অংশীদার – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
গণেশ আমার ব্যবসার পার্টনার। জ্যাঠামশাই তখন ঠিকই বলেছিলেন, দ্যাখো, জগন্নাথ, বেকার থাকা তবু মন্দের ভালো, কিন্তু পার্টনারশিপে ব্যবসা করতে যেয়ো না, মরবে। বাঙালির পার্টনারশিপ টেঁকে না। বাঙালির স্বভাব অতি সাংঘাতিক। দুজন বাঙালি যদি নৌকো চেপে সমুদ্র পাড়ি দিতে যায়, তো একজন যখন ঘুমোবে আর-একজন তখন নৌকোর তলা ফুটো করবে। ভরাডুবি হবে জেনেও এই কাজ করবে।
জ্যাঠামশাইয়ের কথা শুনিনি। না শুনে আমার আজ এই হাল।
হেলেন অ্যান্ড ক্রসবি কোম্পানির ফুটপাথে চোপসানো বেলুনের মতো দাঁড়িয়ে আছি। হাতে সাত হাজার টাকার বিল। নাচতে-নাচতে এলুম, টাকাটা আদায় হলে লিলিকে বলেছিলুম কাশ্মীরে গিয়ে ফুর্তি করব। অ্যাকাউটেন্ট বললেন, ‘কতবার টাকা নেবেন মশাই? তিনদিন আগে আপনার পার্টনার এসে টাকা নিয়ে গেছে।’
‘নিয়ে গেছে মানে? এই তো বিল আমার কাছে, টাকা আমার পার্টনারের কাছে? অলৌকিক ব্যাপার!’
‘অলৌকিক-ফলৌকিক বুঝি না মশাই, এই দেখুন ফাইল, এই দেখুন আপনাদের কোম্পানির স্ট্যাম্প মারা রিসিটেড বিল, আমাদের চালান।’
চোখ ছানাবড়া। ফুটপাথে দাঁড়িয়ে উদাস মুখে সিগারেট খাচ্ছি। টাম যাচ্ছে, বাস যাচ্ছে, লোকের স্রোত বইছে। হাইহিল জুতো পরে মাথায় ফুলেল ছাতা মেলে হেলেদুলে এক মেমসাহেব চলেছে। কোনও কিছুই মনে ধরছে না। এই অবস্থায় আমাকে কেউ দেখলে বলত—জগন্নাথটা উল্লুকের মতো দাঁড়িয়ে আছে।
‘হারামজাদা!’
পাশ দিয়ে চাপ-চাপ দাড়িওলা একটা গুণ্ডামতো লোক যাচ্ছিল। ততটা খেয়াল করিনি। লোকটি ঝপাত করে থেমে পড়ল ‘আমাকে বললেন?’
‘আজ্ঞে না, আপনাকে এসব বলব কেন?’ মনে-মনে খুব ভয় পেয়ে গেছি।
‘তবে কাকে বললেন?’
‘আজ্ঞে, আমার পার্টনার গণেশকে।’
‘কেন? উলটে গেছে?’
‘আজ্ঞে না, নিজে সোজা আছে, আমাকে উলটে দিয়েছে।’
‘সিগারেট আছে?’ লোকটি একটা সিগারেট চাইল। সিগারেট আর নস্যি একা ভোগ করার উপায় নেই। ভাগীদার জুটবেই। সিগারেট ধরিয়ে লোকটি বললে, ‘শালা!’
‘কে, আমি?’
‘না, না, আপনি কেন শালা হতে যাবেন? আমার রিয়েল শালা, বউয়ের ভাই পঞ্চানন।’
‘শালা তো শালা হবেই।’ স্বস্তির গলায় বললুম।
‘আরে না মশাই, না, এ-শালা হল সেই শালা।’ ভীষণ রেগে গেছে লোকটি। একটানে সিগারেটের আধখানাই পড়পড় করে পুড়ে গেল।
‘মানে, সেই ইতর শালা!’
‘ইতর! চামার শালা।’
‘কী করেছেন পঞ্চাননবাবু?’ ভয়ে-ভয়ে জিগ্যেস করলুম।
‘আর বাবু বলে সম্মান করতে হবে না। বলুন, পঞ্চাশালা।’
‘আপনার শ্যালক হলেও, আমার তো নয়। কী করে বলি, বলুন?’
‘আরে মশাই, ও হল সব শালার শালা!’
‘কী করেছেন তিনি?’
‘তিনি আমার স্ত্রীর নেকলেস নিয়ে হাওয়া মেরেছেন।’
‘ছিনতাই?’
‘না, না, ছিনতাই নয়, চোরের ওপর বাটপাড়ি। নেকলেসটা হাতসাফাই করে ওর হাতে দিয়েছিলুম ঝেড়ে দেওয়ার জন্যে। পৃথিবীটা শালা পালটে গেছে। কারোর মধ্যে একটুকু সততা নেই, অনেস্টি নেই। বিশ্বাসের দাম দিতে জানে না। বিশ্বাসঘাতকের দল!’
‘স্ত্রীর গয়না হাতসাফাই করাটা খুব ভালো কাজ নয়, ইয়েবাবু।’
‘ইয়েবাবু নয়, পলটুবাবু।’
‘হ্যাঁ, পলটুবাবু। ওটা খুব নোংরা কাজ, নীচ কাজ।’
‘আপনাকে আর জ্ঞান দিতে হবে না! কী বাবু?’
‘জগন্নাথবাবু।’
‘হ্যাঁ, জগন্নাথবাবু। ওসব জ্ঞানের কথা প্রথম ভাগ, দ্বিতীয় ভাগেই মানায়। স্ত্রীলোকে গয়না পায় স্বামীর দৌলতে। আমি আমার বউকে বিয়ে করেছিলুম বলেই আমার শ্বশুরমশাই ধার-দেনা করে দশ ভরি গয়না দিয়েছিলেন। বিয়ে না করলে মেয়েকে গয়না দিতেন! গবেট!’
‘কে গবেট?’
‘আপনি, আবার কে? যাক, আলাপ যখন হয়েই গেল, তখন চলুন, কোথাও বসে চা খাওয়া যাক। আগেই বলে রাখছি, তিনটের পর আমি শুধু চা খেতে পারব না। মোগলাই-টোগলাই চাই। পকেটে সেরকম মালকড়ি আছে তো?’
বেশ মজার লোক। নিজের দুঃখে এতক্ষণ খুব কাবু-কাবু লাগছিল। এই লোকটিকে পেয়ে বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছি। দুঃখ ভাগ করে নিতে পারলে, সেই প্রবাদের মতো, একের বোঝা দশের লাঠি।
কাঠের কেবিন। ঘ্যানঘ্যান করে একটা কেবিন-ফ্যান ঘুরছে। চারটে পায়া থাকলেই যদি টেবিল হয়, তাহলে সেইরকম একটা টেবিলের দু-পাশে দুটো চেয়ার। চটচটে একটা মরিচ আর একটা নুনদানি। আবার একটা পরদাও ঝুলছে। মেয়েছেলে-ফেয়েছেলে নিয়ে কেউ এলে, ওই ময়লা-ময়লা পরদাটা ঝড়াং করে টেনে দিলেই আড়াল তৈরি হবে। পাশের কেবিনটার পরদা টানা রয়েছে। মাঝে-মাঝে চুড়ির কিনিকিনি শোনা যাচ্ছে।
বয় এসে দাঁড়াতেই আমাকে আর অর্ডার দিতে হল না। পলটুবাবুই হুকুম জারি করলেন, দুটো মোগলাই, একটায় ডবল ডিম আর মাংসের কিমা, বেশি পেঁয়াজ আর আদা-কুচি। বয় চলে গেল। পলটুবাবু বললেন, ‘আপনারটা লাইটই থাক। বলা যায় না, পেটে সহ্য হবে কি হবে না।’
পলটুবাবু গেলাসে চুমুক দিলেন। অল্প একটু জল খেয়ে বললেন, ‘চোখের সামনে দিয়ে সিলভার অ্যারো বেরিয়ে গেল, কিচ্ছু করতে পারলুম না। ইস, ইস! শালা আমাকে হেল্পলেস করে দিলে!’
‘সিলভার অ্যারো? সেটা আবার কী?’
‘আরে ঘোড়া, মশাই, ঘোড়া। ব্যাঙ্গালোর রেসে শনিবার দৌড়চ্ছে। ভেবেছিলুম, টিপলটোটে খেলে একটা নেকলেস দুটো করে আনব। শালা পথ মেরে দিলে। সেই বউই ভালো, যে-বউতে শালা নেই।’
‘আপনি রেস খেলেন? রেসে মানুষ সর্বস্বান্ত হয়।’
‘তা হয়। আমিও হয়েছি। তবে জেদ চেপে গেছে। ঘোড়ার লাগাম আমি ধরবই। করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে। কী অমন জন্তু, মশাই! মেয়েছেলে নাকি? সারা জীবন ছলনা করে যাবে। মানুষ বলবে, দেবা ন জানন্তি কুত মনুষ্যাঃ। ওই তো চারটে পা, একটা ল্যাজ, পিঠে একটা জকি। কতকাল ছলনা করবে? আমি শেষ রাতে স্বপ্ন পেয়েছি—সিলভার অ্যারো, সিলভার অ্যারো।’
মোগলাই এসে গেল। পলটুবাবু ছুরি আর কাঁটা নিয়ে ডিশের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। একটা বড় মাপের টুকরো মুখে পুরে বললেন, ‘আজ থেকে আপনি আমার বন্ধু, বিপদে-আপদে। আপনার কেসটা কী?’
‘আমার কেস, ওই বাঙালির পার্টনারশিপ। একটা ব্যবসা করেছিলুম। গণেশ আমার ওয়ার্কিং পার্টনার। বেটা খুব বেগোড়বাই করছে। টাকা-ফাকা সরাচ্ছে। কিছু বলতে গেলেই চোখ রাঙায়। ভয় দেখায়। মহা ফাঁপরে পড়ে গেছি।’
‘মালটাকে হাটান না, হাপিস করে দিন।’
‘হাপিস মানে?’
‘গুম করে দিন। লোকটা ছিল, লোকটা আর নেই।’
‘মার্ডার?’
‘মার্ডার-ফার্ডার জানি না। মাল চৌপাট।’
‘কীভাবে?’
‘ও অনেক রাস্তা আছে। আমার গুরু জানে।’
‘রেসের গুরু?’
পলটুবাবু ছুরি দিয়ে প্লেটের গায়ে ট্যাং-ট্যাং করে শব্দ করলেন। বয় এসে দাঁড়াল।
‘পেঁয়াজ আনো।’
বয় চলে যেতেই পলটুবাবু বললেন, ‘গুরু আমার নাম্বার ওয়ান, আইন জানে, ক্যারাটে, কুংফু জানে, ভালো ডাক্তারের মতো ছুরি চালাতে জানে। কীরকম চোট দিয়েছে?’
‘এই মাত্র সাত হাজার।’
‘সাত হাজার? কোনও মানে হয়? সাতবার একুশটা ঘোড়া ছোটানো যেত! মালটাকে জোটালেন কোত্থেকে?’
‘জুটে গেল! এখন আর নামতে চাইছে না। ব্যবসা থেকে আমাকেই আউট করে দেবে দেখছি। কোর্টকাছারি কে করবে? আইন দিয়ে হাটাতে গেলে অনেক টাকার ধাক্কা। কারবার লাটে উঠে যাবে।’
পলটুবাবু চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘কোর্টকাছারি ছাড়াও অন্য রাস্তা আছে। ধোলাই।’
‘কে ধোলাই দেবে? আমার ক্ষমতা নেই।’
‘কাপড় ধোলাই করার যেমন লোক আছে, মানুষ ধোলাই করারও তেমনি লোক আছে।’
‘তাতে তো আর টাকা ফিরবে না, জোচ্চুরিও বন্ধ হবে না।’
‘তাহলে মালকে পগার পার করে দিতে হবে।’
‘মার্ডার?’
‘মার্ডার আবার কী? আজকাল মার্ডার বলে কিছু নেই, যাকে পারো ধরো আর মারো।’
‘না মশাই, ওসব ঝামেলার মধ্যে আমি নেই—সাত হাজার গেছে, আরও হয়তো যাবে। যায় যাক।’
‘যায় যাক বলে কোনও শব্দ আমার ডিকশনারিতে নেই। ইউ আর মাই ফ্রেন্ড। গণেশের পেট আমি ফাঁসাবই। ছুরি দিয়ে নয়, দৈব দিয়ে।’
‘মাদুলি-ফাদুলি?’
‘বাণ মেরে। বাণ মেরে শুকিয়ে দেব। দিন-দিন মরা কাঠের মতো চেহারা হয়ে যাবে।’
‘ধ্যুস, ওসবে আমার বিশ্বাস নেই!’
‘বিশ্বাস নেই?’ পলটুবাবু দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে উঠলেন, ‘হিন্দুর ছেলে ঝাড়ফুঁকে বিশ্বাস নেই! কী আমার সায়েব রে!’
‘নেই তা কী করব?’
‘এখুনি বিশ্বাস হবে। এমন এক জায়গায় নিয়ে যাব, আপনি তো তুচ্ছ, আপনার বাবারও বিশ্বাস হবে।’
রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে এসে আবার আমরা রাস্তায়। অফিস-ভাঙা ভিড় বাসে-ট্রামে। পলটুবাবু বললেন, ‘একটা সিগারেট ছাড়ুন। খুব খাইয়েছেন, মশাই। পৃথিবীতে সাধুও যেমন আছে, শয়তানও তেমনি আছে! মিলেমিশে এই জগৎ। আপনার মনটা বেশ ভালোই।’
সিগারেট ধরিয়ে ভুস করে খানিকটা ধোঁয়া ছাড়লেন।
‘নিন, চলুন। শত্রুর শেষ রাখতে নেই। দু-শালাকেই যমের বাড়ি পাঠাব। পঞ্চা আর গণশা। নেকলেস, আর সাত হাজার। হজম করতে দেব না।’
‘কোথায় যাবেন?’
‘সিরিটি।’
‘সেটা আবার কোথায়?’
‘কাছেই। বাসে ঘণ্টা-দেড়েক লাগবে।’
‘সিরিটি যাব কেন?’
‘সেখানে আমার গুরুর আশ্রম। মহাশ্মশানের পাশে। তান্ত্রিক। মন্ত্র পড়ে একটা জবাফুল মাটিতে ফেলে দেবেন, আকাশ থেকে হুড়মুড় করে প্লেন ভেঙে পড়বে, ব্রিজ থেকে ট্রেন ঝাঁপিয়ে পড়বে জলে, শোওয়ার ঘরে খাটের তলায় দপ করে আগুন লাফিয়ে উঠবে, সিলিং থেকে ফ্যান খসে পড়বে মাথার ওপর, আলমারির তলা থেকে সাপ বেরোবে ফোঁস করে। যখন যেখানে যা দরকার, ঠিক তাই ঘটে যাবে। চলুন, চলুন, আর দেরি না।’
গণেশের ওপর আমার ভীষণ রাগ হচ্ছিল। ফ্যা-ফ্যা করে ঘুরছিল। ধরে এনে ব্যবসায় ভেড়ালুম। তিন বছর না যেতেই বিয়ে করে বসল। বাঙালির ছেলে বিয়ে করে সায়েবদের মতো হনিমুনে গেল—কুলু, মানালি, কত কী! তখন কি জানতুম ছাই, আমারই ট্যাঙ্ক ফুটো করে বাবুর লপচপানি। আদুরে বউকে নিয়ে দেড় মাস আদিখ্যেতা। দেখাই যাক না, কী হয়। গণেশকে একটু শিক্ষা দেওয়া দরকার। তা না হলে সারা জীবন জোচ্চুরি করে যাবে। আজ আমার সঙ্গে, কাল রামের সঙ্গে, পরশু হরির সঙ্গে।
ভাবতে-ভাবতেই বাস এসে পড়ল। পলটু ‘উঠুন, উঠুন’ করে ঠেলেঠুলে উঠিয়ে দিলেন।
সিরিটি জায়গাটা আদি গঙ্গার ধারে। কলকাতার এত কাছে এমন একটা অদ্ভুত জায়গা আছে, আমার জানাই ছিল না। পলটুবাবুর গুরুদেবের আশ্রম একেবারে নদীর ধারে। ঢালু জমি আশ্রমের পেছন দিকে গড়িয়ে নেমে গেছে মজা নদীর দিকে। সেখানেই শ্মশান। আধপোড়া মৃতদেহ এখানে-সেখানে ছড়িয়ে আছে। সন্ধে হয়ে এসেছে। গোটাকতক শেয়াল সেই বীভৎস জায়গায় খ্যা-খ্যা করছে। কালো-কালো কুকুর ঘুরছে। জ্বলজ্বলে চোখ। চারপাশে পচা গন্ধ। বিশাল একটা বটগাছ। তলাটা অন্ধকার। বাঁধানো বেদি। মাঝে-মাঝে কালপেঁচা ডেকে উঠছে। একটা দুটো করে বাদুড় ডাল থেকে খসে পড়ে সুইস-সুইস শব্দে আকাশের দিকে উড়ে চলেছে। সমস্ত দৃশ্যটাই যেন একটা দুঃস্বপ্নের মতো।
একটা একতলা কোঠাবাড়ি। বাইরে থেকে দেখলে আশ্রম বলে মনে হওয়ার কথা নয়। সামনেই উঁচু রোয়াক। পথ পাশ দিয়ে ঘুরে গা-ছমছম করা বটতলার অন্ধকার পেরিয়ে পেছনে আদিগঙ্গার ঢালে গিয়ে পড়েছে। বটতলায় দাঁড়িয়ে আছেন মা ছিন্নমস্তা। দেখলেই বুক কেঁপে ওঠে। এক হাতে নিজের মুণ্ড, কাটা গলা দিয়ে ফোয়ারার মতো রক্ত উঠে মুখে ঢুকছে। নিজের রক্ত মা নিজেই পান করছেন।
পলটুবাবুর সঙ্গে পেছনের দরজা দিয়ে বাড়িতে ঢুকতে হল। ভেতরে উঠোন। উঠোন ঘিরে উঁচু দালান। টকটকে লাল রঙের মেঝে। সারি-সারি বড়-ছোট ঘর। একটি মেয়ে এ-ঘর থেকে ও-ঘরে যাচ্ছিল। শ্যামবর্ণা, কিন্তু ভারী মিষ্টি চেহারা। আমাদের দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে বললে, ‘উনি এখন বিশ্রাম করছেন একটু। আজ অমাবস্যা। সারারাত পুজো আছে তো।’
পলটুবাবু বললেন, ‘তা থাক। আমাদের খুব জরুরি দরকর। বেশি দেরি করলে গুরুজির পাওয়ারের বাইরে চলে যাবে। গুরুজি—গুরুজি! আমরা এসে গেছি।’
পলটুবাবুর দাপট কম নয়। গটগট করে দালান পেরিয়ে ঘরে চুকলেন। আমাকে ইতস্তত করতে দেখে বললেন, ‘চলে আসুন না। ভয় পাচ্ছেন কেন?’
প্রথম যে-ঘরটা, সেটা বোধহয় ঠাকুরঘর। বেশ বড়। ধূপধুনো, ফুল-বেলপাতা সব মিলেমিশে কেমন একটা গন্ধ তৈরি হয়েছে। একপাশে উঁচু বেদিতে তারা মূর্তি। বিশাল একটা প্রদীপ জ্বলছে থিরথির করে। সামনে আসন পাতা। চারপাশে ছড়ানো পূজার জিনিস।
ঘর পেরিয়ে ঘর।
‘গুরুজি! গুরুজি!’
ভেতর থেকে ভেসে এল গম্ভীর গলা : ‘অসময়ে কেন?’
‘বিপদে পড়ে গেছি, গুরুজি।’
লাল টকটকে চেলি পরে গৌরবর্ণ এক বৃদ্ধ একটি খাটে শুয়ে আছেন। খোলা গা। লাল পইতে। মুখটি বেশ প্রসন্ন ও উজ্জ্বল।
‘তোর তো পদে-পদেই বিপদ। সঙ্গে আবার কাকে নিয়ে এলি?’
‘আমার এক বন্ধু। দুজনেই বিপদে পড়েছি।’
‘কী বিপদ?’
মেঝেতে দুজনে বসে পড়লুম। পলটুবাবুই সব বললেন। নেকলেস হাতিয়ে শ্যালক বেপাত্তা। সাত হাজার মেরে আমার পার্টনার হাওয়া।
গুরুজি সব শুনে বললেন, ‘আমার কী করার আছে? আমি আমার সাধনভজন নিয়ে একপাশে পড়ে আছি। তোদের এসব ছ্যাঁচড়া ব্যাপারে আমি কী করব?’
‘গুরুজি, সেবার আপনি জগাইকে সাত মাস হাসপাতালে ফেলে রেখেছিলেন।’
‘কোন জগাই?’
‘ওই যে আমার জ্যাঠামশাইয়ের ছেলে। আমাকে একদিন ধরে খুব ধোলাই দিয়েছিল।’
‘বারবার ওসব কাজ হয় না রে, পলটু। তা ছাড়া, এই কিছুদিন আগে আমি একটা বড় কাজ করেছি। এখন কিছুদিন বিশ্রাম চাই।’
‘কী বড় কাজ গুরুজি?’
‘একটা বিমান দুর্ঘটনা, আর-একটা ট্রেন দুর্ঘটনা। আমার বহুত শক্তি ক্ষয় হয়ে গেছে। এখন মাস-তিনেক আমাকে ক্রিয়াকলাপ করতে হবে।’
‘ও দুটো কাজ কেন করলেন, গুরুজি?’
‘প্রয়োজন ছিল।’
পলটু ঘষটে-ঘষটে গুরুজির খাটের দিকে এগিয়ে গিয়ে পা দুটো জড়িয়ে ধরল : ‘সামান্য কাজ, গুরুজি। এ তো আপনার কাছে ছুঁচো মারা।’
‘একটা নেকলেস আর সাত হাজার টাকার জন্যে জ্বলজ্যান্ত দুটো লোককে মেরে ফেলব, শুয়োর?’
‘পাপের শাস্তি, গুরুজি। গীতাতেই তো আছে, বিনাশায় চ দুষ্কৃতকারিণাং।’
‘তোরা কী এমন সুকৃতি করেছিস?’
‘আমি না হয় বদ, গুরুজি, কিন্তু আমার বন্ধু! পার্টনার মেরে ফাঁক করে দিচ্ছে।’
‘তাতে তোর কী রে, শালা?’
‘পরের দুঃখে আমার মন যে কাঁদে।’
‘আহা! আমার শ্রীচৈতন্য রে!’
পলটুবাবু একেবারে নাছোড়বান্দা। পা ধরে ঝুলোঝুলি। আমি একবার ফিসফিস করে বললুম, ‘ছেড়ে দিন না, মশাই। যা হওয়ার তা হবে। নিজেরা বোকা বনেছি, বোকাই থাকি। পরের অনিষ্ট করে কার কী লাভ হবে।’
‘কী যে বলেন? অন্যায় যে সহে, অন্যায় যে করে তব ঘৃণা তারে যেন…।’
‘সে তো ঈশ্বরের ঘৃণা।’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ। সেই ঘৃণা, সেই শাস্তিই তো গুরুদেব নামিয়ে আনবেন।’
গুরুজি এতক্ষণ শুয়ে-শুয়েই কথা বলছিলেন। এইবার ধীরে-ধীরে উঠে বসলেন। পা দুটো খাট থেকে নেমে এসে ঝুলতে লাগল ড্যাং-ড্যাং করে। বেশ গোলগাল বেঁটেখাটো চেহারা। গুরুজি হঠাৎ ডাকতে শুরু করলেন, ‘মায়া—মায়া!’
সেই মেয়েটি ঘরে এল। আমার এখনও বিয়ে হয়নি। বিয়ে হলে হয়ে যেত। বউকে খাওয়াবার মতো পয়সাকড়ির অভাবে আইবুড়ো কার্ত্তিক হয়ে বসে আছি। এই তো সবে লিলি বলে একটা মেয়েকে নাড়াচাড়া করে দেখছি। কিন্তু এই মেয়েটিকে দেখার পর থেকে লিলি বাতিল।
গুরুজি বললেন, ‘একটা বড় বাটি করে একবাটি জল আন তো, মা।’
মায়া চলে গেল। আমার চোখও পেছন-পেছন চলল। নাঃ, গুরুজির চেলা বনে বাকি জীবনটা পদসেবা করেই কাটিয়ে দিই।
মায়া আবার এল। চ্যাটালো একটি কাঁসিতে টলটলে জল। মেঝেতে গুরুজির পায়ের কাছে সামনে ঝুঁকে পড়ে নামিয়ে রাখল। সেইসময় কিছু-কিছু জিনিস দেখে আমি প্রায় মরে যাওয়ার মতো হলুম। শরীর নয় তো, মরণ-ফাঁদ!
গুরুজি সেই জলের দিকে একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘পলটু, তোমার নেকলেস তোমার বাড়িতেই আছে, তোমার বউয়ের কাছে। আর তোমার? কী নাম তোমার?’
‘জগন্নাথ।’
‘জগন্নাথ। বেশ। তোমার সাঙাতকেও আমি আমার জল-দর্পণে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। মুখটা গোল। নাক থ্যাবড়া। চোখ দুটো মার্বেলের মতো। জোড়া ভুরু। ডান ঠোঁটের ওপর কাটা দাগ। কী, মিলছে?’
‘আজ্ঞে, হ্যাঁ। ঠিক-ঠিক মিলছে।’
‘মিলতেই হবে। কী নাম বলেছিলে?’
‘গণেশ।’
গুরুজি স্তব্ধ হয়ে চোখ বড়-বড় করে জলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কী আশ্চর্য! আমরা কিন্তু কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। গুরুজির চমক ভাঙল : ‘ছ’ থেকে সাত মাসের মধ্যে গণেশের ফাঁসি হবে।’
কথা ক’টা বলেই খুব ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়লেন : ‘তারা, তারা! তোরা এখন যা। যাওয়ার আগে মাকে প্রণাম করে যা।’
ঠাকুরঘরে মায়া হাঁটু মুড়ে বসে পুজোর ফুল গুছিয়ে রাখছে। মনে-মনে বললুম, আমার যদি একটা সংসার থাকত। এইরকম একটা শ্যামলী বউ। লিলি? যেমন নাম তেমনি ছিরি। হান্টারওয়ালি। বব চুল। ঠোঁটে লাল রং। মুখে মেকআপ। কটা সুন্দরী!
টেলিফোন বেজেই চলেছে। কেউ ধরে না কেন? বাড়িসুদ্ধ সব একসঙ্গে সুইসাইড করেছে নাকি? অবশেষে কেউ একজন ধরেছে। মেয়েলি গলা।
‘হ্যালো!’
‘গণেশ আছে?’
‘কে আপনি?’
‘আমি যেই হই না, গণেশ আছে কি নেই?’
‘নেই। কলকাতার বাইরে গেছে।’
‘অত পাঁয়তাড়া না করে এই কথাটাই তো আগে বললে হত।’
ফোনটা দুম করে নামিয়ে রাখলুম। বেটা কলকাতাতেই আছে। পালিয়ে বেড়াচ্ছে। কেস ঠোকার আগে মুখোমুখি একবার কথা বলতে চাই। এমনি ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে ভালো। নয়তো উকিলে খাবে হকের পয়সা। আমি নিজেই একবার যাব। আজই যাব। ওকে না পাই ওর বউকে বলে আসব।
ট্রাম থেকে নামতেই টিপটিপ করে বৃষ্টি এল। ট্রামরাস্তা ছেড়ে বাঁয়ে মোড় নিলুম। রাস্তাটা নেহাত কম চওড়া নয়। দু-পাশে খাড়া-খাড়া বাড়ি। দু-একটা বাড়ির সঙ্গে লাগোয়া বাগান। এমন কিছু জোর বৃষ্টি নয়। পিটির-পিটির। সময়টা দুপুর-দুপুর। রাস্তাটা তাই নির্জন। পেছনে একটা মোটর সাইকেল আসছে ঝড়ের বেগে। ওই শব্দটাকে আমি ভীষণ ভয় পাই। ছেলেবেলার আতঙ্ক আর কি! একবার ধাক্কা খেয়েছিলুম। যতটা সম্ভব রাস্তার বাঁ-ধারে সরে গেছি। ভীষণ শব্দ ক্রমশই এগিয়ে আসছে। একে নির্জন রাস্তা, তার ওপর দু-পাশে খাড়া-খাড়া বাড়ি। শব্দটা সেই কারণেই আরও জোর মনে হচ্ছে।
সত্যিই আমি প্রস্তুত ছিলুম না। কী ঘটছে বোঝার আগেই ছিটকে রাস্তার ধারে গিয়ে পড়লুম। মোটর সাইকেলটা বাঁ-দিক থেকে ডান দিকে সোজা হয়ে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল। কোমরে ভীষণ লেগেছে। পড়বার সময় বাঁ-দিকে লাট খেয়েছিলুম, বাঁ-হাতটা মনে হয় ভেঙেই গেছে। হাঁটু দুটো অক্ষত নেই। কপালটাও কেটেছে নিশ্চয়। আচ্ছা জানোয়ার তো! কোনওরকমে উঠে বসতে পেরেছি। উঠে দাঁড়াতে পারব কি! সামনের বাড়ির দোতলার জানলায় একটি মহিলার মুখ। কী লজ্জার কথা! মেয়েদের সামনে বেইজ্জত। উঠে আমাকে দাঁড়াতেই হবে। বাড়িটার দেওয়াল ধরে কোনওরকমে উঠে দাঁড়ালুম। পা কাঁপছে। মাথা ঘুরছে। কোমর সোজা হচ্ছে না। উলটো দিকেই একটা লাল রক। একটু বসতে পারলে ভালো হত। আবার যেন মোটরসাইকেলের আওয়াজ আসছে কানে। সর্বনাশ! আবার ফিরে আসছে নাকি? খুব দ্রুত আসছে। এবার মারলে আর বাঁচব না। বাঁচার একমাত্র রাস্তা কোনওরকমে রকে গিয়ে ওঠা। ঝড়ের বেগে যমদূত এগিয়ে আসছে। ওই তো রক। না, আর হল না। শূন্যে উড়ে গেলুম যেন! শরীরের সমস্ত হাড়গোড় খুলে গেল। মোটরসাইকেলের তীব্র শব্দ। কোথাও সশব্দে জানালা বন্ধ হল। মেয়েলি চিৎকার।
একটা শিশি ঝুলছে। স্বচ্ছ একটা নল হাতে এসে ঢুকেছে। নাকে আর-একটা নল। শরীরটা সিসের মতো ভারী। কে যেন বললেন, ‘জ্ঞান ফিরেছে, জ্ঞান ফিরেছে।’
খুটখুট জুতোর শব্দ। চোখে ঝাপসা দেখলেও দেখতে পাচ্ছি, একটা মুখ, মাথায় সাদা টুপি। সাদা অ্যাপ্রন। নীলপাড় শাড়ি। তিনটি মাত্র শব্দ আমি উচ্চারণ করতে পারলুম। মার্ডার, পুলিশ, গণেশ। তারপর আমি কীরকম এক আলোর স্রোতে ভেসে গেলুম। যেতে-যেতে দেখলুম, একটা ফাঁসিকাঠ। গোল দড়ির ফাঁস, গণেশ। একপাশে গুরুজি লাল চেলি পরে, আর-একপাশে আমি। আমার হাতে পুলিশের ব্যাটনের মতো গোল করে পাকানো, শীল অ্যান্ড সরকার কোম্পানির পার্টনারশিপ ডিড।
এইসব কথা আমি কী করে লিখলুম জানি না। আমি যদি লিখে থাকি, তাহলে আমি মরিনি। কারণ, মরা মানুষ আর যাই পারুক, লিখতে পারে না। আর আমি না মরলে, গণেশের ফাঁসি হয় না। ফাঁসি না হলে, দৈব মিথ্যে হয়ে যায়। তাহলে কী যে হয়েছে, কে জানে!
মাসিক রোমা
পুজো সংখ্যা, ১৯৮০