অকাল বোধন

অকাল বোধন

বিবাহের পরে ননদ প্রথম বার শ্বশুর-বাড়ি যাইবে, নন্দাই লইতে আসিয়াছে; পঙ্কজিনীকে তাহার নিজের ঘরটি কিছুদিনের জন্য এই নব-দম্পতিকে ছাড়িয়া দিতে হইল, কারণ বাড়িতে ঘরের অভাব। কর্তার বন্দোবস্ত হইল সদর-ঘরে। ছোট যে ভাঁড়ার-ঘরটি ছিল, তাহারই জিনিসপত্র সরাইয়া পঙ্কজিনী নিজের পুত্রকন্যাদের এবং দেবরটির সংস্থান করিয়া লইল।

কোলের ছেলেটি এই পরিবর্তনের কারণ বুঝিতে না পারিয়া মার গলা জড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “আমাদের ঘরে ছুলে না কেন মা?”

“তোর পিসি তাড়িয়ে দিয়েছে।”

“বাবাকেও তালিয়ে দিয়েতে?”

“হ্যাঁ, দিয়েছে বই কি।”

“কেন?”

আড়ি পাতিবার সময় উৎরাইয়া যাইতেছিল। ছেলের কানের উপর ঘুমপাড়ানির লঘু আঘাত করিয়া জননী বলিল, “নে, ঘুমো দিকিন তুই এখন, বকর বকর করতে হবে না, ওই, আয় তো রে হুমো—”

সমস্ত দিনের দৌরাত্ম্য-ক্লান্ত শিশু অমন পিসিমার স্বভাবের এই আকস্মিক পরিবর্তনের কথা, হুমোর অলৌকিক চেহারা এবং কীর্তিকলাপের কথা এবং দিবসের হাসিকান্নার দুই-একটা আধবিস্মৃত কথা ভাবিতে ভাবিতে মায়ের কোলে নিদ্রায় এলাইয়া পড়িল। একটু পরেই পাড়ার কয়েকজন যুবতীর চুড়ির ঠুনঠুন, কাপড়ের খসখসানি এবং চাপা গলার ফিসফিসানিতে ঘরের পাশের হাওয়াটা কৌতুক-চঞ্চলতায় জীবন্ত হইয়া উঠিল। পঙ্কজিনী কোলের ছেলেটিকে আরও দুই-একটা নরম আঘাত দিয়া শোয়াইয়া দিল; ঘরের অন্যান্য ঘুমন্ত মুখগুলির উপর চক্ষু বুলাইয়া লইল; তাহার পর চাপা স্বরে অনিচ্ছার আভাস মিশাইয়া বলিল, “জুটেছিস পোড়ারমুখীরা? বলিহারি শখ তোদের, কোথায় একটু চোখ বুজব, না—!” বলিতে বলিতে খিড়কির দরজাটার অর্গল খুলিয়া দিল।

একজন ভিতরে আসিতে আসিতে নথের ঝাঁকি দিয়া বলিল, “নাঃ, শখে আর কাজ কি! তোমার কত্তার কাছে গিয়ে ভাগবতে দীক্ষা নিগে যাই। বলি হ্যাঁ, তাঁকে বাড়ির বাইরে করেছ তো? নইলে আমাদের মতলব টের পেলে এই রাত-দুপুরে ডাকাত-পড়া কাণ্ড ক’রে তুলবেন’খন।”

এই সম্মিলনীটিতে বয়সে বোধ হয় পঙ্কজিনীই সবচেয়ে বড় তাই সে সলজ্জ গাম্ভীর্যের সহিত বলিল, “দেখিস, বেশি বাড়াবাড়ি করিস নি কিন্তু সব। এই দেড় দিন গাড়িতে এসে হা-ক্লান্ত হয়ে আছে বেচারা, একটু ঘুমুনো দরকার।”

এই সহানুভূতিতে একটি তরুণী নরম পর্দাতেই খিলখিল করিয়া হাসিয়া ফেলিল। অপরের গা ঠেলিয়া বলিল, “দিদি ভুলে গেছে সব; ঘুমের জন্যেই ওদের মাথা-ব্যথা বটে।” ইহাতে দলটির একপাশে কয়েকজনার মধ্যে একটু টেপা হাসি, অর্থপূর্ণ চাহনি এবং দুই- একটা অন্যবিধ বয়স-সুলভ ইশারার বিনিময় হইয়া গেল। যাহারা এই চপলতাটুকুর মূল কোথায় বুঝিল না, তাহারা কপট বিরক্তির সহিত মত দিল, এ সব ছ্যাবলাদের সঙ্গে কোথাও যাইতে নাই।

অমনই ছ্যাবলাদের দলের একজন হঠাৎ ভারিক্কি হইয়া বলিল, “তাই না তাই, দু চক্ষের বালাই সব—”

এই ছলাটুকুতে সকলে হাসিয়া উঠিল। পঙ্কজ ঠোঁটে হাসির একটু রেশ টানিয়া রাখিয়া বলিল, “পোড়ার মু–খ, রঙ্গ নিয়েই আছেন!”

ইহারা যতই আনন্দমুখর হইয়া উঠিতেছিল, পঙ্কজিনীর উৎসাহটা যেন ততই শিথিল হইয়া আসিতেছিল। ইহারা সকলে মিলিয়া হঠাৎ ঘরটার মধ্যে পূর্ণ যৌবনের এমন একটা রসহিল্লোল তুলিল যে, যৌবন সীমাগতা এই নারীর ইহাদের মধ্যে নিজেকে নিতান্ত খাপছাড়া বলিয়া বোধ হইল। যদি চিন্তার ক্ষমতা থাকিত, তাহা হইলে স্ফুটমান কলিটির পাশে যে ফুলটি ফোটা শেষ করিয়া দুই-একটি দল হারাইয়া বৃত্তসংলগ্ন রহিয়াছে, সেও বোধ করি এক রকমই ভাবিত। একেবারে তাহার সমবয়সী-গোছের কেহই ছিল না সেখানে, তাহার পাতানো ‘গোলাপ’ পর্যন্ত নয়। কেন যে ছিল না, পঙ্কজ তাহার কারণ নিজের মনকে নিজেই দিল—তাহারা সব নিজেদের সাত-আট দশ বৎসরের পুত্রকন্যা লইয়াই ব্যস্ত, এই সব লঘুতার কি আর অবসর আছে? একজনকে প্রশ্ন করিল, “কই, গোলাপ এল না রে ছোট বউ?” উত্তর পাইল, “তাঁর শরীরটা তেমন ভাল নয়।”

সেই মুখরা মেয়েটা একটু পিছনে সরিয়া গিয়া একজনের ঘাড়ে মুখ গুঁজিয়া বলিল, “মোটে দুদিনের ছুটিতে গোলাপের ‘ভোমরা’ বাড়ি এসেছে।”

কে তাহার গাল দুইটা টিপিয়া ধরিল, বলিল, “মুয়ে আগুন, রস যে ধরে না আর! তোমার ভোমরারও শিগগির আসা দরকার হয়ে পড়েছে।”

পঙ্কজিনী হঠাৎ বলিল, “তা সব দাঁড়িয়ে রইলি যে? যা করতে এসেছিস করুগে।”

একজন বলিল, “বাঃ, আর তুমি?”

“নাঃ, আমি আর না; তোদের সব দোর খুলে দিতে উঠেছিলুম।”

সে গেলই না; বিছানায় গিয়া শুইল এবং উঠানের ওপার হইতে যখন মাঝে মাঝে ত্রস্ত মলের শিঞ্জিনী এবং রুদ্ধ হাসির তরল ঝঙ্কার ভাসিয়া আসিতে লাগিল, সে খোকার মাথায় হাত বুলাইতে বুলাইতে কি ভাবিয়া শরমে সঙ্কুচিত হইয়া উঠিল।

.

বাড়িটা কয়েক দিন ধরিয়া পাড়ার কৌতুক-রহস্যের কেন্দ্র হইয়া রহিল। রাত্রে যুবতীদের রঙ্গরস, সকালে ছোট মেয়েদের দৌরাত্ম্য এবং মধ্যাহ্নে গুলের-কৌটা হাতে ঠানদিদির তামাক গুঁড়ার মতই ঝাঁঝালো রসিকতা—এসবের মধ্যে পঙ্কজিনীকে সহায়িকা হইয়া থাকিতে হইত। ফলে, প্রথম প্রথম তাহার এই নবদম্পতির উপর যে স্বাভাবিক করুণার ভাবটি ছিল, তাহাও তিরোহিত হইয়া ইহাদিগকে বিদ্রূপলাঞ্ছিত করিবার ইচ্ছাটা প্রবল হইয়া উঠিতে লাগিল। তাই সকাল বেলা স্বামীর পূজার জন্য চন্দন ঘষিবার সময় সে দুষ্টামির হাসি হাসিতে হাসিতে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের উপদ্রবের নব নব প্রণালীতে তালিম দিতে লাগিল; রাত্রে আড়ি পাতিবার সুবিধার জন্য দুয়ার-জানালা যাহাতে বাহির হইতে খোলা যায়, তাহার উপায় করিয়া রাখিতে লাগিল; এবং মধ্যাহ্নে প্রবীণারা যখন নূতন বরটিকে ঘিরিয়া আসর জমাইয়া বসিত, তখন সেও পাশ হইতে ফোড়ন দিতে লাগিল, “ঠাকুর-জামাইয়ের আজকাল ওই রকমই গোলমাল হচ্ছে। নিজে পান খান না, অথচ সকালে ঠোঁটের ওপর রাঙা ছোপ লেগে থাকে; আর বিছানা থেকে উঠলে মুখে নয় একটু সিঁদুরের দাগ, নয় কোনখানে সোনার আঁচড়, সে তো রয়েছেই—”

ইহার উপর কেহ বোধ হয় তাহাকেই খোঁচা দিয়া বলিত, “মর্, তোর কথার ভাবে বোধ হয়, সারা সকালটা নাতজামাইয়ের চাঁদমুখটির দিকেই হাঁ করে চেয়ে বসে থাকিস।”

সে উত্তর দিত, “তা একটু থাকি বইকি। জানি দুপুরবেলা দশটি রাহুতে মুখটি নিয়ে কাড়াকাড়ি লাগবে যে!”

এই রকমই হইতে লাগিল। মোট কথা, শান পড়িলে অস্ত্রখানিকে লইয়া কেবল যেমন চোপ বসাইতে ইচ্ছা করে, ক্রমাগত চর্চার ফলে পঙ্কজের রহস্যবিদ্রুপের প্রয়োগ সম্বন্ধে সেই রকম একটা প্রবল ইচ্ছা দাঁড়াইয়া গেল। মাঝে পড়িয়া নাকাল হইতে লাগিল এই লাজুক বরটি।

মনটা পঙ্কজের তারল্যে ছলছল করিতে লাগিল। সে নেহাত কোলে-পিঠে করিয়া মানুষ-করা বলিয়া, ননদের সহিত ঠাট্টা করিত না, কিন্তু আজকাল তাহার বিদ্রূপের দুই- একটা ঝাপটা সে বেচারীকেও বিব্রত করিতে লাগিল।

হঠাৎ যেন নিজের বয়সের ভার ছাড়িয়া পঙ্কজিনী খানিকটা হালকা হইয়া পড়িল।

কিন্তু স্বামী তাহার মাঝে মাঝে রসভঙ্গ করিয়া দিত। জমাট মজলিসের মধ্য হইতে তাহাকে ডাকিয়া লইয়া কখনও বলিত, “নাও নাও, ঢের হয়েছে, আমার ‘বেদান্তদর্পণে’র পাতাটা যে খুঁজতে বলেছিলুম, মনে আছে?”

পাতাটা চার মাস যাবৎ নিরুদ্দেশ। পঙ্কজিনী বোধহয় বলিয়া ফেলিত, “কথাটা ঠিকই মনে আছে, কিন্তু পাতাটা বাড়িতে নেই।”

স্বামী গম্ভীরভাবে বলিত, “আমি জানি, এই বাড়িতেই আছে; তার হাত-পা গজায় নি যে—”

“কিন্তু হাত-পা আছে এমন ছেলেপিলে তো ফেলে দিয়ে আসতে পারে?”

“যেখানে মেয়েমানুষ এমন লঘুচিত্ত, সে বাড়িতে ছেলেপিলেরা সবই করতে পারে। আমি বলি, রঙ্গরস ছেড়ে একটু খুঁজলে ভাল করতে। যত সব—”

একদিন মধ্যাহ্ন-বৈঠক হইতে পঙ্কজের জরুরি তলব হইল। “ব্যাপার কি?” বলিয়া সে একটু বিরক্তভাবেই স্বামীর সামনে আসিয়া দাঁড়াইল এবং বলিল, “তোমার কি একটু আক্কেল নেই? ও-পাড়ার ঠাকরুণদিদি কি বললেন জান?”

“কি?”

“হ্যাঁ, তোমায় আমি সেই কথা বলিগে! আক্কেল খুইয়ে যখন-তখন ডাকলে তো বলবেই।”

“আহা, বলই না, অন্তত আমার আক্কেল বজায় রাখার জন্যেও তো বলা উচিত।” কথাটা পঙ্কজের মনটা আলোড়িত করিতেছিল; সে ঈষৎ হাসিয়া রাগতভাবে বলিল, কেন! বললে, ‘বরের সঙ্গে যে বড় আটা হয়েছে দেখছি!’ কি ঘেন্নার কথা বল দিকিন! এই বয়েসে সবার সামনে —”

স্বামী কপট গাম্ভীর্যের সহিত বলিল, “তা বলেছেন ঠিকই, এই বয়েসে বুড়ো বরকে ছেড়ে কোথায় অন্য—”

“চুপ কর বলছি, আস্পদ্দা।”—বড় বড় চোখ দুইটা আরও বড় করিয়া পঙ্কজিনী স্বামীকে থামাইল। তাহার পর জিজ্ঞাসা করিল, “নাও, কেন ডাকছ বল? দেরি হয়ে যাচ্ছে ওদিকে।”

“একজন অবধূত পদার্পণ করেছেন; মস্ত বড়—”

পঙ্কজের হাসি-হাসি মুখটা মুহূর্তে অন্ধকার হইয়া গেল। সে বিরক্তভাবে বলিল, “তা আসুন, আমার অত ঘি-ময়দা নেই। তা ছাড়া বাড়িতে একটা জামাইয়ের খরচ আছে।”

“সে সংসারের খবর আমিও খুব রাখি। তা ব’লে সাধু-ফকির একজন দয়া ক’রে যখন এসেছেন—”  

“কেতাত্ত করেছেন। বল, চ’লে গেলে বেশি দয়া করা হবে—,” বলিয়া পঙ্কজ চলিয়া যাইতেছিল; স্বামী কহিল, “আরে শোন।”

না ফিরিয়া পঙ্কজ উত্তর দিল, “কি? আমি শুনতে চাই না।”

“রাত্রে ‘হরিকথা’ কইবেন তারও উজ্জ্বগ-টুজ্জগ—”

“ওসব কিচ্ছু হবে-টবে না, ব’লে দিলুম, এক কথা।—” পঙ্কজ উঠান ছাড়িয়া রকে উঠিল।

“আর একটা কথা শুনছ?”

পঙ্কজ আবার না ফিরিয়া উত্তর করিল, “না, শোনাবার দরকার নেই।”

“তোমার গিয়ে বিনোদকেও ডেকে দাও : বাজে ফষ্টিনষ্টি ছেড়ে একটু সদালাপ শুনবে’খন।”

“তুমি একলাই শোন গিয়ে, বিনোদের ভাগ বসাবার দরকার নেই।”

তখন এই তত্ত্বান্বেষী পুরুষটি নিজেই দুই পা আগাইয়া ভগ্নীপতিকে ডাকিয়া যাহাতে তাহার আধ্যাত্মিক উন্নতির সুবিধা হয়, সেইজন্য সন্ন্যাসীর নিকট আনিয়া বসাইল এবং সেদিনকার মত সেই অনাধ্যাত্মিক সভাটিও উঠিয়া গেল।

মাত্র দুই-একটা উদাহরণ দেওয়া গেল, কিন্তু এই রকম রসভঙ্গ প্রায়ই ঘটিত। পঙ্কজিনী বর্ষীয়সীদের বিদ্রূপবাণে জর্জরিত হইয়া স্বামীর উপর ঝাল ঝাড়িত, “আচ্ছা, কেন তোমার এমন ধরন বল দিকিন? দু দণ্ড ব’সে একটু আমোদ-আহ্লাদ করে, তাতে তোমার গায়ে ফোসকা পড়ে?”

স্বামী তখন লেক্‌চার জুড়িয়া দিত, বলিত, “ওই—ওইখানেই তোমাদের সঙ্গে মেলে না আমার। এখন দেখতে হবে, তোমরা যে অসার বাক্যালাপকে আমোদ বলছ, সেটা ঠিক আমোদ কি না, সেটা নির্ণয় করতে হ’লে আগে বুঝতে হবে, শুদ্ধ আমোদের স্বরূপটা কি। তা হ’লে দেখা যাক, শঙ্কারাচার্য এ সম্পর্কে—”  

যাঁহারা পঙ্কজিনীকে চিনিয়াছেন, তাঁহারা সহজেই বুঝিতে পারিবেন, এ বক্তৃতা কখনও শেষ হইত না। শুধু স্ত্রীলোকেরাই পারে, এমনভাবে মুখখানা ঘুরাইয়া লইয়া পঙ্কজ হনহন করিয়া চলিয়া যাইত, বলিত, “ক্ষ্যামা দাও, ঢের ভক্তিমে হয়েছে, যত সব অসৈরণ—”

স্ত্রীর আধ্যাত্মিক উন্নতি সম্বন্ধে হতাশ হইয়া স্বামী একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলিত; বলিত, “ওই তো মুশকিল, মেয়েমানুষের মন ঠিক জায়গায় আসতে আসতে আবার কেমন বিগড়ে যায়।”

.

যেদিন যাওয়ার কথা ছিল, তাহার আগের দিন পঙ্কজের ননদ অসুখ করিয়া বসিল, সুতরাং যাত্রা স্থগিত হইয়া গেল। স্বামী চটিয়া বলিল, “কেবল অনাচারে এটি হয়ছে, এর জন্য কে দায়ী জান?

পঙ্কজ হাসিয়া বলিল, “জানি বইকি।” কিন্তু সে শেষ করিবার পূর্বেই তাহার উত্তরটি কি হইবে আন্দাজ করিয়া তাহার স্বামী তাড়াতাড়ি বলিল, “ঠাট্টা রাখ, তোমাদের জন্যেই হয়েছে এটি; রাত দুপুর পর্যন্ত হুডুদ্দুম ক’রে ঘুমের ব্যাঘাত জন্মানো। আমি তখনই পইপই ক’রে বারণ করতুম; তা গরিবের কথা বাসী না হলে তো আর-

পঙ্কজ একটু সঙ্কুচিতভাবে বলিল, “হ্যাঁ, এ বয়সে রাত জাগলে নাকি আবার অসুখ করে।” বলিয়া সলজ্জ কুটিল হাসির এমনই একটি সঙ্কেত করিয়া স্বামীর মুখের দিকে চাহিল যে তাহার আচারশুদ্ধ মনেও বহু পুরাতন স্মৃতির একটি অসংযত সৌরভ ক্ষণিকের জন্য জাগিয়া উঠিল;—সেই তাহারা দুইটিতে যখন অনর্থক উদ্দেশ্যহীন আলাপে কত বিনিদ্র রজনী অক্লান্তভাবে কাটাইয়া দিত, যখন গ্রীষ্মের রাত্রি উত্তাপ হারাইয়া আর শীতের রাত্রির শৈত্য হারাইয়া কোথা দিয়া যে চলিয়া যাইত—সেই সব দিনের কথা। মনে পড়ে, এক শ্রাবণের রাতে পঙ্কজ অভিমানভরে পাশ ফিরিয়া শুইয়া ছিল, হাজার মিনতিতেও কথা কয় না, ফিরে না; তারপর হঠাৎ একটা মেঘের ডাকে মুহূর্তে ফিরিয়া সে তার বুকে ভয়ে মিশিয়া গিয়াছিল। স্বামী বধূকে বলিয়াছিল, “তোমার চেয়ে বাজও কোমল, সে আমার কাতরানি শুনলে।”

স্বামী কয়েক মুহূর্তের জন্য নিষ্ঠা, সংযম প্রভৃতি দশবিধি সোপানের কথা ভুলিয়া অনেক দিন পরে স্ত্রীর মুখের পানে চাহিয়া যৌবনের সেই বিহ্বল হাসি একটু হাসিল, এবং এই ভাবের আমেজে আর একটা কি শাস্ত্রবিরুদ্ধ কাজ করিবার জন্য মুখটা বাড়াইয়া হঠাৎ নিজেকে সামলাইয়া লইল ও হাসিয়া বলিল, “দিন দিন বয়ে যাচ্ছ তুমি।”

স্ত্রীও শুধু একটু হাসিল, তাহার পর বলিল, “ঠাকুরঝিকে তো আর কয়েক দিন পাঠানো যাবে না, কিন্তু ঠাকুরজামাই আর থাকতে চান না যে।”

“ও বোধ হয় ভাবছে, শ্বশুরবাড়িতে আর কত দিন কাটাব। তা আমি বুঝিয়ে বলব’খন। কাছেপিঠে নয় তো যে, আবার দুদিন পরে এসে নিয়ে যাবে।”

প্রতিদিনই উপশম হইবার আশা দিয়া অসুখটা দশ-বারো দিন পর্যন্ত বিস্তার করিল এবং তাহার পর রোগিণীটিকে এমনই নিস্তেজ করিয়া দিয়া গেল যে; তাহার আর উঠিয়া চলাফেরা করিবার সামর্থ্য রহিল না। দেখিয়া বোধ হইতে লাগিল, যেন প্রাণটি নেহাত নিরাশ-ভাবেই এই শুষ্ক দেহের অবলম্বন ধরিয়া দুলিতেছে।

লাজুক বরটি বড় মুশকিলে পড়িয়া গেল। শ্বশুরবাড়িতে আর অধিক দিন থাকাও যায় না, অথচ নূতন বালিকা-বধূটির জন্যও প্রাণটি নিতান্ত কাতর হইয়া পড়িল। বাড়িতে গিয়া পাঁচ-সাত দিন অন্তর শ্যালকের এক-আধখানা চিঠির উপর ভরসা করিয়া সে যে কি করিয়া থাকিবে, তাহা ভাবিয়া পাইল না। এই তো এইখানেই দিনের মধ্যে কতবার করিয়া খবর পাইতেছে, এবং কাছে বসিবার সুযোগও বউদিদি যথেষ্ট করিয়া দিতেছেন, কিন্তু তাহাতেও তো উৎকণ্ঠার অন্ত নাই—চোখের আড়াল হইলে আর প্রাণে সোয়াস্তি নাই।

এ অবস্থায় যখন শ্যালক আসিয়া হিন্দুদের বৈবাহিক আচার-ব্যবহার, স্ত্রী-পুরুষের শাস্ত্রসঙ্গত প্রকৃত সম্বন্ধ, অন্যান্যের প্রতি শাস্ত্রনির্দিষ্ট কর্তব্য প্রভৃতি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিশ্লেষণ করিয়া একটি সারবান উপদেশ দিয়া বলিল, তাহার থাকাটা একান্ত প্রয়োজন এবং পাড়ার প্রবীণাদের দ্বারাও যখন সেই কথাই বলাইল ও তাহার উপর আবার যাইবার কথা তুলিতে শ্যালকব্জায়া যখন তাচ্ছিল্যভরে হাসিয়া জানিতে চাহিল, বউয়ের অসুখে মাথা খারাপ হইয়া গিয়াছে কি না, তখন বেচারা যেন হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিল। ইহার পরে যাহা সামান্য একটু দ্বিধা ছিল, তাহা নিঃশেষ হইয়া গেল বধূটি যখন বড়ই অভিমানভরে ঠোঁট দুইটি কাঁপাইয়া বলিল, “তা যাবে বইকি। আমি আর তোমার কে?”

এ কথার পরেও কে চলিয়া যাইতে পারে, জানি না। কিন্তু সে থাকিয়া গেল। বাড়িতে লিখিয়া দিল, তাহার নিজের শরীর খারাপ, কিছুদিন যাওয়া চলিবে না, তবে ভাবিবার কিছুই নাই। নববধূটির মায়ায় আটকাইয়া রহিল—এই সত্য কথাটুকু লিখিতে যেন কেমন কেমন বোধ হইতেছিল। এখানে বউদিদিকে বলিয়া দিল, বাড়িতে আর চিঠি দেওয়ার দরকার নেই, আমি সব কথা লিখে দিয়েছি। এবং বধূকে বলিল,”সেখানে গিয়া যেন সব কথা ফাঁস ক’রে দিও না—বড্ড লজ্জায় পড়তে হবে তা হ’লে।”

বধূটি ছোট্ট মাথাটা দুলাইয়া বলিল, “তা ব’লে তোমার অসুখ করেছিল, এমন অলুক্ষুণে মিছে কথা বলতে পারব না।”

ইহাতে নবপরিণীত যুবকটি একটা অপরিসীম তৃপ্তি অনুভব করিল এবং বধূর মুখের কাছে মুখটি লইয়া আবেগভরে কহিল, “মিছে কথা আর কি? মনের অসুখ কি অসুখ নয় শৈল? আমি যে কি অসুখে রয়েছি, কি বুঝবে তুমি? এর চেয়ে তুচ্ছ শরীরের অসুখ যে—” ইত্যাদি অনেক কথা, যাহা না লিখিলেও স্ত্রী-পুরুষ সকলেই আন্দাজ করিয়া লইতে পারেন।

মোদ্দা কথাটা হইতেছে, সে মাসখানেক থাকিয়া গেল। কলেজের পার্সেন্টেজের কথা হিসেব করিল বটে, কিন্তু পার্সেন্টেজের জন্য যেমন এ পর্যন্ত কোন ছাত্রের জীবনের প্রিয়তম কাজটিতে বাধা পড়ে নাই, সেইরূপ তাহারও পড়িল না। সে মনে মনে এই সুদীর্ঘ মানবজীবনে যৌবনের অচিরস্থায়ী দিনগুলোর পার্সেন্টেজ এবং তাহারও মধ্যে আবার নবপরিণয়ের এই স্বপ্নাবিষ্ট দিনগুলোর পার্সেন্টেজ কষিয়া ফেলিল। ফলে যতদিন পর্যন্ত না বধূটি আরোগ্যলাভ করিয়া সক্ষম হইয়া উঠিল, সে আর কাছ-ছাড়া হইল না।

যখন বধূকে নিজের মুখে কহিতে শুনিল যে, আর তাহার বিশেষ কষ্ট নাই, তখন শ্যালকজায়ার নিকট আরজি পেশ করিল, “বউদি, এবার যেতে হচ্ছে—একটা দিন- টিন—”  

পঙ্কজ গাল দুইটি ভার করিয়া বলিল, “তা কি দিয়ে আর রুকে রাখব ভাই? রোকবার যা, তা তো সঙ্গে চলল। কিন্তু এখনও বড্ড কাহিল নয়?”

“না, আর তেমন কাহিল কি? শরীর তো বেশ সেরে উঠেছে।”

পঙ্কজ চাপা হাসির সহিত হঠাৎ ঘাড়টা কাত করিয়া গালে তর্জনীটা টিপিয়া বলিল, “ওমা, তাও তো বটে, আজকাল ঠাকুরঝির শরীরের কথা আর আমরা কি জানব?”

বেচারা বরটি লজ্জিত হইয়া পড়িল। হাসিয়া বলিল, “এইজন্যেই আপনার কাছে বলতে সাহস হয় না বউদি। কিন্তু ঠাট্টা রেখে দাদার সঙ্গে পরামর্শ ক’রে একটা দিন-টিন দেখুন। আর তাও বলি, দাদারও শরীরটা বাইরে প’ড়ে থেকে থেকে খারাপ হয়ে গেছে; ওটা তো আর ঠাকুরঝির শরীর নয় যে, পরেই ভাল তদারক করবে।”

যে বিদ্রূপ অন্তরের কথাটির সহিত মিলিয়া যায়, তাহার আর ভাল জবাব যোগায় না। সলজ্জ সঙ্কোচের সহিত পঙ্কজ শুধু বলিল, “এই যে মুখ ফুটেছে!”—বলিয়া সে তাড়াতাড়ি সে স্থান পরিত্যাগ করিতে যাইতেছিল, এমন সময় ‘বেদান্তদর্পণে’র সে পাতাটা পাওয়া গিয়াছে কি না—প্রশ্ন করিয়া স্বামীটি সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল।

দশ বৎসরের বালকের মা পঙ্কজ নিজেকে সামলাইয়া লইতে পারিল না। নন্দাইয়ের এই ঠাট্টাটুকুর পরেই স্বামীকে সামনে পাইয়া নূতন বধূটির মতই শরমে রাঙা হইয়া ত্বরিতপদে ঘরের ভিতরে আশ্রয় লইল।

ননদটি আজ চলিয়া গিয়াছে।

পঙ্কজের মনটা সমস্ত দিন বড় ছোট হইয়া আছে। ছোট কন্যার মত মানুষ করা ছেলেমানুষ ননদটি বুকের মাঝখানটায় এমন খানিকটা শূন্যতা সৃজন করিয়া গিয়াছে যে, সেটা আর কিছু দিয়াই পূর্ণ করা যায় না! কেবলই মনে হইতেছে, আহা, এটি ও বড় ভালবাসিত; আহা, বড় ছেলেমানুষ; আহা কিছু শিখে নাই সে।

বাড়িটিও দুই দিন হাস্যকলরবে অধিকতর পূর্ণ হইয়া হঠাৎ যেন নির্বাণশিখা প্রদীপটির মত মলিন হইয়া গিয়াছে। নূতন-পরিচিত যুবকটি—যে ‘কৌতুকআলাপের মধ্য দিয়া ছোট ননদিনীর পার্শ্বে তাহার হৃদয়ে একটি স্থান অধিকার করিয়া লইয়াছে, তাহার কথাও বড় বেশি মনে হইতে লাগিল। তাহাকে লইয়া কখন কি অত্যাচারটি করা হইত, প্রবহমাণ দিনটির প্রহরে প্রহরে মনে পড়িয়া মনটাকে আকুল করিতে লাগিল। বিকেলবেলায় সে আর বাড়ি থাকিতে পারিল না। প্রতিবেশীর বাড়িতে গিয়া বিগত কুড়ি-পঁচিশ দিনের খুঁটিনাটি সব আলোচনা করিয়া ভারী মনে কাটাইয়া দিল।

স্বামী বাড়ি ছিল না, নূতন রাস্তা, তাহাতে আবার রেলে কয়েকটি বদলি আছে, সে ভগ্নীপতিকে খানিকটা আগাইয়া দিতে গিয়াছে! কাল সন্ধ্যার পূর্বে ফিরিবে না। চাকরটা পর্যন্ত সঙ্গে গিয়াছে।

পঙ্কজ সকাল সকাল ছেলেমেয়েদের আহার করাইয়া শুইয়া রহিল, সেদিন নিজের ঘরে গিয়া শুইতে ইচ্ছা হইল না। শুইয়া ননদ-নন্দাইয়ের চিন্তার পাশে অলক্ষিতে আর একজনের যে চিন্তাটা আসিয়া উদয় হইল, সেটা স্বামীর—বড় অগোছালো বেহিসাবী মানুষ, ঘর ছাড়িয়া খুব কমই বাহিরে যায়।

.

পরদিন নূতন করিয়া ঘরদোর গুছাইতে, পুরানো রাস্তায় চালাইবার পূর্বে একবার সংসারটাকে দেখিয়া লইতে কাটিয়া গেল। সকলের মধ্যেই যেন পঙ্কজের মনে হইতে লাগিল, স্বামীর জন্য এতদিন যথেষ্ট করা হয় নাই। আজ যে হঠাৎ এত দরদ কোথা হইতে উদয় হইল—সে বুঝিতে পারিল না, বুঝিবার চেষ্টাও করিল না। শুধু যেখানে যেখানে পারিল, স্বামীর জন্য প্রচুর ত্যাগস্বীকার করিয়া নূতন বন্দোবস্তটা যতদূর পারিল নিরস্ত্র করিয়া দাঁড় করাইল, এমন কি ঘরদুয়ার গুছাইতে গুছাইতে ননদ-নন্দাইয়ের কথা ভাবিতে ভাবিতে তাহার ইহাও মনে হইতে লাগিল, আহা এই তালে যদি ওর সেই বইয়ের পাতাটা পেয়ে যেতুম; কতবার যে বলেছে, গা করা হয় নি!

কবে দুইটা রূঢ় কথা বলিয়াছে, কবে একটা আবেদন-অনুরোধ হেলায় অগ্রাহ্য করিয়াছে, নন্দাই থাকিবার সময় আমোদ-প্রমোদে বাধা পাইয়া কবে একটু অবহেলা বিরক্তি দর্শাইয়াছে, সমস্ত আজ তাহার মনের মেঘে এপার ওপার করিয়া এক-একটা বেদনার বিজলীরেখা টানিয়া দিতে লাগিল। সন্ধ্যার সময়ে স্বামী আসিবে; কত দিনের বিরহিণীর মত পঙ্কজ সূক্ষ্ম যত্নের সহিত অভ্যর্থনার আয়োজন করিয়া রাখিতে লাগিল। ঝকঝকে করিয়া মাজা গাড়ুটা টাটকা জলে পূর্ণ করিয়া পাট-করা গামছায় ঢাকা দিয়া পা-ধোয়ার জায়গায় রাখিয়া দিল; আলনায় আহ্নিক করিবার গরদের কাপড়টি এবং তাহার পর পরিবার থান- কাপড়টি মিহি করিয়া কোঁচাইয়া টাঙাইয়া রাখিল! যখন যেটি দরকার, হাতের কাছে করিয়া গুছাইয়া রাখিল। বহুদিনের অনাদৃত স্বামীর আদরের পাত্রী মেজো মেয়েটিকে পর্যন্ত ফিটফাট করিয়া ধুইয়া মুছিয়া সাজাইয়া রাখিল। সন্তানের মুখে বক্ষের স্তন্য উজাড় করিয়া দিয়াও প্রসূতির যেমন অতৃপ্তি থাকিয়া যায়, সেইরূপ তাহারও যেন হাজার করিয়াও আশ মিটিতেছিল না।

তাহার পর সে বিছানা রচনা করিবার জন্য খাটের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। হঠাৎ শরীরে কিসের যে একটা প্রবাহ খেলিয়া গেল, পঙ্কজের সমস্ত শরীরটা রোমাঞ্চে শিহরিয়া উঠিল। নবদম্পতির সদ্যত্যক্ত গৃহে বিলাসের মোহ এখনও লিপ্ত হইয়া আছে। ফুলের ও এসেন্সের মিশ্রিত মৃদু গন্ধে ঘরটি আমোদিত। শয্যার মাথার দিকে এক কোণে একটা গন্ধ তীব্র হইয়া উঠিতেছিল, কুতুহলী হইয়া চাদরের কোণটা উঠাইয়া সে দেখিল, একটি বকুলের মালা সন্তর্পণে কুণ্ডলী করিয়া রাখা। পঙ্কজ একটু হাসিয়া সেটা বাহির করিয়া লইল। তাহার পর অন্য দিকে চাহিয়া অন্যমনস্কভাবে মালাটা দুই হস্তের অঙ্গুলির মধ্যে জড়াইয়া, খুলিয়া, আংটির মত পরিয়া, আবার মণিবন্ধে বলয়ের মত পরিয়া খেলা করিতে লাগিল।

আজ যৌবনের সায়াহ্নে পঙ্কজের প্রথম যৌবনের কথা মনে পড়িয়া গেল। এই সেই গৃহ—এই রকম গন্ধেরও রেশ মাথার মধ্যে যেন ঘনাইয়া উঠিতেছে—তাহাদেরও ঘর আলো করিয়া নিশ্চয়ই এমনই ফোটা ফুলের মেলা তখন বসিত, আর তাহার পায়ের কাঁচা আলতাও কি এমনই করিয়া যেখান-সেখান রাঙাইয়া দিত না? দিত নিশ্চয়, কিন্তু কই, তখন তো সে এত কথা বুঝে নাই! জীবনে তখন যে বসন্ত আসিয়াছিল, তাহার অভ্যর্থনার কলগীতি তো তেমন করিয়া গাওয়া হয় নাই! স্বামী কতটুকু কদর করিয়াছিল, কে জানে— এখন ভাল করিয়া মনে পড়ে না। আর এই তো ভোলানাথ স্বামী–এর কাছে নিজেই যখন নিজের যৌবন-সম্পদকে ভাল করিয়া পরিচিত করিয়া দিতে পারে নাই, তখন কি আর যথাপ্রাপ্যটুকু পাওয়া গিয়াছিল!

আজিকার গৃহিণী পঙ্কজিনী সেদিনকার পনেরো বৎসরের বধূ পঙ্কজিনীকে সখীর মত বক্ষের মধ্যে চাপিয়া ধরিল। অন্তর তাহার ব্যর্থতার বেদনায় মথিত হইয়া উঠিল। তাহার পর ধীরে ধীরে একটা কথা, যাহা এতক্ষণ বাষ্পাকারে মনের মধ্যে ভাসিয়া বেড়াইতেছিল, স্পষ্ট হইয়া উঠিল। বাম হস্তে জড়ানো বকুলের মালাটা দক্ষিণ হস্তে আবেগভরে চাপিয়া ধরিয়া বালিশের মধ্যে মুখ গুঁজিয়া পঙ্কজ ভাবিল, এখনও কি সে ভুল শোধরানো যায় না? একদিনের জন্যও নয়—এক মুহূর্তের?

এবার একটু সামলাইয়া লইয়া ভাবিল, কেন হইল এমনটা? তাহার একটা সুস্পষ্ট উত্তর খুঁজিয়া পাইল না বটে; তবে বিগত সমস্ত মাসটা ব্যাপিয়া ননদ-নন্দাই, পাড়াপড়শী আর সখীবৃন্দ লইয়া যে হাস্যকলরবে কাটানো গিয়াছে, তাহার স্মৃতি মনের মধ্যে স্বপ্নের আমেজে জাগিয়া উঠিল। আর তাহার পর এটা অন্তত বেশ বুঝিতে পারিল যে মনটা পূর্ব হইতেই শিথিল হইয়া পড়ুক আর নাই পড়ুক, আজ এই শূন্য গৃহের মধুময় স্মৃতি তাহাকে পূর্ণভাবেই অভিভূত করিয়া ফেলিয়াছে—আজ আর তাহার আকাঙ্ক্ষার উপর সংযম নাই, তা সে হাজারই বিসৄদশ হউক না কেন?

পঙ্কজিনী গিয়া আয়নার সম্মুখে দাঁড়াইল। প্রথমটা নিজের প্রতিচ্ছবি দেখিয়াই বালিকাটির মতই লজ্জায় সঙ্কুচিত হইয়া উঠিল। তবে এ ভাবটা রহিল না। ক্রমে সে যত্ন করিয়া কবরী বাঁধিল; মুখটি ভাল করিয়া মুছিয়া কপালে একটি খয়েরের টিপ পরিল; তুলিয়া রাখা কানের দুলজোড়া বাহির করিয়া কানে দুলাইয়া মাথার কাপড়ে ঢাকিয়া রাখিল; পায়ে আলতা দিল; অধরোষ্ঠও রঞ্জিত করিতে যাইতেছিল, কিন্তু কি ভাবিয়া আর করিল না। আয়নায় নিজের ছায়াটিকে চোখ রাঙাইয়া বলিল, “মরণ আর কি, বড় বাড় যে!”—তাহার পর সীমন্তে মিহি করিয়া সিন্দুরের রেখা টানিয়া দিয়া সুন্দর মুখখানিকে হেলাইয়া দুলাইয়া আরশিতে নিজেকে একটু ভাল করিয়া দেখিয়া লইল। একটা ভাল কাপড় পরিবার ইচ্ছা ও হইল; কিন্তু পুত্রকন্যাদেবরের মধ্যে নিতান্ত বাধ-বাধ ঠেকিতে লাগিল। তবে একখানি ভাল কাপড় ট্রাঙ্ক হইতে বাহির করিয়া আলনায় স্বামীর পিরানের নীচে লুকাইয়া রাখিল—সময় বুঝিয়া পরিবে। তাহার পরে বহুদিনের ছাড়া শয্যাটি প্রাণের সমস্ত দরদ দিয়া রচনা করিয়া, তাহার এই সমস্ত আয়োজনের দেবতার জন্য অন্তরের কাতর প্রতীক্ষা লইয়া সংসারের কাজে আনমনা হইয়া ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল।

.

এদিকে তাহার দেবতাটি যখন বহুদূর পর্যন্ত অগ্রসর হইয়া ছোট ভগ্নীটিকে বিদায় দিল, তখন তাহার শান্ত সমাহিত চিত্তেও মায়ার একটা তীব্র আঘাত লাগিল। ইহার আগে যে মুখ সে কখনও অশ্রুসিক্ত হইতে দেখে নাই, অশ্রুজলে-ভরা বিদায়কালীন সেই ছোট মুখটি তাহার মনে বিষাদের একটা মৌন ছবি আঁকিয়া দিল, যাহা সে শাস্ত্রের কোন বচন দিয়াই মুছিয়া ফেলিতে পারিল না। ইহাতে অন্য কোন অবাধ মানবকে বোধ হয় সংসারের আপনজনগুলির কাছে নিবিড়তর করিয়া টানিয়া আনিত; কিন্তু এই সতর্ক মুক্তিকামীকে আরও স্বতন্ত্র করিয়া আরও দূরে সরাইয়া দিল। সে ভাবিল, ইহা কিছুই নয়, ‘তাঁহার’ একটি পরীক্ষা মাত্র। যে ভববন্ধন হইতে ত্রাণ পাইতে চাহে, তাহাকে এই অগ্নিপরীক্ষায় উতরাইয়া যাইতে হইবে, নইলে সমস্ত সাধনাই পণ্ড।

সেইজন্য শাস্ত্রও যখন এই মিথ্যা অবিদ্যাজাত মায়ার নিকট পরাস্ত হইল, সে স্থির করিল, একেবারে বাড়ি না গিয়া রাস্তায় দুই এক দিবস গুরুগৃহে থাকিয়া বিক্ষিপ্ত মনটা সুস্থির করিয়া লইবে। আর অনেক দিন গুরুদেবের চরণদর্শনও ঘটে নাই; যখন এটা আসাই গিয়াছে, তখন এই সুবিধাটুকু ছাড়াও উচিত নয়। তাই ফিরিবার পথে সে আর বাড়ি পর্যন্ত নিজের টিকিট করিল না। শুধু চাকরটাকে পাঠাইয়া দিল, আর বলিয়া দিল, “ব’লে দিস, যদি গুরুদেবের সঙ্গে আবার গঙ্গাস্নানটা সেরে আসবার ঝোঁক হয় তো চাই কি আরও দু-একদিন দেরি হয়ে যেতে পারে। আর দেখিস, মেয়েটাকে যেন না বেশি বকে-টকে।”

.

পঙ্কজ সমস্ত আয়োজন নিখুঁত করিয়া শেষ করিল; সকাল সকাল সংসারের কাজকর্ম সারিয়া লইল এবং আর সকলের আহারাদি পর্যন্ত মিটাইয়া ছোট সেই দুরন্ত ছেলেটিকে বুকে চাপিয়া আবেগ-শিথিল চরণে শয়নগৃহে প্রবেশ করিল।

এই সময় দেবর আসিয়া খবর দিল, “দাদা আজ এলেন না বউদি, দুখীরাম একলা ফিরে এসেছে।”

পঙ্কজ শূন্য দৃষ্টিতে দেবরের দিকে চহিয়া রহিল, কোন কথাই কহিতে পারিল না। দুখীরাম নিজেই আসিয়া বলিল, “হ্যাঁ, তেনার মনটা বড় খারাপ দেখলাম বউমা, বোধ হয় গুঠাকুরের সঙ্গে তিথি-টিথি সেরে আসবেন পাঁচ-সাত দিন পরে, গুঠাকুরও বোধ হয় পায়ের ধুলো দেবেন একবার।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *