অংক শ্লোক

অংক শ্লোক

পাখির ডাকে যে সত্যি সত্যি ঘুম ভাঙতে পাড়ে এই ধারণা আমার ছিল না। শহরে পাখি তেমন নেই আর থাকলেও তারা সম্ভবত ভোরবেলায় এত ডাকাডাকি পছন্দ করে না।

ভাটি অঞ্চলে এসে প্রথম পাখির ডাকে জেগে উঠলাম এবং বেশ হকচকিয়ে গেলাম। নানান ধরনের পাখি যখন এক সংগে ডাকাডাকি করতে থাকে তখন খুব যে মধুর অবস্থার সৃষ্টি হয় তা নয়। আমি বিছানায় উঠে বসতে বসতে বললাম, ব্যাপার কি? কিসের হৈ চৈ?

আমার বন্ধু করিম ঘুম ঘুম গলায় বলল, পাখি ডাকছে। এরা বড় যন্ত্রণা করে। তুই চাদরে মুখ ঢেকে শুয়ে থাক।

করিমের সংগে গত রাতে এই অঞ্চলে এসে পৌঁছেছি। আমি ঘরকোনা ধরণের মানুষ। বেড়াতে পছন্দ করি যদি বেড়ানোটা খুব আরামের হয়। দু’দিন নৌকায় করে, জীবন হাতে নিয়ে হাওর পাড়ি দেয়ার ব্যাপারে আমার উৎসাহ কম। করিম বলতে গেলে জোর করে আমাকে নিয়ে এসেছে। তার একটাই কথা, তোর লেখালেখিতে সুবিধা হবে। দু’একটা চরিত্রও পেয়ে যেতে পারিস। কিছুই বলা যায় না।

কোথাও বেড়াতে গিয়ে চরিত্র খোঁজা আমার স্বভাব না। ঢাকা ছেড়ে বাইরে গেলেই মানুষের চেয়ে প্রকৃতি আমাকে অনেক বেশী টানে। মানুষতো সব সময় দেখছি প্রকৃতি দেখার সুযোগ কই। যেখানেই যাই প্রচুর বই সংগে নিয়ে যাই। আমি লক্ষ্য করেছি নতুন পরিবেশে আরাম দায়ক আলস্যে বই পড়ার মত মজা আর কিছুতেই নেই। হুট করে কেউ বেড়াতে আসবে না, বিকট শব্দে টেলিফোন বেজে উঠবে না। চেনা জগৎ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার অন্য রকম আনন্দ আছে। একে বোধ হয় বলে শিকল ছেড়ার আনন্দ।

করিম আমাকে বলেছিল, তোকে দোতলা দালানের বিরাট একটা ঘর ছেড়ে দেব। সামনে বিশাল বারা। বারান্দায় দাঁড়ালেই দেখবি বিশাল হাওর। ঘাটে পানশি নৌকা থাকবে, মাঝি থাকবে। যখন ইচ্ছা নৌকায় চড়ে বসবি। আমি তোকে মোটেও বিরক্ত করব না। তুই থাকবি তোর মত।

মোটামুটি লোভনীয় একটা ছবি তুলে ধরল তবে এও বলল, প্রকৃতি দেখতে প্রথম কয়েকদিন তোর ভাল লাগবে তারপর বোর হয়ে যাবি। চারদিকে শুধু পানি আর পানি দৃশ্যের কোন ভেরিয়েশন নেই। অবশ্যি কোনমতে এক সপ্তাহ কাটাতে পারলে দেখবি নেশা ধরে গেছে। তখন আর যেতে মন চাইবে না।

করিমের সব কথাই মিলে গেল। অষ্টম দিনে আমাদের ঢাকা ফেরার কথা। আমি বললাম, আরো কয়েকটা দিন থেকে যাই। করিম বলল, যত দিন ইচ্ছা থাক আমি এই ফাঁকে আমার মামার বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। একটা হাওর পরেই আমার মামার বাড়ি। তোকে নিতে চাচ্ছি না। কারণ আমি মামার বাড়ি যাচ্ছি ঝগড়া করার জন্যে। তুই থাক এখানে।

আমি থেকে গেলাম।

দিনের বেশীর ভাগ সময় কাটতে লাগল পানসি নৌকায়। বিশাল নৌকা। নৌকার ভেতরই গোসলখানা এবং বাথরুম। নৌকার ছাদে শুয়ে থেকে দুলতে দুলতে আকাশ দেখা যায়। একসময় মনে হয় আমি স্থির হয়ে আছি, আকাশ দুলছে। অপার্থিব অনুভুতি, দালান কোঠার শহরে এই অনুভুতি কল্পনা করা সম্ভব নয়।

এক বিকেলে নৌকার ছাদে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুম ভাঙল সন্ধ্যা মেলানোর পর। উঠে বসতেই ভারী গলায় কে যেন বলল, ভাই সাহেব কেমন আছেন? আপনার সংগে দেখা করার জন্যে আসছি। আমার নাম জালালুদ্দিন বি, এ, বি, টি। আমি ভাটিপাড়া মডেল হাই স্কুলের অংকের শিক্ষক। আপনি অসময়ে নিদ্রা মগ্ন। ছিলেন। এটা স্বাস্থ্যের জন্যে হানিকর। আমি অত্যন্ত বিরক্ত হলাম। ঘুম ভাঙতেই উপদেশ শুনতে কারোরই ভাল লাগার কথা না। শিক্ষক সম্প্রদায়ের স্বভাবই হচ্ছে যখন তখন উপদেশ দিয়ে বেড়ানো।

ভদ্রলোক আগের চেয়েও ভারী গলায় বললেন, আপনার বিনা অনুমতিতে একটা কার্য করেছি। নৌকার মাঝিকে চা বানাতে বলেছি। নিজে এক পেয়ালা খেয়েছি এখন আপনার সংগে আরেক পেয়ালা খাব। যান মুখ ধুয়ে আসুন। শহরের বেশীর ভাগ লোক মুখ না ধুয়ে চা খায়। স্বাস্থ্যের জন্যে হানিকর। স্বাস্থ্যের জন্যে হার্কির বিষয়গুলি যিনি এত ভাল জানেন তাঁর স্বাস্থ্য খুব ভাল দেখলাম না। রোগা কাঠি। মুখ ভর্তি কাঁচা পাকা দাড়ি। যক্ষা রুগীর চোখের মত উজ্জল চোখ। বয়স পঞ্চাশের উপরে। পায়জামার উপর কালো রংগের পাঞ্জাবী।

আমি বললাম, আপনি কি কোন বিশেষ কাজে এসেছেন? না এমি গল্প গুজব করতে এসেছেন।

কাজে এসেছি। গল্প গুজব করে নষ্ট করার সময় আমার নাই। আপনারও নিশ্চয়ই নাই। লোকমুখে শুনেছি আপনি গল্প উপন্যাস লেখেন। অবশ্য পড়া হয় নাই। সময়ের বড়ই অভাব।

একবার ভাবলাম বলি আমাদের কাজের অভাব আছে। সময়ের অভাব নেই। আমাদের সবার অঢেল সময়। বললাম না কথা বার্তা বলে এই মানুষটিকে প্রশ্রয় দেয়া ঠিক হবে না। শিক্ষক শ্রেণীর কেউ কথা বলার প্রশ্রয় পেলে অবনরত কথা বলবে। ফরিদপুরে একবার এমন একজনের সাক্ষাত পেয়েছিলাম। তিনি সন্ধাবেলায় কথা শুরু করলেন এক নাগারে রাত সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত বললেন। কেউ কিছু বলতে গেলেই হাত তুলে বলেন এক মিনিট আমি আমার কথাটা শেষ করে নেই। তারপর যা বলার বলবেন।

এই জালালুদ্দিন বি, এ, বিটিও সেই ধরনের কোন মানুষ কি না কে জানে।

আমি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললাম, আপনি কি সিগারেট খান মাষ্টার সাহেব?

তিনি বিরক্তমুখে বললেন, স্বাস্থ্যের জন্যে হানিকর জিনিষ পরিহার করি। চা পরিহার করতে পারি নাই। লেখালেখি করি এই জন্যে চা-টা প্রয়োজন হয়।

আমি অত্যন্ত শঙ্কিত বোধ করলাম।

অতীত অভিজ্ঞতায় দেখেছি গ্রামে গঞ্জে যে সব লেখক আছেন তারা শহরের শ্রোতা পেলে সহজে ছাড়েন না। জীবন অতিষ্ট করে তুলেন।

জালালুদ্দিন বি,এ, বিটি বললেন, আমি কাব্য চর্চা করি।

আমি চুপ করে রইলাম এই সব ক্ষেত্রে উৎসাহ সূচক কোন কথাই বলা উচিত না।

আপনার মনে হয়ত প্রশ্নের উদয় হয়েছে অংকের শিক্ষক হয়ে কাব্য চর্চা কেন করি।

আমার মনে এই জাতীয় কোন প্রশ্নের উদয় হয় নি। অংকের শিক্ষক কাব্যচর্চা করতে পারবেন না এমন কোন কথা নেই।

সঠিক বলেছেন। তবে আমি প্রথাগত কবি নই। আমি গোটা পাটিগনিত কাব্যে রূপান্তরিত করছি।

বলেন কি?

আপনি হয়ত বাপারটা বুঝতে পারছেন না। উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দেই। পাটিগণিতের একটি অংক আছে এই রকম, ক একটি কাজ পনেরো দিনে সম্পন্ন করিতে পারে। খ সেই কাজ ৩০ দিনে সম্পন্ন করে। ক ও খ মিলিত ভাবে সেই কাজটি কত দিনে সম্পন্ন করিবে? এই অংকটি আমি কাব্যে রূপান্তরিত করেছি। আপনি কি শুনবেন?

অবশ্যই শুনব।

জালালুদ্দিন বিএ, বিটি গম্ভীর স্বরে আবৃত্তি করলেন :

করিম রহিম ছিল সহোদর ভাই
করিমের যে শক্তি রহিমের তা নাই।
করিম যে কর্ম মাত্র পনেরো দিনে করে
সেই কর্ম রহিম করে এক মাস ধরে।
এখন বালকগণ চিন্তা কর ধীরে,
দুই ভ্রাতা সেই কর্ম কত দিনে করে।

 

আমার মুখে কোন কথা জোগাল না। অবাক হয়ে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

ভাইসাব কেমন লাগল?

জ্বি ভাল।

অন্তর থেকেই বলছেন তো?

অন্তর থেকেই বলছি।

শুনে প্রীত হলাম। আরেকটা শুনুন চৌবাচ্চার অংক। আবৃত্তি করব?

জ্বি করুন।

চৌবাচ্চা ছিল এক প্রকাণ্ড বিশাল
দুই নলে পানি আসে সকাল, বিকাল।
এক নলে পূর্ণ হতে কুড়ি মিনিট লাগে
অন্য নলে পূর্ণ হয় না অর্ধঘণ্টার আগে।
চৌবাচ্চা পূর্ণের সময় করহ নির্ণন।
দুই নল খুলে দিলে লাগবে কতক্ষণ?

আমি নিজের বিস্ময় গোপন করে বললাম, এ জাতীয় কবিতা মোট কতগুলি লিখেছেন?

তিন হাজার ছয়শত এগারোটা লেখা হয়েছে। এইসব কবিতার আমি নাম দিয়েছি অংক শ্লোক। পরিকল্পনা আছে দশ হাজার পূর্ণ করে পুস্তকাকারে ছাড়ব।

আমি নিতান্ত আনাড়ির মত বললাম, এতে লাভ কি হবে।

তিনি বিরক্ত গলায় বললেন, লাভ কি হবে তাও ব্যাখ্যা করতে হবে? ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে অংক ভীতি প্রবল। কবিতায় সে অংকগুলি পড়লে ভীতি দূর হবে। তা ছাড়া মেধাবী ছাত্ররা অংকগুলি মুখস্ত করে ফেলতে পারবে। পারবে না?

হাঁ পারবে।

বাঁদরের শ্লোকটা শুনুন। তৈলাক্ত বাঁশ ও বাঁদরের শ্লোক। আমার গ্রন্থে শ্লোক নাম্বার দু’হাজার তিন :

একটি বাঁদর ছিল
দুষ্ট প্রকৃতির।
তৈলাক্ত বাঁশ দেখে
হয়ে গেল স্থির।
বাঁশ বেয়ে উপরে সে উঠিবার চায়,
পিচ্ছিলতার কারণে পড়ে পড়ে যায়।।
এক মিনিট বেচারা উঠে যতখানি
অর্ধপথ নেমে যায় পরাভব মানি
বংশ দণ্ড কুড়ি ফিট লম্বা যদি হয়
উপরে উঠিবার সময় করহ নির্ণয়।।

আবৃত্তি শেষ করে ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। শান্ত গলায় বললেন, উঠলাম। আপনাকে আর বিরক্ত করব না।

বসুন আরেকটু।

জ্বি না সময় অল্প কাজ প্রচুর। দোয়া করবেন যেন কাজটা শেষ করে যেতে পারি। বেশীদিন বাঁচব না। আপনি করিমের বন্ধু। তাকে আমার কথা বলবেন। বললেই সে চিনবে। স্নামালিকুম।

ভদ্রলোক আমাকে দ্বিতীয় কথা বলার সুযোগ না দিয়ে নৌকা থেকে নেমে গেলেন। নিজে ছোট্ট ডিঙ্গি নৌকার মত নৌকা নিয়ে এসেছিলেন। অন্ধকারে শুধুমাত্র নক্ষত্রের আলো সম্বল করে নৌকা ভাসিয়ে দিলেন।

আমার নৌকার মাঝি বলল, ইনার নাম পাগলা মাষ্টার। একলা একলা থাকে। রাইত দিন বিড় বিড় কইরা কি যেন বলে। আন্ধাইর রাইতে একলা একলা নাও নিয়া ঘুরে।

ছেলেপুলে নাই?

একটাই মেয়ে ছিল মইরা গেছে।

আমি লোকটির প্রতি এক ধরনের মমতা অনুভব করলাম। ভুল কাজে জীবন উৎসর্গ করে দেয়ার অনেক নজির আছে। ইনিও তেমন একজন। এদের মমতা দেখানো চলে এর বেশী কিছু না।

করিম এল তার পরদিন।

তাকে জালালুদ্দিন বি এ বিটির কথা জিজ্ঞেস করতেই বলল, তোর কাছে এসেছিলেন না-কি? তাঁকে কি ডাকা হত জানিস? মুসলমান যাদব। অংকের জাহাজ ছিলেন। যে কোন পাটি গণিতের অংক মুখে মুখে করতে পারতেন।

এখন পারেন না?

পারেন বোধ হয়। তবে মাথা খারাপ হয়ে গেছে। দিনরাত কবিতা টবিতা লেখেন-অংক শ্লোক। মেয়েটা মারা যাবার পর মাথাটা খারাপ হয়ে যায়। খুব আদরের মেয়েটি ছিল। নাইনে পড়তো। অংকে কাঁচা ছিল বলে বাবার কাছে খুব বকা খেত। মেয়েটা বাবাকে অসম্ভব ভয় করতো। মেয়েটা মরবার আগে বাবাকে বলল, এখন তোমাকে কেন জানি ভয় লাগছে না বাবা। আগে ভয় লাগতো। অংক ভয় লাগতো সেই সঙ্গে তোমাকেও লাগতো। এখন একটুও ভয় লাগছে না।

মেয়েটার মৃত্যু স্যারকে খুবই এফেক্ট করে। মাথায় একটা চিন্তা ঢুকে যায় কি করে ছাত্রদের অংক ভীতি দূর করা যায়। আস্তে আস্তে মাথাটাই খারাপ হয়ে যায়। ঢাকায় যাবার আগে তোকে একদিন নিয়ে যাব স্যারের কাছে।

গেলাম একদিন উনার সঙ্গে দেখা করতে। আমাকে চিন্তে পারলেন। সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মত কথাবর্তা বললেন। খুব আগ্রহ করে অংক শ্লোকের বিশাল খাতা এনে দেখালেন। গাঢ় স্বরে বললেন, গ্রন্থটির নাম রেখেছি–নুরুন নাহার। আমার কন্যার নামে নাম। বেচারীর বড় অংক ভীতি ছিল। গোপনে কাঁদতো। বইটা আরো পনেরো বছর আগে যদি লিখতে পারতাম ……. জালালুদ্দিন সাহেবের চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়তে লাগল। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলালেন। আমার দিকে তাকিয়ে নীচু গলায় বললেন, একটু দোয়া রাখবেন। কাজটা যেন শেষ করতে পারি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *