অকাল সৎকার
জীবিত অবস্থায় কবরস্থ হওয়ার প্রশ্ন নিতান্তই অবান্তর। আর যদি এ ধরণের দুর্ভাগ্য কারও জীবনে ঘটে, বলতেই হবে সেটি তার চরম দুর্ভাগ্য। অবশ্য জীবন-মৃত্যুর মধ্যে সীমারেখাঁটি অত্যন্ত অস্পষ্ট আর অনির্দিষ্ট। কে বলবে ঠিক কোন বিন্দুতে একটির সমাপ্তি, অন্যটির সূত্রপাত? কোন কোন রোগের কথা আমরা জানি যে সব ক্ষেত্রে মানুষের সাধারণ জীবনলক্ষণ সাময়িকভাবে অনুভবই করা যায় না। এগুলিকে বোধহয় ক্ষণিক বিরতি বলাই সঙ্গত। মানবদেহের মধ্যে যে বিচিত্র যান্ত্রিকক্রিয়া চলেছে এইসব ক্ষেত্রে অত্যন্ত সাময়িকভাবে সেগুলি স্তব্ধ হয়ে যায়। একটা নির্দিষ্ট সময় ফুরোলেই কোন অদৃশ্য হাতের ইঙ্গিতে কলকজাগুলো আবার সচল হয়ে ওঠে। এ যে কী ভাবে ঘটে যায় তার কারণ আজও রহস্যাবৃত। জীবনের রজতসূত্রটি চিরদিনের জন্য ছিন্ন হয়ে যায়না বা এই সব ঘটনার মুহূর্তে মানবজীবনের স্বর্ণাধারটিও চিরকালের মত চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায় না। শুধু একটি প্রশ্নই জেগে থাকে,– দেহযন্ত্রের এই সাময়িক বিরতির সময় আত্মার কী অবস্থা হয়?
যে সিদ্ধান্তেই আমরা উপনীত হইনা কেন বা কাজের প্রকৃতি যে ধরণের ফল উৎপাদন করুক না কেন, আমাদের হাতে এমন সাক্ষ্য প্রমাণ আছে যা দিয়ে প্রমাণ করা যায় যে প্রকৃত মৃত্যুর পুর্বে বহুক্ষেত্রেই মানুষকে কবর দেওয়া হয়েছে। আমাদের এবং চিকিৎসকদের সম্মিলিত অভিজ্ঞতা থেকে এ ধরণের অজস্র প্রমাণ উপস্থিত করা যায়। সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে এমন শতাধিক কাহিনী তত আমারই জানা আছে। এগুলির মধ্যে বাপ্টিমোর শহরের সাম্প্রতিক ঘটনাটি তার আপন বৈশিষ্ট্যে আমাদের স্মৃতির মধ্যে উজ্জ্বল হয়ে আছে। ঐ ঘটনা অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই ব্যাপক বেদনাজনক উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল। কংগ্রেসের একজন সদস্য হঠাৎ ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন আর চিকিৎসকেরা তাকে সুস্থ করে তুলতে সম্পূর্ণরূপেই ব্যর্থ হন। দীর্ঘদিন রোগ ভোগের পর তার মৃত্যু ঘটে–অন্তত মৃত্যু হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়। তাঁর মৃত্যু হয়নি এরকম সন্দেহ পোষণ করার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ ছিল না। নাড়ির গতি স্তব্ধ হয়ে শরীরের উত্তাপ পুরো পুরি চলে গিয়েছিল, তাছাড়া জ্যোতিহীন চোখ, বিবর্ণ অধরোষ্ঠ আর মুখের আকৃতিগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে মৃত্যুর সমস্ত প্রমাণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। কবরে নামিয়ে দেওয়ার আগে তিনদিন দেহটিকে ঘরে শুইয়ে রাখা হয়েছিল আর এর মধ্যেই ওটা পাথরের মত শক্ত হয়ে গিয়েছিল। দেহটিতে পচনক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে যে মুহূর্তে সবাই সন্দেহ করেছেন, সেই মুহূর্তেই দেহটিকে কফিনে পোরার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
কফিনটিকে এরপর পারিবারিক ভল্টের মধ্যে তুলে রাখা হয়। তিন বছর পর কফিনটি বার করে নেবার জন্যে দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে মৃত মহিলার স্বামী বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান। ভল্টের দরজা খোলার মুহূর্তেই সাদা পাথরের টুকরোর মত কিছু জিনিস তার হাতের ওপর এসে পড়ে। তার মৃত পত্নীর কঙ্কাল ছিল সেগুলো। শবাচ্ছাদনের বস্ত্রটিও ছিল অবিকৃত।
খুব সতর্কতার সঙ্গে অনুসন্ধান চালিয়ে বোঝা যায় যে তাকে কফিনে পুরে দেবার দিন দুয়েকের মধ্যেই তিনি বেঁচে ওঠেন। বেঁচে ওঠার পর কফিনের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসার যে প্রাণান্তকর চেষ্টা তিনি করেন তারই ফলে ওটা উঁচু তাক থেকে মেঝেতে পড়ে যায়। এর ফলে কফিনটা ভেঙে যায় আর মহিলাটি তা থেকে সহজেই বেরিয়ে পড়েন। ভল্টের মধ্যে তেলভর্তি একটা লণ্ঠন ভ্রমক্রমে থেকে গিয়েছিল। এখন কিন্তু ওর মধ্যে একবিন্দু তেলও ছিল না। হতে পারে যে পুরো তেলটুকু শুকিয়ে গেছে। ভন্টের মধ্যে নেবে যাবার যে ধাপগুলো তারই ওপরটিতে কফিনের একটা বড় কাঠের টুকরো পড়ে ছিল। বোঝা গেল ওইটে দিয়ে ভল্টের লোহার দরজায় আঘাত করে মহিলাটি বাইরের লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন। এরপর হয় ভয়েই নয়ত দীর্ঘকাল মূৰ্ছা যাবার ফলে তার মৃত্যু হয়েছে। মেঝেতে পড়ে যাবার সময় ওঁর কাপড় একটা লোহার পেরেকে বেধে যায়, তাই সোজা দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় দেহটা পচে নষ্ট হয়ে যায়।
১৮১০ খ্রীষ্টাব্দে ফ্রান্সে এই ধরণেরই এমন একটা ঘটনা ঘটেছিল যাতে আমরা প্রমাণ পেয়েছিলাম যে সত্য ঘটনা গল্প উপন্যাসের চাইতেও কখনো কখনো অবিশ্বাস্য মনে হয়। এ গল্পের নায়িকা কুমারী ভিক্টোরাইন লাফোর্কেড এক বিখ্যাত বিরাট ধনী পরিবারের সুন্দরী কন্যা। প্যারিসের এক দরিদ্র সাংবাদিক ও সাহিত্যিক জুলিয়েন বোসেট ছিলেন ঐ লাফোর্কেডের অন্যতম পাণিপ্রার্থী। বোসেটের প্রতিভা আর অমায়িক ব্যবহারের দরুন মেয়েটি ওঁর প্রতি আকৃষ্ট হয় আর তাকে ভালবাসতে শুরু করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওর নজর পড়ে ধনী আর রাজনীতিবিদ মঁসিয়ে রেনেলের ওপর। বিরাট ধনসম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী লাফোর্কেড প্রতিপত্তিশালী রেনেলকেই বিয়ে করেন। বিয়ের পর কিন্তু এই ভদ্রলোক মেয়েটিকে যে শুধু অবহেলা করতে থাকেন তাই নয়, যথেষ্ট পরিমাণে দুর্ব্যবহারও আরম্ভ করেন। কয়েকটা বছর শোচনীয় জীবন কাটাবার পর লাফোর্কেডের মৃত্যু হয়। বলা উচিত যে যারা সে সময় তাকে দেখেছিল তারা মেয়েটির শরীরে মৃত্যুর লক্ষণই দেখেছিল। ওর কফিন কিন্তু ভল্টে রাখা হয়নি, গ্রাম্য কবরখানায় সেটি সমাহিত হয়। যদিও হতাশায় পুরো ভেঙে পড়েছিলেন তবু বোসেটের জীবনে কুমারী লাফোর্কেডের প্রেম এমন প্রভাব বিস্তার করেছিল যে দূর গ্রামে গিয়ে কবর থেকে মেয়েটির অদ্ভুত সুন্দর চুলের একটি গুচ্ছ সংগ্রহ করার সঙ্কল্প করেন। গাঁয়ে পৌঁছে দুপুর রাতে কবর খুলে বোসেট চুলের গুচ্ছ নিতে গিয়ে মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠেন। আসলে মেয়েটির তখনো মৃত্যু হয়নি। শরীর থেকে প্রাণসত্তা পুরোপুরি চলে যায়নি বলেই প্রেমিকের স্পর্শে সে যেন ঘুমের থেকে জেগে উঠেছিল। বোসেটতাড়াতাড়ি মেয়েটিকে পাশের একটা বাড়ীতে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ করে তোলেন। লাফোর্কেড বোসেটকে চিনতে পারে আর যতদিন না তার শরীর পুরো সেরে ওঠে ততদিন তারই কাছে থাকে। লাফোর্কেডের নারীহৃদয় অকৃতজ্ঞ ছিল না তাই নবলব্ধ জীবনের সমস্তটুকু প্রেম সে বোসেটকেই অর্পণ করেছিল। সে যে জীবন ফিরে পেয়েছে এ খবর প্রচার না করে বা স্বামীর কাছে ফিরে না গিয়ে সে বোসেটের সঙ্গে আমেরিকা চলে যায়। বিশ বছর পরে ওরা যখন প্যারিসে ফিরে আসে তখন মেয়েটির অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ওদের ধারণা ছিল কেউ লাফোর্কেডকে চিনতে পারবেনা, কিন্তু আশ্চর্য! প্রথম দর্শনেই মঁসিয়ে রেনেল ওকে চিনতে পারলেন আর স্ত্রী হিসেবে দাবী করে বসলেন। শেষ পর্যন্ত আদালতের রায় গেল লাফোর্কেডের পক্ষে। বিচারক ঘোষণা করলেন, ঘটনার বৈশিষ্ট্য এবং সুদীর্ঘকাল স্বামীর কাছ থেকে দূরে থাকার ফলে আইনত মেয়েটির ওপর রেনেলের অধিকার নষ্ট হয়ে গেছে।
লেইপসিকের ‘সার্জিক্যাল জার্নাল’ একটি বিখ্যাত পত্রিকা। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি সংখ্যায় এই পত্রিকা এই ধরণের আর একটি ঘটনার খবর দিয়েছে।
গোলন্দাজ বাহিনীর একজন বেশ লম্বা চওড়া চেহারার অফিসার একটা দুষ্টু ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে মাথায় বেশ আঘাত পান। মাথার খুলি একটুখানি জখম হওয়া সত্ত্বেও ওঁর সম্পর্কে বিপদের কোন আশঙ্কা চিকিৎসকেরা করেন নি। যাই হোক শেষ পর্যন্ত মাথায় অপারেশন করা হল, রক্তমোণ আর অন্যান্য সমস্ত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অবলম্বন করা হল, কিন্তু রোগী ধীরে ধীরে গভীর সুপ্তির মধ্যে তলিয়ে গেলেন। শেষ পর্যন্ত সকলেই ধরে নিলেন তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
আবহাওয়া তখন ছিল উষ্ণ আর অস্বাভাবিক ব্যস্ততার মধ্যে তাঁকে একটা সাধারণ কবরখানায় সমাহিত করা হয় এক বৃহস্পতিবার। পরের রোববার স্বাভাবিকভাবেই সেখানে বহুলোকের সমাগম ঘটে। সেদিন দুপুরে হঠাৎ কবরখানায় প্রবল উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। একটি চাষী বলে যে সে যখন অফিসারটির কবরের কাছে বসেছিল তখন মাটির ভেতর থেকে একটা সাড়া পেয়েছে। তার দৃঢ় ধারণা যে তলা থেকে কেউ বাইরে আসার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে। প্রথমটা বড় কেউ একটা ওর কথায় কান দেয়নি। সে কিন্তু ছেড়ে কথা কইবার পাত্র নয়। সে যে সত্যি কথাই বলছে এটা প্রমাণ করার জন্য সে ভীষণ চেঁচামেচি করে। ফলে উপস্থিত লোকজনদের মনের পরিবর্তন হয়। তাড়াতাড়ি কোদাল গাইতি এনে খোঁড়াখুড়ি শুরু হোল। কবরটা মোটেই গভীর ছিল
তাই একটুখানি খোড়বার পরই ওর ভেতর থেকে একটা মাথা বেরিয়ে এলো। ওকে দেখে মৃত বলেই মনে হচ্ছিল। বেচারা কবরের মধ্যে কফিনের ভেতর উঠে বসেছিল আর ওর প্রাণপণ চেষ্টায় কফিনটা ভেঙেও গিয়েছিল।
তাড়াতাড়ি ওকে পাশের একটা হাসপাতালে নিয়ে যাবার পর ওখানে মানুটিকে জীবিত বলেই ঘোষণা করা হয়। অবশ্য চিকিৎসকরা একথা বলেন যে সাময়িকভাবে ওর হৃদস্পন্দনের বিরতি ঘটেছে। কয়েক ঘণ্টার চেষ্টায় সে সেরে ওঠে, পরিচিতদের ঠিকমত চিনতে পারে আর কবরের মধ্যেকার দুঃখময় ভয়াবহ অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেয়। অবশ্য তখনো তার বাচনভঙ্গীর মধ্যে জড়তা ছিল।
ওর বর্ণনা থেকেই এইটি প্রতিপন্ন হয় যে ওকে যখন সমাহিত করা হয় তখন ওর চেতনা ছিল। পরে অবশ্য সে চেতনা হারায়। অত্যন্ত ব্যস্ততার সঙ্গে হালকা রন্ধ্রবহুল মাটি দিয়ে অল্প নীচে কফিনটি চাপা দেওয়া হয়, ফলে ওর মধ্যে বাতাস অনায়াসে যেতে পেরেছে। কবরের ওপরে মানুষের চলাফেরার শব্দ পেয়ে সে প্রাণপণে তার খবর পৌঁছে দিতে চেয়েছে। আসলে ঐ চলাফেরার শব্দই ওর ঘুম ভাঙিয়েছিল কিন্তু তার পরমুহূর্তেই নিজের অবস্থা বুঝতে পেরে সে ভীষণ ভয় পেয়ে যায়।
পত্রিকায় বলা হয়েছে যে রোগী বেশ স্বাভাবিকভাবেই সেরে উঠছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত হাতুড়ে বৈদ্যগিরিতেই বেচারা মারা যায়। কৃত্রিম উপায়ে বৈদ্যুতিক শক্তির সাহায্যে তাকে তাড়াতাড়ি সারিয়ে তোলবার চেষ্টা করার ফলে তারই আকস্মিক প্রচণ্ড ক্রিয়ায় রোগীর মৃত্যু হয়।
বৈদ্যুতিক শক্তির সাহায্য নেবার প্রসঙ্গে আমার আর একটা কাহিনী মনে পড়ছে। কাহিনীটি অদ্ভুত ধরণের হলেও বহুপরিচিত। ১৮৩১ খ্রীষ্টাব্দে লণ্ডনে এক আইনজীবী যুবককে দু’দিন পরে কবর থেকে বার করে এই প্রক্রিয়ায় বাঁচিয়ে তোলা হয়। ঘটনাটা এমন ভাবে প্রচারিত হয়েছিল যে লণ্ডনে যে কোন আলোচনার বিষয়বস্তুই ছিল তখন এই জীবনদান প্রসঙ্গ।
মিঃ এডওয়ার্ড স্টেপলটন টাইফয়েড আর তার আনুষঙ্গিক কতকগুলো উপসর্গের কবলে পড়ে মারা যান। মৃত্যুর সময় তার ঐ বিশেষ উপসর্গগুলো সম্পর্কে চিকিৎসকেরা অনুসন্ধিৎসু হয়ে ওঠেন, তাই মৃত্যুর পর দেহের ওপর অপারেশন করে পরীক্ষা করার জন্যে তার বন্ধুবান্ধবদের অনুমতি চাওয়া হয়। সে অনুমতি কিন্তু পাওয়া গেল না। এ সব ক্ষেত্রে চিকিৎসকেরা কবর থেকে শবদেহ বার করে এনে পরে সময়মতো অপারেশনের সাহায্যে ওঁদের পরীক্ষার কাজ করেন। লণ্ডনে মৃতদেহ বার করে দেবার লোকের অভাব নেই। ওদেরই কারো সাহায্যে মৃত্যুর তিনদিন পরে আটফুট গভীর কবর থেকে স্টেপলটনের মৃতদেহ বার করে একটা বেসরকারী হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে আসা হয়।
মৃতদেহের পেটের ওপর ছুরি দিয়ে একটুখানি কাটার পর দেখা যায় যে দেহের বিন্দুমাত্র বিকৃতি ঘটেনি। সেই মুহূর্তে ব্যাটারী লাগিয়ে বৈদ্যুতিক শক্তি সঞ্চারের চেষ্টা করেন চিকিৎসকেরা। বার বার চেষ্টা করে দেখা গেল দেহের মধ্যে কয়েকবার আক্ষেপ সৃষ্টি করা ছাড়া এই প্রক্রিয়াগুলিতে অন্য ফলোদয় হচ্ছে না।
নানারকম পরীক্ষায় অনেক সময় অতিবাহিত হয়েছিল। তখন প্রায় ভোর হয় হয়। স্থির করা হল যে আর কালবিলম্ব না করে শবব্যবচ্ছেদের কাজ শুরু করা দরকার। একটি ছাত্র কিন্তু এই পরীক্ষায় খুব উৎসাহী ছিল। তার এ সম্বন্ধে কতকগুলো নিজস্ব ধারণা ছিল। সে আর একবার বুকের পেশীগুলিতে বৈদ্যুতিক শক্তি সঞ্চার করে ফলাফল পরীক্ষা করে দেখতে চাইল। তাড়াতাড়ি বৈদ্যুতিক ক্রিয়া সঞ্চারিত করাও হল। মৃতব্যক্তি সেই মুহূর্তে টেবিলের ওপর থেকে নেমে মেঝেতে পায়চারী আরম্ভ করলেন, আর এদিক ওদিকে দেখার পর কথাও বললেন। ওঁর কথা বোঝা যাচ্ছিল না, তবে উচ্চারণে কোন জড়তা ছিল না। কিছুক্ষণ এইভাবে কথা বলার পর উনি মেঝের ওপর আছড়ে পড়লেন।
প্রথমটায় উপস্থিত সবাই ঘাবড়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু ঐ রোগীর জন্যে সেই মুহূর্তেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তোলার আবশ্যকীয়তাই ওঁদের আবার চাঙ্গা করে তোলে। আসলে মিঃ স্টেপলটনের মৃত্যু হয়নি, উনি সংজ্ঞা হারিয়েছিলেন মাত্র। ইথার ব্যবহারের পর তার সংজ্ঞা ফিরে এলো, তিনি সম্পূর্ণভাবে সুস্থ হয়ে আত্মীয়বন্ধুদের কাছে ফিরে গেলেন। পাছে তাঁর শরীরে আবার কোন উপসর্গ দেখা দেয় এই জন্যে কিছুদিন পর্যন্ত তাঁর এই পুনর্জন্ম লাভের ঘটনাটি গোপন রাখা হয়েছিল। পরে যখন আত্মীয়েরা মিঃ স্টেপলটনকে ফিরে পান তখন তাঁরা কী পরিমাণে আনন্দিত হয়েছিলেন তা সহজেই অনুমান করা যায়।
এই ঘটনার সবচাইতে রোমাঞ্চকর অংশটি মিঃ স্টেপলটনের কাছ থেকেই জানা যায়। উনি বলেছেন যে পুরো ঘটনার কোন অধ্যায়েই উনি একেবারে চেতনাহীন ছিলেন না। অসুস্থ অবস্থায় যখন চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন তখন থেকে বেসরকারী হাসপাতালের মেঝেতে আছাড় খেয়ে পড়ে যাওয়া পর্যন্ত সমস্ত ক্ষণ তার চেতনা ছিল। অবশ্য এটা ঠিক যে সমস্ত কিছুর মধ্যে একটা অস্পষ্টতা ছিল আর সবটাই যেন গোলমেলে মনে হচ্ছিল। হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে যে কথাটা তিনি বলতে চাইছিলেন তা হোল, ‘আমি বেঁচে আছি।
এ ধরণের বহু ঘটনারই ইতিহাস এখানে উল্লেখ করা যায় অত্যন্ত সহজেই। কিন্তু মানুষের অকাল সকারও করা হয়ে থাকে সেইটে প্রমাণ করবার জন্যে এত ঘটনার উল্লেখ নিস্প্রয়োজন। যখনই ভাবি যে এরকমের ব্যাপারগুলোকে ভালো করে বুঝে দেখবার শক্তি আমাদের কত কম তখনই মনে হয় এরকম ঘটনা অসংখ্য ঘটে যাচ্ছে। কোন বিশেষ প্রয়োজনে কবরখানা খোলর পর নরকঙ্কাল গুলোকে ঠিক শায়িত অবস্থায় পাওয়া যায় নি, এ অভিজ্ঞতার পরিমাণ অল্প নয়। ফলে আমাদের মনে একটা ভয়াবহ সন্দেহ অবশ্যই জাগে।
আমাদের পক্ষে এগুলো যতই ভয়াবহ হোক না কেন, কবরস্থ হতভাগ্যের মৃত্যুযন্ত্রণা তার চাইতে অনেক বেশী ভয়ঙ্কর। মৃত্যুর পুর্বেই কাউকে সমাহিত করলে তাকে যে দৈহিক আর মানসিক পীড়ন ভোগ করতে হয় তা অকল্পনীয়। পৃথিবীর মুক্ত বায়ুর জন্য দুঃসহ দৈহিক আক্ষেপ, প্রদীপ শিখার শ্বাসরোধকারী প্রভাব, শবাচ্ছাদন বস্ত্রসমূহের অসহনীয় স্পর্শ, কফিনের হিমশীতল আলিঙ্গন, চিরন্তন রাত্রির নিচ্ছিদ্র অন্ধকার, সমুদ্রের গভীরতম নিস্তব্ধতা, দেহটিকে ধ্বংস করে ফেলার জন্যে অজস্র মৃত্যু-কীটের দুঃসহ স্পর্শ আর সেই সঙ্গে শম্পশ্যাম পৃথিবীর প্রিয়জন–যারা অবহিত হলে এই মুহূর্তেই সমাহিত মানুষটিকে উদ্ধার করবার জন্যে ছুটে আসত, সব মিলেমিশে যে চিন্তা ঐ মানুষটিকে আচ্ছন্ন করে ফেলে, কোন অসীম সাহসী মানুষও তার মুখোমুখি দাঁড়াতে পারবে না। পৃথিবীর বুকের ওপর এইসব মর্মান্তিক যন্ত্রণার কোন খবরই আমরা রাখি না। কল্পনা করতে পারি না মাটির তলায় নরক যন্ত্রণার যে স্বরূপ তার অর্ধাংশও। এ ঘটনাগুলোর কাহিনীতে আমাদের আকর্ষণ অপরিসীম আর শ্রদ্ধামিশ্রিত ভীতিও আছে প্রচুর শুধু এই কারণেই যে এই কাহিনীতে আমরা আস্থাবান। সব শেষের যে কাহিনীটি বলছি তা সম্পূর্ণভাবেই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা-নির্ভর।
বেশ কয়েক বছর ধরে আমি যে বিশেষ একটি রোগে ভুগছি চিকিৎসকরা তাকে অন্য কোন নির্দিষ্ট নামে অভিহিত না করে শারীরিক কাঠিন্যযুক্ত সাময়িক চেতনালোপ বলছেন। কেন এই ব্যাধির আক্রমণ ঘটে বা প্রকৃত উৎস কোথায় সে সব কিছুই রহস্যাবৃত থাকা সত্ত্বেও ব্যাধির আক্রমণ মুহূর্তে কী ঘটে সে সম্পর্কে সকলেই ওয়াকিবহাল। বিভিন্ন সময়ের আক্রমণগুলির মধ্যে পার্থক্য শুধু পরিমাণগত। কখনো কখনো রোগী একটি দিন, তারও কম সময়ের জন্যে ভয়ানক ক্লান্তিজনিত অবসন্নতার মত অচেতন থাকে। এই অচেতন অবস্থায় তার অতিক্ষীণ হৃদ্স্পন্দন ছাড়া দৈহিক স্পন্দন আর মোটেই থাকে না। সামান্যতম দৈহিক উত্তাপ, চিবুকের ওপর কোন একটি কেন্দ্রে কিঞ্চিৎ পরিমাণ অক্ষুণ্ণ দেহবর্ণ আর অধরোষ্ঠের কাছে দর্পণ সংলগ্ন করে ফুসফুঁসের ক্ষীণতম ক্রিয়াও লক্ষ্য করা যেতে পারে। কখনো কখনো কয়েক সপ্তাহ বা মাস পর্যন্ত এই চেতনাহীন অবস্থার জের চলে। এই সময় অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের খুঁটিনাটি পরীক্ষা বা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের সাহায্যেও এই অবস্থার সঙ্গে মৃত্যুর লাক্ষণিক পার্থক্য বোঝা যায় না। বন্ধুবান্ধবেরা এ ধরণের আক্ৰমণ সম্পর্কে পূর্ব থেকেই সচেতন আর দেহে পচনক্রিয়ার লক্ষণ থাকে না বলেই রোগীকে অকালে সমাহিত করা হয় না। সৌভাগ্যের কথা, এসব ব্যাধির ব্যাপ্তি ঘটে ক্রম পর্যায়ে। প্রথম যখন ব্যাধির লক্ষণ দেখা যায় তখন সে সম্পর্কে মতদ্বৈধ থাকে না। এরপর সময়ের দৈর্ঘ্য বাড়তে থাকে আর রোগের লক্ষণগুলোও স্পষ্টতর হতে থাকে। রোগীকে যে প্রকৃত মৃত্যুর আগেই সমাহিত করা হয় না তার কারণই এই। যে হতভাগ্যের প্রথম আক্রমণটি গুরুতর প্রকৃতির তার ভাগ্যে অকাল সমাধি সুনিশ্চিত।
চিকিৎসা শাস্ত্রে এ রোগের যে ধরণের বর্ণনা আছে আমার ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম ঘটে নি। কখনো কখনো বাহ কোন কারণ ছাড়াই আমি এলিয়ে পড়তাম আর ধীরে ধীরে চেতনাহীন অবস্থায় উপনীত হতাম। এই সময় কোন প্রকার দৈহিক যন্ত্রণা আমার থাকতে না ঠিকই, কিন্তু আমি কথা বলতে, নড়াচড়া করতে এমনকি কোন কিছু চিন্তা করতেও পারতাম না। আমার মধ্যে এক ধরণের অস্পষ্ট চেতনা কাজ করত আর তারই সাহায্যে যারা তখন আমার বিছানার আশেপাশে থাকত, তাদের উপস্থিতিটি বুঝতে পারতাম। যতক্ষণ রোগের আক্রমণ অন্তর্হিত হোত ততক্ষণ চেতনা আর চেতনহীনতার মোহানায় আমার সময় কাটত। কখনো বা নিতান্তই আকস্মিক দ্রুততার সঙ্গে আমার শরীর শীতল হয়ে যেত, আমার চেতনা সম্পূর্ণভাবেই লুপ্ত হয়ে যেত আর আমি মৃতের মত কয়েক সপ্তাহ পড়ে থাকতাম। এই সময় আমার কাছে সবই মনে হোত শূন্য, অন্ধকার আর নীরব। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তখন আমার কাছে অর্থহীন হয়ে যেত। জগৎসংসার ধ্বংস হয়ে যাওয়া আমার কাছে এমন কিছু বড় ঘটনা নয় তখন। এ সব ক্ষেত্রে ব্যাধির আক্রমণ সম্পূর্ণ আকস্মিক এবং সর্বাত্মক হলেও, আমার জ্ঞান ফিরে আসত, আনুপাতিকহারে অত্যন্ত মন্থর গতিতে। এ যেন সুদীর্ঘ নির্জন শীতরাত্রির একক ভ্রমণের পর, গৃহহীন বন্ধুহীন এক ভিক্ষুকের জীবনে ক্লান্ত মন্থর গতিতে আনন্দময় নবসূর্যোদয়ের মতো আমার দেহের মধ্যে আত্মার প্রত্যাবর্তন।
সাময়িকভাবে চেতনাহীন হওয়া ছাড়া আমার দেহে অন্য কোন প্রকার ব্যাধি ছিল না। সাধারণভাবে বরং আমার স্বাস্থ্য ভালোই ছিল। আমি তখন বুঝতে পারিনি যে আমার ঘুমের মধ্যেই ঐ ব্যাধির বীজ নিহিত। আমার ঘুম ভাঙলে আমি কখনোই দ্রুতগতিতে চেতনা ফিরে পাইনি। বেশ কয়েক মিনিট কেটে যেত আচ্ছন্ন অবস্থায়। মানসিক ক্রিয়া, বিশেষ করে স্মৃতিশক্তির প্রত্যাবর্তন ঘটত অত্যন্ত বিলম্বে।
এসবের জন্যে আমার দৈহিক কষ্ট কিছুই ছিল না, কিন্তু মানসিক যন্ত্রণা ছিল অপরিসীম। আমার কল্পনার জগতে একটি কঙ্কাল শালা গড়ে উঠেছিল, যার ফলে আমার আলাপ-আলোচনার মধ্যে অনিবার্য ভাবেই ‘কবর’, ‘কীট’, ‘কবরের প্রস্তর ফলক’ এই শব্দগুলো ব্যবহৃত হোত। মৃত্যু, অকাল সমাধি–এই সব চিন্তা আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে দাঁড়ালো। দিনের বেলা এগুলো নিয়ে চিন্তা করতাম, ফলে রাত্রে সেগুলো মনের ওপর পাথরের মত চেপে বসে থাকত। যেই অন্ধকার ঘনিয়ে আসত পৃথিবীর ওপর, আমার সমস্ত শরীর শবাধারের মোমবাতির সামনে কম্পমান পালকের মত কেঁপে কেঁপে উঠত। জেগে থাকার মত শক্তি যখন আর থাকত না তখনই ঘুমুতে বাধ্য হতাম আমি। কিন্তু ঘুমুতে যাবার সময় এই ভীতিটিই প্রবল হয়ে উঠত যে হয়ত ঘুম ভাঙলে দেখব আমি কবরের মধ্যে বন্দী হয়ে পড়েছি। ঘুমের মধ্যে আমি অনতিবিলম্বেই চলে যেতাম একটা অলীক ছায়ামূর্তির জগতে, যেখানে কেবলমাত্র সমাধিক্ষেত্রের চিন্তা আমার মনের মধ্যে কৃষ্ণবর্ণের পক্ষবিস্তার করে উড়ে বেড়াত। মৃত্যুর যে বিভিন্ন রূপ আমার মানসিক যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়াতে তার মধ্যে একটির কথাই এখানে উল্লেখ করছি। যদ্দর মনে পড়ে আমি একবার চেতনাহীন অবস্থায় দীর্ঘতর সময় অতিবাহিত করে ছিলাম। সেই অবস্থার মধ্যে হঠাৎ একটা হিমশীতল হাতের স্পর্শ অনুভব করলাম আর শুনতে পেলাম দ্রুততার সঙ্গে উচ্চারিত কিছুটা অস্পষ্ট একটি আদেশ, ‘জেগে ওঠ’ । ঘন অন্ধকারের মধ্যে আমি সোজা হয়ে উঠে বসলাম। যে আমাকে জাগিয়ে তুলেছিল তাকে দেখতে পেলাম না। আমি ঠিক কোথায় আছি আর কতক্ষণই বা আমার চেতনা লোপ পেয়েছিল, কিছুই স্মরণ করতে পারলাম না। স্থিরভাবে বসে থেকে আমি প্রাণপণ শক্তিতে যখন আমার স্মৃতিশক্তি ফিরে পেতে চেষ্টা করছি, তখন সেই ঠাণ্ডা হাতটি আমার কব্জি জোর করে চেপে ধরল আর তেমনি দ্রুত ও অস্পষ্ট কণ্ঠে আদেশ ধ্বনিত হোল, “ওঠ! তুমি কি শুনতে পাচ্ছনা যে তোমাকে জেগে উঠতে বলছি?
‘কিন্তু আপনি কে?’ প্রশ্ন করলাম আমি। শোকক্লিষ্ট কণ্ঠের উত্তর শোনা গেল, আমার যে জগতে বাস, সেখানে কোন নাম নেই আমার। ছিলাম মানুষ কিন্তু হয়েছি দানব। ছিলাম দয়ামায়াহীন, হয়েছি স্নেহপ্রবণ। আমি যে কঁপছি তা তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ। কথা বলতে গিয়ে র্দাতে দাঁত ঠেকে যাচ্ছে। কিন্তু তার কারণ আজকের এই শীতল রাত্রিটি নয়, সীমা সংখ্যাহীন রাত্রিই তার কারণ। এ অবস্থা অসহনীয়। কেন তুমি শান্তিতে ঘুমোতে পার না? তোমাদের মানসিক কষ্টের অভিঘাতে আমার শান্তি নষ্ট হয়ে যায়। তোমাদের যন্ত্রণাভোগের দৃশ্যও আমি সহ্য করতে পারিনা। উঠে দাঁড়াও। আমার সঙ্গে বাইরে রাত্রের পরিবেশে বেরিয়ে এসো। সেখানে তোমাকে কবরগুলোর ভেতরের দৃশ্য দেখাব। বড় শোচনীয় দৃশ্য! তবু দেখ তুমি!
যে অদৃশ্য মূর্তি আমার হাতটিকে তখনো মুঠো করে ধরে রেখেছিল, সে মুহূর্তের মধ্যে অতীতমানব সম্প্রদায়ের সমস্ত কবর উন্মোচিত করে ফেলল। আমি তাকিয়ে দেখলাম প্রতিটি কবর থেকে মৃদু আলোর রশ্মি বিচ্ছুরিত হচ্ছে আর সেই আলোতে কবরগুলোর শোকাবহ নীরব আবেষ্টনীর মধ্যে দেখতে পেলাম নিদ্রিত মানুষ আর কৃমিকীটের সহাবস্থান। কিন্তু হায়, নিদ্রিত মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত অল্পই দেখা গেল। লক্ষ লক্ষ মানুষ মোটেই নিদ্রিতাবস্থায় ছিল না। তারা চাইছিল কবরের বন্ধন থেকে বেরিয়ে আসতে। সেই চেষ্টার ফলে সমস্ত এলাকা জুড়ে একটা চাঞ্চল্য আর বেদনাময় পরিবেশ সৃজিত হয়েছিল। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল শবাচ্ছাদন-বস্ত্রনির্গত মর্মর শব্দ। যারা তখনো নিদ্রিত তাদের কিন্তু দেহভঙ্গীর পরিবর্তন স্পষ্টই দেখতে পেলাম। সাধারণত যে অনমনীয় আর অস্বস্তিকর ভঙ্গীতে মানুষকে কবরস্থ করা হয়, তার পরিবর্তন ঘটেছিল কমবেশী প্রায় সকলেরই।
আমি যখন এই সব দৃশ্য দেখছি তখন আবার শুনতে পেলাম, এগুলো মোটেই কি করুণ দৃশ্য নয়? এই প্রশ্নের উত্তর দেবার আগেই কিন্তু সেই মূর্তি আমার হাত ছেড়ে দিল আর সঙ্গে সঙ্গে সেই ক্ষীণ আলোর রশ্মি মিলিয়ে গেল। পরমুহূর্তেই সমস্ত কবরের দরজা একই সঙ্গে রুদ্ধ হয়ে গেল আর সেগুলি থেকে হতাশামিশ্রিত সমবেত কণ্ঠে প্রশ্ন ধ্বনিত হল, হায় ভগবান, এই দৃশ্য কি করুণ নয়?
এই ধরণের অলীক স্বপ্ন রাতের বেলায় দেখলেও তার প্রভাব দিনের জাগ্রত মুহূর্তগুলোকেও আচ্ছন্ন করে রাখত। এর ফলে আমার এলো স্নায়বিক দৌর্বল্য আর ভীতিপ্রবণতা। যে কোন প্রকার শারীরিক ব্যায়ামের জন্যে ঘরের বাইরে যেতে হয় বলেই আমি ঘোড়ায় চড়া এমন কি বেড়ানোও পরিত্যাগ করলাম। প্রকৃতপক্ষে যারা আমার রোগের কথা জানে তাদের ছেড়ে বাইরে পা বাড়াতেই আমার ভয় হচ্ছিল তখন। কেবল ভয় হোল এদের অনুপস্থিতিতে যদি আমি চেতনা হারাই সেই অবস্থায় হয়ত আমাকে অন্যের কবরে শুইয়ে দেবে। শেষ পর্যন্ত যারা আমার প্রিয়তম বন্ধু তারা কতটা বিশ্বস্ততার সঙ্গে আমার যত্ন নেবে, সে বিষয়েও সন্দেহ সৃষ্ট হোল। সাধারণ অপেক্ষা দীর্ঘতর সময়ের জন্য চেতনাহীন থাকলে ওরা হয়ত ধরে নেবে যে আমার চেতনা আর ফিরবে না। এমন ভয়ও করতে শুরু করলাম যে আমার অসুস্থতার সময় তারা খুবই বিব্রত হয়ে পড়ে তাই হয়ত দীর্ঘসময়ের চৈতন্যহীনতার সুযোগে তারা আমার হাত থেকে মুক্তি পেতেই চাইবে। আন্তরিক প্রতিশ্রুতি দিয়েও বন্ধুরা আমার মানসিক স্বাচ্ছন্দ্য ফিরিয়ে আনতে পারছিল না। ওদের দিয়ে আমি এই শপথ করিয়ে নিলাম যে আমার শরীর যতক্ষণ না পচে ওঠে আর দেহটাকে ঘরে রাখা অসম্ভব মনে না-হয়, ওরা আমাকে কবরে শুইয়ে দেবেনা। কিন্তু তবুও এই মারাত্মক ভীতি আমার রয়েই গেল। কোন রকমের সান্ত্বনাই আমি পেলাম না। আমি কিছু কিছু সাবধানতা অবলম্বন করতে লাগলাম। আমাদের যে পারিবারিক ভল্টটা ছিল সেটাতে এমন ব্যবস্থার প্রবর্তন করলাম যাতে প্রয়োজন হলে ভেতর থেকেও কেউ সেটাকে খুলে ফেলতে পারে। একটা লম্বা হাতল এমন করে লাগিয়ে নিলাম যে কফিন রাখার জায়গা থেকে হাত বাড়িয়ে একটু চাপ দিলেই লোহার দরজা যেন খুলে যায়। ওর মধ্যে যাতে যথেষ্ট পরিমাণে আলো বাতাস যায় তার ব্যবস্থা করা হোল আর কিছু খাদ্য-পানীয় এমনভাবে রাখা থাকল যাতে আমার জন্য নির্দিষ্ট কফিন থেকে হাত বাড়িয়ে সেগুলোর নাগাল পাওয়া যায়। কফিনের ভেতর উষ্ণ আর নরম কাপড়ের আস্তরণ লাগানো হোল আর ওর ঢাকনাটায়ও ওই লোহার দরজা খোলার মত ব্যবস্থা রইল। এমন স্প্রীংয়ের কজা ওতে লাগানো হোল যাতে শরীরের অল্প একটু নড়াচড়াতেই কফিনের ঢাকনা পুরো খুলে যায়। এরপর ভল্টের ছাদে একটা ঘণ্টা লাগিয়ে তার দড়িটা একেবারে কফিনের ভেতর নিয়ে গিয়ে মৃতদেহের হাতের সঙ্গে জড়িয়ে রাখার ব্যবস্থা হোল। কিন্তু এসব দিয়েই কি মানুষের দুর্ভাগ্যকে সত্যিই ঠেকিয়ে রাখা যায়? এত আয়োজন, এত সাবধানতা সত্ত্বেও চিন্তার রাজ্য থেকে জীবন্ত কবরের ভীতি দূরীভূত হল না। সেই আশঙ্কাজনিত মানসিক যন্ত্রণা আমাকে অহরহ পীড়া দিতে থাকল।
আগে যেমন ঘটেছে ঠিক তেমনি করে রোগ ভোগের পর ধীরে ধীরে চেতনা ফিরে আসতে লাগল। বিলুপ্ত চেতনার রাজ্য থেকে একটা দুর্বল আর অনিশ্চিত অস্তিত্বের জগতে প্রত্যাবর্তন ঘটতে থাকল আমার। সে প্রত্যাবর্তন এমন কুর্ম-গতির মন্থরতায় আমার মনোরাজ্যের উষালোক সৃজন করল যাতে আমার মধ্যে একধরণের নতুন অস্বস্তির সৃষ্টি ঘটল। চেষ্টাহীন, যত্নহীন, নৈরাশ্য-পীড়িত একধরণের মানসিকতা আমাকে অনিচ্ছাসত্ত্বেও এই অস্বস্তির যন্ত্রণা সহ্য করতে বাধ্য করল। এরপর দীর্ঘ বিশ্রামের অবসানে শুরু হোল কানের মধ্যে ঘণ্টাধ্বনি, আবার কিছু সময়ের পর সমস্ত শরীরের মধ্যে একটা অবর্ণনীয় অনুভূতি। এরপর কিছু সময় অতিবাহিত হোল অবিচ্ছিন্ন শান্ত আনন্দময় মানসিকতার মধ্যে কিন্তু তারপরই চলে গেলাম বিস্মৃতির অন্ধকারময় জগতে। এ থেকে মুক্তি এলো অনেক পরে। এ সময় চোখের পাতাগুলো নড়ে উঠত আর মারাত্মক অথচ অনিশ্চিত ভাতির আত্যন্তিকতায় দেহের সমস্ত রক্ত যেন বুকের মধ্যে গিয়ে সঞ্চিত হয়ে যেত। একটু চিন্তা, একটুখানি স্মৃতির প্রত্যাবর্তন, তারপর স্পষ্টতর চেতনার রাজ্যে ফিরে গিয়ে অনুভব করা যে এ জাগরণ সাধারণ নিদ্রার আলিঙ্গন থেকে নয়, চেতনাশূন্যতার আক্রমণ থেকে। সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাসের মত আবার সেই ভীতি ফিরে আসত, আবার আচ্ছন্ন করে ফেলত আমার চিন্তা জগৎকে।
অলস কল্পনাগুলোর এই সব মুহূর্তে আমি নড়াচড়াও করতাম না শুধু এই জন্যেই যে তা করার সাহস আমার থাকত না। কে যেন আমার কানে কানে বলে যেত যে আমি বেঁচে আছি তবু আমি অচল অনড় অবস্থায় পড়ে থাকতাম। এই দীর্ঘ বিমূঢ় অবস্থার অবসানে হতাশা নিয়েই চোখ মেলে চাইতাম। আমি জানতাম যে ব্যাধির আক্রমণ থেকে আমি সাময়িকভাবে মুক্ত তবু আমার চারদিকে শুধু অন্ধকারই দেখতাম আমি। আমার দৃষ্টি শক্তি অক্ষত থাকা সত্ত্বেও সেই নিরন্ধ্র অন্ধকারের যন্ত্রণা আমাকে সহ্য করতেই হোত। বুকের ওপর জগদ্দল পাথরেরবোঝা অনুভব করতাম। শুকনো জিভ আর ঠোঁট নেড়ে চেঁচিয়ে উঠতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত গলা দিয়ে কোন শব্দই বেরুত না। আমার প্রাণপণ চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যেত।
গলা ছেড়ে কেঁদেও উঠতে পারতাম না আমি। তা করবার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখেছি মৃত ব্যক্তির মতই আমার মাড়ি দু’টো আটকে আছে। মনে হোত আমি কোন কঠিন বস্তুর ওপর শুয়ে আছি আর আমার চারপাশও সেই রকম বস্তু দিয়ে আটকানো। এ পর্যন্ত আমার শরীরে কোন চাঞ্চল্য ছিল না। এখন আড়াআড়িভাবে হাত দু’টোকে আলগা করে নিয়ে ওপরে ওঠাতে চাইলাম কিন্তু পারলাম না। আমার মুখের ওপর প্রায় ইঞ্চি ছয়েক উঁচুতে নিরেট কাঠের কোন জিনিসে সেগুলো গিয়ে ঠেকল। এখন আর আমার সন্দেহ রইল না যে আমি কফিনের মধ্যেই রয়েছি।
আমার নিঃসীম দুঃখের জগতে হঠাৎ আশার আলো জ্বলে উঠল। যে সব সাবধানতা আমি অবলম্বন করেছিলাম, সেগুলোর কথা মনে পড়ল এক এক করে। শরীরটাকে একটুখানি নড়িয়ে আমি প্রথমেই কফিনের ডালাটা খুলে ফেলতে চাইলাম কিন্তু তা সম্ভব হোল না। আমার হাতে নিশ্চয় ঘণ্টার দড়ি জড়ানো আছে। আমি চাইলাম সেটি স্পর্শ করতে। তার নাগাল পেলাম না আমি। আশার আলো নিভে গেল পর মুহূর্তেই আর সেখানে বিস্তৃত হোল বিজয়ী হতাশার স্থায়ী রাজত্ব। কোথায় গেল অত্যন্ত সাবধানে বানিয়ে রাখা সেই আরামদায়ক উষ্ণ নরম আস্তরণ? কিছু নেই। তার বদলে আম্রাণ পেলাম ভিজে মাটির সুতীব্র দুঃসহ গন্ধের। এরপর তো নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে বিলম্ব হওয়া উচিত নয়। আমার কফিন পারিবারিক ভল্টের মধ্যে নেই। বাড়ীর বাইরে কখনো কোন এক জায়গায় আমি চেতনা হারিয়েছি সম্পূর্ণ অপরিচিতদের মাঝখানে। ওরা সাধারণ একটা কফিনের মধ্যে বন্ধ করে ভালোভাবে পেরেক ঠুকে মরা কুকুরের মত অজ্ঞাত কোন কবরের অনেক অনেক গভীরে পুতে ফেলেছে আমাকে।
এই ভীতি যখন হৃদয়ে পূর্ণ বিশ্বাসের স্তরে গিয়ে পৌঁছল তখন আর একবার চেঁচিয়ে কেঁদে উঠতে চাইলাম আমি। এবার কিন্তু আমি সফল হ’লাম। ভূগর্ভস্থ রাত্রির বুক চিরে একটা দীর্ঘ আর্তনাদ ধ্বনিত হোল। একটি রূঢ় কণ্ঠস্বর পর মুহূর্তেই শোনা গেল, হালদা কে সে? ঠিক পরেই দ্বিতীয় কণ্ঠস্বর শোনা গেল, কিসের গোলমাল শুরু হোল এখানে? তৃতীয় কণ্ঠস্বরও শোনা গেল, বেরিয়ে যাও সব এখান থেকে। এইখানেই থেমে গেল না সবাই, পরের কণ্ঠস্বর প্রশ্ন করল, এ রকম বিশ্রীভাবে যে সব চেঁচিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তার মানেটা কী? এর পরমুহূর্তে কয়েকজন রুক্ষমূর্তির মানুষের একটি দল দেখে আমি নিতান্তই ভীত হয়ে পড়লাম। আমি জেগেই ছিলাম তাই আমাকে নতুন করে জাগিয়ে তোনার প্রয়োজন ছিল না, কিন্তু ওরা আমার স্মৃতিশক্তির প্রত্যাবর্তনে সহযোগিতা করল।
ঘটনাটা ঘটেছিল ভার্জিনিয়া এলাকার রিচমণ্ডের কাছে। জেমস্ নদীর তীর বরাবর বেশ কয়েক মাইল নীচের দিকে এক বন্ধুর সঙ্গে আমি সেদিন শিকারে বেরিয়েছিলাম। সন্ধ্যের দিকে আমরা হঠাৎ একটা ঝড়ের মুখে পড়ি। পাশেই নদীতে একটা নৌকো নোঙর করা ছিল। আমরা সেখানে রাতের মতো আশ্রয় নিলাম। নৌকোটাতে বাগানের জন্য ছাতাধরা ভেজা মাটি ভর্তি ছিল। দুটো মাচানের মধ্যে আমি একটা শোবার জন্যে দখল করলাম। ওটা শোবার মত জায়গাই নয়। চওড়ায় হাতখানেক আর নৌকোর তলা থেকে ও হাতখানেক উঁচুতে ওই মাচানে শুতে গিয়ে নিজেকে অনেকখানি সঙ্কুচিত করে নিতে হয়েছিল আমাকে। অবশ্য ঘুম আমার হয়েছিল বেশ ভালোই কিন্তু আমি যা দেখছিলাম তা পুরোটাই আমার পরিবেশ, স্বপ্ন নয়। এটা ঠিক যে কোন কিছু নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা আমার অভ্যাস। এর ফলে আমার পরিবেশ আর দৈহিক অসুবিধেগুলো নিয়ে আমি নিজের মত করে চিন্তা করে চলেছিলাম। আগেই বলেছি ঘুম থেকে জেগে ওঠার পরও স্মৃতিশক্তির পুরোটা ফিরে পেতে চিরকালই আমার বিলম্ব হোত। যারা আমাকে জাগিয়ে তুলেছিল তারা ছিল সবাই নৌকোর লোক। নৌকো থেকে বাগানের জন্যে মাটি নাবিয়ে নেবার জন্য তারা নিযুক্ত হয়েছিল। যে গন্ধ আমার নাকে লাগছিল তা ছিল ঐ নৌকোর মধ্যেকার মাটিরই। মাথায় রাত্রে পরবার মত টুপী ছিলনা বলে আমিই মাথা আর চিবুকের ওপর দিয়ে নিজের রুমালখানাকে বেঁধে নিয়েছিলাম।
ঐটুকু সময়ের মধ্যে যে যন্ত্রণাভোগ আমাকে করতে হয়েছিল তা কবরের যন্ত্রণারই সমতুল্য। তেমনি জঘন্য আর ভীতিপ্রদ কিন্তু এই চরম যন্ত্রণার অধ্যায় থেকেই জন্ম নিয়েছিল একটি অপূর্ব সুন্দর পরিচ্ছেদ। যন্ত্রণার অসহনীয় অবস্থার মধ্যে আমার সব কিছুই সম্পূর্ণ ভাবে পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। আমার দেহমন এক নতুন অধ্যায়ে উপনীত হল। আমি বিদেশে চলে গেলাম। প্রচুর পরিমাণে ব্যায়াম করা শুরু করলাম আর এর ফলে নির্মল আনন্দ উপভোগ করার শক্তি অর্জন করলাম আমি অল্প দিনের মধ্যেই। মৃত্যুপ্রসঙ্গ বর্জন করে আমি অন্যান্য প্রসঙ্গ নিয়ে চিন্তা করতে শুরু করলাম। চিকিৎসা সংক্রান্ত যে বইখানা আমার ছিল সেটি আমি পুড়িয়েই ফেললাম। “রাত্রির চিন্তা বা এতক্ষণ যে সব কাহিনীর কথা বললাম এসব কাহিনী পরিপূর্ণ পুস্তক পুস্তিকা আর আমি খুলিনি। সংক্ষেপে বলা যায় যে আমি আমার জীবনের পথ সম্পূর্ণভাবেই পরিবর্তিত করে মানুষের মত বাঁচার চেষ্টায় নিযুক্ত হলাম। সেই রাত্রির পর থেকে মৃত্যুর চিন্তা আর কবরভীতি চিরদিনের মত অন্তর্হিত হোল আর সেই সঙ্গে মুক্ত হলাম চেতনালোপ ঘটিত ব্যাধি থেকে।
যুক্তিনির্ভর চিন্তাও কোন কোন দুর্বল মুহূর্তে এই জগতে নরকের চিত্ৰই দেখে। কিন্তু এ কথাও সত্যি যে মনের মধ্যে যে সব গুহা গহর আছে তার সন্ধান নিতে গেলে তাকে শাস্তি পেতেই হয়। কবরখানার ভীতিকে তত সম্পূর্ণ অলস কল্পনা কখনই বলা যায় না। তবুও প্রার্থনা করি, ওখানে যারা আছে তারা শান্তিতে নিদ্রা যাক, নইলে আমাদের ধ্বংস অনিবার্য।