অখণ্ড ভারতবর্ষ – ৮০

৮০

গৃহিনী সন্তানসম্ভবা— জেনে প্রথম যে পরিচিত ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম— তিনি একটি বহুমূল্য জ্ঞান বিনামূল্যে দান করেছিলেন। ‘এইবার তুমি টের পাবে— পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই ডাক্তার। সবাই পরামর্শ দেবে। কানে তুলো দাও। সেটাই করবে— যেটা তোমার জ্ঞানবুদ্ধি অনুযায়ী সঠিক।’

আমার জ্ঞান যদ্রূপ— বুদ্ধিও তদ্রূপ। তবু কথাটা মনে ধরল— যখন আত্মীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধব সকলেই উপদেশ দিতে লাগলেন। এইবার তুলো কাজে এল। আমি নির্বিকার চিত্তে পরবর্তী সাত মাস বাইকে সস্ত্রীক ঘুরে বেড়ালাম, অবিশ্যি গর্ত এড়িয়ে। গিন্নি এতাদৃশ অত্যাচার সত্বেও বহালতবিয়ত রইলেন, এবং যথাকালে একটি সুস্থ সবল সন্তানের জন্ম দিলেন। অবিশ্যি কত্তা-গিন্নিতে একটি চমৎকার কন্যা-নাম ঠিক ক’রে রেখেছিলাম— ছেলে হওয়ায় সেটা জলে গেল। যাক গে’…সুস্থ সন্তান। আবার কি!

ছেলে তো দিব্যি ‘মাতার স্তন্যসুধা’ পান ক’রে প্রথম ছ’মাস কাটিয়ে দিল। সপ্তম মাসে তাকে নিয়ে নিয়ে গেলাম এক ডাক্তারের কাছে। আমি আমার ‘জ্ঞানবুদ্ধি’ মত ভেবে রেখেছিলাম— টিনবন্দি বেবিফুড তার দরকার নেই, এইবার খাঁটি খাওয়া আরম্ভ হবে। কিঞ্চিৎ পড়াশুনোও করলাম। বন্ধু ডাক্তারবাবুরাও বললেন— বেবিফুড নাকি এড়িয়ে যাওয়াই ভাল। বাড়িতেই ও বস্তুটি দিব্যি তৈরি করা সম্ভব— সে বরং ঢের ভাল আর পুষ্টিকর হবে। তা ডাক্তারবাবু বিস্তর পরীক্ষা-টরিক্ষা ক’রে প্রেসক্রিপশন লিখতে লাগলেন—

সকাল ছ’টায়— অমুক বেবিফুড

সকাল ন’টায়— তমুক বেবিফুড… ইত্যাদি।

সসঙ্কোচে বললাম— ‘ইয়ে… ডাক্তারবাবু, এগুলোর কোনও বাড়িতে-তৈরি বিকল্প হয় না? মানে এক বন্ধু বলছিল…’

ব্যস্ত চিকিৎসক আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কেটে কেটে বললেন— ‘যা বোঝেন না, সে বিষয়ে কথা বলবেন না। আপনাকে বোঝানোর সময় আমার নেই; যা বললাম— ইচ্ছে করলে করবেন— নইলে যা খুশি করতে পারেন! এখানে এসেছেন কেন? বিরক্তিকর! আমার সময়ের দাম জানেন?’

পষ্ট টের পেলাম— শরীরে মুছে-আসা বাঙাল গোঁয়ার্তুমি আড়মোড়া ভাঙছে। বিরল ধৈর্যচ্যুতি ঘটল আমার। ডাক্তারবাবুর চোখে চোখ রেখে ওইরকমই চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম—‘আসলে আপনি যে গাড়িটায় এসেছেন— সেটা কোন কোম্পানির উপহার— তা অবিশ্যি জানি না। কিন্তু আমার বাইকটা নিজের পয়সায় কেনা।’

তুমুল গণ্ডগোল, চিৎকার, চেঁচামেচি। গিন্নি কাঁদছে; যে ওষুধের দোকানে ডাক্তারবাবু বসেন— তার মালিক কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভঙ্গিতে ডাক্তার এবং পরিচিত অভিভাবক— উভয়কে সামলাচ্ছেন। বিচ্ছিরি সিন।

সেখান থেকে বেরিয়ে এসে সটান বিশ্বকে ফোন— ‘আসতে পারবি? জরুরি দরকার।’ দশ মিনিটে বিশ্ব হাজির। সোজা বারাসাত। মুখভঙ্গি দেখে এতকালের বন্ধু কিছু বলার সাহস পেল না, নিঃশব্দে গাড়ি চালিয়ে চলল। গেলাম সেই ডাক্তারের কাছে— যিনি জন্মমাত্রে ছেলেকে পরীক্ষা করেছিলেন। চুয়ান্ন নম্বরে নাম, পঁয়তাল্লিশ চলছে। থম মেরে বসে রইলাম একটি ঘন্টা। মাথায় আগুন জ্বলছে— যা বলেছেন— সে জন্য নয়। যেভাবে বলেছেন— তার জন্য। সত্যিই তো এ বিষয়ে আমি কিস্যু জানি না। কিন্তু সে কথাটা ভদ্রভাবে বলা যেত না!

প্রায় দেড়টার সময় ডাক পড়ল। ক্লান্ত মানুষটি প্রায় এলিয়ে ছিলেন চেয়ারে। চেম্বারে ঢুকে সটান বললাম— ‘বাইরে যে গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে, সেটা কোন কোম্পানি দিয়েছে আপনাকে?’

আমায় খানিক নিবিষ্ট চোখে দেখে হো হো ক’রে হেসে উঠে তিনি বললেন—‘কার সঙ্গে ঝগড়া ক’রে এলেন মশাই?’

বললাম সব কথা। আবার পরীক্ষানিরীক্ষা। তারপর খসখস ক’রে লিখতে লাগলেন—

সকাল ছ’টায়— চিঁড়েসেদ্ধ, ভাল ক’রে চটকে….

সকাল ন’টায়— ভাত গলিয়ে ডালের জল দিয়ে মেখে ছাঁকনিতে… ইত্যাদি…

সব বুঝিয়ে দিয়ে হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন— ‘এত্ত ভাল লেখেন আপনি! ‘‘আহির ভৈরবের’’ কবি যদি এমন রেগে যান— সেটা কি শোভন হয়, বলুন দেখি!’

তাই বলছিলাম কি— মানুষ যখন নানারকম— ডাক্তারও তো নানারকমই হবেন— তাই না? কেউ সৎ, কেউ অসৎ। সবাইকে একধারসে দেগে দেওয়াটা কী ঠিক হচ্ছে? শ্রীপতি সামন্তর সেই বিখ্যাত বক্তব্যটা ভুলে গেলে কিন্তু ভারি অন্যায় হবে—‘জাত তুলকে গালাগালি দেওয়াটা আবার কোন্ দেশি ভদ্রতা রে বাপু!’

৮১

তখন সদ্য স্কুলে জয়েন করেছি, হালচাল বুঝি না কিছু। প্রাচীন এক অট্টালিকার বার-বাড়িতে স্কুল চলে। বাইরে পাঁচিলের গায়েই স্কুলের দারোয়ান বীরেনদার কচুরি-মিষ্টির দোকান। মিড-ডে মিল ছিল না তখনও। বাচ্চাগুলো বেজায় গরীব, না-খেয়ে আসে বেশির ভাগ। দুপুরে বাড়ি থেকে কেউ এসে খাবার দিয়ে যায়। ভাত বা রুটি। নইলে বীরেনদার দোকান থেকে কচুরি কিনে খায়।

একদিন টিফিনের সময় দেখি,একটা বাচ্চা সিঁড়িতে ব’সে কাঁদছে। জানা গেল, বাড়ি থেকে খাবার আসে নি। পয়সা দিতে গেলাম। নেবে না। কিছুতেই না। মহা মুশকিল। কী করি!

এমন সময় বেরিয়ে এলেন হেডমাস্টার মশাই। এক পলক তাকিয়ে থেকেই ভয়ংকর গর্জন— ‘বাড়ি থেকে খাবার আসে নি! ব’সে কান্না হচ্ছে! ন্যাকা!!’ এ কী বিশ্রী অসভ্যতা! আমার তখন কান ঝাঁ ঝাঁ করছে রাগে। তিনি কিন্তু তখনও একই গলায় ধমকে চলেছেন—‘আর ন্যাকামো না করে এটা ধর্!’

দেখি, হাতে একটা দশ টাকার নোট। ‘নে বলছি ! কচুরি নিয়ে আয়। নইলে ঠাস ক’রে…’

ভয়ে কাঠ বাচ্চাটা ছুট দিল টাকা নিয়ে। আমার দিকে ফিরে, চোখ টিপে এক্কেবারে অন্যরকম গলায় তিনি বললেন— ‘আসলে বড্ড গরীব তো। আর কিছু নেই; আত্মসম্মান আছে ষোলো-আনা। না ধমকালে নিত-ই না ব্যাটা ! চলো, চা খাওয়া যাক।’

নাঃ, মানুষ চেনা এ জন্মে আমার দ্বারা হবে না। বুঝলেন! বিচিত্র দেশ বটে! আর তেমনি বিচিত্র সব লোকজন!!

৮২

সম্প্রতি দু’টি আপডেট দেখলাম। দু’টিই দিয়েছেন দুই তরুণী। মর্ম মোটের উপর একই। যাঁরা তাঁদের সঙ্গে ইনবক্সে গল্প করেন না, তাঁরা যেন অনর্থক ভিড় না বাড়িয়ে বন্ধুতালিকা থেকে বিদায় নেন। তাঁদের একজনকে আমি তৎক্ষণাৎ আমার তালিকা থেকে আমার অপারগতা জানিয়ে বিদায় দিই। অন্যজনের ক্ষেত্রে সময় পাইনি। যথাকালে দেব।

আমার ইনবক্স স্বভাবতই একটা বিচিত্র বাক্স। সেখানে শব্দার্থ জানার প্রশ্ন আছে, আছে নতুন লেখকদের পাঠানো অজস্র মতামত জানতে চাওয়া গল্প-কবিতা (ভুলবশত এঁরা আমায় মস্ত আলেম ঠাউরেছেন); এক বন্ধু আছেন— যিনি প্রত্যহ কিছু গান পাঠিয়ে দেন; কয়েকজন সম্মাননীয় বন্ধু পাঠান রবীন্দ্রসঙ্গীত থেকে দু’এক কলি প্রত্যেক প্রভাতে। তো তেমনই এক অচেনা বন্ধু একদিন লিখলেন এক বিচিত্র চিঠি। তাঁর টাকার দরকার। অনেক টাকা। নাঃ, নিজের জন্য নয়। তাঁর টাকা চাই কম্বল কেনার জন্য। কলকাতার ফুটপাথে অগুন্তি মানুষ শীতের রাত্রি কাটান খোলা আকাশের নীচে— তাঁদের জন্য কম্বল দরকার। অনেক কম্বল। অনেক টাকাও চাই তাই। তিনি জানেন— অনেক টাকা দেওয়ার ক্ষমতা নেই আমার। তা তিনি দাবীও করছেন না। তাঁর দাবী অন্য কিছু— যা তিনি সাক্ষাতে বলতে চান। ফোন নম্বর চাই। দিলাম। তৎক্ষণাৎ ফোন। এবং দেখা করার তারিখ তৈরি। পরদিনই স্কুলে আসতে বললাম তাঁকে। তখন পরীক্ষা হয়ে গেছে, স্কুল ফাঁকা।

প্রথম পরিচয়ে বয়স-নির্বিশেষে সবাইকে আমি আপনি বলি। কিন্তু পরদিন যিনি উপস্থিত হলেন— তাঁকে ‘আপনি’ সম্বোধন করা অসম্ভব। একটি তরুণ, বয়স তার বড়জোর পঁচিশ (পরে জানলাম বাইশ), শ্যামলা রঙ, রোগাপাতলা চেহারা। অতি সাদামাটা ছেলে একটি, সঙ্গে অমনধারা এক বন্ধু। সমাজসেবী গোছের মস্ত গাড়ি নেই, মাতব্বর হাবভাব নেই। ফাঁকা ক্লাসে নিয়ে গিয়ে বসালাম। বিনা-ভূমিকায় সে বলল— ‘দেখুন স্যার, আমি জানি আপনার লেখা হাজারো মানুষ পড়ে, মান্যিগন্যি করে আপনাকে। আপনি একটু লিখে দিন— আমাদের অনেক টাকার দরকার। অনেক কম্বল কিনতে হবে স্যার, নিদেন দেড়শো। চা-বাগানগুলোর অবস্থা তো জানেন। মানুষগুলো খেতে পায় না, কম্বল কিনবে কোত্থেকে! এদিকে শীত আসছে। পাহাড়ের ভয়ানক শীত। আপনি একটু লিখে দিন— যেন বেশি নয়— অন্তত একটা কম্বলের টাকা সবাই দিয়ে দেন এঁদের জন্য।’

কথাগুলো সে বলল এমন করে— যেন নিজের বাড়ির অভাবের কথা জানাচ্ছে আমাকে। আমি হাঁ করে তাকে খানিক পরখ করে বললাম— ‘সেদিন একটা ছবি দেখছিলাম— কলকাতার রাস্তার ভবঘুরে মানুষদের কম্বল…’

আমার কথার মাঝখানে লাজুক গলায় সে বলল— ‘আমরাই স্যার। চিন্তা করতে পারবেন না, কত মানুষ যে খোলা রাস্তায় শুয়ে এই ঠাণ্ডার মধ্যে ঘুমোচ্ছে…’

আবার সেই ব্যক্তিগত সুর— যেন ও নিজে তাদেরই একজন। এবার একটু রেগেমেগে বললাম—‘ফের ‘‘স্যার’’ বললে কিস্যু করব না। কত টাকা দরকার তোমার?’

ছেলেটি নির্বিকার কণ্ঠে বলল— ‘দেড় লাখ।’ আমি বিষম খেয়ে সামলানোর আগেই সে যোগ করল— ‘অন্তত এই ক’টা কম্বল তো লাগবেই স্যার… ইয়ে… রাজাদা।’

আমি নিশ্চিৎ, যে এই কথাটা বলেছিল— তার পকেটে দেড়শো টাকাও ছিল না। কিন্তু ততক্ষণে সে বলতে আরম্ভ করে দিয়েছে— এর আগেও সে এ কাজ করেছে অজস্রবার। টাকার জন্য কিচ্ছু আটকায় না। আর সবসময় টাকা লাগেও না। এই ধরুন যে মানুষটা মেয়ের অপারেশনের জন্য রক্ত পাচ্ছে না, তার চাই রক্ত। ধরুন, যেখানে অবৈধভাবে কচ্ছপ বিক্রি হচ্ছে— সেখানে চাই শুধুই সাহস। ধরুন— পথশিশুদের পুজোর আগে জামা-কাপড় চাই। ক’টা টাকাই বা লাগে! বা ধরুন ওদের নিয়েই শীতকালে একদিন পিকনিক করলাম। কী এমন খরচ! ও টাকা এমনিই উঠে যায়….

আমার তখন দিশেহারা অবস্থা। এইটুকু ছেলে কত কী করে রে বাবা! কোনটাকে ধরব! আমার ছোট হাতে ধরেই বা কতটুকু! প্রথমে সসংকোচে কিছু টাকা দিলাম। অসংকোচে পকেটে ভরল। বন্ধুটি গম্ভীর হয়ে লিখে নিল। ডেকে নিয়ে এলাম আরও এক শিক্ষককে। তিনিও দিলেন কিছু। কথা দিলাম— নিশ্চই লিখব— মানে আমার দ্বারা যেটুকু সম্ভব। কথা ফুরোতে উঠলাম আমরা। আমার সামনে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করতে লাগল ছেলেটা। বললাম—‘আর কিছু বলবে?’

সে গম্ভীর হয়ে বলল— ‘জানেন স্যার… দুচ্ছাই… রাজাদা, ভারতবর্ষ পড়ি প্রত্যেক শনিবার। কখনও লাইকও করি না, কমেন্ট তো বাদই দিন। অনেকদিনের একটা ইচ্ছে… আমি অবশ্য কাউকে প্রণাম করি না। কিন্তু আজ…’ —ব’লে ঝুপ ক’রে একটা প্রণাম করল।

না, এটাও শেষ নয়। ওর কথায় একটা জম্পেশ ক’রে লেখা তৈরি করছি— এমন সময় আবার ওর ফোন। ‘রাজাদা, লেখাটা এখন দেবেন না। টাকা উঠে গেছে। কম্বলও কেনা কমপ্লিট। আপনি লিখলে আবার টাকা আসবে। দরকার নেই তো! পরে দেবেন, হ্যাঁ?’ টাকা এসে পড়বে— এর জন্য দুশ্চিন্তিত হতে এই প্রথম দেখলাম কাউকে। লিখে রেখে দিলাম। ও বললে পোস্ট করব।

আজও সেই ডাক আসে নি। ওকে দেখেছি বইমেলায়। ভীড়ের মধ্যে ঢুকবে না, দাঁড়িয়ে আছে দূরে। মুখে এমন এক সগর্ব হাসি— যেন আমি না, আমার বইটইগুলো ও-ই লিখেছে, সই দিচ্ছে ও-ই। আবার সেই আত্মপরবোধের অভাব। বোকা ছেলে একটা।

আর আজ সেই বোকা ছেলেটা নিজেই দুলছে জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানে। একটা কিডনি ওর বরাবরই খারাপ ছিল বোধহয়। অন্যটাও জবাব দিয়েছে সম্প্রতি। নিজের কথা ভাববার অবসর ওর মোটে ছিল না কিনা। জীবন বাজি রেখে এন.আর.এস-এর ভেন্টিলেশন থেকে বের করে নিয়ে গিয়ে ওকে পি.জি.তে ভর্তি করেছে ওর বন্ধুরা, যাতে ওই অবস্থাতেই ওর ডায়ালিসিস চলতে পারে। এবার, যদি প্রেশার স্বাভাবিক হয়— হবে ডায়ালিসিস। হ্যাঁ, ক্ষীণ— অতি ক্ষীণ একটা আশা আছে এখনও আমাদের।

হে ভারতভাগ্যবিধাতা! আর দরিদ্র ক’রো না আমাদের। প্রার্থনা— মানে সামূহিক শুভকামনার নাকি একটা শক্তি আছে। এতদিন যেসব ধার্মিক হিন্দু বন্ধুরা ‘ভারতবর্ষ‘ প’ড়ে আমাকে ঈশ্বরে ভরসা রাখার উপদেশ দিয়েছেন; যে মুসলিম বন্ধুরা তাঁদের আল্লাহের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদন করেছেন— তাঁরা সবাই প্রার্থনা করুন আপন আপন দেবতার কাছে— পাগল ছেলেটা যেন বেঁচে ফিরে আসে।

এটা আপনাদের দেবতার পরীক্ষা। মনে থাকে যেন, ঈশ্বর!

কাঞ্চন, তোর লেখাটা রেডি আছে রে। তুই বললেই পোস্ট করব। ফোন করিস। শিগগির।

১১:০৩:২০১৭

(এর ঠিক চোদ্দ দিন পরে, ২৫’শে মার্চ ২০১৭-য়, চলে গিয়েছিল এই আজব ছেলেটা। এক্কেবারে চলে গিয়েছিল। কিন্তু আজও, এই এতদিন পরেও, ওর বন্ধুরা ওর প্রারব্ধ কাজটুকু করে চলেছে। এটুকুই সান্ত্বনা। শুধু ওই ফোনটা আর আসেনি…)

৮৩

সেদিন দুপুরের ট্রেন ধরলাম। ইশকুল ছুটি; ভেবেছিলাম ভাতটাত খেয়ে দিবানিদ্রা দেব, যে কাজটা আমি সবচেয়ে ভাল পারি। এমনি কপাল— কলেজ স্ট্রিটে জরুরি কাজ পড়ে গেল হঠাৎ। কাঁদোকাঁদো মুখে বেরুতেই হল, সামনে বইমেলা। এ সময়ের ট্রেন ধরা হয় না সচরাচর। সকালে যাই, সন্ধ্যায় ফিরি। ফলে ভেবেছিলাম— দুপুরে ট্রেন ফাঁকা থাকবে। ও হরি! কোথায় কী! ডাউন হাসনাবাদ লোকাল এল একটা। তুমুল ভিড়। তবে কী— অভিজ্ঞ ডেলিপ্যাসেঞ্জার মানুষ; ঠেলেঠুলে ঠিক ঢুকে পড়লাম ভিতরে। অবরে-সবরে যাঁরা যাতায়াত করেন— তাঁরা বেজায় ভয় পান এমনতর ভিড়ে। ফলে ছেলে-কাঁখে মা কিংবা গিন্নি-সহ বৃদ্ধেরা বেজায় চেঁচামেচি করতে থাকেন; বই বের করার সাহস হয় না, বের করলে পড়া যায় না, পড়লে বোঝা যায় না মাথামুণ্ডু। কাজেই ব্যাগ ঘাড়ে দাঁড়িয়ে রইলাম দু’টো সিটের মাঝের ফাঁকে ঢুকে। ধাক্কাধাক্কি করতে হচ্ছে না এখানে— এটুকুই যা সান্ত্বনা। বাঁয়ে আগে থেকেই দাঁড়িয়ে ছিলেন এক বয়স্ক ভদ্রলোক ; মাথায় ফেজ, পরনে ঢোলা পায়জামা-পাঞ্জাবি, গালে পাকা দাড়ি। আমার ঘাড় থেকে ব্যাগটা নামিয়ে তুলে দিলেন বাংকে। সামান্য ঠেলেঠুলেই ঢোকাতে হল, ফলে বসে-থাকা মানুষদের মধ্যে একজন মৃদু আপত্তি করলেন। তিনিও একটু রেগেমগে বললেন—‘এই এত্ত বড় ব্যাগডা ঘাড়ে নিয়ে দাঁইড়গে রইয়েস লোকটা। আপনে তো তাও বইসে আছেন!’ তা এসব নিত্যযাত্রীদের রোজকার অভিজ্ঞতা। কোনো পক্ষই কিছু মনে করে না। শুধু ভিতরে ঢোকার দরজার কোনায় একটি উত্তরাধুনিক তরুণ আপাদমস্তক কালো জামাপ্যান্ট পরে, খামোখা কালো একখানা সানগ্লাস পরে রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে গান শুনছিল; তাকে বলা হলেও সে রাস্তা ছাড়ল না। শোনেইনি! কানে ইয়ারপ্লাগ। ইদানীং মানুষের সঙ্গীতপ্রীতি ক্রমবর্ধমান।

বিরাটি থেকে উঠলেন বেশ কিছু মানুষ। মোটাসোটা একটি অল্পবয়সী মেয়ে উঠে পেল্লায় ভিড় দেখে ‘এই মরেছে!’ বলে চিল্লিয়ে উঠে বাঁদিকের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল; পরণে সালওয়ার-কামিজ, মুখে একটু মজাদার হাসি। বিশেষ ভয় পেয়েছে বলে মনে হল না; পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে বোধহয়। মুশকিল হল অবিশ্যি একটু পরেই। এক বৃদ্ধ উঠেছেন এই মেয়েটির পিছন পিছনই; তিনি আটকে পড়েছেন মেয়েটি দাঁড়িয়ে পড়ায়। আমি ভিতর থেকে তাঁর পূর্ণ অবয়ব দেখতে পাচ্ছি না; একবার চিল্লিয়ে বললেন— ‘অ মা-জননী— তুমি তো আমারে এখেনেই আটকে দিলে গো! আমার যন্তরটা গেল বুঝি এবার!’ মেয়েটি অমনই হাসি হাসি মুখে বলল—‘ব্যাগটা আমায় দিন, দাদু; মাথায় নিয়ে দাঁড়াই। এমনিও আপনি এ নিয়ে ভিতরে যেতে পারবেন না। ভিড় দেখেছেন?’ ভদ্রলোকের গলা শুনলাম এবার— ‘আর মা, তোমাকেই বলে বাংকে তুললে ভাল হয়, তুমি ধরবে আমার ব্যাগ। তাহলেই হয়েছে।’ যাক— একটা অনিবার্য ঝগড়া হতে গিয়েও হল না দেখে খুশিই হলাম। খাঁটি ডেলিপ্যাসেঞ্জার হলে এ সুযোগ কদাপি হাতছাড়া করত না।

কিন্তু দুর্গানগর স্টেশন থেকে উঠলেন আরও মানুষ। এবার প্রবল চাপের মুখে ভদ্রলোক রণে ভঙ্গ দিলেন। মেয়েটির পাশ দিয়ে কোনোক্রমে গলে যাওয়ার চেষ্টা করলেন তিনি। ফলে আমি তাঁকে দেখতে পেলাম এবার। একেবারে খাঁটি বৈষ্ণব মূর্তি; পরনে গেরুয়া ধুতি-চাদর, বাবরি চুল, কপালে মস্ত রসকলি, গলায় তুলসির মালা। হাতের মস্ত ঝোলাতে নির্ঘাত খোল আছে। গেরামের কীর্তন দলের লোক, বোধহয় আসর আছে কোথাও। লটবহর নিয়ে এখন ঘোর বিপদে পড়েছেন।

মুশকিল হল— মেয়েটিকে টপকে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করতে গিয়ে ভদ্রলোক তার ওড়নাটায় দিয়েছেন অনিচ্ছাকৃত টান; ফলে তাঁর গায়ের সঙ্গে আটকে ওড়নাটা মালকিনের মায়া ত্যাগ করে তাঁর সঙ্গে রওনা দিয়েছে। এবার বোঝা গেল— মেয়েটি সত্যিই রসিক, এবং স্বঘোষিত ‘নারীবাদী’ নয়। কেননা সে প্রাণপণে ওড়নাটাকে ভদ্রলোকের কবল থেকে উদ্ধার করার চেষ্টা করতে করতে বলল— ‘ও দাদু! এই বয়েসে শেষে ওড়না পরছেন যে বড়! বস্ত্রহরণ পালা করে ফেললেন যে!’ শুনে স্বভাবতই হাসির একটা হররা খেলে গেল ট্রেনময়। আমিও হেসে ফেললাম, আমার পাশের বৃদ্ধটি দেখি হাসি চাপার প্রবল চেষ্টা করতে গিয়ে হার মেনে বললেন— ‘কী সব মেইয়ে দেখেন! বুড়ার টাক অবধি লজ্জায় লাল হইয়ে গিয়েস!’

কার্যক্ষেত্রে অবিশ্যি দেখা গেল— ‘বুড়া’ও কিছু কম যান না। গোঁসাই এবার মরিয়া হয়ে কোনোমতে ছাড়িয়ে নিলেন ওড়নাটা, এক ঝটকায় খোলের ঝুলিটা তুলে ফেললেন মাথায়। তারপর তেড়েফুঁড়ে বললেন— ‘আর বস্ত্রহরণ! এই দ্যাখ— গিরি-গোবর্ধন ধারণটাও হয়ে গেল।’ তারপর চোখের ইশারায় পথ আগলে দাঁড়িয়ে-থাকা কালো পোষাক পরা ছেলেটিকে দেখিয়ে বললেন— ‘এবার এই কালীয়দমনটা করতে পারলেই আজকের মতো পালা সাঙ্গ হয় মা। জয় গৌর! জয় নিতাই!’

এবার তামাম যাত্রীসমেত গোটা ট্রেনটাই হেসে উঠল হো হো করে; আর আমার পাশে দাঁড়ানো বুড়ো এবার একেবারে সোচ্চারে হেসে উঠে বললেন— ‘সুভানাল্লা! অ বাবাজি, দেকি, কোনো গতিকে এদিকে চইলে এস— নিদেন দাঁড়ানোর জায়গা হইয়ে যাবে। যা বইলে দিয়েস— তাতে এট্টা সিট পাওয়া উচিৎ তোমার; নেহাত আল্লা আমারে দাঁড় কইরে রেখেছেন— তাই দিতি পাল্লেম না। হো হো হো! আগে খোলটা দাও দিনি, আমি ধইরে দাঁড়াই…’

ঘাবড়াবেন না, হে আমার প্রিয় ধার্মিক ভ্রাতা ও ভগিনীগণ! এ নিতান্তই একটি ট্রেনে ঘটে যাওয়া বিচ্ছিন্ন ঘটনামাত্র। ধর্মের নামে দাঙ্গা বাঁধানোর জন্য তো গোটা দেশটাই পড়ে আছে— তাই না! আমরা— পাতি লোকজনেরা— যারা ট্রেনে-বাসে ঠেলেঠুলে যাতায়াত করি, আর এইভাবে ধর্ম নিয়ে হা হা হি হি করি— নিতান্তই সংখ্যালঘু। ওই ওড়না সামলানো মেয়েটি, ওই বৈষ্ণব বৃদ্ধ, ওই ফেজটুপি-পরা ফাজিল বুড়ো— এরা দেশের কয়জন? ‘ধরিতে গেলে আপনারাই দেশ’— কেননা আপনাদের মতে আপনারাই সংখ্যাগুরু— যাঁরা ধর্মকে ধারণ করে আছেন। অবিশ্যি কথা ছিল— ধর্মই ধারণ করবে আমাদের।

সে যাক গে’। আপনারা দাঙ্গা করুন, আপন আপন ধর্মের মানরক্ষে করুন। আমরা ততক্ষণে প্রাণপণে প্রার্থনা করি— ‘ভারতেরে এই তীর্থে কর জাগরিত।’

৮৪

ক্লাস শুরু হওয়ার প্রায় মাস-তিনেক পরে ফাইভে ভর্তি হল বান্টি। কৃষ্ণবর্ণ প্রিয়দর্শন বালক; ভারি মিষ্টি করে কথা বলে। যেমন বাচ্চাদের আপনার দেখা-মাত্র মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে ইচ্ছে করে— ঠিক তেমন দেখতে। মুশকিল হলো— কিছু জানে না। মানে একেবারে কিচ্ছু না। অক্ষরজ্ঞান নেই, অ আ ক খ চেনে না; আর সব তো… বাদ দিন। দিন কয়েকের মধ্যেই অন্য বাচ্চাদের থেকে জানা গেল তেমনই আরেকটা গল্প— যেমনটা আমি গত সতেরো বচ্ছর ধরে শুনে আসছি। মা ‘মরে গেছে’, বাবা ‘চলে গেছে’ ( ঠিক এই ভাষাতেই বলে বাচ্চাগুলো!); এখন দাদু-ঠাকুমার কাছে থাকে। গলিতে খেলে বেড়ায় দিনভর— পড়াশুনো হবে কোত্থেকে! ফাইভে আমার ক্লাস থাকে না, তবু অন্যান্য শিক্ষকদের মারফত খবর পাই সবই। খারাপ লাগলেও কিছু করার নেই।

 তা এক শুক্কুরবার এক শিক্ষক আসেননি, যেতে হলো ফাইভে। গিয়ে দেখি, বাকি বাচ্চারা সব চলে গেছে কম্পিউটার ক্লাসে, বান্টি একা বসে আছে— নাকি ভাল লাগে না কম্পিউটার ক্লাস। বেশ। এখন একা একে আমি পড়াই কী! কিছুই তো জানে না! ভেবেচিন্তে বললাম খাতা বের করতে। দেখা যাক, নিদেন অ আ টুকু যদি শিখিয়ে ফেলতে পারি এই সুযোগে। খাতার পুরনো পাতা উলটে বোঝা গেল— অন্য শিক্ষকেরা পূর্বেই এ চেষ্টা করে ক্ষান্ত দিয়েছেন; খাতা-ময় নানান হস্তাক্ষরে বিস্তর স্বরবর্ণ ব্যঞ্জনবর্ণ লেখা আছে আগে থেকেই। তবে কিনা আমি হলাম খাঁটি বাঙাল— গোঁয়ার্তুমি আমার রক্তে। কাজেই ফের লেগে পড়লাম কাজে। গোটা গোটা করে লিখতে লাগলাম অ আ, আর তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে লাগল সুর করে উচ্চারণ। খানিক পরে ওকে বললাম লিখতে; প্রথমে দেখে দেখে, তারপর না-দেখে। দু’তিনবার হোঁচট খাওয়ার পর বাবু ঠিকঠাক লিখতে আরম্ভ করলেন একটা বেজায় ক্ষয়ে-যাওয়া কাঠপেন্সিল দিয়ে। পেন নেই।ক্রমে ব্যাপারটা কঠিন করে তোলার জন্য নানাবিধ আয়োজন করা গেল— একবার আমি এলোমেলোভাবে লিখে পড়তে বললাম, কখনো ওকেই বললাম— ‘লেখ, ঔ, লেখ ঋ’— এই রকম। শেষমেশ যখন বোঝা গেল, ছেলে স্বরবর্ণটুকু আয়ত্ত করে ফেলেছে— কেমন একটা ভারি আহ্লাদ হলো। পকেটে ছিল তিনটাকা দামের একখানা অগ্নি-জেল পেন; ওকে ধরিয়ে দিয়ে বললাম— ‘নে এটা।’ বান্টি তো বেজায় অবাক! কেউ কক্ষনো ওকে খামোখা কিচ্ছু দেয়নি— আজ এমন কী হয়ে গেল রে বাবা! সে ছেলে কিছুতেই নেবে না! কেবলই বলে— ‘না স্যার, আপনার পেন আমি নিয়ে নিলে আপনি লিখবেন কী করে?’ একটা লোকের যে একাধিক পেন থাকতে পেরে, এমন দুরূহ তত্ত্ব ওর মাথায় ঢুকছে না দেখে আমি এক মুঠো পেন বের করে আনলাম আমার ব্যাগ থেকে। বললাম— ‘সব আমার কেনা নয়, বুঝলি বাবা। আমি… মানে… অল্প অল্প লিখি-টিখি কিনা, তাই বন্ধুরা কেবল পেনই দেয়। আমার অনেক আছে।’ ওর ঠিক প্রত্যয় হচ্ছে না দেখে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম— ‘ভাবিস না, বাড়িতে আরও মেলা পেন আছে আমার। আর এটা তো আমি তোকে এমনি দিইনি! তুই জিতেছিস তো! অ আ লিখে ফেলেছিস নিজে নিজে— তাই পেয়েছিস। বুঝলি? প্রাইজ! গিফট নয় কিন্তু!’

এবার ভরসা পেয়ে টেবিলে ছড়ানো পেনগুলো নিয়ে সসম্ভ্রমে নাড়াচাড়া করতে লাগল। সাদা একটা পেন তুলে বেশ মনোযোগ দিয়ে নিরীক্ষণ করছে দেখে সেটার ঢাকনি খুলে দেখালাম— ‘দেখেছিস! এটা নিবওলা পেন। যা খাসা লেখা হয় না!’ তারপর লোভাতুর চোখে চেয়ে আছে দেখে বললাম— ‘এইভাবে যদি ক খ গ ঘ শিখে ফেলতে পারিস, তাহলে এইটে প্রাইজ দেব। দ্যাখ দেখি চেষ্টা করে।’

শুনে সেই কালোকোলো সুকুমার মুখের বড় বড় চোখ উৎসাহে জ্বলজ্বল করে উঠল। বলল— ‘একবার ফের লিখে দেবেন, স্যার? ওমনি ব’লে ব’লে?’— এই বলে তাড়াতাড়ি এগিয়ে দিল একখানা সাদা পাতা।

দিলাম লিখে গোটা গোটা হরফে; আগেরবারের মতোই মুখে উচ্চারণ ক’রে চললাম— ‘ক, খ, গ, ঘ…।’ খাতার উপর ঝুঁকে পড়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার হাতের নড়াচড়া মেপে নিতে লাগল বান্টি।

এমন সময় ঘন্টা পড়ে গেল। ওর পিঠটা একটু ঠুকে দিয়ে বললাম— ‘লেগে পড়, বাবা। মুখে ব’লে ব’লে, হ্যাঁ?’ মাথা নাড়ল ও। স্টাফরুমে ঢোকার খানিক পরেই হেডমাস্টারমশাই এসে মৃদু হেসে বললেন— ‘বান্টিকে একটা পেন দিয়েছেন নাকি?’ আমায় দেখাল; বলল— ‘জিতেছি স্যার। রাজাবাবু-স্যারের কাছ থেকে।’ কী আর বলি, স্মিত মুখে মাথা নাড়লাম।

একটু পরে পরের ক্লাসে যাব বলে বেরলাম স্টাফরুম থেকে। ফাইভের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ চোখ আটকে গেল একটা সাদামাটা দৃশ্যে। মস্ত ফাঁকা ক্লাসঘরে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, বেঞ্চের উপর ঝুঁকে পড়ে একমনে লিখে চলেছে এক কৃষ্ণবর্ণ, প্রিয়দর্শন, অনাথ বালক। মুখ নড়ছে তার নিঃশব্দে। বাইরে থেকেও ঠোঁটের নড়াচড়া বুঝিয়ে দিচ্ছে, সে নিরুচ্চারে বলে চলেছে— ‘প, ফ, ব, ভ…’

ও আমার দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হয়ে চলা স্বদেশ! অনেক কলরব আর আন্দোলনের এক ফাঁকে একটু তাকিও একটা সামান্য নিবওলা পেনের লোভে স্বাক্ষর হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে-চলা ছেলেটার দিকেও! আমি এক অ আ ক খ শেখানো মাস্টার। আমি তো বড়জোর তোমায় ডাক দিতে পারি— তাই না? তুমিও একটু কান পাতো!

৮৫

মনে আছে, অনেকদিন আগে এক ‘ভারতবর্ষ’-এ লিখেছিলাম আরাকুর কথা। ভাইজাগ থেকে একটু দূরের এই উপত্যকা-গ্রাম সেবার স্তব্ধ করে দিয়েছিল দুই রূপমুগ্ধ মানুষকে— আমাকে আর আমার নব্যবিবাহিতা গিন্নিকে। সে সতেরো বছর আগের কথা। আরাকু তখন এত্তটুকুনি ছোট্ট শহর; শহর বললেও যেন বাড়িয়ে বলা হয় তাকে। সব মিলিয়ে খান তিনেক হোটেল, গোটা-দশেক দোকান। বড়রাস্তা ছেড়ে, কিছুটা পিছিয়ে যেন উবু হয়ে বসে-থাকত ভূমিপুত্রদের পাতার ঝুপড়ি। যেকোনো দিকে পনেরো মিনিট হাঁটলে লোকালয় ফুরিয়ে যায়; তারপর ধু ধু ফাঁকা রাস্তা, দুপাশে উদাস মাঠ ছুট দিয়েছে দূরের নীলরঙা পাহাড়ের দিকে। ধাপকাটা চষা জমি নেমে গেছে বহু দূরের রেললাইনের দিকে, টিং টিং করে ধীরেসুস্থে চলে যায় মালগাড়ি— কালভার্টের উপর বসে এইসব দেখতাম আমরা।

হঠাৎ সম্প্রতি একদিন ছেলে কোথা থেকে যেন বের করে আনল সেই পুরাতন ছবির অ্যালবাম। সে ছবির রঙ গিয়েছে ধূসর হয়ে; কিন্তু তাই দেখে ছেলে বায়না ধরল মায়ের কাছে— তাকেও নিয়ে যেতে হবে আরাকুতে— নাকি বেজায় সুন্দর জায়গা। তখন ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলছে বইমেলা, দিন নেই রাত নেই লিখেই চলেছি পাগলের মতো। ওরা মায়ে-বেটায় কী প্ল্যান করল, কোথায় ঘর বুক করা হল, কবে প্লেনের টিকিট কাটা হল— আমি কিছুই জানতে পারলাম না। শুধু এক বন্ধু— সুব্রত— কতকগুলো হোটেলের সুলুকসন্ধান দিয়েছিল; সেগুলো ওদের হাতে ন্যস্ত করে আমি ফিরে গেলাম লেখার টেবিলে।

আরাকু গিয়ে তো আমাদের কত্তাগিন্নির চক্ষু ছানাবড়া! এ কোথায় এলাম রে বাবা! এ তো এক জমজমাট মোটাসোটা শহর! দস্তুরমতো গায়েগতরে বেড়েছে বটে; কিন্তু সে বাড়বৃদ্ধি হয়েছে একেবারে অপরিকল্পিত পথে; যেদিকে ছিল ঢালু হয়ে নেমে-যাওয়া উপত্যকার মায়াবিনী বিস্তার— সেদিকটায় উঠেছে অজস্র কুৎসিত বাড়ি আর দোকান, গাড়ি আর বাইক ছুটছে মুহুর্মুহু, দিন-ভ্যাঙানো নিয়ন আলোর চোটে সেই চাঁদনি রাত কোনকালে পালিয়েছে! উন্নয়নের একেবারে হদ্দমুদ্দ করে ছেড়েছে! মন ভেঙে গেল দু’জনেরই; আর ছেলে শুকনো মুখে ঘুরেফিরে এসে বলল— ‘তোমরা যেমনটি বলেছিলে— তেমন তো দেখছি নে!’

আগেরবার উঠেছিলাম বাজারের মধ্যে একটা ছোট্ট হোটেলে— মস্ত আর দামী হোটেলে ওঠা তখন ছিল সাধ্যের বাইরে। আর বেড়াতে এসে ঘরে বসে থাকতে আমাদের ভারি বয়েই যেত! এতদিনে সাধ্য কিঞ্চিৎ বেড়েছে বইকি! কাজেই উঠেছি এ.পি.টুরিজমের মস্ত গেস্ট হাউসে। রক্ষণাবেক্ষণের বালাই নেই, জাঁকালো হোটেলের সর্বাঙ্গ জুড়ে অনাদরের চিহ্ন। সার সার ঘর ফাঁকা পড়ে আছে। আমরা আগের মতোই মালপত্র ঘরে রেখে বেরিয়ে পড়লাম বটে, কিন্তু দুপুরেই ফিরে এলাম মন ভার করে। অনাদরের চিহ্ন শুধু হোটেলে নয়— সর্বত্র; যেমন ট্রাইবাল মিউজিয়ামে, তেমনই কফি মিউজিয়ামে। আমাদের দেখা সে আরাকু আজ স্মৃতিমাত্রে পর্যবসিত।

আর এক নতুন ব্যাপার চোখে পড়ল সন্ধ্যায় হাঁটতে বেরিয়ে। প্রচুর দোকানের সামনে বাঁশ পোড়ান হচ্ছে। কী ব্যাপার? জানা গেল, বাঁশের ভিতরে মাংস ঢুকিয়ে পোড়ানো হচ্ছে। মেলাই দাম তার। বড়লোক ট্যুরিস্টদের লুব্ধ রসনার পরিতৃপ্তি করার এই পদ্ধতি নাকি এখন এই এলাকার বিশেষত্ব। মাথা নাড়তে নাড়তে বুঝলাম— সুন্দরী তরুণী আরাকু আজ বৃদ্ধ বয়েসে ম্যাসকারা আর রুজ মেখে মন-ভোলানোর চেষ্টায় আছে। তা ভাল…

আটটার মধ্যে দোকানপাট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দেখে খাবারদাবার নিয়ে হোটেলে ফিরতে হল। যে শুনশান রাস্তায় সতেরো বছর আগে ঘুরে বেড়াতাম দুই রূপমুগ্ধ তরুণতরুণী— আজ সে পথে হাঁটতে সামান্য ভয়ই করছে; কানের পাশ দিয়ে তীরের মতো ছুটে চলেছে বাধাহীন বাইকের স্রোত।

হোটেলের ঘরের ব্যালকনিতে বসেছি সবে— এমন সময় কাছেপিঠেই কোথাও বেজে উঠল ঢাক। সে এক আশ্চর্য তাল— যেন আদিজননী পৃথিবীর গর্ভ থেকে উঠে আসছে অনাহত মৃদঙ্গের ধ্বনি। চমকে উঠে বাইরে তাকালাম। না, সযত্নে সাজানো নকল বাগানে আর ঘাসছাঁটা লনে তো দেখা যায় না কিছু! পিছনের বারান্দায় গেলাম এক ছুটে। হ্যাঁ, এদিকেও আছে একটা লন, দুই সারি ঘরের মাঝে। সেই লনে এখন জ্বলেছে মায়াবী আলো, সাজানো হয়েছে টেবিল, পানাহারের ফলাও বন্দোবস্ত সেখানে মজুত। ব্যস্ত পায়ে কোট-পরা দিশি সাহেবদের আপ্যায়ন করছে বেয়ারারা। আর লনেরই একপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে একদল কালোকোলো মানুষ। পুরুষেরা তাল তুলেছে ঢাকে— দ্রিদিম দিম দ্রিদিম দিম…! সবুজ শাড়ি সাদা ব্লাউজ পরা জনাকতক তরুণী তারই তালে তালে গোল হয়ে নাচ আরম্ভ করল এইবার, হাতে তালি দিয়ে, পরস্পরের কোমরে হাত রেখে নাচছে তারা— এক আদিম পৃথিবীর নাচ— যে নাচ তারা একদিন নাচত পূর্ণিমার রাত্তিরে, চারিদিকের বন আর পাহাড় যেদিন ডুবে যেত জ্যোৎস্নাময়ী ঢেউয়ে। সেদিন তারা নাচত এমনিই, নিজেদের খুশিতে; অনেক পরিশ্রম আর অপমান আর অবসাদ তারা ধুয়ে ফেলত সেই নৃত্যের তালে তালে। আজ তারা এসেছে এই সুসভ্য হোটেলের উঠোনে, সেই খুশির নাচ বেচে যে ক’টা পয়সা জোটে— বাড়ি ফিরবে তাই নিয়ে। ওই জমে উঠছে নাচ…জমে উঠছে নেশা…টলমল পায়ে উঠে এসে ওদের নাচের মধ্যে ভিড়ে যাচ্ছেন কোনো কোনো সাহেব…বাড়িয়ে দিচ্ছেন লুব্ধ হাত…বাঁশপোড়া মাংস গরম হয়ে উঠেছে বুঝি…

হঠাৎ আমার মনে পড়ল— সেই সতেরো বছর আগে আমরা দেখেছিলাম এক তরুণী আদিবাসী মেয়েকে। এই যেখানে এখন নাচ চলছে— এর একটু পিছনেই সে একা— নিছক একা হাতে বাপ-মায়ের জন্য গড়ে তুলছিল কাঠকুটো দিয়ে একটা আস্ত বাড়ি। একাই। সেখানে এখন দাঁড়িয়ে আছে একটা রিসর্ট— বিকেলেই দেখে এসেছি। সেই মেয়েটি এখন কোথায় থাকে? ওর তো পাকা বাড়ির স্বপ্ন ছিল না! সাধ্যিও ছিল না! তাহলে কী আরও দূরের, আরও গভীর কোনো আরণ্যক উপত্যকায় ঘর বাঁধতে হয়েছে ওকে? আর কী করে সে মেয়ে এখন? কাজ করে কোনো রিসর্টে? নাকি গড়ে তুলেছে নিজের জন্য, নিজে-হাতে চষার মতো একটুকরো জমি— অনেক দূরের কোনো পাহাড়ের ধাপে?

নাকি… নাকি এই মেয়েদের মধ্যেই একজন আছে— যে বহুকাল আগে নিজের হাতে গড়ে-তোলা ঘর ছেড়ে সরে গিয়েছিল আরও কয়েক ধাপ পিছনে! আর আজ সে এসেছে নাচতে… ঢাকের তালে তালে, উল্লসিত সিটির তালে তালে সখীর কোমর জড়িয়ে নেচে চলে সে নকল জ্যোৎস্নার নিচে… নকল হাসি মুখে মেখে… নকল করে চলে সেই বাঁধভাঙা জ্যোৎস্নাময়ী রাত্রের নাচ…

ও দেশ…ও আমার দুঃখিনী দেশ! আমাদের জায়গা করে দেওয়ার জন্য আর কত পিছোবে তুমি! কোন্ বনে, কোন্ পাহাড়ে একদিন বেজে উঠবে সেই আদিম আনন্দের ঢাক— দ্রিদিম দিম… দ্রিদিম দিম…

৮৬

আগের এক ‘ভারতবর্ষ’-এ বলেছিলাম— এম.এ. করতে গিয়ে প্রথম যার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল— সে হল মইদুল ইসলাম। বলেছিলাম— তার কথা পরে বলব। আজ বরং বলা যাক মইদুলের কথাই।

বেশ দেরি করে ক্লাস শুরু করেছিলাম আমি। মা তখন বাবার হঠাৎ-মৃত্যুর আঘাত নিতে না-পেরে মেডিকেল কলেজে ভর্তি। ফলে ক্লাস শুরু হওয়ার মাস-খানেক পরে একটু যেন রবাহূতের মতো ক্লাস করা শুরু করলাম আমি। এককোণে বসে থাকি একটা বই নিয়ে— যাতে অন্যেরা সমীহ করে এড়িয়ে যায়, আমার অপ্রতিভতা ধরা না-পড়ে। তা এমনই একদিন ব’সে মন দিয়ে পড়ছি ‘স্টোরি অ্যাবাউট আ রিয়েল ম্যান’। মন ঘুরছে হিমশীতল রাশিয়ায়। হেনকালে প্রায় কানে কানে মৃদুস্বরে কেউ আমাকে বলল— ‘ভাই, তুমি কি আঁতেল?’

অপ্রত্যাশিত প্রশ্নে ভড়কে গিয়ে চোখ তুললাম আমি। পিঠের কাছে দাঁড়িয়ে আছে এক তরুণ; পরিপাটি ক’রে দাড়ি-গোঁফ কামানো, পরণে ফর্মাল প্যান্ট-শার্ট; এককথায়— এক সুদর্শন ঝকঝকে ইয়াংম্যান। আমি উত্তর দেওয়ার আগেই সে বলল— ‘আমিও আঁতেল। তবে সামান্য। যেটুকু হলে ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির বাংলা ডিপার্টমেন্টে মানিয়ে যায়— ওইটুকু। ইংরেজি বই লাগে না আর কি।’ এই ব’লে সকালের রোদ্দুরের মতো একটা ঝলমলে হাসি ছুঁড়ে দিল।

এ ছেলের সাথে বন্ধুত্ব না-করে উপায় নেই। আলাপ হল। এবং মইদুল প্রথমেই আমাকে হতবাক ক’রে দিয়ে জানাল— ওর বাড়ি শাসনের কাছে, এবং ও মজিদ মাস্টারকে চেনে না। শাসন! ওকে দেখে তা বোঝার উপায়ই ছিল না! দিব্যি শহুরে চেহারা! যাক। ক্রমে বুঝলাম, মইদুলের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল ওর অপ্রতিহত গতি। সবাই ওর বন্ধু, পরিচিত। আর এর মূল কারণ ওর কথা বলার ঢং। সে ঢং প্রয়োজন অনুসারে পালটায়; অর্থাৎ— দরকারে সে ভাষায় আসে খাসা যশোরের টান, দরকারে নিখুঁত কলকাত্তাই খুশবু। আর আছে অনর্গল ঠাট্টার ফোয়ারা, সে ঠাট্টা কাউকে আহত করে না। ওর কাছ থেকেই জানলাম— ‘উন্নয়নশীল’, ‘প্রগতিশীল’— এরা সকলেই বাগবাজারের মতি শীলের আত্মীয়। নাম শুধু নামমাত্র নয়, তা পদবী-অনুসারী হওয়া উচিত— যেমন— ঠ্যালাঠেলি কর, একে-তাকে ধর— ইত্যাদি। মৌমিতা বৈরাগী আসলে ‘বই দেখিলেই রাগিয়া যায় বলিয়াই’ তার পদবী এইরকম— ইত্যাদি। আমাকে ও ডাকত ‘পণ্ডিত’ ব’লে। আমার অজ্ঞানতার প্রতি কটাক্ষ নয় এটা; গলার পৈতেটার প্রতি। তবু আমরা ক্রমশ ‘মাণিকজোড়’ রূপে চিহ্নিত হতে লাগলাম সারাক্ষণই একসঙ্গে থাকায়। এমন সময়…

এমন সময় ভেঙ্গে পড়ল বাবরি মসজিদ। ট্রেন বন্ধ। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তৃতা। ইউনিভার্সিটি বন্ধ। দেশময় দাঙ্গা।

ইউনিভার্সিটিতে প্রথম আবার গেলাম যেদিন, বড়জোর দশ শতাংশ ছাত্রছাত্রী এসেছে সেদিনমেরেকেটে। মইদুল যথারীতি হাজির। আমাকে দেখেই পকেট থেকে পেন বের ক’রে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে চিল্লিয়ে বলল— ‘একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিমকে যদি খুন করে স্বর্গে যেতে চাস— তবে এই নে তলোয়ার! ঢুকোয়ে দে দিনি আমার পেটে!’ তামাম ইউনিভার্সিটি হো হো করে হেসে উঠল।

ক্রমে সব স্বাভাবিক হল। তখনও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাঁদের হাট। পড়াচ্ছেন দিগবিজয়ী পণ্ডিতেরা। তা তাঁদেরই একজন তখন আমাদের পড়াচ্ছেন বাংলা ভাষার ইতিহাস। প্রসঙ্গক্রমে এসে পড়ল বাংলা ভাষায় না-থাকা কিছু ধ্বনির কথা। যেমন কণ্ঠাশ্রিত ‘খ’, ‘গ’ ইত্যাদি। উর্দু হয়ে বাংলায় এসেছে এরা, কিন্তু উচ্চারণ গেছে বিগড়ে। যথা ‘খ্যয়ের’, ‘গম’— মানে ‘ব্যথা’ আর কি। আমি গজলের পোকা (এই ‘গ’টাও কিন্তু ওইরকম—একটু ঘষে বেরোয়— খেয়াল করুন!), ফলে আমার অসুবিধে হচ্ছে না। পাশে ব’সে মইদুল প্রাণপণে চেষ্টা করে চলল ফিসফিস করে। খানিক চেষ্টার পর হাল ছেড়ে দিয়ে অসন্তুষ্ট হয়ে আমায় কানে কানে বলল—‘এইজন্যেই আম্মি সব সময় বলে— শোনা কথায় কান দিতি নেই।’ আমি মাথা নিচু ক’রে হাসি চাপছি— এমন সময় স্যারের কালান্তক আহ্বান ভেসে এল—‘মইদুল, তোমার তো পারা উচিত! তুমি মুসলিম ছেলে, নমাজ পড় নিশ্চই। আরবি ভাষা কিন্তু অসম্ভব রিচ এ ব্যাপারে, আর উর্দুর অন্যতম পূর্বপুরুষ। বলো দেখি— খাতির!’

কাঁদোকাঁদো মুখে উঠল মইদুল। প্রথম প্রচেষ্টায় বেরুল একটা গলা-খাঁকড়ানির শব্দ-‘খখখখ…’। তারপর করুণ আত্মসমর্পণ— ‘যাতি দ্যান, সার। ও এই এট্টামাত্র জিভে হপে না’নে।’ স্যার নাছোড়বান্দা—‘এ কি কথা! কেন পারবে না! চেষ্টা করো! এ তো তোমার ধর্মাচরণের অঙ্গ! বলো বলো!’

আরও দু’একবার চেষ্টা করে রণে ভঙ্গ দিয়ে মইদুল হঠাৎ আমায় দেখিয়ে বলল— ‘রাজা পারে স্যার। এইমাত্র আমারে শিকোচ্ছিল।’ কাজেই বিশ্বাসঘাতকতার ফল হিসেবে আমি উঠে দাঁড়ালাম— বললাম ধ্বনিগুলো। একগাল হেসে ব’সে পড়ল মইদুল— আমার আগেই।

এতক্ষণে স্যারের ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। ‘দাঁড়াও।’— বলে আদেশ দিতে ধড়মড়িয়ে উঠে দাঁড়াল মইদুল। স্যার কড়া গলায় বললেন—‘নিজের ধর্মকে শ্রদ্ধা না-করলে অন্যের ধর্মকে শ্রদ্ধা করবে কী করে, হ্যাঁ! কেমন ছেলে তুমি! এত অবহেলা কেন? অন্তত আয়াতগুলো তো ঠিকমতো উচ্চারণ করতে পারবে, নাকি?’

এইবার মইদুল গম্ভীর কণ্ঠে বলল— ‘স্যার, এক কাজ করেন। আজ থেকে আপনি আমারে মইদুল ভট্টাচার্য, আর রাজারে রাজা ইসলাম ব’লে ডাকতি শুরু করেন। ওই খ আর গ যদি আমারে মুসলমান হতি না-দেয়— তা’লি আর কী করপ— বলেন!’ ব’লে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর পাশে দাঁড়ান আমায় বলল— ‘আপনে বসেন, মৌলবিসাহেব। আমি বরং দাঁইড়গে থাকি।’

কাঠ হয়ে যাওয়া গোটা ক্লাস হো হো ক’রে হেসে উঠল একটু পরেই। কেননা স্যারের সদাগম্ভীর মুখে ততক্ষণে ফুটে উঠেছে বিচিত্র এক চওড়া হাসি। খানিক হাসিমুখে ছদ্মবিষন্ন মইদুল আর ভ্যাবাচ্যাকা আমার দিকে সস্নেহে তাকিয়ে থেকে মহাপণ্ডিত মানুষটি বললেন নিতান্ত যশুরে উচ্চারণে— ‘এ দুটোরে ধইরে অযোধ্যায় পাঠায়ে দেলে হয়!’

একটু ভালবেসে আর সহজভাবে তাকান ভাই চারপাশে। এতকাল সামলে এসেছি যখন, ঠিক আবার… আরও একবার সামলে যাব। শুধু ত্রিশুল আর চাপাটির দোষ দিলে হবে? দোষ কী আমাদেরও নয় খানিকটা— যারা এড়িয়ে যাওয়ার মহান চেষ্টায় চুপ করে থাকি আর ভাবি— কী বোকা সব লোকজন! সারাক্ষণ ওই এক হিন্দুমুসলিম নিয়ে লড়ে মরছে! আসলে শিক্ষাদীক্ষা নেই কিনা… দেরিদা আর চমস্কি পড়েনি…

৮৭

আচ্ছা, কখনো খেয়াল করেছেন— আমি আর আপনি প্রায় একই ধরণের মানুষ? আপনিও সারাদিন কাটিয়ে দেন ব্যবসা বা আপিস বা ইশকুলের কাজ সামলাতে, এল.আই.সি. বা ব্যাংকের হিজিবিজি সামলাতে, লোন কিভাবে শোধ হবে— ভেবে আপনিও রাত্তিরে ঘুমোতে পারেন না। আপনিও কতকটা আমার মতোই মুখ খোলেন শুধু নিন্দে করতে আর অভিযোগ জানাতে। কত মিল, না, আমাদের মধ্যে?

তাহলে, এমনটাও হতেই পারে, গিন্নির গুঁতো সহ্য করতে না-পেরে আপনি কেটেই ফেলেন টিকিট পুরুলিয়া-গামী একটা ট্রেনের। আর খেয়াল না-করেই সেখানে গিয়ে পড়েন ঠিক ফাল্গুন মাসের শেষ দিনটায়। খেয়াল করার কথাও না, কেননা বহুদিন হয়ে গেল আপনি বাংলা ক্যালেন্ডার দেখেন না; মায় ভাষাদিবসটাও ইংরেজি তারিখ অনুযায়ী ২১’শে ফেব্রুয়ারিই জানেন। কিন্তু ট্রেন থেকে নেমে, পনেরো মিনিট গাড়ি চলার পরেই আপনি হাঁ হয়ে যান। কেননা…

কেননা এখানে এখন পলাশের মাস। আপনার ভাড়া-করা গাড়িটা যে কাঁচা পথ ধরে চলেছে— তার দু’পাশে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে পলাশের পুষ্পভারানত গাছ। দূরে দেখা যাচ্ছে ধোঁয়ার মতো অনুচ্চ পাহাড়ের শ্রেণি; কাছে আছে রুখু মাঠ, ধান কেটে-নেওয়া জমি, বাঁকা আল, রাঙা মাটির পথ। টেলিগ্রাফের তারে বসে আছে মৌটুসি আর ফিঙে; জলায় পায়চারি করছে সুগম্ভীর ধানঠুঁটি, পানকৌড়ি ডুব দিচ্ছে মাছের সন্ধানে। সবুজ ঘাসের উপর ছড়িয়ে-থাকা পলাশের রং যে এমন মারাত্মক বৈপরীত্য তৈরি করে— তা আপনি এই প্রথম দেখলেন। ফলে, এই প্রথম, আপনি বলে বসলেন—‘বাঃ!’

আর অমনি পলাশ আর বনঝোপ আর আলপথ আর শিমুল আর দুগ্গা টুনটুনি আপনাকে দেখে বলে উঠল—‘আসুন, আসুন। কেমন লাগছে?’ আর আপনিও— বহুদিন পর বেখেয়ালে বলে বসলেন—‘বেশ! ইয়ে…মানে…দিব্যি!’ অমনি হাওয়া উঠল নেচে, ফুলেরা উঠল হেসে, পাখিরা উঠল গেয়ে। আপনি ভারি লজ্জা পেলেন। ছি ছি, বয়েসটা তো দেখতে হবে! আর হ্যাঁ, পদমর্যাদা!

কিন্তু বিকেল ঢলতেই আপনাকে যেতেই হল মস্ত লেকটার ধারে, নিতান্ত ছেলে (বা মেয়েই ধরুন না!) আর বউয়ের টানাটানিতেই আর কি। আর আপনার স্তম্ভিত চোখের সামনেই ধীরে…অতি ধীরে, সমস্ত জলটুকু রাঙিয়ে দিয়ে জলে ডুব দিল সূর্য। আপনার মনে পড়তে বাধ্য, ছোট্টবেলায় আপনি একে ‘সুয্যিমামা’ বলেই জানতেন। আর তার খানিক পরেই উলটোদিকের বন আর পাহাড়ের উপরের আকাশ তোলপাড় ক’রে উঠে এল চাঁদ। এখানে কিনা রাস্তায় আলো নেই, তাই সে উঠল রাজার মতো। তার লাল রং আপনার চোখের সামনেই ক্রমে হলুদ হয়ে এল। আপনি দাঁড়িয়ে রইলেন রাস্তার পাশে… বহুদিন পর গায়ে কাঁটা দিতে লাগল আপনার।

পরদিন তাই গিন্নি বা সন্তানের ডাকের অপেক্ষায় না-থেকে আপনিই ডেকে তুললেন তাদের। ওই বাঁধটাকে— যাকে আপনি কাল পর্যন্ত ‘লেক’ বলে জানতেন— কাছ থেকে ভাল করে দেখা চাই যে! মানে…কোনও লাভ নেই, তবু দেখাটা যে নিতান্তই দরকার! অমনি তারা দু’জনে হল্লা তোলে— আজ আর বাঁধা পথে নয়, তারা যাবে মাঠ পেরিয়ে, ক্ষেত পেরিয়ে, আলপথ ধরে। আর কী আশ্চর্য দেখুন— আপনিও রাজি হয়ে গেলেন! পথ ছেড়ে মাঠে নামতেই হল আপনাকে। মাঝে দাঁড়াতেও হল— কেননা আঁকাবাঁকা মেঠো পথের পাশে একটা শিরিষ গাছের পাশেই আছে একটা পলাশগাছ। ফুলে ভ’রে আছে দু’টোই। হাল্কা গোলাপি শিরিষফুল আর আগুনরঙা পলাশকে পাশাপাশি দেখে আপনি এই বয়েসে,এতদিনে বুঝলেন— রবিঠাকুর কেন গেয়েছিলেন— ‘ফাগুন লেগেছে বনে বনে’! তারপর আপনারা হাঁটা দিলেন খোলা মাঠের আল ধরে। একটু এগিয়েই আপনার চল্লিশ পেরিয়ে-যাওয়া গিন্নি কেমন কিশোরীর মতো আহ্লাদি গলায় বলে উঠল—‘দ্যাখো— মাঠে কেমন ঘাসফুল ফুটেছে!’ আপনিও নীচু হয়ে (কত্তদিন পর নতজানু হলেন আপনি!) দেখে নিলেন নীল-বেগুনি ছোট্ট ছোট্ট তারার মতো ফুল। ততক্ষণে অবিশ্যি আপনার গিন্নি আলাপ জুড়েছেন ওই আলের উপরেই বসে-থাকা কুচকুচে কালো এক মহিলার সাথে। আর তিনি বলছেন— এ আর কি। ক্ষেতের রূপ খোলে তখন— যখন ধানের বুকে ঢেউ খেলে যায়। আর অবাক কাণ্ড— আপনি হিসেব করছেন— কোন সময়ে এলে সেটি দেখা যায়!

শেষমেশ অবশ্য আপনারা পৌঁছেই যান সেই বাঁধের পাশে। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে সেই পান্নানীল জলে সারস আর ধানঠুঁটি আর গাইবগলা দেখার পর মনে পড়ে— অনেকটা পথ এবার হেঁটে ফিরতে হবে। এদিকে আল ভেঙে এসে হাঁটুতে বেজায় ব্যথা করছে ততক্ষণে আপনার। বেজার মুখে ফিরছেন— ঠিক তক্ষুনি আসে একটা অটো। চালাচ্ছেন পাকাচুলো এক বুড়ো মানুষ— সাঁওতাল। অমনি অভ্যেসবশতঃ হাত দেখান আপনি। উঠেই মনে পড়ে— ওই যা! টাকা তো নেই পকেটে! ধড়ফড়িয়ে বলতেই হয় তাঁকে—‘নামিয়ে দিন আমাদের। মানিব্যাগটা আনতেই ভুলে গেছি।’ আর তিনি হেসে বলেন ‘তো কি হয়্যাছে! উদিকেই যাচ্ছিলাম তো, নামিয়ে দিই কেনে !’ আপনার লজা করে, কিন্তু বুড়ো হেসে হেসে গল্প করেই চলে—‘তিনদিন দমে বৃষ্টি হল, জানেন। তারপর রিমিকিঝিমিক বৃষ্টি চইলল আরও দুইদিন…’।

আপনাদের নামিয়ে দিয়ে চলে যান তিনি। আর এই প্রথমবার— আপনার মুখে ফুটে ওঠে মৃদু হাসি। কেননা, আপনার এখন মনে হচ্ছে, মনে হতে বাধ্য—‘সত্যিকারের ভারতবর্ষ ব’সে থাকে ধানক্ষেতের আলে, ময়লা শাড়ি পরে। অটো চালায় সে বাঁধের উপরের ভাঙা রাস্তায়। পয়সা না-নিয়েই নামিয়ে দেয় রিসর্টের সামনে। আর তাকে দেখার জন্য আমি কিনা প্রতি শনিবার ব’সে থাকি রাজা ভটচায্যি কী হাতিঘোড়া লিখবে— তার জন্য! ফুসসসসস্! ও ব্যাটা দেখেছে এসব!!!’

৮৮

বেড়ানোর ব্যাপারে বাবা ছিল খাঁটি বাঙালি। বিখ্যাত এবং পরীক্ষিত ‘দীপুদা’ ত্রয়ীর বাইরে ‘পাদমেকং ন গচ্ছামি’— অর্থাৎ দীঘা-পুরী-দার্জিলিং-এর বাইরে কোত্থাও এক পা-ও যেত না। কাজেই আমরা বেড়াতে যেতাম ওই তিন জায়গাতেই ঘুরে ফিরে।

হেনকালে কি এক দৈব যোগাযোগ হল— জানা গেল বাবার এক ছাত্র চাঁদিপুর নামে কোন্ এক অজ্ঞাতপূর্ব স্থানে বেড়াতে গিয়ে মুগ্ধ হয়ে ফিরে এসেছে, এবং এইসান রসিয়ে গপ্প করেছে যে, জন্ম-ঘরকুনো বাবা ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা করেছে— প্রাণ যায় যাক, এবার পুজোর ছুটিতে আমরা সেই আশ্চর্য সমুদ্রতীরস্থ নগরটিতেই যাচ্ছি। যাচ্ছিই। মায়ের তো আনন্দে বাক্যস্ফূর্তি হল না, আমি আর ভাই তুড়িলাফ দিতে লাগলাম। নানান অজানা বাধা টপকে যথাকালে আমরা সেই আনন্দনিকেতনে অবতীর্ণ হলাম, এবং বাক্যিহারা হয়ে গেলাম।

যে বাড়িতে আমাদের ঠাঁই হল (হ্যাঁ, ‘বাড়ি’তেই— কারণ সেটি আদতে একটি বাড়ি, হোটেল নয়।), তার মালিক এক রিটায়ার্ড আর্মি মেজর। নাম— মেজর সিমহা। বাড়ির বাইরের বোর্ড দেখে আমি আর ভাই নিশ্চিত ছিলাম— বানান ভুল হয়েছে— ওটা হবে ‘সিনহা’। ‘সিমহা’ কারুর পদবী হতেই পারে না। তা যাক— বাড়িটার অবস্থান এক আশ্চর্য জায়গায়। একটা টিলার মাথায় বাড়িটা, ঠিক পিছন থেকে নেমে গেছে ঢালু ঘাসে-ঢাকা জমি, গিয়ে মিশেছে ঘন ঝাউয়ের বনে। সেই ঝাউবনের মধ্যে দিয়ে পায়ে-চলা পথ চলে গেছে সমুদ্দুরের পাড় অবধি। আর সে সমুদ্দুরও ভারি মজার। যদ্দূর ইচ্ছে হেঁটে চলে যাও— জল সেই গোড়ালি— বড়জোর হাঁটু পর্যন্ত। সৈকত দেখে হাঁ হয়ে গেলাম; অর্ধচন্দ্রাকৃতি সোনারঙা বিচ ঘিরে আছে ঝাউয়ের বন, তাদের মাথা নড়ছে সমুদ্রের জোলো হাওয়ায়। ভোরে সেই সৈকত ভ’রে পড়ে থাকে পাঁচ বছরের ভাইয়ের নখের আকারের ছোট্ট ছোট্ট রং-বেরঙের অজস্র ঝিনুকে— কুড়িয়ে শেষ করা যায় না— এত্ত ঝিনুক— লাল-নীল-বেগনি-হলুদ— সমুদ্দুর যেন হোলি খেলেছে রাতভোর।

পরদিন আলাপ হল মেজর সাহেবের সঙ্গে। আলাপ হল আসলে বাবার সঙ্গে— কেননা ইনি কথা বলেন ইংরিজিতে, সে ভাষা তখনও আমি বলতে শিখিনি, বাংলা মিডিয়ামের অপ্রতিভ ছাত্র। প্রভাতী ভ্রমণ সেরে ফিরে এসে বাবা বসে গেল তাঁরই সাথে তুমুল আড্ডায়, সমুদ্রমুখী বারান্দার ডেকচেয়ার মুখর হয়ে উঠল বিজাতীয় ভাষার অতিদ্রুত উচ্চারণে। ফিরে এসে বাবা জানাল— মেজর সিমহা আসলে কেরালার মানুষ, আলেপ্পিতে পিতৃপুরুষের ভিটে। সরকারি কাজে এসে চাঁদিপুর তাঁর ভাল লেগে গিয়েছিল; রিটায়ার করে সস্ত্রীক এখানেই এসে বাস করছেন। নিঃসন্তান দম্পতি বাড়ির একটা অংশ ভাড়া দেন, দু’টো মানুষের সাথে দেখা হয়, কথা হয়।

বিকেলের মধ্যেই বোঝা গেল, বাবাকে এঁর বিশেষ ভাল লেগেছে, কেননা রাত্তিরে আমাদের নেমন্তন্ন হল ভিতরবাড়িতে। ভয়ে ভয়ে, তুমুল অনিচ্ছাসত্ত্বেও খেতে গেলাম, ইংরিজিতে কথা বলতে হবে যে! বাবা তো বেজায় গপ্প জুড়ে দিল, খাওয়ার চেয়ে সেদিকেই মন যেন বেশি। মা-ও দেখি সংকোচ কাটিয়ে মিসেস সিমহার সঙ্গে পুটপুট করে কী-সব গল্প করছে। আমরা দুই ভাই বাধ্য হয়ে কাঁকড়ায় মন দিলাম। এমনসময় হঠাৎ কানে এল পরিচিত উচ্চারণ—‘হোয়্যার দ্য মাইন্ড ইস উইদাউট ফিয়ার অ্যান্ড দ্য হেড ইস হেল্ড হাই…!’ এই কমন পড়েছে এতক্ষণে— বাবা এটা হামেশা আওড়ায়— ভেবে প্লেট থেকে চোখ তুলতেই দেখি— বিহ্বল অদ্ভুত এক হাসি নিয়ে বাবার দিকে চেয়ে তিনি বলে যাচ্ছেন কথা…আর…কী আশ্চর্য— সে কথা আমি দিব্যি বুঝতে পারছি—

‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির,

জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর

আপন প্রাঙ্গনতলে দিবসশর্বরী

বসুধারে রাখে নাই খণ্ড ক্ষুদ্র করি….’

সেই দৃশ্য আমি জীবনে ভুলব না। মেজর সিমহা আবৃত্তি করে চলেছেন ‘প্রার্থনা’, বাবা হাতে একটুকরো মাছ নিয়ে স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে আছে সেই উদ্ভাসিত মুখের আর অশ্রুপ্লাবিত চোখের দিকে। পুরো কবিতাটা নিখুঁত বাংলায় আবৃত্তি করে তিনি বন্ধ চোখে বসে রইলেন আরও মিনিট-খানেকের জন্য। তারপর চোখ খুলে নিতান্ত অপ্রতিভ হাসি হেসে অসংলগ্ন ভঙ্গীতে বললেন— ‘আই অ্যাম এক্সট্রিমলি সরি…প্লিজ, কন্টিনিউ…!’

খানিক খাবি খেয়ে আমিই প্রথম কথা বললাম— ‘মানে… আপনি বাংলা জানেন! তাহলে এতক্ষণ যে বড় ইংরেজি বলছিলেন!’

খানিক আমার দিকে বড় বড় চোখে চেয়ে থেকে বৃদ্ধ মানুষটি বাবাকে শুধোলেন— ‘হোয়াট ইস হি সেইং?’

বাবা অনুবাদ করে দিতে এক বিচিত্রমধুর হাসি ফুটল তাঁর মুখে। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে তিনি অত্যন্ত সহজ ইংরেজিতে যা বললেন— তার মানে এইরকম দাঁড়ায়— ‘কী মুশকিল! আমি তো কেরালার মানুষ! বাংলা কোত্থেকে জানব! কিন্তু এ হল এ দেশের শাশ্বততম, সনাতনতম বাণী— যে দেশে ভাষা-ধর্ম-সংস্কৃতি— কোনোটাই মিলনের পথে বাধা নয়— ‘ভারতেরে সেই তীর্থে করো জাগরিত।’— ‘Into that heaven of freedom, my Father, let my country awake.’ তা আমি কেরালার মানুষ, চাকরি করেছি সারা দেশ জুড়ে, অবসর যাপন করছি উড়িষ্যায়, আর পড়ছি বাংলা কবিতা— সর্বোত্তম যা কিছু— সবই তো আমার! আমারই দেশের! ক্ষতি কী!’

আমরা থ। এইবার ঈষৎ লাজুক হেসে, মস্ত পাকা গোঁফওয়ালা প্রাক্তন সৈনিকটি বাধো গলায় বললেন— ‘ইয়ে… তবে এ কবিতা অনুবাদে পড়লে মজা নেই, বুঝলেন স্যার। তাই আমি… এক মিনিট।’

ব’লে তিনি উঠে নিয়ে এলেন একটা প্যাড। তাতে কাঁচা হাতে গোটা গোটা করে অ আ ক খ লেখা। লজ্জিত কন্ঠে বললেন পরাক্রান্ত মানুষটি— ‘শিখছি বাংলা। টেগোরকে তাঁর নিজের ভাষায় না-পড়ে আমি মরছি না, বুঝলেন।’

আর ইদানিং আমরা বলছি— ‘বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান’— এই লাইনটা নাকি ইদানিং ভারি শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে!

৮৯

‘মনসো গহনা গতি’। মনের গতি বোঝা ভার। পরপর ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়ের কথাই কেন ভেসে উঠছে স্মৃতিতে— খোদায় মালুম। যাক গে’, যেমন আসছে— লিখে যাই।

ইন্দ্রনীল মুখুজ্যে ছিল ইংরিজি ডিপার্টমেন্টের দুর্দান্ত ছাত্র। ও, না, মুখার্জি নয়, মুখুজ্যেও নয়— একেবারে মুখোপাধ্যায়; এমনই লিখত ইন্দ্র। পরম নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণসন্তান; গলায় পৈতে, গীতা মুখস্থ। আমরা বলতাম—‘তুই চাকরির পরীক্ষা দিতে পারবি না, ফর্ম ফিলাপ কত্তেই দিন কাবার।’ তা যাক। ওর সাথে আমার আলাপ হওয়ারই কথা না, যদি না ক্লাস শুরু করার ক’দিনের মধ্যেই এক দুপুরে উপুর্ঝন্তি বৃষ্টি নামত। সে যাকে বলে ‘আকাশ-ভাঙা বাদলা’। আমি দু’ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে আসি; যখন বেরিয়েছিলাম— তখন বৃষ্টি ছিল না। এসে দেখি— কেউ নেই, ক্লাস ফাঁকা। শিক্ষকরাও অধিকাংশই অনুপস্থিত। লম্বা ফাঁকা টানা বারান্দাটা থমথম করছে শূন্যতার গৌরবে, আর এই নির্জনতার উপর ছায়া ফেলেছে মেঘ আর বৃষ্টি। জানলার উপর চড়ে ব’সে গলা ছেড়ে গান ধরলাম— ‘উমর ঘুমর ঘির আয়ো রে, সজনি বাদরা’। মেহেদি হাসানের গান, রাগ দেশ। যেন সেই গানের সঙ্গে তাল মেলাতে লাগল ঝরে-পড়া জলবিন্দু, নীচের লনের ঘাস, মেঘে-ঢাকা আকাশ। বর্ষাসজনী তার সজল দুই চোখে মেঘের কাজল মেখে সস্নেহে চেয়ে রইলেন আমার দুঃসাহসী প্রচেষ্টার পানে।

এমনসময় পিছনে টকটক করে বেজে উঠল তাল। আর্ধা বাজছে— এই গানটা সবচেয়ে জমে যে তালে। তড়িঘড়ি পিছনে চেয়ে দেখি— একটি প্রিয়দর্শন যুবক— গৌরবর্ণ, সরু গোঁফ— হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে একটা ডাইরিতে তাল ধরেছে। পরিচয় দেওয়ার আগেই জমে উঠল গান। শেষ হলে তবে পরিচয়। নাম বিনিময় হল, আলাপ হল। সুর, আর বিশেষত তালে মজে-থাকা ছেলে যাকে বলে। তখনও মোবাইল একটা না-শোনা শব্দ। কিন্তু ইন্দ্রর কাছে সর্বদা থাকত একটা ছোট্ট ক্যাসেট-প্লেয়ার আর অজস্র ক্যাসেট। বড়ে গোলাম থেকে মেহেদি হাসান— কে নেই সেখানে! কিন্তু আমাদের মতের মিল ছিল না— আমি সুরের, আর ও তালের ভক্ত যে! আমি যখন বলি—‘কেমন শুদ্ধ নি হয়ে কোমল নি-তে গেল দেখলি!’ ও অমনি বলবে— ‘আর সমটা পড়ল খেয়াল করলি— একটা তেহাই মেরে! উফফ্!!’

এদিকে আমরা দু’জনে তুমুল গান শুনে বেড়াচ্ছি আর তুমুল ঝগড়া করছি। আর ওদিকে খবর এল— নজরুল মঞ্চে বাজাবেন রবিশঙ্কর আর আল্লারাখা। আর কি কখনও কবে, এমন সন্ধ্যা হবে! তায় এঁরা আসছেন একটি এন.জি.ও.র সাহায্যকল্পে— এবং সেটি চালান ইন্দ্রের মামা! আপন মামা! এবং তিনি কথা দিয়েছেন— তিনি আমাদের দু’জনকে বসতে দেবেন স্টেজের ঠিক বাইরে— যদি অবিশ্যি কথা না-বলি। কথা! সে আবার কী! যখন রবিশঙ্কর কথা বলেন তাঁর সেতারে— তখন বাকি পৃথিবী চুপ ক’রে থাকে— এই তো জানি! কাজেই রাজি হতে লাগল ঠিক তিন সেকেন্ড।

অনুষ্ঠান ছ’টা থেকে। আমি আর ইন্দ্র চারটে থেকে স্টেজের পাশে মেঝেতে ব’সে আছি। যথাসময়ে শুরু হল অনুষ্ঠান। পণ্ডিতজি ধরেছেন রূপকে এক ঝামেলাদার গত, এদিকে তার রাগ ইমন-কল্যাণ। যতবার কড়ি-মা হয়ে শুদ্ধ-মা-এ পৌঁছচ্ছেন— আমি হায় হায় ক’রে উঠছি। আর আমারই পাশে ব’সে ইন্দ্র— যতবার আল্লারাখা সমে পৌঁছচ্ছেন বিচিত্র পথে— আলাদা আলাদা তেহাই দিয়ে— আমারই হাঁটুতে এক থাবড়া বসিয়ে হুঙ্কার দিয়ে উঠছে।

যেই বাজনা শেষ হল— আমি নড়ে বসার আগেই দেখি— ইন্দ্র পূর্বের প্রতিজ্ঞা ভুলে পড়ে আছে স্টেজে, আল্লারাখার পায়ে মাথা গুঁজে। আর সেই প্রবীণ মানুষটির মুখে বালকোচিত সরল হাসি, ওর মাথাটা দু’হাত দিয়ে তোলার চেষ্টা করতে করতে তিনি বলছেন— ‘আল্লা তেরা ভালা করে, ভগওয়ান তেরা ভালা করে… লেকিন অব তো ছোড়-দে বেটা… পণ্ডিতজি খড়ে হো রহেঁ হ্যায়…প্যায়ের ছোড় দে বাচ্চা…!’ আর ইন্দ্র— এক নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ বলছে—‘আশীর্বাদ করুন উস্তাদজি…’

না, আমার হিম্মত ছিল না নজরুল মঞ্চের অত্ত শ্রোতার সামনে ওঁদের পা জড়িয়ে ধরার— যদিও ইচ্ছে ছিল ষোল আনা। লজ্জা করছিল, ভয় করছিল— যদি কেউ কিছু বলে! ইন্দ্রর সে হুঁশ ছিল না।

আজ যাঁরা ত্রিশুল নিয়ে মিছিল করছেন, চাপাতি নিয়ে ভয় দেখাচ্ছেন— তাঁরা বরং একটা সুস্পষ্ট যুদ্ধে নেমে পড়ুন। মুখোমুখি যুদ্ধে। যার জোর বেশি, যে বেশি দাঙ্গাবাজ— সে থাকবে, অন্যজন নিকেশ হবে। আমরা তাদের ভয় পাব, মেনে চলব।

শুধু বলি কি— শেখাতে আসবেন না— কাকে বলে ‘ভারতীয় সংস্কৃতি’। ওটা আমরা জানি।

ভারতীয় সংস্কৃতি মানে হল— গুণী মুসলিমের পায়ে মাথা রেখে পড়ে থাকা হিন্দু, বা উল্টোটা। রাজা ভটচাজের প্রিয় লেখকের নাম আখতারুজ্জামান ইলিয়াস হলে আমাদের ভগবান মুচকি হাসেন।

এটুকু আমাদের জানা আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *