1 of 2

ওয়ার্ল্ড-কাপ, এবং…

ওয়ার্ল্ড-কাপ, এবং…

একটু আগেই বৃষ্টি হয়ে গেছে এক পশলা।

আজাদ পথের উপরে লোহার ফর্মাটি সামনে রেখে বসেছিল। মেঘাচ্ছন্ন আকাশের দিকে চাইল একবার। বিরক্ত হল খুবই। এই আবহাওয়াতে কে আর জুতো পালিশ করাবে?

সকাল থেকেই দিনটা খারাপ যাচ্ছে।

বিরজুর চায়ের দোকান অন্যান্য দিন, এমনকী কোনো তেওহারের সময়েও যেমন ভিড় হয়, সেই তুলনায় আজ অনেকই বেশি ভিড়। রিলায়েন্স কাপের একদিনের ক্রিকেট খেলা আজ থেকেই শুরু হল। ওয়ার্ল্ড-কাপ কথাটা শুনছে খুবই আজাদ। ঈদ অথবা দশেরার মতোই তেওহার লেগে গেছে পুরো মহল্লাতে।

বিরজুর দূরদৃষ্টিই আলাদা। ওর পাশেই যে বড়ো মিষ্টির দোকান, তার মালিক মহেশপ্রসাদের কাছ থেকে ধার নিয়ে একটি কালার টিভি কিনে ফেলেছে সে দিনকয় হল। এই ম্যাচ উপলক্ষ্যেই। বলেছে মহেশপ্রসাদকে যে, ফাইনাল খেলা কলকাতায় যেদিন হবে, নভেম্বরের আট তারিখে, সেই দিনই ওর ধার শুধে দেবে বিরজু।

ঔর সুদ? সুদকো ক্যা হোগা?

মহেশপ্রসাদ জিজ্ঞেস করেছিল, নিজে হাতে রসের কড়াইয়ে পান্তুয়া ছাড়তে ছাড়তে।

মহেশপ্রসাদ পাক্কা বানিয়া। তার বাপ বানিয়া ছিল। বানিয়া ছিল বাপেরও বাপ। সুদের সঙ্গে আসলকে কখনোই গুলিয়ে ফেলে না।

বিরজু হেসে উত্তর দিয়েছিল, কমিশন কাহেলা বাবু? কালার টিভি মে ওয়ার্ল্ড-কাপ কি খেলা যব সবেব দিখেগা তব হামারা দুকান সে কুলহারমে চায়ে ঔর পকৌড়াভি যেইসী বিকেগা, আপকি দুকানসে হকিসিমকি মিঠাইভি তো জরুরই বিকবে করে গা। ওহি তো সুদ আপকি রুপাইয়াকি! ক্যা? গলদ বোলিন ম্যায়?

মহেশপ্রসাদ হেসেছিল। চোখ মিচকে।

বলেছিল, বড়া হুঁশিয়ার হো গৈলরে উঁওড়াপুত্তান তু!

এই কথোপকথন বেশ কয়েকদিন আগে হয়েছিল। আজাদ তখন বিরজুর দোকানে বসে ভাঁড়ে চা আর কচুরি খাচ্ছিল বলেই কানে এসেছিল।

বিরজু মানুষটাকে ভালোই বলতে হবে। সরগুজা তেলের সঙ্গে মার্সিডিজ ট্রাকের পোড়া মবিল মিশিয়ে পাকৌড়া ভাজলেও গো-ব্রাহ্মণে ভক্তি আছে। দান-ধ্যানও করে। আজাদের কাছ থেকেও পয়সা নেয় না। তবে প্রতিদিনই বিরজুর নাগড়া জোড়াতে কালি দিয়ে বুরুশ মেরে এক্কেবারে চকমকিয়ে দিতে হয় তাকে। সকাল বিকেল দু ভাঁড় চায়ের বিনিময়ে। এই নিয়মই চলে আসছে গত পাঁচ বছর। যখন থেকে এই মহল্লার পথে রুজির জন্যে এসে বসতে শুরু করেছে আজাদ, সেই দিন থেকেই।

আজকের অবস্থাটা সত্যিই খারাপ। বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপের সৃষ্টি হওয়ায় সকাল থেকেই শাঁওন ভাঁদোর মতো বৃষ্টি হচ্ছে। বিহারের রাজধানী পাটনার এই শহরতলির মহল্লাতে অবশ্য আজ ছুটিরই আবহাওয়া। সেমিফাইনাল হবে নাকি লাহোর আর বোম্বাইতে। ফাইনাল কলকাতাতে। পাটনাতে কোনো খেলাই না হলে কি হয়, হাল-চাল, ফালানা-ঢামকানা দেখে মনে হচ্ছে যেন সব খেলা এইখানেই হচ্ছে। অফিস-কাছারিতে কেউই আজ যায়নি বিশেষ। নেহাত রোজই ঘুষঘাষ পাওয়ার সম্ভাবনা যেসব চাকরিতে আছে, সে বাবুরা আর যাদের মালিক খুবই কড়া, তারাই। বাধ্য হয়ে কাজে গেছে। নইলে সকলেই টিভি দেখতে ব্যস্ত, নয়তো রেডিয়োয় রিলে শুনতে। মর্দ আওরৎ সবাই সামিল।

গেন্দ, বারি এইসব কথাগুলো মুহুর্মুহু ভেসে আসছে বিরজুর দোকান থেকে, আর তুমুল হট্টগোল।

কী খেলা, কে জানে! আজাদ কখনও দেখেনি। তার বাবাকেও খেলতে বা দেখতে দেখেনি।

বিরজুর মুল্লুক বিহারের মধুবনী জেলাতে। বন্যাতে এবারে বড়োই ক্ষতি হয়ে গেছে ওদের। তবে ওদের মানে, বিরজুর এজমালি বাড়ির। ক্ষেতি-জমিন কাঁড়া-ভইষও আছে কিছু। গেছে, গেছে। বিরজুর তাতে কোনোই ক্ষতি-বৃদ্ধি নেই। পাছে রিস্তেদাররা আচমকা এসে পড়ে তার ঘাড়ে চড়াও হয়, সেই ভয়েই ও আগে থাকতেই দু-শোটি টাকা টি এম ও করে দিয়েছে।

বিরজু জানে যে, লোভ বড়োই বাজে জিনিস। আর মানুষের চোখই লোভকে বাড়িয়ে দেয়। ওর বাড়িতে ভাই-ভাতিজারা এসে পড়লে, ওর ঠাট-বাট দেখে ঈর্ষায় তাদের বুক জ্বলে যাবে। মনে করতে থাকবে, এই সবও বুঝি এজমালিই। তাই বন্যাকে ও গড়িয়ে আসতে দেয়নি এখানে। কোনোক্রমেই। নিজের মুলকেই আটকে দিয়েছে মনিঅর্ডারের বাঁধ বেঁধে। সীয়ারাম! সীয়ারাম।

আর-রে। আরে। ক্যা কর রহা হ্যায় তু বেয়াকফু! ছোড় ছোড়। ছোড় না শালে! মারে গা এক লাখ গাঁড়পর। হামসে তোরা লালচ না মিটব।

বলেই, পাঁড়েজি সত্যি সত্যিই মেরে দিলেন এক লাথ, কাঁচা পথের ওপরের কাদাতে প্রায় উঁবু হয়ে বসে পাঁড়েজির দু-পায়ের জুতো চেপে-ধরা আজাদের বুকে।

বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছিল টিপ টিপ করে। সাইকেল-রিকশা থেকে নেমে বিরজুর দোকানের দিকে পা বাড়াতে-না-বাড়াতেই পায়ের ওপর এমন আচমকা হামলাতে উনি প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে গেছিলেন। তা ছাড়া আজ ওয়ার্ল্ড-কাপ-এর খেলার কারণেই বিশেষ ব্যস্ত এবং উত্তেজিতও থাকায় বিরক্তি বেড়ে ছিল আরও। এই সব ইতরজনেরা এসবের কী বোঝে!

ভাবছিলেন পাঁড়েজি।

তবে পাঁড়েজির বাপ-ঠাকুর্দাও জন্মে যে ক্রিকেটের ব্যাট-বলে কখনো হাত দিয়েছেন এমনও নয়। তবে ব্রাহ্মণ্যর অবিংসবাদী অধিকারেরই মতো পয়সাওয়ালা মানুষদেরও তাবৎ ব্যাপারেই। অবিংসবাদী অধিকার। ওঁরা যা বোঝেন, বা ওঁদের জ্ঞানের যা পরিধি, তা কি আজাদদের মতো ছোটোলোকদের কোনোদিনও কল্পনার মধ্যে আসবে? আর রোজই ওই শালা চামার এমন করবে। কথা নেই, বার্তা নেই, খপাখপ পা জড়িয়ে ধরবে জুতো পালিশ করার জন্যে। ভিখিরির মতো বলবে, আজ পঁচাশ নয়া ভি নেই কামায়া হুজৌর সুবেবসে। আইয়ে। দিজিয়ে। আপকি জুতি চকমকা দেতা।

খেটে খাওয়ার ইচ্ছে তো নেই। তাই ভিক্ষে চাইবে।

প্রতিদিন ওই অত্যাচার আর সহ্য হয় না। এ আর ভিক্ষে ছাড়া কী?

লাথি খেয়ে, আজাদ মুখ-বিকৃত করে কাদাভরা পথে পড়ে যাওয়াতে, বিরজুর দোকানের কয়েকজন নতুন খরিদ্দার বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন মুহূর্তের জন্যে।

পরক্ষণেই অন্যদের এবং বিশেষ করে পাঁড়েজি, বিরজু এবং আজাদেরও নিজের ব্যবহারে তাঁরা। বুঝতে পেরে গেলেন যে তাঁরা যেমন পাকৌড়া দিয়ে চা খাওয়াটা স্বাভাবিক ব্যাপার বলে জানেন, আজাদও তেমন লাথি খাওয়াটাকেও স্বাভাবিক ব্যাপার বলেই মেনে নিয়েছে। যে বিনা প্রতিবাদে সুখাদ্যর মধ্যে গণ্য করে লাথি খেয়ে হজম করছে দু-বেলা, তার জন্যে রেসপেকটেবল ভদ্রলোকেরাই বা কেন নিজেদের খামোখা ঝামেলাতে ফাঁসাতে যাবেন?

ছেঁড়া পায়জামা আর তালি-মারা নীল-রং হাফসার্টটা কাদায় আর জলে মাখামাখি হয়ে গেছিল।

ওই অবস্থাতেই হাসতে হাসতে উঠেদাঁড়িয়ে আজাদ হাতজোড় করে পাঁড়েজিকে বলল, হুজৌর মালিক। মাঈ-বাপ। বাড়িতে আমার অসুখ। কাল রাত থেকেই পেটে কিছু পড়েনি। প্রায় বেঁহুশে দেখে এসেছি তাকে।

পাঁড়েজি ধমকে বললেন, চিল্লা মত।

তারপর দোকানের অন্য সমঝদারদের দিকে চেয়ে হাসি হাসি মুখে বললেন, ফালতু আদমী হ্যায়। ইন্ডিয়া ব্যাটিং কর রহা হ্যায়, ঔর ঈ শালে ফজলু বাঁতে কর রহা। ভাগ হিয়াসে। নেহিতো মারেগা ঔর এক লাথ।

এমন সময় একটি ঝকঝকে কালো কন্টেসা গাড়ি এসে দাঁড়াল। গাড়ি থেকে বাবু রামখিলাওন, আচকান পায়াজামা পরে নামলেন। ওপরে খদ্দরের দুধ-সাদা জওহরকোট। দু-টি পাতেই পাঁচটি করে দশটি আংটি। গাড়ি থেকেই তাঁর একটি পা বেরোতেই, আর যায় কোথায়? আজাদ সঙ্গে সঙ্গে সেই পায়ের ওপর বডি-থ্রো করে দিল।

করুণ স্বরে বলল, মালিক। হুজোর। মাঈ-বাপ।

রামখেলাওনবাবুও আজাদের সুগোল কিন্তু নির্বুদ্ধি মাথায় কাবলির মৃদু ঠোক্কর ঠুকলেন একটা।

প্রচণ্ড চটে গিয়ে বললেন, কমবক্ত কাঁহাকা! জলদিমে হ্যায়, ঔর তু মেরি জুতি বরবাদ কর দেলি। ক্যা তু?

জুতি।

জুতি। হাঃ। দামি পোশাক পরা, দামি গাড়ি থেকে নামা বাবুরামখেলাওন এম এল এ-র হুঁড়িতে আর ডাবল-চিন-এ হাসি ঢেউ তুলল। মুখটা খুবই নিষ্ঠুর দেখাতে লাগল। খুনি-খুনি।

হেঁকে বললেন, জুতিহি তো দেলি তোরা। ঔর ক্যা?

বলেই, কথাটা যাঁরা শুনলেন, তাঁদের মনোরঞ্জনে সফল হলেন কিনা দেখে নিয়ে, গাড়িতে এক পা আর জমিতে এক পা রেখে গলা তুলে মহেশপ্রসাদকে বললেন, আররে মহেশ! ঘরমে কাল বিশ কে জি লাড়ু ভেজ দেনা। সুবেব দশ বাজনেকি পহিলেই। ঘিউমে গড়বর-সরবর নেহি কর না, সমঝা?

মহেশপ্রসাদ দোকান ছেড়ে পথের মধ্যে এসে বৃষ্টির মধ্যেই হাতজোড় করে রামভক্ত হনুমানের মতো করে দাঁড়াল। ওর বড়ো বড়ো কালো কালো কানদুটোর গহুর থেকে বেরিয়ে থাকা চুলগুলোকে পেছন থেকে আরশুলার শুড়ের মতো দেখাচ্ছিল।

মহেশপ্রসাদজি হাত জোড় করেই বত্রিশপাটি দাঁত বের করে বললেন, হুজৌর মাঈ-বাপ। হামসে অ্যায়সা বেইমানি কভভি না হোনা হুজৌর। আপনি অর্ডারকি বারেমে বিলকূল বে-ফিকুর রহিয়েগা।

অন্যর লাড়ু যে ভেজাল ঘিতেই বানাক তার নিজের লাড়ু যে খাঁটি ঘিয়েতেই ভাজা হবে, সে সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে বাবুরামখিলাওন এম এল এ খুশি হলেন।

লোকগুলো ভারি ভালো। ওঁকে বেশ মান্যিগন্যি করে। ঘিয়ে একটু ভেজাল না দিলে ওঁর মতো বহুজনকে বিনি-পয়সার সাপ্লাই অথবা নির্বাচনের আগে চাঁদা দেবেই বা কোত্থেকে। লেনদেন এর ওপরেই তো দাঁড়িয়ে আছে রাজনীতি। এই দেশ। বোঝেন সব। উনি খুবই কনসিডারেট।

কনটেসা চলে গেল বাবু রামখিলাওন এম লে এ-কে নিয়ে। মহেশপ্রসাদ নিজের দোকানের মধ্যে গিয়ে ঢুকল। আর সঙ্গে সঙ্গে বিরজুর দোকানের ভেতর থেকে প্রচণ্ড সোরগাল ভেসে এল।

অতলোকের চিৎকারের মানে বোঝা গেল না। অন্তত আজাদ বুঝতে পারল না। কিন্তু শুনল যে, দোকান থেকে নেমে আসা বিড়ির দোকানি গণেশরাম, লুঙ্গির দোকানি গিয়াসুদ্দিনকে বলল, থার্ড ক্লাস। ইক রান। সিফ ইক রানকি লিয়ে খো দিয়া উইকেট। সাচমুচ থার্ড ক্লাস।

পুরো মহল্লার সমস্ত মানুষই উত্তেজিত। কিন্তু মুহ্যমান। দলের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে। যেন কিরিকেট নামক খেলার ওপরে অথরিটি এই মহল্লার প্রত্যেকটি মানুষই!

এই কোলাহল, আক্ষেপ উত্তেজনার মধ্যে আজাদই একেবারেই একা দাঁড়িয়ে ছিল পথের মধ্যে। অন্যদের উত্তেজনা দেখে সেও উঠে দাঁড়িয়েছিল। দুটি হাত বুকের কাছে জড়ো করে, নিরুত্তাপ, শান্ত, স্নিগ্ধ আজাদ একাগ্রমনে চলমান মানুষদের মিছিলে তার সম্ভাব্য খদ্দেরের জুতো-পরা পা। খুঁজে যাচ্ছিল। জুতো চাই-ই আজ। জুতো, জুতোই তার জীবন।

তার ভালো-মন্দর বিধায়ক।

কে যেন বলে গেল, পাশ দিয়ে যেতে যেতে, ঝুট্টোই পরিসান হচ্ছিস আজাদ আজ ওয়ার্ল্ড-কাপের খেলা নিয়েই সকলে ব্যস্ত। সকলেই দৌড়ে যাচ্ছে, দেখছিস না। কারো থামবার উপায় নেই। আর নাই যদি থামে কেউ, তাহলে পা বাড়িয়ে দিয়ে কে তাকে ধন্য করবে? দাঁড়িয়ে পড়ে, আয়েস। করে জুতো পালিশ করানোর তোক দেশে আর নেই। সমস্ত দেশই এখন দৌড়োচ্ছ। অগ্রগতি মানেই দৌড়, যান্ত্রিকতা, অবসরের অভাব, টাকা, আরও টাকার জন্যে শরীর মনের অক্লান্ত সাধনা।

কে বলে গেল?

লোকটাকে চেনার আগেই লোকটার ছাতা-ঢাকা শরীরটা গলির মোড়ে পৌঁছে গেল।

মোড়ের নিসার হোটেল থেকে দারুণ বিরিয়ানি আর চাঁবের গন্ধ ভেসে আসছিল বৃষ্টি-ভেজা হাওয়াতে। ফিরনির গন্ধ ওড়ে না। থিতু হয়ে বসে থাকে বর্ষার দিনের প্যারাপেটের বেড়ালের মতো।

আঃ। উমদা।

ভাগ্যিস গন্ধ নিতেও পয়সা লাগে না!

কিছুক্ষণ পরই সন্ধ্যে হয়ে যাবে। খেলার আলোচনা করতে করতেই অনেকেই গিয়ে ঢুকছে নিসার হোটেলে। গলির ভেতরে, বিরজুর দোকানের উলটোদিকেই ম্যায়কাদা শরাবখানা।

অসময়ের বৃষ্টিতে গা সিরসির করছে। খেলা আজাদের বোধ হয় শেষ হল একটু আগে। সন্ধ্যে প্রায় হয়ে এল। বৃষ্টির দিন। অনেকই লোক গা গরম করতে ম্যায়কাদাতে ঢুকছে। কিছু লোক আছে রোজকার খদ্দের। আজ নতুনও আছে বেশ কিছু। অন্ধকার গাঢ় হতে-না-হতেই কিছু রান্ডি এসে জমেছে। চুমকি-বসানো শাড়ি বা ঘাগড়া পরে সস্তা তীব্রগন্ধী ইত্বর মেখে চুলবুল করে ঘুরে বেড়াতে শুরু করেছে।

পুলিশ কিছু বলে না ওদের। কাউকেই কিছু বলে না। মিলে-জুলে আছে পুলিশ সকলের সঙ্গেই। এ দেশ শান্তির দেশ। এত শান্তি খুব কম দেশেই আছে।

পুলিশের লোক কখনো ভুল করে এদিকে এলে তাদেরও জুতো বিনি-পয়সাতেই পালিশ করে দিতে হয় আজাদের। তাও শান্তিরই জন্যে।

দিন শেষ হয়ে রাত নেমে এলে বিরজু বা মহেশপ্রসাদের দোকানে আর তেমন ভিড় থাকে না। এই পুরো মহল্লাটাই, রাত নামলে চলে যায় অন্যদের দেখলে। মহল্লার চেহারাই পালটে যায়। তখন। আজাদও, কিছু কামাই হলে, সন্ধ্যের আগে আগেই বস্তিতে ফিরে যায়। কোনোদিন। রাতের পরও থাকে। তবে আটটার বেশি কখনোই থাকে না। মাঝে মাঝে ভাবে, প্রত্যেকদিনই সারাটা দিন খেয়ে ঘুমিয়ে তারপর এই মহল্লাতে সন্ধ্যের পরেই বরং এসে বসবে এবার থেকে। রাতের চিড়িয়া বনে যাবে। গভীর রাত্তির অবধি থাকলে বোধ হয় কামাই বেশিই হত। কিন্তু বুড়ি আম্মার কথা ভেবেই তা পারে না। মাকে ফেলতে পারে না। আম্মা যতদিন আছে আজাদের জীবন বাঁধা মায়েরই সঙ্গে।

ওয়ার্ল্ড-কাপ ব্যাপারটা যে ঠিক কী, তা জানে না আজাদ কিন্তু প্রত্যেক মানুষকেই এ নিয়ে এমন মাতামাতি করতে দেখে ওর মনে হচ্ছে, এত বড়ো সমস্যা, মানে ইন্ডিয়া জিতবে কী জিতবে না, অথবা পাকিস্তান (পাকিস্তানের সাপোর্টারও কম নেই ওই মহল্লাতে) এই প্রশ্নের চেয়ে বেশি জরুরি এবং বেশি দরকারি প্রশ্ন এই মুহূর্তে আর কিছুই নেই বোধহয় এই দুই দেশেই। ভারতে অথবা পাকিস্তানেও। আজাদ এ বিষয়ে কিছুমাত্র না জানলেও, ওর কোনো সন্দেহ নেই যে, খাওয়া-পরা শিক্ষা-চিকিৎসা সব সমস্যার চেয়েও এই ওয়ার্ল্ড-কাপ-এর সমস্যাটা অনেকই বড়ো এবং জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছে সমস্ত দেশের কাছে।

ওর নিজের জ্ঞানের স্বল্পতা সম্বন্ধে সচেতন বলেই, ওর মনে খুব দুঃখ হয়। পেটে তার মতো খিদে আর সারাদিনে তিন-জোড়া জুতো পালিশ করার অসফল স্বপ্ন নিয়ে যারা বেঁচে থাকে, তাদের সংখ্যা বোধ হয় এই দুই দেশেই অত্যন্ত নগণ্য। এই দুই দেশেই শহরই সব। শহরবাসীদের সুখ-দুঃখ সাধ-আহ্লাদই সবচেয়ে বেশি জরুরি। গ্রামে-গঞ্জে, বনে-বাদাড়ে যেসব মানুষ বাস করে, তারা সব মনুষ্যেতর জীব। একথাও ঠিক যে, আজাদদের মতো মুষ্টিমেয় কয়েকজন ছাড়া শহরের সকলেই বেশ বড়োলোক হয়ে গেছে।

যে টিভিটাকিনল বিরজু তা অবশ্য রঙিন। কত দাম, তা কে জানে! কিন্তু সাদা-কালো টিভি-তো প্রায় সকলেই কিনেছে। শহরের সাধারণ মানুষদের কাছেও আজকাল দু-চার হাজার টাকা। কোনো টাকাই নয়। অথচ আজাদের কাছে সে টাকা স্বপ্নেরই মতো। তাই, ভুখা, চিন্তিত, ছেঁড়া জামা-পরা, দিন-আনা দিন-খাওয়ার চিন্তায় ক্লিষ্ট আজাদকে বোধহয় এই ওয়ার্ল্ড-কাপ নিয়ে। মেতে-ওঠা মহল্লাতে, এই দেশে একেবারেই মানায় না, মানাচ্ছে না। ভাবছিল আজাদ।

মনে মনে এই ওলা-কাপ-এর ওপরে রীতিমতো বিরক্তিও হয়ে উঠেছে সে। এর জন্যেই তার রোজগার হয়নি একটি নয়াও আজ সকাল থেকে।

রান্ডিদের মধ্যে একটি মেয়ে আছে যে অতি-সাধারণ দেখতে। রোগা, পাণ্ডুর-মুখের। ওর মুখের অসহায়তাই ওর সবচেয়ে বড়ো প্রসাধন। বয়স কত হবে কে জানে! রান্ডিদের কোনো বিশেষ। বয়স থাকে না। যে গ্রাহক যেমন বয়সি মনে করে নিতে চায়, তারা তাদের ঠিক তেমনই বয়সিই দেখায়। তারা বহুরূপী। বহুমনা।

রোজই মেয়েটিকে দেখছে আজাদ গত পাঁচ বছর হল। নামও জানে। ওর নাম ফানুস। ফানুসও চেনে আজাদকে।

ওদের দুজনের নিরুপায়তার কারণেই এক আশ্চর্য বাক্যহীন সখ্য জন্মে গেছে দু-জনের মধ্যে। চোখে চোখে কথা হয়। মুখে কখনোই হয়নি। অসহায়তা একজন মানুষকে অন্যের খুবই কাছে। আনে চকিতেই। সহানুভূতিতে, দরদে দু-জনে মাখামাখি হয়ে যায় চোখের সুর্মার মতো। তেমনই দু-জন অসহায় মানুষের মধ্যে চকিতে বৈরিতাও জন্মায়, পিতৃমাতৃপরিচয়হীন যুযুধান পথের কুকুরেরই মতো। একখানি আধ-পোড়া হাতরুটি বা একটি টাকার জন্যে একে অন্যকে দুবার না ভেবে তারা খুনও করে দিতে পারে। দারিদ্রর গর্ভে যে ভালো ও মন্দ কত কীই থাকে, তা সমুদ্রেরও বোধ হয় অজানা।

ম্যায়কাদা শরাবখানাটি একতলাতে। তার ওপরে আরও দু-টি তলা আছে। লোহালক্কড়ের এক বড়ো ব্যবসাদারই মালিক এই হোটেলটির। এম এল এ বাবু রামখেলানের শালা হচ্ছে সেই ব্যবসাদার। নিসার হোটেলও তাঁরই। এখন থেকে বসেই অ্যামপ্লিফায়ার লাগানো ছোটো মসজিদের মগরীব এর নমাজ শেষ হবার পরই ম্যায়কাদার উপরের দুটি তলার ছোটো ছোটো কুঠুরিতে লাল নীল মৃদু আলো জ্বলে ওঠে। কোনো ঘরে লাল। কোনো ঘরে নীল। যে রঙে, যে। রান্ডিকে নগ্নাবস্থায় বেশি সুন্দর দেখায় সেই রঙের আলো জ্বলে ঘরে। একটি পাহাড়ি মেয়ে আছে যে, পাহাড়িদের মতো দেখতে নয় আদৌ। কোনো পাহাড়ি নারী-পাখিরই মতো তার মা কোনোদিন উড়ে এসেছিল সমতলের কোনো পুরুষ-পাখির সঙ্গে। ডানা সাপটে সেই পুরুষ পাখি উড়ে গেছেনারীর নরম পালকের উষ্ণতার ওম-এ নিজেকে উষ্ণ করে নিয়ে। এই মেয়েটি তার স্মারক। অসম্ভব ফর্সা বলে ও ওর ঘরে হলুদ রঙা বাল্ব জ্বালে। হলুদ বিজলি আলোতে চাঁপাফুলের মতো পাখির ছানাকে দেখতে কেমন দেখায় কে জানে! ভাবে আজাদ।

কত কিছুই তো দেখার ছিল এই জীবনে! তাজমহল, বুলান্দ দরওয়াজা, ফতেহপুর সিক্রি, কত অসংখ্য পিরের দরগা, দিল্লি আর ভোপালের মসজিদ, কাশ্মীর। তাই লাল-নীল-হলুদ রাত-পাখির ছানা, লাল-নীল হলুদ কম-পাওয়ারের বিজলি আলোতে দেখা হয়নি বলে বিশেষ কোনো আক্ষেপও নেই ওর। দেখা হবেও না কোনোদিন। ওর ভুখা পেট আর ভুখা চোখের সামনে দিয়ে রোজ রাতের প্রথম প্রহরে পিয়া-হুয়া কাঁচা-টাকার মোচ্ছব-ওড়ানো রংবাজেরা পীকে ঝুমকে সুন্দরী রান্ডিদের হাত জড়িয়ে ধরে উপরে উঠে যায় কোনো স্বপ্নের দেশে, আসমানে। পথের ধুলো কাদায় কঠিন বাস্তবের জমিনে লুটিয়ে পড়ে থাকে শুধু আজাদ। জুতো খোঁজে। পরের পায়ের জুতো।

মহল্লায় নামি গুন্ডা মকবুলকে পুষেছে ম্যায়কাদার মালিক। সন্ধ্যে হলেই সে লুঙ্গির উপরে বেল্ট এর সঙ্গে লাগানো বিরাট নগরের বর্ডার থেকে আনা চাইনিজ প্তিলটি খুঁজে তার উপরে লাল ঝলমলে সিল্কের কুর্তা চড়িয়ে ম্যায়কাদার দোতলার সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে থাকে।

একদিন মকবুলকে জিজ্ঞেস করেছিল আজাদ, কারা আসে পাখির ছানা নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে?

মকবুল হেসে বলেছিল, প্রিয়ার কাছে অপমানিত বা বিবির হাতে নিগৃহীত কোনো পুরুষ অথবা যে চশমা আনতে ভুলে গেছে বা যার চশমা হারিয়ে গেছে অথবা কখনোই হয়নি, তেমন সব পুরুষেরা। কাকে যে কখন আসতে হয়, তা কে বলতে পারে! সব পুরুষের মধ্যেই অনেকগুলো। পুরুষ বাস করে যে! এই হুরী-পরিরা তাদের ছেনালি আর ভাও দিয়ে কাকে কখন ভুলিয়ে নিয়ে যাবে যে, তা কে জানে।

তারপরে বলেছিল, পুরুষমানুষের মতো অসহায় প্রাণী তো খুদাহ আর বানাননি। পুরুষ যখন বে হোঁস, বে-শরম, বেপাত্তা হয়ে ম্যায়কাদা থেকে টলতে টলতে বেরোয় তখন এইহুঁশিয়ার মেয়েদের কেউ তার হাত জড়িয়ে ধরে তাকে মিথ্যে বেহেস্ত-এর দিকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। ক্ষণিকের বেহেস্ত।

বেহেস্ত বোধ হয় আসলে ক্ষণিকেরই হয়।

দোজখ-এ পড়ে-থাকা, নরকের কীট, আজাদই শুধু নিষ্ঠুর মানুষদের জুতোপরা পায়ের উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে। বেশরম, বে-হুদা।

উপরের ঘরগুলোতে কী হয় তাও জিগগেস করেছিল আজাদ মকবুলকে একদিন। যখন এই মহল্লায় প্রথম এসেছিল।

মকবুল হেসে বলেছিল, ফকিং।

ফানুসও যে অজানা অচেনা মানুষদের সঙ্গে ওই লাল নীল মৃদু আলো জ্বলা ঘরে ফকিং করে, এ কথা বিশ্বাস হয় না আজাদের।

আজ ফানুস হাসল আজাদকে দেখে। এমনকী, কথাও বলল।

বলল, কেমন আছ? এই অসময়ের দুর্যোগ! বুরি-হালত।

আজাদ বিড়বিড় করে বলল, খউব খারাপ। বাড়িতে আম্মার বুখার।

কী হয়েছে?

ফানুস শুধোলো।

খিদে-জ্বর।

আজাদ বলল।

ফানুস বলল, আমারও সব সময়ই জ্বর হয়। হিঃ হিঃ। কাম-জ্বর।

এসো তোমার চটিটা একটু পালিশ করে দি। পয়সা লাগবে না। তোমাকে দিয়ে বউনি করে নসিব যদি ফেরে।

হিঃ হিঃ। তুমি বউনি করো জুতো ঘষে আর আমি বউনি করি…! হিঃ হিঃ।

লজ্জিত হল, অবিবাহিত, সুকুমার আজাদ নির্লজ্জা নারীর কথা শুনে।

আজাদের চরিত্রে অধিকাংশ সাধারণ ভারতীয়দেরই মতো বিশেষ খারাপ কোনো দোষ নেই। ওই একটিমাত্র দোষ। খিদে। যে দোষের বাড়া দোষ নেই দুনিয়াতে।

ততক্ষণে আজাদ ফানুসের পাটি সযতনে তুলে নিয়েছে লোহার তে-ফর্মার উপরে। নিজের দু-পা দিয়ে সেই ত্রিভঙ্গকে জড়িয়ে ধরেছে কোনো নারীর অদেখা জঘনেরই মতো। জোরে। তারপর পালিশ করেছে সযতনে। ডান পা হয়ে গেলে, বাঁ-পায়ের চটি।

নিজের চটির দিকে চেয়ে আবারও হেসেছে ফানুস। হিঃ হিঃ।

বলেছে, জীবনে প্রথম। আমার সব কিছু নিয়েই টানাটানি করে পুরুষমানুষেরা কিন্তু পা ধরে টানাটানি তুমিই প্রথম করলে। অজীব আদমী যা হোক।

বলেই বলল, তোমাকে তো দেখছি বহুদিনই। মানুষটা তুমি বড়ো ভালো। ভালো মানেই অবশ্য বোকা। তাই তো না খেয়ে থাক।

আজাদ চুপ করে রইল। ওর মনের মধ্যে দুশ্চিন্তার পাহাড় জমেছে। কী যে করবে। বাড়িতে না ফিরলেই নয়। অথচ।

কেড়ে খাওনা কেন?

হঠাৎই বলল ফানুস।

কাড়তে জানি না যে।

তবে, জাহান্নামে যাও।

তারপরই বলল, চা খাবে।

নাঃ।

খালি পেটে চা খেতে ইচ্ছে করে না। অনেক সময়ে খিদে মারার জন্যে খায় বটে কিন্তু আজ বাড়ি থেকে বেরিয়েইছিল আগ্রাসী খিদে নিয়ে। এ খিদে চায়ে চাপা পড়বে না।

আজ গাহক পেলে তোমাকে পাঁচ রূপাইয়া দেব। চটি পালিশ করে দিলে আমার তুমি!

আজাদ জবাব দিল না কথার। টাকা বলে কথা। হাতে না পাবার আগে মেহেরবানি জানাবার দরকার কী?

ম্যায়কাদার বাইরের ঘড়িঘরে মস্ত বড়ো ঘড়ি আছে একটা। সাতটা বাজল ঢংঢঙিয়ে। পথময় কাদা-জল। কারো জুতো বা চটিই শুকনো নেই। ক্ষুধার্ত চোখে চারদিকে জুতো খুঁজতে লাগল আজাদ আবারও হন্যে হয়ে। পরের জুতো বুকে নিয়েই তো বেঁচে থাকা। তাও দিনের শেষে, দু টি রুটি-ডাল-এর সংস্থান হবে কি হবে না তারও ঠিক নেই।

ফানুস বলল, এশিয়াড, ভারতোৎসব, ওয়ার্ল্ড-কাপ, আরও কত কিছুর জন্যে যেখানে সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে হেলাফেলায় সেই দেশেও যে কাজ করতে চায়, যার শরীর সুস্থ, সেও না খেয়ে থাকে।

আজাদ জবাব দিল না কথার। পুরোটা বুঝলও না। ও ভাবছিল, দেহপসারিনী নারীরা বন্দরের মতো। কত দেশের কত জাহাজ আর নৌকো এসে লাগে তাদের ঘাটে। কত খবর, কত রকম। মানুষ। মস্ত বড়ো হয় তাদের জানার জগৎ।

ফানুস ওর পাশে দাঁড়িয়েছিল। ওর গায়ে আতরের গন্ধ বৃষ্টিভেজা হাওয়ায় ভেসে আজাদের নাকে আসছিল। অন্য এক ধরনের খিদের আভাস জাগছিল ওর ক্ষুধার্ত শরীরে। এ খিদের অন্য নাম আছে। পেটের খিদে যাদের মিটেছে, তাদেরই শুধু এই খিদেতে অধিকার।

ফানুস হঠাৎই এগিয়ে গেল। চাপা গলায় বলল, তুমি থেকো। আসছি আমি। আমি আসব।

আজাদ মুখ তুলে দেখল, লম্বা চওড়া একজন দশাসই মানুষকে ম্যায়কাদার গেটে দেখেই এগিয়ে গেল ফানুস। সঙ্গে সঙ্গে আবারও বৃষ্টি এল জোর। আজাদ গুড়ি-সুড়ি মেরে গিয়ে বসল মোতাহারের দোকানের ছাতার নীচে, মাথা বাঁচিয়ে।

অনেক বছর হয়ে গেছে মানুষের মুখে তাকাতেই ভুলে গেছে আজাদ। শুধুই জুতো দেখে।

জুতোর শুকতলার গন্ধ ওর নাকে আমার বানানো হাতে সেঁকা-রুটির গন্ধেরই মতো মিষ্টি লাগে। জুতোই ওর রুটি।

দেখতে দেখতে আটটা বাজল। ফানুস সেই লোকটির সঙ্গে ম্যায়কাদা থেকে বেরিয়ে পাশের সিঁড়ি বেয়ে দোতলাতে উঠে গেল। অপ্রকৃতিস্থর মতো হাসছিল ফানুস। শরাব পিয়েছে নিশ্চয়ই।

আজাদকে ফানুস থাকতে বলে গেছে যদি সত্যি পাঁচ টাকা দেয়? দেবে কি না কে জানে। রান্ডির কথার দাম কী? যখন সাধুসন্তদের কথারই দাম নেই কোনো।

আরও আধঘন্টা দেখে জিনিসপত্র গোছগাছ করতে লাগল আজাদ।

ফকিং করতে কতক্ষণ সময় যে লাগে বা লাগতে পারে, তাও জানে না ও। লোহার ফর্মা, বুরুশ, ক্রিমের শিশি আর কালিগুলো সব মোতাহারের দোকানের নীচে যে গর্তমতো আছে, তারই এক কোণে রেখে পাল্লা বন্ধ করে দিল। অন্য জিনিসপত্রও আছে। ভাড়া নেয় না মোতাহার আজাদের কাছ থেকে। মাঝে মাঝে জুতো পালিশ করে দেয় ওরও। মোতাহার ওই গর্তরই এক পাশে নিজেও শোয় রাতে।

আজাদ দেখল, ফানুস নামছে ওপর থেকে। শাবি ফানুসকে গোলাপি চুমকি-বসানো শাড়িতে সত্যি ফানুসেরই মতো দেখাচ্ছে। যেন উড়ে যাবে এখুনি আসমানে। আজাদ আর তার নাগাল পাবে না কোনোদিনও।

ফানুস তুড়ি দিয়ে ডাকল আজাদকে।

বলল, ইয়া আল্লা! ই ক্যা রে! ছুছুন্দরকি শরপর, চামেলিকা তেল! রে আজাদ। বাত ক্যা বে? লাজোয়াব।

ঈশ্বরের মতো নিষ্পাপ আজাদ বলল পাঁচগো রূপাইয়া দেগি, বোলিনথী।

লাও! দেগি যব বোলিন তব রূপাইয়া কওসি বাড় বাত রে বুড়বক! লে লে সবহি লেলে। লে খলখল দে খলখল।

আজাদ শেষ শব্দ দুটির মানে না বুঝতে পেরে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল মোতাহারের দিকে।

মোতাহার শাদিশুদা আদমি। চার বাচ্চার বাপ। সে অনেকই জানেশোনে।

তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে, ফানুস-এর কাছে যাবে বলে রাস্তা পেরুবার জন্যে আজাদ রাস্তায় এসে দাঁড়াল আর ঠিক সেই সময়ই নিসার হোটেলের কাঠ কয়লা নিয়ে আসা একটা ট্রাক পথরোধ করে থেমে গেল। হঠাৎ ব্রেক কষাতে পথ থেকে জল ছিটকে গেল আজাদের পায়জামা আর শার্ট-এ।

ট্রাকটা সরে যেতেই বৃষ্টি ভেজা হাওয়াতে আবারও বিরিয়ানির উমদা গন্ধ ভেসে এল নাকে আঃ। কেউ যদি খাওয়াত কখনো। কতদিন খায় না। নাক ভরে নিশ্বাস নিল আজাদ।

ভাবল, ভাগ্যিস বে-ওয়ারিশ গন্ধ কিনতে এখনও পয়সা লাগে না!

পথ পেরোতেই দেখল যে ফানুস একটি সাইকেল-রিকশা দাঁড় করিয়েছে। ওকে দেখেই ওর হাতে কুড়িটা টাকা দিয়ে বলল, যাও। যাও। নিসার থেকে বিরিয়ানি আর বড়া কাবাব নিয়ে এসো কুড়ি টাকার। তাড়াতাড়ি আসবে।

আজাদের জিভে জল এসে গেল। খুদাহর কী দোয়া! বেহেস্ত এর এই হুরী আজ ওয়ার্ল্ড-কাপ এর রাতে সারাদিনের কষ্ট আর গ্লানিকে যেন মুছিয়ে দিল।

আমি এগিয়ে গিয়ে রিকশাতে অপেক্ষা করছি মোড়ের মাথায়। এখানে দেখতে পেলে কেউ আবার হাত ধরে টেনে নিয়ে না যায়!

ফানুস বলল।

আজাদ যখন ফিরে এসে রিকশাতে ফানুসের পাশে বসল তখন আবার শুরু হল ঝিরঝিরে বৃষ্টি। বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ। নিজের পাশ থেকেও এক সুগন্ধি চাপ অনুভব করছিল। মখমল-এর। কাঁচুলিঘেরা শাবি রান্ডির বেশরম পরশে নিজেকে ওর ঝড়ের ঝাউগাছ বলে মনে হতে লাগল। শরীরের মধ্যে রক্ত এমনভাবে নাচানাচি করতে লাগল যে মনে হল মাথার শিরা ধমনি সব ছিঁড়ে যাবে। নাক দিয়ে রক্ত বেরবে।

বৃষ্টি শুরু হতেই রিকশাওয়ালা সামনের পর্দাটা নামিয়ে দিল। ফানুসের গায়ের সঙ্গে অনিচ্ছায় গা লাগিয়ে বসে খানাখন্দে ভরা বৃষ্টিভেজা পথে চলতে চলতে আজাদের গা সিরসির করতে লাগল। কখনোই সে কোনো নারীর এত কাছে আসেনি। এক আম্মা ছাড়া। রিকশার পর্দার ভেজা ত্রিপলের গন্ধ বৃষ্টি-ভেজা সোঁদা মাটির গন্ধ, ফানুস-এর শরীরের হিম্বা ইত্বরের গন্ধ আর বিরিয়ানি এবং বড়া-কাবাবের গন্ধ মিলে আজাদের মনে হল যে, খুদাহর ফরমানে ও আজ কোনো নবাবই হয়ে গেছে বুঝি।

কিন্তু ভাবনা থামিয়ে বলল, কোথায় যাচ্ছ?

ফানুস খিল খিল করে হেসে, আজাদের গায়ে ঢলে পড়ে বলল, কেন? আমার ডেরায়। তুমি আমাকে পালিশ করেছ তাই আমিও তোমাকে পালিশ করে দেব। হিঃ হিঃ।

না, না।

ঘাবড়ে গিয়ে বলল আজাদ।

আমার বুড়ি আম্মা খিদেয় বে-হোঁস হয়ে আছে। আমাকে বাড়ি যেতে হবে। এখুনি বস্তিতে না ফিরলে বড়োই গুণাহর কাজ হবে।

হিঃ হিঃ।

ফানুস হেসে বলল, ওয়ার্ল্ড-কাপ এর দিনে কারোই কোনো গুণাহ হয় না। হোন্নেই নেহি শকতা। তা ছাড়া তোমার আর আমার মতো মানুষদের মায়েরা যেখানে যাবার সেখানে ঠিকই চলে যাবে। তোমার আমার মদত ছাড়াই।

কোথায়?

দোজখ-এ। আবার কোথায়?

নিজের মুখ প্রায় আজাদের মুখে ঠেকিয়ে বলল, ফানুস।

নেশা হয়েছিল ফানুস-এর। কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল।

পিয়া-হুয়া বহু পুরুষমানুষকে দেখেছে আজাদ। তাদের হাল-হকিকৎ জানে। এই প্রথম একজন জেনানাকে দেখল, মত্ত অবস্থায়। ওর অস্বস্তি লাগছিল। ভয়ও করছিল একটু একটু।

ফানুস বলল, জান, একদিন আমি আমার মাকেও, আমার ভুখা, বুখারসে বেঁহোস মাকে একা ঘরে রেখে তার জন্যে পথ্য আর দাঁবাইয়া কিনতে আজকের মতো এক ঝড়-বাদলের রাতে পথে বেরিয়েছিলাম। তোমার আম্মার ভুখ-বিমারের কথা শুনে সেই কথা মনে পড়ে গেল আজ।

একটু চুপ করে থেকে বলল, তখন আমার বয়স চোদ্দো। সে পথ থেকে আর ফেরা হল না। আম্মার কোনো খবরই আর পেলাম না। আমাদের বাড়ি ছিল গয়া শহরের এক কোণে। আমার পোরমশন হল। গয়া থেকে এখন পাটনা।

বলেই বলল, যাকগে, যাকগে, আজ কোনো দুঃখের কথা নয়। আজ বড়ো খুশির দিন। ওয়ার্ল্ড কাপ এর দিন। আজ খুব আনন্দ করব। চলো তুমি, আমার ডেরায়।

আজাদ কিছু বলার আগেই বলল, তোমার ক-জন বিবি?

আমি শাদিই করিনি।

হাসবার চেষ্টা করে বলল, আজাদ।

যাঃ। ঝুঠ বোল রহা হ্যায় তু। হিন্দুস্তাঁমে যো আহসানকি কাম হর মদনে সবসে ইতমিনানসে কর। বৈঠতা হায়, উও কাম ভি তু কিয়া নেই আভভিতক? অজীব আদমী হ্যায় তু। ইতনা আসহান ক্যা কাম।

পরক্ষণেই উল্লাসে চেঁচিয়ে বলল, তাহলে তুমি কখনো…

না। কখনো না।

প্রশ্নটাকে ফানুস এর হাত থেকে কেড়ে নিয়েই ছিঁড়ে ফেলল আজাদ।

টাকা পাঁচটা পেয়ে গেলে রিকশা থেকে লাফিয়ে নেমে যাবে।

মনে মনে বলল ও।

ওয়াহ। ওয়াহ। আজ বাঘিনী হরিণছানা নিয়ে খেলা করবে। অনভিজ্ঞ ছানা। যে কিছু জানে না।

মনে মনে বলল, ফানুস।

আমার মায়ের কাছে চলো।

আজাদ বলল, একটু পরে।

হিঃ হিঃ। পরের মা কখনো নিজের হয়?

তোমার নামটা কী গো? মুখ তো চিনি তোমার। নাম তো জানি না।

আমার নাম আজাদ। আজাদির দিনে জন্মেছি। আমার জন্ম পনেরোই আগস্ট, যদিও আজাদির অনেকই পরে, তাই আম্মা সখ করে আমার নাম দিয়েছিলেন আজাদ।

আজাদ? হাঃ। হাঃ। ফুলে ফুলে হাসতে লাগল ফানুস।

নেশাগ্রস্ত মানুষের সঙ্গে তর্ক করা চলে না। করলেই বিপত্তি। আজাদ তাই চুপ করে রইল। মনে মনে ঠিক করল রিকশাটা পোস্ট অফিসের মোড়ে এলেই, টাকাটা চেয়ে, ও লাফিয়ে পড়বে। রিকশা থেকে। রিকশাটা ক্যাঁচোর-কোঁচোর ক্যাঁচোর-কোঁচোর করে চলছিল। এইখানে পথের পাশে একটা কবরখানা। বড়ো বড়ো গাছ। হাওয়াতে সুইশ-সুইশ করছে পাতারা। গা ছমছম করে।

ফানুস স্বগতোক্তির মতো বলল, আজাদ! আজাদি!

একটু পরে ফানুস বলল, আমার দু উরুর মধ্যের এই নাজুক, কিমতি, মেয়েদের কাছে কোহিনুর হিরের চেয়েও দামি যে ফুলটি, তাকে বিকিয়ে দিলাম আমি বিনি পয়সায়। চোদ্দো বছর বয়সে। তবুও আমার মাকে বাঁচাতে পারলাম না। তাকে আর দেখতে পর্যন্ত পারলাম না কখনো এই জীবনে।

তারপর বলল, বন্দিদশার কত রকম হয়, তা কি তুমি জান আজাদ?

আজাদ কীভাবে সান্ত্বনা দেবে ফানুসকে, বুঝে উঠতে পারল না। কষ্ট হল খুব।

পাঁচটা টাকার লোভে পড়ে ক্রমশ বড়োই ঝামেলাতে জড়িয়ে পড়ছে ও।

ফানুস আবারও বলল, আর তুমি? তুমি আজাদ। তুমি তোমার দু-পায়ের মধ্যে তোমার বাবার। রেখে-যাওয়া একমাত্র সম্পত্তি, ওই লোহার ফর্মাটাকে বুকের কাছে আঁকড়ে ধরে পরের জুতোতে দিনের মধ্যে যদিও বারো ঘন্টা মুখ ঘষে যাচ্ছ, দিনান্তে তবুও দু-টি রুটি আর ডাল পাবে কি পাবে

তার স্থিরতা নেই। একে কি তুমি আজাদি বল? আমি আর তুমি আজাদ হিন্দুস্থানে জন্মেছি? না, আজাদ। আমরা আজাদনই কেউ। আমি হলেও বা হতে পারি। বন্দিদশার যেমন অনেকরকম। হয় তেমন আজাদিরও হয়। নিজেকে আমি আজাদ বলতে পারি, কারণ আমি আমার নিজের। শরীরের গোলামিই করি। আর কারোই নয়। আমার মতো আজাদও তুমি হবে না কোনোদিনও। সৎপথে যতই মেহনত করো না কেন, তোমার বন্দিদশা ঘুচবে না কোনোদিনও। এখানে নয়, না। তোমার বাবা যা করে গেছে, তুমি মুচি আজাদ যা করে যাচ্ছ, তোমার ছেলেও তাই-ই করে যাবে। আমার জীবন, তোমার জীবন, তোমার আওলাদের জীবন সবই অভিশপ্ত। এর থেকে শুধুমাত্র তুমি নিজেই নিজেকে মুক্তি দিতে পার। আর কেউই নয়। তুমি বরং স্মাগলিং বা ওয়াগন ব্রেকিং এর দলে ভিড়ে যাও আজাদ। যদি সত্যিই স্বাধীন হতে চাও। নইলে তোমার আজাদি তোমার স্বপ্নেই থেকে যাবে। যে নিজের পেটের খিদে থেকেই মুক্তি পেল না, সেও কি না আজাদ! ফুঃ। আজাদির সে জানেটা কী?

আজাদের এমন নিরাশ-করা সাংঘাতিক সব বিপজ্জনক কথা আদৌ ভালো লাগছিল না। ও তো পোলাও-গোসত চায় না খেতে। চায় একুট ডাল-রোটি। ওসব সাংঘাতিক কাজ সে করতে যাবে কেন?

আজাদ বলল, আমি একা গরিব হলে কি হল। দেশের তো অনেক উন্নতি হয়েছে। কত রাস্তা, কত গাড়ি, কত কিছু। লোকের ঘরেঘরে টিভি। মানুষের কাছে আজকাল দু চার হাজার টাকা যেন কিছুই নয়। টাকা আমার একার না থাকতে পারে। আমার নসিব যে খারাপ। খুদাহর আমার উপরে দোয়া নেই বলেই আজাদির পর দেশের মানুষের অবস্থা যে ফিরে গেছে, সকলেই যে আজাদ হয়ে গেছে সেকথা তো আর অস্বীকার করা যায় না। সবাই তো আর আমি নই।

ফানুস হঠাৎ পুলক ভরা গলায় বলল, মারো গুলি! আজ মন খারাপ করার কথা নয়। আজ ওয়ার্ল্ড কাপ এর দিন। ওই লোকটা বলল, ফাইনাল খেলার দিনে কলকাতায় নাকি পাঁচ লাখ টাকার শুধু বাজিই পুড়বে। পুরো কলকাতা শহরের ভোলই পালটে যাচ্ছে। পথ ঘাট ট্রাম বাস সব। ওলা কাপ। ফোয়ারা ফুটছে নাকি দিকে দিকে। ম্যায়কাদার উপরের ঘরগুলির আলোর রঙের মতো। তাদের রং। লাল, নীল, হলুদ, গোলাপি, সবুজ।

আজাদ বলল, কলকাতা তো বড়োলোকদেরই জায়গা। সেখানে তো কোনো গরিব থাকে না। ভিখিরি নেই। ফেরিওয়ালা নেই। স্মাগলার নেই। চোর ডাকাতও নেই। প্রায় দিল্লিরই মতো। কলকাতার সঙ্গে কি আমাদের এই মহল্লার তুলনা চলে? কিন্তু এখানেই বা সাধ আহ্লাদ কমটা হচ্ছে কী? এখনও প্রায় মাসতিনেক বাকি ফাইনালের, এখনই দেখি লোকের মুখে একটাই। বোলি. ওয়ার্ল্ড-কাপ। কাজ-কাম সব চৌপট।

হ্যাঁ, তা ঠিক। তবে এ দেশের যারা রাজা, আর যারা বড়োলোক তাদের প্রত্যেককে আমার পয়সা থাকলে আমি একটা করে উপহার দিতাম।

ফানুস বলল।

রিকশাটা একটা জল-ভরা গাড্ডায় পড়তেই পরক্ষণেই ওঁক করে উঠল।

কী উপহার?

আজাদ শুধোলো। কী দিতে?

আরসি!

কী? আরসি।

হ্যাঁ। আয়না দিতাম মুখগুলো দেখবার জন্যে।

ফানুস থামতেই আজাদ বলল, আমাকে পাঁচটা টাকা কি সত্যিই দেবে তুমি?

এই নাও তোমার টাকা। বলেই জামার মধ্যে হাত চালিয়ে বুকের খাঁজ থেকে এক মুঠো টাকা বের করে দিল আজাদকে।

আজাদ ভেবেছিল টাকা পাঁচটা ভালোবাসা মাখিয়েই দেবে। কিন্তু যখন হাতে নিল টাকাগুলো, ওর মনে হল ঘৃণা, মাখিয়ে দিল ফানুস।

অবাক হয়ে গিয়ে আজাদ বলল, এ কী। এও কেন? না, না। তুমি তো পাঁচ টাকাই…

আরে নাও না।

কোথা থেকে পেলে এত টাকা? লোকটাকে খুনটুন করনি তো?

আরে নাঃ নাঃ। সবই ওয়ার্ল্ড-কাপ-এর দৌলতে। লোকটা এমনিতেই মস্ত বড়োলোক। কাজ বিশেষ কিছুই করতে হয় না। গজার মন্ডিতে থাকে। বাপ-ঠাকুর্দা গঙ্গা মাঈ-এর পাড়ে কয়েক শো বিঘা খেতি জমিন রেখে গেছিল। কুস্তি লড়ে, খায় আর পড়ে পড়ে ঘুমোয়। মাঝে মাঝে বউকে আর আমাকে ফকিং করে। আর বাজি লড়ে। জুয়া খেলে। আজ নাকি বাজি ধরেছিল যে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে যাবে হিন্দুস্থান। এক হাজার টাকা জিতেছে। ফোকটাই। খুব বেশি। তাই আমাকে এক মুঠো কুড়ি টাকা আর দশ টাকার নোট দিল। আমি নিজেই গুনিনি। লোকটার মন ভালো।

আমি এবার নেমে যাব পোস্ট-অফিসের মোড়ে।

বলল, খুবই খুশই হওয়া আজাদ।

না তুমি আমার বাড়ি চলো। আমাকে ফকিং করবে।

আমার আম্মা।

তোমার আজাদি কোনোদিনও জুটবে না কপালে আজাদ।

কেন?

তুমি অন্যের কথা বড়ো বেশি ভাব। মকবুল গুন্ডার মতো, ম্যায়কাদার মালিক ছোটে বাবুর মতো, এম এল এ, রামখিলাওনের মতো হতে না পারলে কোনোদিনও আজাদ হতে পারবে না। আজাদি কেউ কাউকে দিতে পারে না আজাদ। আজাদি কেড়ে নিতে হয়।

সেকথার কোনো উত্তর না দিয়ে, আজাদ বলল, রিকশাওয়ালা, জেরা রোক্কে।

বলেই, বলল, বহতহি মেহেরবানি। কালফিন মিলেঙ্গে।

ফানুস খিল খিল করে হাসছিল। রিকশার পর্দা তুলে ডানহাতের তিনখানি আঙুল নেড়ে বলল, ওয়ার্ল্ড-কাপ জিন্দাবাদ।

আজাদও বাঁ-হাতটা তুলে বলল, জিন্দাবাদ।

আজাদ বলল, কাল।

তারপর আর কিছুই না বলে, হাত তুলে সেলাম করে এগিয়ে গেল।

প্যাকেট চারটের একটাও নিল না ফানুস। সবকটাই আজাদকে দিয়ে দিল।

এটাও কি ভিক্ষে?

হোক ভিক্ষে। যত অপমান এবং গ্লানিই জড়ানো থাক না কেন ভাতে, যার পেটে খিদে, সে কাঁকর বাছার মতো ভাত থেকে ওসব বেছে ফেলে দিয়ে হালুম-হুলুম করে খায়। আর এত বিরিয়ানি!

গলিটাতে খুবই অন্ধকার। কাঁচা নর্দমাতে বস্তির ছেলে-মেয়েরা পায়খানা করে। দুর্গন্ধ। উলটি আসে। ভর পেটেও আসে, খালি পেটেও আসে। কাঁচা পথটা, কাদা আর মানুষের ময়লা, গোবর আর ছাগলের নাদিতে থিকথিক করছে। দোজত। কোনো ঘরে ক্ষুধার্ত শিশু কাঁদছে। রহিমের। বিবি কাঁদছে থেকে থেকে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। হঠাৎ-আসা হঠাৎ-যাওয়া বৃষ্টিরই মতো। রহিম কাল মারা গেছে এনকেফেলাইটিস রোগে। বস্তিতে আরও পাঁচজনের হয়েছে। পাশের ঘরের জুগনু। খুক খুক করে কাশছে। টি বি রোগী। বউ পালিয়ে গেছে ওকে ফেলে। কাজও চলে গেছে। দিন গুনছে মৃত্যুর প্রতীক্ষায়।

প্রায়ান্ধকার ঘরের দরজাটা ভেজানো ছিল। মাটির মেঝেতে কেরোসিনের কুপিটা জ্বলছিল। আম্মা শুয়েছিল ভিজে মাটিতে কাঁথা পেতে।

আজাদ ডাকল, আম্মা!

এসেছিস বাপজান! এত দেরি করলি আজ! খাবার এনেছি তোমার জন্যে আম্মা।

বিরিয়ানি আর বড়া-কাবাব। নিসার হোটেলের।

আঃ।

বুড়ি উঠে বসল কাঁথার উপরে। জাফরান দেওয়া দেরাদুন চালের বিরিয়ানির গন্ধে যে-মানুষ খিদে পেটে নিয়ে মরেছে, সেও কবরের মধ্যেও উঠে বসবে, আর আম্মা তো এখনও বেঁচে আছে!

আম্মা হাসল।

অনেকদিন এমন হাসি হাসেনি।

বাক্সগুলোতে হাত ছুঁইয়ে বুড়ি বলল, গরমই তো আছে রে এখনও। নামাজ পড়েছিলি তো বিকেলে? যা। তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে আয় বাপজান।

আম্মার আর তর সইছিল না।

আজাদ এগোলো পায়জামা ও শার্ট ছেড়ে লুঙ্গি পরে।

আম্মা বলল, কারো কি শাদি ছিল রে? কোথা থেকে পেলি এত সব উমদা খাবার?

ওয়ার্ল্ড-কাপ আম্মা।

সেটা কী বাপজান?

কিরিকেট। এবারে হিন্দুস্তাঁ-পাকিস্তাঁতে ওয়ার্ল্ড-কাপ হচ্ছে। তারই খুশিতে…। আমাদের খুশনসিবি।

আম্মার তুবড়ে-যাওয়া মুখে হাসি ফুটল।

বুড়ি বলল, স্বগতোক্তির মতো, কিরিকেট? সেটা কী করে? যাই হোক, ইনশাল্লাহ। রোজই কেন হয় না-রে বাজান?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *