অখন্ড মেদিনীপুরের পুরাকীর্তি – তারাপদ সাঁতরা
ভৌগোলিক রূপরেখা
মেদিনীপুর আয়তনে পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় বৃহত্তম জেলা। এর উত্তরে বাঁকুড়া, হুগলি ও পুরুলিয়া জেলা, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পুবে হুগলি-ভাগীরথী নদী এবং পশ্চিমে ওড়িশার বালেশ্বর ও ময়ূরভঞ্জ ও বিহারের সিংভূম ও মানভূম জেলা। জেলাটি ২১°৩৬´৩৫´´ থেকে ২২°৫৭´১০´´ উত্তর অক্ষাংশে এবং সমগ্র উত্তরাংশ ৮৮°১২´৪০´´ ও পশ্চিমাংশ ৮৬°৩৩´৩৫´´ দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত। ভারতের সার্ভেয়ার জেনারেলের প্রদত্ত হিসাব মতো এ জেলাটি ১৩,৬১৮ বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত। ১৯৮১ সালের আদমশুমার অনুযায়ী, জেলার মোট লোকসংখ্যা ৬৭,২৩,৮৬০, যার মধ্যে পুরুষ ৩৪,৪৪,৫৬১, নারী ৩২,৭৯,২৯৯ এবং গ্রামে ৬১,৪৯,৮৪৩ জন ও শহরে ৫,৭৪,০১৭ জন বাস করেন।
এ জেলার মহকুমার সংখ্যা পাঁচটি হলেও কার্যত সেটি সদর-উত্তর, সদর-দক্ষিণ, ঘাটাল, তমলুক, কাঁথি ও ঝাড়গ্রাম, এই ছ-টি মহকুমায় বিভক্ত।
মেদিনীপুর জেলার নামের উৎপত্তি নিয়ে নানান মত প্রচলিত। মেদিনীপুর শহরটি বেশ প্রাচীন হলেও, এর নামকরণ সম্পর্কে পন্ডিতেরা সঠিকভাবে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি। পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী শিখরভূমের নৃপতি রাজা রামচন্দ্রের রচিত এক পুঁথির বিবরণ থেকে এই সিদ্ধান্ত করেছিলেন যে, খ্রিস্টীয় তেরো থেকে পনেরো শতকের মধ্যে এদেশে প্রাণকর নামে কোনো এক স্বাধীন হিন্দুরাজার পুত্র মেদিনীকর এই নগরীর পত্তন করায় কালক্রমে সেটির নাম হয় মেদিনীপুর। শাস্ত্রী মহাশয় এই প্রসঙ্গে আরও অবগত করান যে, এই মেদিনীকরই মেদিনীকোষ নামে একটি সংস্কৃত কোষগ্রন্থও রচনা করেছিলেন।
অপর আর একটি মত হল, মেদনমল্ল রায় নামে ওড়িশার এক পরাক্রমশালী নৃপতি ১৫২৪ সালে এখানকার বিস্তীর্ণ ভূভাগ দখল করে কাঁসাই নদীতীরবর্তী এলাকায় শাসন কায়েম করেছিলেন। তাঁর নাম থেকেই পরবর্তীকালে এখানকার নামকরণ হয় মেদিনীপুর। অবশ্য এ মতটির পরিপোষক কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায় না।
ড. মহম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁর রচিত ইসলাম প্রসঙ্গ গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন, ‘মৌলনা মুস্তাফা মদনীকে (রঃ) সম্রাট আওরঙ্গজেব বর্তমান মেদিনীপুর শহরে একটি মসজিদ সম্পর্কিত মহল ও বহু লাখেরাজ সম্পত্তি দান করেন। এই মৌলনা মদনী সাহেবের নাম হইতে মেদনীপুর নাম হয়; পরে তাহার অপভ্রংশ মেদিনীপুর হইয়াছে। বাদশাহী সনের তারিখ ১০৭৭ হিজরী (বাংলা সন ১০৯০-৯১)। ইহা ফুরফুরা কেবলাগাহ সাহেবের খান্দানে রক্ষিত আছে’ (পৃ. ১১৮)। কিন্তু আওরঙ্গজেবের বহু আগে খ্রিস্টীয় ষোলো শতকে প্রণীত আইন-ই-আকবরী তে মেদিনীপুর মহলের অন্তর্গত মেদিনীপুর নগরের নাম উল্লিখিত হয়েছে। সুতরাং, মৌলানা মুস্তাফা মদনীর নামেই যে মেদিনীপুর নামকরণ হয়েছে, তা কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
ওড়িশার গঙ্গবংশের (খ্রিস্টীয় ১২শ শতক) ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, অনন্তবর্মণ চোড়গঙ্গদেব তাঁর রাজ্য বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিলেন। তাঁর প্রদত্ত শ্রীকুর্মম লিপি (১১৩৫ খ্রি.) থেকে জানা যায় যে, এই বৎসরেই তিনি গঙ্গা থেকে গোদাবরী পর্যন্ত বিস্তৃত ভূভাগ অধিকার করেন। এ ছাড়া, অনন্তবর্মণ চোড়গঙ্গ, ২য় নরসিংহ ও ৪র্থ নরসিংহের প্রদত্ত বিভিন্ন লিপির সাক্ষ্য থেকেও জানা যায় যে, অনন্তবর্মণের রাজ্য বিস্তৃত ছিল দক্ষিণে গোদাবরী, উত্তরে মিধুনপুর, পূর্বে বঙ্গোপসাগর এবং পশ্চিমে পূর্বঘাট পর্বতমালা পর্যন্ত। বর্তমানে ওইসব লিপিতে উল্লিখিত সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে ড. নীহাররঞ্জন রায় তাঁর বাঙালির ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ওড়িশার চোড়গঙ্গ রাজাদের আধিপত্য যে মিধুনপুর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল, নিঃসন্দেহে সেটিই হল বর্তমান মেদিনীপুর। সুতরাং, আলোচ্য এই মিধুনপুর অপভ্রংশে যদি মেদিনীপুর হয়ে থাকে, তাহলে খ্রিস্টীয় বারো শতকেই ‘মেদিনীপুর’ নামের অস্তিত্ব রয়েছে।
এ ছাড়া ‘মেদিনীপুর’ নামকরণের পিছনে আরও একটি সম্ভাব্য কারণ উল্লেখ করা যেতে পারে। ঐতরেয় আরণ্যক-এ বঙ্গ, মগধ ও চেরাপাদের উল্লেখ পাওয়া যায়। বঙ্গ ও দক্ষিণ বিহারের মগধ আমাদের কাছে জ্ঞাত হলেও, উল্লিখিত চেরপাদটিকে ঐতিহাসিকেরা দক্ষিণাপথের একটি প্রাচীন রাজ্যের নাম বলেই সিদ্ধান্ত করেছেন। কিন্তু সম্প্রতি প্রকাশিত চেরো নামক গবেষণাগ্রন্থের লেখক হরিমোনের অনুমান, চেরো ভূখন্ড আসলে ছোটোনাগপুরের মালভূমি। এই গ্রন্থে মেদিনীরায় নামে একজন পরাক্রান্ত চেরো সম্রাটের কথা আছে। মেদিনীপুর জেলার পশ্চিম অংশ ছোটোনাগপুর মালভূমির প্রত্যন্তভাগে অবস্থিত। মেদিনীপুরের পশ্চিম অংশ উল্লিখিত মেদিনীরায়ের সাম্রাজ্যভুক্ত হয়ে থাকতে পারে। এই যুক্তিতে মেদিনীরায় প্রসঙ্গে মেদিনীপুর নামের উৎপত্তি হওয়া অসম্ভব নয়।
নামকরণের ইতিহাস যাই হোক না কেন, মেদিনীপুর নামের উল্লেখ পাওয়া যায় আবুল ফজল প্রণীত আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে (১৫৯৬ খ্রি.)। সেই সময় প্রশাসনিক কারণে মেদিনীপুর ওড়িশার মধ্যে ছিল। ওড়িশা ছিল পাঁচটি সরকারে বা প্রশাসনিক বিভাগে বিভক্ত। জলেশ্বর ছিল এর অন্যতম। বর্তমান মেদিনীপুর জেলার অধিকাংশ (আঠাশটি মহলে বিভক্ত) ছিল সরকার জলেশ্বরের অন্তর্ভুক্ত। এরপর শাহজাহানের আমলে (১৬৫৮ সালে) ওই পাঁচটি সরকারকে ভেঙে বারোটি সরকারে পুনর্গঠিত করা হয় এবং উত্তরাংশের ছ-টি সরকারকে সুবা বাংলার অধীনে করা হয়। এর মধ্যে জলেশ্বর, মালঝিটা, মজকুরী ও গোয়ালপাড়া সরকার প্রধানত বর্তমান মেদিনীপুরের এলাকাভুক্ত হয়।
মুর্শিদকুলী খাঁর (১৭২২ খ্রি.) আমলে রাজস্ব সংগ্রহ ব্যবস্থা সংশোধন করে, ‘মহল’-এর বদলে ‘পরগনা’র প্রচলন হয়। এই উপলক্ষে ‘সরকার’ নামীয় বিভাগকে ভেঙে বিভিন্ন ‘চাকলা’য় বিভক্ত করে দেওয়া হয়। চাকলাহিজলির সমগ্র অংশ এবং চাকলা বালেশ্বরের কতক অংশ আজকের এই মেদিনীপুর জেলার মধ্যে পড়ে। পরবর্তী পর্যায়ে ১৭৫১ খ্রিস্টাব্দে মারাঠা অধিকারের পর চাকলা বালেশ্বরকে মেদিনীপুর ও জলেশ্বর এই দুইভাগে বিভক্ত করে দেওয়া হয়।
১৭৬০ সালে যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মীরজাফরকে পদচ্যুত করে তাঁর জামাতা মীরকাসেমকে বাংলার নবাবী প্রদান করেন তখন এই মর্যাদাপ্রাপ্তির মূল্য হিসাবে মীরকাসিম এক চুক্তিবলে মেদিনীপুর, চট্টগ্রাম ও বর্ধমান ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে হস্তান্তরিত করেন। বলতে গেলে এই সময় থেকেই মেদিনীপুর জেলায় ইংরেজদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, মীরকাসেম কর্তৃক হস্তান্তরিত মেদিনীপুর বর্তমান মেদিনীপুর জেলা থেকে অনেক পৃথক। তখন হস্তান্তরিত মেদিনীপুর জেলা তিনভাগে বিভক্ত ছিল। সে বিভাগগুলি হল, চাকলা হিজলি, চাকলা মেদিনীপুর ও চাকলা জলেশ্বর। তার মধ্যে চাকলা হিজলি ছিল, হুগলির সংলগ্ন এবং চাকলা মেদিনীপুর ছিল পশ্চিমে জঙ্গলাকীর্ণ এলাকার সরকার গোয়ালপাড়ার কতকগুলি পরগনার অন্তর্ভুক্ত। ইংরেজদের কাছে হস্তান্তরের সময় বালেশ্বর জেলার উত্তর অংশ (সুবর্ণরেখার উত্তরতীরে) সিংভূমের ধলভূমি মহকুমা, মানভূমের জঙ্গলমহল, বরাহভূম ও মানভূম এবং বাঁকুড়ার জঙ্গলমহল, ছাতনা ও অম্বিকানগর মেদিনীপুর জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়। অপরপক্ষে, হিজলি, মহিষাদল ও তমলুক, মারাঠাদের অধীন পটাশপুর, কামারডিচোর ও ভোগরাই পরগনা এবং বর্ধমানের অন্তর্ভুক্ত তখনকার ঘাটাল মহকুমা, সদর মহকুমার গড়বেতা ও শালবনি থানার কিছু অংশ এবং কেশপুর থানা এই হস্তান্তরের সময় বাদ থেকে যায়।
মেদিনীপুর ও জলেশ্বর এই দু-টি চাকলার শাসনভার মি. জনস্টোন নামে জনৈক ইংরেজ অফিসারের অধীনে দেওয়া হয়। ইনি এই জেলার রাজস্ব, ফৌজদারি ও বিচার বিভাগীয় প্রশাসনিক এলাকার কমার্শিয়াল এজেন্ট, পলিটিক্যাল অফিসার ও মিলিটারি গভর্নরও ছিলেন। এই সময়েই মেদিনীপুর শহরে মেদিনীপুরের প্রশাসনিক সদর দপ্তর স্থাপন করা হয়। জেলার দায়িত্ব গ্রহণ করার পরই জনস্টোন মেদিনীপুর শহরে একটি কমার্শিয়াল ফ্যাক্টরিও নির্মাণ করেন। ১৭৭৪ থেকে ১৭৭৭ সাল পর্যন্ত এ জেলা সরাসরি বর্ধমানের প্রাদেশিক কাউন্সিলের অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং পরবর্তী ১৭৭৭ সালে সর্বপ্রথম এ জেলায় ‘কালেক্টর’-এর পদ সৃষ্টি হওয়ায়, মি. জন পিয়ার্স এ পদে নিযুক্ত হন।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময়, হিজলি, মহিষাদল ও তমলুক ছিল সল্ট কালেক্টরের শাসনাধীন সল্ট এজেন্টের অধীন এবং সদর মহকুমা-উত্তর ও ঘাটাল এই দুই মহকুমা ছিল বর্ধমানের এলাকাধীন। ১৭৯৫ সালে সে সময়ের জঙ্গলমহলের অন্তর্গত গড়বেতার এলাকাধীন বগড়ী পরগনার বেশ কিছু অংশ বর্ধমান থেকে মেদিনীপুরে হস্তান্তরিত করা হয়। এর ঠিক পাঁচ বছর পরে, বিশেষ এক আদেশবলে, বগড়ীর অবশিষ্ট অংশ, ব্রাহ্মণভূম ও চেতুয়া পরগনার অংশ তরফ দাসপুর হুগলি জেলা থেকে পৃথক করে মেদিনীপুরের অন্তর্ভুক্ত করে দেওয়া হয়। এরপর ১৮০৩ সালে মারাঠাদের অধিকারভুক্ত পটাশপুর ও সুবর্ণরেখার উত্তরে অন্য দু-টি পরগনাও মেদিনীপুরের সঙ্গে সংযুক্ত করে দেওয়া হয়। এর ঠিক দু-বৎসর পরেই জঙ্গলমহলে চুয়াড় বিদ্রোহজনিত অশান্তির কারণে জঙ্গলমহলের সাতটি এলাকা মেদিনীপুর থেকে বিচ্ছিন্ন করে, পৃথক একটি জঙ্গলমহল জেলার সৃষ্টি করা হয়। এর ঠিক পরের বৎসর, ১৮০৬ খ্রিস্টাব্দে, শাসনকাজের সুবিধার জন্য পটাশপুর, কামারডিচোর ও ভোগরাই পরগনা হিজলির সল্ট এজেন্সির সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয় এবং পরবর্তী ১৮৩৭ সালে ওই পরগনাগুলিকে পুনরায় বালেশ্বর জেলার এলাকাধীন করে দেওয়া হয়।
১৭৭৪ সালে মেদিনীপুর জেলা পত্তনের সময় থেকেই আজকের ঘাটাল ও চন্দ্রকোণা থানার এলাকা ছিল হুগলি জেলার অন্তর্গত ক্ষীরপাই মহকুমার অধীন। ১৮২৬ সালে চন্দ্রকোণার অধিবাসীদের আবেদন অনুযায়ী, ফৌজদারি ক্ষেত্রাধিকারটি হুগলি জেলা থেকে মেদিনীপুর জেলার অধীনে চলে আসে। তবে রাজস্ব ক্ষেত্রাধিকার পূর্ববৎ থেকে যায়। ১৮৪৫ সালে ক্ষীরপাইকে হুগলি জেলার অন্যতম মহকুমায় পরিণত করা হয় বটে, কিন্তু ১৮৭২ সালে ক্ষীরপাই মহকুমা তুলে দিয়ে চন্দ্রকোণা ও ঘাটাল থানা চূড়ান্তভাবে মেদিনীপুর জেলার অন্তর্ভুক্ত করে দেওয়া হয়। বলা যেতে পারে, এই সময় থেকেই মেদিনীপুর জেলার সীমানা প্রায় পাকাপাকিভাবে নির্ধারিত হয়ে যায় এবং পরবর্তীকালেও তেমন কিছু আর পরিবর্তন হয়নি।
ভূপ্রকৃতির দিক থেকে এ জেলার পূর্ব অংশের সঙ্গে পশ্চিমের মিল নেই। বলতে গেলে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাংশের মাটি কঙ্করময়, উচ্চাবচ এবং রং লালচে। কিন্তু পুবের অংশটি গড়ে উঠেছে হুগলি-ভাগীরথী এবং তার উপনদী ও শাখানদী বাহিত পলি দিয়ে। মেদিনীপুর জেলার পূর্ব সীমানা চিহ্নিত করে হুগলি-ভাগীরথী প্রবাহিত। এ ছাড়া, এই জেলার প্রধান নদ-নদী হিসাবে কংসাবতী, শীলাবতী, রূপনারায়ণ, সুবর্ণরেখা ও রসুলপুর উল্লেখযোগ্য। কংসাবতী (বা চলতি কথায় কাঁসাই) নদী পুরুলিয়া জেলার ঝালদা থেকে উৎপন্ন হয়ে এ জেলার কেশপুর থানার কপাসটিকরীতে দুভাগ হয়ে একটি শাখা (সরকারিভাবে যার বর্তমান নামকরণ পলশপাই খাল) পুবমুখে রূপনারায়ণ নদে মিশেছে। মূল প্রবাহটি নীচের দিকে হলদী নামে হুগলি-ভাগীরথীতে মিশেছে। তারাফেনি ও কেলেঘাই কংসাবতীর উল্লেখযোগ্য উপনদী।
কাঁসাই ছাড়া এ জেলায় শীলাবতী বা শিলাই-এর ভূমিকাও কম নয়। এ নদীর অনেকগুলি উপনদী আছে তার মধ্যে বুড়িগাং, গোপা, বেতাল, তমাল, বিড়াই, পুরন্দর, কুবাই, পারাং, দোনাই, আমোদর, শাকরী ও কেটে উল্লেখযোগ্য। জেলার দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রবাহিত রসুলপুর বা বাগদা নদীটিও একদা বেরোজ নদীর (বর্তমানে সদরখাল নামে পরিচিত) সঙ্গে মিশে হুগলি-ভাগীরথীতে সঙ্গম হয়েছে। জেলার পশ্চিম সীমানা চিহ্নিত করে প্রবাহিত হয়েছে সুবর্ণরেখা ও তৎসংলগ্ন উপনদী ডুলং, যার কুলে কুলে বহু প্রাচীন সব ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্বের নিদর্শন আজও বিদ্যমান। এ জেলার অন্যান্য নদীর মধ্যে ক্ষীরাই, পাঁচথুপি, চন্ডী ও কপালেশ্বরী প্রভৃতির নাম করা যায়। কপালেশ্বরী এ জেলায় একদা খুব গুরুত্বপূর্ণ নদী ছিল। এ নদীতীরবর্তী স্থানে বহু প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষই তার প্রমাণ।
উল্লিখিত এসব নদ-নদীর বিভিন্ন সময়ে নানান পরিবর্তন ঘটেছে এবং কতকগুলি নদ-নদীর গতি পরিবর্তনের ফলে, সেগুলির তীরবর্তী গ্রাম্য সমাজের বিকাশ ও বিলোপ দুই-ই ঘটেছে একই সঙ্গে। এর মধ্যে পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলের কতকগুলি নদ-নদীর প্রবাহ লুপ্তপ্রায়; বর্তমানে এগুলি খালে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। কিন্তু এসব নদীর তীরে যেসব পুরাসম্পদের সন্ধান পাওয়া যায়, তা থেকেই এদের গুরুত্ব ও প্রাচীনত্ব সহজেই অনুমেয়।
মেদিনীপুর জেলায় বেশ কিছু প্রাচীন রাজপথের সন্ধান মেলে। সিংহলী ধর্মগ্রন্থ মহাবংশ-তে উল্লিখিত হয়েছে যে, মৌর্য সম্রাট অশোক কয়েকজন দূতকে বিদায় সংবর্ধনা জানাবার জন্য পাটলিপুত্র থেকে এই বন্দরে নিজে উপস্থিত হয়েছিলেন। চৈনিক পরিব্রাজক ইৎসিঙ (সপ্তম শতক) তাম্রলিপ্ত থেকে বুদ্ধগয়া পর্যন্ত একটি পথের ইঙ্গিত দিয়েছেন। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙের বিবরণ পাঠে জানা যায় যে, তিনি স্থলপথে সমতট থেকে তাম্রলিপ্তি এবং তাম্রলিপ্তি থেকে কর্ণসুবর্ণ গিয়েছিলেন।
তবে পুঁথিপত্রের এ বিবরণ ছাড়া এ জেলার উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত ‘নন্দ কাপাসিয়ার জাঙ্গাল’ নামে উঁচু বাঁধটির অস্তিত্ব আজও লক্ষ্য করা যায়, সেটিও যাতায়াতের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। আনুমানিক পনেরো থেকে ষোলো শতকে নির্মিত এ বাঁধটি ঘাটাল, ডেবরা, সবং প্রভৃতি থানা এলাকার স্থানে স্থানে এখনও বিদ্যমান। এ ছাড়া, নারায়ণগড় থানা এলাকায় আরও একটি পরিত্যক্ত উঁচু বাঁধ দেখা যায়। বাঁধটি কেশিয়াড়ী থেকে নারায়ণগড়ের উপর দিয়ে সবং থানায় ‘নন্দ কাপাসিয়ার বাঁধে’ যুক্ত হয়েছে। এ উঁচু বাঁধটি একদা প্রাচীন পথ ছিল বলে অনুমান করা অসঙ্গত হবে না। এর আশপাশে বহু গ্রামে বেশ কিছু পুরাকীর্তির ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। এছাড়া, বাদশাহী সড়ক নামে খ্যাত মোগল আমলে নির্মিত একটি রাজপথ বর্ধমান থেকে প্রসারিত হয়ে হুগলি জেলার গোঘাট থানার উপর দিয়ে এ জেলার চন্দ্রকোণা ও কেশপুর থানা বরাবর মেদিনীপুর শহরে পৌঁছেছে। এ ছাড়া রানিগঞ্জ থেকে উত্তর-দক্ষিণে প্রসারিত একটি পথ এবং মেদিনীপুর শহর থেকে পশ্চিমে নাগপুর পর্যন্ত যোগসূত্রবাহী আর একটি পথ একসময় ছিল এ জেলার গুরুত্বপূর্ণ দুটি সড়ক। পরবর্তী উনিশ শতকে পোস্তার রাজা সুখময় রায় মহাশয়ের আনুকূল্যে ইংরেজ সরকার তীর্থযাত্রীদের সুবিধার্থে এ জেলার উপর দিয়ে যে রাজপথটি নির্মাণ করেন, তাই একসময় জগন্নাথ রাস্তা অথবা কটক রোড নামে পরিচিত হয়। সুতরাং, এই রাজপথগুলি যে মেদিনীপুর জেলার সঙ্গে বহির্জগতের যোগাযোগসূত্র হিসাবে ব্যবহৃত হত, তাতে সন্দেহ করবার কারণ নেই।
প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক বিবরণ
মেদিনীপুর একদিকে পাথুরে মাটি এবং অন্যদিকে পরিমাটি দিয়ে গঠিত বিস্তৃত ভূভাগ। সুতরাং, আদিম মানুষের সংস্কৃতির সঙ্গে নদীমাতৃক সভ্যতার বিচিত্র আদানপ্রদান ঘটেছে এই জেলায়। স্বভাবতই সেজন্য প্রাগৈতিহাসিক প্রস্তরযুগের সভ্যতার বহু নিদর্শন এ জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে পাওয়া গিয়েছে। এ জেলায় প্রবাহিত রূপনারায়ণ, কাঁসাই, সুবর্ণরেখা, শিলাই ও তারাফেণী প্রভৃতি নদীতীরবর্তী স্থানে প্রত্নতাত্বিক অনুসন্ধান চালিয়ে যেসব প্রস্তরযুগের হাতিয়ারের নিদর্শন পাওয়া গেছে, তা থেকে বেশ বোঝা যায়, এ জেলা এবং তার পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানেও আদিপ্রস্তর যুগ থেকে নব্যপ্রস্তর যুগের সভ্যতা বিভিন্ন পর্বের ভিতর দিয়ে বিকশিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, এ জেলার বিভিন্ন এলাকায় তাম্রপ্রস্তর যুগেরও যে বিকাশ হয়েছিল তার প্রমাণ এ জেলায় বিভিন্ন স্থানে তামার আয়ুধ ও অন্যবিধ প্রত্নসামগ্রী প্রাপ্তিতে বোঝা গেছে। জেলার বীনপুর থানার এলাকাধীন তামাজুড়ি গ্রাম থেকে যে তামার কুঠারটি পাওয়া গেছে, (বর্তমানে সেটি ইন্ডিয়ান মিউজিয়মে সংরক্ষিত) সেটি নিঃসন্দেহে প্রাগৈতিহাসিক তাম্রসম্ভার যুগ সভ্যতার নিদর্শন। এ ছাড়াও প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে গড়বেতা থানার অন্তর্গত আগুইবনি, এগরা থানার এলাকাধীন চাতলা, সবং থানার অধীন পেরুয়া, জামবনী থানার অন্তর্ভুক্ত পরিহাটি এবং তমলুক থেকে যেসব তামার কুঠার ও নানাবিধ অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া গেছে (যা পরবর্তী ‘পুরাকীর্তি পরিচিতি’ অধ্যায়ে বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে) সেগুলি এ জেলার প্রত্নতত্ত্বের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
প্রাগৈতিহাসিক তথা তাম্রপ্রস্তর যুগ থেকে ঐতিহাসিক যুগ পর্যন্ত একটি ধারাবাহিকতা যে এ জেলায় প্রায় অক্ষুণ্ণ রয়েছে, তারও বেশ কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এ জেলার নানাস্থানে অনুসন্ধানকালে পাওয়া গেছে। তমলুক এলাকার বিভিন্ন স্থানে সন্ধান চালিয়ে এবং খননকার্য করে যেসব পুরাবস্তু পাওয়া গেছে সেগুলির কাল নির্ণয় করে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা খ্রিস্টপূর্ব ১ম সহস্রক থেকে শুরু করে ১০ম-১১শ শতকের প্রত্নদ্রব্য বলেই সিদ্ধান্ত করেছেন। এ ছাড়া, জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে পাথরের যেসব মূর্তি-ভাস্কর্য পাওয়া গেছে (যেগুলি প্রসঙ্গত পরবর্তী ‘পুরাকীর্তি পরিচিতি’ অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে) সেগুলিও এ জেলার প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ বলেই গণ্য হতে পারে।
একদা তাম্রলিপ্তের খ্যাতি যে এই সামুদ্রিক বন্দরের জন্য সে সম্পর্কে বিভিন্ন প্রাচীন ধর্মগ্রন্থে এবং বিদেশিদের প্রদত্ত বিবরণেও জানা গেছে। বর্তমান তমলুক ও তার আশপাশ থেকে প্রাপ্ত বেশ কিছু পুরোদস্তুর নজিরে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা সিদ্ধান্ত করেছেন যে, সেকালের প্রাচীন ধর্মগ্রন্থে ও বিদেশিদের বিবরণে উল্লিখিত সামুদ্রিক বন্দর তাম্রলিপ্ত হয়তো বা আজকের এই তমলুক। বিদেশিদের তমলুকের অদূরে রূপনারায়ণ নদের অপর তীরে হাওড়া জেলার চর-রাধাপুরে (থানা : শ্যামপুর) রোমান শিরস্ত্রাণ পরিহিত, দ্বিমুখবিশিষ্ট হাতলযুক্ত পোড়ামাটির এক অদ্ভুত মূর্তি (বর্তমানে কলকাতার আশুতোষ মিউজিয়মে রক্ষিত) সম্পর্কে গবেষকদের মতামত হল, সেটি প্রাচীন রোমক যুদ্ধদেবতা ‘জানুস’-এর সঙ্গে সাদৃশ্যযুক্ত। অতএব প্রাচীন সামুদ্রিক বন্দর তাম্রলিপ্তের সঙ্গে দেশবিদেশের যোগাযোগ থাকার এটি হল এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
তাম্রলিপ্তের বাণিজ্য সমৃদ্ধির কথা প্রাচীন পালি ও সংস্কৃত গ্রন্থেও উল্লিখিত হয়েছে। কথাসরিৎ সাগর-এর একটি কাহিনিতে উল্লেখ করা হয়েছে তাম্রলিপ্তিকা পূর্বাম্বুধির অদূরে অবস্থিত এক নগরী। দশকুমার চরিত-এর মতে দামলিপ্ত ব্যবসা-বাণিজ্যের এক প্রসিদ্ধ কেন্দ্র। চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙও উল্লেখ করেছেন তাম্রলিপ্ত সমুদ্রের খাড়ীর উপর অবস্থিত এবং এই বন্দর থেকেই ৫ম শতকে ফা-হিয়েন সিংহল এবং ৭ম শতকে ইৎসিং সুমাত্রা-যবদ্বীপ যাবার জন্য জাহাজে উঠেছিলেন।
মেদিনীপুর জেলার প্রাপ্য এসব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ছাড়াও অদ্যাবধি সংগৃহীত বিবিধ প্রাচীন পুঁথিপত্রের ও লিপিফলকের বিবরণ থেকে জানা যায় যে, বর্তমান (এ জেলার) তমলুক সন্নিহিত ভূভাগ প্রাচীনকালের সুহ্ম বা তাম্রলিপ্তি জনপদের (বিভাগের) অন্তর্গত ছিল। ‘রাঢ়’ জনপদের দু-টি বিভাগের মধ্যে সুহ্ম বিভাগ সমধিক প্রসিদ্ধ। মহাভারত-এ ভীমের দ্বিগ্বিজয় প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ভীম মুদগগিরি, পুন্ড, বঙ্গ, তাম্রলিপ্তি ও সুহ্মের রাজাদের পরাজিত করেন। দশকুমার চরিত গ্রন্থে সুহ্ম ও তাম্রলিপ্তিকে পৃথক জনপদ না বলে বরং, তাম্রলিপ্তিকে সুহ্মের অন্তর্ভুক্ত বলে বলা হয়েছে। জৈন কল্পসূত্র গ্রন্থে গোদাসগণ নামীয় জৈন সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের অন্যতম শাখার নাম ‘তাম্রলিপ্তিক’ শাখা। জৈন প্রজ্ঞাপনা গ্রন্থেও তামলিপ্তি বঙ্গজনপদের অধিকারে ছিল বলে উল্লিখিত হয়েছে। খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ-৭ম শতকে বরাহমিহির ‘তাম্রলিপ্তিক’ জনপদকে গৌড়ক ও বর্ধমান থেকে পৃথক জনপদ বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু মেদিনীপুর জেলায় আবিষ্কৃত খ্রিস্টীয় ৭ম শতকের শশাঙ্ক প্রদত্ত তিনটি তাম্রপট্ট থেকে জানা যায়, দন্ডভুক্তি ছিল গৌড়রাজ শশাঙ্কের অধীনে এবং উৎকলদেশ ছিল এই রাষ্ট্রবিভাগের অন্তর্গত। এ ছাড়া খ্রিস্টীয় ১০ম শতকের ‘ইর্দা লিপি’তে যে বর্ধমানভুক্তির উল্লেখ করা হয়েছে, তার সীমানা ছিল দন্ডভুক্তি মন্ডল অর্থাৎ, আজকের দাঁতন পর্যন্ত বিস্তৃত। রাজেন্দ্র চোলের তিরুমলয় লিপিতে (১১শ শতক) এবং সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিতে (আঃ ১১-১২ শতক) যথাক্রমে তন্ডবুক্তি = দন্ডভুক্তি ও দন্ডভুক্তি মন্ডলের উল্লেখ আছে। বাঙ্গালীর ইতিহাস প্রণেতা ড. নীহাররঞ্জন রায় লিখেছেন যে, দন্ডভুক্তি বর্তমান মেদিনীপুর (প্রাচীন মিধুনপুর) জেলার দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিম অংশ; বর্তমান দাঁতন প্রাচীন দন্ডভুক্তির স্মৃতিবহ।
খ্রিস্টীয় একাদশ শতকে রাজেন্দ্র চোলের তিরুমলয় লিপিতে জানা যায়, আজকের পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু অংশ তার অধীনস্থ ছিল। ওড্ড বিষয় (ওড়িশা) এবং কোশলৈনাড়ু (দক্ষিণ কোশল) জয়ের পর তাঁর সেনাবাহিনী ধর্মপালকে পরাজিত করে তন্ডবুক্তি (দন্ডভুক্তি) এবং রণসূরকে পরাজিত করে তককণলাড়ম (দক্ষিণ রাঢ়) অধিকার করেন।
ওড়িশার কেন্দুয়া পাটনা, পাঞ্জাবী মঠ এবং শঙ্করানন্দ মঠে রক্ষিত তাম্রপট্টের বিবরণে জানা যায় যে, খ্রিস্টীয় বারো শতকে রামপালের পুত্র কুমারপালের দুর্বলতার সুযোগ ওড়িশার অনন্তবর্মণ যে চোড়গঙ্গ রাঢ় আক্রমণ করে মান্দারের রাজাকে পরাজিত করে তার দুর্গনগর আরম্য ধ্বংস করেন এবং মিধুনপুরের (মেদিনীপুর) ভিতর দিয়ে গঙ্গাতীর পর্যন্ত দখল করেন। এই মান্দার যে গড় মান্দারণ, আরম্য যে আরামবাগ এবং মিধুনপুর যে মেদিনীপুর, সে কথা ড. নীহাররঞ্জন রায় বাঙ্গালীর ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে রক্ষিত মাদলা পঞ্জী-র বিবরণ অনুসারে ওড়িশার পরবর্তী নৃপতি অনঙ্গভীমদেব রাঢ়দেশের দামোদরতীর পর্যন্ত তাঁর রাজ্য বিস্তার করেন। খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতকের প্রথম থেকে বাংলায় মুসলমান অধিকার প্রতিষ্ঠা হতে শুরু হবার পরেও বহুদিন পর্যন্ত মেদিনীপুর জেলার ভূভাগ ওড়িশার অধিনস্থ ছিল বলে মনে হয়। ওড়িশার রাজা কপিলেন্দ্রদেব পনেরো শতকে মেদিনীপুরের কুরুমবেড়ায় যে পাথরের স্থাপত্যসৌধটি নির্মাণ করেন, সেটি থেকেই প্রমাণ হয়, মেদিনীপুরের এই এলাকাটি তখনও ওড়িশার রাজাদের শাসনাধীন রয়েছে।
পরবর্তী পনেরো শতকের শেষদিকে বর্তমান মেদিনীপুর জেলা বাংলার স্বাধীন সুলতানী রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকতে পারে। তবে ষোলো শতকের মধ্যভাগে ওড়িশারাজ মুকুন্দদেব হরিচন্দন বাংলা আক্রমণ করে মেদিনীপুর ও হাওড়ার অংশ-সহ হুগলির ত্রিবেণী পর্যন্ত দখল করে নেন। ১৫৬৮ খ্রিস্টাব্দে আফগান বংশীয় সুলেমান কারনানি মুকুন্দদেবকে পরাজিত ও নিহত করে মেদিনীপুর সমেত চিল্কা হ্রদ পর্যন্ত ওড়িশার এই বিস্তীর্ণ এলাকা অধিকার করেন।
সুলেমান কারনানি ওড়িশায় বিদ্রোহ দমনেই তার অবশিষ্ট জীবন অতিবাহিত করেন। পরবর্তীকালে তাঁর দ্বিতীয় পুত্র দাউদ কারনানিও আকবর বাদশাহের অধীনতা স্বীকার না করায়, এ জেলায় প্রায় তিরিশ বছর ধরে মোগল ও পাঠানে যুদ্ধ বিগ্রেহ লেগে থাকে। মোগল-পাঠান যুদ্ধের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য হল, ১৫৭৫ সালের তুকারই যুদ্ধ। তুকারই দাঁতনের প্রায় তেরো কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। সে যুদ্ধে দাউদ পরাজিত হয়ে মোগল সেনাপতি মুনিম খাঁর সঙ্গে সন্ধি করেন বটে, কিন্তু মুনিম খাঁর মৃত্যুর পর আবার বিদ্রোহী হওয়ায় রাজমহলের যুদ্ধে দাউদ পরাজিত ও নিহত হন।
পরবর্তী ১৬৫১ খ্রিস্টাব্দে মোগলদের ঘরোয়া বিবাদের সুযোগে দাউদ খাঁর সেনাপতি কতলু খাঁ ওড়িশা এবং মেদিনীপুর-সহ বাংলার দক্ষিণ পশ্চিম এলাকার দামোদর পর্যন্ত রাজ্য বিস্তার করলেও শেষ পর্যন্ত মোগলদের সঙ্গে এক চুক্তিবলে মেদিনীপুর-সহ ওড়িশার করদ-রাজ হিসাবে পরিগণিত হন। এরপর পুনরায় আফগান শক্তি বিদ্রোহী হলে মোগল সেনাপতি মানসিংহ ১৫৯৩ সালে সে বিদ্রোহ দমন করেন এবং মেদিনীপুর-সহ ওড়িশা দখল করেন।
মেদিনীপুর জেলার বিভিন্ন প্রান্তে একদা ছোটো-বড়ো বেশ কিছু অর্ধস্বাধীন সামন্ত নৃপতির রাজত্ব ছিল। এঁদের স্মারক হিসাবে পরিখাবৃত গড়বাড়ি বা দুর্গের ধ্বংসাবশেষ আজও দেখা যায়। আইন-ই-আকবরী গ্রন্থতে মেদিনীপুরে যে দু-টি দুর্গের উল্লেখ রয়েছে, সে সম্পর্কে প্রত্নতত্ত্ববিদ মনোমোহন চক্রবর্তীর অনুমান যে, সে দু-টি দুর্গের মধ্যে একটি গোপগড় ও অন্যটি বর্তমানের পুরাতন জেলখানা। এ ছাড়া এ জেলার আড়ঢা তোড়িয়া, আলিশাগড়, চাঙ্গুয়াল, খেলাড়গড়, চন্দ্ররেখাগড়, কর্ণগড়, ময়নাগড় প্রভৃতি প্রাচীন গড় বা দুর্গগুলি বর্তমানে ধ্বংসাবশেষে পরিণত হলেও সেগুলি আজও প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষ্য হয়ে আছে।
মোগল বিজয়ের পর মেদিনীপুর সুবা ওড়িশার অংশ হিসাবে পরিগণিত হয়। সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকালে বাংলার শাসনকর্তা হিসাবে নিযুক্ত শাহজাহানের পুত্র শাহসুজার শাসনকালে সরকার জলেশ্বরকে ওড়িশা থেকে পৃথক করে বাংলার সঙ্গে যুক্ত করেন। এই ব্যবস্থার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, পোর্তুগিজ জলদস্যুদের আক্রমণের হাত থেকে জলেশ্বরের সমুদ্র উপকূলভাগ রক্ষা করা।
সপ্তদশ শতকে মেদিনীপুরের ইতিহাসে তিনটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। ১৬২২ সালে শাহজাদা খুররম (পরবর্তীকালে সম্রাট শাহজাহান) বিদ্রোহী হয়ে মেদিনীপুরের মধ্য দিয়েই দাক্ষিণাত্যে পলায়ন করেন। নারায়ণগড়ের রাজা শ্যামবল্লভ এক রাত্রির মধ্যে এক সড়ক নির্মাণ করে খুররমকে সাহায্য করেন। পরে খুররম বাদশাহ শাহজাহান হয়ে শ্যামবল্লভকে ‘মাড়ী সুলতান’ বা ‘পথের রাজা’ উপাধি দিয়েছিলেন।
দ্বিতীয় ঘটনা, জোব চার্নকের সঙ্গে মোগলদের বিরোধ এবং তারই পরিণতিতে ১৮৬৭ সালে হিজলিতে ইংরেজ ও মোগলের প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে পরাজিত ইংরেজদের সঙ্গে মোগলদের শর্তসাপেক্ষে সন্ধি হয়। তৃতীয় ঘটনাটি হল, ১৬৯৬ সালে মেদিনীপুরের চেতুয়া-বরদার তালুকদার শোভা সিংহের বিদ্রোহ। সে বিদ্রোহে বর্ধমানের মহারাজা কৃষ্ণরাম নিহত হলেও, শেষপর্যন্ত বর্ধমানে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে শোভা সিংহের মৃত্যু হয়। সেজন্য তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ভাই হেম্মত সিংহ বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিতে অগ্রসর হন এবং পাঠান সর্দার রহিম খাঁর সঙ্গে একত্রে বিদ্রোহ ঘোষণা করায়, বাংলার শাসনকর্তা আজিমুশ্বানের হাতে তাদের পরাজয় ঘটে। ফলে এই বিদ্রোহের অবসানে দেশে সাময়িকভাবে শান্তি ফিরে আসে।
আঠারো শতকের শুরুতে বাংলা ও ওড়িশার দেওয়ান হন মুর্শিদকুলি খাঁ। তিনি ১৭২২ সালে যে রাজস্ব সংগ্রহ ব্যবস্থা সংস্কার করেন, তা অনুযায়ী বাংলাকে তেরোটি চাকলায় ভাগ করা হয় এবং প্রত্যেকটি চাকলাকে কতকগুলি পরগনায় বিভক্ত করা হয়।
নবাব আলিবর্দী খাঁর আমলে, ১৭৪২ সালে মেদিনীপুরে মারাঠা আক্রমণ শুরু হয়। ইতিহাসে এটি বর্গী হাঙ্গামা নামে খ্যাত। আলিবর্দী এই মারাঠা আক্রমণের বিরুদ্ধে ক্রমাগত প্রতিরোধ চালিয়ে ১৭৫১ খ্রিস্টাব্দে মারাঠাদের সঙ্গে সন্ধি করেন। সে সন্ধির শর্ত অনুযায়ী স্থির হয় যে, নবাব সুবর্ণরেখা নদীর দক্ষিণ পার পর্যন্ত সমগ্র ওড়িশা মারাঠাদের ছেড়ে দেবেন এবং বাৎসরিক বারো লক্ষ টাকা চৌথ দেবেন। চুক্তি সত্ত্বেও সুবর্ণরেখার উত্তর-পুব এলাকায় ভোগবাই, কামারডিচোর, পটাশপুর ও সাহাবন্ধ পরগনা মারাঠাদের অধিকারে থেকে যায়।
১৭৬০ সালে মীরকাসিমকে বাংলার নবাব করে দেওয়ার বিনিময়ে এক চুক্তিবলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে মেদিনীপুর, চট্টগ্রাম ও বর্ধমান যে হস্তান্তরিত করে দেওয়া হয়, সেকথা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। এই সময় কোম্পানি মেদিনীপুর শহরে বস্ত্রশিল্পের আড়ং স্থাপন করে। ক্ষীরপাই, রাধানগর ও ঘাটাল এলাকাতে ইংরেজ ছাড়া অন্যান্য বিদেশি বণিকরাও রেশম শিল্পের ব্যবসা শুরু করে এবং হিজলিতে দেশীয় প্রথায় লবণ শিল্পটিও ইংরেজ কোম্পানি অধিকার করে।
পৌনঃপুনিক মারাঠা আক্রমণ, দুর্ভিক্ষ এবং সন্ন্যাসী বিদ্রোহের ফলে বিপর্যস্ত জনজীবন চলতে থাকায় এ জেলায় শিল্প-বাণিজ্য ভীষণভাবে ব্যাহত হয়। বাংলা থেকে অর্থশোষণ করাই ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উদ্দেশ্য। তাই কোম্পানির নগদ খাজনা দাবি ও সেইসঙ্গে খাজনার হার বৃদ্ধি এবং লাখেরাজ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করায় জঙ্গলমহল এলাকার জমিদারদের সঙ্গে কোম্পানির বিরোধ শুরু হয়। ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন হওয়ায়, বহু নিষ্কর জমি স্থানীয় জমিদারদের আশ্রিত পাইক বরকন্দাজদের হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার কারণে গোটা মেদিনীপুর জেলার উত্তর-পশ্চিমাংশ জুড়ে যে বিদ্রোহ শুরু হয়, তাই ইতিহাসে ‘চুয়াড় বিদ্রোহ’ নামে খ্যাত। বহু ক্ষয়ক্ষতি ও জীবননাশের পর ১৮০০ সাল নাগাদ কোম্পানি এই বিদ্রোহ নৃশংসভাবে দমন করেন। এরপর ১৮০৫ সাল থেকে ১৮৩২ সাল পর্যন্ত জঙ্গলমহলের নায়েক বিদ্রোহীরা পুনরায় ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করে এবং এই বিদ্রোহীদের দমনে ইংরেজ শাসকদের প্রায় দশবছর সময় লাগে।
এরপর ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের জের এসে পৌঁছোয় মেদিনীপুরে এবং জনৈক তেওয়ারী ব্রাহ্মণের নেতৃত্বে এক ব্যাটালিয়ান রাজপুত সৈন্য বিদ্রোহ ঘোষণা করে। জনশ্রুতি যে, ওই বিদ্রোহী রাজপুত সৈন্যটিকে এখানকার কলেজিয়েট স্কুলের সামনে ফাঁসি দেওয়া হয়। অশান্তি ও বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে মেদিনীপুরের জনজীবন এইভাবেই দীর্ঘদিন অতিবাহিত হয়েছে এবং বিংশ শতকের শুরু থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত এ জেলায় স্বাধীনতার যে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, সে গণ-বিদ্রোহের ইতিহাস বর্তমান আলোচনার বিষয়বস্তু নয় বলেই তা থেকে বিরত থাকা গেল।
মেদিনীপুর জেলার ধর্মীয় স্থাপত্য ও ভাস্কর্য
এ জেলার আয়তনের পরিধি যেমন বিশাল, তেমনি জেলার নানাস্থানে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে নির্মিত বিভিন্ন ধর্মীয় স্থাপত্যের সংখ্যাও অজস্র। এ জেলায় অতি প্রাচীন মন্দির-দেবালয়ের অস্তিত্ব আজ আর না থাকলেও, সেগুলির কেবলমাত্র উল্লেখ পাওয়া যায় কয়েকজন চৈনিক পরিব্রাজকের বিবরণী থেকে। প্রাচীনকালে তাম্রলিপ্ত যখন বন্দর হিসাবে খ্যাত, সে সময় ফা-হিয়েন, হিউয়েন সাঙ প্রভৃতি পরিব্রাজক এখানে বৌদ্ধবিহারের সঙ্গে বহু হিন্দু মন্দিরও লক্ষ্য করেছিলেন। তবে সেসব মন্দিরের গঠন স্থাপত্য যে কোন রীতির ছিল তা স্পষ্টত জানা না গেলেও, প্রাচীন বাংলায় মোটামুটি যে চার শ্রেণির মন্দিরের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় সেগুলি হল, পীঢ়া, শিখর, স্তুূপশীর্ষ পীঢ়া ও শিখরশীর্ষ পীঢ়া দেউল। আলোচ্য এই চার প্রকরণের মন্দিরের মধ্যে শেষোক্ত দু-টি রীতির কোনো মন্দিরের নিদর্শন এ জেলায় দেখা না গেলেও, প্রাচীন বাংলার দন্ডভুক্তিতে যে স্তূপশীর্ষ পীঢ়ারীতির মন্দির প্রচলিত ছিল, সে সম্পর্কে অধ্যাপক সরসীকুমার সরস্বতী খ্রিস্টীয় এগারো শতকের ‘অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা’ পুঁথিতে চিত্রিত সেখানকার এক মন্দিরের উদাহরণ তুলে ধরেছেন। প্রাচীন দন্ডভুক্তি এলাকা যে বর্তমান মেদিনীপুরের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিয়ে গঠিত ছিল, সে সম্পর্কে ইতিপূর্বে প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক বিবরণ প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে।
পূর্বোক্ত প্রাচীন রীতির এই চার প্রকরণ ছাড়াও এ জেলায় আরও এক অভিনব স্থাপত্যের সন্ধান পাওয়া যায়। এ জেলায় অভূতপূর্ব রীতির এই মন্দিরটি খড়্গপুর থানার এলাকাধীন বালিহাটি গ্রামে অবস্থিত। মাকড়া পাথরে নির্মিত ও ভগ্নাবস্থায় পতিত এই স্থাপত্যটির শীর্ষদেশ ভগ্ন এবং জঙ্গলে ঢাকা। সেজন্য আলোচ্য এ মন্দিরটির রীতিপ্রকরণ বেশ অবোধ্য হলেও, এটির গর্ভগৃহের চতুর্দিকে এক ঘেরা প্রদক্ষিণপথ-সহ মূল প্রবেশপথের দু-ধারে দু-টি প্রকোষ্ঠ দেখা যায়। সুতরাং, এ মন্দিরটির গঠন পরিকল্পনায় যে অভিনবত্বের পরিচয় পাওয়া যায়, তা ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় অন্যান্য মন্দিরে অনুপস্থিত। পশ্চিমবঙ্গের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ বালিহাটির এই মন্দিরটির নির্মাণকাল খ্রিস্টীয় দশম শতকের বলে অনুমান করেছেন। কিন্তু এই কাল নির্ণয় হয়তো সম্পূর্ণ গ্রহণযোগ্য হলেও এখানকার এই মন্দিরটি যে মেদিনীপুর জেলার প্রাচীনতম এক মন্দির, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
উল্লিখিত মন্দিরটি ছাড়া প্রাক-মুসলিম যুগের আরও যে একটি মন্দিরের সন্ধান পাওয়া যায়, সেটি বীনপুর থানার এলাকাধীন ডাইনটিকরিতে অবস্থিত। কাঁসাই নদী তীরবর্তী সে মন্দিরটি মাকড়া পাথরে নির্মিত একটি পীঢ়া দেউল এবং বর্তমানে তা একটি পরিত্যক্ত ভূমি। সেটির গঠনস্থাপত্য অনুযায়ী অনুমান যে, খ্রিস্টীয় বারো-তেরো শতকে সম্ভবত এক প্রতিষ্ঠাকাল।
তবে পশ্চিমবাংলার অন্যান্য জেলার মতো, বিশেষ করে বাঁকুড়ার বাহুলাড়া ও সোনাতপল, পুরুলিয়া বড়াম-দেউলঘাটা, পারা, বর্ধমানের দেউলিয়া এবং চব্বিশ পরগনার পশ্চিম জটা গ্রামের মতো, ইটের উচ্চ শিখরযুক্ত মন্দির এ জেলায় নির্মিত হয়েছিল কিনা, তার কোনো হদিশ পাওয়া না গেলেও, এ জেলায় খ্রিস্টীয় দশ থেকে তেরো শতকের মধ্যে পূর্বোক্ত দু-টি মন্দির ছাড়া এ জেলায় আরও অনেক মন্দির যে নির্মিত হয়েছিল তার কিছু কিছু ভগ্নাবশেষ এবং সে সব মন্দিরে পূজিত বিগ্রহাদির নিদর্শন নানাস্থানে পাওয়া গিয়েছে। অতীতে এ জেলার উপর দিয়ে যেভাবে ক্রমাগত রাজনৈতিক ও ধর্মীয় হাঙ্গামার স্রোত বয়ে গেছে, তার ফলে এইসব ধর্মীয় সৌধগুলির অস্তিত্ব বজায় থাকার কথা নয়। বর্তমানে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের ফলে এইসব মন্দির-দেবালয় এবং সে সব দেবালয়ে পূজিত বিগ্রহাদির নিদর্শন প্রাপ্তিতে এ জেলার প্রাচীন মন্দির-দেবালয়গুলির অস্তিত্ব সম্পর্কে কিছুটা ধারণা গড়ে তোলা সম্ভব।
মন্দিরের ভগ্নাবশেষগুলি এ জেলার যেসব স্থানে কেন্দ্রীভূত সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হল, কেলেঘাই নদী তীরবর্তী পাথরঘাটা। এখানে প্রাপ্ত ঘণ্টা ও পদ্মকোরক উৎকীর্ণ পাথরের স্তম্ভগুলি যে কোনো এক প্রচীন দেবালয়ে ব্যবহৃত হয়েছিল তেমন অনুমান মোটেই অসঙ্গত নয়। প্রাপ্ত এসব নিদর্শনগুলি দেখে অনুমান করা যায়, সেগুলি সম্ভবত খ্রিস্টীয় দশ-এগারো শতকের কোনো পুরাকীর্তি।
এ ছাড়া এ জেলার যে এককালে বহু শিখর ও পীঢ়ারীতির মন্দির-দেবালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেগুলি আজ বিদ্যমান না থাকলেও সে সব মন্দিরের ভগ্নাবশেষ ও সেগুলিতে ব্যবহৃত বিরাটাকার আমলকশিলাগুলি আজ অতীতের সাক্ষ্যস্বরূপ বিরাজমান হয়ে আছে। উদাহরণস্বরূপ, এ জেলার কিয়ারচন্দ্র, মৎনগর, রণবনিয়া, ওড়গোঁদা, জিনশহর, ঝাকড়া, চাঙ্গুয়াল, বাড়ুয়া, ভৈরবপুর, রসকুন্ড, রাউতমনি, রোহিণী, পাকুড়সেনী, হীরাপাড়ি, বালীহাটি প্রভৃতি গ্রামগুলিতে যেসব আলকশিলার নিদর্শন পাওয়া যায়, সেগুলি যে সেখানকার কোনো শিখর বা পীঢ়ারীতির মন্দিরে ব্যবহৃত হয়েছিল, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
তবে মুসলমান শাসনের প্রথমভাগে এ জেলার নানাস্থানে ছোটো-বড়ো বেশ কিছু অর্ধস্বাধীন অথবা করদ রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ায়, সেখানকার ভূস্বামীদের কৃত বেশ কিছু মন্দির-দেবালয়ের উদাহরণ দেখা যায়। বিশেষ করে, পনেরো থেকে ষোলো শতকের মধ্যে এ জেলার দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের বেশ কিছুটা অংশে ওড়িশার প্রভাবাধীনে থাকায়, সেইসব এলাকায় বেশ কিছু শিখর ও পীঢ়া মন্দির নির্মাণের প্রমাণ পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ, এ জেলায় গগনেশ্বর, এগরা, দেউলবাড়, সহস্রলিঙ্গ, বাহিরী-দেউলবাড়, ঢেকিয়া, কেদার ও গড়বেতা প্রভৃতি স্থানে প্রতিষ্ঠিত শিখর দেউল এবং দাঁতন, সেঁকুয়া, বেলদা ও গড়বেতায় নির্মিত পীঢ়া দেউলগুলি উল্লেখযোগ্য। তবে উল্লিখিত মন্দিরগুলি ছাড়া পনেরো শতকের শেষ ও ষোলো শতকের প্রারম্ভে একটি মাত্র ইটের চারচালা মন্দিরের নিদর্শন দেখা যায় ঘাটালে, যা সিংহবাহিনীর মন্দির নামে পরিচিত।
এ জেলায় সতেরো শতকে যে মন্দিরগুলি নির্মিত হয়েছে, তার মধ্যে মাত্র দু-টি মন্দিরেই প্রতিষ্ঠালিপি পাওয়া গেছে এবং সে দু-টি মন্দির হল, কেশিয়াড়ীর সর্বমঙ্গলা এবং চন্দ্রকোণার লালগড়ের নবরত্ন। শেষোক্ত মন্দিরটির অবশ্য কোনো অস্তিত্বই আজ আর নেই। লিপিপ্রমাণযুক্ত এ দু-টি মন্দির ছাড়া অনুমানভিত্তিক সতেরো শতকে নির্মিত মন্দিরগুলির অধিকাংশই পাথরের তৈরি এবং বহুক্ষেত্রে এগুলির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন স্থানীয় ভূস্বামী ও রাজা প্রভৃতি।
আঠারো শতকে এ জেলায় দীর্ঘদিন ধরে মারাঠা-বর্গী অত্যাচার চলতে থাকায় এবং সর্বোপরি দুর্ভিক্ষ, সন্ন্যাসী ও চুয়াড় বিদ্রোহের দরুন, গোটা জেলা জুড়ে একটা অস্থির অবস্থা দেখা যায়। সুতরাং, এই শতকে এ জেলায় মন্দির নির্মাণের উদ্যোগ বেশ হ্রাস পায়। তবু এই শতকে নির্মিত যে ক-টি মন্দির-দেবালয়ের সন্ধান পাওয়া যায়, সেগুলির সংখ্যাও কম নয় এবং স্থাপত্য ও অলংকরণ বৈচিত্র্যেও তা বেশ উল্লেখযোগ্য। অবশ্য এই শতকের শেষদিকে রেশম এবং অন্যান্য আরও কতকগুলি শিল্পে উন্নতি ঘটায় বেশ ব্যাপকভাবে মন্দির নির্মাণের উদ্যোগ শুরু হয়। সে কারণে আঠারো শতকের শেষ থেকে উনিশ শতকের শেষ অবধি এ জেলায় যে ব্যাপকহারে মন্দির নির্মাণ হয়েছে তার একটি সামাজিক ভিত্তিও খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। কারণ, এ সময়ের মন্দির প্রতিষ্ঠাতারা ছিলেন ছোটোখাটো জমির উপস্বত্বভোগী, রেশম ও সুতীবস্ত্র, লবণ, দুগ্ধজাত দ্রব্যাদি, গুড় ও পিতলকাঁসা প্রভৃতির উৎপাদক ও ব্যবসায়ী এবং যাজনক্রিয়ারত পূজারী বা কুলপুরোহিত। সুতরাং এইসব প্রতিষ্ঠাতারা তাঁদের বিত্তের অনুপাতে মন্দির স্থাপত্যের সঙ্গে ভাস্কর্যের যোগসাধন করে যেসব নিদর্শন রেখে গেছেন, তা আঞ্চলিক পুরাকীর্তির স্থাপত্য ভাস্কর্যের তুলনামূলক আলোচনা ও গবেষণার সহায়ক হয়েছে।
এ জেলার দেবালয়গুলিকে প্রধানত শিখর, চালা, রত্ন ও দালান এই চার রীতিপ্রকরণে বিভক্ত করা যায়। ভারতীয় দেবালয় স্থাপত্যের ‘নাগর’ শৈলী অনুসারী শিখর মন্দিরের যে স্থাপত্যরূপ এ জেলায় দেখা যায়, তা ওড়িশায় বিবর্তিত শিখর মন্দিরশৈলীর অনুরূপ প্রভাবযুক্ত। কারণ এ জেলাটির সঙ্গে একদা ওড়িশার যোগসূত্র খুব ঘনিষ্ঠ থাকায়, এ রীতিটি যে বহুলাংশে এ জেলায় প্রসারিত হয়েছে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সেদিক থেকে খাঁটি ওড়িশা শৈলীর জগমোহন, নাটমন্দির ও ভোগমন্ডপযুক্ত শিখর মন্দিরের অনুরূপ মন্দিরাদি এ জেলায় তেমন অধিক সংখ্যক দেখা না গেলেও, নয়াগ্রাম থানার দেউলবাড়ের রামেশ্বরনাথের মন্দিরটি এই প্রসঙ্গের এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এ ছাড়া কোনো কোনো ক্ষেত্রে, মূল মন্দিরটি শিখর ও তৎসহ জগমোহনটি পীঢ়ারীতির না হয়ে, গোটাটাই যে পীঢ়ারীতির রূপ গ্রহণ করেছে তেমন মন্দিরের উদাহরণ পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে। পরবর্তীকালে অবশ্য এ জেলার শিখর মন্দিরের ক্ষেত্রে দেখা যায় পীঢ়া জগমোহনের বদলে নির্মাণ করা হয়েছে আঞ্চলিক শৈলীর দোচালা, তিনচালা ও চারচালা রীতির মন্ডপ, যা বাংলা ও ওড়িশি স্থাপত্যের এক সংমিশ্রিত রূপ।
অন্যদিকে, বিশেষ করে এ জেলার কাঁথি মহকুমায়, কতকগুলি শিখর মন্দিরের জগমোহন প্রথাগত পীঢ়ারীতির বদলে শিখরের মতোই উচ্চতাসম্পন্ন করে নির্মাণ করা হয়েছে, যা প্রথম দর্শনে জোড়া শিখর-দেউল বলেই ভ্রম হয় এবং এ জাতীয় স্থাপত্যের নিদর্শন হল, দেউলবাড় (কাঁথি), খারড় (খেজুরি) ও বসুদেবপুর (এগরা) প্রভৃতি স্থানের মন্দিরগুলি।
এ ছাড়া, ওড়িশা মন্দিরশৈলী প্রভাবিত প্রাচীন শিখর মন্দিরের এই রীতিপ্রকরণ খ্রিস্টীয় সতেরো শতকের পর থেকে এ জেলায় পর্যবসিত হয়ে এক সরলীকৃতরূপে এসে পৌঁছেছে। এই রীতি অনুসরণ করে জেলার নানাস্থানে জগমোহন ছাড়াই অসংখ্য শিখর-দেউল নির্মিত হয়েছে। যদিও ওড়িশি শিখর রীতির অংশভাগের নামানুযায়ী ‘বাঢ়’ ও ‘গন্ডী’—এই দু-টি অংশ কেবল নামমাত্রই এসব মন্দিরে দেখা যায় এবং কোথাও কোথাও ‘মস্তক’ অংশে আমলকটিকে একেবারে ক্ষুদ্রাকার করেই নির্মাণ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে পরবর্তীকালের শিখর মন্দিরের এই পরিবর্তিত ও সরলীকৃত রূপায়ণটিকে অনেকে ওড়িশার ময়ূরভঞ্জের খিচিং-এ বিকশিত ওড়িশি মন্দিরশৈলীর প্রত্যক্ষ প্রভাবের ফল বলেই উল্লেখ করে থাকেন। কিন্তু এ মতটি কতটা গ্রহণযোগ্য সে বিষয়ে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছোনো না গেলেও, বাংলার মাটিতে সহজ-সরল করে পরিবর্তিত এই শিখর মন্দিরগুলিও যে চালা ও রত্নমন্দিরের মতোই স্বতন্ত্র এক আঞ্চলিক শৈলীতে পরিণত হয়েছিল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
শিখর রীতির পর চালা রীতির আলোচনা প্রসঙ্গে প্রথমেই বলা যেতে পারে, এ রীতিটি বাংলার নিজস্ব। গ্রামবাংলায় বাঁশ, কাঠকুটো ও খড়ের ছাউনি দিয়ে নির্মিত দোচালা কুঁড়েঘরের আদলে বাঙালি শিল্পী-স্থপতিরাও সেইভাবে দোচালা মন্দির নির্মাণে প্রয়াসী হয়েছেন। পশ্চিমবাংলার অন্যত্র এই ধরনের দোচালা মন্দিরের বহু উদাহরণ থাকলেও, এই জেলায় বর্তমানে এই রীতির মন্দিরের দৃষ্টান্ত খুব কমই দেখা যায়। কেবলমাত্র রামপুর গ্রামেই এর একটিমাত্র নিদর্শন রয়েছে। তবে এককভাবে দোচালা মন্দিরের তেমন কোনো নজির না থাকলেও, শিখর বা একরত্ন মন্দিরের সম্মুখভাগে লাগোয়া মুখমন্ডপ হিসাবে, অথবা চারচালা মন্দিরের সংলগ্ন জগমোহন হিসাবে নির্মিত এমন দোচালার কিছু কিছু উদাহরণ এ জেলায় দেখা যায়। সে সব মন্দিরের মধ্যে প্রথমোক্তটির উদাহরণ হল, এরাপুর ও মোহনপুর এবং শেষোক্তটির নিদর্শন হল আমোদপুর।
অন্যদিকে দু-টি দোচালাকে পাশাপাশি স্থাপন করে এবং শীর্ষে কখনো চূড়া সংযোগ করে যে দেবালয়টি নির্মাণ করা হত, সেগুলিকেই বলা হয় জোড়বাংলা। এ জেলায় এ রীতির উদাহরণ খুব বেশি না হলেও, এ শৈলীর উল্লেখযোগ্য মন্দিরটি হল, চন্দ্রকোণার দক্ষিণবাজারে অবস্থিত মাকড়া পাথরের জোড়বাংলা, যা সতেরো শতকের প্রাচীন বলেই অনুমান করা যায়। এ ছাড়া মাকড়া পাথরের আরও যে দু-টি জোড়বাংলা দেখা যায়, সেগুলি হল লালগড়ের রাধামোহনজিউর এবং বসনছোড়ায় রাধাগোবিন্দ-এর মন্দির। এ জেলায় বাদবাকি ইটের জোড়বাংলা মন্দিরগুলি রানীচক, মেদিনীপুর-বড়োবাজার ও মীরজাবাজার এবং পাইকপাড়িতে অবস্থিত।
আটচালা খোড়ো ঘরের সামনে যেমন তিনচালাযুক্ত বারান্দা নির্মাণ করা হয়, তেমনি আটচালা মন্দিরের সঙ্গে তিনচালা মুখমন্ডপ নির্মাণের যথেষ্ট দৃষ্টান্ত রয়েছে পাশাপাশি হাওড়া জেলায়। এ জেলায় সে ধরনের একটিমাত্র দৃষ্টান্ত দেখা যায় জনার্দনপুর গ্রামে। তবে এ জেলায় শিখর মন্দির নির্মাণের ধারাবাহিকতা থাকায়, শিখর মন্দিরের সঙ্গে তিনচালা মুখমন্ডপ জুড়ে দিয়ে যে জগমোহন নির্মাণের প্রচেষ্টা করা হয়েছে, তার নিদর্শন দেখা যায় লোয়াদা, বলরামপুর ও সুজাগঞ্জ প্রভৃতি স্থানের মন্দিরগুলিতে।
অন্যদিকে চালা মন্দিরের আর এক উদাহরণ হল চারচালা মন্দির, যা গ্রামের চারচালা কুঁড়েঘরের আদলে গঠিত। তবে এ রীতির মন্দির এ জেলায় তেমন আদৃত হয়নি বটে, কিন্তু ঘাটালের সিংহবাহিনীর চারচালা জগমোহন-সহ চারচালা মন্দিরটি খ্রিস্টীয় পনেরো শতকের শেষে নির্মিত এক প্রাচীন চারচালা মন্দিরের দৃষ্টান্ত। পরবর্তী আনুমানিক সতেরো শতকের পাথরের একটি চারচালা মন্দিরের দৃষ্টান্ত হল, গোয়ালতোড়ের সনকা মায়ের মন্দির। পাথরের আরও যে ক-টি চারচালা মন্দির দেখা যায়, সেগুলির অবস্থান হল, জয়ন্তীপুর, রঘুনাথপুর, আমনপুর ও মোষদায়। এ ছাড়া আমনপুর, দেউলি, গোপগড়, আমোদপুর ও শিলদা প্রভৃতি স্থানে ইটের চারচালা মন্দিরও দেখা যায়। নাটমন্ডপ ও দোলমঞ্চ হিসাবে ব্যবহৃত চারচালা রীতির ইমারত এ জেলায় আরও যেসব স্থানে দেখা যায়, সেগুলি হল বনপাটনা, খন্ডরুই এবং পাইকপাড়ি। অন্যদিকে শিখর-দেউলের সঙ্গে জগমোহন হিসাবে চারচালার ব্যবহার দেখা যায়, বেংদা, সারতা, পাইকভেড়ি ও দামোদরপুর প্রভৃতি স্থানের মন্দিরগুলিতে।
গ্রামের আটচালা কুঁড়েঘরের অনুকরণে নির্মিত আটচালা মন্দিরের সংখ্যাও এ জেলায় কম নয়। জেলায় বৃহদায়তন ইটের আটচালাগুলির মধ্যে উল্লেখ করা যেতে পারে চাঁইপাট, খুকুড়দহ, তমলুক, মহিষাদল, দেউলপোতা, রামবাগ, ভবানীপুর, ক্ষীরপাই, মালঞ্চ এবং মনোহরপুর প্রভৃতি স্থানের মন্দির। এই পর্যায়ের ঝামাপাথরের আটচালা মন্দিরের নিদর্শন রয়েছে চন্দ্রকোণা, গড়বেতা, পাথরবেড়িয়া ও ব্রাহ্মণগ্রাম প্রভৃতি স্থানে। তবে এ জেলায় আটচালা মন্দির-স্থাপত্যের মধ্যে বেশ বৈচিত্র্যও লক্ষ্য করা যায়। সে সব অভিনব মন্দিরগুলির উপর ও নীচের চালের মধ্যবর্তী স্থানে সামান্য ফাঁক থাকে; দৃশ্যত মনে হয় যেন চারচালা মন্দিরের টানা চালের দেওয়ালে আড়াআড়িভাবে কোনো রেখা টেনে আটচালার রূপ দেওয়া হয়েছে। বাঁকুড়া জেলার নানাস্থানে এবং সে জেলার সংলগ্ন মেদিনীপুর জেলার গড়বেতা ও চন্দ্রকোণা থানা এলাকার বেশ কিছু অংশে এই স্থাপত্যরীতির মন্দির দেবালয় গড়ে উঠেছে। এ রীতির উদাহরণযুক্ত মন্দির হল, গড়বেতা, ব্রাহ্মণগ্রাম, চন্দ্রকোণা, শিলদা ও কর্ণগড় প্রভৃতি। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে, এ জেলায় একদুয়ারী কতকগুলি আটচালা মন্দির আবার শিখর-দেউলের মতোই রথপগ বিন্যাসযুক্ত, যার দৃষ্টান্ত হল, সত্যপুর, গোপালনগর প্রভৃতি।
এ জেলায় বহুস্থানে বারোচালা বাড়িরও বেশ কিছু দৃষ্টান্ত রয়েছে এবং তারই অনুকরণে নির্মিত বারোচালা মন্দিরের উদাহরণও এ জেলায় দেখা যায়। তবে এ-জাতীয় মন্দিরগুলির আটচালার উপর ক্ষুদ্রাকার একটি চারচালা সংযুক্ত করে বারোচালায় পরিণত করা ছাড়াও, অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিখর মন্দিরের মতো সেগুলিকেও রথপগ করা হয়েছে এবং এ-জাতীয় মন্দির শৈলীর নিদর্শন হল, নতুক জয়কৃষ্ণপুর, জলসরা ও চিরুলিয়া গ্রামের মন্দির।
চালা মন্দিরের মতো ‘রত্ন’ মন্দিরের কার্নিসও বাঁকানো আকারের এবং ছাদও সেইমতো ঢালু হলেও তার স্থাপত্যরীতিতে বেশ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। এক্ষেত্রে চূড়া হল রত্ন কথাটির সমার্থক। সুতরাং, ছাদের কেন্দ্রে একটি চূড়া নির্মাণ করলে হয় একরত্ন এবং সেটিকে ঘিরে ছাদের চারকোণে ক্ষুদ্রতর আর চারটি চূড়া স্থাপন করলে সেটি হয় পঞ্চরত্ন মন্দির। এইভাবে মন্দিরতলের সংখ্যা বাড়িয়ে বা প্রতি তলের কোণে কোণে চূড়ার সংখ্যা বর্ধিত করে তেরো বা সতেরো থেকে পঁচিশ চূড়া মন্দিরও নির্মিত হতে পারে। এ জেলায় মন্দিরের এইসব রত্নগুলির স্থাপত্যও অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘রথপগ’ করা শিখর-দেউলের মতোই, যেন বাংলা ও ওড়িশা সংস্কৃতির এক মিশ্ররূপ এই রত্ন রীতির মন্দির। সমীক্ষায় দেখা যায়, এ জেলার উত্তর-পূর্বাংশে এ রীতির মন্দির যেন বেশি আদৃত হয়েছে।
তবে একরত্ন মন্দিরের সংখ্যা এ জেলায় ঠিক কত তা জানা সম্ভব নয়। কারণ প্রাচীন একরত্নগুলির অধিকাংশই বিধ্বস্ত নয়তো বা সেগুলি ভগ্নদশায় পতিত। এ ছাড়া এ জেলার দক্ষিণাংশে একরত্ন মন্দিরের রত্নটি এমন বৃহদাকার পরিসরে নির্মাণ করা হয়েছে, যেন প্রথম দর্শনেই মনে হয় কোনো রত্ন মন্দিরের বদলে শিখর মন্দির। এ ধরনের মন্দিরের দৃষ্টান্ত দেখা যায়, হরিপুর, গোপালপুর, আলংগিরি ও মোহনপুর প্রভৃতি গ্রামে।
এ জেলায় একরত্ন অপেক্ষা পঞ্চরত্ন ও নবরত্ন রীতির মন্দিরই নির্মিত হয়েছে সর্বাধিক। এর মধ্যে লিপিযুক্ত প্রাচীন দু-টি পঞ্চরত্ন মন্দিরই ঘাটাল থানায় নবগ্রাম ও রাধানগরে অবস্থিত। সতেরো শতকে প্রতিষ্ঠিত চন্দ্রকোণার পাথরের নবরত্ন-মন্দিরটি বর্তমানে বিধ্বস্ত হলেও সেটিতে নিবদ্ধ এক প্রতিষ্ঠালিপি থেকে এ মন্দিরটির স্থাপয়িতা ও প্রতিষ্ঠার তারিখ জানা যায়।
রত্ন মন্দিরের মধ্যে পরবর্তী তেরো রত্ন রীতির মন্দিরের নিদর্শন এ জেলায় খুবই কম এবং উদাহরণ হিসাবে রামগড় ও উদয়গঞ্জের মন্দিরের কথা বলা যেতে পারে। এ ছাড়া সতেরো রত্ন মন্দিরের একটিমাত্র নিদর্শন হল চন্দ্রকোণার রঘুনাথপুরের পার্বতীনাথ শিব মন্দির।
বাংলা মন্দিরশৈলীর সাধারণ আর এক রূপ হল, দালান রীতির মন্দির। সামনে স্তম্ভের উপর অলিন্দসমেত সমতল ছাদযুক্ত আয়তাকার বা বর্গাকার ধরনের মন্দির গুপ্তযুগেও (খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকে) যে প্রচলিত ছিল তার নিদর্শন দেখা যায় সাঁচীতে। পশ্চিমবাংলায় তথা মেদিনীপুর জেলাতেও এ-জাতীয় সামনে খিলানযুক্ত অলিন্দসমেত সমতল ছাদের অসংখ্য দেবালয় দেখা যায়। এ রীতির মন্দির যে সাধারণভাবে ‘দালান’ রীতির মন্দির নামে পরিচিত ছিল, তা বাঁকুড়া জেলার ভগলপুর গ্রামের মন্দিরে নিবদ্ধ প্রতিষ্ঠালিপিতে (দ্র. অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাঁকুড়া জেলার পুরাকীর্তি, ২য় সংস্করণ, পৃ. ১০০) এবং এ জেলার জাড়া গ্রামের এক মন্দিরলিপিতে স্পষ্টভাবে উল্লিখিত হয়েছে। অন্যদিকে, স্নানের ঘাটে চারদিক খোলা শুধুমাত্র থামের উপর স্থাপিত সমতল ছাদযুক্ত ইমারতগুলিকে সাধারণভাবে ‘চাঁদনি’ বলা হয়ে থাকে এবং যেজন্য এই ধরনের দেওয়ালবিহীন শুধুমাত্র থামযুক্ত ‘চাঁদনী’আঁটা প্রশস্ত চক বা বাজার নানাস্থানে চাঁদনিচক নামেও অভিহিত হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, এই বৈশিষ্ট্যযুক্ত নাটমন্দিরগুলিকেও যে ‘চাঁদনী-মন্ডপ’ নামে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল, তারও কিছু কিছু লিপির সাক্ষ্য পাওয়া যায়।
শুধুমাত্র একতলা দালান রীতির মন্দিরই যে এ জেলায় নির্মিত হয়েছে এমন নয়, দোতলা দালান মন্দিরও যে এ জেলার উত্তর-পূর্বাংশে সমাদৃত হয়েছিল তার প্রমাণ হল, নতুক জয়কৃষ্ণপুর, মনোহরপুর ও কাটান গ্রামের মন্দির। শেষোক্ত মন্দিরটিতে পোড়ামাটির উৎকৃষ্ট অলংকরণ-সজ্জা বিদ্যমান। এ ছাড়া, মেদিনীপুর জেলায় মন্দির স্থাপত্য বিষয়ে দালান মন্দিরের সঙ্গে আটচালা, পঞ্চরত্ন ও শিখর মন্দির সংস্থাপন করে এক অভিনব স্থাপত্যের রূপ দেওয়া হয়েছে। গড়ময়না, পিংলা, ঈশ্বরপুর, পাইকভেড়ী ও বসন্তপুর প্রভৃতি স্থানের পুরাকীর্তি প্রসঙ্গে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
অন্যান্য জেলাগুলির মতোই এ জেলায় আটকোণা ন-চূড়াযুক্ত রাসমঞ্চও নির্মিত হয়েছে বহুল পরিমাণে। কতকগুলি স্থানে রাসমঞ্চের চূড়া শিখর-দেউলকৃতি না হয়ে ‘রসুন’-এর মতো আকৃতিসদৃশ হওয়ায় সেগুলিকে ‘রসুনচূড়া’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। প্রথাগতভাবে ন-চূড়া রাসমঞ্চ ছাড়াও সতেরো চূড়া ও পঁচিশ চূড়া রাসমঞ্চও দেখা যায়। অন্যদিকে, দাসপুর থানা এলাকার গোপালপুর ও ডিহিবলিহারপুর গ্রামের রাসমঞ্চ দু-টি প্রথাগত না হয়ে সেগুলি নবরত্ন মন্দির সদৃশ দেখা যায়। এ ছাড়া প্রায় আধ মিটার থেকে এক মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট পোড়ামাটির বিভিন্ন বাদিকা ও দ্বারপালের মূর্তি এইসব রাসমঞ্চে নিবদ্ধ ছাড়াও, কৃষ্ণলীলা বিষয়ক নানাবিধ পোড়ামাটির অলংকরণও দেখা যায়। এই ধরনের তিনটি রাসমঞ্চের উদাহরণ হল, মাংলোই, চাউলি এবং ক্ষীরাটি। এ ছাড়া পঞ্চরত্ন রীতির চারদিক খোলা তুলসীমঞ্চের উদাহরণ দেখা যায়, ঘাটাল-গম্ভীরনগর এবং হুসেনীবাজার প্রভৃতি স্থানে।
এ জেলায় বেশ কিছু মন্দির-দেবালয়ের বহিরঙ্গ সজ্জায় ‘টেরাকোটা’-অলংকরণ করা হয়েছে। বহুক্ষেত্রে মন্দিরের শুধু সামনের দেওয়ালই নয়, মন্দিরের দু-পাশে এবং গর্ভগৃহে প্রবেশপথের দেওয়ালেও ‘টেরাকোটা’-সজ্জা দেখা যায়। দাঁতন থানা এলাকার দামোদরপুর গ্রামের বৃন্দাবনচন্দ্রের শিখর মন্দিরের ভিত্তিবেদিতে বৃহদাকার পোড়ামাটির ফলক সংস্থাপন একান্তই অভিনব এবং সেটি পাল-সেন আমলের পাহাড়পুর বিহারের ভিত্তিগাত্রে অনুরূপ পোড়ামাটির অলংকরণ বিন্যাসের কথাও স্মরণ করিয়ে দেয়। মেদিনীপুর জেলার মন্দিরগাত্রে উৎকীর্ণ পোড়ামাটির ফলকসজ্জার প্রধান বিষয়বস্তু হল, কৃষ্ণলীলা, বিষ্ণুর দশাবতার ও রাম-রাবণ-এর যুদ্ধ দৃশ্যসহ নানাবিধ পৌরাণিক কাহিনি। সেকালের সাধারণ মানুষের ও মন্দিরের পরিচালক মোহন্ত সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রার চিত্র, সমকালীন ফিরিঙ্গি জীবনচিত্র, ধনী ভূস্বামীদের বিলাসবহুল জীবনের ভাস্কর্য, মিথুন দৃশ্য, ফুলকারি ও জ্যামিতিক নকশাও এইসব পোড়ামাটির ফলকে স্থান পেয়েছে।
পোড়ামাটির অলংকরণের সঙ্গে পঙ্খের অলংকরণও এ জেলায় ব্যবহৃত হয়েছে বহুল পরিমাণে। একই মন্দিরে পোড়ামাটি ও পঙ্খের যুগপৎ ব্যবহারের নিদর্শনও এ জেলায় বহু মন্দিরে দেখা যায়। এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য দু-টি মন্দির হল, তিলন্তপাড়া এবং আনন্দপুর।
পোড়ামাটির অলংকরণসদৃশ কাঠখোদাইয়ের কাজেও সমান দক্ষতা দেখিয়েছেন এ জেলার শিল্পী-স্থপতিরা। এসব কাঠের ভাস্কর্যের নিদর্শন বেশিরভাগ দেখা যায় মন্দিরে নিবদ্ধ কাঠের দরজায় পাল্লায় ও চৌকাঠে। এ-ছাড়া রামগড়ের আটচালায় কাঠের খুঁটি ও কাঠামোয় যে ভাস্কর্য-অলংকরণ দেখা যায় তা একান্তই উল্লেখযোগ্য।
ইতিপূর্বে যে মন্দির স্থাপত্য ও ভাস্কর্য এবং দারুতক্ষণশিল্পের উল্লেখ করা হল, সেগুলির স্থপতি ও কারিগরদের সম্পর্কেও বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেছে সংশ্লিষ্ট মন্দিরের প্রতিষ্ঠালিপিতে। সেসব লিপিতে এইসব শিল্পীদের নাম ও নিবাস উল্লিখিত হওয়ায় তাঁদের কেন্দ্রীভূত বাসস্থান সম্পর্কে মোটামুটি একটা স্পষ্ট ধারণা জন্মায়। দেখা গেছে এসব শিল্পীগোষ্ঠী নিজেদের ‘সূত্রধর’ অথবা ‘মিস্ত্রি’ বা ‘কারিগর’ বলে পরিচয় দিয়েছেন এবং বহুক্ষেত্রে তাঁদের পদবী চন্দ্র, দে, শীল, দাস, সাঁই ও কুন্ডু প্রভৃতি বলে উল্লেখ করেছেন। এইসব মন্দিরের উৎসর্গলিপিতে তাঁদের নিবাস সম্পর্কে যে উল্লেখ পাওয়া যায়, তা থেকে বোঝা যায় তাঁরা সাধারণত এ জেলায় দাসপুর, রাজহাটি, তোড়াপাড়া, নির্মলবাজার, বরদা, কলমিজোড়, গৌরা, আজুড়িয়া, হবিবপুর, ক্ষীরপাই ও চন্দ্রকোণা প্রভৃতি স্থানে বসবাস করতেন। একসময় এ জেলার ঘাটাল মহকুমার বেশ কিছু অংশ হুগলি জেলার অধীনে থাকায়, সেখানকার সেনহাটি, খানাকুল, ঘোসপুর প্রভৃতি স্থান থেকে আগত মন্দির স্থপতিরাও এ জেলার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বহু মন্দির নির্মাণ করেছেন। অনুরূপভাবে, পার্শ্ববর্তী জেলা বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর এলাকার এমন বহু শিল্পীও এ জেলার মন্দির তৈরিতে অংশগ্রহণ করেছেন। দাসপুরের বিখ্যাত মন্দির স্থপতিদের মধ্যে ঠাকুরদাস শীল এ জেলায় মোট পাঁচটি, হরিহরি চন্দ্র, বৃন্দাবন চন্দ্র, আনন্দ মিস্ত্রি প্রত্যেকে দু-টি করে মন্দির নির্মাণ করেছেন বলে প্রতিষ্ঠালিপি থেকে জানা গেছে। এ ছাড়া এ জেলায় সেনহাটের মাহিন্দ মিস্ত্রি তিনটি ও তিনকড়ি মিস্ত্রি দু-টি মন্দির যে নির্মাণ করেছেন তার লিপিও প্রমাণ হিসাবে বিদ্যমান। অন্যদিকে পাথরের মন্দির-নির্মাণ কারিগর হিসাবে পাত্র পদবীধারী যে শিল্পীর পরিচয় মারকুন্ডা ও বনপাটনা গ্রামের মন্দিরলিপিতে পাওয়া যায়, তাঁর নিবাসের কোনো উল্লেখ অবশ্য পাওয়া যায় না।
এ জেলার মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের প্রতিষ্ঠিত বহু মসজিদ, ইদগা, দরগা ও মাজার দেখা যায় এবং পুরাকীর্তি হিসাবে সেগুলিও বেশ উল্লেখযোগ্য। তবে ‘টেরাকোটা’-সজ্জা সমন্বিত কোনো মসজিদ এ জেলায় দেখা না গেলেও সতেরো শতকে ইট ও মাকড়া পাথর দিয়ে তৈরি মসজিদের অবস্থান লক্ষ্য করা যায়।
ইংরেজ অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবার পরেই, খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে এ জেলার কেরানিটোলায় রোমান ক্যাথলিকদের গীর্জাটি প্রতিষ্ঠিত হয়, পরে চার্চ অব ইংল্যাণ্ডের উদ্যোগে ‘সেন্ট জনস চার্চ’ গীর্জাটি ১৮৫১ সালে মেদিনীপুর রেল স্টেশনের নিকটবর্তী সেকপুরায় প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তী উনিশ শতকের শেষদিকে আমেরিকান ব্যাপটিস্ট মিশন সম্প্রদায়ের গীর্জাটি প্রতিষ্ঠিত হয় আবাসগড়ে।