অক্টোবর রেইন – ৪০

৪০

ফাহাদের আম্মা সুযোগ বুঝে ভিড়ের মাঝে আরশানের পাশে বসে পড়লেন। আরশানের হাতে এক গ্লাস ভর্তি কোক ধরিয়ে দিয়ে গলা নামিয়ে বললেন, ‘তোমাকে তো পাওয়াই যায় না। পারিবারিক কোনো আলাপ করার উপায় নেই তোমার সাথে।’ 

—‘এটা কোনো কথা হলো? এ কদিন তো আমি বাসায়ই ছিলাম। আপনি ডেকে পাঠালেই পারতেন! 

—‘কেন তোমার অফিস নেই?’ 

—‘না। অক্টোবরে তো ছুটি।’ 

—‘ও হ্যাঁ তোমার তো আবার অক্টোবর প্রীতি আছে।’ 

—‘সব ঠিক আছে?’ আরশান কোকের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল। 

—ঠিক আছে। সেরকম জরুরি কিছু নয়। তবে ভাবলাম ব্যাপারটা তোমাকে জানিয়ে রাখা দরকার।’ 

—‘কী ব্যাপার?’ 

—‘আমরা ফাহাদের জন্য মেয়ে খুঁজছি। মানে বিয়ের জন্য।’ 

আরশান হাসলো, ‘বাহ্, বেশ ভালো খবর তো!’ 

—‘হ্যাঁ খবর ভালোই। কিন্তু ফাহাদ তো বড় ভাইয়ের আগে বিয়ে করতে চায় না।’ 

—‘আশ্চর্য! এমন কোনো নিয়ম আছে নাকি যে বড় ভাইয়ের আগে ছোট ভাই বিয়ে করতে পারবে না?’ 

—‘নিয়ম নেই তবুও আমাদের সামাজিক চোখে একটু দৃষ্টিকটু লাগে আরকি বিষয়টা।’ 

—‘ওকে বলুন এসব নিয়ে যেন একদম না ভাবে। আমার কোনো কিছুর ঠিক নেই। আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকাটা একটা বিশাল বোকামি হবে।’

.

ফাহাদের আম্মা তেরছা চোখে দেখলেন একবার আরশানকে। এই ছেলের কথার ভঙ্গি পাল্টে গেছে। আগে বিয়ের প্রসঙ্গ উঠলেই হাত-পা নেড়ে নাকচ করে দিত। সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠত, বিয়ে আমি জীবনেও করবো না। 

আজ বলল, কোনো কিছুর ঠিক নেই। 

হাওয়া পাল্টাচ্ছে। টের পান ফাহাদের মা। যা করার এখনই করতে হবে। আরশান বাবা তুমি যাকে খুশি তাকে বিয়ে করতে পারো, এমনকি তোমার শেতাঙ্গিনী কলিগটিকেও করতে পারো কিন্তু সকালকে নয়। সকাল আমার পছন্দ। আমার পছন্দ করা মেয়ে আমি কোনোদিনও সতীনের ছেলের হাতে তুলে দেবো না। 

একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে তিনি বললেন, ‘আমি বলে তো লাভ হচ্ছে না। তুমি একটু কথা বলে দেখো ফাহাদের সাথে। ও তোমার কথা খুব মানে।’ 

—‘ঠিক আছে। আমি কথা বলবো। আপনি চিন্তা করবেন না।’ 

ফাহাদের মা মুখে নকল একটা হাসি টেনে বললেন, ‘অনিকের জন্যও মেয়ে খুঁজছে ওর বাবা মা। ওই যে তোমার বাবার বন্ধুর মেয়ে সকাল। সকালকে অনিকের খুব পছন্দ।’ 

আরশান থমকালো। চকিতে তাকালো বক্তার দিকে। অস্ফুটে বলল, ‘তাই?’ 

—‘হ্যাঁ তাই তো। ঐযে দেখো দুজন কী সুন্দর পাশাপাশি বসে ফুসুরফুসুর গল্প করছে? সকালও অনিককে পছন্দ করে। সারাদিন দুজন একসাথে জোড়ায় জোড়ায় ঘুরে বেড়ায়। সারাটাদিন।’ 

আরশান চোখ ঘুরিয়ে সকালকে খুঁজলো। কয়েকগজ দূরে সত্যিই সকাল আর অনিক দুটো চেয়ারে পাশাপাশি বসে আছে। অনিক কিছু একটা বলছে আর সকাল খিলখিল করে হাসছে। 

চোখের সামনে থেকে যেন একটা পর্দা উঠে গেলো। এই দিনের আলোর মতো স্পষ্ট বিষয়টা আরশানের এতদিন কেন চোখে পড়ল না? 

—‘আরো ভালো খবর হলো অনিকের মা সকালের বাপ মায়ের সাথে মোটামুটি একটা কথা বলে রেখেছে। আসছে ডিসেম্বরে হয়তো বিয়ের ডেট ফাইনাল হয়ে যেতে পারে। ছেলে-মেয়ে রাজি থাকলে তো আর আমাদের কোনো আপত্তি নেই। 

এই অংশটা তিনি সম্পূর্ণ বানিয়ে বললেন। তিনি জানেন আদতে কোনো লাভ হবে না। আরশান হয়তো সকালের সাথে সরাসরি কথা বলেই জেনে যাবে যে পুরো ব্যাপারটা সাজানো। কিন্তু এই মুহূর্তে আরশানের বুকে আগুন জ্বালাতে পেরে তার এক ধরনের তৃপ্তি বোধ হচ্ছে। তৃপ্তির কারণ আরশান নয়। তৃপ্তির মূল কারণ হলো আরশান সেই নারীটির সন্তান। যে নারীটির কারণে জীবনে কখনো তিনি শ্বশুরবাড়িতে যোগ্য সম্মান পাননি। তিনি মনে মনে স্বস্তির হাসি হাসলেন। 

তবে আরশান সরে দাড়ালে অনিকের সাথে সকালের বিয়ে দেয়াটা খুব একটা কঠিন কাজ হবে না। মেয়েটাকে তাঁর সত্যি পছন্দ। নিজের ছেলের বউ না হোক। বোনের ছেলের বউ হয়েই থাকুক নাহয়। 

তিনি উঠে পড়লেন চেয়ার থেকে। অতিথিরা সবাই মোটামুটি চলে এসেছে। এসময় বসে থাকলে কি তাঁর চলবে? 

আরশানের মুখে রক্ত জমে উঠছিল। ধীরে ধীরে তার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠছে। চোখ থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে ক্ৰোধ। 

এতটা নির্বোধ সে কী করে হলো? সেই প্রথম দিনই তো দেখতে পেয়েছিল সে নিজের চোখে সকাল আর অনিক কী রকম পাশাপাশি বসে গল্প করছিল। সকাল অনিকের মাঝে এতো ডুবে ছিল যে আরশানকে তার নজরেই পড়েনি। এমন কি নিজের ঘরেও নিয়ে যাচ্ছিল। আরশানই নির্লজ্জের মতো পেছন থেকে ডেকেছিল সকালকে। এরপর জানা গেলো অনিক ওর পূর্বপরিচিত। 

সব কিছু জলের মতো পরিষ্কার হয়ে উঠছে এখন। যতবার সে উপর তলায় গিয়েছে অনিক আর সকালকে একত্রে দেখেছে। সেদিন অনিকের ইউনিভার্সিটি যাবার জন্যেও এক কথায় রাজি হয়ে গেলো সকাল। আরশান জোর করে টেনে নিয়ে আসলো ওকে অনিকের সামনে থেকে। নিজেকে একটা জোকার মনে হচ্ছে এখন। কেন এতটা আহাম্মক হলো সে? সকালের চোখে সর্বদাই অনিকের জন্য ছিল অপরিমেয় প্রশ্রয়। পছন্দ না করলে প্রশ্রয় আসবে কোথেকে? এখন ওদের সম্পর্ক বিয়ে পর্যন্ত গড়াচ্ছে। বাহ সকাল বাহ! আরশানের সাথে তোমার তাহলে যা কিছু ছিল, সবটা মিথ্যা! খেলা ছাড়া কিছুই না! এ কারণেই …হ্যাঁ এ কারণেই আরশান কখনো মেয়েদের বিশ্বাস করেনি। মেয়েরা শুধু খেলতে আর খেলাতে জানে। 

আবার তাকালো আরশান সকালদের দিকে। ওখানটায় এখন নাবিলাও নেই। শুধু অনিক আর সকাল। খুব কথা বলছে দুজনে। কথা যেন তাদের আর ফুরোয়ই না। সেই দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটা ভয়ঙ্কর, করাল রাগ আরশানকে ক্রমশ বশীভূত করে ফেললো। নিমেষে অন্ধকার হয়ে আসলো তার চারপাশ। রোষের তোড়ে সে কাচের গ্লাসটা গায়ের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে হাতের তলায় নিষ্পেষিত করতে লাগলো। একটা সময় গ্লাসটা ঝন ঝন করে ভেঙে গেলো। পানীয় ছিটকে পড়ল তার পাঞ্জাবিতে। কয়েকটা কাচের টুকরো বিঁধে গেলো হাতে। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটলো। উঠে পড়ল সে বসা থেকে। 

সকালকে খবরটা নাবিলা দিলো, ‘এই আরশানের মনে হয় হাত কেটে গেছে। ওকে দেখলাম ঘরের দিকে দৌড়ে যাচ্ছে। হাতে রক্ত।’

সকাল দ্রুত উঠে পড়ল। দৌড়ে আসলো আরশানের ঘরের দিকে। দরজাটা খোলাই ছিল। 

দেখা গেল আরশান ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে একটু কুঁজো হয়ে পাথরের মতো বসে আছে। তার চক্ষুদুটি মেঝেতে নিবদ্ধ। কপালে হালকা কুঞ্চন। হাতে চেপে ধরে আছে একটা সাদা তোয়ালে। সাদা তোয়ালে লাল রক্তে ভেসে যাচ্ছে। 

সকাল দেখে পাগলের মতো চিৎকার করে উঠল, ‘একি? হাত কাটলো কিভাবে?’ 

বলতে বলতে দৌড়ে ছুটে আসলো সে আরশানের কাছে। আরশান এক চুলও নড়লো না। স্থিরচিত্র হয়ে রইল। 

সকাল কাটা রক্তাক্ত হাতটা ধরতে যেতেই আরশান চেয়ারসহ এক হাত দূরত্বে সরে গেলো। কাঠের চেয়ার কাঠের মেঝেতে ঘর্ষণ খেয়ে বিকট একটা শব্দ করে উঠল। সকাল প্রচণ্ড বিস্ময় নিয়ে বলল, ‘কী হলো? দূরে সরে গেলেন কেন?’ 

আরশান মেঝের দিকে তাকিয়ে থেকেই বরফ শীতল গলায় বলল, ‘আপনি এখানে কেন এসেছেন? প্লিজ চলে যান।’ 

বুকের ভেতর যেন একটা শেল বিধলো। সকাল দিশেহারা হয়ে বলল, ‘এভাবে কথা বলছেন কেন?’ 

—‘প্লিজ। বিরক্ত করবেন না আমাকে।’ 

সকাল কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘কিন্তু আপনার তো ব্লিডিং হচ্ছে। কিছু একটা করুন। প্লিজ?’ 

—‘আমারটা আমি বুঝবো। আপনাকে চিন্তা করতে হবে না।’ 

এন্ড্রিয়ানা ঝড়ের বেগে ঢুকলো ঘরের ভেতরে। দৌড়ে ছুটে গিয়ে আরশানের হাতটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে বলল, ‘মাই গড! কাটল কিভাবে? 

দ্রুত ওয়াল ক্যাবিনেট থেকে ফার্স্টএইড বক্স বের করে নিয়ে আসলো এন্ড্রিয়ানা। দেখে মনে হলো সে খুব ভালো করেই জানে এই ঘরে কোথায় কী রাখা আছে। সে যত্ন করে স্যাভলন দিয়ে কাটা জায়গাটা মুছে নিলো। বেশ অনেক খানিই কেটেছে। কয়েকটুকরো কাঁচও বিঁধে গেছে চামড়ার ভেতরে। এন্ড্রি মনোযোগ দিয়ে কাচের টুকরোগুলো বের করে আনার চেষ্টা করছে। রক্ত তখনো থামেনি। 

সকাল দাঁড়িয়ে আছে স্থবির হয়ে। আরশান এন্ড্রিয়ানাকে বাধা দেয়নি, সরেও যায়নি। কিন্তু সকাল যখন ওর কাছে গেলো কেমন দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলো। কেন এই অবহেলা? কেন এই শাস্তি? কী দোষ করেছে সকাল? 

তার চোখের পর্দা ফেটে জলের ফোয়ারা নামছিল। ধারালো ছুরি দিয়ে কেউ যেন গোটা অন্তরটাকে ক্ষত বিক্ষত করে দিচ্ছে ক্রমাগত। শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ চেপে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে সে। ঠিক আছে আরশান ওর সাথে কথা না-ই বলুক। তবু নিজে ঠিক হোক। কাচের টুকরোগুলো ঠিক মতো বেরিয়ে আসলেই হয় এখন। আহারে! ওর কি বেশি লাগছে? 

আরশান ঠিক সেই মুহূর্তে সকালের দিকে তাকিয়ে পরিষ্কার ভাবে বলল, ‘ক্যান ইউ লিভ আস এলোন? প্লিজ?’ 

সকাল থমকে গেলো। প্রস্তরীভূত হয়ে গেলো। কয়েকটা সেকেন্ড স্তম্ভিত ভাবে আরশানের দিকে তাকিয়ে থেকে সে পায়ে পায়ে জায়গাটা থেকে সরে আসলো। তার পা টলছিল। মাথাটা বড্ড এলোমেলো! 

৪১

সন্ধ্যে নামার আগেই কেক কাটা হলো। টিলির বন্ধুরা খুব হৈচৈ করে কেক কাটলো। কেক কাটার পরে নাচ গানের অনুষ্ঠানও হলো। কিন্তু নাবিলা কোথাও সকালকে খুঁজে পাচ্ছিল না। ফোনে ডায়াল করলো কয়েকবার। কোনো খবর নেই। এরমাঝে এক দুবার অনিকও নাবিলার কাছে সকালের খোঁজ করলো। নাবিলা নিজেই জানে না, অনিককে কী করে খোঁজ দেবে? 

অতিথিরা সবাই বসে নেই এখন। কেক কাটার টেবিলে বিভিন্ন রকম ক্যান্ডিসহ স্ন্যাকস রাখা আছে। অনেকেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্যাক্স আর কফি খেতে খেতে কথা বলছেন নিজেদের মধ্যে। নাবিলা টের পাচ্ছিল এই এতো লোকের মাঝে, ভিড়ের মাঝে একজোড়া চোখ থেকে থেকে তার চোখের ওপরে পড়ছিল। হঠাৎ হঠাৎ চারটা চোখ মিলেও যাচ্ছিল একত্রে। নাবিলা লজ্জা পেয়ে চোখ সরিয়ে নিচ্ছিল বারংবার। 

একটা সময় সেই চোখদুটো খুব কাছাকাছি আসলো। বলল, ‘একটু শুনবে?’ 

—‘বলো!’ 

—‘এইদিকে এসো।’ 

—‘আসছি।’ বলে নাবিলা ফাহাদের দেখানো পথে পা বাড়ালো। 

তখন গোধূলি। বিকেল আর সন্ধ্যের মাঝামাঝি এক টুকরো বিশুদ্ধ সময়। পৃথিবীটা এ সময় অন্য রকম হয়ে যায়। স্বর্গ বলে ভ্রম হয়। 

ফাহাদ আর নাবিলা হাঁটছিল রাস্তার ধার ধরে। পশ্চিমের আকাশে হরেক রকম রঙের খেলা। একটা হলদে নরম অদ্ভুত সুন্দর পবিত্ৰ আলো ছড়িয়ে আছে চারপাশে। একেই বোধহয় কনে দেখা আলো বলে। বাতাসে একটু শীত শীত ভাব। ওদের পায়ের কাছে কাছে পোষা বেড়ালের মতো পায়ে পায়ে হাঁটছে একগুচ্ছ শুকনো পাতা। পাখি ডাকছে। কত পাখি যে ডাকছে! সরু রাস্তার দু ধারে জঙ্গল। আরেকটু পরেই নেইবার হুডটা শেষ হয়ে যাবে। তারপর বড় রাস্তা। 

—‘বলো, কী বলতে চেয়েছিলে?’ 

—‘তোমার পার্ট-টাইম জবের ব্যাপারে কথা বলতে চাচ্ছিলাম। একচুয়েলি তুমি মাইন্ড না করলে ড্যাডের স্টোরে কিছুদিন কাজ করতে পারো।’ 

—‘আমি ঠিক করেছি এখন আর পার্ট-টাইম জব করব না। আমার তো সেমিস্টার শেষ হতে আর বেশি দেরি নেই। আর কয়েকটা দিন কষ্ট করে থাকি। এরপর তো দেশে ফিরেই যাব। 

ফাহাদ হাসলো, ‘দেশে ফিরে যেতে খুব ইচ্ছে করে তোমার?’

—‘খুব!’ 

—‘দেশকে তুমি খুব ভালোবাসো তাই না?’ 

—‘তা তো বাসিই। তুমি বাসো না?’ 

—‘বাংলাদেশ?’ 

—হ্যাঁ বাংলাদেশ।’ 

—‘বাংলাদেশের কথা আমার মনেই পড়ে না। 

—‘যাবে ফাহাদ? বাংলাদেশে?’ 

ফাহাদ হাঁটা থামিয়ে নাবিলার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল, ‘এখন মনে হচ্ছে যেতেই হবে।’ 

সন্ধ্যার বাতাসে এলোমেলো উড়ছিল নাবিলার কপালের কাছের কয়েক গাছি চুল। উড়ছে শাড়ির আঁচল। আঁচল সামলাতে সামলাতে নাবিলা বলল, ‘তাই? কেন কী এমন হয়ে গেলো হঠাৎ?’ 

—‘হয়েছে কিছু একটা। আমি আসলে খুব একটা ভালো নেই!’ 

নাবিলা একটু বিষণ্ণ ভাবে বলল, ‘জানি। সকালের ব্যাপারটা তুমি এখনো কাটিয়ে উঠতে পারোনি। অত ভেবোনা। সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে।’ 

ফাহাদ জোরালো গলায় বলল, ‘সকালকে নিয়ে আমি মোটেও ভাবছি না। ভাবিওনি কখনো। হ্যাঁ ভাবতে চেয়েছিলাম একটা সময়। কিন্তু এখন বুঝি, জোর করে আসলে কিছু হয় না। যা হবার, তা এমনি এমনিই হয়ে যায়। আমি ভাবছি অন্য একজনকে নিয়ে।’ 

নাবিলা একটু অপ্রতিভ হলো, ‘অন্য একজনটা আবার কে?’ 

ফাহাদ হাঁটা শুরু করলো আবার। পাশাপাশি নাবিলাও। হাঁটতে হাঁটতে নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে থেকে ফাহাদ বলল, 

—‘আছে একজন। খুব বিরক্ত করছে!’ 

—‘তাই? কী রকম বিরক্ত?’ 

—‘ঐযে বললাম, ভাবাচ্ছে। আই ক্যান্ট স্টপ থিংকিং এবাউট হার। রাতে ঘুম হয় না ঠিক মতো। অফিসের কাজে মন বসে না।’ 

নাবিলা অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে রইল। মুখ ঘুরিয়ে রাখলো অন্যদিকে। 

ফাহাদ গাঢ় ভাবে বলল, ‘সারাক্ষণ মনে হয় মেয়েটার সাথে কথা বলি, ওকে দেখি। এমনকি হঠাৎ হঠাৎ ইচ্ছে হয় ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকি অনন্ত কাল ধরে।’ 

—‘ইশ! তুমি আসলেই অসভ্য ফাহাদ!’ 

ফাহাদ হো হো করে হেসে উঠে বলে, ‘কী করবো? মেয়েটা আমার জীবনে আসার পর থেকে আরো অনেক অসভ্য চিন্তা মাথায় আসে। সবকিছু তোমাকে বলা যাবে না।’ 

নাবিলা ঠোঁট টিপে হাসতে থাকে। মুখে কিছু বলে না। 

—‘তুমি কিছু বলছ না যে?’ 

—‘কী বলবো? সেই ভাগ্যবতীকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে।’ 

—‘তাই?’ বলে ফাহাদ পাঞ্জাবির পকেট থেকে সেলফোন বের করলো। ফ্রন্ট ক্যামেরা ওপেন করে নাবিলার মুখের সামনে ধরে অকপটে বলল, 

—‘দেখো!’ 

নাবিলা লাল হয়ে গেলো। ঘুরে দাঁড়িয়ে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘পাগল!’ 

ফাহাদ নাবিলার হাত ধরে নিজের খুব কাছে টেনে নিয়ে আসলো। ফিসফিস করে বলল, ‘তুমি কি সত্যিই কিছু বুঝতে পারছো না?’ 

নাবিলা কাঁপছিল। কানের কাছে শুনতে পাচ্ছিল ফাহাদের বুকের নিরবচ্ছিন্ন ধুকপুক। 

৪২

আকাশে জেগে আছে পরিপূর্ণ এক গোল চাঁদ। জল, স্থল, অন্তরীক্ষ থৈ থৈ করে ভেসে যাচ্ছে সবুজাভ ফিকে জোছনার আলোয়। হু হু করে দিগ্বিদিক ছুটে বেড়াচ্ছে অক্টোবরের হিম হিম খ্যাপা হাওয়া। আরশান বসে আছে আগুনের পাশে। শুধু শুকনো পাতা নয় জ্বালানি হিসেবে পুড়ছে সকালের কয়েকখানা ছবি। নিজেই এঁকেছিল। এই মুহূর্তে নিজের আঁকা ছবিগুলো পুড়িয়ে ফেলতে পেরে এক ধরনের স্বস্তির ভাব হচ্ছে তার ভেতরে। জোছনা রাতের বন। কাছাকাছি কোথাও শেয়াল ডাকছে। বাতাসে খস খস শব্দ তুলে উড়ে বেড়াচ্ছে শুকনো পাতা। 

এরিক ঘুমাচ্ছে। সুখের ঘুম। অমন নিশ্চিন্তের ঘুম ঘুমাতে আরশানেরও ভারি সাধ হয়। মানুষ হয়ে না জন্মে ঘোড়া হয়ে জন্মালে কেমন হতো? কিংবা জন্মটাই যদি না হতো? এই মানবজন্মটা কিন্তু তার বড় বেশি প্রিয় ছিল। অক্টোবরের একটিমাত্র কমলা রঙের দুপুর দেখবার জন্য হাজার হাজার বছর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে হতো তার। সে মানুষটা বরাবরই একা। একা হলেও একাকিত্ব বোধটা কখনো তাকে কাবু করতে পারেনি। একাকী বেঁচে থাকাটাকে উপভোগ করেছে সে। কিন্তু আজ এই নীল জোছনার ঐন্দ্রজালিক রাতটায় জীবনে প্রথমবারের মতো তার মনে হলো, জন্মটা না হলেই বুঝি ভালো হতো। তার জন্ম না হলেও এ পৃথিবী কোটি কোটি বছর ধরে ঠিক এমনি ভাবেই জেগে থাকত। ওই সোনার থালার মতো মায়াবী চাঁদ পৃথিবীকে ঠিক একই নিয়মে প্রদক্ষিণ করে যেত। না জন্মালে, এই রূপবতী প্রকৃতিকে কখনও চোখ মেলে দেখা হতো না। মধ্যরাতের অরণ্যে এলোমেলো উড়তে থাকা শুকনো পাতার কোলাহল শুনে বুকের মধ্যে জন্ম নেয়া শিরশিরে অনুভূতিটুকু কখনও সে টের পেতো না। কী ভীষণ ভয়ংকর একটা ব্যাপার! ভাবতেই তার গা শিউরে উঠত সব সময়। অথচ আজ মনে হচ্ছে, কী এমন ক্ষতি হতো এ পৃথিবীতে না আসলে? এসেই বা কী হয়েছে? কেন এসেছিল? কেনই বা একদিন আবার চলে যেতে হবে? 

ছবিগুলো পুড়ছে। একদিন মনের চোখ দিয়ে এঁকেছিল ছবিগুলো। কেন এঁকেছিল কে জানে! ভালোবেসে? 

আচ্ছা একেই কি ভালোবাসা বলে? ভালোবাসার রং কী? দেখতে কেমন? এর কি কোনো ঘ্রাণ আছে? নাকি বুকের ভেতর এমন দাউ দাউ করে আগুন জ্বলার আরেক নামই ভালোবাসা? 

যদি এটাই ভালোবাসা হয় তবে আরশান বলবে ভালোবাসা ভালো নয়। সে চিৎকার করে বলবে ভালোবাসা তোমাকে আমি ভালোবাসি না। ঘেন্না করি। প্রচণ্ড ঘেন্না। 

হাতে ধরা শ্যাম্পেনের বোতলটাতে শেষ চুমুক দিয়ে দূরে ছুঁড়ে মারলো সে। চোখ ঠিক মতো খোলা রাখা যাচ্ছে না। মাথাটা ঘুরছে। ঘাস আর আগাছাভরা শক্ত মাটির ওপর শুয়ে পড়ল সে। জ্বর আসছে। জ্বরজারির সাথে তার জানাশোনা খুব কম। অনেক দিন হয় তার কোনো অসুখ করে না। সে বরাবরই বেশ স্বাস্থ্য সচেতন একজন মানুষ। শরীরটাকে কী করে নিজের বশে রাখতে হয় তা খুব ভালো মতোই জানা আছে তার। কিন্তু আজকে নতুন করে জানল যে, মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকলে শরীর হয়ে যায় পর। আগে বশে আনতে হবে মনটাকে তারপর দেহ। 

আজ মন বড়ই অবাধ্য! 

জ্বরটা তার অস্তিত্বকে নাড়িয়ে দিচ্ছে। লুপ্ত হচ্ছে চেতনা। জ্বরই কি? নাকি নেশা? 

ছোটবেলায় দাদুবাড়িতে জ্বর হলে দিদা রাত জেগে বসে থাকতো তার মাথার কাছে। জ্বরের ঘোরে আবোল-তাবোল বকত আরশান। বাবাকে খুঁজতো। দিদা আশ্বাস দিয়ে বলতো, বাবা আসছে। এইতো এলো বলে। 

কিন্তু জ্বরের ঘোরে বিকল হয়ে থাকা দীর্ঘ রাত্রিগুলোতে বাবা কোনোদিন ভুল করেও আসেননি। কিছুদিন বাদে সে বাবাকে খুঁজতে ভুলে গেলো। সকাল বিকাল রাত্তির দাদা দিদা ছিল তার সর্বক্ষণের সঙ্গী। ওই বৃদ্ধ বৃদ্ধাকে নিয়েই সে সন্তুষ্ট ছিল। কিন্তু সেই সুখটাও বেশি দিনের জন্য ছিল না। বাবা জোর করে নিয়ে এলেন আমেরিকায়। মনে আছে এখানে আসার পর এক শীতের রাতে ভয়ঙ্কর জ্বরে পড়েছিল। বাবা অফিসের কাজে কানাডা গিয়েছিলেন। বাড়িতে শুধু মাদার আর ফাহাদ। মাদার সারাটা দিন দুষ্টু ফাহাদকে সামলাতে গিয়ে হিমশিম খান। আরশানের দিকে এক নজর তাকাবারও সময় নেই তার। আরশান তাই একদম একলা একলা কাটালো সেই জ্বরজারির দুর্বিষহ রাতটা। তার কেবলই মনে হচ্ছিল দিদা যদি পাশে থাকতো, একটা বার যদি তার কপালে হাত রাখতো! অথচ দিদা তখন বেঁচে ছিলেন। বেঁচে থেকেও তার পাশে ছিলেন না। এই হলো আরশানের ভাগ্য। 

আজ এতদিন বাদে আবারও ঠিক সেরকম একটা অনুভূতি হচ্ছে। সে কয়েকবার ভারি জিবটা নেড়ে নেড়ে অস্পষ্ট ভাবে উচ্চারণ করলো নামটা, দিদা… দিদা… দিদা… 

ওক গাছের পেছনে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। অনেক কষ্টে চোখের ঢাকনা খুলে তাকালো সে। হাওয়ায় খুব জোর। গাছের পাতা পাগলের মতো নাচছে। যে মানুষটা দাঁড়িয়ে আছে তার পরনে সাদা শাড়ি। অন্ধকারে নীল জোছনা গায়ে মেখে স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। 

আরশান অস্ফুটে বলল, ‘কে?’ 

তার মাথার ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। শরীর ব্যথা। জিব নাড়াতে, মুখ নাড়াতে বড় কষ্ট। 

—‘কে? দিদা?’ 

গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা মানুষটা কোনো কথা বলে না। স্থিরচিত্র হয়ে থাকে। 

—‘ দিদা? ….. সকাল?’ 

একটুক্ষণ চুপ থাকে সে। আবার বলে, ‘সকাল?’ 

রাত গাঢ় হয়। সোনার থালার মতো মোহময় চাঁদটার রূপ গলে গলে পড়তে থাকে অক্টোবরের রংবাহারী বন-বনানীর গায়ে। আরশানের কাছে কেউই আসে না। দিদাও না, সকালও না। আরশান নিজের মনে বিড়বিড় করে, কে আসবে তোমার কাছে? তুমি একা ছিলে, একাই রবে। 

৪৩

বিন্দুবাসিনীর হাতে বকুল ফুলের মালা। সে মালাটি সকালের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘শেহজাদী! এটা আপনার জন্য।’

সকাল উপুড় হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। সে উঠল না। বলল, ‘আমার চাই না বিন্দু! 

—‘শেহজাদী, আমার মনে হয় আপনার পুরো বিষয়টা নিয়ে আরেকবার ভেবে দেখা উচিত।’ 

সকাল ঘুরে তাকালো বিন্দুর দিকে। অন্ধকারেও ওকে স্পষ্ট দেখতে পায় সে। সাদা শাড়ি, পান পাতার মতো চমৎকার গড়নের মুখ। কোমর পর্যন্ত ছড়ানো কালো দীঘল চুল। বিন্দুটা, ভারি সুন্দর। হঠাৎ মনে হয় সকালের। 

সকাল কি পাগল হয়ে যাচ্ছে? এটা বিন্দুর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হবার মতো সময় কি? 

সে শোয়া থেকে উঠে বসে বলল, ‘ভেবে দেখা উচিত মানে?’ 

—‘দেখুন আপনি কিছু মনে করবেন না। কিন্তু আমার উনাকে ঠিক স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে না ইদানিং। যখন যা ইচ্ছে তা করে। ইচ্ছে হলে আপনার রূপের প্রশংসা করে। ইচ্ছে হলে আপনাকে অনিক সাহেবের কাছ থেকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় নিজের কাছে। আবার যখন ইচ্ছে তখন তার ঘর থেকে তাড়িয়ে দেয়। তার আচরণ অস্বাভাবিক। আপনি কি এভাবে ভেবে দেখেছেন?’ 

সকাল কিছু বলে না। তার চোখের তারায় জল ঝিকমিক করে। সত্যিই, কেন একটা ভুল মানুষকে ভালোবাসতে গেলো সে? একেই কি বলে তীরে এসে তরি ডোবা? ভালোই তো ছিল সে। প্রেমহীন, ভালোবাসাহীন জীবনটা তো তার খারাপ যাচ্ছিল না। কে জানে! হয়তো লোকটা এমন পাগল বলেই তার ওকে এতটা ভালো লাগে। বিন্দু বুঝবে না। বিন্দু বুঝবে না যে ভালো লাগাটা, ভালো বাসাটা আসলে অত হিসেব করে হয় না। লুতুপুতু প্রেমে গলে পড়া ছেলে তার কখনোই পছন্দ ছিল না আরশান অমন ছন্নছাড়া, মতিচ্ছন্ন, এলোমেলো আর একরোখা বলে: সকালকে সে অতটা টানে। 

সেলফোনটা বাজছিল, নাবিলা। 

—‘হ্যালো দোস্ত কী খবর?’ 

নাবিলা উচ্ছ্বসিত গলায় বলে, ‘তুই জানিস আমাদের রুমকির বিসি-এস এ হয়ে গেছে।’ 

—‘সত্যিই? বাহ্ খুব ভালো খবর তো! দেখ না লোকে কত কিছু করে ফেলছে আর আমি এখানে বসে বসে মাছি তাড়াচ্ছি।’ 

—‘তুই তো বেড়াতে এসেছিস। ফিরে গিয়ে কোমর বেঁধে লেগে যাবি পড়াশোনায়। আর তোর এখানে পড়ার কী হলো? অনিকের ভার্সিটিতে গিয়ে কি করলি? 

—‘যাইনি তো, কাল সকালে যাবো। অনলাইনে কয়েক জায়গায় এপ্লাই করেছি। মনে হয় না লাভ কিছু হবে। ফান্ড পাওয়াটাই মুশকিল বুঝলি।’ 

—‘চেষ্টা করে দ্যাখ। হলেও হয়ে যেতে পারে।’ 

কথাটা বলে নাবিলা একটা দম নিলো, বলল, ‘একটা কথা বলার ছিল তোকে শেহজাদী!’ 

—‘বলে ফেল।’ 

—‘আচ্ছা শোন। ফাহাদ মনে হয় মানে আসলেই আমাকে পছন্দ করে। বুঝছিস?’ 

সকালের ঠোঁটে হাসি ফুটলো। অনেক অনেকক্ষণ পর সে হাসতে পারলো। 

—‘আচ্ছা?’ 

—‘উম হুম।’ 

—‘আর তুই? তোর কেমন লাগে ওকে?’ 

—‘আমার তো ভালোই লাগছে!’ 

—‘ভালোই? নাকি খুব ভালো?’ 

নাবিলা একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, ‘একটু বেশিই ভালো লাগছে রে! এখন আমি কী করব?’ 

—‘ফাহাদ তোকে কিছু বলেছে?’ 

নাবিলা সংক্ষেপে ঘটনা খুলে বলল। শুনে টুনে সকাল বলল, 

—‘দ্যাখ না ফাহাদ কত রোমান্টিক। কত স্মার্ট! আর আমি যে একটা কিসের পাল্লায় পড়লাম!’ 

—‘আসলেই আরশানটা একটু পাগল আছে রে।’ 

—‘একটু না, পুরাই পাগল।’ 

—‘কেন আবার কিছু হয়েছে নাকি?’ 

সকাল গভীর মন খারাপের গলায় বলল, ‘আমার মনে হয় না ওর সাথে আমার কিছু হবে রে।’ 

—‘কেন কী হয়েছে?’ নাবিলা ভয়ার্ত গলায় প্রশ্ন করলো। 

সকাল আর কথা বলতে পারছিল না। তার ভেতর থেকে একটা কান্নার স্রোত ঊর্ধ্বমুখী হয়ে উঠে এসে গলা থেকে সব শব্দ কেড়ে নিচ্ছে। কিন্তু এ মুহূর্তে তার নাবিলার খুশিতে খুশি হওয়া উচিত। নিজের চিন্তা বাদ দিয়ে নাবিলার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলা উচিত। কিন্তু সকাল এসব কিছুই বলতে পারল না। হ্যাঁ, নিজেকে বেশ স্বার্থপর বলেই মনে হলো তার সে সময়। সে অনেক কষ্টে বলল, 

—‘নাবিলা, তোর সাথে আমি পরে কথা বলি?’ 

৪৪

সকালবেলা নাশতার টেবিলে বাবাকে পাওয়া গেল। বাবা আরশানকে দেখে আঁতকে উঠলেন, ‘তোমার কী হয়েছে?’ 

আরশান বলল, ‘কিছু হয়নি।’ 

খাবার টেবিলে ফাহাদ আর টিলিও উপস্থিত ছিল। সকাল কিংবা অনিককে দেখা গেলো না। মাদার বললেন, ‘বসো বসো। দাঁড়িয়ে কেন?’ 

আরশান বসলো। 

—‘বাবা আপনাদের সাথে আমার একটু কথা ছিল।’ 

—‘তুমি কি রাতে ঘুমোওনি?’ মাদার প্রশ্ন করলেন। 

—‘ঘুম …ঘুম হয়নি ঠিকঠাক।’ আরশান বলল মরা গলায়। 

বাবা বললেন, ‘কোনো জরুরি কথা আছে?’ 

—‘একটু জরুরিই।’ 

মাদার আরশানের দিকে পরোটার প্লেটটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘নাও নাশতা কর।’ 

—‘না এখন কিছু খাবো না।’ 

বাবা বললেন, ‘বলে ফেলো কী বলতে চাও।’ 

আরশান পরিষ্কার ভাবে বলল, ‘বাবা আমি ভাবছিলাম বাংলাদেশে দাদার যেসব ইমমুভেবল প্রপার্টি আছে, যেমন ধরুন দেশের বাড়ির প্লট, ঢাকার বাড়ি। এগুলো আমি ফাহাদ আর টিলির নামে হিবাহ করে দিতে চাই। এটা আমার ফাইনাল ডিসিশন। কোনো সেকেন্ড থট এটাতে দেয়া হবে না। সরি টু সে বাট আপনার পারমিশনও চাইছি না আমি। আমি শুধু জানতে চাইছি আপনি আমাকে কবে সময় দিতে পারবেন। মানে দেশে যেতে পারবেন কবে?’ 

রহমান সাহেবের বিস্ময়ের ধাক্কাটা সামলে উঠতে বেশ একটু সময় লাগলো। তার ধারণাতেও ছিল না আরশান হুট করে এধরনের কোনও প্রস্তাব দিয়ে বসতে পারে। 

ফাহাদ প্রায় আর্তনাদ করে বলে উঠল, ‘সিরিয়াসলি? আমি ঐসব দিয়ে কী করবো? লিসেন ব্রো, আমার ওসব দরকার নেই। আর আমি দেশে গিয়ে কখনো সেটেল করবো না। এসেটগুলো বেকার পড়ে থাকবে।’ 

আরশান ঠান্ডা গলায় বলল, ‘ফাহাদ আমি কিন্তু আগেই বলে দিয়েছি যে এ বিষয়ে কোনো সেকেন্ড থটের সুযোগ নেই। তুমি না নিতে চাইলে টিলি নেবে।’ 

টিলি সঙ্গে সঙ্গে ঠোকর কাটলো, ‘নো ওয়ে! আমি কী করবো জায়গা জমি দিয়ে? আরশান ভাইয়া তুমি আমাকে বলছ আমার বিশ বছরের জন্মদিনে গাড়ি কিনে দিবা। তার বদলে এখন জায়গা জমি দিতে চাচ্ছ। ব্যাপারটা কী? গাড়ি না কিনে দেওয়ার ধান্ধা হচ্ছে?’ 

টিলির কথা শুনে হাসলো আরশান, বলল, ‘গাড়ির বদলে বাড়ি দিতে চাইছি।’ 

—‘বাড়ি চাই না আমার, গাড়ি চাই।’ 

সবচেয়ে বেশি স্তম্ভিত হয়ে গেছেন মাদার। তার চেহারাটা এ মুহূর্তে কেমন একটু বোকা বোকা দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে তিনি কোনো একটা হিসাব মেলাতে পারছেন না। ঘটনা পুরোপুরি বুঝে উঠতে তার বেশ একটু বেগ পেতে হচ্ছে। 

বাবা বললেন, ‘কিন্তু …কেন? মানে কেন তুমি এমন সিদ্ধান্ত নিলে হঠাৎ?’ 

—‘সিদ্ধান্তটা হঠাৎ নিইনি। ভাবছিলাম অনেক দিন থেকেই।’ 

মাদার এতক্ষণে কথা বললেন, 

—‘কেন? তোমার দাদা দিদা তো তোমার নামেই সবটা লিখে দিয়ে গেছেন তাই না?’ 

—‘হ্যাঁ লিখে দিয়ে গেছেন। শৈশবের একটা দীর্ঘ সময় আমার দাদা দিদার সান্নিধ্যে কেটেছে। এ কারণে হয়তো আমার প্রতি তাঁদের একটু বিশেষ দুর্বলতা ছিল। কিন্তু আমি অনেক চিন্তা করে দেখলাম যে ব্যাপারটা নৈতিক নয়। আমি কেন পুরোটা ভোগ করব? দিস ইজ সো আনএথিক্যাল। ইনফ্যাক্ট আমার কোনো কিছুই চাই না। শুধু একটা স্বপ্ন আছে। আমি চাই দাদা দিদার নামে একটি হাসপাতাল করতে আমাদের গ্রামে।’ 

ফাহাদ বলল, ‘ভাই শোনো,আমার বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্ট নেই ওসব প্রপার্টিতে। প্লিজ তুমি আমাকে এসব ঝামেলার মধ্যে জড়িও না।’ 

আরশান দৃঢ় গলায় বলল, ‘ফাহাদ আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। এ সিদ্ধান্তের কোনো হেরফের হবে না।’ 

—‘আমিও তোমাকে পরিষ্কার ভাবে বলে দিলাম, ওসব আমার চাই না।’ আরশান বলল, ‘আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে তুমি এধরনের প্রতিক্রিয়াই দেখাবে।’ একটু থেমে সে আবার বলল, ‘যাই হোক, বাবা আপনি তাহলে ব্যবস্থা করেন। লইয়ারের সাথে কথা বলে রাখুন। নেক্সট ইয়ার জানুয়ারির দিকে আমি দেশে যেতে চাই। আর ফাহাদ আর টিলির যদি এতটাই আপত্তি থাকে সেক্ষেত্রে প্রপার্টিগুলো মাদারের নামে হিবাহ হবে।’ 

মাদার চমকে উঠে বললেন, ‘আমার নামে? কেন? আমার নামে কেন? আমি কে?’ 

আরশান ঠান্ডা ভাবে বলল, ‘আপনি আমার বাবার স্ত্রী। আপনারও তো একটা হক আছে।’ 

কথাটা শুনে মাদার নিষ্পলক চেয়ে রইলেন আরশানের দিকে। তার চোখ ফেটে বেরোচ্ছে রাজ্যের বিস্ময়। কয়েক সেকেন্ড নীরব কাটলো। এরপর তিনি ঠেস দেওয়া গলায় বললেন, 

—‘বাবার স্ত্রী? তোমার কিছু হই না আমি। তাই না?’ 

প্রসঙ্গ ঘুরে যাচ্ছিল। ফাহাদ আর টিলির মুখে অস্বস্তি খেলছিল। 

—‘তা তো বলিনি। 

—‘সেরকমই তো শোনালো কথাটা। আমি কি তোমাকে ছোটবেলায় দেখাশোনা করিনি? আমি কি তোমাকে বড় করিনি? আমি কি তোমার মা নই?’ 

প্রশ্নগুলো শুনে আরশান ঘাবড়ালো না। আজকে তার কেন যেন কোনো কিছুই গায়ে লাগছে না। আজ তাকে কেমন ঘোরে পেয়েছে। সে অকপটে বলল, ‘দেখাশোনা যদি করেই থাকেন তাহলে ছোটবেলায় টানা এতগুলো বছর কেন আমার বাবাকে ছেড়ে দাদা দিদার সাথে থাকতে হয়েছিল বলুন তো?’ 

মাদার এ প্রশ্নের জবাবে পাথর হয়ে গেলেন। তার ঠোঁটদুটো হালকা হালকা কাঁপতে থাকলো। তিনি বাকশূন্য। 

আরশান আবার বলল, যে সময় আপনাদের দুজনকে আমার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল সে সময়টাতেই আপনাদের আমি পাশে পাইনি। এরপর যখন দাদা দিদা আমার অভ্যাস হয়ে গেলো। তখন ছোঁ মেরে নিয়ে আসলেন এই দেশে। একবার জানতেও চাইলেন না আমি কী চাই।’ 

রহমান সাহেব মাথা নত করে বসে ছিলেন। তিনি ছেলেকে বলার মতো কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না। 

আরশান উঠে পড়ল। যাবার আগে মাদারের কাঁধে হাত রেখে শান্ত গলায় বলল, ‘ইটস ওকে। আপনি আমার মায়েরই মতো।’ 

সিঁড়িঘরে ঢোকার সময় সকালের মুখোমুখি পড়ল আরশান। কয়েকটা অস্বস্তির মুহূর্ত কাটলো। সকাল বিষাদ জড়ানো গলায় বলল, ‘আপনি এখন কেমন আছেন?’ 

আরশান চোখ তুলে একবার তাকালো ওর দিকে। এখনো কেন বুক কাঁপে মেয়েটাকে দেখে? আরশানের তো ওকে ঘেন্না করা উচিত! 

আরশান বলল, ‘ভালো।’ 

অনিক হেঁটে এসে সকালের পাশে দাঁড়িয়ে বলল, ‘চল!’ 

পেছন থেকে মাদারের গলার আওয়াজ পাওয়া গেলো, ‘তোমরা সাত সকালে যাচ্ছো কোথায়?’ 

সকাল বলল, ‘অনিকের ভার্সিটি যাচ্ছি চাচি।’ 

আরশান আর দাড়ালো না। সত্যিই ঘেন্না ধরে গেছে তার কষ্ট হয় কেন? ছাই যা খুশি করুক না ওরা! তার কেন কষ্ট হয়? 

আবার বোতল নিয়ে বসলো সে। নেশা খুব কাজের জিনিস। কষ্ট কাটিয়ে দেয়। এ মুহূর্তে অনিককে তার খুন করতে ইচ্ছা হচ্ছে। 

‘এসহোল!’ দাঁতে দাঁত চিবিয়ে শব্দটা উচ্চারণ করলো সে। 

একটু বাদেই তার মনে হলো সে আসলে করছেটা কী? তার সাথে তো এসব হবার কথা ছিল না! একটি মাত্র অমূল্য মানবজন্ম সে হেলায় কাটিয়ে দিচ্ছে? প্রেমের মতো সস্তা আবেগের পেছনে সময় নষ্ট করা কি তার মতো বিচক্ষণ মানুষকে শোভা পায়? এ পৃথিবীতে মানুষ আসে অতি অল্প সময়ের জন্য। এই অল্প সময়টুকু নিজেকে আবিষ্কার করতে করতেই চোখের পলকে কেটে যায়। সেই আবিষ্কারও কারো জীবনে কখনও পরিপূর্ণতা লাভ করে না। মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত একজন মানুষ জানতে পারে না, বুঝতে পারে না, জীবনের কাছে সে আসলে কী চেয়েছিল? অনেকেই আবার এই আরাধ্য অল্পসময় টুকু অন্যের কথা ভেবে পার করে দেয়। দেশের জন্য, মানুষের জন্য নিজের জীবন বিকিয়ে দেয়। আচ্ছা এসব করে কি মানুষ নিজেকে সার্থক ভাবতে পারে? সুখ আর সার্থকতা এই দুটি জিনিস কি একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল? প্রতিটি সার্থক মানুষই কি একজন সুখী মানুষ? আরশানের নিজের সার্থকতা কোথায়? সে কী চায়? সুখ নাকি সার্থকতা? 

বোতলটা দূরে সরিয়ে রাখলো সে। আবেগকে প্রশ্রয় দেয়া যাবে না ঠিক করলো কাল থেকেই অফিস জয়েন করবে। ছুটি আর চাই না তার। আবার ডুবে যাবে কাজে। সারাদিন শুধু কাজ, কাজ আর কাজ। স্নান সেরে তৈরি হয়ে নিল সে। অফিসে গিয়ে জানালো যে ছুটির আর প্রয়োজন নেই। খুব দ্রুতই সে কাজ শুরু করতে পারবে। অফিস থেকে বেরিয়ে উদ্দেশ্যহীন ভাবে এদিক সেদিক ঘুরে বেরালো। বাড়ি ফিরল সন্ধ্যায়। নিজেকে খুব ভালো মতোই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিল কিন্তু বোতলের নেশাটা তার পিছু ছাড়লো না শেষ অবধি। বেহেড হতেও খুব বেশি সময় লাগলো না। একটা সময় তার মনে হলো সকাল যদি অনিককে নিয়ে সুখে থাকতে পারে তাহলে সে কেন অন্য কারুকে নিয়ে সুখে থাকতে পারবে না? 

সেই রাতে আরশান পাগলের মতো ছুটে গেলো শারলিংটনের এক কনডোতে। দরজা খুললো এন্ড্রিয়ানা। তার গায়ে একটা হালকা গোলাপি রঙা রাতের ঘুমোনোর পোশাক। আরশানের বেহেড চোখে এন্ড্রিয়ানাকে ঐ পোশাক পরিহিতা অবস্থায় স্বর্গের হুরপরী মনে হলো। সে ঘরে ঢুকেই জড়ানো গলায় বলল, ‘হেই এন্ড্রি! লিসেন, আই থিংক আই নিড ইউ।’

এন্ড্রিয়ানা বিস্ময় ভরা চোখে আরশানের দিকে চেয়ে বলল, ‘ইউ নিড মি?’ 

—‘হ্যাঁ তোমাকে খুব দরকার আমার।’ বলে আরশান জীবনে কখনো যা করেনি তাই করলো। আচমকা জড়িয়ে ধরলো এন্ড্রিয়ানাকে। এন্ড্রিয়ানা বেসামাল হয়ে বলল, ‘তুমি কি সকালকে আর ভালোবাসো না?’ 

আরশান এন্ড্রিয়ানার সোনালি চুলে মুখ ডুবিয়ে কেমন ঘোরলাগা গলায় বলল, ‘কখনো ভালোবাসিনি আমি ওকে। ও আমার ভালোবাসার যোগ্যই না।’ 

এন্ট্রি আরোশনের বাহু থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ওর চোখে চোখে তাকায়। হতভম্ব হয়ে বলে, ‘বলছো কি তুমি?’ 

আরশান এন্ড্রিয়ানার মুখখানা নিজের দু’ হাতের তালুর মধ্যে নিয়ে বলে, ‘আমি সব কিছু ফেলে তোমার কাছে এসেছি। তুমি কি আমাকে ফিরিয়ে দেবে?’ 

‘সত্যি বলছো তুমি?’ এন্ড্রিয়ানার নীল চোখের মণিতে চিক চিক করে ওঠে কয়েক বিন্দু জল। 

আরশান তার ভারি জিব নেড়ে অনেক কষ্টে টেনে টেনে বলল, ‘সত্যি বলছি।’ 

 এন্ড্রিয়ানা আরশানের চোখে, ঠোঁটে, গালে অনেকগুলো চুমু খেলো পর পর। আরশান বাধা দিল না। ওকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইল অনেকটা ক্ষণ। খানিক বাদে অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে এন্ড্রিয়ানা বলল, 

—‘আই লাভ ইউ শওন!’

আরশান তার বুকের সাথে আরো শক্ত করে চেপে ধরল এন্ড্রিয়ানাকে, গভীর গলায় বলল, ‘আই লাভ ইউ সকাল! 

এন্ড্রিয়ানা তড়িৎ গতিতে পিছিয়ে আসলো। বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইল 

কয়েক সেকেন্ড। আরশান চুপ। মাথা নত 

প্রবল বেগে একটা চড় এসে পড়ল তার গালে। এন্ড্রিয়ানা চিৎকার করে বলল, ‘গেট দ্যা হেল আউট অফ মাই কনডো। রাইট নাও!’ 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *