অক্ষয়বটোপাখ্যানম – তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
পরগণা তিনভুবনপুরের অন্তর্গত ঘাটভুবনপুরের পত্তনীদারনী মহামহিম মহিমার্ণবা শ্রীল শ্রীযুক্তা গয়েশ্বরী ঠাকরুণের পাল্লায় পড়ে ট্রেন অ্যাকসিডেন্টে যে কি নাজেহাল হয়েছিলাম তা আগে বলেছি, এর জের আজও চলছে, মেটেনি৷ ঘাট ভুবনপুরের ঘটনার জের টেনে এসে পড়ল আগয়া নদীর তটভূমিতে সেই বিশাল বটবৃক্ষের ঘটনা৷ অক্ষয় বট-উপাখ্যানম৷ এর জন্য ভূতভুবনপুরের ব্যাপারে যতখানি নাজেহাল হয়েছিলাম আমি না, আমি না, নাজেহাল হয়েছিলেন রামকালীবাবু৷
অবশ্য রামকালীবাবু আমারই ছদ্মনাম৷ ভূত সম্পর্কে গবেষণা করবার আগে ওই নামটা আমি গ্রহণ করেছিলাম৷
যাক গে৷
না, যাবেই বা কেন? ভাগ্যে নামটা নিয়েছিলাম—না হলে ওই রামনামটা ধরে কি লোকেরা অজ্ঞান অচেতন আমার কানের কাছে চিৎকার করে ডাকতেন? আর রামনাম শুনলে কি গয়েশ্বরী ঠাকরুণ তাঁর দামিনী ঝি এবং ঘাটভুবনপুরের সেই ভূতের বাপের শ্রাদ্ধবাসরে সমবেত ভয়ঙ্কর মূর্তি কেঁপে ওঠা এবং ধেই ধেই নৃত্যরত ভূতকুল পিন ফোটানো বেলুনের মতো চুপসে যেত?
এখন জ্ঞান তো ফিরল৷ মানে মানে কলকাতায় ফিরে এলাম৷ এবং ভূতপুরাণটা লিখে ফেললাম৷ তাতে কিন্তু উলটো ফল হল৷ আমি আমার থিসিসে প্রমাণ করতে চাইলাম এক, কিন্তু লোকে বুঝলে অন্য৷
বলতে চাইলাম—ভয়ের মধ্যে ভূতের বাস—
লোকে বুঝলে—ভূত না মানলে সর্বনাশ৷
আমি বলতে চাইলাম—মানুষকে ভূত পারবে না৷
লোকে বুঝলে—ভূত কখনো হারবে না৷ ঘাড়ের দখল ছাড়বে না৷ যাক—একথা আরো অনেক রকম করেই বলা যায়—কিন্তু তার প্রয়োজন নেই৷ তবে ফ্যাসাদে পড়লাম তাতে সন্দেহ নেই কারণ চিঠিপত্রসহযোগে নানান প্রশ্ন আসতে লাগল৷ বিশেষ করে রামাইভূত আর কালীবাবুর বাড়ির সেই প্রেতটির খোঁজ নিয়ে অনেক প্রশ্ন আসতে লাগল৷ একটি ছেলে তো আমাকে লিখলে—রামাইয়ের ঠিকানা দেবেন—আমি তার পেন-ফ্রেন্ড হতে চাই৷ এসব থেকেও নিষ্কৃতি আছে, কিন্তু এটা প্রায় অসহ্য হয়ে উঠল যে মধ্যে মধ্যে কেউ যেন আশপাশে খশখস ফিসফাস করে ওঠে৷ কখনো বা ফিসফিসিনির মধ্যে শুনি—বলি—শুনছ!
বুক ঢিবঢিব করে ওঠে, চোখ পিটপিট করে, সামনে যেন সরষে ফুল ফোটে—মনে মনে বলি—‘‘জয় রাম শিবরাম! সীতারাম হে! ভূতেদের হাত থেকে কর ত্রাণ হে!’’
আশ্চর্য, যে নামে গয়েশ্বরী এবং তাঁর ভূতকুল পিন ফোটানো বেলুনের মতো চুপসে গিছলেন প্রায় এক মুহূর্তে, সে নামেও ফিসফিসিনি এবং এই খশখসানি বন্ধ হয় না! বুঝতে পারি না ব্যাপারটা কি?
যম দত্তকে জিজ্ঞাসা করলাম৷ দত্তমশায় মালদার আমসীর মতো লম্বা শুকনো মুখখানা নিয়ে তিরিক্ষি মেজাজে গোটা মুখের মধ্যে অবশিষ্ট সাড়ে চারখানা দাঁত বের করে বললেন—ওসব গল্প-লিখিয়েদের মাথায় আসবে না৷ মাথায় তো গোবর পোরা আছে৷ বলি ভূত কতপ্রকার সেটা জানা আছে কি?
বললাম—ভূত প্রেত পিশাচ—
দত্ত বললেন—তোমার মাথা৷ ভূত প্রথমত দুই প্রকার—মৌলিক ভূত এবং যৌগিক ভূত৷ সেটা জান?
হাঁ হয়ে গেলাম৷ দত্ত বললেন—মৌলিক ভূত তারাই যাদের ভূত করেই ব্রহ্মা তৈয়ারি করেছিলেন৷ তারা পুরুষানুক্রমে ভূত—যেমন ধর মহাদেবের প্রধান ভূত নন্দী মহারাজ—নন্দী মহারাজের বেটা দণ্ডী কি শৃঙ্গী, তস্য বেটা জঙ্গী, তস্য তস্য বেটা রঙ্গি— এ নামগুলো অবশ্য ঠিক নাও হতে পারে, কিন্তু বেটার বেটা তস্য বেটা তস্য তস্য বেটা তো আছেই৷ অর্থাৎ খাঁটি ভূত৷ মানে কালিকট বন্দরে ভাস্কোডিগামার সঙ্গীসাথী খাঁটি পর্টুগিজের মতো খাঁটি ভূত৷ এদেশের লোককে জোর করে ধর্মান্তরিত করা খ্রিস্টানের মত হল যারা, তারা হল মানুষ মরে ভূত৷ কেউ কিছুর জন্যে মানে অপঘাতে মরার জন্যে ভূত হল—কেউ পিণ্ডি না পেয়ে ভূত হল—কেউ মরার সময় খারাপ লগ্নে মরে ভূত হল৷ তারা হল দুসরা রকমের ভূত৷ তারাই রাম নামে চুপসে যায়৷ অরিজিনাল ভূতেরা হল খোদ শিবের খাস চেলা—তারা এই কালের হিপিদের মতো চব্বিশ ঘণ্টাই সিদ্ধি গাঁজা খেয়ে বোম বোম রাম রাম করে নাচছে—তারা রাম নামে ভয় খাবে সেটা বলে কেডা? হুঁ:—যত সব—!
আমাকে মানতে হল কথাটা৷ হ্যাঁ, কথাটা তো ঠিক৷ এটা তো আমার বোঝা উচিত ছিল৷ ভূত দুই প্রকার—ভূতের বেটা ভূত, আর মানুষ মরে ভূত৷ ভূতের বেটা ভূত হয়, তাদের মরণ নাই৷ মানুষ মরে ভূত হয়, তারাই—আবার ভূত মরে মানুষ হয়৷
দত্ত বললেন—আরো আছে হে বাপু৷ মানুষ মরা ভূতগুলো শুধুই ভূত, তার বেশি বিশেষ কিছু না ওই ধর—বামুন মরে ব্রহ্মদৈত্যি, কায়েত মরে যমরাজার আদালতে কেরানী, গলায় দড়ি দিয়ে মরে ‘গলায় দড়ে’, আগুনে পুড়ে মরলে চামড়া-ওঠা ছালছাড়ানো ও ওলের মতন রং যথা ভূত, তারপর ধর—জলে ডুবে মরা মানুষ—মেয়ে হলে শাঁকচুন্নী, পুরুষ হলে ‘বিলচর’ কি ‘খালচর’ ভূত৷ অনেক আছে৷ এরাই রাম নামকে ভয় করে৷ আর আসল ভূতেরা হল শিবের সেপাই—নন্দীর সন্তান—ওরা দেবতাদের মতোই—সেই কারণে ওদের আর এক নাম হল ‘অপদেবতা’৷
বটে ত! ঠিক বলেছে দত্ত৷ অপদেবতাই তো বটে৷ শিব পঞ্চমুখে রামনাম গান করেন ডমরু বাজান নন্দী মধ্যে মধ্যে শিঙাতে ফুঁ দেয়৷ আর অপদেবতা ভূতেরা—ভূত পত্নীরা বা অপদেবীরা ধুতরা গুলতে এবং কল্কে ফুলের মালা পরে, পায়ে মরার হাড়ের নূপুর পরে তা থৈ থৈ তা থৈ থৈ—থিয়া থিয়া করে নাচে৷ তারা রাম নাম শুনে ভয় করবে কেন?
তা হলে? একটু ভেবে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম—তাহলে তুমি বলছ যারা খশখস করে নড়েচড়ে বা অদৃশ্য থেকে ফিসফিস করে সাড়া দিচ্ছে তারা মানুষ মরে ভূত নয়?
না—৷ বলছি যারা রাম নাম শুনেও মরছে না—তারা মানুষ মরা ভূত নয়, খাঁটি তুর্কীর মতো খান-খানান, কিংবা খাঁটি হারমাদ কি ইংরেজ কি ফরাসি টরাসিদের লর্ড কাউন্ট কি মিস্টার মশিয়েদের মতো খাঁটি ভূতের বেটা ভূত কি অপদেবতা, কি উপদেবতাও হতে পারে৷
কথাগুলি যম দত্ত কট-কট করে কামড়ে-কামড়ে বলার মতো বললে৷ তবে তাতে ফোকলা দাঁত বুড়োর কামড়ের মতো খুব কষ্ট বা যন্ত্রণাদায়ক মনে হল না৷ তার উপর বুড়ো আমাকে ভালোবাসে৷ বললে—দেখ না ইশারা-টিশারা দিয়ে—যদি কিছু নতুন তত্ত্ব কি তথ্য মেলে, তা হলে আমেরিকা রাশিয়াকেও হারিয়ে দিতে পারবে৷ ওরা চাঁদে ল্যান্ড করে যা জানবে—তা থেকে অনেক বেশি জানা যাবে৷ মানে মানুষ মরে যেখানে যায় সেখানকার খবর পেয়ে যাবে৷
কথাটা বুড়ো মন্দ বলেননি মনে লাগল৷ রাশিয়া আমেরিকা চাঁদে নেমে ফিরে আসবে৷ আমি ঘাটভুবনপুরে বৈতরণীর ঘাটের এলাকা পর্যন্ত গিয়ে তো ফিরে এসেছি৷ আমারই বেকুবি, আমি কিছু নিদর্শন আনতে পারিনি৷ এক আধটা ভূতের নখ কি পেতনীর চুল কি মূলোর মতো দাঁতের একটা দাঁত কিংবা খেয়াঘাটের মাটি, এসবের কিছুই আনতে পারিনি৷ পারলে তো বাজিমাৎ হয়ে যেত, তা যখন আনা হয়নি তখন তো প্রমাণ করতে কিছু পারছি না৷ তবে দেখছি গ্রহগ্রহান্তরে—রেডিও সিগন্যালের মতো ওদের কাছ থেকে ইশারার যেন সিগন্যাল পাচ্ছি৷ সেই ইশারায় সাড়া দিয়ে দেখাই যাক না৷ যম দত্ত উপদেশ দিলে—প্রথমেই কিন্তু ‘রামনাম সত্য হ্যায়’ বুঝেছ! তাহলে আর ট্যাঁস ফিরিঙ্গি কি কালো দেশী তুর্কীর মতো মানুষ মরা ভূত আসবে না৷ মানুষ মরা ভূত হলে চামচিকে হয়ে ফুড়ুৎ হয়ে যাবে আর খানদানী মৌলিক ভূত হলে বলবে—নাচব নাকি? যেমন নাচি শিবের সঙ্গে?
ফলটা হাতে-হাতেই ফলল৷
আশেপাশে যখন তখন ফিসফিসিনি খশখসানি কমে গেল৷ তবে মধ্যে মধ্যে দু’চারখানা দীর্ঘনিশ্বাস কি মিহি নাকিসুরে করুণ খুনখুনুনি আওয়াজ পেতে লাগলাম৷ যার অর্থ হল—হায়রে হায় বা তুমি মানুষটা বড় খটরোগা৷ বেরসিক লোক৷
ওতে আমি কিন্তু এতটুকু সংকোচবোধ করলাম না৷
‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’, ‘রামনাম সত্য হ্যায়’! মানুষ মরা ভূতের পরওয়া হম নেহি করতা হ্যায়! আওয়াজ ছাড়লেই সব একেবারে নিস্তব্ধ৷ বুঝতে পারি—শূন্যলোকে অদৃশ্য চামচিকে বা ফড়িংয়ের মতো ভূতের দল উধাও হয়ে গেল৷
হঠাৎ সেদিন৷ এই তো ১৯৭৬ সালের ৪ঠা বৈশাখ৷
ওই যে ঝড়ের দিন৷ পেল্লায় ঝড় হয়ে গেল৷ গোটা বাংলা দেশই প্রায় তছনছ হল সেদিন৷ বেলা তিনটে থেকে ঝড়ের শুরু হল—দমকায় দমকায় তিনবারে প্রায় ঘণ্টা চারেক ঝড় আর জল৷ পশ্চিম আকাশ অন্ধকার করে সে ভীষণ কালো পালবন্দী বুনো মহিষের দলের মতো মেঘ যেন তেড়েফুঁড়ে খুরের দাপটে, শিঙের খোঁচায় গাছপালা টেলিগ্রাফের পোস্ট উপড়ে দিয়ে (বোধ করি সমূলে উৎপাটিত করে বলাই ভালো) ঘরের চাল উড়িয়ে দিয়ে উলটে ফেলে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলে গেল৷ আমি তার আগের দিন রাত্রি থেকে ট্রেনে আসছিলাম৷ ৩রা রাত্রে পাটনা থেকে রওনা হয়ে দেড়টা দুপুরে নেমেছিলাম আমাদের বাড়ির ইস্টিশান—আমদপুরে সেখান থেকে একটা মোটরে লাভপুর গিয়ে মাকে প্রণাম করে সঙ্গে সঙ্গেই বেরিয়ে এলাম—তখন বেলা দুটো৷ গাড়িতে চড়ে মনে হল পশ্চিম আকাশের একেবারে দিগন্তে—প্রথম বুনো মোষের পালটা যেন বন থেকে মুখ বের করে তৈরি হচ্ছে ওদের দলপতি একটা হাঁক দিয়ে ছুটতে শুরু করলেই দড়বড় দড়বড়—গাঁ-গাঁ শব্দ তুলে গোটা পালটাই দৌড়ুতে আরম্ভ করবে৷ ভয় হল কিছুটা, কিন্তু হলে কি হবে আমারও একটা কেমন গোঁ আছে, সেই গোঁয়ের বশে মেঘ গ্রাহ্য না করেই বললাম— চলো, ছেড়ে দাও গাড়ি৷
মোটরে সাত মাইল পথ? পথ এখন নতুন কালের পিচঢালা পথ৷ কতক্ষণ লাগবে? বড় জোর বিশ মিনিট৷ ইতিমধ্যে মনে হল মোষের দলটা যেন দিগন্তের ওপাশে মুখ সরিয়ে নিয়ে—বোধহয় মতলব বদলালে৷ দৌড়টা আজ মুলতুবি রাখলে৷ শুধু তাদের নিশ্বাসে ওড়া খানিকটা লাল ধুলো উড়ল—কিছুক্ষণ বৃষ্টি হল আমরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম৷ কিন্তু হরি হরি! হরির মতলব বোঝা ভার৷ তিনি মারতেও আছেন রাখতেও আছেন৷ সবেতেই বোধ করি সমান খুশি৷ আমদপুর স্টেশনে এসে পৌঁছলাম যখন তখন পশ্চিমাকাশে কালো স্লেটের মতো রঙের পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ দক্ষিণে বোলপুর, উত্তরে সাঁইথিয়া পর্যন্ত আকাশ জুড়ে সোজা পুবমুখে এগিয়ে চলেছে৷ উপমা ওই পালবন্দী বুনো মোষ বা বাইসনের সঙ্গে৷ শিং নীচু করে লেজ পিঠে ফেলে পরস্পরের গায়ে গায়ে ঠাসাঠাসি লেগে গর্জন করতে করতে ছুটেছে৷
এরই মধ্যে বিদ্যুৎ চমকালো একটা তীব্র আলো ঝলসানির সঙ্গে সঙ্গে মেঘ গর্জালে৷ যেন মোষেরা শিঙে শিঙে ঢুঁ মারলে—তাতেই উঠল আগুন এবং আওয়াজ৷ তার সঙ্গে কয়েক মিনিটের মধ্যে এল বৃষ্টি৷ সামনেই প্ল্যাটফর্মের ওপাশে পয়েন্টসম্যান প্রভৃতিদের কোয়ার্টারের ওধারে অনেককালের একটা বাগান৷ বাগানটার গাছগুলোও অনেকদিনের৷ যেন মাথায় বাঁশের বাড়ি খেয়ে বড় গাছগুলো একেবারে বাপ বলে শুয়ে পড়ল৷ স্টেশনের ওয়েটিং রুমের খোলা জানলা একখানা উড়ে চলে গেল৷ কোথা থেকে ঝড়ে উড়ে এসে প্ল্যাটফর্মের উপর সশব্দে আছাড় খেয়ে পড়ল একখানা আস্ত টিন বা করোগেটেড শিট৷ স্টেশন ওয়েটিং রুমে ইলেকট্রিক আলো জ্বলছিল, পাখা চলছিল, ফুস করে আলো নিভে গেল৷ পাখা চলার শব্দ থামল এবং ঘোরার বেগ মন্থর হল—বোঝা গেল ইলেকট্রিক গেছে৷ ওয়েটিং রুমটার মধ্যে একঘর লোক ঠাসাঠাসি হয়ে বসে রইলাম৷ বাইরে খোলা প্ল্যাটফর্ম ফাঁকা, সেখানে মোটামোটা ফোঁটায় ঘন ধারায় বর্ষণ চলছে৷ দেখতে দেখতে প্ল্যাটফর্মের রাঙা কাঁকর ফেলা জায়গায় জল জমে জল বইতে লাগল৷ আমরা বোবা হয়ে বসে রইলাম৷ এর মধ্যে সৌভাগ্য বা সুরাহা হল এই যে, ঝড় বৃষ্টির ফলে গুমোট গরমের অসহনীয়তা আর রইল না৷ একঘর লোক, তা প্রায় জন তিরিশেক—সবাই বোবা হয়ে নিষ্পলক দৃষ্টিতে প্ল্যাটফর্মের ওপর জমা জলের উপর বৃষ্টি ধারাপাতের একঘেয়ে দৃশ্য দেখছে এবং শব্দ শুনছে৷ জলঝড় যখন হয় তখন মানুষকে অভিভূত করা একটা আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়৷ মানুষ অবাক হয়ে দেখে, বিমূঢ় হয়ে শোনে৷ দেখে বৃষ্টি পড়া আর শোনে ঝড়ের গোঙানি৷
এরই মধ্যে ঝড়টা কিছু কমল৷ আকাশ ফরসাও কিছুটা হল৷ ঝড় অবশ্য বইছিল৷ আকাশের কালো মেঘ সেই ঝড়ের বেগে পুবদিকে চলে গেল৷ ওদিকে আপ দার্জিলিং মেলের ঘণ্টা পড়ল৷ স্টেশনে খবর নিলাম, কলকাতার ট্রেনের কত দেরি? খবর পেলাম না৷ মাস্টার বললেন—টেলিফোনে সাড়া পাচ্ছি না বোধ হয় টেলিফোন লাইনে গোলমাল হয়ে থাকবে৷ দাঁড়ান একটু, মেলটা পার হয়ে যাক৷
মনে অস্বস্তি বোধ করছিলাম৷
ঘরে বসতে গিয়ে বসলাম না প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আপ লাইনের সিগন্যালের দিকে চেয়ে রইলাম৷ এরই মধ্যে একসময় মনে হল আবার অন্ধকার ঘনালো৷ উপরে আকাশের দিকে তাকালাম, দেখলাম—আকাশে যেন কালো ছায়া পড়েছে৷ মেঘের ছায়া৷ পশ্চিমে আবার ঘন কালো মেঘ উঠেছে৷ তার চেহারা এমন ভয়াল এবং ভীম যে মনে হল এবার স্বয়ং মহিষাসুর বোধ করি গদা হাতে তার বাছা বাছা সৈন্য-সেনাপতির ঠাসা দল নিয়ে বেরিয়েছে৷
এরই মধ্যে এল দার্জিলিং মেল৷ এল, ছেড়ে গেল৷ মেলখানা ডিস্ট্যান্ট সিগন্যাল পার হল—আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম৷ এক সময় কে যেন বললে—ঘরের ভিতর যান৷
কে বললে? কাউকে দেখলাম না৷ তবে ঝড় এবং জল আবার দ্বিগুণ বেগে নিশ্চিত আসছে বুঝে ওয়েটিং রুমে এসে ঢুকলাম৷ ঘরে তখন অন্ধকার বেশ ঘন হয়েছে৷ গুমোটও বেশ ঘন হয়েছে দেখলাম৷ আর একজন এসে ঘরে ঢুকে বললে—কলকাতার ট্রেনের খবর মিলল না৷ টেলিফোন টেলিগ্রাফ গন!
—গন মানে?
—গো, ওয়েন্ট, গন৷ তার ছিঁড়ে গিয়েছে৷ পোস্ট ধরাশায়ী হয়েছে৷ অথবা যন্ত্র কোনোপ্রকারে অচল হয়েছে৷
—তা হলে?
কে বললে—ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার৷ চুপচাপ বসে থাকুন অভিসারের প্রতীক্ষায়—
আকস্মিক প্রচণ্ড গর্জনে সব থরথর করে কেঁপে উঠল৷ চোখ তার আগেই ধেঁধে গেছে৷ রসিকতা করার সব শক্তি মন যেন মাথায় লাঠি খেয়ে অচেতন হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হল৷
ঝমঝম শব্দে বৃষ্টি হতে শুরু হল—তার সঙ্গে সে এক মাটি থেকে আকাশ পর্যন্ত দীর্ঘকায় জটাধারী পাগলের মাথা নেড়ে নেড়ে তাণ্ডব নৃত্য শুরু হয়ে গেল৷
ঘরের ভিতরটা তখন থমথমে অন্ধকারে ভরে গেছে৷ মধ্যে মধ্যে দু’একজন এক আধ বারের জন্য হাতের টর্চ জ্বেলেই আবার নিভিয়ে দিচ্ছেন৷ কথাবার্তা নেই৷ কেউ কারুর মুখ দেখতে পাচ্ছে না, কথা কইবেই বা কি করে৷ শুধু খেয়ালী মানুষের পাথর বা কাঁকর ছুঁড়ে ঘুমন্ত কুকুরটাকে সজাগ করবার মতো কথা ছুঁড়ছেন৷ কেউ ডাকছেন—বাচ্ছু! বাচ্ছু কোথায় রে?…উত্তর আসে না৷ তার বদলে ওদিক থেকে কেউ আপসোসের সুরে বলেন—
—ওঃ, গাছের পাকা বেলগুলোন আর একটা গাছে থাকবে না, সব পড়ে যাবে৷ রমন্দ বললে পেড়ে নাও৷ তা নিলাম না৷ আঃ, আর একটা পাব না! খাসা বেল৷ মড়ার মাথার মতো৷ আঁ! কজন হাসলে৷ আবার কেউ বললে, মনটা চাঁহা চাঁহা করছে রে! কিন্তু যাই বা কি করে স্টলে? এনেই বা দেবে কে? কেউ বললে—খিদে পেয়েছে৷ আমি এরই মধ্যে শুনছিলাম—কেউ যেন খুনখুন শব্দে কাঁদছে৷ চাপা কান্না৷ মধ্যে মধ্যে দীর্ঘনিশ্বাস৷ মধ্যে মধ্যে দমকা ঝড় এসে ঢুকছিল৷ হঠাৎ কেউ ঘরে ঢুকে বললে—বাস, সব খতম রে বাবা! হয়ে গেল!
একসঙ্গে কয়েকজনই প্রশ্ন করে উঠল—মানে?
—সারারাত এখন থাকুন বসে!
—কেন? কেন বসে থাকব?
—ট্রেন আসবে না৷—
—আসবে না?
—না৷ ঝড়ে গাছ উলটে লাইনের ওপর পড়েছে৷ সাঁইতের আগে৷ দার্জিলিং মেল বাতাসপুরে খোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ কোপাইয়ের কাছে গাছ পড়েছে, সেখানে আটকেছে দানাপুর প্যাসেঞ্জার৷ তার পিছনে বোলপুরে দাঁড়িয়ে গেছে রামপুরহাট প্যাসেঞ্জার৷ সারা জেলার ইলেকট্রিক বুত গিয়া৷ বাস৷ তখনো প্রবল বেগে বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে এবং ঝড় চলছে৷ এরই মধ্যে মনে হল পিছনের দিকে বাথরুমের দরজাটি খুলে গেল এবং কেউ যেন খুন-খুন-খুন-খুন করে করুণ সুরে বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে বেরিয়ে গেল৷
‘‘বুঁনি! বুঁনি! শেঁষে গাঁছ চাঁপা পড়ে অপঁঘাতে মরলি বুঁনি! ওরে আমার বুঁনিরে! কতবার বঁলেছি—বঁনে থাকিস নে৷ হাঁয় হাঁয়, ঝঁড়ের সময় তো চলে এলে পারতিস!
অস্পষ্ট ফিসফিসানি নাকিসুরে কথা কটি ঘরের বাইরে প্ল্যাটফর্মের ঝড়বৃষ্টির মধ্যে মিলিয়ে গেল৷
আমি চমকে উঠলাম৷ ‘‘বুনি! কতবার বলেছি বনে থাকিস নে!’’ কথা যে বললে সে বাথরুমের কোণ থেকে বেরিয়ে এল৷ তা হলে ও কি কুনি? রাম রাম রাম! কিন্তু তবুও কুনির যেন খশখসানি ফিসফিসানি শুনতে পাচ্ছিলাম৷
মনে পড়ে গেল মা বলেছিলেন ‘‘কুনি বুনি’’ দুই বোন ভূতনীর কথা৷ ‘কুনি’ থাকে ঘরের কোণে—‘বুনি’ থাকে বনে৷ একদিন এক বামুন গেছিল বনের মধ্যে৷ কি যেন জড়িবুটি খুঁজতে গিছল৷ সেখানে বামুন মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে শুনতে পেলে কেউ যেন বলছে—‘কুনিকে বলো গিয়ে বুনির ছেলে হয়েছে৷’ বামুন প্রথমটা কেয়ার করে নি, পরে বার বার ওই কথাগুলো শুনে কেয়ার না করে পারলে না৷ শুনলে কিন্তু বুঝতে কিছু পারলে না৷ যাই হোক, বাড়ি ফিরে এসে হাত পা ধুয়ে ধর একটু চা খেতে খেতে বললে—‘বামনী, আজ বনে আশ্চর্য কাণ্ড ঘটেছে!’
বামনী বললে—আশ্চর্য কাণ্ড? কি রকম আশ্চর্য কাণ্ড? তারপর বললে—তোমার তো সবই আশ্চর্য কাণ্ড! যতসব—হুঁ:!
বামুন বললে—শোন তবে৷ বলে বললে—বনের মধ্যে বুঝলি কিনা—আমি মাটি খুঁড়ছি আর কে যেন কোথা থেকে বললে—কুনিকে বলো গিয়ে বুনির ছেলে হয়েছে!
আমি প্রথমটা কেয়ার করিনি৷ কিন্তু সে নাগাড়ে বলে চলল—মেয়েছেলের গলা, তাও একটু একটু খোনা খোনা, ওই এক নাগাড়ে বলে গেল—কুঁনিকে বঁলো গিঁয়ে বুঁনির ছেঁলে হয়েছে৷ কুঁনিকে বঁলো গিঁয়ে বুঁনির ছেঁলে হয়েছে—ও বাঁমুন, কুঁনিকে বঁলো গিঁয়ে বুঁনির ছেলে হয়েছে৷
আমার শেষটা কেমন গা ছমছম করে উঠল আমি ছুটে পালিয়ে এলাম৷
বামনী বললে—খুব বীরপুরুষ আমার৷ ভালো করে দেখলে না একবার খুঁজে পেতে? কোনো বদমাশ মেয়েছেলে তোমার সঙ্গে মস্করা করেছে৷ ভয় দেখিয়েছে৷ খুব ছুটেছ তো?
বলতে বলতে কথা বলা আর শেষ হল না, বামনীর মুখের কথা মুখে থাকল চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল—বামুন আতঙ্কে আঁ আঁ করে উঠল৷ কারণ ঘরের মধ্যে থেকে—অর্থাৎ ঘরের কোণ থেকে এই এক কালো ধিঙ্গী মেয়ে, এই ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল, এই ভাঁটার মতো চোখ, পেঁচার মতো নাক, মুলোর মতো দাঁত, কুলোর মতো কান ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে বেরিয়ে এল৷ আর মুখে সে বেশ সুর করেই বলছিল—কঁয় দিবঁসে? কঁয় দিবঁসে? কঁদিঁন হঁলো, কঁদিঁন হঁলো?
বলতে বলতে এবং নাচতে নাচতে সে বেরিয়ে চলে গেল বনের দিকে৷
এরা কি সেই কুনি এবং সেই বুনি?
মনে তো তাই হচ্ছে৷ বললে—ঝড়ের সময় তো পালিয়ে এলে পারতিস! সেই বুনি এবং সেই কুনি না হলেও তাদেরই সন্তান-সন্ততি কেউ হবে৷ এরা তো মানুষ মরা ভূত নয়, এরা হল আদিকালের মৌলিক ভূত—কোণের অন্ধকারের ভূত কুনি—বনের অন্ধকারের ভূত বুনি৷ এরা মৌলিক ভূত—এদের বংশানুক্রম আছে, এরা বিয়ে করে, এদের ছেলেপিলে হয়৷ এরা রামনামে গয়েশ্বরী বা মানুষ মরা ভূতদের মতো পিন ফোটানো বেলুনের মতো চুপসে মরা চামচিকের মতো হয়ে যায় না৷
আমি তখনো শুনছিলাম—কুনি কাঁদতে কাঁদতে ঝড়ের মধ্যে চলেছে৷ একটা দীর্ঘনিশ্বাস পড়ল৷ না ফেলে পারলাম না৷
ঝড় থামল কিন্তু সমস্ত অঞ্চলটা অন্ধকার৷ ইলেকট্রিক লাইন হয়েছে, বড় বড় গ্রামে ঘরে ঘরে ইলেকট্রিক জ্বলে, স্টেশনে ইলেকট্রিক জ্বলে৷ সব অন্ধকার৷ কেবল টর্চ মধ্যে মধ্যে জ্বলছে এবং নিভছে৷ তাতে যেন অন্ধকার আরো ঘন হচ্ছে৷ এরই মধ্যে মানুষ আটকে আছে স্টেশনে৷ রেললাইনে গাছ উলটে পড়ে ট্রেন চলাচল বন্ধ৷ বাস নেই৷ রাস্তার উপর গাছ পড়েছে৷ দোকানে খাবার নেই৷ অন্ধকারের মধ্যে টর্চের ইশারা আর হাঁক৷—
ও হে—!
ও—!
এরই মধ্যে একটা আশ্রয় পেয়েছিলাম৷ ছোট লাইনের মাস্টার একটি ঘরে একটি বিছানা-পাতা খাটে আশ্রয় দিয়ে বলেছিলেন—কি করবেন? উপায় তো নেই—এইখানে শুয়ে রাতটা কাটিয়ে দিন!
সামান্য খাদ্যও মিলেছিল৷ ক্লান্ত হয়েই ছিলাম—শুয়ে পড়ে ঘুমিয়েই গিয়েছিলাম৷ আলো ছিল না, পাখা ছিল না৷ না থাক, মেঘ কেটে চাঁদ উঠেছে—ঝড় থেমেছে—একটু একটু শীত-ধরা-ধরা হাওয়া দিচ্ছে রাত্রি গভীর বলে মনে হল৷ ঘরে একটা হ্যারিকেন জ্বেলে দিয়েছিলেন মাস্টার, সেটা নিভে গিয়েছে৷ একটা খোলা জানালা দিয়ে দুধের মতো সাদা জ্যোৎস্না এসে মেঝের উপর স্থির হয়ে পড়ে আছে৷ শান্ত পৃথিবী৷ এই ঘণ্টা কয় আগে যে এত বড় প্রলয়ের মতো ঝড় হয়ে গেছে সে কথা কে বলবে! আমদপুর স্টেশনের সাইডিং লাইনে কোনো একটা এঞ্জিনের স্টিমের একটানা সোঁ সোঁ শব্দ বেজে চলেছিল৷ তার সঙ্গে আরো কিছু৷ অর্থাৎ আরো শব্দ ছিল৷ এঞ্জিনের হুইসিল দিয়ে স্টিম বের হচ্ছে, বোধ হয় যার জন্য একটা টানা কোঁ বা পোঁ শব্দ মিলে রয়েছে৷ এবং আরো শব্দ রয়েছে৷
হ্যাঁ, তার সঙ্গে আরো কিছু আছে৷ কানটাকে যথাসাধ্য খাড়া করলাম—অর্থাৎ সজাগ বা সতর্ক৷ বুঝতে পারছি না৷ একটা পেঁচা ডেকে গেল৷ দুটো কুকুর যেন কাঁদছে৷ অনেক দূরে যেন অনেক লোকের সাড়া৷
হ্যাঁ, অনেক লোকের সাড়া৷ এই অনেক কিছুটা যেন অনেক লোকের সাড়া৷ যেন অনেক দূরে অনেক লোকে একসঙ্গে হয়তো বা জটলা করছে নয়তো গানটান করছে৷ যেমন ধর্মরাজ পুজোয় কি গাজনে ভক্তেরা মিলে বোলান গান করে৷ মনে পড়ল ছেলেবেলায় মনসার ভাসান গান শুনতাম—তাতে বেহুলা কলার মান্দাসে লখিন্দরের দেহ নিয়ে নদীতে ভেসে যেত তাই বর্ণনা পরে পাঁচ-ছ’জন গায়কে গান গাইত—
‘‘জলে ভেসে যায় রে—সো-নার কমলা—৷’’
আর দলসুদ্ধ সুরে ধুয়ো গেয়ে উঠত—‘‘অ—গ—অ৷’’
কলার মান্দাসখানি নদীসে উচ্ছলা
মান্দাস উলটি দিতে হাসে খলখলা—
—অ—গ—অ! জলে ভেসে যায় রে—এঃ!
এতে একটা হ্যাঁক দিয়ে খপ করে থেমে যেত!
পাশের বিছানায় ভাইপো বাসু ঘুমুচ্ছে৷ অঘোরে ঘুমুচ্ছে৷ নাক ডাকাচ্ছে৷ জলঝড় এবং সর্বনাশের মাতন থেমে গিয়ে এখন জমিয়ে ঘুম দেবার (বাসুরা বলে—‘পিটোবার’) বাত অর্থাৎ আবহাওয়া হয়েছে৷ আমিও চোখ বুজতে চেষ্টা করলাম কিন্তু কিছুতেই ঘুম এল না৷ জানালা দিয়ে ওই অনেক দূরের বোলান গানের মতো বহু লোকের সমবেত কণ্ঠের একটা কিছু আমাকেই ডাকছে বলে মনে হল৷ ওরা ডাকুক বা না-ডাকুক, আমার মনে হল আমাকেই ডাকছে বা এ-ডাক কিসের সেটা জানা উচিত৷ অবশ্য অবশ্য উচিত৷
আস্তে আস্তে জানালার ধারে এসে দাঁড়ালাম৷ জানালার বাইরে পৃথিবীকে আশ্চর্য সুন্দর বলে মনে হল৷ ধবধবে জ্যোৎস্নায় ভিজে ভিজে বৈশাখ মাসের ফসলহীন মাঠটিকে আশ্চর্য সুন্দর নরম মনে হচ্ছে—ঠিক যেন সদ্য স্নান করা, থান কাপড় পরা, পূজাবাড়িতে গিন্নীবান্নীর মতো লাগছে৷ মাথার উপরে আবহমণ্ডলের বায়ুস্তর, তার উপরে আকাশ একেবারে ধোয়া মোছা হয়ে তকতক করছে৷ নীল নির্মল আকাশে আধখানা চাঁদ ঝলমল করছে৷
দেখা যাচ্ছে একবারে সেই দূরদিগন্ত পর্যন্ত৷ দক্ষিণ দিকে পশ্চিম দিকে আমদপুরের বসতি আজকাল অনেক বড় বড় হালফ্যাসানের পাকা বাড়ি তৈরি হয়েছে৷ সেগুলো জ্যোৎস্নার মধ্যে নিঝুম হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ ওই দিক থেকেই আসছে সাইডিং লাইনে এঞ্জিনটার স্টিম এবং চাপা হুইসিলের শব্দ৷ কিন্তু ওই অনেক মানুষের সাড়ার মতো শব্দটা তো এদিক থেকে আসছে বলে মনে হচ্ছে না৷ উত্তর এবং পূর্ব দিক একেবারে খোলা মাঠ৷ উত্তর দিকটায় অনেক দূরে গ্রাম৷ পূবে খানিকটা খোলা প্রান্তরের পর ‘আগয়া’ নদীর ধারে জঙ্গল এবং রেলের ব্রিজ৷ ওদিকে তো জনমানবের সঙ্গে এই রাতে একসঙ্গে এত মানুষের সাড়া আসার কথা নয়৷
এককালে ডাকাতেরা জমায়েত হত আগয়ার ধারের জঙ্গলে৷ তারও আগে লোকে বলে আগয়ার বটতলায় নাকি ধর্মরাজের সভা বসত৷
বটগাছটার নাকি পাঁচশো বছর বয়স৷ কেউ কেউ বলে তারও বেশি৷ আবার অনেকে বলে—না-না—শ’ খানেক—মানে একশো বছরের হবে৷
তা যত শো বছরেরই হোক, বটগাছটা বিরাট৷ মূল কাণ্ডটা তো আর নাই-ই৷ কোন কালে সেটা নষ্ট হয়ে গেছে—এখন গাছটার কাণ্ড যেটা সেটা নামান৷ ছেলেবেলায় দেখেছি দিনে দুপুরবেলাতেও অন্ধকার থমথম করত গাছতলায়৷ এবং লোকে বলত—গাছতলায় বড় বড় সাপ আছে, পোকামাকড়ের তো অন্ত নেই৷ সারাটা গাছের ডালপালা ধরে ঝুলত—শ-দুশো বাদুড়৷ সন্ধে হলেই তারা আকাশে উড়ত৷ আর গাছের ডালে ডালে নৃত্য শুরু হত তাঁদের৷ মানে ভূতদের৷ আমি জানি না এঁরা কোন ভূত? অর্থাৎ ভেজালহীন আসল, মানে খাঁটি জাত ভূত? না মানুষ মরা ভূত? কেউ কেউ বলত ওই বাদুড়গুলোই ভূত৷ ভূতটুত নাচে না, রাত্রে বাদুড়গুলো ওড়ে চেঁচায় আর খেয়োখেয়ি করে৷
আবার এই গাছটাই ছিল অরণ্যষষ্ঠীর ষষ্ঠীবুড়ির আস্তানা৷ জষ্ঠি মাসে দু’চারখানা গ্রামের মেয়েরা গয়না কাপড় পরে ছেলেদের সঙ্গে নিয়ে ষষ্ঠীবুড়ির পুজো দিয়ে যেত, গাছটার গুঁড়িতে হলুদ সিঁদুর লেপে দিয়ে তালশাঁস আম কাঁকুড় খেজুর জাম ছোলাভিজে ও মিষ্টির ভোগ দিয়ে গাছকে গামছা পরিয়ে বাড়ি ফিরে যেত৷ গাছটা এখন মর-মর হয়ে এসেছে৷ সেখান বা ওদিক থেকে এ আওয়াজ কি করে আসবে!
হঠাৎ জানালার বাইরে মাঠের উপর যেন অকস্মাৎ একটি লোককে দেখা গেল৷ একটি মেয়ে লোক৷ বেশ একটি মিষ্টি চেহারার মা, চোখে কাজল, গৌরবর্ণ রঙের উপরেও হলুদ হলুদ আভা—হাতে শাঁখা, বেশ ঝলমলে করে কাপড়-পরা চমৎকার মেয়ে৷ তার পিছনে মুহূর্তে যেন আর একজন মাটি ফুঁড়ে উঠে দাঁড়াল৷ লোকটির ন্যাড়ামাথা, গলায় গুলঞ্চ ফুলের মালা—পরনে থান কাপড়, চেহারাটা ভালো নয় কিন্তু খারাপ লোক বলে মনে হল না৷
আমাকে ইশারা করে ডাকলে৷ হাত নেড়ে নেড়ে ইশারা৷ আমি তাদের দিকে তাকিয়েই ছিলাম—হঠাৎ যেন অনেকটা অভিভূত হয়ে গেলাম৷ ভালো করছি কি মন্দ করছি—এ বিচারের কথা যেন ভুলে গেলাম৷ এবং একটা অজ্ঞাত আকর্ষণে আকৃষ্ট হয়ে—দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়ালাম৷ বাইরে এসে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পেলাম সেই অনেক লোকের কলরব যেন মুহূর্তে স্পষ্টতর হয়ে উঠল৷ এবং সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারলাম যে এই কলরব—এ গাইয়ে হোক আর মন্ত্রপাঠই হোক আর কোনো বিচিত্র আলোচনা-বাসরই হোক—এটা ওই পূর্বদিক থেকেই আসছে৷ অর্থাৎ আগয়ার জঙ্গলের দিক থেকে!
সেই দিকে তাকালাম৷ ওদিকে মেয়েটি এবং লোকটি এগিয়ে এসে বললে—নমস্কার৷
আমিও প্রতিনমস্কার করলাম৷
লোকটি বললে—আসুন!
সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটি বললে—আমাদের সঙ্গে৷ বলে তারা চলতে লাগল৷ আশ্চর্য, আমিও চলতে লাগলাম৷ চলছিই চলছিই৷ হঠাৎ মেয়েটি বললে—কোনো ভয় নেই আপনার৷
লোকটি বললে—খুবই দুঃখিত আমরা—এই এত রাত্রে আপনাকে কষ্ট দিলাম৷
মেয়েটি বললে—কি করব বলুন! দুর্ঘটনার উপর তো হাত নেই!
লোকটি বললে—আপনি খুব ভাগ্যবান, বুঝেছেন! তা নইলে—
মেয়েটি ধমক দিয়ে বলল—চুপ কর৷ কোনো বুদ্ধি নেই তোমার৷
লোকটি বললে—কেন?
—কেন? ভয় পেয়ে যান যদি?
এবার আমি জিজ্ঞাসা করলাম—ভয় পাব কেন?
—ভয় তো পায় লোকে৷ অনেক কারণে পায়৷
এবার আমার চমক ভাঙল৷ মনে পড়ে গেল গয়েশ্বরী দেবীর এজেন্টের কথা৷ সেই নায়েব গোমস্তা জাতীয় জীবটি যে হ্যা-হ্যা করে হাসত৷ এঁরা আবার তাদেরই কেউ নাকি? আমার উপর এঁদের নেকনজরের কথা তো জানি৷ বলেছি ভূত ঝুট হ্যায়! ভয়ের মধ্যে ভূতের বাসা ভাই—নইলে ভূতের কোনো পাত্তা নাই! তা এরা দুজনেও তাই নাকি?
মনে পড়ে গেল দশরথ রাজার বড় ছেলের নাম৷ মনে মনে বললাম—রামরামরাম জয় রাম জয় রাম! ভূত আমার পুত—পেত্নী আমার ঝি—রাম লক্ষ্মণ বুকে আমার করবে ওরা কি?
আমি মনে মনে বললাম, ওরা কিন্তু দুজনেই খিলখিল করে হেসে উঠল৷ মেয়েটি হাসলে খিলখিল শব্দে, লোকটার হাসি খ্যা-খ্যা বা খ্যাক-খ্যাক করে৷ আমি চমকালাম এবং প্রায় নিশ্চিত করে বুঝলাম যে, এঁরা মানুষ মরা তাঁরা নন৷ এঁরা হলেন জাত তাঁরা৷ নন্দী মহারাজার সইয়ের বউয়ের বকুল ফুলের বোনপো বউ এবং কাকার শালার মামার মেসোর পিসের জাতভাই৷ ভয় এসে গেল—বাতাস দিলে পাতা যেমন দোলে ঠিক তেমনিভাবে ওদের হাসির হাওয়ায় আমার মনের পাতা ভয়ের দোলায় দুলল একটু৷ তবু আমি সাহস সঞ্চয় করে বলতে গেলাম—হাসছ কেন তোমরা এমন করে?
আমি কিছু বলবার আগেই লোকটি বললে—জয় রাম সীতারাম রামকালীবাবু! রামজীর দোহাই, আপনার কোনো ভয় নাই! আমরা ওতে ভয় পাই না!
আমি বলতে গেলাম—তবে আপনারা সেই আদি ও অকৃত্রিম—
মেয়েটি তার আগেই বললে—উঁ-হু, উঁ-হু, উঁ-হু! আমরা তাও নই! আমরা ভূত মানে অপদেবতাই নই রামকালীবাবু৷ আমরা হলাম—
লোকটি বললে—উপদেবতা—
মেয়েটি বললে—এক নম্বরের মুখ্যু তুমি৷ অপতে উপতে তফাতটা কি? যা অপ তাই উপ৷ লালমুখো বাঁদর আর মুখপোড়া হনুমান—এই তো!
লোকটি বললে—তা হলে?
মেয়েটি বললে—আমরা হলাম শিডিউলড দেবতা৷
এবার আমার বিস্ময়৷ এ রকম কথা কখনো শুনি নি৷ শিডিউলড কাস্ট আছে—কিন্তু দেবতার বেলায় এরকম তো শুনি নি!
মেয়েটি বলল—হ্যাঁ, তফশিলী দেবতা বলতে পারেন৷ ও তফশিলী—আমি ট্রাইবাল—মানে ‘‘আদিবাসী’’র মতো আদিবাসী দেবতা৷
হাঁ করে চেয়ে রইলাম তার দিকে৷ সে বললে—ও হল ধর্মরাজের দেবাংশী দেবতা আর আমি হলাম মা ষষ্ঠীর সখী দেবতা৷ আমরা ভূত নই৷ আমাদের পুজো হয়৷
হ্যাঁ, তা হয়৷ মনে মনে স্বীকার করতে হল—তা হয়৷ বারো মাসে তের ষষ্ঠী তেলে হলুদে ডগমগ চেহারা, চোখে কাজল, হাতে ঝিনুক, পরনে ঢেলা পাড় শাড়ি,—মা ষষ্ঠী মাসে মাসে আসেন কখনো অরণ্যে, কখনো পুকুর নদীর ঘাটে নামেন৷ পরের সাত পুত কোলে করে নিজের সাত পুত পিঠে করে মা ষষ্ঠী সন্তানবতী মায়েদের আর ছোট খোকাখুকিদের দেবতা৷ মেয়েরা উলু দেয়, ব্রতকথা শোনে৷ ছেলেরা প্রসাদ পায়৷ আর ধর্মরাজও আসেন বৈশাখ মাসের পূর্ণিমায়৷ ড্যাং ড্যাং ড্যাড্যা ড্যাং ড্যাডা, ড্যাডা, ড্যাডা ড্যাং—শব্দে ঢাক বাজে—ভক্তেরা নাচে৷ জয়ো ধর্ম রাজ্ঞো হে! গুলঞ্চ ফুলের মালা গলায় পরে৷ পণ্ডিতেরা বলে ধর্মরাজ আসলে হলেন—‘‘অমিতাভবুদ্ধ’’৷ অহিংসার প্রেমের অমৃত তাপস সাক্ষাৎ দশ অবতারের অন্য অবতার৷ কিন্তু আশ্চর্যভাবে আমাদের দেশে বটগাছ তলায় কি অশত্থগাছ তলায় পাথর হয়ে বসে আছেন৷ অহিংসার তপস্বী পাথর হয়ে বামুন দেবাংশীদের পাল্লায় পড়ে পাঁঠা খাচ্ছেন৷ বাতের তেল হাঁপানির কবচ চোখের অসুখের ‘আজন’ দিচ্ছেন৷ কথাগুলো তো মিথ্যে নয়৷ তাঁদের প্রতাপ খুব৷ ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর দুর্গা কালী লক্ষ্মী সরস্বতী থেকে কম নয়৷ অবিশ্যি এ-কালে সরস্বতী ঠাকরুণের নাম একসঙ্গে কারুর সঙ্গেই করা যায় না, তবে গ্রীষ্মের রাত্রে অচেনা অজানা জায়গায় অন্তত পাড়াগাঁয়ে শুয়ে কি রাত্রে মাঠের পথে যাবার সময় মা মনসাকে হেলা করা যায় না৷ এ সবই সত্যি কথা কিন্তু এই ধর্মরাজের দেবাংশী আর মা ষষ্ঠীর জয়া-বিজয়ার কেউ একজনা অকস্মাৎ জোট বেঁধে এই নিশুতি রাতে আমার কাছে কেন রে বাপু! উনি তফশিলী দেবতা—ইনি ট্রাইবাল আদিবাসী দেবী—দুজনে খাঁচার পাখি আর বনের পাখির মতো কি মনে করে মিলেছেন? আর এত মানুষ থাকতে আমার কাছেই বা কেন?
মনে করবামাত্র সঙ্গে সঙ্গে উত্তর পেলাম, সেই শিডিউলড দেবতা অর্থাৎ ধর্মরাজ ঠাকুরের দেবাংশী বেশ একটু বিরক্তির সুরে বললে—আসেন না ক্যান মশায়—ঠিক ঠাঁইয়ে গেলেই বুঝতে পারবেন! চোখে দেখবেন কানে শুনবেন!
মা ষষ্ঠীর জয়া বা বিজয়া৷
আমার ভাবনা শেষ হতে না-হতে মেয়েটি হেসে বললে—আমি হলাম ষষ্ঠীবুড়ির মেয়ে, মানে বুড়িকে হাত ধরে ধরে নিয়ে বেড়াই৷ তারপর মেয়েটি বললে—নোটন দেবাংশীর কথায় কিছু মনে করবেন না৷ বয়স হয়েছে তা ছাড়া মানুষটাই একটু গোঁয়ারগোবিন্দ৷ আজকের তো কথাই নাই৷ অক্ষয় বট উপাধ্যায় মশায় মারা যাচ্ছেন, আমরা নিরাশ্রয় হচ্ছি—এখন কোথায় যাব? কি হবে? কি করব? আমাদের আর ভাবনার শেষ নেই৷
আমি বললাম—অক্ষয় বট উপাধ্যায়?
—হ্যাঁ৷ তাঁকে আপনি তো জানেন৷ কতবার তার পাশ দিয়ে গিয়েছেন—তার কাছে বসেছেন—তাকে নিয়ে কত ভাবনা ভেবেছেন৷ আগয়া নদীর ধারে, সেই আদ্যিকালের বুড়ো বটগাছ, যে দেহ পালটে পালটে—কাণ্ড মরে গেলে ঝুরি নামিয়ে তাকেই কাণ্ড করে বেঁচেছিল—এক সময় হয়েছিল সাত-বক্ষ মহাবট, রাবন হয়েছিল, দশমুণ্ড রাবণ আর আমাদের সাত সাতটা ঝুরি কাণ্ডের সাত ছাতি নিয়ে হয়েছিল মহাবট অক্ষয়বট৷ একালে তাঁর হয়েছিল একটি কাণ্ড, বাকিগুলো সব থ্রমবসিস হয়ে প্যারালিসিস হয়ে শুকিয়ে গেছে৷ আজ এই প্রলয় ঝড়ে সেই শেষ দেহটিও সমূলে উৎপাটিত হয়ে ধরাশায়ী হয়েছেন৷
নোটন দেবাংশী বললে—ভালোমন্দ অনেক খেয়েছে, সেই বসুমতীর বুকের মধ্যে মধ্যে শেকড় চালিয়েছে৷ পাথর ফাটানো শেকড়৷ তার ওপর বড়ঘরের ছাওয়াল তো, সজনে নাজনে শ্যাওড়া ফ্যাওড়া তো নয়—বট! শেকড় গাড়লে তো বাস—মানুষের কুড়ুল না ঠেকলে চক্ষু বুজে একশো দেড়শো বছর, বুয়েচ! তপিস্যেও তো আছে, মহাবিরিক্ষির মহাপেরান, ঠিক জানতে পেরেছে তুমি মশায় আমদপুরে এই গাট সাহেবদের—কি রুম কি রুম গো—?
মেয়েটি একটু হেসে বললে—নেহাত পাড়াগেঁয়ে ভূত তুমি৷ এইকালে মানুষগুলো চন্দ্রলোকে যাচ্ছে—আর তুমি ‘রানিং রুম’ কথাটা মনে রাখতে পার না?
—উঁহু, এত সব মনে থাকে না আমার৷ আমি বাবার পেসাদী মদ পাঁট ভাঙটাঙ খাই আর ধরম বাবার সেই ঘোড়াটা যেটার ডান পা-টা লটরপটর, বাঁ পা-খান খোঁড়া, ধরম বাবার ঘোড়াটা চরিয়ে আনি আর বাস৷
মেয়েটি বললে—তা নইলে তোমার এমন দুঃখের দশা কেন হবে বল! মানুষ দেবাংশীরা দিব্যি ধরমবাবার আশীর্বাদী দিয়ে পাফোলা গোদের ওষুধ বেচে টাকার কাঁড়ি করলে—দালান-কোঠা বানালে, আর তুমি—! মাগো চেহারা দেখলেই মনে হবে উপদেবতা না হয় অপদেবতা! হয় ট্রাইবাল নয় অচ্ছুত মানে শিডিউল! বলুন আপনিই বলুন?
শেষ কথাগুলি বললে আমাকে৷
আমি বললাম—আমি কি বলব বলুন, আমি কিছু বুঝতেই পাচ্ছি না৷
—আচ্ছা তাহলে শুনুন৷ ব্যাপারটা স্পষ্ট করে দিই৷ মেয়েটি মাথার উপর টানা আধ-ঘোমটাটা একটু টেনে দিয়ে বললে—ওই যে অক্ষয় বট উপাধ্যায়—
আজকের যে প্রলয়কর ঝড়টা গেল—যে ঝড়ে আজ তিনটে গাছ উপড়ে পড়েছে রেললাইনে উপর এবং দার্জিলিং মেল দানাপুর এক্সপ্রেস রামপুরহাট প্যাসেঞ্জার বারাউনি প্যাসেঞ্জার আটকে পড়েছে, গোটা এলাকাটার ইলেকট্রিক লাইন ছিঁড়ে বিলকুল অন্ধকার করে দিয়েছে, হাজার কতক ঘরের চাল উড়েছে, মানুষ মরেছে জখম হয়েছে—সেই ঝড়ে ওই অক্ষয় বট উপাধ্যায় সশব্দে উৎপাটিত হয়ে ধরাশায়ী হয়েছেন৷
ধরাশায়ী হয়েও একেবারে মরে কাঠ হয়ে যান নি৷ এখনো পাতা সবুজ আছে, শিকড়গুলো ছিঁড়ে গিয়েও সতেজ আছে, তার হাড়গোড় ডালপালা অনেক ভেঙেছে৷ একেবারে শিকড়গুলো আকাশের দিকে তুলে মাঠের উপর মাথা অর্থাৎ শীর্ষদেশের ডালপালা গুঁজড়ে পড়েছেন৷
—সে ভীষণ শব্দ হয়েছিল৷ শুনতে পান নি?
বললাম—না৷
—আমাদিগে ঝড়ের ঠিক আগে বলেছিলেন—তোমরা খুব সাবধান৷ তা সাবধান হয়ে হবে কি—একেবারে ডিগবাজি খেয়ে চিৎপটাং৷ বুড়ো বয়সে এই মরবার আগে আস্পর্ধার কাণ্ড দেখ তো! তার ফল লাও হাতে হাতে!
মেয়েটি বললে—তুমি থাম৷ আমি বলি৷
‘‘ঝড়ে উপড়ে পড়ে উনি অজ্ঞান হয়ে ছিলেন৷ উনি অজ্ঞান হয়েছিলেন, তার সঙ্গে ভীষণ হতাহতের ঘটনা বিপর্যয়ের কাণ্ড৷ গাছে প্রায় পোকামাকড় ছিল আট দশ হাজার, সাপ ছিল গোটা বারো, বিছে ছিল সাতাশিটা আর মানুষ মরা ভূত ছিল পাঁচজন৷ একজন গলায়-দড়ে, তিনি এই গাছের ডালে গলায় দড়ি দিয়েছিলেন৷ একজন ঠ্যাঙাড়ের হাতে মরা রাহী, গলা কাটা ভূত৷ একজন ঠ্যাঙাড়ে ভূত—সে ঠেঙিয়ে মানুষ মারত৷ একজন হল রাজনৈতিক নেতা ভূত, তিনি পাশের গাঁয়ে বক্তৃতা দিতে এসে হার্ট ফেল করে মরেছিলেন, আর একজন গেছো পেতনী সে বেঁচে থাকতে রাত্রে এসে গাছের ডালে চড়ে ডাল দুলিয়ে লোককে ভয় দেখাত, হঠাৎ পা পিছলে পড়ে, ঘাড় ভেঙে মারা যায়৷ এ ছাড়া ছিল অসংখ্য বাদুড়৷ সেগুলোও হল ওই ষষ্ঠীবুড়ির ষষ্ঠীর ছা, যারা ষষ্ঠীর প্রসাদে মায়ের কোলে জন্মে ছেলেবয়সেই মরে ভূত হয়ে ফিরে এসেছে ষষ্ঠীর কাছে৷ ওই ডালে ডালে শুকনো হাড়জিরজিরে ছেলের মতো চেঁচাচ্ছে আর নিচু মুখ করে গাছের ডাল আঁকড়ে ঝুলছে৷ মনে হচ্ছে ওরা বাদুড় কিন্তু বাদুড় ওরা নয়৷ বাদুড়ের চেয়েও বেশি আছে চামচিকে৷ বটগাছের গায়ে মরা ডালে গর্তে গর্তে অসংখ্য চামচিকে৷ ওরাও তাই৷ ওরা হল পঞ্চতন্ত্রের সেই অনাগত বিধাতারা৷ অর্থাৎ যারা পরে জন্মাবেন৷ মা ষষ্ঠীকে তো এরপর মুঠো মুঠো ছানা দান করতে হবে!
মেয়েটি বললে—এরা সব মরে একাকার হয়ে গিয়েছে৷ বেঁচেছি দেবতা—সে ট্রাইবালই হই আর শিডিউলড হই—যাই হই দেবতা বলেই আমরা বেঁচেছি৷
এখন ওঁর জ্ঞান হতেই উনি বললেন—কে বেঁচে আছে?
আমরা দুজন গেলাম বললাম—আমরা আছি৷
উনি বললেন—হ্যাঁ, তোমাদের থাকবার কথা বটে৷ তা দেখ, আমার শেষ কাল উপস্থিত৷ আমি মরব৷ এখন আমার শেষ ইচ্ছা তোমরা পূরণ কর দেখি, অনেক পুণ্য হবে তোমাদের৷
আমরা বললাম—কি, বলুন?
উনি বললেন—আমদপুর ছোট লাইনে গার্ডদের রানিং রুমে রামকালী শর্মা নামক একজন ব্যক্তি আছেন৷ তিনি আজ ওখানে এই ঝড়ের জন্যই আটকে গেছেন৷ তাঁকে ডেকে আন৷ শেষ কথা তাঁকে আমি বলে যেতে চাই৷ গতবার এই ছোট লাইনেরই ও-প্রান্তে ঘাটভুবনপুরে গয়েশ্বরী ঠাকুরানির বাপের শ্রাদ্ধের দিন গয়েশ্বরীর লোকেরা ট্রেনে অ্যাক্সিডেন্ট ঘটিয়ে সেখানে নিয়ে গিয়েছিল৷ তিনি তাদের কথা লিখেছেন৷ গয়েশ্বরীদের কাল যেতে বসেছে৷ লোকে তাদের উড়িয়ে দিচ্ছে৷ উড়েও তারা যাবে৷ ফুৎকারে যেমন শিমুল ফল ফাটার ছোট ছোট টুকরো উড়ে যায়—তেমনি ভাবেই উড়ে যাবে৷ তবু তারা ওই লেখায় থাকবে৷ সুতরাং তাঁকে ডেকে নিয়ে এস—তোমাদের কথা এবং আমার কথাও আমি তাঁকে বলে যেতে চাই৷
মেয়েটি বলল—তিনি আপনার পথ চেয়ে রয়েছেন৷ তাঁর কথাতেই আমরা আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি৷
বললাম—আর কত দূর যেতে হবে?
নোটন বললে—তা দূর একটু আছে গো৷ এক কাজ কর না৷
বললাম—কি?
চোখ বন্ধ কর তারপর মনে কর তুমি যেন ঘুমিয়ে গেছ৷
—সে কি—আমাকে তুলে নিয়ে যাবে নাকি?
—দেখ না৷ এই ফুসমন্তরের চোটে কি হয় দেখ না৷ মনসার কথায় শোননি— তুলোর চেয়ে হালকা হাওয়া, বাঁটুলের মতো গুড়িয়ে-সুড়িয়ে গোল হওয়া—আর সাপেদের ফণায় ভর করা? তেমনি করে ভর কর, বুঝলে?
বুঝতে না বুঝতে পা দুটো যেন মাটি ছেড়ে শূন্যে উঠল৷ আমি ভয়ে চোখ বন্ধ করলাম৷ সঙ্গে সঙ্গে মনে হল—সোঁ—৷
সোঁ-সোঁ-সোঁ-সোঁ!
বেশি না৷ গোটাচারেক বার৷ তারপরই মাটিতে পা ঠেকল৷
লোকটি ঘাড় থেকে নামালে আমাকে আমার হাত ধরে মেয়েটি বললে—আমরা এসে গিয়েছি৷ চোখ খোল৷
চোখ খুলে অবাক হয়ে গেলাম৷ এই কি আগয়ার জঙ্গল নাকি? কোথায় জঙ্গল কোথায় উপড়ে পড়া বৃহৎ বট? এ যে ভেঙে পড়া এক ভাঙা ঠাকুরবাড়ি! বিরাট এক প্রাচীন ঠাকুরবাড়ির ধ্বংসস্তূপ! পাশেই এক কানায় কানায় ভরা নদী৷ বাঁধানো ঘাট৷ নাটমন্দিরে আশ্চর্য এক বুড়ো মাথা ফাটিয়ে হাত ভেঙে ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত অবস্থায় শুয়ে আছেন৷ তাঁর মাথার কাছে হলুদ রঙের কাপড় পরা আদ্যিকালের বদ্যি বুড়ি—তার গায়ের রং সোনার রং সোনার বর্ণ পরনে লালপেড়ে গরদের শাড়ি, হাতে শাঁখা, বসে তালপাতার তৈরি পাখা নিয়ে হাওয়া দিচ্ছে আর মিটমিট করে তাকাচ্ছে৷ আর বুকের কাছে বসে ন্যাড়ামাথা গেরুয়াপরা এক বৃদ্ধ৷ এদের চিনতে দেরি হল না একজন ষষ্ঠী ঠাকরুণ, অন্যজন ধর্মরাজ৷ এরা ছাড়া সে প্রায় শতখানেক কি তারও বেশি মানুষ সে কাচ্চাবাচ্চা বুড়ো জোয়ান নানান বয়সের নানান জাতের মানুষ ঘিরে বসে আছে আর কাঁদছে৷ দৃষ্টি আরো পরিষ্কার হতেই দেখি—আজকের ঝড়েই এই পুরনো মন্দিরটা ভেঙে চাপা পড়ে কত মানুষ যে মরেছে সে আর গুনে শেষ করা যায় না৷ ওরে বাপরে! চারিপাশে ছড়িয়ে পড়ে আছে৷
সেই আশ্চর্য বিশালকায় আহত এবং রক্তাক্ত দেহ বৃদ্ধ আমাকে দেখে বললেন— আসুন, কোনো ভয় করবেন না৷ আমি গয়েশ্বরী নই, আমি অক্ষয় বট৷ আমি ধীর আমি স্থির আমি মহাবলী অথচ মহাশান্ত৷ আমার ধর্ম—ছায়া বিতরণ আশ্রয় দান৷ আজ আমার শেষ দিন শেষ ক্ষণ৷
বৃদ্ধের সে কণ্ঠস্বর অতি আশ্চর্য এবং বিস্ময়কর৷ গম্ভীর অথচ মিষ্ট, স্পষ্ট এবং ধীর—আজ এই শোকাবহ ঘটনার জন্য আমিই খানিকটা দায়ী৷ সে সব কথাই আপনাকে বলে যাবার সময় ও সুযোগ পেয়ে এই শোচনীয় ভাবে অপঘাত মৃত্যু হওয়া সত্ত্বেও আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি৷
—‘‘আপনার কাছে আমি হার স্বীকার করে যাচ্ছি৷ আমরা পরাজিত৷’’
আমি অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকালাম৷ কি বলছে? কিসের পরাজয়?
বৃদ্ধ বললে—মৃত্যুর জন্য দুঃখ নাই৷ জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে? তবে বেঁচেছি তো কম দিন নয়, অনেক দিন৷
এই অনেক দিন ধরেই তোমাদের আমরা ছায়া দান করি ফল দান করি—তোমরা আমাদের দেবতা বলে পূজা কর৷ দেবতারা আমাদের আশ্রয় নেয়—ভূত প্রেত পেতনী এ সবের কথা বলেই কাজ নেই, মরার পর তাদের গ্রাম-শহরই হল গাছের ডালপালা৷
হঠাৎ একটু থেমে থেকে যেন কথাবার্তার সুর পালটে দিয়ে হালকা-পলকা ভাবে বললে—সোজা করে বলি শোন৷
আমি আগয়ার ধারের বুড়ো বট৷
আমি যখন জন্মাই তখন কালটা বোধ হয় মুসলমান আমল৷ এই যে আগয়া নদী এবং এর আশপাশ সব ছিল খুব নির্জন৷ দেশের লোকসংখ্যা ছিল কম৷ এখানে ওখানে ছোট ছোট দু-দশখানা ঘরওয়ালা দু-একটা গ্রাম ছিল৷ এই যে পাকা রাস্তাটা, এটার চিহ্নই ছিল না৷ তবে পায়ে-হাঁটা পথ ছিল৷ এই জঙ্গলে নদীর ধারে ছিল বুনো-শুয়োর আর ভিতরে ছিল খরগোশ, শজারু, দু একটা বাঘ কখনো-শখনও আসত৷ সাপ ছিল বিস্তর আর পাখি ছিল অনেক৷ গাছের মধ্যে গাছ বেশির ভাগই ছিল অর্জুন৷ প্রতি বর্ষায় হাজার হাজার চারা হত৷ এরই মধ্যে জন্মালাম আমি৷
এখানে আগয়া নদীর ধারে কতকগুলো কালো মোটা মোটা পাথর ছিল মাটির সঙ্গে৷ মাটির গড়নই এমনি৷ এখানে ওখানে পাথর আছে দেখছ তো, ঠিক তেমনি৷ সেই পাথরের উপর একটা পাখি একাধারে আমার পিতামাতা—বটবীজটিকে খেয়ে এখানে বসে বিষ্ঠা ত্যাগ করেছিল—সেই বীজকণা থেকে আমি জন্মে আস্তে আস্তে ওই অর্জুন গাছের জঙ্গলের মধ্যে বেড়ে উঠেছিলাম৷ তখন আমি প্রায় তিন-চারহাত লম্বা হয়েছি চারপাশে তখন তিনটি শাখা মেলেছি৷
এই সময় একদিন কাঁদতে কাঁদতে এল একটি অল্পবয়সী মেয়ে৷ তার ছেলে হয়ে মারা গেছে ছেলের শোকে কাঁদবার জন্য এসেছে এই নির্জনে৷ এসে পাথর দেখে বসল এই পাথরে একেবারে আমার গোড়ায় এবং কাঁদতে লাগল৷ ভরতি দুপুর বেলা, গরমের সময়, আমি তখন ছোট গাছ—আমার একটুখানি ছায়া তখন সেই ছায়াতেই কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে গেল৷ ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখলে যে, যে বটগাছটির (‘মানে আমার’ —বুড়ো বটের আত্মা বললে) ছায়ায় শুয়ে আছে তার কচি ডালগুলোর ডগায় ডগায় যে ‘থোকা থোকা’ বটফল ধরে আছে সেগুলো আসলে বটফল নয়—ওগুলো সব হল ছেলেপুলে৷
হাওয়া লেগে ডাল দুলছে—সঙ্গে সঙ্গে ছেলেপুলেগুলোও দুলছে তা দেখে ওই মা-টির মনে হল—যেন ছেলেগুলোকে নিয়ে দোলা দিচ্ছি আমি (মানে বটগাছ)৷
ঘুমের ঘোরেই মেয়েটি ফোঁপাতে লাগল৷
আমি——
সেই আহত রক্তাক্ত দেহ বুড়ো, সেই বট গাছের আত্মা বললে—বুঝেছ, আমি— তখন সেই কালের সেই আমি তাকে বললাম—দেখ, তুমি এক কাজ কর, কাল এখানে আমার গোড়ায় আবার এসো৷ স্নান করে পুজো সাজিয়ে এসো৷ এসে—তুমি যে দেবতা বা দেবী ছেলেপুলের দেবী তাকে পুজো করে যেয়ো, বুঝেছ? আমি সেই ঠাকুরকে ডেকে রাখব৷ মেয়েটি বললে—বেশ৷ বুঝেছ—সে কালে লোকে সহজেই এসব কথা বিশ্বাস করত৷ আলো দেয় সূর্যি ঠাকুর, জ্যোৎস্না দেয় চন্দ্র ঠাকুর, জল দেয় ইন্দ্ররাজা, আগুন দেয় অগ্নিদেব, ধান দেন লক্ষ্মীমা, বিদ্যে দেন সরস্বতীমা, তখন ছেলেমেয়েও নিশ্চয় কোনো না কোনো দেবতাই দেন৷ আমি মনে মনে তাকে ডাকতে লাগলাম৷—আহা মেয়েটির বড় দুঃখু৷ ছেলেমেয়ে দেবার ঠাকুর বা ঠাকরুণ, তুমি বাপু দয়া করে এস৷ মেয়েটি কাল পুজো আনবে তুমি পুজো নিয়ে ওকে দয়া করে একটি ছেলে দিয়ো৷
পরের দিন মেয়েটি এল—গরমের সময়—গাছে গাছে খেজুর পেকেছে জাম পেকেছে আম পেকেছে, ফুটি পেকেছে মাঠে, চাষের ছোলা কলাই ভিজিয়ে নিয়ে—পুজোর থালা সাজিয়ে নিয়ে এল৷ তার সঙ্গে কাপড় গামছা দিলে৷ হলুদ বাটা সিঁদুর আনলে৷ এনে আমার গোড়ায় ঢেলে দিয়ে বললে—এই আমার পুজো নাও, তোমার অনেক ছেলে—অনেক ফল ধরেছে তোমার—আমাকে একটি ছেলে দাও৷
আমি বললাম—হে দেবতা দয়া কর৷
স্বর্গ থেকে এক বুড়ি এল, হলুদ মেখে, কাজল পরে, সেই বলে যে ‘হলুদ ঘুটুঘুটু—কাজলে ভুটুটু সিঁদুরে সুটুসুটু’—(এর মানে কি তা বুঝলাম না আমি, কিন্তু বাধা দিয়ে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে হল না৷) ঠিক তাই৷ বুড়ি বললে আমি এসেছি৷ আমি হলাম স্বর্গের দেবতার দাঈ৷ আমি ছেলেপিলের দেবতা৷ স্বর্গের ইন্দ্ররাজার ছেলে জয়ন্তের আঁতুড়ে আমি ছিলাম৷ মা দুর্গার গড়া পুতুল যখন জ্যান্ত হয়ে কেঁদে উঠল—তখনো আমাকে ডেকেছিল৷ গণেশকে তুলে আমিই দুর্গামায়ের কোলে দিলাম৷ আমার নাম ‘ষষ্ঠী ঠাকরুণ’৷ আমি পৃথিবীতে বারে মাসে তের বার আসি—কখনো আসি অরণ্যে, কখনো পুকুর নদীর ঘাটে—কখনো কিছুতে কখনো মিছুতে৷ তা এই জষ্টিমাসে তোমার এই গাছতলায় এসে পুজো নিয়ে যাব৷ আর মেয়েটির ছেলে হবে৷
এই বলে সে চলে গেল৷ আর তারপর আমি যত বড় হলাম তত ডালপালা মেললাম, ছায়া বড় হল নানান পশুপক্ষী এসে আশ্রয় নিল৷ আর এল এক বামুন৷ সে হল মেয়েদের পুরুত৷ সে পুজো নিবেদন করতে আসত৷ সে পুজো করত আর ষষ্ঠী মায়ের মহিমা প্রচার করত৷ লোকে পুজো যা দিত সেই নিত৷ আমার গোড়া সে পরিষ্কার করত৷ আমার ডাল কাটতে দিত না৷ আমার ডালে বাদুড় চামচিকেরা এসে যখন ঝুলল তখন সেই বললে—ওরা মা ষষ্ঠীর ছানা৷ ওদেরই মা দান করেন মায়েদের৷
তারপর অনেকদিন পর এল ধর্মরাজ৷
ধর্মরাজকে নিয়ে এলেন এক সন্ন্যাসী৷ সন্ন্যাসী ঠাকুরটি তকতকে গাছতলা নির্জন স্থান আর অরণ্য-অরণ্য ভাবের ঠাঁইটি দেখে বাসা গড়লেন৷ ঠাঁইটি মানে আমার তলদেশটি আরো ঝকঝকে তকতকে হল৷ বেদি বাঁধলে৷ মাটির বেদি৷ চেলা চামুণ্ডা জুটল৷ যত সব নিকেজো মানে বেকার বাউন্ডুলে লোক এসে জমে গেল বাবা সন্ন্যাসীকে ঘিরে৷ গাঁজা ভাঙ খেতে লাগল আর যারা কাজ করে—তাদের কাছে গিয়ে দেবতার নাম দিয়ে মাতব্বরি করতে লাগল৷
রামকালীবাবু আজ আর তোমার কাছে লুকোব না, স্বীকার করব সত্য কথা৷ দেবতা কেউ চোখে দেখেনি, স্বর্গে কেউ যায়নি—কেউ স্বর্গ থেকে আসেনি—কিন্তু দেবতা স্বর্গ পরকাল আর ভূত এরা জীবন্ত মানুষের রাজ্যে আশ্চর্যভাবে এক অদ্ভুত সাম্রাজ্যবাদ বিস্তার করে বসে আছে৷ ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর দুর্গা কালী লক্ষ্মী সরস্বতী ইন্দ্র চন্দ্র বায়ু বরুণ গণেশ কার্তিক—গাজনের শিব ধর্মরাজ মনসা ষষ্ঠী, সুন্দরবনের বাঘের ঠাকুর কোথাও ভালুকের ঠাকুর—ঠাকুরের যে ছত্রিশ কোটি বংশাবলী এ সব ভুয়ো—সব ভুয়ো৷ ভালো মানুষ সহজ মানুষেরা এককালে আলো যে দেয় তাকে দেবতা ভেবেছে, জল যে দেয় তাকে দেবতা ভেবেছে—এমনি করে যা কিছুর কারণ খুঁজে না পেয়েছে তাই ধরে নিয়েছিল এসব করেন দেবতারা৷ কিছু কিছু চালাক চতুর লোক—তারা বেশির ভাগ বামুন পাণ্ডা বেকার বাউণ্ডুলে—তারা গাছতলায় পাথর বসিয়ে সিঁদুর লেপে বোম বিশ্বনাথ জয় ধর্ম রাজ্ঞো বলে বসে পড়েছে৷ আমার সেদিনকার এই বাড়বাড়ন্তর দিনে আমাকে ঘিরে এই সব ঠাকুরদের আস্তানা গড়েছিল৷ গোড়াতে একদিকে মা ষষ্ঠী একদিকে ধর্মরাজ, আর ওই দেখ একটু দূরে নদীর ওপারে ওই যে ডাঙ্গাটায় ওই যে ঘরটা ওটা হল মা মনসার ঘর—আরো খানিকটা দূরে এই তো সেদিন রেলের কুলিরা রামদাস হনুমানের নামে মহাবীরের ঝান্ডা টাঙিয়েছে৷
বারো মাসে তেরো পার্বণ হত৷ মধ্যে মধ্যে মেলা বসত আমাকে মাঝখানে রেখে এই চারিপাশে৷ রাত্রে আলো জ্বলত৷ লোকেরা ঢোল বাজিয়ে গান গাইত কবিগান যাত্রাগান হত দিনের বেলা ঢাক ঢোল বাজিয়ে পুজো দিত লোকেরা বলিদান হত ছাগ ভেড়া হাঁস কাটত আবার খোল বাজিয়ে হরিনামও করত৷
আমি মাথা তুলে আকাশকে যেন মাথায় ধরে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম৷ মনে হত আমি সম্রাট৷ আমার নিজের শক্তিতে নিজেই আমি আশ্চর্য হতাম৷ প্রায় ঝগড়া হত আমার মেঘেদের সঙ্গে আর ঝড়ের সঙ্গে৷ সূয্যিঠাকুর লোক ভালো৷ চন্দ্রঠাকুর সেও খুব ভালো৷ কিন্তু এই ঝড়ো ঠাকুর আর এই জলের ঠাকুর মেঘের দেবতা, এরা দেবতা হিসেবে যা হোন মানুষ ভালো নন৷ কুটিল পেঁচালো জেদী, ন্যায়-অন্যায়ের বিচার নাই—স্বেচ্ছাচারী৷ চাঁদসদাগরের সঙ্গে মনসা ঠাকরুণের বাদের কথা জান তো? তুই আমাকে পুজো কর—না করলে তোকে কামড়াব৷ তাও সামনাসামনি নয়—লুকিয়ে চুরিয়ে রাত্রিবেলা৷ আর ঠাকরুণের মুরদ তো খুব—একটা লাঠির এক ঘা পড়তেই কাৎ! তারপর শ্রীবৎস রাজা আর শনিঠাকুরের কথা৷ নলরাজা আর কলিঠাকুরের কথা৷ কত বলব বল! সব দেবতার এক বোল, আমাকে পুজো কর৷ না করলে ছলে বলে তোর সর্বনাশ করব৷ ওই যে বুড়ি ষষ্ঠীবেটি, ওর চরিত্তির তাই গো৷ শেতলা ষষ্ঠীর দিন কোন মা ষষ্ঠীর ভিজে ভাতের পেসাদ না খেয়ে গরমগরম খেয়েছিল—অমনি বুড়ির মেজাজ খাপ্পা!
দেখ না রামকালী, থুড়থুড়ি বুড়ি কটকট করে তাকিয়ে আছে দেখ না৷
যাকগে৷ শোন যা বলছি শোন৷ সে কালে আমার সঙ্গে ওই ঝড় আর মেঘের দেবতাদের লড়াই হত৷ বুঝেছ! আওয়াজ দিয়ে ঝড় সমুদ্র লঙ্ঘনকারী হনুমানের মতো পশ্চিম দক্ষিণ কোণে স্থির হয়ে দাঁড়াত, দম ধরত, সারা শরীরকে শক্ত করে তুলত—বড় বড় কুস্তিগীরদের মতো, তারপর ‘গোঁ-ওঁ-ওঁ’ শব্দ করে দিত ঝাঁপ—শূন্যলোক তোলপাড় করে যে খানিকটা মাথা তুলেছে তারই মাথায় ধাক্কা মেরে ভেঙেচুরে দিয়ে চলে যেত৷ আজও যায় আজই তো দেখলে৷ তার পিছন পিছন আসে মেঘ আর জল, তার সঙ্গে থাকে ইন্দ্রদেবতার বজ্র৷ বড় বড় তাল গাছের মাথা দাউ দাউ করে জ্বালিয়ে দেয়৷ আজও পড়েছে বাজ৷ ওই সুন্দীপুরে পড়েছে তালগাছের মাথায়—হরিরামপুরে পড়েছে পুরোনো মন্দিরের চূড়ায়—আরো দুটো পড়েছে কোপাই নদীর ওপারে৷
আগে আগে আমার উপর বজ্রের আঘাত করেছে—একবার নয়, চার চার বার৷ চারবারে চারটে ডাল শুকিয়ে গেল৷
আমি ঝড়কে জলকে ইন্দ্রকে মানতাম না কিনা৷
বলতাম—তোমাদের মানব কি হে? তোমরাই তো আমার তলাতে এসে আশ্রয় নিয়েছ৷ মনসার কাচ্চাবাচ্চারা থাকে, ষষ্ঠীবুড়ি থাকে, তার বাচ্চা বাদুড় চামচিকে থাকে, ভূতেরা থাকে৷ পাঁচটা ভূত থাকে আমার ডালে, ধর্মরাজ থাকে৷ আমি তোমাদের মানব কেন?
ঝড় বলত—তবে নে, সামাল৷
আমিও তাল ঠুকে শক্ত মাটিতে খুঁটি নিয়ে দাঁড়াতাম আর মুখে কোনো কথা না বলে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম৷ ঠিক ধুলোমাটি মাখা নেঙটা কষা মল্লবীরের মতো৷ ঝড় গোঁ-ওঁ শব্দে এসে ঘাড়ে লাফ দিয়ে পড়ে মুচড়ে মাটিতে ঠেসে ধরে ঘাড় ভেঙে দিতে চাইত৷ আমি নুয়ে পড়তাম প্রথমটায়, তারপরেই ঝটকা দিয়ে ঝড়কে ঘাড় থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আবার সোজা হতাম৷ আবার ঝাঁপ দিত ঝড়৷ আমি আবারও তেমনি করে লড়াই দিতাম৷ একবার দুবার তিনবার৷ তারপর ধস্তাধস্তি৷ সে ফেলে, আমি ছুঁড়ে ফেলে দি৷ সে গোঙায় গোঁ গোঁ, আমি হা-হা করে হাসি৷ আমার তলায় ভয়ে বোবা হয়ে বসে থাকে ধর্মরাজ—ষষ্ঠীবুড়ি৷ সাপখোপ পোকামাকড় বাদুড় চামচিকে আমার গায়ের গর্তটর্ত দেখে তার মধ্যে ঢুকে পড়ত৷ ঝড় ক্রমে ক্রমে ক্লান্ত হত—বৃষ্টি শেষ হত, আমি মাথা তুলে ঠিক দাঁড়িয়ে থাকতাম৷ হাসতাম মিটিমিটি৷ মাথার উপরে আকাশে চাঁদ থাকলে বলতাম—তুমি সাক্ষী ঠাকুর! সূর্য থাকলে তাঁকে বলতাম—প্রভু, তুমি সাক্ষী! অনেকে গাছের দর্প চূর্ণ করেছে, অনেকে হেরেছে, আমি হারিনি৷ আমার সঙ্গে একটা আপস হয়ে গিয়েছিল শেষ দিকে৷ কারণ অনেক দেবতার আশ্রয় তো আমি৷
বেশ দিন যাচ্ছিল৷ আমার বয়স বাড়ছিল, তবু বুড়ো হইনি৷ মূল কাণ্ডটা মরল, তখন আমি নতুন ঝুরি নামিয়ে আরো তিনটে কাণ্ডে ত্রিদেহী মহাবট হয়ে উঠেছি৷ তোমাদের মধ্যে যমজ ছেলে হয় জোড়া লাগা যমজ—তোমরা তাকে বলো শ্যামটুইন—এ টুইনের থেকে বেশি৷
লোক বলত, দেবচরিত্র বোঝা ভার৷
হঠাৎ কাল পাল্টাল৷ মানুষ পরশমণির চেয়েও দামি মণি পেলো৷
বিজ্ঞান-মণি৷
যে জ্ঞানের বলে আগের কালের সকল বিশ্বাসের ওপর আলো ফেলে বিশ্বাসের কালো অন্ধকার ঘুচিয়ে বিশ্বাসকেই মুছে নিল৷
আশ্চর্য ঘটনা ঘটতে লাগল সব৷
লোহার গাড়ি জলে আগুনে কয়লায় লাইনের ওপর চলতে লাগল৷ তারের মুখে বিদ্যুতের আলো জ্বলল৷ তেল নেই সলতে নেই প্রদীপ নেই ঝড়বাদলে নেভা নেই—আলো জ্বলছে৷ অবাক হয়েই দেখছিলাম৷ চমকাই নি৷
হঠাৎ চমকে উঠলাম—মানুষের চিৎকার শুনে৷
—ভূত নাই! ভগবান মানি না—দেবতা মিথ্যে!
—ইনকিলাব জিন্দাবাদ!
আশ্চর্য! আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে ভূতেরা মিলিয়ে যেতে লাগল৷ তোমাদের গ্রামের সেই বিখ্যাত রামাই ভূত কেমন করে নিখোঁজ হল জান? সে সেই বড় শিমুল গাছটার মাথায় বসে পৈতে হাতে নিয়ে জপ করছিল—
ববম ববম ভোলা—জয়কালী জয়কালী—
ধিতাং ধিতাং নাচি—হাতে দিয়ে তালি৷
ঠিক সেই সময়েই গাছটার একটু দূরের রাস্তা ধরে যত হাল আমলের ছোকরাদের মিছিল চলছিল—তারা হাঁক দিচ্ছিল—ভূত! নেহি হ্যায়৷ প্রেত—বিলকুল ঝুট! ভূত প্রেত মুর্দাবাদ৷ ভেঙ্গে দেও—জাহান্নম! সঙ্গে সঙ্গে চমকে গিয়ে রামাই সেই উঁচু শিমুল গাছের সেই উঁচু ডগার ডাল থেকে ফট করে শিমুল ফলের মতো ফেটে গেল৷ শিমুল ফলের তুলো আছে, সেগুলো উড়ে বেড়ায় বাতাসে, খোলাটা লেগে থাকে বোঁটায়—এর খোলাও নেই ভেতরে তুলোও নেই৷ সুতরাং ফট করে শব্দ হওয়ার সঙ্গে ভূত শূন্যে ফুস করে বাতাসের সঙ্গে মিশে যাওয়ার মতো মিশে গেল৷
শেষ পর্যন্ত ওই বৈতরণী ঘাটের ধারে যান, ভুবনপুরে ওরা জড়ো হয়ে আছে৷ কিন্তু তাও আর থাকবে না৷ এবার মানুষরা চন্দ্রলোকে যাচ্ছে গো৷ মহা বিপদ৷ কোথাও গিয়ে পরিত্রাণ নেই৷ তাই—
বললাম—কি তাই? খুব বিস্ময়কর মনে হচ্ছিল৷
বৃদ্ধ বটের আহত আত্মাপুরুষ বললেন—দেখ, সব দেবতারা এবার শঙ্কিত হল৷ ভূত গেছে—এবার এরা মহাশূন্যে মহাযান চালিয়ে সব খুঁজে পেতে ভগবানকে ধরতে যাবে৷
ভগবান বুড়ো কোথায় থাকে তা ওই ইন্দ্র বায়ু বরুণও জানে না৷ বিশ্বাস না হয় উপনিষদ পড়ে দেখো৷ তাই দেবতারা খুব চঞ্চল হল৷ সব দেবতা৷ এরা তো এবার দেবতা-টেবতাদেরও মানবে না৷ ঘাড় ধরে ধরে নিকাল দেবে৷ তখন কোথায় যাবে সব? মানুষ যদি দেবতাদের না মানে তবে তারা যাবে কোথায়? খাবে কি? অক্ষম পশু নড়তে পারে না, চড়তে পারে না, কথা কয় না—বেচারারা যে শুকিয়ে হেজে-মজে, অঙ্গহীন হয়ে, পুতুল হয়ে, পাথর হয়ে, না হয় নস্যাৎ হয়ে উড়ে যাবে৷
রাত্রি শেষ হয়ে আসছিল৷ আকাশের চাঁদ পশ্চিমদিকে ঢলে পড়েছে৷ বৃদ্ধ বট পশ্চিমের ঝড়ে উপড়ে পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা হয়ে পড়েছেন৷ বিশাল শাখাপ্রশাখা মাটির উপর ভেঙ্গেচুরে দুমড়ে মাটির বুকে মুচড়ে মুখ গুঁজে পড়ে আছে৷ তার পাশেই তাঁর আত্মা আহত হয়ে পড়ে আছে৷ দেহ থেকে বেরিয়ে এসেছেন৷ বোধ হয় রাত্রি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চলে যাবেন স্বর্গলোকে৷ আশেপাশে অপ বা উপ দেবতারা বা শিডিউলড আর ট্রাইবাল দেবতারা জমায়েত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷
ধর্মরাজ থুত্থুরে বুড়ো৷ ষষ্ঠী আদ্যিকালের বদ্যিবুড়ি৷ মনসা ঠাকরুণ, গাজনের শিব, শিবের সেনাপতি বাণ গোঁসাই, রক্ষেকালী শ্মশানকালী, সুন্দর রায়, খোসপাঁচড়ার দেবতা ঘেঁটু ঠাকুর—ওরফে ঘণ্টাকর্ণ, তার উপর গলায় দড়ে, পুড়েমরা ভূত, ঘাড়ভাঙা ভূত, জলে ডুবে মরা ভূতনী, সাপে কামড়ে মরা ভূত, তেরোস্পর্শে মরা ভূত, শেখ সাহেবদের মামদো, পাদরিদের সাহেব ভূত সব এসে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে৷
দাঁড়াবে না? বটগাছ যে তাদের আশ্রয়দাতা!
বুড়ো বটের আত্মা বলল—এইসব নিয়ে আমাদের সভা-সমিতি প্রায়ই হচ্ছিল৷ কি করা যায়? কিভাবে বাঁচা যায়? মানুষের ওপর কি করে—টেক্কা-তুরুপ ছাড়া তো পথ নেই! দেখছ তো রাশিয়া আমেরিকার ব্যাপার? এ একটা আকাশযান ছাড়ছে তো ও আর একটা ছাড়ছে৷ এ যদি শূন্যযানে কুকুর পাঠায় তো ও পাঠায় মানুষ৷ তখন ও পাঠায় মেয়েছেলে— তারপর এ পাঠায় দুজন৷ আবার মহাকাশে হেঁটে বেড়ায়৷ দুটো মহাকাশযানে যানে দেখা হয়৷ আমেরিকা তাজ্জব করে দিলে৷ লোক এবার নামাবেই চাঁদের উপর৷ তাই আমাদের ঠিক হল—আমরা তার আগেই পাঠাব আমাদের প্রতিনিধি৷ আমাদের যন্ত্রের দরকার নেই৷ যন্ত্র আমরা বুঝি না৷ আমরা দেবতা৷ আমরা উড়ব৷ তাই ঠিক হয়েছিল আমি উড়ব— ঝড়ের দেবতা রকেটের মতো আমাকে বৃক্ষদেবতাকে আকাশে ছুঁড়ে দেবে আর আমার ডালে ঝোলা হাজারখানেক বাদুড় আর একলক্ষ চামচিকে পাখা ঝাপটাতে থাকবে৷ আমরা মাধ্যাকর্ষণ পার হয়ে চাঁদে গিয়ে ঝপ করে নেমে গোটা চাঁদকে দখল করে হাঁকব— দেবতালোক জিন্দাবাদ৷ জয়—দেবতাদের জয়!
ঝড়ও এল৷ দেখছ কি ঝড়৷ সে আমাকে তুলেও দিলে—কিন্তু দেবতারা বিজ্ঞান জানে না৷ বাদুড়ের চামচিকের পাখায় ভর করে শূন্যলোকে উড়ে চন্দ্রলোকে যাওয়া যায় না৷ আমি ধপাস করে পড়ে গেলাম মাটির বুকে৷ এবং—
মাঝপথেই থেমে গেল বুড়ো বটের আত্মা এবং একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেললে৷
তারপর আবার বললে—ভূত দেবতা ভগবান এসবের কাউকে কিংবা কিছুকে রাখবে না মানুষ৷
আমি বললাম—তাতে কি, গাছ তো থাকবে!
গাছ বললে—হ্যাঁ৷ কিন্তু—
—কিন্তু কি?
—দেবতা হয়ে তো থাকবে না৷
—দরকার কি? গাছ গাছ হয়েই থাকুক৷ মানুষও তো মানুষ হয়েই থাকবে?
গাছ বললে—মানুষদের তো আমরা খুব ভালোবাসি৷ যখন মানুষেরা ঘর গড়তে জানত না—তখন তো ঝড়ের হাত থেকে জলের হাত থেকে রোদের হাত থেকে আমরাই বাঁচিয়েছি৷
বললাম—কে অস্বীকার করছে?
—করছ না, করবে!
—না, মানুষ অকৃতজ্ঞ নয়৷
গাছ বললে—হৃদয়হীনও যেন হয়ো না৷
গাছের ওই শেষ কথা৷ তারপরই পাখি ডাকতে লাগল৷ পূর্বদিকের আকাশে যেন লালচে আভা ধরেছে৷ বাসু আমাকে নাড়া দিয়ে ডেকে তুললে৷ জেগে দেখলাম আমি আমদপুর স্টেশনেই শুয়ে আছি৷
ওঃ, তা হলে সারারাত্রি স্বপ্ন দেখেছি!
না—স্বপ্ন ঠিক নয়৷ কারণ সকালে যখন ট্রেনে চড়ে বাড়ি ফিরলাম তখন দেখলাম আগয়ার ব্রিজের পাশে আগয়া নদীর চরের উপর কুলিরা কাটারি দা কুড়ুল নিয়ে গতরাত্রে ঝড়ে উপড়ে পড়া সেই ষষ্ঠীবুড়ি ও ধরমতলার বটগাছটাকে কেটে টুকরো টুকরো করে লাইন থেকে সরিয়ে ফেলেছে৷ এখন বাকি অংশটাকে টুকরো টুকরো করবে৷ দেখলাম লরি দাঁড়িয়ে আছে৷ গাছ তুলে নিয়ে যাবে৷ শুনলাম এখানকার স-মিল মানে করাত- কলওয়ালারা গাছটাকে কিনে ফেলেছে৷ চিরে কেটে টুকরো করে বিক্রি করবে৷
আরো দেখলাম—অনেক মজুর চাষি দাঁড়িয়ে আছে৷ বটগাছটা গেল, এবার জায়গাটা কেটে জমি করলে কেমন জমি হবে তাই তারা দেখতে এসেছে৷
বিকেলবেলা কলকাতা যাবার জন্যে বাড়ি থেকে আবার এই পথেই ফিরলাম—তখন আগয়ার ধরমতলা বড়তলা পরিষ্কার হয়ে গেছে৷ এরপর জমি হবে৷ মাঠটার দুটো নাম হবে—ধরমতলার মাঠ আর ষষ্ঠীতলার মাঠ৷