২০
—‘সকাল তো আমার জন্য ছিল। তাই না? আমি কেন এভাবে প্রতারিত হলাম? আমার দোষটা কোথায়?’
অবিন্যস্ত ভাবে কথাগুলো বলল ফাহাদ। তার চোখে মুখে একটা ভাংচুরের পূর্বাভাস।
নাবিলা তটস্থ হয়ে বলল, ‘তুমি যা ভাবছ ব্যাপারটা তা নয় ফাহাদ। সকাল সেরকম মেয়েই না!’
—‘আমিও তো তাই ভেবেছিলাম। আমি ভেবেছিলাম ও অনেক অন্যরকম। অনেক ইনোসেন্ট। অনেক পিওর।’
—‘হ্যাঁ। সকাল ঠিক তাই। আর তাছাড়া সেতো তোমার সাথে প্রেমের অভিনয় করেনি তাই না? তুমিও ভালোবাসোনি ওকে। তাহলে প্রতারণার ব্যাপারটা আসছে কোথেকে?’ দৃঢ় ভাবে বলল নাবিলা।
ফাহাদের বিস্ময়ের ঘোরটা তখনো কাটেনি।
—‘আর আমার ভাই? হাউ ক্যুড হি ডু দিস টু মি? আমার যে মেয়েটার সাথে বিয়ের কথা চলছে সেই মেয়েটাকে ও কিভাবে স্টক করলো?’
—‘লিসেন ফাহাদ। আরশান ব্যাপারটা জানে না। তুমি কি কখনো বলেছো ওকে? যে সকালের সাথে তোমার বিয়ের কথা চলছে?’
—‘বলিনি, একবার বলতে গিয়েও শেষমেশ বলিনি। আর এখন… এখন আর বলাবলি করে কোনো লাভ নেই।
—‘তুমি এতো ভেঙে পড়ো না। আমার মনে হয় কোথাও কিছু একটা ভুল হচ্ছে। তুমি ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখো।
ফাহাদ মাথা নেড়ে বলল, ‘ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করার কিছু নেই। যা বোঝার ঠিকই বুঝেছি আমি। শোনো, আমি যাচ্ছি। একা থাকতে চাই। কেউ কোনো প্রশ্ন করলে বলো হঠাৎ একটা জরুরি কাজ পড়ে গেছে।’
কথাটা বলে ফাহাদ ঘুরে দাড়াতেই নাবিলা পেছন থেকে খামচে ধরল ওর হাত, ‘কোথায় যাচ্ছো তুমি?’
—‘জানি না।’
—‘তোমার মাথা ঠিক মতো কাজ করছে না ফাহাদ! এ অবস্থায় কোথাও যেও না তুমি প্লিজ।’
ফাহাদ নাবিলার হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘যেতে হবে। এখানে থাকতে পারছি না। দম আটকে আসছে আমার।’
বলে ফাহাদ আর দাড়ালো না। নাবিলাও ছুটলো ওর পেছন পেছন। গাড়ির কাছে চলে আসার পর ফাহাদ আগুন গলায় বলল, ‘তোমার কী চাই? কেন ফলো করছ আমাকে?’
নাবিলা অসহায় ভাবে বলল, ‘তুমি ভুল বুঝছো ফাহাদ! আমি তোমাকে বোঝাতে চাইছি যে তুমি ভুল বুঝছ।’
ফাহাদ সরু চোখে বলল, ‘তুমিও কি এই ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত আছো নাকি? তোমরা সবাই মিলে জোট বেঁধে আমাকে ঠকাচ্ছ?’
—‘কেউ তোমাকে ঠকাচ্ছে না। তুমি ঠান্ডা মাথায় ভাবলেই বুঝতে পারবে যে কেউ তোমাকে ঠকায়নি।’
ফাহাদ হ্যাচকা টানে গায়ের সব শক্তি দিয়ে গাড়ির দরজা খুললো, বলল, ‘আমি আর কোনো কথা শুনতে চাইছি না। লিভ মি এলোন।
ফাহাদ গাড়িতে উঠে বসার সঙ্গে সঙ্গে নাবিলাও চট করে বসে পড়ল ড্রাইভারের পাশের গদিতে।
—‘কী চাই তোমার?’ ফাহাদ ক্ষুদ্ধ হয়ে প্রশ্ন করল।
নাবিলা শান্ত ভাবে বলল, ‘আমিও যাবো তোমার সাথে।’
—‘নাবিলা, সিরিয়াসলি তুমি আমাকে বিরক্ত করছ!”
—‘বেশ করছি!’
ফাহাদ একটা বড় রকমের শ্বাস ছেড়ে বলল, ‘তুমি কিন্তু বিপদে পড়বে নাবিলা। আমি আজ সারাদিনে আর বাড়ি ফিরছি না।’
—‘এত পক পক করো না।’
—‘ঠিক আছে, তাহলে আমি যেখানেই যাই না কেন, তুমি আমার সঙ্গে যাবে। আমি জাহান্নামে গেলে, তুমিও জাহান্নামে যাবে।’
নাবিলা মুখ বাঁকা করে বলল, ‘জাহান্নামে কেন যাবে?’
—‘কারণ, ওখানেই এখন আমার যেতে মন চাইছে। এখনও সময় আছে। গাড়ি থেকে নেমে যাও!’
—‘না নামবো না।’
ফাহাদ আর কথা না বাড়িয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো। গাড়িটা প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে একটা ধাক্কার সাথে যাত্রা শুরু করলো। স্পিড উঠতে থাকলো। বিশ, তিরিশ, চল্লিশ তারপর একধাপে একশ।
ফাহাদের মুখখানা রাগে থমথম করছে। তার নাক মুখ শক্ত। নাবিলা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ওকে লক্ষ করলো। তারপর ভারি সাবধানে বলল,
—‘ফাহাদ শোনো, আমার মনে হয় ব্যাপারটা আরেকটু খতিয়ে দেখা উচিত আমাদের। তুমি এখনই কাউকে কিছু বোলো না, কেমন?
ফাহাদ ঝড়ের বেগে ঘুরে তাকালো ওর দিকে, ‘মানে? কাকে কী বলবো আমি?’
—‘না মানে তোমার মা বাবার সাথে এখনই কিছু বলো না। তুমি তো বিষয়টা নিয়ে এখনো নিশ্চিত নও তাই না? হতে পারে কোথাও কোনো ভুল হচ্ছে।’
—‘কোথাও কোনো ভুল হচ্ছে না। আমি আমার ভাইয়ের চোখে আজকে সকালের জন্য যা দেখেছি তা এর আগে কখনো কারো জন্য দেখিনি। ইট ওয়াজ টোটালি নিউ এন্ড স্পেশাল। আর সকালও তো… তুমি বোঝো না?’
সেই মুহূর্তে প্রথমবারের মতো ফাহাদের জন্য ভারি মন খারাপ হল নাবিলার। ওর সঙ্গে এই গাড়ি অবধি সে এসেছে করুণার বশে এমনটা কিন্তু নয়। এসেছে এ কারণে যে এখনই যেন ফাহাদ তার বাবা মার সাথে সকাল, আরশানের ব্যাপারটা শেয়ার করে না ফেলে। এই বিষয়টি ফাহাদকে বুঝিয়ে বলা খুব জরুরি যে কথাগুলো কোনোভাবেই এ মুহূর্তে ফাহাদের আম্মার কানে দেয়া যাবে না। রাগের মাথায় হুট করে কোনও অঘটন ঘটিয়ে বসতে পারেন তিনি। আর ওদিকে আরশান, সকাল এখন অবধি নিজেদের অনুভূতি সম্পর্কে সুনিশ্চিত নয়। অতএব বাড়ির বড়দের কানে কথাটা যাবার মতো সময় এখনো আসেনি।
কিন্তু এখন ফাহাদের করুণ মুখখানা দেখে তার খারাপ লাগছে।
ফাহাদ ড্রাইভ করা অবস্থায় নাবিলার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, ‘আমি কারুকেই কিছু বলবো না। বাই দ্যা ওয়ে, তুমি কি আমার সাথে এসেছো এই কারণে যে আমি কাউকে কিছু বলতে গেলে তুমি আমাকে আটকাবে?
ওর স্থির কণ্ঠের অনুসন্ধানী প্রশ্নটা নাবিলাকে একটু ভড়কে দিল। সে তৎক্ষণাৎ কোনও উত্তর দিতে পারল না।
ফাহাদ চোখ ঘুরিয়ে নিলো সম্মুখে, বলল, ‘যদি এ কারণে তুমি আমার সাথে এসে থাকো। তাহলে আমি তোমাকে এশিওর করছি যে আমি খবরটা লিক করব না। তুমি এখন নেমে যেতে পারো।’
—‘তুমি এরকম করছো কেন আমার সাথে?’
—‘বিকজ নাবিলা আই এম হ্যাভিং আ রাফ ডে, এন্ড আই রিয়েলি নিড টু বি এলোন।’
—‘তাই বলে তুমি এমন মিসবিহেভ করবে?
—‘আমি মিসবিহেভ করছি?’
—‘তা নয় তো কী?’
—‘ওকে, ইউ নো হোয়াট। স্টে উইদ মি। বাট ডু নট টক। ওকে? একটা কথাও বলবে না।’
—‘কথা বলার মুড নেই এখন।’
—‘গ্রেট।’
২১
সকাল ছুটতে ছুটতে চাচিদের দলটার কাছাকাছি চলে এসেছিল। চাচি ওকে শক্ত করে দু’ হাত দিয়ে ধরে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘এই মেয়ে তোমার কী হয়েছে?’
সকালের শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। কাঁপছে তার ঠোঁট, কাঁপছে চোখের পাতা। সে কোনো কথা বলতে পারছে না। এ দৃশ্যটা দেখার আগে তার মৃত্যু কেন হলো না? এর চেয়ে তো মরণ ভালো ছিল। এই বিশেষ ঘটনাটি কেন তার চোখের সামনেই ঘটতে হলো? কত কিছু তো ঘটে যাচ্ছে এ পৃথিবীতে প্রতি নিয়ত তার চোখের আড়ালে। এই ঘটনাটিও কি আড়ালে সংগঠিত হতে পারতো না? এতটুকু করুণা কি বিধাতা করতে পারতেন না তার ওপরে?
সকালকে অমন নির্বাক চেয়ে থাকতে দেখে চাচি উদ্বেলিত হয়ে বললেন, ‘এমন করছো কেন? কী হয়েছে বলো?’
চাচির বান্ধবীটি তখনকার মতো বাঁচিয়ে দিলেন সকালকে। পেছন থেকে চাচিকে ডেকে বললেন, ‘তোমার ফিশ বারবিকিউ মনে হয় হয়ে এলো। এসে দেখে যাও।’
চাচি সকালকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘মা তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?’
সকাল এবার কোনো রকমে বলল, ‘জি চাচি। একটু খারাপ লাগছে। পানি খাবো।’
চাচি ওকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বললেন, ‘এসো, পানি দিচ্ছি তোমাকে।’
.
সকাল জায়গাটা থেকে প্রস্থান করা মাত্র আরশানের মাথায় যে ভাবনাটা প্রথমেই খেলে গেলো তা হলো, দৃশ্যটা কি সকাল দেখে ফেলেছে? দেখে ফেললে মেয়েটা ঠিক কী ভাবলো তার সম্পর্কে?
চিন্তাটা মাথায় নিয়ে বিবশ হয়ে মূর্তির মতো অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল সে। তার ভেতরটায় একটা যুক্তিহীন তোলপাড় হচ্ছে। এন্ড্রিয়ানা মাত্র যে কথাগুলো বলে গেলো ঠিক এরকমই কিছু একটার ইঙ্গিত সেদিন মেকানিক হোজেও দিয়েছিল। হোজের কথা সে পাত্তা দেয়নি। কিন্তু এন্ডিয়ানা অনর্থক যুক্তিহীন কথা বলার মতো মেয়ে নয়।
এমন অপবাদ তার জীবনে এই প্রথম। অপবাদ, হ্যাঁ অপবাদ বলেই মনে হচ্ছে তার এ মুহূর্তে ব্যাপারটাকে। সে তো কোনো বাঁধনে জড়াতে চায়নি। সে জানে পৃথিবীতে মানুষে মানুষে বন্ধন বলে কিছু নেই। সত্যিকারের ভালোবাসা বা মনের টান বলে কিছু নেই। যদি থাকতো তাহলে তার স্বীয় মা কখনো তাকে শিশু অবস্থায় ফেলে রেখে পালিয়ে যেতে পারতো না। তাকে তার গর্ভধারিণী, জন্মদাত্রী মা’ ই ভালোবাসতে পারেনি। অপর লোকে কী করে বাসবে?
মেয়েদেরকে সে বিশ্বাস করে না। মেয়েরা বিশ্বাসহন্ত্রী।
এ কথা ঠিক, একটা সুপ্ত, চাপা অপেক্ষা তার ভেতরেও ছিল। আশা ছিল একদিন কোনো মেয়েকে মন থেকে সত্যিই ভালো লাগবে। আটাশটা বছর নেহাৎ কম নয়। অনেক অনেকগুলো দিন কেটে গেছে এই অপেক্ষায়। কোনো নারীর সাথে তার শারীরিক বা মানসিক কোনো রকম সম্পর্কই আজ অবধি গড়ে ওঠেনি। কাছের বন্ধু-বান্ধবরা যারা ব্যাপারটা জানে তারা তাকে ডাকে এবনরম্যাল। বছর দেড়েক আগে নিজের এই দুর্নাম ঘুচানোর জন্য একটি মেয়েকে কল করে ডেকে এনেছিল বাসায়। মেয়েটির বয়স উনিশ কি বিশ হবে। চেহারা মায়া মায়া, শারীরিক গঠনও চমৎকার। কিন্তু কোনো সূচনা বা কথাবার্তা ছাড়াই মেয়েটি যখন শুরুতেই কর্তব্য পালন করতে ওর শরীরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল তখন আচমকা তার দম আটকে আসার উপক্রম হলো। কোনো রকম মানসিক সংযোগ ছাড়া কী করে একটা মানুষের সাথে শারীরিক সংযোগ স্থাপন করা যায় তা কিছুতেই মাথায় ঢুকলো না। সেখানেই থেমে গিয়েছিল। মেয়েটার টাকা পয়সা মিটিয়ে দিয়ে বিদায় করে দিয়েছিল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। এরপর থেকে তার মোটামোটি একটা ধারণা হয়ে গেছে যে এসব তার দ্বারা হবে না। সে বাস্তবিকই একজন এবনরম্যাল, অস্বাভাবিক মানুষ। স্বাভাবিক হবেই বা কী করে? প্রতিটি স্বাভাবিক মানুষের একজন সত্যিকারের মা থাকে। সবার মা আজীবন পাশে না থাকলেও মায়ের স্মৃতিটুকু অন্তত থাকে। তার তো কিছুই নেই। প্রকৃতি তাকে অস্বাভাবিকদের দলে ফেলে রেখেছে সেই সূচনালগ্ন থেকেই।
এন্ড্রিয়ানা মেয়েটা খুব ভালো। বন্ধু হিসেবে চমৎকার। বুদ্ধিমতি, সুন্দরী, বাস্তব জ্ঞান সম্পন্ন। তার হৃদয়বত্তায় বিস্তারতা আছে। ভেবেছিল একদিন হয়তো ওকেই ভালোবাসবে। চেয়েছিলও মনে প্রাণে। কিন্তু সারাক্ষণ ভেতরে ভেতরে একটা নারী ভীতি কাজ করে বলেই হয়তো ব্যাটে বলে লাগছিল না। ভালোবাসতেই ভয় করতো। মনে হতো ভালোবেসে ফেলার পরে যদি ভালোবাসার মানুষটা তাকে ধোঁকা দিয়ে ছেড়ে চলে যায়? তখন সে কী করবে?
আজকে এন্ড্রিয়ানা যা বলে গেলো, তার পরে…আরশান জানে না। জানতে চায় না। শুধু জানে বাঁধনে জড়াতে চায় না সে। বন্ধন মানেই দুর্বলতা। বন্ধন গড়া মানেই বন্ধন ভাঙার আশঙ্কা। রক্তের সম্পর্কই টেকে না। মনের সম্পর্ক টিকে থাকার প্রশ্নই আসে না।
ভাবতে ভাবতে এলোমেলো পায়ে হেঁটে এগিয়ে যাচ্ছিল সে। একটু দূরে বেঞ্চিতে বাবা বসে আছেন। বাবার পাশে তার স্ত্রী। বাবা কি এই রমণীটিকে ভালোবাসে? ঠিক কতটা ভালোবাসে? তার জন্মদাত্রী নারীটি এই সহজ, সাধারণ, নির্ভেজাল মানুষটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল নর্দমার কীটের মতো। এরপর মানুষটা আবার সাহস করে আরেক নারীর সাথে ঘর বেঁধেছে। এতো সাহস কী করে হয় লোকটার? এই রমণীটিও যে তাকে যেকোনো মুহূর্তে ছেড়ে চলে যাবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়? বাবার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আজ তার একটা কথা জানতে খুব ইচ্ছে হয়। চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়, বাবা আপনার ভয় করে না? এতো সাহস কোত্থেকে পান?
কাছাকাছি যেতেই মাদার বললেন, ‘এসো তোমরা, খাবার রেডি। বাকি সব কোথায়? ফাহাদ কোথায়?’
আরশানের কাছে উত্তর নেই। উত্তর দেবার চেষ্টাও করলো না সে। ধীরে ধীরে হেঁটে বাবার পাশে গিয়ে বসলো। তার চোখে মুখে একটা থম থমে চাপা উদ্বেগ খেলা করছে। চোখের দৃষ্টি অস্থির। এই বেঞ্চেরই শেষ মাথায় সকাল বসে আছে। দেখেছে আরশান। কিন্তু ভালোমতো দেখার আর সাহস হয়ে ওঠলো না। তার চাউনিতে নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা আছে। নইলে লোকে অমন আজেবাজে কথা বলবে কেন? কেন বলবে সে সকালের দিকে যেভাবে তাকায় সেভাবে অন্য কারও দিকে কখনও তাকায়নি?
একটু বাদে খাবার আসা শুরু করলো। মাদার আর টিলির সাথে সকালকেও খাবার সার্ভ করতে দেখা গেলো। যা খুশি করুক, আরশান আর ওর দিকে তাকাবেই না। এই মেয়েটিকে সে নিজের কাছে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলো।
বাবা বললেন, ‘ফাহাদ, নাবিলা এরা কোথায়? তোমার কলিগ মেয়েটিই বা কোথায়? হঠাৎ সব এমন ফাঁকা হয়ে গেলো কেন?’
আরশান পকেট থেকে সেল ফোন বের করে ফাহাদের নম্বরে ডায়াল করতে করতে বলল, ‘আমার কলিগ চলে গেছে।’
—‘না খেয়ে চলে গেলো কেন?’
—‘কী জানি! খেতে চাইলো না তো।’
—‘আহা না চাইলেও তোমার তো জোর করতে হবে, তাই না? এসব সামাজিকতা তো তোমাকে শিখতে হবে।এতো বয়স হলো, এখনো যদি না শেখো তো কবে শিখবে?
ফাহাদ ফোন ধরলো না। আরশানের কপালে হালকা একটা চিন্তার রেখা পড়ল। মুখোমুখি বেঞ্চে বসা হিজাবধারী মহিলাটি বাবার কথা শুনে বলে উঠলেন, ‘আহা রহমান ভাই, আপনি ছেলেটাকে বকা দিয়েন নাতো। আপনার এই ছেলেটাকে আমার এত মায়া লাগে! এতো সুন্দর আর ভদ্র হইসে ছেলেটা। আমার মেয়েটা যদি আরেকটু বড় হইতো বয়সে আমি আমার মেয়ের সাথে আপনার ছেলের বিয়ে দিতাম।’
সকাল সেই মুহূর্তে খাবার সার্ভ করছিল টেবিলে। আরশান সাধারণত নিজের প্রশংসা শুনে পুলকিত হয় না। লোকে অনেক সময় অনেক কিছু বলে, এসব শুনে অভ্যাস আছে তার। কিন্তু আজকে সকালের সামনে করা প্রশংসাটি ওর মনের মধ্যে একটা অন্যরকম আনন্দের সঞ্চার ঘটালো। এই অনর্থক আনন্দের কোনো কারণ নেই, কিংবা থাকলেও তার কাছে সেই কারণ স্পষ্ট নয়। তবে আনন্দ যে হলো সেই বিষয়ে সে পুরোপুরি নিশ্চিত। এ অনুভূতি তার কাছে নতুন। কী বিচিত্র মানব মন! কত অকারণ যুক্তিহীন নিত্য-নতুন ভাবের আসা যাওয়া চলতে থাকে এই বিচিত্র স্থানটিতে! ভাবতে অবাক লাগে।
কিছু বলার না পেয়ে সে তার নাক উঁচু অহংকারী হাসিটা হাসলো। তারপর কপালে মাত্র গজানো তৃতীয় চোখটি দিয়ে টের পেলো সকাল ওর দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ তুললো না সে। তুলতে গিয়েও ভেতর থেকে আরেকটা আরশান ধমকে উঠল। না, না! নিষিদ্ধ জিনিসের দিকে তাকানো যাবে না!
বাবা বললেন, ‘সুন্দর চেহারা দিয়ে কোনো কাজ হবে না ভাবি। হতে হবে মানুষের মতো মানুষ।’
—‘আপনি চিন্তা করবেন না। এখনো বয়স কম। সব ঠিক হয়ে যাবে।’
—‘বয়স কম কোথায় হলো? এ বছর আটাশে পড়বে। দুদিন পর তিরিশ হয়ে যাবে। তিরিশ বছর বয়সে আমি বাচ্চার বাপ হয়েছি।’
দৃশ্যপটে মাদার উপস্থিত হলেন, বললেন,
—‘থাক, মেমসাহেবদের সাথে অতো ভদ্রতা করতে হবে না। চলে গেছে ভালো হয়েছে। কিন্তু ফাহাদ কোথায় গেলো? আবার ওই মেমসাহেবটার সাথে কোথাও চলে গেলনা তো?’
আরশান হেসে ফেলল। ফোন করলো ফাহাদের মোবাইলে দ্বিতীয় বারের মতো। সকাল বলল, ‘চাচি, আপনি চিন্তা করবেন না। ফাহাদের একটা জরুরি কাজ পড়ে গেছে। আমার সাথে কথা হয়েছে।’
চাচি চিন্তিত গলায় বললেন, ‘ছুটির দিনে আবার কী কাজ?’
ঠিক সেই সময় আরশানের ফোনটা রিসিভ করলো ফাহাদ।
—‘ফাহাদ, তুমি কোথায়?’
—‘ব্রো, আমি চলে আসছি। আমার একটা আর্জেন্ট কাজ পড়ে গেছে।’
—‘আচ্ছা শোনো, তুমি মাদারের সাথে কথা বলো। উনি চিন্তা করছিলেন।’
ফোনটা মাদারের দিকে এগিয়ে দিলো আরশান।
সকাল বুঝতে পারছে না নাবিলা আর ফাহাদের হঠাৎ একত্রে এমন কী গুরুত্বপূর্ণ কাজ পড়ে গেলো যে কাউকে কিছু না বলে হুট করে বেরিয়ে যেতে হলো? এ মুহূর্তে তার মনের অবস্থা শেয়ার করার জন্য নাবিলাকে খুব দরকার ছিল। বেঁচে থাকাটাকে হঠাৎ হঠাৎ মৃত্যুর চেয়ে কঠিন বলে মনে হয় তার কাছে। কী যন্ত্রণা! চোখ খোলা অথবা বন্ধ, কোনো অবস্থাতেই সে দৃশ্যটাকে মাথা থেকে সরাতে পারছে না।
খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকে গেলে কেউই আর বেশিক্ষণ থাকতে চাইলো না পিকনিক স্পটে। নাবিলারা চলে যাওয়াতে এমনিতেই ছেলে-মেয়েদের দলটা হালকা হয়ে গেছে। টিলি আর তার বান্ধবীই যা একটু হৈচৈ করছে। আর এদিকে সকাল, আরশান দুজন দুই প্রান্তে বসে নিজ নিজ ভাবনায় ডুব দিয়ে আছে। কেউ কোনো কথা বলছে না। দুজনেই যেন মুখ না খোলার, কথা না বলার এক নিভৃত ব্রত পালন করছে। অতএব, পিকনিক আর জমলো না।
চাচির বান্ধবী বললেন, ‘আপনারা সবাই আমাদের বাসায় চলুন। এক সাথে সন্ধ্যার চা খাবো।’
চাচা চাচির রাজি হতে বেশি সময় লাগলো না। আরশান জানিয়ে দিলো সে যাবে না। আর সকাল একটু কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ‘চাচি আমার শরীরটা ভালো লাগছে না। আমি না গেলে হয় না?’
চাচা সাথে সাথে বলে উঠলেন, ‘সমস্যা নেই, তুমি আরশানের সাথে চলে যাও বাসায়। আমরা একটু উনাদের বাসায় হয়ে তারপর ফিরছি।’
আরশান চমকে উঠল বাবার কথা শুনে। চমকানোর মতো ঘটনা ঘটলেও সাধারণত সে চমকায় না। কিন্তু আজকে বাবার প্রস্তাবটি শুনে তার সারা শরীর মন জুড়ে একটা বিদ্যুতের মতো চমকসমৃদ্ধ ভয় খেলে গেলো।
নিষিদ্ধ বস্তুর সাথে তো দূরত্ব বজায় রাখতে হয়। বাবা কি তা জানেন না?
বাবা প্রশ্ন করলেন, ‘কি আরশান, তুমি নিয়ে যেতে পারবে না ওকে? বাড়িতেই তো যাচ্ছো।’
আরশান মিন মিন করে বলল, ‘হ্যাঁ বাড়িতেই যাবো।’
২২
নাবিলার একটু চোখ লেগে এসেছিল। ব্রেক কষার ঝাঁকুনিতে চোখ দুটো যন্ত্রের মতো খুলে গেলো। গাড়ি এসে থেমেছে একটি দোতলা বাড়ির সামনে। সূর্যের আলো এখন নরম। পেলব মেঘ রাশি নিরুদ্দেশ উড়ছে আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত জুড়ে। তাদের গায়ে ছড়িয়ে পড়েছে লাল, বেগুনী আর গোলাপি রঙের প্রলেপ। গ্রীষ্মের বিদায় ঘণ্টা বেজে ওঠার সাথে সাথেই দিনের বেলার দৈর্ঘ্য কমতে শুরু করেছে। বিকেল এর মাঝেই অনেকটা ছোট। একটু বাদেই সন্ধ্যা নামবে। নাবিলা ঘুমো ঘুমো চোখ মেলে চেয়ে দেখলো বিকেলের মরা আলোয় মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা পুরনো ধাঁচের বাড়িটা। বাড়ির চারিপাশে জংলী গাছের সমাহার। দূরে চোখ রাখলে দেখা যায় দিগন্ত ছোঁয়া সবুজ পাহাড়
সদর দরজার সম্মুখে একটি ভারি সুন্দর মেটে রঙের নারী মূর্তি। মূর্তির নাচের ভঙ্গীতে উঁচু করে রাখা হাতের কবজি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে জলের ফোয়ারা। ফোয়ারা ঘিরে রয়েছে পাথরের গোল বেদি। বেদির চারিপাশে ফুটে আছে অজস্র লাল গোলাপ আর সাদা ডগউড ফুল। ফাহাদ নেমে গেছে ততক্ষণে গাড়ি থেকে। নাবিলাও একটু ধাতস্থ হয়ে নামলো। নেমেই চারপাশে চোখ বুলিয়ে অবাক গলায় বলল, ‘এমা! এতো দেখছি পুরাই জঙ্গল! কোথায় এসেছি আমরা?’
ফাহাদ নাবিলার প্রশ্নের উত্তর দেবার প্রয়োজন বোধ করলো না। রিমোট চেপে গাড়ি লক করলো। টুট টুট শব্দ করে তালাবন্ধ হলো বাহনটা।
নাবিলা আবার বলল, ‘এই বলো না, কোথায় এসেছি?’
ফাহাদ গুমোট গলায় বলল, ‘সারা পথে মরার মতো ঘুমোলে আর কী করে জানবে কোথায় এসেছো?’
—‘তুমিই তো বললে কোনো কথা বলা যাবে না। ঘুমাবো নাতো কী করবো? পাশে বসে থাকা অ্যাংরি ইয়াং ম্যানের চেহারা দেখতে থাকবো?’
ফাহাদ চুপচাপ বাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো। উপর্যুপরি ধাক্কা দিতে লাগলো দরজায়। পকেট থেকে ফোন বের করে একটু উত্তেজিত ভাবে ডায়াল করলো কোনো নম্বরে। নাবিলা কথা না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো ওর কাণ্ড।
বাড়িটির সামনে কোনো পাকা রাস্তা নেই। মেঠো পথ এসে মিশেছে সম্মুখের উঠোনে। খাড়া হয়ে উঠে গেছে কয়েক হাত উঁচুতে। লনের ঘাস ছাটা হয় না বুঝি অনেকদিন। লম্বা লম্বা ঘাসের সাথে আগাছারাও পাল্লা দিয়ে মাথা গজিয়েছে। আশেপাশে অনেক দূর অবধি আর কোনো বাড়ি চোখে পড়ছে না। পুরো জায়গাটা কেমন মনুষ্যবিহীন, সভ্যতাবিহীন, বিজ্ঞানরহিত আর দূর্গম বলে মনে হলো নাবিলার। একটা কেমন গা ছমছমে ভাব। হঠাৎ তার কপালে একটি সূক্ষ দুশ্চিন্তার রেখা ভেসে উঠল আগ পিছ কিছু চিন্তা না করে অন্ধ বিশ্বাস নিয়ে এই ছেলেটার সাথে এতটা দূরে চলে এসে কি তবে ভুল করলো? ফাহাদকে সত্যি এলোমেলো দেখাচ্ছে। সে ঠিক তার মধ্যে নেই। খোদা না করুক কোনো অঘটন ঘটে গেলে এই নির্জন, বিজন জায়গায় নাবিলা একা একা কী করে সব সামলাবে?
মিনিট পাঁচেকের মাথায় বাড়ির দরজাটা খুলে গেলো। এক বুড়ো কালো চামড়ার ভদ্রলোক জবুথবু হয়ে বেরিয়ে আসলো। ফাহাদকে দেখে হেসে করমর্দন করে বলল, ‘হেই ম্যান! কখন এলে? কিছু জানাওনি কেন আগে?’ ফাহাদ বলল, ‘কোথায় ছিলে? অনেকক্ষণ হলো দরজা ধাক্কাচ্ছি।’
—‘ওয়াশ রুমে ছিলাম। এসো এসো। বাইরে দাঁড়িয়ে কেন?’
ফাহাদ ঘুরে তাকিয়ে নাবিলাকে বলল, ‘এসো।’
বৃদ্ধলোকটি নাবিলাকে দেখতে পেয়ে বলল, ‘ও কে? তোমার গার্লফ্রেন্ড নাকি?’
ফাহাদ একটু অপ্রতিভ হলো, ছোট করে বলল, ‘নাহ।’
বাড়ির ভেতর ঢুকতে ঢুকতে আবার বলল, ‘পিটার, একচুয়েলি উই আর স্টারভিং। তোমার কাছে কি খাবার কিছু আছে?’
পিটার বলল, ‘ফ্রিজে ব্রেড আছে, জ্যাম জেলি আছে। এছাড়া তোমরা অন্য কিছু খেতে চাইলে বলতে পারো। আমি একটু পরে গ্রোসারি করতে যাচ্ছি। ফিরে আসার সময় তোমাদের জন্য কিছু কিনে নিয়ে আসবো।’
—‘তুমি কী খাবে?’ ফাহাদ প্রশ্ন করলো নাবিলাকে। নাবিলা একটু আড়ষ্টতা নিয়ে বলল, ‘কিছু একটা হলেই হলো।’
ফাহাদ আর সময় নষ্ট না করে পিটারকে বলল, ‘পিৎজা নিয়ে এসো। তোমার ইচ্ছে মতো টপিং দিলেই হবে। শুধু পাইনএপলটা এভয়েড করো।’
—‘আমি পর্ক খাই না।’ নাবিলা ফোড়ন কাটলো।
—‘ওকে দেন নো পর্ক, নো পাইনএপল।’ বলল ফাহাদ।
বাড়িটা বেশ বড়। বসার ঘর আর কিচেনের সাথেই লাগোয়া সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। আসবাব থেকে শুরু করে দেয়ালের রঙে, দরজা জানালায় সমস্ত কিছুতেই একটি পুরনো ছাপ আছে। নাবিলার চোখে নানা প্রশ্নের উঁকি-ঝুঁকি বুঝে নিয়ে ফাহাদ নিজ থেকেই বলল, ‘বাড়িটা আমাদের। পিটার নিচের তলাটা ভাড়া থাকে। কাছেই ওর টার্কির খামার আছে।’
—‘ও, কিন্তু এটা কোন জায়গা?’
—‘বারবার একই প্রশ্ন কেন করছ? আমি তো বলেছি যে বলা যাবে না। এমনটাই তো ডিল ছিল তাই না?’
নাবিলা ব্যাগ থেকে ফোন বের করে বলল, ‘তুমি কি মনে করেছো, তুমি না বললে আমি জানতে পারবো না?’
ফোনের লোকেশন অন করতে গিয়ে দেখা গেলো নেটওয়ার্ক নেই। নাবিলা চোখ কপালে তুলে বলল, ‘কী কাণ্ড! কোন জঙ্গলে এসে পড়েছি আমি? এখানে তো নেটওয়ার্ক নাই!”
ফাহাদ হেসে বলল, ‘বোঝো এবার ঠ্যালা!’
কিচেনের ক্যাবিনেট থেকে একটা হুইস্কির বোতল বের করলো ফাহাদ। ফ্রিজের সাথে লাগানো আইস চেম্বার থেকে সুইচ চেপে টপাটপ দুটি গ্লাসে ঢেলে নিলো একগাদা আইস কিউব। এসে বসলো ডাইনিং এর চেয়ারে, বলল, ‘হুইস্কি চলবে?’
—‘হ্যাঁ। কেন নয়?’ বলল নাবিলা।
ফাহাদ বোতল থেকে গ্লাসে পানীয় ঢালতে ঢালতে থমথমে গলায় বলল,
‘সবচেয়ে বড় আইরনি কী জানো? আমি আমার ভাইকে ভালোবাসি। আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না যে ও আমার সাথে এমন একটা কাজ কিভাবে করলো।’ এটুকু বলে একটু থেমে বিষণ্ন ভাবে কিছু একটা চিন্তা করলো সে। তারপর আবার বলল, ‘আমার মম বলে ভাই নাকি আমার কাছ থেকে এক এক করে সব কেঁড়ে নেবে। বাংলাদেশে আমার দাদুবাড়ির যেসব সম্পত্তি ছিল, মারা যাবার আগে দাদু সব কিছু ভাইয়ের নামে লিখে দিয়ে গেছেন। আমার জন্য এক রত্তি পরিমাণ প্রপার্টিও রাখেননি। সেই থেকে মমের খুব রাগ ভাইয়ের ওপর। মমের ধারণা ড্যাড আমাদের দুই ভাই-বোনের চেয়ে ভাইকে বেশি ভালোবাসে। কথাটা কিছু হলেও সত্য। জানো, ভাই সবসময় সব কিছুতে আমার থেকে এগিয়ে। লেখা-পড়ায়, আউট লুকে, ক্যারিয়ারে সবকিছুতে ওর একটা এ গ্রেড তকমা লেগে থাকে সর্বদা। আত্মীয়-স্বজনদের মুখে সবসময় ওর প্রশংসা আর গুণগান জারি থাকে। তবে এসব নিয়ে কখনো মাথা ঘামাইনি আমি। অন্ধের মতো ভালোবেসেছিলাম ওকে। কিন্তু দেখো, শেষমেশ মমের কথাই ঠিক হলো। হি হ্যাজ স্টোলেন দ্যা গার্ল ফ্রম মি।’
নাবিলা চুপ করে শুনছিল। প্রত্যুত্তরে বলবার মতো কোনো শব্দ খুঁজে পাচ্ছিল না সে। ফাহাদই আবার কথা বলল, ‘সে যাকগে, তুমি বলো, কেন আসলে এতটা পথ আমার সাথে? করুণা করে?’
—‘করুণা করবো কেন?’
ফাহাদ শ্লেষের গলায় বলল, ‘আমাকে পছন্দ না করে আমার হবু বউ আমার ভাইকে পছন্দ করে ফেলেছে। এরপরেও কি তোমার আমার উপর করুণা হচ্ছে না?’
নাবিলা দৃঢ় ভাবে বলল, ‘না একেবারেই না।’
—‘তোমার সাথে যদি ঘটনাটা ঘটতো নাবিলা তবে বুঝতে পারতে এ মুহূর্তে আমার কী রকম লাগছে। আচ্ছা একটা কথা বলো তো? আমি কি একেবারেই অপছন্দনীয় একজন মানুষ? আমার মধ্যে কি পছন্দ করার মতো কিছু নেই?’
নাবিলা চোখ বড় করে বলল, ‘কে বলেছে নেই? লুক এট ইওরসেলফ। ইউ আর হ্যান্ডসাম, চার্মিং, হাম্বল! সকালের জায়গায় যদি আমি হতাম, হু নোজ হয়তো আমি তোমাকে প্রথম দেখায়ই পছন্দ করে ফেলতাম। কারণ, তুমি প্রথম দেখায় পছন্দ করার মতোই ছেলে।’
ফাহাদের ঠোঁটে একটা নিষ্প্রাণ হাসি ভেসে উঠল, ‘এসব তুমি এমনি এমনি বলছ, আমাকে খুশি করতে।’
নাবিলা মাথা নেড়ে বলল, ‘মোটেও এমনি এমনি বলছিনা। যা বলেছি সত্য বলেছি।’
২৩
গাড়ি চলতে শুরু করার পর দুজনেই টের পাচ্ছিল একটা অস্বস্তি দানা বাঁধছে হাওয়ায়। কেউ কারো দিকে সরাসরি তাকাচ্ছে না। কথা বলছে না। কী রকম একটা থমথমে ভাব। সকাল চোরাচোখে দেখছে আরশানকে। দেখছে মানুষটার দৃষ্টি স্থির। চোয়াল শক্ত। ঠোঁটের কাছটায় একটু কেমন সূক্ষ নিষ্ঠুর ভাব। সে যেন ঠিক এই ধরাধামে নেই। তার মস্তিষ্কে চলছে কোনো গভীর, ক্ষুরধার, উচাটন ভাবনা।
সূর্য ধীরে ধীরে পশ্চিমে হেলছে। তার অবস্থান এখন ঠিক মুখ বরাবর। তির্যকভাবে চোখে এসে পড়ছে প্রখর তাপ। তেজ এতো বেশি যে চোখ খোলা রাখা যাচ্ছে না। সকাল ব্যাগ থেকে রোদ চশমা বের করে পরলো। রোদ এড়ানো ছাড়াও রোদ চশমার আরো উপকারিতা আছে। রোদ চশমা চোখের ভাষা লুকোতে সাহায্য করে। মনের ভাব ধরা পড়ার ভয় কম থাকে।
ছেলেটা এমন অদ্ভুত আচরণ করছে কেন? আজ দুপুরেই তো সব ঠিক ছিল। ওই নীল চোখের মেয়েটা একটা চুমু খেয়ে কি দুনিয়া পাল্টে দিলো?
মনে পড়তেই আবার সেই বিশ্রী অনুভূতিটা ফিরে আসলো বুকের ভেতর। চোখ বন্ধ করে ফেললো সকাল। ভালো লাগছে না। কিচ্ছু ভালো লাগছে না।
রোদে ডোবা হলদে ছিমছাম রাস্তা দিয়ে গাড়িটা হু হু করে ছুটে চলেছে। রাস্তার দুপাশে কখনও খোলা মাঠ, কখনো বন বনানী, কখনো আবার দোকান পাট। জি পি এস বলছে গন্তব্যে পৌঁছুতে আরো পঁয়ত্রিশ মিনিট সময় লাগবে। এই পঁয়ত্রিশ মিনিট কাটবে কী করে? বাক্যহীন ভাবে এমন যন্ত্রের মতো বসে থেকে?
.
—‘আপনার কী হয়েছে?’ হঠাৎ করেই প্রশ্নটা করে ফেললো সকাল।
আরশান ঘাড় ঘুরালো সকালের দিকে। কিন্তু চোখ রাখলো জানালার বাইরে। বলল, ‘কিছু না। কী হবে?’
—‘কী হবে তা আমি কী জানি? কেমন কেমন করছেন!’
আরশান অস্বস্তি নিয়ে একটু হেসে প্রশ্নের ওপর প্রশ্ন করলো, ‘কেমন করছি?’
সকাল এ প্রশ্নের উত্তরে অন্য গলায় বলল, ‘মেয়েটা সত্যি সুন্দর!’
—‘কার কথা বলছেন?’
—‘আপনার গার্লফ্রেন্ড।’
শুনে আরশান যেন আরো একটু বেশি গম্ভীর হয়ে গেলো। কিছু বলল না। ওকে চুপ করে থাকতে দেখে সকাল বলল, ‘আপনি খুশি হননি?
—‘খুশি হওয়ার কী আছে?’
—‘এই যে আমি আপনার গার্লফ্রেন্ডকে সুন্দর বললাম। আপনার তো ভালো লাগা উচিত।’
আরশান যেমন শক্ত হয়ে ছিল তেমন শক্ত হয়েই রইল। গাড়ি ঘুরিয়ে গ্যাস স্টেশনে থামালো। কোনো কথা না বলে যন্ত্রের মতো গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে আসলো। ক্রেডিট কার্ড পাঞ্চ করে নিলো মেশিনে তারপর গ্যাস নজেল ঢুকালো গাড়ির ট্যাংকে। চিন্তিত গম্ভীর মুখ নিয়ে অপেক্ষা করলো গ্যাস লোড হবার সময় টুকু। সেই মুহূর্তে ওর দিকে তাকিয়ে সকালের মনে হলো এই আরশানকে যেন সে চেনে না। তার কেমন ভয় ভয় করতে লাগলো।
গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসলো সে। রোদের তেজ বুঝি একটু কমে এসেছে। ঝির ঝির করা ঠান্ডা হাওয়াটা ভালো লাগছে। এদেশে প্রতিটা গ্যাস স্টেশনে একটি করে দোকান থাকে। এখানে আছে সেভেন ইলেভেন। গ্যাস ভরা হয়ে গেলে আরশান কী কারণে যেন সেভেন ইলেভেনের ভেতরে গেলো একবার। চলেও আসলো কিছুক্ষণের মাঝেই। সকাল গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রাস্তা দেখছিল। আজ বেজায় গাড়িঘোড়া পথে। এ দেশেও যানবাহনের ভিড় হয়। বিশেষ করে অফিস ছুটির সময়টাতে সকাল দেখেছে, যে পর্যায়ের যানজট রাস্তায় হয় তা কোনো অংশেই ঢাকা শহরের তুলনায় কম নয়। কিন্তু তফাৎটা হচ্ছে এদের যানজটের মধ্যেও একটা সুশৃঙ্খল ভাব বিরাজ করে। নিয়ম অমান্য করে না কেউ। তাই জ্যাম লাগার পর ছাড়তে বেশি সময় লাগে না।
—‘আপনার কিছু লাগবে? কিছু খাবেন?’ আরশান পাশে এসে দাড়ালো। সকাল নিস্তেজ ভাবে বলল, ‘না।’
—‘আমি কি স্মোক করতে পারি? যদি কিছু মনে না করেন?’
—‘পারেন।’
—‘ধন্যবাদ।’
আরশানের হাতে সিগারেটের বাক্স ধরা ছিল। মনে হয় সেভেন ইলেভেনে এটা কিনতেই গিয়েছিল। লাইটার বের করে আগুন ধরাতে ধরাতে সে বলল, ‘আপনার চাই?’
—‘আমার অভ্যাস নেই।’
—‘গুড ফর ইউ।’
বক্সটা পকেটে পুরে রেখে সে সকালের দিকে একবার চাইলো। চাইলো সকালও। চকিতে চোখ সরিয়ে নিলো আরশান। আর সরানোর পরেই টের পেলো খুব ভালো মতো, যে মেয়েটা তার চোখদুটোকে চুম্বকের মতো টানছে। এই উপলব্ধির পর অস্বস্তিটা আরও ভালো মতো পেয়ে বসল তাকে।
আরশানের চোখ ঘুরিয়ে নেয়া দেখে অবাক না হয়ে পারলো না সকাল। একটা ব্যথা চিনচিন করে উঠল বুকের বাঁ পাশে।
—‘আসলে এন্ড্রিয়ানা আমার গার্লফ্রেন্ড না।’ একটু থেমে থেমে সময় নিয়ে বলল আরশান কথাটা।
সকাল বিস্মিত, ‘মানে?’
আরশান সিগারেটে টান দিলো। চোখ দুটো শূন্যে রেখে বলল, ‘মানে ও আমার খুব ভালো বন্ধু। ব্যাস এটুকুই।’
সকাল টের পেলো কথাটা শোনা মাত্র তার বুকের চিনচিনে ব্যথাটা ম্যাজিকের মতো উধাও হয়ে গেছে। এক ঝাপটা স্বস্তির হাওয়া ঢুকে গেছে মনের ঘরের ফাঁক ফোঁকর গেলে। তবুও চাপা একটা অভিমান সদর্পে বিরাজ করছে সেখানে। সেই অভিমান থেকেই বলল,
—‘মিথ্যে কথা!’
—‘মানে কী? আমি কেন আপনাকে মিথ্যা কথা বলব?’
—‘কেন বলবেন তা তো জানি না। কিন্তু বলছেন।’ চোখ থেকে সান গ্লাস খুলে নিতে নিতে বলল সকাল। হালকা বাতাসে তার খোলা চুল উড়ছে তির তির করে। বিকেল শেষের এক খন্ড কমলা রঙা চকচকে রোদ এসে পড়েছে তার ডান গালে। সেই দিকে আরশানের অবাধ্য চোখদুটি পাগলা ষাঁড়ের মতো ছুটে যেতে চাচ্ছে বারে বারে।
আরশান বিপন্ন গলায় বলল, ‘মিথ্যে বলছি না।’
—‘তাহলে ওকে চুমু খেলেন কেন?’ সকালের মুখ ফসকে বেরিয়ে গেলো প্রশ্নটা।
—‘আই ডিড নট। শী ডিড!’
—‘আবার মিথ্যা কথা। আমি নিজের চোখে দেখেছি।’
—‘কী ভুলভাল দেখেছেন আপনিই জানেন। ঠিক মতো দেখে থাকলে বুঝতেন কাজটা আমি করিনি। সে করেছে।’
সকাল একদম ঝগড়াটে গলায় বলে উঠল, ‘গার্লফ্রেন্ড না হলে সে কোন অধিকারে আপনাকে চুমু খাবে? এ তো ভারি অন্যায়!’
কথাটা শুনে কেন কে জানে, আরশান আকস্মিক ওর ডাঁটিয়াল, হামবড়া হাসিটা হেসে ফেললো। সকাল ফোঁস করে উঠে বলল, ‘এতো হাসির কিছু নেই। এমনিই বললাম কথাটা। আপনার যা ইচ্ছা তা করেন। আমার কী?’
—‘আচ্ছা আপনি কোনো কথা মন দিয়ে, মাথা দিয়ে বোঝার চেষ্টা করেন না কেন? কিছু বললেই কেমন ক্যাট ক্যাট করে ওঠেন। প্রব্লেম কী আপনার?’
ধমক খেয়ে সকাল একটু মুখ গোঁজ করলো। একটা রাগ রাগ ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। একটু সময় পর আরশান অপরাধীর গলায় বলল, ‘এন্ড্রিয়ানা অনেক দিন থেকেই আমাকে পছন্দ করে। তাই হয়তো …হঠাৎ ইমোশোন থেকে কিস করে ফেলেছে। এটাতে অত দোষের কী আছে?’
—‘না দোষ কিসের? আপনারা তো ভাই আমেরিকান। আপনাদের কাছে এসব ডাল ভাত!’
আরশান গম্ভীর ভাবে বলল, ‘সে যাই হোক। আপনাকে আমি এসব কৈফিয়ৎ কেন দিচ্ছি জানি না। আমি যা খুশি করতে পারি। আমার তো কারো কাছে কোনো দায়বদ্ধতা নেই। তাই না?’
সকাল চোখ নামালো নিচে। সে জানে না এ প্রশ্নের উত্তরে ঠিক কী বলা যায়। সিগারেট শেষ করে নিয়ে আরশান বলল, ‘চলুন যাওয়া যাক।’
বাকিটা পথ কেউ তেমন কোনো কথা বলল না। দুরু দুরু বুক নিয়ে সকাল শুধু একবার প্রশ্ন করলো, ‘আপনার কী হয়েছে আরশান? কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে আপনাকে।’
—‘আমি মানুষটা মনে হয় একটু অদ্ভুতই আছি।’ বলে একটু হাসলো আরশান।
—‘আপনার কি কিছু নিয়ে মন খারাপ?’
কথাটা শুনে আরশান গাড়ির স্টিয়ারিং এ হাত রেখেই ঘাড় ঘুরিয়ে সকালের দিকে তাকালো। ঠাণ্ডা গলায় বলল, ‘আমার মন খারাপ হোক বা ভালো, তাতে আপনার কী এসে যায়?’
খটোমটো প্রশ্নটা সকালের বুকের মধ্যে শেলের মতো গিয়ে বিঁধল। আরশান বিষাদগ্রস্ত গলায় বলল, ‘আমি মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কে বিশ্বাস করি না।’
—‘এর মানে কী?’ সকালের গলাটা একটু কাঁপছিল।
—‘সহজ ভাবে বলতে গেলে আমি ভালোবাসায় বিশ্বাস করি না। কিংবা বলতে পারেন মেয়েদেরকে বিশ্বাস করি না।’
—‘কেন?’
—‘কারণটা আমার সঠিক জানা নেই। আপনার কি মনে হয় না পৃথিবী থেকে এখন কমিটমেন্ট ব্যাপারটা উঠে যাচ্ছে? মানুষ যত সভ্য হচ্ছে তত বেশি সম্পর্কের মায়াজাল থেকে মুক্ত হচ্ছে? বিয়েশাদীর মতো ট্রেডিশনাল কনসেপ্টগুলো ধীরেধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। যৌন সম্পর্কটাই আসল।’
—‘তাহলে পশুর সাথে মানুষের পার্থক্যটা কোথায়?
—‘মাঝে মাঝে মনে হয় পশুসমাজের যে জিনিসগুলো উপকারী সেই জিনিসগুলো আয়ত্ব করে মানুষ আসলে নিজেকে সমৃদ্ধই করবে।’
—‘আমাকে এসব কথা কেন বলছেন?’ একটু বিরক্ত ভাবে বলল সকাল।
আরশান শ্লেষের হাসি হাসলো। কেমন আচ্ছন্ন ভাবে বলল, ‘জানি না!’ বাড়ি ফিরলো ভর সন্ধ্যেবেলা। সকাল গাড়ি থেকে নেমে বলল, ‘শুনুন, আপনার অত বড় বড় কথা আমি বুঝি না। শুধু এটুকু বলব কিছু নিয়েই বেশি চিন্তা করবেন না। অত বেশি চিন্তা করতে গেলে পাগল হয়ে যাবেন। ভালো থাকার চেষ্টা করুন। আপনার মন যা বলে, তা ই করুন।’
আরশান স্তিমিত ভাবে বলল, ‘দেখা যাক!’
বাড়ি ফিরে একলা হয়ে আরশান নিজের মুখোমুখি দাড়ালো। বন্ধন ভারি খারাপ জিনিস। পিছুটান, বন্ধন, সম্পর্ক এসব মানবিক দিকগুলো প্রকৃত অর্থে মানুষকে দুর্বল করে ফেলা ছাড়া অন্য কিছুই করে না। একবার এই মায়ার ফাঁদে পা দিলে পস্তাতে হবে সারাটি জীবন।
নিজের ভেতর থেকে একটা ডাক শুনতে পায় আরশান। কেউ একজন বলছে, ‘পালাও! পালাও! সময় থাকতেই পালাও!’
কেমন ভূতগ্রস্তের মতো উঠে দাড়ালো সে। ব্যাগপ্যাকে কয়েকটা কাপড় আর প্রয়োজনীয় জিনিস তুলে নিয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে আসলো ঘর থেকে।
গাড়িতে উঠতে যাবার সময় কেউ একজন পাশে এসে দাড়ালো, বলল, ‘মাত্র তো আসলেন। আবার কোথায় যাচ্ছেন?’
সন্ধ্যের ফিকে বাদামি আলোয় আরশান চোখ তুলে দেখলো সকালকে। ওই স্নিগ্ধ মুখের দিকে চেয়ে থেকে তার হৃৎপিন্ড একটা বারের জন্য স্পন্দিত হতে ভুলে গেলো। সে কেমন অন্যমনস্ক গলায় বলল, ‘পালিয়ে যাচ্ছি।’
—‘কী বললেন?’ উত্তেজনায় তখন সকাল নিশ্বাস নিতে ভুলে গেছে।
আরশান কোনো কথা না বলে গাড়ির দরজা খুলে উঠে বসলো। সকাল পাগলের মতো গাড়ির জানালায় ধাক্কা দিতে দিতে বলল, ‘কথা শুনুন আমার! আপনি কোথায় যাচ্ছেন?’
জানালার কাচ নামালো আরশান, ‘স্টেটের বাইরে যাচ্ছি। কাজ আছে।’
সকাল বিস্মিত, ‘কেন যাচ্ছেন?’
—‘বললাম তো! কাজ আছে!’
সকাল বাষ্পাচ্ছন্ন গলায় বলল, ‘কবে ফিরবেন?’
—‘জানি না!’
জানালার কাচ উঠে গেলো। কিছুক্ষণের মাঝেই গাড়িটা ধীরে ধীরে নেমে গেলো ঢালু ড্রাইভ ওয়ে ধরে। উঠল রাস্তায়।
একটা কান্নার ডেলা সকালের গলার কাছে এসে আছড়ে পড়তে চাইছিল। রাস্তার ওপরেই ধপ করে বসে পড়ল সে।
জীবনে এই প্রথমবারের মতো বাড়ি ছেড়ে যাবার সময় আরশানের মনে হলো সে কিছু একটা রেখে এসেছে। একটা পিছুটান কাজ করছে তার ভেতরে। মনে হচ্ছে ঘরমুখো তাকে হতেই হবে আজ নয়তো কাল। একটা গভীর নিশ্বাস বেরিয়ে গেলো বুক চিরে। এতটা ফাঁকা লাগছে কেন ভেতরটা? কেন মনে হচ্ছে ওই মুখটা আর একবার দেখতে না পেলে সে একদম মরে যাবে?
নিশ্বাস আটকে আসছে। চোখের সামনে নেমে আসছে এক মেঘাচ্ছন্ন অন্ধকার।
গাড়ি ঘুরিয়ে নিলো। ক্যাত করে চার চাকায় বিকট শব্দ তুলে ঝড়ের বেগে গাড়িটা ফিরে চললো উল্টো পথে। গাড়ি বারান্দায় এসে দেখা গেলো মেয়েটা বসে আছে হাঁটু গেঁড়ে। পথের ওপর
দ্রুত নেমে আসলো আরশান গাড়ি থেকে। দৌড়ে এসে সকালকে বসা থেকে টেনে তুলতে তুলতে বলল, ‘ফিরে এসেছি। যান, বাড়ির ভেতরে যান!’
সকাল কাঁদছিল। তার চোখ ভেসে যাচ্ছিল অশ্রুর নোনা জলে। আরশানের তখন বুকের ভেতর এক উদ্বেল ঢেউ ভাঙছে। কেমন একটা অর্ধচৈতন্য অবস্থা। সামনে দাড়ানো মানবীটি ঠিক কী কারণে তার কাছে এমন অসাধারণ হয়ে উঠছে দিনকে দিন আরশান তা জানে না। কিন্তু জানে মেয়েটির উপচে পড়া চোখের জলের ধারা এই মুহূর্তে শুধুমাত্র তার জন্যে। মানুষ সর্বদাই প্রিয়জনের চোখে নিজের দৃঢ় অবস্থান দেখতে পছন্দ করে। সে চায় বিশেষ কেউ চিরটা কাল ধরে তাকে চোখের ভেতর, মনের ভেতর, স্বপ্নের ভেতর বাঁচিয়ে রাখুক। আরশানের এইসব সাধারণ মানবিক দুর্বলতা কখনো ছিল না। শুধুমাত্র নিজের জন্যেই বাঁচতে শিখেছে সে। তার বুক থেকে কখনো দীর্ঘশ্বাসেরা বেরিয়ে এসে হাহাকার করে বলে ওঠেনি, কেউ যদি ভালোবাসতো!
কিন্তু এই ঐন্দ্রজালিক ক্ষণে তার চোখের সম্মুখে যে অশ্রুসজল মায়াবী মুখখানা, এই মুখটি কেমন যেন পাগল করা অন্যরকম। এর সাথে জগতের আর কিছুর তুলনা হয় না। সেই দিকে চেয়ে থেকে আরশান জীবনে প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করলো, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ঘটনাটি হলো একজন মানুষের অন্য একজন মানুষের জন্য ভালোবাসার অশ্রুজল বিসর্জন দেয়া।
সকাল একটু তটস্থ হয়ে ওড়না দিয়ে চট করে চোখ মুছে নিলো। মুখ লুকিয়ে বলল, ‘কেন গেলেন? আবার ফিরেই বা আসলেন কেন? আপনাকে আমি কিচ্ছু বুঝি না।’
আরশান স্বগতোক্তির মতো বলল, ‘আমিও বুঝিনা আমাকে!’
গাড়ির হেডলাইটের আলো এসে পড়ল দুজনের মুখ বরাবর। সন্ধ্যা পালিয়েছে একটু আগে। রাতের অন্ধকার জেঁকে বসছে চারপাশে। ওরা দুজনেই একটু অপ্রস্তুত হলো।
গাড়ি থেকে নামতে নামতে চাচি বললেন, ‘তোমরা কি মাত্রই আসলে? ট্র্যাফিক ছিল নাকি?’
আরশান বা সকাল কেউ কোনো কথা বলল না। একটা অস্বস্তি খেলছে ওদের মুখে।
চাচি অবশ্য তেমন কিছু খেয়াল করলেন না। ঝলমল হেসে বললেন, ‘জানো না তো কী কাণ্ড। ওই বাসায় গিয়ে পৌঁছনোর সাথে সাথেই লিরা ফোন দিয়েছে। লিরাকে চিনেছো তো? আমার ছোট বোন। বলল ওরা নাকি আসছে বিশ মিনিটের মধ্যেই। ওর ছেলে জর্জ মেসনে এডমিশন নিয়েছে। পিএইচডি করবে।’
আরশান এবার বলল, ‘অনিকের কথা বলছেন?’
—‘হ্যাঁ হ্যাঁ অনিক।’
—‘বাহ ভালো তো।’
—‘হ্যা অনিক তো ভীষণ ব্রাইট ছেলে।’
বলতে বলতে চাচি সদর দরজার কাছটায় এসে দাঁড়িয়ে পড়লেন। ঘাড় ঘুরিয়ে সকালকে দেখে বললেন, ‘তুমি ঘরের বাইরে এমন স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কেন? এসো, ভেতরে এসো। তোমার চাচা গাড়ি গ্যারেজে রেখে আসছে।’
—‘আসছি চাচি।’ বলে সকাল ভেতরে পা দেয়ার আগে একবার তাকালো আরশানের দিকে। লাইট পোলের গ্যাস জ্বলা আগুন আলোয় দেখলো আরশান তার দিকেই চেয়ে আছে। সকালকে তাকাতে দেখে একটু হাসলো।
মন কেমন করতে থাকলো। কী যেন কী বলার ছিল, বলা হলো না। কী যেন হবার ছিল, হলো না।
সেইরকম হলো না, হলো না হাহাকার নিয়েই আরশান হেঁটে ব্যাক ইয়ার্ডে আসলো। ডেকের ওপর দাঁড়িয়ে চোখ রাখলো দূরে। খানিক বাদে তার ভেতরকার মানুষটা এক বদখত অট্টহাসি দিয়ে বলে উঠল, ‘তুমি কি হেরে গেলে হে?’
শুনে আরশান নড়ে চড়ে সোজা হয়, বুক টান করে বলে, ‘না, হারার প্রশ্নই আসে না।’
—‘তাহলে তাকে নিয়ে এত ভাবছ কেন?’
—‘ভাবতে দোষ কোথায়?’
—‘যত বেশি ভাববে তত বেশি ও তোমায় দখল করে নেবে। নিজের ওপর অন্যের দখলদারী কি তোমার সইবে?’
—‘আমাকে দখল করা কি অত সোজা?’
বলল মুখে কিন্তু ভাবনাটা গেঁড়ে বসলো তার অন্তরের অন্তস্থলে। সত্যিই তো। তার একান্ত নিজের আপন ভুবনটিতে কেন অন্য লোকের অংশীদারিত্ব থাকবে? সে যেমন ছিল, ভালো ছিল, সুখে ছিল। মেয়েটা তার জীবনে আসার পর থেকেই চেনা নিজস্ব পৃথিবীটা কেমন পর হয়ে গেলো। একলা থাকার সময়গুলোতেও পরিপূর্ণ ভাবে একলা হতে পারে না সে। আবার হঠাৎ হঠাৎ ঘরভর্তি লোকের মধ্যে আচমকা একলা হয়ে যায়। নিউইয়র্কের দিনগুলোতেও হালকা টের পেয়েছিল। কোনো কিছুতেই ঠিকঠাক মন লাগছিল না।
ধুরছাই, মেয়েটাকে কেন তার এত বেশি ভালো লাগছে?
আজকে ভায়োলিন নিয়ে উঠোনে এসে বসলো। মনে হচ্ছিল ভায়োলিনের সুর শুনে কেউ একজন বারান্দায় এসে দাড়াবে। কিন্তু কেউ আসলো না। ঘরটায় বাতি জ্বলছে। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে কোনো মানুষ নেই।
যাক গে, তুমি এতো ভাবছো কেন? তোমার ভাবনার বিষয় বস্তুর কি অভাব পড়ল? পৃথিবীকে নিয়ে ভাবো হে! যে পৃথিবীর বুকে তোমার আশ্রয় সেই পৃথিবী আর তার ওপর চড়ে খাওয়া সাধারণ মানুষগুলোকে নিয়ে ভাবো। দেখো প্রতিনিয়ত কত কী ঘটে যাচ্ছে সারা দুনিয়ার আনাচে-কানাচে, বিস্তৃত মহাকাশে, এমনকি সমুদ্রের নিচে। পৃথিবী কোথায় চললো আর তুমি পড়ে রইলে কোন চুলোয়। শেষ পর্যন্ত তোমার মতো বুদ্ধিমান, বিজ্ঞানমনস্ক এবং বিবেচক মানুষের ভাবনার খোরাক হয়ে দাড়ালো এক অতিশয় সাধারণ আটপৌরে বাঙালি রমণী!
ধিক তোমাকে ধিক!
আজ রাতটা তাহলে জঙ্গলেই কাটুক। তাই হোক। ঠিক তাই হোক।
জঙ্গলের হাওয়ায় হাওয়ায় এখন শরতের ছোঁয়া। গাছের সবুজ পাতায় পাতায় লালচে রঙের আঁচড়।
ঐখানে, ঐ নিবিড় বনানীর মধ্যে ডুবে গেলে তার আর দুনিয়া জাহানের চেতনা থাকে না।
যাচ্ছিল জঙ্গলেই। কিন্তু কী মনে করে আবার ঘুরে দাড়ালো। ধীর পায়ে ঘরে ফিরে এসে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে আসলো। ভেতরের মানুষটা বলে ওঠে, যেও না! যেও না! ওকে এড়িয়ে যাও। তার পা পিছিয়ে আসে। মুহূর্তের জন্য থমকে দাড়ায়। একটা ঘোর কাজ করে ভেতরে। তারপর একটা বড় নিশ্বাস ছেড়ে দরজা খুলে ঢুকে পড়ে ভেতর বাড়িতে। ড্রইংরুমেই বসে আছে সকাল। ঘরভর্তি লোকজন গিজগিজ করছে। বাঙালি সমাজের এই একটা দিক আরশানের খুবই বিরক্ত লাগে। না বলে কয়ে হুট করে দল বেঁধে কারো বাড়িতে হামলে পড়ার মতো বুনো সংস্কৃতি পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই। সবার সময়ের দাম আছে।
মাদারের বোন লিরা আরশানকে দেখে এক গাল হেসে বলল, ‘এইযে, তোমার খোঁজই করছিলাম এতক্ষণ। আছো কেমন?’
আরশান এগিয়ে আসলো, ‘ভালো আছি। আপনাদের কী খবর?’
কথাটা বলে সকালকে আড়চোখে দেখলো সে। সোফায় বসে আছে অনিকের পাশে। অনিক ভীষণ মেধাবী ছেলে। একই সাথে সপ্রতিভ, উচ্ছ্বল এবং অমায়িক। মুহূর্তের মাঝে যে কারো সাথে ভাব জমিয়ে ফেলতে পারে।
–‘আমরা কেমন আছি সে খবরটা তো একটা বার নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করো না বাছা!’
দুই সিটের সোফায় দুজন পাশাপাশি বসা। অনিক হেসে কিছু বলছে। উম্মুখ হয়ে শুনছে সকাল।
লিরা আবার কিছু একটা বললেন। আরশান অন্যমনস্ক ভাবে বলল, ‘জি? কিছু বলেছেন?’
—‘এমা এই ছেলের হয়েছে কী? কানে সমস্যা হচ্ছে নাকি? কথা শুনতে পাচ্ছো না?’
আরশান বিপন্ন ভাবে তাকালো লিরার দিকে। বলল, ‘দুঃখিত খেয়াল করিনি।’
—‘শুনলাম তুমি নাকি সারাদিন জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াও? কেন বাপ? সন্যাসী হবে নাকি?’
চোখ টানছে চুম্বক। অবাধ্য দৃষ্টি বার বার ছুটে যাচ্ছে তার দিকে। গালে হাত দিয়ে মনোযোগের সাথে অনিকের কথা শুনছে। আবার কী যেন বলতে গিয়ে হেসেও ফেললো। এখন ওর টোল পড়া গালের দিকে অনিক অপলক চেয়ে আছে।
সকাল জায়গাটা থেকে সরে আসছেনা কেন?
—‘তুমি ঠিক আছো তো? তোমাকে খুব আপসেট দেখাচ্ছে।’ লিরা বললেন।
—‘আমি ঠিক আছি।’ আরশান বলল শুকনো গলায়।
উঠে পড়ল সে। চাপা একটা উদ্বেগ খেলছে তার মুখে। লিভিং রুমে বাবার মুখোমুখি পড়ল। বাবা বললেন, ‘ডিনার করেছো?’
আরশান আলগা ভাবে বলল, ‘না।’
—‘এখানে করবে। আমাদের সাথে।’
—‘হুম ঠিক আছে।’ বলে আরশান ধপ করে বসে পড়ল লিভিং রুমের কাউচে। ঘাড় ঘুরিয়ে উঁকি দিয়ে দেখলো। আলোচনা এখনো চলছে। সকাল কি তাকে দেখতে পায়নি? পেয়েছে তো। ঢোকার মুখেই চোখে চোখ পড়েছে একবার। তবুও কেন ওখানে ঠাঁয় বসে আছে? আরশানের চাইতে কি অনিক তার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ?
আবার উঠে পড়ল বসা থেকে। পরের বার তাকাতেই দেখলো ওরা আর আগের জায়গায় নেই। কোথায় গেলো? বিচলিত আরশান এদিক- সেদিক ঘাড় ঘুরিয়ে খুঁজতে লাগলো। ড্রইং রুমে নেই, লিভিং রুমে নেই। গেছে কোথায়?
সিঁড়ির সামনে এসে দেখা গেলো দুজনে কথা বলতে বলতে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠছে। যাচ্ছে কোথায় সকাল ওকে নিয়ে? নিজের ঘরে নিয়ে যাবে নাকি?
আরশান অন্য কিছু চিন্তা করতে পারলো না। তার ভেতর থেকে আপনা আপনি একটা ডাক উঠে আসলো, ‘সকাল!
সকাল থমকে দাড়ালো। ওরা তখন মাঝ সিঁড়িতে। আরশান সিঁড়ির গোড়ায়।
ঘুরে দাঁড়িয়ে সকাল বলল, ‘জি বলুন?’
কথা আটকে গেলো আরশানের। সে ঠিক জানে না তাকে কী বলতে হবে। তার মতো অকপট, সপ্রতিভ ব্যক্তির জীবনে এই অভিজ্ঞতা নতুন।
—‘একটু আসবেন? কথা ছিল!’
অনিক সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামতে নামতে বলল, ‘আরশান ভাই, আপনি তো আমাকে চিনতেই পারলেন না।’
আরশান ভারি লজ্জা পেয়ে গেলো। পরিচিত একজন মানুষ তার সামনে দাড়ানো অথচ সে সামান্য কুশল বিনিময়টুকু পর্যন্ত করতে ভুলে গেলো। আরশান তোমার হয়েছে কী? মেয়েটা কি তোমাকে এতটাই বদলে দিলো এ ক দিনে? দখলদারীর কর্মযজ্ঞ তবে শুরু হয়ে গেছে! এবার তুমি নিঃস্ব হয়ে গেলে। যা তোমার ছিল তাও আর তোমার রইল না।
—‘কেমন আছো অনিক?’ বলে আরশান হাত বাড়িয়ে দিলো। তারপর আবার বলল, ‘শুনলাম তুমি পিএইচডি শুরু করেছো। খুব ভালো খবর। কিসের ওপর করছ বাই দ্যা ওয়ে?’
—‘সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং।’
—‘গুড, ভেরি গুড।’
সকাল এসে দাঁড়িয়েছে পাশে। কৌতূহলের চোখ নিয়ে আরশানের দিকেই চেয়ে আছে। চেয়ে আছে অনিকও। আরশান বুঝতে পারছে না তার এই মুহূর্তে ঠিক কী করা উচিত। সব কিছু এলোমেলো লাগছে।
সকাল বলল, ‘বলুন, কী বলতে চাইছিলেন?’
আরশান ভারি আহত চোখে তাকালো সকালের দিকে। কী বলবে সে? এইখানে অনিকের সামনে? সকাল কি এতটুকু বোঝে না? সে স্তিমিত গলায় বলল, ‘বলছি।’ তারপর এক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকলো ওদের দিকে। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে কী যেন চিন্তা করলো। একটা বড় নিশ্বাস ফেলে সকালকে বলল, ‘ঐদিকে চলুন। একটু প্রাইভেসি দরকার।’
অনিকের মুখে একটা হালকা অপমানের ছায়া খেলে গেলো। সে সকালের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘নো প্রব্লেম, টেক ইওর টাইম। আমি তো আজ রাতে থাকছিই এখানে। সারারাত গল্প করা যাবে।’
‘সারারাত গল্প করা যাবে’ কথাটা আরশানের কানে ঝাঁঝাঁ করে বাজতে থাকলো।
সকাল আরশানকে অনুসরণ করে হেঁটে আসলো। বাড়ির বাইরে। তার ভেতরটা একটা অনাবিল শান্তিতে ভরে গেছে। আরশান তার সাথে নিজ থেকে কথা বলেছে। গায়ে পড়ে। আহা বাতাসে কেমন মন কাঁপানো সুখের ছড়াছড়ি!
বাইরে এসে দরজার সামনে একটু দাড়ালো আরশান। তারপর বলল, ‘চলুন হাঁটি।’
সকাল মুচকি হেসে বলল, ‘এই রাতের বেলা?’
—‘কেন কোনো সমস্যা?’
—না মানে, অন্ধকার তো।’
—‘আপনি রাতকানা নাকি?’ কাটাকাটা গলায় বলল আরশান।
—‘রাতকানা হব কেন?’
—‘তাহলে অন্ধকারে সমস্যা কী?’
সকাল একটা হতাশ নিশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘আচ্ছা চলুন। কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।’
লন পার হয়ে রাস্তায় উঠে আসলো ওরা। জঙ্গলের একদম ধার ঘেঁষে সাপের মতো এঁকেবেঁকে বয়ে গেছে ফুটপাতটা। কোনো আলো নেই। মানুষ জনও নেই। নেই কোনো গাড়িঘোড়া রাস্তায়। রাত আটটার সময়ই এখানে মধ্যরাতের নীরবতা।
আকাশ পরিষ্কার। কালো আকাশের পাতলা আস্তর ভেদ করে উঁকি ঝুঁকি মারছে নীলচে রঙা অজস্র নক্ষত্র।
সকাল অনেকদিন এরকম গ্রাম্য ঘুটঘুটে অন্ধকার দেখেনি। তার শহুরে চোখে এই অন্ধকার সয়ে আসতে সময় লাগছিল।
—‘আপনাদের এ জায়গাটা কেমন গ্রামের মতো!’
—‘হুম।’ আরশান বলে একটু অন্যমনস্ক ভাবে।
হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে সকাল বলল, ‘বলুন কী বলবেন বলছিলেন?’
আরশান একটু বিরক্ত গলায় বলল, ‘বলব তো, আপনার কোনো তাড়া আছে?’
—‘চাচি কী মনে করবেন?’
—‘মনে করার কী আছে এখানে?’
অন্ধকারে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে দুজনে। কেউ কারো চোখ মুখ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না।
সকালের একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। দিশাহারা আনন্দে তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে এ কথা ঠিক আবার কেমন ভয়ও লাগছে। এই ছেলেটাকে সে একদম বুঝতে পারে না। ছেলেটা যেন কেমন ধারা। কে জানে! হয়তো কেমনধারা বলেই একে তার এতো বেশি ভালো লাগে।
—‘আমাকে যেতে মানা করলেন কেন?’ গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করে আরশান।
সকাল একটু অপ্রতিভ হলো। চোখ নামালো নিচে। তার বুক কাঁপছে। সে কি ধরা পড়ে গেলো? কিছুক্ষণ চুপ থেকে আস্তে করে বলল, ‘এমনি!’
—‘কাঁদছিলেন কেন?’
—‘এমনি!’ আগের সুরেই বলল সকাল। তারপর আবার বলল, ‘আপনি কোথায় যাচ্ছিলেন? কেনই বা যাচ্ছিলেন?’
আরশান আঙ্গুল নেড়ে এয়ার কোট করে বলে, ‘এমনি!’
সকাল হাসে, ‘আপনি পাগল আছেন।’
—‘আপনিও।’
—‘কী কথা বলছিলেন?’ আরশানের প্রশ্ন।
—‘কী কথা?’ প্রশ্নের ওপর প্রশ্ন করে সকাল।
—‘অনিকের সাথে?’ কেমন থম ধরা গলায় বলে আরশান।
—‘ও! কত কথাই তো বললাম। কোনটা বলবো আপনাকে?’
সকালের মুখে চিলতে একটা হাসির রেখা ফুটে ওঠে। অন্ধকারে সেই হাসি টের পেলো না আরশান। বলল,
—‘হুম তাই তো দেখলাম। অনেক কথা বলছিলেন।’
—‘না আসলে বাংলাদেশে ওর কলেজ আর আমার কলেজ সেইম ছিল। সেইম ব্যাচ।’
—‘ও আপনারা পূর্ব পরিচিত নাকি?’
—‘না, সেভাবে নয়। একচুয়েলি আমার অনিককে মনে নেই। কিন্তু সে বলছে আমাকে নাকি সে খুব ভালো মতো চেনে।’
—‘তাই? আপনি চেনেন না কিন্তু সে আপনাকে চেনে? আপনি কি সেলিব্রিটি নাকি?’ একটু কেমন কাঠ কাঠ শোনায় আরশানের গলা।
সকাল গলায় মেকী অহংকার ফুটিয়ে বলল, ‘আমাকে তো কত জনেই চেনে। বিশেষ করে ছেলেরা। কলেজ লাইফে কত কত এডমায়ারার ছিল! অনিকও বোধহয় আমার এডমায়ারারদের দলভুক্ত ছিল। কে জানে!
আরশানের ভেতরে একটা অদ্ভুত জ্বালা হচ্ছে। সে কিছুতেই ‘সারারাত গল্প করা যাবে’ কথাটা ভুলতে পারছে না। কানের কাছে মাছির মতো ভনভন করছে অনিকের মুখ নিঃসৃত উক্তিটা। তার ওপর সকালের এমন ড্যাম কেয়ার উদ্ধত আচরণে তার মেজাজটা আরো বিগড়ে গেলো। সে তার নিজস্ব কায়দায় ঠোঁট বাঁকা টাকা করে আকাশ পাতাল ভাবলো কিছুক্ষণ। তারপর একটু ঝাঁঝের সাথেই বলল, ‘বেশ তো, যান তাহলে বাড়ি যান, গল্প করুন। সারারাত গল্প করতে পারবেন।’
হাসি চলে আসলো সকালের। অনেক কষ্টে ঠোঁট চেপে হাসিটা থামালো সে।
—‘কিন্তু আপনার যে কী একটা জরুরি কথা বলবার ছিল!’
—‘কিছুই বলার ছিল না।’
—‘তাহলে ডাকলেন কেন?’
—‘হ্যাশট্যাগ এমনি!
—‘বেশ!’ বলে সকাল চুপ করে যায়। আরশানও কিছু বলে না আর। দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ দুজনে, মুখোমুখি। একটা বুনো খরগোশ জংলা ঝোপ থেকে বেরিয়ে এসে ওদের পায়ের দিকে থপ থপ করে হেঁটে আসে অন্ধকারে। আবার ভয় পেয়ে পালিয়ে যায় ঝোপের আড়ালে।
তক্ষক ডাকে। এলোমেলো হাওয়া খেলে। সকাল সে হাওয়ায় আতরের খুশবু পায়। খসখস শব্দ করে শুকনো পাতা সরে যায়, উড়ে যায়, ভাসতে থাকে শূন্যে। বুক কাঁপতে থাকে।
—‘চলুন ফিরে যাই।’
‘চলুন।’ ক্লান্ত গলায় বলল আরশান।
তারপর হঠাৎ সকালের দিকে কী মনে করে যেন ভারি মনোযোগ দিয়ে তাকায়। কয়েক সেকেন্ড চেয়ে থাকে অন্ধকারে। এরপর সম্মোহিতের মতো ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে কাছে। খুব কাছে।
সকালের হৃৎপিন্ড একটিবারের জন্য থমকে দাড়ায়, তারপর ছুটতে থাকে তীরের বেগে। একদম কাছে যখন আসলো মানুষটা। সকালের তখন নিশ্বাস আটকে গেছে। কী হচ্ছে এসব? সে কি স্বপ্ন দেখছে? কোনো কথা নেই। শুধু হৃদয়ের ধুকপুক। এলোমেলো নিশ্বাস।
আরশান হাত দিয়ে আলতো ভাবে সকালের চুল থেকে কিছু একটা সরিয়ে নিল। চাপা গলায় বলল, ‘ভয়ের কিছু নেই। আপনার চুলে পাতা আটকে ছিল। অক্টোবর এসে গেছে তো, এখন খুব পাতার ওড়াওড়ি!’
২৪
নাবিলার গায়ের রংটা একটু চাপা হলেও মুখখানায় বেশ ধারালো একটা সৌন্দর্য আছে। আজকে স্নানের পর সে যখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গাঢ় কাজল লাগালো চোখে তখন ভারি অপরূপ দেখতে লাগলো তাকে। কিন্তু এই বাড়িটা কেমন যেন অদ্ভুত ধরনের গা ছমে ছমে। বেশ বড়সড় শোবার ঘরটায় একটিমাত্র হলদে বাতি জ্বলছে। কাঠের মেঝেতে কোনো কার্পেট নেই। আসবাব বলতে একটা বিছানা আর ড্রেসিংটেবিল।
বন্ধ জানালার কাচের ওপর পাগলাটে হাওয়া ছুটে ছুটে এসে মাথা খুঁটছে, শব্দ করছে হু হু করে। দূর থেকে ভেসে আসছে বুনো কোনও জন্তুর অচেনা ডাক। এছাড়া আর কোনো শব্দ নেই কোথাও। হঠাৎ হঠাৎ শুধু মনে হয় দরজার ওপাশে বুঝি কাঠের মেঝের ওপর মড়মড় শব্দ তুলে কেউ হাঁটছে। হাঁটছে কেউ এ কথা ঠিক, কিন্তু দরজার বাইরে নয়। নিচতলায় কিংবা পাশের রুমে।
ফোন হাতে নিয়ে দেখলো নাবিলা। হালকা একটু নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে এখন। সকালের নাম্বারে ডায়াল করলো। রিং পড়ল কিন্তু ধরলো না কেউ। এই যা! এখন কী করবে সে এই ভূতের বাড়িতে একলা বসে বসে? সর্বক্ষণের সঙ্গী ইন্টারনেটটাও যে সাথে নেই! এ বাড়িতে কোনো ওয়াইফাই আছে কিনা কে জানে। ফাহাদকে একবার জিজ্ঞাসা করবে কি?
না থাক।
কোনো কাজ না পেয়ে ঘরের মধ্যে কিছুক্ষণ পায়চারি করলো নাবিলা। ঘড়িতে রাত নটা। ডিনারে পিৎজাই খেয়েছে ওরা। পিৎজা জিনিসটা যদিও তার খুবই বাজে লাগে। কিন্তু এখন তো আর পছন্দ অপছন্দ নিয়ে চিন্তা করার সময় না।
বিছানায় শুয়ে পড়লেও ঘুম আসবেনা। সকালের নাম্বারে আরেকবার ডায়াল করলো নাবিলা। নো রেসপন্স।
দরজার ওপাশে কিসের যেন একটা শব্দ হচ্ছে। কেউ একজন দরজার নবটা ঘুরালো বলে মনে হলো। নাবিলা তটস্থ হয়ে তাকালো। কিন্তু কাঠের দরজাটা বিন্দু পরিমাণও নড়ল না। ফিকে হলদে আলোয় দেখলো একটা ছায়া ঝুলে আছে আড়াআড়ি ভাবে দরজার গায়ে। ছায়াটা ঠিক কিসের তা ঠাওর করে উঠতে পারলো না সে। বড় একটা শ্বাস নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করলো। ঠান্ডা মগজে দেখলো আবার দরজার দিকটা। বোঝার চেষ্টা করলো ঘটনা। একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল মেরুদণ্ড দিয়ে।
নাহ এখানে আর এক মুহূর্তও থাকতে পারবে না সে। প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে আসলো ঘর থেকে। করিডোরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। আল্লাহ! এরকম আজগুবি ভুতুড়ে জায়গায় সব কিছু থাকতে পারে। জ্বীন, ভূত, দাঁতওয়ালা ড্রাকুলা, ভ্যাম্পায়ার সব। ভূতের সিনেমাগুলোয় এধরনের বাড়িগুলোকেই হন্টেড হাউজ হিসেবে দেখানো হয়। কিছুদিন আগে একটি ভূতের মুভি দেখেছিল সে। সেই ছবিতে ঠিক এরকম একটি বাড়িরই বেজমেন্টে ভূতের বসবাস। আজ এই মুহূর্তে সেই সিনেমার ভূতটার কথাই মনে পড়ছে বারবার।
পাশের ঘরের দরজার সামনে এসে একটু দাড়ালো নাবিলা। ভেতর থেকে টিভির আওয়াজ আসছে। ফাহাদ ঘুমায়নি। অবশ্য এতো তাড়াতাড়ি ঘুমানোর কথাও না। ওকে এই অসময়ে বিরক্ত করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কিন্তু ওই ঘরে যে একলা একলা দম আটকে আসছে। কী করবে নাবিলা? কোন কুলক্ষণে যে সে আসতে গিয়েছিল এই বাজে জায়গাটায়!
দরজায় টোকা দিলো। একবার …..দ্বিতীয়বার …..তৃতীয়বার দেবার সময় খুলে গেলো দরজাটা।
ফাহাদের গায়ে রাতের ঘুমোনোর পোশাক। ছাইরঙা টি শার্ট। কালো ট্রাউজার। হাতে এখনও হুইস্কির গ্লাস। নাবিলাকে দেখে হালকা উৎকণ্ঠা নিয়ে বলল,
—‘কী হয়েছে? সব ঠিক?
নাবিলা বিব্রত ভাবে বলল, ‘না কিছু হয়নি। তুমি ….তুমি কি ঘুমাচ্ছো?’
—‘না ঘুমোচ্ছি কোথায়? এইতো দাঁড়িয়ে আছি তোমার সামনে।’
—‘ও’ নাবিলাকে একটু অপ্রতিভ দেখালো।
—‘এসো ভেতরে এসো।’
নাবিলা আড়ষ্ট ভাবে ঢুকলো ঘরের ভেতর। এ ঘরেও জ্বলছে টিমটিমে একটা ল্যাম্পশেড। অপরাধীর গলায় বলল, ‘খুব সরি ফাহাদ। তোমাকে বিরক্ত করার কোনো ইচ্ছে আমার ছিল না
ফাহাদ খাটের পাশে রাখা কাউচে ধপ করে বসে পড়ে বলল, ‘তাই?’
—‘ঠিক তাই। তুমি বিশ্বাস করলে না?’ নাবিলা ড্রেসিংটেবিলের সামনে রাখা টুলের ওপর এসে বসলো।
—‘না না অবিশ্বাসের কী আছে? কিন্তু বিরক্ত তো করে ফেললে। এখন কী হবে?’ রিমোট দিয়ে টিভি অফ করলো ফাহাদ।
নাবিলা কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ‘তোমাদের এই বাড়িটা একদম ভূতের বাড়ি একটা। হন্টেড হাউজ।’
—‘ঠিক ধরেছো।’
—‘ঠিক ধরেছি মানে?
—‘মানে এ বাড়িটা অনেক পুরনো। আমরা কেনার আগে প্রায় একুশ বছর টানা খালি পড়ে ছিল।’
নাবিলা চোখ কপালে তুলে বলল, ‘একুশ বছর?’
—‘উম হুম!’ বলে গ্লাসে চুমুক দিলো ফাহাদ।
—‘ক… কেন?’ নাবিলা কিছুটা বিচলিত।
—‘এ বাড়িতে একটা মেয়ে সুইসাইড করেছিল। এই ঘরে।’
—‘এই ঘরে?’
—‘হুম, এই ঘরে, বাথরুমে লাশ পাওয়া গিয়েছিল।’
—‘যা!’
—ট্রু স্টোরি! তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না?’
—‘বেশ তো সুইসাইড করেছে তো হয়েছে কী? অনেকেই করে। তার সাথে একুশ বছর বাড়ি খালি থাকার সাথে সম্পর্ক কী?’
—‘মেয়েটার আত্মা প্রতি রাতে ফিরে আসে। ঘটনার এক বছর পর এই বাড়ি ভাড়া নিয়েছিল এক আইরিশ দম্পতি। এক মাসের মাথায় সেই দম্পতির লাশ পাওয়া গিয়েছিল এই ঘরে।’
শুনে নাবিলার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। ভয়ার্ত চোখে একবার চারপাশে চোখ বুলালো সে। আবছা হলদে আলোয় ঘরটা হয়ে আছে এখন অদ্ভুত বিষাদময়। এরকম অভিশপ্ত, ভয়ংকর, বিষাদমাখা ঘরে অনায়াসে এ ধরনের অপমৃত্যুর ঘটনা ঘটতে পারে। অসম্ভব কিছু না। সে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘তুমি আমার সাথে দুষ্টুমি করছো। রাইট?’
ফাহাদ ভারি অবাক গলায় বলল, ‘দুষ্টুমী করবো কেন? সত্যি কথা!
—‘তাহলে এমন একটা ভুতুড়ে বাড়ি তোমরা কিনলে কেন?’
—‘আমি কী জানি? ড্যাড কিনেছে। মনে হয় কম দামে পেয়েছিল। বাট আমি এ জায়গাটা ভীষণ পছন্দ করি। মন খারাপ হলেই চলে আসি এখানে। আসলেই কেমন একটা শান্তি শান্তি ভাব চলে আসে মনের ভেতর। ‘ ফাহাদের গলা একটু একটু জড়িয়ে যাচ্ছে। নাবিলা বলল,
—‘তুমি কি একটু বেশি ড্রিংক করে ফেলেছ?’
—‘করবো না? আমি করবো না তো কে করবে? আমার বড় ভাই, আর আমার হবু বউ। ওয়াও! দারুণ একটা ব্যাপার!
—‘তুমি ব্যাপারটা ভোলার চেষ্টা করো।’
—‘এতো সোজা না।’ সজোরে মাথা নেড়ে বলল ফাহাদ।
—‘তুমি চেষ্টা তো করে দেখো!’
—‘আর চেষ্টা! ইউ নো হোয়াট? আই হ্যাভ অলওয়েজ হেটেড বাংলাদেশি গার্লস, বাংলাদেশি কালচার এন্ড এভরিথিং। আমি জানতাম যে বাঙালি মেয়েরা খুবই খারাপ হয়। ওরা ভেতরে একরকম আর বাইরে আরেকরকম। দে আর প্যারাডক্স, হিপোক্রেট। আই হেইট দেম। শুধু মমের জন্য আমি এই চান্সটা নিতে চেয়েছিলাম।’
.
নাবিলা এবার একটু কড়া গলায় বলল, ‘তুমি প্রথম থেকেই ভুল বুঝে আসছ। সকালের সাথে তো তোমার কোনো কমিটমেন্ট ছিল না ফাহাদ! ও তো তোমার কাছ থেকে সময় চেয়েছিল তাই না?’
—‘সময় চেয়েছে তো কী হয়েছে? ওর যাকে ইচ্ছা তাকে ভালোবাসুক বাট হোয়াই ডিড শী চুজ মাই ব্রাদার ওভার মি? হ্যাঁ? হোয়াই মাই ব্রাদার?’
নাবিলা একটা হতাশ নিশ্বাস ফেলে চুপ করে গেলো। এই ছেলেকে এখন কিছু বোঝানোর চেষ্টা করাই বৃথা। এর মাথা গেছে।
—‘মম চায় আমি বাংলাদেশি মেয়ে বিয়ে করি। নো ওয়ে! আই এম নট বাইইং দ্যাট শিট এনিমোর। নেভার এভার!’
নাবিলা প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, ‘যাই হোক। যা হবার হয়ে গেছে। তোমার ফোন কি কাজ করছে? একটা ফোন করা যাবে? আমার ফোন হঠাৎ হঠাৎ নেটওয়ার্ক পাচ্ছে, আবার পাচ্ছে না।’
—‘আই সুইচড অফ মাই ফাকিং ফোন। আই ডোন্ট নিড এনিবডি।
বলে হাতের গ্লাসটা টেবিলের ওপর রেখে ফাহাদ কাউচের ওপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। চোখ বন্ধ করে বলল, ‘তোমার একা থাকতে ভয় করলে তুমি এই ঘরে ঘুমাতে পারো। দ্যা বেড ইজ ইওরস।’
নাবিলা ভারি মুশকিলে পড়ল। এই ছেলে যে অর্ধেক মাতাল হয়ে গেছে তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। ভেবেছিল গল্প-টল্প করে এই ভয়ংকর অভিশপ্ত রাতটা কোনো রকমে পার করে দেবে। কিন্তু এখন তো দেখা যাচ্ছে শেষমেশ পড়তে হলো মাতালের পাল্লায়। আর এই ঘরে সে কী করে ঘুমাবে? তা কী হয়? পাশের ঘরেই কাটাতে হবে রাতটা। একা একা। ইশ কান্না পাচ্ছে নাবিলার। আল্লাহ কী হবে এখন?
—‘তুমি কি ভাবছ আমি অলরেডি লস্ট? না, আমার নিজের ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আছে। তুমি ভয় পেয়ো না। ফিল ফ্রি। আই এম নট আ ব্যাড গাই।’
—‘না থাক, আমি পাশের ঘরেই থাকছি।’
—‘কিন্তু তুমি তো ভয় পাচ্ছো। ভয়ে তোমার মুখ শুকিয়ে গেছে।’
—‘ভয় পাচ্ছি। কিন্তু কী করার আছে? কিছু তো করার নেই।’
—‘বললাম তো উই ক্যান শেয়ার দ্যা রুম। এন্ড ইউ আর গেটিং দ্যা বেড! আর কী চাই তোমার?’
নাবিলা মিন মিন করে বলল, ‘নাহ থাক!
—‘ওকে। যা ভালো মনে হয় তাই করো।’
নাবিলা উঠে বলল, ‘তুমি টায়ার্ড। ঘুমোও তাহলে।’
—‘হুম।’ ছোট করে বলল ফাহাদ। দরজার কাছাকাছি গিয়ে নাবিলা খুব সাবধানে বলল, ‘আচ্ছা একটা কথা বলি?’
—‘বলো।’
—ঘরের দরজাটা একটু খোলা রাখবে?’
—‘কেন?’
—‘না মানে, যদি আমার বেশি ভয় করে …মানে’
ফাহাদ হো হো করে শব্দ করে হেসে উঠল, ‘মানে ভূত তোমার ঘাড় মটকাতে আসলে তুমি যেন দৌড়ে এসে আমার ঘাড়ে চড়তে পারো। তাই তো?’
নাবিলা নিভলো, ‘যাহ!’
ফাহাদ আগের মতো হাসতে হাসতেই বলল, ‘দরজা খোলা রাখলে রাখতে পারো। আমার কোনো আপত্তি নেই।’
নাবিলা ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ বলে দরজাটা খোলা রেখেই বেরিয়ে এলো ঘর থেকে।
নিজের ঘরে ফিরে এসে সোজা বিছানায় চলে গেলো সে। আর কোনো চিন্তা নয় এখন শুধু ঘুম হবে, শান্তির ঘুম! চোখদুটো জোর করে টেনে বন্ধ করলো। মাথা ঢেকে নিলো কম্বলে। তিনবার সূরা ইখলাস পড়ে বুকে ফু দিলো। তারপর একটু একটু করে যখন চোখটা লেগে আসলো হালকা ঠিক সেই সময় দড়াম করে একটা শব্দ এসে লাগলো কানে। বুক ধক করে উঠল। গলা শুকিয়ে কাঠ। ধড়ফড় করে উঠে বসলো সে। দরজার ওপাশে শব্দ হচ্ছে। কারো পায়ের শব্দ। নাবিলা চিৎকার করে উঠল, ‘কে?’
কোনো শব্দ নেই। নাবিলা আবার বলল, ‘কে? ফাহাদ?’
নাহ কোনো শব্দ নেই। কিন্তু কানে স্পষ্ট এসে লাগছে কারো হাঁটার আওয়াজ।
নাবিলা বিছানা থেকে নেমে ধীরে ধীরে ঘরের দরজাটা খুললো। এতো ভয় সে জীবনে কোনোদিন পায়নি। দরজার ওপাশে যদি এ মুহূর্তে কোনো অশরীরী সত্যিই দাঁড়িয়ে থাকে, তাহলে কী করবে নাবিলা?
দরজার ওপাশে অন্ধকার। শুধুই অন্ধকার।
করিডোর পার হয়ে ফাহাদের ঘরের সামনে আসলো। দরজাটা খোলা। এসে দাড়াতেই ভেতর থেকে গলার স্বরটা ভেসে আসলো, ‘ভয় পেয়েছো?’
নাবিলা একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো, ‘যাক ফাহাদ ঘুমায়নি এখনো। একটা জ্যান্ত মানুষ অন্তত পাওয়া গেলো এই ভূতের রাজ্যে।
ঘরে ঢুকতে ঢুকতে নাবিলা বলল, ‘কিসের শব্দ হচ্ছিল?’
—‘আমি পানির জগ আনতে গিয়েছিলাম। কিচেনে। সরি তোমার ঘুমের ডিস্টার্ব হলো।’
নাবিলা টুলের ওপর বসলো, ‘তুমি ঘুমাওনি যে?’
—‘ঘুম আসছে না তো!’
—‘ও!’
ফাহাদ শোয়া থেকে উঠে বসলো, বলল, ‘তোমাকে খুব বিপদে ফেলে দিলাম। এক্সট্রিমলি সরি।’
—‘না তোমার সরি হওয়ার কিছু নেই। আমি তো নিজ থেকেই এসেছি তোমার সাথে। তুমি তো জোর করোনি।’
—‘মুভি দেখবে?’
—‘দেখা যায়।’
—‘হরর মুভি?’
—‘ফাজলামো হচ্ছে?’
—‘হ্যাঁ হচ্ছে।’
—‘ফাজলামো করো না।’
—‘তুমি হাউজ অব কার্ডস দেখেছো?
—‘সিরিয়াল?’
—‘হুম।’
—‘হ্যাঁ দেখেছি। যদিও আমার পলিটিক্সে ইন্টারেস্ট নেই, কিন্তু এই সিরিয়ালটা অসাম লেগেছে।’
—‘নতুন সিজন এসেছে নেটফ্লিক্স এ। ওয়ানা ওয়াচ?’
—‘দেখা যায়। নেটফ্লিক্স আছে তার মানে ওয়াইফাইও আছে। আমাকে পাসওয়ার্ড দাও।’
—‘পাসওয়ার্ডটা তো আমার এখন মনে নেই। সকালে পিটারের কাছ থেকে নিয়ে দেবো। কেমন?’
টিভিটা লাগানো আছে উল্টো দিকের দেয়ালে। অগত্যা নাবিলাকে টুল ছেড়ে উঠে কাউচে গিয়ে বসতে হলো, ফাহাদের পাশে। ফাহাদের কোলের ওপর কম্বল রাখা ছিল আধখোলা অবস্থায়। নাবিলা বসতেই সে কম্বলটা ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘শীত করছে?’
—‘নাহ!’
—‘শিওর?’
—‘হুম।
—‘তোমাকে হঠাৎ এতো সুন্দর লাগছে কেন? কিছু করেছো নাকি?’
—কী করবো?’ নাবিলা লজ্জা পেয়ে গেলো। ফাহাদ ওর মুখের লালিমাটুকু লক্ষ্য করলো। কিন্তু বুঝে উঠতে পারলো না এই কথায় লজ্জা পাওয়ার মতো কিছু আছে কিনা। সে কথাবার্তা অত ভেবে চিন্তে বলে না। যা মনে আসে তাই বলে বসে।
—‘না মানে সাজগোজ?’
—‘রাতের বেলায় কী সাজবো? আমি তো ঘুমিয়েই পড়েছিলাম।’
—‘ও, আচ্ছা তাই বলো। ঘুম থেকে ওঠার পর তোমাকে সুন্দর দেখায়।’
—‘আর ঘুমোতে যাবার আগে?’
ফাহাদ হাসলো, ‘লক্ষ্য করিনি।’
সিরিয়াল দেখতে দেখতে নাবিলার চোখে ঘুম নেমে এসেছিল। ঢলে পড়ে যাচ্ছিল সে কাউচের ওপর। ফাহাদ ওকে ডেকে তুলে বলল, ‘তুমি বিছানায় যাও। আরাম করে ঘুমোও।’
কথা বাড়ালো না আর নাবিলা। বাধ্য মেয়ের মতো বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। কিন্তু কী আশ্চর্য বিছানায় শোয়ার সাথে সাথেই ঘুম পালালো। এপাশ-ওপাশ করতে লাগলো সে। ফাহাদ একটু বাদে টিভি বন্ধ করল। বাতি নেভালো। নাবিলা তখনো জেগে। চোখ মেলে রেখে সে দেখলো ফাহাদ অন্ধকারে পানির জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢালছে, খাচ্ছে। পানি খাওয়ার পর ফাহাদ এগিয়ে গিয়ে জানালার ব্লাইন্ড তুলে দিলো। ব্লাইন্ড তুলতেই চোখের সামনে বিস্তৃত কালো আকাশ ম্যাজিকের মতো দৃশ্যমান হয়ে উঠল। বাইরে এখনো প্রবল বাতাস। পুরো অক্টোবর জুড়েই এরকম তীব্র বাতাসের চাপ থাকবে। তারপর সেই বাতাসে ভর করে ধীরে ধীরে উড়ে এসে জুড়ে বসবে জরাজীর্ণ শীতের বুড়ি। আকাশ জুড়ে সেজে আছে অসংখ্য নক্ষত্র। দূর পাহাড়ের গায়ে দাঁড়িয়ে থাকা সারি সারি গাছের মাথা দুলছে অন্ধকারে প্রবল হাওয়ার বেগে। ফাহাদ কিছুক্ষণ জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলো স্থবির হয়ে। খানিকক্ষণ পর ধীরে ধীরে এসে কাউচে শুয়ে পড়ল।
তারপর কোথাও আর কোনো শব্দ রইল না। শুধু নিশ্বাসের ওঠানামা।
কেউই ঘুমোচ্ছিল না। ওরকম না ঘুমানো অবস্থায় চুপচাপ শুয়ে থেকে কেটে গেলো আরো একটি ঘণ্টা।
একটা সময় ভোরের সূর্য রশ্মি আকাশের গায়ে তেরছাভাবে ফুটে উঠতে দেখলো নাবিলা। এ এক আশ্চর্য সুন্দর দৃশ্য। ভোর অনেক দেখেছে সে। কিন্তু আজকে যেন সে পৃথিবীর বুকে সূর্যের আগমনের প্রথম পদচিহ্নটি দেখতে পেলো। এই দৃশ্যটি স্বর্গীয়, নিঃসন্দেহে স্বর্গীয়। সম্মোহিতের মতো বিছানা ছেড়ে উঠে জানালার পাশে এসে দাড়ালো সে।
আকাশের গায়ে প্রথম অংকিত হওয়া সেই অলৌকিক আলোকরশ্মিটি ধীরে ধীরে ডালপালা গজাতে শুরু করলো। পাহাড়ের মাথায় ভারি আদুরে অবতরণ করলো সেই সিঁদুর রঙের মায়াবী আলোর ছটা। নিচে জঙ্গলের গাছে গাছে হাওয়া খেলছে। হাওয়া খেলছে দূর পাহাড়ের গায়ে। ঠিক সেই সময় বাড়ির বাম পাশের জংলা ঝোপ থেকে হঠাৎ এক ঝাঁক পাখি উড়ে গেলো ভোরের আকাশের দিকে। আধো অন্ধকারে তাদের গায়ের রং চেনা গেলো না। কিন্তু দৃশ্যটি এতো অপূর্ব যে নাবিলা বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো।
—‘কী করছো?’ ফাহাদ কখন নিঃশব্দে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেনি নাবিলা। হালকা চমকে উঠল সে। বলল, ‘ভোর দেখছি।’
—‘ভোর আবার দেখার কী আছে? ভোর তো রোজ হয়।’
—‘ইশ ফাহাদ! তুমি না একদম রোমান্টিক নও। তোমার বউয়ের কপালে দুঃখ আছে।’
ফাহাদ একটু শ্লেষের হাসি হাসলো, ‘ঠিক বলেছো। এ কারণেই তো কপালে বউ জুটলো না।’
—‘আবার শুরু হয়ে গেলো। তুমি কি দেবদাস হয়ে যাবা নাকি শেষ পর্যন্ত?’
—‘দেবদাস কী?’
—‘তুমি দেবদাসকে চেনো না?’
—‘না কে সে?’
—‘ও তুমি তো বাংলা পড়তেই পারো না। কী করে চিনবে। আচ্ছা শোনো, এখন কোনো কথা না বলে চুপচাপ ভোর হওয়া দেখো।’
—‘চুপচাপ ভোর হওয়া দেখতে হবে? কথা বলে বলে দেখা যাবে না?’
—‘না যাবে না!’
—‘এটা নিয়ম?’
—‘হ্যাঁ, এটাই নিয়ম।’
ফাহাদ এগিয়ে এসে জানালা খুলে দিলো। ঝাপটা বাতাস হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল ঘরের ভেতর। ছুঁয়ে দিলো ওদেরকে। আর সেই সাথে কানে এসে লাগলো কিচিরকিচির পাখির ডাক। কত পাখি কতরকম সুরে যে ডাকছে!
পূবের আকাশ লাল হতে শুরু করেছে। পৃথিবী ভরে যাচ্ছে এক আবছা ধোঁয়াটে আলোয়। পবিত্র হয়ে উঠছে চারপাশ।
মিহি বাতাসের ছোঁয়ায় ছোঁয়ায় ফাহাদের মনের গুমোট কাটছে। এমন আয়োজন করে ভোর দেখা তার জীবনে কখনো হয়ে ওঠেনি। ভোর যে একটা দেখার মতো ব্যাপার, এই উপলব্ধিটিও তার জন্য নতুন। খোলা বাতাসে প্রাণ ভরে আকণ্ঠ শ্বাস টেনে নিলো সে। তারপর নাবিলার দিকে চেয়ে বিমুগ্ধ হয়ে বলল, ‘ভালো লাগছে। ভোর দেখার আইডিয়াটা আসলে অতটা খারাপ না।’