অক্টোবর রেইন – ২৫

২৫

খাবার টেবিলে চাচা বললেন, ‘আরশান কোথায়? তার তো আমাদের সাথে ডিনার করার কথা ছিল।’ 

চাচি সকালকে বললেন, ‘তোমার সাথে তো বের হলো দেখলাম। এখন কোথায়?’ 

অতিথিদের সামনে সকাল একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলো কথাটা শুনে। আড়ষ্ট হয়ে বলল, ‘আমি ঠিক বলতে পারছি না চাচি। বাড়ির ভেতর ঢুকতে দেখেছি।’ 

টিলি নিচে গিয়ে খবর আনলো, ‘আরশান ভাইয়া নেই। গাড়িও নেই গ্যারেজে। তার মানে বাইরে গেছে।’ 

সকাল মুখে খাবার তুলতে যাচ্ছিল। কথাটা কানে ঢোকা মাত্র তার হাত থমকে গেলো। 

মানুষটা কি তাহলে পালিয়েই গেলো? 

চাচি বললেন, ‘এই বাড়ির ছেলেগুলোর যে কী অদ্ভুত স্বভাব আমি বুঝি না। যখন তখন এরা হাওয়া হয়ে যায়। ফাহাদটার কাণ্ড দেখেছো? কোনো খবর নেই সারাদিন। কোন চুলোয় গিয়ে বসে আছে খোদা জানেন।’ 

চাচা বললেন, ‘আমার মনে হচ্ছে ও ফিলাডেলফিয়ার বাড়িতে গেছে। কিন্তু হঠাৎ কাউকে কিছু না বলে চলে যাওয়ার কারণ কী? এক কাজ করি চল, আমরা সবাই কাল খুব ভোরে ফিলাডেলফিয়া চলে যাই। গিয়ে দেখে আসি গাধাটা কী করছে ওখানে।’ 

চাচি সাথে সাথে রাজি হয়ে গেলেন, ‘খুব ভালো হবে। লিরা তোরা তো আমাদের ওই বাড়িটা দেখিসনি। চল কালকে সবাই মিলে যাই।’ 

সকালের কানে এসব কিছুই ঢুকছিল না। বুকের ভেতরে একটা অদ্ভুত ভয় হচ্ছে। পাগলটাকে শেষমেশ আটকাতে পারলো না সে। কোথায় গেছে কে জানে। কতদিনের জন্য গেছে? কবে ফিরবে? 

খাওয়া শেষ হলে নিজের ঘরে ফিরে এসে দরজা দিলো সে। তার বুক ভার। চোখ টলমলে। 

বিন্দুবাসিনী বলল, ‘ভাববেন না শেহজাদী। ওকে একটু সময় দিন। ঠিক ঠিক ফিরে আসবে।’ 

—‘এমন কেন করে? ওকে ছাড়া যে আমি থাকতে পারি না, এটা কি ও বোঝে না?’ 

—‘বুঝবে ঠিক। আরেকটু সময় দিন।’ 

—‘না বিন্দু, মানুষটাকে আমি একটুও বুঝি না। মাঝে মাঝে মনে হয় সে বুঝি আমাকে পছন্দ করে। আবার মাঝে মাঝে মনে হয় যেন সহ্যই করতে পারছে না।’ 

—‘চিন্তা করবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে। আর কটা দিন সময় দিন।’ মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলো নাবিলার মিসড কল। ডায়াল করলো। কল রিচ করলো না। নাবিলাটা কোথায় উধাও হয়ে গেছে কে জানে। কেমন একটা দুশ্চিন্তা হচ্ছে ভেতরে ভেতরে। কী একটা দিন কাটলরে আজ বাবা! 

২৬

আরশান যখন এন্ড্রিয়ানার কনডোতে এসে পৌঁছুলো ঘড়িতে তখন রাত দশটা। ঠিক সেই সময় ফোনটা আসলো। সেই নম্বর থেকে যে নম্বরটা নিউইয়র্কের রাস্তায় ছিনতাইকারীর হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল সে। নম্বরটা চিনে নিতে খুব একটা সময় লাগলো না তার। কিন্তু অবাক না হয়ে পারলো না। কে এই ব্যক্তি? কী চাই তার কাছে? 

—‘হ্যালো!’ 

ওপাশে কোনো শব্দ নেই। আরশান আবার বলল, ‘হ্যালো।’ 

সাড়া নেই। শুধু শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ। কয়েকটি নীরব মুহূর্ত। তারপর ওপাশ থেকে লাইন কেটে দেয়া। 

আরশানের কপালে একটা চিন্তার রেখা ফুটে উঠল। এন্ড্রিয়ানা বলল,

—‘তোমাকে খুব আপসেট দেখাচ্ছে শওন। কী হয়েছে?” 

আরশান নিস্তেজ গলায় বলল, ‘আমি ঠিক ভালো নেই এন্ড্রি।’

এন্ড্রিয়ানা ওর পাশে এসে বসলো। একটা হাত নিজের হাতে তুলে নিয়ে নরম গলায় বলল, ‘ভালো নেই কেন? কী হয়েছে? 

আরশান সোফার ওপর মাথা হেলিয়ে দিলো। চোখদুটো বন্ধ করে ক্লান্ত ভাবে বলল, ‘আমি আমাকে বুঝতে পারছি না। 

—‘বুঝতে পারছো না মানে কী? খুলে বলো।’ 

—‘আমি বুঝতে পারছি না ওই মেয়েটাকে কেন আমার এতটা ভালো লাগছে!’ 

—‘তুমি ওর প্রেমে পড়ে গেছ। তাই ভালো লাগছে।’ 

আরশান একটু লাজুক গলায় বলল, ‘ন্যাহ! 

এন্ড্রিয়ানা খুব হাসলো, বলল, ‘তুমি লজ্জা পেলে তোমাকে এতো কিউট লাগে দেখতে।’ 

—‘প্লিজ তুমি আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করো না।’ 

—‘ঠাট্টা করছি না। আচ্ছা, ও কি আমার চেয়ে বেশি সুন্দর?’ 

আরশান প্রশ্নটা শুনে একটু থমকে গেলো। সকাল পৃথিবীর সবকিছুর চাইতে সবচেয়ে বেশি সুন্দর। এমন কি অক্টোবরের চাইতেও! কিন্তু এ মুহূর্তে তার এন্ড্রিয়ানার মুখের দিকে চেয়ে একধরনের মায়া হলো। 

—‘তুমি সুন্দর এ কথা তো তোমাকে অনেকবার বলেছি এন্ড্রি।’ 

—‘তাহলে ভালোবাসলে না কেন?’ 

—‘ভালোবাসা …ভালোবাসা জিনিসটা মনে হয় আমি পারি না।’

—‘পারলে তো!’ 

—‘না পারিনি। আমার খুব খারাপ লাগছিল আজকে। মনে হচ্ছিল তুমি ছাড়া আমার আর কোনো বন্ধু নেই যার সাথে ব্যাপারটা শেয়ার করা যায়। তাই কিছু চিন্তা না করেই তোমার কাছে চলে আসলাম। কিন্তু তুমি যদি এভাবে কষ্ট পাও … বিশ্বাস করো তুমি কষ্ট পাবে জানলে তোমাকে আমি এসব বলতাম না।’ 

—‘তুমি তো এখন একজনকে ভালোবাসো। এখন বুঝবে ভালোবাসলে কষ্ট পেতে হয়।’ 

—‘আমি কষ্ট পেতে চাই না।’ 

—‘চাওয়া না চাওয়ার ওপরে কিছু ডিপেন্ড করে না।’ 

—‘আমি পালাচ্ছি।’ 

—‘কোথায় পালাচ্ছো?’ 

—‘টিকেট বুকিং দেয়া হয়ে গেছে। পরশু দিন যাচ্ছি। ইয়েলো স্টোন।’

—‘কদিনের জন্য?’ 

—‘দশ দিন। এবার আমাকে পুরো মাসের ছুটি দিলো না, দেখেছো?’

—‘দেয়ার মতো অবস্থা নেই। কত কাজ পড়ে আছে।’ 

—‘হুম’ বলে আরশান একটু চুপ করে থাকে। কিছু সময় নীরবে কাটে। তারপর একটা প্রলম্বিত নিশ্বাস ছেড়ে ভারি করুণ গলায় আরশান বলে ওঠে, ‘ওকে ছাড়া আমার কিছুই ভালো লাগছে না। আই থিংঙ্ক আই মিস হার!’ 

২৭

দরজায় ধাক্কা পড়ছে। ফাহাদ চোখ খুলে দেখলো নাবিলা ঘুমোচ্ছে বিছানায়। এক টুকরো কমলা রঙা আদুরে রোদ্দুর এসে পড়েছে ওর চুলে, ডান গালে আর ঠোঁটে। তির তির করে হাওয়ায় কাঁপছে কপালের কাছে পড়ে থাকা একগুচ্ছ চুল। দরজায় ডাকাত পড়েছে। শুয়েছে ওরা একটু আগে। ঘণ্টা খানেক হয়েছে বোধহয়। কে এলো এত সকালে? নিশ্চয়ই পিটার। 

কপাল কুঁচকে মুখে একটা বিরক্তির ছাপ ফেলে দরজা খুললো ফাহাদ। খুলে যা দেখলো তা প্রথম দেখায় ঠিক বিশ্বাস হলো না তার। ঘুম ঘুম চোখদুটো হাতের উল্টো পাশ দিয়ে কচলে নিলো কয়েকবার। চোখ বড় করে তাকালো। বিস্ময়ের সাথে উচ্চারণ করলো শব্দটা, ‘মম!’ 

মম হাসলেন, ‘কী ভেবেছিলে হ্যাঁ? তুমি পালিয়ে থাকবে আর আমি তোমাকে খুঁজে পাবো না?’ 

ফাহাদের মুখখানা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। মুখ নড়ছে না তার। 

—‘অমন ভূত দেখার মতো চমকে উঠলে কেন?’ এটুকু বলে মমের দৃষ্টি ফাহাদকে অতিক্রম করে ঘরের ভেতর গিয়ে পড়ল। বিছানাটা একদম দরজা বরাবর হওয়ায় অনায়াসে দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। 

—‘তোমার ঘরে কে?’ 

ফাহাদ প্রস্তরীভূত হয়ে গেলো। তার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বেরোচ্ছে না।

মম গায়ের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে ফাহাদকে দুহাত দিয়ে ঠেলে সরিয়ে ঘরের ভেতর ঝটিকা প্রবেশ করলেন। 

বিছানায় শোয়া ঘুমন্ত মেয়েটিকে চিনে নিতে তার কয়েক সেকেন্ডের বেশি সময় লাগলো না। 

—‘এই মেয়ে এখানে কী করছে?’ মমের চোখদুটো কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইল। মুখ আগুন লাল। 

নাবিলা ধড়ফড় করে উঠে বসলো। তার সদ্য ঘুম ভাঙা মস্তিষ্ক মূল ঘটনা ধরতে পারলো না তাৎক্ষণিক ভাবে। যখন পারলো তখন বুঝলো যে সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন আর কিছুই করার নেই। 

তার মুখখানা রক্তশূন্য দেখালো। 

ফাহাদের মা কোমরে হাত দিয়ে তার দিকে বিষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে তিনি নাবিলাকে খুনও করে ফেলতে পারেন। 

ফাহাদ এগিয়ে এসে মায়ের হাতটা ধরার চেষ্টা করে বলল, ‘মম, আই ক্যান এক্সপ্লেইন। তুমি একটু মাথা ঠান্ডা করে বসো…’ 

মম হাতটা এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে চিৎকার করে উঠে বললেন, ‘আমি তোমার কোনো কথা শুনতে চাই না। ঘেন্না হচ্ছে আমার তোমার সাথে কথা বলতে। ছিঃ আমার ছেলে হয়ে তুমি এমন কাজ করলে কী করে? যেখানে তোমার অন্য একটা মেয়ের সাথে বিয়ের কথা চলছে!’ 

নাবিলা ভয়ে, অপমানে, লজ্জায় একদম কাদা হয়ে গেলো। বিছানা থেকে উঠতেও ভুলে গেলো সে। নত মুখে পাথরের মতো বসে রইল। নড়তে পারলো না এক চুল পরিমাণ। 

ফাহাদ বলল, ‘মম তুমি ভুল বুঝছ। আমাদের মধ্যে কিছুই হয়নি। নাথিং হ্যাপেন্ড!’ 

মম হাত তুলে ফাহাদকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ফাহাদ আমাকে বোঝাতে এসো না। আমি কচি খুকি না। এসব মেয়েদের আমার চেনা আছে।’ 

নাবিলার চোখে জল চলে আসলো। 

—‘মম এভাবে কথা বলছো কেন? ওর তো কোনো দোষ নেই এখানে।’

মম ক্রোধে ফেটে পড়ে বললেন, ‘ওর কোনো দোষ নেই না? ঠিক আছে সব দোষ তোমার। এখন শোনো তাড়াতাড়ি এই মেয়েকে এখান থেকে বিদায় করো। আমার সাথে আমার আত্মীয়-স্বজন এসেছে। জানাজানি হয়ে গেলে একটা কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। মুখ দেখানোর উপায় থাকবে না কারো কাছে।’ এটুকু বলে নাবিলার দিকে তাকিয়ে বিষঢালা গলায় বললেন, ‘আর তুমি, তোমাকে আমি ভালো মেয়ে বলে জানতাম। আজকে তোমার আসল রূপটা ধরা পড়ল। কেমন ফ্যামিলির মেয়ে তুমি? বাবা মা কিছু শেখায়নি? 

নাবিলা চকিতে তাকালো ফাহাদের মায়ের মুখের দিকে। তার চোখের কোল ভিজে উঠেছে জলে। ঠোঁট কাঁপছে হালকা। সেই অবস্থায় যথেষ্ট দৃঢ় গলায় বলল, ‘বাবা মা’ কে টানছেন কেন? আমাকে নিয়ে যা খুশি বলতে পারেন কিন্তু আমার বাবা মা সম্পর্কে একটা মন্দ কথাও আমি সহ্য করবো না।’ 

কথাটা বলে শেষ করে নাবিলা চট করে উঠে পড়ে বেরিয়ে আসলো ঘর থেকে। ফাহাদ হতাশার একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়লো। মাথায় হাত দিয়ে ধপ করে বসে পড়ল বিছানায়। 

মম চাপা গলায় বললেন, ‘তুমি এটা কোনো কাজ করলে? সকাল কী ভাববে? এই ঘটনার পর কি মেয়েটা তোমাকে বিয়ে করতে রাজি হবে? কেন চুনকালি মাখলে আমার মুখে?’ 

ফাহাদ কিছুই বলল না। স্থবির হয়ে বসে রইল শুধু। 

ড্যাড আসলেন ঘরে। চিন্তিত গলায় বললেন,’ কী ব্যাপার কী হয়েছে?’

মম চাপা গলায় বললেন, ‘পরে বলবো। এখন গেস্ট আছে সাথে। কারো কানে কোনো কথা যাওয়া যাবে না।’ 

সকাল দেখলো নাবিলা ফাহাদের ঘর থেকে আতঙ্কগ্রস্ত কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে বেরিয়ে আসছে। বুকটা ধক করে উঠল তার। দৌড়ে ছুটে গেলো নাবিলার কাছে। 

—‘নাবিলা! কী হয়েছে? তুই এমন করছিস কেন?’ 

নাবিলা দাড়ালো না। সকালের কথা যেন তার কানেই ঢোকেনি। করিডোর দিয়ে হেঁটে এসে সোজা সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলো নিচে। নিচে বসার ঘরে লোকজন গিজগিজ করছে। নাবিলা নিচে নামতেই প্রায় দশ বারো জন মানুষ একত্রে মুখ তুলে তাকালো তার দিকে। এতো এতো দৃষ্টির সামনে নাবিলা আরো বেশি কুঁকড়ে গেলো। এক ছুটে চলে আসলো বাড়ির বাইরে। 

সকালও আসলো নাবিলার পেছন পেছন। বাইরে তখন রোদ ঝকঝকে চমৎকার একটি দিন। নীল আকাশে সাদা তুলতুলে মেঘ ইচ্ছেমতো উড়ে বেড়াচ্ছে। বাতাস স্নিগ্ধ। 

নাবিলা মূর্তির সামনের বেদিতে এসে বসলো। নিরিবিলিতে আসবার পরে অনেকক্ষণ ধরে আটকে রাখা কান্নাটা বাঁধ ভাঙলো। 

সকাল হাহাকার করে উঠল, ‘একী! কী হয়েছে দোস্ত? কী হয়েছে বল আমাকে?’ 

নাবিলা কথা বলতে পারছে না। কান্নার দমকে তার গা কেঁপে কেঁপে উঠছে। 

সকাল নাবিলার হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বলল, ‘লক্ষ্মী মেয়ে। বল আমাকে কী হয়েছে? ফাহাদ কিছু বলেছে তোকে? কার এতো সাহস? কে আমার বন্ধুকে কষ্ট দিয়েছে?’ 

নাবিলা চোখের জল মুছলো। কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে নিজেকে 

কিছুটা ধাতস্থ করার চেষ্টা করলো। তারপর কাঁপা গলায় বলল, 

—‘একটা বাজে ব্যাপার ঘটে গেছেরে শেহজাদী।’ 

সকালের বুক কেঁপে উঠল, ‘কী হয়েছে?’ 

—‘প্রথম থেকে শুনতে হবে তোকে। ধৈর্য ধরে শোন।’ 

—‘হ্যাঁ বল।’ 

—‘গতকাল পিকনিকে তোর আর আরশানের ব্যাপারটা টের পেয়ে গিয়েছিল ফাহাদ।’ 

—‘বলছিস কী?’ সকালের নিশ্বাস আটকে গেলো। 

—‘ঠিক বলছি।’ 

—‘কিন্তু টের পাওয়ার মতো কী আছে? আমাদের ভেতর তো কিছু হয়নি এখনো!’ 

—‘তা হয়নি কিন্তু তোরা যে একজন আরেকজনকে চাস সেটা আশেপাশের লোকে খুব ভালো মতোই বুঝতে পারে। লোকে বেকুব না।’ 

সকাল শিউরে উঠল। কী সাংঘাতিক কথা! সে কি তবে ধরা পড়ে গেছে? ছিঃ, কী লজ্জা! কী লজ্জা! সকাল আর কিচ্ছু ভাবতে পারছিল না। কোনো রকমে বলল, 

—‘আমি নাহয় আরশানকে পছন্দ করি। কিন্তু আরশান?’ 

—‘আরশান তোর জন্য মরে যাচ্ছে! এই সত্যটা তোর মতো গাধী না বুঝলেও লোকে ঠিকই বুঝতে পারছে।’

কথাটা শুনে এতো উথাল-পাতাল করা ঝামেলার মধ্যেও সকালকে একটা ভালোলাগার হাওয়া কোত্থেকে যেন আচমকা এসে ছুঁয়ে গেলো। 

নাবিলা বলল, ‘সে যাই হোক, ফাহাদ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে খুবই আপসেট হয়ে গিয়েছিল। আমাকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলো আমি কি এ ব্যাপারে কিছু জানি কিনা। বললাম না আমি কিছুই জানি না।’ 

ভয়ে সকালের গলা শুকিয়ে গেছে। ফ্যাকাশে ভাবে সে বলল, ‘ফাহাদ কি আমার ওপরে রাগ করেছে?’ 

—‘করেছে তো বটেই। সে এমনটাও ভাবছে যে তুই ওকে ঠকিয়েছিস। তো সেইরকম হাইপার অবস্থায় সে পিকনিক স্পট থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। আমার মাথায় চট করে চিন্তা আসলো যে এই ছেলে যদি এখনই ওর বাবা মাকে কিছু বলে দেয় তো সর্বনাশ হয়ে যাবে। কারণ, তোদের মধ্যে এখনো কিছু শুরুই হয় নাই। আর তাছাড়া আরশানকে কেন জানি আমার খুব সেনসিটিভ মনে হয়। এই ব্যাপারটা ওর কানে গেলে ও হয়তো তোর ব্যাপারে পিছিয়েও যেতে পারে। তাই আমার মনে হচ্ছিল কোনো ভাবেই কথাটা অন্য কারো কানে যাওয়া যাবে না। তো আমিও ফাহাদের সাথে উঠে বসলাম গাড়িতে…’ 

বাকি ঘটনাটা একটু সময় নিয়ে গুছিয়ে গুছিয়ে বলল নাবিলা। যথেষ্ট গুছিয়ে এবং বিস্তারিত ভাবেই বলার চেষ্টা করলো। কারণ, তার কাছে শুধুমাত্র সকালই এখন গুরুত্বপূর্ণ। অন্য কে কী ভাবলো তাতে তার কিচ্ছু যায় আসে না। আজকের পর থেকে এ পরিবারের সাথে তার কোনো যোগাযোগ থাকবে না। প্রয়োজনও নেই। অতএব সমাপ্তিটা টানার আগে যার মাধ্যমে এই মানুষগুলোর সাথে তার পরিচয় সেই প্রধান ব্যক্তিটির কাছে নিজেকে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরাটাই জরুরি বলে মনে করে সে। 

সকাল বিস্মিত ভাবে বলল, ‘চাচি এরকম ভাবে বলতে পারলো? 

—‘বলল তো! তবে এ কথা ঠিক ব্যাপারটা ভীষণ অকওয়ার্ড ছিল। যেকোনো বাঙালি সাধারণ মা এ পরিস্থিতিতে এরকম প্রতিক্রিয়াই দেখাবে। সব কপালের দোষ। কে জানতো ওই মহিলা সাত-সকালে এসে হাজির হবে?’ 

ফাহাদ নিঃশব্দে এসে দাড়ালো ওদের পাশে। ফাহাদকে দেখে সকাল আড়ষ্ট হয়ে গেল। এখন ফাহাদ ব্যাপারটা জেনে গেছে। সকাল অনেক বেশি নিচে নেমে গেছে ওর চোখে। ফাহাদের মুখোমুখি দাড়ানোর সাহস পাচ্ছে না সে। একটা প্রবল অপরাধবোধ আচ্ছন্ন করে রেখেছে তাকে। 

ফাহাদের চোখে মুখে চাপা উদ্বেগ খেলছে। সে সকালের দিকে তাকালো না। সরাসরি নাবিলাকে বলল, ‘নাবিলা একটু কথা বলতে পারি তোমার সাথে?’ 

সকাল জায়গাটা থেকে সরে আসল। মনে হচ্ছিল ওদের এ মুহূর্তে একটু প্রাইভেসি দরকার। 

সকাল চলে গেলে ফাহাদ বসল নাবিলার পাশে। নাবিলা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে ছিল। চোখ দূরের দিকে। 

ওর ওই বিষণ্ন মূর্তি দেখে ফাহাদের কেমন যেন একটু ভয় করতে লাগল। কথা শুরু করার সাহস হচ্ছে না তার। 

—‘নাবিলা!’ 

—‘বল।’ ক্ষীণ স্বরে বলল নাবিলা মুখ ঘুরিয়ে রেখেই। 

—‘মমের হয়ে আমি তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।’ 

নাবিলা এবার তাকালো। ওর চোখ দুটি একটু ফোলা। নাক হালকা লাল। 

—‘তোমার ক্ষমা চাওয়ার কিছু নেই ফাহাদ। তোমার কোনো দোষ নেই। আমি তোমার সাথে জোর করে এসেছি এ জায়গায়। আর তাছাড়া তোমার ঘরে, তোমার বিছানায় ঘুমিয়ে পড়াটা আমার একেবারেই উচিত হয়নি। দোষ আমার।’ 

—‘এখানে দোষের কিছু নেই। তুমি ভয় পাচ্ছিলে বলে এসেছিলে। শখ করে তো আসোনি।’ 

নাবিলা আবার মুখ ঘুরিয়ে নিলো। যেন বোঝাতে চাইলো যে এই কথোপকথনের সমাপ্তি হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। একটু সময় ফাহাদও কোনো কথা বলল না। ছোট একটা বিরতির পর সে বলল, ‘তাহলে …তাহলে নাবিলা আমরা ঠিক আছি?’ 

নাবিলা তাকালো। ফাহাদের চোখে চেয়ে বলল, ‘ঠিক থাকা না থাকার ব্যাপারটা কী? বুঝলাম না।’ 

ফাহাদ একটু অপ্রস্তুত ভাবে বলল, ‘না মানে আমার ওপরে তোমার কোনো রাগ নেই তো?’ 

—‘প্রশ্নই আসে না।’ 

—‘তোমাকে দেখে কিন্তু খুব আপসেট মনে হচ্ছে।’ 

—‘ঠিক হয়ে যাবে।’ বলে নাবিলা উঠে দাড়ালো। 

—‘আরেকটু বসবে?’ করুণ শোনালো.ফাহাদের গলা। 

—‘না। ভালো দেখায় না। তোমার মা দেখলে মাইন্ড করবেন।’ 

ফাহাদ উঠে দাড়ালো বসা থেকে, বলল, ‘তোমাকে একটা কথা বলার ছিল।’ 

নাবিলা তাকালো ওর চোখের দিকে, বলল, ‘বল।’ 

ফাহাদ একটু হাসার চেষ্টা করলো, ‘অনেক ধন্যবাদ তোমাকে। গতকাল আমাকে সময় দেয়ার জন্যে। তুমি যদি না থাকতে পাশে, তাহলে একা একা আমার আরো অনেক বেশি কষ্ট হতো। জানি না হয়তো রাগ আর হতাশায় খারাপ কিছুও করে ফেলতে পারতাম।’ 

—‘নো প্রব্লেম।’ নাবিলা বলল আলতো ভাবে। 

—‘আর ভোর দেখা ব্যাপারটা যে এতো সুন্দর এটাও আমি আগে জানতাম না। অতএব তোমার আরো একটি ধন্যবাদ প্ৰাপ্য।’ 

হাসলো নাবিলা। কিছু বলল না। তারপর দুজনে যখন দুজনের চোখের দিকে চাইলো, মনের গভীরে টের পেলো এই রোদ ঝিকিমিকি আশ্চর্য সুন্দর সকাল বেলাটায় মাত্র যেন খুব অন্যরকম কিছু একটা ঘটে গেলো। অন্য কেউ কিছু জানলো না, বুঝলো না। শুধু ঝিরঝিরে পাগল করা হাওয়াটা কোনো এক অলৌকিক উপায়ে ওদের মনের গভীরে জানান দিয়ে গেলো, কিছু একটা ঘটে গেছে, বদলে গেছে। দিনগুলো আর আগের মতো রইল না। 

২৮

ফিলাডেলফিয়ার বাড়িতে খুব বেশিক্ষণ থাকা হলো না। চাচির মুড অফ। এই অফ মুড নিয়েই তিনি রান্না করলেন। নাবিলা সারাদিন চাচির চোখ বাঁচিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে থাকলো। এমন কি খাবার সময়টাতেও ধরা দিলো না সে। সকাল ওর জন্য প্লেটে করে ভাত তরকারি বেড়ে নিয়ে দিয়ে আসলো অন্য ঘরে। 

সকালের মনটাও বেশ খারাপ। আরশান সেই যে গেলো গতকাল রাতে, আর কোনো খবর নেই। মানুষটাকে বোঝে না সে। ভালো যদি বেসেই থাকে তাহলে কেন এই অবহেলা? কেন এই পালিয়ে বেড়ানো? এমন ভীতু পুরুষ মানুষ সে এ জীবনে আর দ্বিতীয়টি দেখেনি। 

খাওয়া-দাওয়ার পর ফাহাদকে একলা পাওয়া গেলো বাড়ির সামনের উঠোনে। সকাল নিভৃতে গিয়ে দাড়ালো ওর পাশে। আস্তে করে বলল, 

—‘ফাহাদ!’ 

ফাহাদ তাকালো নির্বিকার ভাবে। 

—‘বলো।’ 

—‘তোমার সাথে একটু কথা ছিল।’ নার্ভাস দেখাচ্ছিল সকালকে।

—‘বলে ফেলো।’ 

—‘আমি দুঃখিত।’ 

—‘কিসের জন্যে?’ 

 —‘না মানে। যা ঘটে গেলো। আসলে …আসলে আমি খুবই সরি। দেখো এসবের ওপরে তো মানুষের কোনো হাত নেই তাই না?’ 

গতরাতে ফাহাদ ভেবে রেখেছিল সকালের মুখোমুখি সে কোনোদিন হবে না। আর যদি হয়ও তাহলে ঠিক ঠিক মুখের ওপর বলে দেবে ‘তুমি একটা হিপোক্রেট।’ কিন্তু কী আশ্চর্য! এ মুহূর্তে তার সকালের ওপর একটুও রাগ হচ্ছে না, ঘেন্না হচ্ছে না। বরং কেমন একটু কৃতজ্ঞ ভাব হচ্ছে ওর ওপর। কেন এই কৃতজ্ঞতা তা ফাহাদ এখনো স্পষ্ট জানে না। হয়তো জেনে যাবে খুব শীঘ্রই। সারারাত ধরে অপমানের একটা তীব্র যন্ত্রণা বুকের মধ্যে চেপে বসে ছিল সে। এখন এই মিষ্টি সকালবেলাটায় সেই অপমানের বিন্দু মাত্র রেশও লেগে নেই ভেতরে। তার বদলে একটা শান্তির হাওয়া বইছে মনের অলিন্দে। 

সে সকালের দিকে চেয়ে প্রসন্ন হাসলো, ‘দুঃখ পাবার কিছু নেই।

—‘তুমি আমাকে ক্ষমা করেছো তো?’ 

—‘হ্যাঁ করেছি।’ 

সকাল হাসলো। স্বস্তির হাসি। ফাহাদ বলল, ‘আচ্ছা শোনো, ভাই কি ব্যাপারটা জানে? মানে তোমার আর আমার বিয়ের ব্যাপারে একটা কথা চলছিল, এ ধরনের কিছু কি ওর কানে গেছে?’ 

—‘না। আমি তো কিছু বলিনি।’ 

—‘ভালো করেছো। বলার দরকারও নেই। এই তথ্যটা ওর অজানাই থাকুক।’

২৯ 

বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে গেলো। সকাল পৌঁছনো মাত্ৰ গলা বাড়িয়ে গ্যারেজটা দেখলো। না, আরশান আসেনি এখনো। ওর গাড়ি নেই। মনটা খারাপ হয়ে গেলো। কখন ফিরবে ছেলেটা? 

ফিরলো আরো ঘণ্টা দেড়েক পরে। সকাল কিচেনে খাবার টেবিলে বসে শশা কাটছিল। ওর পাশে অনিক বসে আছে ল্যাপটপ নিয়ে। অনিকটা খুব বেশি কথা বলছে। সকালের কিছুই ভালো লাগছে না। কোনো কথা সে মন দিয়ে শুনতে পারছে না, বলতে পারছে না। সকালের এই অন্যমনস্কতা অনিক বেকুবটা টের পাচ্ছে না। অনর্গল বক বক করে যাচ্ছে। টেবিলে চাচা চাচি আর চাচির বোনও বসে আছেন। চা খেতে খেতে গল্প করছেন তারা। 

অনিক বলছিলো, ‘তুমি কি একবার আমার সাথে আমার ইউনিভার্সিটি ঘুরে আসবে? গেলে পারতে।’ 

খুবই ভালো কথা। সকাল ওর কথায় সায় দিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। কিন্ত তার মুখের কথা মুখেই রয়ে গেলো। আটকে গেলো মাঝপথে। আরশান হেঁটে আসছে। তার চুল এলোমেলো। চোখ কিঞ্চিৎ লালচে। দৃষ্টি অস্থির। 

সকাল থমকে গেলো। ওর থমকানো দৃষ্টির পিছু ধরে অনিকও তাকালো আরশানের দিকে। তাকালো চাচা চাচি, চাচির বোন। 

আরশান অন্য কোনোদিকে তাকালো না। শুধু অনিককে একবার চোখা চোখে আপাদমস্তক দেখে নিলো। তারপর সরাসরি সকালের চোখে চেয়ে ভরাট গলায় বলল, ‘কালকে আপনি কী করছেন?’ 

সকাল অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। আমতা আমতা করে বলল, ‘কিছু তো করছি না।’ 

আরশান টেবিলের ওপর রাখা ফলের ঝুড়ি থেকে একটা আপেল তুলে নিলো। আপেলটাকে শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে আবার হাত বাড়িয়ে লুফে নিয়ে ড্যাম কেয়ার ভাবে বলল, ‘কালকে তাহলে আমার সাথে লাঞ্চ করছেন। শার্প এট টুয়েলভ। রেডি থাকবেন।’

সকালের সারা শরীরে একটা কাঁপন ছড়িয়ে পড়ল। চোখ নামিয়ে নিলো সে। 

কথাটা বলেই আরশান ঘুরে দাড়ালো। কয়েক পা এগিয়ে আবার পেছন ফিরে তাকালো, বলল, ‘আর হ্যাঁ। আপনি শাড়ি পরেন? সাদা শাড়ি আছে আপনার?’ 

সকাল মাটির সাথে মিশে যেতে যেতে বলল, ‘আছে।’ 

—‘অসাম!’ বলে আরশান ফিরে চললো। 

সকাল গলার সাথে চিবুক লাগিয়ে শসার ওপর ছুরি চালাতে থাকলো। ফিরে আসতে আসতে আরশান দাঁত দিয়ে জিব কাটলো। কী করে বসলো সে হুট করে? এভাবে সবার সামনে? নিজের গালে ঠাস করে একটা চড় বসাতে ইচ্ছে করছে। পালাবে বলে ঠিক করে রেখেছিল। কিন্তু পালাতে গিয়ে যে আরো বেশি করে ধরা পড়ে যাবে এমনটা জানলে মেয়েটার সামনেই যেতো না আজ। 

ইশ আরশানটা …স্মার্ট, বিচক্ষণ, অতিশয় সুদর্শন, নাক উঁচু, অহংকারী আরশানটা হঠাৎ কেমন ঝুপ করে বোকা মানব বনে গেলো, সাধারণ এক বাঙালি মেয়ের জন্যে। সাধারণ …সত্যিই সাধারণ কি সে? সাধারণ হলে কি আশেপাশের অসংখ্য নজরকাড়া সুন্দরীদের মধ্যে শুধুমাত্র ওই একটা মুখ আরশানের বুকের গভীরে এমন ভাবে গেঁথে গেলো? ঘরে এসে গরম জলের নিচে দাঁড়িয়ে শাওয়ার নিতে নিতে আরশানের মনে হলো, যা হবার ভালোই হয়েছে। এখন সকাল তার কথার দাম দিলেই হয়। যদি না দেয় …সেই অপমান আরশান সইতে পারবে তো? 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *