অকল্পিত

অকল্পিত

একটিমাত্র হলে এত পরিচ্ছদ, এত শাড়ীর বৈচিত্র্য, তবু গুঞ্জন কোলাহল হইয়া ওঠে নাই, আর হয় না। কারণ যে সমাবেশ, যে পরিবেশ—এখানকার বাতাসে যে সুরুচির সৌরভ, জীবনের বিশেষ অভিব্যক্তি।

মিসেস ঘোষ সমুদ্রপারের মেয়ে, আরও অনেক ইংরেজমেয়ের মতোই একটি বাঙালি ছেলেকে বিবাহ করিয়া আজ বছর দশেক হয় কলিকাতায়, অর্থাৎ ভারতবর্ষের আকাশের নীচে। বিদেশি এই বিহঙ্গীর বয়স হইয়াছে কিন্তু চেহারার জৌলুস এতটুকু কমে নাই। বিশেষ করয়ি হাসিটি—বরফের কুচির মতো দাঁতগুলি কী সুন্দর চকচক করিয়া ওঠে! যাই বলো, ঘোষ লোকটি ভাগ্যবান, পত্নী ভাগ্যে ভাগ্যবান। সেই মিসেস ঘোষ আজ এখানে আগত কয়েকটি স্বজাতির সঙ্গে একেবারে মিশিয়া গিয়াছেন। হয়তো মুখের দিকে চাহিয়া লণ্ডনের রাজপথের অনেক তুষারভেজা সকালের কথা, বা গ্রীষ্মকালের সমুদ্রস্নান, তীরবর্তী বালুর আঘ্রাণ, অথবা কলেজবিল্ডিং-এর করিডোরে একদিনের চপলতায় নিঃশঙ্ক আচরণ ও বিচরণের কথা মনে হইতেছে।

বাহিরে মোটরের ভিড় বাড়িয়া চলিয়াছে। শিল্পী জীবানন্দ সেন একা মানুষ, কারের হুশহুশ আর জুতার মচমচ আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত এবং ব্যস্ত হইয়া আসেন অভ্যর্থনা করিতে। নিঃসঙ্গতাহেতু এই ভয়, তার চারদিকে দৃষ্টি না দেওয়ার ফলে যদি কোনো সম্ভান্ত অতিথি অভ্যর্থনার উষ্ণতা হইতে বাদ পড়িয়া যান।

এটর্নি অতুল চৌধুরী একটি বন্ধুর ছবি দেখিয়া আশ্চর্য হন, পাশে জীবানন্দের দিকে চাহিয়া বলিলেন, বাঃ চমৎকার। জীবানন্দবাবু শুধু এই ছবিখানা দিয়েই আপনাকে পৃথিবীর একজন শ্রেষ্ঠ শিল্পীরূপে অভিহিত করা যায়; সত্যি, চমৎকার! জীবানন্দ মুচকিয়া হাসেন। এটর্নি সাহেবের সময় নাই, তাড়াতাড়ি সারিতে হইবে, চারিদিকে একবার দৃষ্টি বুলাইয়া পাশে অগ্রসর হন।

আর একটি মেয়ে—যে মেয়েটির আঘ্রাণ পাইয়া নেহাৎ আত্মাভিমানী কোনো মেয়েরও চোখে তাক লাগিবে, তির্যকদৃষ্টিতে একবার অন্তত সেদিকে চাহিবে সেই মেয়েটিকে অনেকেই জানে, ব্যারিস্টার প্রতুল চক্রবর্তীর কন্যা, অপরূপ রূপবতী (নেহাৎ আত্মাভিমানী কোনো মেয়েও একথা বলিবে)।

গায়ের রঙ এত ফর্সা যে ঠোঁটের নকল রঙও সৌন্দর্যে তীব্র হইয়া উঠিয়াছে। মাথার চুল কপালের পাশে ঈষৎ কোঁকড়ান, কালো কুচকুচ। মসৃণ নগ্ন দুই হাতে চুড়ির ভার অল্প, পরনের শাড়িতে আগুন জ্বলে, লাল।

প্রোফেসর সুব্রত রায়ের বয়েস অল্প, ছেলেরা তাহার সঙ্গে ইয়ার্কি দেয়, তাহার সম্বন্ধে অনেক কিছু জানে, এমনকি তাহার ব্যক্তিগত জীবনেও দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়াছে। অবশ্য সুব্রতর সেখানে অসম্মতি ছিল না, সে বলে: কেবল পড়ার সময় পড়া, অন্য সময় আমরা বন্ধুর মতো ব্যবহার যেন করি। কিন্তু ভাগ্যিস এখানে কোনো ছেলেই আসে নাই। তাহার পরনে ছাই রঙের সুট, চুলগুলি ব্যাক-ব্রাশ করা, কতকটা লালচে রং ধরিয়াছে।

তাড়াতাড়ি অগ্রসর হইয়া বলিল, মিস চক্রবর্তী? পাশে চাহিয়া শকুন্তলা হাসিয়া ফেলিল-আপনি? তাহার মুখের দিকে চাহিয়া সুব্রত বলিল, ওই দিকটাতে একটা ছবি ছিল, সেটাকে আমার মতে শ্রেষ্ঠ বলা চলে—দেখেছেন? এ্যস্তভাবে কথা বলা শকুন্তলার অভ্যাস। বলিল, আমি তো সব ছবিই দেখেছি, কোনটা বলুন তো?

সে একখানা পোট্রেট। শকুন্তলার গা ঘেঁষিয়া সেই ছবিটার দিকে যাইতে যাইতে সুব্রত বলিল। প্রথমে চারদিকে একবার যথাসম্ভব সুন্দর ভঙ্গিতে তাকাইয়া তারপর শকুন্তলা ছবির দিকে দৃষ্টি দিল, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কতক্ষণ দেখিয়া বলিয়া উঠিল, শ্রেষ্ঠ একে বলা চলে না, রয়, আপনার বিচারকে তারিফ করতে পারিনে।

সুব্রত হাসিয়া বলিল, তাই নাকি? তাহার চোখে চোখ চাহিয়া শকুন্তলা বলিল, ছবিটার দিকে একবার চেয়ে দেখুন, যে অঙ্কন পদ্ধতিতে এই ছবিটা এঁকেছেন, সেই ধরনের অনেকগুলো ছবি তাঁর আছে। এই দেখুন না এটাও। এগুলোই নাকি তাঁর আজকালকার আঁকা—আমার কিন্তু ভালো লাগে না। তবে এখানাকে কিছু সইতে পারি, বেশ ভালোই এটা, কিন্তু তাবলে শ্রেষ্ঠ নয়।

-সেই হিসেবে দেখতে গেলে অবিশ্যি আপনার কথাই ঠিক, হ্যাঁ, আপনি যা বলেছেন…। টানিয়া টানিয়া বলিতে লাগিল সুব্রত। কোন হিসেবে দেখিতে গেলে যে তাহার কথাটা ঠিক, সেটা সে নিজেও জানে না।

তাড়াতাড়ি আর এক পাশে গিয়া আঙুল বাড়াইয়া শকুন্তলা বলিল, দেখুন তো এটা কী, wonderful execution।

অতিরিক্ত হাসিয়া সুব্রত বলিল, wonderfull।

–মিস চক্রবর্তী।

পেছনে ফিরিয়া শকুন্তলা আশ্চর্য হইল, হাত বাড়াইয়া বলিল, good Heavens ! কখন এলেন? মৃদু হাসিয়া পল বলিল, এই তো এখন। আপনি?

—আমিও বেশিক্ষণ হয়নি এসেছি।

–সব ছবি দেখা হল?

—হ্যাঁ। শকুন্তলা তাহার হাত ধরিয়া বলিল,-চলুন আপনাকে দেখাচ্ছি।

ভয়ানকভাবে সুব্রত ছবি দেখায় মন দিল। কিন্তু মাঝে মাঝেই চোখদুটি ছবি হইতে সরিয়া সেই ছোকরা সাহেবটি আর শকুন্তলার উপরে গিয়া পড়ে। পল বড়ো সোজাসুজি—দেরি সহিতে পারে না, সম্মুখের ছবির বিষয়ে শকুন্তলার বক্তব্যকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিয়াই বলিয়া ফেলিল: মিস চক্রবর্তী, আপানাকে ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে।

হাসিয়া শকুন্তলা বলিল, Thank you.

হলের মাঝখানে দাঁড়াইয়া একদল গল্প করিতেছে। অবসরপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট অবনী সিংহ এক বন্ধুর ছেলের সঙ্গে নিজের মেয়ের পরিচয় করাইয়া দিতেছিলেন, ছেলেটির গায়ে এখনও বিলাতের গন্ধ তীব্র। সিংহ-কন্যা সেই গন্ধই শুকিতে লাগিল। নিজেও তিনি কয়েক বছর আগে তাঁহার বাবার সঙ্গে বিলাতে গিয়াছিল। সে-কথাও জানাইতে ভুলিল না। অবনী সিংহ নিজে আর এক পাশে সরিয়া মিশনারি উইলিয়ামসনের সঙ্গে আলাপ আরম্ভ করিলেন। বাহিরে এখনও একটু আলো আছে বটে, ভিতরে অন্ধকার। তাই সবগুলি আলো জ্বলিয়া উঠিয়াছে। সেই আলোতে মেয়েদের শাড়ী ঝলমল। মুখে স্নিগ্ধতা। মসৃণ মেঝেতে জুতার মৃদু আওয়াজ, কথার গুঞ্জনে কতকটা চাপা পড়িয়াছে।

জীবানন্দ জানিতেন, ইহাদের বেশিরভাগই ছবি কিনিবেন না, ইহাদের অনেকেই ঠিক সমঝদার নন, এবং-জীবানন্দ আরও কিছু হয়তো জানিতেন কিন্তু তবুও আশা! যাই বলল, এমন সমাবেশ আর কোনোবারই হয় নাই। না, না, তাঁহাদের সম্বন্ধে অভিযোগ করা মিথ্যা।

আবার কে আসিলেন?

সকলে বাহিরের দিকে তাকাইল। জীবানন্দ অগ্রসর হইলেন। বাইরে হাসি, কথা—আর জুতার শব্দ। ক্রমেই স্পষ্ট হইতেছে।

তাহারা কয়েকটি ছেলে ও মেয়ে-বাইশ তেইশ হইতে তিরিশ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন বয়সের। ছেলেমেয়েদের মধ্যে পরনে কারোর সুট, কারুর সাদা ধুতি আর পাঞ্জাবি। তাহাদের আসার সঙ্গে সঙ্গে সারা হলটি কোলাহলে ভরিয়া উঠিল। একেক জন উজ্জ্বল হাসিয়া, জোরে কথা বলিয়া স্বাস্থ্যের প্রসন্নতায় এখান হইতে সেখানে ঘুরিয়া ছবির পর ছবি দেখিয়া চলিল।

সকলে বিরক্ত হইল। মিসেস গুপ্ত আজকালকার ছেলেমেয়েদের—বিশেষত ওই নবাগত দলটির মধ্যে ফর্মালিটির নিতান্ত অভাব দেখিয়া নাক সিঁটকাইলেন। কী বিশ্রী। সাধারণ এটিকেটও কী ইহাদের জানা নাই?

এটর্নি অতুল সরকার নিজের মেয়ের দিকে হইতে এমন কোনো দোষ নাই ভাবিয়া মনে মনে আশ্বস্ত হইলেন। আর কী চেঁচামেচি? তাহাদের দিকে মাঝে মাঝে আড়চোখে চাহিয়া শকুন্তলা কথা বলিতে লাগিল। পেছনে চুলে হাত দিয়ে অবনী সিংহের মেয়ে ভাবিলেন : আহা মেয়েগুলির চেহারার যা ছিরি! তেমনি কাপড় আর জামা। যেন এইমাত্র কোথা হইতে যুদ্ধ করিয়া আসিল! বুকের উপরে আঁচল টানিবার সাধারণ স্টাইলটুকুও কী উহাদের জানা নাই? ওরকম পাড়ের আর রঙের কাপড় আর আজকাল চলে না, যাই বলো।

জীবানন্দও দারুণ বিরক্ত হইয়া এদিকে আসিয়া যোগ দিলেন।

বেগনী রঙের শাড়ি-পরিহিতা একজোড়া তীক্ষ্ণ ভ্র-বিশিষ্ট শ্যামবর্ণা একটি মেয়ে প্রায় চীৎকার করিয়া উঠিয়াছেঃ আয়ার? আরার?

একপাশে দাঁড়াইয়া আরও কয়েকটির সঙ্গে মিলিয়া আরার একটা ছবি দেখিতেছিল, ডাক শুনিয়া ইংরাজিতে বলিল, কেন?

হাত দিয়া কাছে আসিতে ইঙ্গিত করিল মেয়েটি। কিন্তু উত্তর দিয়া আর আয়ার সেদিকে তাকায় নাই, নিজ মনে ছবি দেখিতে লাগিল। কিছুক্ষণ পরে মেয়েটি তাহার কাছে আসিয়া বলিল

–Am I to shout your name this whole evening comrade ?,outs হাসিয়া ফেলিল, বলিল, এ-তো তোমাদেরই দেশ কমরেড। তোমরা তো ঘরের লোক, আমরা তোমাদের অতিথি।

মেয়েটি বলিল come, come, কিন্তু ওধারে তোমাকে একটি জিনিস দেখাবার আছে, চলো৷ ভাসা, ভাসা, সুন্দর চক্ষুবিশিষ্ট আরেকটি মেয়ে কাছে আসিয়া বলিল, লাবণ্য কেমন লাগছে?

লাবণ্য আর এক দিকে যাইতে যাইতে বলিল,-এখনও বলতে পারিনে।

-–তার মানে? কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করিয়াই ফর্সা মেয়েটি হাসিয়া ফেলিল।

নির্মল আসিয়া বলিল, মিস, সীতা, আপনার দেখা হয়েছে?

—মোটেই না।

–কমরেড আয়ার এসব দেখে খুশি হচ্ছে নিশ্চয়ই।

–তাই মনে হল।

—আর, দেশাই?

—ওই তো-সীতা আঙুল দিয়া দেখাইয়া দিল।

দেখা গেল, দেশাই ভয়ানক নত হইয়া গভীরভাবে কী একখানা ছবি দেখিতেছে।

নির্মল তাহার উপরে গিয়া পড়িল, হ্যালো, কমরেড দেশাই, Youve found something, I see?

মিসেস গুপ্তা যেন আর এখানে থাকিতে না পারিয়াই স্বামীকে লইয়া মোটরে উঠিলেন।

লাবণ্য আবার আর এক গোলমাল বাধাইয়াছে। জীবানন্দর কাছে গিয়া বলিল, আপনিই জীবানন্দবাবু?

বিরক্তি চাপিয়া তিনি বলিলেন, হ্যাঁ।

–একটু এদিকে আসুন। পরিত্যক্ত একখানা ছবির কাছে গিয়া লাবণ্য বলিল Loneliness বলে এই যে ছবিখানা, এতে ল্যাণ্ডসকেপ নেই কেন।

জীবানন্দর বলিতে ইচ্ছা হইল, ফুটপাথের ধারে ল্যাণ্ডসকেপের অনেক ছবিই পাওয়া যায়, সেগুলি কিনলেই তো হয়।

লাবণ্য বলিল, কিন্তু তার আগে বলে রাখি, আপনার ছবি সম্বন্ধে আমার কোনো জ্ঞান নেই, বুঝিনে। তবে আপনি আমাকে বুঝিয়ে বলুন, আপনার আরও আঁকা ছবি সম্বন্ধেও বুঝিয়ে বলুন। আমি জানি, তাতে আমার মনে হয়তো একটা নূতন রুচি জন্মাবে, যাতে আপনার ছবি আমার খুব ভালো লাগবে। বিশ্বেস হচ্ছে না? নতুন একটা টেস্ট জন্মানো বুঝি অসম্ভব? কখনো নয়। তাহলে একটা ব্যাপার বলি শুনুন। ছেলেবেলা থেকেই আমি পুঁই চচ্চড়ি–

পুঁই চচ্চড়ি? এই আন্তর্জাতিক আবহাওয়ায় পুঁই চচ্চড়ির নাম শুনিয়া জীবানন্দ সভয়ে একবার চারিদিকে চাহিলেন।

লাবণ্য বলিল, হ্যাঁ। ওটা আমি কখনো দেখতে পারিনে, গন্ধ পর্যন্ত শুকতে পারিনে, অথচ সকলের মুখে তার কত নাম শুনেছি; শুনেছি, খেতে নাকি চমৎকার—এসব দেখে আশ্চর্য হয়েছি, ভেবেছি, তাহলে আমার কী হল। কিন্তু আপনিও আশ্চর্য হবেন, আজ আমি পুঁই চচ্চড়ি ভালোবাসি, ভালো জিনিসের প্রতি মানুষের রুচিও তেমনিভাবে জন্মায়, যদি দুর্ভাগ্যবশত তেমন জিনিস তার কোনোদিন ভালো না লাগে। পুঁই চচ্চড়ির ইতিহাস অবশেষে লাবণ্য শেষ, করিল, আপনার ছবিও আমার তেমনি ভালো লাগবে আপনি বুঝিয়ে বলুন। এই ছবিতে ওই লোকটির নিঃসঙ্গতাকে ফুটিয়ে তুলতে ল্যাণ্ডসকেপের দরকার ছিল বলে মনে হয় না? লাবণ্য আগ্রহভরা চোখে কতকটা বিজ্ঞের মতো শিল্পীর দিকে চাহিল।

অসহ্য! সহিতে না পারিয়াও অতিকষ্টে জীবানন্দ মনের বিরক্তি চাপিলেন। বলিলেন, ল্যাণ্ডসকেপ ছাড়াই কি ওতে একটা Loneliness ফুটে ওঠেনি!

—হ্যাঁ, তা ফুটে উঠেছে অবিশ্যি।

—তাহলে? যে জিনিসটির কথা আপনি বলেছেন, সেটা আপনার—শুধু আপনার কেন, সকলের কল্পনায় জন্ম নিক, আমার আঁকার বিষয় নয়, আমি ওই পর্যন্ত এঁকে বোঝাতে পেরেছি, ওখানেই শেষ করেছি, ওই ছবি উপলব্ধি করার পক্ষে আমার আর কোনো দায়িত্ব নেই।

আশ্চর্য হইয়া লাবণ্য একবার শিল্পীর দিকে, একবার ছবির দিকে চাহিল।

—যদি আপনার এ সম্বন্ধে কিছুমাত্র জ্ঞান থেকে থাকে তবে নিশ্চয় বুঝতে পারবেন প্রেজেন্টেশনের ওই টেকনিকই আমার আবিষ্কারের কৃতিত্ব।

ব্যাপার দেখিয়া পূর্বাগতদের যে নিশ্বাস রুদ্ধ হইয়া আসিবে, তাতে আর আশ্চর্য কী? তাঁহারা যেন কোণঠাসা হইয়া পড়িয়াছেন। বয়স্করা যথাসম্ভব স্বাভাবিক ও সহজ হইয়া ছবি দেখিতে লাগিলেন। বয়স যাদের অল্প, শকুন্তলা ও অন্যান্য মেয়েরা, আড়চোখে চাহিয়া সব দেখিয়া দেখিয়া চরকির মতো ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল।

পল চলিয়া গিয়াছে। সুব্রত হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিল, সামনের ছবিটি তার চোখে অপূর্ব হইয়া উঠিল, নত হইয়া খুব ভালো করিয়া সেটা দেখিয়া সে আবার চারিদিকে চাহিল। একটু পরে স্বাভাবিকভাবে কতকটা অগ্রসর হইয়া দেখিল, ইতিমধ্যে আর একজন কার অত্যন্ত গা ঘেঁয়িয়া শকুন্তলা কথা বলিতেছে।

-Aweful, aweful! সেক্সপিরিয়ান নায়কের মতো আরও কাছে গিয়া বলা হইল না যে—অথবা কানের কাছে মুখ দিয়া বিনা আড়ম্বরে এবং স্বাভাবিকভাবে মিস চক্রবর্তী, ছবি দেখা হল?—ইহাও বলা হইল না। চুলোয় যাক! নিজের উপর অনেক অভিমান করিয়াই সুব্রত একথা বলিতে বাধ্য হইল এবং কাছেই একটি বয়স্কা, ছিপছিপে অত্যন্ত লম্বা, ছুঁচলো মুখের, শাড়ী-পরিহিতা শ্বেতাঙ্গিনীকে দেখিয়া তাহার কানে কানে না হোক, সামনেই একটু ঝুঁকিয়া সুব্রত বলিল,

— Have you finished, Madam?

–No. Thank you.

অনেকক্ষণ পরে যখন প্রায় সকলেই চলিয়া গিয়াছে, সেই দলটি কেবল তখন একটা মস্ত বড়ো ছবির সামনে জটলা করিয়া দাঁড়াইয়া ছিল।

জীবানন্দ মাথায় হাত দিয়া বসিয়াছেন, দুই একটি সস্তা ছবি ছাড়া আর বিক্রি হইল না। আশ্চর্যের বিষয় সন্দেহ নাই। তার উপর এই মেয়ে আর ছেলেগুলির যন্ত্রণা। তাঁহার সব রাগ যেন উহাদের উপর গিয়া পড়িল।

বড়ো ছবিখানার নাম Mass.

সীতা বলিল, কী সুন্দর!

দেশাই অত্যন্ত খুশি হইয়া সায় দিল।

লাবণ্যের চোখেও বিস্ময়।

নির্মল বলিল, দেখেছেন, কমরেড ঘোষ, মাস-এর কী চমৎকার রূপ ফুটে উঠেছে এই একখানা ছবিতে। এরা পথ চলতে পারে না, এদের দাঁড়াবার ক্ষমতা পর্যন্ত নেই, এদের দৃষ্টি নিষ্প্রভ, অথচ এরা জীবনের জীবন, মহাপ্রাণের মূল উৎস, মুষ্টিমেয় মানুষের অসম্ভব বিলাসের উপকরণ জোগায় এরাই! কী আশ্চর্য দেখুন, একখানা ছবিতেই আমাদের কত কথা মনে পড়ে গেল, আমরা অনুভব করলাম (এ কথায় সবচেয়ে আশ্চর্য হইল লাবণ্য, কারণ এই কথাটি জীবানন্দ তাহার কাছেই প্রথম বলিয়াছেন)। কমরেড সীতা, এই একটি ছবি দেখেই আপনার নিশ্চয় মনে হয় আমাদের চারিদিকে চাপা কান্নার শব্দ, আমাদের চারিদিকে জীবনের হীনতম উদাহরণ, খাদ্যের অভাবে, শিক্ষার অভাবে কুৎসিত ব্যায়রামের ছড়াছড়ি, মানুষ হয়ে পশুর জীবন-যাপন। আমাদের চারদিকে অবরুদ্ধ নিশ্বাস, কোটি কোটি ভয়ার্ত চোখ, তারা যেন খুনের অপরাধে অপরাধী একপাল মানুষ। কমরেড দেশাই, এত কথা যাঁর ছবি দেখে আমাদের মনে হয়, তাঁর উদ্দেশে নমস্কার জানাই।—তাহার কণ্ঠস্বর এক অপূর্ব স্নিগ্ধতায় ভরিয়া উঠিয়াছে, চোখের দৃষ্টি উজ্জ্বল।

সকলেই স্তব্ধ, ছবিতে নিবদ্ধ দৃষ্টি।

একটু পরে একজন বলিল, Let us buy this picture.

লাবণ্য তৎক্ষণাৎ অত্যন্ত উৎসাহে বলিয়া উঠিল : আমি সায় দিচ্ছি। আরও সকলের সায় দেওয়ার উৎসাহে সারা হলটি আবার কোলাহলে ভরিয়া উঠিল। জীবানন্দ মুখ তুলিয়া চাহিলেন, রাগে দৃষ্টি তাঁহার তীব্র হইয়া উঠিল।

দেশাই বলিল, ছবিটার দাম কত?

–তিনশো।

নির্মল মুখে মুখে হিসাব করিল আমরা পনেরো জন প্রত্যেকে কুড়ি টাকা করে দিলেই হবে। রাজি?

–রাজি।

লাবণ্য দৌড়াইয়া গেল জীবানন্দর কাছে, তাঁহার হাত ধরিয়া আদরের ভঙ্গিতে বলিল, আমরা অত কষ্ট করে একা একা সব দেখে বেড়াচ্ছি, আর আপনি এখানে চুপ করে বসে আছেন। জানেন আপনার অঙ্কন-পদ্ধতি আমি বুঝতে পেরেছি। তাই তো অত ভালো লাগল। না, না, এখানে বসে থাকলে চলবে না, আপনি চলুন, আমাদের সঙ্গে যোগ দিন। জানেন, আপনার মাস ছবিখানা আমরা কিনব! চলুন, লাবণ্যের দুই চোখে হাসি।

জীবানন্দ আশ্চর্য হইলেন, কিছুই বুঝিতে না পারিয়া অভিভূতের মতো সঙ্গে সঙ্গে চলিলেন, কাছে গেলে সকলে শ্রদ্ধা আর বিস্ময়ে তাঁহার দিকে চাহিল, দুই হাত তুলিয়া নমস্কার করিল। লাবণ্য কিন্তু হাসিমুখে জীবানন্দর একটি ভারী হাত ধরিয়া দাঁড়াইয়া আছে, যেন তাঁহার অতি আপনার কোনো আত্মীয়! তারপর যখন তাহারা সকলে শিশু-সুলভ হাস্য কোলাহলে চারিদিক ভরিয়া চলিয়া গেল, জীবানন্দ তখনও বিস্ময়ে তাহাদের দীপ্তি গতিপথের দিকে চাহিয়া রহিলেন, কোনো এক সময় সেই বিস্ময়ের ভাব কাটিলে জীবানন্দ ফিরিয়া সেই ছবিখানার দিকে তাকাইলেন, আজ এই মুহূর্তেই নিজের সৃষ্টিরও অত বড়ো রহস্য তাঁহার কাছে দুৰ্ব্বোধ্য হইয়া উঠিল যেন!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *