৭০
আরশানের তথাকথিত খালার সাথে দেখা করার কথা সন্ধ্যা সাতটায় সেন্টারভিলে একটি চাইনিজ রেস্টুরেন্টে। অফিস থেকে বেরিয়ে সরাসরি সেখানেই চলে যাবার কথা ছিল তার। কিন্তু সকাল ফোন করে বলেছে তার নাকি খুব জরুরি একটা কথা আছে। জরুরি কথাটা খুব তাড়াতাড়ি বলা চাই। অগত্যা আরশানকে প্ল্যানটা একটু বদলে নিতে হলো।
ছয়টার সময় অফিস থেকে বেরিয়ে সে প্রথমেই ছুটে চলল বাড়ির পথে। রোজ অফিস ছুটির সময়টায় রাস্তায় ট্রাফিক থাকে মারাত্মক। আধাঘণ্টার পথ অতিক্রম করতে লেগে যায় পাক্কা এক ঘণ্টা। সারি বেঁধে গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে থাকে ঠায়। পিঁপড়ার মতো পিল পিল করে এগোয়। স্টিয়ারিং এ হাত রেখে শূন্য চোখে চেয়ে ছিল আরশান হলুদ বাতির চোখ ওয়ালা সারি বেধে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলোর দিকে।
অফিসে কাজের চাপ প্রচুর। জাপানী এক ভদ্রলোক ফ্লোরিডার মায়ামিতে একটি স্টিল হাউজ বানাবেন। কোটি কোটি টাকার প্রজেক্ট। বাড়িটি হবেও ভারি আধুনিক। শোবার খাট থেকে শুরু করে ঘরের প্রতিটি আসবাব থাকবে দেয়ালের মাঝে লুকায়িত অবস্থায়। ব্যবহারকারী প্রয়োজনের সময় সুইচ টেপা মাত্র দেয়াল ফুঁড়ে নির্দিষ্ট আসবাব প্রকাশ্যে বেরিয়ে আসবে। ব্যবহার শেষ হলে আবার সেই আসবাব যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফিরে যাবে পূর্বের স্থানে। এছাড়া বেডরুমের জানালা থেকে সরাসরি সুইমিং পুলে ঝাঁপ দেবার মতো ব্যবস্থা থাকতে হবে। অর্থাৎ বাড়ির ডিজাইন করতে হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক আঙ্গিকে। মাথা থেকে বাদ বাকি সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে কাজে নামতে হবে। কাজে মনোনিবেশ করতে হবে পরিপূর্ণ ভাবে।
কিন্তু তা আর হচ্ছে কোথায়? সকাল আছে আর মাত্র তিনদিন এই দেশে। তার ওপর ওর বাবা যদি বিয়েতে রাজি না হয়…. আরশান আর ভাবতে পারছিল না। তার বুকের ভেতর ক্রমশ একটা ব্যথা ঘনিয়ে আসছিল।
সকাল বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিল, প্যাটিও তে। একটা নীল জামদানী শাড়ি তার পরনে। গায়ে জড়ানো নীল চাদর। সুন্দর দেখাচ্ছিল তাকে।
আরশান যখন পৌঁছুলো তখন সন্ধ্যে নেমে গেছে। ড্রাইভ ওয়েতে আরো দুটো অচেনা গাড়ি রাখা ছিল। দেখে বুঝলো আরশান, বাড়িতে অতিথি এসেছে। গাড়ি গ্যারেজে রাখলো না সে। স্ট্রিট পার্কিং করলো।
পশ্চিমের আকাশে নানা রঙের খেলা। কোনো উঁচু দরের শিল্পী যেন এই মাত্র জলরঙে এঁকে গেছে ওপাশের আকাশটা। হাওয়া ঠান্ডা কিন্তু প্রফুল্ল। আরশানের গায়ে সাদা শার্ট, তার ওপরে কালো ওভার কোট।
একটু দূরে বাগানের কাছের লনটায় চিকেন বারবিকিউ করা হচ্ছ। রহমান সাহেব নিজেই বারবিকিউর তদারকি করছেন। তাঁর পাশে অনিক দাঁড়িয়ে আছে।
ধোঁয়া উঠছে। কয়লা পোড়া গন্ধে ভারি হয়ে আছে বাতাস।
আরশান ধোঁয়া ধোঁয়া আবছা সন্ধ্যেটায় সকালকে এক পলক দেখে নিয়ে অবাক গলায় বলল, ‘এতো সাজগোজ? বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠান হচ্ছে নাকি?’
সকাল হেসে বলল, ‘অনুষ্ঠান নয়। চাচির বোনেরা বেড়াতে এসেছেন।’
—‘এতো জরুরি তলব কেন? সব ঠিক আছে তো?’
সকালের মুখ থেকে হাসিটা সরলো না, ‘একটা খবর দিব বলে ডাকলাম আপনাকে।’
—’কী খবর?’ আরশানের আর তর সইছিল না।
—‘বাবা আমাদের বিয়েতে রাজি হয়েছেন।
আরশানের ঠোঁটে একটা স্বস্তির হাসি ফুটে উঠল। বুকের ওপর চেপে থাকা রাক্ষুসে ব্যথাটাও মুহূর্তে উধাও হয়ে গেলো। সে সকালের হাত দুটি নিজের দুহাতে তুলে নিয়ে প্রসন্ন গলায় বলল, ‘আমার মন বলছিল, তিনি রাজি হবেন।’
সকাল খুশিতে ঝুমঝুমিয়ে বলে উঠল, ‘উনারা বিয়ের তারিখও ঠিক করে ফেলেছেন। ডিসেম্বরের ঊনত্রিশ তারিখ।’
—‘এতো দেরি কেন?’
সকাল হেসে ফেললো, ‘দেরি কোথায়? ধুর বোকা! আয়োজন করতে করতেই দুটা মাস কেটে যাবে।’
দমকা বাতাসে সকালের চুলগুলো এলোমেলো উড়ছিল। কী যেন ছিল সেই হিম ছোঁয়া শেষ সন্ধ্যের কয়লা পোড়া ধোঁয়াটে হাওয়াটায়। ফিকে আলোর নিচে সকালের ওই অলৌকিক টোল পড়া হাসির দিকে চেয়ে থেকে আরশানের মনের মাঝে ভারি এক উদ্ধত, স্পর্ধিত ইচ্ছের উদয় হচ্ছিল ধীরে ধীরে। মন চাইছিল সকালকে জড়িয়ে ধরে খুব খুব আদর করে দেয়। আদরে আদরে ওকে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে ফেলে।
বিয়েটা তাহলে হচ্ছে। তাদের আর কোনো বাঁধা রইল না। আনন্দম, আনন্দম, আনন্দম! পৃথিবীতে আর কোনো দুঃখ নেই!
—‘সরি, ডিস্টার্ব করলাম আরশান ভাই। আপনার সাথে কথা বলতে চাইছিলাম। একটু সময় হবে?’
অনিকের গলার স্বরে ওদের ঘোর ভাঙল। আরশান হেসে বলল, ‘বল।’
—‘আমি চলে যাচ্ছি। আজ রাতেই মুভ করছি।’
—‘কেন?’
—‘স্পেসিফিক কোনো কারণ নেই। ইউনিভার্সিটির কাছে একটি বাসা পেয়ে গেছি। ওটাই আমার জন্য কনভেনিয়েন্ট হবে।’
—‘ও তাই বল।’
অনিক এবার সকালের দিকে একবার চাইলো। তারপর পুনরায় আরশানের দিকে চেয়ে শান্ত গলায় বলল, ‘আপনাদের জন্য শুভকামনা। সুখবরটা পেলাম।’
আরশান একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘থ্যাংক ইউ। বাই দ্যা ওয়ে, একচুয়েলি আই ও ইউ এন এপোলোজি। আমি আসলেই দুঃখিত। তোমার সাথে সকালের বিয়ের কথা চলছিল। আই কাইন্ডা স্টোল দ্য গার্ল ফ্রম ইউ।’
অনিক একটু অবাক হয়ে গিয়ে বলল, ‘আমার সাথে সকালের বিয়ের কথা হচ্ছে এরকম কোনো কথা তো আমি আপনাকে বলিনি ভাই। হ্যাঁ একরকম ফিলিংস ওর জন্য আমার ছিল। কিন্তু বিয়ের কথা তো হচ্ছিল না!’
আরশান একটা ধাক্কা খেলো কথাটা শুনে। চকিতে তাকালো সে সকালের দিকে। সকালের বুক কাঁপছে। এই ভয়টাই পাচ্ছিল সে ভেতরে ভেতরে। ভেবে রেখেছিল আজ কালের মধ্যেই আরশানের সাথে ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলবে। কিন্তু তার আগেই অনিকটা হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিলো।
আরশান হতভম্ব গলায় সকালকে বলল, ‘আপনাদের বিয়ের কথা হচ্ছিল না?’
সকাল পড়ল ব্যাপক অস্বস্তিতে।
অনিক বোধহয় পরিস্থিতির ঘোলাটে ভাবটা আঁচ করতে পেরেই বলে উঠল, ‘আমি আসছি তাহলে। রাতের খাবার খেয়েই রওয়ানা দিয়ে দেব।’
অনিক জায়গাটা ছেড়ে যাবার সাথে সাথে আরশান বলল, ‘কাহিনিটা কী? আমাকে একটু বলবেন?’
সকাল একটা দম নিয়ে সাহস সঞ্চয় করলো, বলল, ‘কাহিনি তেমন কিছুই না। আমি কি আপনাকে কখনো বলেছি যে অনিকের সাথে আমার বিয়ে হবে?
—‘বলেন নি?’
—‘না বলিনি। আপনিই বলেছেন।’
আরশান অধৈর্য গলায় বলল, ‘কিন্তু আপনি তো না করেননি। ব্যাপারটা আমাকে বুঝিয়ে বলাটা কি জরুরি ছিল না? আমি এসব লুকোচুরি একদম পছন্দ করি না।’
সকাল কুঁকড়ে যাচ্ছিল ভেতরে ভেতরে, মিনমিনে গলায় বলল, ‘এটা কি খুব জরুরি কিছু ছিল?’
—‘আপনার প্রতিটা খুঁটিনাটি বিষয়ই আমার কাছে জরুরি। আপনি কি এটা বোঝেন না?’
আরশান একটা হতাশ নিশ্বাস ফেললো, ‘আমি আমার লাইফের প্রতিটা বিষয় আপনার সাথে শেয়ার করার চেষ্টা করেছি। এড্রিয়ানার ব্যাপারটাও আমি আপনার কাছ থেকে লুকাইনি। আমি চেয়েছিলাম আমাদের সম্পর্কের সূচনাটা স্বচ্ছতা দিয়ে হোক। অথচ আপনি শুরুতেই একটা মিথ্যে কথা বলে ফেললেন।’
সকালের চিবুক লেগে গিয়েছিল গলার সাথে। কথা বলতে পারছিল না সে। কী করে বলবে যে আরশানকে পাবার জন্যেই এই মিথ্যের আশ্রয় নিতে হয়েছিল তাকে? কোন মুখে স্বীকার করবে এই অপরাধ?
কোনো উত্তর না পেয়ে আরশান বলল, ‘থাকুন। আমি আসছি।’
আরশান চলে যাবার পর সকালের মনে হচ্ছিল মাটির নিচে গর্ত খুঁড়ে লুকিয়ে যেতে। অপমানে সারা শরীর জ্বলছিল তার। বুকে তীব্র এক যন্ত্রণা!
৭১
রেস্টুরেন্টের শেষ মাথায় যে মহিলাটি বসে আছে তাকে দেখা মাত্রই বোঝা গেলো সে বাঙালি। হালকা পেঁয়াজ রঙের তাঁতের শাড়ি তার পরনে। মাথায় রং মেলানো হিজাব।
আরশানের মনের মধ্যে একটা মিশ্র অনুভূতি হচ্ছিল। এই প্রথম সে তার বায়োলজিক্যাল মায়ের কোনো নিকটাত্মীয়ার সাথে সাক্ষাৎ করছে। এই নারীটির কথা যদি সত্য হয় তাহলে এ তার মায়ের আপন রক্তের বোন। অতএব খুব কাছের কেউ। তার গর্ভধারিণীর সাথে নিশ্চয়ই এই মহিলার মিল আছে কোথাও না কোথাও।
আরশানকে আনমনা দেখাচ্ছিল। ভাবনাগুলো বিক্ষিপ্ত। সকাল কেন শুরুতেই ব্যাপারটা খোলাসা করে বলেনি তাকে? কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে এই ইচ্ছাকৃত গোপনীয়তার? মাদারই বা তাহলে কেন বলেছিল তাকে টিলির জন্মদিনের দিন, যে অনিক আর সকালের বিয়ের কথা চলছে? আর এই সামনে বসা মহিলা! এতকাল পরে তাকে কেন ডেকে পাঠিয়েছে? কী হিসেব বাকি রয়ে গেছে তার আরশানের সাথে?
প্রশ্নগুলো বুকের মধ্যে শেলের মতো বিঁধছিল। ভালো লাগছিল না। সারা দেহ মন কেমন অসাড় হয়ে আছে। মাথাটা ভোঁতা।
রেস্টুরেন্টের ভেতর আলো খুব বেশি নেই। কম পাওয়ারের একটা নীলচে বাতি জ্বলছে। চার চেয়ারের একটা টেবিল দখল করে বসে আছেন মহিলা। আরশানকে দেখে নড়েচড়ে বসলেন। পরিষ্কার বাংলায় বললেন, ‘তুমি আরশান?’
আরশান গায়ের কোটটা খুলে নিয়ে চেয়ারের গায়ে ঝুলিয়ে রাখলো। ভদ্রমহিলার মুখোমুখি চেয়ার টেনে বসতে বসতে মৃদু ভাবে বলল, ‘জি!’
ভদ্রমহিলা পরিপূর্ণ চোখে তাকালেন আরশানের দিকে। কয়েক সেকেন্ড চেয়ে রইলেন অপলক। আরশান একটু অস্বস্তি বোধ করছিল। মহিলার চোখে চোখে তাকাচ্ছিল না। চেয়ারে বসেই কপাল কুঁচকে মেনুতে চোখ বুলানো শুরু করল সে। যেন খাবার অর্ডার দেয়াটাই এখন সব চাইতে জরুরি কাজ।
ভদ্রমহিলা কেশে গলা পরিষ্কার করলেন, বললেন, ‘মা শা আল্লাহ! তুমি একদম বুবুর মতো দেখতে হয়েছ। সেই একই চোখ। কী সুন্দর লম্বা চোখের পাঁপড়ি!’
আরশানের সারা শরীর ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল কথাটা শুনে। আজ পর্যন্ত কেউ কোনোদিন তাকে এসব কথা বলেনি। যে মানুষটাকে সে চেনে না, দেখেনি কখনো, যে মানুষটা তাকে জন্মের পর পর আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল উচ্ছিষ্ট খাবারের মতো; সেই স্বার্থান্বেষী, হৃদয়হীনার চিহ্ন সে কেন আজীবন বয়ে বেড়াবে? কোন অপরাধে? তার হঠাৎ মনে হলো জন্মের আগে আসলে বাবা মা বাছাই করার একটা উপায় থাকা উচিৎ ছিল। কেমন হতো যদি প্রতিটি মানুষ নিজে সজ্ঞানে সিদ্ধান্ত নিত, সে কার গর্ভে এবং কার মাধ্যমে এ পৃথিবীতে আসতে চায়।
আরশান মেনুর দিকে তাকিয়ে ছিল। ওয়েটার এসে জিজ্ঞাসা করলো, ওরা খাবার অর্ডার করার জন্য প্রস্তুত কিনা
অর্ডার দেয়া হয়ে গেলে আরশান ভদ্রমহিলার দিকে তাকালো। প্রথম বারের মতো। মহিলার তীক্ষ্ণ নাসা। টানা বড় চোখ। চোখে চশমা। গায়ের রং কিছুটা চাপা।
এরকমই কি দেখতে ছিল? সেই মানুষটা?
যদি সত্যিই কিছু বলার থেকে থাকে তাহলে নিজে সশরীরে আসলো না কেন? এতো কাল বাদে কেন বোনের মাধ্যমে বার্তা পাঠানো হচ্ছে?
আরশান স্ট্র দিয়ে গ্লাস থেকে পানি খেলো একটু সময় নিয়ে। বলল, ‘কেন ডেকেছেন? বলুন’।
ভদ্রমহিলা চোখ থেকে চশমা খুলে নিয়ে ধীরস্থির ভাবে বললেন, ‘আমি জানি তুমি আমাকে খুব একটা ভালো মতো গ্রহণ করতে পারছো না। এর পেছনে তোমার কোনো দোষ নেই। আবার আমারও কোনো দোষ নেই।’
—‘আপনি আসল কথা বলুন।’ গম গম করে বলে ওঠে আরশান।
—‘আমি… আমি তোমার খালা হই সম্পর্কে।’
আরশান বিরক্ত হয়। অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে, ‘আগেও বলেছেন এ কথা।’
—‘আমরা দুই বোন। আমি ছোট। তুমি কি আমাদের সম্পর্কে কিছু জানো? তোমার নানাবাড়ি সম্পর্কে কিছু বলা হয়েছে তোমাকে কখনো?’
আরশান লোহার মতো মুখ করে বলল, ‘না!’
—‘আশ্চর্য!’
—‘আশ্চর্যের কী আছে?’
—‘তোমার জানতে ইচ্ছে হয়নি?’
—‘না হয়নি।’
—‘তোমার বাবাও কখনো তোমাকে কিছু বলেনি? এরা কেমন ধরনের মানুষ?’
—‘আপনি মূল কথায় চলে যান প্লিজ। আমার অত সময় নেই।’
—‘ঠিক আছে আমি আর কথা বাড়াচ্ছি না। আসলে বুবুর একটা জিনিস তোমাকে দিতে এসেছি। বুবু মারা যাবার সময় বলে গিয়েছিলেন আমি যেন যেকোনো উপায়ে জিনিসটা তোমার হাতে পৌঁছে দেই।’
হৃদযন্ত্রটা কেউ একজন খামচে ধরল হিংস্র ভাবে। স্তম্ভিত আরশান দিশাহারা ভাবে বলে উঠল, ‘উনি কি নেই?’
—‘এ খবরটাও জানো না?’
আরশান চোখ বুজে ফেলল।
ঘোড়া ছুটছে……খুরের আঘাত হেনে……হৃৎপিন্ডের রক্তাক্ত জমিনের ওপরে। অশ্বখুর ধ্বনি কানে এসে লাগছে তার। মৃত্যুসংবাদটা তাকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়ে গেলো।
গ্লাসে চুমুক দিয়ে ঢক ঢক করে পানি পান করল সে। দীর্ঘ কম্পনযুক্ত এক শ্বাস পড়ল। এত কাল ধরে বড় আশা ছিল ভেতরে ভেতরে….. একদিন দেখা হবে। এ জন্মে আর হলো না!
—‘তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে?’
পানি খাওয়া শেষ করে আরশান নিবিষ্ট মনে নিজের হাতের নখ দেখছিল। তার চোখদুটো ঈষৎ রক্তবর্ণ। সে মুখ না তুলে ঠান্ডা গলায় বলল, ‘আমার কথা বাদ দিন। আপনি বলুন।’
ভদ্রমহিলা হ্যান্ডব্যাগ খুলে একটি ছোট বাক্স বের করলেন। আরশানের দিকে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এটা তোমার মায়ের। তোমার দাদীর কাছ থেকে পাওয়া। বুবু মারা যাবার আগে বলে গিয়েছিলেন তোমার কাছে যেন এই জিনিসটা পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করি।’
আরশান ছোট্ট লাল বাক্সটা খুলে ভেতরে একটি সোনার আংটি দেখতে পেলো। অবাক গলায় বলল, ‘এটা দিয়ে আমি কী করবো?’
খালা হালকা হেসে বললেন, ‘তোমার বউকে দেবে। তোমার বউই এর যোগ্য উত্তরাধিকারিণী। তুমি বিয়ে করেছ?’
—‘না’, বলে আরশান আংটিটা আঙ্গুল দিয়ে তুলে নিল বাক্স থেকে। জীবনে প্রথম বারের মতো সে তার মায়ের কোনও স্মৃতি স্পর্শ করে দেখছে। বুকের ভেতর টনটনে একটা ব্যথা! ভারি সাধ ছিল, জীবনে অন্তত একটিবার নিজের গর্ভধারিণীকে চর্মচক্ষু মেলে দেখবে। ভাগ্যে ধরল না। আচ্ছা, ওই মানুষটার কি কোনও দিন আরশানকে এক নজর দেখতে ইচ্ছে হয়নি?
ছাই, সে কেন কষ্ট পাচ্ছে? যে মানুষের কোনও অস্তিত্বই ছিল না তার জীবনে কখনও, সেই মানুষের মৃত্যুতে তার কী এসে যায়?
—‘উনি কবে মারা গেছেন?’ হঠাৎ প্রশ্নটা করল আরশান, অন্যমনস্ক গলায়।
—‘অনেক বছর হলো।’
—‘কত বছর?’
—‘আঠারো বছর হয়ে গেলো। ক্যান্সার ধরা পড়েছিল। ব্লাড ক্যান্সার।’
—‘আঠারো বছর!’ নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না, এমন ভাবে শব্দগুলো উচ্চারণ করলো আরশান।
ওয়েটার খাবার নিয়ে এসেছে ততক্ষণে। খাবারের ডিশগুলো সাজিয়ে রাখছে টেবিলের ওপর।
খালা সিচুয়ান চিকেনের ডিশ কাছে টেনে নিয়ে বললেন, ‘মৃত্যুর আগে বুবু একবার তোমার সাথে দেখা করতে চেয়েছিল। তোমার বাবা বারণ করে দিয়েছিলেন।’
আরশানের মুখে প্রগাঢ় এক বিস্ময় খেলে গেলো। চোখ হয়ে উঠল বিস্ফারিত। সে হতভম্ব গলায় বলল, ‘কী বলছেন আপনি? বাবা বারণ করেছিলেন মানে?’
—‘তোমার বাবা সরাসরি না করে দিয়েছিলেন, বলেছিলেন হঠাৎ করে অসুস্থ মায়ের সংবাদ নিয়ে তোমার সামনে হাজির হলে নাকি তুমি ভেঙে পড়বে। তিনি তোমাকে কষ্ট দিতে চান না। এর চেয়ে তোমার মা নেই এটা জানাই তোমার জন্য মঙ্গল।’
আরশানের মনে হচ্ছিল তার পায়ের তলা থেকে ধীরে ধীরে মাটি সরে যাচ্ছে। সারা শরীর ঝিমঝিম অবশ। হৃৎপিন্ডে ঘোড় দৌড়!
সে রুখে উঠে বলল, ‘আমি আপনাকে কেন বিশ্বাস করবো?
খালা কথাটা শুনে একটু থমকে গেলেন। চিকেন চিবোতে চিবোতে কিছুক্ষণ এক দৃষ্টে চেয়ে রইলেন আরশানের দিকে। বললেন, ‘যুক্তিযুক্ত কথা বলেছ। আমাকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। বাড়ি গিয়ে তোমার বাবার কাছ থেকে যাচাই করে নিও আমার বলা কথাগুলো সত্য নাকি মিথ্যা। আমার মনে হয় বুড়ো বয়সে এসে তিনি মিথ্যা বলবেন না।’
আরশান এই কথার প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না। স্থিরচিত্র হয়ে রইল। ঠান্ডা হতে থাকলো সামনে রাখা ধোঁয়া ওঠা খাবার। সে ছুঁয়েও দেখলো না।
খালা বললেন, ‘আমার ধারণা ছিল তোমার মায়ের মৃত্যু সংবাদটা কোনো একভাবে তোমার কান পর্যন্ত পৌঁছুবে। কিন্তু অবাক হলাম, তুমি কিছুই জানো না!’
আরশান কোনো দিকে না তাকিয়ে জাড় গলায় বলল, ‘উনি কেন আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন?’
—‘কে ছেড়ে গিয়েছিল?’
—‘উনি ….আপনার বোন।’
খালা বিস্ময়ে ফেটে পড়ে বললেন, ‘তোমাকে এইসব ভুলভাল কথাবার্তা কে বলেছে? তোমার বাবা?’
প্রশ্নটা শুনে আরশান একটু থমকায়। উত্তরটা খুঁজে পেতে তার সময় লাগে। কে যেন প্রথম বলেছিল? যে তার নিজের মা তাকে শিশু অবস্থায় ফেলে রেখে পালিয়ে গিয়েছিল?
বাবা…হ্যাঁ বাবাই বলেছিলেন ওর পাঁচ বছরের জন্মদিনে। বলেছিলেন, ‘তোমার আপন মা তোমাকে ফেলে রেখে চলে গেছে। সে তোমাকে ভালোবাসে না। আজকের পর থেকে আমরা আর কোনোদিন তার কথা বলবো না, কেমন?’
আরশান কথা রেখেছিল। সেদিনের পর থেকে আর কোনোদিন বাবার সামনে নিজের মায়ের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেনি। বাবা কেন, দাদা দাদুর সাথেও কখনো এ বিষয়ে কথা বলেনি সে। এর কয়েক বছর বাদে মাদার একদিন নিজ থেকেই সম্পূর্ণ ঘটনা খুলে বললেন। আরশান জানলো, যে তার মা অন্য একজন মানুষের ভালোবাসার জন্য তাকে ফেলে রেখে পাড়ি দিয়েছিল নতুন এক ভুবনে। ঘেন্নায় সারা শরীর গুলিয়ে উঠেছিল তার। সেই থেকে আজ অবধি আরশান ওই মানুষটাকে শুধুই ঘেন্না করে এসেছে।
খালা বললেন, ‘তোমার মা তোমাকে ছেড়ে যেতে চায়নি আরশান। তাকে বাধ্য করা হয়েছিল।’
আরশান ঘোলা চোখে তাকালো বক্তার দিকে। বুকের ভেতর একটা চাপ অনুভব করছে সে। অস্ফুটে বলল, ‘বাধ্য করা হয়েছিল মানে?’
—‘তুমি খাওয়া শুরু করো, খেতে খেতে কথা বলি।’
—‘না সরি! এখন কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। আপনি বলুন প্লিজ। কথাগুলো শুনে নেই আগে। খাওয়া-দাওয়া পরে হবে।’
খালা একটা বড় নিশ্বাস নিলেন। গম্ভীর ভাবে বললেন, ‘তোমার বাবা তোমার মাকে ছেড়ে এই দেশে চলে এসেছিলেন।’
আরশান টেবিলের ওপর আঙ্গুল দিয়ে আঁকিবুকি করতে করতে কথা শুনছিল। খালা থামতেই সে আঁকিবুকি করতে করতেই বলল, ‘থামলেন কেন, বলতে থাকুন।
—‘আসলে…তোমার বাবার একটি বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল এখানে, আমেরিকায়।
আরশান এবার মুখ তুলে তাকালো। তার চোখের দৃষ্টি তীব্র হয়ে উঠল। মুখে ঝিলিক দিলো তেজের হলকা। সে হুংকার ছেড়ে বলে উঠল, ‘কী বলছেন এসব?’
—‘ঠিক বলছি। তোমার বাবা বিয়ের পর এ দেশে অনেকদিন একলা ছিলেন। সে সময় তার সাথে একজন বাঙালি মহিলার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। খুব সম্ভবত পরবর্তীতে তিনি সেই মহিলাকেই বিয়ে করেছেন। তোমার দাদা দাদী এই নতুন মহিলাকে কোনো দিন গ্রহণ করেননি। সেই ক্ষোভ থেকেই তোমার নতুন মা গ্রামে গিয়ে একটা মিথ্যে রটনা রটিয়েছেন আমার বুবুর নামে। তিনি সবার মাঝে এই ধারণা ঢুকিয়ে দেবার চেষ্টা করেছেন যে বুবু অন্য লোকের হাত ধরে ভেগে গেছে সংসার ফেলে।’
আরশান পাথর হয়ে চেয়ে ছিল মহিলার দিকে। তার মুখ জুড়ে একটি প্রলয়ের পূর্বাভাস।
—‘তোমার মা, মানে আমার বুবু ছিলেন খুবই সহজ সরল একটা মেয়ে। দারুণ সুন্দরী ছিলেন। শুধু দোষ ছিল বোধহয় একটাই। বুবু ছিলেন নিতান্তই গ্রামের গরিব ঘরের মেয়ে। আমাদের মতো গরিব পরিবারের সাথে তোমার দাদার বাড়ির সম্পর্ক হওয়াটাই ছিল গ্রামের লোকের কাছে একটা মস্ত বড় বিস্ময়। কিন্তু তোমার দাদা দাদি বুবুকে খুব ভালোবেসে ঘরে তুলেছিলেন। তোমার জন্মের এক বছর পর তোমার বাবা জোর করে তোমাকে আমেরিকা নিয়ে আসেন। এতো ছোট বাচ্চা কখনো মা ছাড়া করতে নেই। কিন্তু তোমার বাবা এই নিষ্ঠুর কাজটা করতে পেরেছিলেন। তোমার দাদা দাদির হাজার বারণ সত্ত্বেও তিনি তোমাকে ছিনিয়ে নিয়ে গেলেন তোমার মায়ের কাছ থেকে।’
আরশান দম বন্ধ করে বলল, ‘এর মানে কি আমি উনার সাথে জন্মের পর এক বছর ছিলাম? মানে ডিড শী টেক কেয়ার অফ মি ফর দ্যা ফার্স্ট ওয়ান ইয়ার অফ মাই লাইফ?’
—‘হ্যাঁ অবশ্যই। তোমার জন্মের এক বছর পর তোমার বাবা এই কাণ্ডটা করেন। তুমি চিন্তা করতে পারো একজন মায়ের জন্য এটা কতটা কষ্টের?’
সেই কষ্টের চাইতেও আরশানের কাছে এখন অন্য একটা কষ্ট বড় বেশি ওজনদার হয়ে উঠেছে। বাবা এতকাল তবে তার সাথে মিথ্যা প্ৰহসন করে এসেছেন? এই মহিলার বলা কথাগুলো যদি সত্য হয় তাহলে আরশানের গোটা জীবনটাই একটা মিথ্যে নাটক ছাড়া কিছুই না। এতকাল ধরে সে যা কিছু জেনে এসেছে, বিশ্বাস করে এসেছে, সব ভুল। যে মানুষটা তার সবচাইতে বেশি আপন ছিল, কাছের ছিল, নিজের ছিল, নির্ভরশীলতার ছিল, সেই বাবা!
—‘সেই যে গেলেন তোমার বাবা, আর দেশে ফেরার নাম নিলেন না। নিউইয়র্কে তোমার বাবার এক ফুপু থাকতেন। আমাদের জানানো হলো যে সেই ফুপুই নাকি তোমার দেখাশোনা করছেন। এভাবে বছর পার হয়ে গেলো। আমরা গরিব ছিলাম। ইচ্ছা থাকলেও আইনের আশ্রয় নিতে পারলাম না। তোমাকে কাছে না পেয়ে বুবু কেমন পাগলের মতো হয়ে গেলো। কারো সাথে কথা বলতো না, সারাদিন গুম হয়ে বসে থাকতো, গভীর রাতে চিৎকার করে কাঁদতো। তোমার বাবা আমেরিকা থেকে বলে পাঠালেন যে তোমার মাকে বাড়ি থেকে বিদায় না করলে তিনি দেশে ফিরবেন না। অগত্যা তোমার দাদা দাদি বুবুকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। কিছুদিন পর শোনা গেলো তোমার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। বুবুর কাছে ডিভোর্স লেটারও চলে আসলো। বুবুর তখন শরীর খুব খারাপ। আমার বাবার ধারণা হলো বুবুকে আরেকবার বিয়ে দিয়ে দিলে এই অসুস্থতা দূর হবে। তিনি এক ব্যবসায়ীর সাথে বুবুর বিয়ে ঠিক করলেন। ভদ্রলোক থাকতেন দুবাইয়ে। বুবুর যে সন্তান ছিল কোনো এক অদ্ভুত কারণে বাবা এই সত্যটি গোপন করেছিলেন ওই ভদ্রলোকের কাছ থেকে। বুবুও কিছু বলেনি। বুবু এমনিতেই কথা কম বলতেন। তোমাকে তার জীবন থেকে সরিয়ে ফেলার পর তার কথাবার্তা আরো কমে গেলো। দুবাইয়ে বুবু পাঁচ বছর থাকলেন। কিন্তু বুবুর ভাগ্যটা খারাপ ছিল, জানো? সেই সংসারও টিকলো না। ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়ার পর ভদ্রলোক বুবুকে কিছুতেই নিজের কাছে রাখতে চাইলেন না। এছাড়া তিনি আরো দাবি করলেন বুবুর নাকি মাথা খারাপের দোষ আছে। পাঠিয়ে দিলেন দেশে। আমার বাবা ক্ষেত খামারি করে সংসার চালাতেন। বুবুর চিকিৎসাটা ঠিক মতো হলো না…’
খালার গলা ভেঙে আসছিল এই পর্যায়ে। তিনি ঢোঁক গিললেন। তবুও চোখে জল উথলে উঠল প্লাবনের মতো। ন্যাপকিন দিয়ে তিনি চোখের পানি মুছতে লাগলেন।
আরশানের বুকে একটা হিংস্র আক্রোশ জন্ম নিচ্ছিল ধীরে ধীরে। একটা বিস্ফোরণ ঘটবে সেখানে, খুব শিঘ্রই!
খালা কাঁপা গলায় বললেন, ‘তোমাকে দুবাই থেকে চিঠি লিখেছিল বুবু তুমি মনে হয় পাওনি। মরার আগে বললেন, এই আংটিটা আমার আরশানের হাতে পৌঁছে দিস। যে করেই হোক। আমি এটা শাশুড়ির কাছ থেকে পেয়েছিলাম। আমি চাই আমার ছেলের বউয়ের কাছেও এই একই জিনিস থাকুক। আংটিটা নিয়েছিলাম ঠিক কিন্তু কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি তোমার দেখা পাবো। তোমার বাবা আমাদের সাথে সকল রকম যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিলেন। চার বছর আগে আমার বড় ভাসুর ডিভি পেয়ে আমেরিকায় আসলেন। আমি সেই থেকে তক্কে তক্কে ছিলাম একটা বার অন্তত আমেরিকায় পা রাখার। ভাসুর মশাই ব্যবস্থা করে দিলেন। নইলে কি আর আমার ভাগ্যে এই আমেরিকায় আসা সম্ভব হতো? এখানে আসার পর তোমার ঠিকানা যোগাড় করতে খুব বেগ পেতে হয়েছে। আমার ভাসুরের মেয়ে ইন্টারনেট খুঁজে খুঁজে তোমার ঠিকানা বের করলো। কিন্তু ফোন নম্বর পাওয়া গেলো না। একটা ছবি পাওয়া গেলো শুধু। নিউইয়র্কের রাস্তায় একদিন সেই ছবির মতো একটা ছেলেকে দেখতে পেলাম। আমার ভাস্তিই তখন ওই ছিনতাইকারীটার সাথে চুক্তি করে তোমার নম্বর হাতানোর প্ল্যান করলো। হুট করে সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলেছিল সে আমাকে কিছু ভাবার সুযোগ না দিয়েই। লাভ কিছুই হলো না। ওই ব্যাটা তোমার নম্বর দিতে পারলো না। পরে আমার ভাসুর তোমার অফিস থেকে তোমার ফোন নম্বর যোগাড় করে দিলেন।
আরশান হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আপনার সাথে পরে কথা হবে। আমি এখন আসছি।’
খালা ব্যস্ত গলায় বললেন, ‘সেকি? খাওয়াটা তো শেষ করে নাও!’
—‘না আজ নয়। কথা দিচ্ছি, আবার দেখা হবে।’
৭২
অফিসের পর ফাহাদ আসলো নাবিলার অ্যাপার্টমেন্টের নিচে। নাবিলা নামতেই ফাহাদ বলল, ‘কী ব্যাপার এতো জরুরি তলব?’
—‘হুম কথা আছে।
—‘বল।’
—‘তুমি তোমার মমকে সরি বলেছ?’
ফাহাদ একটু বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘এই তোমার জরুরি কথা?’
—‘উত্তর দাও আমার প্রশ্নের।’
—‘সরি বলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু মম আমার সাথে কথা বলছে না।’
—‘ব্যাপারটা ঠিক হয়নি, তুমি বুঝতে পারছো?’
—‘বুঝতে পারছি। তোমাদের চাইতে কয়েকগুণ বেশি খারাপ আমার লাগছে। আমি আমার মমকে কতটা ভালোবাসি সেটা আমি বলে বোঝাতে পারবো না। কিন্তু মাঝে মাঝে ভালোবাসার চাইতে নৈতিকতাকে বেশি মূল্য দিতে হয়। আবেগ দিয়ে নয়, যুক্তি দিয়ে চিন্তা করতে হয়।’
—‘হাজার হোক তিনি তোমার মা।’
—‘আমি জানি। আর এ কারণেই আমি তার সাথে যেচে কথা বলতে গিয়েছি। সরি বলেছি।’
—‘ফাহাদ শোনো, তোমার মা রাজি না হলে কিন্তু এই বিয়ে হওয়া সম্ভব নয়।’
ফাহাদ কথাটা শুনে একটু চোখাভাবে তাকালো নাবিলার দিকে। ঝাঁঝ নিয়ে বলল, ‘এটার মানে কী?’
—‘মানে তোমার আম্মা রাজি না হলে আমি বিয়ে করব না তোমাকে।’
—‘কেন জানতে পারি?’
—‘আমি চাই না আমাদের জীবনের শুরুটা তোমার মায়ের আশীর্বাদ ছাড়া হোক।’
ফাহাদ কয়েক সেকেন্ড থমথমে মুখে চেয়ে রইল নাবিলার দিকে। বলল, ‘একটা প্রশ্নের উত্তর দেবে?’
—‘কী প্রশ্ন?’
—‘তুমি কি আমাকে ভালোবাসো?’
নাবিলা ফাহাদের একটু কাছে এগিয়ে আসলো। ওর হাত ধরে নরম গলায় বলল, ‘কোনো সন্দেহ আছে?’
—‘এতদিন ছিল না, এখন হচ্ছে।’
নাবিলা হাসার চেষ্টা করলো, ‘সন্দেহ করো না। আমি তোমাকে ভালোবাসি। শুধু চাই আমাদের বিয়েটা যেন আমাদের বাবা মায়ের দোয়া নিয়ে হয়। তাদের বদদোয়া সাথে নিয়ে নয়।’
—‘বাবা মা কি কখনো বদদোয়া দিতে পারে সন্তানকে?
—‘করতে হয় না, আমি শুনেছি এমনিই লেগে যায়।’
—‘এগুলো ফালতু কথা।’
—‘হলে হবে। কিন্তু আমি চাই সবার মত নিয়ে বিয়ে করতে।’
ফাহাদ হঠাৎ একটু অন্যরকম গলায় বলল, ‘দেখো নাবিলা তুমি হয়তো এখনো বোঝোনি তুমি আমার কাছে কী। আমি আমার মমকে অসম্ভব ভালোবাসি। সেই অসম্ভব ভালোবাসার মানুষটির সাথে গতকাল চরম দুর্ব্যবহার করেছি শুধু মাত্র তোমার জন্য। তোমার আগে আমার আরো তিনটা গার্লফ্রেন্ড ছিল। তুমি তো জানো, এদের একজনের সাথে আমি শুয়েছি পর্যন্ত। আই লস্ট মাই ভার্জিনিটি টু হার। কিন্তু এদের কারুকেই কখনো আমি ভালোবাসিনি। তুমিই প্রথম এবং একমাত্র ভালোবাসা আমার জীবনে। তুমি কি এর গুরুত্বটা বোঝো?’
নাবিলা ফাহাদের হাত আরো শক্ত করে চেপে ধরে বলল, ‘আমি বুঝি। আমিও তোমাকে খুব খুব ভালোবাসি ফাহাদ। ভালোবাসি বলেই চাইছি তোমার মায়ের সাথে তোমার ঝামেলাটা মিটে যাক। মায়ের মনে কষ্ট দিয়ে তুমিও শান্তিতে থাকতে পারবে না।’
৭৩
সকাল ড্রইংরুমের কাউচে বসে ছিল। ঘর ভর্তি লোকজন গিজগিজ করছে। এই মুহূর্তে এতো লোক তার অসহ্য লাগছে। নিজের ঘরে দরজা আটকে বসে থাকার উপায় নেই। চাচি চাইছেন সকাল তার আত্মীয়-স্বজনের সাথে কথা বলুক, সময় দিক। সকাল চাচির চাওয়াটা পূরণ করতে চায়। তাই যতটা সম্ভব হাসি মুখে কথা বলছে সবার সাথে। আরশানের ফোনে দশ বারো বার কল দিয়ে ফেলেছে সে। আরশান একটা বারও রিসিভ করেনি। সারাদিন অফিস করে এসে আবার কোন রাজকার্য উদ্ধার করতে গেলো কে জানে! কেমন একটু দুশ্চিন্তা হচ্ছিল তার। মনটা বিষণ্ন। মনে হচ্ছে কোথাও বুঝি খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে।
অথচ এরকম মনে হওয়ার কোনও কারণ নেই। বাবার সাথে ফোনে কথা হয়েছে একটু আগে। বাবা কথা বলেছেন খুব শান্ত, স্বাভাবিকভাবে। আরশানের সাথে কথা বলতে চেয়েছেন। কিন্তু আরশান বাড়িতে নেই বলে ফোনালাপটা হলো না। বাবা বলেছেন বাড়ি ফিরলেই তাকে ফোন লাগাতে। সকাল তাই অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে আরশানের জন্য। বাবাও অপেক্ষা করছেন নিশ্চয়ই। কিন্তু আরশান গেলো কোথায়?
থেকে থেকে মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছিল সকালের। রাগ হচ্ছিল আরশানের ওপর, অনিকের ওপর। অনিকের কী দরকার ছিল মুখের ওপর অত কথা বলে ফেলার? সময় বুঝে কথাগুলো গুছিয়ে বলতে চেয়েছিল সকাল আরশানকে। যা হয়েছে খুব খারাপ হয়েছে। আরশানের চোখে সকাল অবিশ্বাস দেখেছে। আরশান এসব বিষয়ে অনেক বেশি সংবেদনশীল। সকালের উচিত ছিল আরও বেশি সচেতন হওয়া।
বসার ঘরে ফাহাদের খালারা বসে আছেন। চাচি আছেন। টিলিটা সকালের পাশে বসে বড্ড বেশি বকবক করছে। বিয়েতে কী পরবে, কোথায় সাজবে এইসব নিয়ে গবেষণা করতে করতে পাগল হয়ে যাচ্ছে সে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে বড় ভাইয়ের বিয়ের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং আনন্দময় ঘটনা পৃথিবীতে এ মুহূর্তে আর দ্বিতীয়টি নেই।
একটা গাড়ি বীভৎস শব্দে ব্রেক কষে চার চাকা থামালো বাড়ির সামনে। সকাল জানালা দিয়ে উঁকি দিল। অন্ধকারে দেখলো আরশানের গাড়ি এসে থেমেছে ড্রাইভ ওয়েতে। খুব দ্রুত গাড়ি থেকে নামল আরশান। তারপর অত্যন্ত ক্ষিপ্র গতিতে হেঁটে আসতে থাকলো মূল বাড়ির দিকে। কেন যেন বুক কেঁপে উঠল। কিছু হয়েছে কি? মানুষটাকে এমন এলোমেলো দেখাচ্ছে কেন?
বাড়ির সদর দরজায় কোনো তালা দেয়া ছিল না। আরশান নব ঘোরাতেই দরজাটা নিঃশব্দে খুলে গেল। সকাল ব্যতিত অন্য কোনও ব্যক্তি তখনো আরশানকে লক্ষ্য করেনি। সেই মুহূর্তে ফাহাদের মেজো খালা উঁচু গলায় হেসে হেসে চাচিকে বলছিলেন, ‘আমি যে তোমার বউমাকে একটা আংটি দিয়েছিলাম সেই আংটিটা তো তার হাতে দেখছি না।’
সকাল বেশ অপ্রতিভ হলো কথাটা শুনে। চাচিও একটু অপ্রস্তুত বোধ করলেন। মুখে হাসিটা ঝুলিয়ে রেখেই মেজো খালা বললেন, ‘আংটিটা দিয়েছিলাম নাহয় ছোট ছেলের বউ হিসেবে, সেই বিয়েটা তো হলো না। কিন্তু এখন বড় ছেলের বউ হিসেবে পরতে তো সমস্যা নেই। আসছো তো সেই আমাদের ফ্যামিলিতেই।’
আরশান শুরু থেকেই কেমন মারমুখো হয়ে ছিল। তার চোখে ধিক ধিক করে জ্বলছিল আগুন। মেজো খালার বলা কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে সে ফুঁসে উঠে বলল, ‘কী বললেন? ছোট ছেলের বউ, বড় ছেলের বউ মানে? ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না।’
সকালের বুকে উথলে উঠল ভয়। হাতে পায়ে ধরল কাঁপন।
চাচির মুখখানাও দুশ্চিন্তায় ছোট হয়ে আসছিল। এই একদিনের ভেতরে তার পরিবর্তন দেখার মতো। বোঝা যাচ্ছে এই মুহূর্তে তিনি আরশানকে কোনোভাবেই কষ্ট দিতে চাইছেন না।
কিন্তু মানুষের চাওয়া না চাওয়ার উপর আদতে কিছুই নির্ভর করে না। প্রকৃতির অমোঘ পরিকল্পনায় বাধা হয়ে দাড়ানোর সাধ্য কারো নেই।
হ্যাঁ সত্য সামনে আসতেই হতো। কিন্তু আজকেই কেন?
উত্তরটা কারো জানা নেই।
আরশানের রুদ্রমূর্তি দেখে ফাহাদের খালা একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। আমতা আমতা করে বললেন, ‘না মানে …..সকালকে আমি একটা সোনার আংটি দিয়েছিলাম…’
—‘কেন দিয়েছিলেন?’
—‘নতুন বউয়ের মুখ দেখে দিতে হয়।’
আরশান দিশাহারা হয়ে তাকালো সকালের দিকে, ‘আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’
সকাল দুরুদুরু বুক নিয়ে সংকোচের সাথে বলল, ‘আপনি আমার সাথে আসুন এদিকটায়, আমি বলছি।’
আরশান হুঙ্কার ছেড়ে বলল, ‘কোথাও যাবো না আমি। এখানেই বলুন যা বলার। আমার অত সময় নেই!’
আচমকা ওই গগনবিদারী চিৎকারটা উপস্থিত মানুষগুলোকে চমকে দিল। থর থর করে কেঁপে উঠল সকালের দুটি ঠোঁট। একটা কান্নার দলা ঢক করে উঠে এসে লাগলো গলায়।
চাচি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আমি বলছি, শোনো।’
আরশান হিম শীতল গলায় বলল, ‘বলুন, আমি শুনছি।’
—‘সকালের সাথে ফাহাদের বিয়ের কথা চলছিল। মানে সকাল যখন এখানে প্রথম আসলো… সেই সময়…আসলে দেশে ওকে দেখে আমার খুব পছন্দ হয়েছিল। তাই আমি ওর আব্বা আম্মার কাছে প্রস্তাব দিয়েছিলাম ফাহাদের জন্য…’
আরশানের চেহারা পাল্টে যাচ্ছিল। মাদার ওই চেহারার দিকে তাকিয়ে থেকে কথা গুলিয়ে ফেললেন। এই ছেলের আজকে হয়েছে কী? একে এমন দেখাচ্ছে কেন? মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে সে মানুষ খুন করতে পারবে!
আরশান চিৎকার করে উঠে বলল, ‘ফাহাদের সাথে?’
এটুকু বলে সে বিস্ফোরক চোখে তাকালো সকালের দিকে, স্বগতোক্তির মতো বলল, ‘আমার ছোট ভাইয়ের সাথে?’
সকালের চিবুক লেগে গেছে গলায়। চোখ দিয়ে টপ টপ করে গড়িয়ে পড়ছে জল। সে কোনো কথা বলতে পারছে না।
আরশান পাগলের মতো বলে চলল, ‘হ্যাংগ অন, হ্যাংগ অন… লেট মি থিংক…এর মানে আপনি এখানে এসেছিলেন ফাহাদকে বিয়ে করার জন্য?’
সকাল চুপ। সবাই চুপ। কয়েক সেকেন্ড কেউ কোনো কথা বলল না। আরশান দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল, ‘এই কথাটা আমাকে এতদিন কেউ বলেনি কেন?’ উপস্থিত ব্যক্তিবর্গ আগের মতোই চুপ, হতভম্ব, আতংকিত এবং দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। আরশান সকালের দিকে কয়েক সেকেন্ড শীতল চোখে চেয়ে রইল। খানিক বাদে তার চোখের কার্নিশে দেখা দিলো জলের ছায়া। লম্বা লম্বা পাঁপড়িগুলোতে চিকচিক করে উঠল কয়েক বিন্দু অশ্রু। সে দ্রুত পায়ে দরজা খুলে বেরিয়ে আসলো বাড়ি থেকে।
সকাল ওর পেছন পেছন দৌড়ে গেলো। চিৎকার করে ভাঙা গলায় বলতে লাগলো, ‘আরশান শুনুন, প্লিজ শুনে যান একটা বার। আমি আপনাকে বুঝিয়ে বলছি।’
আরশান শুনলো না। বিদ্যুৎ বেগে ছুটে গেলো গাড়ির কাছে। উঠে বসলো ড্রাইভিং সিটে। গাড়ি চলতে শুরু করলো।
৭৪
ঘরটা আধো অন্ধকার। বাইরে সন্ধ্যা। উত্তরের জানালা খোলা। সকাল বসে আছে জানালার মুখোমুখি, বিছানার ওপর। গতকাল রাত থেকে শুরু হয়েছে বিরামহীন বৃষ্টিপাত। মেঘ ডাকছে, ঝড়ো ঝড়ো হিম শীতল বাতাস বইছে।
হাতে পায়ে কেমন খিল ধরে গেছে তার। মাথা ঘুরাচ্ছে হালকা। স্নায়ু টান টান। খানিক বাদে বাদে অকারণে চমকে উঠছে। আরশান সেই যে গত রাতে হাওয়া হলো, তারপর থেকে তার আর কোনো খবর নেই। সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। অফিসে ফোন করে জানা গেছে সে অফিসেও যায়নি। এদিকে সকালের হাতে আছে আর মাত্র তিনটি দিন। এই তিনদিন তো তাদের জীবনের বিশেষ তিনটি দিন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার বদলে কেমন এক প্রলয়ংকরী ঝড়ের কবলে পড়তে হলো। তার ভাগ্যটা এতো খারাপ কেন?
শরীর অত্যন্ত দুর্বল। আজ সারাদিন কিচ্ছু খায়নি সে। কারো সাথে কথাও বলেনি। ঘরবন্দি হয়ে কখনো কেঁদেছে, কখনো চুপ করে বসে থেকেছে। আবার কখনো কখনো বিন্দুবাসিনীর সাথে এলোমেলো কথা বলেছে। মা ফোন করেছিল, মাথা ব্যথার অজুহাত দেখিয়ে ফোন রেখে দিয়েছে। সারা দিনে তার একেকবার একেকরকম অনুভূতি হচ্ছিল। শঙ্কা, উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা সব মিলিয়ে মাথার ভেতরটা কেমন পাগল পাগল লাগছিল। হঠাৎ হঠাৎ মনে হচ্ছিল এই মুহূর্তে আরশানকে একটাবার চোখের দেখা না দেখতে পেলে সে মরে যাবে। আবার মনে হচ্ছিল কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। ফাহাদকে সাথে নিয়ে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে মানুষটাকে খুঁজে বেড়ায়।
শুধু অপেক্ষা আর অপেক্ষা। এমন নিরবচ্ছিন্ন ভাবে, তীব্র ভাবে আর কোনোদিন কারো জন্য অপেক্ষা করেনি সকাল। কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেলো ফাহাদের ব্যাপারটা না বলাতে? এটা কি একেবারেই ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ? নাহয় হয়ে গেছে একটা ভুল। তাই বলে কি এভাবে পুরোপুরি গায়েব হয়ে যেতে হবে? কাউকে কিছু না বলে?
থেকে থেকে অপেক্ষাটা বুকের ভেতর একটা অন্ধ বোবা রাগের জন্ম দিচ্ছিল। ক্রোধে ভেসে যাচ্ছিল বুক। কী পেয়েছে মানুষটা? যা ইচ্ছা তা করে যাবে আর সকাল সব মুখ বুজে সহ্য করবে? সকাল কি তার হাতের খেলনা পুতুল?
বোঁ বোঁ করে মাথা ঘুরছিল তার। টলমল করছে শরীর। শক্তি নেই একটা ফোঁটা। শুয়ে পড়ল সে, ধপ করে বিছানার ওপর।
কতক্ষণ কাটলো কে জানে। একটা সময় গাড়ির চাকার শব্দ শোনা গেলো সদরের সামনে। ভারি মাথাটা টেনে তুললো সকাল বালিশ থেকে। দৌড়ে ছুটে গেলো জানালার কাছে। এসেছে, তাকে লণ্ডভণ্ড করে দেয়া, নিঃশেষ করে দেয়া সেই মতিচ্ছন্ন দুর্বত্ত ব্যক্তিটি অবশেষে এসেছে।
সকাল দ্রুত তর তর করে সিঁড়ি ভেঙে নেমে আসলো। তার বুক কাঁপছে। নিঃশ্বাস এলোমেলো।
বসার ঘরে চাচা বসে ছিলেন। সাথে ফাহাদও আছে। সকাল সেদিকে ভ্রুক্ষেপ মাত্র করলো না। বাতাসের চেয়েও ক্ষিপ্র গতিতে যেন তার চলা চাই। দরজা খুলে বেরিয়ে আসলো বাইরে মিনিটের মধ্যে।
আরশান গাড়ি গ্যারেজে রেখে হেঁটে আসছিল ঢালু ড্রাইভ ওয়ে ধরে। সকাল উম্মাদিনীর মতো ছুটতে ছুটতে ওর সামনে গিয়ে পড়ল। খর বাতাসে তার চুল উড়ছে, উড়ছে গায়ের ওড়না। তার সর্বাঙ্গে একটা অপ্রতিরোধ্য ক্ষ্যাপামির ছাপ।
অন্ধকার জেঁকে বসেছে তখন চারপাশে। এদিকের রাস্তায় কোনো আলো নেই। রাস্তা ভেজা, অনেকটা পিচ্ছিল। এলোমেলো ভাবে গাছের শুকনো পাতা উড়ছে বাতাসে। আরশান অন্ধকারের ভেতর ওই পাগল পাগল সকালকে আবিষ্কার করে একটু থমকে গেলো।
মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রইল দুজনে কিছুক্ষণ। সকাল নিশ্বাস ফেলছে ফোঁস ফোঁস। বোঝা যাচ্ছে তার ভেতরে একটা আগুন জ্বলছে।
সে আকস্মিকভাবে দু হাত দিয়ে আরশানের শার্টের কলার চেপে ধরে ঝাঁকুনি দিতে দিতে চিৎকার করে বলে উঠল, ‘আবার কোথায় গিয়েছিলেন? কোথায় গিয়েছিলেন? কেন গিয়েছিলেন? মেরে ফেলতে চান আমাকে?’ ঝাঁকুনির চোটে আরশান প্রথমে একটু কেমন থতমত খেয়ে গেলো। তারপর শক্ত হাতে সকালের হাত দুটো নিজের গলা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ঠান্ডা গলায় বলল, ‘ভেতরে যান।’
সকাল আরো বেশি জ্বলে উঠল এই কথা শুনে, ‘ভেতরে যান মানে? কোথাও যাবো না আমি আপনার সাথে ফয়সালা না করে। হঠাৎ হঠাৎ কোথায় চলে যান আপনি কাউকে কিছু না বলে? বিয়ের পরেও কি এসব চলতে থাকবে?’
আরশান একটা নিশ্বাস ফেললো, ‘আর বিয়ে…’
—‘আর বিয়ে মানে?
—‘বিয়েশাদি মনে হয় আমাকে দিয়ে হবে না।’
একটা ডাইনি রাগ লুপ্ত করে দিল সকালের কাণ্ড জ্ঞান। সে চিৎকার করে বলে উঠল,
—‘এটার মানে কী? আপনি আমাকে বিয়ে করবেন না?’
—‘হবে না মনে হয়।’
সকাল দাঁত কিড়মিড় করে বলে, ‘কেন করবেন না? ফাহাদের ব্যাপারটা আপনাকে বলিনি তাই?’
আরশান কেমন জড়ানো গলায় বলল, ‘হয় তো…’
সকাল হঠাৎ শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দেয় অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা লম্বা মূর্তিটার গালে। মূর্তি দাঁড়িয়ে থাকে পাথর হয়ে, কিছু বলে না। সকাল দাঁতে দাঁত পিষে বলল, ‘খেলা পেয়েছেন? জীবনটাকে ছেলেখেলা বলে হয়?’ এটুকু বলে সে আরশানের বুকের ওপর হামলে পড়ল। দু’হাত দিয়ে ওর বুকের ওপর এলোপাতাড়ি মারতে মারতে বলল, ‘আমি জানতাম আপনি কোনোদিন ভালোবাসেননি আমাকে। ভালো যদি বাসতেন তাহলে এত সহজে সিদ্ধান্ত বদলাতে পারতেন না। কেন এরকম করলেন আমার সাথে? কেন? কেন?’
আরশান সকালের কাঁধ ধরে সোজা করে দাঁড় করায় ওকে। অদ্ভুত ঠান্ডা গলায় বলে, ‘বিশ্বাস ভেঙে গেলে কেমন লাগে আপনি জানেন?’
সকাল এই প্রশ্ন শুনে একটু থমকে যায়। কান্না ফোলা চোখ নিয়ে ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ আরশানের দিকে। তার নিজের শরীরের ওপর এখন তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। মনে হচ্ছে আরশান ওর কাঁধ ছেড়ে দিলেই সে ঢলে পড়বে। সেই অবস্থায় ভারি করুণ গলায় সে বলল, ‘বিষয়টা আপনার কাছ থেকে লুকাতে চাইনি আরশান। শুধু বলা হয়ে ওঠেনি।’ আরশান সকালের কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে নিলো। বলল, ‘আমার আর এই জীবনে কাউকে বিশ্বাস করা হয়ে উঠবে না। আমাকে ক্ষমা করে দিন।
বলে আরশান দাড়ালোনা জায়গাটায়। হেঁটে এগিয়ে গেলো বাড়ির দিকে। সকাল টলমলে পা আর ঢুলু ঢুলু মাথা নিয়ে চেয়ে রইল অন্ধকারে ওর ওই চলে যাওয়া পথটার দিকে। মানুষ এতো নিষ্ঠুর হয় কী করে? কেন ভালোবেসেছিল সে এই হৃদয়হীন পুরুষটিকে? কী দোষ করেছিল সে তার এই স্বল্প পরিসরের জীবনে? কেন এই শাস্তি?
কষ্টে তার হৃৎপিন্ড ছিঁড়ে যাচ্ছে। এই কষ্টের অবসান ঘটানো যায় কী করে? বিষ খাবে কি? কোথায় পাবে? কেউ কি এক বোতল বিষ এনে দেবে তাকে? কেউ করবে কি এই ছোট্ট উপকারটা তার জন্য? যে করবে সকাল তার প্রতি চির কৃতজ্ঞ থাকবে!
টলতে টলতে বাড়ির ভেতর আসলো সে। তাকে দেখাচ্ছিল বিধ্বস্ত। চুল এলোমেলো। চোখ ভর্তি জল। নাকের ডগা রক্তলাল। কিন্তু তার সেই ক্ষ্যাপা রূপটি বাড়ির কোনো সদস্য প্রত্যক্ষ করলো না। চাচা আর ফাহাদ বসে আছে বসার ঘরের সোফায়। চাচার সামনে আরশান দাঁড়িয়ে আছে উদ্ধত একটা ভাব নিয়ে। যেন কোনো কৈফিয়ত চাইছে সে বাবার কাছ থেকে। সকাল নিঃশব্দে এসে দাড়ালো ঘরের কোণায়। কেউ টের পেলো না।
আলোর নিচে আরশানের মুখটা দেখলো সে এতক্ষণে। আর দেখার সঙ্গে সঙ্গে একটা কম্পন উঠে আসলো বুকের ভেতর থেকে। শিউরে উঠল। দেখা মাত্রই বোঝা গেলো এই মানুষটা ভালো নেই। মনে হচ্ছে গভীর কোনো অসুখ একে কুরে কুরে খেয়ে ফেলছে। তার গায়ে গতকালকের সেই অফিসের শার্ট। চুল অবিন্যস্ত। সকাল নিশ্বাস বন্ধ করে চেয়ে রইল মানুষটার দিকে।
চাচাকে বলতে শুনলো, ‘কী হয়েছে তোমার? শরীর খারাপ নাকি? এমন দেখাচ্ছে কেন?’ আরশান বাবার চোখে সরাসরি চেয়ে অদ্ভুত গম্ভীর গলায় বলল, ‘আমার মা কি বেঁচে আছেন?’ রহমান সাহেব চমকে উঠলেন। চকিতে তার মুখে ফুটে উঠল এক আতঙ্কের ছাপ। তিনি অপ্রস্তুত গলায় বললেন, ‘হঠাৎ … এই প্রশ্ন?’
ফাহাদও বেশ অবাক হয়ে গেছে। সে বিস্ফারিত চোখে একবার ভাইকে দেখছে আরেকবার বাবাকে।
—‘আপনি প্রশ্নের উত্তর দিন।’ আরশান বলল।
সকালের হাত পা অবশ হয়ে আসছিল। তার মন বলছে খারাপ কিছু ঘটেছে। খুব খারাপ কিছু। রহমান সাহেব আমতা আমতা করে বললেন, ‘মনে হয় না বেঁচে আছেন।’ আরশান হঠাৎ সিংহের ন্যায় গর্জে উঠল, ‘স্পষ্ট উত্তর দিন। হ্যাঁ নাকি না?’
রহমান সাহেব ঢোঁক গিললেন একটা। নত মুখে বললেন, ‘না।’
—‘আমাকে জানানো হয়নি কেন?’
রহমান সাহেব ছেলের দিকে তাকালেন চোখ তুলে। তাকানো মাত্রই আবার চোখ সরিয়ে নিলেন। ওই চোখের দিকে তিনি তাকিয়ে থাকতে পারবেন না। ওই চোখের ভেতর প্রলয় ঘটছে।
—‘আমার মা মৃত্যুর আগে আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছিলেন?’
রহমান সাহেবকে এ কথায় রক্তশূন্য দেখালো। ফ্যাকাশে হয়ে উঠল তার চেহারা। অসহায় ভাবে তিনি বলে উঠলেন, ‘তোমাকে এসব কে বলেছে?’
আরশান গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলল, ‘আমার প্রশ্নের উত্তর দিন!’
—‘হ্যাঁ চেয়েছিল।’
—‘আমার মা আমাকে কোনো চিঠি লিখেছিল কোনোদিন?’
—‘লিখেছিল।’
আরশানের মুখটা যন্ত্রনায় কুঁকড়ে গেলো। সে শ্বাসরুদ্ধ গলায় বলল, ‘আমার মা অন্য লোকের সাথে পালায়নি কখনো। রাইট?’
রহমান সাহেব নিজের মাথায় হাত দিলেন। বড্ড দুর্বল গলায় বললেন, ‘রাইট।’
—‘আমাকে ছেড়েও যায়নি কখনো!”
—‘যায় নি।’
—‘কেন মিথ্যে বলেছিলেন আমার সাথে? কী দোষ ছিল আমার মায়ের? কী দোষ ছিল আমার?
রহমান সাহেব স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইলেন ছেলের করুণ, ব্যথাতুর মুখখানার দিকে। তাঁর ঠোঁটে কোনো বাক্য নেই। তিনি বাক্যহারা।
আরশান খানিক বাদে মাথা নিচু করে খুব ধীর পায়ে যন্ত্রের মতো হেঁটে হেঁটে বেজমেন্টের সিঁড়ি ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো। তার আর কিছু বলার নেই। শোনারও নেই।