৬৫
—‘ফাহাদ অমন করছে কেন? ওর কী হয়েছে?’ সকাল প্রশ্ন করলো ক্ষীণ গলায়। নাবিলা শুয়ে ছিল বিছানার ওপর। সকাল ওর মাথার কাছে বসে আস্তে আস্তে চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। বাতি নেভানো। সন্ধ্যার পর তাপমাত্রা অত্যধিক কমে যাওয়ায় ঘরের ভেতর হিটার চালাতে হচ্ছে। ভোঁতা একটা শব্দ করে ছোট চারকোণা বাক্সের মতো যন্ত্রটা ঘুরে ঘুরে উত্তাপ ছড়াচ্ছে চারপাশে।
নাবিলা একটু চাপা স্বরে বলল, ‘আর বলিস না, ড্রিংক করেছে অনেক। মাথা এইটি পার্সেন্ট আউট।’
—‘এতো ড্রিংক করতে দিলি কেন?’
—‘আমার কিছু করার ছিল না। ওর মায়ের কথা শুনে খুব রেগে গিয়েছিল। কষ্টও পেয়েছে অনেক বেচারা।’
—‘ওর মা করেছে কী আসলে? আমি তো কিছুই জানি না।’
—‘আমাকে ফোন করে বলেছে আমি যেন ফাহাদের সাথে না মিশি।’
সকাল অবাক গলায় বলল, ‘বলিস কী? এই মহিলাতো ডেঞ্জারাস!’
—‘খুবই ডেঞ্জারাস দোস্ত। আমার তো এখন খুব ভয় হচ্ছে।’
—‘শোন ভয়ের কিছু নেই। আরশান তো বলল ও ব্যাপারটা দেখছে আল্লাহ ভরসা।’
—‘নারে, আমার চিন্তা অন্য জায়গায়। ফাহাদ আমাকে বিয়ে করেই ছাড়বে যে কোনো উপায়ে এটা আমি শিওর। কিন্তু বিয়ের পর এই মহিলার সাথে এডজাস্ট করবো কী করে?’
মনে হলো সকাল নিজেও একটু চিন্তায় পড়ে গেলো কথাটা শুনে। ভারি গলায় বলল, ‘সেটা ঠিক। আমারও মাঝে মাঝে খুব দুশ্চিন্তা হয় জানিস? মনে হয় এই মহিলাটা আমার লাইফ হেল করে দিবে বিয়ের পর।
নাবিলা একটু হাসলো। আলতো গলায় বলল, ‘আমরা দুজন একসাথে থাকলে সে কোনো ঝামেলা করতে পারবে না। আমাদের দল ভারি। আমরা দুইজন আর সে তো একা।’
সকালও খিক খিক করে হেসে উঠল, ‘ঠিক বলেছিস। ইশ দোস্ত এই ব্যাপারটা ভাবলে আমার খুবই মজা লাগে জানিস?’
—‘কোন ব্যাপারটা?’
—‘এইযে আমরা দুজন একই বাড়ির বউ হতে যাচ্ছি। ক্যান ইউ ইমাজিন? সারাজীবন আমি তোকে আমার পাশে পাবো। এটা ভাবলে যে আমার কী আনন্দ হয়!
নাবিলা কিছু বলল না আর। মিট মিট করে হাসলো একটু। তার মাথার রগ নাচছে দপ দপ করে। দুশ্চিন্তায় জ্বলছে বুক। নিজের বাবা মায়ের সাথে এখনো ফাহাদের ব্যাপারে একটা কথাও বলেনি সে। খুব শীঘ্রই বলবে। বাবা মায়ের আপত্তি করার সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ। তবুও একটা ফয়সালা হওয়ার আগ পর্যন্ত সে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারছে না। তার ওপর সামনের মাসে তার ফাইনাল সেমিস্টারের পরীক্ষা। পরীক্ষা হয়ে গেলে এ দেশে আর একটা বাড়তি দিনও থাকা যাবে না বলে নির্দেশ দিয়েছেন বাবা। পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়াতে ব্যাঘাত তৈরি হয়েছে। কদিন হলো পড়ালেখায় মন বসছে না একেবারেই। সবকিছু মিলিয়ে একটা ভীষণ বাজে অবস্থা। ভাবতে ভাবতে নাবিলার চোখে ঘুম নেমে এসেছিল। তার শরীর ভারি ক্লান্ত। ক্লান্তি শেষমেশ সকল দুশ্চিন্তা কেড়ে নিলো। বিনিময়ে দিলো শান্ত একটি নিবিড় ঘুম।
নাবিলা ঘুমিয়ে পড়লে সকাল দেখলো বিছানার কোণায় বিন্দুবাসিনী দাঁড়িয়ে আছে। বিন্দুর হাতে বেলিফুলের মালা। সকাল ফুলের খুশবু পাচ্ছে। সেই খুশবু তার মনের মেঘ কাটিয়ে দিচ্ছে একটু একটু করে।
বিন্দু বলল, ‘শেহজাদী! আপনি তো রাজকুমারকে পেয়ে আমার কথা ভুলেই গেছেন।’
সকাল চমকে উঠল কথাটা শুনে, ‘যা! তোমাকে আবার ভোলা যায় নাকি?’
বলল ঠিকই কিন্তু তার মনের মধ্যে একটি অদ্ভুত ভাবনার উদয় হলো। এ কথা তো সত্য যে আরশানের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ার পর বিন্দুর কথা তার খুব একটা মনে থাকছে না! বিন্দু ছিল তার একাকিত্বের সঙ্গী। যখন কেউ ছিল না। তখন বিন্দু ছিল।কিন্তু আরশান যখন আসলো তখন সকালের সমস্তটা কেমন এক নিমেষে দখল করে নিলো। বিন্দু কেন তার নিজের জন্যেও একরত্তি জায়গা থাকলো না আর।
সে জানে দিনে দিনে এই দখল আরো বেশি গভীর হবে, বিস্তৃত হবে। ডাল-পালা মেলবে। সে ক্রমশ নিজেকে হারিয়ে ফেলবে ওই মানুষটার মধ্যে, দাম্পত্য জীবনের মধ্যে, সংসারের মধ্যে। বিন্দুবাসিনী হারিয়ে যাবে। হারিয়ে যাবে তার ফেলে আসা দিনগুলো। শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য …হারিয়ে যাবে হরিণডাঙ্গা!
মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় কঠিন সত্য হলো সময় তার কাছ থেকে মূল্যবান কিছু বস্তু বিনা অনুমতিতেই ছিনিয়ে নেয়। ছিনিয়ে নিতে নিতে এক সময় গোটা মনটাকেই পরিবর্তন করে দেয়। মানুষ ভুলে যায় অনেক দিন আগে তার একদম অন্যরকম আরেকটা মন ছিল।
সকালের বুকটা কেমন মোচড় দিয়ে ওঠে।
বিন্দু বলে, ‘আপনার শাহজাদা কেমন আছেন?’ সকাল হাসে, ‘ভালো।’
—‘আপনাকে খুব ভালোবাসে বুঝি?
—‘ভালো আর বসলো কই? বলেইতো দিল পরিষ্কারভাবে ভালোবাসে না।’
শুনে বিন্দু খুব হাসলো, বলল, ‘উনি একটু পাগল আছেন।’
—‘তা আছে। তবে একটা জিনিস আমার খুব খারাপ লেগেছে কি জানো? সে বলেছে সে আমাকে ছাড়া বেঁচে থাকতে পারবে। কী করে পারবে বিন্দু? আমি তো ওকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না।’
বিন্দুবাসিনী একটু গম্ভীর গলায় বলল, ‘কথাটা তিনি একেবারে ভুল বলেননি শেহজাদী। পৃথিবীতে কারো জন্য কিছু থেমে থাকে না। শুনতে খারাপ লাগলেও একথা সত্য যে সময় কারো জন্য বসে থাকে না। আপনার মনে হচ্ছে এখন আপনি উনাকে ছাড়া বাঁচতে পারবেন না। কিন্তু আদতে পারবেন।’
—‘আমি পারবো না।’
—‘পারবেন।’
—‘শুধু নিশ্বাস নেয়াকে কি বেঁচে থাকা বলে? ও আমার জীবনে না থাকলে আমার হৃৎপিণ্ডটা কেবল নিশ্বাসই নেবে। বেঁচে থাকতে ভুলে যাবে।’
—‘তিনি হয়তো শুধু নিশ্বাস নেয়াকেই বেঁচে থাকা বুঝিয়েছেন।’
—‘মানুষটাকে আমি বুঝি না বিন্দু! ভারি দুর্বোধ্য!”
—‘বুঝে যাবেন। আরেকটু সময় দিন।’
৬৬
আরশান ডেকের ওপর বসে ছিল চেয়ার পেতে। তার গায়ে মোটা লেদারের জ্যাকেট। কোলে রাখা ভায়োলিন। বাইরে ঝুপসি অন্ধকার। আকাশ ভর্তি নীল নীল নক্ষত্রর সাথে একটা দুর্বল চাঁদ জেগে আছে। চাঁদের আলোটা বড় ম্লান। জোছনা নেই।
কয়েকটা তক্ষক ডাকছে সুতীব্র ভাবে। দূরে একটা শেয়াল ডেকে উঠল আচমকা। হাওয়ায় শন শন শব্দ তুলে শুকনো পাতা সরে গেলো এদিক থেকে সেদিক।
রাত বাড়ছে। শীত বাড়ছে।
আজকে ভায়োলিন বাজাতে ইচ্ছে হচ্ছে না। মনটাকে আঁকড়ে ধরে আছে এক অদ্ভুত বিষণ্নতা। হাজার রকম চিন্তা মাথায় ঘুরছে।
ফাহাদ জন্মাবার দিন দিদা বাংলাদেশ থেকে ফোন করে বলেছিল, ‘দাদুভাই দোয়া করো যেন তোমার একটা বোন হয়। কারণ, ভাই হলে কিন্তু তোমার আদর একদম কমে যাবে। তোমাকে আর কেউ আদর করবে না। সব্বাই শুধু নতুন ভাইটাকে আদর করবে।’
এখনো স্পষ্ট মনে আছে তার দিদার বলা কথাগুলো। সেই কথাগুলো তার শিশু মনে প্রভাব ফেলেছিল। সে মনে প্রাণে আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিল তার যেন ভাই না হয়ে বোন হয়। কিন্তু আল্লাহ তাঁর দোয়া কবুল করলেন না। সেদিন সন্ধ্যা বেলায় তার একটা ফুটফুটে ভাইয়ের জন্ম হলো। ভাইয়ের জন্মের সংবাদ পেয়ে সে একদম মর্মাহত হয়ে পড়েছিল। বুকটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছিল। কাঁদতে কাঁদতে সে বাবাকে বলেছিল, ‘বাবা এখন তো আপনি আর আমাকে আদর করবেন না। আর ভালোবাসবেন না।’
বাবা তাকে বুকে টেনে নিয়ে বলেছিলেন, ‘কে বলেছে এসব আজেবাজে কথা তোমাকে? শুধু মাত্র তোমাকে ভালোবাসার জন্যই পৃথিবীতে আরো একজন মানুষ জন্ম নিলো। তোমার ভাই তোমাকে খুব ভালোবাসবে। আর তুমি তোমার ভাইকে। কেমন?’
আরশান সেদিন কথাগুলো শুধু শুনেছিল। মন দিয়ে অনুধাবন করেনি। কিন্তু কিছুদিন পর পুতুল পুতুল ফাহাদটা যখন ওর একদম ন্যাওটা হয়ে উঠল তখন বুঝতে বাকি রইল না সত্যিই শুধুমাত্র তাকে সঙ্গ দেবার জন্যেই পৃথিবীতে ওই পুতুলটার জন্ম হয়েছিল। দেশ থেকে আমেরিকায় ফেরত আসার পর ফাহাদের সাথে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হয়ে গেলো। ফাহাদ খুব ভক্ত ছিল তার। একটু বড় হবার পর সমস্তটা দিয়ে সে তার বড় ভাইকে শ্রদ্ধা করতে শিখলো, ভালোবাসতে শিখলো। অন্ধ ভাবে অনুসরণ এবং অনুকরণ করতে লাগল। আরশানের বুকের ভেতর ফাহাদের জন্য স্নেহের এক অগাধ সমুদ্র আছে। সত্যি বলতে অতটা টিলির জন্যেও নেই। কিন্তু সময় গড়ানোর সাথে সাথে কেন কে জানে একটু একটু করে দূরে ছিটকে পড়ল ফাহাদ। নিজের একটা আলাদা জগত তৈরি করে নিলো। একটা অদৃশ্য দেয়াল গড়ে উঠল দুই ভাইয়ের মাঝে। এই অদৃশ্য দেয়াল গড়ে ওঠার পেছনে ফাহাদের মায়ের ভূমিকা যে নিছক কম নয় এটা আরশান জানে।
আজকে ফাহাদ বলল, আরশানের কোনো মা নেই। তাই মাতা-পুত্রের ভেতরকার আবেগ অনুভূতি এবং সর্বোপরি সম্পর্কের গভীরতা আরশান কখনওই অনুধাবন করতে পারবে না। ফাহাদ কিন্তু জানে না, যে ফাহাদ এ পৃথিবীতে আসার আগে আরশানেরও একজন মা ছিল। সেই মা তাকে পেটে ধরেনি, কিন্তু বুকে ধরেছিল। তার নিজের গর্ভধারিণীকে সে কোনোদিন এক মুহূর্তের জন্যেও ভালোবাসেনি। বাসতে পারেনি। কিন্তু এই মা’কে সে ভালোবেসেছিল খুব ছোট বেলায়। ফাহাদ আসলো, এবং আরশানের কাছ থেকে সেই মা’কে ছিনিয়ে নিয়ে গেলো। সময় গড়ানোর সাথে সাথে সে খুব ভালো মতোই বুঝতে পারল যে মাদার শুধুমাত্র ফাহাদ আর টিলির মা। তার মা নয়।
আচ্ছা,কারও মা না থাকাটা কি দোষের কিছু? না তা নয়। যে মা নিজের শিশু সন্তানকে ফেলে রেখে পালিয়ে যায় সেই মায়ের সন্তান হওয়াটা দোষের।
দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ হচ্ছে। চিন্তায় ছেদ পড়ল আরশানের। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো কাচের দরজার ওপাশে একটি নারীমূর্তি দঁড়িয়ে আছে। আরশান উঠে দাঁড়িয়ে হাত থেকে ভায়োলিনটা চেয়ারের ওপর নামিয়ে রাখল। এগিয়ে এসে স্লাইডিং ডোর খুলে ঢুকল ঘরের ভেতর।
অন্ধকারে মাদার দাঁড়িয়ে আছেন।
—‘কিছু বলবেন?’ দরজা টেনে বন্ধ করতে করতে আরশান প্রশ্ন করলো। ঘরের বাতি জ্বালালো। তাকালো মাদারের দিকে। তার চোখ অসম্ভব রকমের ফোলা। নাক লাল।
—‘বসুন। দাঁড়িয়ে কেন?’ আরশান বলল।
মাদার বসলো। তার পরনের শাড়ি এলোমেলো। চুল আলুথালু। তাকে দেখাচ্ছে বিধ্বস্ত। তিনি সোফার উপর বসলেন। আরশানের চোখে চেয়ে বললেন, ‘তুমি বসো আমার পাশে। কয়টা কথা বলি।’
আরশান বিস্মিত ভাবটা লুকোতে পারলো না। মাদারের পাশে এসে বসে অবাক গলায় বলল, ‘হঠাৎ কী হলো? ফাহাদ আবার কিছু বলেছে?’
মাদার এ প্রশ্নের উত্তরে কিছু বলল না। হঠাৎ শাড়ির আঁচল মুখে চাপা দিয়ে তিনি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। আরশান অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। দিশাহারা হয়ে বলল, ‘সেকি, কাঁদছেন কেন? সমস্যাটা কী আমাকে বলবেন তো।’
মাদার আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছলেন, ধরা গলায় বললেন, ‘তুমি কি কখনও আমাকে ক্ষমা করতে পারবে?’
প্রশ্নটা এত বেশি অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল যে আরশানের প্রাথমিকভাবে মনে হলো সে ভুল শুনছে। তার দু চোখে খেলে গেলো প্রবল বিস্ময়। কপালে পড়ল অনভিপ্রেত ভাঁজ। সে অনেক কষ্টে ঠোঁট দুটো নেড়ে বলল, ‘কী বললেন?’
মাদার মুখের ওপর থেকে শাড়ির আঁচল সরালেন। ভেজা চোখদুটো আলতোভাবে মেলে ধরলেন আরশানের চোখের ওপর, বললেন, ‘ক্ষমা চাই তোমার কাছে। ক্ষমা করতে পারবে?’
বিস্ময়ের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে আরশানের মিনিট দুয়েক সময় লেগে গেল। সে খুব ভালো মতোই জানে যে সামনে বসা পঞ্চাশোর্ধ প্রৌঢ়া রমণীটির জীবনে সে এক আশশ্যাওড়া বৈ অন্য কিছুই না। এ কথা সত্য এ মানুষটা যদি তাকে অবহেলা না করতো তাহলে হয়তো আরশান আজ একটু অন্যরকম হলেও হতে পারতো। আরশান জানে, টের পায় একটা সময় তার সত্যিই একজন মায়ের বড় প্রয়োজন ছিল। স্কুল থেকে ফেরার পর মন চাইতো কেউ একজন খাবার নিয়ে অপেক্ষা করে থাকুক তার জন্য। পরীক্ষার আগের রাতগুলোতে মাদার যখন ফাহাদের জন্য দুধের গ্লাস হাতে নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতেন ওর পড়ার টেবিলের পাশে, আরশানের তখন একটা অনিচ্ছাকৃত দীর্ঘশ্বাস আপনাআপনি বেরিয়ে পড়তো বুক চিরে। দিদার মৃত্যু হয়েছে প্রায় সতেরো বছর আগে। এর পর থেকে তার জীবনে আর কোনো নারীর ভালোবাসা নেই।
আচ্ছা, সকাল কি তাকে ভালোবাসে?
আরশান অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল। কেন এসব কথা আসছে এতকাল পরে? যে সময় আরশানের একজন মায়ের দরকার ছিল, সে সময় তো কেউ তার দিকে ফিরেও তাকায়নি। বাবাই বা কতটা বুঝতে পেরেছিলেন তাকে? আরশান সেইসব পুরনো হিসেব নিকেশ ভুলে যেতে চায়। নতুন করে বাঁচতে চায়। এখন তার জীবনে সকাল আছে। তার আর কোনো অভাব নেই। যে সময় চলে গেছে সেই বিগত সময়কে তো আর কোনোভাবেই ফেরানো যাবে না।
আরশান একটু অস্থিরভাবে ভাবে বলল, ‘কেন বলছেন এসব কথা?’
—‘কেন বলছি জানি না। শুধু মনে হচ্ছে আমি কিছু ভুল করে ফেলেছি।’
—‘কী ভুল?’
—‘সবটা তোমাকে বলা যাবে না বাবা।’
—‘ক্ষমা চাইছেন কেন? কী দোষ করেছেন আপনি?
মাদার প্রশ্নটা শুনে কিছুক্ষণ থম ধরে বসে রইলেন। তার চোখ থেকে টপ টপ করে গড়িয়ে পড়ল কয়েক ফোঁটা জল। তারপর হঠাৎ বললেন,
—‘তোমাকে কখনো আমি ঘেন্না করিনি। এ কথা তুমি বিশ্বাস করো?’
আরশান থমকে গেল। তার বুকের ভেতর পায়ে পায়ে ফিরে আসছিল ছেলেবেলার বোকা অভিমান। আসলে মানুষের শৈশবের মনটা কোথাও হারায় না কখনো। ঘুমিয়ে থাকে বুকের ভেতর। হঠাৎ হঠাৎ জেগে ওঠে। জেগে ওঠার পর টের পাওয়া যায় যে, বয়স জিনিসটা নিছক সংখ্যা মাত্ৰ। মানুষের মনের কোনো বয়স নেই। মন চির নবীন এবং চির বৈচিত্র্যময়।
বেশিরভাগ মানুষের শৈশব স্মৃতি হয় মধুর। দাদুবাড়িতে কাটানো দিন গুলো বাদে তার বাকি শৈশবটা মধুর নয়। এমনকি দাদুর বাড়ি থাকার সময়ও সে পরিপূর্ণ ভাবে সুখী ছিল না। সে সময় বাবাকে মিস করতো ভীষণ ভাবে। আর মাদার যে তাকে আর আগের মতো চায় না সেই বাস্তব সত্যটিও তার ওই ছোট্ট, অপরিণত মস্তিষ্ক ঠিক ঠিক বুঝে গিয়েছিল।
আরশান খুব নিস্তেজ গলায় বলল, ‘বিশ্বাস করি না।’
মাদার আকুল হয়ে বললেন, বিশ্বাস করো প্লিজ। আমি কোনোদিন তোমাকে ঘেন্না করিনি। আমার শাশুড়ি চাইতেন না যে তোমার দায়িত্ব আমি নেই। উনি আমাকে অনেক অপমান করেছেন। আমার কোল থেকে তোমাকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছেন বাড়ি ভর্তি লোকের সামনে। বলেছে সৎ মায়ের হাতে তিনি তার নাতিকে তুলে দেবেন না। তোমার চার বছরের জন্মদিন গ্রামের বাড়িতে হলো। আমি পায়েশ রান্না করলাম শখ করে। আমার শাশুড়ি সেই পায়েশ তোমার মুখে তুলতে দিলেন না। বললেন সেই পায়েশ খেলে নাকি তোমার অমঙ্গল হবে। আর তোমার বাবা আজীবনই একরকম মেনিমুখো মানুষ। সে কোনোদিন তার বাবা মায়ের মুখের ওপর কিছু বলতে পারেনি।’
—‘কেন বলছেন এসব কথা? এতকাল পরে?’
—‘কেন বলছি জানি না। মনে হচ্ছিল কথাগুলো বলা দরকার। তাই বললাম।’
আরশান মাদারের দিকে চাইলো, ধীরে ধীরে বলল, ‘একটা সময় আপনাকে আমার প্রয়োজন ছিল। আমার তো মা ছিল না কখনও। তাই আপনি চাইলেই আমার সেই খালি জায়গাটা পূরণ করতে পারতেন। কিন্তু করেননি আপনার ইচ্ছে শক্তি ততটা প্রবল ছিল না বলেই। আমার সেই সমস্ত দিনগুলো তো আপনি এখন আর চাইলেই ফিরিয়ে দিতে পারবেন না তাই না?’
মাদার চুপ করে থাকেন। তার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকে কান্নার ধারা। মানুষটাকে এমন ভাবে ভেঙে পড়তে আরশান এর আগে কখনো দেখেনি। সে বুঝতে পারে, ফাহাদের কাছ থেকে পাওয়া চোটটা তিনি সামলে উঠতে পারছেন না।
সে উঠে দাঁড়িয়ে মাদারের পাশে এসে দাড়ালো। তাঁর মাথায় হাত রেখে শান্ত ভাবে বলল, ‘এভাবে ভেঙে পড়বেন না। আমি ফাহাদকে বুঝিয়ে বলব। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। আর নাবিলা মেয়েটা ভালো। আপনি আর কথা না বাড়িয়ে ওদের সম্পর্কটা মেনে নিন
মাদার ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ আরশানের দিকে। ফাহাদকে তিনি যত আদর, ভালোবাসা, যত্ন দিয়েই বড় করুক না কেন, তিনি খুব ভালোমতোই জানেন যে আরশানের মতো স্বচ্ছ বুদ্ধি, এবং প্রাঞ্জল মন ফাহাদের কোনো কালেই ছিল না, এখনো নেই। তিনি নিজের মাথায় রাখা আরশানের হাতটি ধরে আকুল গলায় বললেন, ‘এ মুহূর্তে আমি ফাহাদকে নিয়ে ভাবছি না। ভাবছি তোমাকে নিয়ে!’
৬৭
ফাহাদ উপুড় হয়ে শুয়ে ছিল বিছানায়। তার মাথার ভেতরটা কেমন বোধ শূন্য হয়ে আছে। মস্তিষ্ক অবশ। ঘুম ছাড়া এখন আর কোনো গতি নেই। একটা নিপাট পরিচ্ছন্ন ঘুমই এখন তাকে এই নরক থেকে উদ্ধার করতে পারবে।
দরজায় টোকা পড়তেই সে কর্কশ গলায় চেঁচিয়ে উঠে বলল, ‘কে?’
আরশান ভেজানো দরজাটা খুললো। এ দেশে বেডরুমগুলোর দরজায় লক থাকে না। কেউ আলাদা ভাবে চাইলে লাগিয়ে নিতে পারে। কিন্তু বেশিরভাগ বাড়িতেই সেই বাড়তি কাজটা কেউ করে না।
ঘরের ভেতর একটা টিমটিমে হলদে আলোর ল্যাম্পশেড জ্বলছিল। ফাহাদ ফিকে আলোটায় ঘোলা চোখ মেলে দেখলো আরশানকে। আরশান সচরারচর তার ঘরে আসে না। শেষবার কবে এসেছিল মনে পড়ে না ফাহাদের। আজকে তার আসার পেছনের উদ্দেশ্যটা কী ফাহাদ তা জানে। আর জানে বলেই সে অবাক হলো না। উঠে বসতে বসতে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘কী খবর?’
আরশান চেয়ার টেনে নিয়ে বসলো বিছানার পাশে। ফাহাদকে আপাদমস্তক একবার দেখে নিয়ে বলল, ‘তুমি কি আজকাল বেশি ড্রিংক করছ?’
ফাহাদ মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বলল, ‘আরে না। তুমি বল কী বলতে এসেছ? মম ড্যাডের সাথে কথা হয়েছে? কী বলল ওরা?’
—‘কথা হয়েছে। তোমার চিন্তার কিছু নেই। তোমার বিয়ে নাবিলার সাথেই হবে।
‘আর ইউ শিওর? মম আবার কোনো ঝামেলা করবে না তো?’
—‘করার কথা না।’
ফাহাদ একটা কৃতজ্ঞতার হাসি হাসল, ‘থ্যাংক ইউ।’
আরশান একটু সময় চুপ করে থাকলো। চোখ বুলালো চারপাশে। ঘরটা খুবই অগোছালো হয়ে আছে। দেয়ালে টাঙানো তিনটি পারিবারিক ছবির একটিতে আরশান আছে। বছর সাতেক আগের তোলা ছবি। দুই ভাই একত্রে স্বচ্ছ সাদা বরফের ওপর স্কি পোল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের গায়ে মোটা জ্যাকেট, হাতে গ্লভস, মুখ ঢাকা স্কি মাস্কে। আরশান একটু অবাক গলায় বলল, ‘এই ছবিটা বড় করলে কখন?’
—‘অনেক দিন হলো।’
—‘তোমার মনে আছে? সেদিন তোমার একটা ছোটখাটো ইনজুরি হয়ে গিয়েছিল।’
—‘মনে আছে। ওটা ছিল তোমার সাথে আমার লাস্ট আউটিং। এরপর তোমার সাথে আর কোনো এডভেঞ্চারে যাওয়া হয়নি।’
—‘কেন যাওয়া হয়নি বলোতো? হঠাৎ করে দূরে সরে গেলে কেন?’ ফাহাদ অকপটে বলল, ‘মম বারণ করেছিল। তার ধারণা হয়েছিল সেদিন তোমার কারণে আমি ইনজ্যুরড হয়েছিলাম।’
আরশান চমকালো না কথাটা শুনে। ব্যাপারটা সে আগে থেকেই কিছুটা ধারণা করতে পেরেছিল। আজকে পুরোপুরি ভাবে নিশ্চিত হলো।
ফাহাদ বলল, ‘ওসব বাদ দাও। তোমার খবর বল। তোমাদের বিয়েটা কবে হচ্ছে?’
আরশান অপ্রস্তুত হলো কথাটা শুনে।
—‘এখনো জানি না।’
—‘জানো না? সেকি? তাড়াতাড়ি জেনে নাও ভাই। তোমার বিয়েটা হয়ে গেলে আমার রাস্তা ক্লিয়ার হয়ে যাবে।’
আরশান হাসলো, ‘তোমার রাস্তা এখনো ক্লিয়ার। তুমি চাইলে কালকেই বিয়ে করতে পারো।’
—‘বড় ভাইয়ের আগে ছোট ভাই বিয়ে করবে?’
—‘কেন নয়? বড় ভাইকে আগে বিয়ে করতে হবে এটা কোন আইনে লেখা আছে?’
—‘যাই হোক। আমি সত্যি অনেক খুশি ভাই, যে ফাইনালি তুমি কোনও রিলেশন শীপে যেতে পেরেছ।’
আরশান কী বলবে খুঁজে পায় না। ফাহাদের সাথে ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আলাপ হচ্ছে অনেক দিন পর। একটু কেমন অস্বস্তি লাগছে তার। সে ছোট করে বলল, ‘হুম।’
—‘আর কিছু বলার ছিল তোমার?’
আরশান ফাহাদের দিকে সরাসরি তাকালো, বলল, ‘আজকে এমন করলে কেন?’
—‘কী করেছি?’
—‘মাদারকে এভাবে অপমান না করলেও পারতে, সবার সামনে।’
ফাহাদ একটা হতাশ নিশ্বাস ফেললো, ‘মম দিন দিন যাচ্ছেতাই হয়ে যাচ্ছে তুমি জানো? সবটা আমি তোমাকে বলতে পারবো না। আজকের ব্যাপারটাই চিন্তা করে দেখো। কী করে সম্ভব এটা? যে মেয়েটাকে আমি পছন্দ করি সেই মেয়েটাকে সরাসরি ফোন করে যা তা কথা বলে দিল। আমার যে কী কষ্ট লেগেছে তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। মমের জন্য নাবিলা আমার সাথে ব্রেক আপ করেছিল। কী পরিমাণ মেন্টাল ট্রমার ভেতর দিয়ে আমাকে সারাটা দিন পার করতে হয়েছে সেটা তোমরা ধারণাও করতে পারবে না।’
—‘ফাহাদ, কাজটা অন্যভাবেও করা যেত। তুমি তাঁর সাথে ঠান্ডা মাথায় কথা বলে দেখতে পারতে, অনুরোধ করতে পারতে। তা না করে একদম সরাসরি কথা শোনানোটা ঠিক হয়নি। হাজার হোক গুরুজন। তিনি কষ্ট পেয়েছেন।’
ফাহাদ একথা শুনে একটু দমে যাওয়া গলায় বলল, ‘আমি জানি মম কষ্ট পেয়েছে। আমি নিজেও শান্তি পাচ্ছি না।’
—‘তোমার উচিত তাঁর কাছে ক্ষমা চাওয়া।’
—‘ক্ষমা চাইবো? আমি? দোষ করেছে মম। সে নাবিলাকে ফোন করে আজেবাজে কথা বলেছে। আমার ফিলিংসকে হার্ট করেছে। আর এখন ক্ষমা চাইব আমি?’
—‘হ্যাঁ চাইবে। কারণ, তিনি তোমার মা। দিদা সব সময় কী বলতেন জানো?’
—‘গ্র্যান্ডমা?’
—‘হ্যাঁ গ্র্যান্ডমা।’
—‘কী বলতেন?’
—‘বলতেন বাবা মায়ের চোখের জলের কারণ হয়ে দাড়ায় যে সন্তান, সেই সন্তানের অবনতি অনিবার্য। দিদা শিখিয়েছিলেন আমাকে। কখনো বাবা মায়ের মনে কষ্ট দিয়ে কথা বলতে নেই।’
ফাহাদ হতাশ গলায় বলল,’আর বাবা মা যদি সন্তানের মনে কষ্ট দেয়? তখন কী হবে? এইসব একতরফা নিয়ম কানুন কারা বানায়?’
—‘ফাহাদ, “আমি সত্যিই চাই তুমি মাদারকে সরি বল। প্লিজ আমার কথাটা শোনো। খুব বেশি দেরি করো না।’
ফোনটা আসলো সেই সময়। আরশান রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে নারী কণ্ঠটি বলে উঠল, ‘আরশান, আমি ভার্জিনিয়া এসে গেছি। একটু আগেই আসলাম। তুমি কাল দেখা করতে পারবে?’
হতচকিত ভাবে একটুক্ষণ চুপ করে থাকল আরশান, তারপর বলল, ‘জি পারবো অফিসের পরে। সন্ধ্যে হবে।’
৬৮
ফাহাদের ঘর থেকে বেরোনো মাত্র লম্বা করিডোরের একদম শেষ মাথার দরজাটা খুলে গেলো। করিডোরের বাতি নেভানো। খোলা দরজা দিয়ে ঘরের ভেতর জ্বলতে থাকা হলদে আলোর কিছুটা এসে পড়ল বাইরে। সেই আলোতে আরশান আবিষ্কার করলো সকালকে। সকাল চাপা গলায় বলে উঠল, ‘আপনি? এখানে কী করছেন?
কথাটা বলে সকাল ঘরের দরজা টেনে দিল। ভেতরে নাবিলা ঘুমোচ্ছে। ওদের কথা বলার শব্দে বেচারির ঘুম ভেঙে যেতে পারে।
আরশান করিডোরের আলো জ্বালালো। সকাল একটা হালকা গোলাপি রঙের নাইটি পরেছে। চুলগুলো ছড়ানো পিঠের ওপর। চোখ মুখে কোনো প্রসাধন নেই। তবুও কী সুন্দর দেখাচ্ছে! তার গায়ের সাথে সিল্কের নরম কাপড়টা আষ্টেপৃষ্ঠে লেগে আছে। স্পষ্ট হয়ে ভেসে আছে শরীরের প্রতিটি ঢেউ।
সেই মুহূর্তে ওর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থেকে আরশানের জীবনে প্রথমবারের মতো মনে হল যে সত্যিই বুঝি নারী দেহের মতো যত্ন করে বিধাতা এ বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের অন্য কোনো সৃষ্টিকেই গড়েননি। নারী তাঁর এক আশ্চর্য সুন্দর অপার মোহনীয় সৃষ্টি!
বুকের তারে একটা কম্পন সৃষ্টি হলো।
সকাল অপ্রস্তুত হয়ে বলল, ‘কী হয়েছে?’
আরশান কিছু বলল না। চেয়েই থাকলো।
সকাল চট করে ঢুকে গেলো ঘরের ভেতর। আরশানকে কিছু না বলেই। মিনিট দুয়েকের মধ্যে আবার বেরিয়ে আসলো। এখন তার গায়ে একটি লাল চাদর জড়ানো।
আরশান চোখ কপালে তুলে বলল, ‘সিরিয়াসলি? আপনি চাদর আনার জন্য ভেতরে গিয়েছিলেন?
সকাল আস্তে করে বলল, ‘হ্যাঁ।’
—‘কেন?’
সকাল খানিকটা বিপন্ন বোধ করল, ‘এমনি।’
—‘এমনি মানে? হঠাৎ চাদর কেন দরকার হলো আপনার?’
সকাল পড়ল ভারি বিপাকে। কী করবে সে এই একরোখা জেদী ছেলেটাকে নিয়ে? কী উত্তর দিবে ভেবে পেলো না। ব্যাক্কলের মতো দাঁড়িয়ে থাকলো জায়গাটায়।
—‘আপনি আমাকে ইনসাল্ট করলেন।’
—‘আজব, এখানে ইনসাল্টের কী আছে আরশান?’
আরশান কোনও কথা না বলে লম্বা পা বাড়িয়ে সিঁড়ির কাছাকাছি পৌঁছে গেলো কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে। সকাল ওর পেছন পেছন এগিয়ে এসে বলল, ‘আমি আপনাকে কিচ্ছু বুঝি না। আমার গায়ে চাদর জড়ানোর সাথে আপনাকে ইনসাল্ট করার কী সম্পর্ক?’
আরশান থমথমে গলায় বলল, ‘খুব ভালো মতোই বুঝতে পারছেন আপনি। ঢং করবেন না।’
দোতলার সিঁড়ি থেকে নেমে ওরা বেজমেন্ট যাবার সিঁড়িঘরের সামনে আসলো। সকাল হাঁটছিল আরশানের পেছন পেছন। আরশান ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘কেন আসছেন?’
—‘ওমা! এতো রেগে যাওয়ার মতো কী হলো?’
—‘যান, আপনার ঘরে যান।’
—‘না যাবো না। আমি আপনার ঘরে যাবো।’
—‘না আমার ঘরে এখন যাওয়া যাবে না।’
—‘এরকম করছেন কেন?’
—‘করছি কারণ, আপনার মধ্যে কিছু খ্যাত ব্যাপার স্যাপার আছে। হুইচ রিয়েলি সাকস।’
সকাল অপরাধীর গলায় বলল, ‘কী করলাম আবার।’
—‘আপনি বুঝবেন না। বোঝার মতো বুদ্ধি আপনার মাথায় নেই।’
—‘এখন কিন্তু আপনি আমাকে ইনসাল্ট করছেন।’
—‘বেশ করছি।’
কথাটা বলে শেষ করে আরশান সিঁড়ি ভেঙে নামতে লাগলো নিচে। নামলো সকালও। বলল, ‘সব কিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি করেন কেন?’
—‘বাড়াবাড়ি আমি করছি না। আপনি করেছেন।
—‘আমি তো কিছুই করিনি। ইনফ্যাক্ট আমি বুঝতেই পারছি না আমার দোষটা কোথায়।’
আরশান ঘরের মূল বাতি নিভিয়ে দিয়ে ল্যাম্প শেড জ্বালালো। স্লাইডিং ডোর খুলে হেঁটে উঠে আসলো ডেকের ওপরে। চেয়ারে রাখা বেহালাটা হাতে তুলে নিয়ে বসলো চেয়ারে। সকালও আসল খানিক বাদে। এসে দাড়ালো আরশানের পাশে।
বাইরে তখন নিকষ-কালো অন্ধকার। হাওয়া ভারি ঠাণ্ডা। সকাল আরশানের কাঁধে একটা হাত রেখে বলল, ‘আমি আপনার রাগের কারণটা ধরতে পারছি না।’
‘আমাকে দেখতে পেয়েই আপনি দৌড়ে গিয়ে চাদর গায়ে দিয়ে এসেছেন তাইতো? কিন্তু আমার কথা হচ্ছে কেন? আমি কি বাইরের লোক?’ সকাল একটু আমতা আমতা করে বলল, ‘না মানে…একটু অস্বস্তি লাগছিল।’
—‘বেশ তো! এখন আপনি আমার অত কাছে আসছেন কেন? আমারও অস্বস্তি লাগছে।’
সকাল হাসলো, ‘আপনি একটা কী বলেন তো? বাচ্চাদের মতো করেন কেন সবসময়?’
আরশান কিছু বলল না। গনগনে মুখে চেয়ে থাকল সামনে।
—‘আচ্ছা, বিয়ের পরেও কি আমরা আপনি আপনি করে কথা বলবো?’
—‘বলতে দোষ কোথায়? তাছাড়া আপনি হলেন প্রিন্সেস। রয়েল মানুষজনকে কি তুমি করে ডাকা যায়?’
সকাল খিলখিলিয়ে হেসে উঠল, ‘তাহলে আপনি আমাকে আপনি বলবেন আর আমি আপনাকে তুই বলবো। কেমন?’
—‘বলেন!’ বিরস গলায় বলল আরশান।
—‘আপনার হয়েছে কী?’
—‘কিছু না।’
—‘ভায়োলিন রাখেন তো এখন। একটু পরে বাজান।’
—‘কেন?’
—‘আমি বলছি তাই। এখন ভায়োলিন বাজাতে হবেনা।’
—‘তাহলে এখন কী করতে হবে?’
—‘এখন আমাকে আদর করতে হবে।’
আরশান থমকালো। বিস্মিত গলায় বলল,’ কী করতে হবে?’
সকাল ভারি আকুলিবিকুলি হয়ে বলল, ‘আমাকে একটু আদর করবেন?’
এই অসহ্য সুন্দর মিনতিটা শুনে আরশান ওর হামবড়া, দাম্ভিক হাসিটা হাসলো।
—‘এত আদর পেতে চাইছেন কেন? আমি তো এখনো আপনাকে ভালোবাসি বলিনি। বিয়েও হয়নি এখনো।’
সকালের চোখদুটো হঠাৎ কেমন বিষণ্ণ হয়ে উঠল। অন্য গলায় বলল, ‘যদি ভালোবাসি কথাটা আপনি কোনোদিন না বলেন? যদি…যদি বিয়েটা না হয়?’
আরশান ঘুরে তাকালো সকালের দিকে, ‘এটা কেন বললেন?’
সকাল বাতাস গিললো।
—‘এমনিই বললাম।’
আরশান বসা থেকে উঠে দাড়ালো। ভায়োলিন চেয়ারের ওপর রেখে সকালের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,
—‘আপনার বাবা মা কী বলেছেন?’
সকাল একটা লম্বা দম নিলো, মুখ নিচু করে বলল, ‘এখনো কিছু জানাননি। সময় চেয়েছেন।’
আরশান নিভলো। ওর নিভন্ত মুখখানা অন্ধকারেও স্পষ্টভাবে ধরা পড়ল সকালের চোখে। বুকে একটা ধাক্কা এসে লাগলো। পরিস্থিতি সামলাতে বলল, ‘চিন্তার কিছু নেই। রাজি হয়ে যাবে।’
আরশান করুণ গলায় বলল, ‘যদি রাজি না হয়?’
সকাল জানে না এ প্রশ্নের উত্তরটা ঠিক কিভাবে দেয়া উচিত। সে অন্ধকারে কিছুক্ষণ স্থবির হয়ে আরশানের মুখের দিকে চেয়ে থাকলো। কোনো কথা খুঁজে পেলো না। আরশানই কথা বলল আবার, বলল, ‘কিছু বলছেন না যে? রাজি না হলে কী হবে?’
—‘কী হবে?’ সকাল স্বগতোক্তির মতো আওড়ালো শব্দগুলো। তার বুকে একটা চিনচিনে ব্যথা হচ্ছিল। ভেতরে ভেতরে সে নিজেও প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিল। বাবা মা এই বিয়েতে রাজি না হলে কী হবে? কী করবে সকাল?
আরশান সকালের একটা হাত ধরলো, ‘আপনি আমাকে ছেড়ে চলে যাবেন?’
সকাল একটু অভিমানী গলায় বলল, ‘আপনি তো বলেছেন আপনি আমাকে ছাড়া বেঁচে থাকতে পারবেন।’
—‘পরীক্ষা নিচ্ছেন?’
সকাল অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে রইল আরশানের দিকে। তার নিশ্বাসে সে কম্পন টের পাচ্ছে। প্রতিরোধের বাঁধ ভাঙছে।
সে আরশানের গালের ওপর আলতো করে একটা হাত রাখলো। তারপর খুব আকস্মিকভাবে ওর ঠোঁটে নিবিড় একটা চুমু খেলো। দৃঢ় গলায় বলল, ‘আপনি আমারই থাকবেন।’
আরশান চুমুটা ফিরিয়ে দিলো প্রবল ভাবে। ওই আক্রমণে সকাল দাড়ানো থেকে বেসামাল হয়ে পড়ে যাচ্ছিল। আরশান ওর কোমর খামচে ধরল। ধীরে ধীরে চেয়ারের ওপর বসিয়ে দিয়ে বলল, ‘বসুন, পড়ে যাচ্ছিলেন কেন?’
সকাল হাঁপ ধরা গলায় বলল, ‘যেমন দৈত্যের মতো এসে পড়লেন, পড়ব না তো কী করব?’
আরশান মৃদু হাসল শুধু। কিছু বলল না। মেঝে থেকে তুলে নিলো ভায়োলিনটা। তারপর রেলিং এ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে যন্ত্রটা কাঁধে তুলে নিলো।
বেহালার করুণ সুর দিগ্বিদিকে ছড়িয়ে যাচ্ছিল। আকাশের গায়ে গায়ে, অক্টোবরের হিম হিম বাতাসে, অন্ধকারের রন্ধ্রে রন্ধ্রে গেঁথে যাচ্ছিল সেই সুর। গেঁথে যাচ্ছিল সকালের মনের মধ্যে। এক অপার্থিব মায়াবী অনুভূতির বুদ বুদ তৈরি হচ্ছিল সেখানটায়।
সকাল বশীভূত হয়ে পড়ল। মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইল বেহালাবাদকে দিকে।
টানা কয়েক মিনিট বাজানোর পর আরশান হঠাৎ থেমে পড়ল, সকালের দিকে চেয়ে বলল, ‘কোন গান বলুন তো?’
—‘ধরতে পারছি না।‘
আরশান ভায়োলিন কাঁধ থেকে নামালো, ধীরে ধীরে গাইলো, ‘Will you love me like you loved me in the October rain?’
গানটা আরশান বেশ ভালোই গাইলো। সকাল বিস্মিত হয়ে বলল, ‘আপনি গান গাইতে পারেন!’
দমকা হাওয়াটা কোত্থেকে যেন একদল শুকনো পাতা উড়িয়ে নিয়ে এসেছিল। জঙ্গলের গাছে গাছে কয়েকটা পাখি ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছিল শব্দ পেয়ে। ডানা ঝাপটে কিচিরমিচির করে দল বেঁধে উড়ে গেল তারা এক ডাল থেকে আরেক ডালে। অন্ধকারে তাদের শরীর দেখা যায় না। শুধু আওয়াজ পাওয়া যায়।
—‘মূল গানে আছে জানুয়ারি রেইন। আমি অক্টোবর রেইন করে দিলাম।’
এটুকু বলে আরশান আবার গাইলো,
‘Mom and Dad and violins
Somber country silence
The needle stopped the kicking
The clothespins on the floor
And my heart is playing hide and seek
Wait and count to four
Will you love me like you loved me
and I’ll never ask for more
Will you love me like you loved me in the october rain …..?’
৬৯
ঘুম ভাঙানিয়া পাখির মতো একটি সুমিষ্ট বার্তা বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার মাইল পথ অতিক্রম করে, ফুলগন্ধী হাওয়ায় চেপে, অতলান্তিকের বিস্তৃত জলরাশি পাড় হয়ে, অবশেষে একরাশ স্নিগ্ধ শিউলি ফুলের মতো ঝরঝর করে ঝরে পড়ল সকালের দরজায়, আজকের এই অক্টোবরের সোনাবরণ সকালটায়।
নাশতার টেবিলে চাচা চাচি দুজনেই উপস্থিত ছিলেন। টিলিও ছিল। চাচি সকালকে দেখতে পেয়েই সহাস্যে বল উঠলেন, ‘ঐযে, আমাদের বউমা ঘুম থেকে উঠে গেছে।
‘বউমা’ শব্দটা শুনে সকাল ভারি আড়ষ্ট হয়ে পড়ল। চাচির আচরণ আজ বেশ অন্য রকম। গত এক সপ্তাহ ধরে তিনি সকালের চোখে চোখেই তাকাচ্ছিলেন না। আজ হঠাৎ এই আন্তরিক সম্বোধনে তাই সে অবাক না হয়ে পারলো না। মুচকি হেসে চেয়ার টেনে নিয়ে বসলো।
চাচি মুখে হাসি ঝুলিয়ে রেখেই বললেন, ‘তোমার বাবার সাথে কথা হলো একটু আগে। তিনি বিয়েতে রাজি হয়েছেন।’
সকালের মুখ খানা ঝলমল করে উঠল। ঝিলিক দিল চোখের তারা। উত্তেজনা লুকাতে পারলোনা সে। গাল ভর্তি হাসি হেসে বলল,
—‘সত্যি?’
চাচা কথা বললেন এবার, ‘সত্যিই, তোমার বাবার সাথে মোটামুটি বিয়ের তারিখ নিয়ে পাকা কথা হয়ে গেছে। ডিসেম্বরের ঊনত্রিশ তারিখ। তবে এই ক্রেডিটটা কিন্তু তোমার চাচির। তিনি গতরাতে তোমার বাবাকে ফোন করে অনেক বুঝিয়েছেন। রাজি না হয়ে আর কোনো উপায় ছিল না তোমার বাবার।
আনন্দ, আবেগ, বিস্ময় সমস্ত অনুভূতি একত্রে মিলেমিশে ভাসিয়ে দিচ্ছিল সকালকে। চাচির এই আচমকা পরিবর্তনের সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা তার কাছে এখন নেই। ব্যাখ্যা সে আপাতত খুঁজতেও চায় না।
উত্তেজনা আর আনন্দের পাশাপাশি সকালের একটু কেমন লজ্জাও করছিল। চোখ তুলে তাকাতে পারছিল না সে চাচা চাচির দিকে। তার খুব মনে হচ্ছিল এই সময় আরশানের উপস্থিতিটা খুব দরকার ছিল। আরশানকে খবরটা জানাতে হবে। গত রাতে খুব দুশ্চিন্তা করছিল সে। বলতে কি সকালেরও এই দুশ্চিন্তায় ঘুম হয়নি ঠিক মতো।
টিলি গদ গদ গলায় সকালকে বলল, ‘আমি কিন্তু তোমাদের বিয়েতে বলিউড ড্যান্স দিবো। ইনফ্যাক্ট আমার কয়েকটা ফ্রেন্ড বলিউড স্টাইল বিয়ে দেখার জন্য পাগল হয়ে আছে। আমি ভাবছি ওদেরকে বাংলাদেশে নিয়ে যাবো। তুমি কী বল?’
সেই মুহূর্তে ফাহাদের আগমনটা উপস্থিত সবার মাঝে একটি অস্বস্তির উদ্রেক করলো। ফাহাদ অফিসে যাবার জন্য তৈরি হয়েছে। তার গায়ে সাদা ফুল হাতা শার্ট, কালো প্যান্ট। তার চোখ দুটো ঈষৎ ফোলা। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এই ছেলে রাতে ঘুমোয়নি এক ফোঁটা।
সে আসা মাত্রই সকালকে প্রশ্ন করলো, ‘নাবিলা কোথায়?’
—‘ঘুমোচ্ছে।’ সকাল বলল।
ফাহাদ চেয়ার টেনে নিয়ে বসলো। তাকালো মায়ের দিকে। তার মা কোনো দিকে না তাকিয়ে পরোটা আর আলু ভাজি খাচ্ছে নিবিড় মনোযোগের সাথে। ফাহাদ সামনে রাখা প্লেট থেকে হাত বাড়িয়ে একটা ক্রসেন্ট তুলে নিলো। মমকে দেখল আবার আড়চোখে। গ্লাসে ঢেলে নিলো অরেঞ্জ জ্যুস। সিপ করলো। তারপর কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বলল,
—‘মম!’
মম তাকালেন না। তাকে দেখে মনে হলো তাঁর কর্ণকুহরে একটি শব্দও প্রবেশ করেনি। ফাহাদ আবার ডাকলো,
—‘মম!…ক্যান আই হ্যাভ আ ওয়ার্ড উইদ ইউ?’
মম নড়লেন না, মুখ তুলে চাইলেনও না।
সকাল আর টিলি চুপচাপ খাবার খাচ্ছিল। কেউ কোনো দিকে তাকাচ্ছিল না। ভারি একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতি জন্ম নিচ্ছিল ধীরে ধীরে।
ফাহাদ নিরুপায় হয়ে বাবাকে বলল, ‘ড্যাড, তুমি কি মমকে আমার হয়ে একটা কথা বলতে পারবে?’
রহমান সাহেব নিরুত্তাপ গলায় বললেন, ‘বল কী বলতে হবে?’
–‘মমকে বলবে যে আমি অত্যন্ত দুঃখিত। আমি তার কাছে ক্ষমা প্রার্থী। গতকাল একটি কথাও আমি সজ্ঞানে বলিনি। আমার মাথা আউট ছিল। আমি মন থেকে ক্ষমা চাই তার কাছে।’
কথাগুলো বলা শেষ করে ফাহাদ এক ঢোকে গ্লাসের জ্যুস শেষ করলো। ক্রসেন্টটা হাতে নিয়ে উঠে পড়ল। রহমান সাহেব তড়িঘড়ি করে বলে উঠলেন, ‘সেকি! কোথায় চললে তুমি? নাশতা করে যাও।’
—‘দেরি হয়ে যাচ্ছে। আজ থাক।’ যেতে যেতে এটুকু বলে আবার পেছন ফিরলো ফাহাদ, জরুরি গলায় বলল, ‘ড্যাড, নাবিলাকে একটু ওর বাসায় ড্রপ করে দিয়ে আসতে পারবে? ইটস রিয়েলি চিলি আউটসাইড। বৃষ্টি আসবে দুপুরে। আমি চাইছি না বৃষ্টির মধ্যে ও বাসের জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকুক।’
—‘আমি নামিয়ে দিয়ে আসবো। তুমি চিন্তা করো না।’
সকাল দেখলো চাচির চোখদুটো একটু একটু করে ঘোলাটে হয়ে উঠছে।’ এই প্রথম বারের মতো মানুষটার জন্য মন কেমন করে উঠল I নিজের সন্তানও একটা সময় কতটা পর হয়ে যায়, অন্য রকম হয়ে যায়, অচেনা হয়ে যায়!
সকাল একটু আনমনা হয়ে উঠছিল। নাবিলার উপস্থিতিতে তার ঘোর ভাঙলো। নাবিলা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে যাবার জন্য তৈরি। তার মুখখানা ভারি শুকনো দেখাচ্ছে। মরা গলায় সে বলল, ‘আমি তাহলে আসি।’
রহমান সাহেব ব্যস্ত গলায় বললেন, ‘এখনই যাবার দরকার নেই। আমি তোমাকে ড্রপ করে আসবো বাসায়। তুমি এসো আমাদের সাথে বসে নাশতা কর।’
নাবিলা চোখের কোণ দিয়ে ফাহাদের আম্মাকে দেখলো একবার। জড়তা নিয়ে বসলো চেয়ারে। খাবার কিছুই স্পর্শ করলো না। কিছুক্ষণ থম ধরে বসে থেকে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, ‘আন্টি, আমি গতরাতের ঘটনার জন্য খুবই সরি। আপনাকে অপমান করার কোনো ইনটেনশন ছিল না আমার।’
ফাহাদের আম্মা বসা থেকে উঠে পড়লেন, নাবিলার দিকে না তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘তোমার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই, রাগও নেই। তুমি চিন্তা করো না।’
কথাটা বলে আর দাড়ালেন না তিনি। টেবিল থেকে এঁটো বাসন কোসন সরিয়ে নিয়ে সিঙ্কের কাছে চলে গেলেন।