৪৫
বাইরে ঝিম ঝিম দুপুর। মিঠা রোদে ডুবে আছে সমগ্র চরাচর। একটা ছোট্ট লাল রঙের কার্ডিনাল পাখি গান গেয়ে গেয়ে এক ঝোপ থেকে আরেক ঝোপের মাথায় মহা আনন্দে উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। সকাল মুগ্ধ হয়ে ওই পাখিটার ডাক শুনছিল বারান্দায় বসে। দুপুরটা ভারি শান্ত, নিরিবিলি আর নির্জন। চোখের সামনে লাল, হলুদ আর সবুজ রঙে সাজা বিস্তৃত বন বনানী। কতটা বিস্তৃত তা সকাল জানে না। তবে এই বারান্দায় বসে, খালি চোখে তাকালে মনে হয় যেন ভারি গভীর এক অরণ্য হাজার রকম রহস্য গায়ে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
সকাল একটু একটু করে গোছগাছ শুরু করে দিয়েছে। বলতে কি আর একটা দিনও তার এই বাড়িতে থাকতে মন চাইছে না। নিজের দেশের জন্য, বাবা মায়ের জন্য মনটা থেকে থেকে খুব খারাপ হয়ে উঠছে। তার ওপরে কী বাজে একটা ঘটনা ঘটে গেলো তার জীবনে। ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো রাবার দিয়ে ঘষে ঘষে তুলে ফেলা গেলে কী ভালোই না হতো। তার মাঝে মাঝে মনে হয় মানুষের জীবনে কম্পিউটার বা সেলফোনের মতো একটা ডিলিট অপশন থাকা খুব জরুরি ছিল। কোনো ঘটনা পছন্দ না হলেই টুপ করে ডিলিট করে দেয়া যেত।
চাচা বলেছেন এই উইকেন্ডে তাকে নিয়ে বেড়াতে যাবে। কিন্তু সকালের যে বেড়ানোর মতো মনটা মরে গেছে এই কথাটা চাচাকে কে বোঝাবে?
কী এমন ক্ষতি হতো এই মার্কিন দেশে কয়েকদিনের অতিথি হয়ে বেড়াতে না আসলে? ভাবনাটা মাথায় খেললেই একটা অদ্ভুত তরঙ্গায়িত অনুভূতি হয় আজকাল তার। এখানে না আসলে আরশানের সাথে তার জীবনে কোনও দিন দেখা হতো না। এখানে না আসলে সে জানতেই পারতোনা যে ভালোবাসতে পারার মতো একটা মন তার ভেতরেও ছিল অনেক কাল ধরে, শুধু ভালোবাসবার মানুষটি ছিল না। সেই বিশেষ মানুষটি ছিল এই দূর দেশে। অতলান্তিকের এ পারে। সম্পূর্ণ অন্য এক গোলার্ধে।
ভাবতে অবাক লাগে, এতদিন কী করে বেঁচে ছিল সকাল ওকে ছাড়া? আর কী করে বেঁচে থাকবে সামনে?
দরজায় টোকা পড়ছে। সকাল উঠল। দরজা খুলে দেখা গেলো ফাহাদ দাঁড়িয়ে আছে।
—‘কী খবর?’
—‘ভালো।’ শুকনো গলায় বলল সকাল।
—‘ভেতরে আসতে বলবে না?’
— ‘হ্যাঁ এসো।’
ফাহাদ ঢুকলো ঘরে। বলল, ‘তোমার কদিন ধরে কী হয়েছে বলো তো? খুব আপসেট দেখায়।’
—‘তেমন কিছু না।’
ফাহাদ চেয়ারে বসলো। সকাল বলল, ‘তুমি অফিসে যাওনি?’
—‘আজকে ছুটি। কলম্বাস ডে।’
—‘কলম্বাস ডে কী?’
—‘ন্যাশনাল হলিডে। ১৪৯২ সালে এই দিনে ক্রিস্টোফার কলম্বাস আমেরিকায় পা রেখেছিলেন। প্রতি বছর অক্টোবরের দ্বিতীয় সোমবার এই দিনটি পালন করা হয়।’
—‘ও আচ্ছা।’
ফাহাদ চেয়ারে বসতে বসতে বলল, ‘তোমার কী হয়েছে?’
সকাল করুণ মুখ করে বিছানার ওপর বসলো। কী বলবে সে? কিভাবে বলবে? বলার মতো কোনো ভাষা বা মানসিকতা কোনোটিই তার নেই এ মুহূর্তে। বুকের ভেতরটা থমকে আছে। মনে হচ্ছে একটা ভারি পাথরের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।
ফাহাদই কথা বলল, ‘শোনো। নাবিলা আমাকে বলেছে তোমার আর ভাইয়ের ব্যাপারে। তুমি কি আমাকে একটু খুলে বলবে যে সমস্যাটা আসলে কোন জায়গায়?’
সকাল একটা দীর্ঘ নিশ্বাস নিলো। তাকালো ফাহাদের চোখে চোখে। কোনো রকম সূচনা ছাড়াই বলে ফেললো,
—‘তোমার ভাই আমাকে পছন্দ করে না। আর দুঃখজনক হলেও ব্যাপারটা সত্য যে আমি তাকে পছন্দ করেছিলাম। কিন্তু এখন আমি পুরোপরি নিশ্চিত যে সে আমাকে চায় না। তাই চেষ্টা করছি পুরো বিষয়টা ভুলে যাবার। একটু কষ্ট হচ্ছে। সময় লাগবে হয়তো। কিন্তু আমার বিশ্বাস আমি সামলে নিব।
ফাহাদ খুব অবাক গলায় বলল, ‘তুমি কী করে বুঝলে যে ভাই তোমাকে পছন্দ করে না?’
সকাল সংক্ষেপে টিলির বার্থডের দিনের ঘটনাটি খুলে বলল। শুনে ফাহাদ খুব চিন্তিত গলায় বলল,
—‘আমার মনে হচ্ছে কোথাও কোনো ভুল হচ্ছে। তোমাদের উচিত সামনা-সামনি বসে ব্যাপারটা নিয়ে খুলে কথা বলা।’
—‘কী করে কথা বলবো? সে তো আমাকে ধরাই দিচ্ছে না। আমি যেচে কথা বলতে গেলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিচ্ছে। ভাবটা এমন দেখাচ্ছে যে আমার সাথে কথা বলা তো দূরে থাক যেন আমার দিকে তাকালেও তার ঘেন্নায় গা গুলিয়ে আসছে।’
—কিন্তু কেন? হঠাৎ করে ও কেন এমন আচরণ করবে? শোনো ভাই হচ্ছে প্রচণ্ড ইন্ট্রোভার্ট একটা ছেলে। আমি যদি এখন ওর সাথে এ ব্যাপারে কথা বলতে চাই, তাহলে কী হবে জানো? সে পুরো বিষয়টা চেপে যাবে। তোমাকে যে পছন্দ করে এই কথাটাও স্বীকার করবে না। আমি ওর সাইকোলজিটা বুঝি। ওর ইগো অনেক বেশি। সে মরে যাবে কিন্তু মানুষের কাছে ছোট হবে না।’
—‘এতো ইগো থাকলে তো সমস্যা।’
—‘হ্যাঁ সমস্যা তা আমি জানি। এখন তোমাকেই কিছু করতে হবে।’
—‘আমারও ইগো অনেক বেশি ফাহাদ। আমার আত্মসম্মান বোধ প্রবল। আমি যেচে কথা বলতে গেছি গতকাল সকালে। সে আমাকে পাত্তাই দিচ্ছে না।’
—‘যে কোনো একজনকে তো এগিয়ে আসতেই হবে। তোমাকে আমি শত ভাগ নিশ্চিত করে বলে দিতে পারি যে ভাই কখনো মুখ ফুটে কিছু বলবে না। মেয়েদের ব্যাপারে সে সব সময়ই খুব উদাসীন।’
সকাল একটু রাগের সুরে বলে, ‘থাক তাহলে উদাস হয়েই থাক। সে কিছু না বললে আমিও বলবো না। আমি অত সস্তা না।’
ফাহাদ হেসে ফেললো এই পর্যায়ে। বলল, ‘তোমরা দুজনে একইরকম। কিন্তু এই একগুঁয়েমিটা তোমাদের ক্ষতি করছে। সময় একবার হাত থেকে চলে গেলে সারা জীবন পস্তাতে হবে।’
সকাল চুপ করে থাকে। ভারি বিষণ্ণ আর হতাশ দেখায় তার মুখখানা ফাহাদ বলল, ‘শোনো, আর দেরি করো না। যাও গিয়ে কথা বলো ওর সাথে।’
সকালের বুক ধক করে ওঠে। চমকলাগা গলায় বলে,
—‘কী বলছো? এখন কথা বলবো?’
—হ্যাঁ এখনই। বাড়িতেই আছে ও। গাড়ি গ্যারাজে।’
সকাল হতভম্ব গলায় বলল, ‘কী বলবো?’
—‘কী বলবে তা আমার শিখিয়ে দিতে হবে?’
সকাল কেমন বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ ফাহাদের দিকে। তারপর সন্দিহান গলায় বলে,
—‘যাবো বলছো?’
—‘অবশ্যই যাবে।’
—‘কিন্তু ফাহাদ, আমরা কেউ তো কাউকে ভালোলাগার কথা কখনও মুখ ফুটে বলিনি। আজ হঠাৎ আমি কীভাবে কথা শুরু করবো?’
—‘তুমি খুব বোকা সকাল। মুখ ফুটে বলোনি বলেই তো সমস্যাটা দেখা দিয়েছে। যাও সব কিছু খুলে বল। তোমার মনে যা আছে সবটা ঝেড়ে ফেলো। দেখবে হালকা লাগবে।‘
—‘কিন্তু ও যদি ….ও যদি না করে দেয়? যদি ও আমাকে সত্যিই ভালো না বেসে থাকে? তখন সেই অপমান আমি সইবো কী করে?’
ফাহাদ একটু চুপ করে থেকে বলে, ‘এরকম মানসিক টানাপোড়েনের ভেতর থাকার চাইতে আমার মনে হয় ওটাই বেটার হবে। এটলিস্ট তুমি জানতে পারবে যে তোমার অবস্থানটা কোথায়। যদি ও তোমাকে পছন্দ না করে থাকে তাহলে তোমাকে তো মুভ অন করতে হবে তাই না?’
সকাল আর কিছু বলতে পারলো না। তার বুকের ভেতরে তুফান বইছে। সে বুঝতে পারছে যে ফাহাদের বলা কথাগুলোতে যুক্তি আছে। তার উচিত লোকটার সাথে সরাসরি কথা বলা। কিন্তু একটা অসম্ভব রকমের ভয় তাকে ক্রমে ক্রমে গ্রাস করে ফেলছে। তার মনে সংশয় দেখা দিয়েছে। কেবলই মনে হচ্ছে যদি আরশান তাকে ভালো না বাসে? যদি মুখের ওপরে না করে দেয়? যদি আবার সেদিনের মতো তাড়িয়ে দেয়?
মরে যাবে সকাল। ফাহাদ জানে না। কেউ জানে না। জানে শুধু সকাল নিজে। লোকটা তাকে অবহেলা করলে, অপমান করলে, ঘেন্না করলে সকালের মরণ সুনিশ্চিত।
ফাহাদ তাড়া দিয়ে উঠল, ‘বসে আছো কেন? যাও যাও। এক্ষুণি যাও।’
—‘যাবো?’
—‘হ্যাঁ যাবে।’
ফাহাদ সকালের হাত টেনে ধরে বসা থেকে দাঁড় করায় ওকে
সকাল দুরুদুরু বুক নিয়ে বলে, ‘আচ্ছা যাচ্ছি একটু পরে।’
—‘একটু পরে না। এখুনি যাবে তুমি।’
সকাল বেকায়দায় হাসে, ‘কী যন্ত্রণা!’
খানিক বাদে সকাল বলল, ‘যাই হোক। তোমার আর নাবিলার ব্যাপারে শুনলাম ফাহাদ। কনগ্রেচুলেশনস।’
ফাহাদ একটু লাজুক হাসলো, বলল, ‘ধন্যবাদ।’
—‘তারপর তোমাদের প্রেম কেমন চলছে?’
—‘আর প্রেম! তোমার বান্ধবীতো পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত সারাদিন। আমাকে একটুও সময় দেয় না।’
—‘তাই নাকি?’ দেবে দেবে। মাত্র তো শুরু!’ বলে সকাল দুষ্টুমির হাসি হাসে। তারপর আবার বলে, ‘তুমি এতো স্মার্ট। এতো রোমান্টিক। আর তোমার ভাইটি অমন হাঁদারাম কেন বলো তো?’
ফাহাদ হো হো করে হেসে উঠল, বলল, ‘আমার ভাই হচ্ছে রিয়েল জেম। অত সহজে ওকে পাওয়া যাবে না। যাই হোক। আমি যাচ্ছি। তুমিও যাও নিচে।’
সকাল বলল, ‘হ্যাঁ যাবো। তোমাকে একটা কথা বলি ফাহাদ। মন দিয়ে শোনো।’
—‘বল।’
—‘নাবিলা খুব ভালো মেয়ে। মুখে যতই পকপক করুক না কেন মনটা একদম কাদার মতো নরম। ওকে কখনো কষ্ট দিও না, কেমন?’
ফাহাদ স্ফীত হেসে বলল, ‘কষ্ট দেবো না। কথা দিচ্ছি।’
—‘মনে রেখো। ওয়াদা করলে কিন্তু।’
ফাহাদ চলে যাবার পর নাবিলাকে ফোন করলো সকাল। ফাহাদের সাথে যে কথোপকথন হয়েছে তার অনেকখানিই তুলে ধরলো ওর কাছে। শুনে নাবিলা বলল,
—‘আমার মনে হয় ফাহাদ ঠিকই বলেছে। তোর উচিত নিজ থেকে কথা বলা।’
—‘আমি কোনো মতেই মুখ ফুটে ভালোলাগার কথা জানাতে পারবো না।’
—‘তাহলে লিখে দে।’
—‘ধ্যাত্তেরিকা, জীবনটা সিনেমা নাকি?’
নাবিলা একটু চুপ করে থাকলো। তারপর বলল,
—‘তাহলে এক কাজ কর। ওকে বল যে তোর জন্য তোর বাসা থেকে ছেলে দেখছে। বিয়ে দিয়ে দেবে তোকে।’
—‘এরকম বলবো কেন?’
—‘বলেই দেখ না। দেখবি কেমন সোজা হয়ে যায় কথাটা শুনে।
—‘মানে তুই বলতে চাইছিস আমার বিয়ের কথা শুনলে ও জেলাস হবে?’
—‘আলবৎ হবে। শুধু জেলাস হবে না, দেখবি তোকে প্রপোজও করে ফেলবে। ওর মুখ থেকে কথা বের করে আনার এর চেয়ে ভালো উপায় আর নাই।’
সকাল ভাবলো। বলল,
—‘তুই ভেবে চিন্তে বলছিস?’
—‘খুব ভেবে বলছি। ছেলেরা এমনই। নিজের জিনিসে অন্যের হাত পড়ার আগে টনক নড়ে না। দাম থাকে না।’
—‘আচ্ছা ভেবে দেখি।’
—‘ভাবতে হবে না। যা বললাম, তা কর। এখনই যা। দেরি করিস না। এমনিই অনেক দেরি হয়ে গেছে। তোমাদের ইগো তোমাদের জীবন শেষ করে দিচ্ছে। তবুও তোমরা ইগো ছাড়তে পারো না। দুইজনকে ধরে আমার মারতে ইচ্ছা করে।
ফোন রাখার পর নিজেকে একটু ঠিকঠাক করে নিল সকাল। তার পরনে একটি সবুজ রঙের টি শার্ট ছিল। ওটা পাল্টে সাদা একটা টপ পরে নিলো। আরশানের সাদা রং পছন্দ তাই। ঠোঁটে মাখলো হালকা গোলাপি লিপস্টিক। সাদা টপ আর কালো জিন্স পরে আয়নার সামনে দাড়ানোর পর নিজেকে তার বেশ সুন্দর বলেই মনে হলো।
৪৬
সিঁড়িঘরের দরজাটা খুললো সকাল। তার ভেতরে একটা ঘোর কাজ করছে। মস্তিষ্কের শিরা উপশিরাগুলো নিঃসাড়। ভেতরটা অনুভূতিশূন্য। শুধু টের পাচ্ছে দু’ চোখ জুড়ে এক অদমনীয়, অপ্রতিরোধ্য তৃষ্ণা জেগেছে। তৃষ্ণা জেগেছে ওই মানুষটাকে এক নজর দেখবার জন্যে। মনে হচ্ছে যেন বহু বহু দিন ধরে দেখেনা ওই মুখটা।
সকাল দরজায় টোকা দিলো না। কিছুক্ষণ ঝিম ধরে দাঁড়িয়ে রইল সিঁড়ির সামনে। একটু বাদে ধীরে ধীরে নেমে আসলো সিঁড়ি বেয়ে। নিচ থেকে কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। মানুষটা কি বাসায় নেই নাকি? কিন্তু ফাহাদতো বলল ও গাড়ি দেখেছে গ্যারেজে। অবশ্য গাড়ি থাকলেই বা কী? এই ছেলে সারাদিন জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। হয়তো এখনো জঙ্গলেই গেছে।
মনটা খারাপ হয়ে গেলো। তাহলে তো দেখা হবে না। কিন্তু তার যে খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে এক নজর!
লিভিং রুমে সিঙ্কের নিচে ডিশ ওয়াশার চলছে শো শো শব্দ করে। ডাইনিং এর চেয়ারগুলো খালি। কেউ নেই কোথাও।
না আছে ….আছে। নিশ্বাসের শব্দ পাচ্ছে সকাল।
চারিদিকে চোখ ঘোরাতেই সোফার ওপর শুয়ে থাকা লম্বা মানুষটাকে দেখতে পেলো সে।
ঘুমোচ্ছে।
চিৎ হয়ে শুয়ে হাত দুখানা বুকের ওপর আড়াআড়ি ভাবে রেখে অঘোরে ঘুমোচ্ছে।
সকাল পায়ে পায়ে সোফার কাছে এগিয়ে আসলো। কাচের দরজা ভেদ করে ঝিম দুপুরের এক টুকরো মিঠা রোদ এসে পড়েছে ওর কপালের কাছে। অবিন্যস্ত চুল। গায়ে একটি বাদামি রঙের কলার ওয়ালা পোলো শার্ট।
সকাল সোফার সামনে মেঝেতে বসলো হাঁটু গেঁড়ে। খুব কাছ থেকে চাইলো আরশানের মুখের দিকে। গায়ে গতরে, লম্বা চওড়া বিশাল মানুষটি হলেও এই মুহূর্তে ঘুমের ঘোরে তাকে দেখাচ্ছে অপাপবিদ্ধ সরল শিশুর মত। খোঁচা দাড়ির জঙ্গলের পেছনে মনে হচ্ছে যেন ভারি নিষ্পাপ একখানা মুখ লুকিয়ে আছে।
সকাল খুব আস্তে করে ওর কপালে হাত রাখলো। ধীরে ধীরে হাত বুলাতে থাকলো ওর ছোট করে ছাঁটা চুলে। তার হৃৎপিন্ডের গতি বাড়তে থাকলো।
হাত কাঁপছে। আশ্চর্য এক পবিত্র ভালো লাগায় শরীর মন ভরে যাচ্ছে।
কাচ তোলা জানালায় নীরব, নিরিবিলি শান্ত এক দুপুর। রোদে ভাসছে ঘরের মেঝে। কোথাও কোনো শব্দ নেই, শুধু ডিশ ওয়াশারের শা শা, আর এই মানুষটার নিশ্বাসের ওঠানামা।
আরশান ঘুমে কাদা। লম্বা চোখের পাঁপড়িগুলো চোখের কার্নিশে পড়ে আছে সুবিন্যস্ত হয়ে। সকাল শুনতে পাচ্ছে ওর বুকের ধুকপুক। তার চোখদুটি ঈষৎ জলসিক্ত হয়ে উঠেছে। গলায় কান্নার ঢেউ।
কতক্ষণ কে জানে! সকাল ওখানটাতেই বসে রইল ওই মুখের দিকে তাকিয়ে। চিরুনির মতো চলতে থাকলো তার হাতের আঙ্গুল আরশানের চুলের ভেতর। চেয়ে থাকতে থাকতে সকালের মনে হচ্ছিল এই মানুষটাকে সৃষ্টিকর্তা ভারি যত্নে গড়েছেন বুঝি, সময় নিয়ে একটু একটু করে।
চোখদুটো আচমকা যন্ত্রের মতো খুলে গেলো। সকাল চমকে উঠে পিছিয়ে গেলো এক হাত দূরত্বে।
আরশান ধাঁধা লাগা চোখে অপলক চেয়ে রইল খানিকক্ষণ সকালের দিকে।
হতভম্ব হয়ে বলল, ‘আপনি এখানে? কী চাই?’
সকাল বিমূঢ়, বুদ্ধিভ্রষ্ট! চোখে খেলছে ভয়, লজ্জা এবং অপরাধবোধের এক মিশ্র অনুভূতি।
আরশান ভ্রু কুঁচকে শোয়া থেকে উঠে বসলো। তীক্ষ্ণভাবে আরেকবার দেখে নিলো সকালকে।
—‘কী ব্যাপার?’ ভীষণ রুক্ষ শোনায় আরশানের কণ্ঠস্বর।
সকাল আতঙ্কে কেঁপে ওঠে ভেতরে ভেতরে। ভয়ার্ত গলায় বলে, ‘কিছু না।’
—‘কিছু না মানে? আপনি আমার ঘরে কী করছেন?’
সকাল নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করলো। একটা দম নিয়ে সাহস সঞ্চয় করে বলল, ‘কিছু করছি না। এমনিই এলাম।’
কথাটা শুনে আরশান সকালের দিকে এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো। যেন এহেন আজগুবি কথা সে তার জীবনে এর আগে কখনো শোনেনি।
সকাল তখনও মেঝেতেই বসে আছে।
—‘এমনিই এলেন? এমনি কেন এলেন?’
অপমানে থমথম করে উঠল সকালের মুখখানা। অভিমানও হলো খুব কিন্তু প্রশ্নটা যুক্তিযুক্ত। একজন যুবতী মেয়ে ভরদুপুর বেলা অনাত্মীয় এক যুবকের ঘরে কেন আসবে এমনি এমনি কোনো কারণ ছাড়া?
—‘আমার ইচ্ছে করলো তাই।’
আরশান উঠে পড়ল। বলল, ‘আমি এখন শাওয়ার নিব। তারপর মিটিং আছে। আপনার কিছু বলার থাকলে বলে ফেলে কেটে পড়তে পারেন।’
সকান কিছুই বলল না। যেভাবে বসে ছিল সেভাবেই বসে রইল মেঝের ওপর মূর্তির মতো হয়ে।
আরশান আর কোনও কথা না বলে নিজের বেডরুমে এসে টাওয়েল নিয়ে গোসল খানায় ঢুকলো। সকালের এই আকস্মিক আগমনে সে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। গতরাতে এন্ড্রিয়ানার বাসা থেকে ফেরার পর থেকে খুব দিশেহারা লাগছিল। ভুলেও জানতো না সে যে মুখ ফসকে কথাটা ওভাবে বেরিয়ে যাবে। তার জীবনটা ছিল ঝামেলা বিহীন, নিশ্চিন্ত এবং কিছুটা বিষণ্ণ। এ কথা ঠিক মাঝে মাঝে খুব লন্ডভন্ড করতে ইচ্ছে হতো। মনে হতো ঘটনাবিহীন জীবনটাতে দারুণ কিছু ঘটুক। কোনো যুদ্ধ বাঁধুক কোথাও। আগুন জ্বলুক। এক ঘেয়েমি ভাব কাটিয়ে তুলতে কী না করেছে সে? নানা রকম দুঃসাহসিক কাজে ডুবে থেকেছে দিন রাত। দিনের দিনের পর দিন একলা বনমানুষের মতো ঘুরে বেড়িয়েছে জঙ্গলে। পাহাড় বেয়েছে, পাহাড় থেকে লাফিয়ে নেমেছে জলাশয়ে, সমুদ্রের নিচে ঘুরে বেরিয়েছে অসংখ্য বার। সমুদ্রের তলদেশের বিচিত্র দৃশ্য এবং প্রাণের অস্তিত্ব তাকে মুগ্ধ করেছে বারংবার। বৈচিত্র খুঁজে পেতে ইরাকে গিয়ে মুমূর্ষ যুদ্ধাহত শিশুদের পাশে গিয়ে দাড়াবে বলেও মনস্থির করেছিল এক সময়। বাবার জন্য পারেনি। একঘেয়ে জীবন তার ভালো লাগে না। বিশেষ করে যে জীবনে বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করতে হয় না। সব কিছু পরিকল্পিত এবং সুনিশ্চিত সেই জীবন যাপন করার মাঝে কোনো তরঙ্গ খুঁজে পায় না সে।
তরঙ্গ অবশেষে এলো। এ এক অন্যরকম তরঙ্গ। সেই তরঙ্গে তোলপাড় হলো তার একার নিজস্ব ছোট্ট ভুবনটা। আর এই তোলপাড়ের পর পুরো দুনিয়াটা তার কাছে কেমন মূল্যহীন হয়ে পড়ল। এখন কেবলই মনে হয় ওই মানুষটার সাথে একঘেয়ে, নির্ঝঞ্জাট, সাধারণ একটা জীবন কাটাতে পারলেই এই জন্ম বুঝি সার্থক হবে।
ভেতরের মানুষটা অট্টহাসি দিয়ে উঠল,
‘শেষ পর্যন্ত তুমিও…’
আরশান ওতে কর্ণপাত করলো না। গরম জলের নিচে দাঁড়িয়ে ভিজতে ভিজতে তার মাথায় তৎক্ষণাৎ যে চিন্তাটা এলো তা হলো, অনিককেই যদি ভালোবাসে সকাল তাহলে তার কাছে কী চায়? তার প্রতি ওর ওই চাউনিতে, কথার ঢঙে কোথাও না কোথাও কি কোনো বিশেষ অনুভূতির ছোঁয়া লেগে নেই? আছে তো! আরশান তো টের পায়, বোঝে। তাহলে আবার অনিকের সাথে কেন অমন নিশ্ছিদ্র ঘনিষ্ঠতা?
মেয়েটা কি ডাবল প্লে করছে?
হঠাৎ কেমন একটা ঘেন্না হলো তার। মনে পড়ল অনিকের সাথে সকালের অমন গায়েপড়া প্রতিটা মুহূর্ত। মেয়েটা এমন কেন?
স্লাইডিং ডোরে কেউ একজন টোকা দিচ্ছে। সকাল তাকিয়ে দেখলো একটি কালো ছেলে হাতে বাক্স নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে উঠে গিয়ে দরজাটা খুললো। ছেলেটা দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল, ‘গুড আফটার নুন! তোমার পিৎজা এসে গেছে।’
সকাল একটু আমতা আমতা করে বলল, ‘আমি তো অর্ডার করিনি। যে অর্ডার করেছে সে ওয়াশরুমে। তোমাকে কি অনলাইনে টাকা দেয়া হয়েছে?’
ছেলেটি বলল- ‘হ্যাঁ দেয়া হয়েছে। কিন্তু টিপস ইনক্লুডেড ছিল না। ‘ বোঝা গেল সে টিপস চায়।
সকাল বলল, ‘তুমি একটু অপেক্ষা কর। আমি আসছি।’
ছেলেটিকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে পিৎজার বক্সটা টেবিলের ওপর রাখলো সে। অস্বস্তি লাগছিল তার। সে আরশানের শোবার ঘরের দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকলো। আজকে মনে হচ্ছে ঘরটা একটু এলোমেলো। বিছানার ওপর ডাই করে রাখা কাপড়চোপড়, ল্যাপটপ, ল্যাপটপের চার্জার এবং আরো অনেক অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। বিছানার চাদরটাও দুমড়ে-মুচড়ে আছে। টেবিলের ওপর বইপত্রের ছড়াছড়ি। বইগুলো নেড়েচেড়ে দেখলো সকাল। বেশির ভাগ বই-ই আর্কিটেকচারের ওপর। সালমান রুশদির লেখা ‘দ্যা সাতানিক ভার্সেস’ বইটি আধ খোলা অবস্থায় উল্টো করে রাখা টেবিলের ওপর। দেয়ালের চিত্রকর্মগুলোর সামনে মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে খানিকক্ষণ। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখল একলা হলুদ বনে দাঁড়িয়ে থাকা আঁকা বাকা শিং ওয়ালা, মায়াবী চোখের হরিণটাকে। মনে হচ্ছে এখুনি যেন ছবি থেকে বেরিয়ে আসবে। এতটাই জীবন্ত! ছুঁয়ে দেখল ওক গাছের ডালের ঝুলনে বসা আদুরে কবুতরটাকে। আবিষ্ট হয়ে চেয়ে রইল হরেক রঙে রাঙানো সেই অচিন পুরের ছবিটির দিকে। এ ঘরের একেকটি দেয়াল যেন একেকটি ভিন্ন জগৎ, ভিন্ন গল্প।
খুট করে দরজা খোলার শব্দ হল। ভীষণ চমকালো সকাল। আরশান বেরিয়ে এসেছে বাথরুম থেকে। তার কোমরে টাওয়েল জড়ানো। আদুর গা। চুল থেকে তখনো টুপটাপ ঝরে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা পানি। বাতাসে ভেসে আসছে আফটার শেভের সুন্দর ঘ্রাণ। সকালকে ওরকম আচমকা নিজের ঘরে আবিষ্কার করে সে স্তম্ভিত হয়ে গেল। হতচকিত ভাবে বলল, ‘সিরিয়াসলি? মানে আপনি হুট করে আমার বেডরুমে ঢুকে গেলেন? আপনার কোনো কমন সেন্স নেই?’
সকাল লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে যেতে বলল, ‘আপনার পিৎজা নিয়ে এসেছে।’
—‘তো?’
—‘টিপস চায় ছেলেটা আর আমার কাছে ভাংতি টাকা নেই। থাকলে দিয়ে দিতাম।’
—‘আমার ঘরে টাকা চুরি করতে এসেছেন?’
—‘চুরি করতে আসব কেন? চাইতে এসেছি। এত ক্যাট ক্যাট করার কী হল?’
—‘ক্যাট ক্যাট করব না তো কী করব? আপনি অনুমতি না নিয়ে আমার ঘরে ঢুকে গেলেন কোন আক্কেলে? আমি যদি নেকেড বেরিয়ে আসতাম বাথরুম থেকে?’
শুনে সকাল মুখে হাত চাপা দিয়ে হাসতে লাগলো। আড়চোখে ওই সবল, দীর্ঘকায়, সুন্দর গড়নের শরীরটার দিকে তাকিয়ে থেকে একটু কেমন সম্মোহিতও হয়ে গেলো যেন। আরশান টেবিলের ড্রয়ার খুলে ওয়ালেট বের করল। পাঁচ ডলারের একটা নোট ওয়ালেট থেকে বের করে সকালের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এটা দিয়ে দিন।’
সকাল বেরিয়ে আসলো। ডেলিভারি বয় চলে যাবার আরো মিনিট পাঁচেক পর আরশান বেরোলো ঘর থেকে। গায়ে নেভিব্লু টি শার্ট, কালো ট্রাউজার।
চোখ কপালে তুলে বলল, ‘আপনি এখনো যান নাই?’
—‘না।’
—‘কেন? পিৎজা চাই?’
—‘আমি পিৎজা খাই না।’
—‘তাহলে বসে আছেন কেন?’
—‘আমার ইচ্ছা।’
আরশান ডাইনিং এর চেয়ারে বসে পিৎজার বক্স খুলতে খুলতে বলল, ‘আমার মিটিং আছে।’
—‘বের হবেন? আজ তো সরকারি ছুটি। কোথায় যাবেন? আর আপনার না ভ্যাকেশন চলছে?’
—‘না বাসায়ই থাকবো। অনলাইন মিটিং। আগামীকাল থেকে অফিস জয়েন করছি। ভালো লাগছে না বাসায় বসে থাকতে।’
—‘বেশ।’
—‘বেশ মানে?’
—‘বেশ মানে বেশ।’
—‘আপনি বসে থাকবেন?’
—‘হ্যাঁ বসে থাকবো।’
আরশান পিৎজার স্লাইসে কামড় দিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘আপনার মতলবটা কী আসলে?’
সকাল হেঁটে এসে বসলো ওর পাশের চেয়ারে। একটা বড় নিশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘কোনো মতলব নেই। বলতে এসেছি যে আমার বিয়ের কথা চলছে।’
আরশান কথাটা শুনে চমকালো না। স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘অনিকের সাথে?’
সকাল হকচকিয়ে গেলো ক্ষণিকের জন্য নামটা শুনে।
— ‘আছে একজন। আপনার নাম না জানলেও চলবে।’
—‘সেই একজনকে আপনি ভালোবাসেন?’
সকাল চোখ নামিয়ে নিল এবং আরশানের নির্বিকারত্ব দেখে মর্মাহত হয়ে পড়ল। মনে হচ্ছে প্ল্যানটা কাজ করবে না। এই ছেলেটা …..নাহ ছেলেটা মনে হয় ওকে ভালোবাসে না। ভালোবাসার মানুষের অন্য জায়গায় বিয়ে হয়ে যাচ্ছে এটা শোনার পরে কি কেউ এত স্বাভাবিক থাকতে পারে?
সকাল মরা গলায় বলল, ‘আপনাকে কেন বলবো?’
কথাটা শুনে আরশান ওর নিজস্ব কায়দায় মুখ বাঁকালো, স্পষ্টভাবে বলল, ‘কথা ঠিক। আমাকে কেন বলবেন? কিন্তু আপনার বিয়ে ঠিক হয়েছে এই কথাটাই বা আমাকে কেন বললেন? আমি জেনে কী করবো?’
সকাল নিভলো। ফাটা বেলুনের মত চুপসে গেলো তার মুখখানা। বলল, ‘আমার ইচ্ছা!’
আরশান ওর নাকউঁচু হাসিটা হাসলো শুধু। মুখে কিছু বলল না। পূৰ্ণ চোখ মেলে চাইলো সকালের দিকে। মনে হচ্ছিল যেন বহু বহু দিন পর চোখের সামনে এই মুখটি দেখতে পেলো। চোখ ভরে, মন ভরে, প্রাণ ভরে এই সহজ-সরল স্নিগ্ধ মুখখানা দেখতে তার এতো কেন ভালো লাগে? দেখতে দেখতে তার চোখে কেমন ঘোর লেগে গেলো। সে পিৎজার স্লাইস সরিয়ে রেখে ঢক ঢক করে এক গ্লাস পানি খেলো। সকাল বলল,
—‘শেষ করুন। রেখে দিলেন কেন?’
—‘খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না।’ বলে সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালো। কফি মেশিনে সময় নিয়ে কফি বানালো। ওই সময়টুকুতে কেউ কোনো কথা বলছিল না। সকাল অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে বসেছিল। কী করা উচিত, কী বলা উচিত কিছুই সে বুঝে উঠতে পারছিল না। নাবিলার প্ল্যান তো ফেইল করে গেল। এখন?
কফি বানানো হয়ে গেলে আরশান ধোঁয়া ওঠা কফির মগ হাতে নিয়ে আবার চেয়ারে এসে বসলো। সকালের নিখুঁত সুন্দর ঠোঁটজোড়ায় চোখ রেখে একটু দুর্বল গলায় বলল, ‘আপনার ঠোঁটদুটো কি আসলেই একটু বেশি সুন্দর? নাকি আমার কাছে লাগে?’
সকাল চোখ নামালো। শিরশির করে একটা স্রোত বয়ে গেলো মেরুদণ্ড দিয়ে। রক্ত জমলো ফর্সা মুখখানায়। আস্তে করে বলল,
—‘আমার শুধু ঠোটই সুন্দর? অন্য কিছু সুন্দর নয়?
আরশান ঠাট্টার ছলে বলল, ‘সবটা তো দেখিনি!’
—‘আপনি কি সব মেয়েদের সাথেই অমন ফাজিল কথা বলেন? নাকি শুধু আমার সাথে?’
—‘আপনিই প্রথম। তবে শেষ কিনা বলতে পারছি না।’ এটুকু বলে কিছু একটা মনে পড়তেই সে হঠাৎ খুব গম্ভীর হয়ে গেল।
ভারি গলায় বলল, ‘আপনি আমাকে খারাপ করে দিচ্ছেন। আমি ভালো ছিলাম আগে।’
—‘এখন আমার দোষ?’
—‘হ্যাঁ। সব আপনার দোষ। মিটিং শুরু হয়ে যাচ্ছে। আপনি কি উঠবেন?’
সকাল অকপটে বলল, ‘না।’
—‘থাকুন তাহলে।’
আরশান ব্যস্ততার সাথে উঠে পড়ল। শোবার ঘরে গিয়ে দোর আটকালো।
সকাল থম মেরে বসে ছিল। জানালা দিয়ে রোদ এসে লুটোপুটি খাচ্ছে মেঝেতে। আলোয় ভাসছে চারপাশ। তার কেমন ভয় ভয় করছে। ভারি অনিশ্চয়তায় কাঁপছে বুকের ভেতরটা। নাবিলা বলেছিল বিয়ের কথা বললেই আরশান ভেজা বেড়ালটি হয়ে যাবে। ছেলেরা নাকি এমনই। নিজের জিনিসে অন্যের হাত যতক্ষণ না পড়ে ততক্ষণ তাদের টনক নড়ে না। কিন্তু বিয়ের কথা শুনে এই ছেলের টনক নড়ার তো কোনো লক্ষণ দেখা গেলো না। ভীষণ এলোমেলো লাগতে লাগলো সকালের। কেমন একটা ধোঁয়াশার ভেতর ডুবে রইল সে অনেকটা ক্ষণ।
সকাল এখন কী করবে? খুলে বলবে কি সব কিছু? একটা মেয়ে হয়ে সে কী করে করবে এমন বেহায়ার মতো কাজটা? নারীরা সংকোচ করবে, আর পুরুষ সেই সংকোচ ভাঙাবে। এটাই তো নিয়ম। এই নিয়ম ভঙ্গ করার সাহস অন্তত তার মতো সাধারণ একটি মেয়ের কখনওই হয়ে উঠবে না।
সকাল সোফায় শুয়ে পড়ল। তার কি এখন চলে যাওয়া উচিত? হয়তো উচিত। কিন্তু ইচ্ছে করছে না তো যেতে! মনে হচ্ছে চিরটা কাল এভাবে এখানেই থেকে যেতে, মানুষটার কাছাকাছি।
প্রায় চল্লিশ মিনিট পরে আরশান ঘর থেকে বেরোলো। বের হয়েই তীরের মতো ছুঁড়ে দিলো কথাটা, ‘আমি বাইরে যাচ্ছি।’
—‘কোথায়?’
—‘জঙ্গলে।’
—‘জঙ্গলের ভেতর অত কী করেন আপনি?’
—‘ধ্যান করি।’
—‘কিসের ধ্যান করেন?’
—‘আপনাকে কেন বলবো?’
—‘আচ্ছা বলতে হবে না। আমিও যাবো আপনার সাথে।’
—‘আপনার হয়েছে কী আজকে? আঠার মতো লেগে আছেন কেন আমার সাথে? স্পাইগিরি করছেন নাকি?’
—‘হ্যাঁ করছি।’
—‘কেন?’
—‘আমার ইচ্ছা।’
—‘প্রতিটা প্রশ্নের উত্তরে আমার ইচ্ছা আমার ইচ্ছা করছেন কেন? প্রব্লেম কী আপনার? আর তাছাড়া আপনার ফিউচার হাজবেন্ড মাইন্ড করবে না?’
—‘মাইন্ড করবে কেন?’
—‘সে কি জানে যে আপনি তখন থেকে আমার ঘরে এসে বসে আছেন?’
—‘তার জানতে হবে কেন?’
আরশান এই পর্যায়ে খুব বিরক্ত হলো, মুখ দিয়ে একটা চ-কারান্ত বিরক্তিসূচক শব্দ করে উঠে বলল, ‘আমি চাই না আপনি আমার সাথে আসেন। যে জায়গায় যাচ্ছি সেখানে আমি ছাড়া আর কেউ যায় না।’
সকাল বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে দৃঢ় গলায় বলল, ‘আমি যাবো।’
৪৭
পায়ের কাছ দিয়ে একটা চার পেয়ে ছোটখাটো জন্তু সড়াৎ করে সরে গেলো। সকাল চমকে উঠেছিল। ভয় পাওয়া গলায় বলল,
—‘এটা কী?’
আরশান এগিয়ে হাঁটছিল। সকাল ঠিক কিসের কথা বলছে তা সে ঠাওর করে উঠতে পারলোনা। বলল,
—‘কোনটা কী?’
—‘এইযে মাত্র আমার পায়ের কাছ দিয়ে গেলো।’
—‘ভূত মনে হয়।’
—‘ধ্যাৎ, ভূত কি ওরকম জন্তুর মতো হয় নাকি দেখতে?’
—‘ভূত কি শুধু মানুষের হয়? পশুর হয় না?’
—‘না হয় না।’
—‘কে বলেছে আপনাকে? এই জঙ্গলে সব কিছুর ভূত আছে। গাছ ভূতও আছে। আর মানুষ ভূত তো অসংখ্য!’
—‘মনে হচ্ছে মানুষ ভূতটা আসলে আপনি।’
আরশান হাসলো। তার হাতে একটি ভাঙা গাছের ডাল। তা দিয়ে সামনের আগাছা সরিয়ে বনপথ পরিষ্কার করে হাঁটছে সে। শেষ দুপুরের মিঠা রোদ আলো ছায়ার খেলা খেলছিল ধু ধু করা অরণ্যের মাঝে। চারপাশটা ভারি রঙিন। প্রকৃতিতে কত রঙের যে খেলা! শুকনো পাতার দল লাল গালিচার মতো ছড়িয়ে আছে বন্য সুড়িপথে। সেই গালিচার ওপরে সূর্যের সোনালি পেলব আলো বিস্তর আরামে শুয়েছে, সারা গায়ে ঝিম ধরা শান্ত দুপুরের আলস্য মেখে। জঙ্গলের ভেতর অবিরাম শোঁ শোঁ বাতাসের ফিসফাস। পাতায় খস খস শব্দ তুলে দুষ্টু কাঠবেড়ালির দল ছুটছে এদিক সেদিক। হাওয়ায় আসন্ন শীতের ঘ্রাণ।
—‘এই লম্বা লম্বা গাছগুলোর নাম কী?’ সকালের প্রশ্ন।
—‘এগুলো সব পাইন গাছ। সামনে বাশঝাড় আছে। আপনি যে জন্তুটাকে দেখেছেন ওটা দেখতে কেমন?
—‘অনেকটা কাঠবিড়ালির মতো। তবে কাঠবিড়ালির চেয়ে আকারে বড় আবার অনেকটা ভাল্লুকের মতো।…’
—‘মনে হচ্ছে র্যাকুন দেখেছেন।’
—‘মনে হয়। ইশ আমার গায়ের কাছ দিয়ে লেগে লেগে গেলো একদম। কেমন গা ঘিন ঘিন করছে।’
আরশান একটু অবাক গলায় বলল, ‘গা ঘিন ঘিন করবে কেন? আপনার ওসিডি আছে নাকি? অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার?’
—‘না না। আমি কি মনিকা গেলার নাকি?’
—‘মনে তো হচ্ছে আপনার কথা শুনে। বাই দ্যা ওয়ে মনিকা গেলার আমার পছন্দের চরিত্র।’
—‘আমার রেচেলকে ভালো লাগে। আর ছেলেদের মধ্যে জোয়ি।’
—‘জোয়ি ট্রিবিয়ানি হ্যা? কেন বাকিদের ভালো লাগে না?’
—‘প্রত্যেকেই অসাধারণ অভিনয় করে। কিন্তু জোয়ি ইজ টু কিউট, ইউ
নো! আর রেচেলকে তো সব ছেলেরা পছন্দ করে। আপনার রেচেলকে ভালো লাগে না?’
—‘উহু! মনিকা ইজ আ বিউটি।’
—‘বিউটি না ছাই! রেচেল সুন্দর।’
—‘হোয়াটেভার।’
—‘এই সিরিয়ালটা’কে এখন পর্যন্ত কেউ বিট করতে পারেনি। আমি তো মন খারাপ হলেই নেটফ্লিক্স খুলে দেখা শুরু করি।’
—‘বাংলাদেশে নেটফ্লিক্স আছে?’
—‘থাকবে না কেন? আপনি আমাদের দেশটাকে কী মনে করেন বলেন তো?’
—‘দেশটা যেরকম, সেরকমই মনে করি।’
‘দেশটা এই ওয়ার্ল্ডের বেস্ট দেশ। জেনে রাখুন।’
আরশান শ্লেষের গলায় বলল, ‘দেশপ্রেম থাকা ভালো কিন্তু মিথ্যা অহংকার থাকা ভালো নয়।’
—‘মিথ্যা অহংকার বলতে?’
—‘এইযে আপনারা মাঝে মাঝেই যেসব ন্যাকা ন্যাকা ডায়লগ ছাড়েন দেশ নিয়ে। এগুলো সব বুলশিট। আপনি তো ঢাকায় থাকেন, বলুন তো ঢাকাকে কি আপনার বসবাসের যোগ্য শহর বলে মনে হয়?’
প্রশ্নটা শুনে সকালের মুখে একটি মেঘ মেদুর ছায়া পড়ল। গম্ভীর গলায় বলল,
—‘আপনার কী মনে হয়?’
—‘ঢাকা একটি ডেন্সলি পপুলেটেড সিটি। শুনুন, শুধু উঁচু উঁচু বিল্ডিং আর ফ্লাইওভার বানালেই উন্নয়ন হয় না। শহরটার ভেতরে একটু বিশুদ্ধ হাওয়া ঢোকানোর ব্যবস্থা করেন। ঢাকার বাইরের শহর, গঞ্জ এলাকাগুলোতে ভালো ভালো স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল গড়ে তুলুন। দেশের আনাচে- কানাচে পড়ে থাকা বেকার জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করুন। শুধুমাত্র রিকশা চালানোর জন্য যে লোকগুলো দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ছুটে আসে রাজধানীতে তাদেরকে নিজের গ্রামে বসবাস করে পেট চালানোর মতো ব্যবস্থা করে দিন। তাহলেই ঢাকার ওপরে চাপ কমবে।’
—‘জনসংখ্যা অত্যধিক বেশি। এসব বড় বড় কথা বলা সোজা। করে দেখানো কঠিন।’
—‘মন থেকে চাইলে ঠিকই করা সম্ভব। কেউ তো এসব নিয়ে ভাবে না আসলে।’
—‘আপনাদের আমেরিকায় এতো এতো খালি জায়গা। দেশ থেকে কিছু মানুষ এখানে নিয়ে আসলেও তো পারেন। দেশটা হালকা হয়।’
—‘আমেরিকা এখন আর আগের মতো নেই। নিজের দেশে বহির্বিশ্বের মানুষের স্থায়ীভাবে থেকে যাওয়াটা এখন আর ওরা সহজ চোখে দেখছে না। ট্রাম্প তো জন্মগত নাগরিকত্ব আইনই বদলে ফেলতে চাইছে।’
সকাল ফোঁস করে একটা ছোট নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘থাক বাদ দিন। এতো সুন্দর একটা দিনে এসব মন খারাপের কথা না বলি আমরা কেমন?’
আরশান পেছন ফিরে তাকালো সকালের দিকে, বলল, ‘দিনটা সুন্দর, তাই না?’
—‘অসম্ভব সুন্দর!’
—‘অক্টোবরের দিনগুলো এমন সুন্দরই হয়। মাঝে মাঝে আমার কী মনে হয় জানেন? মনে হয় চির অক্টোবরের একটা দেশ থাকলে বেশ হতো।’
—‘চির অক্টোবরের দেশ। ভালোই বলেছেন।’
সকালের সেলফোনটা হঠাৎ বেজে উঠল। অনিক ফোন করছে। সকাল ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে বলল,
—‘তুমি কোথায়?’
—‘বাইরে আছি একটু। কেন?’
—‘কখন আসবে?’
—‘এই তো ঘণ্টা খানেক পরে।’
—‘একা একা কোথায় গেলে?’
—‘একা নই।’ বলে ফোনটা কেটে দিল সকাল। আজকাল অনিকের বাড়াবাড়ি একদম সহ্য হচ্ছে না তার। বন্ধুদের একটা নির্দিষ্ট সীমা থাকে, এই বাস্তব জ্ঞানটা বোধহয় ছেলেটার নেই।
আরশান বলল, ‘কে ফোন করেছে? আপনার বয়ফ্রেন্ড?’
—‘অনিক।’ সকাল বলল।
আরশান একটু দ্রুত হাঁটা শুরু করলো। মেয়েটার মতিগতি সে কিছুই বুঝতে পারছে না।
মেয়েটা কি একটু এমনই? ছেলেঘেঁষা আর গায়ে পড়া? হঠাৎ করে নারী জাতির প্রতি তার দীর্ঘ দিনের ধারণা করা ক্ষোভ আর ঘেন্নাটা পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। সে আর পেছন ফিরে তাকালো না। হন হন করে হেঁটে যেতে থাকল। বাঁশঝাড় পেরোনোর পর বন্য গাছের ডালপালার ফাঁক দিয়ে একটি মাঠের মতো ছোট জায়গা দেখতে পেলো সকাল। জায়গাটির ওপর সূর্যরশ্মি এসে পড়েছে তির্যকভাবে। হীরের টুকরোর মতো ঝিকমিক করছে সবুজ ঘাস আর আগাছা ঢাকা মাটি। কাছাকাছি যেতেই সকাল বিস্ময়ভরা চোখে আবিষ্কার করলো একটি ছোট্ট পর্ণকুটির। সবুজ লতা পাতা দিয়ে ছাওয়া সেই কুটিরের ছাদ। ছাদ থেকে লতানো পাতা নুইয়ে পড়ে মাটি ছুঁয়েছে। পর্দার মতো ঢেকে দিয়েছে কুটিরের প্রবেশ পথ। ঘরের পাশেই একটি বিশাল বড় ঝাঁকড়া মাথার ওক গাছ। লাল আর হলুদ রং ধরেছে গাছের পাতায় পাতায়। ডালে ঝুলছে একটি হ্যামক এবং তার পাশে ভারি আয়েশি ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে একটি মেটে রঙের হৃষ্টপুষ্ট ঘোড়া। ঘোড়ার পেছনে ছোট্ট একটি কাঠের ঘর। বোঝা গেল ওই ঘরটিই তার বাসস্থান।
চারপাশে বন্য আগাছা। সেই আগাছায় ফুটে আছে নীল আর বেগুনী রঙের বুনো ফুল। মাঠের ঠিক পরেই মাটি ঢালু হয়ে নেমে গেছে অনেক নিচ পর্যন্ত। পাকদণ্ডী পথ গিয়ে মিশেছে একটি দূর গ্রামের সাথে। উঁচু থেকে সেই গ্রামটি খালি চোখে স্পষ্ট দেখা যায়। ছোট ছোট সাজানো বাড়ি ঘর, রাস্তা, গাড়িঘোড়া। গ্রামের পরে পাহাড়। পাহাড় উঁচু হয়ে মাথা তুলে ছুঁতে চাইছে বিস্তৃত ঝকঝকে নীল আকাশ। পাহাড়ের গা জুড়ে হলদে আর লাল রঙা গাছের সমাহার। হঠাৎ দেখলে মনে হয় যেন লাল রঙের পরচুলা পরে আছে সে।
আহা কী সুন্দর! সকাল একদম বিহ্বল হয়ে গেল! স্নিগ্ধ হয়ে গেলো! বশীভূত হয়ে গেল!
এতো সুন্দর জায়গা সে এর আগে কোনোদিন দেখেনি।
সে আচ্ছন্ন ভাবে বলে উঠল, ‘এ জায়গাটা এতো সুন্দর কেন? এটা কি জান্নাত?’
আরশান এরিকের খাবার তৈরি করছিল। সকালের কথাটা তার কানে ঢুকলো ঠিকই কিন্তু উত্তর দেবার প্রয়োজন বোধ করলো না। তার মনটা বিষণ্ন হয়ে আছে। সকালের সেলফোনে অনিকের কলটা আসার পর থেকে তার আর কিছু ভাল লাগছে না।
সকাল আবার সবিস্ময়ে বলল, ‘না না, এটা মনে হয় হরিণডাঙ্গা!’
আরশান তাকালো সকালের দিকে।
সকাল নিজের মাঝে নিজে বুঁদ হয়ে বলল, ‘ঠিক তাই। এটাই হরিণডাঙ্গা। আমি হরিণডাঙ্গাকে স্বপ্নে এমনটাই দেখেছি।’
আরশান অবাক গলায় বলল, ‘হরিণডাঙ্গা? সেটা আবার কী?
—‘একটা রাজ্যের নাম।’
আরশান ঠোঁট উল্টালো, ‘বুঝলাম না।’
সকাল আরশানের প্রশ্নের উত্তর দিলো না। এরিকের কাছে গিয়ে ওর
গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে আহ্লাদী গলায় বলল, ‘ঘোড়াটা আপনার?
—‘উম হুম।’
—‘কী নাম ওর?’
—‘এরিক’
—‘আর ওই ঘরটা? আপনি বানিয়েছেন বুঝি?’
—‘হ্যাঁ আমিই বানিয়েছি।’
শুনে সকাল একটু অন্যরকম ভালো লাগায় বুঁদ হয়ে রইল কিছুক্ষণ। মানুষটার শৌখিনতা আর রুচির মাধুর্য দেখে তার একে আরো বেশি করে ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে। তার অনেক দিনের স্বপ্ন ছিল হরিণডাঙ্গার কোনো এক জঙ্গলে পাহাড়ের ধারে, নদীর কাছাকাছি একটা ছোট্ট কুটির বানাবে। সেই কুটিরে নির্বিঘ্নে কাটবে তার অবসর জীবন। এই জায়গাটি যেন তার কল্পনার খাতা থেকে সরাসরি কেউ কপি পেস্ট করে নিয়েছে। সব একই রকম। শুধু একটি নদীর অভাব।
আরশান এরিকের খাবারগুলো দুই হাতে মুষ্টিবদ্ধ করে নিয়ে এসে ওর মুখের সামনে রাখলো। তার কপালে একটু বিরক্তির ভাঁজ। এ জায়গাটিতে এর আগে শুধু হোজে ছাড়া আর কেউ আসেনি। হোজে এসেছে কাজে। অন্য কোনো ব্যক্তি তার এই পরিপূর্ণ নিজের ভুবনটিতে প্রবেশ করুক এটা সে কখনোই চায়নি। আজকে সকাল একরকম জোর জবরদস্তি করেই চলে আসলো।
কিন্তু আসার পর অতটা খারাপ তো লাগছে না! গত কয়েকদিন এইখানে একলা বসে বসে সকালের কথাই ভেবেছে সে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে। আজকে ভাবন ঘরের দরজা খুলে সেই মানুষটা যখন চর্মচক্ষুর সামনে এসে হাজির হলো তখন একটা স্নিগ্ধ তরল অনুভূতি আপনা আপনিই মনের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু অনিককে নিয়ে খচখচে ভাবটা তার মন থেকে বিদায় করা যাচ্ছে না।
আরশান চুপচাপ এরিককে ঘাস খাওয়াচ্ছিল। সকাল বলল,
—‘আপনার ছাউনির ভেতরে যেতে পারি?’
—‘না।’
সকাল নিভলো, ‘কেন?’
—‘ওটা আমার ব্যক্তিগত জায়গা।’ কেমন গমগম করে বলে উঠল আরশান কথাগুলো।
সকাল আরশানের অভদ্রতাটা অত গায়ে মাখল না। কিছুক্ষণ নিজের মনে জায়গাটায় ঘুরে বেড়ালো। গুনগুন করে গান গাইলো। বিন্দুবাসিনীর সাথে গল্প করলো। আরশান আগুন জ্বালানোর জন্য জ্বালানীর যোগাড় করছিল আর আড়চোখে দেখছিল ওকে। মেয়েটা ভালোই পাগল আছে। আপন মনে কথা বলছে, আর হাসছে। তবে এতটা হাসিখুশি আর প্রাণবন্ত ওকে এর আগে কখনো দেখেনি সে। দেখে ভালো লাগছিল। এই নিঝুম একলা অরণ্যে কমলা রঙের মিষ্টি রোদের নিচে সাদা জামা পরা সকালকে ভারি পবিত্র আর মনোরম দেখাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যেন আকাশ থেকে মাত্ৰ একটা পরী নেমে এসেছে, বনের গাছে গাছে ফুল ফোটাবে বলে। আরশানের এই পর্ণকুটিরে এতোকাল একটি পরীরই অভাব ছিল বোধহয়। আজ এই পরীর আগমনে সেই অভাব দূর হলো, কানায় কানায় পূর্ণ হলো তার কুঞ্জবনের বাসস্থান।
হাওয়ায় বেশ জোর। হ্যামকটা দুলছিল বাতাসে। শুকনো পাতা বৃষ্টির মতো ঝরে ঝরে পড়ছে গাছের গা থেকে।
সকাল তখন শুয়ে শুয়ে নির্নিমেষ চেয়ে দেখছিল আরশানকে। মানুষটা মাটিতে বসে আছে। তার কপালে একটি কুঞ্চন রেখা। কিছু একটা ভাবছে গভীর ভাবে। কী ভাবছে ও? এই মুহূর্তে সকালের খুব অন্তর্যামী হতে মন চাইলো। ইচ্ছে করলো ছেলেটার মনের ভেতরটা একবার উঁকি দিয়ে দেখে।
শুয়ে শুয়ে হ্যামকে দোল খেতে খেতে সকালের একটু ঘুম এসে গিয়েছিল। ঘুম যখন ভাঙলো তখন দেখলো, দূর আকাশ থেকে হরেক রহস্য গায়ে জড়িয়ে পেঁয়াজ রঙের এক আশ্চর্য সুন্দর পড়ন্ত বিকেল মাত্র খসে পড়েছে এই ভূখণ্ডে। আরশান কুটিরের সামনে আগুন জ্বালিয়েছে। হু হু করা হাওয়া বিলি কেটে যাচ্ছে বন বনানীর গাছে, মাঠে, ঘাসে, সকালের চুলে। পাখি উড়ছে এক গাছ থেকে আরেক গাছে। ডাকছে কিচিরমিচির করে।
শীত করছিল ঠিক। কিন্তু ভালোও লাগছিল।
সকাল উঠল। পায়ে পায়ে এগিয়ে আসলো আগুনের কাছে। বসলো আরশানের মুখোমুখি।
আরশান মুখ তুলে চাইলো। কেমন যেন ওই চোখের চাওয়াটা। বুক কাঁপে।
—‘আপনার শীত করছে?’
—‘একটু একটু।’
—‘আমার কাছে একটা কমফোর্টার আছে। এনে দেবো?’
—‘এখন লাগবে না।’
—‘সন্ধ্যার পর কিন্তু শীত লাগবে।’
—‘আমরা কি সন্ধ্যার আগে এখান থেকে ফিরে যাবো না?’
—‘মনে হয় না।’
সকাল কিছু বলল না। এমনিতে এখানে থাকতে তার ভালো লাগছে এ কথা ঠিক। কিন্তু এইরকম একটা নির্জন, নীরব গহীন বনের ভেতর রাত কাটানোর কথা চিন্তা করেই তার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।
একটু বাদে খরশান হাওয়াটা শরীরের চামড়ায় কামড় বসাতে থাকলো
সকাল বলল, ‘কই, আপনার কমফোর্টার কোথায়? এনে দিন। শীতে মারা যাচ্ছি।’
আরশান উঠে হেঁটে গেলো ছাউনির দিকে। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই ফিরে আসলো। সকাল কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে নিলো। আরশান বসলো গিয়ে আগের জায়গায়।
আলো কমে আসছিল একটু একটু করে। এলোমেলো বাতাসে ভাসছিল পাতা পোড়া গন্ধ। ওক গাছের মাথায় পাখিদের নিরবিচ্ছিন্ন কোলাহল। গাছের পাতার যেন মাটির সাথে হয়ে গেছে এক গভীর প্রেম! হাওয়ায় উড়ে উড়ে ভেসে ভেসে প্রেমে পড়ার মতো করেই ভূখণ্ডের ওপর পড়তে লাগল তারা।
পৃথিবীটাকে কোনো এক অলীক জগৎ বলে মনে হচ্ছে। ওদের মুখে কোনো কথা ছিল না বরং কেমন যেন এক ঘোর লেগে ছিল।
আগুনের শিখার ভেতর দিয়ে সকালের মুখখানা দেখছিল আরশান। দেখছিল সকালও। দুই জোড়া চোখ নিঃসংকোচে লেগে ছিল পরস্পরের সাথে। অনেকটা ক্ষণ ধরে।
একটা সময় সকাল বলল, ‘আপনার শীত করছে না?’
—‘না। আমার অভ্যাস আছে।’
—‘আপনি চাইলে আমার পাশে এসে বসতে পারেন।’ সকাল বলল নির্লজ্জের মতো।
আরশান উঠল না। নড়লোও না। তার মাথা থেকে অনিকের ব্যাপারটা যাচ্ছে না। না যাওয়ার কারণে সকালকে তার ঠুনকো মনে হচ্ছে, সস্তা মনে হচ্ছে, দুই নাম্বার মনে হচ্ছে। এক বিচিত্র অনুভূতি হচ্ছে তার ভেতরে। মেয়েটা কাছে আছে বলে ভালো লাগছে আবার একই সাথে একটা অরুচিও হচ্ছে। ওর যদি সত্যিই অনিকের সাথে বিয়ের কথা ঠিক হয়ে থাকে তাহলে এই সন্ধ্যেবেলা গভীর অরণ্যের মাঝে সে আরশানের সাথে কেন আছে? কী কারণে আছে?
সকালই উঠে আসলো। বসলো আরশানের পাশে।
আরশান তাকালো না ওর দিকে। পলক হীন চোখে চেয়ে রইল আগুনের দিকে। সকাল হঠাৎ গভীর গলায় বলল,
—‘আচ্ছা আরশান! আপনি কখনো কাউকে ভালোবেসেছেন?’
প্রশ্নটা শুনে’, আরশান চমক লাগা চোখে চাইলো সকালের দিকে। কিছুক্ষণ কোনো কথা বলল না। কয়েকটা মুহূর্ত কাটার পর শীতল গলায় বলল, ‘জানি না।’
অজান্তেই একটা দীর্ঘ নিশ্বাস পড়ল সকালের বুক চিরে। সে জানতো উত্তরটা এরকমই হবে।
সকাল নিজের গায়ের কম্বলের একটা দিক আরশানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এদিকে আসুন, আপনার শীত করছে। আমি বুঝতে পারছি।’
আরশান কথা না বাড়িয়ে এগিয়ে আসলো। কম্বলের এক পাশ জড়িয়ে নিলো গায়ে। আর অন্যপাশে সকাল তখন ওর খুব কাছে।
কয়েকটা মিনিট কেমন অস্বস্তিতে কাটলো। তারপর আরশান হঠাৎ হাত বাড়িয়ে সকালকে টেনে নিয়ে আসলো নিজের আরো অনেক কাছে।সকাল ধীরে ধীরে মাথা রাখলো আরশানের বুকে, নিঃসংকোচে।
ওরা তখন একজন আরেকজনের হৃৎপিন্ডের ধুকপুক শুনতে পাচ্ছিল।
সন্ধ্যার হাওয়া দিনের আলো হটিয়ে দিচ্ছিলো ধীরে ধীরে। একটা বাদামি রঙা মায়াবী চেহারার হরিণ ওক গাছের নিচে এসে নিশ্চিন্তে ঘাস খাচ্ছিল। আগুনের ওম এসে ছুঁয়ে দিচ্ছিল ওদের। থেকে থেকে একটা স্বৰ্গছোঁয়া পবিত্র সুখ ছড়িয়ে পড়ছিল সমগ্র বিশ্বচরাচরে, আলো নিভু নিভু সন্ধ্যা নামা অন্তরীক্ষে।
সকালকে ওভাবে জড়িয়ে ধরে বসে থাকতে থাকতে আরশানের হঠাৎ মনে হলো এই মেয়েটাকেই তার চাই। যেকোন মূল্যে, যেকোন উপায়ে তার একে চাইই চাই।
কতক্ষণ কাটলো কে জানে। সকাল একটা সময় প্রায় ফিসফিসিয়ে বলল, ‘আমি চলে যাবার পর আপনার আমার কথা মনে পড়বে আরশান?’
আরশান ভারি গলায় বলল, ‘পড়বে।’
—‘আমাকে মিস করবেন?’
—‘জানিনা।’
—‘আপনি জানি না ছাড়া আর কিছু বলতে পারেন না?’
—‘পারি না।’
—‘আপনার কী হয়েছে?’ সকাল মুখ ঘুরিয়ে তাকালো আরশানের দিকে। আরশান তখনো আগুনের দিকে চেয়ে আছে। হাওয়ার তোড়ে আগুনটা এখন ঠিক মতো জ্বলতে পারছে না। শিখাগুলো এদিক-সেদিক বেঁকে যাচ্ছে। সকাল ওই লাল আগুনের ঝলকে আরশানের পাশ ফেরানো দেবোপম মুখটার দিকে অপলক চেয়ে রইল। তারপর মোহাবিষ্টের মতো আকস্মিক একটা চুমু খেলো ওর গালে। আরশান চমকে তাকালো সকালের দিকে।
সকাল বিদ্যুৎস্পৃষ্ঠ। নিজের আচরণে সে নিজেই বিস্মিত, কুণ্ঠিত এবং সীমাহীন লজ্জিত।
বিদ্যুৎ বেগে দূরে সরে আসলো সে আরশানের কাছ থেকে। আরশান বিস্ময় নিয়ে চেয়ে আছে তখনো ওর দিকে সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে।
সেই মুহূর্তে অনিকের ফোনটা দ্বিতীয় বারের মতো আসলো সকালের সেলফোনে। বেঁচে গেলো সকাল।এই ফোনটার খুব দরকার ছিল এখন। সকাল ফোনটা ধরে কাঁপা গলায় বলল, ‘কে অনিক?’
নামটা শোনা মাত্র আরশান ছোঁ মেরে সকালের কাছ থেকে ফোনটা ছিনিয়ে নিয়ে নিজের কানে দিয়ে বলল, ‘অনিক শোনো। আরশান বলছি। তোমার সাথে আমার একটু কথা আছে। তুমি কি ফ্রি আছো আজ রাতে?’
ওপাশ থেকে অনিক কী বলল সকাল তা জানে না। আরশানকে বলতে শুনলো, ‘ঠিক আছে, রাতে দেখা হচ্ছে।’ বলে আরশান ফোন কেটে দিলো। সকাল তখনো ভেতরে ভেতরে কাঁপছিল। আরশানের চোখে চোখে তাকাতে পারছিল না। ফোনটা হাতে নিতে নিতে কোনো রকমে প্রশ্ন করলো, ‘অনিকের সাথে আপনার কী কথা?
—‘একটা জরুরি আলাপ আছে। চলুন, এখন ফিরে যাই।’
—‘চলুন।’ সকাল বলল, নিস্তেজ গলায়।
৪৮
সেদিন হরিণডাঙ্গা থেকে ফেরার পর পর আরশান আবার উধাও হলো। বাড়ি ফিরে অনিকের সাথে দেখা হয়েছিল প্যাটিওতে। আরশান সকালকে বলল, ‘আপনি ভেতরে যান। আমার অনিকের সাথে একটু কথা আছে।’
সকাল বাধ্য মেয়ের মতো বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ল। বুকের ভেতর ছটফট ছটফট করতে থাকলো প্রাণ পাখিটা। আরেকটু হলেই যেন বেরিয়ে যাবে। কী কথা বলছে ওরা? পাগল, মতিচ্ছন্ন, ছিটিয়াল আরশানের হঠাৎ কী অমন জরুরি কথা বলার প্রয়োজন পড়ে গেল অনিকের সাথে?
তার ওপর নিজের কৃতকর্মের জন্য লজ্জায় শরমে মরে যাচ্ছিল সে। কী করে সে এমন নির্লজ্জের মতো একটা কাণ্ড করে বসলো? ছিঃ ছিঃ ছিঃ.. ঘেন্না, লজ্জা, রাগে, দুঃখে, দুশ্চিন্তায় একদম মরে যেতে মন চাইছিল তার।
নিজের ঘরে এসে অপেক্ষা করছিল। ভেবেছিল খানিক বাদে গিয়ে অনিককে কিংবা আরশানকে নিজ থেকেই প্রশ্ন করে জেনে নেবে যে দুজনের মাঝে কী কথা হলো। ঘণ্টা খানেক পরে নিচে নেমে আরশানের ঘরে উঁকি দিয়ে আসলো। ঘর ফাঁকা। গ্যারাজে গাড়িটিও নেই। দৌড়ে ছুটে গেলো সে অনিকের খোঁজে। অনিক নিচতলার গেস্টরুমেই থাকছে কদিন হলো। সেই ঘরটাও ফাঁকা। মাথামুন্ডু কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না। এরা দুজন একসাথে হাওয়া হয়ে গেলো কেন? দুশ্চিন্তায় কেমন পাগল পাগল লাগতে থাকলো।
অনিক ফিরলো বেশ রাতে। সকাল ড্রইং রুমেই বসা ছিল।অনিক ঢুকতেই প্রশ্ন করলো,
—‘কোথায় গিয়েছিলে?’
অনিক নিস্তেজ গলায় বলল,
—‘একটু কাজ ছিল।’
সকাল আর সময় নষ্ট না করে আসল কথাটা তুললো, কাঁপা বুক নিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘আচ্ছা আরশান তোমাকে কী বলেছে?
অনিক শান্ত চোখে তাকালো সকালের দিকে, বলল, ‘আমাকে তোমার কাছ থেকে দূরে থাকতে বলেছে।’
সকাল দম বন্ধ করে শুনলো কথাটা। কোনো রকমে বলল, ‘আর কী বলেছে?’
—‘আরও কিছু কথা হয়েছে আমাদের মাঝে। এ মুহূর্তে তোমাকে আমি বলতে পারছি না। একটু সময় দাও আমাকে।’
সকাল আর কিছু না বলেই ফিরে এসেছিল সেদিন অনিকের ঘর থেকে। নিজের জায়গায় ফিরে এসে ঝিম ধরে বসে ছিল।
ছেলেটা এমন কেন? মুখ ফুটে সরাসরি কথা বলতে তার বাঁধে কোন জায়গায়? এতো কিসের দ্বিধা? অনিককে যে কথাটা বলতে পারলো সকালকে নিজ মুখে সেই কথাটা বললে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত?
কেমন যেন একটা ঘোর লাগতে থাকে তার। কান্না পাচ্ছে, আবার কেমন হাসিও পাচ্ছে। বিছানার ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে চাদরে আঁকি বুকি করতে করতে নিজের মনে বলতে থাকে সে, পাগল একটা। একদম পাগল একটা ছেলে!
তারপরের দুটা দিন ওই পাগলটা লাপাত্তা। অপেক্ষায় থাকতে থাকতে শ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হলো সকালের। কোথায় গেলো আবার? বলেছিল অফিস শুরু করবে পরদিন থেকে। অফিস যদি করতেই হয় তো বাড়ি থেকে কি করা যায় না? যেখানেই যাক অন্তত কিছু তো জানিয়ে যাবে সকালকে। এ ধরনের দায়িত্বজ্ঞান হীনতার মানে কী?
দুটা দিন সকাল লুকিয়ে লুকিয়ে খুব কাঁদলো। বুক জ্বলতে থাকলো। কাউকে কিচ্ছু বলল না। আর কত ছোট হবে সে মানুষের কাছে? নাবিলা আর ফাহাদকেও তো দেখছে। দুজনের মাঝে কী সুন্দর বোঝাপড়া। ওদের ওই পরিচ্ছন্ন সুন্দর সম্পর্কের সামনে নিজের একতরফা অনুভূতি আর উড়ুটি মানুষটার প্রসঙ্গ বারে বারে তুলতে কেমন অস্বস্তি লাগে তার আজকাল। মনে মনে ঠিক করলো এবার আরশান ফিরলে একটা রফাদফা করেই ছাড়বে। ওর মুখ থেকে কথা বের করতেই হবে। যে করেই হোক।
রন্ধ্রে রন্ধ্রে রাগ ছড়িয়ে পড়ছিল তার। আসুক এবার। মজা দেখাবে। পেয়েছে কী লোকটা?
দুদিন কাটার পর শনিবার সকালে হুট করে নাবিলা আসলো বাড়িতে। এসেই হৈ হৈ করে বলল,
—‘শেহজাদী, তৈরি হয়ে নে। আমরা ফল কালার দেখতে যাবো।’
—‘কোথায় যাবি ফল কালার দেখতে?’
—‘যাবো এক জায়গায়। তুই রেডি হ।’
নাবিলার ঝলমলে মুখটার দিকে চেয়ে সকাল আর না করলো না। তৈরি হতে গেলো। নাবিলা কথাটা বলে সকালের ঘরে আর দাড়ালো না। আজকাল সে এ বাড়িতে এসে সকালের চেয়ে ফাহাদকেই সময় দেয় বেশি। সকাল কিছু মনে করে না। বরং ভালো লাগে তার। ফাহাদকে ভালো না বাসতে পেরে মনে মনে যে অপরাধবোধটা জন্মেছিল সেই অপরাধবোধটা ওদের দুজনকে একত্রে দেখে দেখে লাঘব হয়ে গেছে।
৪৯
ফাহাদের আম্মা রান্না করছিলেন। বাটার চিকেন। তার ছেলে-মেয়ে দুটো ঝাল একেবারেই খেতে পারে না। সব খাবারেই তাই অল্প বিস্তর চিনি মিশিয়ে দেন তিনি। রান্না করতে করতে তিনি ফাহাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
ফাহাদ আসলো আরো মিনিট দশেক সময় পরে। কিন্তু সে একা নয়। তার সাথে নাবিলাও আছে। নাবিলাকে দেখে তার কপালে একটা স্পষ্ট ভাঁজ পড়ল। এই মেয়ে কখন আসলো বাড়িতে কে জানে। আজকে স্যাটার ডে। ছুটির দিন। ভেবেছিল ছেলের সাথে কিছু প্রয়োজনীয় কথা সেরে নেবেন। কিন্তু তা আর পারা গেলো কই? তার ছেলের আক্কেল জিনিসটা কোনো দিনও হবে বলে মনে হচ্ছে না। মায়ের সাথে কথা বলতে এসেছে সে বাইরের একটা মেয়েকে সাথে নিয়ে। বাইরের লোকের সামনে যে সব কথা বলা যায় না এই নূন্যতম সাধারণ জ্ঞান কি এই ছেলের নেই?
—‘মম কী অবস্থা? জরুরি কোনো কথা আছে?’
—‘হ্যাঁ আছে। অনেক জরুরি কথা আছে। তুমি বসো এই চেয়ারে। এক এক করে বলছি সব।
ফাহাদ বাধ্য ছেলের মতো বসলো ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে। বসলো নাবিলাও। মমের চোখে খেলছে উদ্বেগ। কপালে ভাঁজ। নিজের মায়ের এই চেহারাটাকে ফাহাদ একটু ভয়ই পা” আজকাল। কোনো কূটবুদ্ধি সম্পন্ন মতামত দেবার আগে মায়ের চেহারাটা এমন হয়ে যায়। ফাহাদ আর কৌতূহল চাপাতে না পেরে প্রশ্ন করলো, ‘কিছু হয়েছে?’
মম ছেলের কথার উত্তর না দিয়ে রান্নার লবণ চেখে দেখলেন। চুলা বন্ধ করলেন। তারপর চেয়ার টেনে বসলেন ফাহাদের পাশে। বললেন,
—‘তোমরা কি কোথাও যাচ্ছো?’
—‘হ্যাঁ, ভাবছিলাম ফল কালার দেখতে যাবো।’
—‘বেশ তো।’
—‘তুমি বলো কী বলতে চেয়েছিলে?’
—‘শোনো, সকালের সাথে তো তোমার বিয়েটা দিতে পারলাম না। কিন্তু মেয়েটাকে আমার সত্যিই খুব পছন্দ ছিল।’
ফাহাদের মুখে অস্বস্তি ফুটে উঠল। নাবিলা নড়েচড়ে উঠে একটু দ্বিধা নিয়ে বলল, ‘আপনারা তাহলে কথা বলুন। আমি উঠছি।’
ফাহাদ বাঁধ সাধলো, বলল, ‘না না। তুমি বসো।’
অগত্যা নাবিলাকে থেকে যেতে হলো। ফাহাদ বলল, ‘ওই চ্যাপ্টার তো অলরেডি ক্লোজড মম। কেন ওসব কথা আবার টানছো?’
মম মুখটাকে হাড়িপানা করে বললেন, ‘ক্লোজ হবে কী করে? তোমাকে একটা বিয়ে দেয়ার আগ পর্যন্ত তো বিষয়টা ক্লোজ হচ্ছে না। এটা বুঝতে পারছো না? শোনো তোমার বড় খালা একটা মেয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। মেয়েটা ইঞ্জিনিয়ার। ফ্লোরিডায় থাকে। বাংলাদেশি মেয়ে। তুমি কি ছবি আর বায়োডাটা দেখতে চাও?’
—‘না।’ দৃঢ় গলায় উত্তরটা দিল ফাহাদ। নাবিলা নতমুখে বসে আছে পাথর হয়ে।
—‘কেন?’ মমের প্রশ্ন।
ফাহাদ কিছুক্ষণ অস্বস্তি আর বিরক্তিতে চুপ হয়ে রইল।
তারপর বলল, ‘আপাতত বিয়ের কথা ভাবছি না। তাই।’
—‘ভাবছো না মানে কী? এই মেয়েটা দেখতে ভারি সুন্দর। ফর্সা টকটকে গায়ের রং। আমি কিন্তু আমার ছেলের জন্য কালো মেয়ে আনবো না। এ আমি আগেই বলে দিলাম।’
কথাটা শুনে কেন কে জানে নাবিলা ভারি সংকুচিত হয়ে উঠল। ফাহাদ এখনো তাকে বিয়ের কথা কিছু বলেনি। প্রেম করলেই যে বিয়ে করতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা আজকাল আর কোনও দেশের সংস্কৃতিতে নেই। এখন প্রেম নিবেদন করা আর বিয়ের প্রস্তাব দেয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। তবুও দুজনের মাঝে প্রেম যেহেতু এসেছে তার পিছু পিছু বিয়ের প্রসঙ্গটাও আজ বাদে কাল চলে আসবে বলেই তার ধারণা ছিল। কিন্তু বিষয় হলো ফাহাদ ভারি মাতৃভক্ত ছেলে। নিজের মায়ের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু করার মতো মানসিকতা বা সাহস ওর কখনো হবে কিনা তা নিয়ে নাবিলার মনে ষোল আনা সংশয় আছে। তা ছাড়া ফাহাদের আম্মা ফর্সা সুন্দরী বউ চান। নাবিলা জানে তার চেহারা খানা ভালো হলেও গায়ের রংটা একটু চাপা। অতএব ছেলের বউ হিসেবে ফাহাদের আম্মার চোখে সে প্রথম দফায়ই বাতিল বলে গণ্য হবে।
ফাহাদ বিপন্ন বোধ করতে লাগলো নাবিলার সামনে। দোনোমোনো করে কথাটা বলেই ফেললো,
—‘আমি একজনকে পছন্দ করি। মনে হয় তাকেই বিয়ে করবো।’
মমের চেহারায় বিস্ময় ফুটে উঠল। তিনি অবাক গলায় বললেন,
—‘সে কি! কিন্তু এমন তো কথা ছিল না ফাহাদ! তুমি বলেছিলে তুমি আমার পছন্দে বিয়ে করবে। বলো নি?’
—‘বলেছিলাম। কিন্তু হলো না।’
—‘মেয়েটা কে?’
ফাহাদ বসা থেকে উঠে পড়ে বলল, ‘সময় হলে জানতে পারবে।’
উঠল নাবিলাও। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সে এখান থেকে কেটে পড়তে চায়। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে।
মম বললেন, ‘চললে কোথায়? আমার কথা শেষ হয়নি।’
ফাহাদ দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায়ই বলল, ‘বল।’
—‘তুমি আরশানের প্রস্তাবটাতে রাজি হলে না কেন?’
—‘কোন প্রস্তাব?’
—‘জায়গা-জমি বুঝে নেবার প্রস্তাব।’
ফাহাদ তাচ্ছিল্যের গলায় বলল, ‘সিরিয়াসলি মম? এখন তুমি আমাকে এই সব ব্যাপারেও ফোর্স করবে? আমার চাই না ওসব। তাই নাকচ করে দিয়েছি।
—‘চাই না বললেই হলো? তোমাদের তিন পুরুষের সব সম্পত্তি ওই ছেলে একা কেন ভোগ করবে? তোমার বাবার যদি আরো ভাই-বোন থাকতো তাহলে কি সে এটা পারতো?’
—‘এখানে তো ভাইয়ের কোনো দোষ নেই মম! দাদা দিদা যা ভালো বুঝেছেন তা-ই করেছেন। তোমার এতো ইচ্ছে থাকলে তুমি নিজের নামে করিয়ে নাও সব কিছু। ভাই তো সেই অফারটাও দিয়েছে।’
—‘সেটা ভালো দেখায় না। শোনো, তুমি ওর প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাও।’
ফাহাদ ব্যথাতুর নয়নে তাকালো নিজের মায়ের দিকে। বলল, ‘আমার সিদ্ধান্ত আমি নিয়ে ফেলেছি।’
কথাটা বলে ফাহাদ আর দাড়ালো না। ফাহাদের আম্মা বজ্রাহত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন ছেলের চলে যাওয়ার পথটির দিকে তাকিয়ে অনেকক্ষণ।
এ মুহূর্তে তিনি খুব পরিষ্কার ভাবেই বুঝতে পারলেন যে তার ছেলের পছন্দের মেয়েটি আসলে কে। কূট সন্দেহটি সত্য হয়ে গেলো অবশেষে। ফিলাডেলফিয়ার সেই সকাল বেলাটাতেই তিনি টের পেয়েছিলেন জল কোনদিকে গড়াচ্ছে। কিন্তু ব্যাপার হলো নাবিলা মেয়েটিকে তার ছেলের বউ হিসেবে একেবারেই পছন্দ না। বাপ মা ফেলে একা একা বিদেশ বিভূঁইয়ে পড়া-লেখা করতে এসেছে। চলন বলনে নম্রতা নেই। সকালের ভেতরে যেমন ঘরোয়া, স্নিগ্ধ, লক্ষ্মী একটা ভাব আছে এই মেয়ের মাঝে সেসবের ছিটে ফোটাও নেই। চেহারা খানা মন্দ না এ কথা ঠিক। বরং একটা ধার আছে মুখে। কিন্তু হলে কী হবে? গায়ের রং তো কালো। আর সবচেয়ে বড় কথা তিনি এর মাঝেই খোঁজ নিয়ে দেখেছেন মেয়ের মায়ের বাড়ি হলো ইন্ডিয়া। অর্থাৎ ঘটি। কোনো ভাবেই তিনি ঘটি বাড়ির সাথে আত্মীয়তা করবেন না। ছেলেকে ফেরাতে হবে। যেকোনো উপায়ে ফেরাতে হবে তার ছেলেকে। কী বিপদে যে পড়া গেল! সকালের ওপর ইদানীং তার খুব রাগ হয়। চোখে চোখে তাকিয়ে কথাও বলেন না তিনি ওর সাথে আজকাল। এতো ভালোবেসে, এতো আদর করে, সাধ করে তিনি নিয়ে আসলেন মেয়েটাকে। মেয়েটা তার দাম দিতে জানলো না।