতার বাড়িতে হাত ভেঙে পড়ে আছে। আজ সকালেই ভেঙেছে। মারাত্মক কিছু নয়।’

পূর্ণিমা চমকে উঠল। সমস্ত মুখ ফ্যাকাশে।

লতিকা আবার কী বললেন। প্রমথবাবু শুনলেন কথাগুলো।

এবার আমার দিকে তাকিয়ে প্রমথবাবু বললেন, ‘কলকাতায় আপনার শোওয়ার ঘরের মাথার দিকে যে-ছবিটা আছে সেটা কি আপনার প্রথমা স্ত্রীর?’

আমার পায়ের তলার মাটি যেন সরে গেল। আমার প্রথমা স্ত্রী মাত্র ছ’মাস বেঁচেছিল। বছর-দুই পরে আমি পূর্ণিমাকে বিয়ে করি।

প্রমথবাবু হাসলেন যেন : ‘অগ্নিশুদ্ধ বলে একটা কথা আছে। লতিকার বোধহয় আগুনে পুড়ে আত্মাশুদ্ধি হয়েছে। ও এসব পারে। …যাক গে, আপনাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই।’

পরের দিন কলকাতার বাড়ি থেকে টেলিগ্রাম এল, ছেলে হাত ভেঙেছে সিঁড়ি থেকে পা পিছলে পড়ে।

ক্রাইম

পুজো সংখ্যা, ১৯৮২

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *