অখণ্ডের ঘরের কথা
আমাদের মতো সাধারণ মানুষ পৃথিবীতে আসছি, যাচ্ছি, সভ্যতা তৈরি করছি। কুরুক্ষেত্র থেকে শুরু করে এই কালে দুটো বিশ্বযুদ্ধেও আমরা লড়েছি। এখানে মানুষ প্রতিনিয়ত যা দেখে সেটা হচ্ছে—জন্ম আর মৃত্যু। মানুষ আসছে, মানুষ বড় হচ্ছে, মানুষ বিষয়ের মধ্যে প্রতিপালিত হচ্ছে এবং তার সুখ-দুঃখের নিজস্ব সংজ্ঞা আছে। কেউ মারা গেলে সে দুঃখ পায়, সংসারে কেউ জন্মালে সে আনন্দ পায়। সেখানেও আবার একটি ব্যাপার আছে। সংসারে কন্যা সন্তান এলে অনেকে দুঃখ পায়, পুত্র সন্তান হলে আনন্দ পায়। আনন্দ সম্পর্কে তাদের ধারণা—আমাদের দেহ দিয়ে, বোধ-বুদ্ধি দিয়ে যা ভোগ করতে পারি, স্পর্শ করতে পারি সেটাই আনন্দের বিষয়। এইসব যদি আমাদের না আসে বা অন্যের থেকে একটু কম আসে তাহলে আমরা দুঃখ পাই। তখনি আমরা বলতে থাকি—আমার কিছু হলো না, আমি অপদার্থ, আমার দ্বারা কিছু হবে না। এইসমস্ত মানুষকে অপরেও ঐ একই কথা বলতে থাকে। মন তখন বিষণ্ণ হয়। মনোরোগ হওয়াও বিচিত্র নয়।
মন আর আত্মা—এদুটি ভিন্ন ভিন্ন বস্তু। আমরা মনকে সাধারণত আত্মা বলি না। আত্মা সম্পর্কে আমাদের যা ধারণা তা বেশির ভাগ মানুষের ধারণা—একটা ভৌতিক ব্যাপার। কোন মানুষ মারা গেলে যদি আবার তিনি কোন কারণে সূক্ষ্মশরীরে দেখা দেন তাহলে আমরা বলি—ভূত হয়ে ফিরে এসেছেন। আর একথাও বলতে চাই—তাঁর আত্মার মুক্তি হয়নি। গয়ায় গিয়ে পিণ্ডদান করে এস। আত্মার মুক্তি চাই। যদি মুক্তি না পায় তাহলে সেই আত্মা অত্যন্ত কষ্টে থাকে এবং তার উত্তরপুরুষকে তারা অপরাধী করে। সেজন্য আমরা এসব কথা শুনে থাকি—শীগগিরই গিয়ে গয়ায় পিণ্ড দিয়ে এস, তাহলে তোমার মাতা-পিতা উদ্ধার পাবেন। এসবই হচ্ছে স্থূলজগতের কথা। মানুষ স্বভাবতই তার অবস্থানকে, তার জন্মকে একটা সহজ সংজ্ঞার মধ্যে আনতে চায় এবং সেইটি করতে গিয়ে সে আবিষ্কার করে মানুষের দেহ, তার চলা-ফেরা, খাওয়া- দাওয়া—এটা একটা ব্যাপার, মানুষের মন আরেকটা ব্যাপার। মানুষ মনে চিন্তা করে, মনে ভাবে, মনে সঙ্কল্প করে—এটা খাব, ওটা খাব, একে কটু কথা বলব, তাকে ভালবাসব। এগুলো হলো মনের ক্রিয়া, চলতেই থাকে। মনের এই ক্রিয়া দেহের মধ্যে বসেই চলেছে। মন ভাবলে তবে দেহ কাজ করে। একালের যাঁরা মনস্তত্ত্ববিদ্, তাঁরা বলছেন, তোমার মনকে আগে দেখ। সেই মনের দুটো অংশ আছে। একটা হচ্ছে conscious part, আরেকটা হচ্ছে sub-conscious part—যেটি মনের তিনের চারভাগ এবং glacier বা হিমশৈলের মতো জলের তলায় অর্থাৎ অবচেতনে আছে। আর একের চারভাগ অর্থাৎ conscious part ওপরে উঠে আছে। এই তিনের চারভাগের মধ্যে তার সমস্ত সংস্কার লুকিয়ে আছে। তার ভাবনা-চিন্তা, তার frustration, তার আঘাত। সমস্ত কিছু সেখানে চলে যাচ্ছে, আর সেখান থেকে সক্রিয় মনকে নিয়ন্ত্রণ করছে। সে পৃথিবীতে চলে-ফিরে বেড়াচ্ছে, আর এই পৃথিবী সম্পর্কে একটা ধারণা সে নিজের মধ্যে তৈরি করছে। পৃথিবীটা কি আনন্দের? পৃথিবীটা কি দুঃখের? যেমন, একজন মানুষের সবকিছু আছে। তিনি তাঁর স্ত্রীকে খুব ভালবাসতেন, কিন্তু স্ত্রী তাঁকে ত্যাগ করে চলে গেছেন। তখন তাঁর জাগ্রত মন একটি ধাক্কা খেল এবং ধাক্কাটি চলে গেল তার অবচেতন মনে। সেখানে গিয়ে এমন একটি কাণ্ড ঘটতে পারে, যার ফলে পরবর্তী কালে তিনি নারী-বিদ্বেষী হয়ে গেলেন। এইরকম একটি মন নিয়ে জুলে ভার্নের একটি উপন্যাস আছে। ভারী সুন্দর! ‘Twenty thousands leagues under the sea’ I
এক সাবমেরিনের ক্যাপ্টেন। তিনি তাঁর স্ত্রীর দ্বারা প্রতারিত ও পরিত্যক্ত হওয়ার ফলে নারী-বিদ্বেষী হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি এরপর সমুদ্রের তলায় গিয়ে একটি সাবমেরিনের চালক হলেন। তাঁর কাজই হলো—তিনি সমুদ্রে যত জাহাজ দেখেন সেগুলিকে টর্পেডোর সাহায্যে ভরাডুবি করে দেন। সেই জাহাজে কোন নারী যাত্রী অবশ্যই আছে, সেই বিদ্বেষেই তিনি জাহাজগুলিকে ধ্বংস করতেন। এইবার যখন তাঁকে ধরা হলো তখন সাবমেরিনের কেবিনে গিয়ে দেখা গেল, একটি সুন্দর কারুকার্য করা সিন্দুকের মধ্যে তাঁর স্ত্রীর ব্যবহৃত সমস্ত পোশাকাদি রয়েছে। সেগুলিকে এর মধ্যে সঞ্চিত রেখে তিনি তাঁর বিদ্বেষ এইভাবে কার্যকর করতেন। এটি তাঁর অবচেতন মনের ক্রিয়া।
কিছু কিছু মানুষ আছেন যাঁদের মনস্তত্ত্ববিদ্রা বলে থাকেন ‘sadist’। তাঁরা নিজেকে এবং অপরকে দুঃখ দিয়ে, যন্ত্রণা দিয়ে আনন্দ পান। মাইকেল দ্য সাদ ছিলেন ফ্রান্সের মানুষ। তিনি এই প্রকৃতির ছিলেন। এজাতীয় মনোবিকলন তাঁরই নামে চিহ্নিত—’sadism’। তাত্ত্বিকরা বলেছেন, কোন মানুষের মন শুদ্ধ মন নয়। তার অবচেতনে দীর্ঘদিন ধরে পুঞ্জীভূত হয়ে আছে যে-বোধ, সেই বোধ তার সক্রিয় মনের দ্বারা প্রকাশিত হচ্ছে। যার ফলে কোন মানুষ প্রেমিক, কোন মানুষ সমালোচক, কোন মানুষ নিষ্ঠুর, কোন মানুষ দয়ালু, আবার কোন মানুষ অন্যের দোষ দেখে আনন্দ পায়। এরকম বহু বিচিত্র মানুষ আমরা আমাদের চারপাশে দেখতে পাই।
একটা মানুষ তার স্থূলশরীর, সূক্ষ্মশরীর এবং কারণ-শরীর—এই তিনটি অংশ নিয়ে এই জগতে বিচরণ করছে। ‘ব্রহ্ম’ বলে একটি শব্দ আমরা শুনেছি এবং সেটি কি তা আমরা জানি না। ব্রহ্ম সম্পর্কে বলতে গিয়ে এইটি বলা হয়ে থাকে—জ্ঞানী, বেদান্তবাদী যাকে ‘ব্রহ্ম’ বা ‘আত্মা’ বলেছেন, যোগী তাঁকে ‘পরমাত্মা’ বলেছেন, ভক্ত তাঁকে বলছেন ‘ভগবান’। এক ব্রহ্মের এই তিনটি সংজ্ঞা। আবার এও বলা হচ্ছে—ব্রহ্মের কোন সংজ্ঞা নেই।
মনস্তাত্ত্বিক কার্ল ইয়ুং একটি সুন্দর কথা বলেছেন—এই মানুষের পৃথিবীতে ‘সিক্রেট’ বা গোপনীয় বলে কিছু নেই। অনেকে বলে, ফিসফিস করে- তোমাকে একটা গোপন কথা বলছি। সেটা সংজ্ঞা অনুসারে আদৌ গোপন কথা হলো না। পৃথিবীর একজন লোকও যদি জেনে থাকে, তাহলে তার গোপনীয়তা নষ্ট হয়ে গেল। তাহলে প্রকৃত গোপন জিনিস কি? তা হলো ব্রহ্ম। বিদ্যাসাগরকে ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন—সমস্ত জ্ঞানই উচ্ছিষ্ট হয়েছে, একমাত্র ব্রহ্ম উচ্ছিষ্ট হননি। কারণ, ব্রহ্ম কি তা কোন মানুষের পক্ষে বলা সম্ভব নয়। আর যিনি বলতে পারেন, যিনি ব্রহ্মে উপনীত হয়েছেন—তিনি কখনো আর ফিরে আসবেন না। ফিরে এসে বলবেন না, আমি তা দেখে এসেছি। এটারই একটা ছোট রূপ হচ্ছে—মৃত্যুর পর কি আছে কোন মানুষ বলতে পারে না। না মারা গেলে কেউ জানে না যে, এই লোক থেকে কোন্ লোকে সে যাচ্ছে। একটি অতি সুন্দর বই আছে—’Near Death Experience’। এবিষয়ে যদি জানতে হয় তাহলে এই বইটি থেকে জানা যাবে। পৃথিবীতে এরকম ঘটনা ঘটেছে—death experience। এক-একজন মানুষ medically declared dead। ডাক্তার লিখে দিয়েছেন—তিনি মারা গিয়েছেন, কিন্তু পরে বেঁচে উঠেছেন। এবং তিনি ফিরে এসে বলেছেন কি কি দর্শন হলো। মোটামুটি দেখা গেছে, এঁদের যেসমস্ত অভিজ্ঞতা ঐ বইটিতে বিবৃত, তা একইরকম। হঠাৎ যেন দরজা খুলে গেছে, হঠাৎ ভীষণ উন্মুক্ত প্রান্তরে তাঁরা দাঁড়িয়ে আছেন। সেখানে যেসব বস্তু আছে তার আকার, আকৃতি কিছুই বলা যাচ্ছে না। একটা ভয়ঙ্কর আলো, সেই আলোর অনুভূতিটা তাঁদের হয়েছে। তার সঙ্গে একটা ভারহীনতা আর অদ্ভুত ধরনের একটা আনন্দ! এটা তাঁরা বোধ করেছেন। অর্থাৎ আমরা যতদিন এই দেহখাঁচায় আবদ্ধ হয়ে আছি ততদিন এই বোধটিও আমাদের মধ্যে ছিল, আমাদের মধ্যে আছে।
রবীন্দ্রনাথ একেই বলছেন—সীমার মধ্যে অসীমের সুর। আমরা বোঝার চেষ্টা করিনি, প্রয়োজনবোধ করিনি। বেদান্তবাদীরা এই চৈতন্যকে বলেছেন, যেন ‘অয়স্কান্ত মণি’। অদ্ভুত ধরনের উজ্জ্বল এক অবস্থিতি। আমাদের ভিতরে রয়েছে, কিন্তু আচ্ছন্ন অবস্থায়—মেঘে ঢাকা তারা! অনেক মাটির তলায় পড়ে থাকে হীরকখণ্ড। আমার মধ্যেই আছে। তাঁরা বারবার বলেছেন—অনুসন্ধান কর। ‘সার্চ’। পৃথিবীতে সোনা অনুসন্ধান করার জন্য মানুষ টেক্সাসে গেছে, অ্যারিজোনায় গেছে। হীরে খোঁজার জন্য সেখানকার খনিতে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পাথর কেটেছে, মাটি কুপিয়েছে, হয়তো হঠাৎ একটি হীরে পেয়েওছে; কিন্তু নিজের মধ্যে যে মণির মণি, চেতনার চৈতন্য, অস্তিত্বের অস্তিত্ব আছে সেটিকে আমরা আবিষ্কার করার চেষ্টাই করি না।
পদ্ধতিটি অতি সহজ আবার অতি কঠিন। সেটি হচ্ছে—আমি ইন্দ্রিয় দিয়ে যে রূপ, রস, গন্ধ, বর্ণ প্রভৃতি জগতের ধারণায় মোহিত সেই তুচ্ছ বোধ দিয়ে এই বস্তুটিকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। কারণ, সেই জায়গায় পৌঁছাতে গেলে এবং আমাদের sub conscious ও conscious-এর মাঝে যে-জগৎ আছে, ইন্দ্রিয়রা ঐকতানে আমাদের মনে জগৎ-অস্তিত্ব সম্পর্কে যে-ধারণা তৈরি করছে তা স্তব্ধ করে দিতে হবে। আমার ‘আমি’টা যতক্ষণ পর্যন্ত perfect আমি না হচ্ছে ততক্ষণ ‘বৃহৎ-আমি’কে জানা যাবে না। ‘Perfect আমি’টা কিরকম? Physics বলছে-আমরা যদি কোন বস্তুকে মাপতে চাই, ওজন করতে চাই তাহলে যা দিয়ে মাপব, ওজন করব—সেই পরিমাপককে আগে পরীক্ষা করতে হবে। ঠিক আছে কিনা! কতটা বেঠিক? ‘পারসেন্টেজ অফ এরার’ কতটা? ঠিক সেইরকম, যে-আমি ঐ বড় ‘আমি’টিকে ধরবে, যে-আমি থেকে সমস্ত ‘আমি’র উদ্ভব—তাকে ধরতে গেলে এই ‘আমি’টিকে পরিশ্রুত হতে হবে। ইংরেজীতে একটি কথা আছে—’bias’। সেটি থাকলে হবে না। এই আমি যেন সেই আমি না হয়, যা দেহগত আমি। যেটিকে বলা হয় ‘অহঙ্কার’। আমি আর অহঙ্কার—এই দুটো বস্তু আলাদা। ক্ষুদ্র ‘আমি’কে বলে অহঙ্কারে আচ্ছন্ন আমি। যে-আমি নিজের জ্ঞান, বুদ্ধি, শিক্ষাগত ও দেহগত যোগ্যতাবলী, পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষা এবং ইতিহাসের ধারায় তৈরি, সেই ‘আমি’কে বলে ‘conditional আমি’। সে ইতিমধ্যে জর্জরিত ও একপেশে হয়ে আছে। সে perfect নয়। অতএব এই আমি দিয়ে সেই ব্রহ্ম নামক বস্তুটিকে খুঁজে পাওয়া কঠিন। এর মধ্যে আছে অবিশ্বাস। সে জানে না, কার অনুসন্ধান করতে সে যাচ্ছে এবং যতক্ষণ না একটা আত্মিক বিশ্বাস তৈরি হচ্ছে ততক্ষণ সেই জায়গায় আমরা পৌঁছাতে পারব না।
এবার আমরা মনের কাছে ফিরে আসি। দেখতে পাব, যে-জিনিস আমরা ঠিকমতো করতে পারি তাতে আমার মনের সায় আছে। তাহলে কি মানুষ মন ছাড়া কাজ করছে? হ্যাঁ, খুব দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে—করছে। অভ্যাস। মন বাঁচতে বাঁচতে অনেক অভ্যাস সঞ্চয় করছে। তখন সে যা করে সেটা অনেকটা blind folded। যেমন চোখ-বাঁধা অবস্থায় যাদুকর মোটরসাইকেল চালায়। সকালবেলা উঠে যার যত শরীর খারাপ থাকুক না কেন, তার ‘ক্যাজুয়াল লিভ’ পাওনা না থাকলে সে অফিসে যাবেই। সকালে তার যেমনই শরীর থাক, বাজারে যাবেই বা শ্মশান থেকে ফিরে এলেও সকালের খবরের কাগজ পড়বেই। নিত্যনৈমিত্তিক অভ্যাসের কাজ, যেমন দাঁত মাজা, চুল আঁচড়ানো সকলেই করে থাকে—এক-একজন এক-এক ভাবে। সুতরাং মন যখন অভ্যাসে হারিয়ে যায় তখন সেই মনের ওপর আস্থা রাখা যায় না। সেখানে—”He becomes an automation.” ‘রোবট লাইফ’। যেমন যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিকদের বলা হয় ‘মার্চ’ বা বলা হয় ‘ফায়ার’। তখন সে বিচার করে না, কাকে ‘ফায়ার’ করছে, কাকে মারছে। মানুষ মানুষকে মারছে। কেন মারছে—সেই বোধ তার মধ্যে আসে না! এইধরনের উচ্চচিন্তা, আধ্যাত্মিক চিন্তা তার মধ্যে আসে না! সৈন্যবাহিনীতে প্রথমেই মানুষকে মৃত মানুষে বা রোবটে পরিণত করা হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন establishment-এ যাঁরা চাকরি করছেন, তাঁদেরও একই অবস্থা। তাঁরা প্রত্যেকেই ‘দাস আমি’তে পরিণত হয়েছেন। আমি বলব, তুমি গুলি চালাবে। একটিমাত্র উদ্দীপক কথা বলা হবে—দেশাত্মবোধ, কোন প্রশ্ন করো না মার, কাট। যে-কাজ মানুষ নিজের সিদ্ধান্ত অনুসারে সঠিক না বেঠিক, সেই সন্ধান পায় না, সেগুলি তার অভ্যাসের দুনিয়ার কাজ। একটা ঘোড়া দৌড়াচ্ছে, মানুষ ছুটছে, বাসে উঠছে, অফিসের ফাইল টেনে লিখছে—এসবই তার অভ্যাসের দুনিয়ার কাজ। এই মনটাই ঘুরেফিরে আমাদের জীবন চালাচ্ছে। আবার বাড়ি ফিরে আসছে দেহের ব্যাগে ভরা সেই মনটা।
Medical world বলছে, ‘নিউরো ডিজিজ’-এর সংখ্যা বাড়ছে। কোন মানুষই সুস্থ নয়। সমস্ত মানুষ ‘টেনশন’ আর বদহজমের শিকার। কেন এমন হচ্ছে? কারণ, তাদের মন। যে-মন তার সারা শরীরে বিচরণ করে বেড়াচ্ছে, তাকে আনন্দে রাখবে, আনন্দে খাওয়াবে, হজম করাবে, আনন্দে সুখ-নিদ্রায় অর্পণ করবে, পরিবার-পরিজনের সঙ্গে আনন্দে থাকবে। সে আর সম্ভব নয়। কারণ, this world is a civilized world. সভ্যতা আজ এমন একটা জায়গায় উঠেছে যেখানে মনে হতে পারে, মানুষ অপ্রয়োজনীয়। মানুষের আর প্রয়োজন নেই। মানুষের মধ্যে একটা inferiority complex তৈরি হচ্ছে। যন্ত্র, টেকনোলজি আজ মানুষকে ছাপিয়ে গেছে। মানুষের যেন কোন কাজ নেই! কম্পিউটারই সব কাজ করে দেবে। এইধরনের কথা শুনতে শুনতে আমাদের মনে হচ্ছে, মানুষের প্রয়োজন বুঝি ফুরিয়ে এসেছে! সুতরাং এই মন নিয়ে আমরা সেই ব্রহ্মকে কি করে খুঁজে পাব? তাঁকে পেতে হলে উপনিষদ্ বলছেন : “নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্যো।” (মুণ্ডক উপনিষদ্, ৩।২।৪) “নায়মাত্মা প্রবচনেন লভ্যো ন মেধয়া ন বহুনা শ্রুতেন।” (ঐ, ৩।২।৩) যতই পড়, যতই শোন, যতই cerebral exercise কর, তাঁকে পাবে না। কারণ ব্রহ্মলাভ করতে হলে তোমাকে বীর্যবান এবং সঙ্কল্পে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। তোমাকে এই সঙ্কল্প করতে হবে—আমি পৌঁছাব। কোথায় যাব? এক ফার্লং, দু-ফার্লং, এক কিলোমিটার, দশ কিলোমিটার? না। It is very near – তোমার পাশে বসে আছেন। উপমায়—আমরা পৃথিবীতে যে-গাছ দেখি তার শেকড় তলায়, শাখা- প্রশাখা ওপরে। আর বিশ্ব নামক যে-বৃক্ষের ডালে ডালে আমরা বিচরণ করছি সেটি হলো ঊর্ধ্বমূল, অধঃশাখ। “ঊর্ধ্বমূলমধঃশাখমশ্বত্থং প্রাহুরব্যয়ম্।/ছন্দাংসি যস্য পর্ণানি যস্তং বৈদ স বেদবিৎ।।” (গীতা, ১৫।১)
এই সংসাররূপ মায়াময় বৃক্ষের মূল (কারণ) ঊর্ধ্বে, অর্থাৎ মায়াশক্তিবিশিষ্ট ব্রহ্মে; হিরণ্যগর্ভাদি শাখা নিম্নদিকে আর কর্মকাণ্ডরূপ বেদসমুদয় এই বৃক্ষের পত্র। এই অনাদি সংসারকে বেদপুরাণাদি শাস্ত্র অশ্বত্থ বলে থাকেন। এইপ্রকার সংসারবৃক্ষকে যিনি জানেন, তিনিই বেদজ্ঞ। এই গাছেরই একটি ডালে বন্ধুর মতো দুটি পাখি বসে আছে পাশাপাশি—”দ্বা সুপর্ণা সবুজা সখায়া সমানং বৃক্ষং পরিষস্বজাতে”। (মুণ্ডক উপনিষদ্, ৩।১।১) এই দুটি কে? একটি জীবাত্মা, একটি পরমাত্মা। তাদের মধ্যে ভীষণ বন্ধুত্ব। তারা পাশাপাশি দুটি ডালে বসে আছে। জীবাত্মা নামক পাখিটি সংসার আস্বাদন করছে। তিক্ত, কটু কষায় ফল আস্বাদন করছে। সুখে-দুঃখে তাড়িত, পীড়িত হচ্ছে। তার জন্ম-মৃত্যু বোধ আছে, তার সময়ের বোধ আছে। আর পাশের ডালে যে বসে আছে, সে পরমাত্মা। সেটি এটিকে দেখছে আর অপেক্ষা করে আছে, কখন সে লব্ধ জ্ঞান থেকে পৃথিবীটাকে বুঝতে পারবে—নিত্য শাশ্বত বলে কিছু নেই। আজ যা আছে, কাল তা থাকবে না। আজ যা নেই কাল তা হবে। আমি মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যা অর্জন করেছি, সংগ্রহ করেছি—অর্থ, বিত্ত—মৃত্যুর কালে কোনটাই আমার সঙ্গে যাবে না। বিবাহিত জীবনে যে-প্রেয়সীকে কাছে পেয়েছিলাম, সে আমার সঙ্গে যাবে না। এই পৃথিবীতে এসেছি আমি, কি আলো নিয়ে এসেছি জানি না। ছিলাম একটা ছোট্ট গুহার মতো জায়গায়—মাতৃজঠরে, গর্ভসলিলে। ঊর্ধ্বপদ, হেঁটমুণ্ড। একটা ‘intact system’ আরেকটি system- এর অভ্যন্তরে। শুধুমাত্র brain-টি waves নিতে শিখেছে, বাকি lungs, heart, kidney তখনো sealed। যতক্ষণ না পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করছে ততক্ষণ পর্যন্ত সেগুলি উন্মোচিত হবে না। টিকটিক করবে না, লাবডুব, লাবডুব শব্দ হবে না হৃদয়ে। পাকস্থলী কাজ করবে না। ফুসফুস বায়ু নেবে না, অন্ত্র কার্যকরী হবে না। অদ্ভুত ব্যাপার! দশটি মাস যোগে, যাগে। অবতীর্ণ হলো কোন্ পৃথিবীতে?—যে-পৃথিবী থেকে তাকে চলে যেতে হবে। ধীরে ধীরে সে বড় হবে। যদি সে নিজের পায়ে হেঁটে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড নাও ঘোরে, পায়ে পায়ে তাকে চলে যেতে হবে সাধের পৃথিবী ছেড়ে।
এ যেন আমি ছাড়াই এক পথিক আমার থেকে বের হয়ে দূর, বহু দূরে চলে যাচ্ছে। আজ থেকে তিরিশ বছর দূরে সে দাঁড়িয়ে বলছে—আমি এখানে, আমি এই অবধি চলে এসেছি। আরো তিরিশ বছর পেরিয়ে সে বলছে—আমি এই অবধি চলে এসেছি। আরো তিরিশ বছর পেরিয়ে এসে সে বলছে—আমি সমুদ্র পেয়ে গেছি। আর যে-মুহূর্তে সে বলছে—আমি পেয়ে গেছি তাঁকে, বিশালে এসে গেছি ভাই—সেই মুহূর্তে আমার দেহ, আমার যন্ত্র, আমার খাঁচা ‘কোল্যান্স’ করছে। ইংরেজীতে ‘কিক দ্য বাকেট’। কে গেল চলে! আমার দেহাসীন মহাপ্রাণ সেই পরমাত্মা। শুধু আমার ভিতরেই নয়, পৃথিবীর যত ‘আমি’ আছে, তার ভিতরে আরেকটি আমি বসে আছে। তাঁকে ভক্ত বলছে ‘তুমি’, আর ব্রহ্মবিদ্রা বলছেন ‘আত্মা’। আত্মার কি দরকার ছিল এই ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে বসে আমার সঙ্গে দুঃখভোগ করার? না, তিনি দুঃখ ভোগ করছেন না। তিনি বারেবারে আমাকে শেখাতে চাইছেন—এই পৃথিবীর তুমি জ্ঞান অর্জন কর, তাহলেই পৃথিবীর মায়া তোমাকে গ্রাস করতে পারবে না। আত্ম-তত্ত্ব সম্পর্কে সেই কারণেই বলা হচ্ছে, নদীর ঘাটে গিয়ে ঘট ভরে জল এনেছি—তা কিন্তু হবে না। ভরা যায় না, ভরে যায়। অনুভূতি, উপলব্ধি, দর্শন, অন্যকে দেখা ও বিচারের পথ ধরে জাগে।
বেদান্তীই হচ্ছেন একজন প্রকৃত বিচারকর্তা, যিনি বসে বসে ‘নেতি, নেতি’ করে সেই ব্রহ্মে পৌঁছাচ্ছেন—যা “নিত্যো নিত্যানাং চেতনশ্চেতনানাম্/একো বহূনাং যো বিদধাতিকামান্।।” (শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ্, ৬।১৩) যা নিত্য, যা শাশ্বত। সকলের এই উপলব্ধি সম্ভব নয়। একমাত্র তিনিই পারবেন, যাঁর মধ্যে সঙ্কল্পের উদয় হয়েছে, যিনি ঘা খেতে খেতে ‘frustrated’ হননি। ঘা খেতে খেতে তিনি স্কিজোফ্রেনিক হননি। একপাশে বসে ‘হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হলো’ বলছেন না। দুঃখের গান গাইছেন না। বীর হতে হবে। মেরেছ, বেশ করেছ। তুমি তো মারবে আমি জানতাম, কিন্তু তোমার কোন মারই আমাকে আহত করতে পারবে না। কারণ, আমি তাঁরই সন্তান। এই হচ্ছে আত্মবোধ। আত্মবোধে জাগরিত হয়ে যে-যাত্রী যাত্রা শুরু করেছেন, তিনি সেই পরমপদ পাবেন। কখন পাবেন? সব শেষে পাবেন? না। তখন তাঁর এই আত্মজ্ঞান তাঁকে বন্ধুর মতো সঙ্গে করে এই পৃথিবীর পথ ধরে নিয়ে যাবে আর বলবে, ‘কেয়া তামাশা!’
রামপ্রসাদকে আজু গোঁসাই বলেছিলেন :
“এই সংসার মজার কুটি,
আমি খাই দাই আর মজা লুটি।”
সেইজন্য ‘আত্মা” বা ‘আত্মজ্ঞান’কে কোন সংজ্ঞায় বাঁধা যায় না। ইংরেজীতে self বলে একটি কথা আছে। What is self? সেটি হচ্ছে ‘আমি’রই একটি variation। যখনি ‘আমি আমি’ বলছি তখনি সেটা আমার ভিতরের একটা অহঙ্কার। আমার নিজস্ব বোধ, আমার নাম-রূপ, আমার উপাধি, আমার শিক্ষা, আমার জ্ঞান, আমার পারিবারিক পরিচয় এই ‘আমি’কে গঠন করছে। সেই আমি যখন বলছে—আমার শরীর, আমার দেহ, আমার জ্ঞান–তখন সবই অহং-সংস্পষ্ট। কূপবৎ। ঠাকুর বলছেন, উপাধি নাশ না হলে বিশুদ্ধ ‘আমি’- ‘পাকা আমি’কে পাওয়া যাবে না।
এইবার ব্রহ্মতত্ত্ব। ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ যেভাবে বুঝিয়েছেন, আমাদের বেদান্ত, সাংখ্য, পঞ্চদশী, বিভিন্ন শাস্ত্রসমূহ তত সহজে বোঝাতে পারেননি। কারণ, ন্যায়ের পথ, শ্রুতি, স্মৃতি এবং বিচারের পথ হচ্ছে জ্ঞানের পথ—যে- পথে শঙ্করাচার্য বিচরণ করেছেন, বলছেন—ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা। ঠাকুর বললেন, অবশ্যই মিথ্যা, কিন্তু কখন? যখন তুমি ব্রহ্মের দিক থেকে দেখবে। সমাধিতে উঠবে। কিন্তু যতক্ষণ ‘আমি’ বোধ আছে ততক্ষণ জগৎ সত্য। ব্ৰহ্মও সত্য, জগত্ত সত্য। ব্রহ্মেরই মায়া। আর মায়াতেই জীবজগৎ। উৎস ব্রহ্ম। বোধের জগৎ। এই বোধের জগতের অনুভূতি দিয়ে বোধাতীতকে কে ধারণা করবে? সরে আসতে হবে। অনিত্য ছেড়ে নিত্য বস্তুর অনুসন্ধান। ‘নিত্য’ কি বস্তু? মানুষের আসা-যাওয়ার পথের ধারে একটি ‘light house’, যা মৃত্যুদ্ৰষ্ট তাৎক্ষণিক অবস্থানের ওপর শাশ্বতের আলো ফেলছে। কোনদিন এই সৃষ্টিকে নিঃশেষ করা যাবে না, কারণ এটি ‘শাশ্বতের শ্বাস’। ব্রহ্ম অনন্ত সিন্ধু। নিশ্চল, নীরব, নিথর। পরিমণ্ডলে আকাশ, বাতাস, আলো। আছে কি নেই! পৃথিবী অন্ধকারের না আলোর-কে বলতে পারে? একমাত্র তিনিই বলতে পারেন। আমরা আপাতদৃষ্টিতে ইন্দ্রিয়ের চোখ দিয়ে দেখি—সূর্য উঠছে, সূর্য ডুবছে। যতক্ষণ সূর্য, ততক্ষণ আলো। যখন সূর্য থাকে না তখন অন্ধকার। অন্ধকার আকাশে তারা, নক্ষত্র, চন্দ্র দেখতে পাই। এ তো আমার ইন্দ্রিয়ের চোখের দেখা। প্রকৃত দর্শন স্বামীজীর গানে—”নাহি সূর্য, নাহি জ্যোতিঃ, নাহি শশাঙ্কসুন্দর,/ভাসে ব্যোমে ছায়াসম ছবি বিশ্বচরাচর।।/অস্ফুট মন-আকাশে জগৎসংসার ভাসে,/ওঠে ভাসে ডোবে পুনঃ ‘অহং-স্রোতে নিরন্তর’।।”
এই জগৎ হলো মায়ার জগৎ-’আমি আমি’র জগৎ। এই মায়ার জগৎ কি করে তৈরি হলো? নিশ্চেষ্ট নিরাকার, সিন্ধুস্বরূপ ব্রহ্ম পড়ে আছেন—অচল, অবিচল। বেদান্ত যাকে বলছেন মায়ার তরঙ্গ, বিজ্ঞান তাকেই বলছে স্ফুট— ‘Big Bang’। বস্তুকণা উৎক্ষিপ্ত হলো। পরমাণু। ‘অ্যাটম’। পরমাণুতে পরমাণুতে মিলিত হয়ে তৈরি হলো বিভিন্ন বস্তু। ‘ম্যাটার’। পরমাণুর ‘স্ট্রাকচার’ যেন এক সৌরজগৎ। একটি করে ‘নিউক্লিয়াস’। অণুর আবার বাহু আছে এক বা একাধিক। এক একটি বস্তু, যাকে বলে ‘ভ্যালেন্সি’। যেমন অক্সিজেন। তার দুটো হাত। সে দুহাতে একহাত-বিশিষ্ট হাইড্রোজেনকে ধরতে চাইছে। এই অক্সিজেন যেই দুই হাত বাড়িয়ে দুটি হাইড্রোজেনকে ধরল, তখনি সৃষ্টি হলো জল। এই ‘ম্যারেজ’ বা পরিণয়ের ফলে তৈরি হলো জল, একবিন্দু। এইবার বিজ্ঞানীরা বললেন—’হাইড্রোজেন’ নামক বস্তুটি একহাত দিয়ে আরেকটিকে ধরতে চাইছে, আর দুহাত-বিশিষ্ট অক্সিজেনও চাইছে। অদ্ভুত আকাঙ্ক্ষা! হাত যেন খালি না থাকে। একটি বিখ্যাত বই আছে—’First few minutes of creation’। সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ড একসময় কিছুই ছিল না। তারপর হঠাৎ একটি বিস্ফোরণ। চরাচর একটা উত্তপ্ত গ্যাসে ভরে গেল। সেই পরিমণ্ডল ধীরে ধীরে ভীষণ উত্তপ্ত, ভীষণ জ্যোতির্ময় হলো। যেন কোটি সূর্যের দীপ্তি! আস্তে আস্তে যখন ঠাণ্ডা হতে লাগল তখন ‘particles atoms’ তৈরি হলো। তারা তখনো পর্যন্ত ‘positive’। ‘Negative’ বস্তুকণা তখনো তৈরি হয়নি। অদ্ভুত ব্যাপার! সবই positive, অর্থাৎ সবই পুরুষ। তখনো তো প্রকৃতি আসেনি। পুরুষ আর প্রকৃতি না হলে তো সৃষ্টি হবে না। একজন পিতা কি ইচ্ছা করলে শত সন্তানের জনক হতে পারেন? না, একজন জননী চাই। শক্তি চাই। সঙ্গে সঙ্গে negative particles তৈরি হলো।
এখন বেদান্তের সাংখ্যতত্ত্বে আসা যাক। ব্রহ্মের বুকের ওপর যখন মায়ার তরঙ্গ, তখন তিনি সক্রিয়। সৃষ্টির কাজ মায়া সহায়ে। ইচ্ছমাত্র তাঁর কাজ শুরু হলো। ঐ যে বাইবেলে আছে—”Let there be light and there was light, let there be all sorts of species!” সৃষ্টির ঊষাকালে ভগবান নিজের হাতে পৃথিবীর ধূলিকণা দিয়ে তাঁর অবয়বের সাদৃশ্যে মানুষ সৃষ্টি করলেন। তাকিয়ে দেখছেন, চমৎকার তৈরি হয়েছে। তখনো তাতে প্রাণসঞ্চার হয়নি। সেদিনের সেই চিত্রটি কল্পনা করুন, সৃষ্টির সেই প্রথম সকালে ভগবান স্বয়ং হাঁটু গেড়ে বসেছেন এবং তাঁর নিজেরই রচনা মনুষ্যমূর্তির ঠোঁট-দুটি ফাঁক করে “he breathed in three puffs of air.” তিনটি শ্বাস ভরে দিলেন। প্রাণ, অপান, ব্যান, সমান, উদান বায়ুর কথা আমাদের শাস্ত্রে আছে। এই বায়ুই কোনটি আমাদের হৃদয়কে চালাচ্ছে, কোনটি আমাদের ফুসফুসকে সক্রিয় রেখেছে, কোনটি আমাদের উদরের পাকপ্রণালী চালাচ্ছে। কোনটি উদরের বর্জ্যপদার্থ পয়ঃপ্রণালীর মাধ্যমে ঠেলে বের করে দিচ্ছে। আরেকটি বায়ু ক্রমশ ঊর্ধ্ব থেকে ঊর্ধ্বে গিয়ে আমাদের মস্তিষ্ককে সক্রিয় করছে। ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্নার পথে এই বায়ুর বিচরণ।
এরপর আসছে যোগের কথা। আমাদের বৈদান্তিকরা বলছেন, ব্রহ্ম আর শক্তি অভেদ। ব্রহ্ম means আত্মা। আত্মা যখন সক্রিয় হয়ে শক্তির সাহায্য নিচ্ছেন, তখনি অদ্ভুত এই বিশ্ব তার বিরাট বৈচিত্র্য নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে এবং তখনি জন্মাচ্ছে আমি, আমি, আমি—অনেক আমি। সমস্ত আমিই বৃহৎ আমি থেকে উদ্গত। ক্ষুদ্র আমি হচ্ছে অহঙ্কার। নিজের অহঙ্কার, আমার অবস্থিতির অহঙ্কার, আমার জন্মের অহঙ্কার, আমার পিতৃ-মাতৃ পরিচয়ের অহঙ্কার, এই পৃথিবীর অহঙ্কার। আমার আবিষ্কারের, আমার বক্তব্যের, আমার বেঁচে থাকার, আমার অর্জনের, আমার চেষ্টার অহঙ্কার। সমস্ত কিছু নিয়ে যে-আমিটি তৈরি হয়েছে, এমনি মজা যে, সে মায়াচ্ছন্ন হয়ে ক্রমশ আত্মবিস্মৃত হয়ে সে কে— এইটি ভুলে অন্ধকারে নেশার ঘোরে মাতালের মতো টলে টলে চলেছে। নিজেদের মধ্যে ঘাত, প্রতিঘাত, স্বার্থ, দ্বন্দ্বের সঙ্ঘাতে নিজের জীবন ক্ষয় করে আবার ফিরে চলে যাচ্ছে। লয়।
ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ এর একটি সুন্দর ব্যাখ্যা করেছেন। মানুষ যদি অমৃতের পুত্র হয়, তবে কেন এরকম হয়? সবাই যদি ভগবান হয়, তবে কেন এমন হয়? ঠাকুর যে-কথাটি বলেছেন সেটি কবির কথা—’নিজেরে হারায়ে খুঁজি’। কারণ, একটা কিছু তো খুঁজতে হবে। একটা কিছু তো অজানা থেকেই যাবে। সব পাওয়ার শেষে সেই বস্তুটি পেয়ে মানুষ ‘ধন্য ধন্য’ করবে। এই পৃথিবীর দিকে পরিত্যক্ত চপ্পলের মতো তাকিয়ে বলবে—পড়ে থাক ছেঁড়া জুতো, ছেঁড়া জামা, ছেঁড়া জীবন, ছেঁড়া সংসার। আমি পেয়ে গেছি তাঁকে। এই যে তাঁকে পাওয়া—এটিই হচ্ছে আত্মা। এইটি হচ্ছে আত্মজ্ঞান। এইটিকেই বলা হচ্ছে ‘চৈতন্যের আলো’। সেজন্য বোধ ও বুদ্ধির ঊর্ধ্বে বসে আছেন—চৈতন্য।
আমাদের ভিতরে তিনটি আকাশ আছে। একটি মহাকাশ। ঘরের বাইরে বেরিয়ে আকাশের দিকে তাকালে দেখা যায় অনন্ত, অনন্ত, অনন্ত আকাশ। সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ, তারা। এটি মহাকাশ। মহাকাশে মহাযান চলেছে মঙ্গল গ্রহের দিকে। আর দুটি কি আকাশ? একটি হলো আমার দেহের ভিতরে, যে-আকাশ আছে, সেই আকাশ। সেই আকাশে আমার বোধ, বুদ্ধি সমস্ত ভাসছে, আর তার মধ্যেই আচ্ছন্ন করে বসে আছে আমার চিদাকাশ। এই ‘চিৎ’ প্রতি মুহূর্তে আমাকে ভাবাচ্ছে। প্রত্যেক কাজের পরে আমাকে চিন্তা করতে বাধ্য করাচ্ছে। পৃথিবীতে এমন কোন মানুষ নেই, যে ছুটতে ছুটতে একবার থমকে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রশ্ন করে না—তুমি কি করছ? ‘আমি সারাটা দিন কি যে করে বেড়াচ্ছি তা আমি নিজেও জানি না!’ এইখানেই তিনি বসে আছেন। একটা লোক হঠাৎ ভ্যাচ ভ্যাঁচ করে হাঁচতে শুরু করল। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলে বলল, নাকের ভিতর কি যেন সুড়সুড় করে উঠল। তেমনি দেহের ভিতরে মনেরও এইরকম সব ‘ফাইবার’ আছে। সে প্রতি মুহূর্তে নড়ে নড়ে একবার বলতে চাইছে—মন, তুমি একবার ভেবে দেখ, তুমি কিসের পিছনে ছুটছ? এটাই হচ্ছে মনুষ্য নামক প্রাণীর একটি প্রকাশ। একটি আচরণ। মনুষ্যেতর প্রাণী এরকম করে না। একমাত্র মানুষই এরকম করে। তার কারণ, মানুষ হচ্ছে জীবাত্মা ও পরমাত্মায় জড়াজড়ি একটি অবস্থান। সেখানে মস্ত বড় একটি বস্তু চেপে বসে আছে লেপের মতো, কম্বলের মতো। সেটি হচ্ছে আত্মবিস্মৃতি। সে ভুলে গেছে, সে কে! সে জানে না। এই জানাটাকেই বলে স্বপ্রকাশ। তুমি নিজেকে নিজে প্রকাশ কর। তোমার মোহের আবরণটি কেটে ভিতরের অয়স্কান্ত মণিটি কোন সার্জেনই গলস্টোনের মতো কেটে তোমার হাতে ধরিয়ে দিতে পারবে না। এটির জন্য দরকার আমাদের ভারতের বৈদান্তিক ঋষিদের মতো সাধনা। “চরৈবতি, চরৈবতি”। আরো এগোও, আরো এগোও। জীবনের পথ ধরে, সংসারের পথ ধরে, অভিজ্ঞতার পথ ধরে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে এগোও। আর যত তুমি এগোবে, ততই তুমি আরো দৃঢ় ও শক্ত হবে। তখন তিনি পরীক্ষা করে দেখবেন তোমাকে, সেই জ্ঞানটি গ্রহণ করার উপযুক্ত তুমি হয়েছ কিনা!
ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, এক পোয়া পাত্রে এক সের ঢেলে দিলে পাত্রেরও বিপদ, আর যা ঢালা হচ্ছে তারও বিপদ। এই প্রসঙ্গে একটি সুন্দর কথা তিনি বলেছেন। এই যে মতিচ্ছন্ন, আবদ্ধ, ক্ষুদ্র আমি—এই আমি তিনিই রেখে দিয়েছেন। তাঁর খেলা, তাঁর লীলা। যার ভিতরে আত্মজ্ঞানের একটু স্ফুরণ হয়েছে, সে তখন এই কথাই বলে—এই আমি তিনিই রেখে দিয়েছেন। এই যে দেখছ আমি খাচ্ছি, ঘুমাচ্ছি, কাজ করছি, বেড়াচ্ছি—এইসব তিনিই করাচ্ছেন। আমি যন্ত্রমাত্র। “আত্মানং রথিনং বিদ্ধি শরীরং রথমেবতু।/বুদ্ধিন্তু সারথিং বিদ্ধি মনঃ প্রগ্রহমেব চ।।” (কঠ উপনিষদ্, ১।৩।৩)
একদিন গোপীরা যমুনার তীরে এসে দেখলেন, শেষ খেয়াটি চলে গেছে ওপারে। তাঁরা মহা চিন্তায় পড়লেন, কারণ বাড়ি ফিরতে হবে। যমুনার তীরে দুধের কলস রেখে চিন্তা করছেন, এমন সময় ব্যাসদেব সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। তাঁরা বললেন : “ঋষি, ভীষণ বিপদ হয়েছে, নৌকা তো ওপারে চলে গেছে। এখন যাব কি করে? আপনি একটা ব্যবস্থা করতে পারেন?” ব্যাসদেব বললেন : “একটা উপায় করতে পারি, কিন্তু তার আগে আমাকে পেটপুরে কিছু খাওয়াতে হবে।” তাঁরা বললেন : “বিশেষ কিছু তো নেই, তবে কলসী, হাঁড়িতে যদি কিছু অবশিষ্ট থাকে তাহলে চেঁছেপুঁছে দিতে পারি।” যা পাওয়া গেল তা মন্দ নয় একজনের পক্ষে। তিনি পেটপুরে খেয়ে সন্তুষ্ট হয়ে যমুনাকে বললেন : “যমুনে, আমি যদি কিছু খেয়ে না থাকি তাহলে তুমি দ্বিধাবিভক্ত হও।” সঙ্গে সঙ্গে যমুনার জল দুভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। পথ তৈরি ব্যাসদেব-সহ গোপীরা ওপারে চলে গেলেন। ওপারে পৌঁছে গোপীরা প্রশ্ন করছেন : “ঋষি, এটা কিরকম হলো? মিথ্যা ভাষণ! পেটপুরে খেলেন, অথচ যমুনাকে বললেন, যদি খেয়ে না থাকি তাহলে তুমি দ্বিধাবিভক্ত হও, আর যমুনাও দ্বিধাবিভক্ত হলেন! ব্যাপারটা তো বুঝতে পারলাম না।” ঋষি বললেন : “যমুনাকে দ্বিধাবিভক্ত করেছে আমার ব্রহ্মশক্তি—যার দেহ নেই, যার ক্ষুধা নেই। খেয়েছে ব্যাসের খোলটা। আর যিনি যমুনাকে দ্বিধাবিভক্ত করেছেন তিনি তো ব্রহ্মস্বরূপ। তিনি তো সেই পরমাত্মা। তিনি খানও না, তিনি হজমও করেন না।” তখন তাঁরা বুঝতে পারলেন।
এই ‘আমি’ তিনিই রেখে দিয়েছেন। তাঁর লীলা, তাঁর খেলা। তাঁর সাক্ষাৎকার যদি হয় তবেই বোঝা যাবে। এইবার ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ এমন একটি উপমা দিচ্ছেন, যার পরে আর কিছু দরকার হয় না। কারণ তিনি নিজে বেদ, উপনিষদ্ সমস্ত কিছু আত্মস্থ করেছেন। তিনি সাধনা করেছেন। তোতাপুরী এসে তাঁকে ব্রহ্মদর্শন করিয়েছেন। তাঁর ক্ষণে ক্ষণে এ-জগৎ ও ও-জগতের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপিত হয়। তিনি মহাসমাধিতে লীন হন। সাধারণ জীব মহাসমাধিতে একবারই মাত্র যেতে পারে। একুশ দিন পর তার লয় হয়। একমাত্র অবতারাদি সমাধি থেকে ফিরে আসেন ওপারের খবর নিয়ে।
ঠাকুর বলছেন, যাঁরা মানুষকে লোকশিক্ষা দিতে আসেন তাঁরা কেমন জান? যেমন একজন পাতকুয়া খুঁড়েছিল। কোদাল, দড়ি, ঝুড়ি সব ছিল। সাধারণ লোক সেগুলি কাজ হয়ে গেলে ফেলে দেয়। আর কিছু কিছু লোক তা তুলে রাখে যদি অপর লোক পাতকুয়া খোঁড়ে তার কাজে লাগবে বলে। যাঁরা ব্রহ্মবিদ্ তাঁরা এইরকম। তাঁরা যার সাহায্যে যে-জ্ঞান পেয়েছেন, চৈতন্যসমুদ্রের দর্শন পেয়েছেন—তাতে শুধু নিজে অবগাহন করেন না; সবাইকে বলেন—চল চল দেখবে চল। এখানে কেন দুঃখ পাচ্ছ? তুমি মানুষ। তুমি “অণোরণীয়ান্ মহতো মহীয়ান্”। তুমি কেন কীটাণুকীট হয়ে থাকবে? তুমি চল। তিনি বলেন না- রেসের মাঠে বা পার্ক স্ট্রীটে গিয়ে পয়সা ওড়াতে। তিনি বলেন-এমন জায়গায় চল, যেখানে গেলে অনন্তের আনন্দস্বাদ পাওয়া যায়। এই হচ্ছেন অবতার।
অবতার কিরকম? তিনি আমটি খেয়ে আঁটিটি ফেলে মুখটি মুছে ফেলেন না। নিজে যে-বাগানে আম খেয়েছেন, সেই বাগানে সকলকে ডেকে ডেকে ঢুকিয়ে বলেন—আম খা। এই হচ্ছেন অবতার। অবতারের উদাহরণ দিতে গিয়ে ঠাকুর বলেছেন যে, তিন-চার জন একটি পথ ধরে যাচ্ছিল। পাশে পড়ল একটা বিশাল পাঁচিল। সবাই শুনছে, পাঁচিলের ওপারে ভয়ঙ্কর আনন্দধ্বনি হচ্ছে। নাচ, গান, নানারকম সুরধ্বনি। এক-একজন পাঁচিলে উঠছে আর হা-হা করে হাসতে হাসতে পাঁচিলের ওপারে গিয়ে পড়ছে, কিন্তু আর ফিরে আসছে না। এর মধ্যে একজন পাঁচিলের ওপরে উঠল, সে হা-হা করে হাসল বটে, কিন্তু যারা এপাশে ছিল তাদের বলল—এখানে খুব আনন্দ হচ্ছে। তোমরাও দেখবে এস। এই আমি পা-টা নামিয়ে দিচ্ছি। এটা ধরে ওঠ। অবতার হচ্ছেন বাহাদুরী কাঠ। তার ওপরে দশ-বার জন উঠে নদী পার হয়ে যেতে পারে। আর হাভাতে কাঠে উঠলে সকলের সলিলসমাধি। ঠাকুর বলছেন—মনে কর মহাসমুদ্র। অধঃ ঊর্ধ্ব চারিদিক পরিপূর্ণ। তার ভিতরে একটি ঘট রয়েছে। ঘটের অন্তরে বাহিরে জল, কিন্তু না ভাঙলে ঠিক একাকার হচ্ছে না। তিনি এই আমি-ঘট রেখে দিয়েছেন। ঠাকুরের উপমায় সব এক-একটি উপুড় করা ঘট। সেই ব্ৰহ্ম সমুদ্রে ভাসমান। ঘট যেমন ভাবাচ্ছে ঘটের আকাশকে, আমরা ভাবছি এটাই আমার আকাশ। কিন্তু ওটি ঘটাকাশ। চিদাকাশের সন্ধান আমরা পাচ্ছি না। যতক্ষণ না দেহঘট আমরা নিজেরা ভাঙছি, নাহয় তিনি এসে কৃপা করে ভেঙে দিচ্ছেন, ততক্ষণ আত্মার অনন্ত জ্যোতিতে আমার মুক্তি সম্ভব নয়। যতক্ষণ না আমি মুক্তি পাচ্ছি, ততক্ষণ ব্রহ্ম কি? ব্রহ্ম কাকে বলে? ব্রহ্মের সংজ্ঞা কি? এ নিয়ে নানা তর্কবিতর্ক হতে পারে। গ্রন্থের পর গ্রন্থ লেখা যেতে পারে, তাতে আমাদের কোন লাভ হবে না। আমাদের কোন কাজে লাগবে না। উপলব্ধি চাই। অনুভূতি চাই।
Knowledge সম্পর্কে মনস্তত্ত্ববিদেরা দুটো কথা বলেছেন। এক হচ্ছে first hand knowledge’, আরেকটি হচ্ছে ‘second hand knowledge । ঠাকুর এসম্পর্কে একটি চমৎকার উপমা দিয়েছেন—কেউ শুনেছে দুধ, কেউ দেখেছে দুধ, আর কেউ খেয়েছে দুধ। যে শুনেছে দুধ, সে শুনেছে গরুতে থাকে, সাদা দেখতে, তরল পদার্থ, স্নেহজাতীয় পদার্থ। আর যে দেখেছে, সে তো দেখেইছে। কিন্তু এতেও সে সন্তুষ্ট নয়। সে খেয়েছে। খেয়ে মুখ মুছেছে। ভিতরে পরিতৃপ্ত হয়েছে। সেইজন্য ব্ৰহ্ম-অনুভূতি, ব্ৰহ্মলাভ সম্পর্কে শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, বহু লোক শুনেছে, নারদ দর্শন করেছেন আর স্বয়ং শিব তার থেকে এক গণ্ডুষ পান করে সংসার-টংসার ত্যাগ করে নীলকণ্ঠ হয়ে বসে আছেন। নিত্য আর লীলা। ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা। বেদান্ত বলেছে বটে, কিন্তু যতক্ষণ আমি আছি ততক্ষণ লীলাও সত্য। তাই ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, ব্রহ্মেরই মায়া। আর সেই মায়ায় বসে আদ্যাশক্তি এই জীবজগৎ রচনা করেছেন। যতক্ষণ আমি-তুমি বোধ আছে, ততক্ষণ তুমি বলতে পার না— ‘সোহহম্’। যতক্ষণ ‘আমি’ আছে ততক্ষণ লীলাও সত্য। যতক্ষণ না পর্যন্ত তিনি এই অহংটি মুছে দিচ্ছেন কৃপা করে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি থাকবে।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন : “আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর/তোমার প্রেম হতো যে মিছে।” আমি আর তুমি—এই dual existence মিথ্যা হলেও মধুর। এ হচ্ছে ভক্ত আর ভগবানের লীলা। ঠাকুর বলছেন, আমি চিনি হতে ভালবাসি না। আমি আর চিনি—এই দুটোরই অস্তিত্ব থাক। তার কারণ, আমি আস্বাদন করব। এই যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেছেন মায়া, এর আস্বাদনটা থাক না। আমি আর তুমি—এই লীলাটা যেন থাকে। কারণ, লীলা ছাড়া, ভক্ত আর ভগবান ছাড়া জ্ঞানীর পৃথিবী শুষ্ক। ভক্তের পৃথিবী সরস। ঠাকুর তাই বলছেন, যতক্ষণ আমি আছি ততক্ষণ লীলাও সত্য। তিনি কৃপা করে এই ভ্রমটি ভেঙে দিলে ‘যা আছে তাই আছে’ বলার উপায় নেই। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, personal experience । যেমন ইউং বললেন : “There is only one secret that is Bramhan. ‘ তার কারণ “Nobody can say what is Bramhan, what is Atman.” যার experience হয়েছে, সে আর ফিরে আসবে না। নুনের পুতুল সমুদ্র মাপতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। সে গলে গেছে। এই বিরাট আমিতে ক্ষুদ্র আমি যখন গুলে যাবে, তখন কোথায় আমি পাব আমার ক্ষুদ্র আমিকে? বিচারের পথে, জ্ঞানের পথে ব্রহ্মজ্ঞান হতে পারে। আবার এও সত্য—শুধু বিচারে ব্রহ্মকে জানা যায় না। আত্মার দ্বারাই আত্মাকে জানা যায়। যতক্ষণ পর্যন্ত আমার ভিতরের বস্তুটিকে খুঁজে না পাচ্ছি, ততক্ষণ tuning হচ্ছে না। যতক্ষণ না tune করতে পারছি, ততক্ষণ অন্য সব ধ্বনি মুছে গিয়ে সেই ধ্বনি আসবে না।
ঠাকুর বলছেন-সত্যই সত্যকে দর্শন করায়। একথা ক্যাথলিকরাও বলে গেছেন। টমাস আ কেম্পিস বলেছেন, সেই মানুষই blessed, যাকে সত্য এসে সত্য দর্শন করায়। “How happy a man is when the Truth teaches him directly not through Symbols and words that are soon forgotten, but by contact with itself.” ঠাকুর একটি ভারী সুন্দর গল্প বলেছেন। এক রাজার সামনে এক ব্যক্তি খুব সুন্দর ভেলকি দেখাচ্ছে। সে একটু সরে যাওয়ার পর রাজা দেখলেন, একজন ঘোড়সওয়ার আসছে ঘোড়ার ওপর চড়ে। হাতে অস্ত্রশস্ত্র। খুব সাজগোজ। সভাসুদ্ধ লোক। রাজা বিচার করছেন—এর মধ্যে সত্য কোনটি? এ তো যাদুকরের ভেলকি! ঘোড়া তো সত্য নয়। সাজগোজ? অস্ত্রশস্ত্র? তাও নয়। শেষে সত্য সত্যই দেখালে। যে সওয়ার সে একলা দাঁড়িয়ে আছে, তখন দেখছে সেই যাদুকর। বাকি সব ভেলকি। এই হলো আত্মতত্ত্বের গূঢ় কথা। তাহলে আমাদের কী করণীয়? আমাদের করণীয় শোনা নয়, পড়া নয়—যুক্ত হওয়া, নিমগ্ন হওয়া, “দম সামর্থ্যে” কুলকুণ্ডলিনীর কূলে যাওয়া। ঠাকুর বলেছেন, বেদ, বেদান্ত, পুঁথিতে অনেক জ্ঞানের কথা লেখা আছে। পাঁজিতে বিশ আড়া জলের কথা বলা আছে, নিংড়ালে একবিন্দু জলও পড়বে না।
তাহলে এতক্ষণ ধরে যে-আলোচনা হলো তার থেকে আমরা কি পেলাম? পেলাম—বেঁচে থাকার নেশা থেকে বেরিয়ে এস। যে-পৃথিবী তোমাকে কষ্ট দিচ্ছে, যে-জীবনে প্রতিদিন মৃত্যু, যে-জীবনে বাঁচতে বাঁচতে রাজা, প্ৰজা, মন্ত্ৰী সবাই বলছে—আর ভাল লাগে না, যে বেঁচে থাকায় প্রতিমুহূর্তে ক্ষয়, আয়নার সামনে দাঁড়ালে প্রতিবিম্ব বলছে—তুমি বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছ। টি. এস. এলিয়টের কবিতার মতো—
“Growing old growing old
I will have to wear my
Trousers rolled.’
ধীরে ধীরে তিলে তিলে বৃদ্ধ হচ্ছি, ‘না থাকা’র দিকে এগোচ্ছি। ইউরোপ শেখাবে—”Cowards die many times before their death.” আমাদের বেদান্তচিন্তায় বিপরীত কথা—’তুমি মৃত্যুস্মরণ হও’। প্রতিদিন সকালে তোমার সমস্ত চিন্তার সঙ্গে একটি সঙ্কল্প রাখ—এই জীবন, এই বেঁচে থাকা, এই ভোগ, এই ঐশ্বর্য সমস্ত অনিত্য। একদিন আমি মরে যাব। তখনি আমার ভিতরে আরেকটি অস্তিত্বের সন্ধান পাব। তিনি হলেন- পরমাত্মা। তিনি আমার জীবাত্মার দিকে সরে আসবেন। অবশেষে একদিন দুজনে মিলে যাবে। তখন সেই গানের মতো—
“অনন্ত হয়েছ ভালই করেছ
থাক চিরদিন অনন্ত অপার।
ফুরাবে না তুমি ফুরাব না আমি
তোমাতে আমাতে হব একাকার।”
তোমাতে আমিতে হব একাকার। এটাই হচ্ছে realisation। যাচ্ছ কোথায় কোন্ দেশে, কোন্ মুলুকে? না যেখান থেকে এসেছিলাম সেখানেই ফিরে যাচ্ছি। রবার্ট ফ্রস্টের একটি বিখ্যাত কবিতার ভাব—বনের পথ ধরে চলেছ, অনেকটা গেছ, দেখছ বিশাল একটা গাছ তোমার পথরোধ করে পড়ে আছে। একি অবরোধ? একি তোমার গতি থামিয়ে দিতে চাইছে? না! এই বাধা বলতে চাইছে—তুমি এতটা পথ হেঁটে এসেছ, এখানে একটু দাঁড়াও। তিষ্ঠ ক্ষণকাল। পিছনদিকে তাকিয়ে দেখ কি পথ ফেলে এসেছ। সেই অভিজ্ঞতাই তোমাকে একটি অন্য শক্তি দেবে, যাতে তুমি শেষ বাধাটা উত্তীর্ণ হয়ে সেই আলোকিত জগতের দিকে চলে যেতে পারবে।
একটি সুন্দর গল্প আছে। মেক্সিকান রূপকথা। বিশাল মরুভূমি। সেই মরুভূমিতে মধ্যরাতের গভীর অন্ধকার। দূরে, বহুদূরে একটা লণ্ঠনের আলো দুলছে। কে যেন কি খুঁজছে? কাছে গিয়ে দেখা গেল, অতি বৃদ্ধা এক রমণী লণ্ঠনের আলোতে মরুভূমির বালি থেকে খুঁড়ে খুঁড়ে হাড় বের করছে। সমস্ত হাড় সংগ্রহ করে সে একটি গুহার মধ্যে ঢুকল এবং তাই দিয়ে একটি আকৃতি রচনা করতে লাগল। দেখা গেল, সেটি একটি নেকড়ে বাঘ। নেকড়ের সম্পূর্ণ দেহাবয়ব। সূর্য উদিত হচ্ছে পুব আকাশে। সে লণ্ঠনটি নিবিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এইবার প্রাণপ্রতিষ্ঠা। সেই নেকড়ে বাঘ উঠে দাঁড়াল এবং তীর বেগে দিগন্তের দিকে ছুটে গেল। সেখানে তখন উদিত সূর্য। নেকড়ে এক লাফ মারল সূর্যের দিকে। মরুভূমির বৃদ্ধা সেই আদ্যাশক্তি মহামায়া।
ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, সৃষ্টির শেষে তিনি সমস্ত বীজ সংগ্রহ করে রাখেন—যেমন গিন্নিদের একটা ন্যাতা-কাতার হাঁড়ি থাকে, যেখানে শশার বীজ, কুমড়োর বীজ, ঝিঙের বীজ, সমুদ্রের ফেনা ইত্যাদি সঞ্চিত। এটি তারই একটি বিকল্প গল্প। বৃদ্ধা রমণী জীবের অস্থি সংগ্রহ করে করে তাকে আকৃতি দিচ্ছেন, সূর্যের আলোয় তারা প্রাণিত হচ্ছে। যখন দিগন্তের দিকে চলে যাচ্ছে, তখন দেখা যাচ্ছে শক্তির রূপ। মা কালী, মা দুর্গা, মা জগদ্ধাত্রী। এখানেই তন্ত্রের বীজ। পুরুষ ও প্রকৃতির মিলন। মহাসত্য। আত্মার তত্ত্ব। জীবাত্মা এবং পরমাত্মার মিলন। হর-পার্বতীর যুগ্ম রূপ
আত্মাই আত্মাকে খণ্ডিত করছেন। আত্মাই আত্মাকে আবদ্ধ করছেন। গীতায় শ্রীভগবান বলছেন, আত্মাই আত্মার শত্রু। আত্মাই আত্মার বন্ধু। উপনিষদের ঋষি প্রার্থনা করছেন—হে মায়া! তুমি কৃপা করে অর্গল খুলে দাও। তুমি দয়া করে সরে দাঁড়াও। আমি সেই সত্য সদনে প্রবেশ করি। সেখানে ব্রহ্মের আত্মা, যোগীর পরমাত্মা এবং ভক্তের ভগবান বসে আছেন। ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, তুমি চেষ্টা কর আর নাই কর, সমস্ত জীবের গতি তাঁর দিকে। হয়তো লক্ষ জন্ম কেটে যাবে, কিন্তু পাবে। সবাই ফিরে আসবে। এ কিরকম? যেন দম দিয়ে মা সব পুতুল ছেড়ে দিয়েছেন। এমনভাবে কল বেঁধে দিয়েছেন যে, চক্কর মেরে ফিরে আসবেই। হয়তো অনেক জন্ম কেটে যাবে, তবু ফিরে তাকে আসতেই হবে। এইবার শেষকথা।
এক রাজা তাঁর দুই পুত্রকে বলেছিলেন : “যাও গুরুগৃহে গিয়ে ব্ৰহ্মজ্ঞান লাভ করে এস।” ছয় বছর পর তারা দুজনে ফিরে এসেছে। এরপর রাজা বড় পুত্রকে জিজ্ঞাসা করছেন : “ব্রহ্ম সম্পর্কে তোমার উপলব্ধি কি?” সে নানারকম শ্লোক বলতে লাগল। তাঁর জ্যোতির্ময় শরীর, তিনি অনন্ত শক্তি, অনন্ত বাহু, অনন্ত বীর্যের অধিকারী। রাজা বললেন : “আচ্ছা বুঝেছি।” এবার তাঁর দ্বিতীয় পুত্রকে বললেন : “ব্রহ্ম কি?” সে পিতার সামনে মাথাটি হেঁট করে দাঁড়িয়ে রইল। পিতা বললেন : “হ্যাঁ, তুমিই ঠিক বুঝেছ।” আর ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বরে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন—তোমাদের রামকৃষ্ণ এতদিনে এইটুকুই বুঝেছেন যে, তিনি কিছুই বোঝেননি।
কেম্পিসের সেই কথা – “ Learned arguments do not make a man holy and righteous, whereas a good life makes him dear to God.’ ঠাকুর বললেন, সত্যই কলির তপস্যা। মন মুখ এক কর। অকপট হও। নিজেকে মেলে দাও। ফেলে রাখ তাঁর কৃপার আলোকে। বৈশাখের রোদে ডোবার জল শুকোলে তলায় কি আছে দেখা যাবে।
জয় ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ!