৫০
তৈরি হতে খুব বেশি সময় নিলো না সকাল। জিন্স আর টি শার্টের ওপর লাল রঙের একটা উইন্ডব্রেকার পরে নিলো। বাইরে খুব বাতাস হয় আজকাল। শীত করে রীতিমতোন।
একটু বাদে দরজায় আবার ধাক্কা পড়ল। খুলে দেখা গেলো শয়তানটা দাঁড়িয়ে আছে। প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে, পা ছড়িয়ে। সকাল ওকে দেখা মাত্র ফুঁসে উঠল,
—‘কোথায় গিয়েছিলেন?’
আরশানের চোখে রাত জাগার ক্লান্তি। মুখ শুকনো। সে মলিন দুখানা চোখ সকালের চোখে রেখে বলল,
—‘গিয়েছিলাম একটা জায়গায়।’
—‘ফিরে এলেন কেন?’
আরশান দুর্বল গলায় বলল, ‘আসতেই হলো।’
নাবিলা সেই সময়টাতে হাজির হলো আবার, বলল, ‘চল চল। রেডি তুই? আরশান ভাই আপনিও চলেন।’
আরশান বলল, ‘কোথায় যাচ্ছো তোমরা?’
—‘ফল কালার দেখতে।’
আরশান আর কথা বাড়ালো না। বলল, ‘বেশ তো, চল।’
আই সিক্সটি সিক্স দিয়ে ফাহাদের গাড়ি চললো শেনেনডোয়া ন্যাশনাল পার্কের উদ্দেশ্যে। ঘড়িতে তখন সকাল এগারোটা। অক্টোবরের সোনালি রোদ দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে এর মাঝেই। ফাহাদ গাড়ি ড্রাইভ করছিল। নাবিলা বসেছে ওর পাশে। সকাল আর আরশান পেছনে। দুজনে দুই প্রান্তে। মাঝখানে এতো খালি জায়গা যে অন্য একজন মানুষ অনায়াসে বসতে পারবে। কেউ কোনো কথা বলছিল না। আরশান ঘাড় ঘুরিয়ে দু একবার দেখলো সকালকে। সকাল ফিরেও তাকালো না। বেশ অনেক ক্ষণ হাইওয়ে দিয়ে গাড়ি চলার পর হঠাৎ দৃশ্যপট পাল্টে গেল।
গাড়িতে তখন জন ডেনভারের বিখ্যাত গান বাজছিল,
Almost heaven, West Virginia
Blue Ridge Mountains, Shenandoah River
Life is old there, older than the trees
Younger than the mountains, blowing like a breeze
Country roads, take me home
To the place I belong
West Virginia, mountain mama
Take me home, country roads
ঝকঝকে রোদ ধোয়া রাস্তার দু’ পাশে ঘন জঙ্গল। কোথাও বা আবার খাদ। কোথাও উপত্যকা। কোথাও কোথাও অরণ্য ফুঁড়ে হঠাৎ উঁকি দিচ্ছে এক দুখানা অভিজাত সুন্দর ছবির মতো বাড়ি। রাস্তার ধারে হরিণ ঘুরে বেড়াচ্ছে নিশ্চিন্তে, ঘাস খাচ্ছে।
সকাল বুঁদ হয়ে ছিল প্রকৃতিতে। চেয়ে থাকতে থাকতে এই পাহাড়ঘেরা জায়গাটিকে তার অলমোস্ট হেভেনই মনে হচ্ছিল। গানের কথার সাথে পাহাড়ের সাথে, রৌদ্রে ডোবা রাস্তার সাথে ক্রমশ মিশে যাচ্ছিল সে। তার বুক থেকে কষ্টগুলো, দুঃখ গুলো,অতৃপ্তিগুলো খসে পড়ছিল ধীরে ধীরে। খানিক বাদে গাড়ি স্কাইলাইন ড্রাইভে উঠল। গাড়ির স্পিড লিমিট বেঁধে দেয়া আছে ঘণ্টায় পঁয়ত্রিশ মাইল। মনে হচ্ছিল যেন মেঘ ভেদ করে ছুটে চলেছে ওরা। ব্লুরিজ মাউন্টেনের কোল ঘেঁষে সাপের মতো এঁকে বেঁকে একশ পাঁচ মাইল দীর্ঘ রূপালি সড়কটি বয়ে চলেছে যেন কোন এক অজানার উদ্দেশ্যে। এই পুরো জায়গাই শেনেনডোয়া ন্যাশনাল পার্কের নিয়ন্ত্রণাধীন। রাস্তার ডান পাশে ঢালু হয়ে পাহাড় নেমে গেছে খাদে। খাদের ওই পাড়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সুবিশাল তিনটি পাহাড়। ধোঁয়া ধোঁয়া উড়ন্ত মেঘের সাথে মিশে গেছে তাদের অস্তিত্ব। বাঁ পাশে রাস্তার ধার ঘেঁষা পাহাড়ের শরীর জুড়ে বেড়ে উঠেছে জঙ্গল। ছোট বড় অসংখ্য পাথর পড়ে আছে ছড়ানো ছিটানো অবস্থায়। পাহাড়ের গায়ে লাল রঙের ছোপ। কোথাও আবার হলুদ, কোথাও সবুজ। ফল সিজন আসতেই গাছের পাতায় পাতায় যে বর্ণিল পরিবর্তনটা আসে তা দেখার জন্য বছরের এ সময় অসংখ্য পর্যটক ভিড় করে এ জায়গায়। আজকেও বেশ ভিড়। পুরো রাস্তা জুড়ে খানিক বাদে বাদে রয়েছে পাহাড় দেখার জন্য পাথুরে দেয়ালের প্রাচীর দেয়া সিনিক ওভার লুক।
সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় চার হাজার ফুট উঁচুতে এসে একটা ভিজিটর স্পটে গাড়ি থামালো ফাহাদ। পাথুরে রেলিং এর পাশের পার্কিং লটে পর্যটকদের তিন চারটি গাড়ি রাখা। নেমে আসলো ওরা। দাড়ালো রেলিং এর ধার ঘেঁষে। রেলিং এর ওপাশেই পাহাড়ি ঢাল। পর্যটকরা চাইলে দেয়ালের ওপর বসতে পারবে। উঠে দাড়াতে পারবে। ছবি তুলতে পারবে।
সকাল বসলো দেয়ালের ওপর পা ঝুলিয়ে। নাবিলা আর ফাহাদ একটু দূরে ছবি তোলায় ব্যস্ত। বুনো ঘ্রাণ বুকে নিয়ে হু হু করে হাওয়া ছুটে আসছে। ধোঁয়াটে মেঘ ভেসে যাচ্ছে গা ছুঁয়ে ছুঁয়ে।
আরশান এসে বসলো ওর পাশে। সকাল তাকালো না। দূরগত এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল সামনে।
—‘কেমন আছেন?’ আরশান প্রশ্ন করলো একটু ভয়ে ভয়ে।
—‘তাতে আপনার কী?’
আরশান কেশে গলা পরিষ্কার করে নিলো। একটু সময় নিয়ে ভাবলো কিছু একটা। বলল,
—‘আপনার সাথে আমার জরুরি একটা কথা আছে।’
জরুরি কথা! লোকটা কি শেষ পর্যন্ত তবে সেই বহু কাঙ্ক্ষিত, আরাধ্য জরুরি কথাটি বলবে আজ? বলবে তো? যে কথাটার জন্য সকাল বুভুক্ষের মতো, তৃষ্ণার্তের মতো অপেক্ষা করছে বহু বহু দিন ধরে?
সকাল দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো, বলল, ‘তার আগে এটা বলুন আপনি গত দুদিন কোথায় ছিলেন?’
—‘নিজেকে একটু সময় দিলাম।’
—‘এতো সময় দেয়ার কী আছে?’
—‘সময় দেয়াটা জরুরি ছিল।’
—‘আচ্ছা বলুন, কী বলবেন।’
বাতাস খুব ঠান্ডা। আরশান ওর জ্যাকেটের হুডি মাথায় তুলে নিলো। পেছনের জঙ্গলে একটা স্কারলেট পাখি শিস দিয়ে ডাকছিল। একটু নিচে পাহাড়ের ঢাল ধরে পুঞ্জিভূত মেঘমালার ভেতর গা ঢাকা দিয়ে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে ঘাস খাচ্ছিল একদল নিরীহ হরিণ।
আরশান বলল, ‘আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
সকালের দমে টান পড়ে। শিহরিত হয়ে ওঠে মনের অন্দরমহল। সিদ্ধান্ত? কীসের সিদ্ধান্ত? সকাল তো কোনো সিদ্ধান্তের কথা শুনতে চায়নি। সে শুনতে চেয়েছিল ভালোবাসার কথা, মনের কথা, অনুভূতির কথা!
—‘এতো ঢং না করে বলে ফেললেই তো পারেন।’
আরশান ভীষণ গম্ভীর ভাবে বলল, ‘আপনার বিয়ের প্রস্তাবটা আপনি নাকচ করে দিন।’
সকাল চকিতে ঘুরে তাকালো আরশানের দিকে।
—‘মানে?’
—‘মানে অনিকের সাথে আপনার বিয়ের কথা চলছে বললেন না? ওই বিয়েটা বাদ দিন।’
—‘কেন?’
আরশান চোখ সরিয়ে নিলো, ‘আমি বলেছি তাই।’
—‘আপনি কেন বলছেন কথাটা?’
আরশান মুখ বাঁকা করে ভাবলো কী যেন। অস্বস্তি নিয়ে বলল, ‘বলছি কারণ…. কারণ আমি ঠিক করেছি আমি আপনাকে বিয়ে করবো।’
বাতাস থমকে গেলো। সময় আটকে গেলো। মুহূর্তের জন্য বন্ধ হয়ে আসলো হৃদয়ের ধুকপুক।
—‘কী বললেন?’
আরশান নিচের দিকে চোখ নামিয়ে দৃপ্ত কণ্ঠে বলল, ‘আমি আপনাকে বিয়ে করবো।’
—‘কেন?’
—‘আমার ইচ্ছা।’
—‘আপনার ইচ্ছেটাই সব? আমার ইচ্ছার কোনো দাম নেই?’
আরশান চোখ ছোট করে বলল, ‘আপনার কি অমত আছে?’
—‘থাকতেই পারে!’
এ কথা শুনে আরশানের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল হঠাৎ। চোখে ভর করলো ক্রোধ। একরোখা ভাবে বলল,
—‘দেন হোয়াই ডিড ইউ কিস মি?’
সকাল হোঁচট খেলো প্রশ্নটা শুনে। সংকুচিত হয়ে পড়ল। টলমল করে উঠল ভেতরটা। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল,
—‘আমি কেন আপনাকে কিস করতে যাবো? স্বপ্নে দেখেছেন নাকি?’
আরশানের মুখ বিস্ময়ে হা হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ কোনো কথা বলতে পারলো না সে। মিনিট দুয়েক সময় কাটার পর উত্তেজিত ভাবে বলল,
—‘আপনি তো খুব মিথ্যা কথা বলতে পারেন!’
—‘আমি মিথ্যা বলি না।’ সকাল বলল নির্বিকার গলায়।
আরশান বসা থেকে উঠে সকালের মুখোমুখি দাড়ালো, ‘আপনি তাহলে আমাকে বিয়ে করবেন না?’
—‘করবো না সেটা বলিনি। ভাবছি।’
—‘তাই? ভাবছেন?’
—‘হ্যাঁ ভাবছি। অনিকের সাথে আপনার কী কথা হয়েছে?’
—‘অনিক তো আপনার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।’
সকাল হাসলো কথাটা শুনে, বলল, ‘তাই নাকি?’
আরশান ধারালো গলায় বলল, ‘সব এই হাসির দোষ।’
—‘মানে?’
—‘মানে সব আপনার এই হাসির দোষ। এরকম করে হাসলে মানুষ তো এমনিই পাগল হয়ে যাবে।’
—‘কী রকম করে হাসলে?’
—‘আপনার হাসিতে একটা প্রব্লেম আছে।’
—‘কী প্রব্লেম?’
—‘আপনি হাসলে আপনার আশেপাশের মানুষগুলোর ভেতরে কিছু একটা ঘটে যায়। আপনি সেটা টের পান না।’
সকাল অনেক কষ্টে হাসি চেপে বলল, ‘কী ঘটে যায়?’
—‘বাদ দেন। আপনি তাহলে আমার বিয়ের প্রস্তাবটা নিলেন না?’
—‘আপনি তো উত্তর দিলেন না
—‘কিসের উত্তর?’
—‘আমার প্রশ্নের উত্তর।’
—‘প্রশ্নটা কী?’
—‘আপনি কেন আমাকে বিয়ে করতে চাইছেন?’
—‘বলেছি তো আমার ইচ্ছা।’
—‘ইচ্ছাটা কেন হলো?’
আরশান একটা হতাশ নিশ্বাস ছাড়লো,
—‘বিয়ে করতে চাই কারণ …কারণ হয়তো আপনি অনেক সুন্দর।’
সকাল খুব রেগে গেলো এ কথা শুনে।
—‘এটা কোনো কথা হলো? একটা মানুষ সুন্দর হলেই আপনি তাকে বিয়ে করতে চাইবেন? আমার চেয়ে সুন্দর মেয়ে আর দেখেননি জীবনে?’
আরশান ভারি ইনোসেন্ট গলায় বলল, ‘দেখিনি তো!’
সকাল এই সামনে দাড়ানো কিম্ভুত লোকটাকে কী বলবে, কী করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না।
খানিক বাদে বিদ্রূপপূর্ণ গলায় সে বলল, ‘কাল বাদে পরশু আমার চেয়ে সুন্দর কাউকে দেখলে, কী করবেন তখন শুনি?’
—‘কী আর করবো? তাকেও বিয়ে করে ফেলতে হবে!’ বলে আরশান অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে হাসলো।
—‘আপনি ফাজলামো করছেন আমার সাথে?’
—‘শুনুন, কথা বাড়িয়ে লাভ নাই। আপনি আপনার বাবা মায়ের সাথে কথা বলুন। আমি আমার বাবার সাথে কথা বলবো।’
—‘কী ব্যাপারে কথা বলব?’
—‘বিয়ের ব্যাপারে।’
সকালের সেই মুহূর্তে খুব কান্না পাচ্ছিল। চোখের পর্দা উপচে নামতে চাইছিল জলের ফোয়ারা। সে মুখ নিচু করে জায়গাটা থেকে আস্তে আস্তে সরে আসল। এই অশ্রুজল সে কাউকে দেখাতে চায় না।
হেঁটে এগিয়ে এসে গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে দাড়ালো সে। একটু পর আরশানও হেঁটে আসলো। সকাল তখন চোখের জল মুছে নিয়ে একটু ধাতস্থ হয়েছে। আরশানকে দেখে সে সরাসরি প্রশ্ন করল, ‘আপনি হঠাৎ আমাকে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে গেলেন কেন?’
—‘অন্য লোকে আপনাকে নিয়ে যাচ্ছে তাই।’ অকপট বলল আরশান।
—‘অন্য লোকে না নিয়ে গেলে বিয়ে করতে চাইতেন না?’
—‘আপনি সেই তখন থেকে আমাকে প্রশ্নের ওপর প্রশ্ন করে যাচ্ছেন কেন?’
—‘প্রশ্ন করছি কারণ আমি আপনাকে বুঝতে পারছি না।’
—‘ঠিক কোন ব্যাপারটা আপনি বুঝতে পারছেন না?’
—‘বলা নেই, কওয়া নেই, হুট করে আপনি আমাকে বিয়ে করতে চাইবেন কেন?’ প্রশ্নটা করে সকাল একটু বিরতি নিলো। এরপর সরাসরি আরশানের চোখে চেয়ে নরম গলায় বলল, ‘ভালোবাসেন আমাকে?’
আরশান প্রশ্নটা শুনে ব্রিত হয়ে পড়ল। একটু লালও হলো। কোনো চিন্তা-ভাবনা না করেই বলে ফেললো,
—‘ন্যাহ্…’ শব্দটা উচ্চারণ করে অস্বস্তিতে কাদা হয়ে তাকালো সে সকালের দিকে। চোখ সরালো, আবার তাকালো। কয়েকটা সেকেন্ড গড়ালো নিঃশব্দে। এরপর একটু গম্ভীর গলায় বলল, ‘আমি আসলে জানি না!’
সকালের বুক চিরে হতাশার নিশ্বাস গড়িয়ে পড়ল।
—‘আর আপনি?’
—‘আমি কী?’
—‘আপনার আমাকে পছন্দ?’
সকাল স্পষ্ট গলায় বলল, ‘মনে হয়।’
—‘তাহলে আপনি বিয়েতে রাজি?’
নাবিলার বুদ্ধিই শেষ পর্যন্ত কাজে আসলো। কিন্তু অনিকের ব্যাপারটা যে সম্পূর্ণ সাজানো ছিল এই সত্যটা জানতে পারলে কি আরশান খুব রেগে যাবে? ঘটনা তো পুরোপুরি মিথ্যে নয়, অনিক তাকে পছন্দ করে এ বিষয়টা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। রেগে যাবার মতো তেমন কোনো যুক্তিযুক্ত কারণ তো সকাল আপাত চোখে দেখতে পাচ্ছে না।
বুকের কান্নাটা আবার গলার দ্বারপ্রান্তে এসে কড়া নাড়ছে। দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে কান্না সামলে নিয়ে সকাল বলল, ‘রাজি।’
শুনে আরশান হাসলো। বলল, ‘আমি কখনো ভাবিনি বিয়ের মতো একটা সিদ্ধান্ত এতো দ্রুত নিতে পারবো। মেয়েদেরকে আমি ঠিক বুঝি না। মেয়েদের ব্যাপারে সব সময় ভীতি কাজ করতো ভেতরে। হয়তো আমার মা ছিল না তো, তাই। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার কী জানেন? আপনাকে হারিয়ে ফেলার একটা তীব্র ভয় খুব জ্বালাচ্ছিল এ কদিন যাবৎ। তাই সব শেষে মনে হলো বিয়ে ছাড়া আপনাকে বেঁধে রাখার অন্য কোনো উপায় নেই।’
সকাল কিছু বলছিল না। চুপচাপ তাকিয়ে ছিল আরশানের দিকে। তার দুচোখে টস টস করছে জল।
আরশান একটু কাছে সরে আসলো। সকালের একটা হাত নিজের হাতে তুলে নিয়ে বলল, ‘আমার মা আমার বাবাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। আপনি কখনো আমাকে ছেড়ে যাবেন না অে?’
সকাল অশ্রুরুদ্ধ গলায় বলল, ‘কখনো ছেড়ে যাবো না।’
সেই মুহূর্তে একটা আশ্চর্য ভালো লাগায় তার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। স্বপ্ন সত্যি হলে কী রকম পাগল পাগল লাগে সেই প্রথম বারের মতো জানতে পারলো সে।
৫১
বাবা বসে আছেন খাবার টেবিলে। তাঁর পাশে মাদারও আছেন।
আরশান বসেছে তাদের মুখোমুখি চেয়ারে। তাকে বেশ বিচলিত দেখাচ্ছে। টানা বিশটা মিনিট ধরে ঠায় বসে আছে এখানটায়। কিছু একটা বলতে চাইছে কিন্তু বলতে পারছে না। ছেলেকে এরকম বেকায়দা অবস্থায় রহমান সাহেব এর আগে কখনো দেখেননি। তার দুই পুত্রই অকপট, সপ্রতিভ এবং বুদ্ধিমান। পার্থক্য একটাই, আরশান অন্তর্মুখী এবং ফাহাদ বহির্মুখী। কিন্তু আরশানের মধ্যে একটা একরোখা জেদী ভাব আছে। জেদ চেপে বসলে দুনিয়ার তাবৎ বিষয়কে সে তোয়াক্কা করে না। সেই জেদী ছেলের আজকে হঠাৎ কী হলো কে জানে! তখন থেকে সামনে বসে থেকে গ্লাসের পর গ্লাস পানি খেয়ে যাচ্ছে।
রহমান সাহেব উদ্বেগ নিয়ে বললেন, ‘এতো সময় নিচ্ছো কেন কথাটা বলতে? খারাপ কিছু হয়েছে নাকি? আমার তো বি পি বেড়ে যাচ্ছে।’
আরশান একটা বড় নিশ্বাস নিলো। মুখ বাঁকা করে, কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে বাবার দিকে ঠাণ্ডা চোখে তাকিয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড। তারপর যথাসম্ভব স্থিরতার সাথে বলল, ‘বাবা আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
—‘কী সিদ্ধান্ত?’
—‘আমি ঠিক করেছি আমি বিয়ে করবো।’
আরশান গুরুগম্ভীরভাবে কথাটা বলে ফেলেই চোখ নিচের দিকে নামিয়ে নিয়েছিল। রহমান সাহেব নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। তিনি সন্দিহান হয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কী করবে?’
আরশান কাঠ কাঠ গলায় বলল, ‘বিয়ে।’
রহমান সাহেব হতভম্ব দৃষ্টিতে একবার তাঁর স্ত্রীর দিকে তাকালেন। মাদারের চক্ষু চড়ক গাছ। তিনি বাতাসে বিপদের আভাস পাচ্ছেন। তার বুক ধড়ফড় করছে।
কয়েকটা সেকেন্ড গড়ানোর পর রহমান সাহেবের মুখে ধীরে ধীরে স্ফীত একটি হাসি ফুটে উঠল। তাঁর মনে হলো অনেক দিন বাদে তিনি কোনো সত্যিকারের সুসংবাদ শুনতে পেলেন। প্রসন্ন গলায় তিনি ছেলেকে বললেন,
—‘এতো খুবই খুশির কথা। তা কাকে বিয়ে করবে বলে ঠিক করেছো? তোমার সেই সাদা চামড়ার কলিগটি নয় তো?’
—‘না।
—‘তাহলে কে?’
অনেক কষ্টে নামটা উচ্চারণ করলো আরশান, ‘সকাল!’
রহমান সাহেব হো হো শব্দ করে হেসে উঠলেন। হাসতে হাসতে তিনি তার স্ত্রীকে বললেন, ‘কী ফাহাদের মা দেখলে,আমার ছেলে এতদিনে একটা কাজের কথা বলল। সুমতি হলো তার এতো দিনে। এখন আমি এই আনন্দ কোথায় রাখি।’
মাদারের দুচোখে বিস্ময় ফেটে পড়ছে। সারা মুখ জুড়ে একটা প্রবল ঝড়ের পূর্বাভাস। তিনি জোর করে মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে বললেন, ‘সেকি কথা! সকাল কি রাজি হয়েছে এই প্রস্তাবে?’
আরশান স্তিমিত গলায় বলল, ‘জি রাজি।’
জিতে যাওয়া খেলায় একদম শেষ মুহূর্তে এসে হেরে গেলে যেরকম দেখতে লাগে মাদারের মুখখানা তখন ঠিক সেরকম দেখাচ্ছিল। তিনি কোনো কথা বলতে পারছিলেন না।
রহমান সাহেব চেঁচিয়ে উঠে বললেন, ‘কই সকাল মা কোথায়? এদিকে এসো তো একবার।’
আরশান আড়ষ্টভাবে বসে টেবিলের ওপর নখ দিয়ে টোকা দিচ্ছিল। বাবার কাছে নিজের বিয়ের কথা এভাবে বলে ফেলতে পারবে এটা সে স্বপ্নেও ভাবেনি কখনো। ভীষণ একটা অস্বস্তির হাওয়া জেঁকে ধরেছে তাকে। হাঁসফাঁস লাগছে।
সকাল লিভিং রুমেই বসা ছিল। কান পেতে শুনছিল ওদের কথোপকথন। চাচা তার নাম ধরে ডাকতেই হাত পা কেমন অসাড় হয়ে আসলো। ভীষণ লজ্জা লাগছে। কী করে মুখ দেখাবে সকাল এখন ওদের? ইশ চাচার এখনই, ওকে ডাকবার কী দরকার ছিল? একবার ভাবলো, না শোনার ভান করে কেটে পড়ে। কিন্তু বিষয়টা ভালো দেখাবে না ভেবে জবুথুবু হয়ে হেঁটে আসলো সে কিচেনে। দাড়ালো অবনত মুখে চাচা চাচির সামনে।
চাচা বললেন, ‘অনেক দিন পরে আমি একটা খুশির সংবাদ শুনলাম, বুঝলে মা? এখন বলো দেশে এ মুহূর্তে কয়টা বাজে? তোমার বাবাকে প্রস্তাবটা দিতে হবে না?’
সকাল মুচকি হেসে বলল, ‘দেশে এখন মধ্যরাত চাচা।’
—‘আচ্ছা তাহলে তো আমার অপেক্ষা করতে হবে। এই ডিসেম্বরেই বিয়ের তারিখ ফেলে দিব। দেশে অনুষ্ঠান হবে। আবার এখানেও অনুষ্ঠান হবে। আমার বড় ছেলের বিয়ে বলে কথা।’
এ কথা শুনে আরশান আঁতকে উঠে বলল, ‘অনুষ্ঠান মানে? বাবা শুনুন, আমি কোনো অনুষ্ঠান ফনুষ্ঠান করবো না। ওসব আমার দ্বারা হবে না।’
রহমান সাহেব বললেন, ‘অনুষ্ঠান হবে না মানে? আলবৎ হবে। আমার বাড়িতে নতুন বউ আসবে আর অনুষ্ঠান হবে না? এটা কী করে সম্ভব?’
আরশান কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ‘এসব সোশ্যাল গ্যাদারিং আমার একদমই পছন্দ না। বিয়ে একটা ব্যক্তিগত ব্যাপার। অত লোকজন জানানোর কী দরকার?’
রহমান সাহেব ধমকে উঠলেন, ‘তুমি এতো কথা বোলো না। কী করা হবে, কী করা হবে না তা আমি ঠিক করবো। তোমার কোনো ভূমিকা নেই এখানে। তুমি শুধু বিয়ের আসরে কবুল বলবে। বোঝা গেলো?’
মাদার একদম নিশ্চল হয়ে শুনছিলেন সবকিছু এতক্ষণ। এই পর্যায়ে তিনি সকালের দিকে তীব্র চোখে তাকিয়ে ঠেস মারা গলায় বলে উঠলেন,
—‘বেশ ভালোই তো টোপ ফেললে। এখন আর কী? নাচতে নাচতে খুশির খবরটা জানিয়ে দাও তোমার বাবা মা’কে।’
সকালের মুখটা কেমন সাদা হয়ে গেলো। অপমানে থর থর করে কেঁপে উঠল তার ওষ্ঠদ্বয়। কিছু বলতে পারলো না সে। মিনিট দুয়েক সময় প্রস্তরীভূত হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে সে ধীরে ধীরে সরে আসল জায়গাটা থেকে।
রহমান সাহেব উত্তেজিত গলায় স্ত্রীকে বললেন, ‘এ ধরনের একটা কথা বলা কি খুব জরুরি ছিল?’
ফাহাদের আম্মা না বোঝার ভান করে বললেন, ‘কী এমন খারাপ কথা বলে ফেললাম আমি? আশ্চর্য তো!’
আরশান ধারালো চোখে দেখছিল সামনে বসা মহিলাটিকে। কোনো একভাবে সে জেনে গেছে এই মহিলা তার সুখের খবর শুনে শত ভাগ খুশি কখনো হয়ে উঠতে পারেনি, পারবেও না। কোনো এক অজানা রহস্যজনক কারণে তার ওপরে এই নারীটির রয়েছে প্রবল বিতৃষ্ণা। সকাল যদি তার স্ত্রী হয়ে এ বাড়িতে আসে তবে সেই বিদ্বেষ বা বিরাগের বোঝা সকালকেও বইতে হবে সারা জীবন। কিন্তু আরশানের ধারণাতেও ছিল না যে একেবারে সূচনাতেই সেই বিদ্বেষের এমন নগ্ন বহিঃপ্রকাশ ঘটবে এভাবে।
তার মনটা খারাপ হয়ে গেলো এবং জীবনে এই প্রথম বারের মতো সে অনুভব করলো সকালকে কেউ খারাপ কিছু বললে তার সহ্য হয়না। এই জায়গাটাতে কোনো রকমের কম্প্রোমাইজ সে করতে পারবে না।
সে বসা থেকে উঠতে উঠতে মাদারকে ঠান্ডা গলায় বলল, ‘কথাটা আপনার এভাবে বলা উচিত হয়নি। ভবিষ্যতে এই টোনে আর কথা বলবেন না ওর সাথে।’
মাদার ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, ‘কিভাবে কথা বলতে হবে তা এখন আমার তোমার কাছ থেকে শিখতে হবে?’
আরশান কোনো উত্তর দিলো না। ছেড়ে আসলো জায়গাটা।
ফোন বাজছিল। হাতে নিয়ে দেখলো সেই নম্বরটা। যে নম্বরটা সে নিউইয়র্কের রাস্তায় ছিনতাইকারীর হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল। সাথে সাথে ফোনটা রিসিভ করলো সে। হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে একটি নারীকণ্ঠ পরিষ্কার বাংলায় কথা বলে উঠল।
—‘হ্যালো আরশান বলছো?’
—‘বলছি। আপনি কে?
—‘আমাকে তুমি ঠিক চিনবে না। আমি সম্পর্কে তোমার খালা হই।’
একটা ধাক্কা খেলো আরশান। হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ফোনটা কানে নিয়ে বেশ খানিকটা সময়। তার মুখে কোনো রা নেই। মায়ের কোনো আত্মীয়স্বজন আজ অবধি তার কোনো খোঁজ-খবর নেয়নি। তার যদি আদতেই কোনো খালা থেকে থাকে তাহলে এতো দিন সেই খালা কোন চুলোয় ছিল? একটা তীক্ষ্ণ আর গনগনে ভাব ফুটে উঠল তার চেহারায়। সে একটু কড়া ভাবে বলল,
—‘আর এটা আমি কেন বিশ্বাস করবো?’
—‘কোনটা?’
—‘এইযে আপনি আমার খালা?’
ওপাশের মহিলা একটু বিরতি নিলো। নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পেলো আরশান ফোনের ভেতর দিয়ে।
—‘তুমি আমার সাথে দেখা করতে পারবে? আমি আগামী সপ্তাহে ভার্জিনিয়া আসছি।’
—‘কিন্তু এতো দিন পরে আপনি কেন আমার সাথে দেখা করতে চান? কী দরকার আপনার আমার সাথে?
— সেটা দেখান লিই বলবো।’
—‘আপনি আমার ওয়ালেট ছিনতাই করানোর চেষ্টা করেছিলেন কেন?
—‘কারণ তোমার ফোন নম্বরটা আমার প্রয়োজন ছিল। অবশ্য ফোন নম্বর যোগাড় করার অন্য উপায় ছিল না তা নয়। কিন্তু হঠাৎ তোমাকে টাইমস্কয়ারের রাস্তায় দেখতে পেয়ে অন্য কোনও বুদ্ধি তাৎক্ষণিকভাবে কাজ করেনি।’
—‘আপনি কোথায় থাকেন?’
—‘থাকি বাংলাদেশে। আমেরিকায় এসেছি মাস তিনেকের জন্য। এখন নিউইয়র্ক আছি। তোমার সাথে সাক্ষাতটা হয়ে গেলেই আমার এবারের মতো কাজ শেষ হবে।’
আরশান একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘ঠিক আছে। ভার্জিনিয়া এসে ফোন দিয়েন।’
ফোনটা রাখার পর আরশান কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেলো। এতো কাল পরে সেই মানুষটার একটু খানি আভাস মাত্র পাওয়া গেলো। তাতেই আরশানের বুকের ভেতরে একটা কেমন তোলপাড় হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত কি দেখা হবে? এ জীবনে একটি বার অন্তত সে তার গর্ভধারিণীর মুখোমুখি দাড়াতে পারবে কি? চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করতে পারবে কি?
—কেন এমন করলে? কী দোষ ছিল আমার?
বলতে কি পারবে চিৎকার করে, আমি তোমাকে ঘেন্না করি!
ভাবতে ভাবতে আনমনা আরশান জঙ্গলের দিকে পা বাড়ালো।
৫২
সার্কেল টাওয়ারে নাবিলার অ্যাপার্টমেন্টের সামনে এসে পৌঁছুতেই ঝুম বৃষ্টি নামলো। অথচ সকাল বেলাটা ছিল একদম রোদে ফকফকা। এখন বৃষ্টিতে সাদা চারপাশ। ফাহাদ গাড়ি থামিয়ে নাবিলাকে প্রশ্ন করলো, ‘বৃষ্টিতে ভিজবে?’
‘না থাক। ‘ নাবিলার গলাটা একটু বিষণ্ন শোনালো।
ফাহাদ সরু চোখে তাকালো নাবিলার মুখের দিকে, প্রশ্ন করলো, ‘কী ব্যাপার? কিছু হয়েছে নাকি?’
নাবিলার সাথে থেকে থেকে ফাহাদের বাংলাটা এখন আগের চাইতে ঢের ভালো হয়েছে। এখন আর অতটা হাস্যকর শোনায় না।
নাবিলা সজোরে মাথা নাড়লো, ‘না কিছু হয়নি। আমি আসছি।’
—‘আমি আসবো তোমার সাথে?’
—‘না দরকার নেই।
নাবিলা গাড়ির দরজা খুললো। খুলতেই তেজী বৃষ্টির ছাট গাড়ির ভেতর এলোমেলো ভাবে ছুটে আসতে লাগলো।
ফাহাদ গলা বাড়িয়ে প্রশ্ন করলো, ‘আবার কবে দেখা হচ্ছে?’
—‘এ মুহূর্তে বলতে পারছি না।’
নাবিলা মুখের ওপর গাড়ির দরজাটা আটকে দিলো। ফাহাদ দ্রুত গাড়ি পার্ক করলো। অ্যাপার্টমেন্টের লবিতে এসে দেখা গেলো নাবিলা লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ফাহাদ ভিজে গেছে অনেক খানি। তার মাথার চুল থেকে টপ টপ করে ঝরছে বৃষ্টির জল। গায়ে লেদারের সাদা জ্যাকেট ভিজে সপসপে হয়ে গেছে।
নাবিলা ওকে দেখে বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘ভিজলে কেন? কী দরকার ছিল ভেতরে আসার?’
ফাহাদ অবাক গলায় বলল, ‘তোমার কী হয়েছে নাবিলা?’
নাবিলা এ কথার প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না। কেমন শূন্য চোখে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ ফাহাদের দিকে। ঢোঁক গিললো একবার।
বলল, ‘ফাহাদ শোনো, আমার মনে হয় আমাদের আর দেখা সাক্ষাৎ করাটা ঠিক হবে না।’
—‘মানে?’
—‘মানে আমি আর এই রিলেশন কন্টিনিউ করতে চাইছি না। আমি ব্ৰেক আপ করছি তোমার সাথে।’
ফাহাদ থমকে গেলো। চোখদুটি বিস্ফারিত।
লিফ্ট চলে এসেছে। নাবিলা লিফটের ভেতরে ঢুকে গেলো নিঃশব্দে। ফাহাদ লিফটের বাটন প্রেস করে দরজা টেনে ধরলো, হিম শীতল গলায় প্রশ্ন করলো,
—‘আমি কি জানতে পারি হোয়াই আর ইউ ব্রেকিং আপ উইদ মি?’
—‘ধরে নাও আমার আর ভালো লাগছেনা তোমাকে।’
লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে হয়ে গেলো আপনাআপনি। জায়গাটায় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল ফাহাদ স্থিরচিত্র হয়ে। তার গা থেকে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির জল পড়ে অ্যাপার্টমেন্টের কার্পেটের লবি ভিজে যাচ্ছিল। একটি কালো চামড়ার বয়স্ক কঠিন মুখের মহিলা চিৎকার চ্যাঁচামেচি করে তাকে বেশ কিছু কথা শুনিয়ে গেলো এই অভদ্রতার জন্য। সেদিকে ভ্রূক্ষেপ মাত্র করলো না সে। তার বুকের ভেতরে শুধুমাত্র একটি কথা দীর্ঘশ্বাস হয়ে ঘুরপাক খাচ্ছিল।
নাবিলা তাকে ঠকিয়েছে …… এতোটা বোকা কী করে হলো সে?
৫৩
সকাল বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে ছিল। কেমন অদ্ভুত এক বিষাদে তার বুক ভরে আছে। একটা মানুষকে পাবার জন্য কতটা নিচে নামতে হলো। মিথ্যা বলা থেকেও পিছপা হলো না। ফাহাদের মা ঠিকই বলেছেন। একরকম টোপই তো ফেলেছে সে। বিয়ে হয়ে যাবার মিথ্যে হুমকি কি দেয়নি সে আরশানকে? ফাঁদ কি পাতেনি?
ঘেন্না হচ্ছে নিজের ওপর। এহেন কূটবুদ্ধিসম্পন্ন একটি কাজ করার আগে তার মৃত্যু হলো না কেন?
থেকে থেকে বুকের ভেতর একটা কেমন ভয় জেঁকে বসছিল তার। আরশান এখনো নিজের অনুভূতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভাবে জ্ঞাত নয়। সকালকে সে চায় ঠিক। কিন্তু সেই চাওয়ার পেছনে শুধুই মোহো কাজ করছে নাকি ভালোবাসা সেই তথ্যটা সকালের এখনো অজানা রয়ে গেলো। আরশান নিজেই ঠিক মতো কিছু বুঝে ওঠেনি। এতটা ছেলেমানুষ হলেও কি হয়? তার ওপর আরশানের সৎ মা আজীবন কাঁটার মতো লেগে থাকবে তার গলায়। এই মহিলা আরশানকে আজ অবধি নিজের সন্তান হিসেবে মেনে নেয়নি। সকালকেও যে মেনে নেবে না তা এক অবশ্যম্ভাবী সত্য।
মোবাইলে টুং করে একটা শব্দ হলো। সকাল জল টসটসে চোখ নিয়ে হাতে তুলে দেখলো ফোনটা। বার্তা এসেছে। প্রেরকের নামের জায়গায় ইংরেজিতে লেখা আরশান রহমান। এই প্রথম তার মোবাইলে কোনো বার্তা আসলো এই নাম থেকে।
আরশান লিখেছে, ‘আপনার হরিণডাঙ্গায় একবার আসবেন?’
‘আপনার হরিণডাঙ্গা’ কথাটায় কোনো ম্যাজিক ছিল মনে হয়। পড়া মাত্র সকালের মুখে একটা স্ফীত হাসি ফুটে উঠল। বুকের জ্বালায় প্রপে পড়ল। হরিণডাঙ্গায় যাবার নিমন্ত্রণ কি সে কখনো পায়ে ঠেলতে পারবে?
বাইরে আকাশ খুব মেঘলা আজ। ঝড়ো বাতাস লুটোপুটি খাচ্ছে জঙ্গলের গাছে গাছে। সকাল গায়ে নীল রঙের একটা জ্যাকেট পরে নিয়েছে। মাথায় দিয়েছে হুডি।
মেঘ ডাকছে। আকাশে কালো, নীল আর বেগুনি মেঘের ছড়াছড়ি। হাওয়ায় উড়ছে অজস্র মেপল লিফের দল। সুড়িপথ ভরে আছে অচেনা কোনো এক বুনোফুলের গন্ধে। ঝোপ থেকে ঝোপে গান গেয়ে গেয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে এক জোড়া কার্ডিনাল পাখি। পুরুষ পাখিটির গায়ের রং লাল আর নারী পাখিটির গায়ের রং কমলা। কী সুন্দর যে দেখাচ্ছে তাদের!
মেঘলা দিনের গভীর অরণ্যে হাঁটতে হাঁটতে সকাল ভাবছিল আরশানের সাথে একটা বোঝাপড়া করেই ছাড়বে আজ সে। জেনে নেবে কেন সে এতো অদ্ভুত আর কিম্ভূত। কেন ভালোবেসেও ভালো না বাসার ভান করে। আর কেনই বা বিয়ের অনুষ্ঠান করতে চায় না। সকাল কি বউ সাজবে না? আজকাল কত ঢং করে মেয়েরা বউ সাজে, ছবি তোলে, ফেসবুকে আপলোড করে। সকালের জীবনে কি সেই সব সাধ-আহ্লাদ অপূর্ণই থেকে যাবে? পেয়েছে কি ছেলেটা? সে যা বলবে তাই হবে? সকালের মতামতের কোনো গুরুত্ব নেই?
হরিণডাঙ্গায় এসে দেখা গেলো আরশান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রং তুলি দিয়ে মনোযোগের সাথে ছবি আঁকছে। তার গায়ে কালো রঙের পাতলা একটি উইন্ডব্রেকার। বোর্ডে আটকানো তার ছবি আঁকার কাগজ। পর্ণ কুটিরের লতানো পাতাবাহার হাওয়ায় নাচছে পাগলের মতো। এরিক তার কাঠের ঘরের জানালা দিয়ে সোনালি চুলের লম্বা মাথা বের করে উঁকি দিয়ে দেখছে।
সকাল এসেই তারস্বরে বলে উঠল, ‘কেন ডেকেছেন?’
আরশান হাতের কাজ বন্ধ করে তাকালো ওর দিকে। সকালের চোখ দুটো একটু ফোলা ফোলা। ঠোঁট শুকনো। তাকে এলোমেলো দেখাচ্ছে। তবুও ওই মুখটা দেখা মাত্র আরশানের বুকের ভেতর একটা স্নিগ্ধ ভাব ছড়িয়ে গেলো। সে প্রমত্ত চোখে চেয়ে রইল ওর দিকে 1
আরশানের ওই মোহময় সুন্দর চোখের চাউনির সামনে এলেই সকাল কেমন আচ্ছন্ন হয়ে যায়, পাগল হয়ে যায়। বুকের রাগগুলো আর রাগ থাকে না। পানির মতো টলমল করে। তবুও… যে করেই হোক আজকে একটা ফয়সালা তাকে করতেই হবে। জানতেই হবে এই মানুষটার সমস্যা কোন জায়গায়।
মেঘ ডাকলো বিকট শব্দে। এরিক চিঁহি চিঁহিহি করে ডেকে উঠল হেঁড়ে গলায়। হাওয়া উড়িয়ে নিলো সকালের মাথার হুডি। চুল উড়তে থাকলো পতাকার মতো বাতাসে। সকাল একটু উত্তেজিত গলায় বলল, ‘কেন ডেকেছেন? আর কী বলার আছে আপনার? বিয়ের অনুষ্ঠান করবেন না। ভালোবাসেন কিনা সেটাও জানেন না। এখন কী বলবেন? বলেন যে বিয়ের পর সংসারও করবেন না।’
আরশান কোনো উত্তর দিলোনা। আরো কয়েকটা সেকেন্ড অমন থম ধরেই দাঁড়িয়ে রইল। দেখতে লাগলো সকালকে ঘোরলাগা চোখে। একটা সময় হাতে ধরা সরঞ্জাম ফেলে রেখে ধীরে ধীরে মোহাবিষ্টের মতো এগিয়ে আসলো সে।
সকালের কপালের কাছে পড়ে থাকা এক গাছি চুল হাত দিয়ে সরিয়ে ওর কানের পাশে গুঁজে দিতে দিতে কেমন আচ্ছন্ন ভাবে বলল, ‘ডেকেছি কেন জানেন?’
বলে সে সকালের মোমের মতো ফর্সা নরম গালে হাতের একটা আঙ্গুল ছোঁয়ালো কয়েক সেকেন্ডের জন্য। সকাল কেঁপে উঠল। কোনো রকমে বলল, ‘জানি না। না বললে জানবো কী করে?’
আরশান আঙ্গুল দিয়ে এবার ওর ঠোঁটজোড়া ছুঁয়ে দিলো। অদ্ভুত মাদক হাসল সেদিকে তাকিয়ে। তারপর ধীরে ধীরে মাথা নত করে এনে তৃষ্ণার্তের মতো গাঢ় ভাবে একটা চুমু খেলো সকালের নিটোল দুটি ঠোঁটে। অনেকটা সময় নিয়ে। ফিসফিস করে বলল, ‘ডেকেছি আপনাকে আদর করবো বলে। আপনাকে খুব আদর করতে ইচ্ছে করছিল।’
তিরতির করে তীব্র এক ভালোলাগার কাঁপুনি ছড়িয়ে গেলো সকালের সর্বাঙ্গে। বিরস গলায় সে বলল, ‘ভালোবাসেন না কিন্তু আদর করতে চান। এ ভীষণ অন্যায়।’
—‘হোক অন্যায়। আজকে আমার অন্যায় করতেই মন চাইছে।’
কথাটা বলা শেষ করে আরশান আরো অনেকগুলো অবাধ্য, অশান্ত চুমু খেলো সকালের গালে, চোখে, চিবুকে আর গলায়।
সকাল কত কী বলবে বলে ঠিক করে রেখেছিল। ঠিক করে রাখা খটোমটো, রুক্ষ কথাগুলো আদরে আদরে কেমন চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেলো। তার আর কিছুই মনে থাকলো না। মানুষটাকে মনের অজান্তেই ক্ষমা করে দিলো সে।
তারপর …ওরা যখন একজন আরেকজনের ঠোঁটের মাঝে নেশাগ্রস্তের মতো ডুবে যাচ্ছিল, একলা গভীর, লাল গালিচা পাতা জঙ্গলটায় তখন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছিল। বাদলা হাওয়ায় এলোমেলো উড়ছিল ওক গাছের লালচে সোনালি পাতা।
বেশ কিছুক্ষণ পর সকাল আচমকা আরশানের বুকে একটা ধাক্কা দিয়ে দূরে ঠেলে দিয়ে বলল, ‘না এসব হবে না।’
বৃষ্টির জোর খুব। এলোমেলো একরোখা হাওয়া মুখের কথা উড়িয়ে নিচ্ছে। আরশান ধাক্কাটা খেয়ে হতভম্ব হয়ে গেল। সাদা বৃষ্টিতে আবছা হয়ে আছে সকালের মুখখানা। ঝমঝম বৃষ্টিটায় চোখ ঠিকমতো খোলা রাখা যায় না। বেপরোয়া জল ঢুকে পড়ে চোখের বারান্দায়।
দিশেহারা আরশান বিভীষণ গলায় বলে উঠল, ‘কী হলো হঠাৎ?’
সকাল যতটা সম্ভব কঠিন ভাবে বলল, ‘এসব চলবেনা!’
আরশান বিস্মিত, ‘কী চলবে না?’
—‘এইযে …এসব। মানে আপনি আমাকে ভালো না বাসলে আদর করতে পারবে না।’
কথাটা শুনে আরশান এমন ভাবে তাকালো সকালের দিকে যে ওর চাউনির ধরনই বলে দিলো গোটা জীবনে সে এহেন আজগুবি কথা আর একটাও শোনেনি। বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে খানিকক্ষণ। তারপর কড়া ভাবে বলল, ‘এটার মানে কী? আপনি জোর করে আমাকে দিয়ে ভালোবাসি বলাতে চাইছেন?’
শুনে অপমানে গা রি রি করে ওঠে সকালের। বলে, ‘আপনি আমাকে ভালো না বাসলে আমার বয়েই গেছে! কিন্তু ভালোবাসা ছাড়া কোনো আদর হবে না। বলে দিলাম।’
দামাল বৃষ্টিটা ঝর ঝর করে ঝরে যাচ্ছে অবিরাম। ওদের চোখ, মুখ, চুল গায়ের কাপড় সব ভিজে একাকার। আরশানের মুখখানা রাগে গনগন করছে। সে ক্ষুদ্ধ ভাবে বলল, ‘বেশ তো! আপনাকে আদর করা আর না করায় আমার কিছুই এসে যায় না। জেনে রাখুন।’
—‘মনে থাকে যেন!
—‘সিরিয়াসলি। আপনার আই কিউ এভারেজের চাইতেও লো।’
এ সময় প্রকট শব্দ করে ঝলসে উঠল মেঘ। আরশানের বলা শেষের কথাটা বজ্রপাতের শব্দে ঢাকা পড়ল। সকাল তেড়ে উঠে বলল,
—‘কী বললেন?’
—‘বলেছি আপনার মাথায় বুদ্ধি বলতে কিছুই নেই। নিরেট একদম।’
—‘ফালতু কথা বলবেন না। আপনি জানেন আমার রেজাল্ট কী? জানেন আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটির আইবিএ-তে চান্স পাওয়া ছাত্রী?’
আরশান প্রেতের মতো হো হো করে হেসে উঠল, ‘ভালো ছাত্রী হওয়া আর বুদ্ধিমতী হওয়া এক জিনিস নয়।’
–‘আপনি আমাকে আন্ডারএস্টিমেট করছেন!’
—‘আপনার ঘটে বুদ্ধি থাকলে এটুকু বোঝার চেষ্টা করতেন যে আই নেভার কিসড আ গার্ল বিফোর! আপনিই প্রথম। সো ডেফিনিটলি ইউ আর স্পেশাল।’
—‘রাখেন আপনার স্পেশাল।’
—‘আপনি আমাকে বিশ্বাস করেন না?’
সাদা বৃষ্টির পর্দা ভেদ করে সকাল আরশানের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি দিলো।
—‘বিশ্বাস অবিশ্বাসের প্রশ্ন আসছে কেন?’
—‘প্রশ্নের ওপর প্রশ্ন না করে আমার কথার উত্তর দিন।
—‘বিশ্বাস করতে চাই।’
আরশান হতাশার শ্বাস ফেললো একটা। ভারি গলায় বলল,’ দেখুন, এইসব ভালোবাসা টাসা আমার দ্বারা হবে না। ভালোবাসা কখনো ভালো রাখে না।’ এটুকু বলে একটু থামলো সে। এরিক চিঁহি চিঁহি করে কয়েকবার ডাক ছাড়লো। আরশান এরিকের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘আপনাকে আমার ভালো লাগে। এতটা ভালো অন্য কাউকে কখনো লাগেনি। এটুকু আপনার জন্য যথেষ্ট নয় বুঝতে পারছি। কিন্তু বিশ্বাস করুন এর চেয়ে বেশি কিছু আমার কাছ থেকে আশা করাটা বোকামী হবে।’
সকাল রাগে গজ গজ করতে করতে বলল, ‘ঠিক আছে তাহলে, আমার কাছ থেকেও বেশি কিছু আপনি আশা করবেন না।’
আরশান ঘুরে দাড়ালো, ‘বুঝলাম না। কী আশা করবো না?’
—‘কিছুই না।’
—‘কাম অন! ইউ আর গোয়িং টু বি মাই লফুলি ওয়েডেড ওয়াইফ!’
—‘বিয়ের পরেরটা পরে দেখা যাবে।’
আরশান গনগনে গলায় বলল, ‘ঠিক আছে আমারও অত দরকার নাই।
মরে যাচ্ছি না আমি আপনাকে চুমু খাওয়ার জন্য।’
—‘মরেই তো যাচ্ছিলেন!’
—‘মোটেও না!’
—‘মোটেও হ্যাঁ।’
আরশান কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই ওর সেলফোনটা বেজে উঠে মুখের কথা আটকে দিলো। ফাহাদ ফোন করেছে। হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে ইংরেজিতে বলল, ‘ভাই তোমার সাথে কি সকাল আছে?’
—‘আছে।’
—‘কোথায় তোমরা?’
—‘এইতো বাড়ির কাছেই। কেন?’
—‘সকালকে একটু বলবে প্লিজ আমার সাথে দেখা করতে?’
—‘বলছি। কিন্তু তোমার কী হয়েছে? সব ঠিক আছে তো?’
ফাহাদ একটু চুপ থেকে বলল, ‘নাবিলা আমার সাথে ব্রেকআপ করেছে। তুমি সকালকে একটু পাঠিয়ে দিও।
লাইন কেটে গেলো। আরশানের মুখে উৎকণ্ঠার ছাপ দেখতে পেয়ে সকাল প্রশ্ন করলো, ‘কী হয়েছে? কিছু হয়েছে?’
আরশান একটু দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বলল, ‘নাবিলা আর ফাহাদ। দে ব্রোক আপ!’
সকাল চমকে উঠল, ‘বলছেন কী?’
—‘সেরকমই তো শুনলাম।’
—‘কিন্তু কেন?’
—‘জানি না তো! যাই হোক আপনি ফিরে যান। ফাহাদ ওয়ান্টস টু মিট ইউ।’
—‘আপনি আসবেন না? বৃষ্টি থামার তো কোনো লক্ষণ নেই। আর কতক্ষণ ভিজবেন? জ্বর আসবে তো।’
—‘আমার অভ্যাস আছে। আপনি যান।’
সকাল বাড়ি ফিরলো একদম ভেজা জবজবে হয়ে। মাথার চুল ভিজে লেপ্টে আছে কপালের সাথে।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তোয়ালে দিয়ে মাথার জল মুছে নিলো। তার ঠোঁটে, গলায়, চিবুকে তখনো লেগে আছে, মিশে আছে আরশানের ঠোঁটের ছোঁয়া। মিশে থাকবে আজীবন। ভালোবাসার মানুষ কাছে আসলে কী রকম করে সব ওলটপালট হয়ে যায় তা সে আজ এই প্রথমবার টের পেলো। শরীরে এখনও রক্তচ্ছাস টের পাচ্ছে সে। বুকের ভেতর চাপা একটা সুখানুভূতি গুমগুম করে হাহাকার করছে। এতটা অনুভূতিশীল সে এর আগে কখনোই ছিল না। আজকের এই তুমুল আলোড়ন তাকে অন্যরকম করে দিয়েছে, বদলে দিয়েছে।
দরজায় করাঘাত হচ্ছিল। নিশ্চয়ই ফাহাদ। সকাল একটু উঁচু গলায় বলল, ‘আসছি। দুইটা মিনিট টাইম দাও।’
কাপড় পাল্টে নিলো সে চট করে। ভেজা চুলে তোয়ালে দিয়ে ঝাড়ন দিতে দিতে দরজা খুললো। ফাহাদের মুখটা অত্যধিক শুকনো। দেখেই বুক কেমন কেঁপে উঠল
—‘কী হয়েছে?’
ফাহাদ ঘরের ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ‘নাবিলা আমার সাথে ব্রেক আপ করেছে।’
—‘কিন্তু কেন?’
—‘আমাকে নাকি ওর আর ভালো লাগছে না।’
সকালের চেহারা আতঙ্কে কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। সে দিশাহারা ভাবে বলল, ‘বিশ্বাস হচ্ছে না আমার। নাবিলা একথা বলতেই পারে না।’
ফাহাদ বিছানার ওপর বসলো। তার চোখে ভর করেছে গভীর এক শূন্যতা। কোনো উত্তেজনা নেই, উদ্বেগ নেই, শুধুই খাঁ খাঁ শূন্যতা।
সে একটা বড় শ্বাস ফেলে বলল, ‘আমারও বিশ্বাস হচ্ছিল না। এখনো মনে হচ্ছে বুঝি ভুল শুনেছি। আসলে কি জানো? কিছু কিছু মানুষের ভাগ্যটা হয় খুবই খারাপ। তারা যতই চেষ্টা করুক না কেন ভালো থাকার, জীবন তাদেরকে সেই ভালোটাকে খারাপ করে দেবার নানা রকম উপায় বাতলে দেবে। ভালো থাকা আর হয়ে উঠবে না।
—‘এভাবে বলো না ফাহাদ। আমার মনে হচ্ছে কোথাও কোনো ভুল বোঝাবোঝি হচ্ছে। দাড়াও আমি নাবিলাকে ফোন দিয়ে দেখি।’
নাবিলাকে ফোন করে দেখা গেলো তার ফোন বন্ধ। দুশ্চিন্তায় সকালের মুখ ছোট হয়ে গেলো। ফাহাদকে এভাবে কষ্ট পেতে দেখলে তার খুব খারাপ লাগবে। সে মনে প্রাণে ফাহাদের ভালো চায়। ওর মতো একটা সাদা মনের ছেলের তো ভালো থাকাই উচিত।
ফাহাদ বলল, ‘তোমার যদি ওর সাথে কথা হয় তাহলে আমার হয়ে একটা কথা বলে দিও যে, আমি ওর জন্য অপেক্ষা করবো।’
কথাটা বলে ফাহাদ উঠে দাড়ালো। সকাল মরিয়া হয়ে বলল, ‘ফাহাদ শোনো, লক্ষ্মী ভাই আমার। তুমি একটুও দুশ্চিন্তা করো না। আমি নাবিলার বাসায় যাচ্ছি আজকেই। ওর সাথে কথা বলে তোমাকে সব জানাচ্ছি। আমার মনে হচ্ছে কোথাও কোনো ঘাপলা লেগেছে। আমি নাবিলার চোখে তোমার জন্য যে ফিলিংস দেখেছি সেটা মিথ্যা হতে পারে না। তুমি কিন্তু বাসায়ই থাকো। কোথাও চলে যেও না আবার।’
ফাহাদ উত্তরে কিছু বলল না। গুমোট মুখে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে।
সকাল তড়িঘড়ি করে আরশানকে একটা ফোন করলো।
—‘আরশান, আমার একটু নাবিলার বাসায় যেতে হচ্ছে। আপনি কি আমাকে নিয়ে যেতে পারবেন? নাকি বাসে যাবো?’
আরশান একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘আমি থাকতে আপনি বাসে যাবেন কেন? ঢং করেন?’
—‘ঢং করবো কেন আজব! আপনার অন্য ব্যস্ততা থাকতে পারে না?’
—‘না আমি ভাবলাম আমার গাড়িতে ওঠা নিয়েও আবার কোনো রেস্ট্রিকশন আছে কিনা আপনার। কিস করা যাবে না, জড়িয়ে ধরা যাবে না, গাড়িতে ওঠা যাবেনা … ব্লা ব্লা ব্লা।’
এই চিন্তাযুক্ত সময়টাতেও আরশানের কথাগুলো শুনে হেসে ফেললো সকাল। হাসি চেপে বলল,
—‘গাড়িতে ওঠা যাবে।’
—‘রেডি হয়ে নিচে নামেন। আমি আসছি।’
৫৪
বৃষ্টি থামলো একটু আগে। এখন রূপালি আকাশে নিরুদ্দেশ ভেসে বেড়াচ্ছে ধোঁয়া ধোঁয়া মেঘ। সেই মেঘ ভেদ করে সোনালি এক আশ্চর্য সুন্দর নরম আলোক রশ্মি নেমে এসেছে পৃথিবীর গায়ে। আরামে শুয়ে আছে বৃষ্টিভেজা জল টলমলে রঙিন গাছের পাতায় পাতায়। সকাল নিচে নেমে এসে ডেকের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল। হাওয়া এখন মসৃণ। সদ্য বৃষ্টি জলে স্নানের পর চারপাশ ভারি ঝকঝকে। দুটি মেটে চামড়ার বালিহাঁস প্যাক প্যাক করে ডানা ঝাপটে মাথার ওপর দিয়ে উড়ে চলে গেলো জঙ্গলের দিকে, গিয়ে মিশলো দূর আকাশের ধোঁয়াটে মেঘের সাথে। স্বপ্নের মতো চিক চিক করে উঠল তাদের ঝাপটানো ডানা। এই আশ্চর্য মায়াবী বৃষ্টিভেজা বিকেলটা সকালের বুকের ভেতরে ক্রমান্বয়ে এক কোমল, স্নিগ্ধ, সুগন্ধি ভাব ছড়িয়ে দিচ্ছিল। অলৌকিক আলোয় মোড়ানো, মেঘ ভাসানো, রূপোরঙা আকাশটার দিকে চেয়ে থেকে থেকে তার হঠাৎ কেমন উদাস লাগতে থাকলো। মনে হলো এরকম এক রূপালি আকাশের পাগল পাগল বিকেলে ঠিক কী যেন একটা হবার ছিল তার। হলো না।
আজকের বিকেলটা এতো সুন্দর কেন?এমন বিকেলে মরতেও সুখ!
সেই সময় জংলা গাছগাছালি আর ঝোপের ভেতর দিয়ে ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হলো মানুষটা। অপার্থিব এক টুকরো সোনালি রোদ ছুঁয়ে আছে তার কপাল আর গাল। হালকা বাতাসে উড়ছে কপালের কাছের ছোট ছোট চুলগুলো। তার চুল এখনো ভেজা। ভেজা পরনের বসন। অরণ্য ভেদ করে লোকালয়ে আসতেই সে ডেকের রেলিঙের কাছে দাড়ানো সকালকে দেখতে পেল।
সকালের বুকের ভেতর থেকে উদাস ভাবটা পালিয়ে যাবার আগে সদ্য বয়ঃসন্ধি পেরোনো এক টালমাটাল অনুভূতির জন্ম দিয়ে গেলো। বুকের মাঝে ফিরে আসলো কম্পন। বয়ঃসন্ধির প্রেমেরই মতোন। তারপর, চারটা চোখ যখন চুম্বকের মতো আটকে গেল পরস্পরের সাথে, অক্টোবরের মোহময় রূপালি বিকেলটা বুঝি ঠিক তখনই এক পরিপূর্ণ সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।
আরশান সিঁড়ি ভেঙে ডেকের ওপর উঠতে উঠতে বলল, ‘সো ফ্যাস্ট!’
—‘হুম আমি সবসময়ই ফ্যাস্ট। আপনি এতো দেরি করলেন কেন?’
—‘এরিককে দেখতে এসেছিল।’
বলতে বলতে ঘরের ভেতর ঢুকলো আরশান। সকালও ঢুকলো পেছন পেছন। বলল,
—‘দেখতে এসেছিল মানে? এরিকের বিয়ে দিচ্ছেন নাকি?’
শুনে আরশান হো হো শব্দ করে হেসে উঠল, ‘ভালো বলেছেন। এরিকের বিয়ে দেয়া গেলে বেশ হতো। তবে আপাতত বিয়ে নয়। মালিকানা হস্তান্তর হচ্ছে।’
সকাল শুকনো গলায় বলল, ‘কেন?’
—‘ঘোড়া মেইনটেইন করা ঝামেলার কাজ। এক্সপেন্সিভও অনেক। আর আমি সময় পাই না। সারাদিন এরিককে একা থাকতে হয়। প্রতিটা প্রাণীর জন্যই একাকিত্ব একটি অভিশাপ।
আরশানের চুল থেকে কপাল বেয়ে জলের একটা ক্ষীণ রেখা নেমে আসছিল। সকাল ব্যস্ত হয়ে চেয়ারের হাতলে রাখা তোয়ালেটা তুলে নিলো। বলল, ‘আপনি আর কোনো কথা না বলে মাথা মুছে নিন।’
আরশান সোফার ওপর ঝুঁকে বসে জুতোর ফিতে খুলছিল। সকাল পাশেই দাঁড়িয়ে হাতে তোয়ালে নিয়ে। দেরি সহ্য হচ্ছে না তার। মানুষটা নির্ঘাৎ অসুখে পড়বে এই অসময়ের বৃষ্টিতে ভিজে। সে কোনো কথা না বলে নিজেই তোয়ালে দিয়ে আরশানের চুল মুছে দিতে লাগলো। আরশান ঝুঁকে থাকা অবস্থা থেকে সোজা হলো। বেকায়দায় পড়ে বলল, ‘কী হচ্ছে? জুতোটা তো খুলতে দিন।’
সকাল বেশ মা মা গলায় বলল, ‘জুতো পরে খুললেও চলবে। ভেজা চুল নিয়ে অতক্ষণ থাকতে নেই। মাথা ব্যথা করবে আপনার। জ্বর আসবে।’
আরশান একটু অস্বস্তি বোধ করছিল। এইসব যত্নআত্তি আর আদিখ্যেতার অভ্যেস নেই তার। দাদা দিদাকে ছেড়ে এদেশে চলে আসার পর, সেই প্রথমদিন থেকেই সে সনির্ভর হতে শিখেছে। বাবা চাকরি নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। বাড়িতে ফাহাদ ছোট। টিলির তখনও জন্মই হয়নি মাদারের সমস্ত সময় ফাহাদের জন্য বরাদ্দ ছিল। এ কথা ঠিক বাবা ছুটির দিনগুলোতে যথেষ্ট সময় দিতেন, পড়ালেখার খোঁজ-খবর নিতেন, নিয়ম করে তাদের দুভাইকে নিয়ে আউটিং এ যেতেন। কিন্তু বুকের উত্তাপ দিয়ে, মায়া দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে সেভাবে আগলে রাখতে কখনো পারেননি। বাবার ডাক পড়েছিল বাইরের পৃথিবীতে। কত কত ব্যস্ততা তার। ঘর সংসার নিয়ে পড়ে থাকার সময় কোথায়?
তাই এমন যত্ন করে,এর আগে কেউ কোনোদিন আরশানের মাথা মুছে দেয়নি। তার বুকের ভেতর একটা তরল ভাবের সৃষ্টি হচ্ছিল ধীরে ধীরে। কেমন যেন অন্যরকম গলায় সে বলল, ‘আমার জ্বর আসলে আপনি কি সারারাত জেগে বসে থাকবেন আমার মাথার কাছে?’
সকালের হাত এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেলো কথাটা শুনে। সে অবাক চোখে তাকালো আরশানের দিকে। আরশান প্রশ্নটা করে অপলক চেয়ে আছে তার দিকে। তার চোখে মুখে এখন ভারি এক ছেলেমানুষী ভাব। লম্বা পাঁপড়িওয়ালা মোহময় চোখদুটো আচ্ছন্ন। সকালের ভীষণ মায়া হলো। কতটা ভালো সে এই মানুষটাকে বাসে তা যদি এই মানুষটা জানতো! কবে মুখ ফুটে বলতে পারবে ভালোবাসার কথা কে জানে! কিন্তু মুখে না বললেই কী? হৃদয়ের কথা কি হৃদয়ে গিয়ে পৌঁছোয় না?
সকাল স্তিমিত ভাবে বলল, ‘থাকবো।’
আরশান বসা থেকে উঠে দাড়ালো—‘তাহলে মাথা মুছে কাজ নেই। আমি চাই জ্বর আসুক।’
সকাল হেসে ফেললো, ‘কী পাগল!’
—‘আমি তো পাগলই। আর হ্যাঁ আপনি আমার অত কাছে আসবেন না যেন। হঠাৎ কিছু করে ফেলতে পারি।’
—‘কিছু করে ফেলতে পারি মানে? কী করবেন?’
প্রশ্নটা শুনে আরশান আকস্মিকভাবে সকালের দুহাত খামচে ধরে নিজের কাছে টেনে নিয়ে এসে বলল, ‘দেখতে চান?’
সকালের মুখটা রাঙা হয়ে উঠল। সে লাজুক গলায় বলল, ‘না ওসব তো বারণ। আর আপনি আমাকে ছেড়ে দিন আপনার ভেজা জামা আমাকেও ভিজিয়ে দিচ্ছে।’
—‘বারণ করলেন কেন? জানেন না? নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের ঝোঁক বেশি?’
—‘আপনি কিন্তু অসভ্য।’
—‘আমি অসভ্য, পাগল। আর কী কী আমি?’
সকাল মিটিমিটি হাসি নিয়ে আরশানের চোখে চেয়ে বলল, ‘আর আপনি অনেক সুন্দর।’
আরশান পিলে চমকে উঠে বলল, ‘সুন্দর? ধ্যাৎ! আমি কি মেয়ে নাকি?’
—‘শুধু মেয়েরাই বুঝি সুন্দর হয়? ছেলেরা হয় না?’
হাসলো আরশান, ‘হয় বুঝি? হলে হতে পারে কিন্তু সুন্দর শব্দটা কেমন মেয়েলি লাগে আমার কাছে।’
—‘আপনি অনেক বোকা।’
—‘আমি বোকা?’
—‘হ্যাঁ বোকা।’
—কী আশ্চর্য! আমাকে কেন বোকা মনে হলো আপনার?
—‘কারণটা আজকে নয়। অন্য কোনো দিন বলবো।’
আরশান একটা বড় নিশ্বাস ফেললো তারপর সকালের ঠোঁটের দিকে চেয়ে উষ্ণ গলায় বলল, ‘ঠিক আছে ‘ অন্যদিন বলতে পারেন। আমি জোর করবো না। কিন্তু তার বিনিময়ে আমাকে একটা জিনিস দিতে হবে এখন।’
—‘না এখন কিচ্ছু দেয়া যাবে না।’
—‘আপনি খুব নিষ্ঠুর।’
—‘মাঝে মাঝে নিষ্ঠুর হওয়া ভালো।’
—‘প্লিজ?’
—‘নো ওয়ে।’
—‘আপনি তো আমার বউ!’
—‘বউ হইনি এখনো।’
—‘হয়ে গেছেন। মনে মনে বিয়ে করে ফেলেছি আমি আপনাকে।’
সকাল আরশানকে ঠেলে সরিয়ে দিল দূরে। চপল গলায় বলল, ‘হবে না!’
আরশান মুখ বাঁকালো,’ যান যান ভাগেন। আর কখনো চাইবো না। আপনি চাইলেও দিব না। মনে থাকে যেন।’