৯
ভোরে ঘুম ভাঙলো চাচির ডাকে।
—‘সকাল, মা! আমার একটু বেরোতে হবে। আমার বড় বোনের ছেলেটা আবার নতুন করে একটা সমস্যা ক্রিয়েট করেছে। বোনের শরীরটাও ভালো না। আমি টিলিকে নিয়ে একটু পরেই বাসে করে নিউইয়র্ক যাচ্ছি। বেড়ানোর উদ্দেশ্যে গেলে তোমাকেও নিয়ে যেতাম। কিন্তু এই ঝামেলার ভেতর গিয়ে তুমি কোনো মজা পাবে না। তুমি বরং থাকো তোমার চাচার সাথে।’
সকালের মাত্র ঘুম ভাঙা মস্তিষ্ক একসাথে এতগুলো কথা ধারণ করতে পারলো না। কিছুক্ষণ ঘুমো চোখে চাচির দিকে তাকিয়ে থেকে সে ভারি গলায় বলল, ‘কোথায় যাচ্ছেন?’
—‘নিউইয়র্ক।’
—‘ও’
—তুমি কি রাগ করলে?’
—‘না না, রাগ করবো কেন?’
—‘কটা দিন মাত্র। একটু ম্যানেজ করো। তোমার সেই বন্ধুটি কি যেন নাম নাবিলা। ওই মেয়েটাকে নিয়ে উইক ডে তে এদিক সেদিক ঘুরতে যেতে পারো। আর বিকেলে টিলি স্কুল থেকে ফিরলে টিলিকে নিয়েও বের হতে পারবে। উইকেন্ডে তো ফাহাদ তোমাকে সময় দেবেই। দেখবে খারাপ লাগবে না।’
চাচি তাকে নিয়ে এতো ভাবছে দেখে তার মুখে একটি কৃতজ্ঞতার হাসি ফুটে উঠল, বলল, ‘আপনি চিন্তা করবেন না চাচি। ঘুরে আসুন। আল্লাহ ভরসা।’
আরো খানিকক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ি করলো সকাল। বেলা বাড়লেও আজ আকাশে রোদ চড়লো না। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। বাতাসে এখনো গতরাতের বৃষ্টির ছোঁয়া আছে, স্নিগ্ধ একটা ছোঁয়া আছে। ঠিক যেমনটা ছোঁয়া এখনো লেগে আছে সকালের বাঁ হাতের কব্জিতে। সেই ছোঁয়াতেও একটা কেমন মিষ্টি মিষ্টি ভালোলাগার ঘ্রাণ। আতরের খুশবুর মতো।
বারোটার দিকে ফ্রেশ ট্রেশ হয়ে সকাল রান্নাঘরে গেলো। চাচি তো গেলেন চলে খুব। কিন্তু খাওয়া-দাওয়ার কী হবে? চাচা তো বলতে গেলে প্রতিদিনই বাড়িতে থাকেন। বয়স পঁয়ষট্টি পেরোনোর সাথে সাথে তিনি স্বেচ্ছায় অবসর নিয়েছেন। দুটি সেভেন ইলেভেন স্টোরের মালিকানা আছে তার। দু’ স্থানেই ম্যানেজারের ওপর পুরোপুরি দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। তিনি সপ্তাহে দু একবার সশরীরে উপস্থিত হয়ে সবকিছু তদারক করে আসেন শুধু।
সকাল চাচার ঘরে উঁকি দিলো। চেয়ারে বসে পত্রিকা পড়ছেন তিনি। সকাল বলল,
—‘চাচা, দুপুরে কী খাবেন?’
চাচা পত্রিকাটি মুখের সামনে থেকে সরিয়ে এক গাল হেসে বললেন, ‘ফাহাদের আম্মা সব রান্না করে রেখে গেছে। ফ্রিজ খুলে দেখো। এখন শুধু আমরা ওভেনে গরম করবো আর খাবো।’
—‘না চাচা, ফ্রিজের খাবার আজ খাবো না। আমি রান্না করব। আপনি বলুন কী খাবেন।’
—‘তুমি রান্না করতে পারো?’
—‘তা পারি। জীবনে শুধু দুটা কাজই আমি মোটামোটি ভালো করতে শিখেছি চাচা, রান্না আর পড়াশোনা।’
—‘বাঃ! এই দুটো গুণ থাকলে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না।’
—‘কী খাবেন বলুন।’
চাচা একটু চিন্তা করে নিয়ে বললেন, ‘ভর্তা জাতীয় কিছু বানাতে পারো?’
—‘অবশ্যই! কীসের ভর্তা খাবেন? আলু?’
—‘সে তোমার ইচ্ছে। কিন্তু খুব করে ঝাল দিবে কেমন? অনেক দিন ঝাল খাই না। আমার ছেলে-মেয়েগুলো হয়েছে একদম পাক্কা সাহেবের বাচ্চা। তরকারিতে একটু মশলা দিলেই এদের নাক কান দিয়ে ধোঁয়া বের হয়। ওদের জ্বালায় তোমার চাচি এখন তরকারিতে ঝাল দেয়া একরকম বন্ধই করে দিয়েছে।’
—‘নো প্রব্লেম চাচা। আজকে একদম বাংলাদেশি স্টাইলের ঝাল দেয়া হবে তরকারিতে। কোনো চিন্তা করবেন না
কিন্তু রান্না করতে এসে বোঝা গেলো নতুন পরিবেশে সম্পূর্ণ নিজের হাতে রান্না করাটা একটু ঝঞ্ঝাটময়ই বটে। দেশে মা এটা সেটা এগিয়ে দেন। কাজের বুয়া পেঁয়াজ রসুন ছিলে, কেটে দেয়। মাছ মাংস ধুয়ে দেয়। কিন্তু এখানে তো সবটা নিজের করতে হবে। কোনও হেল্পিং হ্যান্ড নেই। জীবনে এই প্রথমবারের মতো প্রকৃত অর্থে সে নিজের হাতে রান্না করতে যাচ্ছে। রান্না জিনিসটা আসলে শুধু মশলার পরিমাণ নির্ধারণ করা নয়, রান্না একটি সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া। আনাজপাতি যোগাড় করা থেকে শুরু করে মুখে তোলা পর্যন্ত যে নিপুণভাবে সবটা শেষ করতে পারে সেই সত্যিকারের রাঁধুনী। বাংলাদেশের একটি রান্নায় কাজের লোকের ভূমিকা থাকে অনেক খানি। কিন্তু দিন শেষে সুনাম হয় গৃহকর্ত্রীর যে কিনা শুধু পরিমাণ মতো মশলা দিয়ে খুন্তি নেড়েই রান্নার পাট চুকিয়েছেন।
ইলেকট্রিক চুলাটা হাই পাওয়ারে দিয়ে চালু করলো সকাল। এই চুলাগুলো গরম হতে একটু সময় নেয়। খেয়াল করে দেখেছে সে। আগুন জ্বলে না। ইলেকট্রিক প্লেট গরম হলে লাল বর্ণ ধারণ করে। কয়েকটা আলু কেটে নিয়ে পানিশুদ্ধ পাতিল বসিয়ে দিলো চুলায় সেদ্ধ করার জন্য। পেঁয়াজ কাটতে গিয়ে মনে হলো পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিনতম কাজ এটা। বলা বাহুল্য বাড়িতে বুয়াই সবসময় পেঁয়াজ কাটে। মাটিতে বসে বটি দিয়ে সুন্দর কুচি কুচি করে কেটে দেয়। আজকে পেঁয়াজ ছিলতে গিয়ে তার চোখে জল চলে আসছে। দেশে নিজের বাড়িতে কাজের বুয়া রোজ এই ভীষণ কঠিন কাজটা করে দেয় বলে বুয়ার প্রতি কৃতজ্ঞতায় মনটা কানায় কানায় ভরে উঠছে।
বেশ খানিকক্ষণ সময় নিয়ে সকাল একটি সম্পূর্ণ পেঁয়াজ কুচি করলো। কিন্তু তখন তার চোখ নাক মুখ ভাসছে জলে। হঠাৎ তারস্বরে ঘরের ভেতর কিসের একটা সাইরেন বেজে উঠল। টু টু টু করে বিকট ভাবে বাজতে থাকলো শব্দটা। আতঙ্কে সকালের মুখ ছাই রং হয়ে গেলো। বুক ধড়ফড় করতে থাকলো। এটা কীসের শব্দ? কী হচ্ছে এখানে? তার মাথায় তো কিছুই ঢুকছে না। মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসলো শব্দটা ‘চাচা!
চাচা আসার আগেই বেজমেন্টের দরজা খুলে দ্রুত পায়ে করিডোর পার হয়ে ছুটে আসলো লম্বা মানুষটা। রান্নাঘরের সিলিঙে লাগানো ফায়ার ডিটেক্টর ডিভাইসের সামনে হাত নাড়ল। সকাল তখন বুঝলো এটা ফায়ার ডিটেক্টরের এলার্ম। কোথাও ধোঁয়া বা আগুন লাগার সংকেত পেয়ে এই ডিভাইস এলার্ম দিচ্ছে। চকিতে তাকালো সে চুলার দিকে। আলুর ডেকচিটার পানি শুকিয়ে গেছে। পোড়া লেগেছে পাতিলের নিচে। তড়িঘড়ি করে সে চুলা নিভালো।
ততক্ষণে মেশিনের বিপ বিপ থেমে গেছে। কিন্তু পোড়া একটা গন্ধ ছড়িয়ে গেছে ঘরময়। আরশান ঝেঁঝে উঠে বলল, ‘সিরিয়াসলি? আপনি চুলার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন আর দেখলেন না যে খাবার পুড়ে যাচ্ছে? থাকেন কোন ধ্যানে?’
সকালের মুখে তখনো আতঙ্ক। শুধু আতঙ্ক নয় তার চোখের কোল জুড়ে জলের ফোয়ারা। হাতে আধা-ছেলা পেঁয়াজ।
—‘কাঁদছেন কেন?’ আরশান বিস্মিত
সকাল বিব্রত ভাবে বলল, ‘কই, কাঁদছি না।’
আরশান ওর বিশেষ কায়দায় ঠোঁট বাঁকিয়ে কিছু একটা চিন্তা করলো কয়েক সেকেন্ডের জন্য। সকালের হাত থেকে ছোঁ মেরে পেঁয়াজটা নিয়ে বলল, ‘আমিতো দেখতে পাচ্ছি একটা মানুষ দুই চোখে পানির কল ছেড়ে রেখেছে। আমাকে দিন আমি কেটে দিচ্ছি। কান্নাকাটি বন্ধ করেন। কেউ দেখলে নাইন ওয়ান ওয়ানে কল করে দেবে নির্ঘাৎ। মনে করবে আমরা আপনাকে টর্চার করছি।’
সকাল পরনের ওড়না দিয়ে মুখ চোখ মুছে নিলো।
ধাক্কাটা সামলে উঠতে তার মিনিট দুয়েক সময় লাগলো। সত্যি এতো বেশি কেয়ারলেস হয়ে যাচ্ছে সে দিনকে দিন যে নিজের ওপর থেকে নিজের পুরো দমে আস্থা উঠে যাচ্ছে। চোখের সামনে আলুসহ পাতিল পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে অথচ সে টের পাচ্ছে না। অন্যমনস্কতার একটা সীমা আছে। ভাগ্যিস আরশান সময় মতো এসে পড়েছিল। সে কৃতজ্ঞতার চোখে আরশানের দিকে তাকালো একবার। আরশান মনোযোগ দিয়ে চপিং বোর্ডের ওপর পেঁয়াজ রেখে কুচি করছে ছুরি দিয়ে। সকাল ওর কাজের দক্ষতা দেখে বিস্মিত হয়ে গেলো। সত্যি বলতে ওদের বাড়ির কাজের বুয়াও এই কাজটা এতটা নিখুঁত ভাবে করতে পারে না। মানুষটার হাতে জাদু আছে। আর জাদুওয়ালা হাতগুলো বুঝি পৃথিবীর যে কোনো কাজকেই শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়। আরশান ত্যাড়া চোখে চাইলো সকালের দিকে, ‘এতো মুগ্ধ হয়ে কী দেখছেন?’
সকাল ভড়কানো গলায় বলল, ‘মুগ্ধ? মুগ্ধ হওয়ার কী আছে? আজাইরা কথা বলেন কেন?’
আরশান হাসে, ডাঁটিয়াল হাসি। বলে, ‘মুগ্ধ হওয়ার কী আছে তা আমি জানি না, তবে মেয়েরা হয় আর কি।’
–‘কী হয়?’
—‘মুগ্ধ!’
—‘নিজের সম্পর্কে একটু বেশি উঁচু ধারণা আপনার। কেউ আপনাকে দেখে মুগ্ধ হয় না। তালগাছের মতো লম্বা জ্বীনের মতো একটা মানুষ! তাকে দেখে আবার মুগ্ধ হবে মেয়েরা। শখ কত!’
ততক্ষণে পেঁয়াজ কাটা হয়ে গেছে। আরশান বলল, ‘আর কোনও হেল্প লাগবে?’
সকাল একটু চিন্তা করে নিয়ে বলল, ‘না থাক, বাকিটা আমি পারবো।’
—‘পারবেন তো?’ দ্বিধাগ্রস্থ গলায় প্রশ্ন করে আরশান।
সকাল কটমটিয়ে তাকায়, ‘না পারার কী আছে?’
—‘না আপনারা তো ফার্মের মুরগী। হয়তো রান্না করার অভ্যেস নেই। বাই দ্যা ওয়ে মাদার কোথায়?’
—‘উনি নিউইয়র্ক গেছেন। একটা কাজে। আর দেশে আমি রোজ রান্না করি।’
আরশান বাঁ কানটা সামনে এগিয়ে দিয়ে না শোনার ভান করে বলল, ‘কী? দেশে আপনি রোজ কান্না করেন?’
—‘রান্না করি। রান্না! কান্না করবো কেন?’
আরশান ঠোঁট উল্টে বলল, ‘ও আমি শুনেছি দেশে রোজ আপনি কান্না করেন। কারণ, রান্নার সাথে আপনার কান্না ফ্রি। আজ দেখলাম তো আপনার রান্না মানেই কান্না।’
সকাল ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘দেখুন আপনার জোকগুলো হয় না বুঝছেন? খুবই লেইম লাগে।’
—‘আমার জোক ঠিকই আছে। ঠিক নেই আপনার সেন্স অব হিউমার। যাই হোক, রান্নাকান্না করেন আপনি। আর দয়া করে আপনার ইমাজিনারি ওয়ার্ল্ডটা কাজের সময় একটু মাথা থেকে দূরে রাখুন। নইলে বিপদে পড়বেন।’
—‘অফিস যাননি কেন আজ?’
—‘শরীর ভালো লাগছিল না তাই।’
—‘আচ্ছা ফাঁকিবাজ তো আপনি!
আরশান হাসে। উত্তরে কিছু বলে না। সকাল বলল, ‘যাই হোক, দুপুরে আমাদের সাথে লাঞ্চ করুন।’
—‘মনে হয় না।’
—‘কেন?’
—‘কারণ গত রাতে আমি আপনাকে বলেছিলাম যে আপনি যেন আমাকে আর বিরক্ত না করেন। বারণ করেছিলাম। মনে আছে?’
—‘বারে! খাওয়ার দাওয়াত দিচ্ছি আর এটাকে আপনার বিরক্ত করা মনে হচ্ছে? আপনি আমাকে হেল্প করলেন বলেই বলছি। নইলে আপনাকে খাওয়ানোর জন্য আমি মরে যাচ্ছি না।’
—‘তা বুঝলাম। কিন্তু আপনার তো কোনো ঠিক নেই। দেখা গেলো আমি আসলাম, তারপর আপনি হঠাৎ বলে বসলেন চলে যান আমি আপনাকে খাওয়া দিবো না।’
সকাল আকাশ থেকে পড়ল, ‘এ মা! কী আজিব আমি কেন এমন অদ্ভুত আচরণ করবো?’
—‘আমারও একই প্রশ্ন। হঠাৎ হঠাৎ আপনার কী হয়?’
সকাল একটু অপ্রস্তুত ভাবে চুপ করে গেলো। খানিক বাদে বলল, ‘লাঞ্চের দাওয়াত রইল। আসলে খুশি হবো।’
—‘কয়টায় লাঞ্চ?’
—‘আজকে আপনাদের আমেরিকান নিয়ম চলবে না। এটা এখন বাংলাদেশ। লাঞ্চের কোনো ফিক্সড টাইম নাই। কয়টায় বলতে পারবো না। ঘণ্টা খানেক সময় লাগবে। হয়ে গেলে আমি আপনাকে ডেকে নিয়ে আসবো।’
আরশান আর কথা বাড়ালো না। ‘ওকে, সি ইউ সুন’ বলে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলো।
রান্না শেষ হতে পাক্কা এক ঘণ্টা সময় লাগলো। টেবিল সাজিয়ে চাচাকে যখন ডাকতে গেলো ঘড়িতে তখন দুপুর দুটো। চাচা গোসল সেরে বাথরুম ছেড়ে বেরিয়েছেন মাত্র। চাচাকে খবরটা দিয়ে সকাল আরশানকেও ‘আমি ডেকে আনলো। আরশান দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ভেবেছিলাম আজকে না খেয়েই থাকতে হবে। আমি বারোটায় লাঞ্চ করি।’
—‘একদিন নাহয় একটু দেরিতে খেলেন। কী এসে যায়?’
‘ভালো স্বাস্থ্যের প্রথম শর্ত হচ্ছে সময় মতো খাবার খাওয়া। অনিয়ম করা যাবে না।’
—‘আচ্ছা বাবা একদিন অনিয়ম করলে আপনার স্বাস্থ্যের তেমন কিছু ক্ষতি হবে না।’
খাবার টেবিলে চাচা আরশানকে দেখে খুব খুশি হলেন। দারুণ একটা হাসি দিয়ে তিনি বললেন, ‘আরে! তুমি অফিস যাওনি? এ সময় বাড়িতে কী করে?’
আরশান নিঃশব্দে হাসলো। কিছু বলল না। সকালের মনে হলো নিজের বাবার সামনে ওর হাসিটা যেন একটু অন্যরকম। উদ্ধত ভাবটা নেই বরং বিনয়ের ছাপ আছে। চেয়ারে বসলো ওরা বাবা ছেলে। সকাল পানির গ্লাস, জগ এগুলো এগিয়ে দিতে লাগলো। চাচা বললেন, ‘তুমিও বসো। অনেক কষ্ট করেছো। এখন একটু বসো তো মা।’
সকাল বসলো। চাচার পাশের চেয়ারে।
টেবিলে সাজানো আছে আলুর ভর্তা, ডাল আর মৃগেল মাছের তরকারি। সাথে সালাদ। আরশানের চেহারা দেখে মনে হলো খাবারের মেনু তার খুব একটা পছন্দ হয়নি। সে মুখ গোঁজ করে কিছুক্ষণ তরকারির বাটিগুলোর দিকে চেয়ে থেকে প্লেট, কাটাচামচ টেনে নিলো। দেখে সকাল খিল খিল করে হেসে উঠল। চাচার সামনেই।
বাপ ছেলে দুজনে ওর হাসি শুনে তাকালো ওর দিকে। আরশান ভু উঁচিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘হাসির কী আছে?’
সকাল হাসতে হাসতে চাচাকে বলল, ‘চাচা! আপনার ছেলে কাটা চামচ দিয়ে ডাল, ভাত খাবে? বাঙালির ছেলের এই দুরবস্থা?’
চাচাও হাসলেন, বললেন, ‘ওদের হাত দিয়ে খাওয়ার অভ্যাস চলে গেছে। ছেলে-মেয়েগুলো বিদেশিদের সাথে মেলামেশা করতে করতে নিজস্ব সংস্কৃতি বিসর্জন দিয়েছে।’
আরশান গম্ভীর গলায় বলল, ‘সংস্কৃতি বিসর্জন দেয়ার ব্যাপার না বাবা। অভ্যাস বলে কথা আর আমার তো ভাত খাওয়াই হয় খুব কম।
সকাল বলল, ‘ওসব অভ্যাস-টভ্যাস বুঝি না। আজকে সবাই হাত দিয়ে খাবে।’ বলেই সে আরশানের সামনে থেকে ছুরি, কাটাচামচ সরিয়ে নিলো। আরশান তেরছাভাবে তাকালো সকালের দিকে, বলল, ‘এটার মানে কী?’
—‘মানে হাত ধুয়ে আসুন। মাছ ভাত খাবেন তো বাঙালির মতো খান। সাহেব গিরি ছাড়েন।’ বিরক্ত আরশান বাবার দিকে তাকিয়ে দেখলো বাবা মিটমিট করে হাসছেন। বাবার সম্মানেই আর কোনো কথা না বাড়িয়ে সকালের দিকে একটা গিলে খাবার মতো ভয়ঙ্কর দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে সে হাত ধুতে গেলো। সকাল চাচার প্লেটে ভাত তুলে দিতে দিতে বলল ‘রাগ করলো নাকি?’
—‘আর রাগ! ওর স্বভাবটা একটু খটোমটো ধরনের। তুমি মাইন্ড করো না।’
আরশান হাত ধুয়ে এসে ফুল হাত শার্টের হাতা গুটিয়ে নিয়ে বসলো। সকাল ওর পাতে খাবার বেড়ে দিলো। চাচা বললেন, ‘আরশান তোমার সাথে আমি অনেকবার তোমার ফারুক চাচার গল্প করেছি। মনে আছে?’
আরশানের মনে করতে খুব বেশি সময় লাগলো না। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠল, ‘হ্যাঁ মনে আছে তো। আপনার কলেজ লাইফের ফ্রেন্ড।’
—‘সকাল কিন্তু তোমার ফারুক চাচার মেয়ে।’
শুনে আরশান চমকপ্রদ গলায় ‘ওয়াও। তাই নাকি?’ বলে সকালের দিকে তাকালো। যেন নতুনভাবে আরেকবার আবিষ্কারের চেষ্টা করলো তাকে।
—‘আপনি আমার বাবাকে চেনেন?’ সকালের প্রশ্ন।
—‘চিনি বলতে সামনা-সামনি কখনও দেখা হয়নি। তবে অনেক গল্প শুনেছি বাবার কাছ থেকে।’
চাচা সকালকে বললেন, ‘আরশানের জন্মের পর থেকেই তোমার বাবার সাথে যোগাযোগটা একটু আলগা হয়ে গেলো। তোমার বাবা সরকারি চাকরি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। আমিও আমেরিকা এসে জীবন যুদ্ধে রত হয়ে গেলাম। দুই বন্ধুতে দেখা হলো এই এতো বছর পর। তবে যোগাযোগ না থাকলেও আমাদের মনের টানটা কিন্তু ঠিকই রয়ে গিয়েছিল।’
একটু থেমে চাচা আবার বললেন, ‘তোমার রান্না তো মা দারুণ! মনে হচ্ছে অনেক দিন পর সত্যিকারের দেশি রান্না খাচ্ছি। তোমার চাচির রান্না এখন হয়ে গেছে ফিউশন বুঝলে। ঝাল-টাল দেয়া সে ভুলেই গেছে।’
ওদিকে আরশানকে দেখে মনে হচ্ছে হাত দিয়ে ভাত খাওয়ার মতো জটিল এবং গোলমেলে কাজ এ পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। তার চেহারায় বিপন্ন ভাব। অনেক কষ্টে দু এক লোকমা ভাত ভর্তা দিয়ে মেখে সে মুখে দিলো। দিতেই নাক মুখ লাল টুকটুকে হয়ে গেলো। মুখ দিয়ে হু হা করে নিশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে সে চোখ পাকিয়ে সকালকে বলল, ‘আপনি কি পাগল? এতো ঝাল দেয় কেউ খাবারে? মরিচের ফ্যাক্টরী খুলেছেন নাকি?’
সকাল হেসে ফেললো। ঠোঁট চেপে কোনো রকমে হাসি থামিয়ে সে বলল, ‘কাঁদছেন নাকি?’
আরশানের চোখের লম্বা পাপড়ি জোড়ায় সত্যিই দু’ এক ফোঁটা জল চিক চিক করছিল। ঢক করে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি গলায় ঢেলে দিয়ে সে রাগে ফেটে পড়ে বলল, ‘দিস ইজ ইনসেইন! বাবা আপনি খাচ্ছেন কিভাবে? খেয়েন না এসব, মরে যাবেন।’
রহমান সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, ‘ভর্তাটা বাদ দিয়ে শুধু ডাল দিয়ে মেখে খাও। মাছ তুলে খাও। অত ঝাল লাগবে না।’
সকাল রান্নাঘরের ক্যাবিনেট খুলে চিনির কৌটা নিয়ে এসে বলল, ‘নিন চিনি খান।’
পূর্ণ বয়স্ক একজন মানুষকে চিমটি পরিমাণ ঝাল খেয়ে এরকম ডাঙায় তোলা মাছের মতো কাতরাতে দেখে তার বিস্ময়ের সীমা রইল না। ধীরে ধীর তার ঠোঁট থেকে হাসির রেখা মুছে গেলো। আজ পর্যন্ত তার রান্না খেয়ে কেউ এতটা অসন্তুষ্ট হয়নি। এই প্রথম কেউ তার রান্নার এমন দুর্নাম করলো। সে নিস্তেজ গলায় বলল, ‘সরি, আমি আসলে বুঝিনি যে আপনার এতটা খারাপ লাগবে।’
রহমান সাহেব ছেলের প্লেটে এক চামচ ডাল আর ঝোল ছাড়া শুকনো মাছ তুলে দিয়ে বললেন, ‘এটা খাও। ঝাল লাগবে না।’
আরশান বাধ্য ছেলের মতো ভাত টুকু খাওয়ার চেষ্টা করলো। তার চোখজোড়া তখনও লাল।
কিছুক্ষণ পর সে সকালের দিকে আড়চোখে চেয়ে বলল, ‘মাছটা খেতে ভালো হয়েছে। খাওয়া যায়।’
সকাল বুঝলো এই প্রশংসাটুকু ভদ্রতার খাতিরেই করা। ছেলে ভোলানো কথা বার্তা।
রহমান সাহেব বোধ করি সকালের মনের অবস্থা কিছুটা আঁচ করতে পেরেই বেশ জোর গলায় বললেন, ‘মাছটা খেতে খুবই ভালো হয়েছে। অনেক দিন বাদে আমি এমন স্বাদের রান্না খেলাম। আরশানের মা একদম এরকম রান্না করতেন। সেই স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে।’
শেষের কথাটা তিনি অসাবধানতাবশত বলে ফেললেন। মুখ দিয়ে পিছলে বের হয়ে আসলো যেন কথাগুলো। বলেই ভীষণ বেকায়দায় পড়লেন। আরশান একটা হিম শীতল দৃষ্টি দিলো বাবার দিকে। তার মায়ের কথা এ বাড়িতে কেউ বলে না। আরশান চায় না কেউ বলুক। বাবা তাকে একা পেলে মাঝে মাঝে অতিরিক্ত আবেগ থেকে পুরনো কিছু স্মৃতি চারণ করে ফেলেন অবশ্য। কিন্তু আরশান ভাবে সাবে বুঝিয়ে দিয়েছে যে পিতার জীবনের ঐ অধ্যায়টুকু নিয়ে তার কোনো আগ্রহ নেই, বরং বিরক্তি আছে।
রহমান সাহেব পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য প্রসঙ্গ পাল্টালেন, ‘তো আজকে করছ কী? সারাদিন বাড়িতেই থাকবে?’
আরশান ঘাড় ঘুরিয়ে জানালার বাইরেটা একবার দেখে নিয়ে বলল, ‘বিকেলে ওয়েদার ভালো থাকবে। ভাবছি বেরোবো।’
—‘কোন দিকে যাবে?’
—‘দেখি বাবা, ফিশিং করতে যেতে পারি। সামার তো প্রায় শেষ হয়ে আসলো। এখন না গেলে আর হবেই না এ বছর।’
রহমান সাহেব সকালকে ইঙ্গিত করে বললেন, ‘তা যাচ্ছ যখন মেয়েটাকেও নিয়ে যাও না। বেচারি বেড়াতে এসে ঘরবন্দি হয়ে পড়ে আছে।’
সকাল মুখে ভাতের লোকমা তুলছিল। কথাটা কানে যেতে তার বুক ধক করে উঠল। আঙুলের ফাক গলে পাতে পড়ে গেলো কয়েক দানা ভাত। অপ্রস্তুত হয়ে সে চোখ তুলে তাকালো আরশানের দিকে। আরশান ভু উঁচিয়ে ওর স্বভাবসুলভ গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলো, ‘আপনি যাবেন?’
সকাল অস্বস্তিতে কাদা হয়ে গেলো। সে জানে না উত্তরে কী বলবে।
চাচা বাঁচিয়ে দিলেন ওকে। বললেন, ‘আরে যাবে যাবে। ওর আর কাজ কী। বাড়িতে বসে থাকবে নাকি সারাদিন?
আরশান বলল, ‘ওকে, রেডি থাকবেন তাহলে। আমি এইতো চারটার দিকেই বেরোবো।’
সকাল অবনত মুখে ভারি ক্ষীণ গলায় উত্তর দিলো, ‘ঠিক আছে।’
নিজের ঘরে এসে দৌড় দিয়ে সকাল আয়নার সামনে দাড়ালো। মানুষের মন বড়ই বিচিত্র। কখন কী কারণে কীসের ঘনঘটা যে চলে ওই মন নামের বিচিত্র চরাচরে তা ঠাওর করে ওঠা মুশকিল। পৃথিবী আর মহাকাশের সমস্ত রহস্য সমাধান করে ফেলার পরেও মানুষ তার মনোজগতের রহস্যের কোনো কূলকিনারা পাবেনা। মানুষের মন এক অতি আশ্চর্য সৃষ্টি বিধাতার।
এই মুহূর্তে তার এতো বেশি আনন্দ হচ্ছে যে মনে হচ্ছে বেঁচে থাকার চেয়ে সুন্দর আর কিছুই হতে পারে না। একটা অবাধ্য, তারছেঁড়া, পাগলপারা সুখের প্লাবন বইছে মনের আনাচে-কানাচে। নিজের ছেলে- মানুষীতে নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছে।
খুশিতে বানভাসি হয়ে সে সুটকেস থেকে কাপড়চোপড় সব বের করে, মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে হুলুস্থুল কাণ্ড করে ফেললো। কিন্তু কিছুতেই সিদ্ধান্ত নিতে পারলো না যে ঠিক কোন জামাটা পরা উচিত। কিভাবে সাজা উচিত। হন্যে হয়ে সে নাবিলাকে ফোন দিলো।
এক দুটা রিং পড়তেই নাবিলা ফোন ধরলো।
—‘কীরে কী খবর?’
সকাল দম বন্ধ করা খুশি নিয়ে বলল, ‘দোস্ত, আজকে আমি ওর সাথে প্রথমবার বের হচ্ছি। আমি জানি না আমি কিভাবে রেডি হবো, প্লিজ হেল্প কর।’
নাবিলা কথা শুনে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো, ‘তোর কী হয়েছে?’
—‘কী হবে আবার?
—‘এতো খুশি কেন?’
—‘খুশিতে মরে যাচ্ছি দোস্ত। বললাম তো বের হচ্ছি ওর সাথে। ফর দ্যা ফার্স্ট টাইম।’
—‘মোটেও ফার্স্ট টাইম না, সেদিনই তুই ডিসি গিয়েছিস তোর ফিয়ান্সের সাথে।’
সকাল বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘আমি ফাহাদের কথা বলছি না।’
—‘তাহলে কার কথা বলছিস?’ নাবিলা বিস্মিত।
—‘আমি বলছি আরশানের কথা।’
—‘হ্যাংগ অন। তুই আসলে করছিস কী? লাইন মারতে চাচ্ছিস কার সাথে? ছোটজন নাকি বড়জন?’
প্রশ্ন শুনে সকাল একটু থমকালো। অপরাধী গলায় বলল, ‘দোস্ত ফাহাদের জন্য তো আমি কিছু ফিল করতে পারছি না, তুই এটা জানিস।’
—‘ওকে, তাহলে এই দুনিয়ায় শেষমেশ তুমি অন্তত একটা মানুষের জন্য কিছু ফিল করতে পারছ, তাই না শেহজাদী? আর সেই মানুষটা আরশান?’
সকাল চুপ করে রইল। নাবিলা হঠাৎ শব্দ করে হেসে উঠে বলল, ‘ওয়াও। ফাইনালি তুমি তোমার প্রিন্স চার্মিং পেয়েই গেলে প্রিন্সেস! জোশ তো! আমি প্রথম দিনই তোমার চেহারা দেখে বুঝছি।’
সকাল একটু লাজুক গলায় বলল, ‘আরে ধুর, আমি পছন্দ করলেই কি হবে? ওর ও তো আমাকে পছন্দ করতে হবে। আর তাছাড়া ঝামেলা অনেক। ছোট ভাইকে বিয়ে করতে এসে বড় ভাইয়ের প্রেমে পড়ে গেছি এটা আমি কিভাবে বলবো মানুষকে? এটা কি সম্ভব? এছাড়াও আরো ঝামেলা আছে। ঐ ব্যাটার গার্লফ্রেন্ড আছে।’
—‘আরে ধুর গার্লফ্রেন্ড কোনো সমস্যাই না।’
—‘জানি না নাবিলা। কিচ্ছু মাথায় ঢুকছে না। এখন তুই আমাকে বল যে আমি কী পরব? কিভাবে রেডি হব। প্লিজ হেল্প মি!’
—‘যাচ্ছিস কোথায়?’
—‘জানি না, বলল মাছ ধরতে যাবে।’
নাবিলা ওপাশ থেকে খিল খিল করে হেসে উঠল। বলল, ‘জীবনে প্রথম শুনলাম যে মানুষ ডেটে গিয়ে মাছ ধরে।’
—‘ইটস নট আ ডেট!’
—‘হোয়াটেভার। দেখি ভিডিও কল দে। কী কী জামা কাপড় আনছিস দেখা।’
সকাল ভিডিও কল করলো নাবিলাকে। ফোনের পর্দায় নাবিলার মুখটা ভেসে উঠতেই দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে বলল,
—‘নাবিলা আমার জান! তুই এমন কিছু করে দে, যেন ও আমাকে দেখামাত্র পাগল হয়ে যায়।’
—‘পাগল তো তুই হয়ে গেছিস।’
—‘আমি শেষ!’
নাবিলা হেসে কুটি কুটি হয়ে গেলো, ‘এক কাজ কর আজকে প্রপোজ করে ফেল।’
সকাল জিব কেটে বলল, ‘এই কাজটা আমি জীবনেও করতে পারবো না। মরে গেলেও না। নেভার এভার!’
—‘এতো ইগো থাকলে সমস্যা।’
—‘জানি সমস্যা। কিন্তু কিছু করার নাই। আমি জীবনেও কিছু বলবো না।’
—‘আচ্ছা ব্ল্যাক ড্রেসটা মেলে ধর তো দেখি।’
—‘আমার একটা ভালো ঢঙের ড্রেস নাই জানিস? এতো বিরক্ত লাগছে!’ বলতে বলতে কালো একটা গাউন মেলে ধরলো সকাল ক্যামেরার সামনে। নাবিলা বলল, ‘এটার তো গলা অনেক বড়। তুমি কি প্রথম দিনই ওকে তোমার ক্লিভেজ দেখাইতে চাও শেহজাদী?’
সকাল তেড়ে উঠে বলল, ‘হেল নো! ফাজিল কথা বলিস না! ফাজিল মেয়ে।’
নাবিলা খিকখিক করে হাসে। সকাল চোখ পাকিয়ে বলে, ‘মজা নিচ্ছো, না?’
নাবিলা হাসি থামিয়ে কোনো রকমে বলল,’ না না মজা নিব কেন? আচ্ছা বলো, তুমি কি আজকে হট হইতে চাও নাকি সুন্দর হইতে চাও।’
সকাল দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘তুমি মজা নেয়া বন্ধ করো!’
—‘আরে সিরিয়াসলি!’
সকাল নাবিলার কথার উত্তর না দিয়ে একটা নীল জর্জেট কাপড়ের টপ নিজের সামনে ধরে বলল, ‘এটা কেমন?’
—‘পরে আয় তো! দেখি।’
ওয়াশরুমে গিয়ে জামাটা গায়ে দিয়ে আসলো সকাল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঘুরে ঘুরে নিজেকে দেখতে দেখতে ভারি আফসোসের গলায় বলল, ‘আমি অনেক মোটা হয়ে গেছি দোস্ত! আমাকে ওয়ার্ক আউট করতে হবে। ও কি ভীষণ ফিট জানিস? কত হেলথ কনশাস? আর আমার আরো একটু লম্বা হওয়া দরকার ছিল। আমি ফাইভ ফোর। আর দুই তিন ইঞ্চি লম্বা হইলে …’
নাবিলা এবার ফোনের ওপাশ থেকে খ্যাক দিয়ে উঠল, ‘সকাল শোন, তুই একটা থাপ্পড় খাবি। তুই যেমন আছিস যথেষ্ট ঠিক আছিস। সুন্দর আছিস। কেউ তোকে পছন্দ করলে এভাবেই করবে। নিজেকে বদলাবার কথা ভুলেও মাথায় আনবি না। আর মোটেও তুমি মোটা হওনাই। যেমন আছ একদম পারফেক্ট আছো। বি কনফিডেন্ট।’
সকাল কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ‘কী করতে বলছিস?’
—‘বললাম তো আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনো। লিসেন টু মি। টেক আ ডিপ ব্রেথ।’
সকাল নাবিলার কথা মতো একটা দীর্ঘ নিশ্বাস নিলো, সময় নিয়ে।
—‘হ্যাঁ, গুড গার্ল। এবার শোনো, তোমার এই জামাটা একদম ঠিক আছে। এটাই পরো। আর জাস্ট মেক আপটা ঠিক মতো করো। ন্যাচারাল মেকআপ। ম্যাট কিছু করো। অনেক সুন্দর লাগবে। আর তোমার প্রীতি জিনতা মার্কা হাসিটা দিবা, এমনিতেই ঘায়েল হয়ে যাবে। বুঝছ?’
ঠিক বিকেল চারটায় সকালের দরজায় করাঘাত পড়ল। সকাল লাফ দিয়ে উঠে নাবিলাকে বলল, ‘মনে হয় ও আসছে।’
—‘আচ্ছা শোন। ট্রাই টু বিহেভ নরমাল। দয়া করে ফ্রিক আউট কইরো না। অল দ্যা বেস্ট।
দরজা খুলে দেখা গেলো আরশান দাঁড়িয়ে আছে। তার পরনে হাফ প্যান্ট এবং ছাইরঙা টি শার্ট। প্রথমেই সে সকালকে জহুরি চোখে আগাগোড়া একবার দেখে নিলো। সকালের খোলা চুল, ব্লু টপ, ব্ল্যাক প্যান্ট, পায়ে বাদামি বুট। সব দেখে নিয়ে তার চোখজোড়া এসে নিবদ্ধ হলো গাঢ় লাল লিপস্টিক দেয়া সুন্দর নিখুঁত ঠোঁটদুটোতে। অস্ফুটে বলে ফেললো, ‘বাপরে বাপ!’
—‘কী বললেন?’ সকাল ভ্রু কুটি করে প্রশ্ন করল।
আরশান ঠোঁট বাঁকা করে কিছু একটা চিন্তা করলো। তারপর নিজের খোঁচা-খোঁচা দাড়িওয়ালা চিবুকটা হাতড়ে নিয়ে গম্ভীর গলায় বলে, ‘না মানে …কিছু না।’
—‘কিছু না বলছেন কেন? কিছু তো বললেন শুনতে পেলাম।’
—‘শুনতেই যদি পেয়েছেন তবে প্রশ্ন করছেন কেন? শুনেই তো ফেলেছেন।’
সকাল মুখ গোঁজ করে বলল, ‘বাপরে বাপ বললেন কেন?’
আরশান আরেকবার সকালকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলল, ‘আপনি কি রেডি?’
—‘কেন? আপনি বেরোচ্ছেন?’
—‘হ্যাঁ। যদি আপনার সাজগোজ কমপ্লিট হয়ে যায়। তাহলে আমরা এখন স্টার্ট করতে পারি। বাই দ্যা ওয়ে, আপনি জানেন তো না? যে আমরা কোথায় যাচ্ছি?’
—‘কোথায় যাচ্ছি?’
—‘মাছ ধরতে। পার্টিতে না।’
সকাল খোঁচাটা বুঝতে পেরে সামলে নিলো নিজেকে। অর্থাৎ শয়তানটা বলতে চাইছে সকাল পার্টিতে যাবার মতো জাঁকজমক করে সেজেছে। এই জন্যেই দেখা মাত্র বাপরে বাপ বলে বিস্ময় প্রকাশ করেছে। রাগ চাপানোর জন্য সময় নিয়ে একটা নিশ্বাস নিলো সে। তারপর মুখে একটু ড্যাম কেয়ার ভাব আনার চেষ্টা করে বলল, ‘ওয়েল। আমার একটা পার্টি আছে রাতে।’
—‘ও! তাই নাকি?
মিথ্যে বলার অভ্যাস নেই সকালের। ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে সে চোখ নিচের দিকে নামিয়ে দরজা থেকে একটু সরে আসলো। ঘরের ভেতর কাপড়-চোপড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বিছানার ওপর এলোমেলো ভাবে রাখা মেক আপের সরঞ্জাম। আরশান উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখছিল ঘরটা। সকাল একটু ধমকে উঠে বলল, ‘মেয়েদের ঘরে উঁকি দিতে হয় না। আক্কেল নাই আপনার?’
আরশান ধমক খেয়ে ঘাড় সোজা করে বলল, ‘তা আপনার পার্টি কখন?’
—‘রাতে।’ চোখ লুকিয়ে বলে সকাল। নিজের বোকামির মাশুল দিতে গিয়ে এই মিথ্যের আশ্রয় নিতে হচ্ছে। কোন কুক্ষণে যে সে অত সাজগোজ করতে গিয়েছিল আল্লাহ জানে। রাগে দুঃখে অপমানে এখন চোখে জল নেমে আসতে চাইছে। এই বদ ছেলেটার জন্য কিছু করতে যাওয়াই তার ভুল হয়েছে। দুপুরে এতো যত্ন করে রান্না করলো। খেয়ে এমন কীর্তন করলো যেন খাবার নয়, বিষ তুলে দেয়া হয়েছে তার মুখে। এখন আবার ভাবটা এমন দেখানো হচ্ছে যেন সকাল রং মেখে সং সেজে ফেলেছে। ফালতু একটা।
—‘কোথায়?’
—‘তা দিয়ে আপনার কী?’ দাঁত কিড়মিড় করে বলল সকাল।
—‘না মানে, এড্রেস জানা থাকলে আমি হয়তো আপনাকে ড্রপ করতে পারবো।’
—‘লাগবেনা।’
—‘ও আচ্ছা।’ বলে আরশান চুপ করে যায়। ঠোঁট বাঁকিয়ে, চোখ ঘুরিয়ে, আপন মনে কী যেন ভাবতে থাকে। সকাল দাঁড়িয়ে থাকে কাঁচুমাচু হয়ে। কী বলবে খুঁজে পায় না। নিজের ওপর রাগ লাগতে থাকে তার।
একটা সময় আরশানই কথা বলল, ‘তো আপনি কি যাবেন আমার সাথে?’
শয়তান মিনসে কোথাকার! তোমার সাথে যাওয়ার জন্যই তো এত কায়দা করে রেডি হলাম। এখন এই ঢঙের প্রশ্নের মানে কী? মনে মনে বলল সকাল। আর মুখে বলল, ‘হ্যাঁ যাওয়া যায়।’
শুনে আরশান শ্রাগ করে বলে, ‘ওকে, দেন লেটস গো!’
আকাশের মেঘ কেটে গেছে। বাইরে চিক চিক করছে কাচরঙা রোদ্দুর। আকাশ কী সুন্দর আশ্চর্য নীল!
আরশানের কালো টয়োটা কনভার্টিবল গ্যারাজের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। গাড়ির কাছাকাছি আরশানই আগে পৌঁছুলো। ড্রাইভিং সিটের পাশের দরজাটি এক হাত দিয়ে খুলে রেখে সকালের জন্য দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো সে। সকাল ভেতরে উঠে বসার পর অতি বিনয়ের সাথে দরজা বন্ধ করলো। তারপর ঘুরে এসে বসলো নিজের জায়গায়। বসে সিট বেল্ট বেঁধে নিয়ে স্টার্ট দেবার আগে সকালের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে সুন্দর হাসলো সে। তার চোখে নীল রঙের রোদ চশমা। চিবুকের কাছটায় আর গালে একটু একটু দাড়ি। চুল আঁচড়ানোর ঢংটা আজ একটু অন্যরকম। জেল- টেল দিয়েছে মনে হয়। সকাল চোরা চোখে ওকেই দেখছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে আচমকা ওই মাদক মাদক হাসিটা দেখে সে একটা হার্ট বিট স্কিপ করে গেলো। অপ্রস্তুত হয়ে সরিয়ে নিলো চোখ। তার কেমন বুক ধড়ফড় করছে। কপাল ঘামছে। আচ্ছা যন্ত্রণায় পড়া গেলো তো!
গাড়ি রাস্তায় ওঠার পর আরশান সহজ গলায় বলল, ‘আপনি ঠিক আছেন?’
—‘ঠিক থাকবো না কেন?’
—‘না মানে, কোনো সমস্যা হলে বলবেন।’
সকাল অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘সমস্যা হবে কেন?’
—‘হওয়াটাই স্বাভাবিক, আপনি তো সমস্যার রাণী।’
সকাল কড়া চোখে তাকালো একবার আরশানের দিকে
—‘আমরা কোথায় যাচ্ছি?’
—‘কাছাকাছি একটা লেক-এ। আপনি এর আগে কখনো মাছ ধরেছেন?’
—‘না।’
‘কখনও না?’
রোদ ভালোই উঠেছে। সকাল ব্যাগ থেকে সানগ্লাস বের করে নিয়ে চোখে পরলো। শুকনো গলায় বলল, ‘না।’
আরশান কথাটা শুনে ওর দিকে এমন ভাবে তাকালো যেন মাছ ধরার অভিজ্ঞতা না থাকাটা অত্যন্ত বিস্ময়কর একটি ব্যাপার।
—‘এভাবে তাকাচ্ছেন কেন? মাছ ধরতেই হবে এমন তো কোনো কথা নেই তাই না? আর আমরা থাকি ঢাকা শহরে ঠিক আছে? ঢাকা শহর হচ্ছে একটা রাজধানী। আপনাদের এই স্প্রিংফিল্ডের মতো গ্রাম এলাকা না। শহর মানে বোঝেন? শহরে মাছ টাছ ধরার জায়গা নেই।
অনেকগুলো কথা একসাথে বলে থামলো সকাল। আরশান ওর কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনে টুনে চোখ বড় বড় করে বলল,
—‘ঢাকায় থাকেন মানে কী? আপনারা কি ঢাকাইয়া? মানে আপনার গ্রামের বাড়ি নেই?’
—‘নেই’ সকাল গম গম করে উত্তর দেয়। বিরক্ত লাগছিল তার এই প্রশ্নোত্তর পর্বটা।
—‘ও মানে আপনারা হচ্ছেন কুট্টি। মানে ঢাকাইয়া। ও … আই সি!’ বলে আরশান ঘাড় ঘুরিয়ে সকালকে দেখে। মুখে ওই ডাঁটিয়াল হাসিটা টেনে এনে বলে, ‘পারেন নাকি?’
—‘কী?’
—‘ঢাকাইয়া ভাষা?’
সকাল চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি কি আমাকে অপমান করতে চাইছেন?’
আরশান বিস্মিত হবার ভান করে বলল, ‘অপমানের কী আছে? আপনার ভাষা আপনি বলতে পারবেন এটাই তো স্বাভাবিক তাই না? নিজের সংস্কৃতিকে এত ঘেন্না?’
সকাল দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘আপনি একটু চুপ করুন তো। আপনাকে আমার অসহ্য লাগছে।
আরশান ঠোঁট উল্টে বলল, ‘আজব! আপনি… মানে আমি আসলে বুঝি না যে আপনার প্রব্লেমটা কোন জায়গায়।
তারপর একটু থেমে বলে, ‘আচ্ছা, ঢাকায় আপনি কী করেন?’
—‘পড়াশো না।’
—‘কোথায় পড়ছেন?’
—‘এমবিএ করছি, ডি ইউ তে।’
—‘গুড গুড! এরপর কী করার ইচ্ছা?’
—‘জানি না।’
—‘হুম, জব মার্কেট কেমন এখন দেশে?’
—‘ভালো না।’
—‘আপনি চাকরি করবেন না?’
—‘জানি না। করতে পারি নাও করতে পারি।’
—‘ও আপনি তো আবার প্রিন্সেস। প্রিন্সেসদের কি চাকরি করা মানায়?’
—‘ঠিক বলেছেন।’
—‘আপনার মুড অফ নাকি?’
—‘হ্যাঁ।’
—‘কেন?’
—‘কারণ আপনি বেশি কথা বলছেন।’
আরশান এবার একটু গম্ভীর হয়ে বলল, ‘কথা না বলে যদি চুপচাপ বসেই থাকবেন তাহলে আসলেন কেন? বাড়িতেই থাকতেন।
—‘আমি এসেছি আশপাশটা দেখতে। আপনার সাথে কথা বলতে নয়।’
—‘ও আচ্ছা। ঠিক আছে।’
বলে সে কিছুক্ষণ স্টিয়ারিং এ হাতের আঙুল নাচিয়ে তবলা বাজালো। তারপর হাত বাড়িয়ে একটা সুইচ চাপতেই গাড়ির ছাদ ফরফর করে ম্যাজিকের মতো খুলে গেলো। একরাশ মিঠা রোদ আর রেশমি হাওয়া লাফ দিয়ে এসে পড়ল ওদের গায়ের ওপর। সকালের মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসলো শব্দটা, ‘ওয়াও!’
দুপাশে হলদে রোদে ডোবা বন-বনানী ফেলে রেখে রূপো রঙের পরিষ্কার রাস্তা দিয়ে ঘণ্টায় আশি মাইল স্পিড তুলে ছুটতে লাগলো গাড়িটা। মাথার ওপর পরিষ্কার নীল আকাশ। তার মধ্যিখানে পালতোলা নৌকোর মতো ভাসছে সাদা মেঘ।
হাওয়ায় সকালের খোলা চুল উড়ছে। গতি বাড়ছে। ভালো লাগছে। ভালো লাগার সাথে সাথে ভয়ও লাগছে। গাড়ির গতি অত্যধিক বেশি। আশেপাশের সব গুলো গাড়িকে পেছনে ফেলে তাদেরটাই তীরের বেগে ছুটছে হাওয়া কেটে কেটে। বাতাসের তোড়ে নিশ্বাস নেয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে।
—‘একটু আস্তে চালান। পুলিশ ধরবে আপনাকে।’ না পেরে বলেই ফেললো সকাল।
আরশান কোনো উত্তর দিলো না। তার চোয়াল শক্ত, রোদ চশমার আড়ালে চোখের চাউনি শক্ত। মনে হলো সকালের বলা কথার জবাবে চলার গতি আরেকটু বাড়িয়ে দিলো।
—‘রাগ করলেন নাকি?’ সকাল প্রশ্ন করলো ভয়ে ভয়ে।
—‘শুনুন, ফালতু ব্যাপার স্যাপার নিয়ে রাগ করার মতো সময় আমার নেই।’
—‘না বলছিলাম যে এতো জোরে গাড়ি চালাচ্ছেন, পুলিশ ধরবে না?’
—‘ধরলে ধরুক। কী আর হবে? টিকেট খাবো।’
—‘টিকেট খেতে কোনো অসুবিধা নেই আপনার?’
—‘নাহ! কী অসুবিধা? টিকেট কি প্রতিদিন খাই নাকি? অনেক দিন পর পর খেলে ভালোই লাগে। সুস্বাদু মনে হয়।’
—‘আপনার ছোট ভাই কিন্তু অনেক ভালো গাড়ি চালায়।’
আরশান ঘুরে তাকালো, ‘ফাহাদের কথা বলছেন?’
—‘কয়টা ভাই আছে আপনার?’
—‘হুম। ভালো গাড়ি চালায় বলতে কী বোঝাচ্ছেন আপনি?’
—‘মানে এমন মহিষের মতো দৌড়ায় না। ধীরে ধীরে শান্ত ভাবে চালায়।’
—‘মহিষ কিভাবে দৌড়ায়?’ আরশান অবাক।
—‘আপনার মতো।’
—‘স্ট্রেঞ্জ!’
বাকি পথটা আর কেউ কোনো কথা বলল না। সকালের জীবনে এই প্রথম হুড ছাড়া গাড়িতে চড়া। তার ভালো লাগছিল। কথা না বলা মনোযোগী, সিরিয়াস আরশানকে চোখের কোণ দিয়ে দেখতে আরো বেশি ভালো লাগছিল। কথা বললেই ছেলেটা এমন ক্যাট ক্যাট শুরু করে যে মাথার ভেতর সব একদম তাল গোল পাকিয়ে দেয়। সব এলোমেলো করে দেয়। এর চেয়ে কথা না বলে চুপ করে চেয়ে থাকাই ঢের ভালো।
বার্ক লেকের পার্কিং এ গাড়ি রেখে আরশান ব্যাক ডালা থেকে মাছ ধরার বড়শি বের করে নিলো। সাথে একটা ছোট কৌটা আর খালি বালতি। তারপর একবারও পেছন ফিরে না তাকিয়ে ঢুকে গেলো সবুজ গাছের ছাউনি ওয়ালা পার্ক ওয়ের ভেতরে। সকাল ছুটলো ওর পেছন পেছন
সারি সারি জংলা গাছের মধ্যিখানে চমৎকার লাল মাটির বনপথ। ওয়ার্কিং-ডে বলে খুব একটা মানুষ নেই আজ। কয়েকটা কম বয়সী ছেলে- মেয়ে দলবদ্ধভাবে দৌড়চ্ছে। তাদের গায়ে একই ধরনের, একই রঙের পোশাক। বোঝা যায় আশেপাশের কোনো বিদ্যাপীঠ থেকে একত্রে এসেছে ওরা। হয়তো স্কুল থেকে কোনো খেলার আয়োজন করা হয়েছে। আমেরিকানরা হাত দিয়ে অদ্ভুত কায়দায় যে বল খেলাটা খেলে তাকে বলে ফুটবল। যে খেলায় পায়ের কোনো ভূমিকা নেই সেই খেলাকে কেন ফুটবল বলা হবে এটা সকালের মাথায় ঢোকে না। সে গট গট করে হাঁটতে থাকা আরশানকে পেছন থেকে ডেকে বলল,’ শুনুন আপনারা আমেরিকানরা যে ফুটবল গেমটা খেলেন ওটা তো পা দিয়ে নয় হাত দিয়ে খেলে তাই না? তবে কোন যুক্তিতে এটাকে ফুটবল বলা হয়?’
আরশান হাঁটা বন্ধ করলোনা। সকালের দিকে ঘুরে গিয়ে উল্টোভাবে পা চালাতে চালাতে বলল, ‘আমি আমেরিকান এটা আপনাকে কে বলেছে?’
—‘আপনি আমেরিকান না? তাহলে কী আপনি?’
আরশান আবার ঘুরে গেলো সামনে। এবার সোজা হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘আমি পৃথিবীর অধিবাসী।’
সকাল একটু শব্দ করেই হেসে উঠল।
—‘হাসছেন কেন?’
—‘হাসছি কারণ কথাটা আপনি ভালো বলেছেন। আমেরিকান পাসপোর্ট থাকলে মানুষ একরকম পৃথিবীর অধিবাসীই হয়ে যায়।’
—‘এখানকার ফুটবল মানে এই না যে আপনাকে পা দিয়ে কিক করতে হবে। এটাকে ফুটবল বলা হয় কারণ, যে বলটা দিয়ে খেলা হয় তার দৈর্ঘ এক ফুট।’
বলতে বলতে আরশান অনেকখানি এগিয়ে চলে গেছে। শেষের কথাগুলো ঠিকমতো কানে আসলো না সকালের। বনপথের দুপাশে কত রকমের গাছ! কোনোটা লম্বা হয়ে উঠে গেছে সবুজ পতাকার মতো আকাশের দিকে। কোনওটা ঝাঁকড়া মাথা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভাস্কর্যের মতোন। কোনো কোনো আগাছার গায়ে নানা রঙের বুনো ফুল। গাছের ডালের ফাঁকে ফাঁকে ঝিলমিল করছে রোদ। হাওয়া চলছে, পাতা নড়ছে, চলছে আলো ছায়ার খেলা। সবুজ আর হলুদের এ এক আশ্চর্য মায়াময় সমাহার।
লম্বা একটা গাছের দিকে আঙ্গুল তাক করে সকাল বলল, ‘এগুলো কী গাছ?’ প্রশ্নটা করার সাথে সাথেই মনে পড়ল এই গাছের নামই জানতে চেয়েছিল সেদিন সে ফাহাদের কাছে। ফাহাদ বলেছিল, ‘ট্রিইজ আর ট্রিইজ।’ কে জানে আরশানও হয়তো বলবে, ‘গাছ তো গাছই।
কিন্তু আরশান বলল অন্য রকম গায়ে জ্বালা ধরানো কথা। দূর থেকে একটু উচ্চস্বরে বলল,
—‘আপনি চেনেন না এই গাছ?’
—‘আমি কী করে চিনব? এই গাছ তো আমাদের দেশে নেই।’
—‘কে বলেছে নেই?’
—‘কে বলেছে আছে?’
—‘একই রকম না থাকলেও একই জাতের আছে।’
—‘শুনুন আপনার উত্তরটা জানা থাকলে সরাসরি দিয়ে দেন। এতো প্যাঁচান কেন?’
—‘এগুলো পাইন গাছ। লং লিফ পাইন। আর পাশের ঝাঁকড়া মাথার গাছগুলো হলো হিকরি।’ তারপর একটু এগিয়ে গিয়ে একটা ঝাউ গাছের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এটা হোয়াইট সিডার।
আরেকটু হাঁটতেই একটা সাদা ফুলে ছাওয়া অপূর্ব সুন্দর গাছ চোখে ‘এটা পড়ল। সকালের প্রশ্ন করতে হলো না। আরশান নিজ থেকেই বলল, আলমন্ড ট্রি।’
কিছুটা পথ এগোতে লেকের পানি নজরে আসলো। স্বচ্ছ নীল রঙের টলটলে জল। জলের আয়নায় নিজের মুখ দেখছে বিকেল বেলার রোদময় আকাশ। লেকের ওপারে আকাশের নীলের সাথে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে গাঢ় সবুজ বনানী।
লেকের ধারে একটা লম্বা সরু কাঠের ডেক। ডেকের উপর উঠে একটু হেঁটে গেলেই জলের কাছাকাছি যাওয়া যায়। আরশান ডেকের একদম কিনারে গিয়ে বসলো। জুতো খুলে জলে পা ডুবিয়ে।
এদিকটায় এখন কেউ নেই। কোনো কোলাহল নেই। হঠাৎ হঠাৎ একজন দুজন মানুষ পায়ে হেঁটে বা দৌড়ে অতিক্রম করছে বনপথ। লেকের বুকের আঁশটে গন্ধ নিয়ে হু হু করে হাওয়ারা ছুটে যাচ্ছে জংগলে, পাতায় তুলছে শনশন আওয়াজ। জলের ওপর রাজার মতো সাঁতরে বেড়ানো হাঁস ডাকছে প্যাক প্যাক করে। ডাকছে একটা ঘুঘু মন কেমন করা সুর তুলে। আকণ্ঠ ওই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ডুবে গিয়ে কিছুক্ষণ কেমন থ-মেরে দাঁড়িয়ে রইল সকাল।
একটু বাদে পায়ের বুট খুলে আরশানের পাশে এসে বসলো। খালি পা ডুবিয়ে দিলো জলে। ডোবাতেই একটা ঠান্ডা তুলতুলে নরম স্পর্শে শরীর মন ভরে গেলো।
আরশান কৌটোর ভেতর থেকে হাত দিয়ে একটা পোকা বের করে বড়শির সুতোয় বাঁধতে লাগলো। পোকাটা এখনো জীবন্ত। কিলবিল করে নড়ছে। দেখেই কেমন গা ঘিনঘিন করে উঠল।
—‘ইয়া আল্লাহ! আপনি এই জ্যান্ত পোকা কোথায় পেয়েছেন?
‘পাওয়া যায় কিনতে। তবে এগুলো আমিই ধরেছি। জঙ্গল থেকে।’ পানিতে ছিপ ফেলে হাতে ধরা হুইল ঘুরাতে লাগলো আরশান। বলল, ‘কী মনে হয়? মাছ পাবো?’
—‘পেতে পারেন।’
—‘না পেলে আপনার দোষ।’
—‘সেকি কেন?’
—‘কারণ, আমি একজন খুবই ভালো এবং দক্ষ মৎস শিকারী। আজকে না পেলে বুঝতে হবে আপনি ব্যাড লাক নিয়ে এসেছেন সাথে করে।’
শুনে সকাল একটু মুখ গোঁজ করে ফেললো, ‘নিজের দোষ অন্যের ওপর চাপাতে খুব মজা লাগে, না?’
আরশান মিট মিট করে হাসতে লাগলো। কিছু বলল না।
খানিক বাদে বড়শিতে একটা মাঝারি হোয়াইট পার্চ আটকা পড়ল। খুশিতে লাফিয়ে উঠে মাছটাকে ডাঙায় তুললো আরশান। ছটফট করে কাতরাতে লাগলো মাছটা মাটিতে শুয়ে। বালতিতে পুরতে না পুরতেই তার ছটফটানি আরো বাড়লো।
হঠাৎ আরশান কেমন অন্যরকম গলায় বলল,’ ইউ নো হোয়াট? আজকে ওয়েদার অনেক ভালো। পানিও খুব পরিষ্কার। আজকে সাঁতার কাটা দরকার।’
সকাল চমকে উঠল, ‘কী বললেন?’
—‘সাঁতার! লেটস গো!
ভয়ে সকালের মুখ শুকিয়ে গেলো, ‘কী বলছেন পাগলের মতো?’
আরশান সকালের কথায় পাত্তা না দিয়ে গা থেকে টি শার্ট টা খুলে নিলো চট করে। সকাল চোখ কপালে তুলে লজ্জায় লাল হয়ে গিয়ে বলল, ‘একী! কাপড় চোপড় খুলে ফেলছেন কেন?’
আরশান হেসে ফিচেল গলায় বলল,’ওয়েদার ডিমান্ডস!
তারপর হাত পা প্রসারিত করে ঝপাং করে লাফ দিয়ে পড়ল জলের ওপর। জলের ছিটা এসে পড়ল সকালের নাকে মুখে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে রইল সে নিষ্পলক। প্রায় অনেকটা ক্ষণ।
আরশান হাত-পা ছুঁড়ছে জলে। ডুবছে, ভাসছে, সাঁতরাচ্ছে। সকাল রোদ চশমার ভেতর থেকে আড়চোখে দেখছে ওর তামা রঙের পেটানো দীর্ঘকায় সবল শরীর। প্রশ্বস্ত বুক … মেদহীন কোমর…।
হঠাৎ পায়ের কাছটায় কীসের যেন একটা হ্যাঁচকা টান অনুভব করলো সে। তারস্বরে চিৎকার দিয়ে ওঠার আগেই তার শরীরটা পিছলে পড়ে গেলো পানিতে। শব্দ হলো ঝপাং করে। তার হাতের ব্যাগ, মোবাইল সব পড়ে রইল ডেকের কাঠের ওপরে। কাতরাতে থাকা পার্চ মাছটা এবং আরশানের টি শার্টের সঙ্গী হয়ে।
সে নিশ্বাস নিতে পারছিল না। তার চারপাশে একটি ঘন থকথকে নীল বলয়। ক্রমশ সেই নীল বলয়ের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে সে। চোখের সামনে সমস্ত কিছু শূন্য। নাকে, কানে গলগল করে ঢুকে যাচ্ছে পানি। কানের কাছে বেজে চলেছে একটানা চিঁ চিঁ শব্দ। প্রাণপণে চিৎকার করে সে কিছু একটা বলতে চাইছে কিন্তু পারছে না।
কোমরে একটা শক্ত স্পর্শ অনুভব করলো ঠিক সেই মুহূর্তে। কিছুক্ষণের মাঝেই জলের চাপ নিচে ফেলে দ্রুত উঠে আসলো তার শরীরটা ওপরের দিকে। নাকে মুখে লাগলো বাতাসের ঝাপটা। চোখে ধাক্কা খেলো আলোর জোয়ার।
মুখ হা করে নিশ্বাস নিতে লাগলো সে। তার চোখ দুটো বিস্ফারিত। ঠোঁট কাঁপছে উত্তেজনায়। একজন দীর্ঘকায় মানুষ সবল হাতে তার কোমর জাপটে ধরে তাকে ভারসাম্য রক্ষায় সাহায্য করছে। তার দৃষ্টির সীমানা জলের মতো ঝাপসা। সে কিছু দেখতে পাচ্ছে না।
সে কি মরে গেছে?
আরশান ওর গালে একটা হাত রেখে বলল, ‘আপনি ঠিক আছেন?’
সকাল কিছু বলতে পারলো না। তার চোখের দৃষ্টি একটু একটু করে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসছে। চোখ মেলে ধরার পর সে আবছা দেখলো আরশান তার খুব কাছে দাঁড়িয়ে আছে। মুখ ঝুঁকিয়ে এনে কৌতূহল আর উৎকণ্ঠা নিয়ে চেয়ে আছে তার দিকে।
—‘আপনি ঠিক আছেন?’ আবার প্রশ্ন করলো আরশান।
মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো সকাল। বেঁচে আছে সে। ঠিক আছে কিনা বলতে পারে না।
আরশান একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ওর কোমর থেকে হাতটা সরিয়ে নিলো। তাৎক্ষণিকভাবে আবার তাল হারিয়ে টলতে টলতে পানিতে পড়ে যেতে লাগলো সকাল। আরশান ফিরে এসে আবার তাকে এক ঝটকায় টেনে তুললো।
—‘এটার মানে কী? এখানে তো জল একদম গভীর নয়। আপনি অনায়াসে দাড়াতে পারবেন। পড়ে যাচ্ছেন কেন?’
কথাটা বুঝে উঠতে সকালের একটু সময় লাগলো। বোঝার পর সে পা সোজা করে দাড়ালো। পায়ের তলায় খুঁজে পেলো পিচ্ছিল আর নরম মাটি। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো ডেকের একদম গা ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে আছে তারা। এ জায়গাটায় গলা পর্যন্ত পানি। সকাল জল ঠেলে ডেকের কাছে এগিয়ে গেলো। কিন্তু উঠতে গিয়ে সমস্যা হয়ে গেলো। ডেকটা তার মুখ বরাবর। কী করে উঠবে সে এর উপরে?
আরশান এগিয়ে এসে একরকম পাঁজাকোলা করে তুলে ধরে তাকে ডেকের ওপর উঠিয়ে দিলো। তারপর নিজে জলে অর্ধেক ডুবে থেকে ডেকের কাঠের ওপর দুহাত রেখে ভর দিয়ে ভারি হতাশ গলায় বলল,
—‘আপনি একটা কী বলেন তো? কিছুই করতে পারেন না। জীবন চলবে কিভাবে আপনার?’
সকালের খোলা চুল লেপ্টে মাথায় লেগে গেছে। ছড়িয়ে গেছে চোখের কাজল, লিপস্টিক। ভেজা কাপড় আঁটসাঁট হয়ে লেগে আছে গায়ে। পাতলা কাপড় ভিজে গিয়ে শরীরের অবয়ব ফুটিয়ে তুলছে স্পষ্ট ভাবে। এরই মাঝে নদীর বুকের হু হু করা হাওয়াটা সারা গায়ে শীত ধরিয়ে দিলো। থরথর করে তার ঠোঁটদুটো কেঁপে উঠল। সে দুই হাত দিয়ে নিজের শরীরটা ঢাকার চেষ্টা করে ক্ষুদ্ধ ভাবে বলল, ‘আপনি কি মানুষ? নাকি অন্য কিছু?’
—‘এখন আমার দোষ?’
—‘তো কার দোষ? আপনি কেন ফেলে দিলেন আমাকে পানিতে? আমি যদি মরে যেতাম?’
—‘আই ওয়াজ জাস্ট ট্রাইং টু হ্যাভ সাম ফান। আমি তো জানি না যে আপনি সাঁতারটা পর্যন্ত পারেন না।’
—‘কেন জানবেন না? আমার মুখে কি কোথাও লেখা আছে যে আমি সাঁতার পারি?’
আরশান সকালের ওই লেপটে যাওয়া কাজল, ছড়িয়ে পড়া লিপস্টিক ওয়ালা এলোমেলো মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো।
—‘হাসছেন কেন?’ শীতে কাঁপতে কাঁপতে বলল সকাল।
—‘আপনার পার্টি লুক দেখে হাসছি।’
—‘পার্টি লুক তো আপনি বরবাদ করে দিয়েছেন। ইচ্ছা করে করেছেন আপনি। আমার সুন্দর সাজটা নষ্ট করে দেয়ার জন্য এই পরিকল্পনা এঁটেছেন মনে মনে। সব বুঝি আমি।’
আরশান হো হো শব্দ করে ডাকাতের মতো হেসে উঠল, ‘সুন্দর সাজ তাই না? এটাকে আপনি সুন্দর বলেন?’
সকাল অপমানে জ্বলতে জ্বলতে বলল, ‘অবশ্যই সুন্দর। হান্ড্রেড পার্সেন্ট সুন্দর। আপনি কী বোঝেন?’
আরশানের হাসির দমক বেড়ে গেলো, গলার স্বরে একগাদা তাচ্ছিল্য টেনে এনে সে রসিয়ে রসিয়ে বলল, ‘আই রিয়েলি থিঙ্ক ইউ নিড টু ইম্প্রভ ইয়োর ফ্যাশন সেন্স।’
—‘কী? এটার মানে কী?’
—‘ইংরেজি বোঝেন না? বাংলায় অনুবাদ করে বলতে হবে?’
সকাল চোখ বড় বড় করে খেয়ে ফেলার মতো দৃষ্টি দিয়ে বলল, ‘আমার অত ফ্যাশন-ট্যাশন করা লাগবে না বুঝছেন? এখন আমার আপনার কাছ থেকে ফ্যাশন দীক্ষা নিতে হবে তাই না? এসব ফালতু প্যাঁচাল আপনার গার্লফ্রেন্ডের সাথে গিয়ে করেন যান। আমার সাথে না।’
—‘গার্লফ্রেন্ড বেচারিকে নিয়ে আসলেন কেন আবার এর মাঝে?’ আফসোসের গলায় বলল আরশান।
—‘কেন আনবো না? নিশ্চয়ই আপনার গার্লফ্রেন্ড সারাদিন ফ্যাশন নিয়ে চিন্তা করা টাইপ ঢঙ্গী মেয়ে।’
—‘আমার গার্লফ্রেন্ডের আসলে ফ্যাশন-ট্যাশন করা লাগেনা। সে এমনিই সুন্দর।’
সকাল সাপের মতো ফণা তুলে তাকালো আরশানের দিকে, ‘তাই না?’
—’ঠিক তাই। ওর চোখের মণি ন্যাচারাল ঘন নীল। গায়ের রং ফকফকা। আপনাদের মতো এতো আটা ময়দা মেখে সুন্দর হতে হয় না।’
সকালের এই মুহূর্তে ইচ্ছা করলো পায়ের জুতা তুলে আরশানের গায়ে ছুঁড়ে মারে। অপমানে, দুঃখে, লজ্জায় তার চোখের কোণ ভিজে উঠল। এতো নির্দয়, নিষ্ঠুর আর বদ মানুষ সে তার জীবনে আর দেখেনি।
আরশান কাঠের ওপর ভর দিয়ে ডেকে উঠে আসলো। তার চুল বেয়ে, আদুর গা বেয়ে টপ টপ করে ঝরে পড়ছিল জল।
পার্চ মাছের ছটফটানি তখন কমে গেছে। আরশান বড়শি এবং যাবতীয় সরঞ্জাম গুছিয়ে নিলো। গায়ে চড়ালো টি শার্ট। জুতো পরলো। তারপর সকালকে বলল, ‘যাবেন না? নাকি থাকবেন? আপনার কাণ্ড দেখে আমার মাছ ধরার ইচ্ছে মরে গেছে।’
সকাল পায়ে বুট চাপালো। তারপর নিজের হাতদুটো দিয়ে শরীর ঢেকে রেখে অতি সংকোচের সাথে উঠে দাড়ালো। আরশান ওকে একবার আগাগোড়া দেখে নিয়ে মুখ ভার করে বলল, ‘এরকম গেঁয়োপনা করছেন কেন? দিস ইজ আমেরিকা। আপনি নেকেড হেঁটে গেলেও কেউ আপনার দিকে তাকাবে না। নো বডি কেয়ারস! বরং চোরের মতো হয়ে থাকলে লোকে সন্দেহ করবে।’
সকাল দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল, ‘আমার শীত করছে!’
—‘ও! ‘ বলে আরশান কিছু একটা চিন্তা করলো। তারপর নিজের গায়ের
টি শার্টের দিকে ইঙ্গিত দিয়ে বলল, ‘এটা পরবেন?’
—‘না! আপনার কাপড় আমি কেন পরব? ছি!’
আরশান সকালের ভাবভঙ্গী দেখে থ বনে গেলো।
—‘ছিঃ বললেন কেন?
—‘ছিঃ বলেছি কারণ আপনি একজন রেসিস্ট। আপনার গার্লফ্রেন্ডের গায়ের চামড়া সাদা বলে সে ন্যাচারাল সুন্দরী। আর আমরা কালো বলে আমরা হলাম ন্যাচারাল বান্দরী।
আরশান হেসে ফেললো। অনেক কষ্টে হাসি চেপে বলল, ‘আমার গার্লফ্রেন্ড এর পেছনেই লেগে আছেন দেখি সেই তখন থেকে। বাই দ্যা ওয়ে, আপনি কি জেলাস?’
সকাল আক্রোশে ফেটে পড়ল, ‘কথাই বলবেন না আপনি আমার সাথে। আপনি একটা অসহ্য!
গাড়িতে উঠে বসে সকাল বলল, ‘দয়া করে আপনার গাড়ির ছাদটা টেনে দিন। নইলে মরে যাব ঠান্ডায়।’
আরশান ছাদ টেনে দিলো। গাড়ির হিটার অন করে দিলো। ততক্ষণে সকাল তিন চারবার হাঁচি দিয়ে ফেলেছে। তার চোখদুটো হালকা লাল। দেখে বোঝা যাচ্ছে তার শরীরটা খুব একটা ভালো নেই।
গাড়ি স্টার্ট দিয়ে আরশান একটু চিন্তিত গলায় বলল, ‘জ্বর টর আসবে নাকি আবার?’
—‘জ্বর আসলে আপনার দোষ। কেন এরকম করলেন আপনি? যদি মরে যেতাম?’
—‘মরবেন কেন? এতটুকু পানিতে কেউ মরে নাকি?’
—‘মরেই তো যাচ্ছিলাম। আরেকটু হলেই মরে যেতাম। বাঁচাতে পারতেন না আমাকে।’
—‘মরা কি এতো সোজা?’
—‘আপনার মনে কি একটু দয়া মায়া নাই?’
আরশান উত্তরে বিরক্ত চোখে সকালের দিকে একবার তাকালো। কিছু বলল না।
বাড়িতে পৌঁছনোর পর সকাল বলল, ‘চাচা জিজ্ঞাসা করলে কী বলব?’
—‘কী জিজ্ঞাসা করবে?’
—‘যদি প্রশ্ন করে যে তুমি ভিজছ কেন?’
—‘বলবেন, মনে চাইছে ভিজতে তাই ভিজছি। এতো নাটকের কী আছে?’
—‘জি, না আমি সত্য কথা বলবো। বলবো যে আপনি আমাকে পানিতে ফেলে দিয়েছেন।’
—‘আপনি কিন্তু ভীষণ বোরিং, আপনি জানেন?’
—‘কী বললেন?’
—‘বলেছি আপনি খুব বোরিং।’
সকাল আর কোনো কথা না বাড়িয়ে গটগট করে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেলো। ভাগ্যিস কারো মুখোমুখি পড়তে হলো না। নিজের ঘরে প্রায় দৌড়ে ঢুকে পড়ল সে। তারপর তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছে, গা মুছে, কাপড় পাল্টে নিলো। বিছানায় শুয়ে বুঝতে পারলো মাথাটা ধরেছে। চোখ দুটোও জ্বলছে। জ্বর আসার পূর্বাভাস। বুকের ভেতর একটা দলা পাকানো কষ্ট পাথরের মতো ভারি হয়ে চেপে বসে আছে। ছেলেটা ঠিকই বলেছে যে সে খুব বোরিং, তার কোনো ফ্যাশন সেন্স নেই। সত্য, সত্য ভীষণ সত্য। সকাল যে বড্ড সেকেলে, আনস্মার্ট আর বোকা। এতো বোকাও মানুষ হয় নাকি?
আচ্ছা, ভালোবাসলে কি মানুষ আরো বেশি বোকা হয়ে যায়? হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে যায়? সকালের কাছে এই অনুভূতিটি সম্পূর্ণ নতুন। সে সারাটা জীবনভর অপেক্ষা করেছে এই বিশেষ মুহূর্তটির জন্য, এই অলৌকিক উপলব্ধির জন্য। এতো কাঠখড় পুড়িয়ে যখন এলো সেই বিশেষ ক্ষণ তখন ঝড়ের মতো তার সমস্তটা ভেঙেচুরে নিঃশেষ করে দিল। এই আসার চেয়ে না আসাই ঢের ভালো ছিল।
আরশান! তুমি কি জানো ভালোবাসা কী? হয়তো জানো। জানো বলেই তোমার ভালোবাসার মানুষটি সাধারণত্বের খোলস পাল্টে তোমার চোখে ঈশ্বরী হয়ে উঠেছে। ভালোবাসাই একজন মানুষকে অন্য মানুষের কাছে দেবতা বানায়। যদি ওই নীল নয়নাকে ভালো না বেসে তুমি আমাকে ভালোবাসতে, এই রক্তমাংসের সাধারণ সকালকে। তাহলে সকালও তোমার কাছে বিরক্তিকর, বোরিং, আনস্মার্ট মানুষের চামড়া বদলে ঈশ্বরী হয়ে উঠতো। কিংবা কে জানে! হয়তো নীল চোখের মেয়েটি সত্যিই পরীর মতো সুন্দর। অন্তত সকালের চাইতে তো ঢের সুন্দর। পরীর মতো… হ্যাঁ ডানাকাটা পরীই মানায় তোমার পাশে আরশান! সকালকে নয়।
তার চোখের কোল বেয়ে জলের একটা ধারা গড়িয়ে পড়ছিলো। নীরবে, আলতো ভাবে।
মোবাইলটা বাজছিল। ধরলো না সে। উঠে দেখলোও না কে ফোন করেছে। যেমন ছিল সেভাবেই শুয়ে থাকলো।
সারা শরীরে পিঁপড়ার মতো পিলপিল করে ক্রমে ক্রমে ছড়িয়ে পড়ছে জীবাণুটা। গায়ের তাপ বাড়ছে। মাথার চারপাশে মৌমাছি হুল ফোটাচ্ছে।
দরজায় টোকা পড়ছে। কে আসলো আবার? নিশ্চয়ই চাচা। কিংবা ফাহাদ। অফিস থেকে ফিরেই একবার তার ঘরে রোজ উঁকি দেয় সে। আহা ফাহাদ ছেলেটা বড় ভালো। সকালের দুর্ভাগ্য এমন একটা মানুষকে পেয়েও পেলো না। সকালের চেয়ে হাজার গুণ ভালো মেয়ে জুটবে গো তোমার কপালে ফাহাদ! সকালকে তুমি ক্ষমা করে দিও। সকাল তোমার কাছে আজীবনের ক্ষমাপ্রার্থী!
নিজের মনে বিড়বিড় করতে করতে দরজা খুললো সে। আরশান দাঁড়িয়ে আছে। সকালকে দেখামাত্র চমকে উঠে বলল,
—‘মাই গড! এই অবস্থা কেন আপনার?’ কথা বলতে বলতে ঘরে ঢুকে গেলো সে। অনুমতি চেয়ে সময় নষ্ট করলো না। অগোছালো ঘরের মাঝে আরশানকে বসতে দেবার মতো একরত্তি জায়গা নেই। সকাল একটু ব্যতিব্যস্ত হয়ে চেয়ারের ওপর ডাই করে রাখা কাপড়-চোপড়গুলো সরিয়ে দিলো। শুকনো গলায় বলল, ‘বসুন।’
আরশান নিজে বসলো না। সকালের কাঁধে দুহাত রেখে বিছানার ওপর জোর করে বসিয়ে দিলো ওকে। তারপর আলতো ভাবে ওর কপালটা হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখে চিন্তাযুক্ত গলায় বলল, ‘আপনার তো জ্বর আসছে। এখন কী হবে?’
সকাল হাসে। আর জ্বর। গায়ের জ্বরটাই তুমি দেখলে আরশান! মনের জ্বরটা দেখলে না!
সকাল দুর্বল চোখে মুখ তুলে চায় আরশানের দিকে। আবিষ্টভাবে চেয়েই থাকে।
আরশান ওর হাতটা আস্তে করে ধরে নরম গলায় বলল, ‘আমি আসলে এক্সট্রিমলি সরি। আমি বুঝতে পারিনি আপনাকে এতটা ইফেক্ট করবে। জানলে আমি কখনোই এমনটা করতাম না।’
সকাল আরশানের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলো। তার চোখদুটো কেমন ঝাপসা লাগছে। সে স্পষ্ট ভাবে কিছু চিন্তা করতে পারছে না। জ্বরের ভেতরেও মানুষটার সঙ্গ ভালো লাগছে। সে জানে মানুষটা তাকে এক ফোঁটা পছন্দ করে না, দাম দেয় না। তবুও মানুষটার উপস্থিতি তার ভেতর বাহির একযোগে আন্দোলিত করছে।
—‘আরশান, আমি ঠিক আছি। আপনি একটু বসুন আমার পাশে।’
আরশান বসলো সকালের পাশে, বিছানায়।
হাত ধরাই ছিল। কেন ধরা ছিল ওরা জানে না। শুধু জানে কারোরই ছাড়তে মন চাইছিল না।
—‘আপনার কি বেশি খারাপ লাগছে? দাড়ান আমি ওষুধ নিয়ে আসছি।’
সকাল ওর কথা শুনে হেসে বলল, ‘ওষুধ লাগবে না। এমনিই ঠিক হয়ে যাবে।’
আরশান ওর হাসিটার দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টে চেয়ে রইল। এই হাসিটায় কী যেন আছে। একদম বুকের পাঁজরে গিয়ে লাগে।
সকাল আলতোভাবে আরশানের কাঁধে মাথা রাখলো। আরশান প্রথমে কিছুক্ষণ অস্বস্তিতে কাঁটা হয়ে গুম মেরে রইল। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো সকালের দিকে। চোখ বুজে আছে মেয়েটা। ওই অবোধ ছেলেমানুষ নিষ্পাপ মুখখানার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে ধীরে ধীরে সমস্ত অস্বস্তি হাওয়ায় উড়ে গেলো। সে অপর হাতটি সকালের কাঁধের ওপর রাখল।
বাইরে বিকেল মরে গিয়ে সন্ধ্যের তরল আলো ছড়িয়ে পড়ছে ক্রমে ক্রমে। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে আগুন রঙের বিস্তৃত পশ্চিম আকাশ। ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিরা উড়ে যাচ্ছে ফিকে হয়ে আসা লালচে আকাশের বুক চিরে।
সন্ধ্যার রহস্যময় বর্ণালি আকাশটার সম্মুখে বসে থেকে আরশানের বুকের ভেতর ক্রমশ একটা কোমল পবিত্র ভাব ছড়িয়ে যাচ্ছিল। সকালের চুলের ঘ্রাণ, নিঃশ্বাসের ওঠানামা, হাতের স্পর্শ সমস্তটা মিলেমিশে ভারি এক মায়াবী অনুভূতি জন্ম নিচ্ছিল ধীরে ধীরে।
সকাল শুনতে পাচ্ছিল আরশানের হৃৎপিণ্ডের শব্দ।
ধুক পুক ধুক পুক ধুক পুক।
কতক্ষণ কাটলো কে জানে। একটা সময় সকাল ধড়ফড় করে সোজা হয়ে উঠে বসলো। সারাঘর অন্ধকার। কোথাও আলো নেই। আরশানের বাহুবন্ধনে নিজেকে দেখতে পেয়ে ভারি বিব্রত হয়ে পড়ল সে। নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলল, ‘আমি কি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম?’
আরশান নরম গলায় বলল, ‘হুম, ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।’
সকাল লজ্জায় একদম মাটির সাথে মিশে গেলো। মাথা নিচু করে চিবুক গলার সাথে লাগিয়ে অপরাধীর গলায় বলল, ‘ছি! আমাকে জাগালেন না কেন?’
আরশান বসা থেকে উঠে দাড়ালো। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে ঘরের বাতি জ্বালালো। তারপর পরিষ্কার ভাবে বলল,
—‘আপনার শরীর খারাপ ছিল, তাই ডাকিনি। এখন একটু বেটার ফিল করছেন?’
সকালের গায়ের ওড়না সরে গেছে গা থেকে। চুলগুলো আলুথালু। সে ওড়না ঠিক করে নিয়ে একটু নার্ভাস ভাবে বলল, ‘এখন ঠিক আছি।’
আরশান হাসলো, ‘গুড! আমি একটু পরে ওষুধ দিয়ে যাচ্ছি। রাতের খাবার ঠিক মতো খাবেন। রাতে ভালো ঘুম হলেই দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে। আর হ্যাঁ, আমি আসলেই সরি। আমার জন্য আপনার পার্টি মিস হয়ে গেলো।’
সকাল কিছু বললনা। মিথ্যে কথাটা বলার জন্যে ভেতরে ভেতরে এক ধরনের অপরাধবোধ কাজ করলো। কী এমন ক্ষতি হতো পার্টি নিয়ে মিথ্যে না বললে?
আরশান ওর দিকেই তাকিয়ে ছিল। সেই দৃষ্টিটা। যে দৃষ্টির সামনে সকাল এলোমেলো হয়ে যায়।
—‘ঠিক আছে। আমি তাহলে চলি।’
—‘আসুন।’ বলে হাসলো সকাল। হাসলো আরশানও।
তারপর খানিক বাদে চাচা এসে ওর ঘরে ওষুধের কৌটা দিয়ে গেলেন। আরশান নাকি নিচে যাবার সময় তাকে বলে গেছে ওষুধের ব্যাপারে। মনটা একটু খারাপ হলো। মানুষটা নিজে আসতে পারতো না? এতো কেন অবহেলা?
সেদিন রাতে ঘুম এলো না। গায়ের জ্বর ছেড়ে গেছে, কিন্তু মনের জ্বর ছাড়লো না। অনেক রাত অবধি সকাল জেগে বসে রইল বেহালার সুর শোনার আশায়। কিন্তু বেহালা বাজলো না। এমন কি গভীর রাতে জঙ্গলের দিকে কেউ হেঁটেও গেলো না।
পরদিন সারাবেলা ঘরে বসে রইল। কিচ্ছু করার নেই। নাবিলাকে ফোন দিয়ে বিরক্ত করলো। নাবিলার পরীক্ষা চলছে। সে প্রচণ্ড ব্যস্ত। বিকেলে টিলির সাথে বাইরে হাঁটতে বের হলো। বিকেল থেকে সন্ধ্যা অবধি হাঁটলো। সন্ধ্যার পর বাড়ির পেছন দিকে একবার ঢুঁ মারলো। নাহ, মানুষটার কোনো খবর নাই। বাড়ির কোনও সদস্যকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করার সাহস হলো না। রাতে চাচা সবাইকে বাইরে ডিনার করালেন। রেস্টুরেন্টের নাম নাইন্টি নাইন সি হটপট। প্রতিটা টেবিলে একটি করে হট প্লেট লাগানো। মেনু বেছে পছন্দ মতো ব্রথ অর্ডার দিতে হবে। দুই ধরনের ব্রথ একসাথে নেয়া যাবে। ওরা নিলো ভেজি এবং টমইয়াম ব্রথ। ঝোলসহ বাটি বসিয়ে দেয়া হলো টেবিলের মাঝখানে ইলেক্ট্রিক প্লেটের ওপর। ধীরে ধীরে ব্রথ গরম হতে থাকল। এরপর একে একে আসতে লাগল অর্ডার দেয়া কাঁচা সবজি, মাংস, ফিশ বল, চিংড়ি, নুডলস, মিট বল ইত্যাদি। কাঁচা শাকসবজি এবং মাছ মাংসের টুকরো এত পাতলা করে কাটা যে গরম ধোঁয়া ওঠা ব্রথে ছেড়ে দিতেই রান্না হয়ে যাচ্ছে। রান্না হয়ে গেলে তুলে নিয়ে খেতে হবে। চাইনিজ রেস্তোরাঁ বলে কাটাচামচের পাশাপাশি চপস্টিকও দিয়ে গেল। সকাল চপস্টিক দিয়ে খেতে পারে না, কখনো খায়নি। ফাহাদ, টিলি দুই ভাই-বোন চপস্টিক ব্যবহার করেই দিব্যি খাওয়া শেষ করল। রাত দশটার মাঝেই ফিরে আসতে পারল বাড়ি।
সে রাতেও ভায়োলিন বাজলো না। বুকের কোণে চিনচিন করে বাজতে থাকলো একটা অসহ্য ব্যথা। কোথায় চলে গেলো পাগল লোকটা? এভাবে না বলে কয়ে?