অগাধ জলের রুই-কাতলা – হেমেন্দ্রকুমার রায়
টেলিফোনের রিসিভারটা ধরে বিমল বললে, হ্যালো ! কে ? সুন্দরবাবু ? নমস্কার মশাই, নমস্কার! কি বলছেন ? আমাদের দরকার ? কেন বলুন দেখি ? পরামর্শ করবেন ? কিসের পরামর্শ ? রহস্যময় হত্যাকাণ্ড, আসামী নিরুদ্দেশ ? কিন্তু সে জন্যে আমাদের সঙ্গে পরামর্শ করে কি হবে বলুন, আমরা তো ডিটেকটিভ নই। আপনার ডিটেকটিভ বন্ধু জয়ন্তবাবুর কাছে যান না। তিনি অন্য একটা মামলা নিয়ে বাইরে গিয়েছেন ? ও ! আচ্ছা, আসতে ইচ্ছে করেন, আসুন,—কিন্তু আমরা বোধ হয় আপনার কোন কাজেই লাগব না, কারণ গোয়েন্দাগিরিতে আমরা হচ্ছি নিতান্ত গোলা ব্যক্তি, কিছুই জানি না বললেও চলে। কি বলছেন ? আমাদের ওপরে আপনার গভীর বিশ্বাস ? ধন্যবাদ⋯
এখানে এসে চা খাবেন ? বেশ তো ! গোটা-দুয়েক ‘এগ-পোচ’ পেলেও খুশি হবেন ? চারটে ‘পোচ্’ পেলেও আপত্তি করবেন না ? তথাস্তু !’ রিসিভারটি রেখে দিয়ে বিমল ফিরে বললে, ‘বাঘা, রামহরিকে ডেকে আন তো!’
বাঘা তখন উপর দিকে মুখ তুলে ল্যাজ নাড়তে নাড়তে ভাবছিল, দেওয়ালের গা থেকে ওই টিকটিকিটাকে কি উপায়ে টেনে নিচে নামানো যায়। বিমলের ফরমাশ শুনে সে তখনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মানুষের ছোট ছোট কোন কোন কথা কুকুর হলেও বাঘা বুঝতে পারত। যাঁরা কুকুর পোষেন, তাঁরাই এ কথা জানেন।
একটু পরেই বাইরে থেকে রামহরির গলা পাওয়া গেল—‘ছাড়, ছাড় । ওরে হতচ্ছাড়া, কাপড় যে ছিঁড়ে যাবে, এমন ছিনেজোঁক ধড়িবাজ কুকুর তো কখনো দেখিনি !’ তার পরেই দেখা গেল, রামহরির কোঁচার খুঁট কামড়ে ধরে বাঘা তাকে টানতে টানতে ঘরের ভিতরে এনে হাজির করলে।
রামহরি বললে, ‘খোকাবাবু, তুমিই বুঝি বাঘাকে আমার পিছনে লেলিয়ে দিয়েছ ?’
বিমল হেসে বললে, ‘লেলিয়ে দিইনি, তোমাকে ডেকে আনতে বলেছি। শোন রামহরি, মিনিট দশেকের মধ্যেই ইন্সপেক্টর সুন্দরবাবু এখানে এসে পড়বেন, তিনি তোমার হাতে তৈরি চা আর এগ্পোচের পরম ভক্ত ! অতএব বুঝেছ ?’
রামহরি ঘাড় নেড়ে বললে, ‘সব বুঝেছি !’
কুমার ঘরের এক কোণে বসে একখানা মাসিক পত্রিকার পাতা ওল্টাচ্ছিল। মুখ তুলে বললে, ‘আর বুঝেছ রামহরি, আমাদেরও, পেটে যে খিদে নেই এমন কথা জোর করে বলতে পারি না।’
রামহরি বললে, ‘সব বুঝেছি। তোমরা দুটিতেই যে বাঘার মতই পেটুক আমি তা খুব জানি। খাবারের নাম শুনলেই তোমাদের খিদে পায়।’
কুমার বললে, ‘খাবারের নাম তো দূরের কথা রামহরি, তোমার নাম শুনলেই আমাদের খিদেয় ঘুম ভেঙে যায়, বুঝেছ ?’
‘সব বুঝেছি। ভয় হয় এইবারে কোনদিন হয়তো আমাকেই গপ করে গিলে ফেলতে চাইবে—’ বলতে বলতে রামহরি বেরিয়ে গেল।
বিমল বললে, ‘কুমার, সেই ড্রাগনের দুঃস্বপ্নের মামলার পর থেকেই আমাদের উপর সুন্দরবাবুর বিশ্বাস খুব প্রবল হয়ে উঠেছে দেখছি। কি একটা হত্যাকাণ্ড তদ্বির করার ভার পড়েছে তাঁর উপর, তাই নিয়ে তিনি আমাদের সঙ্গে পরামর্শ করতে আসছেন।’
কুমার বললে, ‘হত্যাকাণ্ডটা নিশ্চয়ই রহস্যময়, নইলে পরামর্শের দরকার হত না।’
অল্পক্ষণ পরেই মোটরের ভেঁপুর আওয়াজ শুনে বিমল পথের ধারের জানলার কাছে গিয়ে দেখলে, গাড়ির ভেতর থেকে আত্মপ্রকাশ করছে সুন্দরবাবুর কাঁসার রেকাবির মত তেলা টাক এবং ধামার মত মস্ত ভুঁড়ি ।
বিমল হাঁকলে, ‘রামহরি, অতিথি দ্বারদেশে, তুমি প্রস্তুত হও।’
টেবিলের উপরে তখনও চা এবং খাবারের ধ্বংসাবশেষ পড়ে ছিল।
বিমল সোফার উপরে ভাল করে বসে বললে, ‘সুন্দরবাবু, এইবারে আপনার হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা শুরু করুন।’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘হুম, তাহলে শুনুন । যিনি খুন হয়েছেন, তাঁর নাম মোহনলাল বিশ্বাস । লোকটি খুব ধনী, আর তাঁর বয়স ষাটের কম নয়। তিনি নিজের বাড়িতে একলাই বাস করতেন, কারণ তাঁর স্ত্রী-পুত্র কেউ আর বেঁচে নেই। আত্মীয়ের মধ্যে কেবল এক ভাগিনেয়, তিনিই বর্তমানে তাঁর বিষয়ের উত্তরাধিকারী, তাঁর নাম ভূপতিবাবু। কিন্তু তিনিও মোহনবাবুর বাড়িতে থাকেন না ; তার প্রথম কারণ ভূপতিবাবু বেড়াতে আর শিকার করতে ভালবাসেন বলে আজ তিন বৎসর ধরে ভারতের নানা দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, কলকাতায় ভূপতিবাবুরও নিজের বাড়ি আছে। মোহনবাবুর বাড়ির পিছনেই একটি ষাট-পঁয়ষট্টি গজ লম্বা বাগান, তারপরেই ছোট রাস্তার উপরে ভূপতিবাবুর বাড়ি।
মাসখানেক আগে মোহনবাবু নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্ত হন। তাঁর অবস্থা এমন খারাপ হয়ে পড়ে যে, ভূপতিবাবুও খবর পেয়ে বিদেশ থেকে চলে আসেন। তিনি তখন রেঙ্গুনে ছিলেন।
তারপর কিন্তু মোহনবাবুর অবস্থা আবার ভালোর দিকে ফিরতে থাকে। ডাক্তারদের মতে, ভূপতিবাবুর আশ্চর্য সেবা-শুশ্রূষার গুণেই মোহনবাবুর অবস্থা হয় আবার উন্নত।
কিন্তু তাঁর যম তাঁকে ছাড়লে না, তাঁর কাল ফুরিয়েছিল । পরশুদিন দুপুর বেলায় মোহনবাবু দোতলার ঘরে বিছানার উপরে আধশোয়া অবস্থায় খবরের কাগজ পড়ছিলেন। ঘরের ভিতরে আর কেউ ছিল না।
পাশের ঘরে ছিল নার্স । মোহনবাবুর ঘরে ঢোকবার দরজা আছে একটিমাত্র। সেই দরজার সামনেই বারান্দার উপরে মাদুর বিছিয়ে বিশ্রাম করছিল বাড়ির পুরোন চাকর চন্দর। তাকে এড়িয়ে বা ডিঙিয়ে কোন লোকের ঘরের ভিতরে ঢোকবার উপায় ছিল না। সে ছেলেবেলা থেকে এই বাড়িতেই কাজ করছে। চন্দর এত বিশ্বাসী লোক যে, সকল রকম সন্দেহের অতীত।
ভূপতিবাবু তখন আহার ও বিশ্রাম করবার জন্যে নিজেদের বাড়িতে গিয়েছিলেন। বাড়ির সদর দরজায় ছিল দ্বারবান। সে বলে, বাইরে থেকে কোন লোক বাড়ির ভিতরে ঢোকেনি। চন্দর বলে সে সম্পূর্ণ সজাগ ছিল, বারান্দা দিয়ে কোন লোক তাকে পেরিয়ে ঘরের ভিতরে যায়নি।
বেলা তখন দেড়টা। ঘরের ভিতর থেকে মোহনবাবু হঠাৎ উচ্চস্বরে আর্তনাদ করে উঠলেন।
সেই চিৎকার শুনে পাশের ঘর থেকে নার্স ছুটে এল । চন্দরও ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল। তারপর তারা দুজনেই একসঙ্গে দরজা ঠেলে মোহনবাবুর ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়ল।
মোহনবাবুর মুখ দিয়ে তখন ফেণা উঠছে, আর গলা দিয়ে বেরুচ্ছে গোঁ-গোঁ আওয়াজ। দেখতে দেখতে তাঁর জ্ঞান লুপ্ত হয়ে গেল।
নার্স ও চন্দন দুজনেই নিশ্চিতভাবে বলেছে, ঘরের ভিতরে মোহনবাবু ছাড়া দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিল না।
খবর পেয়ে ভূপতিবাবু ও-বাড়ি থেকে ছুটে এলেন । তখনি ডাক্তারও এসে পড়লেন। কিন্তু তাঁর সামনেই অল্পক্ষণ পরে মোহনবাবুর মৃত্যু হল। ডাক্তারের মতে মৃত্যুর কারণ হচ্ছে, কোন রকম তীব্র বিষ।
অকারণে বিষের সৃষ্টি হয় না। মোহনবাবুর কাঁধের উপর বিদ্ধ হয়েছিল অদ্ভুত একটি অস্ত্র। এমন অস্ত্র আমি জীবনে দেখিনি। এটা যে বিষাক্ত, তাতে আর কোনই সন্দেহ নেই। এই দেখুন—’ বলে সুন্দরবাবু মোড়কের ভিতর থেকে সন্তর্পণে কাঠির মতন একটি জিনিস বের করলেন।
বিমল সাগ্রহে সেটিকে নিয়ে পরীক্ষা করতে লাগল। লম্বায় সেটি এক বিঘত । চওড়ায় নরুণের চেয়ে মোটা নয়। তার মুখটা তীক্ষ্ণ, আর একদিকে ইঞ্চিখানেক লম্বা একটি সোলার চোঙা বা নল বসানো।
বিমল বললে, ‘সুন্দরবাবু, এই কাঠিটি কোন্ কাঠ দিয়ে তৈরি, বুঝতে পেরেছেন?’
‘হুম, না !’
‘সাগু কাঠ দিয়ে।’
‘কাঠ-ফাঠ নিয়ে এখন আমার মাথা ঘামাবার সময় নেই। আমাদের এখন জানা দরকার, ওই বিষাক্ত কাঠের সূচ দিয়ে মোহনবাবুকে আঘাত করলে কে ? অস্ত্রটা তো আর আকাশ থেকে খসে পড়েনি ?’
কুমার বললে, ‘কার উপরে আপনার সন্দেহ হয় ?’
‘কপাল দোষে সন্দেহ করবার কোন লোকই পাচ্ছি না। ঘরের আশেপাশে হাজির ছিল কেবল দুজন লোক—নার্স আর চন্দর। কিন্তু মোহনবাবুকে খুন করবে তারা কোন্ উদ্দেশ্যে ? মোহনবাবুর ঘরের ভিতর থেকে টাকা বা কোন দামী জিনিসও চুরি যায়নি। তাঁর মৃত্যুতে তাদের কোনই লাভ নেই, বরং লোকসান আছে। মোহনবাবুর মৃত্যুর জন্যে লাভ হবে খালি ভূপতিবাবুর। কারণ তিনিই তাঁর বিশ লাখ টাকা দামের সম্পত্তির মালিক হবেন। কিন্তু তাঁর উপরেও সন্দেহ করবার উপায় নেই। কারণ প্রথমত, ঘটনার সময় তিনি যে নিজের বাড়িতে ছিলেন, এর প্রমাণ আমি পেয়েছি। দ্বিতীয়ত, দ্বারবানের চোখ এড়িয়ে এ-বাড়িতে, আর চন্দরের চোখ এড়িয়ে মোহনবাবুর ঘরে ঢোকা তাঁর পক্ষে অসম্ভব। তৃতীয়ত, তিনি যদি মোহনবাবুর মৃত্যু চাইতেন, তবে সেবা-শুশ্রূষা করে তাঁকে নিউমোনিয়ার কবল থেকে উদ্ধার করতেন না। চতুর্থত, মোহনবাবুর মৃত্যুতে তিনি এমন কাতর হয়ে পড়েছেন যে তা আর বলা যায় না । হুম, ভাল কথা। একটা কথা আপনাকে এখনও বলা হয়নি। ভূপতিবাবু অঙ্গীকার করেছেন, মোহনবাবুর হত্যাকারীকে যে ধরে দিতে পারবে, তাকে তিনি বিশ হাজার টাকা পুরস্কার দেবেন ! ’
বিমল বললে, ‘বলেন কি, বি-শ-হাজার টাকা ?’
‘হ্যাঁ। সেই জন্যেই তো মামলাটা নিয়ে এত বেশি মাথা ঘামাচ্ছি ! কিন্তু হায় রে, ব্যাপার যা দেখছি, হত্যাকারীর নাগাল পাওয়া একরকম অসম্ভব বললেও চলে। হুম, আমার কপাল বড় মন্দ !’
বিমল খানিকক্ষণ বসে রইল চুপচাপ। তার দৃষ্টি নিবদ্ধ সাগুকাঠের সেই কাঠিটির দিকে। তারপর সে বললে, ‘বিশ হাজার টাকা পুরস্কার ! এ লোভ সামলানো শক্ত। আচ্ছা, সুন্দরবাবু, এ বিষয় নিয়ে আমি ভূপতিবাবুর সঙ্গে কথাবার্তা কইতে চাই।’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘বেশ তো, এখনি আমার সঙ্গে চলুন না !’
ভূপতিবাবুর বাড়িখানি বড় নয়, কিন্তু দিব্য সাজানো-গুছানো।
তিনি বৈঠকখানাতেই বসেছিলেন। সুন্দরবাবু তাঁর সঙ্গে বিমল ও কুমারের পরিচয় করিয়ে দিলেন।
ভূপতিবাবুর বয়স পঁয়ত্রিশের বেশি হবে না, চেহারা লম্বা-চওড়া, রং ফর্সা, মুখশ্রী সুন্দর।
বিমল হাসিমুখে বললে, ‘আপনার বিশ হাজার টাকার গন্ধ পেয়ে আমরা এখানে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে এসেছি ।’
ভূপতিবাবু বললেন, ‘হ্যাঁ, হত্যাকারীকে কেউ ধরতে পারলেই ওই টাকা আমি উপহার দেব । এর মধ্যেই আমি বিশ হাজার টাকার একখানি চেক আমার এটনির কাছে জমা রেখেছি।’
বিমল নীরবে কৌতূহলী চোখে ঘরের সাজ-সজ্জা লক্ষ্য করতে লাগল। এ ঘরের ভিতরে এলেই বোঝা যায়, এর মালিক খুব শিকার-ভক্ত লোক। মেঝের উপরে বাঘ-ভাল্লুকের ছাল পাতা এবং দেয়ালের গায়ে টাঙানো রয়েছে বুনো মোষ আর হরিণের মাথা বা শিং এবং হরেক রকম ধনুক, তরবারি, বর্শা প্রভৃতি অস্ত্রশস্ত্র ।
বিমল বললে, ‘আপনি কি শিকার করতে খুব ভালবাসেন ?’
ভূপতিবাবু বললেন, ‘খুব—খুব বেশি ভালবাসি। শিকারের লোভে আমি কোথায় না গিয়েছি—আফ্রিকা, সুমাত্রা, জাভা, বোর্নিও, সিলোন, বর্মা কিছুই আর বাকি নেই । ওই যে সব অস্ত্রশস্ত্র দেখছেন, ওগুলি আমি নানান দেশ থেকে সংগ্রহ করে এনেছি।’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘হুম, আমিও শিকার করতে ভালবাসি । তবে আপনি করেন জন্তু শিকার, আর আমি করি মানুষ শিকার।’
বিমল বললে, ‘মোহনবাবুর বাড়ি এখান থেকে কোন দিকে ?’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘উত্তর দিকে। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখুন না, ওই যে বাগানের ওপারে ওই লাল বাড়িখানা। দোতলার ডানপাশে সব-শেষে যে ঘরখানা দেখছেন, ওই ঘরেই হতভাগ্য মোহনবাবুর মৃত্যু হয়েছে। মাঝখানের জানলার দিকে চেয়ে দেখুন, যে খাটে তিনি শুতেন, তারও খানিক অংশ এখান থেকে দেখতে পাবেন।’
ভূপতিবাবু দুঃখিত স্বরে বললেন, ‘ও-ঘরের দিকে তাকালেও আমার বুকটা হু-হু করে ওঠে! ’
বিমল সহানুভূতির স্বরে বললে, ‘এটা তো খুবই স্বাভাবিক ভূপতিবাবু। আপনি কি এই বাগান পেরিয়েই ওই বাড়িতে যেতেন ?’
‘না, ওর ভেতর দিয়ে যাবার কোন উপায় নেই। একে তো ওর চারদিকেই উঁচু পাঁচিল, তার উপরে ওটা হচ্ছে পরের বাগান! বাগানের ওপার থেকে ও-বাড়িতে ঢোকবার কোন দরজাও নেই।’
সুন্দরবাবু বিমলের দিকে ফিরে বললেন, ‘এখানে এসে বিশ হাজার টাকার পাকা খবরটা পেলেন তো ? এখন চলুন, আমার হাতে অনেক কাজ আছে।’
বিমল বললে, ‘হ্যাঁ, যাচ্ছি। ভূপতিবাবুর এই ঘরখানি আমার ভারি ভাল লাগছে—’ বলতে বলতে ও চারিদিকে তাকাতে তাকাতে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ে জিজ্ঞাসা করলে, ‘এই বর্শাটা কোন্ দেশের ভূপতিবাবু ?’
‘বোর্নিওর।’
বিমল হাত বাড়িয়ে বর্শাটা নামাতে গেল, কিন্তু ভূপতিবাবু শশব্যস্ত হয়ে বলে উঠলেন, ‘হাঁ, হাঁ, করেন কি, করেন কি ! ওর ফলায় বিষ আছে !’
কিন্তু বিমল ততক্ষণে বর্শাটা নামিয়ে নিয়েছে। সে শান্তভাবে বললে, ‘ভয় নেই, আমি খুব সাবধানেই এটা নাড়াচাড়া করব। কিন্তু এর ফলায় কী বিষ আছে ? ইপো-গাছের বিষ ?’
ভূপতিবাবু কিছুক্ষণ অবাক হয়ে বিমলের মুখের পানে তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে বললেন, ‘আপনি কি করে জানলেন ?’
সে কথার জবাব না দিয়ে বিমল বললে, ‘বর্শার ডাণ্ডিটা তো দেখছি জাজাং-কাঠে তৈরি।’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘হুম, এর ডাণ্ডিটা আবার ফাঁপা ! এর কারণ কি বিমলবাবু ?’
‘কারণ এর দ্বারা বর্শার কাজ চালানো গেলেও আসলে এটি বর্শা নয়, বোর্নিওয় একে কি বলে ডাকা হয় ভূপতিবাবু ?’
‘আমার মনে নেই।’
‘আমার মনে আছে। এর নাম হচ্ছে সুম্পিটান।’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘বাবা, কি বিচ্ছিরি নাম ! কিন্তু আপনি জানলেন কেমন করে ? আপনিও কি বোর্নিওয় গিয়েছিলেন ?’
‘গিয়েছিলুম। সুম্পিটান ব্যবহার করতেও শিখেছিলুম। এটা একবার ধরুন না, আপনাকেও এর ব্যবহার হাতে-নাতে শিখিয়ে দিচ্ছি।’
সুন্দরবাবু আঁতকে উঠে তাড়াতাড়ি ভুঁড়ি দুলিয়ে পিছিয়ে গিয়ে বললেন, ‘হুম, না, আমি ওর ব্যবহার-ট্যবহার শিখতে চাই না। শেষটা কি বিষ-টিষ লেগে খুন-টুন হব ? আপনি ও আপদ রেখে দিয়ে আসবেন তো আসুন ! আমার হাতে ছেলেখেলা করবার সময় নেই !’
‘আর একটু সবুর করুন সুন্দরবাবু, আপনাকে সুম্পিটানের বাহাদুরিটা না দেখিয়ে আমি এখান থেকে এক পা নড়ছি না ! হ্যাঁ, সাগু-কাঠের কাঠিটা আমাকে একবার দিন তো !’
সুন্দরবাবু কাঠিটা বিমলের হাতে দিয়ে আশ্চর্য স্বরে বললেন, ‘আপনার মতলবটা কি ?’
বিমল জবাব না দিয়ে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। সাগুকাঠের কাঠিটা আগে বর্শার ফাঁপা ডাণ্ডির গর্তের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলে। তারপর জানলা গলিয়ে ডাণ্ডিটাকে দুই হাতে তলার দিকে ধরে উঁচু করে ফেললে। তারপর ডাণ্ডির তলার দিক মুখে পুরে দুই গাল ফুলিয়ে খুব জোরে দিলে বিষম এক ফুঁ !
বাগানের ওপারে মোহনবাবুর বাড়ির ছাদের উপর একটা চিল চুপ করে বসেছিল। হঠাৎ সে ঘুরতে ঘুরতে ধুপ্ করে মাটির উপরে পড়ে গেল।
সুন্দরবাবু বিস্মিত স্বরে বললেন, ‘কোথাও কিচ্ছু নেই, খামোকা চিলটা পড়ে গেল কেন ?’
বিমল বর্শাটা নামিয়ে সহজভাবেই বললে, ‘আপনার সাগু-কাঠের কাঠিটা তার গায়ে গিয়ে বিঁধেছে। সুন্দরবাবু, সুম্পিটানের ইংরেজি নাম কি জানেন ? ‘ব্লো-পাইপ।’ বোর্নিওর লোকেরা ‘ব্লো-পাইপে’ বিষাক্ত কাঠি ঢুকিয়ে এইভাবে জন্তু বা শত্রু নিপাত করে। এই তীরকাঠির গতি বড় কম নয়, সত্তর গজ দূরেও সে মারাত্মক। বোর্নিওর কাঠিতে ইপো গাছের বিষ ব্যবহার করা হয়, কিন্তু আমার বিশ্বাস, এই কাঠিতে অন্য কোন রকম বেশি-তীব্র বিষ মাখানো হয়েছে।⋯আরে, আরে ভূপতিবাবু ! পায়ে পায়ে পিছু হটে কোথায় যাচ্ছেন ? আমি সুন্দরবাবুর সঙ্গে কথা কইছি বটে, কিন্তু ওই আরশিখানার দিকে চেয়ে আপনার ওপরেও সজাগ দৃষ্টি রেখেছি ! পালাবার চেষ্টা করবেন না, আমি বর্শা ছুঁড়লে আপনি মারা পড়তে পারেন। আপনার মত দুরাত্মা ছুঁচোকে মেরে আমি হাত গন্ধ করতে চাই না ! আসল ব্যাপার কি জানেন সুন্দরবাবু ? এই ভূপতি মোহনবাবুর লোক-দেখানো সেবা করেছিল, কারণ তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, তিনি এ-যাত্রা কিছুতেই রক্ষা পাবেন না। কিন্তু মোহনবাবু যখন আবার সামলে উঠে ভূপতির বিশ লক্ষ টাকার সম্পত্তি ফিরিয়ে নেবার যোগাড় করলেন, ভূপতি তখন মরিয়া হয়ে ‘ব্লো-পাইপে’র আশ্রয় নিতে বাধ্য হল। সে বোর্নিওয় গিয়ে এই অস্ত্রটি ব্যবহার করতে শিখেছিল। এখান থেকে খাটের উপর শয্যাশায়ী মোহনবাবুকে দেখা যায়। এখান থেকে পথের কাঁটা সরালে ভূপতিকে কেউ সন্দেহ করতে পারবে না, কারণ বাংলাদেশের পুলিশ ওই সাগু-কাঠের আসল রহস্য চিনবে কি করে ? অতএব সে নির্ভাবনায় করে বসল বিশ হাজার টাকার পুরস্কার ঘোষণা। ভূপতি হচ্ছে অগাধ জলের রুই-কাতলা। কিন্তু তার দুর্ভাগ্যক্রমে পুলিশ দৈবগতিকে ডেকে এনেছে জল-স্থল-শূন্যের পরিব্রাজক বিমল আর কুমারকে ! কাজে কাজেই ভূপতির পুরস্কারের ঘোষণা ব্যর্থ হল না, সে যখন ফাঁসিকাঠে দোললীলার সুখ উপভোগ করবে, তখন আপনি আর আমি করব বিশ হাজার টাকা আধাআধি ভাগ করে নেবার সাধু চেষ্টা ! কি বলেন ?’
সুন্দরবাবু পকেট থেকে হাতকড়া বার করে ভূপতির দিকে এগুতে এগুতে কেবল বললেন, ‘হুম !’
সুন্দরবাবুর এই বিখ্যাত ‘হুম’ হচ্ছে আশ্চর্য শব্দ। এর দ্বারা তিনি হাস্য, করুণ, রৌদ্র, অদ্ভুত ও শান্ত প্রভৃতির শাস্ত্রোক্ত নয় রকম রসেরই ভাব প্রকাশ করতে পারেন।