অক্টোবর রেইন – ৬

সকালরা বাড়ি ফিরলো বিকেলে। এখন গ্রীষ্মের শেষ বলে ধীরে ধীরে দিন ছোট হয়ে আসছে। ভীষণ ক্লান্ত লাগছিল তার। দেহের মাঝে এখনো যে বাংলাদেশের দিন রাত্রির হিসেব! তাই মস্তিষ্ক জেগে থাকতে চাইলেও শরীর চাইছে বিশ্রাম। বুঝতে পারছে সকাল। বিশ্রাম প্রয়োজন। অনেক হেঁটেছে আজ। 

প্রথমেই দেখতে গিয়েছিল ওয়াশিংটন মনুমেন্ট। ওয়াশিংটন মনুমেন্ট মূলত পাঁচশ পঞ্চান্ন ফিট উচ্চতার একটি স্মৃতিস্তম্ভ। আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের স্মৃতির উদ্যেশ্যে এই স্তম্ভটি নির্মাণ করা হয় আঠারোশ চুরাশি সালে। স্তম্ভর সাথে খনন করা হয়েছে স্বচ্ছ জলের এক পুকুর। এই পুকুরের নাম ‘রিফ্লেকটিং পুল’। কথিত আছে এই পুকুরে মনে মনে কিছু কামনা করে পয়সা নিক্ষেপ করলে, নিক্ষেপকারীর মনের সুপ্ত বাসনা বা ইচ্ছা পূরণ হয়। দর্শনার্থীদের অনেকেই তাই পুকুরে কয়েন ফেলছে। পরিষ্কার জলের নিচে চকচক করছে তামার পয়সা। পুকুরের পানিতে নিশ্চিন্তে সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে অগণিত হাঁস আর হাঁসের বাচ্চা। বাচ্চারা হাঁসের পালকে খাবার দিচ্ছে। মনুমেন্টকে কেন্দ্রে রেখে গড়ে উঠেছে মার্কিন প্রশাসনের চারটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। হোয়াইট হাউজ, লিঙ্কন মেমোরিয়াল, জেফারসন মেমোরিয়াল এবং ক্যাপিটল বিল্ডিং। লিঙ্কন মেমরিয়ালের সাদা ভবনটি প্রাসাদতুল্য। চওড়া এবং দীর্ঘ সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতে হয়। প্রায় অনেকগুলো সিঁড়ি ভেঙে ভেতরে ঢুকতেই দেখা যায় নিরানব্বই ফিট উচ্চতার আব্রাহাম লিঙ্কন বসে আছেন একটি চেয়ারে। ভবনের দেয়াল জুড়ে খোদাই করে লেখা আছে আব্রাহাম লিঙ্কনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বাণী। লিঙ্কনের রাজকীয় দীর্ঘকায় মূর্তি দেখে মনটা অন্যরকম হয়ে গেলো। রাষ্ট্রনায়ককে সম্মান দেখানোর এই অভিনব কায়দা সত্যি মনোমুগ্ধকর। মার্কিন প্রেসিডেন্টের বাসভবন হোয়াইট হাউজ দেখে অবশ্য সকালের তেমন কোনও রোমাঞ্চ বোধ হলো না। একেবারেই সাধারণ একটি সাদা রঙের ভবন। যার চারপাশে সর্বক্ষণ টহল দিয়ে কড়া পাহারা দিচ্ছে নিরাপত্তা বাহিনী। তবে এই ভবনটিই বিশ্ব জনপ্রিয় নেতা বারাক ওবামার এক কালের বাসস্থান ছিল, এটা মনে পড়ায় কিঞ্চিৎ পুলকিত হলো সে মনে মনে। 

মন বিশেষ ভালো ছিল না। স্বস্তি ছিল না, তবুও টু শব্দটি না করে বাধ্য মেয়ের মতো ঘুরেছে নাবিলা আর ফাহাদের সাথে। ঘোরা শেষে নাবিলাকে ওর বাসায় ড্রপ করে এসেছে সে আর ফাহাদ। গাড়ি থেকে নামার আগে নাবিলা খুব জরুরি গলায় বলেছে, ‘তুই অবশ্যই আরশানকে সরি বলবি। ভুলে যাবি না। লিসেন হি ইজ গোয়িং টু বি ইওর ব্রাদার ইন ল। ট্রাই টু হ্যাভ সাম রেস্পেক্ট।’ 

সকাল হ্যাঁ, না কিছুই বলেনি। কিন্তু ভেতরে ভেতরে একটা অপরাধ বোধ তাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। আরশানকে কোথায় পাবে সে? ঐ মানুষটা থাকে পাতাল ঘরে। সবার চোখের আড়ালে। ঐ অদ্ভুত রহস্যময় মানুষটার হদিশ পাওয়া কি এতই সহজ? ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল সকাল। ঘুম ভাঙলো মাঝ রাত্তিরে। বেহালার সুরে। 

ধড়ফড়িয়ে উঠে বারান্দায় ছুটে গেলো সে। কাউকে বলে দিতে হলো না সে নিজেই বুঝে নিলো আরশান বাড়িতে আছে। ঐ বেহালাবাদক আরশান ছাড়া অন্য কেউ নয়। 

.

কিন্তু ভায়োলিনের যে শুধু সুরই শোনা যায়। গভীর রাতের নিকষ কালো আঁধারে সুরের স্রষ্টাকে কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না। 

অনেক অনেকক্ষণ অবধি বসে রইল সে বারান্দায়। একটা সময় ভায়োলিনের সুর থামলো। কিন্তু জঙ্গলের ধারে লম্বা ভূতের মতো লোকটাকে আজ আর দেখা গেলো না। শুধু হঠাৎ একটিবারের জন্য মনে হলো কেউ একজন গাছের তলা দিয়ে, ঝোপ ঝাড়ে কাঁপন তুলে জঙ্গলের দিকে হেঁটে গেলো। 

তারপর ক্রমাগত ঝিঁঝি পোকার শব্দ। হঠাৎ হঠাৎ প্যাঁচার ডাক আর উষ্ণ বাতাসের ফিসফাস। আজ আকাশে তারা নেই। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। 

বিন্দুবাসিনী নিভৃতে এসে দাড়ালো তার পাশে।

—‘শেহজাদী আপনি কাজটা ঠিক করেননি।’ 

—‘জানি, খুব বড় বোকামি করে ফেলেছি। এখন কী করবো বলতো?’

—‘আপনার সখি ঠিকই বলেছেন। আপনার উচিত ক্ষমা চাওয়া।’ 

সকাল কুঁকড়ে যায়। মুষড়ে যায়। ভালো লাগে না তার। ঐ মানুষটার মুখোমুখি হতে ভয় পায় সে। একটা অকারণ অযৌক্তিক গা শিরশিরে ভয়। নিজেকে নিজে বুঝে উঠতে পারে না সে। জীবন বিস্বাদ লাগে। 

নাহ থাকবে না সকাল এই বাজে দেশে। চলে যাবে। কালকেই চাচিকে বলবে সে। তবে এতো টাকা খরচ করে আসার পর অন্তত একটা মাস থেকে না গেলে বাবা ভীষণ রাগ হবেন। বাবা মেনে নেবেন না তার এই সিদ্ধান্ত, সকাল জানে। 

একটু বাদে পূবের আকাশ লালচে হওয়া শুরু করলো। জঙ্গলের ভেতর প্লাবিত হলো ভোরের স্নিগ্ধ হাওয়া। নানা রঙের নানা জাতের পাখি কিচির মিচির করে গাছে গাছে, ডালে ডালে উড়ে বেড়াতে লাগলো। তার মাঝে একটি ছোট্ট লালরঙা পাখি, কী যে সুন্দর! পাখিটার নাম জানে না সকাল। ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে এই ঝোপ থেকে ওই ঝোপে উড়ে বেড়াচ্ছে। টিউ টিউ করে ডাকছে। তার সারা রাতের ক্লান্তি আর দুশ্চিন্তা এই আশ্চর্য সুন্দর মায়াবী ভোরের আগমনে মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে গেলো। 

সেই সময় ভোরের আবছা মন কেমন করা নরম আলোয় সকাল দেখলো একটা লম্বা মানুষ জঙ্গলের ভেতর থেকে, ডাল পাতা, ঝোপঝাড় মাড়িয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে আসছে। আরশান। তার গায়ে ছাই রঙের টি শার্ট। কালো হাফ প্যান্ট। আশ্চর্য! এই ছেলে কি সারারাত বনের মধ্যে ছিল? 

সকাল বসা থেকে চট করে উঠে পড়ল। বারান্দার রেলিঙে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ডাকলো, ‘এইযে! শুনুন একটু। শুনছেন আপনি? 

স্নিগ্ধ, মসৃণ, শব্দহীন, নীরব ভোরে সকালের আচমকা ডাকটা শুনে একটু চমকে উঠল আরশান। মাথা উঁচু করে চাইলো বারান্দায় দাড়ানো সকালের দিকে। তার চোখজোড়া সকালের নাক, মুখ, চুল সব ঘুরে এসে অবশেষে থামলো ওর সুন্দর নিখুঁত ঠোঁট যুগলের কাছে। কয়েকটা মুহূর্ত কাটলো নিঃশব্দে। সকাল ঝুঁকে দাঁড়িয়েছিল রেলিঙে ভর দিয়ে। তার পরনে রাতের ঘুমানোর পোশাক। ঢেউ খেলানো চুলগুলো এসে পড়েছে বুকের ওপর। চোখ দুটো একটু ফোলা। ভোরবেলার রেশমী ঐন্দ্রজালিক আলোয় তার রূপ তখন অপার্থিব। 

আরশানই কথা বলল, ‘কিছু বললেন?’ 

—‘জি।’ 

—‘বলুন, কী চাই?’ 

ওই আত্মম্ভরী, হামবড়া প্রশ্নের ধরন দেখে সকাল একটু বিচলিত হলো। কোন কুলক্ষণে যে সে কথা বলতে গিয়েছিল এই ডাঁটিয়াল লোকটার সঙ্গে। সকাল একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো। বলল, 

—‘একটু কথা ছিল আপনার সাথে।’ 

—‘বলুন।’ 

—‘এক মিনিট। আমি আসছি।’ বলে সকাল তড়িঘড়ি করে গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে নিয়ে, পায়ে চপ্পল লাগিয়ে, সিঁড়ি ভেঙে নেমে আসলো। কাঠের সিঁড়িতে পা রাখলেই ভুবন কাঁপানো আওয়াজ হয়। চারপাশ নিশ্ছিদ্র নীরব হওয়ায় নিজের পায়ের আওয়াজ নিজের কানে ভূতের মতো লাগে। সকালের মনে হলো বাড়ির লোকেরা সব ঘুমিয়ে থাকলেও এই শব্দে বুঝি তাদের ঘুম ভেঙে যাবে। মনে হতেই সে সংযত হলো। পা টিপে টিপে এগোতে লাগল। দরজা খুললো সন্তর্পণে 1 

বাইরে বেরোবার পর আবিষ্কার করলো যে বস্তুত আরশান দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির পেছন দিকে এবং সে বেরিয়ে এসেছে সামনের দিক দিয়ে। অতএব ব্যাক ইয়ার্ডে যাবার রাস্তা খুঁজে বের করতে হবে। তখনও অন্ধকার সম্পূর্ণ কাটেনি। এদিক-সেদিক ঝুলছে মাকড়সার জালের মতো। বাগানে ফুটে থাকা রঙ বেরঙের ফুলগুলো হাওয়ায় কাঁপছে তিরতির করে। গ্রীষ্মকাল হলেও ভোরের বাতাস ঠান্ডা। একটু একটু শীত করছিল সকালের। খেয়াল করলো বাগানের পাশ ঘেঁষে বাড়ির পেছন দিকে চলে গেছে সরু একটি মাটির রাস্তা। ঢালু হয়ে নেমেছে দুই তিন ফিট নিচে। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলো সে। ঢালু পথ দিয়ে নামতে নামতে দেখা গেলো সরু রাস্তার পাশে থোকায় থোকায় ফুটে আছে নীল রঙের কতক জংলী ফুল। দেখে সকালের চোখ জুড়িয়ে গেলো। সে মোহাবিষ্ট হয়ে হাত বাড়িয়ে ছিঁড়ে নিলো তিন চারটি ফুল। গুঁজলো কানের কাছে। তার পরনের নাইটিটিও হালকা নীল রঙের। বেশ মানিয়ে গেলো ফুলের রঙের সাথে। আমেরিকার শুধু একটি দিকই সকালকে ভীষণভাবে আলোড়িত করেছে। সেটি হলো এদেশের প্রাকৃতিক শোভা। প্রকৃতিকে কী করে ভালোবেসে বুকে আগলে রাখতে হয় সে বিষয়ে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর শিক্ষা নেয়া উচিত প্রথম বিশ্বের দেশগুলোর কাছ থেকে। 

আরশান দাঁড়িয়ে আছে ঠায়। সকালকে দেখামাত্র ঝাঁঝের সাথে বলে উঠল, ‘এই আপনার এক মিনিট? টানা পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে আছি।’ বলতে বলতে ওর চোখ পড়ল সকালের কানের পাশে গোঁজা ফুলগুলোর দিকে। একটু বুঝি বিদ্রুপের হাসি ফুটে উঠল ওর ঠোঁটে। বলল, ‘সাজগোজ করে আসবেন যেহেতু, এক মিনিট বললেন কেন? আরেকটু বাড়িয়েই বলতেন সময়টা।’ 

আচ্ছা মুশকিল তো! এমন কূটবুদ্ধি সম্পন্ন পুরুষ মানুষ সকাল জীবনে এর আগে কোনোদিন দেখেছে বলে মনে পড়ল না। কথার ধরন দেখলে গায়ে জ্বালা ধরে যায়। সকাল রাগ সামলে বলল, 

—‘সাজগোজের কী দেখলেন? চলতে চলতে এই সুন্দর ফুলগুলো দেখলাম। এই ফুল আমি চিনি না। তাই কৌতূহল বশত তুলে নিলাম।’ 

—‘এর নাম ভার্জিনিয়া ব্লুবেলস। ওয়াইল্ড ফ্লাওয়ার। তবে গার্ডেনেও চাইলে কাল্টিভেট করা যায়।’ 

বলে আরশান সকালকে আরেকবার ভালো মতো দেখে নেয় তার বড় বড় পাঁপড়ি ওয়ালা চোখ দুটো মেলে। তার চোখদুটি ভারি মনোহর কিন্তু চাউনি অতিশয় তির্যক এবং তেজালো। সকাল ব্রিত বোধ করে। গায়ের চাদরটা ভালোমতো টেনেটুনে জড়িয়ে নেয় সর্বাঙ্গে। 

—‘যাই হোক। কিছু বলার আছে আপনার?’ আরশানের কাঠ কাঠ প্রশ্ন। মেয়েটিকে তার খুব একটা সুবিধার মনে হচ্ছে না। প্রথম এবং দ্বিতীয় সাক্ষাতে এই মেয়ে উপর্যুপরি তাকে অপদস্থ করার চেষ্টা করেছে। আজ পর্যন্ত অন্য কোনো ব্যক্তি তার সাথে এতটা অফেন্সিভ আচরণ করতে পারেনি। এখন এই ভোরবেলায় মেয়েটি ঠিক কী মতলবে তার কাছে এসেছে তা বোঝা যাচ্ছে না। 

—‘আসলে…’ 

—‘শুনুন, আমার হাতে যাও চার পাঁচ মিনিট সময় ছিল, তা আপনি সাজগোজের পেছনে খরচ করে ফেলেছেন। এখন আমার সময় নেই। আমি দৌড়োতে যাব, শাওয়ার নিব, ব্রেকফাস্ট করবো, রেডি হব এবং অফিস যাবো। অফিস পৌঁছুতে হবে দশটার আগে। অতএব আমাকে এখন যেতে হবে। তবে হ্যাঁ কথা হতে পারে ব্রেকফাস্টের টেবিলে।’ 

আরশানের চটাং চটাং কথা শুনে সকাল কাঁচুমাচু হয়ে যাচ্ছিল। আর ওই কাঁচুমাচু চেহারা দেখে আরশান ভেতরে ভেতরে মজা পাচ্ছিল। সে তারিয়ে তারিয়ে বলল, 

—‘অতএব আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে।’ 

সকাল কোনো রকমে শুধু বলতে পারলো, ‘ও!’ 

—‘আপনি চাইলে ওয়াক করে আসতে পারেন, এই সময়টুকুতে।’

—‘ওয়াক?’ 

—‘হ্যাঁ মর্নিং ওয়াক।’

—‘আচ্ছা।’ সকালকে বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে। সে ঠিক বুঝতে পারছে না কী করা উচিত। কী বলা উচিত 

—‘চাইলে আমার সাথে আসতে পারেন। 

—‘আপনার সাথে?’ 

—‘হ্যাঁ আমার সাথে। 

—‘আচ্ছা আমি তাহলে তৈরি হয়ে আসছি।’ 

—‘ও সাজগোজ করবেন? তাহলে এক কাজ করুন আপনি সাজগোজ শুরু করে দিন। ওটা করতে করতেই আমার সব কাজ শেষ হয়ে যাবে। দেন উই ক্যান হ্যাভ ব্রেকফাস্ট টুগেদার। বায়।’ বলে আরশান আর দাড়ালো না। সকাল দাঁতে দাঁত চেপে ওর চলে যাওয়া দেখলো। একটা মানুষ এতো অসভ্য আর অভদ্র কী করে হয়? মরে গেলেও একে সরি বলবে না সে। সরি পাবার মতো কোনো যোগ্যতা এর নেই। 

সকাল ওপরে নিজের ঘরে এসে তৈরি হয়ে নিলো। না আরশানের সাথে নয়, নিজে একা একাই যাবে সে মর্নিং ওয়াকে। আসার পর থেকে আশপাশটা একবারও ঘুরে দেখা হয়নি। কালো ট্রাউজার, সাদা টি শার্ট আর কেড্স পরে, চুল বেঁধে নিয়ে নিচে নেমে আসলো সে। নামার পর প্যাটিওতে যখন আরশানকে দেখলো তখন অনুভব করলো যে মনে মনে সে এমনটাই চাইছিল। আরশানকে বোঝাতে চেয়েছিল যে সাজগোজ করতে গিয়ে অযথা সময় নষ্ট করার মতো মেয়ে সে না। আরশান চেয়ারে বসে জুতোর ফিতে বাঁধছিল। মুখ তুলে সকালকে এক নজর দেখে নিয়ে বলল, ‘ওয়াও! সো ফ্যাস্ট!’ 

সকাল তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। বোঝাতে চাইলো যে এসব সস্তা তারিফে তার কিছু এসে যায় না। 

জুতো ঠিক করে নিয়ে আরশান উঠে দাড়ালো। দু’ তিনটা লাফ ঝাঁপ দিয়ে শরীর গরম করে নিতে নিতে সে বলল, ‘চলুন যাওয়া যাক।’ 

তালগাছের মতো লম্বা, চওড়া সুঠাম দেহের আরশানকো বাচ্চাদের মতো লাফাতে দেখে সকাল হেসে ফেললো। 

—‘হাসছেন কেন?’ আর ঠিক তখন, আরশান আবিষ্কার করলো সকাল হাসলে তার গালে টোল পড়ে। মেয়েটা খুব কম হাসে। অথচ হাসলে কী ভীষণ ভালো দেখায়! 

—‘এমনি।’ হাসি চাপিয়ে বলল সকাল। 

—‘স্ট্রেঞ্জ!’ বলে আরশান কয়েক লাফে উঠোন পার হয়ে গেলো। সকালও এগোলো তার পেছন পেছন। রাস্তায় ফুটপাতে উঠে মানুষ জনের আনাগোনা দেখা গেলো। একটি কালো ছেলে কুকুর নিয়ে হাঁটতে বের হয়েছে। কুকুরটির গায়ের রং ফর্সা সাদা। মনিবের ঠিক বিপরীত। সকালদের দেখে ছেলেটি সহাস্যে বলে উঠল, ‘হাই দেয়ার! গুড মর্নিং।’ 

সকাল হেসে ‘গুড মর্নিং’ বলল। একটি বেগুনি চুলো মেয়ে হাফ প্যান্ট আর টেন টপ পরে দৌড়ে গেলো ওদের পাশ দিয়ে। যেতে যেতে হাত নেড়ে ‘গুড মর্নিং’ বলতে ভুলল না। আরশান বলল, ‘আপনি যেমন গদাই লস্করী চালে হাঁটছেন। তাতে তো মনে হচ্ছে মেইন রাস্তায় উঠতেই সন্ধ্যা হয়ে যাবে। আমি চললাম। আপনি চাইলে আমাকে ফলো করতে পারেন। কিন্তু ভুলেও হারিয়ে যেয়েন না।’ 

এরপর দৌড়োতে শুরু করলো সে। লম্বা লম্বা পা ফেলে মুহূর্তের মধ্যে কয়েকশ গজ দূরে চলে গেলো সকালকে ফেলে। সকাল হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ। তারপর আগপিছ কিছু চিন্তা না করে শুরু করলো দৌড়। 

দেশে সে রোজ নিয়ম করে যোগব্যায়াম করে। সপ্তাহে দুদিন যোগব্যায়ামের ক্লাসে যায়। শরীর তার মোটামুটি ফিট। কিন্তু এমন খোলা আকাশের নিচে প্রাণপণে দৌড় দেয়া তার জীবনে এইই প্রথম। বাতাস কেটে কেটে বাড়িঘর, বন জঙ্গল পেছনে ফেলে রেখে দৌড়োতে লাগলো সে ফুটপাথ ধরে। সে একা নয়, দৌড়াচ্ছে আরো অনেকেই। কেউ কারো দিকে ভ্রুক্ষেপ মাত্র করছে না। চোখে চোখ পড়ে গেলে শুধু ভদ্রতার হাসি দিচ্ছে। আকাশে সদ্য ফোটা দিনের আলো। হাওয়া বিশুদ্ধ। গাছেগাছে পাখিরা তখনও নিরবচ্ছিন্ন ডেকে যাচ্ছে। রাস্তায় গাড়িঘোড়া বেরিয়ে গেলেও কালো ধোঁয়া নেই। অযথা হর্ন দিয়ে কেউ কাউকে বিরক্ত করছে না। একটি দুটি ছেলে-মেয়ে আপন মনে সাইকেল চালাচ্ছে। একটি বাচ্চা মেয়ে এক পায়ে চালাচ্ছে স্কুটার। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে এরা প্রাতঃকালীন কার্যকলাপ শেষ করে সকাল দশটার মধ্যে যার যার মতো কর্মক্ষেত্রে চলে যাবে। এদের জীবন চলে রুটিন মাফিক। ছুটির দিনেও খেয়াল করেছে সকাল, এদের দিন শুরু হয় খুব ভোরবেলায়। বাঙালিরা ছুটির দিন পেলে সারা সপ্তাহের ঘুম একবারে ঘুমিয়ে নিতে চায়। বেলা পর্যন্ত বিছানায় গড়াগড়ি করে। দুপুরের খাবার বিকেলে খায়, বিকেলের খাবার রাতে। কিন্তু পশ্চিমাদের কাছে জীবনের অর্থ অন্যরকম। স্বাস্থ্য নিয়ে এরা কোনো রকম আপস করে না। 

রাস্তার মানুষগুলোর মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই। কেউ সাইকেল, কেউ পায়ে হেঁটে, কেউবা গাড়িতে চড়ে বেড়ালেও প্রতিটি মানুষ এখানে সমমর্যাদায় অধিষ্ঠিত। প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের সবচেয়ে বড় তফাৎটা এখানেই। 

পাশ্চাত্য সমাজে সবাই সমান। কে গরিব, কে বিত্তবান, তা এক নজরে বোঝার কোনো উপায় নেই। সুইপারকেও এখানে লোকে হাসিমুখে ধন্যবাদ দিতে ভুলে না। অথচ বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ রিক্সাওয়ালা – বা কাজের লোককে একটি বিনে পয়সার ধন্যবাদ দিতে কতটাই না কার্পণ্য বোধ করে। 

টানা দশ মিনিট দৌড়নোর পর সকাল হাঁপিয়ে উঠল। হাঁটুতে হাতদুটো রেখে কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস নিতে থাকলো সে। দর দর করে ঘামতে লাগলো। বুক করতে লাগলো ধড়ফড়। আরশান পেছন ফিরে তাকিয়ে সকালের দুরবস্থা দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। কোমরে হাত দিয়ে সরু চোখে চেয়ে দেখলো খানিকক্ষণ সকালের কাণ্ড। তারপর উল্টো পথ ধরে ঝড়ের বেগে দৌড়ে মুহূর্তের মাঝে হাজির হলো সে সকালের সম্মুখে। মেকি উদ্বেগ নিয়ে বলল, 

—‘সেকী! মরে যাচ্ছেন নাকি?’ 

সকাল তীক্ষ্ণ ফলার মতো ধারালো দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ওর মুখে। তার গলা দিয়ে কথা বেরুচ্ছে না। গলা শুকিয়ে কাঠ 1 

—‘পানি খাবেন? ও সরি, পানি তো নেই আমার কাছে।’ 

সকাল বলল না কিছু। হাঁসফাঁস করতে থাকলো। মুখ হা করে দম নিতে থাকলো। 

—‘এই অবস্থা কেন? খাওয়া দাওয়া করেন না কিছু? বাবা মা খাওয়া দেয়না?’ 

জ্বলন্ত চোখে চাইলো আবার সকাল আরশানের দিকে। এটা কি মানুষ? নাকি অন্য কিছু? 

—‘এভাবে তাকাচ্ছেন কেন? ভুল কিছু তো বলিনি।’ 

সেই মুহূর্তে একটি সাদা চামড়ার ছিপছিপে দেহের মেয়ে ঝড়ের বেগে ওদের অতিক্রম করে গেলো। আরশান মেয়েটিকে ইঙ্গিত করে সকালকে বলল, 

—‘দেখুন, কিভাবে দৌড়তে হয় দেখুন। আপনি তো দেখি ফার্মের মুরগী। কয়েক কদম হেঁটেই কাত হয়ে গেলেন?’ 

সকাল কোনো কথা না বাড়িয়ে আরশানকে রেখে ছুট দিলো আচমকা। এই হামবড়া ছেলেটা তাকে ফার্মের মুরগী বলল? সে জানে না সকাল কী জিনিস। কোনো ভাবেই হারবে না সকাল।এবার দেখো আরশান সাহেব, সকালকে তুমি আর নাগালে পাও কিনা। 

সকাল ছুট দেবার সাথে সাথে আরশানও আর দাঁড়িয়ে রইল না। দৌড়নো আরম্ভ করলো। কিন্তু সকালের গতি এবার সত্যি মারাত্মক। বেপরোয়া আরশান ছুটতে লাগলো প্রাণপণে। ছুটতে ছুটতে অন্যমনস্ক, সকাল একটি ভুল করে ফেললো। নেইবারহুডের ফুটপাথ ছাড়িয়ে আগ পিছ চিন্তা না করে মূল রাস্তায় উঠে পড়ল সে। দ্বিমুখী একটি দুই লেনের রাস্তা। সেই রাস্তায় জেব্রা ক্রসিং নেই। অতএব পথচারীদের এ পথ দিয়ে রাস্তা পার হওয়ার কথা না। দু দিক থেকেই গাড়ি আসছে। এসব রাস্তার স্পিড লিমিট পঁয়ত্রিশ বেঁধে দেয়া হলেও কিছু গাড়ি চল্লিশের ওপরে তুলে ফেলে অনায়াসে। সেই রকম চল্লিশের ওপরে চলতে থাকা একটি লাল রঙের জিপ গাড়ির সামনে গিয়ে পড়ল সকাল। গাড়িটি বিকট শব্দে ব্রেক কষে থেমে পড়ল মাঝ রাস্তায়। ভাগ্যিস এর ঠিক পেছনে বা কাছাকাছি দূরত্বে অন্য কোনো যানবাহন ছিল না। থাকলে এই আচমকা গতিরোধের কারণে পেছনের গাড়িগুলো মুখ থুবড়ে পড়তে পারত জিপ গাড়ির ওপরে। একটি বৈনাশিক দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারত চোখের নিমেষে। সকাল ঘটনার আকস্মিকতায় পাথর হয়ে গেছে। তার এবং ব্রেক কষে থেমে যাওয়া গাড়িটির মধ্যিখানে দূরত্ব দেড় হাত। একেই বলে দৈবক্রমে বেঁচে যাওয়া। জিপ গাড়ির পেছনে ধীরে ধীরে আরো গোটা তিনেক গাড়ির লাইন পড়তে থাকল। 

সকাল হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কাঁপন ছড়িয়ে যাচ্ছে সর্বাঙ্গে। আশেপাশের পথচারীদের সবকটা চোখ তার ওপর নিবদ্ধ। 

জানালার কাচ নামিয়ে একটি কালো হোঁৎকা গোছের লোক ক্ষুদ্ধ গলায় বলে উঠল, ‘ইউ স্টুপিড থিংগ! রাস্তার মাঝখানে কি করছ? ইউ কুড হ্যাভ ডাইড রাইট হেয়ার।’ 

আতঙ্কে সকাল কাগজের মতো সাদা হয়ে গেছে। তার মুখ নড়ছে না। ঠিক সেই মুহূর্তে দুটি সবল পুরুষালী হাত রাস্তার মাঝখান থেকে তাকে সযত্নে টেনে নিয়ে আসলো কিনারে। সকাল মুখ তুলে দেখলো আরশানকে। সে শক্ত করে আরশানের হাত চেপে ধরলো। তার চক্ষু দুটি বিস্ফারিত। ওষ্ঠদ্বয় কম্পিত। জিপ গাড়ির ড্রাইভারকে আরশান বলল, ‘এক্সট্রিমলি সরি, আসলে ওর একটু তাড়া ছিল। তাই কোনো দিকে খেয়াল না করে ছুটছিল। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ গাড়ি থামানোর জন্য। তুমি একজন প্রাণ রক্ষাকারী।’ ড্রাইভার শান্ত হলো না। সে উত্তেজিত গলায় বলল, ‘তোমার গার্লফ্রেন্ডকে সামলাও ম্যান। আরেকটু হলেই আমার হাতে মার্ডার হয়ে যেত। জেল যাওয়া লাগতো আমার।’ 

পেছনের গাড়ি গুলো অধৈর্য হয়ে হর্ন দেয়া শুরু করেছে। অগত্যা জিপ ড্রাইভারকে গালাগালিতে ইস্তফা দিয়ে গাড়ি টান দিতে হলো। 

তারপর কয়েক সেকেন্ড কাটলো স্থবিরতায়। যেমন ছিল তেমনিই দাঁড়িয়ে রইল সকাল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যারা দৃশ্যটা দেখছিল তাদের মধ্যে থেকে একজন বয়স্ক সাদা ভদ্রলোক ভারি করুণ গলায় আরশানকে বলল, ‘গড সেভ করেছে তোমাদের। আজকে তুমি তোমার ভালোবাসার মানুষটিকে হারিয়ে ফেলতে পারতে। খুব বড় বাঁচা বেঁচে গেছ।’ 

আরশান কী বলবে খুঁজে পেলো না। মনে মনে বলল, ভালোবাসার মানুষ না ছাই, সাক্ষাৎ আপদ একটা। কোনোরকমে ঘাড় নাড়লো সে ভদ্রলোকের কথায়। সম্মতি জানালো নাকি অসম্মতি তা ঠিক বোঝা গেলো না। সকালের বুকের ধুকপুকানি শুনতে পাচ্ছে সে। মেয়েটার চোখে এখনও আতঙ্ক। সুন্দর ঠোঁটদুটো থেকে থেকে কেঁপে উঠছে। আরশান এক সময় বলল, ‘আপনি ঠিক আছেন?’ 

সকাল ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে সায় দিলো। ঠিক আছে সে এখন।

—‘তাহলে এখন আমার হাতটা ছাড়ুন!’ আরশান বলল অস্বস্তি নিয়ে চাপা গলায়। 

সকাল অপ্রস্তুত হয়ে আরশানের হাতটা ছাড়লো। 

বাড়ি ফেরার পথটায় অনেকক্ষণ ওরা কেউ কোনো কথা বলল না। আরশান খানিক বাদে বাদে সকালের দিকে নিবিড় চোখে চাইছিল শুধু। কী ভাবছিল, কী দেখছিল তা সে নিজেই জানে। ততক্ষণে রোদ চড়ে গেছে আকাশে। তেজী নয়, মিষ্টি একটা রেশমী রোদ্দুর। ওরা ফিরছে অন্য পথ দিয়ে। একটা পার্কের ভেতরের সাজানো-গোছানো চমৎকার মাটির বনপথ দিয়ে। আরশানের ঐ ঘন ঘন চেয়ে থাকা দেখে সকাল উসখুস করে উঠে বলল, 

—‘কী দেখছেন তাকিয়ে তাকিয়ে?’ 

আরশান একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বলে, ‘দেখছি না, ভাবছি।’ 

—‘কী ভাবছেন?’ 

—‘ভাবছি মানুষ কী করে এতটা নির্বোধ হতে পারে।’ 

—‘নির্বোধ বলতে চাইছেন আপনি আমাকে?’ 

—‘হ্যাঁ বলতে চাইছিলাম এবং বলেও ফেললাম। কী করে করলেন আপনি এমন আহাম্মকের মতো একটা কাজ?’ 

সকালের মুখ খানা অপমানে থম থম করে উঠল। সে জানে যে সে বিশাল বড় একটা ভুল করে ফেলেছে। এই মানুষটা পাশে না থাকলে অচিন দেশের অচিন পথে তাকে নাস্তানাবুদ হতে হত। এই মানুষটা গিয়ে পাশে দাড়ানোতেই সে বল ফিরে পেয়েছে। সে জানে দোষ ষোলো আনাই তার। কিন্তু অমন হাবিজাবি উসকানি মূলক কথা না বললে তো সকালের জেদ চাপতো না তাইনা? অমন ভর্ৎসনার সুরে তাকে ফার্মের মুরগী বলাতেই তো সে উঠেপড়ে দৌড় লাগালো। অতএব দোষ শুধু সকালের একার না। সকাল মুখ ভোঁতা করে বলল, 

—‘দোষ আপনারও হয়েছে।’ 

আরশান চমকে উঠে বলল, ‘আমার দোষ? আমি বলেছি আপনাকে গাধার মতো মাঝ রাস্তায় গিয়ে জগিং করতে?’ 

—‘না তা বলেননি কিন্তু ফার্মের মুরগী বললেন কেন? ওটা না বললে তো আর আমি ওভাবে ছুটতাম না।’ 

কথা শুনে আরশান ভারি হতাশ একটা নিশ্বাস ফেললো, ‘আপনি সত্যি পাগল। জানেন আপনি? আপনি যে পাগল?’ 

—‘আমি মোটেও পাগল নই। আপনি পাগল।’ 

—‘আমি না, আপনি। পাগল বলেই রোজ রাতে বারান্দায় বসে একলা একলা কথা বলেন। হাসেন। নাচেন, আরো কত কী করেন সব জানি আমি।’ 

সকাল বিস্ময়ে ফেটে পড়ে বলল, ‘সর্বনাশ! আপনি কী করে জানেন এসব?’ 

—‘বললাম তো, আমি সব জানি। জেনে শুনেই বলছি যে আপনার মাথা খারাপ।’ 

ভারি রাগ হয়ে গেলো সকালের। এতো স্পর্ধা কোথেকে পায় এই ছেলেটা? মুখের কোনো লাগাম নেই! 

—‘আমার মাথা খারাপ তাই না? আর আপনার মাথাটা তো একদম ঠিকঠাক। তাই তো মাঝরাতে ভায়োলিন বাজিয়ে লোকের ঘুম হারাম করেন। তারপর ভূতের মতো অন্ধকার গাছের নিচে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মেয়ে দেখেন। জঙ্গলে রাত কাটান। এসবই তো ঠিক ঠাক মাথার লক্ষণ, তাই না?’ 

—‘হ্যাংগ অন, হ্যাংগ অন। মেয়ে দেখি মানে কী?’ 

—‘মানে বোঝেন না? মাঝ রাতে গাছতলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাকে দেখেন কেন শুনি? হ্যাঁ? মতলব কী আপনার?’ 

আরশান বিরক্ত গলায় বলে ওঠে, ‘যতসব ফালতু কথা আপনার। সেদিন রাতে হঠাৎ চোখ পড়ল আমাদের বাড়ির বারান্দায় অচেনা একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাই কৌতূহল বশত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করলাম আপনাকে। ব্যাস এতটুকুই।’ 

এই রাস্তাটা ওদের বাড়ির ব্যাক ইয়ার্ডের সাথে লাগোয়া। উঠোনে এসে আরশান বলল, ‘আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন। আমি ঝটপট একটা শাওয়ার নিয়ে ব্রেকফাস্ট রেডি করছি।’ 

সকালের মনে পড়ল। এই ছেলেটাকে তার সরি বলার ছিল। একটা ‘সরি’ বলতে গিয়ে কত কী ঘটে গেলো। দুই মিনিটের জন্যে কথা বলতে গিয়ে বাঁধা পড়ে গেলো ঘণ্টার পর ঘণ্টায়। তবে সকাল সূক্ষ্মভাবে টের পাচ্ছিল যে অস্বস্তি, বিরক্তি, ভয়, সংকোচ সমস্তকে ছাপিয়ে অন্যরকম একটি অনুভূতি তার সমস্ত ভেতরটাকে আবিষ্ট করে তুলছিল ক্রমে ক্রমে। সেই অনুভূতিটির নাম ভালোলাগা। ভালো লাগাতে তো দোষের কিছু নেই। জীবনের এইসব ছোট ছোট ভালো লাগাকে দাম দিতে হয়। অথচ আজ ভোরবেলাতেও এই মানুষটা ছিল তার চক্ষুশূল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে যেন আরেকটু সময় এর সাথে কাটাতে না পারলে কোথাও কিছু একটা ভীষণ ক্ষতি হয়ে যাবে। 

সকাল বলল, ‘আপনার শাওয়ার নিতে কতক্ষণ লাগবে?’ 

—‘পাঁচ মিনিট?’ 

—‘ঠিক আছে, আমি আসছি।’ 

সকাল চলে যাবার পর আরশান খুব দ্রুত গোসল সেরে নিলো। এ তার রোজকার রুটিন। রুটিনের হেরফের হয় খুব কম। সে একা মানুষ। বাড়ির অন্যান্য সদস্যরা তাকে খুব একটা বিরক্ত করে না। বাবা মাঝে মাঝে ভালো কিছু রান্না হলে বা জরুরি কথা থাকলে ডেকে পাঠায়। এছাড়া শুক্রবার দিনে বাবা আর ভাইয়ের সাথে একত্রে মসজিদে গিয়ে জুম্মার নামাজটা আদায় করতে হয়। ব্যাস এইটুকুই তার পারিবারিক জীবন। ওপর তলার কক্ষগুলোতে তার যাতায়াত নেই বহু বহু দিন। দরকারও পড়ে না। নিচে বেজমেন্টে তার বেডরুম, লিভিং রুম সবই আছে। শুধু চুলার ব্যবস্থা না থাকায় বাইরে ডেকের ওপর একটি গ্যাস স্টোভ বসিয়েছে সে। নিজের রান্নাবান্না ওখানেই সেরে নেয়। পারিবারিক জীবন খুব একটা মিস করে না। একটা সময় ছিল যখন সত্যিকারের একজন মায়ের অভাব বোধ করতো ভীষণভাবে। ফাহাদের মা আর তার নিজের বাবার দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে যে পরিবারটা তাতে নিজেকে মানিয়ে নেবার বৃথা চেষ্টা করেছে টানা অনেক গুলো বছর। লাভ কিছুই হয়নি। ক্রমে নিজেকে নিজে একজন অবাঞ্ছিত, অযাচিত সদস্য হিসেবে আবিষ্কার করেছে শুধু। ভাগ্যের লিখন কি কেউ খণ্ডাতে পারে? 

তার অবশ্য একলা থাকতে খারাপ লাগে না আজকাল। বাবার জন্যই পড়ে থাকা এ বাড়িতে। বয়স আটাশ হলো। এত বয়স পর্যন্ত এ দেশের ছেলে-মেয়েরা বাবা মায়ের সাথে এক বাড়িতে থাকে না। তারা আত্মনির্ভরশীল হতে চায়। আরশানও আর চায় না বিনা পয়সার এই আশ্রয়স্থল। ভাড়া হিসেবে বাবাকে কিছু টাকা দেয়ার চিন্তা করছে সে। কয়েকবার বাবার সামনে কথাটা তুলেছে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। বাবা নাকচ করে দিয়েছেন। বলেছেন, ‘শোনো হে, তোমরা নিজেদের আমেরিকান মনে করলে অনেক বড় ভুল করবে। তোমাদের রক্তে বাংলাদেশ আছে। বাংলাদেশের সংস্কৃতি আছে। সেই সংস্কৃতিকে ভুলে যাবার দুঃসাহস কখনো করো না।’ 

বাংলাদেশ! হ্যাঁ বাংলাদেশে আরশানের কেটেছে শৈশবের টানা অনেক গুলো বছর। ফাহাদ আসার পর মাদার যখন ওকে একেবারেই সময় দিতে পারতেন না, বা দিতে চাইতেন না। বাবা তখন আরশানকে বাংলাদেশে নিজের মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। মানিকগঞ্জ, দাদুর বাড়িতে। 

আরশান চটপট ব্রেকফাস্ট তৈরি করে নিলো। তার নাশতা বলতে শুধু সিরিয়াল আর এক কাপ কফি। কিন্তু আজ তো সে একা নয়। অনেক অনেক দিন বাদে অন্য একজন মানুষ আজ তার ঘরে, তার সাথে একত্রে বসে খাবে। আয়োজন তো একটু করতেই হয়! 

ঝটপট দুটা ডিম পোচ করে ফেললো সে। পাউরুটি টোস্ট করে নিলো। ফ্রিজ থেকে বের করে টেবিলে গুছিয়ে রাখলো এগ স্যালাড, স্ট্রবেরি জ্যাম আর টার্কি সালামি। গ্রাইন্ডারে গ্রাইন্ড করে নিলো ফ্রেশ অরেঞ্জ জ্যুস। টেবিলে সাজিয়ে রাখলো প্লেট ছুরি কাটাচামচ। তারপর অফিসে যাবার জন্য তৈরি হয়ে নিয়ে টেবিলে বসে সকালের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। ঘড়িতে বাজে এখন পৌনে আটটা। তাকে বাড়ি থেকে বেরোতে হবে সোয়া নয়টার মাঝে। অতএব ঘণ্টা খানেক সময় পাওয়া গেলো। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *