অক্টোবর রেইন – ৭

বাথটাবের উষ্ণ ফেনা ওঠা সাবান সুগন্ধী জলে ডুবে থেকে সকালের মনের ভেতরেও একটা কেমন উষ্ণ, কোমল, পেলব অনুভূতির সৃষ্টি হচ্ছিল ক্রমান্বয়ে। আজকের ভোরবেলাটা ঠিক যতটা ভালোলাগার ছিল ঠিক এতটা ভালো বুঝি তার বহু বহু দিন লাগেনি। বহুদিন বললে ভুল বলা হবে। আসলে কোনো দিনই লাগেনি। এ ভালোলাগা কেন কোথেকে আচমকা এসে তার ওপর ভর করলো তা সে জানে না। জানতে চায়ও না। কিছু কারণ, কিছু যুক্তি যদি না বুঝে, না খুঁজে, না জেনে দিব্যি দিন কাটানো যায়, তো মন্দ কী? 

সে স্নানের জল দিয়ে দেয়ালে ভারি যত্ন করে সুনিপুণ ভাবে বাংলায় একটি নাম লিখলো, ‘আরশান!’ লিখাবার পর ব্যাকুল চোখে সেই নামটির দিকে কিছু সময় তাকিয়ে রইল। খানিক বাদে সংকোচ ভিড় করলো তার জল ভেজা চোখের দু’ পাতায়। চকিতে অন্য হাত দিয়ে লেখাটি মুছে দিলো আবার। হঠাৎ মনে পড়ল আজ আরেকটু হলেই গাড়ির তলায় চাপা পড়তো সে। আল্লাহ বাঁচিয়ে দিলেন। যদি না বাঁচাতেন এ যাত্রা তাহলে সকাল এখন কোথায় থাকতো? কিভাবে থাকতো? এই আশ্চর্য সুন্দর পৃথিবীর সাথে তার এক জীবনের সম্পর্কটা কাটতে কাটতেও কাটলো না আজ। এ সম্পর্কটা বুঝি নিদারুণ সূক্ষ্ম পাতলা একটি সুতোর বুনোটের মতোন। একটু টান পড়লেই যে কোনো মুহূর্তে ছিঁড়ে যাবার আশঙ্কা আছে। সারা পৃথিবীতে কত লোক কত ভাবে মরে যায় রোজ। কত রোগ শোকে আক্রান্ত হয়। নতুন প্রাণ আসে, পুরনো প্রাণ ঝরে পড়ে। একই সাথে চলতে থাকে এই আসা যাওয়ার খেলা। কেউ আসে, কেউ যায়। এভাবেই ভারসাম্য টিকে থাকে। হাজার রকম দুর্ঘটনা আর রোগ শোকের বিপরীতে সুস্থভাবে নিশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকাটাই যে আজকের পৃথিবীতে একটি বিস্ময়কর ঘটনা তা সাধারণ লোকে ভেবে দেখে না। মানুষের বেঁচে থাকার প্রত্যেকটা দিন আসলে লটারি জেতার মতো। এই সত্যটা উপলব্ধি করতে পারলে যাবতীয় পার্থিব টানাপোড়েনগুলোকে অত্যন্ত তুচ্ছ বলে মনে হওয়ার কথা। 

এসব ভাবতে ভাবতে সকালের মনটা আবার উদাস হয়ে উঠছিল। সে লেখক নয় এ কথা সত্য কিন্তু ভাবতে সে বড় বেশি ভালোবাসে। মনের ডাইরিতে ভাবনার কলম দিয়ে প্রতি নিয়ত কত অদৃশ্য লেখা যে লিখতে থাকে তার ইয়ত্তা নেই। স্নান সেরে ঝটপট তৈরি হয়ে নিলো সে। হালকা গোলাপি রঙের একটি স্যালোয়ার কামিজ পরলো। ভেজা চুল ড্রায়ার দিয়ে শুকিয়ে নিলো। চোখে কাজল দিতে গিয়ে থমকে গেলো। না থাক। বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। ঐ ডাঁটিয়াল ছেলেটা আবার সাজগোজ নিয়ে খোঁটা দিয়ে বসতে পারে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতে দেখতে ঐ হামবড়া নাক উঁচু ছেলেটার কথা মনে হতেই তার মুখে একটি স্ফীত হাসির রেখা ফুটে উঠল। ভাগ্যিস এ যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিল। নইলে ঐ মানুষটার সাথে দ্বিতীয়বার দেখা হবার কোনো সুযোগ থাকতো না। 

ঝরঝরে শুকনো চুলগুলো যখন কাঁধময় ছড়িয়ে গেলো সকালকে তখন দারুণ দেখালো। কাজল না পরলেও লাল ছোট্ট একটা টিপ বসিয়ে দিলো সে মাঝ কপাল বরাবর। 

বাইরে একটি উজ্জ্বল, ঝকঝকে দিনের সূচনা হচ্ছে। পাইন, মেপল আর সিডার গাছের পাতায় পাতায় ঝিকোচ্ছে রোদ। হলদে, মিষ্টি, আদুরে রোদ্দুরটা জংলি গাছের ফাঁকে ফাঁকে জায়গা মতো সুযোগ বুঝে শুয়ে পড়ছে। এবার সারা দিনময় চলবে এই রৌদ্র ছায়ার খেলা। ডেকের ওপর নিশ্চিন্তে বসে একটি ছোট্ট টিটমাউজ পাখি হুহু করে ডেকে উঠছিল থেকে থেকে। থাই এলুমিনিয়াম গ্লাসের স্লাইডিং দরজা ভেদ করে সূর্যের আলো এসে পড়েছে আরশানের পায়ের কাছে। আরশান চেয়ারে বসে খাবার টেবিলের ওপর ডান কুনুই রেখে গালে হাত দিয়ে জানালার ওপারের রোদময় আকাশটা দেখছিল। আর টিটমাউজের হুহু ডাক শুনছিল। এ বাড়িটা মূলত সম্মুখে দোতলা এবং পশ্চাতে তিনতলা। বেজমেন্টের তিনটি ঘরের দুটি পড়েছে সম্পূর্ণ মাটির তলায়। যেখানে কিনা কোনও জানালা দরজা নেই। আর বাকি ঘরটা পড়েছে খোলা জায়গায়। খোলা জায়গার ঘরটিতে আছে ওয়াক আউট দরজা এবং জানালা। দরজা খুলেই হাতের ডান পাশে একটি প্রশস্ত টাইগার উড কাঠের ডেক। ডেকের ওপর গ্যাস স্টোভ রাখা। একটি মাঝারি আকারের বারবিকিউ গ্রিল রাখা। ছুটির দিনের দুপুরগুলোতে আকাশে রোদ চড়লেই আরশান জঙ্গলের ধারে গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে কয়লা পুড়িয়ে চিকেন অথবা ফিশ বারবিকিউ করে। খেতে বেশ ভালো হয়। গেলো মাসে তার অফিসের কলিগদের করে খাইয়েছে। সবাই মুগ্ধ। 

ঘড়ির কাঁটা এগোচ্ছে খুব ধীরে ধীরে। এতো ধীরে সময় কাটছে কেন আরশান তা বুঝতে পারছে না। অপেক্ষা জিনিসটা তার ব্যক্তিগতভাবে খুবই অপছন্দের। দরজার ওপাশে দুটো ছাই রঙা দুষ্টু কাঠবেড়ালী বাদাম নিয়ে ঝগড়া করছে। রোজ অফিস যাবার আগে সে এই কাঠবেড়ালি পরিবারটাকে খাবার দিয়ে যায়। আজকেও দিয়ে এসেছে একটু আগে। এক মুঠো কাজু বাদাম। খাবার পেলেই ওরা মানুষের মতো বসে পড়ে দু’ হাত দিয়ে কুটকুট করে খেয়ে নেয়। ভারি মিষ্টি লাগে দেখতে। আরশান গত রাতে ঠিক এরকম একটা ছবিই এঁকেছে, জলরং দিয়ে। একটা মিষ্টি কাঠবেড়ালি গাছের ডালে বসে হাত দিয়ে কুটুরমুটুর করে খাবার মুখে পুরছে, চিবোচ্ছে। ছবি আঁকতে সে ভালোবাসে। আর ঐ ছবি আঁকার প্রতি ভালোবাসা থেকেই আর্কিটেকচার নিয়ে পড়াশোনা করা। ছবি আঁকাটা তার নেশা। 

হঠাৎ টুং করে মোবাইল শব্দ করে উঠল। মেসেঞ্জারে বার্তা এসেছে। এন্ড্রিয়ানা। ওর কলিগ প্লাস হলেও হতে পারে গার্লফ্রেন্ড। আরশান জানে মেয়েটি তাকে পছন্দ করে। সত্যি বলতে তার নিজেরও যে মেয়েটিকে খারাপ লাগে তা নয়। কিন্তু কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না এখনও। বলতে কি মেয়েদের সম্পর্কে একটা ভীতি তার মনের মধ্যে সর্বদা কাজ করে। মেয়েদের সে বিশ্বাস করতে পারে না। মানুষের জীবনের প্রথম ভালোবাসা হলো মা। সেই প্রথম ভালোবাসাই তার সাথে প্রতারণা করেছে। এরপর অন্য কাউকে ভালোবাসতে যাবে কোন সাহসে? মায়ের ভালোবাসা আর মায়া মমতা থেকে সে চিরবঞ্চিত। তাই তো তার জীবনটা বড্ড এলোমেলো আর অগোছালো। 

এন্ড্রিয়ানাকে তুলে নিয়ে একত্রে অফিস যেতে হলে তার ঘর ছেড়ে বেরোতে হবে এক্ষুণি। আর এক্ষুণি বের হয়ে পড়লে সকালের সাথে মিটিংটা বাতিল করতে হবে। সে এন্ড্রিয়ানাকে উত্তরে লিখে পাঠালো, ‘দুঃখিত। আজ অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে গেছি। তুমি একটু ম্যানেজ করো। অফিসে দেখা হচ্ছে।’ 

লিখলো আরশান কিন্তু এদিকে সকালের খবর নেই। সত্যিই কি সাজগোজ করা আরম্ভ করে দিলো নাকি মেয়েটা? এতক্ষণ সময় নেয়ার কারণ কী? সাজগোজের বিষয়টা মুখে বললেও ভেতরে ভেতরে সে বুঝেছে সকাল মোটেও রূপ সচেতন মেয়ে না। খুব সাধারণ। কথাবার্তায় একটা অন্যরকম শৈলী আছে। লোক দেখানো ভাব নেই বরং একটা ব্যক্তিত্বের ধার আছে। চোখের দিকে তাকালেই মনে হয় যেন মনের ভেতরটা পড়ে ফেলা যাবে। একটু পাগলাটে। হ্যাঁ পাগল ছাড়া আর কী? 

আরশানের চোখে ভাসছিল ওর হাসিটা। নিখুঁত ছাঁচে ঢালা ঠোঁট দুটো দুপাশে প্রসারিত হয়ে পড়লেই টুপ করে গালের চামড়া ঢুকে যায় ভেতরে। টোল পড়ে। ভারি সুন্দর দেখতে লাগে! 

সকাল নিচে নামতেই কিচেনে চাচির মুখোমুখি পড়ল। তাকে দেখামাত্র তিনি বলে উঠলেন, ‘এইতো ঠিক সময়মতো উঠে পড়েছো। বাহ্ তৈরিও হয়ে গেছ। বেশ দেখাচ্ছে তোমাকে। আর ঘণ্টা দুয়েক পরেই আমার বোনরা চলে আসবে।’ 

সকালের মনে পড়ল। আজ চাচির বোনদের আসার কথা। বেমালুম ভুলে বসে ছিল সে বিষয়টা। খাবার টেবিলে নাশতা সাজানো হয়ে গেছে। টিলি স্কুলে যাবার জন্য তৈরি হয়ে টেবিলে বসেছে নাশতা খেতে। সকালকে দেখে বলল, ‘তুমি দাঁড়িয়ে কেন? বসো আমার সাথে। নাশতা করো। 

চাচি ব্যস্ত গলায় বলে উঠলেন, ‘সেকি দাঁড়িয়ে রইলে কেন? বসে পড়ো। ফাহাদ এসে যাবে কিছুক্ষণের মধ্যেই।’ 

একটা অস্বস্তি জেঁকে বসলো সকালের মুখে। এদেরকে সে কী করে বলবে যে নিচের তলায় একটা মানুষ তার জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে? 

সকালকে ওরকম থ-মেরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চাচি উদ্বেগের সাথে বলে উঠলেন, ‘কী হয়েছে তোমার? সব ঠিক আছে তো?’ 

সকাল প্রস্তরীভূত হয়ে রইল। নড়লোও না, কিছু বললও না। চাচা এসে বললেন, ‘বসে পড়ো। দাঁড়িয়ে কেন?’ 

অগত্যা সকালকে বসতেই হলো। তার ইচ্ছে করছিল এক ছুটে দৌড়ে পালিয়ে যেতে। ইচ্ছে হচ্ছিল চিৎকার করে বলে উঠতে, ‘সরি আমি আপনাদের সাথে এখানে বসতে পারবো না। আমার একজনের সাথে দেখা করার কথা আছে। আমাকে যেতেই হবে। প্লিজ! আমাকে যেতে দিন।’ 

মনে মনে অনেক কথা বলে ফেললেও মুখে কিছুই বলতে পারলো না সে। কোথেকে যেন দ্বিধা, সংকোচ আর ভয় এসে বুকে জড়ো হলো। 

প্রায় চল্লিশটা মিনিট টানা অপেক্ষা করে আরশান কী করে যেন টের পেলো সকাল আর আসবে না। 

খাবারগুলো সব ছুঁড়ে মেরে ট্র্যাশ করলো সে। মুখে কিছু দেবার ইচ্ছেটাও রইল না। এমনকি এক কাপ কফিও না। মেয়েরা এমনই। কথা দিয়ে কথা রাখেনা। শুধু খেলে আর খেলায়। 

জুতো পরে নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে আসলো। নিচের ওয়াক আউট দরজাটার তালা ভেঙে গেছে। বাইরে থেকে লক করা যাচ্ছে না। কয়েকদিন যাবৎ সদর দরজা দিয়েই যাওয়া আসা করছে সে। উপরে উঠে দরজা খুলতেই দেখে গেলো কিচেনে নাশতার টেবিলে বাড়ির প্রত্যেকটি সদস্য উপস্থিত। সকালও বসে আছে। হাতে পাউরুটি নিয়ে কামড় বসাতে যাচ্ছে। আরশানকৈ দেখে থেমে গেলো ওর হাত। 

আরশানের মুখখানা ভারি গম্ভীর। চোখে ভাসছে অভিমানের মতো কী যেন এক চাপা অনুভূতি। 

সকালের চোখে চোখ পড়তেই সে একটু শ্লেষের হাসি হাসলো। তারপর চোখ সরিয়ে নিলো। 

বাবা বললেন, ‘আরশান বাবা, ব্রেকফাস্ট করেছো?’ 

আরশান একটু কাটা কাটা গলায় উত্তর দিল, ‘নাহ, আজকে ব্রেকফাস্ট স্কিপ করলাম।’ 

শুনে সকালের হাত থেকে পাউরুটির টুকরোটা পড়েই যাচ্ছিল। কোনো রকমে সামলে নিলো সে। 

বাবা চোখ কপালে তুলে বললেন, ‘সেকি! শরীর খারাপ করবে তো! 

আরশান কথাটা শুনেও না শোনার ভান করে বেরিয়ে পড়ল। সকালের মুখ দিয়ে আর কোনো খাবার ঢুকলো না তখনকার মতো। তার ভেতরটা কেমন থমথমে হয়ে আছে। গলার কাছে আটকে আছে একটা কান্নার দলা। 

ফাহাদ আর টিলি একটু বাদেই যার যার মতো বের হয়ে গেলো। চাচির বোনরা চলে আসলো যথা সময়ে। চাচিরা তিন বোন। তিন বোনই থাকেন আমেরিকাতে। চাচি ভার্জিনিয়ায়। বাকি দুজন নিউইয়র্কে। বোনেরা আসতেই চাচি সকালকে নিয়ে এমন আহ্লাদীপনা শুরু করলেন যে সকাল সংকোচে, লজ্জায়, অস্বস্তিতে একদম কাঁচুমাচু হয়ে গেলো। চাচির ভাব দেখে মনে হচ্ছে সকাল এর মাঝেই এ বাড়ির বউ হয়ে গেছে। বোনদের দেখে প্রথমেই তিনি যে কথাটা বললেন তা হলো, ‘দেখে যাও তোমরা। আমার হবু বউমাকে দেখে যাও।’ 

মহিলা দুজনের মধ্যে একজন সকালকে একটি সোনার আংটিও উপহার দিয়ে ফেললো। সকাল ছোটবেলা থেকেই একটু মুখচোরা গোছের। বাড়ির বড়দের সাথে কথা বলতে গেলে ভাষা হারিয়ে ফেলে। তালগোল ঠিক পায় না। চাচির বোনকেও সে যথারীতি কিছু বলতে পারলো না। বিরক্তিতে, অস্বস্তিতে কাদা হয়ে গিয়ে ঘরের এককোণে ঠেসে রইল। 

সন্ধ্যের পর ফাহাদ উঁকি দিলো তার ঘরে। দরজায় টোকা দিয়ে বলল, ‘আসবো?’ 

সকাল নড়েচড়ে বসে গায়ের কাপড় ঠিক করে নিলো। বলল, ‘এসো।’ 

—‘তুমি ঠিক আছো?’ সকালের বিবর্ণ মুখখানা দেখে ফাহাদ প্রশ্ন করলো কিছুটা উৎকণ্ঠা নিয়ে। 

ঘরে একটা হলদে কম পাওয়ারের ল্যাম্পশেড জ্বলছে। সকাল বিছানায় গুটিশুটি মেরে বসে ছিল। ড্রেসিংটেবিলের সামনে একটা টুল রাখা আছে। ফাহাদ কথা বলতে বলতে সেই টুলের ওপর বসলো। সকালের মুখোমুখি। 

—‘ঠিক আছি।’ সকাল বলল। 

—‘মুখটা ভীষণ শুকনো দেখাচ্ছে।’ 

—‘কই নাহ!’ সকাল এবার একটু হাসে। ওর হাসিমুখের দিকে ফাহাদ কিছুক্ষণ মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থেকে বলল, 

—‘তোমাকে হাসলে মিরান্ডা কেরের মতো দেখায়।’ 

—‘কে সে?’ 

—‘চেনো না?’ ফাহাদ ভারি অবাক হলো। 

—‘না চিনি না।’ 

—‘মডেল। শী ইজ সো প্রিটি। আমার ফেভারিট।’ 

—‘তাই?’ 

—‘হুম তাই। মিল আছে তোমার সাথে।’ বলে ফাহাদ হাসে। 

সকালও হাসে অপ্রস্তুত ভাবে। কী বলবে খুঁজে পায় না। 

এবার ফাহাদ কোনো রকম সূচনা ছাড়াই সোজাসোজি প্রশ্নটা করে বসলো, ‘উড ইউ লাইক টু গো আউট উইদ মি সামটাইম? মে বি নেক্সট উইকেন্ড? পারহ্যান্স ফর ডিনার?’ 

সকাল একটু সন্দেহের গলায় বলল, ‘ইজ ইট গোয়িং টু বি আ ডেট?’

ফাহাদ একটু লাজুক হাসলো, ‘ইয়েস ইট ইজ।’ 

কথাটা শুনে গুম মেরে গেলো সকাল। কয়েক সেকেন্ড কিছু বলল না। ওর নীরবতা দেখে ফাহাদ অস্থির হয়ে বলে উঠল, 

—‘ইয়েস অর নো?’ 

—‘ফাহাদ শোনো আমাকে কি তুমি আরেকটু সময় দিতে পারবে? প্লিজ? তুমি খুবই ভালো একটা ছেলে। কিন্তু আমি আসলে এতো তাড়াহুড়া করে কোনো ডিসিশন নিতে চাইছি না।’ করুণ গলায় বলল সকাল। 

—‘তোমাকে তাড়াহুড়া করে কোনো ডিসিশন নিতে হবে না। ইটস আ সিম্পল ডেট। একদিন আমার সাথে ডেটে গেলে তো তোমার আমাকে বিয়ে করতে হবে না। ইউ আর ফ্রি টু টেক এনি কাইন্ড অব ডিসিশন এনি টাইম।’ 

সকালের বুক চিরে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস বেরিয়ে গেলো। এই ছেলের চিন্তা-ধারার সাথে সে কিছুতেই তাল মিলাতে পারছে না। সিম্পল ডেট! এই সিম্পল ডেট’টাই তার পঁচিশ বছরের জীবনে প্রথমবারের মতো আসবে! ছেলেটা কি এর গুরুত্ব বুঝতে পারছে? 

—‘তবুও, আরেকটু সময় চাই আমার।’ এবার একটু শক্ত ভাবে বলল সকাল। ফাহাদ গলায় অস্থিরতা বজায় রেখেই বলল, 

—‘কত সময়?’ 

ভারি মুশকিলে পড়া গেলো তো! সকাল কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছিল না। ভাবলো খানিকক্ষণ। ভেবেও কূল কিনারা পেলো না। 

—‘আমি সঠিক বলতে পারছি না। কয়েকটা দিন। বেশি হলে এক দু সপ্তাহ।’ 

ফাহাদকে চিন্তিত দেখালো। সে কৈফিয়ত দেবার ভঙ্গিতে বলল, 

—‘দেখো সকাল একদিন আমার সাথে বেরোলেই কিন্তু তোমার ফাইনাল ডিসিশন নিতে হবে না। এর পরেও অনেক সময় থাকবে। আমি শুধু চাইছি তোমার সাথে একান্তে কিছু সময় কাটাতে।’ 

—‘একান্তে সময় তো আমরা বাড়িতে বসেও কাটাতে পারি। ডেটে যাওয়ার কী আছে?’ 

ফাহাদ হেসে ফেললো। 

—‘কী বলছো তুমি? এভাবে হয় নাকি?’ 

সকাল আর কোনো দ্বিরুক্তি না করে চুপ করে রইল। 

ওর মুখে খেলতে থাকা অস্বস্তিটা টের পেয়ে ফাহাদ বলল, ‘কোনো সমস্যা নেই। তুমি সময় নাও। আর মুখচোখ অমন ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে কেন? সারাদিন কিছু খাওনি?’ 

—‘খেয়েছি।’ শুকনো গলায় বলল সকাল। কিন্তু আসলে কী, ও সারাদিন ঠিকমতো কিছুই খেতে পারেনি। সেই যে সকালবেলা ঐ মানুষটা বলে গেলো, আজকে ব্রেকফাস্ট স্কিপ করলাম, এরপর থেকে তার গলা দিয়ে আর কিছুই নামছে না। অনেক চেষ্টা করেও দুপুরে কিছু মুখে দিতে পারেনি। বিকেলে শুধু এক কাপ চা খেয়েছে নিজের হাতে বানিয়ে। 

ফাহাদ ‘গুড নাইট’ বলে চলে যাবার মিনিট দুয়েকের মাথায় চাচি আসলেন ঘরে। এসেই একগাল হাসি দিয়ে একটা স্যামসাং মোবাইল সকালের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,’ এই মোবাইলটা তুমি রাখো। আপাতত আমি এই নাম্বার ইউজ করছি না। তোমার কাছে থাকুক। বাসার বাইরে এদিক সেদিক গেলে যেন তোমার খোঁজ-খবর নিতে পারি।’ 

সকাল মোবাইলটা হাতে নিল। কৃতজ্ঞতার গলায় বলল, ‘অনেক ধন্যবাদ চাচি!’ 

—‘কেমন দেখলে আমার বোনদের বলো।’ 

সকাল বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে চাচিকে বসতে দিয়ে বলল, ‘খুব ভালো লেগেছে চাচি। বসুন।’

চাচি খুশিতে গদগদ হয়ে বললেন, ‘তুমি উঠলে কেন? বসো বসো! দেখো কী ভদ্র মেয়ে গো! এসব ভদ্রতার জন্যেই দেশ থেকে বউ আনবো বলে ঠিক করেছিলাম অনেক দিন আগে। বুঝলে? এখানকার মেয়েগুলো মনের দিক থেকে যতই ভালো হোক না কেন ভদ্রতার বালাই নাই। জানো না তো আমার বড় বোনের ছেলেটা গত এক বছর যাবৎ একটা আমেরিকান মেয়ের সাথে লিভ টুগেদার করছে।’ 

খবরটা তেমন চমকপ্রদ কিছু বলে মনে হলো না সকালের কাছে। দেশের ছেলে-মেয়েরাই আজকাল এইসব করছে বলে শুনতে পায় সে। আর এদেশে তো ডাল ভাত হওয়ার কথা। অবাক না হলেও চাচির মন রাখতে অবাক হওয়ার ভান করলো। বলল, ‘তাই?’ 

—‘হ্যাঁ তাই তো। আর বোলো না, আমার বোনের যা মন খারাপ! ওই আমেরিকান মেয়ে এমনি ভালো খুব। কিন্তু ছেলের বউ বলতে মানে আমরা যেরকম চাই সেরকম তো আর জীবনেও হবেনা, তাই না?’ 

সেরকমটা যে আদতে কী রকম সকাল তা জানে না। তবে প্রশ্ন না করে সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লো সে। মা বলে দিয়েছে, চাচি যা বলবে তাতেই যেন সে বাধ্য মেয়ের মতো ঘাড় নাড়ে। কথাবার্তাও বলতে হবে খুব সাবধানে, বুঝে শুনে। মায়ের আদেশ বরাবরই পালন করে এসেছে সে। মুখে নানারকম তর্ক করলেও দিন শেষে মা বাবার আদেশ পালনে অটল থাকাটাকেই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে হয় তার। তাই তো আমেরিকায় আসবে না, আসবে না করেও শেষ অবধি এসেই গেলো। 

—‘তোমার আংটিটা কোথায়, দেখি?’ প্রশ্নটা করে চাচি সকালের হাতের দিকে চাইলেন। সকাল একটু বিপাকে পড়ল। আংটিটা সে তুলে রেখেছে সুটকেসের ভেতর। যেহেতু বিয়ের কথা এখনো পাকাপাকি হয়নি তাই তুলে রাখাটাই সমীচীন বলে মনে হয়েছে তার কাছে। সে অস্বস্তি নিয়ে বলল, 

—‘আসলে চাচি, আংটিটা আমি রেখে দিয়েছি। সুটকেসে।’ 

—‘সেকি, তোমার পছন্দ হয়নি? 

—‘না না পছন্দ অপছন্দের বিষয় না। আসলে…’ আমতা আমতা করে শেষ পর্যন্ত কথাটা বলেই ফেললো সকাল, 

—‘আসলে এখনও তো বিয়ের কথা পাকা হয়নি তাই ভাবছিলাম আংটিটা…মানে আংটিটা এখন পরা ঠিক হবে কিনা…’ 

চাচির মুখটা একটু ফ্যাকাশে দেখালো। উদ্বেগ নিয়ে বললেন, ‘এখনও কিছু ঠিক হয়নি তো কী হয়েছে? ঠিক হয়ে যাবে। তাই বলে তুমি জিনিসটা ফেলে রাখবে? কেউ ভালোবেসে কিছু দিলে সেটা গ্রহণ করতে হয় মা।’ 

সকাল লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলো নিচে। আজকের দিনটা তার আসলে ভালো যাচ্ছে না। নানাভাবে অপদস্থ হচ্ছে দিনের শুরু থেকে! এখনও হলো। 

চাচি হঠাৎ জরুরি গলায় বললেন, ‘আচ্ছা শোনো, তোমার আম্মা ফোন দিয়েছিলেন। আমাকে প্রশ্ন করলেন আমার বড় ছেলের ব্যাপারে। মানে, আমার তো ছেলে না, ফাহাদের আব্বার ছেলে।’ 

সকাল একটু বেকুবের মতো চেয়ে রইল খানিকক্ষণ চাচির মুখের দিকে। সে বুঝতে পারলো না চাচি ঠিক কী বিষয়ে কথা বলছেন। সকালের ঐ অকপট চেয়ে থাকা দেখে চাচি বললেন, ‘মানে আমি আরশানের কথা বলছি।’ 

কেন কে জানে, ঐ নামটা শোনা মাত্র সে তার হৃৎপিণ্ডে একটা রক্তচ্ছাস টের পেলো। বুক কেঁপে উঠল দুরু দুরু। তটস্থ হয়ে বলল, ‘আরশান?’ 

—‘হ্যাঁ আরশান। ফাহাদের আব্বার আগের স্ত্রীর ছেলে।’ 

—‘ও’ বলে সকাল মাথা নিচু করে নিজের হাতের নখ দেখতে লাগলো মনোযোগ দিয়ে। যেন চাচির এই মুহূর্তে তোলা প্রসঙ্গে তার কোনো আগ্রহ নেই। চাচি বললেন, ‘যেহেতু এ বাড়ির সাথে তোমার একটা সম্বন্ধের কথা চলছে, সেহেতু ব্যাপারগুলো তোমার জানা দরকার। আমি ভেবেছিলাম তোমার বাবা মা এই বিষয়ে বিস্তারিত জানেন। কিন্তু এখন দেখা গেলো আরশানের ব্যাপারটা তাদের মাথায়ই ছিল না। আসলে আরশানের জন্মের পরপরই ফাহাদের বাবা আমেরিকায় চলে এলেন তো, তাই হয়তো খবরটা তোমার বাবাকে দেয়া হয়ে ওঠেনি। এখন জরুরি কথা শোনো, আরশানের মা মহিলাটা বেশি সুবিধার মানুষ ছিল না, বুঝলে? 

সকাল বোঝার জন্যে চোখ তুলে সরাসরি চাইলো চাচির দিকে। সতীনের প্রশংসা কোনো নারীর মুখ দিয়ে কোনো কালে বের হবে না এটা সে জানে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হলো আরশানের মায়ের প্রসঙ্গ উঠতেই সে ভেতরে ভেতরে একটা পবিত্রতা অনুভব করছিল। যে নারী আরশানের মতো এক পুত্রসন্তানের জন্ম দিতে পারে সে নারী মানুষ হিসেবে খারাপ হবে এটা তার কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকছিল। তা ছাড়া এখন সকাল বুঝতে পারছে পারিবারিক এলবামের ছবিগুলোতে আসলে চাচার পাশে এই চাচি নয় বরং আরশানের মা’ই ছিলেন। এ কারণেই ছবির চেহারার সাথে এই মহিলার কোনও মিল খুঁজে পায়নি সে। 

চাচি সকালের চোখে চোখ রেখে গলাটা একটু নিচে নামিয়ে বললেন, ‘ওর মা দুধের বাচ্চাকে ফেলে রেখে অন্য পুরুষের হাত ধরে পালিয়ে গিয়েছিল।’ 

সকাল চমকে উঠল। অস্ফুটে বলল, ‘মানে?’ 

চাচি খুব মজাদার কোনো গল্প বলার ঢঙে বললেন—‘মানে ওর মা বাচ্চা ফেলে রেখে পালিয়ে গিয়েছিল। কী সাংঘাতিক ঘটনা চিন্তা করতে পারো?’

সকাল থ বনে যাওয়া গলায় বলল, ‘এটা … এটা আরশান জানে?’

চাচি রসিয়ে রসিয়ে বললেন, ‘খুব জানে। জানবে না আবার?’ 

সকালের চোখে তখনও বিস্ময়ের ঘোর। তার নিজের কানকে নিজের বিশ্বাস হচ্ছে না। এ আবার কেমন মা? যে কোলের শিশুকে রেখে পালিয়ে যায়? তার নিজের মা যদি এমন কাজ করতো ….ভাবতে পারলো না আর।  দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হলো। 

—‘তা, ওর মা চলে যাওয়ার কিছু দিনের মাঝেই ওর আব্বার সাথে আমার বিয়ে হলো। বিয়ের পরে এই ছেলেকে তো আমিই কোলে পিঠে করে মানুষ করলাম। কিন্তু একটু বড় হতে হতেই তার আসল রূপ আমাকে দেখিয়ে ছাড়লো। যত যাই বলো শরীরে তো বইছে ঐ বাজে মহিলার রক্ত, তাই না?’ 

সকাল স্তব্ধ হয়ে চেয়ে ছিল। 

—‘আর এই ছেলের তো এখন মাথা ঠিকমতো কাজ করে না বুঝলে? সারারাত জঙ্গলে পড়ে থাকে। কী করে রাত জেগে আল্লাহ মালুম। কাউকে যেতে পর্যন্ত দেয় না সেই জায়গায়। বলে সে নাকি ক্যামেরা বসিয়ে রেখেছে। লুকিয়ে কেউ গেলে সে ঠিক ঠিক টের পেয়ে যাবে। আর যদি কেউ এমন কাজ করে থাকে তাহলে সে তৎক্ষণাৎ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। আমি কিছু বলি না কারণ হাজার হোক ফাহাদের আব্বার নিজের ছেলে। কিছু বললে সে কষ্ট পাবে। তাই এসব পাগলামি সহ্য করে আছি।’ 

—‘কাউকে যেতে দেয় না কেন?’ 

‘কী করে বলবো বলো? ভাবটা এমন যেন গোটা জায়গাটার মালিক সে নিজে একা। আমিও ফাহাদের আব্বাকে জানিয়ে দিয়েছি ঐ জায়গাটাই আমার চাই। আমি একটা ডে কেয়ার খুলবো। বাড়ির একদম কাছে হবে।’ 

—‘বন-জঙ্গলের ভেতর?’ সকালের কেন যেন মনে হলো, ডে কেয়ারের বিষয়টা বাহানা মাত্র। আরশানকে জায়গাটা থেকে উৎখাত করাই চাচির মূল উদ্দেশ্য। 

—‘কেন নয়? লাইসেন্স হয়ে গেলে কয়েকটা গাছ লতাপাতা কেটে পরিষ্কার করে নিলেই হবে। আর জঙ্গল তো আর সেরকম গহীন নয়। শীত আসলে গাছের পাতা পড়ে গেলেই দেখবে খালি চোখে বহুদূর দেখা যায়।’ 

সকাল বাতাসে কেমন রহস্যের গন্ধ পায়। মনে পড়ে সেদিন স্টেক হাউজে বসে ফাহাদের সাথে এ ব্যাপারেই কথা বলছিল আরশান। দুই ভাইয়ের কথোপকথন শুনে সে আঁচ করতে পেরেছিল যে আরশান জায়গাটা অত সহজে ছাড়বে না। এই মহিলাও নাছোড় বান্দা। ঝামেলা না বাঁধিয়ে ক্ষান্ত হবে না। শেষমেশ হয়তো আরশান এই বাড়ি ছেড়েই চলে যাবে। চাচিকে তার প্রথমদিকে যতটা ভালো লেগেছিল আজ হঠাৎ তার চাইতেও অনেক বেশি খারাপ লাগতে শুরু করলো। একটা মাতৃহারা ছেলেকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসাটা কি এতটাই কঠিন? 

তার মনে হলো মহিলার বাইরের আবরণটা যতই আধুনিক হোক না কেন, ভেতরটা একেবারে প্রাচীনপন্থি। আধুনিকতা আসলে সাজসজ্জার ওপর নির্ভরশীল নয়, মানসিকতার ওপর নির্ভরশীল। 

আর কিছুই ভালো লাগছিল না তার। অকারণ এক অশান্তি দানা বাঁধছে বুকের ভেতর। আরশানের গল্পটা শুনে পৃথিবীর সকল মাতৃহারা সন্তানের জন্য তার মন হাহাকার করে উঠল। তার মনটা যে ভারি নরম! কষ্ট সইতে পারে না। একদম না। বলতে কি তার সাদা মাটা জীবনটায় কোনো সত্যিকারের কষ্ট নেই। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। বাবা সরকারি চাকরি করেছেন সারাজীবন। মা গৃহিনী। দুজনের দাম্পত্য জীবন স্বাভাবিক। সে জানে তার বাবা মায়ের ভেতর পারস্পরিক বোঝাপড়া আছে। ভাব-ভালোবাসারও কমতি নেই। বড়লোক কোনো কালেই ছিল না তারা। তবে স্বচ্ছল ছিল। অভাব অনটন দেখেনি কখনো নিজের চোখে। সব মিলিয়ে ভারি পরিচ্ছন্ন, ছিমছাম জীবন তার। কোনো উৎকণ্ঠা নেই, তরঙ্গ নেই আছে স্থিরতা, আছে শান্তি। কিন্তু ফাহাদের সাথে বিয়ে হয়ে এ বাড়িতে আসার পর তার শান্ত স্থির ঢেউহীন জীবনটা কি আগের মতোই থাকবে? মনে হয় না। সামনে বসা মহিলাটাকে তার নিজের শাশুড়ি ভাবতে এ মুহূর্তে কষ্ট হচ্ছে। নাহ, চিন্তা করতে হবে সকালের। ভালো সময় নিতে হবে। হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না। 

—‘তোমার কী হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে নাকি?’ 

মনের অস্থিরতা চোখে মুখে ধরা পড়ে গেলো। বলল, ‘জি চাচি শরীরটা ঠিক ভালো লাগছে না।’ 

—‘খাওয়াদাওয়া করে শুয়ে পড়। এসো আমি তোমাকে খাবার দিচ্ছি। এতো কিছু রান্না করলাম। কিছু তো মুখে দিলে না।’ 

—‘চাচি আমার কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। আপনারা খেয়ে নিন। 

আরো কিছুক্ষণ খাওয়া সংক্রান্ত ব্যাপারে ব্যর্থ জোরাজোরি করে উঠলেন চাচি। সকাল বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে রইল খানিকক্ষণ। বুকের অশান্তিটা কমছে না। বরং ধীরে ধীরে বাড়ছে। নিজের দেশে এখন ভোর হচ্ছে। আহারে দেশটা। সোনা দেশটা! 

দেশ বলতে আসলে কী বোঝায়? বিদেশের মাটিতে বসে জীবনে এই প্রথমবারের মতো সকাল ভাবতে বসলো, হ্যাঁ প্রথম বারেরই মতো যে দেশ বলতে আসলে কী বোঝায়? শুধু একটা ভূ-খণ্ডই কি? নাকি সেই ভূখণ্ড সাথে জড়িত সমস্ত কিছু? তার মনে হলো দেশ মানে আসলে নিজের বাবা মা, নিজের বাড়ি, নিজের বিছানা, নিজের চায়ের কাপটা। দেশ মানে রাস্তার ধারের ফুচকা, বিকেল বেলায় উদ্দেশ্যহীনভাবে রিকশায় ঘোরাফেরা, বন্ধুদের সাথে টিএসসি-তে আড্ডা। দেশ মানে শৈশব, দেশ মানে তারুণ্য, দেশ মানে মনের ঘুপচি অলি গলিতে জমে থাকা হাজার হাজার স্মৃতির বস্তা! ফিরে যাবে সকাল। যেখান থেকে এসেছে সেখানেই ফিরে যাবে। এই পরিষ্কার ঝকঝকে সাজানো নগরী তাকে একটুও টানছে না। তার ধূলো বালিতে জন্ম, ধূলো বালি ছাড়া তার নিশ্বাস নেয়াই দায়! এমনই সব এলোমেলো ভাবনা ভাবতে ভাবতে সকালের হঠাৎ মনে পড়ল আরশানকে তার সরি বলার কথা ছিল। বলা হলো না। 

শোয়া থেকে সটান উঠে বসলো সে। বলতেই হবে, যে করেই হোক ছেলেটার কাছে দোষ স্বীকার করেতেই হবে। 

আরশান বাড়ি ফিরলো একটু রাত করে। কাজের চাপ ছিল খুব। দুপুরে তাড়াহুড়া করে একটা স্যান্ডউইচ খেয়ে নিয়েছিল। এখন এই রাত দশটায় বাড়ি ফিরে নিজের জন্য আর কিছু রান্না করতে ইচ্ছে হলো না তার। অফিসের জামা-কাপড় পাল্টে নিয়ে এক কাপ কফি বানিয়ে নিলো শুধু। আজ সে রাত জাগবে। সারারাত জেগে জেগে ছবি আঁকবে। মন খারাপের রাতগুলোতে সে খুব করে ছবি আঁকে। ছবি আঁকার মধ্যে ডুবে যায় একদম। 

আজ তার মনটা খারাপ। তবে মন খারাপের কারণ স্পষ্ট না। অবশ্য সে জানে এবং মানে যে মন খারাপের কোনো নির্দিষ্ট কারণ লাগে না। মানুষের সত্যিকারের মন থাকলে সেই মন হঠাৎ কারণে-অকারণে খারাপ হবে আবার ভালো হবে এটাই স্বাভাবিক। 

এন্ড্রিয়ানা আজ সরাসরি প্রশ্নটা করেছিল, ‘শাওন, পরিষ্কার করে বল তো তুমি সত্যি আমাকে পছন্দ কর নাকি করো না?’ 

আরশান দুঃখ প্রকাশ করে বলেছে, ‘দেখো এন্ড্রি, আমি এখনও নিজেকে ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না, আমার আরও কিছু সময় দরকার। কিন্তু তুমি আমার জন্য আর অপেক্ষা করে থেকো না। আমার খুব খারাপ লাগছে।’ 

এন্ড্রিয়ানার সবুজ সুন্দর চোখজোড়া একটু জলসিক্ত হয়ে উঠেছিল। সে গভীর গলায় বলে উঠেছিল, ‘তোমার জন্য আমি আরো অনেক দিন অপেক্ষা করতে পারবো শওন। আমি জানি তুমি ঠিক অন্যদের মতো নও। আর এ কারণেই আমি তোমাকে এতো পছন্দ করি। তুমি সময় নাও। আমি অপেক্ষায় আছি।’ 

অপেক্ষা জিনিসটা আরশানের পছন্দ নয়। সে চায় না তার জন্য কেউ এমন নিরবচ্ছিন্ন ভাবে অপেক্ষা করুক। সে নিজেও কারো জন্য অপেক্ষা করতে চায় না। অপেক্ষার ফল কখনো সুমিষ্ট হয় না। এইতো আজ সকালে ঐ মেয়েটার জন্য সে নাশতা নিয়ে অপেক্ষা করে বসে রইল। ফলাফল কী দাড়ালো? সেই মেয়ে তার কথা বেমালুম ভুলে বসে ছিল। 

জীবন শিখিয়েছে আরশানকে, কারো জন্য কখনো অপেক্ষা করতে নেই। মায়ের জন্য অপেক্ষা করতো আগে, ছেলেবেলায়। জন্মদিনের দিন কেক কাটার আগে উইশ করতো, ‘হে আল্লাহ আমার মা যেন ফিরে আসে। আমার মা’ কে তুমি ফিরিয়ে দাও আমার কাছে।’ 

মা আসেনি। আর আসবে না কোনো দিন, আরশান জানে। 

এক হাতে কফির মগ আর অন্য হাতে বেহালা নিয়ে ডেকে এসে বসলো সে। কফির মগ রাখলো রেলিং এর ওপর। নিজে বসলো চেয়ারে। 

আজ রাতে বৃষ্টি হবে। ওয়েদার ফোরক্যাস্ট সেরকমই সংবাদ দিলো। ইতিমধ্যেই আকাশ মেঘলা। জঙ্গলের লম্বা মাথাওয়ালা গাছগুলোর গায়ে শন শন বইছে বাতাস। দানবের মতো দুলছে পাইন আর সিডার গাছের শরীর। দূরের বনে শিয়াল ডাকছে হুক্কা হুয়া। আর তার সাথে থেকে থেকে ডাকছে একটা প্যাঁচা। 

একটু বাদে ভায়োলিনের সুর ছড়িয়ে গেলো চারপাশে। ব্যাকুল সেই মনকাড়া সুর বৃক্ষরাজির লতাপাতা ভেদ করে ছড়িয়ে পড়ল অরণ্যে অরণ্যে, আকাশের মেঘের কিনারে কিনারে, রাত পাখিদের দুয়ারে দুয়ারে। 

আসন্ন ঝড়বৃষ্টির ভেজা বাতাসের সাথে, কালো আকাশের গায়ে নিরুদ্দেশ উড়তে থাকা ছাইরঙা মেঘগুলোর সাথে আর আরশানের বুকের ভেতরে গুমরে ওঠা কষ্টগুলোর সাথে ভায়োলিনের পাগল করা আকুল সুরটির কোথায় যেন একটা গভীর মিল আছে। 

চিবুক আর হাত দিয়ে চেপে ধরে বাম কাঁধের ওপর বেহালাটা শুইয়ে রেখেছে সে। ডান হাতে ধরা বো বাদ্যযন্ত্রের গায়ে উঠা নামা করে সুরের লহরী তুলছে হাওয়ায়। উতলা হাওয়া দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তার মাথায় ঘাসের মতো ছোট করে ছাঁটা মসৃণ চুলগুলোতে। তার চক্ষু দুটো বোজা। মুখের ভাঁজে ভাঁজে এক ধরনের ব্যগ্রতা। 

ঠিক সেই মুহূর্তে তার এই বহুদিনের চেনা, পুরনো একান্ত নিজের নৈঃশব্দ্যে ভরা স্থানটিতে সে ছাড়া অন্য একজন দ্বিতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি টের পাওয়া গেল। 

ডেকের কিনার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে আগন্তুক। আরশানের হাত থেমে গেলো। থেমে গেলো সুর। তারপর শুধু বাতাসের সাঁই সাঁই, শেয়ালের হুক্কা হুয়া আর দুটি মানুষের নিবিড় শ্বাস-প্রশ্বাস। 

—‘কী চাই?’ বেহালাটা কাঁধ থেকে নামিয়ে রাখতে রাখতে আরশান শুধোল আগন্তুকের দিকে না তাকিয়েই। নিস্তরঙ্গ গলায়। 

—‘আপনি সবসময় এতো রুঢ় ভাবে কথা বলেন কেন?’ 

—‘আমি এমনই।’ 

—‘এমন কেন আপনি? 

—‘উত্তরটা জানা নেই। ভেতরে যান। অনেক রাত হয়েছে।

—‘আপনি মানুষটা খুব অভদ্ৰ।’ 

—‘জানেনই যেহেতু তাহলে কেন বারবার যেচে পড়ে কথা বলতে আসছেন অভদ্র মানুষটার সাথে?’

সকাল কিছু বলল না প্রত্যুত্তরে। কয়েক কদম হেঁটে, দুই ধাপ কাঠের সিঁড়ি ভেঙে উঠে আসলো ডেকের উপরে। আরশান চেয়ার ছেড়ে উঠল দাড়ালো সকালের মুখোমুখি। অন্ধকারে চোখ মুখ কিছু ঠিক মতো দেখা যায় না। আশেপাশে কোথাও কোনো আলো নেই। হঠাৎ হঠাৎ শুধু চোখে পড়ে একটা দুটা উড়তে থাকা সবুজ ডানার জোনাকী। একটু বাদেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামবে। জোনাকিরাও আর উড়বে না বেশিক্ষণ। 

—‘আপনি না দেখেই কী করে বুঝলেন যে আমি এসেছি? অন্য কেউ তো হতে পারতো।’ 

—‘এ সময় কেউ আসে না আমার কাছে।’ 

মুখে বলল আরশান কিন্তু সত্যিই তো! কী করে চোখ তুলে না দেখেও চিনে ফেললো সে মানুষটাকে? তার অবচেতন মন কি কোনো এক ভাবে জানতো? যে মেয়েটা আসবেই? 

—‘নিষেধ আছে নাকি?’ 

—‘হ্যাঁ বলতে পারেন একরকম নিষেধই আছে।’ 

—‘ও নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ফেললাম তাহলে।’

—‘করলেন তো!’ 

—‘হুম, তিন নম্বর অপরাধটা করে ফেললাম। আপনার কাছে করা আমার অপরাধের মাত্রা দেখি সীমা অতিক্রম করে ফেলছে।’ 

আরশান ভ্রু কুঁচকে কথাটার অর্থ উদ্ধার করার চেষ্টা করলো। তারপর তাচ্ছিল্যের গলায় বলল, 

—‘কী বললেন? কোনো সেন্স মেক করলো না তো আপনার কথাটা।’ 

—‘বাংলা ভাষা একটু কম বোঝেন মনে হয়।’

—‘বাংলা ভাষা আমি খুব ভালোই বুঝি।’ 

—‘অবশ্য আপনার অন্য দুই ভাই-বোনের তুলনায় আপনার বাংলা যথেষ্ট 

ভালো বলতে হবে। আপনার জন্ম তো আমেরিকায়। কী করে শিখলেন এতো ফ্লুয়েন্ট বাংলা বলা?’ 

—‘আমার জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশে, আমেরিকায় নয়।’ 

বিদ্যুৎ চমকালো। আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত সাপের মতো এঁকেবেঁকে বয়ে গেলো একটি গভীর নীল দাগ। আচমকা ভূখণ্ডে লাফিয়ে পড়া এক টুকরো বিদ্যুৎ আলোয় আরশান দেখলো দমকা হাওয়া দুরন্ত খেলায় মেতেছে সকালের এলোমেলো খোলা চুল নিয়ে। মাথা ভর্তি অবাধ্য চুলগুলোকে দু’ হাত দিয়ে সামলাতে সামলাতে সকাল হঠাৎ অন্য রকম গলায় বলল, 

—‘আচ্ছা, আপনি কি রাগ করেছিলেন?’ 

—‘রাগ? রাগ করবো কেন?’ 

ভারি অবাক হয় আরশান এই স্বল্প পরিচিতা মেয়েটিকে এমন অদ্ভুত কথা বলতে শুনে। আবার ভেতরে ভেতরে একটু কেমন ভয়ও পায়। মেয়েটি কি অন্তর্যামী? মনের ভেতর তো সত্যিই একটা কালো মেঘের মতো থমথমে রাগ অকারণে গর্জে উঠছিল খানিক বাদে বাদে। কিন্তু ঠিক কার ওপরে সেই রাগ তা তার কাছে স্পষ্ট না। এই মেয়েটির ওপরেই কি? নাহ তা কেন হবে? মেয়েটি কে? কেউ না। তার রাগ তো নিজের ওপর, জীবনের ওপর, ভাগ্যের ওপর। কিন্তু জীবন বা ভাগ্য এরা কেউই কখনো মানুষের মতো কথা বলে ওঠে না। রাত গভীরে চোখে চোখ রেখে অকপটে শুধোয় না, ‘তুমি কি আমার ওপরে রাগ করেছ?’ যদি করতো তাহলে হয়তো এই মেয়েটিরই মতোন জীবনকেও তার সেই মুহূর্তে ভারি স্নিগ্ধ লাগতো। হ্যাঁ সিগ্ধই লাগছে তার সকালকে এখন। অথচ খানিক আগেও মেয়েটির প্রতি তার ছিল চরম বিরক্তি ভাব। 

সকাল একটু থেমে থেমে বলল, ‘না মানে, আমি ভেবেছিলাম আপনি আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।’ 

—‘যদি জানতেনই যে অপেক্ষা করছিলাম, তাহলে এলেন না কেন? 

—‘আপনার কাছেই আসছিলাম। কিন্তু চাচা চাচি এমনভাবে চেপে ধরলেন উনাদের সাথে নাশতা করার জন্য, আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। যদি উনারা আবার কিছু মনে করেন! 

—‘তাই? তা এখন কী করে এলেন? কাউকে কিছু না বলে? লুকিয়ে?’ 

সকাল একটু অপ্রতিভ হলো প্রশ্নটা শুনে। এই মানুষটার ব্যক্তিত্বের ধার এতো বেশি যে খুব বেশিক্ষণ এর সাথে সমান তালে কথা বলা যায় না। একটু এগোতেই তাল কেটে যায়। এলোমেলো হয়ে যায়। 

—‘এসেছি আপনাকে সরি বলতে।’ 

—‘সরি? সরি কিসের জন্য?’ 

—‘না মানে, আপনি অপেক্ষা করছিলেন, আমি আসতে পারিনি… তাই। আরশানের ঠোঁটে একটা বাঁকা হাসি ফুটে উঠল। ওই অহংকারী গায়ে জ্বালা ধরানো হাসিটা। অন্ধকারেও টের পায় সকাল যে ছেলেটার মুখে এখন ফকফক করছে ডাঁটিয়াল হাসি। সে ঝেঁঝে উঠে বলে, 

—‘অত হাসির কিছু নেই। ভাবলাম সরি বলা উচিত। তাই বললাম।’

—‘বেশ তো, ভালোই ভেবেছেন। তা সরি বলার জন্যেই কি এতো রাতে লুকিয়ে লুকিয়ে আসলেন?’ 

—‘লুকিয়ে আসব কেন? আমিতো আপনাদের বাড়িতে অতিথি হয়ে এসেছি। কয়েদি হয়ে নয়। যেখানে ইচ্ছা যেতে পারি। গভীর রাতে আপনার মতো জঙ্গলে গিয়েও বসে থাকতে পারি। কারও কিছু বলার নেই।’ 

সে সময় আবার গমগম করে সারা আকাশ কাঁপিয়ে মেঘ ডেকে উঠল ধূলা উড়তে লাগলো বাতাসে। আরশান বলল, ‘চলুন ভেতরে যাওয়া যাক। বৃষ্টি নামবে।’ আরশানের কথা পুরোপুরি শেষ হবার আগেই তার মুখ নিঃসৃত বাণী সত্য প্রমাণ করার উদ্দেশ্যেই বুঝি ঝেঁপে বৃষ্টি নামলো। আরশান দ্রুত পা চালালো ঘরের দিকে এক হাতে ভায়োলিন আর অন্য হাতে কফির মগ নিয়ে। সকালও ছুটলো ওর পেছন পেছন। 

ঘরের ভেতরটাও অন্ধকার হয়ে ছিল। আরশান ঢুকে পড়েই প্রথমে বাতি জ্বালিয়ে দিলো। একসাথে তিন চারটা বাতি জ্বলে উঠে সারা ঘর আলোয় আলোয় ভরিয়ে দিলো। অনেকটা ক্ষণ অন্ধকার সয়ে আসা চোখের ওপর ছুরির মতো গিয়ে আঘাত হানলো যেন ওই আলোর জোয়ার। চোখ খুলতে কষ্ট হচ্ছিল সকালের। ধীরে ধীরে অনেক কসরৎ করে যখন চোখ খুললো তখন আবিষ্কার করলো তালগাছের মতো লম্বা শরীরের সুন্দর চোখ ওয়ালা মিনসেটা অকপটে চেয়ে আছে তার দিকে। মিনসেটার গায়ে একটা ঢলঢলে সাদা রঙের টি শার্ট। কালো ট্রাউজার। খুবই শ্যাবি আউটফিট। তবুও ভালো দেখাচ্ছে তাকে। এতো ভালো যে বুক কেঁপে যায়। অতএব ওই চোখের সামনে দাঁড়িয়ে সকাল বরাবরের মতোই অস্বস্তি বোধ করতে লাগলো। কী করবে, কী বলবে কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না। 

—‘বসুন।’ আরশান বলল। 

সকাল চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিলো একবার। ঘরটা বেশ বড়। অনায়াসে দুই সেট সোফা আর একটা চার চেয়ারের ডাইনিং টেবিল এঁটে গেছে। টেবিলের পাশে রয়েছে ফ্রিজ। তার পাশে দেয়ালের তাকে মাইক্রো ওয়েভ, কফি মেশিন। ধোঁয়াধায়ী করার জন্য একটা সিংকও আছে। সকাল দেখেশুনে বিজ্ঞ গলায় বলল, ‘বাহ্ বেশ ভালোইতো দেখছি আপনার সংসার।’ 

শুনে আরশান একটু দুর্বোধ্য হাসলো। সংসার! সংসার বলতে আসলে আমরা কী বুঝি? গৃহে সাজিয়ে রাখা আসবাব আর টুকিটাকি যন্ত্রপাতি? নাকি গৃহের ভেতরে বসবাস করা মানুষগুলো আর মানুষগুলোর ভেতরের পারস্পরিক ভাব ভালোবাসা? সংসার কি আসলে বস্তুগত নাকি ভাবগত? দৃশ্যমান নাকি অদৃশ্য? ভালোবাসার কেউ না থাকলে একা একা কি সংসার এটা হয়? হয়তো হয়। হয়তো না, নিশ্চয়ই হয়। ঠিকই বলেছে মেয়েটা, একরকম তার সংসারই বলতে গেলে। তার একার সংসার। 

সোফায় বসলো সকাল। বসলো আরশানও। সকালের মুখোমুখি। বলল, ‘এখন বলুন। কী যেন বলছিলেন?’ 

নিজের অজান্তেই একটা ঢোঁক গিললো সকাল। অন্ধকারে কথা বলা সহজ কাজ ছিল। যেমন ইচ্ছে বলা যাচ্ছিল। কেউ কারো মুখের ভাব টের পাচ্ছিল না। এখন ফকফকে আলোর নিচে সামনা সামনি বসে মানুষটার চোখে চোখে চেয়ে কথা বলতে গিয়ে কেমন অস্বস্তিতে কাঁটা হয়ে রইল সে। 

—‘না বলছিলাম যে, ইয়ে… তেমন কিছুই না। মানে আমি সরি। 

—‘সেটা তো বললেন একবার।’ 

—‘হ্যাঁ বলেছি। বলেই তো ফেলেছি। সো…’ আমতা আমতা করে সকাল। 

—‘আর কিছু বলার নেই?’ 

—‘না। আর কী বলার থাকবে?’ 

—‘বেশ।’ বলে ঠোঁট টিপে একটা অদ্ভুত মুখভঙ্গি করলো আরশান। পায়ের ওপর পা তুলে হেলান দিয়ে আরাম করে বসলো সোফায়। তারপর পা নাচাতে লাগলো আর ভারি মনোযোগ দিয়ে সকালকে দেখতে লাগলো। সকালের চুল, চোখ, ঠোঁট, গায়ের জামা… 

একটা সময় সকাল বিরক্ত গলায় বলে উঠল, 

—‘এভাবে কী দেখছেন?’ 

—‘আপনাকে।’ 

—‘আমাকে অত দেখার কী আছে?’ 

—‘তা ছাড়া আর কী দেখব? এটা আমার বাসা এখানকার প্রতিটি জিনিস তো আমি রোজ দেখি। নতুন জিনিসের মধ্যে আপনিই আছেন। তাই আপনাকেই দেখছি।’ 

—‘এভাবে দেখতে হয় না।’ 

—‘কে বলেছে?’ 

—‘কে আবার? ভদ্রতা বলে একটা কথা আছে না?’ 

—‘অভদ্রতার কী দেখলেন? ও আচ্ছা একটু ভদ্রতা করি তাহলে আপনার সাথে, কী খাবেন? চা? কফি? বা অন্যকিছু? ডিনার করেছেন?’ 

সকাল মুখ নামিয়ে বলল, ‘না।’ 

—‘কেন? বাড়ির অতিথি না খেয়ে আছে এটা ভাবতেই তো খারাপ লাগছে। খাননি কেন?’ 

সকাল চোখ তুলে চাইলো আরশানের দিকে। কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, ‘আপনি খেয়েছেন?’ 

সকালের ওই চোখ চেয়ে চাওয়া, আর প্রশ্নের ধরন দেখেই বুঝতে পারলো আরশান সকাল কেন খায়নি। বোঝার পরে কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে রইল সে। 

কিছু জিনিস কত সহজেই না বোঝা যায়! মুখে বলতে হয় না, আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হয় না, কলম দিয়ে লিখেও দিতে হয় না। শুধু চোখ চেয়ে চাইলেই এক মন থেকে অন্য মনে কথাগুলো নিজ থেকে উড়ে উড়ে চলে যায়। 

আর সকাল যখন টের পেলো যে আরশান ব্যাপারখানা বুঝে গেছে সে তখন তড়িঘড়ি করে প্রসঙ্গ পাল্টানোর ছলে বলল, ‘আপনার বাসাটা ঘুরে দেখি। কটা ঘর এখানে?’ বলতে বলতে উঠে দাড়ালো সে। 

—‘তিনটে ঘর। দুটা বেডরুম, একটা ডাইনিং। আমি অবশ্য একটা ঘর তালা মেরে রেখেছি। প্রয়োজন হয় না বলে।’ বলল আরশান। 

সকাল পাশের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে উঁকি দিলো ভেতরে। আরশান ওর পেছন পেছন এসে ঘরের বাতি জ্বালালো। বাতি জ্বলতেই ঘরের দেয়াল গুলি যেন ঝলমল করে কথা বলে উঠল। সম্মুখের দেয়াল জুড়ে গভীর এক হলদে পাতার বন। বনের মাঝে একটি বাদামী চামড়ার লম্বা শিং ওয়ালা হরিণ ঘাড় উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মায়াবী চোখ মেলে। ডান দিকের দেয়ালে শাখা-প্রশাখা মেলে দাঁড়িয়ে আছে একটি চেস্ট নাট ট্রি। গাছের ডাল থেকে ঝুলছে একটি ঝুলন। সেই ঝুলনে কোনো মানুষ নেই আছে একটি কবুতর। রানির মতো বসে দোলনায় দোল খাচ্ছে ছাই রঙের পাখনাওয়ালা কবুতরটি। ছবির নিচে ইংরেজিতে লেখা, 

‘Painting from nature is not copying the object, it is realizing one’s sensations.’ তার উল্টো দিকের দেয়ালে নানা রঙের নকশা তোলা। মনে হচ্ছে ইচ্ছে মতো রঙধনুর সাতরঙ ঢালা হয়েছে। সব রং মিলে মিশে তৈরি হয়েছে একটি উঁচু মানের চিত্রকর্ম। চার নম্বর দেয়ালে ঘরের প্রবেশ দ্বারের পাশে পর পর লাগানো আছে তিনটি ছবি। প্রথম ছবিটি ভ্যান গগের আঁকা ‘স্টারি নাইট’, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ছবিটি সে চিনে নিতে পারলো না। 

ঘরের ভেতর একটা বিছানা আর পড়ার টেবিল ছাড়া কোনো আসবাব নেই। দেয়ালের চিত্রকর্মগুলো ঘরটায় একটা আলাদা সৌন্দর্য এনে দিয়েছে। সকাল মুগ্ধ হয়ে বলল, ‘এগুলো কে এঁকেছে?’ 

আরশান দরজার পাশের দেয়ালে টাঙ্গানো ছবিগুলোর দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ‘ভিনসেন্ট ভ্যানগগ, পাবলো পিকাসো, সাল্ভাদর ডালি।’ 

—‘ওয়াল পেইন্টিং গুলো? ওগুলো কার আঁকা?’ 

—‘আমার।’ আরশান বলল। 

—‘ওয়াও… আরশান আপনি একজন শিল্পী! সত্যিকারের শিল্পী!’ বলে সে হরেক রঙের ছোপওয়ালা দেয়ালটার সামনে এসে দাড়ায়, বলে, ‘এই ছবিটার কি কোনো বিশেষ অর্থ আছে?’ 

—‘যে যার ইচ্ছে মত অর্থ বের করে নিতে পারে।’ 

—‘আপনি এঁকেছেন কী ভেবে?’ 

—‘অজানাকে এঁকেছি। যা আমি জানি না, যা আমি দেখিনি কখনো, যা আমি ভাবিনি কখনো। এমন কি আমার নিজের মনের ভেতরের যে অংশটাকে আমি বুঝতে পারি না, ধরতে পারি না, সেই ধরা ছোঁয়ার বাইরের জগতটাকে এঁকেছি।’ 

—‘অজানাকে আঁকতে গেলেন কেন? জানা জিনিসের কি অভাব পড়েছে দুনিয়ায়?’ 

প্রশ্ন শুনে আরশান একটু দুর্বোধ্য হাসল, বিড়বিড় করে বলল, ‘The mind loves the unknown. It loves images whose meaning is unknown, since the meaning of the mind itself is unknown.’ 

—‘কী বলছেন এসব?’ 

—‘আচ্ছা! আপনি কী করতে ভালোবাসেন অবসরে?’ প্রসঙ্গ পাল্টালো আরশান। 

—‘অবসরে? কিছুই না! 

—‘কিছুই না?’ 

—‘নাহ, আমার আপনার মতো অত গুণ নেই। বেগুণ একটা আমি।’ 

আরশান ভারি অবাক হয়, বলে, ‘এটা কোনো কথা হলো? অবসরে সময় কাটে কী করে?’ 

—‘কেটে যায় কোনও এক ভাবে।’ 

—‘শুধু বসে থাকেন আর নিজে নিজে কথা বলেন তাই না?’ 

—‘ঠিক তাই। কী করে বুঝলেন? অবসরে আমি ভাবি, খুব ভাবি!’

—‘কী ভাবেন?’ 

—‘ভাবনাসমূহ।’ 

—‘ভাবনাসমূহ? অত কীসের ভাবনা আপনার? লেখক নাকি আপনি?’ 

—‘কী ভাবি জানেন? আমি ভাবি যে আমি এক অচিন দেশের রাজকন্যা। আমার আছে হাজার হাজার প্রজা, ভৃত্য আর দাসদাসী। তার মাঝে সবচাইতে নিকটতম এবং বিশ্বস্ত দাসী হলো বিন্দুবাসিনী। অবসরে আমি বিন্দুর সাথে কথা বলি।’ 

আরশান হেসে ফেললো, অবিশ্বাসের গলায় বলল, ‘বলছেন কী? এতো চরম পাগলামো!’ 

সকাল হাসতে লাগলো। হাসতে হাসতেই আচমকা থমকে গেলো সে। এই প্রথম …. জীবনে এই প্রথমবারের মতো কাউকে সে বিন্দুবাসিনীর কথা বলল। তার স্বপ্নের রাজ্যপটের কথা একমাত্র সে নিজে ছাড়া পৃথিবীর একটি কাক পক্ষীতেও জানতো না আজ পর্যন্ত। তানভীরকে বলতে গিয়েও খুলে বলতে পারেনি। কিছুটা বলার পর মনে হয়েছে চেপে যাওয়াই ভালো। এমন কি নাবিলাও জানে না। কিন্তু মাত্র একদিনের পরিচয়ে এই ছেলেটাকে কত সহজে মনের কথাগুলো অনর্গল বলে ফেললো! 

বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করে সেই ভয়টা ফেরত আসলো। এই মানুষটাকে তো সে এড়াতে চাইছিল। ভাগ্যের ফের। বারে বারে ভাগ্য তাকে এর সামনে এনে দাঁড় করাচ্ছে। 

হঠাৎ বিচলিত ভাবে বলে উঠল, ‘আমি যাই, আরশান। অনেক রাত হয়েছে।’ 

আরশান অবাক হলো। মেয়েটার সমস্যা কী? হঠাৎ অসময়ের ঝড়ের মতো আসে। অপেক্ষা করায়, ভাবায়, তারপর হঠাৎ আবার উধাও হয়ে যায়। 

— ‘কোথায় যাচ্ছেন? আবার কী হলো?’ 

সকাল জবাব না দিয়ে দৌড়ে গিয়ে লিভিং রুমের স্লাইডিং দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ল। বৃষ্টি তখনও পুরোপুরি থামেনি। ঝরছে টিপটিপ করে পাতলা সুতোর মতো। আরশানও বেরোলো সকালের পেছন পেছন। 

বাইরে উঠোনে এসে চিৎকার করে বলল, ‘এই যে শুনুন! কথা শেষ না করে হঠাৎ পালিয়ে যাচ্ছেন যে? আপনার মাথায় কি কোনও সমস্যা আছে? সকালে আসবেন বলে কথা দিয়ে আসলেন না। আপনি জানেন আপনার জন্য আমি আমার গার্লফ্রেন্ডকে ওর বাসা থেকে পিক করতে পারিনি। অফিসেও লেট খেয়েছি।’ 

সকাল অন্ধকারে টিপটিপ বৃষ্টি গায়ে মাখতে মাখতে ঘুরে দাড়ায়, চোখ নাচিয়ে বলে, ‘ও! গার্লফ্রেন্ডও আছে তাহলে?’ 

আরশান একটু অপ্রস্তুত হয়। গার্লফ্রেন্ড। হ্যাঁ এন্ড্রিয়ানা এক রকম গার্লফ্রেন্ডই তো ওর। ভালোবাসেনি কখনো, চুমুও খায়নি। তবুও গার্লফ্রেন্ড বলাই যায়। সে আলতোভাবে বলে, ‘থাকতেই পারে।’ 

‘হ্যাঁ, থাকাটাই স্বাভাবিক।’ সকালের কণ্ঠে একটু কেমন রাগ রাগ ভাব। আরশান উঠোনের ভেজা নরম মাটিতে পা ফেলে এগিয়ে আসল সকালের কাছে।তার পায়ে জুতো নেই। বের হবার সময় তাড়াহুড়োয় জুতো পায়ে দিতে ভুলে গেছে। কাছাকাছি এসে সে ঠেস মারা গলায় বলল, ‘এতো রেগে যাচ্ছেন যে? আপনার নেই নাকি?’ 

—‘কী?’ 

‘বয়ফ্রেন্ড কিংবা গার্লফ্রেন্ড। আমিতো জানি না আপনার ছেলে পছন্দ নাকি মেয়ে?’ 

সকাল সাপের মতো ফোঁস করে ফণা তুলে তাকায় আরশানের দিকে। 

—‘আপনি একটা অসভ্য।’ বলে সে আর দাড়ায় না। আরশানও নাছোড় বান্দা। চট করে সকালের হাত টেনে ধরে সে পেছন থেকে। এক ঝটকায় নিজের অনেকটা কাছে টেনে এনে বলে, ‘সমস্যা কী আপনার?’ 

সকাল লাফিয়ে ওঠা হৃৎপিণ্ডটা কোনও রকমে সামলে নিয়ে শ্বাসরুদ্ধ ভাবে বলল, ‘হাত ছাড়ুন!’ 

আরশান কাঠ কাঠ হাসে, ‘ছাড়লেই তো পালাবেন।’ 

সকাল অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। চাপা গলায় বলে, ‘পালাতেই তো চাইছি।’ 

ওর হাতের কব্জিতে পাঁচ আঙ্গুলের দাগ বসিয়ে দিতে দিতে একরোখা গলায় আরশান বলে ওঠে, 

—‘কেন? এতো কীসের ভয়?’ 

প্রশ্ন শুনে সকাল ঘাবড়ে গেল না, বরং চকিতে পরিপূর্ণ চোখ মেলে তাকালো সামনে দাড়ানো জেদি, বেপরোয়া যুবকটির দিকে। সে নিজেও জানতে চায়, বুঝতে চায়। তার সমস্ত চেতনাও একযোগে প্রশ্ন করে উঠল ভেতর থেকে, এতো কীসের ভয়? 

কিছুক্ষণ কেউ কোনও কথা বলল না। বৃষ্টিভেজা হিম বাতাস কোমল ভাবে আদর করে দিয়ে গেলো ওদের চুলে, মুখে, গলায়। কয়েক ফোটা বেহায়া বৃষ্টির জল এলোমেলো ভাবে শরীর দিলো ছুঁয়ে। ওরা বুঝল না কেন, কিন্তু ভালোলাগার একটা কাঁপন উঠল হাওয়ায় হাওয়ায়। 

একটা সময় আরশান চোখ সরিয়ে নিলো। ছেড়ে দিলো হাতের বাঁধন। সকালকে মুক্ত করে দিয়ে বলল, ‘যান, চলে যান। কিন্তু আর জ্বালাতে আসবেন না আমাকে। মনে থাকে যেন।’ 

সকাল হঠাৎ মুক্ত হয়ে তাল সামলাতে না পেরে পড়েই যাচ্ছিল। বহু কষ্টে সামলে নিলো নিজেকে। আর যখন সামলে নিয়ে মাটির ওপর শক্ত ভাবে দাড়ালো তখন দেখল আরশান হেঁটে হেঁটে চলে গেছে, অনেকটা দূর। 

নিজের ঘরে ফিরে এসে আরশান একটু চমকালো। ফাহাদ বসে আছে লিভিং রুমের সোফায়। আরশানকে দেখা মাত্র উদ্বেগ নিয়ে ইংরেজিতে বলে উঠল, ‘কোথায় গিয়েছিলে ভাই? দরজা খোলা ছিল। এসে দেখি বৃষ্টিতে তোমার মেঝের কার্পেট ভিজে গেছে।’ 

বাড়ির ছেলে-মেয়েরা নিজেদের মধ্যে সর্বদা ইংরেজিতেই কথা বলে। এমন কি টিলি আর ফাহাদ বাবা মায়ের সাথেও ইংরেজি ছাড়া কথা বলে না। আরশান ব্যতিক্রম সে বাবা আর মাদারের সাথে বাংলায় কথা বলতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। কিন্তু ভাই বোন দুটা বাংলার কিচ্ছু জানে না। অতএব ইংরেজি ছাড়া গতি নেই। 

— ‘এইত খুব একটা দূরে যাইনি। এখানেই ছিলাম।’ 

এরপর স্লাইডিং ডোরটা ভালো করে সময় নিয়ে বন্ধ করতে করতে বলল, ‘তোমার কী খবর? হঠাৎ এতো রাতে? 

—‘একটু কথা ছিল ভাই, রাতে ছাড়া তোমাকে তো আর পাওয়া যায় না। আজ আমার ঘুমও আসছিল না।তাই ভাবলাম এই সুযোগে তোমার সাথে কিছু জরুরি কথা সেরে ফেলি।’ 

আরশান বসল ছোট ভাইয়ের মুখোমুখি। বলল, ‘বলো কী বলবে? সব ঠিক আছে তো?’ 

ফাহাদ নড়েচড়ে বসে বলল, ‘মমের সাথে কথা হয়েছে। তোমার ওই জায়গার ব্যাপারে। আমি তাকে রাজি করিয়েছি। শ্যান্টেলির জায়গাটাতেই আপাতত ডে কেয়ার হবে। কিন্তু ভাই, তুমি তো মমকে চেন। তার ঝামেলাটা অন্য জায়গায়। সে জানতে চায় জঙ্গলের ভেতরের ওই প্লেসটায় তুমি আসলে কী করো। অত বড় একটা প্লট ইউজলেস ভাবে ফেলে রাখা ঠিক হচ্ছে না। এটাই উনার বক্তব্য।’ 

আরশান একটা হতাশ নিশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘দিস ইজ অল বুল শিট ইউ নো! ওটা এমন কোনও প্লেস না যেটা নিয়ে এতো ভাবতে হবে। এই নেইবার হুডে প্রতিটা বাড়ির পেছনে এরকম মাইলখানেক জংলা জায়গা পরিত্যক্তভাবে পড়ে আছে। কই সেগুলো নিয়ে তো কেউ মাথা ঘামাচ্ছে না? আমি জাস্ট ওখানটায় একান্তে কিছু টাইম স্পেন্ড করি। দ্যাটস ইট! মাদারের রিয়্যাকশন দেখে মনে হচ্ছে যেন ওখানে আমি কোনও গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েছি এবং সেই মহামূল্যবান গুপ্তধন থেকে তোমাদের বঞ্চিত করছি।’ 

আরশানের বলা শেষ কথাটা শুনে ফাহাদ হেসে ফেলল। সে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলল, ‘একটু ম্যানেজ করো না ব্রো! মামকে একদিন জায়গাটায় নিয়ে যাও। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখাও। একবার সব খোলামেলা ভাবে প্রকাশ করে ফেললেই দেখবে মাম এ ব্যাপারে আর কোনও ঝামেলা করছে না।’ 

আরশান চিবুকে হাতের তিন আঙ্গুল রেখে মেঝের দিকে তাকিয়ে ফাহাদের কথা শুনছিল মনোযোগের সাথে। তার চোখ দুটোতে হালকা দুশ্চিন্তার ছায়া। ফাহাদ তাকে চুপ করে থাকতে দেখে আবার বলল, ‘আমাকে কথা দাও ভাই, তুমি মামকে ম্যানেজ করবে। তুমি বোঝ না, বা বুঝতে চাও না যে মাম তোমাকে কতটা কেয়ার করে। সিরিয়াসলি! আমি একটা ফোটাও মিথ্যে বলছি না। তুমি তাঁর বড় ছেলে। তোমার জায়গাটা অন্যরকম।’ 

আরশান স্নিগ্ধ চোখে তাকায় ফাহাদের দিকে। সে জানে ফাহাদ মাত্ৰ যে কথাগুলো বলল তা সে নিজেও পুরোপুরি বিশ্বাস করে না, কিন্তু বিশ্বাস করতে চায়। বিশ্বাস করতে চায় বলেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথাগুলো প্রায়ই বলে। ভাইটার দিকে তাকিয়ে এক ধরনের মায়া হয় আরশানের। বুদ্ধি হবার পরেও অনেক দিন অবধি ফাহাদ জানতো না যে আরশান ওর মায়ের পেটের ভাই নয়। জানার পরে সত্যটা মেনে নিতে তার খুব কষ্ট হয়েছিল। 

আরশান একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘ঠিক আছে, তুমি যেহেতু বলছ, আই উইল ট্রাই টু ম্যানেজ হার সাম হাও।’ 

ফাহাদ হাসিমুখে উঠে দাড়ালো। বের হবার মুহূর্তে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলো, ‘আচ্ছা ভাই, ওই যে বাংলাদেশ থেকে একটা মেয়ে এসেছে না? ড্যাডের বন্ধুর মেয়ে। ওকে তোমার কেমন লাগে?’ 

এ ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হবার কোনো প্রস্তুতি ছিলো না আরশানের সে জানে তার ছোট ভাইয়ের ব্যক্তিগত জীবনে বেশ কিছু মেয়ের আনাগোনা আছে। কিন্তু কখনও কোনো মেয়েকে নিয়ে তাদের ভেতরে কথা হয়নি, আলাপ-আলোচনা হয়নি। একটু বিষম খেলো সে প্রশ্নটা শুনে। 

‘কেমন লাগবে আবার? নরমাল। নাথিং স্পেশাল। বাট একটু পাগল ছাগল আছে। সব মিলিয়ে খারাপ না। কেন জানতে চাইছ?’ 

—‘খারাপ না বলছ?’ 

—‘হ্যাঁ। তাই বলছি। কিন্তু কেন এই প্রশ্ন করলে?’ 

ফাহাদ আর কথা বাড়ায় না। লাজুক হেসে বলে, ‘অন্য একদিন বলবো।’ 

ফাহাদ চলে যাবার পর আরশান কিছুক্ষণ ঝিম ধরে বসে রইল। কাকে কার কী রকম লাগবে এই অনুভূতিগুলো আসলে আপেক্ষিক। জগতের প্রতিটি বস্তুরই খারাপ এবং ভালো দুটি দিক আছে। নির্ভর করে কার চোখ কী রকম ভাবে দেখতে চাইছে তার উপর। দেখার জিনিসগুলো একই থাকে, বদলে যায় শুধু মানুষের দৃষ্টিভঙ্গী। 

তার এই আটাশ বছরের জীবনে সে মেয়ে তো কম দেখল না। এদের অনেককেই চোখে ধরেছে। সুন্দর লেগেছে। তার ভেতরে একটা শিল্পীর মন আছে, সৌন্দর্যের দাম দিতে সে জানে। কিন্তু চোখে লাগা আর মনে লাগার মাঝে তফাৎ আছে। চোখে লাগাটা স্থায়ী হয় না কিন্তু মনে লাগাটা স্থায়ী হয়। মনে কিছু লেগে গেলে তা অনেকদিন পর্যন্ত ভালো লাগায় কিংবা ভাবায়। চোখ তো কত কী দেখে প্রতি নিয়ত! কিন্তু চোখ যা যা দেখে তার সব কি মনে ধরে? 

বাইরে তখন আবার ঝেঁপে বৃষ্টি নেমেছে। আজ আর জঙ্গলে যাওয়া হবে না। ফ্রিজ থেকে একটা আধ-খাওয়া হুইস্কির বোতল, আর আইস ভর্তি গ্লাস হাতে নিয়ে সে সোফায় এসে বসলো। উইকেন্ড ছাড়া সে ড্রিংক করে না। কিন্তু আজ কেন যেন ইচ্ছে হচ্ছে। ড্রিংক করলে তার দিন শুরু হয় বড় বেলা করে। অনিয়ম হয়। কাল অফিস যেতে কষ্ট হবে। 

.

সকাল ছুটে আসলো নিজের ঘরে। কাঠের সিঁড়ি মড়মড় করে আর্তনাদ করে উঠল ওর ছুটে চলার দাপটে। 

নিজের ঘরে এসে দরজা আটকে সে বিছানায় লুটিয়ে পড়ল। তার ভেতরে একই সাথে উথলে উঠছে রাগ, আতঙ্ক, শঙ্কা এবং ভালোলাগা। হাতের কব্জিতে এখনো সে মানুষটার স্পর্শ লেগে আছে। তার জীবনে এই প্রথম জানলো সে, যে কিছু কিছু ছোঁয়া এতো মারাত্মক হয়! 

ঘরে কোনো আলো নেই। বিদ্যুতের নীল বিভা চলকে চলকে এসে পড়ছে ঘরের ভেতর খানিক বাদে বাদে। মাতাল হাওয়ায় সয়লাব পুরো ঘর। 

বিন্দুবাসিনী তার পাশে এসে বসলো নিভৃতে। আজকে তার বিন্দুর চোখে চোখে চাইতেও লজ্জা করছে। কী ভীষণ ঘোর ঘন বিপদ ঘনিয়ে আসলো তার নিস্তরঙ্গ ঢেউহীন জীবনটাতে! 

—‘শেহজাদী! এতো ভয়ের কী আছে?’ 

—‘তুমি বুঝতে পারছো না বিন্দু?’ 

—‘আমি বুঝতে পারছি, কিন্তু আপনি তো এরই অপেক্ষায় ছিলেন তাই না? আপনি বলতেন আপনার নাকি কোনো দিন হবে না, আপনার ভেতরে ওসব নেই। কিন্তু দেখুন, হয়ে তো গেলো!’ 

—‘যা হয়েছে খারাপ হয়েছে বিন্দু। বিপদ হয়েছে। সর্বনাশ হয়েছে।’

—‘সর্বনাশের কিছু নেই। সব ঠিক আছে।’ 

—‘না তুমি বুঝতে পারছ না। এই সর্বনাশের হাত থেকে আমাকে রক্ষা পেতেই হবে। আমার বিয়ে হবে ফাহাদের সাথে। আমি ফাহাদকেই ভালোবাসবো। আর যদি তা না পারি তাহলে এই বাড়ির সাথে আমার কোনো সম্পর্ক থাকবে না। এতো বড় প্রতারণা আমি এই মানুষ গুলোর সাথে করতে পারবো না।’ 

এ কথার পর বিন্দু আর কিছু বলে না। চুপ করে বসে থাকে। রাত বাড়তে থাকে। আকাশ কাঁদতে থাকে অনবরত। এতো দুঃখও চেপে ছিল আকাশের বুকে! 

চোখে চুপি চুপি ঘুম নামবার আগে সকাল বিড় বিড় করে ধরা গলায় বলল, ‘এমনিতেও হবেনা বিন্দু! ওর গার্লফ্রেন্ড আছে। নিশ্চয়ই ওর গার্লফ্রেন্ড দেখতে অনেক সুন্দর। ওরই মতো। আমাকে ও কোনোদিন ভালোবাসবে না। আমি যে ওর যোগ্যই নই! 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *