৩৫
গাড়িতে আরশানের পাশে ফাহাদকে দেখে একটু ভড়কে গেলো নাবিলা জড়োসড়ো হয়ে উঠে বসলো পেছনের সিটে সকালের পাশে। কালো জিন্সের সাথে হালকা খয়েরি একটা ফুল হাত শার্ট পরেছিল ও। ওপরে খয়েরি পাতলা শাল। সিল্কের মতো চুলগুলো খোলা ছিল কাঁধের ওপর। চোখে কাজল। সুন্দর দেখাচ্ছিল ওকে। সকাল দেখামাত্র একটু জোরেই বলে উঠল, ‘বাহ্! তোকে তো খুব সুন্দর লাগছে। তুই দিনদিন অনেক সুন্দর হয়ে যাচ্ছিস দোস্ত। কাহিনি কী?’
নাবিলা গর্জে উঠে বলল, ‘ফালতু কথা বলিস না তো সকাল! আমি আবার সুন্দর নাকি? যত সব আজাইরা কথাবার্তা।’
সকালের মন মেজাজ আজ বেশ ভালো। অনেকদিন পর তার ভেতরটা কেমন যেন শান্তি শান্তি লাগছে। নাবিলার রাগটা সে গায়ে মাখলো না এই মুহূর্তে। শান্ত গলায় বলল, ‘তুই সুন্দর না?’ এটুকু বলে সামনের সিটে বসে থাকা দুই ব্যক্তির উদ্দেশ্যে সে বলে উঠল, ‘তোমরাই বলো, নাবিলা কি সুন্দর না?’
ফাহাদ পেছনে ঘুরে তাকালো। নাবিলাকে এক পলক দেখে নিয়ে মিটমিটে হাসি হেসে বলল, ‘সুন্দরীরা নিজেদের সুন্দর বলে স্বীকার করে না মুখে।’ ফাহাদের বাংলাটা আগের চাইতে অনেক ভালো হয়েছে। এমন কি আজ একটু আগে সে তার নিজের বড় ভাইয়ের সাথেও বাংলায় কথা বলেছে। জীবনে প্রথম বারের মতো!
সকাল হাসতে হাসতে বলল, ‘তাই হবে, তাই হবে।’ এরপর নাবিলার হাতে একটা চিমটি কেটে বলল, ‘এতো ঢঙ্গী হয়েছিস কেন তুই?’
নাবিলা হেসে ফেললো। রসিয়ে রসিয়ে প্রায় ফিসফিস করে সকালকে বলল, ‘কী শেহজাদী? এতো খুশি কেন আজকে?
সকাল ফিসফিস করে উত্তর দিলো, ‘ট্যুর ক্যানসেলড! আমার প্ল্যান সাকসেসফুল!’
৩৬
—‘আর ইউ স্টিল ম্যাড এট মি?’ ফাহাদের প্রশ্ন। ওরা পাশাপাশি হাঁটছিল। নাবিলা টিলির জন্য মেসি’স থেকে একটা একশ ডলারের গিফট কার্ড কিনবে বলে ঠিক করেছে। কিন্তু মেসি’স এ পৌঁছনোর আগে পথিমধ্যে ভিকটোরিয়াস সিক্রেটের শো রুম পড়ল। নাবিলা কথা বলতে বলতে ঢুকে পড়ল দোকানটায়। এখানে মাঝে মাঝে ডিসকাউন্টে ভালো জিনিস পাওয়া যায়। সামনেই হলিডে সিজন। হলিডে অফারগুলো এখন থেকেই আসা শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু সে ভুলে গিয়েছিল যে আজকে তার পাশে একটি পুরুষ সঙ্গী আছে। ফাহাদও আসলো ওর পেছন পেছন।
—‘নো। আই এম নট ম্যাড এট ইউ। তোমার ওপরে আমার কোনো রাগ নেই।’ নাবিলা বলল।
—‘তাহলে এমন রাগ রাগ গলায় কথা বলছো কেন?’
—‘কই নাহ!’ নাবিলা হাসার চেষ্টা করলো।
—‘আমি নোটিস করেছি তুমি আমার সাথে ঠিক মতো কথা বলছো না। ইনফ্যাক্ট আমার চোখে চোখেও তাকাচ্ছো না। কেন?’
নাবিলা চোখ বড় বড় করে ফাহাদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কই তাকাচ্ছি না, এইযে দেখো তাকালাম।’
ফাহাদ হেসে বলল, ‘সকাল ঠিক বলেছিল।’
—‘মানে?’
—‘মানে আসলেই তোমাকে অনেক সুন্দর দেখাচ্ছে।’
—‘মোটেও না।’
একজন সাদা চুলো মধ্যবয়স্কা দোকানি হাস্যোজ্জ্বল মুখে ওদের দিকে এগিয়ে এসে বলল, ‘হাই দেয়ার!’
দোকানির কথা নাবিলার কানে ঢুকলো না। ফাহাদ হেসে উত্তরে হ্যালো বলল।
সাদা চুলো মহিলা দ্বিগুণ উৎসাহে বলে উঠল, ‘আমি জানি তোমার গার্লফ্রেন্ডের জন্য তোমার ঠিক কী চাই।’
ফাহাদ একটু থতমত খেয়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে মাথায় ক্লিক করলো ব্যাপারটা। এই শো রুমের ভেতরে সে এর আগে কখনো ঢোকেনি প্রয়োজন পড়েনি। বাইরে থেকেই দেখেছে শুধু। এটা যে নিতান্তই মেয়েদের একটা জায়গা এই বিষয়টা ঢোকার সময় মাথায়ই ছিল না।
নাবিলা এবার চমকে তাকালো সাদা চুলো মহিলার দিকে। মহিলা একটা সাদা নেটের লঞ্জরি স্লিপওয়্যার হাতে নিয়ে নাবিলার গায়ের সামনে ধরে ফাহাদকে বলল,
‘এটা নতুন এসেছে। একটি কিনলে দ্বিতীয়টি ফিফটি পার্সেন্ট অফ। তোমার গার্লফ্রেণ্ডকে এটাতে সুপার হট লাগবে। জাস্ট এটা পরে সামনে দাড়ালেই তোমার মাথা খারাপ হয়ে যাবে। ট্রাস্ট মি আমি তোমাদেরকে বেস্ট জিনিসটা দিচ্ছি।’
ফাহাদ হতভম্ব।
নাবিলা বিস্মিত, লজ্জিত, কুণ্ঠিত।
দোকানি বলল, ‘কিন্তু আমার সাইজটা জানা দরকার।’
ফাহাদ গোল গোল চোখ বানিয়ে যন্ত্রের মতো শব্দটা উচ্চারণ করলো, ‘সাইজ?’
—‘ইয়েস। হোয়াট সাইজ?’
নাবিলা আর এক মুহূর্তও দেরি না করে লাফিয়ে উঠে ফাহাদের হাত টেনে ধরে বলল, ‘বের হও তো এখন থেকে!
নাবিলার মুখ থম থম করছিল। মনে হচ্ছে যেন এই মাত্র তাকে নিয়ে কোনো মারাত্মক রসিকতা করা হয়ে গেছে। ফাহাদ ব্ৰিত বোধ করছে। কী করবে, কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না।
খানিক বাদে, নাবিলার ওই থমথমে রাগ রাগ চেহারা দেখে ফাহাদ জানে না কেন হঠাৎ তার হাসি পেয়ে গেলো। পুরো ঘটনাটা মনে পড়ায় হাসির দমক আরো বেড়ে গেলো। নাবিলা হতবাক হয়ে দেখলো ফাহাদ হো হো শব্দ করে ডাকাতের মতো হেসে যাচ্ছে।
সে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল, ‘তুমি হাসছো কেন?’
ফাহাদ হাসির দমকে উত্তর দিতে পারছে না।
নাবিলা দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘হাসছো কেন?’
ফাহাদ হাসি থামালো অনেক কষ্টে। তারপর গলায় খুব ইনোসেন্ট একটা ভাব আনার চেষ্টা করে বলল, ‘বাই দ্যা ওয়ে, হোয়াট সাইজ?’
নাবিলা হাতে ধরা ব্যাগটা ছুঁড়ে মারলো ফাহাদের দিকে, চিৎকার করে বলল, ‘চুপ থাকো। অসভ্য ছেলে!’
ফাহাদ নাবিলার ছুঁড়ে মারা ব্যাগটা হাত দিয়ে ধরে ফেলে নিজেকে বাঁচাল। হাসতে হাসতে বলল, ‘ইউ নো হোয়াট? আই থিঙ্ক ইউ শ্যুড বাই দ্যাট লঞ্জরি।’
—‘চুপ থাকো ফাহাদ।’ নাবিলা মুচকি হাসছে।
—‘না সিরিয়াসলি। সেলসগার্লটা বলল তো, তোমাকে ওটা পরলে অনেক হট লাগবে।’
—‘ফাহাদ তুমি চুপ করবা?’
—‘অবশ্য তুমি এমনিই হট।’
নাবিলা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘আর তুমি একটা ফাজিল।’
৩৭
শপিং মলে ঢোকার পর ওদের দলটা দুই ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। সকাল আরশানকে বলল, ‘নাবিলাদের একটু স্পেস দিতে চাইছি। আসলে ওদের ভেতরে একটা প্রব্লেম চলছে তো।’
—‘প্রব্লেম চলছে মানে কী? ওরা কি কোনো রিলেশনশিপে আছে? আরশানের গলায় কৌতূহল।’
সকাল একটু আমতা আমতা করে বলল, ‘রিলেশনশিপে নেই। তবে হয়েও যেতে পারে।’
—‘হুম …কুল! নাবিলা মেয়েটা ভালো। হলে ভালোই হয়।’
হলদে বৈদ্যুতিক আলোয় ঝলমল করছে চারপাশ। ছুটির দিন বলে মানুষের ভিড়ও আছে বেশ। এই শপিং মলটার নাম টাইসন্স কর্নার। এটি ভার্জিনিয়ার সবচেয়ে বড় শপিং সেন্টার। এর আগেও একবার এসেছিল সকাল এখানটায় ফাহাদের সাথে। ঢোকার মুহূর্তেই চলন্ত সিঁড়ির সামনে একটি চুম্বন দৃশ্য দেখে ওরা দুজন কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। একটি কালো মেয়ে আর সাদা ছেলে সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে একজন আরেকজনকে গভীর ভাবে চুমু খাচ্ছে।
সকাল বিরক্তি নিয়ে বলে উঠল, ‘কী হচ্ছে এসব?’
আরশান একটু ফিচেল গলায় বলল, ‘ভালোবাসা হচ্ছে।’
চলন্ত সিঁড়িতে উঠল ওরা। সকাল বলল, ‘সেফোরার শো রুম কোথায়? ভাবছি ওখান থেকেই কিছু কিনব টিলির জন্য। আপনি কী বলেন?’
—‘আপনার ইচ্ছা। সেফোরা সম্ভবত দোতলায়। আমি ঠিক জানি না। ম্যাপ দেখতে হবে।’ এটুকু বলে নিচে চুম্বনরত ছেলে-মেয়ে দুটোর দিকে আরেকবার আড়চোখে তাকিয়ে নিয়ে আরশান চাপা কিন্তু উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, ‘হোও! দ্যাট গার্ল ইজ আ ড্যাম গুড কিসার।
সকাল অবাক হয়ে বলল, ‘কী করে বুঝলেন?’
—‘দেখে!’
সকাল একবার তাকালো চোরা চোখে প্রেমিক যুগলটির দিকে। নাক কুঁচকে বলল ‘অশ্লীল!’
আরশান হেসে ফেললো, ‘অশ্লীল? বলছেন কী? কিসিং ইজ এন আৰ্ট!’
সকাল হতচকিত হয়ে বলে উঠল, ‘ও রিয়েলি আরশান? কিসিং ইজ এন আর্ট? আপনি তো মনে হচ্ছে একজন এক্সপার্ট।’
আরশান কুণ্ঠিত হলো, ‘না না আমি এক্সপার্ট নই। আমার ইনফ্যাক্ট কোনো এক্সপেরিয়েন্সই নেই।’
—‘কোনো এক্সপেরিয়েন্স নেই?’
—‘নাহ!’
—‘আজ পর্যন্ত কোনো মেয়েকে চুমু খাননি আপনি?’
—‘না তো!’
—‘কেন?’
—‘কে জানে! হয়তো সেরকম কাউকে পাইনি বলে। আপনি?’
—‘আমার তো বয়ফ্রেন্ডই ছিল না কখনো।’
—‘সো?’
—‘সো আই নেভার ডিড ইট!’
কথাটা শুনে আরশান ঘোলাটে হাসলো, ‘এতো সুন্দর ঠোঁট দুটোতে কোনো পুরুষ কখনো চুমু খায়নি? দিস ইজ আনবিলিভেবল!’
সকাল মুখ ঘুরিয়ে নিলো। ঠোঁট চেপে অনেক কষ্টে হাসি চাপালো। মুখ ফুটে বলতে পারলো না কিছু।
৩৮
বিকেল পাঁচটার পরেই অতিথিরা একে একে আসা শুরু করলো। ব্যাক ইয়ার্ডে চেয়ার টেবিল সাজানো হয়ে গেছে। যে পরিমাণ জায়গা আছে তাতে অনায়াসে তিরিশ জন লোক এঁটে যাবে। কিন্তু মনে হচ্ছে অত লোক শেষ পর্যন্ত হবে না। এর মাঝেই তিন চারজন ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে আসতে পারছে না। আগামীকাল তার বোন এবং বোনের পরিবার ফিরে যাবে নিউইয়র্ক। থেকে যাবে শুধু অনিক। ফাহাদের মা-ই প্রস্তাবটা দিয়েছে। অনিকের ভার্সিটি এখান থেকে খুব একটা দূরে নয়। এতো কাছে আপন খালার বাসা থাকতে ছেলে কেন অন্য বাড়ি ভাড়া করবে? প্রশ্নই আসে না।
তা ছাড়া আজ দুপুরে একটি দৃশ্য দেখে ফাহাদের মায়ের মনের মাঝে একটি গোপন অভিসন্ধির উৎপত্তি হয়েছে। তিনি দেখলেন অনিক আর সকাল দুজনে পাশাপাশি বসে আছে। সকাল চপিং বোর্ডে সবজি রেখে ছুরি দিয়ে কাটছে। অনিক মুগ্ধ চোখে চেয়ে আছে তার দিকে। অনিকের এই চাউনিটা সাধারণ নয়। তাঁর বয়স হয়েছে। আজকাল মানুষের চোখের দৃষ্টি দেখেই তিনি বলে দিতে পারেন ভেতরে কী চলছে। অনিক যে সকালের প্রতি আসক্ত তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ফাহাদের চোখে সকালের জন্য এই ধরনের অভিনিবেশ তিনি কখনো লক্ষ্য করেননি। ফাহাদ আর সকালের যে হবে না তা তিনি শত ভাগ নিশ্চিত হয়ে গেছেন এর মাঝেই।
কিন্তু ফাহাদ যা পেলো না। তা আরশান কেন পাবে?
আরেকটু চিন্তা ভাবনা করে তিনি বোনের সাথে কথাটা তুললেন।
—‘অনিককে দেখে মনে হলো সকাল মেয়েটাকে ওর মনে ধরেছে। তুই কি ওর বিয়ে শাদীর কথা কিছু ভাবছিস?’
লিরা বলল, ‘হ্যাঁ আপা আমিও ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছি। ওর মনে হয় মেয়েটাকে বেশ পছন্দ।’
—‘তুই বললে আমি ওর বাবা মায়ের সাথে কথা বলে দেখতে পারি।’
—‘কিন্তু ওকে তো তুমি ফাহাদের জন্য পছন্দ করেছিলে।’
—‘করেছিলাম। কিন্তু ফাহাদ তো আগ্রহ দেখাচ্ছে না। ওর মনে হয় ইচ্ছা নাই।’
—‘হুম …তবুও আত্মীয়-স্বজন অনেকেই জেনে গেছে।’
—‘কে আর জেনেছে? আমার বোনরাই শুধু জানে। আর বিয়ের কথাবার্তা তো হতেই পারে। কথা হওয়া মানেই তো বিয়ে হয়ে যাওয়া নয়, তাই না?’
—‘তা বটে। কিন্তু এখনই আমি আগাতে চাইছি না আপা। দেখি অনিক কিছু বলে কিনা আমাকে। ও মুখ ফুটে বললে তখনই আগাবো। তার আগে নয়। আর তাছাড়া সকালেরও মতামতের ব্যাপার আছে। হুট করে কিছু করা ঠিক হবে না।’
ফাহাদের মা চুপ করে গেলেন। তার মনের ভেতর একটা প্রতিশোধের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছিল। আরশানের দোষ শুধু একটাই। ফাহাদের সম্পদে, বিভবে, ঐশ্বর্যে হাত বাড়ানোর দুর্ধর্ষ প্রচেষ্টা। দেশের বাড়ির বিঘার পর বিঘা জমি এবং ঢাকা শহরের তিন তিনটা বাড়ি যে আরশান একলা গ্রাস করে নিয়েছে এই ভয়ঙ্কর ঘটনাটি তিনি ভুলতেই পারেন না। তাঁর শ্বশুর শাশুড়ি তাকে বাড়ির বউ হিসেবে মন থেকে মেনে নিতে পারেননি কখনও। পুত্রবধূ হিসেবে আরশানের মা যে সম্মানটুকু পেয়েছিল তার কানা কড়িও ফাহাদের মায়ের ভাগ্যে জোটেনি।
‘মম দেখো তো আমাকে কেমন লাগছে?’ টিলির কথায় ঘোর ভাঙলো তার। টিলি একটা স্লিভলেস সবুজ গাউন পরেছে। পা পর্যন্ত ঝুলানো লেস কিন্তু হাঁটুর দিকটায় বেশ লম্বা ফাঁড়া। হাঁটলে হাঁটু সহ উরুর অনেকখানি অংশ বেরিয়ে আসে। মম ঠান্ডা গলায় বললেন,
—‘এই জামা পরা যাবে না টিলি।’
টিলি আর্তনাদ করে উঠল, ‘কেন মম? এটা আমার ফেভারিট জামা। আমি তিন মাস আগে কিনছি এটা আমার বার্থডে তে পরার জন্য।’
‘যা বলার একবারেই বলে দিয়েছি। এটা পরা যাবে না। অনুষ্ঠানে তো শুধু তোমার আমেরিকান বন্ধুরা আসবে না। দেশের আত্মীয়-স্বজনরাও আসবে। ওদের সামনে তুমি এই পোশাক পরে ঘুরে বেড়াবে? যাও চেঞ্জ করে নাও। বাংলাদেশ থেকে তোমার জন্য যে জামদানি শাড়িটা নিয়ে এসেছিলাম। ওটা পর।’
‘মম আমি শাড়ি পরতে পারি না। আর জামদানি তে আমাকে অনেক মোটা লাগবে। আমি জামদানি পরবো না।’
—‘গাউন পরলে সাধারণ গাউন পর, আজকে অন্তত হাঁটু দেখানো গাউন পরা যাবে না।’
—‘না আমি এটাই পরব।’
আচ্ছা যন্ত্রনায় পড়া গেলো তো এই মেয়েকে নিয়ে। ফাহাদের মা এগিয়ে এসে বিরক্ত গলায় বললেন, ‘আচ্ছা এসো আমার সাথে। দেখি কোনটা পরা যায়।’
৩৯
সকাল একটা হালকা আকাশি রঙের তাঁতের শাড়ি পরেছিল। গলায় মুক্তোর মালা, কানে মুক্তোর দুল। নাবিলা, সকাল আর অনিক পাশাপাশি তিনটা চেয়ারে জঙ্গলের কাছাকাছি বসেছিল। আরশানের ঘরের মুখোমুখি। ইচ্ছে করেই সকাল এদিকটায় বসেছে যেন আরশান বেরোলেই ওকে দেখতে পায়। কিন্তু মহারাজের তো কোনো খবর নেই। এখানে বসে আছে প্ৰায় আধা ঘণ্টা হয়ে গেলো।
নাবিলা অফ হোয়াইট কাতান শাড়ি পরেছিল। চুলে খোঁপা করে কানের কাছে গুঁজেছিল হোয়াইট ম্যাগনোলিয়া ফুল। সুন্দর দেখাচ্ছিল ওকে।
বিকেলটা মোহময়। আকাশের নীল চাঁদোয়া ভেদ করে সিঁদুর রঙা রোদ নেমে এসেছে রংবাহারী জঙ্গলের পাশের এক টুকরো উঠোনটায়। হাওয়া খেলছে গাছের মাথায় মাথায়। লম্বা লম্বা পাইন গাছের ছায়া পড়ে আছে উঠোন জুড়ে। নয় দশটি গোল টেবিল বসানো হয়েছে সদ্য ছাটা লনের সবুজ ঘাসের ওপর। একেকটা টেবিলে ছয়টা করে চেয়ার পাতা। অতিথিরা অনেকেই আসা শুরু করে দিয়েছে। মেকানিক হোজে কে দেখা যাচ্ছে লাইটের তার নিয়ে এদিক-সেদিক দৌড়তে। হোজে ছাড়া উপস্থিত লোকজনদের মধ্যে অন্য কাউকে তেমন একটা চেনে না সকাল। তবে মনে হচ্ছে অতিথিদের মাঝে টিলির বন্ধুদের সংখ্যাই বেশি। অল্পবয়সী, উচ্ছ্বল, পরিপাটি ও সুদর্শন একঝাঁক ছেলে-মেয়ে জড়ো হয়েছে অফুরন্ত প্রাণশক্তি হাতে নিয়ে। ওদের দেখতে ভালো লাগছিল। সকাল নাবিলাকে বলল,
—‘এই বয়সটাই সবচাইতে সুন্দর, নারে? আমার খুব ছোটবেলাটা ফিরে পেতে ইচ্ছে করে।’
নাবিলা বলল, ‘এই বয়সে আমরা কলেজে পড়েছি। ইন্টার ফার্স্ট ইয়ার মনে হয়।’
—‘হুম। কলেজের দিনগুলা মনে আছে তোর? কী আশ্চর্য সুন্দর দিন ছিল তাই না?’
—‘তোর হাফিজ স্যারের কথা মনে আছে?’
শুনে সকাল খুব হাসলো, ‘মনে থাকবে না আবার? হাফিজ স্যারের তোর ওপর সিরিয়াস ক্রাশ ছিল।’
নাবিলা মুচকি হেসে বলল, ‘তোকে বলা হয়নি, হাফিজ স্যার আমাকে কদিন আগে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে।’
উত্তেজনায় সকাল একটু জোরেই বলে ফেললো, ‘আসলেই?’
অনিক নাবিলার পাশে বসা ছিল। সকালের কথা তার কানে যেতেই ফোড়ন কাটলো সে, ‘কী হয়েছে?’
সকাল বলল, ‘এই অনিক তোমার হাফিজ স্যারের কথা মনে আছে? কেমিস্ট্রির প্রফেসর?’
অনিক চোখ ছোট করে একটু চিন্তা করে নিয়ে বলল, ‘ঐযে বেটে করে চশমা পরা স্যারটা? হ্যাঁ মনে আছে তো।
সকাল রসিয়ে রসিয়ে বলল, ‘হাফিজ স্যারের আমাদের নাবিলার ওপর সিরিয়াস ক্রাশ ছিল।’
—‘বল কী?’ অনিক চওড়া হাসলো।
নাবিলা বলল, ‘ওটা তো পুরনো নিউজ। লেটেস্ট নিউজ হচ্ছে উনি আমাকে ফেসবুকে এড করেছেন।’
অনিক হেসে বলল, ‘উনার তো তখনই চল্লিশের ওপর বয়স ছিল। এখন তো আরো বুড়া হয়ে গেছে।’
নাবিলা বলল, ‘বুড়া হলেই কী আমার না হলেই কী?’
অনিক বলল, ‘হাফিজ স্যার কিন্তু আমাদের ছেলেদের সাথে খুব অসভ্য ব্যবহার করতো। আমাকে আফটার ক্লাস ডিটেনশন দিয়েছিল একবার। দ্যাট ওয়াজ ক্রেইজি। কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে মানুষ আফটার ক্লাস ডিটেনশন দেয় কখনো? এসব তো স্কুলে হয়। বাট আমি শুনেছি উনি নাকি এখন কী করে যেন অনেক টাকার মালিক হয়ে গেছেন। অনেক বড়লোক। মানে সেইরকম, ফিলদি রিচ।’
—‘কিভাবে? কলেজের প্রফেসর কী করে ফিলদি রিচ হয়?’ সকাল বলল।
নাবিলা খুব সিরিয়াস হবার ভান করে বলল, ‘বলো কী? তাহলে কি ফেসবুকের রিকুয়েস্টটা একসেপ্ট করবো? একটা চান্স নিয়ে দেখবো?’
ওর কথা শুনে সকাল আর অনিক শব্দ করে হেসে উঠল।
হাসতে হাসতেই হঠাৎ করে সকালের চোখ দুটো কেমন অন্যরকম হয়ে উঠল। চাউনি হয়ে উঠল বিহ্বল।
আরশান তখন সাদা পাঞ্জাবি পরে ভিড়ের মাঝে এসে দাঁড়িয়েছে। সকালের মনে হলো সিঁদুর রঙের বিকেলটা আকস্মিক এক অলৌকিক সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল যেন। এতো লোকের ভিড়ের মাঝে, কোলাহলের মাঝে, ওই পরিপূর্ণ পুরুষটির ওপর তার অবাধ্য চোখ জোড়া চুম্বকের মতো আটকে গেলো। সকালকে দেখতে পেয়ে আরশান একটু এগিয়ে আসলো। চেয়ার ছেড়ে উঠল সকাল। মুখোমুখি দাড়াতেই লক্ষ্য করলো আরশানের হাতে একগুচ্ছ নীল রঙা জংলী ফুল।
—‘ফুল কার জন্য?’
আরশান হাসলো। নাকউঁচু হামবড়া হাসিটা। বলল, ‘আজকের সন্ধ্যার সবচেয়ে সুন্দর মেয়েটার জন্য।’ সকাল মুখ বাঁকা করে বলল, ‘ওরে বাবা! এতো রসিক আপনি তা তো জানা ছিল না!’
—‘দিনে দিনে আরো কত কী জানবেন!’
মেকানিক হোজে ওদের পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল। সকালকে এক নজর দেখে নিয়ে আরশানের কানে কানে ফিসফিস করে কিছু একটা বলেই কেটে পড়ল জায়গাটা থেকে। সকাল বলল, ‘কী বলছে লোকটা? নিশ্চয়ই আমার নামে কিছু বলেছে সেদিনের মতো।’
শুনে আরশান সুন্দর হাসলো। সকালের দিকে প্রচ্ছন্ন চেয়ে থেকে একটু আলগা ভাবে বলল, ‘ জানেনই তো। লোকে বলে আমি আপনাকে ভালোবাসি!’ হৃৎপিন্ড থমকে গেলো একটা মুহূর্তের জন্য। সকাল অস্ফুটে বলল, ‘কী?’
সেইসময় টিলিকে দেখা গেলো দৃশ্যপটে। টিলি একটা নীল বালুচরি কাতান পরেছে। আরশান ওকে দেখে বলল, ‘এই মহিলাটা কে?’
টিলি ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, ‘এভাবে বোলো না আরশান ভাইয়া! আমি জানি শাড়িতে আমাকে খুবই বিচ্ছিরি দেখায়।’
—‘মোটেও বিচ্ছিরি দেখাচ্ছে না। ইউ আর লুকিং স্টানিং।’
টিলির পেছনে একটা ব্লন্ড মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল হাসিমুখে। টিলি ওকে দেখিয়ে আরশানকে বাংলায় বলল, ‘আমার এই ফ্রেন্ড তোমাকে দেখে পাগল হয়ে গেছে। তোমার সাথে কথা বলতে চায়। ও আসলে বাদামি চামড়া অনেক পছন্দ করে।’ এটুকু বলে মেয়েটাকে সামনে ডেকে এনে বলল, ‘হেই ক্যারোল! মিট মাই ব্রাদার।’
মেয়েটি এগিয়ে এসে আরশানের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘ক্যারোল।’
আরশান হেসে করমর্দন করলো, বলল, ‘আরশান।’
টিলি জায়গাটা ছেড়ে যেতেই সকাল আরশানকে মুখ ঝামটা মেরে বলল, ‘এই সন্ধ্যার সবচেয়ে সুন্দর মেয়েটা মনে হয় আপনি পেয়ে গেছেন। অভিনন্দন আপনাকে। দিয়ে দিন ফুলগুলো!’
বলে আর দাড়ালো না সে। নাবিলা ওকে দেখে বলল, ‘তোর আবার কী হলো?’
—‘কী আর হবে? হয়েছে আমার কপাল!’
—‘কপালের দোষ দিচ্ছিস কেন?’
—‘কপালেরই দোষ সব।’
—‘তোর বরটাকে যা লাগছে না দেখতে। বেশিক্ষণ সামনে ঘুর ঘুর করলে আমিও প্রেমে পড়ে যেতে পারি। আড়ালে থাকতে বল।’
সকাল খুব রেগে গেলো, ‘ও আমার বর টর কিছুই না। ফালতু কথা বলবি না সব সময় নাবিলা।’
—‘কী হয়েছে তোর? এরকম রাগ দেখাচ্ছিস কেন?’
সকাল আর কোনো কথা বলল না। খানিক বাদে ক্যারোল সকালদের টেবিলের দিকেই এগিয়ে আসলো। তার হাতে একগুচ্ছ নীল ফুল। সে ফুলের গুচ্ছটি সকালের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এটা তোমার ‘
সকালের মুখ থেকে মেঘের ছায়া সরল। ফুলগুলো তুলে নিতে নিতে সে একবার আরশানের দিকে তাকালো। আরশান নিজের খোঁচা খোঁচা দাড়ি ওয়ালা চিবুকটায় হাত বুলাচ্ছে আর হাসি হাসি চোখ নিয়ে সকালকে দেখছে। ফুলের গুচ্ছটির সাথে ছোট্ট একটি চিরকুট পাওয়া গেলো। সকাল সীমাহীন বিস্ময় নিয়ে চিরকুটটির ভাঁজ খুললো। তাতে ইংরেজিতে লেখা, “পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মেয়েটার জন্য।”
সকালের চোখ বাষ্পময় হয়ে উঠল। এতো সুন্দর উপহার সে এর আগে কোনোদিন পায়নি। ঘোরলাগা চোখে চাইলো সে আরশানের দিকে। চাওয়ার সাথে সাথে আরশান নিজের ডান চোখটা ব্লিঙ্ক করলো। তারপর একটু ফিচেল হাসলো।
হাসলো সকালও, মুখে বলল, ‘শয়তান একটা।’
নাবিলা ব্যঙ্গ করল, ‘তোমাদের প্রেম দেখে আমি মরে যাচ্ছি। আবার বলে ও আমার বর না! ঢং যত্তসব।
সকাল বলল, ‘কী করবো বল? কিচ্ছু বুঝি না আমি এই মানুষটার। পাগল তো!’
ফাহাদ এদিকেই আসছিল। ওর গায়ে একটা ছাইরঙা পাঞ্জাবি। অনিক বসা থেকে উঠে ফাহাদের দিকে এগিয়ে গেলো। মেয়েদের ফুসুরফাসুরের মাঝে সে বেশ একটা সুবিধা করতে পারছিল না।
সকাল ঢং করে বলল, ‘তোমার উনার পাঞ্জাবির রংটা কিন্তু সুন্দর। তাকে দেখাচ্ছেও জোশ। তুমিও কিন্তু সামলে রেখো। সে আবার আমার দেবর হয় কিনা! বোঝো তো, দ্বে-বর। অর্থাৎ দ্বিতীয় বর! অতএব আমার এমনিতেই একটা অধিকার আছে আর কি!
নাবিলা ঝেঁঝে উঠল, ‘মজা নিচ্ছো, না? আমার সাথে ওর কিছুই হয় নাই। সম্ভাবনাও নাই।’
সেই সময় সকালের ফুরফুরে মেজাজটা আরো একবার বিনা বাক্যব্যয়ে উড়াল দিলো। এন্ড্রিয়ানা এসেছে। তার গায়ে একটা স্লিভলেস লাল গাউন। হাতে উপহারের বাক্স।
নাবিলা সকালের বদলে যাওয়া চেহারা দেখে হড়বড় করে বলে উঠল, ‘ওকে নিশ্চয়ই টিলি দাওয়াত করেছে। আমি শিওর আরশান একে ইনভাইট করেনি। তুই শুধু শুধু রাগ করিস না।’
ফাহাদের সাথে কথা শেষ করে অনিক আবার ফিরে এসেছে ততক্ষণে।