অক্টোবর রেইন – ৭৫

৭৫

ঘরে এসে একটা বোতল নিয়ে সোফার ওপর বসলো সে। বুকের ভেতর হিংস্র জন্তুর মতো গর্জে গর্জে উঠছে অন্ধ এক রাগ। চেতনা বিলুপ্তির পথে। 

হরেক রকম তরঙ্গ আজ তার ভেতরটাকে ওলোট পালট করে দিচ্ছে। পৃথিবীতে তার আর আপন বলতে কেউ রইল না। সে একা। আজ থেকে সে একদম একা। এ পৃথিবীর কোনো মানুষ বিশ্বাসের যোগ্য নয়। ভালোবাসার যোগ্য নয়। এ কারণেই ভালোবাসাকে ঘেন্না করে এসেছে সে এতকাল। 

কিন্তু এ কেমন অদ্ভুত! এ কেমন আকস্মিক! যে মানুষটাকে সে কোনো দিন একটা ফোঁটা ভালোবাসেনি। নিজের এলোমেলো, অস্বাভাবিক জীবনের জন্যে যে মানুষটাকে প্রতি নিয়ত দায়ী করে এসেছে, আজকে এতো দিন বাদে জানা গেলো সেই ব্যক্তিটির কোনো দোষই ছিল না! অন্যদিকে যাকে সে অন্ধভাবে বিশ্বাস করে এসেছে, ভালোবেসে এসেছে, সেই লোকটা… 

আর ভাবতে পারছিল না সে। কেন করলো জীবন তার সাথে এই প্রতারণা? বোতল তুলে ধরে ঢক ঢক করে পানীয়টা ঢালল গলায়। নিস্তার চাই। বুকের ভেতর, মাথার ভেতর চলতে থাকা লক্ষ লক্ষ অনুভূতির অবিরাম অত্যাচার থেকে নিস্তার চাই। শরীর আর মাথাকে সে আর নিজের জিম্মায় রাখতে চায় না। নিয়ন্ত্রণ হারাতে চায়। 

অনেক খানি তরল গলায় ঢেলে নিয়ে বোতলটা নামিয়ে রাখলো সে। শরীরে একটু একটু ভাসন্ত ভাব টের পেলো। চোখ বুজলো। মাথাটা ভোঁতা হয়ে আছে। হঠাৎ মনে হলো, অন্য সবার মতোই, তারও একটা মা ছিল! 

তফাৎটা শুধু এখানে যে তার মা’ কে সে কোনোদিন দেখেনি, কোনো দিন ভালোবাসেনি, কোনোদিন মা বলে ডাকেনি…তবুও, ছিল তো একটা মা! খুট খুট করে শব্দ হলো একটা। কেউ এসেছে। আরশানের চোখের পাতা ভারি হয়ে আসছিল। কানের কাছে ঝিঁ ঝিঁ করা একটা শব্দ। কষ্ট করে চোখ মেললো। ঘরের ভেতর জ্বলতে থাকা টিমটিমে ল্যাম্পশেডের আলোয় দেখলো একটি নারী-মূর্তি এগিয়ে আসছে। নারী-মূর্তির হাতে কিছু একটা ধরা ছিল। সে হাতে ধরা জিনিসটা সেন্টার টেবিলের ওপর রাখল। 

ঘোরের মধ্যেও মেয়েটাকে চিনতে পারলো আরশান। এই মেয়েটাকে সে বড় আপন ভেবেছিল। তার জীবনে দেখা সবচেয়ে স্নিগ্ধ আর পবিত্র একটা মেয়ে। মেয়েটা হাসলে তার কাছে আশেপাশের পৃথিবীটাকে জান্নাত বলে মনে হতো। এই হাসিটা তাকে নতুন করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখিয়েছিল। হায়, কে জানতো? সেই নির্মল, নিষ্কলঙ্ক হাসির পেছনেও যে লুকিয়ে ছিল একটি কুচক্রী, চাটুকারিতায় ভরা মন! 

ফাহাদ! তার ছোট্ট ভাইটা! 

ফাহাদের বউ হবার জন্য এসেছিলে তুমি এই দেশে সকাল? কেন বললে না আমাকে আগে? এ কথাটা জানলে কি আমি কখনো তোমার দিকে অন্যভাবে তাকাতাম? 

হঠাৎ ফ্ল্যাশ লাইটের আলোর মতো করে ঘটনাটা জ্বলে ওঠে মাথার ভেতর। মনে পড়ে যায় সকাল তখন সদ্য এসেছে বাংলাদেশ থেকে। ফাহাদ এক রাতে হুট করে চলে আসলো এই ঘরে। কথায় কথায় জানতে চাইলো সকালকে আরশানের কেমন লাগে? ইশ আরশান কী ভীষণ বোকা। ফাহাদের ওই আলাপচারিতা থেকেও কিছু আঁচ করতে পারলো না। খতিয়ে দেখলো না ব্যাপারটা। 

ফাহাদ কি কষ্ট পেয়েছে? ফাহাদ তার ছোট্ট পুতুল পুতুল ভাইটা? কষ্ট জিনিসটা তো ওর জন্য নয়। ওর তো সাজানো সুন্দর একটা পৃথিবী আছে। বাবা মা আছে, বোন আছে, ভাই আছে। কেউ তাকে ধোঁকা দেয়নি, কেউ তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। তাহলে ও কেন কষ্ট পাবে? 

—‘আরশান!’ সকাল ডাকলো। 

ঘাড় ঘুরিয়ে রক্তবর্ণ চোখ তুলে তাকালো আরশান সকালের দিকে। সকাল ওর সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসলো। আরশান শোয়া থেকে উঠল না, নড়লো ও না। শুধু কেমন দুর্বোধ্য চোখে চেয়ে রইল। 

সকাল আরশানের হাতের ওপর তার নিজের একটি কম্পনরত হাত রাখলো। আরশান চকিতে সরিয়ে ফেললো হাতটা। ভারি গলায় বলল, ‘কী চাই?’ 

—‘কয়টা কথা বলব।’ 

আরশান চোখ বুজলো আবার। তার মাথা ঘুরাচ্ছে। সারা শরীরে ঝিম ঝিম ভাব। 

সকাল ওর হাত ধরলোনা আর। হাঁটু গেড়ে বসে একটু দূর থেকেই বলল, ‘আপনার জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে আমার! 

—‘করুণা দেখাতে এসেছেন?’ 

—‘না করুণা নয়।’ 

—‘তাহলে কী? প্লিজ চলে যান।’ 

—‘কয়টা কথা বলেই চলে যাব।’ 

আরশান কিছু বলল না। চুপ করে চোখ বুজে শুয়ে থাকলো। যেন সকাল থাকলো না গেলো, কী বলল না বলল তাতে তার কিছু এসে যায় না। 

সকাল বলল, ‘ফাহাদের ব্যাপারটা নিয়ে আপনি ভুল বুঝছেন।’

আরশান চোখ মেললো আবার। তাকালো সিলিং-এর দিকে, ভাবলেশহীন ভাবে। 

—‘মানে…এটা ঠিক যে ফাহাদের জন্য চাচি আমাকে পছন্দ করেছিলেন। বাবা মায়ের সাথে এরকম একটা কথা হয়েছিল যে আমি এখানে আসার পর যদি আমার আর ফাহাদের মধ্যে ব্যাপারটা ক্লিক করে যায় তাহলে আমাদের বিয়ে হবে, নইলে হবে না।’ 

আরশানের হাতদুটো নিজের অজান্তেই মুষ্টিবদ্ধ হয়ে যায়। চোয়াল হয়ে যায় শক্ত। ফাহাদের সাথে সকাল? বিষয়টা এতো অদ্ভুত আর বাজে ঠেকছে কেন তার কানে? এসব কথা শোনার আগে তার মৃত্যু হলো না কেন? 

কেমন দমবন্ধ একটা ভাব হয় তার। সে কি মরে যাচ্ছে? 

সকাল আরশানের মনের গনগনে ভাবটা টের পায়। ভীত চোখ নিয়ে পর্যবেক্ষণ করে আরশানকে। একটা ভয় জাপটে ধরে তাকে। সতর্ক গলায় কিছুটা এলোমেলো ভাবে বলে, ‘কিন্তু ফাহাদের সাথে আমার কখনোই কিছু হয়নি। এখানে আসার পর থেকে ওকে আমি শুধু মাত্র বন্ধু হিসেবেই দেখেছি। কিছুদিনের মধ্যেই আমরা টের পেয়ে গেলাম যে আমাদের মধ্যে অন্যরকম কিছু কখনো হবে না।’ 

—‘আমি আর কিছু শুনতে চাইছি না। এসব বলে এখন কোনো লাভ নেই। আমাকে কিছু শুরু থেকে জানানো হয়নি। জানানো উচিত ছিল।’ 

সকাল ব্যাকুলভাবে বলে উঠল, ‘কিন্তু আমাকে যে কথাগুলো বলতেই হবে আজকে! বলতে হবে কেন আমি ফাহাদের ব্যাপারটা আপনাকে বলিনি!! 

—‘কেন বলেন নি?’ 

—‘বলিনি আপনাকে হারানোর ভয়ে!’ 

আরশান থমকে গেলো। বিস্ময়াভিভূত হয়ে তাকালো সকালের দিকে সকাল কান্নার একটা ঢোঁক গিললো। তার গলা কেঁপে যাচ্ছে। হৃৎপিণ্ডে উথাল পাতাল। সে ভারি করুণ গলায় বলল, 

—‘ফাহাদের কথা বলিনি কারণ আমি জানতাম আপনি যে মুহূর্তে শুনবেন যে আমার সাথে আপনার ভাইয়ের বিয়ে হওয়ার কথা চলছে, বা কথা ছিল সেই মুহূর্ত থেকে আপনি আমার দিকে চোখ তুলেও তাকাবেন না। কিন্তু আপনাকে…’ 

কান্নার স্রোত বাক্য কেঁড়ে নিল। ওড়না দিয়ে চোখের জল, নাকের জল মুছতে মুছতে সকাল কোনোরকমে বলল, ‘আমি আপনাকে ভালোবাসি আরশান! সেই প্রথম দিন থেকে!! 

আরশান বাকরুদ্ধ। 

—‘আপনার মনে আছে কিনা জানি না। সেই প্রথম যেদিন আপনাকে নাশতার টেবিলে দেখলাম, সেদিন এক নাম না জানা অনুভূতি হয়েছিল আমার মধ্যে। একটা অদ্ভুত সেনসেশন! যেই সেনসেশন আমার কখনো ফাহাদকে দেখে হয়নি, অনিককে দেখে হয়নি। পৃথিবীর অন্য কোনো পুরুষকে দেখে হয়নি! আমার ভেতরে সেই প্রথম একটা ডঙ্কা বেজে উঠেছিল। যে বাজনাটার অপেক্ষা করেছিলাম মনে মনে সারাটি জীবনভর। আপনি কাছে থাকলে আমি আতরের খুশবু পেতাম। আমার মনে হতো আপনি আর আমি, আমরা দুজন কোনো একভাবে কানেক্টেড। আমি বুঝেছিলাম আপনি আমাকে পছন্দ করেন। একটা সময় ধারণা হয়েছিল এই পছন্দটা আসলে ভালোবাসা। আপনি শুধু স্বীকার করতে চাইছেন না। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম আরশান! আপনি কখনো আমাকে ভালোবাসেননি। ভালো বাসলে এতো সহজে আমাকে যেতে দিতে পারতেন না। সত্যিকারের ভালোবাসলে আপনি ঠিক ঠিক টের পেতেন ফাহাদ নয়, অনিক নয়, আমার মনটা শুধুমাত্র আপনার জন্যই সর্বদা কেমন কেমন করে!’ 

সকাল কথাগুলো বলা শেষ করে উঠে দাড়ালো, আবার বলল, ‘ভালোই করেছেন বিয়েটা ভেঙে দিয়ে। একতরফা ফিলিংস দিয়ে কোনো সম্পর্ক টেকে না।’ 

সেন্টার টেবিলের ওপর থেকে খামটা হাতে তুলে নিলো সে। আরশানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এটা চাচা দিতে বলেছেন আপনাকে। এখানে আপনার মায়ের ছবি আছে। একটা চিঠিও আছে।’ 

আরশান উঠে বসলো ধীরে ধীরে। কাঁপা হাতে তুলে নিলো খামটা। তার মনে হচ্ছে তার মাথাটা ছিঁড়ে যাবে। আর নিতে পারছে না সে। 

খামটা দিয়ে সকাল আর দাড়ালো না। যেতে যেতে শুধু একবার বলল, ‘আমি ছবিটা দেখেছি, আপনার মা খুব সুন্দর ছিলেন। আপনারই মতো!’ 

আরশান সাদা খামটা খুলতেই ভেতর থেকে একটা মাঝারি আকারের রঙিন ছবি উঁকি দিলো। ঝাপসা চোখে ছবিটা দেখলো সে। চব্বিশ কি পঁচিশ বছর বয়সী একটি যুবতী মেয়ে। পেঁয়াজখসি রঙের শাড়ি। চুলে বেণি। আঁকাবাঁকা দাঁত দেখানো ঝিকিমিকি হাসি। 

এই মেয়েটা তার মা! 

যুবতীর কোলে কাঁথায় মোড়া একটি সদ্যজাত শিশু। কাউকে বলে দিতে হলো না, আরশান চিনে নিলো ছবির শিশুটিকে 1 

অনেক দিন পর সে ছবিটা হাতে নিয়ে বাচ্চা ছেলের মতো হাউ মাউ করে কাঁদলো। ছোট বেলায় কান্না করলে দিদা খুব রাগ হতেন। ধমক দিয়ে বলতেন, ব্যাটা ছেলেদের নাকি কাঁদতে নেই। আজকে দিদা নেই, ধমক দেবার কেউ নেই। আজকে সে ইচ্ছে মতো কাঁদবে। 

৭৬

গভীর রাতে ভায়োলিনের সুর উঠল হাওয়ায়। সকাল শোয়া থেকে উঠে ধীরে ধীরে বারান্দায় এসে দাড়ালো। ভারি করুণ এই সুর। রাত গভীরের হাওয়ার সাথে, গাঢ় অন্ধকারের সাথে আর সকালের মনের ভেতরে জমে থাকা কষ্টগুলোর সাথে বেহালার এই হৃদয় ছেদক সুরটা মিলেমিশে এক আশ্চর্য হাহাকার সৃষ্টি করছিল শরীরের প্রতিটি রক্ত কণিকায়। মনে পড়ল সেই প্রথম রাতের কথা। যেদিন এই ভুতুড়ে বেহালার শব্দ শুনে আর গাছের নিচে লম্বা মানুষটাকে দেখে সে শিহরিত হয়ে উঠেছিল। আহা! এই এক জন্ম কেন, এ পৃথিবীতে শত বার জন্ম নিলেও সে এই মানুষটাকে ভুলতে পারবে না। এই বেহালার সুর তার অন্তরের প্রতিটি তারে তারে বাঁধা হয়ে গেছে। এই বাঁধন থেকে আর মুক্তি নেই। 

না হোক মুক্তি। এই কারাগারে সে আজীবন বন্দি থাকতে রাজি আছে। কিন্তু মানুষটা যে বড় কষ্ট পেলো। হে আল্লাহ, হে মালিক! মানুষটাকে তুমি সুখী করে দাও। তার কষ্টগুলো বিলুপ্ত করে দাও। সে ভালো থাকুক। খুব ভালো। সকাল যদি পারতো, ওই বেহালাবাদকের কষ্টগুলো সব টেনে হিঁচড়ে নিজের কাছে নিয়ে আসতো। ইশ, যদি একটা বার পারত! 

বিন্দুবাসিনী নিঃশব্দে এসে দাড়ায় ওর পাশে। আকাশে মেঘ ডেকে ওঠে। বিদ্যুৎ চমকায়। জঙ্গলের বুক থেকে হু হু করে ছুটে আসে উত্তরে হাওয়া। সকাল সেই হাওয়ায় আতরের খুশবু পায়। তার হঠাৎ কেন যেন হরিণডাঙ্গায় যেতে খুব ইচ্ছে করে। শেষবারের জন্য! 

৭৭

হরিণডাঙ্গায় ভোর হচ্ছে। মেঘ ভাসা আকাশের ধূসর শামিয়ানা ভেদ করে এই মাত্র জমিনে অবতরণ করলো দিনের প্রথম আলোক রশ্মি। ফিকে আলোটার দেখা পেতেই জঙ্গলের গাছে গাছে পাখিরা মেতে উঠল কোলাহলে। নেচে, গেয়ে শিস বাজিয়ে মহা আড়ম্বরে তারা বরণ করে নিতে লাগলো সূর্যদেবকে। এদিক-ওদিক দৌড়নো শুরু করলো কয়েকটা দুষ্টু আদুরে কাঠবেড়ালি। মেটে রঙের হৃষ্টপুষ্ট ঘোড়াটা চিঁহি চিঁহি করে ডেকে উঠল। রেশমী হাওয়ায় ছুটলো বুনো ফুলের গন্ধ। 

আনন্দম! আনন্দম! আনন্দম! 

জঙ্গলের ভোর মানেই আনন্দের ছড়াছড়ি। ঠিক সেই সময় ওই আবছা ভোরের আনন্দ ঘন কুঞ্জবনে হঠাৎ উপস্থিত হলো স্বয়ং হরিণডাঙ্গার রাজকন্যা। সাথে তার একান্ত বিশ্বস্ত সহচরী বিন্দুবাসিনী। রাজকন্যার গায়ে একটি লাল রঙের উলের শাল। শালের নিচে সাদা ফতুয়া আর নীল জিন্স। তার চুলগুলো এলো করে খোলা। চোখ দুটো স্বপ্নাচ্ছন্ন। তার পোশাকে রাজকন্যা সুলভ কোনো ছোঁয়া নেই। তবু তার রূপের ছটা আর হাঁটার ধরন দেখলেই তাকে রাজকন্যা বলে ঠাওর করা যায়। 

হরিণডাঙ্গায় রাজকন্যার পা পড়া মাত্র দমকা এক রেশমি হাওয়া তাকে অভ্যর্থনা জানালো। 

সকালের খোলা চুল সেই হাওয়ার দমকে এলোমেলো হয়ে গেলো। বাতাসে কী সুন্দর মিষ্টি একটা ঘ্রাণ! সে বুক ভরে শ্বাস নিলো। তার রাত জাগার ক্লান্তির উপর ধীরে ধীরে প্রলেপ পড়তে থাকলো। রাতে ঘুম হয়নি। সারারাত অপেক্ষা করেছে এই ভেবে যে ভোর হলেই হরিণডাঙ্গায় আসবে একবার। শেষ বারের মতো! যাত্রা যখন শুরু করেছে, তখনও জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে অন্ধকার ঘাপটি মেরে বসে আছে। একটু ভয় ভয় করছিল কিন্তু ভয়ের চাইতে বেশি হচ্ছিল উত্তেজনা। একটা আশ্চর্য শিহরণ হচ্ছিল ভেতরে ভেতরে, সেই সাথে ভালো লাগা। 

এদিকে রাজকুমার যে তার পর্ণকুটিরে রাত কাটিয়েছে, রাজকন্যার সেই তথ্যটা জানা ছিল না। রাজকন্যার এই আচমকা আবির্ভাবে রাজার কুমারের আধো ঘুমটা ভেঙে গেলো। সে চোখ মেলে কুটিরের পাতার ফাঁক দিয়ে চেয়ে আবিষ্কার করল একাকিনী, উদাসিনী, রূপবতী রাজকন্যাকে। 

ওক গাছের নিচে লালচে পাতার গালিচা বিছানো। হাওয়ায় হালকা দুলছে গাছের ডালে ঝোলা হ্যামক। এরিক তার ঘরের জানালা দিয়ে মাথা বের করে রেখেছে। সকাল ধীরে ধীরে বলল, ‘বিন্দু জানো, এরিককে বিক্রি করে দেবে।’ 

—‘হুম শুনেছি।’ 

—‘আমার না অনেক দিনের শখ ছিল একটা ঘোড়া পালবো। যদি পারতাম এরিককে আমি প্লেনে করে নিয়ে যেতাম ঢাকায়। 

শুনে বিন্দু খুব হাসলো। হেসে কুটি কুটি হয়ে বলল, ‘ঘোড়া প্লেনে উঠবে? বিষয়টা কল্পনা করেই আমার হাসি পাচ্ছে। 

—‘চাইলেই শিপে করে নিয়ে যাওয়া যেতো। কিন্তু আমার অত সামর্থ্য নেই। 

ততক্ষণে রাজার কুমার পর্ণকুটির থেকে বেরিয়ে এসেছে। তার গায়ে কালো উইন্ডব্রেকার। কালো জিন্স। চুল এলোমেলো। তার শ্রীময় মুখখানায় আজ ভারি মলিনতার ছাপ। সে কুটির থেকে বেরোনো মাত্র রাজকন্যাকে বলল, ‘আপনি?’ 

সকাল একটু চমকে উঠল। কিন্তু পরমুহূর্তেই সামলে নিলো চমৎকার ভাবে। সে এখন হরিণডাঙ্গার রাজকন্যা। তাকে কি বিচলিত হওয়া মানায়? 

—‘আমার রাজ্যে আমি কেন এসেছি তার কৈফিয়ৎ আপনাকে দিতে হবে?’ 

শুনে আরশান অদ্ভুত ভাবে একবার হাসল শুধু। মুখে কিছু বলল না। একটা বাচ্চা শেয়াল হরিণডাঙ্গার সীমানায় দাঁড়িয়ে জংলা ঝোপঝাড়ের আড়াল থেকে ভয়ে ভয়ে উঁকি দিচ্ছিল। আরশান এগিয়ে গিয়ে বাদামি চামড়ার শেয়ালটার গায়ে হাত বুলিয়ে খুব আদর করলো। সকাল একটু চমকে উঠে বলল, 

—‘ওমা! কামড়ে দেয় যদি?’ 

আরশান নরম আর আহ্লাদী গলায় বলল, ‘এটুকু বাচ্চা কামড়াবে? ওর তো মনে হয় দাঁতই গজায়নি এখনো।’

.

সকাল এরিকের মাথায় আলতো ভাবে একটা হাত রেখে বলল, ‘ওর পিঠে চড়া যাবে?’ আরশান প্রশ্নটা শুনে গম্ভীর ভাবে কিছু একটা চিন্তা করলো কয়েক সেকেন্ড। তারপর কোনো কথা না বলে এরিককে তার ঘর খুলে বের করল। জল খাওয়ালো। ছাউনির ভেতর থেকে একটি আসন নিয়ে আসলো। আসনটা লাগালো এরিকের পিঠে। ঠান্ডাভাবে হুকুম করলো, ‘উঠুন।’ 

সকাল হুকুমটা শুনে একটু হকচকিয়ে গেল প্রথমে। কী রকম ভয়ঙ্কর গমগমে গলার স্বররে বাবা! কিন্তু এখন তো তার সাথে কেউ এমন রাগী স্বরে কথা বলতে পারবে না। হুকুম দিতে পারবে না। এ মুহূর্তে সে হরিণডাঙ্গার রাজকন্যা। তার সাথে কথা বলতে হবে মাথা নুইয়ে আদব এবং বিনয়ের সাথে। সে কড়া ভাবে বলল, ‘আপনি একজন রাজকন্যাকে হুকুম করতে পারেন না।’ 

কথাটা শুনে আরশান এমন ভাবে তাকালো ওর দিকে যেন এহেন আজগুবি কথা সে এর আগে কোনো দিন শোনেনি। বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘দেখুন, আপনার এসব রাজকন্যা রাজকন্যা খেলায় আপাতত আমার মন নেই। খেলতে চাইলে একা একা খেলুন। আমাকে টানবেন না এসবে।’ 

সকাল আগুন চোখে আরশানকে একবার আগাগোড়া দেখে নিয়ে একদম অন্যরকম গলায় বলল, ‘এই বেয়াদবির কী শাস্তি হতে পারে জানো তুমি? গর্দানও যেতে পারে!’ 

 আরশান কথাটা শুনে বিষম খেলো। পর মুহূর্তেই হেসে ফেলল নিজের মনে।

—‘হাসছ যে খুব? গর্দান গেলে তখন মজা বুঝবে।’ আরশান হাসতে হাসতে বলল, ‘দুঃখিত ইওর হাইনেস! ভুল হয়ে গেছে। প্লিজ এই অধমের প্রাণ নেবেন না।’ কথাটা বলে শেষ করে সে হাঁটু গেঁড়ে মাটিতে বসে জিনের সিঁড়িটায় হাত চেপে ধরে সবিনয়ে বলল, ‘উঠুন শেহজাদী।’ 

সকাল সিঁড়িতে পা দিয়ে রাজকীয় ভাবে উঠে বসলো এরিকের পিঠে। তার চোখ মুখ গম্ভীর। চুলগুলো ছড়ানো পিঠের ওপর। চোখের চাউনি দেখে মনে হয় সত্যিই বুঝি সে কোন এক অচিন রাজ্যের রাজকন্যা। আরশান এরিকের লাগাম টেনে ধরে হাঁটা শুরু করলো। ভোরের তরল আলোটা তখন জঙ্গলের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে গেছে। পূবের আকাশ রঙিন। মেঘে মেঘে আলতা রঙের ছড়াছড়ি। নিচে দূর গ্রামের বাসিন্দারা জেগে উঠেছে ওপর থেকে দেখা যায় রাস্তায় চলাচল রত মানুষ, পোষা কুকুর, একটা দুটা চলন্ত গাড়ি আর সাইকেল। সামনের অসমান বুনো সুড়িপথ লাল লাল মেপল গাছের শুকনো পাতা দিয়ে ঢাকা। যেন এই পথ দিয়ে রাজকন্যা যাতায়াত করবেন বলে তাঁর সম্মানার্থে বিছানো হয়েছে লাল গালিচা। শুকনো পাতায় মড় মড় শব্দে পা ফেলে আরশান এরিকের রাশ টেনে ধরে ধীরে ধীরে হাঁটছিল। সকাল ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছিল চারপাশ। আরশানের চোখ সামনের দিকে। রাজকন্যার দিকে সে ফিরেও তাকাচ্ছে না। যেন রাজকন্যার মুখের দিকে চাওয়াও একটি গুরুতর অপরাধ। পথের দুপাশ নীল রঙের বুনো ফুল আর ঝাঁটি জঙ্গলে ভরা। হাওয়া স্নিগ্ধ কিন্তু বেশ শীতল। মেপল গাছের গুঁড়িতে বসে একটি লাল ঝুঁটি ওয়ালা কাঠঠোকরা অনেকক্ষণ যাবত ঠক ঠক করে কাঠ ঠোকরাচ্ছিল। ঘোড় সওয়ারিদের এই পথে আসতে দেখে সে মুখ তুলে তাকাল। তারপর ফুড়ুৎ করে উড়াল দিল অন্য গাছে। খানিক বাদে শেহজাদী অকস্মাৎ গম্ভীর গলায় আদেশ করে বসলেন, ‘থামো, থামো!’ 

আরশান থামালো এরিককে। ঘাড় ঘুড়িয়ে অবাক চোখে দেখলো ঘোড়ায় বসা রাজকন্যাকে। রাজকন্যা ঘোড়া থেকে নেমে মোহাবিষ্টের মতো এগিয়ে গেলেন জংলি ফুলের ঝোপের কাছে। থোকায় থোকায় ফুল প্ৰাণ ভরে, মন ভরে কুঁড়িয়ে নিলেন অনেকটা সময় নিয়ে। গুঁজলেন কানের পাশে। ভোরের মিহি আলো লেগে ছিল তাঁর চুলে, নাকে, চোখে। কী স্নিগ্ধ! কী অলৌকিক! আরশান রূপবতী রাজকন্যাকে নিবিড় ভাবে দেখছিল। দেখতে দেখতে তার চোখে কেমন নেশা লেগে যাচ্ছিল। 

লাল চাদরের কোচর ভর্তি ফুল নিয়ে রাজকন্যা যখন ঘোড়ায় চড়ে বসে আদেশ দিল, ‘চলো!’ তখনও সে মুগ্ধ নয়নে চেয়ে আছে, নির্বাক। 

—‘কী হলো?’ 

আরশান চুপচাপ হেঁটে এসে এরিকের পিঠে চড়ে বসলো। হতভম্ব শেহজাদী বিস্ময়ের ঝাপটায় কোনো কথা বলতে পারছিল না। হাত বাড়িয়ে ঘোড়ার রাশ টেনে ধরল আরশান। শেহজাদী সকাল ওর দু বাহুর মাঝখানে বন্দি হলো। আরশান এখন তার চুলের ঘ্রাণ পাচ্ছে। হাওয়ায় উড়ে এসে সেই খোলা চুল সুরসুড়ি দিচ্ছে তার গলায়। 

সকাল অনেক কষ্টে বলল, ‘কী হচ্ছে?’ আরশান হাসল। শেহজাদীর নিখুঁত সুন্দর দুটি ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে বলল, ‘শ শ শ…কথা নয়!’ 

তারপর ছুটলো এরিক ধূলো উড়িয়ে, বাতাস কেটে, টগবগিয়ে, খুরের আঘাত হেনে অক্টোবরের সোনালি ভোরের লাল গালিচা পাতা বুনো পথটি ধরে। সকাল মানুষটার নৈকট্য পেয়ে পাগল হয়ে যাচ্ছিল, স্নিগ্ধ হয়ে যাচ্ছিল। আতরের খুশবুতে ম ম করছিল চারপাশ। ভালোলাগায় তোলপাড় হয়ে যাচ্ছিল গোটা দুনিয়া। উঁচু নিচু পথ ধরে দৌড়াচ্ছিল এরিক। ঝাঁকুনি খেয়ে শেহজাদীর কোচরভর্তি জংলি ফুল ঝরে ঝরে পড়ছিল পথের ওপর। আরশান শক্ত করে রাশ টেনে ধরেছিল আর শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিল সকালকে। 

হরিণডাঙ্গায় ফিরল ওরা আধা ঘণ্টা পরে। সকালের চোখ মুখ থেকে উপচে পড়ছে খুশি। কিন্তু আরশানের মুখে হাসি নেই। গম্ভীরভাবে সে এরিককে ওক গাছের গুঁড়ির সাথে বেঁধে রাখছে। সেই সুযোগে সকাল একটা সাহসের কাজ করে ফেললো। চকিতে গিয়ে হাজির হলো পর্ণকুটিরের সামনে। লতাপাতার বেড়া ডিঙিয়ে ঢুকে গেলো ভেতরে। জায়গাটা খুব বেশি বড় নয়। ঘাসের ওপর বিছিয়ে রাখা চাদরে এলোমেলো করে ছড়ানো ছিটানো ছবি আঁকার নানা রকম সরঞ্জাম। একটা ল্যাপটপ। আর কয়েকটা মদের বোতল। ছবি আঁকার বোর্ডে একটি অসমাপ্ত জলরঙে আঁকা ছবি। ছবিতে একটা নদী আর দিগন্ত বিস্তৃত আকাশ দেখা যাচ্ছে। নদীর ওপর ভাসমান কিছু একটা তৈরি হচ্ছে। সেই ভাসমান বস্তুটির পুরোপুরি জন্ম হয়নি এখনো। 

—‘এখানে কী করছেন?’ গমগম করে প্রশ্ন করলো আরশান। 

রাজকন্যা সহাস্যে বলে,’আমার একটা শখ ছিল, শেষ ইচ্ছা বলতে পারেন। পূরণ করবেন?’ 

—‘কী ইচ্ছা?’ 

—‘আমার একটা ছবি এঁকে দেবেন? কেউ কোনোদিন আমার ছবি আঁকেনি।’ 

শুনে আরশান কী যেন চিন্তা করল খানিকক্ষণ ওর নিজস্ব কায়দায় মুখ বাঁকিয়ে। তারপর ক্ষীণ গলায় বলল, ‘ঠিক আছে। আপনি বাইরে গিয়ে বসুন। আমি আসছি।’ 

কিছুক্ষণের মাঝে ছবি আঁকার সরঞ্জাম নিয়ে আরশান বেরিয়ে আসলো। একটা ছোট মোড়ার আকারের গাছের গুঁড়ি খুঁজে নিয়ে আসলো জঙ্গল থেকে। বলল, ‘এটাতে বসুন।’ 

ওক গাছের নিচে, লাল পাতার গালিচার ওপর গাছের গুঁড়ি পেতে বসলো সকাল। তার একটু দূরে মুখোমুখি ছবি আঁকার বোর্ড দাঁড় করলো আরশান। 

সকাল গায়ে জড়ানো চাদরটা নিয়ে কী করবে বুঝে পেলো না। খুলে রাখবে? নাকি জড়ানোই থাকবে? মনে পড়ল সেদিন গায়ে চাদর জড়িয়েছিল বলে আরশান কী রাগটাই না করেছিল। সে একটু অস্বস্তি নিয়ে বলল, ‘কীভাবে বসবো? চাদরটা থাকবে? নাকি খুলে রাখবো?’ 

আরশান চোখ তুলে একবার আগাগোড়া দেখলো সকালকে। ভাবলেশহীন গলায় বলল, ‘চাদর থাক। আমি শুধু আপনার ফেস আঁকবো। শরীর নয়।’ 

কাটা কাটা কথা শুনে সকালের একটু রাগ ধরে যায়। সে বিড়বিড় করে বিন্দুবাসিনীকে বলে, ‘ভাবটা দেখো না বিন্দু! গায়ে জ্বালা ধরে যায়।’ 

বিন্দু পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। সকালের কথাটা শুনে সে খিলখিল করে হেসে উঠল। কিছু বলল না। 

—‘কার সাথে কথা বলছেন আপনি?’ আরশানের কণ্ঠে বিস্ময় খেলা করে। 

সকাল স্পষ্ট বলল, ‘কার সাথে আবার? বিন্দুর সাথে! 

—‘বিন্দুটা কে? …..ওহ! আপনার ইমাজিনারি ফ্রেন্ড?’ 

 বলে আরশান হাসে। হামবড়া, নাক উঁচু হাসিটা। আগে এই হাসিটা তার গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দিত। কিন্তু আজ মনে হলো এত সুন্দর করে এই পৃথিবীতে আর কেউ হাসতে পারে না। যে এই হাসি একবার দেখবে, সে পাগল হয়ে যাবে! 

আরশান বলল, ‘নড়বেন না, কেমন? 

—‘পাথর হয়ে বসে থাকতে হবে?’ 

—‘হ্যাঁ পাথর হয়ে বসে থাকতে হবে। আপনার ইমাজিনারি ফ্রেন্ডকে বলুন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে। কথা বলে বিরক্ত করা যাবে না।’ 

—‘ঠিক আছে।’ সকাল বলল। 

এক জোড়া কার্ডিনাল পাখি সকালের পায়ের কাছে এসে লুটোপুটি খাচ্ছিল। ওক গাছের ডালে দোল খেতে খেতে মন কাঁড়া সুরে শিস দিয়ে ডাকছিল একটি রুবি ক্রাউন্ড কিংলেট পাখি। আর কোমল মসৃণ হাওয়াটা সকালের খোলা চুল নিয়ে খেলছিল ইচ্ছে মতো। 

আরশানের আচ্ছন্ন দুটি চোখ সকালের মুখের মাঝে নিলীন হয়ে ছিল। অপলক চেয়ে থেকে মনে মনে কী যেন মাপজোক করে নিল সে। তারপর হাত চালাতে শুরু করলো। সাদা কাগজে পড়ল প্রথম তুলির দাগ। 

হাত চালানোর ফাঁকে ফাঁকে সে সকালের দিকে চাইছে, একাগ্রচিত্তে পড়ছে সকালের মুখ। একটা সময় তার আবিষ্ট চোখদুটো গিয়ে পড়ল সকালের নিটোল ঠোঁটজোড়ায়। 

সকালের দৃষ্টি তাক করা ছিল চিত্রকরের দিকে। চিত্রের কারিগর যখন নেশাড়ু চোখে ওকে ওলটপালট করে দেখছিল, একটা অদ্ভুত শিহরণে কেঁপে কেঁপে উঠছিল তার অন্তরের অন্তর্দেশ। এই মাদক মাদক চাহনীটা সে খুব বেশি মিস করবে। এই একটি মাত্র পুরুষ, যে তাকালে তার কখনো গা ঘিনঘিন করে না বরং একটা পবিত্রতায় ছেয়ে যায় সমস্ত সত্তা। মনে হয় 

যেন ওর ওই চেয়ে থাকার জন্যই তার জন্মটা হয়েছিল এ পৃথিবীতে।  

কিন্তু কাল বাদে পরশু সকাল যখন এই দেশ ছেড়ে চলে যাবে, তারপর …..আর কোনোদিন মানুষটা তার দিকে চাইবে না এমন ভাবে। এ কথা মনে হতেই তার চোখ দুটি হঠাৎ ঝাপসা হয়ে উঠল। ঠোঁট উঠল কেঁপে। সে প্রাণপণে চেষ্টা করলো নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার। শিরদাড়া সোজা করে টান টান হয়ে বসে রইল। খানিক বাদে তার দুচোখ বেয়ে টপ টপ করে গড়িয়ে পড়তে লাগলো জল। 

আরশান ওই অশ্রুভেজা মুখখানার দিকে বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে চেয়েছিল। ভোরের পেলব রোদে হীরের মতো চিকচিক করছে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রু বিন্দু। তার বুক থেকে দীর্ঘ একটা কাঁপা কাঁপা শ্বাস নেমে আসলো। সে হাত নামিয়ে ভারি ক্লান্ত গলায় বলল, ‘এভাবে হবে না। আপনি চলে যান। এখন ভালো লাগছেনা আঁকতে।’ 

কথাটা বলে সে খুব দ্রুত পায়ে হেঁটে ঢুকে গেলো কুটিরের ভেতর। সকাল গাছের গুঁড়ির ওপর বসে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে কাঁদলো। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বিন্দুকে বলল, ‘চল বিন্দু! থেকে আর কাজ নেই! 

৭৮

অফিস যাবার আগে ফাহাদ একবার উঁকি দিলো পাতাল ঘরে। আরশান কফি তৈরি করছিল। ফাহাদের উপস্থিতি টের পেয়েও সে তেমন একটা গা করলো না। কফির মগে কফি মেট মেশালো। সময় নিয়ে চামচ দিয়ে নাড়লো। টোস্টারে রুটি গরম করলো। আর এই পুরো সময়টা ফাহাদ সোফায় বসে অপেক্ষা করলো। কথা বলে আরশানের কাজে ব্যাঘাত ঘটাল না। 

কিছু সময় পর আরশান এক হাতে রুটি আর অন্য হাতে কফির মগ নিয়ে সোফায় এসে বসলো, ফাহাদের পাশে। চোখ তুলে তাকালো না। মনোযোগ দিয়ে রুটিতে কামড় বসালো। 

ফাহাদই কথা বলল প্ৰথম, ‘ভাই!’ 

—‘বলো। ‘ আরশান বলল ফাহাদের দিকে না তাকিয়েই। 

—‘একটু কথা বলব তোমার সাথে?’ 

—‘বলো, শুনছি।’ 

—‘আমার খুব খারাপ লেগেছে পুরো ব্যাপারটা জানতে পেরে। ড্যাড কাজটা একেবারেই ঠিক করেনি।’ 

আরশান একটা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বলল, ‘বাদ দাও ওসব কথা।’ 

—‘হ্যাঁ আমিও ঠিক এটাই ভাবছিলাম। তোমারও উচিত পেছনের ঘটনাগুলোকে পেছনেই ফেলে আসা। সামনের দিকে তাকাও ভাই। দিনগুলো সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পেছনে কিছুই নেই।’ 

আরশান কিছু বলল না। কফির মগে চুমুক দিলো। 

—‘আর আরেকটা বিষয় নিয়ে তোমার সাথে কথা বলতে চাইছিলাম। সকালের সাথে আমার বিয়ের কথাটা একেবারেই প্রাইমারি লেভেলে ছিল। হ্যাঁ মম হয়তো শতভাগ পছন্দ করেছিল ওকে আমার জন্য কিন্তু আমি কিংবা সকাল আমরা কেউই এই সম্পর্কটাকে সিরিয়াসলি নেইনি কখনো। তুমি কি বুঝতে পারছ?’ 

আরশান কিছুটা বিরক্তি আর কিছুটা উদাসীনতা নিয়ে বলল, ‘ফাহাদ এসব নিয়ে কথা বলার কোনো মানে হয় না এখন।’ 

ফাহাদ এ কথা শুনে একটু ক্ষণ চুপ করে থাকলো। তারপর খুব গুরুত্ব দিয়ে বলল, ‘সকালকে যেতে দিও না ভাই! ওকে আটকাও।’ 

—‘যেতে না দেয়ার আমি কেউ নই।’ 

—‘কী বলছো এসব? তুমি ওকে ভালোবাসো না?’ 

—‘কাউকে ভালোবাসার মতো কোনো যোগ্যতা আমার নেই। আমি ভালোবাসতে পারি না।’ 

—‘ভুল করছো।’ 

—‘আমার জন্মটাই ভুল ছিল।’ 

—‘এভাবে বলো না।’ 

—‘আসলে আমি সকালকে ডিজার্ভ করি না। আমার জীবনটা বড্ড এলোমেলো। আমার এই এলোমেলো জীবনে এসে ও শুধু কষ্টই পাবে।’ 

—‘তোমার অতীত একটু এলোমেলো হলেও বর্তমানটা কিন্তু খুবই গোছানো ভাই। তুমি চাইলেই সবকিছু ভুলে গিয়ে নতুন করে সব শুরু করতে পারো। 

আরশান এবার তাকালো ফাহাদের দিকে। চোখে চোখে চেয়ে খুব ঠান্ডা ভাবে বলল, ‘বাবাকে আমি খুব বিশ্বাস করেছিলাম জানো? আমার গোটা পৃথিবী এক দিকে আর তিনি অন্যদিকে ছিলেন। তাকে ভালোবেসে বিশ্বাস করে নিজের মাকে ঘেন্না করে এসেছি সারাজীবন। মৃত্যুর আগে আমার মা আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছিলেন। বাবা তার সেই শেষ ইচ্ছেটাও পূরণ করেননি। আমার মা জীবনে কিছুই পায়নি। কিচ্ছু না! আমার খুব ইচ্ছে ছিল জীবনে একটা বার অন্তত নিজের মায়ের মুখটা দেখব। শুধু একটা সাদামাটা সাক্ষাৎ। সেই সাক্ষাৎটা তো এই জীবনে আর কখনো হবে না ফাহাদ! এই জীবনের প্রতি আমার একটা চরম বিতৃষ্ণা এসে গেছে। এভাবে খুব বেশিদিন মনে হয় বেঁচে থাকতে পারবো না।’ 

‘ভাই প্লিজ! এভাবে বলো না। দেখো ড্যাড হয়তো একটা ভুল করে ফেলেছে। কিন্তু এই ভুলের পেছনে কাজ করেছে তোমার প্রতি তীব্র ভালোবাসা। তুমি একটু বোঝার চেষ্টা করো। আমাদের কথাও একটু চিন্তা করো। আমরা তো তোমাকে ভালোবাসি। তুমি এরকম মরা মরা হয়ে থাকলে আমরা তো শান্তি পাবো না।’ 

—‘আমরা বলতে কারা ফাহাদ?’ 

—‘আমরা বলতে আমি, টিলি…আর মম। তুমি জানো না মম খুব কান্নাকাটি করছে গত কাল থেকে।’ 

আরশান একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘অত চিন্তা করোনা। আমি ঠিক আছি। তোমার অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে। তুমি এসো এখন।’

ফাহাদ উঠে দাড়াতে দাড়াতে গলায় একটু আকুতি নিয়ে বলল, ‘সকালকে কষ্ট দিও না ভাই। ও তোমাকে খুব ভালোবাসে।’ 

আরশান কিছু বলল না। চোখ নামালো। 

ফাহাদ বলল, ‘তোমার একটা পার্সেল এসেছে। আমি রিসিভ করেছি ভোরবেলায়। নর্ডস্টর্ম থেকে। এখানে দিয়ে যাবো?’ 

আরশানের মনে পড়ল। কদিন আগে একটা জিনিস অর্ডার করেছিল সে অনলাইনে। সকালের জন্য। বড় অসময়ে এসে পৌঁছুলো জিনিসটা। 

তার কেবলই সবকিছু দেরি হয়ে যায়, এলোমেলো হয়ে যায়, নষ্ট হয়ে যায়…কপালের ফের! 

—‘থাক আমি নিয়ে আসবো। তোমার কষ্ট করার প্রয়োজন নেই।’ 

একটু পর আরশান উঠে আসলো ওপর তলায়। ড্রইংরুমের সেন্টার টেবিলের ওপর পার্সেলের বাক্সটি রাখা। আরশান ওয়ালেট থেকে ছোট সাদা রঙের একটি কার্ড বের করলো। কার্ডের ওপর তার নিজের নাম ধাম, চাকরির বৃত্তান্ত ইত্যাদি ছাপার অক্ষরে লেখা আছে। বুক পকেটে একটা কলম ছিল। কলম হাতে নিয়ে কার্ডের উল্টো পিঠে খস খস শব্দ তুলে কিছু একটা লিখলো সে। লেখা হয়ে গেলে নিচে নেমে এসে নিজের ঘর থেকে স্কচটেপ খুঁজে নিয়ে আসলো। কার্ডটা আটকে দিল স্কচটেপ দিয়ে বাক্সের গায়ে। তারপর বাক্স হাতে নিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে আসলো সকালের ঘরে। 

ঘরটা ফাঁকা। কেউ নেই। বিছানা পরিপাটি। কোথায় গেলো মেয়েটা? যাবার কথা তো আরো দুদিন পরে। 

সে বাক্সটা বিছানায় রাখলো। বসলো বিছানার ওপর। বসেই রইল চুপচাপ। অনেকটা ক্ষণ! জানালার বাইরে অক্টোবরের এক ঝকঝকে রোদ ধোয়া সকাল। সকাল! তারও একটা সকাল ছিল। আজ থেকে আর নেই অক্টোবরও চলে যাবে। অক্টোবরকে আর আগের মতো করে ভালোবাসা হবে না কখনো। বরং অক্টোবর আসলে তার অনেক অনেক কিছু মনে পড়ে যাবে। 

আচ্ছা! তার কেন মন খারাপ হচ্ছে? সে তো চিরদিন একটা বন্ধনহীন নিশ্চিন্ত জীবনের প্রত্যাশা করে এসেছে। সম্পর্ক মানেই তো বোঝা! শেষমেশ তার সেই আরাধ্য জীবনটা তার কাছে এসে ধরা দিলো। এতকাল বাবার কথা ভেবে এ বাড়িতে বাঁধা পড়ে ছিল। এখন সেই বাঁধন কাটাবার সময় এসেছে। হঠাৎ তার মনের ভেতর এক অদ্ভুত সংজ্ঞাহীন সুখের সঞ্চার হল। নিজের মনে হাসলো সে। 

আজ থেকে তার আর কোনো পিছুটান নেই। সে স্বাধীন! 

৭৯

বাড়ির ভেতরে কেমন দমবন্ধ হয়ে আসছিল সকালের। একটা মন খারাপ করা তিক্ত বাতাস পরিপূর্ণভাবে গ্রাস করে ফেলেছে বাড়িটাকে। চাচা সারাদিন ঝিম ধরে বসে আছেন। চাচি কান্নাকাটি করছেন। টিলিটা মুখ শুকনো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সকাল আর টিকতে পারছিল না। তার একটু খোলা হাওয়ায় দম নেবার প্রয়োজন ছিল। সে আর না পেরে চাচিকে বলল, ‘চাচি, একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি নাবিলার সাথে। বাসায় ভালো লাগছে না।’ 

চাচি রাজি হয়ে গেলেন, বললেন, ‘তোমার যেমন ইচ্ছে তেমন কর মা। আমার আর কিছু বলার নেই।’ 

নাবিলা আর ওর নতুন রুমমেট এসেছিল সকালকে পিক আপ করতে। নাবিলা সকালকে নতুন মেয়েটির সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। তার নাম দিহা। এসেছে সুদান থেকে। মেয়েটা দেখতে যে কী ভীষণ সুন্দর! টানা টানা মায়াবী চোখ। খাঁড়া নাক। এরকম নিখুঁত সুন্দরী সামনা-সামনি খুব কম দেখেছে সকাল। দিহা’ই গাড়ি চালাচ্ছিল। নাবিলা ড্রাইভিং সিটের পাশে বসা। সকাল গাড়ির পেছনের সিটে বসে ড্রাইভারকে মুগ্ধ চোখে দেখছিল। 

নাবিলা বলল, ‘শপিং টপিং সব শেষ? মলে যাবি নাকি?’ 

—‘শপিং শেষ না কিন্তু আমার টাকা শেষ। আর কিচ্ছু কিনতে পারবো না রে। তবে এমনি ঘুরতে যেতে পারি।’ 

—‘চল তাহলে। ঘুরতেই যাই।’ 

দিহা ঘাড় ঘুরিয়ে এক পলক সকালকে দেখে নিয়ে ইংরেজিতে বলল, ‘আমি তোমার বয়ফ্রেন্ডকে চিনি।’ 

সকাল বেশ চমকে উঠল আকস্মিক এই অপ্রাসঙ্গিক কথাটা শুনে। নাবিলাও অস্বস্তিতে পড়ে গেল। দুদিন আগে গল্পে গল্পে সকালের সাথে আরশানের সম্পর্কের কথা বলেছিল সে দিহাকে। দিহা ফাহাদ আর আরশান দুই ভাইকেই চেনে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে নাবিলা নিজেই সকালকে বলতো ব্যাপারটা। হয়তো আরশানের সাথেও দেখা করিয়ে দিত দিহার। কিন্তু এখন যে চিত্র একেবারে পাল্টে গেছে এই খবরটা তো দিহার জানার কথা নয়। নাবিলা চেয়েছিল আরশানদের বাড়ির গুমোট ভাবটা থেকে সকালকে অল্পক্ষণের জন্য হলেও দূরে সরিয়ে নিতে। কিন্তু দিহা মেয়েটা তো একেবারে বিসমিল্লায় গলদ বাঁধিয়ে দিলো। 

সকাল একটু অবাক গলায় বলল, ‘কী করে চেনো?’ 

দিহা তার সুন্দর মুখ ভরে চমৎকার এক হাসি হাসলো, ‘আমি ওর অফিসে কাজ করেছি কিছুদিন। ইন্টার্নি ছিল।’ 

—‘তুমি কি আর্কিটেক্ট?’ 

—‘হুম আমি আর্কিটেক্ট। তুমি জানো? তোমার বয়ফ্রেন্ডের ওপর আমার ভয়ঙ্কর ক্রাশ ছিল।’

সকাল হেসে ফেললো, ‘সিরিয়াসলি?’ 

—‘সিরিয়াসলি! আমি পাগল ছিলাম ওর জন্য। সরাসরি বলেও দিয়েছিলাম ভালো লাগার কথা।’ 

দিহার অকপট স্বীকারোক্তিতে না হেসে উপায় ছিল না সকালের। মেয়েটা ভালোই পাগল আছে। সে হাসতে হাসতেই বলল, 

—‘তো বলার পর ও কী বলেছিল?’ 

—‘করুণার হাসি হেসে বলেছিল, আই থিংক ইউ ডিজার্ভ সাম ওয়ান বেটার দ্যান মি! এর পরেও আমি পিছু ছাড়িনি। ফোন নম্বর যোগাড় করে খুব জ্বালাতাম।’ 

—‘কত দিন আগের কথা এসব?’ 

—‘এইতো সাত আট মাস হলো। খুব বেশি দিন হয়নি। তুমি কিন্তু খুব লাকি। আমার খুব হিংসে হচ্ছে তোমাকে! 

সকাল একটু অন্যমনস্ক ভাবে বলল, ‘তোমার মতো সুন্দরী মেয়েকে না করে দিল? এটা কোনো মানুষ করতে পারে?’ 

দিহা ওর চমৎকার হাসিটা আরেকবার হাসলো, ‘তোমাকে দেখে এখন বুঝতে পারছি কেন আমাকে ওর পছন্দ হয়নি।’ 

—‘কী বুঝলে?’ 

—‘তোমার মধ্যে একটা ভীষণ পবিত্র ভাব আছে। আর তোমার হাসিটা যে কী দারুণ! আমি স্ট্রেইট না হলে নির্ঘাৎ তোমার হাসির প্রেমে পড়তাম!’ 

সকাল লাজুক গলায় বলল, ‘যা! তুমি আমার চেয়ে আরো অনেক বেশি সুন্দর।’ 

টাইসুনস কর্নারে অনেকটা ক্ষণ ঘুরলো ওরা। সামনেই হ্যালোইন। প্রতিটা দোকানে হ্যালোইনের সাজ-সজ্জা। পশ্চিমাদের ভূত প্রেত নিয়ে শৌখিনতা দেখার মতো। ভূত-প্রেতের পোশাক, খেলনা, পেইন্টিং আর ঘর সাজানোর জিনিসে ভরে গেছে সব দোকান পাট। শুধু ভূত নয়, হ্যালোইন উপলক্ষে ছেলে-মেয়েরা সাজবে পছন্দের সব ফিকশনাল ক্যারেক্টারের সাজ। কেউ প্রিন্সেস, কেউ হুইচ, কেউ বা আবার সুপার হিরো। বাচ্চাদের জন্য এরকম নানা সাজ-পোশাকে জমজমাট হয়ে আছে প্রতিটি স্টোর। সেই সাথে আছে ফল সিজনের বিশেষ বৈচিত্র্যপূর্ণ সরঞ্জাম। হলদে আর লাল গাছ লতা-পাতার নকশা ওয়ালা নানা রকম ঘর সাজানোর সামগ্রী। চারিদিকে বেশ জমকালো ভাব। নাবিলা জানালো এই উৎসব উৎসব ভাবটা টানা চলবে ক্রিসমাস পর্যন্ত। হ্যালোইনের পর পর থ্যাংকস গিভিং, এরপর ক্রিসমাস। এই উৎসব-গুলোকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের দোকানগুলোতে চলবে দীর্ঘ মেয়াদি ছাড় এবং আকর্ষণীয় নানা রকম অফার। বেশিরভাগ লোকজন বছরের এই সময়টাকে কেনাকাটা করার সর্বোৎকৃষ্ট সময় বলে মনে করে। এছাড়া নভেম্বরের শেষে থাকছে ব্ল্যাক ফ্রাইডে। যেদিন কিনা সব রকম ইলেক্ট্রনিক্স জিনিসের ওপর সারাদিন ব্যাপী থাকবে আকর্ষণীয় ছাড়। 

হরেক রকম রঙের ভিড়ে, হরেক মানুষের গায়ের গন্ধে একটু একটু মনের মেঘ কাটছিল সকালের। একটু স্বস্তির হাওয়া বইছিল মনের বারান্দায়। কিন্তু সেই স্বস্তিটাও বড় ক্ষণিকের জন্য। যখনই মনে পড়ছে দুদিন পর ওই মানুষটাকে ছেড়ে চলে যেতে হবে, অনেক দূরে। এবং সেই যাওয়ার পর আবার কখনো দেখা হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ, তখনই এক অসহনীয় কষ্ট বুক খামচে ধরছে। পৃথিবী অন্ধকার হয়ে আসছে। হাহাকারে ছেয়ে যাচ্ছে চারপাশ। ভালো থাকার অভিনয় করতে করতে হাঁপিয়ে উঠছে সে। হঠাৎ মনে হলো এর চেয়ে বাড়ির মধ্যে বদ্ধ ঘরে বসে থাকাই ঢের ভালো ছিল। কয়েকদিন সময় লাগবে তার নিজেকে নিজের মাঝে ফিরে পেতে। মানুষের ভিড়ে সে এখন মিশতে পারবে না। 

দুপুরে আমেরিকান তন্দুর নামে একটা রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করলো ওরা। ইন্ডিয়ান খাবার আমেরিকান স্টাইলে রান্না করা হয়েছে। খাওয়ার পর বোঝা গেলো এ খাবার ঠিক আমেরিকানও না, ইন্ডিয়ানও না। মিলেমিশে অদ্ভুত একটা স্বাদ হয়ে উঠেছে। সকালের ভালো লাগলো না স্বাদটা। 

খাবার পর বাড়ি ফিরে যাবার জন্য অস্থির হয়ে উঠল সে। কিন্তু নাবিলা ছাড়লো না ওকে। ধরে বেঁধে বাসায় নিয়ে গেলো। নাবিলার হাত থেকে ছাড়া পেতে পেতে রাত হয়ে গেল। রাত দশটার সময় দিহা গাড়ি ড্রাইভ করে এসে নামিয়ে দিয়ে গেলো ওকে। 

বাড়িতে ঢোকার মুখে কেন যেন একবার দাঁড়িয়ে পড়ল সকাল। ব্যাক ইয়ার্ডে যাবার ইচ্ছেটাকে গলা টিপে হত্যা করলো। একটা দীর্ঘ নিশ্বাস বেরিয়ে গেলো তার বুক চিরে। কেন বারবার ওখানটায় যেতে ইচ্ছে করে? 

এতো অপমানের পরেও শিক্ষা হয়না কেন তার? 

ঘরে এসে বাতি জ্বালালো। বিছানার ওপর একটা বেশ বড়সড় বাক্স রাখা। কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে গেল সে। বাক্সের ওপরে একটা কার্ড লাগানো আছে স্কচটেপ দিয়ে। চিরকুটে লেখা, ‘ভালো থাকবেন হরিণডাঙ্গার রাজকন্যা! আপনার টোল পড়া হাসিটাকে যত্নে রাখবেন। হ্যাপি হ্যালোয়িন! 

হাতের লেখাটা চিনতে পেরেছে সকাল। এই হাতটাই একদিন তাকে কাগজে লিখে দিয়েছিল, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মেয়েটার জন্য। সাথে ছিল নীল জংলি ফুল। আজকে দুরুদুরু বুক নিয়ে বাক্সটা খুললো সে। ভেতর থেকে উঁকি দিলো সাদা রঙের একটি নেট আর সিল্ক মেশানো ভাঁজ করা ফুলে ফেঁপে থাকা কাপড়। কাপড়টা হাত দিয়ে খুলে মেলে ধরতেই দেখা গেলো এটি একটি লম্বা ঘের ওয়ালা জামা। 

প্রিন্সেস ড্রেস! 

হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে উঠল। আয়নার কাছে ছুটে গিয়ে জামাটা নিজের সামনে মেলে ধরলো সে। তাকে এখন সত্যিকারের রাজকুমারী বলে মনে হচ্ছে। মাথায় একটা মুকুট থাকলেই ষোলো আনা পূর্ণ হতো। নিজেকে এতটা সুন্দর এর আগে তার কখনো লাগেনি। তার চোখের দেয়াল উপচে নামতে থাকল জলের ধারা। আহা অনেক দিনের শখ ছিল সিন্ডারেলার মতো, এলসার মতো, বেলার মতো, প্রিন্সেস ড্রেস পরে সে সত্যিকারের প্রিন্সেস সাজবে একদিন! আজ অবশেষে সেই দিন আসলো! 

জামাটা হাতে নিয়ে খুশিতে বাক বাকুম হয়ে গেল সকাল। ঘুরে ঘুরে নাচতে লাগলো, গাইতে লাগলো। আবার ভস করে কেঁদেও ফেললো। 

বিন্দুবাসিনীর মুখটা ভেসে উঠল শূন্যে, ‘একি শেহজাদী? কাঁদছেন কেন?’ সকাল কাঁদতে কাঁদতেই বলল, ‘দেখেছ বিন্দু? আজকে আমি সত্যিকারের প্রিন্সেস। আমার একটা প্রিন্সেস ড্রেস আছে।’ 

বিন্দু খুব হাসলো, ‘আপনি কী যে বলেন শেহজাদী! আপনি তো সবসময়ই সত্যিকারের প্রিন্সেস। প্রিন্সেস হবার জন্য কি আবার প্রিন্সেস ড্রেস লাগে নাকি? এসব পোশাক ছাড়াই তো আপনি হরিণডাঙ্গার রাজকন্যা।’ 

সকাল বিন্দুর কথা শুনে কান্না মাখা মুখটা নিয়ে ভারি মিষ্টি হাসে, বলে, ‘তুমি বুঝবে না বিন্দু। আমার কেমন যে একটা ফিলিংস হচ্ছে সেটা আমি কাউকে বলে বোঝাতে পারবো না। সবচেয়ে বড় কথা হলে পছন্দ করে আমাকে এই উপহারটা দিয়েছে। এরপরেও বলবে ভালোবাসে না।’ 

—‘ভালোবাসে তো!’ 

—‘স্বীকার করে না তো।’ 

—‘স্বীকার না করলেই কী? ভালোবাসার কথা অত বলতে নেই। 

সকালকে দ্বিধাগ্রস্ত দেখায়, ‘কিন্তু আমার যে তার কাছ থেকে একটা বার অন্তত শুনতে ইচ্ছে করে কথাটা। আসলে কি জানো, ভালোবাসলে বিয়েটা এত সহজে ভেঙে দিতে পারত না। ভালোবাসে না। আমি শিওর!’ 

বিন্দুবাসিনী এ কথা শুনে কেমন গম্ভীর হয়ে যায়। কিছু বলে না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে ঘরের কোণে। 

খানিক বাদে ভায়োলিনের সুর ওঠে হাওয়ায়। সকাল প্রিন্সেস ড্রেস হাতে নিয়ে বারান্দায় এসে দাড়ায়। 

আজকের বেহালার সুরটা তার চেনা। 

‘Will you love me like you loved me in the October rain?’ 

আঁধার রাতের বাতাসে হাহাকারের মতো ছড়িয়ে পড়ছে সুরটা। বিষাদে ভরিয়ে দিচ্ছে চারপাশ। কান্নার মতো মিশছে গিয়ে নিঝুম অরণ্যের বৃক্ষরাজির মাঝে। 

ভার্জিনিয়ায় সকালের আজ শেষ সকাল। এবার যেতে হবে। দেশটা ডাকছে। ডাকছে নিজের পরিবার। সব চলে যাওয়াতেই অল্প বিস্তর শোকের উপস্থিতি থাকে। আজকের এই চলে যাওয়াতে শোকের পাশাপাশি আছে হতাশা। ভোরবেলা ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে তাকে চেপে ধরেছে এক বুক গহন হতাশা বোধ। 

মানুষটাকে নিয়ে ঘর করার এক অদম্য সুপ্ত বাসনায় পেয়ে বসেছিল তাকে। মনের ডায়েরীতে স্বপ্নের বুনন বুনেছিল বেখেয়ালে, আনমনে। স্বচ্ছ কাচের বাক্সে যত্নে মোড়া স্বপ্নগুলো যেন আকস্মিক হাত ফসকে পড়ে ঝনঝন করে ভেঙে গেলো। এখন সেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভাঙাচোরা স্বপ্নের টুকরোগুলোর মাঝে লুণ্ঠিত হয়ে বসে আছে সে। মনে হচ্ছে যেন 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *