৩০
—‘ঘটনা কোন দিকে যাচ্ছে তুমি কি বুঝতে পারছো?’
রহমান সাহেবের চোখের সামনে পত্রিকা ধরা ছিল। তিনি পত্রিকা সরিয়ে নিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। ফাহাদের মায়ের নাক মুখ লাল। চোখ বিস্ফারিত। রহমান সাহেব ঠান্ডা গলায় বললেন,
—‘কোন ঘটনার কথা বলছ?’
—‘তোমার ছেলে …তোমার ছেলে কি আমার ছেলের বউয়ের সাথে প্রেম করছে? এটাই দেখার বাকি ছিল?’
—‘মেয়েটা এখনো তোমার ছেলের বউ হয়নি। ভেবে চিন্তে কথা বলবে।’
—‘হয়নি তো কী হয়েছে? হবে। আরশান কি জানে যে সকালের সাথে ফাহাদের বিয়ের কথা চলছে?’
—‘জানে না বোধ হয়।’
ফাহাদের মা তৎক্ষনাৎ ঘরের দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে উত্তেজিত ভাবে বললেন, ‘এখনই বলছি আমি।’
রহমান সাহেব কড়া স্বরে বলে উঠলেন, ‘ফাহাদের মা থামো!’
—‘কেন? কেন থামবো?’
—‘তোমার কি মনে হয় না কিছু বলার মতো থাকলে সকাল নিজেই বলবে? সে তো কচি খুকি না।’
—‘সকাল বলেছে নাকি বলেনি তা আমি জানি না। জানতে চাই না। আমি নিজেই বলবো। তোমার ছেলে আমার ছেলের সর্বস্ব কেঁড়ে নেবে আর আমি চুপচাপ বসে থাকবো তা হয় না।’
—‘সর্বস্ব কেঁড়ে নেয়ার ব্যাপারটা কী?’
ফাহাদের মা ফুঁসতে ফুঁসতে বললেন, ‘তোমার দেশের বাড়ির সম্পত্তির এক কণাও তো আমার ছেলে পেলো না। তোমার বাবা সমস্ত কিছু আরশানের নাম লিখে দিয়ে গেছে। এখন দেশ থেকে আমি নিজে পছন্দ করে ছেলের বউ খুঁজে বের করেছি। সেই বউয়ের ওপরও তোমার ছেলে নজর দিলো। সাহস তো কম না!’
—‘সম্পত্তি আরশানের নামে কেন লিখে দিয়েছেন বাবা তা তুমি জানো।’
—‘বেশ এখন আমি চললাম।’
—‘তুমি যদি আরশানকে কিছু বলেছো তাহলে জেনে রাখো তোমার সাথে আমার সম্পর্ক এখানেই শেষ।’
ফাহাদের মা থমকে গেলেন।
—‘কী বোঝাতে চাইছ তুমি?’
—‘আরশানকে কিছু বলার দরকার নেই।’
—‘কেন?’
—‘কারণ ও অনেক বেশি ইমোশনাল। ফাহাদ স্মার্ট ছেলে। সামলে নিবে নিজেকে।’
—‘বাহ্ চমৎকার! ফাহাদ কি তোমার ছেলে নয়? কেন ওর প্রতি তোমার এই নিষ্ঠুর মনোভাব?’
—‘আমার ছেলে বলেই আমি দুজনকে খুব ভালো মতো চিনি। আরশান ছোটবেলা থেকে বুকের মধ্যে একটা কষ্ট নিয়ে বড় হয়েছে। ও কিন্তু ঠিক স্বাভাবিক না। ফাইনালি সে যদি কোনো মেয়েকে পছন্দ করতে পারে তাহলে আমাদের উচিত হবে না সেখানে বাধ সাধা। বুঝতে পারছো? এরপরেও যদি তুমি ওকে কিছু বলেছো তো জেনে রাখো এখানেই তোমার সাথে আমার সম্পর্কের ইতি টানা হয়ে যাবে।’
ফাহাদের মা আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে রইলেন স্বামীর দিকে। খানিক বাদে বললেন, ‘কিন্তু সকাল কেন কিছু বলেনি?’
—‘হয়তো বলেছে। হয়তো বলেনি। এটা নিয়ে তুমি এতো ভাবছো কেন? মেয়েটা এ বাড়ির বউ হলেই তো হলো। বড় বউ নাকি ছোট বউ তা দিয়ে তো আমার কিছু এসে যায় না। শুধু বলি বাচ্চাদের ব্যাপারে ইন্টারফেয়ার করো না। ওরা বড় হয়েছে। ওদেরকে ওদের মতো থাকতে দাও।’
৩১
সেদিন অক্টোবর। আকাশ অলৌকিক নীল। কাঁচপোকা ওড়া সোনাবরণ রোদ্দুরে ছেয়ে আছে চারপাশ। জঙ্গল থেকে হুহু করে হাওয়ারা ছুটে আসছে বুক ভর্তি শুকনো পাতার দল নিয়ে। বৃষ্টির মতো ঝরছে পাতা, উড়ছে বাতাসে অবিরাম, খস খস শব্দ তুলে।
সকাল যখন সাদা জমিন আর রূপালি পাড়ের সিল্ক শাড়ি পরে প্যাটিওতে এসে দাড়ালো, অক্টোবরের মন কেমন করা সোনালি দুপুরটা তখন আচমকা এক অপার্থিব, স্বর্গীয় ক্ষণে রূপান্তরিত হলো।
আরশান সেইদিকে অনেকটা ক্ষণ আবিষ্টভাবে চেয়ে রইল। তার মনে হলো এত সুন্দর দৃশ্য সে এর আগে কখনো দেখেনি। সে আচ্ছন্ন গলায় স্বগতোক্তি করলো, বলো পৃথিবী! কার অক্টোবর বেশি সুন্দর? তোমার নাকি আমার?
পৃথিবীর উত্তর আরশানের কাছে পৌঁছে দেবার নিমিত্তেই বুঝি দৈবাৎ একগুচ্ছ হঠাৎ হাওয়া ছুটে এসে সকালের খোলা চুল আর শাড়ির আঁচল এলোমেলো করে দিয়ে গেলো। আরশান বুঝলো, জানলো যে তার অক্টোবরই বেশি সুন্দর। পৃথিবীও মেনে নিয়েছে এ সত্যটা। তার ঠোঁটের কোণে একটি তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল ধীরে ধীরে।
এলোমেলো চুল আর শাড়ির আঁচল সামলাতে গিয়ে সকাল হিমশিম খেয়ে গেলো। এজন্যেই শাড়ি পরতে তার বিরক্ত লাগে। শাড়ি সামলানোর চাইতে হরিণডাঙ্গার রাজত্ব সামলানোও ঢের সহজ কাজ।
আরশান গাড়ির দরজা খুলে দিলো, সকালের জন্য। সকাল উঠল। উঠে বসলো আরশানও, ড্রাইভিং সিটে।
কেউ কোনো কথা বলছিল না। কেমন অস্বস্তিতে কাদা হয়ে আছে ওরা। চোখে চোখে তাকাতেও সংকোচ হচ্ছে।
সকাল খুব একটা সাজেনি। চোখে হালকা কাজল, আর লাল টিপ দিয়েছে কপালে। বেশি সাজগোজ করতে লজ্জা লাগছিল ওর। চাচির কড়া নজর ছিল কাল রাত থেকেই তার ওপরে। সেই নজর উপেক্ষা করে, লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে যথা সময়ে তৈরি হয়ে নিয়েছে সে। আরশান ডেকেছে বলে কথা। বাদ বাকি সব গোল্লায় যাক।
সকাল আড়চোখে দেখলো একবার আরশানকে। হালকা আকাশি রঙের একটা টি শার্ট পরেছে। চোখে সানগ্লাস। গালে দু তিনদিনের খোঁচা দাড়ি। শেভ করেনি তবুও সুন্দর লাগছে। ওই মুখটার দিকে তাকালে সে সম্মোহিত হয়ে যায়, পাগল হয়ে যায়। জগৎ সংসার এলোমেলো লাগতে শুরু করে।
—‘কী খাবেন?’ আরশানই কথা বলল প্রথম। চোখ সামনের রাস্তার দিকে রেখে।
সকাল একটু সংকুচিত ভাবে বলল, ‘উম ….জানি না আপনার ইচ্ছা।’
—‘আপনার ইচ্ছার কথা জানতে চাইছি।’
—‘আমার কোনো ইচ্ছে নেই। আর আমি তো এখানে নতুন। কোনো আইডিয়া নাই।’
—‘আপনাকে অপশন দিচ্ছি।’
—‘শিওর।’
‘চাইনিজ/ ইটালিয়ান/ মেডিটেরেনিয়ান/ ম্যাক্সিকান/ ইথিওপিয়ান/ ভিয়েতনামি …’
—‘থামেন থামেন কনফিউজড হয়ে যাচ্ছি। আমাদের দেশের চাইনিজ ফুড আমি খুব পছন্দ করি। বাট রিয়েল চাইনিজ আসলে কখনো ট্রাই করিনি। সো চাইনিজ খাওয়া যায়। নইলে ইটালিয়ান।’
—‘আপনি সি ফুড পছন্দ করেন?’
—‘ভীষণ!’
—‘ঠিক আছে। তাহলে সি ফুডই হোক।’
বাকি পথটা কেউ আর কোনো কথা বলল না। কথা খুঁজে পাচ্ছিল না। ভালোলাগা, সংকোচ, অস্বস্তি সবকিছু মিলিয়ে একটা অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতি হচ্ছিল। রেড লবস্টারের সামনে গাড়ি থামলো।
রেস্টুরেন্টে ঢোকার পর সুন্দরী সোনালি চুলো ওয়েট্রেস দুজনের জন্য একটা খালি টেবিল দেখিয়ে দিলো। বসলো ওরা। বসেও কেউ কোনো কথা বলল না। মনোযোগ দিয়ে মেনু দেখতে লাগলো। আরশান অর্ডার করলো ফ্রাইড ওয়েস্টারস, শ্রিম্প এন্ড উডগ্রীলড চিকেন। সকাল একটা গার্লিক শ্রিম্প স্ক্যাম্পি অর্ডার করলো।
অর্ডার করা হয়ে গেলে আরশান তাকালো সকালের দিকে। সকাল চোখ সরিয়ে নিলো। আবার তাকালো। ভারি অস্বস্তি লাগছে তার।
আরশান নড়ে চড়ে বসে পকেট থেকে সেলফোন বের করে টেবিলের ওপর রাখলো। হাত ঘড়ি দেখলো। সাড়ে বারোটা বাজে। কিছু একটা বলা উচিত। কিন্তু কী বলবে, কিভাবে শুরু করবে তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না। এতো আন্সমার্ট সে ছিল না কোনো দিন। কথা মনে আসার আগে মুখে আসে তার। আজকে কী হলো আল্লাহ জানে। বোবায় ধরেছে বলে মনে হচ্ছে। গলা দিয়ে স্বর বেরোচ্ছে না।
—‘কী খবর আপনার?’
অনেক কষ্টে প্রশ্নটা করতে পারলো আরশান। সকালের সত্যি নার্ভাস লাগছে। এতো নার্ভাস লাগবে জানলে সে জীবনেও আসতো না। এখন মনে হচ্ছে আসাটা ভুল হয়েছে। নার্ভাসনেসের ঠ্যালায় উল্টাপাল্টা কিছু না করে বসে। আল্লাহ বাঁচাও!
—‘এইতো চলছে।’ বলল সকাল।
তারপর কী? এবার কী হবে? মনে মনে প্রশ্ন করলো আরশান নিজেকে। উত্তর পেলো না।
সেই মুহূর্তে অপরিচিত একটি গলার স্বর ওদেরকে হালকা চমকে দিলো। সকাল চোখ তুলে দেখলো একটি সাদা চামড়ার পাতলা গড়নের যুবক আরশানের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। আরশান উঠে দাঁড়িয়ে হাত মেলালো। যুবকটি বলল, ‘কী ম্যান? ছুটি কেমন কাটাচ্ছ?’
—‘ভালো।’ আরশান বলল।
—‘হুম ভালো যে যাচ্ছে তা তো দেখতেই পাচ্ছি।’ এটুকু বলে আড়চোখে সকালকে একবার দেখে নিয়ে ফচকে গলায় বলল, ‘কী তোমার গার্লফ্রেন্ডের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে না?’
আরশান বিব্রত হয়ে পড়ল। অপ্রস্তুত ভাবে একবার তাকালো সকালের দিকে। সকাল চোখ নামিয়ে নিলো নিচে। থতমত খাওয়া আরশানের মুখ দিয়ে টানা দুই তিন সেকেন্ড কোনো কথা বের হলো না। একটা সময় সে বলল, ‘হ্যাঁ নিশ্চয়ই। …সকাল! ও হচ্ছে রবার্ট আমার কলিগ। আর রবার্ট, ও সকাল।’
রবার্ট ‘হ্যালো সকাল’ বলে হাত বাড়িয়ে দিলো। সে সকাল নামটা উচ্চারণ করলো ভারি অদ্ভুত ভাবে। বলতে চাইলো সকাল কিন্তু শুনতে লাগলো ‘শোয়াখ্যাল। নিজের নামের এ ই দুরবস্থা দেখে সকাল হেসে ফেললো। রবার্ট হ্যান্ডশেক করতে করতে বলল, ‘তোমার কথা আমি শুনেছি এন্ড্রিয়ানার কাছে। ওর বর্ণনার চাইতেও তুমি আরো অনেক বেশি সুন্দর। আমি জানতাম না বাংলাদেশের মেয়েরা এতো সুন্দর হয়। আমি বাকরুদ্ধ।’
সকাল হেসে বলল, ‘নাইস টু মিট ইউ, রবার্ট।’
রবার্ট বলল, ‘লাইক ওয়াইজ। ঠিক আছে। তোমাদের আর ডিস্টার্ব করবো না। এনজয় দ্যা ডেট।’
ডেট শব্দটা কানে লাগলো। সকাল দেখলো আরশান লাল হয়ে গেছে। সকালেরও লজ্জা করছিল। তবুও রবার্ট চলে যাওয়ার পর লজ্জার ঢোক গিলে ফেলে সে বলল, ‘গার্লফ্রেন্ড, ডেট, এসবের মানে কী? কী বলে গেলো আপনার বন্ধু?’
প্রশ্নটা শুনে আরশান একটু অপ্রস্তুত হলো প্রথমে। এরপর তার নিজস্ব কায়দায় মুখ বাঁকা করে কী যেন চিন্তা করলো, বলল,
—‘বাদ দিন। লোকে কত কিছু বলে। লোকের কথায় অত কান দিতে হয় না।’
—‘তাই?’
—‘উম হুম!’
—‘আপনি ভুলটা ভেঙে দিলেই তো পারতেন।’
একটা স্তব্ধ অভিমান চেপে বসলো আরশানের বুকে। সকালের কি তাহলে ওর গার্লফ্রেন্ড হতে আপত্তি আছে?
আরশান একটু উত্তেজিত ভাবে বলল, ‘ও এখনো জায়গাটা ছাড়েনি। ডেকে ভুলটা ভাঙিয়ে দিবো? বলবো যে আপনি আমার কেউ নন?’
—‘কেউ নই?’ নিজের অজান্তে প্রশ্নটা বেরিয়ে আসলো সকালের মুখ থেকে।
আরশান স্থির চোখে তাকালো সকালের দিকে। ক্ষীণ গলায় বলল, ‘কে হন আপনি আমার?’
সকাল মুখ ঘুরিয়ে নিলো অন্যদিকে, বলল, ‘আপনিই তো বললেন কেউ নই
ঠিক সেই সময় রবার্ট আবারও জায়গাটা অতিক্রম করছিল। হাতে খাবারের প্যাকেট নিয়ে। আরশান ডাকলো ওকে পেছন থেকে।
এগিয়ে আসলো রবার্ট। আরশান বলল, ‘তুমি ভুল বুঝেছ। উই আর নট ইন আ রিলেশনশিপ। এন্ড ইটস নট আ ডেট। জাস্ট আ র্যান্ডম হ্যাং আউট। বুঝতে পেরেছ?’ রবার্ট হতভম্ব হয়ে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকলো আরশানের দিকে। আরশান তার অনেকদিনের পরিচিত কলিগ। প্রায় বছর তিনেক হয়ে গেলো ওরা একসাথে কাজ করছে। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে এই আরশানকে সে চেনে না। বলল, ‘এক্সট্রিমলি সরি…। মাই ব্যাড!’
আরশান বলল, ‘উইল টক টু ইউ লেটার।’ ।
সকাল লজ্জায় একদম মাটির সাথে মিশে যাচ্ছিল। কী দরকার ছিল নাটকটা করার? ভুল ভাঙাতে চাইলে প্রথম দফায়ই ভাঙ্গানো উচিত ছিল। এভাবে বেচারাকে ডেকে এনে ব্রিত করাটা কি ঠিক হলো? আরশানটা না একদম পাগল। কী করবে সকাল এই পাগলটাকে নিয়ে?
রবার্ট জায়গাটা ছাড়ার পর আরশান আর কোনো কথা বলল না। মনোযোগের সাথে স্ট্র দিয়ে পানির গ্লাস থেকে পানি খেতে লাগলো। তার চোখে মুখে একটা চাপা উদ্বেগ খেলছে।
সকাল বলল, ‘কী দরকার ছিল এভাবে ডেকে এনে লোকটাকে ব্ৰিত করার?’
—‘সেটা নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না। আমার বন্ধু আমি বুঝবো।’
খাবার আসলো। সকালের এখন আর কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না। হঠাৎ করে পরিবেশটা কেমন ভারি ভারি লাগতে শুরু করেছে। আরশানের থমথমে মুখটা দেখে তার কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে। সে কি বড়সড় কোনো দোষ করে ফেলেছে?
খেতে ইচ্ছা না করলেও খেতে হবে। নইলে আরশানের আরো রেগে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। খাবার কাছে টেনে নিতে নিতে সকাল সাবধানে প্রশ্ন করলো, ‘আপনি কি রাগ করলেন?’
আরশান গম গম করে বলে উঠল, ‘রাগ করবো কেন? আমি কি আপনাকে আমার গার্লফ্রেন্ড বানানোর জন্য মরে যাচ্ছি নাকি?’
সকাল হেসে ফেললো, ‘রাগের বাহার দেখে তো তাই মনে হচ্ছে।’
আরশান ক্রুর চোখে তাকালো সকালের দিকে, ‘ফাজলামো করছেন?’
—‘একটু একটু করছি।’ হাসি সামলে বলল সকাল। রাগান্বিত মানুষটাকে এতো কিউট লাগছে কেন জানে না সে। ইচ্ছে হচ্ছে গাল টেনে একটু আদর করে দিতে।
আরশান দীর্ঘ একটা নিশ্বাস নিয়ে রাগটা চাপালো। এরপর কাষ্ঠ হাসি হেসে বলল, ‘শুনুন, আমার কোনোদিন কোনো গার্লফ্রেন্ড ছিল না। হবেও না কখনো।’
—‘কখনো হবে না?’
—‘মনে হচ্ছে না।’
শুনে সকাল ঠোঁট টিপে হাসলো, ‘এতো ইগো থাকলে হবে কী করে?’
আরশান ভ্রু উঁচিয়ে তাকালো, ‘এটার মানে কী?’
—‘কিছু না।’
—‘আপনার কথা বলুন। আপনার কোনো প্রেমিক নেই?’
—‘প্রেমিক? প্রেমিক তো অনেক আছে!’
—‘ওরে বাবা! কয়টা বয়ফ্রেন্ড আপনার?’ কাঠ কাঠ গলায় প্রশ্ন করলো আরশান।
—‘বয়ফ্রেন্ড আর প্রেমিক কি এক হলো?’
—‘আলাদা নাকি?’
—‘প্রেমিক মানে আমার প্রেমে পড়েছে এমন। আর বয়ফ্রেন্ড মানে যার সাথে আমার রিলেশন আছে এমন একজনকে বোঝায়। তাই না?’
—‘তাই নাকি? আমি তো জানি না। আমার আবার এসব বিষয়ে আপনার মতো অত জ্ঞান নেই।’
—‘হুম ….বয়ফ্রেন্ড একটাও নেই। কপাল খারাপ, জুটলো না!’
আরশানের বুক থেকে অজান্তেই একটা স্বস্তির নিশ্বাস বেরিয়ে গেল। মুখে নির্বিকার ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে সে বলল, ‘বলেন কী? এতো এতো প্রেমিকের ভিড়ে একটামাত্র বয়ফ্রেন্ডও খুঁজে পাওয়া গেলো না?’
—‘গেলো না তো!’
—‘কেন?’
সকাল এ প্রশ্নের উত্তরে মুখ তুলল। আরশানের চোখে চেয়ে ক্ষীণ গলায় বলল, ‘মনের মতো কাউকে পাইনি বলে।’
আরশান ফ্রাইড ওয়েস্টার চিবোতে চিবোতে বলল, ‘আপনার বয়স কত? এতো দিনেও মনের মতো কাউকে পাননি। আর পাবেন বলে তো মনে হয় না।’
—‘আমার বয়স পঁচিশ। অত বুড়োও হয়ে যাইনি যে মনের মানুষ পাবার স্বপ্ন টুকুও দেখতে পারবো না।’
—‘ফেয়ার এনাফ।
—‘আপনার কী সমস্যা? আপনি এখনো সিঙ্গেল কেন?’
—‘সিগন্যাল পাইনি বলে।
—‘সিগন্যাল?’
—‘হ্যাঁ সিগন্যাল। মনের ভেতর থেকে একটা সিগন্যালের অপেক্ষায় আছি। আর আসলে আমি এসব নিয়ে ভাবি না। একা থাকতে আমার ভালো লাগে। পিছুটান জিনিসটাকে আমি ব্যক্তিগত ভাবে একটু ভয় পাই।’
—‘ভয়?’
—‘হ্যাঁ ভয়। আমার মনে হয় মানুষ সম্পর্ক গড়ে সম্পর্ক ভাঙার জন্যে।’
—‘খুব অদ্ভুত আপনার চিন্তা ভাবনা।’
—‘ঠিক বলেছেন। আমি মানুষটা বেশ অদ্ভুত আছি।’
—‘এমন অদ্ভুত কেন আপনি?’
—‘জানি না। আমার মা নেই তো! এটা একটা কারণ হতে পারে।’
—‘অনেকেরই মা থাকে না।’
আরশান সকালের দিকে তাকালো। মুখ বাঁকিয়ে, ভ্রু কুঁচকে কিছু একটা চিন্তা করলো খানিকক্ষণ। তারপর খুব ধীরে ধীরে একটু ভারি গলায় বলল,
—‘আমার মা আমাকে ফেলে রেখে চলে গিয়েছিল। তখন আমি খুব ছোট।’ জীবনে এই প্রথমবারের মতো আরশান নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় অপ্রিয় সত্যটি কোনো দ্বিতীয় ব্যক্তিকে মুখ ফুটে বলল। কেন বলল তা জানে না সে। শুধু মনে হচ্ছিল বলাটা দরকার। আর বলার পর আশ্চর্যজনক ভাবে আবিষ্কার করলো, তার ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে বুক থেকে একটা পাথর নেমে গেছে।
সকাল একটু অপ্রস্তুত হলো। সে জানে না এ ধরনের একটা কথার পর ঠিক কী বলা যায়। খাওয়া থামিয়ে কিছুক্ষণ সে নরম চোখে তাকিয়ে রইল আরশানের দিকে।
—‘তারপর ….তারপর কী হলো?’
আরশান ছুরি কাটাচামচ দিয়ে প্লেটের চিকেনটাকে টুকরো টুকরো করতে করতে বলল, ‘বাবা যখন মাদারকে বিয়ে করলেন আমার বয়স তখন দেড় কি দুই। সেই বয়স থেকে আমি তাকেই মা বলে জেনে এসেছি, কিন্তু একটু বড় হবার পর বুঝতে পারলাম উনি আসলে আমার মা নন, উনি শুধুমাত্র ফাহাদের মা। ফাহাদকে নিয়ে মাদার এতো বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন যে আমার টেক কেয়ার করার মতো কোনো সময় তাঁর হাতে ছিল না। আর বাবার তখন ফুল টাইম জব। সো আমাকে নিয়ে খুব সাধারণভাবেই বাবা একটু ইনসিকিওর্ড ফিল করছিলেন। যার কারণে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে আমাকে দেশে পাঠিয়ে দেয়া হবে। দাদুর বাড়িতে।’
—‘আপনার দাদুর বাড়ি কোথায়?’
—‘মানিকগঞ্জ।’
—‘আচ্ছা। তারপর?’
—‘তারপর আর কী? টানা ছয় বছর আমি দাদা দাদুর সাথে কাটালাম। আমাদের গ্রামের বাড়িতে। ওখানেই আমার লেখাপড়ার হাতেখড়ি। আমার দাদুর কাছে। জানেন আমাদের গ্রামটা না স্বপ্নের মতো সুন্দর ছিল! পৃথিবীর কত দেশই তো দেখলাম। বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি আমাদের গ্রামের মতো সুন্দর জায়গা পুরো পৃথিবীতে আর একটিও নেই। আমাদের পুকুরেই আমার প্রথম সাঁতার শেখা। সেটাও দাদুর কাছে।’
বলতে বলতে আরশানের চোখ জোড়া কেমন স্বপ্নাচ্ছন্ন হয়ে যায়। তার গলার স্বর অন্যরকম শোনায়। খাওয়া থামিয়ে জানালার বাইরে চোখ রেখে সে বলতে থাকলো, ‘আর আমার দিদার রান্নার হাত ছিল অসাধারণ! শুধু লবণ দিয়ে আলুর ভর্তা মেখে দিলেও খেতে অমৃত বলে মনে হতো। ওই দুজন বৃদ্ধ বৃদ্ধা আমার জীবনের অনেকটা জুড়ে ছিল। আমি ভালো ছিলাম। বিচিত্র সুন্দর একটা শৈশব ছিল আমার। বাবা মায়ের অভাব কখনো বোধ করিনি। কিন্তু আমার ওই সুখটা বেশিদিন টিকলো না। বাবার মনে হলো যে গ্রামে থেকে আমি প্রপার এডুকেশন পাচ্ছি না। অতএব আমাকে নিয়ে আসা হলো এখানে। তখন আমার বয়স বারো। আমি একদমই আসতে চাইছিলাম না দাদা দিদাকে ছেড়ে। ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলাম! প্রায় দু বছর সময় লেগেছিল এই হোমসিকনেস পুরোপুরি ভাবে কাটিয়ে তুলতে।’
অনেকগুলো কথা বলা শেষ করে আরশান তাকালো সকালের দিকে। সকাল গালে হাত দিয়ে ব্যথাতুর নয়নে দেখছিল ওকে। একটু কেমন মুগ্ধতাও লেগে ছিল ওর চাউনিতে। আরশান একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘সরি, অনেক আবোল তাবোল বকে ফেললাম।’
—‘আরশান!’
এবার সকাল কেমন অদ্ভুত ভাবে ডাকলো। এমন গভীরতার সাথে বুকের ভেতর থেকে বুঝি কেউ কোনোদিন ডাকেনি আরশানকে এর আগে। ডাকটা একদম মনের ভেতর গিয়ে লাগলো। আরশান নিবিড় চোখে তাকালো সকালের দিকে, ‘জি বলুন।’
সকাল ফিক করে হাসলো। টোল পড়ল ওর দু গালে। বলল, ‘আপনি খুব সুন্দর করে কথা বলেন।’
আরশান একটু লাল হলো। হাসিটা ফিরিয়ে দিয়ে বলল, ‘আর আপনি খুব সুন্দর করে হাসেন।’
সকাল লজ্জা পেয়ে গেলো। চোখ নামিয়ে বলল, ‘নাহ!’
—‘কী নাহ?’ আরশান হাসে। লজ্জায় লাল টুকটুকে হয়ে যাওয়া সকালের মুখখানা দেখতে কী ভালো লাগছে!
—‘কিছু না।’
—‘কেন আপনাকে কেউ বলেনি এর আগে?’
—‘কী বলেনি?’
—‘এই যে আপনার হাসি সুন্দর?’
—‘বলেছে তো।’
—‘তাহলে এতো লজ্জা পাচ্ছেন কেন?’ আরশানের ঠোঁটে এখন ওর সেই হামবড়া নাকউঁচু হাসিটা। এই হাসিটাকেও সকাল এখন ভালোবাসে। আগের মতো গায়ে জ্বালা ধরায় না এই হাসি। বরং ভালো লাগায়।
—‘জানি না কেন লজ্জা পাচ্ছি।’ এটুকু বলে একটু থেমে প্ৰসঙ্গ পাল্টানোর উদ্দেশ্যে বলল, ‘গতকাল আপনি কোথায় ছিলেন? বাড়িতে তো ছিলেন না মনে হয়।’
—‘এন্ড্রিয়ানার বাসায় গিয়েছিলাম।’
সকালের মুখে একটা মেদুর ছায়া পড়ল।
—‘রাতে কোথায় ছিলেন?’
—‘বললাম তো, এন্ড্রির বাসায়।’
সকাল পুরোপুরি নিভে গেলো। ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘আপনি ওর বাসায়, ওর সাথে একত্রে রাত কাটিয়েছেন?’
আরশান সকালের ঝাঁঝালো প্রশ্ন শুনে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো, ‘ওয়েল, টেকনিক্যালি ইয়েস। বাট আই স্পেন্ট দ্যা হোল নাইট অন আ কাউচ।’
সকাল একটা হতাশ নিশ্বাস ফেলে খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। তার যেন আর কোনো কথা নেই। সব কথা ফুরিয়ে গেছে।
আরশান আস্তে করে বলল, ‘আপনি কি রাগ করলেন?’
—‘রাগ করবো কেন? আপনার যেখানে খুশি যাবেন, রাত কাটাবেন। আমার কী?’
—‘এন্ট্রি আমার খুব ভালো বন্ধু।’
—‘আমি জানি। খুব ভালো বন্ধু আপনারা। একদম চুমু খাওয়ার মতো ভালো বন্ধু।’
আরশান বিরক্ত গলায় বলল, ‘দ্যাট ওয়াজ এন অ্যাক্সিডেন্ট।
সকাল পানির গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে বলল, ‘ঝুঁকিপূর্ণ, বিপদজনক জায়গায় থাকলে অ্যাক্সিডেন্ট তো হবেই। যাই হোক, এন্ড্রিয়ানা আমার কথা কী বলেছে রবার্টকে?’
প্রশ্নটা শুনে আরশান একটু থমকে গেলো। কয়েকটা মুহূর্ত কাটলো নীরবে।
একটা সময় আরশান জানালার বাইরে চোখ রাখলো। তারপর কেমন আচ্ছন্ন গলায় বলল,
—‘শী থিঙ্কস দ্যাট আই এম ইন লাভ উইদ ইউ!’
চমকে ওঠা সকালের মুখ থেকে জল ছিটকে বেরিয়ে আসলো। কিছুটা পড়ল টেবিলের ওপর। কিছুটা নিজের শাড়িতে।
আরশান বিব্রত ভাবে বলল, ‘সরি, আমার মনে হয় কথাটা বলা উচিত হয়নি।’
সকাল ব্যস্ত হয়ে ন্যাপকিন দিয়ে ছিটকে পড়া জলটুকু মুছে নিয়ে বলল, ‘না না ঠিক আছে। ছিঃ কী কাণ্ড করে বসলাম। আমি আসলে একটা টোটাল মেস।’
একটু ধাতস্থ হবার পর সকাল ধীরে ধীরে প্রশ্ন করলো,
—‘কিন্তু এন্ড্রিয়ানা এমনটা কেন ভাববে?
আরশান অপরাধীর গলায় বলল, ‘আমি জানি না। সত্যি জানি না!’
—‘জানেন না?’
—‘না…. মানে আমি আমাকে ঠিক মতো বুঝে উঠতে পারছি না। ইটস কমপ্লিকেটেড। আমি বোঝাতে পারবো না।’
—‘বেশ!’
—‘আর আসলে হুট্ করে কাউকে ভালোবেসে ফেলার মতো মানুষ আমি না। এন্ড্রির ধারণাটা আমার সাথে একেবারেই যায় না।’
—‘ও! তাই বলুন। যাই হোক, এটা আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাইছি না।’ চিংড়ি মাছ চিবোতে চিবোতে গম্ভীর গলায় বলল সকাল।
এরপর কথাবার্তা খুব একটা বেশি এগোলো না। বাইরে বেরোনোর পর ভর দুপুরের সোনারঙা রোদে সকালকে একবার পুলক ভরে দেখে নিয়ে আরশান বলল, ‘আপনাকে শাড়িতে ভালো লাগছে।’
প্রশংসাটা শুনে সকাল খুব একটা উচ্ছ্বাস দেখালো না। একটু কেমন বিষণ্ণ গলায় বলল, ‘ধন্যবাদ।’
হ্যাঁ, এই মুহূর্তে তার মনের ভেতরটা কেমন বিষণ্ন হয়ে আছে। একটা হতাশার চাপ অনুভব করছে বুকের ওপর।
একজন প্রাপ্তবয়স্ক, বিচক্ষণ, শিক্ষিত মানুষ কেন নিজের মনের ভাব ধরতে পারবে না? মানুষটা কি একটু বেশি মাত্রায় খেয়ালি আর পাগলাটে? এন্ড্রিয়ানার প্রতিও কি সে ঠিক এই একই রকম মনোভাবই পোষণ করে? সকাল কি তবে ভুল মানুষকে ভালোবেসে ফেললো? ভাবতে ভাবতে সকালের চোখে একটা সূক্ষ্ম দুশ্চিন্তার ছায়া ফুটে উঠছিল।
আরশান বলল ‘কী হয়েছে আপনার? কী ভাবছেন?’
—‘কিছু না।’
—‘এতো ভাববার কিছু নেই। নিজের মন যা বলে তা ই করুন।’
—‘আমি সবসময় আমার মনের কথাই শুনি। আমার মন আপনার মনের মতো অতটা জটিল নয়।’
ওরা হাঁটছিল। কথাটা শুনে আরশান দাঁড়িয়ে পড়ল। চোখা ভাবে তাকালো সকালের দিকে। সন্দিহান হয়ে বলল, ‘আপনার মন কী বলে?’
সকালও দাঁড়িয়ে পড়ল। একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘আপাতত মন বলছে এবার ফিরে যাওয়া উচিত। অনেক দিন তো হলো। বাবা মা কে মিস করছি।’
কথাটা শোনা মাত্র আরশানের চোখে একটা কৃষ্ণাভ ছায়া পড়ল। সে নিষ্প্রভ গলায় বলল, ‘এখনই চলে যাবেন? এতো তাড়াতাড়ি?’
—‘আসলে বাবা মা কে ছেড়ে এতদিন কোথাও থাকিনি। আর ভালো লাগছে না।’
আরশান চুপ হয়ে গেলো। এতো চুপ হয়ে গেলো যে ফিরতে ফিরতে আর একটি কথাও বলল না। কথা বলল না সকালও।
জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে রইল। বাইরে এক স্বপ্নীল দুপুরবেলা। নীল আকাশের নিচে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা বৃক্ষরাজির গায়ে গায়ে এখন কত যে রং! কোথাও সবুজ, কোথাও হলুদ, কোথাও আবার লাল অথবা খয়েরী। এই রঙের খেলা দেখতে দেখতে চোখে নেশা লেগে যায়। হুহু করা হাওয়া বিলি কাটছে রংবাহারী বন-বনানী ভেতর। রোদ ধোয়া, স্বচ্ছ ঝকঝকে সাপের মতো রাস্তা উঁচু নিচু হয়ে বয়ে চলেছে দূর, বহুদূরে। এ রাস্তার যেন শেষ নেই। শেষ না হোক। সকাল এখন এই দুপুরের প্রেমে পড়েছে। এমন মোহময়, মন কেমন করা দুপুরবেলাটা তাকে সারা সারাটা জীবন ধরে জাপ্টে থাকুক এভাবেই।
বুকের ভেতরটা এক অসহনীয় যন্ত্রণায় অবশ হয়ে আছে। এইযে পাশে মানুষটা বসে আছে, এই মানুষটাকে যে সে ভালোবাসে সে বিষয়ে তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। মানুষটা কাছে থাকলে সে আতরের খুশবু পায়। সে জানে এই খুশবু আর কিছুই নয়। এ তার ভালোবাসা। তার জানা ছিল না কোনো পুরুষকে সে কখনো এতটা ভালোবাসতে পারবে। এই সুদূর মার্কিন মুলুকে বেড়াতে এসে যে গভীর ক্ষতি তার হয়ে গেলো, পুরো জীবন দিয়েও তা সে এই ক্ষতি কখনো পূরণ করতে পারবে না আর। যা সে হারালো, হারিয়েই গেছে সারাটা জীবনের জন্যে। দেশে ফিরে যাবে। ঠিক ঠিক ফিরে যাবে। কিন্তু যেভাবে এসেছিল, সেভাবে নয়। অন্য এক সকাল হয়ে।
বাড়ি ফেরার পর গ্যারেজে গাড়ি পার্ক করে নিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করে আরশান বলল, ‘আপনি ঠিক কবে নাগাদ ফিরে যাবার প্ল্যান করছেন?
—‘বাবা বলেছেন নেক্সট উইকে টিকেট বুক করার চেষ্টা করবেন।’
আরশান বিমর্ষ গলায় বলল, ‘আমি আগামী কাল ভ্যাকেশনে যাচ্ছি। দশ দিনের জন্য। তাহলে কি আপনার সাথে আর দেখা হবে না?’
সকালের মুখে একটা ভাংচুরের ছাপ পড়ল, ‘কাল আপনি ভ্যাকেশনে যাচ্ছেন? দশদিনের জন্য? কেন?’
—‘প্রতি বছর এ সময়টায় আমি ঘুরতে যাই।’
সকাল সিট বেল্ট থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে কাটা কাটা ভাবে বলল, ‘খুব ভালো, যান, ঘুরতে যান।’
—‘না বলছিলাম তাহলে কি আপনার সাথে আর দেখা হবে না?’
—‘দেখা হলেই কী? আর না হলেই কী?’ বলে সকাল গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। আরশানও নামলো তড়িঘড়ি করে। সকালকে পেছন থেকে ডেকে বলল, ‘শুনুন, আপনি কোনো মোবাইল সিম ইউজ করছেন এখানে?
—‘হ্যাঁ। চাচি দিয়েছে একটা।’
—‘দেয়া যাবে নাম্বারটা আমাকে?’
—‘আমার মনে নেই এখন নাম্বার। পরে দেবো। বাই দ্যা ওয়ে, থ্যাংকস ফর দ্যা ট্রিট!
সকাল গ্যারাজ থেকে বের হয়ে ড্রাইভওয়ে দিয়ে হাঁটছিল। পথটা উঁচু হয়ে উঠে গেছে আট’ন ফুট উপরে। গিয়ে মিশেছে বাড়ির সামনের উঠোনে। আরশান দৌড়ে এসে পেছন থেকে সকালের একটা হাত ধরে ফেলে অস্থির গলায় বলল, ‘আপনি এরকম করছেন কেন?’
সকাল হাতটা ছাড়িয়ে নিলো এক ঝটকায়, ‘কী করলাম?’
—‘ইগনর করছেন কেন আমাকে?’
—‘ইগনর করলাম কোথায়?’
—‘আমি কথা বলছিলাম। আপনি আমার কথা না শুনে আমাকে এড়িয়ে চলে যাচ্ছেন। কেন?’
—‘কারণ, আমার কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না।’
—‘আমার সাথে কথা বলতে আপনার ভালো লাগে না?’
—‘আরশান! বাচ্চাদের মতো করছেন কেন?’
সেই মুহূর্তে অনিককে দেখা গেলো ঢালু পথটা ধরে হেঁটে আসতে। ওর কানে হেড ফোন, কাঁধে ব্যাগ প্যাক। পরনে হাফ প্যান্ট আর লাল টি শার্ট। সকালকে দেখে সে কান থেকে হেডফোন খুলে নিয়ে বলল, ‘হেই সকাল! আমি যাচ্ছি আমার স্কুলে। ওয়ান্না কাম উইদ মি? বাস নিয়ে চলে যাবো।’
সকাল এখানে আসার পর থেকে একবারও বাস ট্রেনে চড়েনি। তাই এ সুযোগটা সে হাতছাড়া করতে চাইলো না। বলল, ‘চলো যাই। এখানকার বাসে উঠিনি আমি কখনো।’
—‘লেটস গো, আজকে ওয়েদার খুব ভালো।’ খুশিতে ঝলমলিয়ে উঠে অনিক বলল। এরপর যেন এতক্ষণে তার আরশানকে নজরে পড়ল। হেসে বলল, ‘হাই আরশান ভাই। হোয়াটস আপ?’
আরশান দায়সারা ভাবে বলল, ‘এইতো!’
সকাল আরশানকে বলল, ‘আমি তাহলে যাই।’
—‘কোথায় যাচ্ছেন?’ গম গম করে প্রশ্ন করলো আরশান।
—‘জর্জ মেসন।’
—‘জর্জ মেসন গিয়ে আপনি কী করবেন?’
—‘ঘুরে দেখবো।’
আরশান কয়েক সেকেন্ড সকালের দিকে উগ্র চোখে তাকিয়ে থাকলো। তারপর হঠাৎ সকালের ডান হাতটা খামচে ধরে কঠোর গলায় হুকুম করলো, ‘কোথাও যেতে হবে না। আসুন আমার সাথে!’
সকাল অস্ফুটে বলে উঠল, ‘একি? হচ্ছেটা কী?
আরশান কোনো দিকে না তাকিয়ে সকালের হাত টেনে ধরে ঝড়ের বেগে হাঁটা শুরু করলো। হতভম্ব অনিক দাঁড়িয়ে রইল। হা করে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলো দৃশ্যটা।
সকাল ছটফট করে উঠে বলল, ‘কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আপনি আমাকে?’
আরশান প্রশ্নের জবাব দেবার প্রয়োজন বোধ করলো না। ভূত গ্রস্থের মতো হন হন করে হেঁটে যাচ্ছে সে। তার কপালে বিরক্তিসূচক কুঞ্চিত রেখা। চোয়াল শক্ত। নিশ্বাসে ফোঁস ফোঁস শব্দ
ব্যাক ইয়ার্ডে চলে আসলো আরশান। তারপর নিজের ঘরে। হাতটা চেপে ধরে রেখেই পকেট থেকে চাবি বের বরে স্লাই?ি ভোরের লক খুললো সে। তারপর ঘরের ভেতর ঢুকে সকালকে প্রায় এক ধাক্কায় ফেলে দিলো সোফার ওপরে। সকাল ধপ করে গিয়ে পড়ল সোফার গদিতে। সাঁড়াশির মতো কঠিন হাতের মুঠো থেকে ছাড়া পেয়ে নিজের কব্জি ডলতে ডলতে ক্রোধে ফেটে পড়ে বলল, ‘হোয়াট দ্যা হেল? এতো জোরে কেউ হাত ধরে? উফ আল্লাহ! এ কীসের পাল্লায় পড়লাম আমি?’
আরশান যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে উল্টো দিকের সোফায় বসে নিজের পায়ের জুতো খুলতে লাগলো।
সকাল চিৎকার করে বলে উঠল, ‘পেয়েছেন কী আপনি? ফাজলামো পেয়েছেন? কেন আমার হাত ধরে নিয়ে আসলেন এখানে? ওই ছেলেটা কী ভাবলো আপনাকে? ছিঃ’
আরশান ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘ওই ছেলেটার জন্য দেখি দরদে আপনি মারা যাচ্ছেন!’
—‘দ্যাখেন, ফালতু কথা বলবেন না!’
—‘ফালতু কথা আমি বলছি না আপনি বলছেন। অনিক কী ভাবলো না ভাবলো তাতে কিচ্ছু এসে যায় না। আই ডোন্ট কেয়ার!’
—‘আপনি মানুষটা এমন কেন?’
—‘কেমন?’
—‘ভীষণ হিংসুটে।’
আরশান দুর্বোধ্য হাসলো, ‘আমি হিংসা করছি? অনিককে? সিরিয়াসলি! হ্যাভ ইউ লস্ট ইয়োর মাইন্ড?’
কথাটা বলে আরশান উঠে পড়ল। বিনা বাক্য ব্যয়ে ক্যাবিনেট খুলে একটা ওয়াইনের বোতল বের করলো। সকাল চেঁচিয়ে উঠে বলল, ‘রাখেন তো ওটা। যেখানে ছিল সেখানেই ফিরিয়ে রাখুন।’
আরশান বোতলটা হাতে ধরে রাখা অবস্থায় ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো, বিস্মিত গলায় বলল, ‘কী বললেন?’
—‘বললাম মদের বোতলটা রেখে দিন। খুলবেন না।’
—‘কেন?’
—‘আমি বলেছি তাই।’
আরশান ঠোঁট উল্টে বলল, ‘স্ট্রেঞ্জ!’
কয়েক সেকেন্ড ওখানটায় দাঁড়িয়ে থেকেই কী যেন ভাবলো। তারপর বোতলটা ফিরিয়ে রাখলো যথাস্থানে। সোফার কাছে ফিরে এসে অধৈর্য গলায় বলল, ‘স্মোক করতে পারবো একটু? প্লিজ?’
সকাল ঠান্ডা ভাবে হুকুম করলো, ‘শুধু একটা।’
আরশান আপ্লুত হবার ভান করে বলল, ‘সো কাইন্ড অফ ইউ। শেহজাদী!
আরশানের মুখে প্রথমবারের মতো শেহজাদী ডাকটা শুনে সকালের ভালো লাগলো। লাগবেই বা-না কেন? শুধুমাত্র আপন লোকেরাই তো তাকে ওই নামে ডাকে।
আরশান জানালার গ্লাস তুলে দিলো। তারপর সোফায় বসে লাইটার দিয়ে একটা সিগারেট ধরালো। জানালা খুলে দিতেই একগুচ্ছ রেশমি হাওয়া বুনো ফুলের খুশবু সঙ্গে নিয়ে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল ঘরের ভেতর। ঢুকে পড়েই অবধারিত কর্তব্যের মতো সকালের খোলা চুলগুলো নিয়ে খেলতে শুরু করলো এক দুরন্ত খেলা। সকাল ব্যাগ থেকে পাঞ্চ ক্লিপ বের করে দুহাত দিয়ে চুল বাঁধতে গেলো। আরশান আপত্তির গলায় বলে বসলো, ‘উঁহু, এভাবেই ভালো লাগছে।’
সকাল ঠোঁট উল্টে বলল, ‘চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, বাতাসে।’
—‘যাক!’ নির্বিকার গলায় বলল আরশান।
আর কী করবে সকাল। বাধ্য মেয়ের মতো পাঞ্চ ক্লিপটা আবার ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলো।
ঘড়িতে দুপুর তিনটা। রোদে এখন তেজ কম। সোনালি রোদটায় রাঙা ভাব। লালচে রঙের ছটা মেপল, সিডার আর পাইন গাছের মাথায় মাথায়। প্রকৃতিতে এতো রঙের খেলা সকাল এর আগে কোনোদিন দেখেনি। ডেকের ওপর দুটি ছাইরঙা কাঠবিড়ালি সভ্য মানুষের মতো বসে কুটুর কুটুর করে কী যেন খাচ্ছে। আদুরে দেখাচ্ছে ওদেরকে। সকালের ভালো লাগছিল। ভাগ্যিস এই পাগলটা তাকে জোর করে টেনে নিয়ে এসে নিজের সামনে বসিয়ে রেখেছে। নইলে এখন অনিকের সাথে জর্জ মেসনে গিয়ে এই পাগলাটাকেই ভীষণ ভাবে মিস করতো সে। দিনটাই মাটি হয়ে যেত। মন পড়ে থাকতো এই পাতালঘরে। জঙ্গলের কাছে। তার ওপর আবার কানের কাছে লেগে থাকতো অনিকের নিরবচ্ছিন্ন বকবকানি।
মনে মনে সে আল্লাহকে অসংখ্য বার ধন্যবাদ দিলো, অনিকের সাথে যেতে হয়নি বলে। এরপর কৃতজ্ঞতার চোখে আরশানের দিকে তাকালো।
আরশানের চোখজোড়া সকালের মুখের ওপরেই ছিল। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে মন ভরে, চোখ ভরে সকালকেই দেখছিল সে। সকালও চোখ সরালো না এবার। চারটা চোখ অনেকটা ক্ষণ একে অপরের দিকে নিবদ্ধ হয়ে রইল ওই লালচে রঙা রেশমী হাওয়ার ফুলগন্ধী অক্টোবরের দুপুরবেলাটায়।
একটা সময় আরশান কেমন মাদক হেসে আবিষ্ট গলায় বলে উঠল, ‘আপনি এতো সুন্দর কেন?’
সকালের বুকটা এমনিতেই ধড়ফড় করছিল। এই আকস্মিক প্ৰশ্ন শুনে তার হৃৎপিন্ড কয়েক সেকেন্ডের জন্য একেবারে থমকে গেলো। তারপর ছুটতে লাগলো পাগলের মতো। সে মনে মনে বলল, আপনি আরো অনেক বেশি সুন্দর আরশান।
মুখে বলল, ‘আপনি এতো বাচ্চা কেন?’
—‘বাচ্চা?’
—‘বাচ্চা নয়তো কী? কখন কী করে বসেন নিজেই জানেন না।’
কথাটা বলে সকাল বসা থেকে উঠে দাড়ালো। ধীরে পায়ে মোহাবিষ্টের মতো আরশানের দিকে হেঁটে আসলো। খুব কাছে এসে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আরশানের মুখের দিকে খুব ভালো করে তাকালো। আরশানের মুখের ওপর যখন সকালের উষ্ণ নিশ্বাস এসে পড়ল আরশান তখন একটা হার্ট বিট মিস করলো। সকালের নিখুঁত সুন্দর ঠোঁটদুটোর দিকে কিছুক্ষণ স্থবির হয়ে চেয়ে থেকে একটু বিব্রত হয়ে বলল, ‘কী হয়েছে?’
সকাল ধীরস্থির ভাবে আরশানের গালের ওপর থেকে আঙ্গুল দিয়ে কিছু একটা তুলে নিলো। ঠান্ডা গলায় বলল, ‘ভয়ের কিছু নেই, আপনার চোখের পাঁপড়ি পড়েছিল।’
আরশান হেসে ফেললো। মনে পড়ল সেদিন রাতের বেলায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে সকালের চুলের ওপর থেকে পাতা সরাতে গিয়ে ঠিক একই রকম ডায়লগ দিয়েছিল সে নিজে। বুঝতে পারলো আজকে সেই ঘটনারই শোধ নেয়া হলো।
সকাল বলল, ‘পুরুষ মানুষের চোখের পাঁপড়ি এতো লম্বা হয়! না দেখলে বিশ্বাস হতো না।’ এরপর আরশানের হাত ধরে, হাতের তালুর উল্টো পিঠে চোখের পাঁপড়িটা রেখে বলল, ‘নিন, উইশ করুন।’
চাচা এসে দাঁড়িয়েছেন স্লাইডিং ডোরটার ওপাশে। তিনি দরজায় নক করে ওঠার আগেই সকালের চোখ গেলো ঐদিকে। আড়ষ্ট হয়ে পড়ল সে। আরশানকে বলল, ‘দরজা খুলে দিন। আপনার আব্বা এসেছে।’
আরশানও একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে হাতের আধখাওয়া সিগারেটটা এশট্রেতে চেপে ধরে আগুন নেভালো। চাপা গলায় সকালকে বলল, ‘এশট্রে টা সরিয়ে রাখুন তো। আমি দরজা খুলে দিচ্ছি।’
রহমান সাহেব নির্বিকার ভাবেই ছেলের ঘরে ঢুকলেন। আরশান সকালকে একত্রে দেখে কোনো বিস্ময় বা বিরক্তি প্রকাশ করলেন না। মনে হলো যেন ওদের একসাথে থাকাটাই স্বাভাবিক।
সোফায় বসতে বসতে তিনি নাক কুঁচকে বললেন, ‘তুমি স্মোক করছিলে?’
আরশান আমতা আমতা করে বলল, ‘ন নাহ …বাবা। স্মোক তো আমি …আসলে করি না।’ এরপর একটু থেমে মাথা নিচু করে ম্লান হয়ে বলল, ‘মাঝে মাঝে করি।’
সকাল মুখ ঘুরিয়ে ঠোঁট টিপে হাসতে লাগলো। রহমান সাহেব একটু উঁচু গলায় বললেন, ‘মাঝে মাঝেও করো না। এটা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তুমি কি বড় হওনি এখনো? সব কথা আমাকে পইপই করে শিখিয়ে পড়িয়ে দিতে হবে?’
আরশান কিছু বলল না। নত মুখে দাঁড়িয়ে রইল। বাবা সুযোগ পেলে তাকে দুই চার কথা শোনাতে পিছপা হন না। সে এক কান দিয়ে ঢোকায় আরেক কান দিয়ে বের করে দেয়। কিন্তু আজকে সকালের সামনে বাবার শাসনের তোপের মুখে পড়ে সে বেশ বিপন্ন বোধ করতে লাগলো।
না তাকিয়েও বুঝতে পারছে সে, সকাল মুখ টিপে হাসছে।
রহমান সাহেব বললেন, ‘বসো তোমরা দাঁড়িয়ে রইলে কেন?
বসলো ওরা।
—‘তোমার মা সব কেমন চলছে?’ সকালকে প্রশ্ন করলেন রহমান সাহেব।
—‘এইতো চাচা ভালো।’
—‘তোমার বাবা ফোন করেছিলেন আজ ভোরে। তোমার সাথে কথা বলতে চেয়েছিলেন। তুমি ঘুমোচ্ছিলে বলে বিরক্ত করিনি।’
—‘তাই নাকি?’
—‘হ্যাঁ। বললেন তোমার ফিরে যাবার টিকেট করে ফেলেছেন আগামী বিশ তারিখে। বিশে অক্টোবর।’
শুনে সকাল একটু নিভন্ত গলায় বলল, ‘ও আচ্ছা!’
—‘আজ তো চার তারিখ। আর মাত্র পনেরো দিন পাচ্ছো হাতে। কিন্তু এখনই ফিরে যাচ্ছো কেন? তুমি তো কোথাও ঘুরতে যাওনি। কিছুই দেখলে না। এতো দূরে এসে এতো অল্প সময় থাকলে কি হয়?’
আরশান ফোড়ন কাটলো, ‘একজেক্টলি। কম পক্ষে তিন চার মাস না থাকলে আপনার টিকেটের দামই উশুল হবে না।’
—‘অনেক দিন হয়ে গেলো। আর কত?’
রহমান সাহেব বললেন, ‘আচ্ছা শোনো, তুমি একটা লিস্ট করে ফেলো যে কোথায় কোথায় তুমি যেতে চাও। কী কী দেখতে চাও। নেক্সট উইকেন্ডে আমি নিজে তোমাকে নিয়ে যাবো।’
সকাল কৃতজ্ঞতার হাসি হেসে বলল, ‘জি আচ্ছা চাচা। অনেক ধন্যবাদ।’
রহমান সাহেব এবার আরশানকে বললেন, ‘শোনো। পরশু দিন টিলির বার্থডে। এবার ওর আঠারো হবে। তো এ উপলক্ষে বাসায় কিছু গেস্ট ইনভাইট করা হয়েছে। বিকেলে। তোমার মাদার ব্যাক ইয়ার্ডটা ব্যবহার করতে চাইছেন। এখানে কিছু টেবিল চেয়ার দিয়ে গেস্টদের বসার ব্যবস্থা করা হবে। তোমার কোনো আপত্তি আছে?’
আরশান পরিষ্কার গলায় বলল, ‘আমার আপত্তির কী আছে? আপনার বাড়ি, আপনি যা খুশি করবেন।’
—‘বাড়িটা তোমারও। লনের ঘাস টাস তো কিছুই কাটা হয়নি দেখছি। ঠিক আছে যা করার তোমার মাদারই করে নেবেন।’
—‘আমার মোয়িং মেশিনটা কাজ করছেনা। তাই করতে পারিনি 1 আপনারটা ঠিক আছে না বাবা?’
—‘মনে হয়। আমি ঠিক জানি না। এসব তো ফাহাদই ম্যানেজ করে। ওকে জিজ্ঞাসা করে দেখো।’
—‘হুম। ঠিক আছে।’
—‘তুমি থাকছো তো পার্টিতে?’
—‘না বাবা। আমি কাল যাচ্ছি ভ্যাকেশনে।
—‘কবে ফিরছো?’
—‘দশ দিন পর।’
রহমান সাহেব বসা থেকে উঠতে উঠতে বললেন, ‘না গেলে হয় না? তোমার বোনের আঠারো বছরের জন্মদিনে তুমি থাকবে না। বেচারি মন খারাপ করবে তো।’
আরশান একটু নিস্তেজ হয়ে বলল, ‘আমার মাথায়ই ছিল না যে শী ইজ এপ্রোচিং এইটিন দিস ইয়ার। টিলিটাও বড় হয়ে গেলো। ডোন্ট ওরি বাবা। আই উইল ম্যানেজ হার।
রহমান সাহেব বেরিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে সকাল মৃত গলায় বলল, ‘কাল যাচ্ছেন আপনি? দশ দিনের জন্য?’
আরশান একটু হাসার চেষ্টা করলো, ‘সে রকমই তো কথা! না যাবার কোনো কারণ আছে কি?’
—‘আছেই তো!’
—‘কী কারণ?’
—‘আপনার বোনের জন্মদিন।’
আরশান হাসলো, ‘ভালো বলেছেন। ওটা আমি ম্যানেজ করে নেবো।’ সকাল উঠে পড়ল।
—‘কোথায় চললেন?’ আরশানের প্রশ্ন।
—‘যাই!’
—‘হঠাৎ কী হলো আপনার?’
—‘ও আপনি বুঝবেন না।’
—‘বুঝিয়ে বলা যায়না একটু?’
—‘সব কথা বুঝিয়ে বলতে নেই।’
—‘আপনাকে জোর করে টেনে নিয়ে আসলাম এখানে। অনিকের সাথে যেতে দিলাম না। এর জন্যে কি আপনি আমার ওপরে রাগ করেছেন?
সকাল তাকালো আরশানের দিকে, নরম গলায় বলল, ‘না। রাগ করিনি।’
৩২
ফোন আসলো গভীর রাতে।
নাবিলা রাত জেগে পড়াশোনা করছিল। কাল একটা পরীক্ষা আছে। পড়তে পড়তে টেবিলের ওপর মাথা রেখে একটু ঝিমোচ্ছিল সে। সেই সময় মোবাইলটা বেজে উঠল।
নাবিলা নাম্বারটা চিনতে পারলো না। ফোন রিসিভ করলো। গভীর রাতে ফোন আসলে তার খুব বুক ধড়ফড় করে। তার অভিজ্ঞতা বলে মাঝ রাতের দূরালাপনী কখনো সুখ সংবাদ নিয়ে আসে না। ছোট ফুপু মারা যাবার পর থেকে এই ভীতিটা তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। ছোট ফুপুর মৃত্যু সংবাদ এসেছিল রাত তিনটের সময়। তার জীবনের সবচেয়ে বীভৎস দিন ছিল ওটা।
দু’ তিনবার হ্যালো বলার পর ওপাশ থেকে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো। গলাটা নাবিলার চেনা।
চেনা গলাটা বলল, ‘হ্যালো নাবিলা? ঘুমিয়ে পড়েছো?’
—‘এটা কার নাম্বার?’
—‘আমার কাজিন অনিকের নাম্বার।’
—‘ফাহাদ তুমি আমাকে অনিকের নাম্বার থেকে কেন ফোন করেছ? এতো রাতে?’
ফাহাদ একটু চুপ করে রইল। বিষণ্ণ গলায় বলল, ‘তুমি তো আমার নম্বর থেকে ফোন রিসিভ করছিলে না। আর কোনো উপায় ছিল না আমার।’
—‘কী চাই তোমার?’
—‘আমি জাস্ট জানতে চাইছিলাম যে তুমি কেমন আছো।’
—‘আমি ভালো আছি। খুব ভালো আছি। এখন খুশি? ফোনটা কি আমি এখন রাখতে পারি?’
—‘নাবিলা শোনো। একটা প্রশ্নের জবাব দাও। তুমি আমার সাথে কথা বলতে চাইছো না কেন? আজকে সারা দিন আমি তোমাকে মনে হয় থার্টি টাইমস এর বেশি ফোন দিয়েছি। তুমি একটা বারও রিসিভ করোনি। কেন?’
—‘মোটেও তুমি থার্টি টাইমস ফোন দাওনি। পঁচিশটা মিসড কল পেয়েছি আমি।’
ফাহাদ ক্লান্ত গলায় বলল, ‘পঁচিশ বার কি কম? তুমি নিজে জীবনে কখনো কারুকে এতো বার ফোন করছ?’
—‘না।’
—‘আমিও করিনি। এই প্রথম আমি একটা মানুষকে এতো বার ফোন করলাম আর মানুষটা আমার ফোন একটা বারের জন্যেও এনসার করলোনা।’
—‘কেন ফোন করেছো বলো?’
—‘আগে তুমি বলো ফোন ধরোনি কেন?’
—‘ফাহাদ লিসেন। আমি ঘটনাটা ভুলতে চাইছি।’
—‘কোন ঘটনা?’
—‘তোমার মা আমাকে যে অপমানটা করেছেন, সেই অপমানটা আমি ভুলে যেতে চাইছি। তোমার সাথে কথা বললে, তোমার সাথে যোগাযোগ রাখলে আমি ব্যাপারটা অত সহজে ভুলতে পারবো না। ক্লিয়ার?
—‘আমি তো তোমাকে সরি বলেছি মমের হয়ে। বলিনি?’
—‘তুমি সরি বললেই হবেনা ফাহাদ! উনি আমাকে একদমই পছন্দ করেন না। আমার মনে হয় না উনি চান যে আমি তোমার সাথে কোনো রকমের যোগাযোগ রাখি। হাজার হোক উনি তোমার মা। আমার জন্য তোমার মায়ের সাথে তোমার কোনো ঝামেলা হোক সেটা আমি চাই না।’
—‘দেখো আমি একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ। আমি কার সাথে মিশবো কার সাথে মিশবো না সেটা কোনো ভাবেই আর আমার মা এখন আর নির্ধারণ করে দিতে পারেন না।’
—‘তুমি বুঝতে পারছো না।’
ফাহাদ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। তারপর একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘ঠিক আছে। ছাড়ছি।’
.
রাতে ভালো ঘুম হলো না ফাহাদের। সকালে নাশতার টেবিলে সে মমকে সরাসরি বলে বসলো, মম, ক্যান ইউ ডু মি আ ফেভার?’
—‘কী চাই তোমার?’
ফাহাদ নিজের ফোনটা মায়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে ঠান্ডা গলায় বলল, ‘এটা নাবিলার নাম্বার। তুমি এই নাম্বারে ডায়াল করে ওকে সরি বলো।
মম আগুন গরম চোখে চেয়ে বললেন, ‘কী বললে তুমি?’
টেবিলে সকাল আর টিলিও ছিল। দুজনে মা ছেলের কথোপকথন গিলছে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে।
ফাহাদ বলল, ‘আই ওয়ান্ট ইউ টু কল হার
—‘কেন?’
—‘তুমি সরি বলবে তাই ‘
—‘কেন আমি সরি বলবো?’
—‘কারণ, তুমি মেয়েটাকে অপমান করেছো।’
মম ক্রোধে ফেটে পড়ে বলে উঠলেন, ‘অসম্ভব! আমি কখনই সরি বলবো না ওই মেয়েকে। যা বলেছি একদম মোক্ষম কথা বলেছি।’
মম উঠে গেলেন চেয়ার ছেড়ে। আজকে তার আর নাশতা করা হবে না।
কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থেকে ফাহাদও উঠে পড়ল। সকাল ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে উঠল, ‘ফাহাদ নাশতা করে যাও। প্লিজ!’
ফাহাদ আস্তে করে বলল, ‘নাহ, অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
ফাহাদকে আর আটকানো গেলো না।
টিলিকে একলা পেয়ে সকাল একটু সাবধানী গলায় বলল, ‘টিলি,
আমার একটু তোমার সাহায্য চাই।’
৩৩
শেষ রাতে বৃষ্টি নেমেছিল। উত্তর দিক থেকে ছুটে আসছিল ভয়ঙ্কর বাতাস। সারারাত জানালা খোলা রেখে লিভিং রুমে বসে ছিল আরশান। ঘুম হয়নি এক ফোঁটাও। মেয়েটা দুপুরবেলা চলে যাবার পর বাকিটা দিন তার জঙ্গলে কেটেছে। হেঁটে, দৌড়ে, ছবি এঁকে, এরিকের দেখা শোনা করে। আর হ্যাঁ, ভাবনায় ডুব দিয়ে। গভীর থেকে গভীরতর সব চিন্তায় ডুবে ছিল সে সারাটা দিন, সারাটা রাত। সেইসব চিন্তারা ভারি বিক্ষিপ্ত, ভারি উদাসীন আর বড্ড একাকী। একাকিত্ব জিনিসটা তার ভেতরে আগে ছিল না। আজকাল একটু বেশি সময় একা থাকলেই মনে হয় কী যেন নেই, কী যেন নেই। এই বদলে যাওয়া ভেতরের মানুষটাকে মেনে নিতে তার কষ্ট হচ্ছে। অনেক বোঝাপড়া করলো নিজের সাথে পুরো একটা দিন, একটা রাত। বোঝাপড়া করে লাভ হলো। আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলো অনেকটাই। এতটুকু বিশ্বাস করতে পেরে নিশ্চিন্ত হলো যে সে কোনো বাঁধনে জড়াচ্ছে না। কোনো মানুষ তাকে বাঁধতে পারবে না। বেঁধেছে শুধু এ পৃথিবী।
সকাল দশটায় ফ্লাইট। ঘড়িতে বাজে সাড়ে সাতটা। ব্রেকফাস্ট করেই বের হয়ে পড়বে। এয়ারপোর্টে গাড়ি নেবে না। উবার নিয়ে চলে যাবে। তারপর তার একান্ত নিজের ভুবনটায় কেবলমাত্র সে নিজে। ভাবতেই কেমন একটা মুক্তির আস্বাদন টের পাচ্ছে মনে মনে।
শাওয়ার নিয়ে বেরোনোর পর মনে হলো লিভিং রুমে কেউ একজন আছে। আরশান কৌতূহল নিয়ে বেডরুম থেকে বেরোলো। সকাল বসে আছে ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে। আরশানকে দেখে উঠে দাড়ালো, বলল, ‘আপনার ফ্লাইট কয়টায়?’
আরশান উত্তরটা সাথে সাথে না দিয়ে ঠোঁটে একটা মুচকি হাসি নিয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল ওর দিকে। ওই মুখটার দিকে তাকাতেই চারপাশে রাশি রাশি শিউলি ফুলের শুভ্রতা ছড়িয়ে গেলো। স্নিগ্ধ হয়ে উঠল বাতাস। দৌড় দিয়ে পালিয়ে গেলো রাত জাগার ক্লান্তি।
—‘ফ্লাইট দশটায়। আপনি কিছু বলবেন?’
সকাল একটু দ্বিধাজড়িত গলায় বলল, ‘না কিছু বলার নেই। আপনার জন্য নাশতা নিয়ে এসেছি। ভাবলাম আজ তো আপনার তাড়া আছে। না খেয়ে আবার বের হয়ে পড়েন কিনা।’
আরশান এক গাল হেসে বলল, ‘জেনে ভালো লাগছে আমার জন্য কেউ এতটা চিন্তা করে।’
শুনে সকাল একটু লজ্জা পেলো। ধরা পড়ে যাচ্ছে সে। নিজেকে আর লুকোতে পারলো না।
আরশান এগিয়ে এসে খাবারের ঢাকনা খুলে বলল, ‘এটা কী?’
—‘খিচুড়ি। চাচি রান্না করেছেন।’
—‘আমি তো খিচুড়ি খাই না।’
—‘খাওয়া-দাওয়া নিয়ে অনেক নকড়া আছে আপনার।’ অসন্তুষ্টি নিয়ে বলল সকাল।
—‘তা আছে বৈকি। আমি খুব হেলথ কনশাস। এই খিচুড়িতে যে পরিমাণ তেল মসলা দেয়া হয়েছে এই তেল আর মসলা আমার পেটে গেলে আজকে ভোর বেলার ওয়ার্কআউট পুরোপুরি বৃথা হয়ে যাবে।’
—‘একদিন খেলে কিচ্ছু হবে না।’
—‘ঠিক আছে খাবো। আপনি কষ্ট করে নিয়ে এসেছেন তাই।’ বলে আরশান চামচ নিয়ে খেতে বসে গেলো, বলল, ‘আপনি খেয়েছেন?’
—‘হুম খেয়েছি।’
—‘আপনি ঠিক করেছেন কোথায় কোথায় ঘুরতে যাবেন?’
—‘এখনো ঠিক করিনি। আচ্ছা! আপনার একা একা বেড়াতে ভালো লাগে?’
—‘এতকাল তো ভালো লেগেছে। এবার কী রকম লাগবে বুঝতে পারছি না।’ কথাটায় একটা চাপা ইঙ্গিত ছিল। টের পেয়ে সকাল সরু চোখে তাকালো আরশানের দিকে।
লঘুভাবে বলল, ‘কেন? এবার অন্যরকম কিছু হবে বলে মনে হচ্ছে নাকি?’
‘সব কিছুই কেমন অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে। এইযে আমি ব্রেকফাস্ট করছি খিচুড়ি দিয়ে। এটা ও তো একটা অন্যরকম ঘটনা।’
সকাল একটা হতাশ নিশ্বাস ছাড়লো। এই ছেলের সাথে কথায় পারা যাবে না।
উঠে পড়ে বলল, ‘সাবধানে থেকেন। এনজয় করেন। বেঁচে থাকলে দেখা হবে আবার।’
—‘চলে যাচ্ছেন?’
—‘থেকে যাবার কোনো কারণ আছে কি?’
—‘সব কিছুর পেছনে কি কারণ থাকতে হয়? কারণ ছাড়া কি কিছু ঘটেনা?’
—‘না ঘটে না।’
সকালের বুক ধড়ফড় করছিল। কথা ছিল টিলি এর মাঝেই উপস্থিত হবে এখানটায়। আজকে ছুটির দিন। সম্ভবত মেয়েটা এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। যদি টিলি ঘুম থেকে ওঠার আগেই আরশান বেরিয়ে পড়ে? তখন কী হবে? সকালের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। মানুষটা চলে গেলে সে মরে যাবে। দশদিনে দশবারের বেশি মৃত্যু হবে তার। একে আটকাতে হবে। যে করেই হোক আটকাতে হবে।
—‘আচ্ছা! আমি চলে যাবার পর, আপনার কি আমাকে মনে পড়বে?’ অন্যরকম গলায় প্রশ্নটা করলো আরশান।
সকাল কেঁপে উঠল। ইচ্ছে হলো বলে, নতুন করে মনে পড়ার কিছু নেই। মনের ভেতরেই আছেন আপনি, সৰ্বক্ষণ।
কিন্তু কিছু বলার আগেই সিঁড়ি ভেঙে ধড়মড় আওয়াজ তুলে টিলি নেমে আসলো নিচে। সকাল স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো।
টিলি নেমে এসেই হৈ হৈ করে বলে উঠল, ‘আরশান ভাইয়া! আমার বার্থডে। আর তুমি পালাচ্ছো। এটার মানে কী?’
আরশান একটু থতমত খেয়ে গেলো। কী বলবে খুঁজে পেলো না। নির্বাক হয়ে চেয়ে রইল টিলির দিকে।
—‘কী কথা বলছো না কেন? তুমি আমার বার্থডেতে থাকছো না? আমার আঠারো বছর হবে এবার!’
আরশান একটু রয়ে সয়ে বলল, ‘তোমার যে আঠারো হচ্ছে এটা সত্যি আমার মাথায় ছিল না।’
—‘থাকবে না তো, কারণ তুমি আমাকে ভালোবাসো না। তোমার একটা মাত্র বোনকে তুমি ভালোবাসো না। তুমি এরকম কেন?’
আরশান অপরাধীর গলায় বলল, ‘ব্যাপারটা মোটেও তা নয়।’
—‘তাহলে ব্যাপারটা কী?’
—‘আমি একটু দুশ্চিন্তায় ছিলাম কিছু ব্যাপার নিয়ে। তাই মাথা থেকে তোমার জন্মদিনের বিষয়টা ছিটকে গেছে। সরি।’
সকাল চুপ করে ওদের ভাই-বোনের কথোপকথন শুনছিল আর মিটি মিটি হাসছিল। প্ল্যান মনে হচ্ছে সফল হবে। আনন্দে তার নাচতে মন চাইছে।
টিলি ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, ‘এ থেকেই বোঝা যায় যে তুমি আমাকে একটা ফোঁটাও ভালোবাসো না।’ কথাটা শেষ করে টিলি ঘুরে দাড়ালো। রাগী ভঙ্গিতে আবার বলল, ‘যাও তোমার যেখানে খুশি। আমার জন্মদিনে তুমি কেন থাকবে? আমি তোমার কে? আশ্চর্য লাগছে আমার। কালকে থেকে আমি অফিসিয়ালি একজন এডাল্ট হতে যাচ্ছি। এরপর থেকে আমি ড্রাইভ করতে পারবো, ড্রিংক করতে পারবো, যা ইচ্ছা করতে পারবো। আমার লাইফ চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে! আর আমার বড় ভাই এই বিশেষ দিনটাতে থাকছে না। হ্যাপি মি!
আরশান উঠে এসে টিলির কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘সরি বললাম তো! আচ্ছা ঠিক আছে, আমি কোথাও যাচ্ছি না। ট্যুর ক্যানসেল করছি। এখন বলো তোমার কী চাই বার্থডে তে?’ খুশিতে ঝুম ঝুম করে উঠে ভাইকে জড়িয়ে ধরলো টিলি। সকালেরও আনন্দে জড়িয়ে ধরতে মন চাইলো ওদেরকে।
টিলি বলল, ‘আই ওয়ান্ট আ কার, ভাইয়া!’
—‘কার? তোমার তো লাইসেন্সই হয়নি এখনো। আর আমার অত টাকা নাই।’
—‘লাইসেন্স হয়ে যাবে। তোমার অনেক টাকা। আমি জানি।
—‘ছাই জানো তুমি। কার এখন নয়। আফটার টোয়েন্টি। ওকে? এখন অন্য কিছু বলো।’
—‘আচ্ছা তাহলে আই ফোন টেন ম্যাক্স।’
—‘ওকে ডান।’
টিলি আনন্দে হাত পা ছুঁড়ে লাফাতে লাগলো। তারপর বলল, ‘তাহলে তোমার বিয়ের সময় তুমি আমাকে একটা কার গিফট করবে।’
আরশান চোখ কপালে তুলে বলল, ‘আমার বিয়েতে আমি কেন তোমাকে গিফট করবো? তুমি আমাকে গিফট দেবে। আর তাছাড়া আমি কখনো বিয়ে করবো না।’
—‘বিয়ে করবো না বললেই হলো? করবে ঠিকই।’
—‘জীবনেও না।’
—‘দেখা যাবে।’ বলে টিলি যেমন নাচতে নাচতে কাঠের সিঁড়ি মড়মড়িয়ে নিচে নেমে এসেছিল তেমনিই আবার নাচতে নাচতে উপরে উঠে গেলো।
সকালের মুখে হাসি উপচে পড়ছিল। আরশান একটু চোখা গলায় বলল, ‘আপনি অত হাসছেন কেন?’
সকাল অনেক কষ্টে হাসি চেপে বলল, ‘না হাসছি না। ভাবছি আপনার অত সাধের ট্যুরটা কিনা ক্যানসেল করতে হলো? ইশ!
আরশান ভ্রু উঁচিয়ে বলল, ‘মজা নিচ্ছেন?’
—‘আপনি তাহলে বিয়ে করবেন না কখনো?’
—‘না। বিয়ে করবো কেন?’ আরশান এমন ভাবে কথাটা বলল যেন বিয়ে করাটা কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের কাজ নয়। সকাল জানে না এই কথাটায় তার মন খারাপ হওয়া উচিত ছিল কিনা। মন তার খারাপ হলো না বরং মনে হলো এই মানুষটা একটা ছেলেমানুষ আর পাগল। কী বলে আর কী ভাবে তা সে নিজেই জানে না।
সকালের সেলফোনটা বেজে উঠল ঝন ঝন করে। নাবিলা।
—‘শেহজাদী! কী খবর?’
—‘এইতো। তোর অবস্থা কী?’
—‘শোন, তোর চাচি ফোন করেছিলেন একটু আগে।’
—‘তাই নাকি?’ সকালের মুখে একটা চওড়া হাসি ফুটে উঠল।
—‘হ্যাঁ। উনি সরি বললেন বুঝেছিস? ওই দিনের ঘটনার জন্য।
—‘ওয়াও! দ্যাটস ওয়ান্ডারফুল দোস্ত। তুই কী বলেছিস উনাকে? ক্ষমা করে দিয়েছিস?’
—হ্যাঁ। আসলে বয়স্ক একজন মানুষ সরি বলছেন এভাবে। ক্ষমা না করে কি পারা যায় নাকি?’
—‘সেটাই সেটাই।’ সকাল খুব হাসছে। তার মনটা আনন্দে কেমন ফুর ফুর করে উড়ছে। আজকের সব খবর ভালো। মনে হচ্ছে দিনটা ভালো কাটবে।
নাবিলা বলল, ‘কালকে নাকি টিলির বার্থডে। উনি আমাকে ইনভাইট করেছেন।’
সকাল লাফিয়ে উঠল, ‘বাহ্ বেশতো! আমার খুব খুশি খুশি লাগছে।’
—‘হুম, বাট আমি বুঝতে পারছি না টিলির জন্য কী কেনা যায়। তুই কিছু কিনেছিস?’
—‘নারে। আমারও তো কিছু কেনা দরকার। মানে গিফট তো কিছু করতেই হবে।’
—‘আজকে যাবি? শপিং মলে?’
—‘হ্যাঁ যাওয়া যায়। চল যাই।’
—আচ্ছা শোন। ওদিকে কাছাকাছি গিয়ে তোকে ফোন করব। তুই আসতে পারবি না?’
—‘মনে হয় পারবো।’ মুখে বলল। কিন্তু সকাল তো এখানে কিছু চেনে না। একা ঘর থেকে বেরও হয়নি কখনো।
—‘তাহলে রেডি হয়ে যা।’
—‘আচ্ছা দোস্ত।’
—‘রাখছি তাহলে।’
—‘বায়।’
ফোন রেখে সকাল আরশানকে বলল, ‘আপনি তো আর যাচ্ছেন না আপনার হানিমুনে। আমাদেরকে বরং একটু সার্ভিস দিন আজকে।’
—‘কিসের সার্ভিস?’
—‘ড্রাইভিং সার্ভিস। শপিং মলে যাবো। আমি আর নাবিলা।’
—‘কখন যাবেন?’
—‘এইতো একটু পরেই।
—‘ঠিক আছে। রেডি হয়ে আমাকে কল দিয়েন।’
—‘কল?’
—‘হ্যাঁ কল। এতো অবাক হচ্ছেন কেন?
—‘আমার কাছে তো আপনার নম্বর নেই।’
—‘মেসেঞ্জারে আছেন আপনি?’
—‘আছি শেহজাদী নামে। আমাকে রিকোয়েস্ট পাঠান।’
—‘সব কিছু আমাকেই করতে হবে?’
বলে আরশান একটু থেমে নিজের ফোন নম্বরটা বলল। সকাল টুকে নিলো নম্বরটা, মোবাইলে।
৩৪
ফাহাদ কিচেনে ছিল। চেয়ারে বসে খবরের কাগজ পড়ছিল। সকাল খুশিতে ডুবো ডুবো হয়ে তাকে বলল,
—‘এইযে মিস্টার, একটা গুড নিউজ আছে।’
—‘কী নিউজ?’
সকাল চাপা গলায় অনেকটা ফিসফিস করে উঠল, ‘চাচি ফোন করেছিল নাবিলাকে।’
ফাহাদের মুখে একটা দ্যুতি খেলে গেলো, ‘সিরিয়াসলি?’
—‘সিরিয়াসলি!’
—‘কী বলেছে মম?’
—‘সরি বলেছে!’
—‘তারপর?’
সকাল এবার আরো জমিয়ে জমিয়ে বলল, ‘তারপর টিলির বার্থডের জন্য দাওয়াত দিয়েছে!’
ফাহাদ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল, ‘ওয়াও! অসাম! নাবিলা কি আসছে কালকে?’
—‘হ্যাঁ আসছে। ও টিলির জন্য গিফট কিনতে চাচ্ছে। তো আমরা যাচ্ছি এখন শপিং এ। আরশান নিয়ে যাচ্ছে। তুমিও চল।’
ফাহাদ একটু আমতা আমতা করে বলল, ‘ন্যাহ ….আমার যাওয়াটা…. কেমন লাগে। নাবিলা কী ভাববে?’
—‘কী ভাববে আবার? আমি বলবো আমি তোমাকে জোর করে নিয়ে গেছি। যাতে তুমি নাবিলাকে কোম্প্যানি দিতে পারো। আর আমি আর আরশান একটু, ইউ নো …আমরা একটু স্পেস পেলাম।’
ফাহাদ চোখ ছোট করে বলল, ‘হোয়াট আ প্ল্যান!’
সকাল লাল হলো, ‘আরে না। এটা তো আমি বানিয়ে বলব। আসলে আমি চাই তুমি আমাদের সাথে আসো। তোমাদের ভেতরে একটা প্রব্লেম চলছে আমি বুঝতে পারছি। প্রব্লেমটা সলভ হওয়া দরকার।’
ফাহাদ একটুক্ষণ চুপ করে থেকে কিছু একটা ভাবলো। তারপর বলল, ‘ওকে।’