অক্টোবর রেইন – ১০

১০

মানুষ কি কোনো পিছুটান বা মায়া ব্যতীত বেঁচে থাকতে পারে? শুধুমাত্র নিজের জন্য? যদি পেরেও থাকে সেই বেঁচে থাকাকে কি প্রকৃত অর্থে বেঁচে থাকা বলে? এই বাস্তব খটোমটো চিন্তাটা আরশানের মাথায় আসলো তখন, যখন এন্ড্রিয়ানা নিউইয়র্কের হিলটন হোটেলের ৩০২ নম্বর রুমের সফেদ বিছানায় বসে ভারি যত্নের সাথে তার হাতে ওয়াইনের গ্লাস তুলে দিচ্ছিল। ঘরের ভেতর ল্যাম্পশেডের হলুদ ফিকে আলো। কোথাও কোনো কোলাহল নেই। শুধু এয়ারকন্ডিশন চলার একটা ভোঁতা ঝিম ঝিম শব্দ। বিছানায় বসা দুটি প্রায় সমবয়সী যুবক-যুবতী। ঠিক সেইরকম একটা মদির, মত্তখঞ্জন সময়ে তার মাথায় হঠাৎ বিদ্যুতের মতো ভাবনাটা খেলে গেলো। 

পিছুটান ছাড়া কি মানুষ বেঁচে থাকতে পারে? 

এন্ড্রিয়ানার হাত থেকে ওয়াইনের গ্লাসটা নিলো সে, বলল, ‘মানুষ কি একদম একা বেঁচে থাকতে পারে? শুধু নিজের জন্য?’ 

—‘অবশ্যই পারে। কেন পারবে না?’ 

‘সেই বেঁচে থাকাকে কি সত্যিকারের বেঁচে থাকা বলে?’ 

এন্ড্রিয়ানা ওর নীল মণি খচিত অপূর্ব সুন্দর চোখদুটি বড় বড় করে মেলে ধরে বলল, ‘তোমার কী হয়েছে শওন? গতকাল থেকেই তোমাকে একটু কেমন কেমন দেখাচ্ছে। তোমার কি কিছু নিয়ে মন খারাপ?’ 

আরশান চিন্তাযুক্ত গলায় বলল, ‘মন খারাপ নয়। আবার খুব একটা ভালোও নয়। শোনো, রাত কিন্তু বাড়ছে। তুমি ঘুমোতে যাও।’ 

এ কথা শুনে এন্ড্রিয়ানা একটু শ্লেষের গলায় বলল, ‘তুমি কি এটা ভেবে ভয় পাচ্ছো যে আমি তোমার সাথে এখানেই ঘুমিয়ে পড়বো? 

আরশান হাসার চেষ্টা করলো, ‘কী জানি, হয়তো পাচ্ছি। আমার আসলে নিজেকেই নিজের বেশি ভয়। নিজের ওপরে আমার একটা ফোঁটা বিশ্বাস নেই।’ 

—‘না শওন, তুমি মিথ্যে বলছো। তুমি আসলে আমাকে ভালোবাসো না। এখনো বাসো না। জানি না কোনো দিন বাসবে কিনা। 

—‘তোমাকে ভালো না বেসে থাকলে সেটা আমার ব্যর্থতা এন্ট্রি। তোমার নয়। তোমাকে আমি ভালোবাসতেই চাই। হয়তো বেসেও ফেলবো কোনো একদিন। তুমি দেখো?’ 

এন্ড্রিয়ানা আরশানের হাতে নিজের একটা হাত রেখে অনেকটা করুণ গলায় বলল, ‘তোমাকে একটা চুমু খেতে পারি শওন?’ 

আরশান ওর হাতটা সসম্ভ্রমে আগের জায়গায় ফিরিয়ে দিয়ে বলল, 

‘আজ নয়।’ 

—‘কেন? কেন নয়?’ 

—‘আমি তৈরি নই। 

—‘তুমি সবসময় কেন বারণ করো শওন? কেন কখনো আমার ডাকে সাড়া দাও না?’ 

—‘আচ্ছা, আমরা বন্ধু আছি, ভালোই তো আছি তাই না? কেন বারবার এসব কথা টেনে এনে আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্কটা নষ্ট করতে চাও?’ 

এন্ড্রি এবার একটু তেজি গলায় বলল, ‘তুমি আমার বন্ধুর চেয়ে বেশি কিছু। 

—‘একতরফা কিছু হয় না।’ 

—‘একতরফা বলছ কেন? মাত্র তো তুমি বললে যে তুমি আমাকে ভালোবাসতে চাও। বলোনি?’ 

—‘হ্যাঁ বলেছি। সত্যি আমি চাই। কিন্তু ভেতর থেকে সিগন্যালটা এখনো পাচ্ছি না। তুমি বোঝার চেষ্টা করো।’ 

এন্ড্রিয়ানার নীলাভ চোখে একটা মেদুর ছায়া পড়ল। সে ক্ষীণ গলায় বলল, ‘আমার মনে হয় তুমি আর পারবে না।’

—‘কী পারবো না?’ 

—‘যাকগে বাদ দাও। যাই আমি।’ 

হাতে ধরা গ্লাসের পানীয়টুকু এক ঢোকে গলায় ঢেলে দিয়ে এন্ড্রিয়ানা উঠে দাড়ালো। 

ও চলে যাবার পর আরশান অনেকটা সময় একই ভাবে বসে রইল ঝিম ধরে। এই কনফারেন্সে তার আসার কথা ছিল না। আসার কথা ছিল রবার্ট আর এন্ড্রিয়ানার। কিন্তু শেষ মুহূর্তে রবার্ট শরীর খারাপের বাহানায় ট্রিপটা নাকচ করে দিলো। হঠাৎ সন্ধ্যেবেলা বস ফোন দিয়ে বলল, রবার্টের পরিবর্তে কনফারেন্সে যোগ দিতে হবে আরশানের। কোনো প্রস্তুতি ছিল না। চট করে একটা স্যুটকেস গুছিয়ে নিলো তারপর আধাঘণ্টার ভেতর এন্ড্রিয়ানাকে নিয়ে যাত্রা শুরু করলো নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে। 

এসেছে দুদিন হয়ে গেলো। চলে আসার আগে বাড়িতে কাউকে কিছু বলে আসা হয়নি। স্টেটের বাইরে সে হরহামেশাই আসা-যাওয়া করে। অফিসের কাজে ক্রমাগত এদিক-সেদিক যেতে হয়। এছাড়া তার নিজেরও ঘুরে বেড়ানোর নেশা আছে। হঠাৎ হঠাৎ কোনো প্ল্যান ছাড়া সে লং ড্রাইভে বেরিয়ে পড়ে। বাবা এগুলো নিয়ে অতটা মাথা ঘামান না এখন আর। শুধু কোথায় আছে কেমন আছে এই আপডেটটুকু দিয়ে রাখলেই বাবা সন্তুষ্ট। বের হবার সাথে সাথেই বাবাকে মেসেজ করে জানিয়ে দিয়েছে সে। ওই এক বাবাই। আরশানের আর কেউ তো নেই এ জীবনে! বাবা না থাকলে, বলতে নেই, এমন ভাবনা ভাবতেও নেই। তবুও আজ হঠাৎ তার মনে অনিচ্ছাকৃত ভাবেই চিন্তাটা চলে এলো। বাবা না থাকলে তার জীবনে আর কোনো পিছুটান থাকবে না। তখন কী হবে? কী নিয়ে এবং কেনই বা বেঁচে থাকবে সে? শুধুমাত্র নিজের জন্যে? শুধুমাত্র নিজের জন্যে কি বেঁচে থাকা যায়? যায় না। মানুষ স্বার্থপর এ কথা ঠিক। অন্যের সাথে মায়ার বাঁধনে জড়ায় সে নিজের স্বার্থের কারণেই। অপর একজনের মনের ভেতর নিজের স্থান খুঁজে নেয়। নিজেকেই খুঁজে ফেরে সে আপন জনের চোখে। সেরকম প্রকৃত আপনজন বাবা ছাড়া আরশানের আর কেউ তো নেই! ফাহাদ, টিলিকে সে ভালোবাসে এ কথা ঠিক। মনে প্রাণে ভাই বোন দুটির ভালো চায় সে। কিন্তু কোনও পিছুটান কাজ করে না ওদের জন্য। 

বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে একটা অদ্ভুত ক্ষীণ অনুভূতি কাজ করছিল তার ভেতরে। বের হবার আগে বার বার মনে হচ্ছিল কিছু একটা ফেলে যাচ্ছে, কিংবা কোনো অসমাপ্ত কাজ রয়ে গেছে যেটা করা খুব জরুরি ছিল কিন্তু করা হয়নি। মনের ভেতর দারুণ একটা খচখচে ভাব নিয়ে বাড়ি থেকে বের হলো। আর গাড়িতে উঠেই, কী আশ্চর্য! পাশের সিট টায় চোখ পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে আসা মেয়েটার কথা মনে পড়ল। তৎক্ষণাৎ মনে হলো আসার আগে মেয়েটাকে একবার বলে আসা উচিত ছিল। এই ভাবনাটা তাকে ভেতরে ভেতরে অবাক করে দিলো। তার তো কোনো দায়বদ্ধতা নেই মেয়েটার কাছে। সে স্বাধীন মানুষ। যেখানে ইচ্ছে যেতে পারে। কাউকে কিছু বলার নেই, কওয়ার নেই। কিন্তু জানে না কেন সারাটা পথ ধরে তার বুকের ভেতরে একটা চাপা অস্বস্তি গুনগুন করতে থাকলো। কেবলই মনে হতে থাকলো, কী যেন করা হয়নি। কী যেন হওয়ার ছিল, হলো না। 

—‘মা, বাবা কী বলেছে? আরশানের ব্যাপারে কিছু জানত কি বাবা?’ 

—‘আরে না এই ছেলের জন্মের খবর তো তোর বাবার কানে কখনও যায়নি। কিন্তু ফাহাদের আব্বা বলছেন যে তিনি নাকি আমেরিকা যাবার আগে তোর আব্বাকে ফোনে পুত্র সন্তান জন্মের সুখবরটা দিয়ে গিয়েছিলেন। তোর বাবা তো বেমালুম ভুলে বসে আছে।’ 

—‘তোমাদের কথাবার্তা খুব এলোমেলো লাগছে মা। আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না।’ সকালকে খুব বিষণ্ণ শোনালো। 

—‘এত দুশ্চিন্তার কিছু নেই। তোর বাবা ফাহাদের সম্পর্কে খুব ভালো মতো খোঁজ-খবর নিয়েছেন। সব কিছু ঠিক আছে। ওদের বড় ছেলেকে নিয়ে অত ভাবতে হবে না।’ 

—‘ফাহাদকে যদি আমার পছন্দ না হয় তাহলে কী করব?’ 

মা একটু বুঝি থমকে গেল সকালের প্রশ্নটা শুনে। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল, ‘ভালো না লাগলে নেই। তোকে তো কেউ জোর করছে না। আর তুই বলেছিলিস যে পড়াশোনার ব্যাপারে খবর নিবি। কিছু এগোলো কি?’ 

—‘দেখি নাবিলার সাথে ওর ভার্সিটি যাব, কাল পরশু। গিয়ে যদিও তেমন কোনও লাভ হবে না।’ 

—‘লাভ হবে না কেন?’ 

—‘আমি গেলেই কি আমার চেহারা দেখে ওরা আমাকে নিয়ে নেবে নাকি? ফ্যাকাল্টির সাথে কথা বলে দেখতে হবে। আমাকে ফান্ড দেবে কি দেবে না তা তো জানি না। অনেক ঝামেলা। তুমি বুঝবে না মা। 

মায়ের সাথে ফোনে কথা বলা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই নাবিলা এসে পৌঁছুল। তার পরীক্ষা চলছে। পরীক্ষা শেষ করে ভার্সিটি থেকে সরাসরি এসেছে সে। গত কয়েকদিন যাবৎ রাত জেগে পড়াশোনা করেছে মেয়েটা। চোখমুখ জুড়ে রাত জাগার ক্লান্তি। কিন্তু তার ক্লান্তির চেয়ে সকালের অবসাদ আরো ভয়ংকর। দেখলেই মনে হবে মেয়েটা কোনো মারাত্মক মানসিক অশান্তিতে ভুগছে। নাবিলাকে দেখা মাত্র সে ব্যাকুল হয়ে বলল, 

—‘নাবিলা, ও আমাকে ভালোবাসে না। আমি শিওর।’ 

—‘বাচ্চাদের মতো করিস নাতো। তোর সাথে ওর পরিচয় মাত্র কদিনের বল তো? এর মাঝেই কী করে তুই টের পাবি যে ও তোকে ভালোবাসে কি বাসে না?’ 

—‘আমি তো প্রথম দেখাতেই ওকে ভালোবেসেছি। ওর এত সময় লাগছে কেন?’ অস্থিরভাবে বলে সকাল। এ মুহূর্তে তাকে দেখাচ্ছে বারো কি তেরো বছরের সদ্য বয়ঃসন্ধিতে পা দেয়া এক কিশোরীর মতো। তার দু চোখ ভরা কৈশোরের অবুঝ অভিমান। 

—‘এই দুইদিনে তুই এত পাল্টে গেলি কিভাবে রে? তুই তো আগে এতো গাধা ছিলি না। তোর মতো স্মার্ট মেয়ের কিনা এই দশা?’ 

সকাল নাবিলাকে জড়িয়ে ধরে করুণ গলায় বলে, ‘আমি পারছি না রে! একদম পারছি না। দুটা দিনকে আমার দুই বছর মনে হচ্ছে। মানুষটা কি আমাকে একটুও মিস করছে না? একটা বারও আমার কথা ভাবছে না?’ 

নাবিলা সকালের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘ভাবছে, নিশ্চয়ই ভাবছে।’ 

—‘মিথ্যা কথা নাবিলা। একদম মিথ্যা কথা। ও আমাকে ভুলেই গেছে। গিয়ে দেখ গার্লফ্রেন্ডের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে।’ 

—‘আসলে গেছে কোথায় সে?’ 

—‘আমি জানি না। দোস্ত কিচ্ছু জানি না।’

—‘কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করে দেখ। দাড়া আমি টিলিকে প্রশ্ন করব।’

—‘নারে ও যদি আবার কিছু মনে করে?’ 

—‘কী মনে করবে? তুই থাক। আমি দেখি টিলি কি ওর ঘরে আছে কিনা।’ 

নাবিলা উঠে দাড়ালো। সকাল উদ্বেগ নিয়ে বলল, ‘বারে, টিলি যদি জানতে চায় যে ওর ভাইয়ের খবর দিয়ে তোর কী?’ 

—‘বলবো যে… বলব আমার একটা এসাইনমেন্টে হালকা হেল্প লাগবে। একটা ডায়াগ্রাম এঁকে দিতে হবে।’ 

নাবিলা এই বলে ঘর থেকে বেরোলো। ফিরেও আসলো মিনিট চারেকের মধ্যে। এসে হালকা গলায় বলল, ‘আরে সে তো অফিসের কাজে গেছে নিউইয়র্কে। কনফারেন্স আছে। তুই শুধু শুধুই দুশ্চিন্তা করছিস।’ 

শুনে সকাল কিছুক্ষণ ঘোরলাগা চোখে নাবিলার দিকে তাকিয়ে থাকলো। একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলল ‘ও!’ 

তারপর আবার বলল, ‘বেশ তো সে কনফারেন্স করে বেড়াক, দেশ বিদেশ জয় করে বেড়াক। আর আমি এখানে একলা বসে সারাদিন তার ধ্যান করি। তার কথা ভাবি। এটাই আমার কপালে লেখা ছিল।’ 

—‘তা কেন করছিস এরকম নিজের সাথে? বাদ দে না ওর কথা। জাস্ট ভুলে যা। আমার পরীক্ষা শেষ, চল কাল থেকে আমরা সারাদিন ঘুরবো। তুই দেশ দেখতে আসছিস, দেশ দেখবি। ঘুরবি ফিরবি আমোদ করবি অন্য সব চিন্তা বাদ। 

সকাল শূন্য চোখে চেয়ে থাকে। মুখে কোনোরকমে বলে, ‘তাই হবে, তাই হবে।’ 

১১

সন্ধ্যের মুখে মুখে বেরিয়ে পড়ল নাবিলা। ফাহাদ অফিস থেকে ফিরেছে মাত্র। নাবিলাকে নিজেদের বাড়ির সামনে দেখে গাড়ির জানালার কাচ নামিয়ে সে বলল, 

—‘হাই নাবিলা! কী খবর?’ 

—‘এইতো, সকালের সাথে দেখা করতে এসেছিলাম। এখন ফিরে যাচ্ছি।’ 

—‘কিভাবে যাবে? ডু ইউ নিড আ রাইড?’ 

—‘না না, আমি বাসে করে চলে যাবো।’

—‘বাস স্টপ এখান থেকে কত দূরে?’

—‘বেশি দূর নয়। টেন মিনিটস ওয়াক।’ 

—‘বাসে যেতে হবে না। গেট ইন দ্যা কার।’ 

নাবিলা আর কথা না বাড়িয়ে কিছুটা সংকোচ আর দ্বিধা নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। সিট বেল্ট বেঁধে নিয়ে বলল, 

—‘আমার বাসে চড়ার অভ্যাস আছে। বাস ট্রেইন করেই দিন চলে যাচ্ছে।’ 

—‘ড্রাইভ করো না কেন?’ 

—‘ভয় লাগে?’ 

—‘বলছো কী? ড্রাইভিং হলো পৃথিবীর সবচেয়ে সোজা কাজ।’ 

নাবিলা হাসলো, ‘শিখে নেবো দেখি। আমার কিন্তু লারনার্স হয়ে গেছে। এখন শুধু ম্যানুয়াল টেস্টটা বাকি। 

—‘বাহ্ তাহলে তো তোমার অর্ধেক কাজ শেষ। এখন শুধু হাতে কলমে গাড়ি চালানোটা শিখে নিলেই দেখবে আস্তে আস্তে ভয় কেটে যাবে। দেখছো তো, গাড়ি ছাড়া আমেরিকায় টিকে থাকা সম্ভব না। ড্রাইভ তোমাকে করতেই হবে।’ 

—‘হুম তা তো দেখছিই। এই একটা বছর ধরে হাঁটাহাঁটি করেই আধমরা হয়ে গেলাম। কোনো দিন স্বপ্নেও ভাবিনি যে এই আমি কখনো এতো কষ্ট করতে পারবো। ইউএসএ-তে লাইফ অতটা ইজি না। প্রতিটা মুহূর্তে স্ট্রাগল করছি।’ 

শুনে ফাহাদ একটু ভারি গলায় বলল, ‘ইজি করে নিতে চাইলে লাইফ ইজি হতে বাধ্য। চেষ্টা থাকা চাই। যাই হোক তোমার ঠিকানাটা বলো।’ 

নাবিলা তাকালো ফাহাদের দিকে। ঠিকানা বলল। বাইরে সন্ধ্যার ফিকে আলো। পশ্চিম আকাশের মেঘে মেঘে আগুন লেগেছে। রাস্তায় আর কোনো আলো নেই। কোনো ল্যাম্পপোস্ট জ্বলেনি এখনো। 

সন্ধ্যার ওই ফিকে আলোতে ড্রাইভ করতে থাকা কুঞ্চিত ভুর কিছুটা গম্ভীর ফাহাদকে দেখে নাবিলার কিন্তু অতটা খারাপ লাগলো না। সকাল ছেলেটাকে কেন যে কোনো রকম বাছ-বিচার না করেই বাতিলের খাতায় ফেলে দিলো তা তার মাথায় ঢুকছে না। কী নেই এই ছেলের? যা আরশানের আছে? হ্যাঁ আরশানের চেহারা খানা হয়তো একটু বেশিই ভালো। কিন্তু শুধু বাইরের চটক দিয়ে কি জীবন চলে? জীবনের খাতায় এগোতে হয় হিসেব করে, চোখ কান খোলা রেখে, বাস্তব বুদ্ধি প্রয়োগ করে। বোকার মতো আবেগে ভেসে গেলে, আবেগকে প্রশ্রয় দিলে দিন শেষে হিসেবের খাতায় নাচতে থাকবে একটা পেট মোটা শূন্য। সকাল গাধীটাকে এসব কথা কে বোঝাবে? এখন আরশানের বিরহে নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। ওই ব্যাটার চিন্তা বাদ দিয়ে ফাহাদকে একটু সময় দিলেও তো পারতো। একে অপরের সাথে মেলামেশা না করলে ভালো লাগাটা আসবে কোথেকে? ভাবতে ভাবতে বড় একটা নিশ্বাস ফেললো নাবিলা নিজের অজান্তেই। 

ফাহাদ হঠাৎ জরুরি গলায় বলল, ‘নাবিলা শোনো, তোমার কি একটু সময় হবে আজকে? যদি হয় তাহলে আমরা একটা কফিশপে বসতে পারি।’ 

নাবিলা একটু জড়তা নিয়ে বলল, ‘কেন বলো তো?’ 

—‘একটু কথা বলতে চাইছিলাম। তোমার সময় হবে?’ 

নাবিলা ঘড়ি দেখলো। আটটা বাজে। বাড়ি ফিরে রান্না করতে হবে। গত তিন চারদিন পড়াশোনার পেছনে সময় দিতে গিয়ে কিছুই রান্নাবান্না হয়নি। বাইরের কেনা খাবার খেতে হয়েছে। অবশ্য এখন রান্নাঘর খালি পাওয়ার কথা না। পূজা রোজ এ সময়টাতেই রান্না করে। ওরা পাঁচজন ছাত্র-ছাত্রী মিলে একটা এপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়েছে। মাস শেষে জনপ্রতি চারশ ডলারের মতো পড়ে। তিন বেডরুম, কিচেন আর লিভিংরুম। সাথে একটা হাফ বাথরুম এবং একটি ফুল বাথরুম। রুমমেটরা প্রত্যেকেই ভারতীয়। দুজন ছেলে, দুজন মেয়ে। ছেলে দুজন হায়দ্রাবাদী মুসলিম। মেয়ে দুটোই হিন্দু। একজন আবার ভালো ধার্মিক আছে। রোজ সকালে ঘণ্টা বাজিয়ে গান গেয়ে পূজো করে। ঘণ্টা আর গানের শব্দে সকাল বেলার কাঁচা ঘুম ছুটে যায়। রান্নাঘরে লাইন পড়ে, বাথরুমে লাইন পড়ে। প্রতিটা ক্ষেত্রে অপেক্ষা করে, কম্প্রোমাইজ করে তারপরেই টিকে থাকতে হচ্ছে এই দেশে। একা পুরো বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকার মতো সামর্থ্য তার নেই। দেশের মানুষেরা মনে করে আমেরিকা মানে স্বর্গ। এখানে থাকা আর স্বর্গে থাকা একই কথা। কিন্তু এটা আদতে স্বর্গ না নরক তা সেই বোঝে যে এখানে একলা এসে দিন কাটানোর নামে যুদ্ধ করে কাটায়। 

—‘সময় হবে।’ বলল নাবিলা। 

—‘গ্রেট। থ্যাংক ইউ।’ বলে ফাহাদ গাড়ি ঘোরালো। এই রাস্তার ধারেই স্টারবাক্স আছে। নেমে পড়ল ওরা। 

কফি হাতে নিয়ে টেবিলে মুখোমুখি বসলো দুজনে। ফাহাদ কোনো ভূমিকা ছাড়াই হঠাৎ কী মনে করে বাংলায় বলে বসলো, ‘সকাল কী বলল?’ 

ফাহাদের বাংলাটা একেবারেই ভালো নয়। বাংলা সে বলে কম। তার সাথে ইংরেজিতেই কথোপকথন চালাতে হয়। বাংলা যখন বলে তখন হাস্যকর শোনায়। ওর বাংলা শুনে নাবিলার ঠোঁটে একটা মুচকি হাসির রেখা ফুটে উঠল। তা দেখে ফাহাদ আবার ইংরেজিতে ফিরে গেলো, 

—‘তুমি কি আমার বাংলা শুনে হাসলে?’ 

—‘হ্যাঁ, তোমার বাংলা কিন্তু ভয়ঙ্কর!’ 

ফাহাদও হাসলো, ‘আসলে দেশের সাথে আমার যোগাযোগটা সবসময়ই খুব খাপছাড়া ছিল। আমার বড় ভাই ছোটবেলায় টানা অনেকগুলো বছর বাংলাদেশে থেকেছে তাই ওর বাংলা বলার অভ্যাস আছে। আমি যদি কিছু দিন দেশে থেকে আসতাম তাহলে হয়তো আমিও বলতে পারতাম।’ 

—‘এটা তোমার দোষ নয়। অভ্যাসের ব্যাপার। যাই হোক, কী বলছিলে?’ 

—‘বলছিলাম, তোমার বান্ধবী কী বলল?’ 

 বান্ধবী যে তোমার বড় ভাইয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে এই তেতো সত্যটা তোমাকে আমি কী করে বলি ফাহাদ? মনে মনে বলল নাবিলা। আর মুখে বলল, 

—‘কত কথাই তো বলল, তুমি ঠিক কী জানতে চাইছো?’ 

ফাহাদ সিরিয়াস ভাবে বলল, ‘দেখো, আমি তোমার ফ্রেন্ডকে ঠিক বুঝতে পারছি না। ও কি আমার কাছ থেকে কিছু লুকোচ্ছে?’ 

নাবিলা একটু তটস্থ হলো, ‘না না! কী লুকোবে? 

—‘তাহলে ওর প্রব্লেমটা কী? ও আমাকে সময় দিতে চায় না কেন? আমার কেন যেন মনে হয় আমার প্রতি ওর বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। দেখলে কেমন এড়িয়ে চলে। কথা বলতে চাইলে পাত্তা দেয় না। ও কি এখানে আসলেই বিয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবার জন্যে এসেছে? নাকি শুধুমাত্র বেড়ানোর উদ্দেশ্যে এসেছে? যেটাই হোক ওর তো খোলামেলা কথা বলা উচিত তাই না? এভাবে একটা মানুষকে ঝুলিয়ে রাখা কি ঠিক? 

কথাগুলো যোক্তিক এবং বাস্তবিক। শুনে নাবিলা একটু কোণঠাসা হয়ে গেলো। শুকনো মুখে সময় নিয়ে কফি সিপ করলো। ভাবলো। তারপর গলাটা একটু কেশে পরিষ্কার করে নিয়ে বলল, ‘দেখো ফাহাদ, সকাল একটু অন্যরকম। হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত নেবার মতো মেয়ে সে না। ওর ভেতরে কিছু গভীর ব্যাপার-স্যাপার আছে। তুমি তো জানোই যে ওর কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই, ছিল ও না কখনো। ও আসলে মন থেকে একটা সিগন্যাল পাবার অপেক্ষা করছে। সিগন্যালটা পেলে দেখবে নিজ থেকেই এগিয়ে আসবে। তুমি আরেকটু অপেক্ষা করো। 

সুন্দর করে সাজিয়ে মিথ্যে কথাগুলো বলল নাবিলা। বলে একটা আত্মবিশ্বাস-ওয়ালা নিশ্বাস ছাড়লো। মিথ্যেটা ভালো হয়েছে। অবশ্য সবটা যে মিথ্যা তা ও তো নয়। সকাল গভীর মনের মেয়ে এ কথা সত্য। কিন্তু মিথ্যেটা হলো সকাল কোনোদিন ফাহাদের দিকে এগিয়ে যাবে না। বেচারাকে মিছিমিছি স্বপ্ন দেখানো হলো। বেচারা নাবিলার কথা বিশ্বাস করেছে। তার চোখে মুখে একটা নরম ভাব ছড়িয়ে পড়েছে। সে হালকা একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘সাউন্ডস লাইক মাই এল্ডার ব্রো। তুমি জানো আমার ভাইও একই কথা বলে? ওর সারাটা জীবন কেটে গেছে সিগন্যালের অপেক্ষায়। সিগন্যাল আর আসছেই না।’ 

নাবিলা নড়ে চড়ে বসলো, সাবধানে প্রশ্ন করলো, ‘তোমার ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড নাই?’ 

—‘না নেই। খুব ঘনিষ্ঠ একজন কলিগ আছে। মেয়েটা ওকে ভীষণ পছন্দ করে। বাট হি ইজ স্টিল ওয়েইটিং ফর দ্যা সিগন্যাল থিংগ, ইউ নো? আমাকে কিছু বলেনি কখনো। কিন্তু আমি সব খবরই পাই।’ 

নাবিলার ঠোঁটে হালকা একটা হাসির রেখা ফুটে উঠল। সকালকে খবরটা জানাতে হবে। 

—‘হাসছো যে?’ ফাহাদের প্রশ্নে ঘোর কাটলো নাবিলার। 

—‘না এমনি। ভাবছি কিছু কিছু মানুষ একটু অদ্ভুত ধরনের হয়। যেমন তোমার ভাই আর আমার বান্ধবী। ওদের দুজনের বেশ মিল আছে।’ বলে নাবিলা আড়চোখে তাকায় ফাহাদের দিকে। ফাহাদ ইঙ্গিতটা ধরতে পারে না। কোনো ভাবান্তর ঘটেনা তার মাঝে। মনোযোগ দিয়ে কফির কাপে চুমুক দেয়। 

‘বেচারা!’ মনে মনে বলে নাবিলা। তারপর একটু লঘুভাবে প্রশ্ন করে,

—‘তোমার কী মতামত সকালের ব্যাপারে? তোমার কি ওকে পছন্দ?’ 

ফাহাদ খুব সাবলীল গলায় বলল,’ দেখো শী ইজ এক্সট্রিমলি প্রিটি। এন্ড আই লাইক প্রিটি গার্লস। আমি সত্যিই চাই ওর সাথে সময় কাটাতে। ওকে বুঝতে। কিন্তু সে তো আমাকে কোনো সুযোগই দিচ্ছে না। 

—‘না সেটা না। আমি জানতে চাইছি তুমি কি ওকে বিয়ে করার জন্য তৈরি?’ 

ফাহাদ সজোরে ঘাড় নেড়ে বলল, ‘একেবারেই না। যাকে আমি চিনি না, বুঝি না তাকে বিয়ে করবো কী করে? আর তাছাড়া আমি ওর প্রেমেও পড়িনি। আমার মা ওকে ভীষণ পছন্দ করে তাই মনে প্রাণে চাইছি মায়ের পছন্দটাকে নিজের পছন্দ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে। এটা করতে হলে আমাদের একজন আরেকজনকে সময় দিতে হবে। কিন্তু সে তো পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায়।’ 

—‘হুম, আসলে কী, বেচারি এতো দূর থেকে এসেছে। নিজের ইচ্ছা মতো কয়েকটা দিন একটু নির্বিঘ্নে কাটাক। ঘুরাফিরা করে দেশটা দেখুক। তারপর সুড়সুড় করে লাইনে চলে আসবে। তুমি অতো চিন্তা করো না!’ 

ফাহাদ এ কথার উত্তরে কিছু বলল না। গম্ভীর হয়ে কিছু একটা চিন্তা করলো। তারপর প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, 

—‘তোমার খবর কী? কেমন যাচ্ছে সব?’ 

—‘চলে যাচ্ছে কোনো রকম। স্ট্রাগল এন্ড স্ট্রাগল।’ 

—‘তুমি কি পার্ট টাইম জব করছো?’ 

—‘না খুঁজছি। পাচ্ছি না।’

—‘আই ক্যান হেল্প ইউ। তোমার স্কেজিউলটা আমাকে জানিয়ে রেখো।’ 

—‘জব করলে উইকেন্ডেই করতে হবে।’ 

—‘স্যাটারডে, সান ডে?’ 

—‘হুম। স্যাটারডে, সান ডে।’ 

—‘গ্রেট, আমাকে তোমার কন্ট্যাক্ট নাম্বারটা দাও। আমি জানাবো তোমাকে।’ 

নাবিলা ফোন নাম্বার দিলো ফাহাদকে। ফোন নাম্বার নিয়ে ফাহাদ হঠাৎ বলল, 

—‘আর ইউ সি ইং এনি বড়ি?’ 

নাবিলা একটু ভড়কে যাওয়া গলায় বলল, ‘নাতো! কেন? জবের পাশাপাশি বয়ফ্রেন্ডও সাপ্লাই দেবে নাকি তুমি?’ 

ফাহাদ হেসে ফেললো, ‘হ্যাঁ, চাইলে দিতেই পারি। আমার নেটওয়ার্ক ভালো। লাগলে বলো।’ 

নাবিলা কৌতুকের গলায় বলল, ‘ওয়াও ফাহাদ। ইউ আর আ লাইফ সেভার! কী নেই তোমার কাছে?’ 

—‘আমার কাছে সব সমস্যার সমাধান আছে। যে কোনো সমস্যায় তুমি আমাকে পাশে পাবে। আমার মানুষের উপকার করতে ভালো লাগে।’ 

নাবিলা হাসলো। দেখো তো ছেলেটা কী ভীষণ ভালো! সকালটা একটা গাধী! এমন অসাধারণ একটা ছেলেকে নজর ভরে একবার দেখলোও না। পোড়াকপালী একটা! 

১২

চাকরি করা মানে আদতে একধরনের পরাধীনতার শেকল পরিধান করে থাকা। মাঝে মাঝেই এই চাকরবৃত্তি ছেড়ে দিয়ে স্বাধীন জীবনে ফিরে যেতে ইচ্ছে হয় আরশানের। তার ভেতরে একটা বাউন্ডুলে মন আছে। সেই মনটা কোনো রকম দায়বদ্ধতায় আটকা পড়ে থাকতে চায় না। সর্বক্ষণ ইচ্ছে মতো চড়ে বেড়াতে চায় আকাশে বাতাসে, বনে জঙ্গলে, পাহাড়ে পর্বতে। 

সামনে অক্টোবর। অক্টোবরের একটা মাস সে কোনও কাজ করে না। যে করেই হোক ছুটি যোগাড় করেই নেয়। তার মতে বছরের সবচেয়ে বিশুদ্ধ সুন্দরতম মাস হলো অক্টোবর। সূর্যকে প্রদক্ষিণ করার পুরো সময়টার মধ্যে একমাত্র অক্টোবরে এসেই পৃথিবী সবচেয়ে বেশি রূপবতী হয়ে ওঠে পৃথিবীর ওই রূপকে উদযাপন করতেই তার ছুটি নেয়া। অক্টোবরে শুধু একটাই কাজ। মন প্রাণ দিয়ে প্রকৃতি উপভোগ করা। প্রতি বছর তার অক্টোবরটা ভালো যায়। সারাদিন ইচ্ছে মতো ছবি আঁকে। মনে চাইলে পানিতে নেমে সাতার কাটে, পাহাড় বায়। জঙ্গলের রঙিন বুকে দৌড়ে দৌড়ে হারিয়ে যায়। আর ঘুরে ঘুরে পৃথিবীটাকে দেখে। গত বছর গিয়েছিল নর্থ ক্যারোলি না। তার আগের বছর ইউরোপ। এবারের প্ল্যান এখনো হয়নি। খুব শীঘ্রই হয়ে যাবে। 

অক্টোবরের কথা মনে পড়তে তার সারা শরীর মন জুড়ে একটা আদুরে ভালোলাগার পরশ লেগে গেলো। অক্টোবর আসছে। অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো বলে। 

এসব কনফারেন্স টনফারেন্স আরো বাজে ব্যাপার। সারাদিন হোমরা- চোমরা লোকদের বকবকানি শুনো। নিজের প্রেজেন্টেশন তৈরি করো। জনসম্মুখে স্পিচ দাও। নিয়মমতো ঘুম থেকে ওঠো। সবার সাথে একত্রে বসে লাঞ্চ, ডিনার করো। শুধু নিয়ম, নিয়ম আর নিয়ম। সকাল বিকাল রাত্রি আকণ্ঠ নিয়মের মধ্যে ডুবে থাকা। আজকাল আর ভালো লাগে না এসব। কথা বলার মুড থাকলে কথা সে ভালোই বলে। কিন্তু সমস্যা হলো সবসময় সবার সাথে কথা বলতে ভালো লাগে না। সে মানুষটা আদতে একটু রাশভারি এবং অন্তর্মুখী। এই যেমন এই মুহূর্তে এন্ড্রিয়ানাকে তার খুবই বিরক্ত লাগছে। একসাথে একই কনফারেন্স এ এসেছে এর মানে এইতো নয় যে সারাক্ষণ গায়ে গায়ে লেগে থাকতে হবে। মেয়েটা ভারি গায়ে পড়া! মাঝে মাঝে ওর এই গায়ে পড়া সপ্রতিভ ভাবটা খুব খারাপ লাগে। 

এখন রাত আটটা। ডিনারের পর হোটেলের সুইমিং পুলের পাশে এসে বসেছিল সে একান্তে কিছু সময় পার করবে বলে। নিজের বেহালাটাকে ভীষণ ভাবে মিস করছিল। মিনিট না গড়াতেই এন্ট্রি এসে হাজির। 

—‘কী করছো এখানে? সাঁতার কাটবে?’ 

—‘নাহ, এখন নয়।’ 

—‘তাহলে এখানে এসে বসলে কেন?’ 

—‘ইচ্ছে হলো।’ 

—‘আমার খুব সাঁতার কাটতে ইচ্ছে করছে। চলো পানিতে নামি।’

আরশান একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললো। মানুষ কেন নিজের ইচ্ছা অন্যের ওপরে চাপাতে চায়? অথচ অন্যের ইচ্ছাকে সম্মান দেখানোর আরেক নামই হলো শিক্ষা। প্রিয়জনদের সাথে, ভালোবাসার মানুষের সাথে আমরা এই দারুণ অশিক্ষিতের মতো কাজটাই করে থাকি সর্বদা। নিজের ইচ্ছা চাপিয়ে দিই। অন্যের উপরে। 

এন্ড্রিয়ানা কথা না বাড়িয়ে কাপড় পাল্টে এসে পানিতে ঝাঁপ দিলো। চিৎকার করে বলল, ‘এসো এসো, পানি একদম ঠান্ডা না। মজা হবে।’ 

আরশান উঠলনা। পুলসাইডে একটা হলদে ফিকে আলো জ্বলছে। সেই আলোয় নিবিড় চোখে দেখতে লাগলো জলকন্যার মতো সাঁতার কাটতে থাকা এন্ড্রিয়ানাকে। তার পরনে সুইমিং কস্টিউম। অন্ধকারেও চকচক করছে তার মোমের মতো ফর্সা গা। সেই দিকে তাকিয়ে থেকে আরশানের চোখের সামনের দৃশ্যটা হঠাৎ কেমন পাল্টে গেলো। তার অকস্মাৎ মনে পড়ে গেলো সেদিন লেকের পানিতে প্রায় ডুবে যাওয়া নাস্তানাবুদ জবুথবু সকালকে। এতো ভীতুও মানুষ হয়? ভীতু আর বোকা। এসব বোকা মানুষদের রাগিয়ে দেয়ার একটা আলাদা মজা আছে। চালাক মানুষরা সহজে রাগে না। কিংবা রাগলেও রাগ প্রকাশ করে না। কিন্তু বোকারা সাথে সাথে রাগ প্রকাশ করে ফেলে। তাই বোকাদের চটাতে মজাই মজা। 

আরশান নিজের মনে হেসে ফেললো। মেয়েটা জ্বরের ঘোরে যখন ওর কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল তখন মনে হচ্ছিল পৃথিবীর কোনো পাপ কোনোদিন ওই মুখটাকে স্পর্শ করেনি। একটু পাগলও আছে। নইলে ওরকম চট করে কি ঘুমিয়ে পড়া যায়? বাচ্চাদের মতো? কী করছে এখন মেয়েটা? জানে না আরশান কেন কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে খুব জানতে ইচ্ছে হলো, সকাল এখন কী করছে? 

পর মুহূর্তেই ভাবনাটা কেটে গেলো এন্ড্রিয়ানার ডাকে। 

১৩

—‘মানুষটা এখন কী করছে বিন্দু? ঠিক এই মুহূর্তে? 

বিন্দুবাসিনী হাসলো। তার হাতে একটি সদ্য গাঁথা বেলী ফুলের মালা। তারা বারান্দায় এসে বসেছে। আজ আকাশে মেলা তারা! নীলচে তারার বন্যায় ভেসে যাচ্ছে সারাটা আকাশ। কী যে সুন্দর লাগছে দেখতে! এতো সুন্দর যে বুকের ভেতরটা কেমন হু হু করে ওঠে। ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা শব্দ, জোনাকীর উড়াউড়ি, সমস্ত কিছুতে ভারি একটা মন কেমন করা ভাব। 

বিন্দু হাতের মালাটি সকালের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘শেহজাদী, আপনার জন্য মালা গেঁথেছি। এটা নিন।’ 

সকাল হাত বাড়িয়ে মালাটি নিলো, বলল, ‘মালা দিয়ে কী হবে বিন্দু? আমার যে খুব তার কথা জানতে ইচ্ছে করছে। খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছে এই মুহূর্তে সে কী করছে?’ 

কথাটি বলা মাত্র এক ঝাপটা ঝিরঝিরে রেশমী হাওয়া সকালের চুলে আর মুখে আদর করে দিয়ে গেলো। রেশমি হাওয়ায় তার চুল কাঁপলো, পরনের ওড়না উড়লো, মনে স্নিগ্ধ ভাব ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু এই কথাটি সে মনে মনে জানলো না যে ঠিক এই মুহূর্তে সেই মানুষটাও তাকেই ভাবছিল। মন-প্রাণ উজাড় করে জানতে চাইছিল, সকাল এখন কী করছে? 

পৃথিবীতে কিছু কিছু ঘটনা এমন অজানাই থেকে যায়। মহাকালের ডাইরিতে সেইসব টুকরো টুকরো কাহিনি লেখা থাকে ঠিকই কিন্তু কেউ কোনোদিন পড়ে না। কেউ কোনোদিন জানে না। 

 মোবাইল বেজে উঠল। নাবিলা। ফোন ধরতেই খুব জরুরি গলায় বলল,

—‘শেহজাদী, কাল নাইট ক্লাবে যাবি?’ 

সকাল আঁতকে ওঠা গলায় বলল, ‘সেকি কেন?’ 

—‘কেন আবার, দেখতে।’ 

একটু আমতা আমতা করলো সকাল, ‘কার সাথে যাবো?’ 

—‘আমার রুমমেট রা যাচ্ছে কাল। আমাকেও যেতে বলল। তো আমি ভাবলাম তোকেও নিয়ে যাই। তাছাড়া তোর সাথে একটু কথাও আছে আমার।’ 

—‘বাসায় কী বলব? মানে চাচিকে?’ 

—‘বললেই হবে যে তুই আমার বাসায় রাতে স্টে করবি।’ 

—‘ঠিক আছে।’ 

—‘আর শোন পাসপোর্টটা নিয়ে নিস সাথে করে। ক্লাবের ওরা বয়স যাচাই করে ঢোকার আগে।’ 

—‘ওকে। কাল দেখা হবে।’

—‘ছাড়ছি তাহলে।’ 

—‘হুম বায়।’ 

১৪

শর্ট স্কার্ট পরা মেয়েটির নাম পূজা। সে ড্রাইভ করছে। ড্রাইভ করতে করতে পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে সকালকে দেখে ইন্ডিয়ান এক্সেন্টওয়ালা ইংরেজিতে টেনে টেনে বলল, ‘তুমি এই জামা পরে ক্লাবে যাবে?’ 

সকাল ব্যাক্কল বনে গেলো। নিজের গায়ে পরা গোলাপি আর সাদার মিশেলের ফতুয়া আর নীল জিন্সের প্যান্টের দিকে তাকিয়ে মিইয়ে যাওয়া গলায় বলল, ‘হ্যাঁ, কেন কোনো সমস্যা?’ 

পূজা একটা দুষ্টু হাসি হেসে বলল, ‘ক্লাবে যেতে হয় ছোট জামা পরে বেবি! নইলে ছেলেরা তোমার দিকে তাকাবে কেন?’ 

সকালের মুখ থেকে বেকুবী ভাবটা সরল না। সে কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে কোনোরকমে আওড়ালো শব্দটা, ‘ও!’। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে ফিসফিস করে একদম ঝগড়াটি গলায় নাবিলাকে বলল, ‘ছি! কী খারাপ খারাপ কথা! কাদের সাথে মিশিস?’ 

নাবিলা ওর হাতে চিমটি কাটলো,’ আস্তে বল, পূজা একটু একটু বাংলা বোঝে।’ 

গাড়ির পেছনের সিটে নাবিলা আর সকাল বসেছে। সামনের সিটে পূজা আর সুহাসিনী। ছেলে রুমমেটরা আসতে চেয়েছিল। কিন্তু মেয়েরা তাদেরকে আজকের জন্য দলচ্যুত করেছে। আজকে হলো ‘গার্লস নাইট আউট।’ কোনো পুরুষ বন্ধু আজকে মেয়েদের দলে থেকে দাদাগিরি করতে পারবে না। 

পূজা আর সুহাসিনী মালায়লাম ভাষায় নিজেদের মধ্যে সমানে বকবক করে যাচ্ছে। হিন্দিতে কথা বললে বুঝতে কোনো অসুবিধা হতো না। কিন্তু এই জটিল ভাষাটার একটা শব্দও উদ্ধার করতে পারছে না সকাল। সে একদম বিস্মিত হয়ে বলল, ‘কী ভীষণ কঠিন ওদের ভাষাটা! দেখ না মনে হচ্ছে ঝগড়া করছে।’ 

—‘ওয়েল তোমার আমার বাংলা শুনেও ওরা একই কথাই বলবে। বলবে ঝগড়া করছি।’ 

—‘মোটেও না বাংলা কত সুন্দর একটা ভাষা!’

—‘বোকার মতো কথা বলিস না সকাল। সবার কাছেই নিজ নিজ ভাষা প্ৰিয়।‘

সকাল আর কিছু বলল না। কেন যেন পূজা মেয়েটাকে তার প্রথম থেকেই বিরক্ত লাগছে। নাবিলা কী করে এর সাথে একই বাড়িতে থাকে খোদা জানে! বেচারি নাবিলাটা একা একা এই ভিন দেশে পড়ে থেকে ভালো কষ্টই করে। দেশে বাবা মায়ের হোটেলে খেয়ে পড়ে বাবু সেজে থাকা ছেলে-মেয়েরা এইসব কষ্টের রকম-সকম ধারণাও করতে পারবে না। 

রাতের আমেরিকা সকালের কাছে নতুন। রাতের বেলা এই প্রথম বের হওয়া তার। কোনো রকম আলোর ঝলকানি নেই। অনেক দূরে দূরে একেকটি ল্যাম্প পোস্ট। অন্ধকার গায়ে মেখে দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার দু ধারের বনাঞ্চল। শুধু খাবারের দোকান আর ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলোতে আলো জ্বলছে। হাইওয়েতে ওঠার পর অবশ্য আর কোনো দোকানপাটও দেখা গেলো না। বসত বাড়িগুলো সব অন্ধকার। বোঝা যায় বাড়ির বাসিন্দারা গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে। হঠাৎ দেখলে শহর বলে মনে হয় না। মনে হয় গ্রাম এলাকা। এই ছিমছাম ভাবটা সকালের বেশ লাগে। 

ডিসির জর্জটাউনে গাড়ি রাখা নিয়ে ভালোই ঝামেলায় পড়তে হলো। যেখানে সেখানে পার্ক করলে গাড়ি টো হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। টাকা দিয়ে গাড়ি রাখার জায়গাগুলো সব বুকড। প্রায় আধা ঘণ্টা শহরের অলিতে গলিতে টহল দেবার পরে একটা জায়গা পাওয়া গেলো। সেখানে গাড়ি রেখে ক্লাব এলাকায় হেঁটে যেতে সময় লাগলো আরো পনেরো মিনিট। গন্তব্যে পৌঁছুল ওরা রাত দশটায়। 

রাস্তার ওপর পাশাপাশি অনেকগুলো নাইটক্লাব। এ জায়গায় এসে মনে হলো শহর আসলে ঘুমোয়নি। বরং মাত্র আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠেছে। ফ্রাইডে নাইট বলে ভিড়টা বেশ জমানো। প্রতিটা ক্লাবের বাইরে ছেলে- মেয়েরা লাইন দিয়ে আছে। গার্ড সবার আই ডি চেক করছে, বয়স যাচাই করছে তারপর একে একে ঢুকতে দিচ্ছে ভেতরে। বয়স একুশের নিচে হলে ঢোকা যাবে না। 

মেয়েরা যে কত রকম সাজ সেজে এসেছে! তবে পূজার কথা সত্য। বেশির ভাগ মেয়েই ছোট পোশাক পরে এসেছে। এ যেন কে কত ছোট পোশাক পরতে পারে তার একটা অঘোষিত প্রতিযোগিতার আয়োজন। ব্যতিক্রমও আছে। অনেকে লম্বা গাউন পরে এসেছে। কিন্তু সেটাও ভীষণ শরীর দেখানো। বুক পিঠ অনেকখানি খোলা। কারো কারো গাউন আবার পায়ের গোড়ালি থেকে শুরু করে হাঁটুর ওপর পর্যন্ত ফাড়া। হাঁটার সময় সেই ফাড়া কাপড় সরে গিয়ে হাঁটু ভেসে ওঠে। এটাই স্টাইল। বেশির ভাগ মেয়েরাই হাই হিল জুতো পরেছে। ইট বসানো ফুটপাতের রাস্তায় টুক টুক করে হাইহিলে শব্দ তুলে হেঁটে বেড়াচ্ছে। ছেলেদের পোশাকে অত রকম- সকম নেই। বেশিরভাগ ছেলেরাই সাধারণ টি শার্ট পরা। কেউ কেউ আবার হাতের পেশী দেখানো হাতাকাটা গেঞ্জি পরা। সেই পেশিতে আগাগোড়া উল্কি আঁকা। কারো পরনে হাফ প্যান্ট নেই। স্যান্ডেল নেই। ফুল প্যান্ট আর পায়ে বুট অথবা কেডস। 

ভালোই লাগছিল সকালের দেখতে। চারপাশের এতো ঝিকিমিকির মধ্যে নিজেকে হঠাৎ করেই তার কেমন একটু বেখাপ্পা লাগতে শুরু করলো। একটা ক্লাবের সামনে লাইনে দাড়ালো ওরা। নাবিলারা স্টেট আইডি দেখিয়ে ভেতরে ঢুকলো। আর সকাল পাসপোর্ট। কোনো ঝামেলা হলো না। মোটাসোটা গার্ডটা ভ্রু কুঁচকে পাসপোর্ট কিছুক্ষণ নেড়ে চেড়ে দেখে ফেরত দিয়ে দিলো। ঢোকার মুহূর্তে সবার হাতের উল্টো পিঠে একটি করে কালো সিল মেরে দেয়া হচ্ছে। সকালের হাতেও পড়ল সিল। 

ভেতরের দৃশ্যটা পরিচিত। বাস্তবে দেখেনি তবে নাটক সিনেমায় অনেক দেখেছে এইসব নাইট ক্লাবের দৃশ্য। খুব হালকা সবুজ একটা আলো ছড়ানো চারপাশে। অন্ধকার কিন্তু আবার ঠিক পুরোপুরি অন্ধকারও নয়। সব কিছু দেখা যায় কিন্তু বোঝা যায় না। তবে দৃশ্য চেনা হলেও অনুভূতিটা চেনা নয়। অতি উচ্চশব্দে মিউজিক চলছে। মিউজিকের প্রতিটা বিট বুকের হৃৎপিণ্ডে গিয়ে আঘাত করছে। দুম দুম করে ধাক্কা লাগছে বুকে। প্রথম কয়েকটা মিনিট সকালের মনে হলো আর কিছুক্ষণ এখানে থাকলে সে হার্ট এটাক করে মরে যাবে। একটু বাদে কানে আওয়াজ কিছুটা সয়ে আসলো। কিন্তু বুকের ধাক্কা কমলো না। ছেলে-মেয়েরা পাগলের মতো হাত পা ছুঁড়ে নেচে যাচ্ছে ড্যান্স ফ্লোরে। 

ধোঁয়া ছাড়া হচ্ছে। সবুজ, লাল, হলুদ আলো জ্বলছে নিভছে মিউজিকের তালে তালে। 

পূজা আর সুহাসিনী বার টেন্ডারের সাথে আলাপ জমিয়ে দিয়েছে। মদ টদ কিনছে খুব সম্ভবত। দেখে নাবিলা একটু চিন্তিত গলায় বলল, 

—‘এই দুইটা যদি আজকে টাল হয়ে যায় তো সমস্যা আছে। গাড়ি ড্রাইভ করতে দেয়া যাবে না। বাড়ি ফিরবো কী করে? 

সকাল গানের আওয়াজে ঠিকমতো শুনতে পেলো না নাবিলার কথা। জোরে জোরে বলল, ‘কী বললি?’ 

নাবিলা বলল, ‘কিছু না। শোন কী করবি? নাচবি নাকি?’ 

সকাল বিরক্ত গলায় বলল, ‘মাথা খারাপ? পাগল?’ 

নাবিলা হেসে বলল, ‘মদ খাবি?’ 

—‘তুই খাবি। মদ না, থাপ্পড়।’ 

নাবিলা মুখে ফিচেল হাসিটা বজায় রেখেই বলল, ‘আচ্ছা আজকে নয়। তুই বরং আরশানকে নিয়ে আসিস এখানটায়। ডেট মারতে।’ 

সকাল চোখে মুখে অদ্ভুত ভাব ফুটিয়ে বলল, ‘জীবনেও না। দেখেছিস মেয়েগুলো কী রকম বেহায়া। জীবনেও আরশানকে নিয়ে আমি এখানে আসবো না।’ 

শুনে নাবিলা খুব হাসলো, ‘আহা তোর বরটা তো যেন একদম ধোয়া তুলসী পাতা। জীবনে কোনোদিন এসব ক্লাবে আসেনি। মেয়ে দেখেনি! আহা!’ 

সকাল কড়া গলায় বলল, ‘দেখলে দেখেছে। কিন্তু বিয়ের পর আর ওসব চলবে না।’

—‘তুই কিন্তু ভীষণ পজেসিভ।’ 

— ‘ভীষণ! ‘ হেসে কথাটা বলল সকাল। কিন্তু ঠিক পর মুহূর্তেই কী মনে 

করে যেন তার মুখ থেকে হাসিটা মুছে গেলো। নিভে যাওয়া গলায় বলল, ‘কী যে পাগল আমরা। ও তো আমার বর হওয়ার জন্য বসে আছে। আকাশ কুসুম কল্পনা করছি আমি। সে আমার প্রতি একটুও ইন্টারেস্টেড না।’ 

নাবিলা গলায় একটু রহস্য জড়িয়ে বলল, ‘কে বলেছে? আমার তো মনে হচ্ছে ঘটনা অন্যরকম। কেন যেন মনে হচ্ছে তোদের জিনিসটা হয়ে যাবে।’ 

‘আহারে দোস্ত তোর মুখে ফুল চন্দন পড়ুক। কিন্তু তোর পায়ে ধরি আমাকে মিছে মিছে স্বপ্ন দেখাস না।’ 

—‘স্বপ্ন দেখিস না। গাধার মতো স্বপ্ন দেখিস না। আমি শুধু প্রবাবিলিটির কথা বলছি। তাছাড়া আমি একটা নিউজ পেয়েছি ওর ব্যাপারে। যেটা শুনলে তোর হয়তো ভালো লাগবে।’ 

সকাল ঝলমল করে উঠে বলল, ‘কী নিউজ?’ 

নাবিলা দুষ্টু হেসে রসিয়ে রসিয়ে বলল, ‘বলবো কিন্তু তার আগে বল আমাকে কী দিবি?’ 

—‘কসম লাগে দোস্ত, তুই যা চাইবি তাই দিবো। আগে আমাকে খবরটা বল।’ 

—‘এখানে অনেক শব্দ। বাইরে চল।’ 

—‘হুম চল।’ 

বেরিয়ে আসলো ওরা। রাস্তায়। ফুটপাতের ধার ধরে হাঁটতে হাঁটতে নাবিলা বলল, 

—‘খবরটা হলো আরশানের আসলে কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই।’ 

—‘যা! তুই কী করে জানলি? 

—‘জেনেছি। ওর একটা কলিগ আছে, যে ওকে পছন্দ করে। কিন্তু আরশান এখনো ওই মেয়ের সাথে কোনো রিলেশনে জড়ায়নি।’ 

—‘কিন্তু ও যে আমাকে বলল ওর গার্লফ্রেন্ড আছে?’ 

—‘সেটাই তো প্রশ্ন, কেন বলল? তোকে টোকা দিয়ে দেখতে? তোর হিংসা হয় কিনা তা যাচাই করতে?’ 

সকাল একদম কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ‘দোস্ত তাহলে কি ও টের পেয়েছে যে আমি ওকে পছন্দ করি?’ 

—‘পেতেই পারে। তুই একটা ব্যাক্কল। রাখ ঢাক করতে পারিস না।’ 

—‘ছিঃ, কী বাজে ব্যাপার হলো বল তো! মান সম্মান কিছুই থাকলো না। আমি আর কখনো ওর সামনেই যাব না।’ কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল সকাল। 

—‘আজিব! সামনে না গেলে তোমাদের সম্পর্কটা হবে কিভাবে? তোমাকে তো প্ল্যান মাফিক আগাইতে হবে তাই না?’ 

—‘ধুর ছাই কী প্ল্যান? আমি জীবনেও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারবো না।’

—‘তুই কেন বলবি? বলবে ওই ব্যাটা।’ 

—‘বসে আছে বলতে। চিনিস না তুই পুরুষ মানুষদের। সম্পর্কে জড়ায়নি কিন্তু ঠিকই টাইম পাস করে মজা নিচ্ছে ওই মেয়েটার সাথে। সব বুঝে গেছি আমি।’ 

—‘উঁহু, আমার মনে হয় না। আমার মনে হয় আরশান একটু অন্যরকম।’ 

—‘কিন্তু তুই কী করে জানলি এসব কথা? কে বলেছে তোকে?’ 

সেই মুহূর্তে ভূতের মতো অকস্মাৎ হাজির হলো পূজা আর সুহাসিনী। নাবিলার হাত টেনে ধরে বলল,’ কী করছ বাইরে? চলো চলো নাচবো। আজকে আমরা একদম নেচে নেচে বিনদাস হয়ে যাবো।’ 

অগত্যা সকালদের ক্লাবে ঢুকতে হলো। এবার অন্য আরেকটায়। আগেরটায় নয়। 

পূজা আর সুহাসিনী ওদের হাত ধরে একদম ড্যান্স ফ্লোরের মাঝখানে নিয়ে গেলো। তারপর সুরের তালে তালে, গানের তালে তালে হরেক নারী পুরুষের শরীরের ভিড়ে, সকালরাও এক সময় হারিয়ে গেলো। সারাটা পৃথিবী সবুজাভ মদির আলোতে ছেয়ে গেলো। মত্ত আর খেপা গানের সুরে সুরে খেপলো মনের ভেতরটাও, শরীরটাও। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *