অক্টোবর রেইন – ৬০

৬০

রাতে খুব ঝড় বৃষ্টি হলো। এমন কালান্তক ঝড় সকাল বহুদিন দেখেনি। হাওয়ার তোড়ে জঙ্গলের বড় বড় গাছগুলো শেকড় শুদ্ধ উড়াল দেবে বলে মনে হচ্ছে। বাড়িটাকে ঘিরে প্রেতাত্মার কান্নার মতো হু হু শব্দ করে ঘুরপাক খাচ্ছে প্রবল শক্তিশালী বাতাস। ধাক্কা খাচ্ছে বাড়ির দেয়ালে। হিংস্র জন্তুর মতো গর্জে উঠছে মেঘ। বিদ্যুৎ ঝলসাচ্ছে আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। 

সকালের বুকের ভেতরেও ঠিক এইরকম এক ঝড়ই বইছিল। সেই ঝড় দেখা যায় না। শুধু অনুভব করা যায়। 

চাচা ডেকে পাঠিয়েছেন তাকে নিজের ঘরে। সকাল বসে আছে তাঁর সামনে একটি চেয়ারে। চাচি বিছানার ওপর স্তূপ করে রাখা কাপড়-চোপড় গোছাচ্ছেন। সকাল এই মহিলার উপস্থিতিতে অস্বস্তি বোধ করছে। তার মনে হচ্ছে চাচার সাথে একান্তে কিছু কথা বলতে পারলে ভালো লাগত। 

—‘শোনো মা। তোমার বাবার সাথে আমার কথা হয়েছে। কেন যেন মনে হলো তিনি প্রস্তাবটা শুনে খুব একটা তৃপ্ত হননি। তার মনের মধ্যে দ্বিধা আছে। তিনি আমার কাছে সময় চেয়েছেন।’ 

সকাল নিশ্চুপ। মাথা অবনত। 

—‘এই দ্বিধার কারণ কী তা আমি সঠিক জানি না তবে মনে হয় কিছুটা ধারণা করতে পারছি। তুমি কি কিছু জানো মা এ ব্যাপারে? তোমার বাবা কি কিছু বলেছেন তোমাকে?’ 

সকাল ঢোক গিললো। ম্লান গলায় বলল, 

—‘না চাচা।’ 

চাচা একটা বড় নিশ্বাস ছাড়লেন, ‘আমার ছেলেটা ছোটবেলা থেকে বুকের মধ্যে একটা কষ্ট চেপে রেখে বড় হয়েছে। এই কারণে ওর চিন্তা ভাবনাগুলো বরাবরই একটু অন্যরকম ছিল, এলোমেলো ছিল।’ 

এটুকু বলে চাচা থামলেন। বসা থেকে ধীরে ধীরে উঠে ড্রেসিং টেবিলের ওপর রাখা পানির জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢাললেন। ঢক ঢক করে পানিটা গিলে ফেলে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুখ মুছে নিয়ে ক্লান্ত গলায় বললেন, ‘আরশান তোমাকে খুবই পছন্দ করে মা। আমি ওর চোখে তোমার জন্য ভালোবাসা দেখতে পেয়েছি। তোমাকে পেয়ে ও নতুন করে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা পেয়েছে। এবার যদি ওর মনটা ভেঙে যায় তাহলে… তাহলে খুব মুশকিল হয়ে যাবে! আমার ছেলেটাকে তুমি বাঁচাও।’ 

সকাল প্রায় কেঁদে ফেলছিল। ধরা গলায় বলল, ‘এভাবে বলবেন না চাচা। এতো চিন্তার কিছু নেই। দেখবেন সব ঠিক থাকবে।’ 

—‘আমার ছেলেটা একটু অ্যাবনরম্যাল আছে আমি জানি। হয়তো ওর সাথে এডজাস্ট করতে তোমার একটু কষ্ট হবে। একটু মানিয়ে নিতে হবে। কিন্তু এটুকু বলে দিতে পারি যে ও তোমাকে পাগলের মতো ভালোবাসবে। তুমি শুধু ওকে একটু সামলে নিও। মানুষ তো কন্যা সম্প্রদান করে। আমি তোমার কাছে পুত্র সম্প্রদান করলাম।’ 

এ পর্যায়ে ফাহাদের মা আচমকা একটু উঁচু স্বরে বলে উঠলেন, ‘মনে হয় আরশানের মায়ের ব্যাপারটা নিয়েই উনারা একটু ভাবছেন।’

রহমান সাহেব ধমকে উঠলেন স্ত্রীকে, ‘তুমি চুপ থাকো। মাঝখান থেকে কথা বোলো না।’ 

ধমক খেয়ে ফাহাদের মা একটু থমকে গেলেন। কিন্তু গলার তেজ কমল না। ঝেঁঝে উঠে বললেন, ‘আমি খারাপ কথাটা কী বললাম হ্যাঁ? যুক্তিসঙ্গত কথাই তো বলেছি।’ 

সকাল ফাহাদের মায়ের কথায় কান না দিয়ে বলল, ‘চাচা, আপনি এতো চিন্তা করবেন না। আপনি শুধু দোয়া করেন, সব কিছু যেন ঠিক থাকে।’ 

কথাটা বলে সকাল উঠে দাড়ালো। তার বুকের ভেতর থেকে কান্নার একটা স্রোত উঠে আসছে গলার কাছে। আপ্রাণ চেষ্টা করেও নিজেকে সামলাতে পারছে না সে। 

ঘরে এসে বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে অনেকক্ষণ কাঁদলো সকাল। বিন্দুবাসিনী পাশে এসে বসল নিভৃতে। সকাল দুশ্চিন্তার গলায় বলল, ‘বাবা রাজি না হলে কী হবে বিন্দু?’ 

—‘হবে, নিশ্চয়ই হবে। আপনি এত ভাববেন না।’ 

বিন্দুর সাথে বিড়বিড় করে কথা বলতে বলতে ঘরের ভেতর পায়চারি করতে লাগলো সকাল। খানিক বাদে বাথরুমে গিয়ে সময় নিয়ে গোসল করলো। কিন্তু দুশ্চিন্তার ভূতটা মাথা থেকে কিছুতেই নামলো না। 

৬১

নাবিলা কাউচের ওপর লুটিয়ে পড়ে ছিল। ফাহাদ দৌড়ে কাছে গিয়ে দেখলো নাবিলা চোখ বন্ধ অবস্থায় মুখ হা করে নিশ্বাস নিচ্ছে। তার হাত পা কাঁপছে অস্বাভাবিক ভাবে। ফাহাদ ওর কাঁধ ধরে উঠে বসালো জোর করে। ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, 

—‘নাবিলা তুমি ঠিক আছো?’ 

নাবিলা অনেক কষ্টে চোখের ঢাকনা খুললো। ঘোলাটে দৃষ্টিতে দেখলো ফাহাদকে। স্থবির হয়ে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ। শুকনো ঠোঁট নেড়ে কিছু একটা বলল। কী বলল বোঝা গেলো না। ফাহাদ দৌড়ে গিয়ে এক গ্লাস পানি নিয়ে আসলো। নাবিলার চোখে মুখে জলের ছিটা দিলো। কয়েক ঢোঁক জল খাইয়েও দিল জোর করে। খেয়ে নাবিলা আবার শুয়ে পড়ল। উদ্বিগ্ন ফাহাদ ওর পাশে বসে হাত ধরে বলল, ‘তোমার কী হয়েছে?’ 

নাবিলা ক্ষীণ ভাবে বলল, ‘ওই ঘরে কে যেন হাঁটছিল।’ 

—‘কোন ঘরে?’ 

-‘পাশের ঘরে।’ 

—‘পাশের ঘরে কেউ নেই নাবিলা। সব তোমার মনের ভুল।’ 

—‘আছে। কেউ একজন আছে।’ 

নাবিলার চোখ দেখে বোঝা যাচ্ছে সে ভয় পেয়েছে। ফাহাদ পাশের ঘর থেকে একবার ঘুরে আসলো। এসে বলল, 

—‘কেউ নেই। বললাম তো তোমার মনের ভুল।’ 

নাবিলা আর কিছু বলল না। চোখ বুজলো। ফাহাদ ওর মাথার কাছে এসে বসলো। বলল, 

—‘এতো ভয় পেয়েছো কেন? বোকা নাকি?’ 

—‘তুমি আমাকে একলা ফেলে রেখে চলে গেলে কেন?’ 

—‘যাবো আর কোথায়? গিয়েছিলাম খাবার আনতে। এক ঘণ্টাও তো হয়নি। এর মাঝেই এমন একটা ম্যাসাকার হয়ে যাবে তা কে জানতো!’ 

নাবিলা ঘোলা চোখদুটো মেলে ফাহাদের দিকে চাইলো একবার। এই ছেলেটা আজ রাতে ফিরে না আসলে সে নির্ঘাৎ মরে যেত। তার আর অন্য কোনো কিছুর ভয় নেই। শুধু ঐ ভূতের ভয়টাই তাকে খেলো। বাড়িতে ডাকাত পড়লেও মনে হয় সে অতটা ভয় পাবে না। যাক ফাহাদ ফিরে আসায় তার মনের ভেতরে স্বস্তি ফিরে এসেছে, প্রাণ ফিরে এসেছে। সে নিশ্চিন্তে চোখ বন্ধ করলো আবার। 

—‘এখন কিছু খাবে?’ ফাহাদের প্রশ্ন। 

—‘কী এনেছো?’ 

—‘বার্গার।’ 

—‘কোথেকে?’ 

—‘রেড রবিন।’ 

নাবিলা উঠে বসলো। পেটে চনমন করে ক্ষিদে পেয়েছিল। এখন না খেলেই নয়। 

ওরা চুপচাপ খেয়ে নিলো। খাওয়ার সময় কেউ কারো সাথে কোনো কথা বলল না। ফাহাদ খেতে খেতে ল্যাপটপ খুলে কাজ করলো। ঠাণ্ডা মাথায় ফোনে কথা বলল কার সাথে যেন। কাজের কথা। আজকের রাতটা যেন আর দশটা রাতের মতোই সাধারণ একটা রাত। অসাধারণ কিছুই যেন ঘটেনি এই রাতে। ওর নির্বিকারত্ব দেখে নাবিলার রাগ হচ্ছিল। টার্কি বার্গারে কামড় বসাতে বসাতে বিষ দৃষ্টিতে দেখছিল সে ফাহাদকে। খাওয়া শেষ করেও আরো মিনিট পনেরো সময় ফাহাদ ল্যাপটপ খুলে বসে থাকলো। কপাল কুঁচকে কী সব রাজ কার্য উদ্ধার করলো। তারপর উঠে গিয়ে কিচেন থেকে ভদকার একটা বোতল নিয়ে আসলো। সাথে দুটো কাচের গ্লাস। সেন্টার টেবিলের ওপর বোতল আর গ্লাস রেখে চেয়ার টেনে সে নাবিলার মুখোমুখি বসলো। গ্লাসে পানীয় ঢেলে নাবিলার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, 

—‘চলবে?’ 

নাবিলা থমথমে মুখে গ্লাসটা নিলো। ফাহাদকে দেখে মোটেও বিচলিত মনে হচ্ছে না। তার চোখে মুখে একটা ঠান্ডা ভাব বিরাজ করছে। এই ঠান্ডা ভাবটা নাবিলার গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছে। ছেলেটা কি ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না? নাবিলা ওর সাথে ব্রেক আপ করেছে! ব্রেক আপ! কিছুই কি এসে যায় না তার? এতটা কুল কিভাবে থাকে সে ব্রেকআপের পরে? 

ফাহাদ গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, ‘এখন বলো, কী বলার আছে তোমার।’

—‘যা বলার বলে দিয়েছি। নতুন করে কিছুই বলার নেই।’ 

—‘কী বলেছিলে? আবার বল।’ 

নাবিলা অস্বস্তি বোধ করতে লাগলো। কথাটা বারবার বলা তার জন্য সহজ কাজ নয়। পুনরায় সেই কথাটা বলতে তার কতটা কষ্ট হবে ফাহাদের কি কোনো ধারণা আছে? সে দেয়ালে টাঙানো মোনালিসার দিকে চোখ রেখে বলল, ‘তোমার সাথে আমার ব্রেকআপ।’ 

—‘আর?’ 

—‘আর ….আই থিঙ্ক উই শ্যুড নট সি ইচ আদার এনিমোর।’ 

—‘আর?’ 

নাবিলার চোখ দেয়ালেই আটকানো ছিল। এই পর্যায়ে তার গলার স্বর হালকা হালকা কাঁপছিল। সে কম্পনরত গলা নিয়ে বলল, 

—‘আর তুমি আমাকে ভুলে যাও।’ 

—‘কেন?’ 

—‘আমি বলেছি তাই।’ 

—‘জুবায়েরের ব্যাপারটা কী?’ 

—‘ও আমার বয়ফ্রেন্ড।’ 

—‘আজকেই আমার সাথে ব্রেকআপ করলে আবার আজই নতুন বয়ফ্রেন্ড জুটিয়ে ফেললে। আমি জানতাম না তুমি এতটা স্মার্ট!’ 

নাবিলা এ কথার পিঠে কিছু বলল না। 

ফাহাদ বলল, ‘তুমি আমাকে আর ভালোবাসো না?’ 

নাবিলা একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো। বলল, ‘না।’

—‘আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বল।’ 

নাবিলা তাকালো। ফাহাদ আবারও করলো প্রশ্নটা। 

—‘ডোন্ট ইউ লাভ মি এনিমোর? 

নাবিলা চোখ নামালো নিচে, বলল,’না।’

ফাহাদ উঠে এসে বসলো নাবিলার পাশে। দুহাত দিয়ে শক্ত করে নাবিলার কাঁধ চেপে ধরে কঠিন গলায় বলল, 

—‘তোমাকে বলেছি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে। তুমি চোখ লুকাচ্ছো কেন?’ 

নাবিলা ফাহাদের চোখের দিকে তাকালো না। ছটফট করে ফাহাদের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করলো খানিকক্ষণ। না পেরে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘ছাড়ো ফাহাদ। ব্যথা পাচ্ছি। তোমার হাতে অনেক জোর।’ 

ফাহাদ ছাড়লো না। এ মুহূর্তে একটা পিশাচের মতো রাগ ভর করেছে তার ওপর। সে ক্রুদ্ধ গলায় চিৎকার করে বলে উঠল, ‘কেন এমন করছো? বলো আমাকে কেন এমন করছ? বলতে তোমাকে হবেই। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে একবার বল তুমি আমাকে ভালোবাস না।’ 

নাবিলা কেঁদে ফেললো। ফুঁপিয়ে উঠে বলল, ‘পারবো না। প্লিজ পারবো না। মাফ করে দাও আমাকে। 

ফাহাদের হাতের মুঠো শিথিল হলো। আগুনের মতো জ্বলতে থাকা রাগটায় একটু ঠান্ডা জলের ছিটা পড়ল মনে হয়। সে ধীরে ধীরে ছেড়ে দিলো নাবিলাকে। খানিকক্ষণ চেয়ে রইল কাঁদতে থাকা মেয়েটার দিকে। খানিক বাদে তার বুকের ভেতরের রাগটা মুছে গিয়ে একটা নিদারুণ কষ্ট এসে ভর করলো। নাবিলা শক্ত পোক্ত, আত্মবিশ্বাসী এক মেয়ে। এর আগে সে কোনোদিন ওকে এভাবে কাঁদতে দেখেনি। সে হাত বাড়িয়ে নাবিলাকে নিজের কাছে টেনে আনলো। হাতের আঙ্গুল দিয়ে ওর চোখের জল মুছে দিতে দিতে বলল, ‘আমাকে একটু বলবে তোমার কী হয়েছে? প্লিজ?’ 

নাবিলা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, ‘আমি তোমার সাথে থাকতে পারবো না ফাহাদ। কথাটা বোঝার চেষ্টা করো। 

শুনে ফাহাদ কিছু বলল না। চেয়ে রইল নাবিলার দিকে গভীর চোখে। নাবিলা প্রায় আর্তনাদ করে বলে উঠল, ‘এভাবে তাকিয়ে থেকো না।’ 

ফাহাদ এই কথার পিঠেও কিছু বলল না। কয়েকটা সেকেন্ড নীরবে কাটল। কিছুক্ষণ পর ফাহাদ আকস্মিক এক তপ্ত চুমু খেলো নাবিলার ঠোঁটে। জড়ানো গলায় বলল, ‘তুমি কি বোঝো না আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি?’ 

নাবিলা চুমুতে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল। তার কান্নার দমক কমলো। সে দ্বিধাগ্রস্ত চোখে চেয়ে রইল ফাহাদের দিকে। তার এক মন বলছে ছেলেটাকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দাও, আরেক মন বলছে ক্ষতি কী একটু কাছে আসলে? 

তারপর ফাহাদ যখন ওর ঠোঁটে, চিবুকে, গলায় অনবরত চুমু খেতে থাকলো তখন সে একবার শুধু ক্ষীণ গলায় বলতে পারলো, ‘ঠিক হচ্ছে না।’ 

সদর দরজা খুললো কেউ একজন। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো পিটার। ঢুকতেই ওদের দুজনকে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখে সে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। নাবিলা সরে আসলো। পিটার থতমত খাওয়া গলায় বলল, ‘সরি ইউ গাইজ! মাই ব্যাড।’ 

কথাটা বলে সে জায়গাটা ছাড়লো খুব দ্রুত। নাবিলা বসা থেকে উঠতে যাচ্ছিল। ফাহাদ ওর হাত ধরে বলল, 

—‘যেও না। কথা আছে।’ 

নাবিলা দাঁড়ালো। কিন্তু মুখ রাখলো ঘুরিয়ে। ফাহাদ উঠে এসে দাঁড়ালো নাবিলার মুখোমুখি। প্যান্টের পকেট থেকে বের করলো একটা ছোট লাল রঙের বাক্স। খুললো। বাক্সের ভেতর উঁকি দিচ্ছে হীরক খচিত চমৎকার একটি আংটি। 

নাবিলা নিজের হাতের আঙ্গুল কাটছিল দাঁত দিয়ে। তার চোখের দৃষ্টি অস্থির। বুক কাঁপছে।কী করছে এই ছেলেটা? 

সেইরকম দুনিয়া কাঁপানো অস্থিরতার মধ্যে সে ফাহাদকে বলতে শুনলো, 

—‘নাবিলা, উইল ইউ ম্যারি মি?’ 

নাবিলার পায়ের তলার মাটি নড়তে লাগলো। এই মুহূর্তটা তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত হতে পারতো। গত কয়েকটা দিন সে এই মুহূর্তের জন্য অধীর হয়ে অপেক্ষা করেছে মনে মনে, স্বপ্ন এঁকেছে। কিন্তু হায় আজ যখন এলো সেই কাঙ্ক্ষিত মুহূর্তটি, তখন এই আরাধ্য ক্ষণটিকে বরণ করার মতো সবটুকু ক্ষমতা বিধাতা তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিলেন। টলতে টলতে কাউচের ওপর ধপ করে বসে পড়ল সে। তার চোখ উপচে কান্নার ঢল নামছে। ঠোঁট চেপে সে কান্না রুখে রাখলো। ফাহাদ বিহ্বল হয়ে বলল, ‘নাবিলা! আমার উত্তরটা চাই।’ 

নাবিলা ধরা গলায় বলল, ‘পারবো না ফাহাদ।’ 

—‘কেন? আমি জানি তুমি আমাকে এখনো ভালোবাসো।’ 

—‘ফাহাদ শোনো, তোমার মম আমাকে পছন্দ করেন না।’

—‘সো হোয়াট? ইউ আর নট ম্যারিইং মাই মম।’ 

নাবিলা লম্বা দম নিলো, বলল, ‘তোমার মম আজকে দুপুরে আমাকে ফোন করেছিলেন। ফোন দিয়ে বলেছেন আমি যেন তোমার কাছ থেকে দূরে সরে যাই। আদার ওয়াইজ উনি আমার বাবা মার কাছে কমপ্লেইন করবেন।’ 

ফাহাদের মুখটা রক্তশূন্য দেখালো। সে বিমূঢ় হয়ে চেয়ে রইল কিছু মুহূর্ত নাবিলার দিকে। অনেক কষ্টে জিব নেড়ে বলল, ‘মম এটা বলেছে?’ 

৬২

খুব ভোরে মেসেঞ্জারে টুং করে একটা শব্দ করে উঠল। সকাল সারা রাত বলতে গেলে না ঘুমিয়েই ছিল। এই খানিকক্ষণ আগে একটু করে চোখ লেগে এসেছিল। মোবাইলের শব্দে সেই কাঁচা ঘুমটা ছুটে গেলো। সে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলো আরশান লিখেছে, ‘অফিসের কাজে মেরিল্যান্ড যাচ্ছি। আজ রাতেই ফিরবো। একটু দেরি হবে হয়তো। ভালো থাকবেন শেহজাদী।’ 

মনটা খারাপ হয়ে গেলো। ভেবেছিল ভোরে ঘুম থেকে উঠে দৌড়ে গিয়ে ছেলেটাকে দেখে আসবে এক নজর। আধো ঘুমে কী সব আবোল- তাবোল স্বপ্ন দেখছিল। স্বপ্ন নয়, দুঃস্বপ্ন। বিষাদে ছেয়ে আছে মনটা। 

দিনটা খুব খারাপ কাটলো সকালের। চাচির মুখোমুখি সে পারতপক্ষে হতে চাইলো না। চাচার সামনেও কেমন একটা অস্বস্তি। নিজের ঘরে গাঁট হয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কোনো কাজ রইল না। এদিকে নাবিলা আর ফাহাদেরও কোনো খবর নেই। সব মিলিয়ে ভারি একটা শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। বেলা বারোটার দিকে একবার অনিক এসে উঁকি দিলো ওর ঘরে। সকাল মাথা ব্যথার দোহাই দিয়ে বিদায় করে দিলো ওকে। 

ফোনটা আসলো দুপুরে। একটু যেন প্রাণের ছোঁয়া পেলো নিঃসাড় মনটা। 

ফোন ধরতেই আরশান ওপাশ থেকে বলল, ‘দিস ইজ রিডিকিউলাস! কেমনে পারেন আপনি এইসব?’ 

ফোনটা পেয়ে কেমন অন্যরকম একটা সুখানুভূতি হচ্ছিল। সকাল সেই সুখ সুখ অনুভূতিটাতে আকণ্ঠ ডুবে গিয়ে বলল, 

—‘আমি আবার কী করলাম?’ 

—‘কী করেন নাই তাই বলেন? আমাকে এখন ডিস্টার্ব করা বন্ধ করেন। সিরিয়াসলি! খুবই ইম্পর্টেন্ট একটা মিটিং এ আছি।’ 

—‘আজকে তো রবিবার। আজকে আবার কিসের মিটিং?’ 

—‘আমাদের ওসব কিছু ঠিক নেই। মিটিংগুলো হলিডেতে পড়ে যায় মাঝে মাঝে।’ 

—‘তা বুঝলাম কিন্তু আমি আপনাকে ডিস্টার্ব করলাম কখন বলেন তো? ভয়ে ভয়ে সকাল থেকে একটা ফোন দেইনাই আপনার কাজের সমস্যা হবে ভেবে। এখন আমার ওপর দোষ চাপাচ্ছেন।’ 

—‘দোষ তো আপনারই। ফোন না দিলে কী হবে? মাথার ভিতর তো সারাক্ষণ ঘুরঘুর করছেন। এখন একটু ব্রেক দেন প্লিজ! আই নিড টু কন্সান্ট্ৰেট!’ 

সকাল মিটমিট করে হাসতে লাগলো। কিছু বলল না মুখে। 

আরশান বলল, ‘আমার মনে হয় আমি আপনাকে মিস করছি।’

—‘মিস করলে তাড়াতাড়ি চলে আসেন। আমার একলা একলা ভাল্লাগছে না।’

—‘আহ এভাবে বললে তো আমি আর এক মুহূর্তও এখানে টিকতে পারবো না!’ 

সকাল হেসে বলল, ‘থাক। এখন আসতে হবে না। মন দিয়ে কাজ করেন।’ 

রাতে আরশান যখন ফিরলো বাড়িতে, সকাল তখন মায়ের সাথে ভিডিও কলে আছে। আরশান বাড়ি ফিরেই সকালের ঘরে ঢুঁ মারলো। দরজাটা আধখোলা ছিল। ভিডিও ক্যামেরার ভেতর মা দেখতে পেলো তার মেয়ের ঘরে এক আগন্তুক বিনা অনুমতিতেই ঢুকে পড়েছে। মা একটু তটস্থ হয়ে বলল, ‘এইটা কে?’ 

সকাল অপ্রস্তুত হয়ে গেল। আমতা আমতা করল, ‘মা এটা আরশান। নাও কথা বল।’ 

আরশানকে একটুও বিচলিত দেখালো না। মাথা নিচু করে ক্যামেরার সামনে মুখ এগিয়ে নিয়ে আসলো সে। হেসে বলল, ‘হ্যালো আন্টি!’ 

সকাল আরশানের হাতে একটা চিমটি কেটে ফিসফিস করে বলল, ‘সালাম দিন।’ 

আরশান একটু ভড়কে গেলো সকালের চিমটি খেয়ে। ভুল শুধরে নিয়ে বলল, ‘ও আচ্ছা! আসসালামু আলাইকুম আন্টি।’ 

মা সালামের উত্তর দিয়ে বলল, ‘তুমি কোথায় চাকরি করো?’ 

সকাল একটু অস্বস্তি বোধ করতে লাগলো মায়ের কথার ধরন দেখে। ভাবটা এমন যেন আরশানের ইন্টারভিউ নেয়া হচ্ছে। আরশানটাও না! হুট্‌ করে ঘরের ভেতর ঢুকে যাবে তা কে জানতো! 

আরশান বলল, ‘আন্টি আমি একটা আর্কিটেকচারাল ফার্মে আছি।’

—‘তুমি কি বিল্ডিং বানাও?’

সকালের রাগ ধরে যাচ্ছিল। মায়ের কথার ধরনটা দেখো!

আরশান স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘বিল্ডিং ডিজাইন করি।’ 

মায়ের মুখ দেখে কিছু বুঝতে পারছে না সকাল। মনে হচ্ছে আরশানকে তার পছন্দ হচ্ছে আবার হচ্ছেও না। আরশান হেসে বলল, ‘আপনারা কথা বলেন। আমি আসছি। ভালো থাকবেন আন্টি।’ 

ঘর থেকে বেরোবার আগে সকালকে বলল, ‘আপনি একবার আসবেন নিচে?’ 

সকাল সম্মতিসূচক মাথা নাড়লো। আরশান চলে গেলে মা কেমন কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ‘দেখি তোর বাবার সাথে ভালো মতো কথা বলবো।’ 

‘কী কথা বলবা?’ 

—‘এইযে আরশানের সাথে বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে। কেন যে তোর বাবাটা এমন বেঁকে বসলো।’ 

সকাল ঠাট্টার ছলে বলল, ‘তুমিও তো বেঁকেই ছিলে, হঠাৎ কী হলো তোমার?’ 

মা করুণ গলায় বলল, ‘নারে, ছেলেটাকে দেখে মায়া লেগে গেছে।কী সুন্দর মায়া মায়া চেহারা।’ 

সকাল চিন্তিত গলায় বলল, ‘বাবাকে তাড়াতাড়ি রাজি করাও মা। তোমার কথা বাবা ফেলবে না। খুব বেশি দেরি কোর না। চাচা বাবার উত্তরের অপেক্ষা করছেন।’ 

ফোন রেখে নিচে নেমে আসলো সকাল মিনিট দশেকের মধ্যেই। লিভিং রুমটা অন্ধকার। কেউ আছে বলেও মনে হচ্ছে না। আরশান কি তবে ঘরের বাইরে? 

শেষ সিঁড়িটা ভেঙে ঘরের মেঝেতে পা রাখতে যাবে ঠিক সেই সময় ডান হাতের কুনুইয়ে একটা শক্ত চাপ অনুভব করলো সে। কেউ একজন টেনে নিচ্ছে তাকে। নিজের অজান্তেই একটা গগন বিদারী চিৎকার বেরিয়ে আসলো মুখ দিয়ে। 

লম্বা মানুষটা অন্ধকারে সকালের মুখ চেপে ধরলো। মুখ চেপে ধরে রাখায় ভয়াবহ চিৎকার প্রশমিত হলো। তবুও হালকা কোঁকাচ্ছিল সকাল। অন্ধকারে মানুষটার মুখ দেখতে পেলো না সে। কিন্তু নাকে যখন আতরের খুশবু এসে ধাক্কা খেলো তখন আর বুঝতে বাকি রইল না এই দুর্বত্ত ব্যক্তিটি আসলে কে। 

আরশান ধীরে ধীরে সকালের মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিলো। সকালের মাথা তখন তার বুকের খুব কাছে। সে মাথা ঝুঁকিয়ে চেয়ে আছে সকালের দিকে। নিকষ কালো অন্ধকারে। কী দেখছে কে জানে! সকালতো কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছে না। এমন ঘুটঘুটে অন্ধকার সে বহুকাল দেখেনি। ঢাকা শহরে এমন অন্ধকার দেখার কোনো অবকাশ নেই। ঢাকায় শুধুই আলোর বন্যা। গভীর রাতেও জলজল করে শহুরে বাতি। 

সকাল একটু কৌতুক করে বলল, ‘কে?’ 

—‘বেজমেন্টের ভূতটা!’ আরশান বলল, চাপা গলায়। 

—‘তা আপনার ঘর এতো অন্ধকার কেন বেজমেন্টের ভূত?’

—‘ভূতরা তো অন্ধকারেই থাকতে ভালোবাসে।’ 

—‘তাই বুঝি? বেশ বেশ। আমার কাছে আপনার কী চাই ভূত মশাই? ঘাড় মটকাতে চান? 

—‘নাহ ঘাড় মটকানোর প্ল্যান আপাতত নেই। তবে ভূতটার আজকাল বড্ড একা একা লাগে কিনা তাই তার একটা ভূতনি চাই। কিন্তু ভূতটার ভাগ্য কী ভালো দেখুন না, ভূতনির বদলে জ্যান্ত একটা পরী পেয়ে গেলো। একদম আকাশ থেকে নেমে আসলো একটা সত্যিকারের পরী!’

সকাল হেসে ফেললো, বলল, ‘ধুর লাইট জ্বালান তো। অন্ধকারে আপনার চেহারা দেখতে পাচ্ছি না।’

—‘আমি তো আপনাকে দেখতে পাচ্ছি।’ 

—‘আমি পাচ্ছি না।’

—‘আপনি মনে হয় সত্যিই রাতকানা।’ 

—‘হলে হব, এখন বাতি জ্বালান।’ 

আরশান সকালকে টেনে নিয়ে এসে সোফার ওপর বসলো। 

সকাল বলল, ‘অন্ধকার ভালো লাগে আপনার?’ 

—‘খুব ভালো লাগে। জঙ্গলের ভেতর রাত কাটানোর সময় তো আমি অন্ধকারেই থাকি। আমার অভ্যাস আছে।’ 

—‘তাহলে জঙ্গলেই চলে যান। আকাশে মোটামুটি একটা চাঁদ আছে। অসংখ্য নক্ষত্র।’ 

—‘না আজকে ঠান্ডা পড়বে খুব। রাতে টেম্পারেচার দেখাচ্ছে থার্টি সেভেন।’ 

— ‘থার্টি সেভেন হলে তো গরম।’ 

—‘বলছেন কী? সেলসিয়াস নয়তো, ফারেনহাইট।’ 

—‘ও আমি ভেবেছি সেলসিয়াস। আমি আপনাদের এখানকার হিসাব বুঝি না। আমাকে সেলসিয়াসে বলেন।’ 

আরশান একটু চিন্তা করে নিয়ে বলল, ‘তিন ডিগ্রির মতো হবে। ফিল লাইক মাইনাস ওয়ান।’ 

—‘ও তবে তো বেশ ঠান্ডা।’ 

ওরা দূরত্ব রেখেই বসেছিল। অন্ধকার চোখে একটু সয়ে আসার পর অতটা খারাপ লাগছিল না সকালের। কাচের দরজার বাইরে নক্ষত্র খচিত আকাশটা দেখা যাচ্ছিল। দারুণ লাগছিল দেখতে। 

ঘরের ভেতর নিশ্ছিদ্র নীরবতা। শুধু ওপর তলায় ধুপধাপ শব্দ হচ্ছে একটা। টিলি খুব সম্ভবত স্কিপিং করছে। মেয়েটার আজকাল রাতের বেলায় দড়ি লাফ খেলার অভ্যাস হয়েছে। ওজন কমানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছে সে। ওর লাফ ঝাঁপের চোটে মনে হচ্ছে যেন মাথার ওপর ছাদ ভেঙে পড়বে। ধুপ ধুপ ধুপ… শব্দটা একদম বুকে এসে বাড়ি খাচ্ছে। 

সকালের খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল। ওই সুন্দর চোখ ওয়ালা বেজমেন্টের ভূতটাকে একটা বার আলোর নিচে মন ভরে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল। 

আরশানই কথা বলল, ‘আমি অনেক বদলে গেছি, জানেন?’ 

—‘কী রকম?’ 

—‘কাজে মন বসছে না এরকমটা কখনো হয়নি আমার। আজকেই প্ৰথম।’ 

—‘মন বসছিল না?’ 

—‘না।’ 

—‘কেন?’ 

—‘মনটা বাড়িতে থেকে গিয়েছিল। অফিস যায়নি।’ 

—‘নিয়ে গেলেই পারতেন।’ 

—‘অনেক জোর করলাম। যেতেই চাইলো না। বড় অবাধ্য।’ 

সকাল চুপ করে রইল। মানুষটা কথা বলে সুন্দর করে। শুনতে ভালো লাগে। 

আরশান বলল, ‘এরকম কেন হচ্ছে বলুন তো? আমি তো আগে এমন ছিলাম না।’ 

সকাল সাবধানে বলল, ‘ভালোবেসে ফেলেছেন মনে হয়।’ 

আরশান কথাটা শুনে চুপ হয়ে গেলো। অন্ধকারে তার মুখভঙ্গী ধরতে পারলো না সকাল। খানিক বাদে আরশান একটু কেমন রূঢ় গলায় বলল, 

—‘এসব ভালোবাসা টাসার কথা আমাকে একদম বলবেন না আর। আমি ভালোবাসতে চাই না।’ 

সকাল একটু চমকে উঠল আরশানের কথার তেজ দেখে। অত রেগে যাওয়ার মতো কি কিছু বলে ফেলেছে নাকি সে? আজব লোক তো! 

সে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘কেন ভালোবাসতে চান না কেন?’ 

—‘প্রয়োজন নেই।’ 

—‘তাহলে আমাকে বিয়ে করছেন কেন?’ 

—‘আপনাকে আমার চাই।’ 

—‘কেন চাই?’ 

—‘ভালো লাগে, তাই।’ 

—‘ভালোলাগা আর ভালোবাসা কি খুব কাছাকাছি দুটো অনুভূতি নয়?’

—‘না নয়। ভালোবাসা গভীর জিনিস। আমার ভেতরে অত গভীর ব্যাপার স্যাপার নেই। আর ভালোবেসে ফেললে আপনি যখন আমাকে ছেড়ে চলে যাবেন তখন আমি নিজেকে সামলে উঠতে পারবো না।’ 

—‘আরশান আমি আপনাকে কখনো ছেড়ে যাবো না।’ 

—‘বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়।’ 

—‘বিশ্বাস করুন। কারণ এটাই সত্য।’ 

—‘হয়তো করবো কোনো একদিন।’ 

—‘এখন আমি আপনাকে ছেড়ে চলে গেলে আপনি সামলে উঠতে পারবেন?’ 

আরশান স্পষ্ট গলায় বলল, ‘পারব। কষ্ট হবে, তবে বেঁচে থাকতে পারব।’ 

—‘আমাকে ছাড়া বেঁচে থাকতে পারবেন?’

—‘পারব।’ 

৬৩

অক্টোবরের শীত ছুঁই ছুঁই হিমেল অন্ধকার রাত্রি। আকাশে অনেক তারা। অসংখ্য হীরক খণ্ডে ঝিকমিক করছে গোটা অন্তরীক্ষ। রহমান সাহেব প্যাটিওতে বসে আছেন। অত্যন্ত অশান্ত এক মন নিয়ে। মাথার ভেতর ধিকি ধিকি জ্বলছে আগুন। বুকে কষ্টের একটা চাপ 

এ সংসার বড়ই অশান্তির জায়গা। কোথাও একরত্তি ভালোবাসা নেই, মায়া নেই, প্রেম নেই। তিনি আজীবনই ভালোবাসার কাঙাল ছিলেন। একটু ভালোবাসা, একটু আদর যত্নের জন্য জীবন বিকিয়ে দিতেও রাজি ছিলেন। অত চেয়েছিলেন বলেই বুঝি এমনটা হলো তার জীবনে। স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, অর্থ সম্পদ সমস্ত কিছু থাকার পরেও আজ তিনি একলা, বড়ই একলা এবং নিঃসঙ্গ। 

আকাশের দিকে চেয়ে ছিলেন। বড় সুন্দর ওই তারা কুচি কুচি অন্ধকার আকাশটা। মনে হচ্ছে যেন অগণিত পবিত্র ফেরেশতা নিষ্পলক চেয়ে আছে তার দিকে। নিবিড় মনোযোগের সাথে। একদিন ওই আকাশের দিকে মুক্ত বিহঙ্গ পাখি হয়ে উড়ে যাবেন ঠিক ঠিক। গিয়ে মিশবেন ওই খণ্ড খণ্ড হীরের টুকরোর সাথে। সেই দিনটা আর বেশি দূরে নয়। জীবন তার শেষ স্টেশনে পৌঁছে গেলো বলে। কাজগুলো গুছিয়ে নিতে হবে। 

সকালের আব্বার ফোনের অপেক্ষা করেছেন তিনি সারাদিন। এখনো করছেন। কেন যেন মনে হচ্ছে তার বন্ধু এই প্রস্তাবে রাজি হবে না। আরশান মাতৃহারা। খুব সম্ভবত এটাই তার একমাত্র দোষ। অথচ একজন শিক্ষিত, বিবেচক মানুষের কাছে এটা কোনো দোষ বলে গণ্য হওয়ার কথা না। তার প্রথম স্ত্রীকে নিয়ে কিছু গুজব আছে গ্রামের বাড়িতে এ কথা সত্য। এসব ব্যাপার নিয়ে সকালের আব্বার সাথে খোলামেলা কথা বলতে হবে। তিনি অপেক্ষা করছেন বাংলাদেশে ভোর নামার। আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই দেশে কর্মব্যস্ত দিন শুরু হয়ে যাবে। তিনি ফোন করে কথা বলবেন বন্ধুর সাথে। 

আজকে সাবিলার কথা খুব মনে পড়ছে। সাবিলা তাঁর প্রথম স্ত্রী। সে থাকলে আরশানের জীবনটা হয়তো অন্যরকম হতো। আরশানের কাছে তার মায়ের ব্যাপারে কোনো কথা তিনি আজ অবধি খোলামেলা ভাবে বলেননি। ছেলে কষ্ট পাবে ভেবেই বলেননি। কিংবা কে জানে ছেলের চোখে নিজে ছোট হয়ে যাবেন ভেবেও হয়তো বলেননি কখনো কথাগুলো। তার ভেতরে একটা অপরাধবোধ আজও বিষাক্ত সাপের মতো ফণা তুলে আছে। সাবিলার অভিশাপই হয়তো লেগে গেল জীবনে। তাই তো সুখের খুব কাছাকাছি থেকেও সুখী হওয়া আর হয়ে উঠল না তার। সাবিলা ছিল সাদা সিধে সহজ সরল গ্রাম্য এক মেয়ে। বাবা-মায়ের পছন্দেই বিয়ে হয়েছিল তাদের। তিনি বুয়েটের ছাত্র ছিলেন। সদ্য পড়াশোনা শেষ করে গ্রামের বাড়িতে ফিরেছেন। সেই সময়ই বাবা এক রকম তাড়াহুড়া করেই বিয়েটা ঠিক করে ফেললেন। সাবিলার রূপ ছিল আগুনের মতো। চেহারা দেখে বিয়েতে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। মেয়েটার বুদ্ধির ধার কম থাকলেও ঝকঝকে একটা মন ছিল। 

রহমান সাহেবের নিজের কোনো আপন ভাইবোন ছিল না। তিনি ছিলেন বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। একমাত্র পুত্রবধূ হিসেবে সাবিলা অত্যন্ত সুনিপুণ হাতে সংসারের দায়িত্ব বুঝে নিল অল্প কিছুদিনের মধ্যেই। কিন্তু কোথায় যেন একটা অদৃশ্য দেয়াল রয়ে গিয়েছিল তাদের স্বামী স্ত্রীর মধ্যে। নিতান্তই গ্রাম্য জীবনে অভ্যস্ত মেয়েটি রূপ গুণে অনন্যা হওয়া সত্বেও কোনো ভাবেই শিক্ষিত, মেধাবী, শহুরে ছাপ ওয়ালা সুদর্শন স্বামীটির মনের ভেতর জায়গা করে নিতে পারলো না। কেন পারলো না কে জানে। পৃথিবীতে কিছু রহস্য চিরকাল রহস্য হয়েই টিকে থাকে। সেইসব রহস্য কোনো এক আশ্চর্য কারণে কেউ কখনও ভেদ করতে পারে না। 

এর মাঝেই একদিন ভাগ্যক্রমে আমেরিকার নর্থ ডাকোটা ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্সের একটা স্কলারশিপ হয়ে গেলো তার। তারপর শুরু হলো প্রবাস জীবন। দেড়টা বছর স্ত্রীকে ছাড়াই প্রবাসে বসবাস করলেন। ইচ্ছা থাকা সত্বেও বাবা মা একলা হয়ে যাবেন ভেবে সাবিলাকে নিয়ে এই দেশে নিয়ে আসা সম্ভব হয়নি। পড়াশোনা শেষ করার পর চাকরিটাও পেয়ে গেলেন যুৎসই। অতএব দেশে ফিরে যাবার ইচ্ছা বা উপায় কোনটিই আর থাকলো না। বেড়াতে গেলেন দেশে দীর্ঘ দেড় বছর পর। সেবারই আরশানের আবির্ভাব হলো তাদের জীবনে। দেশ যখন পুনরায় ছাড়লেন তিনি আরশান তখন ওর মায়ের পেটে। পোয়াতি স্ত্রীকে নিয়ে পৃথিবী পাড়ি দেয়ার মতো সাহস তখন তার ছিল না। তাছাড়া স্ত্রীকে নিয়ে আসলে বাবা মা নিতান্তই সঙ্গীহীন হয়ে পড়বেন। অতএব আবারও একলাই পা রাখলেন মার্কিন মুলুকে। 

প্রথম চাকরি হলো নিউইয়র্কে। সে সময় তার খুব কাছের বন্ধু ছিল রাশেদ। রাশেদ বাঙালি এবং তাদের মানিকগঞ্জেরই ছেলে। সস্ত্রীক বসবাস করে জ্যামাইকার একটি অ্যাপার্টমেন্টে। উইকেন্ডে তার স্ত্রী ভালো মন্দ রান্না করত। প্রায় ছুটির দিন গুলোতেই বন্ধুদের দাওয়াত থাকতো তার বাসায়। সেইরকম এক ছুটির দিনে রাশেদের বাসায় প্রথম দেখা হলো ফাহাদের মায়ের সাথে। গল্পে গল্পে জানা গেল ফাহাদের মা রাশেদের কাজিন। অর্থাৎ তার বাড়িও মানিকগঞ্জেই। ড্রাইভওয়েতে একটি গাড়ি এসে থামলো প্রকট শব্দে ব্রেক কষে। রহমান সাহেবের ধ্যান ছুটে গেলো। মন নামক টাইম মেশিন ১৯৯১ থেকে চট করে অবতরণ করলো ২০১৯ এর বুকে। তিনি হালকা. চমকে উঠে লক্ষ্য করলেন তার কনিষ্ঠ পুত্র ফাহাদ গাড়ি থেকে নামছে। তার ভেতরে একটা উদ্ধত ভাব কাজ করছে। এই অস্থিরতার কারণ কী হতে পারে তা ভেবে তার দুশ্চিন্তার মাত্রাটা আরেকটু বাড়লো। ফাহাদের সাথে নাবিলা নামের মেয়েটাকেও দেখা যাচ্ছে। মেয়েটির চোখ মুখে একটি দিশেহারা ভাব। ফাহাদ মেয়েটির হাত ধরে জোর করে বাড়ির ভেতর টেনে নিয়ে যাচ্ছে। রহমান সাহেব চিন্তিত মুখে বসা থেকে উঠে দাড়ালেন। তার বুকে একটু চিন চিনে ব্যথা হচ্ছে। তিনি দুশ্চিন্তার ধকল সইতে পারছেন না। 

৬৪

আরশান উঠে গিয়ে ঘরের বাতি জ্বালালো। হঠাৎ এক ঝাঁক আলো এসে চোখের দরজায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল। চোখ বন্ধ করে ফেললো সকাল। তারপর ধীরে ধীরে চোখ দুটো যখন খুললো, তখন দেখলো আরশান দাঁড়িয়ে আছে সাদা টি শার্ট আর কালো ট্রাউজার পরে। 

—‘আপনি ডিনার করেছেন?’ সকালের প্রশ্ন। 

—‘হ্যাঁ।’ 

—‘কোথায়?’ 

—‘অফিসেই।’ 

শুনে সকাল কেন কে জানে একটু গম্ভীর হয়ে গেলো। ঠান্ডাভাবে বলল, ‘আপনার ওই কলিগ মেয়েটা। কী যেন নাম? এন্ড্রিয়ানা। তার সাথে আপনার যোগাযোগ আছে?’ 

আরশান বুঝি খানিকটা অবাক হলো এই প্রশ্ন শুনে। হেঁটে এসে বসলো সকালের পাশে। 

বলল, ‘যোগাযোগ থাকবে না কেন? শী ইজ মাই কলিগ।’

—‘ও,ওর সাথেই ডিনার করে এসেছেন বুঝি?’ 

—‘না, সে তো এখন আমার সাথে কথা বলে না।’ 

আরশানের মুখ ফসকে বেরিয়ে গেলো কথাটা।

—‘সেকি কেন? কথা বলে না কেন?’ 

আরশান সঙ্গে সঙ্গে কিছু বলল না। নিজের খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা গাল হাতড়ে হাতড়ে কী যেন চিন্তা করলো। একটু দ্বিধাগ্রস্ত দেখালো তাকে সেই মুহূর্তে। সকাল অস্থির হয়ে বলল, ‘কথা বলছেন না যে?’ 

—‘আসলে…ওর সাথে আমার একটা ঝামেলা হয়ে গেছে।’

ঝামেলার সংবাদটা কেন যেন সকালের মনের মধ্যে একটা স্বস্তির ভাব এনে দিল। 

সে চায় না ওই মেয়ে আরশানের ধারে কাছেও থাকুক। ভাবনাটা খুব টিপিক্যাল হয়ে যাচ্ছে এটা সে বুঝতে পারছে। কিন্তু কিছু করার নেই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে যুক্তি দিয়ে ভাবতে হয় না, ভাবতে হয় অনুভূতি দিয়ে। এন্ড্রিয়ানা যে আরশানের প্রতি ভয়াবহ রকমের আসক্ত সেটা প্রথম দিন ওকে দেখেই টের পেয়েছিল সে। 

স্বস্তির ভাবটা মুখ থেকে চট করে লুকিয়ে নিয়ে সকাল উৎসুক গলায় বলল, ‘কী ঝামেলা?’ 

আরশান একটু ম্লান ভাবে বলল, ‘আমি আসলে একটা ভুল করে ফেলেছিলাম।’ 

এবার একটু বুক কাঁপলো সকালের, ‘কী ভুল?’ 

—‘কদিন আগে…’ আরশান চুপ করে গেলো আবার। তাকে এতটা অপ্রতিভ হতে সকাল এর আগে কখনো দেখেনি। সে একটু জোরেই বলে উঠল, 

—‘কী হয়েছে কদিন আগে?’ 

আরশান সকালের চোখে চোখে তাকালো। তার মুখে একটা অপরাধবোধ খেলছে এখন। সে ধীরে ধীরে বলল, 

—‘কদিন আগে আমি এন্ড্রিয়ানার বাসায় গিয়েছিলাম। তো আমি… আমি ভেবেছিলাম…আচ্ছা আমাকে একটু সময় দিন আমি কথাগুলো গুছিয়ে নেই। 

সকালের মন থেকে স্বস্তির ভাবটা মুছে গেছে। তার মন বলছে ঘটনা অন্যরকম। আরশান কি তাহলে এন্ড্রিয়ানার সাথে ব্রেকআপ করার পরেই তার সাথে এসে জুটেছে? এর মানে সকাল এখন এন্ড্রিয়ানার পরিপূরক? 

আরশান কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বলল, ‘আমি শুনেছিলাম যে আপনার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে অনিকের সাথে। তো ব্যাপারটা আমাকে খুব হন্ট করছিল। আই ওয়াজ লিটারেলি আউট অফ মাই মাইন্ড। তাই আমার মনে হয়েছিল আমি যদি এন্ড্রিয়ানার কাছে যাই…তাহলে হয়তো আমি আপনাকে ভুলতে পারবো।’ 

সকাল নিশ্বাস বন্ধ করে শুনছিল। তার চক্ষু দুটি বিস্ফারিত। চাউনিতে দিশাহারা ভাব। সে কোনো রকমে বলল, ‘তারপর?’ 

—‘তারপর…আমি এন্ড্রিয়ানার বাসায় গেলাম। ওকে বললাম যে ওকে আমার চাই ফর দ্যা টাইম বিইং।’ 

সকালের মুখে রক্ত জমে উঠছে। আগুন লাগার পূর্বাভাস। 

কিন্তু আরশানকে যে কথাগুলো বলতেই হতো। আজ নয় কাল। লুকোচুরি করা তার স্বভাবে নেই। সে সকালের গনগনে মুখটা লক্ষ্য করলো। একটু ভয়ে ভয়ে বলল, ‘আপনি ঠিক আছেন?’ 

— ‘তারপর কী হলো?’ 

—‘তারপর সে আমাকে প্রশ্ন করলো যে কেন আমি তাকে চাই? আমি কি আর সকালকে পছন্দ করি না? তো আমি বললাম যে না, করি না। দেন শী স্টার্টেড কিসিং মি। এন্ড আই হাগড় হার।’ 

সকালের চোখ ঝাপসা হয়ে উঠল।

।সে বসা থেকে উঠে পড়ে ধরা গলায় বলল, ‘আমি আর কিছু শুনতে চাই না।’ 

আরশান সকালের হাত ধরে ফেললো, ‘বসুন বসুন। পুরোটা শুনে নিন। 

—‘না শুনতে চাই না। অনেক হয়েছে। 

আরশান সকালকে টেনে বসালো সোফার ওপর। করুণ গলায় বলল, ‘আপনি রাগ করছেন আমার ওপর?’ 

সকাল হঠাৎ সোফায় রাখা একটা কুশন আরশানের দিকে সজোরে ছুঁড়ে মেরে প্রায় চিৎকার করে বলে উঠল, ‘রাগ করব না তো কী করবো? কেন গেছেন আপনি ওই মেয়ের কাছে? কেন গেছেন?’ 

আরশান দু হাত ঠেকিয়ে কুশনের আঘাত থেকে নিজেকে রক্ষা করলো, বলল, ‘তো কী করবো আমি? আপনি তো নাচতে নাচতে যাচ্ছিলেন অনিককে বিয়ে করতে।’ 

—‘অনিককে আমি কখনোই বিয়ে করতাম না।’ 

—‘কিন্তু আপনাদের বিয়ের কথা হচ্ছিল। আর ওই ছেলেটা সারাদিন আপনার পিছে ঘুরঘুর করতো। আপনি যদি বিয়েই করবেন না তো অত মাখামাখি কিসের?’ 

—‘মানুষের বন্ধু থাকতে পারে না? ও তো আমাকে কিস করে নাই। আপনারা তো…ছিঃ ছিঃ ভাবতে আমার ঘেন্না হচ্ছে।’ 

—‘আমাকে একটু বোঝার চেষ্টা করেন। সেই রাতে আমি আপনাকেই চাইছিলাম ভীষণ ভাবে।এন্ড্রিয়ানাকে নয়।’ 

—‘তাই বলে আপনি ওর সাথে শুয়ে পড়বেন? বিশ্বাস হচ্ছে না আমার! 

কথাটা শুনে আরশান হতভম্ব হয়ে গেলো। স্তম্ভিত গলায় বলল, ‘কী বলছেন এসব? সেরকম কিছুই হয়নি। আমি তার আগেই একটা স্টুপিড কাজ করে ফেলেছিলাম। 

—‘কী করেছেন?’ 

—‘ওয়েল, যখন আমি এন্ড্রিয়ানাকে জড়িয়ে ধরে ছিলাম, তখন সে হঠাৎ করেই বলে উঠল যে, সে আমাকে ভালোবাসে। দেন আমি ওর কথার প্রেক্ষিতে বলে ফেলেছিলাম আই লাভ ইউ সকাল…।’ 

বিস্ময়ে সকালের ভেজা টলমল চোখ দুটো কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছিল। সে হতভম্ব গলায় বলল, ‘আপনি কী বলেছেন?’ 

আরশান মুখ ঘুরিয়ে নিলো, স্তিমিত গলায় বলল, ‘আপনি তো শুনেছেন।’ 

—‘আমি আবার শুনতে চাই।’ 

আরশান খুব ক্ষীণ গলায় বলল, ‘আমি বলেছি, আই লাভ ইউ সকাল। দেন শী স্ন্যাপড মি ইন মাই ফেস।’ 

সকাল কোনো কথা বলতে পারছিল না। তার বুকের ভেতর একটা মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে। সামনে বসা মানুষটা তাকে পাগল বানিয়ে ছাড়বে। এই মানুষটাকে সে একটা ফোঁটা বুঝতে পারে না। তবুও মানুষটা তাকে চুম্বকের মতো টানতে থাকে সারাটাক্ষণ। একটু আগেও তার প্রচন্ড রাগ হচ্ছিল এর ওপর। কিন্তু এই মুহূর্তে সেই রাগের পাশাপাশি অন্যরকম একটা অনুভূতি হচ্ছে। সেই অনুভূতির নাম জানে না সকাল। শুধু জানে অনুভূতিটা তার সমস্ত সত্বাকে নাড়িয়ে দিচ্ছে। 

সে আচ্ছন্ন ভাবে আবার করল প্রশ্নটা, ‘কী বলেছিলেন? আরেকবার বলবেন?’ 

আরশান তাকালো সকালের দিকে। চোখে চোখ রেখে বলল, ‘না আর বলব না!’ 

—‘কেন বলেছিলেন এই কথাটা?’ 

আরশান মাথায় হাত রেখে ক্লান্ত গলায় বলল, ‘জানি না!’ 

সকাল হঠাৎ উম্মাদের মতো তেড়ে এসে আরশানের টি শার্টের গলা চেপে ধরে বলল, ‘আর কোনোদিন যাবেন ওই মেয়ের কাছে?’ 

আরশান সকালের আকস্মিক আক্রমণে সোফার পিঠের ওপর হেলে পড়ল খানিকটা। বিপন্ন গলায় বলল, ‘ওরে বাবা! মারবেন নাকি?’

সকাল প্রাণপণে চেঁচিয়ে উঠে বলল, ‘মারবো, খুব মারবো আপনাকে। বলেন আর কখনো যাবেন নাকি ওর কাছে?’ 

সকালের হাতে কোত্থকে যেন অসুরের শক্তি নেমে এসেছিল। আরশান ওর হাতের চাপে হাঁসফাস করছিল। কোনো রকমে বলল, ‘যাবো না।’ 

—‘গেলে একদম খুন করে ফেলবো। আপনি আমার। শুধুই আমার। জেনে রাখুন।’ 

এ পর্যায়ে আরশান হেসে ফেললো। ডাকাতের মতো হো হো করে হাসতে হাসতে বলল, ‘আমার তোমার ব্যাপারটা কী? আমি কি প্রপার্টি নাকি?’ 

—হ্যাঁ আপনি আমার প্রপার্টি, বোঝা গেল?’ 

আরশান সকালের হাতদুটো জোরজবরদস্তি করে নিজের কলার থেকে সরিয়ে নিলো। হেলে থাকা অবস্থা থেকে সোজা হয়ে উঠে বসলো। 

বলল, ‘আপনি তো আদর টাদর করতে দেন না। আমাকে এরকম বঞ্চিত করলে এন্ড্রিয়ানার কাছে তো আমাকে যেতেই হবে তাই না?’ 

—‘আপনি একটা ফালতু।’ 

আরশান হঠাৎ একটু গম্ভীর গলায় বলল, ‘আচ্ছা আপনি আমাকে চুমু খেতে বারণ করেছেন কেন? আপনার ভালো লাগেনি?’ 

সকাল একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল প্রশ্নটা শুনে। মুখ নিচু করে বলল, ‘ভালো লেগেছে।’ 

—‘তাহলে নিষেধ কেন?’ 

সকাল বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আগেই বলেছি। ভালোবাসা ছাড়া ওসব হবে না।’

বলল মুখে। কিন্তু বলতে নেই, ভেতরে ভেতরে সে প্রবলভাবে চাইছিল আরশান তার খুব কাছে আসুক। প্রলয়ংকরী ঝড়ের মতো ছুটে এসে ওকে লণ্ডভণ্ড করে দিক। 

সেই সময় হঠাৎ ওপর তলা থেকে একটি গলা ফাটানো চিৎকার ভেসে আসলো। সেই সাথে ভারি কাচের জিনিস ভাংচুরের শব্দ। সকাল চমকে উঠল। চমকে উঠে দাড়ালো আরশানও 

এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে দ্রুত পায়ে উঠে আসলো ওরা সিঁড়ি ভেঙে। লিভিং রুমে উপস্থিত হয়ে দেখলো ফাহাদ রুদ্রমূর্তি ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে ঘরের মাঝখানে। তাকে ঘিরে রেখেছে মাদার, বাবা আর নাবিলা। মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে ভাঙা কাচের ফুলদানির টুকরো। একটু দূরে রক্তশূন্য মুখ নিয়ে তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে টিলি। 

আরশান আর সকাল আচমকা এমন এক বিস্ফোরক পরিস্থিতির মুখে গিয়ে পড়ল যে বেশ খানিকক্ষণ তারা কেউ কোনো কথা বলতে পারলো না। থ বনে গিয়ে তাকিয়ে রইল শুধু। ফাহাদের চোখ মুখ গনগনে রাগে জ্বলছে। তার সামনে মম দাঁড়িয়ে আছেন জবুথবু হয়ে 

ফাহাদ প্রাণপণে চেঁচিয়ে উঠে বলল, ‘মম! আমার কথার উত্তর দাও, তুমি কি কাজটা করেছ?’ 

মমের চোখে মুখে অপমানের ছায়া টলমল করছে। সকাল আরশানকে দেখে তিনি একটু বেশি অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছেন। তাঁর মনে হচ্ছে শত্রুপক্ষের সামনে তাকে ষড়যন্ত্র করে অপদস্ত করা হচ্ছে। তাঁর নাস্তানাবুদ অবস্থা দেখে এখন বৈরিদলের সদস্যদের মনে আনন্দ অনুভূত হচ্ছে। এটা কোনো ভাবেই সহ্য করা যায় না। এতক্ষণ রাগটা টিপে টিপে প্রকাশ করলেও এবার তিনি পুত্রের ওপর বজ্রের ন্যায় পতিত হলেন। 

‘করলে করেছি। কী হয়েছে তাতে? মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেছে?’ ফাহাদ দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল, ‘তুমি এটা করতে পারো না। আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে তুমি দখল দিতে পারো না!’

—‘ব্যক্তিগত ব্যাপার? তুমি কাকে কী বলছো হ্যাঁ? বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়াটা তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপার হলো কী করে?’ 

নাবিলা বেশ ঘাবড়ে গেছে। সে নতমুখে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ফাহাদের পাশে। তার চোখে মুখে গাঢ় আতঙ্কের ছাপ। সকাল এগিয়ে গিয়ে নাবিলার পাশে দাড়ালো। তার একটা হাত চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল, ‘ভয় পাস না। সব ঠিক হয়ে যাবে।’ 

আরশান চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘটনাটা বোঝার চেষ্টা করছিল। তার ভ্রু কুঞ্চিত। কপাল ভাঁজযুক্ত। 

রহমান সাহেব কাউচের ওপর বসে পড়েছেন তখন। তিনি নীরব দর্শক। টিলি দরজার আড়ালে দাড়ানো। মূল ঘটনাস্থলে এসে দাড়াতে যেন সে ভয় পাচ্ছে। 

ফাহাদ বলল, ‘আমি কাকে বিয়ে করবো কাকে করবো না সেটা সম্পূর্ণ আমার নিজস্ব ব্যাপার। তুমি মতামত দিতে পারো। কিন্তু কোনো ডিসিশন নিতে পারো না।’ 

মম জ্বলতে জ্বলতে বললেন, ‘তাহলে এখন কী করতে হবে? ক্ষমা চাইতে হবে তোমার কাছে?’ 

ফাহাদ লোহার মতো শক্ত মুখ করে বলল, ‘আমার কাছে নয়, তুমি নাবিলার কাছে ক্ষমা চাইবে।’ 

মমের চোখ দুটি বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে উঠল। তারপর হলো ক্ষোভে অগ্নিদগ্ধ। তিনি নিজের পেটে ধরা সন্তানকে চিনতে পারছেন না। তার নিজের ছেলে বাড়ির সমস্ত সদস্যদের সামনে দাঁড়িয়ে তাকে এভাবে অপমান করতে পারবে এটা তার ধারণাতেও ছিল না কখনো। ফাহাদ বরাবরই একটু ঠোঁটকাটা। মা-কে সে ভালোবাসে ঠিক কিন্তু মায়ের কোনো সিদ্ধান্ত বা কাজকেই সে পুরোপুরিভাবে গ্রহণ করতে পারেনি আজ অবধি। মতের অমিল হলে সে ঠান্ডা মাথায় তাকে বুঝিয়েছে। যুক্তির সাথে তর্ক করেছে। কিন্তু উঁচু গলায় কথা বলেনি কখনো। এমন ঔদ্ধত্য পূর্ণ আচরণ ছেলের কাছ থেকে এই প্রথম পাচ্ছেন তিনি। এই নাবিলা মেয়েটা সাংঘাতিক। এই কদিনেই ছেলেকে এতটা বদলে দিয়েছে। বিয়ে হয়ে গেলে, বিয়ের পরে কী করবে? 

তিনি ফুঁসতে ফুঁসতে বললেন, ‘কী বললে তুমি?’ 

ফাহাদ স্পষ্ট ভাবে বলল, ‘তুমি নাবিলার কাছে ক্ষমা চাইবে।’ 

নাবিলা এবার অস্ফুটে বলে উঠল, ‘ফাহাদ প্লিজ! বাড়াবাড়ি হচ্ছে।’

ফাহাদ নাবিলার কথায় কর্ণপাত করলো না। রুদ্রমূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। শক্ত চোয়াল আর জ্বলন্ত চোখ নিয়ে 

এ পর্যায়ে মম দিশেহারা হয়ে তাঁর স্বামীর দ্বারস্থ হলেন, আকুল হয়ে বললেন, ‘তুমি চুপ করে আছো কেন? কিছু বলছো না যে?’ 

রহমান সাহেব বুকের উত্তেজনা চাপা দিয়ে শান্ত ভাবে বললেন, ‘আমার তো এখানে কিছু বলার নেই। তুমি কাজটা করার আগে কি আমার অনুমতি নিয়ে করেছিলে?’ 

ফাহাদের আম্মার মুখখানা মোচড়ানো কাগজের মতো কুঁচকে গেলো। তিনি বিস্ফারিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘কথাটা তুমি বলতে পারলে? তোমার ছেলে তোমার সামনে দাঁড়িয়ে একটা বাইরের মেয়ের জন্য আমাকে অপমান করছে। এর পরেও তুমি চুপ করে থাকবে?’ 

—‘থাকবো। কারণ এখানে আমি কেউ নই। আমি তৃতীয়পক্ষ।’ 

ফাহাদের আম্মার চোখ ছলছল করে উঠল। কান্নার দমকে কেঁপে উঠল তার শরীর। তিনি মুখে শাড়ির আঁচল চাপা দিতে দিতে ফাহাদকে বললেন, ‘তুমি আমার ছেলে? তোমাকে আমি পেটে ধরেছিলাম?’ 

ফাহাদ কঠিন গলায় বলল, ‘এসব কথা পরে হবে। আমি বলেছি তুমি নাবিলার কাছে ক্ষমা চাও। যদি না চাও তাহলে আমি এখন এই মুহূর্তে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো।’ 

মম দিগভ্রান্ত হয়ে বললেন, ‘কী বললে?’ 

—‘যা বলার বলে দিয়েছি। বার বার বলবো না।’ 

নাবিলা খুব কাঁদছিল। সকাল ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে, চোখের পানি মুছে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করছিল। কয়েকটা সেকেন্ড কেউ কোনো কথা বলল না। মম স্থবির হয়ে ফাহাদের দিকে চেয়ে ছিল। রহমান সাহেব এবার বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে মানে?’ 

ফাহাদ আগের চাইতেও জোরালো গলায় বলল, ‘মম যদি নাবিলার কাছে ক্ষমা না চায় তাহলে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো।’ 

—‘এটা কোনো কথা হলো না। তুমি ….তুমি কি ড্রিংক করেছো? তোমার কথাবার্তা এমন অসংলগ্ন লাগছে কেন?’ 

—‘সেটা অন্য বিষয়। কথা হচ্ছে মম যা ইচ্ছা তা করতে পারে না। অন্যের অনুভূতিগুলোকে দাম দিতে শিখতে হবে তার।’ 

মম ফুঁসে উঠে বললেন, ‘তুমি এখন আমাকে শিক্ষা দিতে এসেছো? শেখাতে এসেছো?’ 

—‘হ্যাঁ শিক্ষা দিতে এসেছি। শিক্ষা তোমার প্রয়োজন।’ 

আরশান অনেকক্ষণ ধরে চুপচাপ দেখছিল সবকিছু। এবার সে এগিয়ে এসে ফাহাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল, ‘তুমি এভাবে কথা বলছো কেন? ইউ আর সাউন্ডিং স্ট্রেঞ্জ! আর ইউ হাই?’ 

প্রশ্ন শুনে ফাহাদ একটুও দমলো না। কঠোর ভাবে বলল, ‘আমার আরো বেশি খারাপ ভাবে কথা বলা উচিত এই মুহূর্তে। ইউ হ্যাভ নো আইডিয়া হোয়াট শী ডিড টু মি।’ 

আরশান অত্যন্ত ঠান্ডা গলায় বলল, ‘তিনি যেটাই করুক না কেন। শী ইজ স্টিল ইওর মাদার।’ 

ফাহাদ তাচ্ছিল্যের সুরে বলে উঠল, ‘মাদার? হোয়াট ডু ইউ নো এবাউট মাদার সান রিলেশনশিপ? তোমার তো কোনও মা নেই!’ 

কথাটা এত সহজে বলে ফেলতে পারবে ফাহাদ আরশান তা স্বপ্নেও ভাবেনি কখনো। তার মুখখানা এই আকস্মিক নিষ্ঠুর মন্তব্যের আক্রমণে ভারি সংকুচিত হয়ে গেলো। 

অন্যদের কাছে কেমন লাগলো কথাটা শুনে জানে না সকাল। কিন্তু তার সারা শরীর ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। সে চায়নি এদের পারিবারিক ব্যাপারে নাক গলাতে। তাই প্রথম থেকে চুপ করে ছিল। কিন্তু এই কথার পর কিছু না বলে থাকতে পারলো না সে। জোর গলায় বলে উঠল, ‘মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ ফাহাদ। কী বলছো তুমি?’ 

।ফাহাদ সকালের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, ‘ঠিকই তো বলছি। ভাই এমন একজন মানুষের পক্ষ নিয়ে কথা বলতে এসেছে যে মানুষটা কিনা সারা জীবনভর তাকে ঘেন্না করে এসেছে।’

মম বলে উঠলেন, ‘আমি আরশানকে ঘেন্না করি এ কথা তোমাকে কে বলেছে? ও আমার ছেলে! 

ফাহাদ কাঠ কাঠ হাসলো, মমের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলল, ‘ইউ আর সাচ আ হিপোক্রেট!’ 

আরশান ধীরে ধীরে একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে গুছিয়ে নিলো খানিকটা। স্থিরতার সাথে বলল, ‘আমার মা নেই একথা সত্য। তবে এ মুহূর্তে তুমি যার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছো সেই মহিলাটি আমার মায়েরই মতোন। আমার জীবনে যদি কোনো মাতৃতুল্য স্থান থেকে থাকে তাহলে সেই স্থানটির দাবিদার একমাত্র তিনি। নিজের মায়ের মুখ তো আমার মনেই পড়ে না। আর একটা ব্যাপার হলো মাদার আর আমার রিলেশনশিপ নিয়ে তোমাকে না ভাবলেও চলবে। তুমি আমার ভাই। বড় ভাই হিসেবে আমি তোমাকে বলছি যে তুমি তোমার মায়ের সাথে এই টোনে কথা বলতে পারো না।’ 

ফাহাদ অধৈর্য হয়ে বলল, ‘ভাই প্লিজ! তুমি মাঝখান থেকে কথা বলতে এসো না। মমকে ক্ষমা চাইতেই হবে। নইলে আমি আজই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো।’ 

ফাহাদের মায়ের চোখ বেয়ে টপ টপ করে জল পড়ছিল অবিরল। আরশান ফাহাদের চোখে চেয়ে শক্ত গলায় বলল, ‘উনি ক্ষমা চাইবেন না।’ 

—‘তাহলে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি। আই এম মুভিং আউট। রাইট নাও।’ 

—‘নো ইউ আর নট। লিসেন, তুমি নাবিলাকে বিয়ে করতে চাও এই তো? আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, তুমি যা চাও তাই হবে। এখন এসব নাটক বন্ধ করো।’ 

ফাহাদ কিছুক্ষণ শুষ্ক কঠিন চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকলো আরশানের দিকে। বড় ভাইয়ের চোখে সে এমন উদ্ধত দৃষ্টিতে চায় না সচরাচর। আজকে তাকে অন্যরকম দেখাচ্ছে। সে যেন ঠিক তার ভেতরে নেই। 

—‘ঠিক আছে। তোমার কথা বিশ্বাস করলাম।’ 

কথাটা বলে ফাহাদ আর দাড়ালো না। দ্রুত পায়ে জায়গাটা ছাড়লো। সকাল আর নাবিলাও গুটি গুটি পায়ে সরে পড়ল জায়গাটা থেকে। 

আরশান বাবার কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘দুশ্চিন্তার কিছু নেই বাবা, আমি দেখছি ব্যাপারটা। কিন্তু আপনারা নাবিলাকে মেনে নিচ্ছেন না কেন?’ 

বাবা বললেন, ‘আমার তো কোনো প্রব্লেম নেই। তোমার মাদার কেন এসব আজগুবি কাজ করে তা তো আমার মাথায় ঢোকে না।’ 

—‘ঘটনা আসলে কী? মাদার কী করেছেন?’ 

—‘তিনি নাবিলাকে ফোন করে বলেছেন নাবিলা যেন ফাহাদের সাথে 

কোনো যোগাযোগ না রাখে।’ 

আরশান কথাটা শুনে মুখ দিয়ে আফসোসের একটা চ-কারান্ত শব্দ করলো, বলল, ‘এটা খুব খারাপ হয়েছে। 

এরপর সে মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাচের টুকরোগুলো জড়ো করে ট্র্যাশ করল। কার্পেট ভ্যাকুয়াম করল। 

ফাহাদের আম্মা নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার যেন কোনও চৈতন্য নেই এ মুহূর্তে। তিনি শূন্য চোখে চেয়ে আছেন সম্মুখে। তাঁর মনে পড়ছে আজ থেকে প্রায় পঁচিশ ছাব্বিশ বছর আগের এক ঘন ঘোর শ্রাবণ মেঘের রাতের কথা। তারা তখন নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে দুই রুমের একটা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়েছিলেন। বিয়ে হয়েছে মাত্র কদিন আগে। 

রহমান সাহেবের সে রাতে বাড়ি ফিরতে কিঞ্চিৎ বিলম্ব হলো। তিনি খালি হাতে ফিরলেন না। তার কোলে এক ফুটফুটে শিশু। শিশুটির বয়স দেড় কি দুই বছর হবে। ফাহাদের মা অবাক হয়ে বললেন, ‘এইটা কে?’ 

রহমান সাহেব বাচ্চাটাকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘নাও, সামলাও। আজ থেকে ওর দায়িত্ব তোমার ‘ 

কী সুন্দর দেবদূতের মতো দেখতে বাচ্চাটা! তার মনটা এক সীমাহীন পবিত্রতায় ছেয়ে গেলো। তিনি বিস্মিত গলায় প্রশ্ন করলেন, ‘ও কি আমাদের সাথেই থাকবে?’ 

—‘হ্যাঁ, ছোট ফুপু ওকে ছাড়তে চাইছিলেন না। কিন্তু আমি জোর করে নিয়ে এসেছি।’ 

সে সময় রহমান সাহেবের দূর সম্পর্কের এক ফুপু নিউইয়র্কে থাকতেন। আরশানের দাদুর আদেশ ছিল যে নতুন বউয়ের হাতে যেন কোনো ভাবেই তার নাতিকে তুলে দেয়া না হয়। তিনি নাতিকে দেশে নিয়ে আসবেন দরকার হলে কিন্তু কোনও মতেই বিমাতার ওপর তার নাতির লালন পালনের দায়িত্ব দেয়া যাবে না। 

ফাহাদের আম্মা প্রসন্ন গলায় বলেছিলেন, ‘ভালো করেছো।’ 

সেই প্রথম মাতৃত্বের স্বাদ পেলেন তিনি। আরশানকে সম্পূর্ণ নিজের করে নিয়েছিলেন। কিন্তু মাস খানেক বাদে দেশে বেড়াতে যাবার পর শ্বশুর বাড়ির বৈরী আবহাওয়া এবং আত্মীয়-স্বজনদের আচার-আচরণ তাকে খুব স্পষ্ট ভাবে মনে করিয়ে দিলো যে আরশান আদতে তার সতীনের ছেলে। তার শাশুড়ি একদিন বাড়ি ভর্তি লোকের সামনে আরশানকে তার কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়ে বললেন, ‘ওর কাছ থেকে তুমি দূরে থাকো। আমার নাতি সৎ মায়ের কাছে বড় হইবো। আমি বাঁইচা থাকতে এই ঘটনা ঘটতে দিমুনা কইলাম।’ 

তিনি কাঁদতে কাঁদতে জায়গাটা থেকে দৌড়ে পালিয়ে এসেছিলেন। 

ফাহাদ তার গর্ভে আসল আরো এক বছর পর। আরশানের বয়স যখন পাঁচ ছাড়িয়ে ছয়ে পড়ল তখন তিনি অনুধাবন করলেন যে দুই ছেলেকে সমান ভাবে দেখাশোনা করা, লালন পালন করা তার দ্বারা সম্ভব হচ্ছে না। এই দেশে সব কাজ এক হাতে সামলাতে হয়। এতকাল আরশানের দাদির বারংবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও তিনি আরশানকে কাছ ছাড়া করেননি কিন্তু এবার মনে হলো এখন সময় এসেছে আরশানকে তার দাদির কাছে পাঠিয়ে দেবার। তিনি অনেক ভেবেচিন্তে স্বামীর কাছে কথাটা তুললেন। রহমান সাহেব কাজে কর্মে ব্যস্ত থাকতেন। স্ত্রী এবং সন্তানদের দেবার মতো পর্যাপ্ত সময় তার ছিল না। অতএব সিদ্ধান্ত নেয়া হলো আরশানকে কিছু দিনের জন্য তার দাদা দাদির কাছে পাঠানো হবে। 

ফাহাদের জন্মটা ছিল তার জীবনের সবচাইতে সুন্দর ঘটনা। এই ঘটনা তার জীবন পাল্টে দিল। সতীনের ছেলেকে নিয়ে আহ্লাদ করার দিন শেষ হলো। শ্বশুর বাড়িতে মর্যাদা বাড়লো। ফাহাদকে পেয়ে তিনি দুনিয়া জাহান ভুলে গেলেন। ফাহাদ তার সাত রাজার ধন, একটি মাত্র মানিক। 

আজকে সেই মানিক রত্নটি তাকে বলে গেলো, ‘হিপোক্রেট।’ 

বলে গেলো তার বিয়ে নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার তার মায়ের নেই। 

‘হিপোক্রেট!’ শব্দটা বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলেন তিনি বশীভূতর মতো। হ্যাঁ লোভ থেকে, রাগ থেকে, প্রতিহিংসা থেকে তিনি কদাচিৎ কিছু কুরুচিপূর্ণ কাজ করে থাকেন বৈকি। তাই বলে তার নিজের ছেলে তাকে ‘হিপোক্রেট’ বলবে? একেই কি বলে প্রকৃতির প্রতিশোধ? 

আজকে আরশান না থাকলে ওই বাইরের মেয়েটার কাছে তার হয়তো সত্যিই ক্ষমা চাইতে হতো। ক্ষমা না চাইলে পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হতো। তার নিজের স্বামীও আজকে তার পক্ষে একটি মাত্র কথা বলেননি। তার পক্ষ নিয়ে কথা বলল কে? 

আরশান! 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *