অগাধ জলের রুই-কাতলা

অগাধ জলের রুই-কাতলা

টেলিফোনের রিসিভারটা ধরে বিমল বলল, ‘হ্যালো! কে? সুন্দরবাবু? নমস্কার মশাই, নমস্কার! কী বলছেন? আমাদের দরকার? কেন বলুন দেখি? পরামর্শ করবেন? কীসের পরামর্শ? রহস্যময় হত্যাকাণ্ড, আসামি নিরুদ্দেশ? কিন্তু সে জন্যে আমাদের সঙ্গে পরামর্শ করে কী হবে বলুন, আমরা তো ডিটেকটিভ নই৷ আপনার ডিটেকটিভ বন্ধু জয়ন্তবাবুর কাছে যান না৷ তিনি অন্য একটা মামলা নিয়ে বাইরে গিয়েছেন? ও! আচ্ছা, আসতে ইচ্ছে করেন, আসুন,-কিন্তু আমরা বোধ হয় আপনার কোনো কাজেই লাগব না, কারণ গোয়েন্দাগিরিতে আমরা হচ্ছি নিতান্ত গোলা ব্যক্তি, কিছুই জানি না বললেও চলে৷ কী বলছেন? আমাদের ওপরে আপনার গভীর বিশ্বাস? ধন্যবাদ . . .

‘এখানে এসে চা খাবেন? বেশ তো! গোটা-দুয়েক এগ পোচ পেলেও খুশি হবেন? চারটে পোচ পেলেও আপত্তি করবেন না? তথাস্তু!’ রিসিভারটা রেখে দিয়ে বিমল ফিরে বলল, ‘বাঘা, রামহরিকে ডেকে আন তো!’

বাঘা তখন উপর দিকে মুখ তুলে ল্যাজ নাড়তে নাড়তে ভাবছিল, দেয়ালের গা থেকে ওই টিকটিকিটাকে কী উপায়ে টেনে নীচে নামানো যায়৷ বিমলের ফরমাশ শুনে সে তখনই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল৷ মানুষের ছোটো ছোটো কোনো কোনো কথা কুকুর হলেও বাঘা বুঝতে পারত৷ যাঁরা কুকুর পোষেন, তাঁরাই এ-কথা জানেন৷

একটু পরেই বাইরে থেকে রামহরির গলা পাওয়া গেল-‘ছাড়, ছাড়৷ ওরে হতচ্ছাড়া, কাপড় যে ছিঁড়ে যাবে, এমন চিনেজোঁক ধড়িবাজ কুকুর তো কখনো দেখিনি!’ তার পরেই দেখা গেল, রামহরির কোঁচার খুঁট কামড়ে ধরে বাঘা তাকে টানতে টানতে ঘরের ভিতরে এনে হাজির করল৷

রামহরি বলল, ‘খোকাবাবু, তুমিই বুঝি বাঘাকে আমার পিছনে লেলিয়ে দিয়েছ?’

বিমল হেসে বলল, ‘লেলিয়ে দিইনি, তোমাকে ডেকে আনতে বলেছি৷ শোনো রামহরি, মিনিট দশেকের মধ্যেই ইন্সপেক্টর সুন্দরবাবু এখানে এসে পড়বেন, তিনি তোমার হাতে তৈরি চা আর এগ পোচের পরম ভক্ত! অতএব বুঝেছ?’

রামহরি ঘাড় নেড়ে বলল, ‘সব বুঝেছি!’

কুমার ঘরের এক কোণে বসে একখানা মাসিক পত্রিকার পাতা ওলটাচ্ছিল৷ মুখ তুলে বলল, ‘আর বুঝেছ রামহরি, আমাদেরও পেটে যে খিদে নেই এমন কথা জোর করে বলতে পারি না৷’

রামহরি বলল, ‘সব বুঝেছি৷ তোমরা দুটিতেই যে বাঘার মতোই পেটুক আমি তা খুব জানি৷ খাবারের নাম শুনলেই তোমাদের খিদে পায়৷’

কুমার বলল, ‘খাবারের নাম তো দূরের কথা রামহরি, তোমার নাম শুনলেই আমাদের খিদেয় ঘুম ভেঙে যায়, বুঝেছ?’

‘সব বুঝেছি৷ ভয় হয় এইবারে কোনোদিন হয়তো আমাকেই গপ করে গিলে ফেলতে চাইবে-‘ বলতে বলতে রামহরি বেরিয়ে গেল৷

বিমল বলল, ‘কুমার, সেই ড্রাগনের দুঃস্বপ্নের মামলার পর থেকেই আমাদের উপর সুন্দরবাবুর বিশ্বাস খুব প্রবল হয়ে উঠেছে দেখছি৷ কী একটা হত্যাকাণ্ড তদবির করার ভার পড়েছে তাঁর উপর, তাই নিয়ে তিনি আমাদের সঙ্গে পরামর্শ করতে আসছেন৷’

কুমার বলল, ‘হত্যাকাণ্ডটা নিশ্চয়ই রহস্যময়, নইলে পরামর্শের দরকার হত না৷’

অল্পক্ষণ পরেই মোটরের ভেঁপুর আওয়াজ শুনে বিমল পথের ধারের জানলার কাছে গিয়ে দেখল, গাড়ির ভেতর থেকে আত্মপ্রকাশ করছে সুন্দরবাবুর কাঁসার রেকাবির মতো তেলা টাক এবং ধামার মতো মস্ত ভুঁড়ি৷

বিমল হাঁকল, ‘রামহরি, অতিথি দ্বারদেশে, তুমি প্রস্তুত হও৷’

টেবিলের উপরে তখনও চা এবং খাবারের ধ্বংসাবশেষ পড়ে ছিল৷

বিমল সোফার উপরে ভালো করে বসে বলল, ‘সুন্দরবাবু, এইবারে আপনার হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা শুরু করুন৷’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘হুম, তাহলে শুনুন৷ যিনি খুন হয়েছেন, তাঁর নাম মোহনলাল বিশ্বাস৷ লোকটি খুব ধনী, আর তাঁর বয়স ষাটের কম নয়৷ তিনি নিজের বাড়িতে একলাই বাস করতেন, কারণ তাঁর স্ত্রী-পুত্র কেউ আর বেঁচে নেই৷ আত্মীয়ের মধ্যে কেবল এক ভাগিনেয়, তিনিই বর্তমানে তাঁর বিষয়ের উত্তরাধিকারী, তাঁর নাম ভূপতিবাবু৷ কিন্তু তিনিও মোহনবাবুর বাড়িতে থাকেন না; তার প্রথম কারণ ভূপতিবাবু বেড়াতে আর শিকার করতে ভালোবাসেন বলে আজ তিন বৎসর ধরে ভারতের নানা দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন৷ দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, কলকাতায় ভূপতিবাবুরও নিজের বাড়ি আছে৷ মোহনবাবুর বাড়ির পিছনেই একটি ষাট-পঁয়ষট্টি গজ লম্বা বাগান, তারপরেই ছোটো রাস্তার উপরে ভূপতিবাবুর বাড়ি৷

‘মাসখানেক আগে মোহনবাবু নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্ত হন৷ তাঁর অবস্থা এমন খারাপ হয়ে পড়ে যে, ভূপতিবাবুও খবর পেয়ে বিদেশ থেকে চলে আসেন৷ তিনি তখন রেঙ্গুনে ছিলেন৷

‘তার পর কিন্তু মোহনবাবুর অবস্থা আবার ভালোর দিকে ফিরতে থাকে৷ ডাক্তারদের মতে, ভূপতিবাবুর আশ্চর্য সেবা-শুশ্রূষার গুণেই মোহনবাবুর অবস্থা হয় আবার উন্নত৷

‘কিন্তু তাঁর যম তাঁকে ছাড়ল না, তাঁর কাল ফুরিয়েছিল৷ পরশুদিন দুপুর বেলায় মোহনবাবু দোতলার ঘরে বিছানার উপরে আধশোয়া অবস্থায় খবরের কাগজ পড়ছিলেন৷ ঘরের ভিতরে আর কেউ ছিল না৷

‘পাশের ঘরে ছিল নার্স৷ মোহনবাবুর ঘরে ঢোকবার দরজা আছে একটিমাত্র৷ সেই দরজার সামনেই বারান্দার উপরে মাদুর বিছিয়ে বিশ্রাম করছিল বাড়ির পুরোনো চাকর, চন্দর৷ তাকে এড়িয়ে বা ডিঙিয়ে কোনো লোকের ঘরের ভিতরে ঢোকবার উপায় ছিল না৷ সে ছেলেবেলা থেকে এই বাড়িতেই কাজ করছে৷ চন্দর এত বিশ্বাসী লোক যে, সকলরকম সন্দেহের অতীত৷

‘ভূপতিবাবু তখন আহার ও বিশ্রাম করবার জন্যে নিজেদের বাড়িতে গিয়েছিলেন৷ বাড়ির সদর দরজায় ছিল দ্বারবান৷ সে বলে, বাইরে থেকে কোনো লোক বাড়ির ভিতরে ঢোকেনি৷ চন্দর বলে সে সম্পূর্ণ সজাগ ছিল, বারান্দা দিয়ে কোনো লোক তাকে পেরিয়ে ঘরের ভিতরে যায়নি৷

‘বেলা তখন দেড়টা৷ ঘরের ভিতর থেকে মোহনবাবু হঠাৎ উচ্চস্বরে আর্তনাদ করে উঠলেন৷সেই চিৎকার শুনে পাশের ঘর থেকে নার্স ছুটে এল৷ চন্দরও ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল৷ তারপর তারা দুজনেই একসঙ্গে দরজা ঠেলে মোহনবাবুর ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়ল৷

‘মোহনবাবুর মুখ দিয়ে তখন ফেনা উঠছে, আর গলা দিয়ে বেরোচ্ছে গোঁ-গোঁ আওয়াজ৷ দেখতে দেখতে তাঁর জ্ঞান লুপ্ত হয়ে গেল৷

‘নার্স ও চন্দর দুজনেই নিশ্চিন্তভাবে বলেছে, ঘরের ভিতরে মোহনবাবু ছাড়া দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিল না৷

‘খবর পেয়ে ভূপতিবাবু ও-বাড়ি থেকে ছুটে এলেন৷ তখনই ডাক্তারও এসে পড়লেন৷ কিন্তু তাঁর সামনেই অল্পক্ষণ পরে মোহনবাবুর মৃত্যু হল৷ ডাক্তারের মতে মৃত্যুর কারণ হচ্ছে, কোনো রকম তীব্র বিষ৷

‘অকারণে বিষের সৃষ্টি হয় না৷ মোহনবাবুর কাঁধের উপর বিদ্ধ হয়েছিল অদ্ভুত একটি অস্ত্র৷ এমন অস্ত্র আমি জীবনে দেখিনি৷ এটা যে বিষাক্ত, তাতে আর কোনোই সন্দেহ নেই৷ এই দেখুন-‘ বলে সুন্দরবাবু মোড়কের ভিতর থেকে সন্তর্পণে কাঠির মতন একটি জিনিস বের করলেন৷

বিমল সাগ্রহে সেটিকে নিয়ে পরীক্ষা করতে লাগল৷ লম্বায় সেটি এক বিঘত৷ চওড়ায় নরুনের চেয়ে মোটা নয়৷ তার মুখটা তীক্ষ্ণ, আর একদিকে ইঞ্চিখানেক লম্বা একটি সোলার চোঙা বা নল বসানো৷

বিমল বলল, ‘সুন্দরবাবু, এই কাঠিটি কোন কাঠ দিয়ে তৈরি বুঝতে পেরেছেন?’

‘হুম, না!’

‘সাগু কাঠ দিয়ে৷’

‘কাঠ-ফাঠ নিয়ে এখন আমার মাথা ঘামাবার সময় নেই৷ আমাদের এখন জানা দরকার, ওই বিষাক্ত কাঠের সুচ দিয়ে মোহনবাবুকে আঘাত করল কে? অস্ত্রটা তো আর আকাশ থেকে খসে পড়েনি?’

কুমার বলল, ‘কার উপরে আপনার সন্দেহ হয়?’

‘কপাল দোষে সন্দেহ করবার কোনো লোকই পাচ্ছি না৷ ঘরের আশেপাশে হাজির ছিল কেবল দু-জন লোক-নার্স আর চন্দর৷ কিন্তু মোহনবাবুকে খুন করবে তারা কোন উদ্দেশ্যে? মোহনবাবুর ঘরের ভিতর থেকে টাকা বা কোনো দামি জিনিসও চুরি যায়নি৷ তাঁর মৃত্যুতে তাদের কোনোই লাভ নেই, বরং লোকসান আছে৷ মোহনবাবুর মৃত্যুর জন্যে লাভ হবে খালি ভূপতিবাবুর৷ কারণ তিনিই তাঁর বিশ লাখ টাকা দামের সম্পত্তির মালিক হবেন৷ কিন্তু তাঁর উপরেও সন্দেহ করবার উপায় নেই৷ কারণ প্রথমত, ঘটনার সময় তিনি যে নিজের বাড়িতে ছিলেন, এর প্রমাণ আমি পেয়েছি৷ দ্বিতীয়ত, দ্বারবানের চোখ এড়িয়ে এ-বাড়িতে, আর চন্দরের চোখ এড়িয়ে মোহনবাবুর ঘরে ঢোকা তাঁর পক্ষে অসম্ভব৷ তৃতীয়ত, তিনি যদি মোহনবাবুর মৃত্যু চাইবেন, তবে সেবা-শুশ্রূষা করে তাঁকে নিউমোনিয়ার কবল থেকে উদ্ধার করতেন না৷ চতুর্থত, মোহনবাবুর মৃত্যুতে তিনি এমন কাতর হয়ে পড়েছেন যে, তা আর বলা যায় না৷ হুম, ভালো কথা৷ একটা কথা আপনাকে এখনও বলা হয়নি৷ ভূপতিবাবু অঙ্গীকার করেছেন, মোহনবাবুর হত্যাকারীকে যে ধরে দিতে পারবে, তাকে তিনি বিশ হাজার টাকা পুরস্কার দেবেন!’

বিমল বলল, ‘বলেন কী, বি-শ-হা-জা-র টা-কা?’

‘হ্যাঁ৷ সেই জন্যেই তো মামলাটা নিয়ে এত বেশি মাথা ঘামাচ্ছি! কিন্তু হায় রে, ব্যাপার যা দেখছি, হত্যাকারীর নাগাল পাওয়া একরকম অসম্ভব বললেও চলে৷ হুম, আমার কপাল বড়ো মন্দ!’

বিমল খানিকক্ষণ বসে রইল চুপচাপ৷ তার দৃষ্টি নিবন্ধ সাগুকাঠের সেই কাঠিটির দিকে৷ তারপর সে বলল, ‘বিশ হাজার টাকা পুরস্কার! এ লোভ সামলানো শক্ত৷ আচ্ছা, সুন্দরবাবু, এ বিষয় নিয়ে আমি ভূপতিবাবুর সঙ্গে কথাবার্তা কইতে চাই!’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘বেশ তো, এখনই আমার সঙ্গে চলুন না!’

ভূপতিবাবুর বাড়িখানি বড়ো নয়, কিন্তু দিব্য সাজানো-গুছানো৷

তিনি বৈঠকখানাতেই বসেছিলেন৷ সুন্দরবাবু তাঁর সঙ্গে বিমল ও কুমারের পরিচয় করিয়ে দিলেন৷

ভূপতিবাবুর বয়স পঁয়ত্রিশের বেশি হবে না, চেহারা লম্বা-চওড়া, রং ফর্সা, মুখশ্রী সুন্দর৷

বিমল হাসিমুখে বলল, ‘আপনার বিশ হাজার টাকার গন্ধ পেয়ে আমরা এখানে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে এসেছি৷’

ভূপতিবাবু বললেন, ‘হ্যাঁ, হত্যাকারীকে কেউ ধরতে পারলেই ওই টাকা আমি উপহার দেব৷ এর মধ্যেই আমি বিশ হাজার টাকার একখানি চেক আমার এটর্নির কাছে জমা রেখেছি৷’

বিমল নীরবে কৌতূহলী চোখে ঘরের সাজসজ্জা লক্ষ করতে লাগল৷ এ-ঘরের ভিতরে এলেই বোঝা যায়, এর মালিক খুব শিকার-ভক্ত লোক৷ মেঝের উপর বাঘ-ভাল্লুকের ছাল পাতা এবং দেয়ালের গায়ে টাঙানো রয়েছে বুনো মোষ আর হরিণের মাথা বা শিং এবং হরেকরকম ধনুক, তরবারি, বর্শা প্রভৃতি অস্ত্রশস্ত্র৷

বিমল বলল, ‘আপনি কি শিকার করতে খুব ভালোবাসেন?’

ভূপতিবাবু বললেন, ‘খুব-খুব বেশি ভালোবাসি৷ শিকারের লোভে আমি কোথায় না গিয়েছি-আফ্রিকা, সুমাত্রা, জাভা, বোর্নিও, সিলোন, বর্মা কিছুই আর বাকি নেই৷ ওই যে সব অস্ত্রশস্ত্র দেখছেন, ওগুলি আমি নানান দেশ থেকে সংগ্রহ করে এনেছি৷’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘হুম, আমিও শিকার করতে ভালোবাসি৷ তবে আপনি করেন জন্তু শিকার, আর আমি করি মানুষ শিকার৷’

বিমল বলল, ‘মোহনবাবুর বাড়ি এখান থেকে কোন দিকে?’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘উত্তর দিকে৷ জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখুন না, ওই যে বাগানের ওপারে ওই লাল বাড়িখানা৷ দোতলার ডানপাশে সব শেষে যে ঘরখানা দেখছেন, ওই ঘরেই হতভাগ্য মোহনবাবুর মৃত্যু হয়েছে৷ মাঝখানের জানলার দিকে চেয়ে দেখুন, যে খাটে তিনি শুতেন, তারও খানিক অংশ এখান থেকে দেখতে পাবেন৷’

ভূপতিবাবু দুঃখিত স্বরে বললেন, ‘ও-ঘরের দিকে তাকালেও আমার বুকটা হু-হু করে ওঠে!’

বিমল সহানুভূতির স্বরে বলল, ‘এটা তো খুবই স্বাভাবিক ভূপতিবাবু৷ আপনি কি এই বাগান পেরিয়েই ওই বাড়িতে যেতেন?’

‘না, ওর ভেতর দিয়ে যাবার কোনো উপায় নেই৷ একে তো ওর চারদিকেই উঁচু পাঁচিল, তার উপরে ওটা হচ্ছে পরের বাগান! বাগানের ওপার থেকে ও-বাড়িতে ঢোকবার কোনো দরজাও নেই৷’

সুন্দরবাবু বিমলের দিকে ফিরে বললেন, ‘এখানে এসে বিশ হাজার টাকার পাকা খবরটা পেলেন তো? এখন চলুন, আমার হাতে অনেক কাজ আছে৷’

বিমল বলল, ‘হ্যাঁ, যাচ্ছি৷ ভূপতিবাবুর এই ঘরখানি আমার ভারি ভালো লাগছে-‘, বলতে বলতে ও চারিদিকে তাকাতে তাকাতে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে একজায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘এই বর্শাটা কোন দেশের ভূপতিবাবু?’

‘বোর্নিওর৷’

বিমল হাত বাড়িয়ে বর্শাটা নামাতে গেল, কিন্তু ভূপতিবাবু শশব্যস্ত হয়ে বলে উঠলেন, ‘হাঁ, হাঁ, করেন কী, করেন কী! ওর ফলায় বিষ আছে!’

কিন্তু বিমল ততক্ষণে বর্শাটা নামিয়ে নিয়েছে৷ সে শান্তভাবে বলল, ‘ভয় নেই, আমি খুব সাবধানেই এটা নাড়াচাড়া করব৷ কিন্তু এর ফলায় কী বিষ আছে? ইপো-গাছের বিষ?’

ভূপতিবাবু কিছুক্ষণ অবাক হয়ে বিমলের মুখের পানে তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে বললেন, ‘আপনি কী করে জানলেন?’

সে-কথার জবাব না দিয়ে বিমল বলল, ‘বর্শার ডান্ডিটা তো দেখছি জাজাং কাঠে তৈরি৷’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘হুম, এর ডাণ্ডিটা আবার ফাঁপা! এর কারণ কী বিমলবাবু?’

‘কারণ এর দ্বারা বর্শার কাজ চালানো গেলেও আসলে এটি বর্শা নয়, বোর্নিওয় একে কী বলে ডাকা হয় ভূপতিবাবু?’

‘আমার মনে নেই৷’

‘আমার মনে আছে৷ এর নাম হচ্ছে সুম্পিটান৷’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘বাবা, কী বিচ্ছিরি নাম! কিন্তু আপনি জানলেন কেমন করে? আপনিও কি বোর্নিওয় গিয়েছিলেন?’

‘গিয়েছিলাম৷ সুম্পিটান ব্যবহার করতেও শিখেছিলাম৷ এটা একবার ধরুন না, আপনাকেও এর ব্যবহার হাতে-নাতে শিখিয়ে দিচ্ছি৷’

সুন্দরবাবু আঁতকে উঠে তাড়াতাড়ি ভুঁড়ি দুলিয়ে পিছিয়ে গিয়ে বললেন, ‘হুম, না, আমি ওর ব্যবহার-ট্যবহার শিখতে চাই না৷ শেষটা কি বিষ-টিষ লেগে খুন-টুন হব? আপনি ও আপদ রেখে দিয়ে আসবেন তো আসুন! আমার হাতে ছেলেখেলা করবার সময় নেই!’

‘আর একটু সবুর করুন সুন্দরবাবু, আপনাকে সুম্পিটানের বাহাদুরিটা না দেখিয়ে আমি এখান থেকে এক পা নড়ছি না! হ্যাঁ, সাগু কাঠের কাঠিটা আমাকে একবার দিন তো!’

সুন্দরবাবু কাঠিটা বিমলের হাতে দিয়ে আশ্চর্য স্বরে বললেন, ‘আপনার মতলব কী?’

বিমল জবাব না দিয়ে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল৷ সাগু কাঠের কাঠিটা আগে বর্শার ফাঁপা ডান্ডির গর্তের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল৷ তারপর জানলা গলিয়ে ডান্ডিটাকে দুই হাতে তলার দিকে ধরে উঁচু করে ফেলল৷ তারপর ডান্ডির তলার দিক মুখে পুরে দুই গাল ফুলিয়ে খুব জোরে দিল বিষম এক ফুঁ!

বাগানের ওপারে মোহনবাবুর বাড়ির ছাদের উপর একটা চিল চুপ করে বসেছিল৷ হঠাৎ সে ঘুরতে ঘুরতে ধুপ করে মাটির উপরে পড়ে গেল৷

সুন্দরবাবু বিস্মিত স্বরে বললেন, ‘কোথাও কিচ্ছু নেই, খামোকা চিলটা পড়ে গেল কেন?’

বিমল বর্শাটা নামিয়ে সহজভাবেই বলল, ‘আপনার সাগু কাঠের কাঠিটা তার গায়ে গিয়ে বিঁধেছে৷ সুন্দরবাবু, সুম্পিটানের ইংরেজি নাম কি জানেন? ব্লো-পাইপ৷ বোর্নিওর লোকেরা ব্লো-পাইপে বিষাক্ত কাঠি ঢুকিয়ে এইভাবে জন্তু বা শত্রু নিপাত করে৷ এই তিরকাঠির গতি বড়ো কম নয়, সত্তর গজ দূরেও সে মারাত্মক৷ বোর্নিওর কাঠিতে ইপো গাছের বিষ ব্যবহার করা হয়, কিন্তু আমার বিশ্বাস, এই কাঠিতে অন্য কোনোরকম বেশি তীব্র বিষ মাখানো হয়েছে৷ . . . আরে, আরে ভূপতিবাবু! পায়ে পায়ে পিছু হটে কোথায় যাচ্ছেন? আমি সুন্দরবাবুর সঙ্গে কথা কইছি বটে, কিন্তু আরশিখানার দিকে চেয়ে আপনার ওপরেও সজাগ দৃষ্টি রেখেছি! পালাবার চেষ্টা করবেন না, আমি বর্শা ছুড়লে আপনি মারা পড়তে পারেন৷ আপনার মতো দুরাত্মা ছুঁচোকে মেরে আমি হাত গন্ধ করতে চাই না! আসল ব্যাপার কী জানেন সুন্দরবাবু? এই ভূপতি মোহনবাবুর লোক-দেখানো সেবা করেছিল, কারণ তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, তিনি এ-যাত্রা কিছুতেই রক্ষা পাবেন না৷ কিন্তু মোহনবাবু যখন আবার সামলে উঠে ভূপতির বিশ লক্ষ টাকার সম্পত্তি ফিরিয়ে নেবার জোগাড় করলেন, ভূপতি তখন মরিয়া হয়ে ব্লো-পাইপের আশ্রয় নিতে বাধ্য হল৷ সে বোর্নিওয় গিয়ে এই অস্ত্রটি ব্যবহার করতে শিখেছিল৷ এখান থেকে খাটের উপর শয্যাশায়ী মোহনবাবুকে দেখা যায়৷ এখান থেকে পথের কাঁটা সরালে ভূপতিকে কেউ সন্দেহ করতে পারবে না, কারণ বাংলাদেশে পুলিশ ওই সাগু কাঠের আসল রহস্য চিনবে কী করে? অতএব সে নির্ভাবনায় করে বসল বিশ হাজার টাকার পুরস্কার ঘোষণা৷ ভূপতি হচ্ছে অগাধ জলের রুই-কাতলা৷ কিন্তু তার দুর্ভাগ্যক্রমে পুলিশ দৈবগতিকে ডেকে এনেছে জল-স্থল-শূন্যের পরিব্রাজক বিমল আর কুমারকে! কাজে কাজেই ভূপতির পুরস্কারের ঘোষণা ব্যর্থ হল না, সে যখন ফাঁসিকাঠে দোললীলার সুখ উপভোগ করবে, তখন আপনি আর আমি করব বিশ হাজার টাকা আধাআধি ভাগ করে নেবার সাধু চেষ্টা! কী বলেন?’

সুন্দরবাবু পকেট থেকে হাতকড়া বার করে ভূপতির দিকে এগোতে এগোতে কেবল বললেন, ‘হুম!’

সুন্দরবাবুর এই বিখ্যাত ‘হুম’ হচ্ছে আশ্চর্য শব্দ৷ এর দ্বারা তিনি হাস্য, করুণ, রৌদ্র, অদ্ভুত ও শান্ত প্রভৃতির শাস্ত্রোক্ত নয় রকম রসেরই ভাব প্রকাশ করতে পারেন৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *