একমাস কেটে যায়…পরের মাসও কাটে তারপর। নববর্ষের আগের দিন শ্যালক শহরে এসে তার বাড়িতেই ওঠে। ইভান ইলিচ তখন আদালতে। প্রাসকভিয়া ফেদরভনা গিয়েছিলেন দোকান করতে। বাড়ি ফিরে পড়ার ঘরে শ্যালককে দেখতে পান ইভান ইলিচ। স্বাস্থ্যবান সজীব মানুষ। নিজেই পোর্টমান্ট খুলছিলেন। ইভান ইলিচের পায়ের শব্দ শুনে সে মাথা তোলে…পলকের জন্য নির্বাকভাবে চেয়ে থাকে তার দিকে। এই অপলক চাহনি ইভান ইলিচকে সব কিছু বলে দেয়। শ্যালক বিস্ময়সূচক শব্দ করবার জন্য মুখ হাঁ-করে থেমে যায়। তার এই ভঙ্গীই ইভানের সমস্ত শংকা সপ্রমাণ করে।
–আমি বদলে গিয়েছি বুঝি?
–হ্যাঁ, পরিবর্তন খানিকটা হয়েছে বটে!
কিন্তু তারপরে শ্যালককে চাহনি-প্রসঙ্গে আবার যতবার তিনি ফিরিয়ে আনতে চাইলেন, সে আর রা-টি করল না। প্রাসকভিয়া ফেদরভনা বাড়ি ফিরে এলে সে বোনের কাছে চলে যায়। ইভান ইলিচ প্রথমে দরজার দিকে তাকান, তারপর আয়নার সামনে এসে প্রথমে মুখোমুখি দাঁড়ান তারপর তাকান কাত ভাবে। সস্ত্রীক যে ছবিখানা তুলেছেন তার দিকে চেয়ে নিজের বর্তমান চেহারার সঙ্গে তুলনা করেন। প্রচুর পরিবর্তন হয়েছে তার। তারপর কনুই অবধি হাতা খুলে নিজের হাতের দিকে তাকান। পরক্ষণেই আবার হাতা নামিয়ে দিয়ে ধপ করে গদি-আঁটা আসনের উপর বসে পড়েন। সে রাত্রে তার মুখ আরও কাল হয়ে যায়।
খানিক বাদে আপনমনে বলে ওঠেন, না না, এ চলবে না! লাফ দিয়ে উঠে বসে তিনি টেবিলের কাছে চলে যান এবং মামলার নথিপত্র খুলে পড়তে শুরু করেন। কিন্তু একটানা বেশিক্ষণ পড়তে পারলেন না। কপাট খুলে তিনি বৈঠকখানায় আসেন। বৈঠকখানার বাইরের কপাট বন্ধ। আঙুলে ভর দিয়ে চুপে সাড়ে কপাটের কাছে এসে তিনি কান পেতে থাকেন।
প্রাসকভিয়া ফেদারভনা বলছিলেন, না, তুমি বাড়িয়ে বলছ।
–বাড়িয়ে বলছি! নিজের চোখে দেখতে পাচ্ছ না? দেখছ না কেমন মরা মানুষের মত চেহারা হয়ে গেছে? চোখ দুটো দেখেছ? কেমন নিষ্প্রভ হয়ে গেছে দেখেছ? কিন্তু আসলে ওর রোগটা কি?
কেউ জানে না। নিকোলায়েভিচ (আর একজন ডাক্তার) একটা কি যেন বলেছে–আমি ঠিক বলতে পারব না। কিন্তু লেশচিতস্কি (বিখ্যাত বিশেষজ্ঞ) বলেছেন আলাদা কথা…
ইভান ইলিচ তখন নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েন। মনে মনে ভাবেন, মূত্রাশয়…মূত্রাশয়ের স্ফীতি। মূত্রাশয় সম্পর্কে ডাক্তারদের প্রতিটি মন্তব্য একে একে তার মনে পড়ে। কল্পনায় তিনি মূত্রাশয় ধরে আটকে রাখতে চান যাতে নড়াচড়া করতে না পারে। তার মনে হল, এর জন্য আর বিশেষ কি প্রয়োজন! না, আজকেই আবার পেতর ইভানভিচের সঙ্গে দেখা করব। (এই বন্ধুর এক বন্ধু ডাক্তার)। বেল বাজিয়ে তিনি গাড়ি নিয়ে আসার হুকুম দেন এবং রওনা হবার জন্য তৈরি হন।
–কোথায় চললে, হ্যাঁগো? বিশেষ বিষণ্ণ গলায় অতি সদয় দৃষ্টিতে চেয়ে স্ত্রী জিজ্ঞাসা করেন।
স্ত্রীর এই অতিরিক্ত সদয় দৃষ্টিতে ইভান ইলিচ বিষম চটে যান। বিমর্ষভাবে তাকান স্ত্রীর দিকে।
–পেতর ইভানভিচের সঙ্গে দেখা করতে যেতে হবে।
প্রথমে তিনি পেতর ইভানভিচের কাছে যান। তারপর দুজনে মিলে যান। ডাক্তার বন্ধুর কাছে। ডাক্তার বাড়িতেই ছিল। অনেকক্ষণ তার সঙ্গে আলোচনা করেন ইভান ইলিচ।
তার দেহের অভ্যন্তরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সম্পর্কে ডাক্তারের মতামত পর্যালোচনা করে তিনি সব কিছু বুঝতে পারেন।
এপেনডিকসের মধ্যেই ক্ষুদ্র একটা কিছু ছিল। সব কিছু আবার ঠিক হয়ে যেতে পারে। অঙ্গ বিশেষের শক্তি বাড়িয়ে দিলে এবং অপর এক অঙ্গের প্রক্রিয়া রোধ করলে দোষটুকু মিলিয়ে গিয়ে আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। রাতের খাবার সময় পার হয়েই তিনি বাড়ি ফেরেন। খাবার সময় যেন হাসিখুশিভাবে আলাপও করলেন। কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে কাজকর্মে মন দেবার মেজাজ ফিরে পেলেন না। শেষ অবধি পড়ার ঘরে গিয়ে প্রয়োজনীয় কাজকর্ম করেন। কিন্তু তিনি যে একটি বিষয় একান্তে ঠেলে রেখেছেন, আর কাজ শেষ হয়ে গেলেই যে এই গুরুত্বপূর্ণ অন্তরঙ্গ বিষয়ের প্রতি তার মন অকৃষ্ট হবে, এই চিন্তা কখনও মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারলেন না। কাজ শেষ করে তিনি উপলব্ধি করলেন, চিন্তাটি এপেনডিকসের চিন্তা বই আর কিছুই নয়। কিন্তু এ চিন্তার কাছে তিনি আত্মসমর্পণ করলেন না। চা খেলেন বৈঠকখানায় গিয়ে। একজন ম্যাজিস্ট্রেটসহ কিছু দর্শনার্থী ছিল সেখানে। এই ম্যাজিস্ট্রেট পাত্রটি তার কন্যার যোগ্য বর। তারা দুজনে আলাপ করছিল, পিয়ানো বাজাচ্ছিল আবার গানও করছিল মাঝে মাঝে।
প্রাসকভিয়া ফেদরভনার মতে অন্যান্য দিনের তুলনায় সেদিনকার সন্ধ্যা ইভান ইলিচের বেশ প্রসন্নভাবেই কাটে। তবু পলকের জন্যেও তিনি বিস্মৃত হতে পারেন নি যে এপেনডিকসের গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা তিনি স্থগিত রেখেছেন। এগারটার সময় সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তিনি শোবার ঘরে যান। অসুস্থতা আরম্ভ হবার পর থেকেই পড়ার ঘরের লাগোয়া ছোট্ট একটি কামরায় শুচ্ছেন। পোশাক ছেড়ে তিনি জোলার একখানি উপন্যাস তুলে নেন। পড়ার বদলে আবার তার মাথায় পুরনো চিন্তা ঘুরপাক খায়। কল্পনায় আবার এপেনডিকসের ঈন্দিত উন্নতি অনুভব করেন। মনে হয়, দোষটুকু মিলিয়ে গিয়ে আবার স্বাভাবিক ক্রিয়া-প্রক্রিয়া ফিরে এসেছে। মনে মনে বলেন, হ্যাঁ, নিশ্চয়! প্রকৃতিকে সাহায্য করতে পারলে আর কিছু দরকার হয় না। সঙ্গে সঙ্গে ওষুধের কথা মনে পড়ে। উঠে গিয়ে ওষুধ খেলেন এবং চিৎ হয়ে শুয়ে ওষুধের শুভফল অনুভব করবার চেষ্টা করলেন।–ওষুধটা নিয়মিত খেতে হবে। আর অপকার যাতে না হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। এখুনি অনেক ভাল লাগছে–সত্যি, বেশ ভাল লাগছে। আস্তে তিনি কোকে হাত দেন। হাত লাগায় কোন ব্যথা লাগল না তো!–তাইতো, কোন ব্যথা টের পেলাম না তোর ইতিমধ্যেই অনেকটা ভাল হয়ে গেছে নিশ্চয়। কাত হয়ে তিনি আলো নিভিয়ে দেন।…এপেনডিক্স ভাল হয়ে উঠেছে…দোষটা মিলিয়ে যাচ্ছে নিশ্চয়ই..
সহসা সেই সাবেক পরিচিত খামচে ধরার মত ব্যথা অনুভূত হয়। বেদনাটা এবার যেন বেশ জোরেই আসে। আবার মুখে সেই বিরক্তিকর স্বাদ লাগে। সঙ্গে সঙ্গে মনটা দমে যায়…মাথাটা কেমন ঝমঝম করে ওঠে। অস্কুটকণ্ঠে তিনি বলেন, ভগবান! হে ভগবান! আবার এল! না, এ আর সারবে না! সহসা বিষয়টি সম্পর্কে তার দৃষ্টি ভঙ্গী বদলে যায়। মনে মনে বলেন, এপেনডিক্স! মূত্রাশয়…না, এ শুধু এপেনডিক্স বা মূত্রাশয়ের প্রশ্ন নয়, এ জীবন-মরণের সমস্যা! হ্যাঁ, জীবন ছিল, কিন্তু এখন ক্রমে ক্রমে বিদায় নিচ্ছে। আমার সাধ্য নেই যে তাকে ধরে রাখতে পারি। সত্যি! আর আত্মপ্রবঞ্চনা করে কি লাভ? সবাই হয়তো ব্যাপারটা বুঝছে না। তবে আমি বেশ বুঝতে পারছি যে মরতে চলেছি। এখন শুধু কয়েক সপ্তাহ বা দিনের প্রশ্ন! হয়তো এই মুহর্তেও হয়ে যেতে পারে। একদিন আলো ছিল কিন্তু এখন অন্ধকার। আমি ছিলাম এখানে কিন্তু চলেছি অন্যত্র। কোথায় চলেছি? আতঙ্কে তার সর্বাঙ্গ শিউরে ওঠে, শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। তখন শুধু বুকের ঢিপ ঢিপি অনুভূত হয়।
–আমি যখন থাকব না কি থাকবে তখন? কিছুই থাকবে না। কোথায় যাব মারা গেলে? এই কি মৃত্যু? না না না, আমি মরব না! লাফ দিয়ে উঠে তিনি আলো জ্বালাবার চেষ্টা করেন। কম্পিত হাতে মোম হাতড়াতে গিয়ে মোম ও মোম দানিটি ঠেলা লেগে মেজের উপরে পড়ে যায়। ধপ করে আবার বিছানার উপর শুয়ে পড়েন ইভান ইলিচ।
বিস্ফারিত চোখে একদৃষ্টে অন্ধকারের পানে চেয়ে আপন-মনে বলেন, কি লাভ? কোন ইতর-বিশেষ হবে না। মৃত্যু…তার বেশি কিছু নয় তো। তাদের কেউ একথা জানেনা–কিংবা চায়ও না জানতে। আমার জন্য কারও কোন মমতা নেই। (বহু দূরের এক সঙ্গীত আর সঙ্গে যন্ত্র সঙ্গীতের ঝঙ্কার কপাটের ফাঁক দিয়ে তার কানে ভেসে আসে) ওদের কাছে সবই সমান। কিন্তু একদিন তো তাদেরকেও মরতে হবে। মূর্খ! আমি আগে, তারপর ওরা…রেহাই নেই কারও। তবু এখন ওরা আনন্দোল্লাস করছে। জানোয়ার যত সব!
ক্রোধে তার কণ্ঠরোধ হয়ে আসে। মুহ্যমান করে তোলে দুঃসহ যন্ত্রণা।–সব মানুষকেই এই মর্মান্তিক বিভীষিকার দহনজ্বালা ভুগতে হবে…নিশ্চয়ই কোন একটা গোলমাল ঘটেছে। নিজেকে শান্ত করতে হবে…সব কিছু ভেবে দেখতে হবে গোড়া থেকে। আবার তিনি ভাবতে শুরু করেন।–হ্যাঁ রোগের প্রথম যা হয়েছিল। কোকে চোট খেলাম; কিন্তু সেদিন কি তার পরের দিনও বেশ ভাল ছিলাম। সামান্য ব্যথা লেগেছিল…তারপর আর একটু বেশি লাগে। তারপর ডাক্তারের কাছে গেলাম…সেই থেকে হতাশা আর বিষণ্ণতা চলছে। তখন আরও ডাক্তার দেখালাম…তারপর ক্রমে ক্রমে এগিয়ে গেলাম অন্ধকার গহ্বরের মুখে। ক্রমেই আমার শক্তি লোপ পেতে থাকে…চোখ নিষ্প্রভ হয়ে আসে। এরপর প্রতিনিয়ত এপেনডিক্সের কথা ভাবতে থাকি…এই তো মৃত্যু! আমি ভাবছি এপেনডিক্স সারাবার কথা, কিন্তু মৃত্যু আমার শিয়রে। সত্যিই কি মরব?
আবার মৃত্যু-ভীতি তাকে বিহ্বল করে ফেলে। হাঁ-করে তিনি শ্বাস ছাড়েন, নিচু হয়ে দেশলাই হাতড়াতে থাকেন-কনুই দিয়ে ভর করেন বিছানার পাশের একটা স্ট্যান্ডের উপর। এইটেই তার ধরন। কিন্তু ব্যথা লাগে। স্ট্যান্ডটার উপরেই বেদম রাগ হয়–আরও জোরে চেপে ধরেন। সেটা উলটে যায়। রুদ্ধশ্বাসে আর হতাশায় আবার তিনি শুয়ে পড়েন। মনে হয়, এখুনি মৃত্যু আসবে।
ইতিমধ্যে অভ্যাগতেরা চলে যেতে শুরু করে। প্রাসকভিয়া ফেদরভনা তাদের বিদায় সম্ভাষণ জানাচ্ছেন। একটা কিছু পড়ে যাবার শব্দ শুনে তিনি ঘরে ঢোকেন।
–কি হল?
–কিছুই না। আচমকা আমি ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছি।
আবার বেরিয়ে গিয়ে মোম নিয়ে ফিরে আসেন প্রাসকভিয়া ফেদরভনা। ইভান ইলিচ তখন জোরে জোরে হাঁপাচ্ছেন–মনে হয় যেন হাজার খানেক গজ দৌড়ে এসেছেন। স্ত্রীকে ঘরে ঢুকতে দেখে চোখ উপরে তুলে একদৃষ্টে চেয়ে থাকেন তার দিকে।
–ব্যাপার কি জ্যাঁ?
–কি–দুই–না। আমি উলটে ফেলেছি।
মনে মনে ভাবেন, বলে কি লাভ? বললেও বুঝবে না তো!
প্রকৃতই বুঝতেন না প্রাসকভিয়া। স্ট্যান্ডটি কুড়িয়ে মোম জ্বালিয়ে দিয়েই আবার তিনি অভ্যাগতদের বিদায়-সম্ভাষণ জানাবার জন্য বেরিয়ে যান। ফিরে এসেও দেখেন, শূন্যে চেয়ে একইভাবে শুয়ে আছেন ইভান ইলিচ।
–ব্যাপার কি? বেশি খারাপ ঠেকছে?
—হ্যাঁ।
মাথা ঝেকে তিনি বসে পড়েন।
–জান হ্যাঁ, আমার মতে লেশচিতস্কিকে ডাকা দরকার।
তার মানে খরচের কথা না ভেবে বিখ্যাত বিশেষজ্ঞকে ডাকতে হবে। ক্রুর হাসি হেসে ইভান ইলিচ বলেন, না। স্ত্রী আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেন। তারপর এগিয়ে স্বামীর কপালে চুমু খেয়ে বেরিয়ে যান।
চুমু খাবার সময় স্ত্রীর প্রতি অন্তরের অন্তস্তল থেকে ঘৃণা উথলে উঠে। অতি কষ্টে নিজেকে সংযত করে তাকে সরিয়ে দিলেন না।
–যাচ্ছি! দোহাই ভগবানের, একটু ঘুমোও।
–ঘুমোচ্ছি!
ইভান ইলিচ স্পষ্টই বুঝতে পারেন যে মৃত্যু আসন্ন। কাজেই নিরবচ্ছিন্ন হতাশা আর ঘোচে না।
অন্তরের অন্তস্থলে তিনি টের পান যে মৃত্যু এগিয়ে আসছে। কিন্তু এ ধরনের চিন্তায় তিনি যে শুধু অভ্যস্তই নন তা নয়, সোজা কথায়ই এর অর্থও তার কাছে দুর্বোধ্য লাগে।
কিয়েজত্তয়েট্টারের তর্কশাস্ত্রে পড়েছেন : কাইয়াস মানুষ আর মানুষ নশ্বর, অতএব কাইয়াসও নশ্বর। এই যুক্তি কাইয়াস বরাবর সম্পর্কেই প্রযোজ্য বলে মনে হয়েছে। তার সম্পর্কে নিশ্চয়ই নয়! সেই কাইয়াস, সেই বিমূর্ত মানুষ নশ্বর একথা সত্য। কিন্তু ইভান ইলিচ কাইয়াসও নন আবার বিমূর্ত মানুষও নয়। সমস্ত মানুষ থেকে আলাদা জীব তিনি। মা-বাবার কাছে তিনি ছোট্ট ভান্যা মিত্যা ভলদিয়া আর পুতুল কোচোয়ান আর ধাত্রীর কাছে পরে কাতেংকার কাছেও তার একই পরিচয়। বাল্য কৈশোর ও যৌবনের সমস্ত সুখ-দুঃখ-আনন্দের মধ্যে তার একমাত্র পরিচয় ছিল ভান্যা। ভান্যা যে ছোট্ট চামড়ার বলটি ভালবাসত কাইয়াস কি জানত তার কথা? কাইয়াস কি তার মাকে চুমু খেয়েছে? কোনদিন কাইয়াসের জন্য কি তার রেশমি পোশাক অমনভাবে খসখস্ করেছে? প্যাস্ট্রি খারাপ হলে কোনদিন স্কুলে অমন হট্টগোল বাঁধিয়েছে কাইয়াস? অমন করে ভালও কি বেসেছে কখনও? পারত কাইয়াস তার মত আদালতে বিচার করতে? কাইয়াস সত্যই নশ্বর ছিল–সে মরে ভালই করেছে। কিন্তু আমি? এত চিন্তা, এত আবেগভরা ছোট্ট ভান্যা আর ইভান ইলিচের ব্যাপার সম্পূর্ণ আলাদা। আমি মরব এ হতেই পারে না। সে বড় মর্মান্তিক ঘটনা।
এই ছিল তার মনোভাব।
–কাইয়াসের মত আমাকে যদি মরতেই হয় তো আগে থাকতে তা জানা উচিত ছিল। অন্তর্যামীর বলে দেওয়া উচিত ছিল একথা। কিন্তু কোনদিন নিজের অন্তরে তো তেমন কিছু টের পাইনি। আমি কিংবা আমার বন্ধু-বান্ধব সবাই ভেবেছে যে আমাদের অবস্থা কাইয়াস থেকে আলাদা। আর এখন দেখছি বিপরীত! এ হতে পারে না। অসম্ভব! তবু আজকে তাই সত্য। কি করে হল? কি করে বোঝা যায় এই রহস্য?
সত্যিই তিনি বুঝতে পারতেন না। তাই এই অলীক বিষণ্ণ চিন্তা দূর করে দিয়ে সুস্থ সজীব ভাবনায় অন্যমনা হতে চাইতেন। কিন্তু সেই এক চিন্তা, শুধু সেই চিন্তাই নয়–সেই বাস্তব সত্য বারংবার এসে তার মুখোমুখি দাঁড়াত।
এই চিন্তা চাপা দেবার জন্য পর পর তিনি অন্য কথা ভাববার চেষ্টা করলেন। ভাবলেন, এতে যদি মনে বল পাওয়া যায়। সাবেকদিনে যে সব চিন্তা মৃত্যু-চিন্তাকে আড়াল করে রেখেছে, নতুন করে আবার তিনি তার কথা ভাবতে চাইলেন। কিন্তু বড়ই আশ্চর্যের কথা, আগের দিনে যে সব চিন্তা অন্তরে মৃত্যুর অনুভূতি চাপা দিয়ে লুকিয়ে রেখেছে, আজ আর তাতে কোন কাজ হচ্ছে না। সাবেক চিন্তা-ধারা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবার প্রয়াসেই আজকাল ইভান ইলিচের অধিকাংশ সময় কেটে যায়। আবার আমি কাজে মন দেব–শত হলেও ঐ কাজ নিয়েই তো বেঁচেছিলাম। সব দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলে তিনি আদালতে চলে যেতেন। আনমনা হবার জন্য আলাপ করতেন সহকর্মীদের সঙ্গে। ওক কাঠের চেয়ারের হাতলে শীর্ণ হাত রেখে অভ্যস্ত ভঙ্গীতে হেলান দিয়ে বসে চিন্তামগ্ন দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতেন জনতার দিকে। কখনও বা নিচু হয়ে নথিপত্র কাছে টেনে কোন সহকর্মীর সঙ্গে ফিস ফিস করে কথা কইতেন। তারপর সহসা চোখ তুলে সোজা হয়ে বসে জোরে জোরে কয়েকটি কথা ঘোষণা করে আদালতের কাজ শুরু করে দিতেন।
আদালতের কাজ চলবার সময়েই আচমকা হয়তো অনুভব করতেন যে কোকের ব্যথাটা আবার খামচাতে শুরু করেছে। মামলার তখন যে অবস্থাই হোক না কেন ইভান ইলিচের দৃষ্টি অমনিই ব্যথার দিকে নিবদ্ধ হত। এই দুশ্চিন্তা হটাবার জন্য তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করতেন, কিন্তু কোন লাভ হত না। ব্যথাটা হাজির হয়ে যেন তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে চেয়ে থাকত। সঙ্গে সঙ্গে তিনি প্রস্তরের মত অসাড় হয়ে যেতেন। নিষ্প্রভ হয়ে যেত চোখের দীপ্তি। আবার নিজেকে জিজ্ঞাসা করতেন, এই ব্যথাই তার জীবনে একমাত্র সত্য কি না। তার সহকর্মী আর অধস্তন কর্মচারীরা ক্ষোভে বিস্ময়ে লক্ষ করত যে তার মত বিচক্ষণ ধীমান বিচারক বিভ্রান্ত হয়ে ভুল করছে। গা ঝাড়া দিয়ে তিনি নিজেকে সংযত করবার চেষ্টা করতেন এবং কোনমতে আদালতের কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরতেন। পথে এই বিষাদভরা অনুভূতি ব্যাকুল করে তুলত যে বিচার বিভাগের কাজকর্ম দিয়ে যা তিনি চাপা দিতে চাইছেন আগের মত আর তা ঢাকা যাচ্ছে না। আদালতের কাজ আর পারছে না তাকে ব্যথার বিভীষিকা থেকে ত্রাণ করতে। তার চাইতেও বিচ্ছিরি ব্যাপার হচ্ছে, তিনি কিছু একটা করুন এই দাবি ব্যথাটা করে না। শুধু চায়, তার দিকে ইভান ইলিচের দৃষ্টি নিবদ্ধ হোক–সব কাজকর্ম ছেড়ে তার মুখোমুখি চেয়ে নিরবে দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগ করুন।
এই অবস্থা থেকে ত্রাণ পাবার আশায় ইভান ইলিচ সান্ত্বনার খোঁজ করেন। সন্ধান করেন চাপা দেবার নতুন পর্দার। নতুন পর্দা জোটে এবং ক্ষণিকের জন্য তিনি রক্ষেও পান। কিন্তু পরক্ষণেই সেই অবগুণ্ঠন টুকরো টুকরো হয়ে ছিঁড়ে যায় কিংবা স্বচ্ছ হয়ে পড়ে। মনে হয় যেন ব্যথাটা তাকে ভেদ করে গেছে। এমন কিছুই নেই যা দিয়ে তাকে ঢাকা যায়।
এই শেষের দিকে তিনি নিজের সাজানো বৈঠকখানায় যেতেন। এই বৈঠকখানাতেই তিনি পড়ে যান আর এর জন্যই জীবন খোয়াতে বসেছেন। কথাটা হাস্যকর মনে হয় বটে, তবু তিনি জানেন, এইখানে পড়ে গিয়ে যে চোট লেগেছিল সেই থেকেই তার রোগের উৎপত্তি। ঘরে ঢুকে নজরে পড়ত যে পালিশ করা টেবিলে আঁচড় লেগেছে। কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখতেন যে অ্যালবামের ব্রোঞ্জের কারুকার্যটা বাঁকা হয়ে গেছে। মূল্যবান এই অ্যালবামটি তিনি পরম যত্নে সাজিয়ে রেখেছিলেন। হাতে তুলে নিয়ে সেটি তিনি নাড়াচাড়া করতেন। মেয়ে আর বন্ধু বান্ধবদের অপরিচ্ছন্ন অভ্যাসের দরুন বেজায় বিরক্তও হতেন। কারণ, অ্যালবামটি এখানে-সেখানে ছিঁড়ে গিয়েছিল আর দু চারটে ছবিও মাথা নিচুর দিকে দিয়ে রাখা হয়েছে। সযত্নে আবার তিনি ছবিগুলো সাজিয়ে রাখতেন। বাঁকানো ব্রোঞ্জের কারুকার্যটিও ঠিক করে দিতেন সন্তর্পণে। তখন মনে হত, এই সব জিনিস চারাগাছগুলোর পাশে ঘরের অপর প্রান্তে সাজিয়ে রাখলে ঠিক থাকবে। অমনিই আরদালির ডাক পড়ত। কিন্তু আসত মেয়ে কিংবা স্ত্রী। তারা সম্মতি দিত না। স্ত্রী তো প্রতিবাদই করতেন। তর্ক করে তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে পড়তেন। এও তবু ভাল। কারণ তখন তিনি ব্যথার কথা ভাবতেন না। ব্যথা তখন অদৃশ্যে লুকিয়ে থাকত।
তারপর তিনি নিজে কিছু সরাতে গেলেই স্ত্রী বলে উঠতেন, থাকনা, চাকরদেরই করতে দাও! তোমার আবার চোট লেগে যেতে পারে। অমনি পলকের মধ্যে পর্দার আড়াল থেকে ব্যথার বিভীষিকা উদ্ভাসিত হয়ে উঠত। স্পষ্টই দেখতে পেতেন তিনি। শুধু একটা উদ্ভাস। ভাবতেন, এখুনি আবার লুকিয়ে যাবে। কিন্তু নিজের অনিচ্ছাসত্ত্বেও কোকের দিকে মন ঘুরে যেত।–ঠিক আগের মতই বসে বসে খামচাচ্ছে। আর তিনি ব্যথার কথা ভুলতে পারতেন না! স্পষ্ট দেখতে পেতেন যেন ফুলের আড়াল থেকে সরাসরি তার দিকে চেয়ে আছে।কি আর হবে এত সব করে?
–সত্যিই তো, কেল্লা দখল করতে গিয়ে যেভাবে প্রাণ হারাতে পারতাম, ঠিক তেমনিভাবে ঐ পর্দাটার জন্যই প্রাণটা গেল! একি সম্ভব? কি ভয়ানক–কি নির্বোধের মত কথা! না না, এ সত্য হতে পারে না। নিশ্চয়ই এ সত্য নয়…তবু এই তো সত্যি!
পড়ার ঘরে গিয়ে আবার তিনি শুয়ে পড়তেন। এখন আবার একাকী তিনি ব্যথার মুখোমুখি। এর দিকে চেয়ে আঁতকে ওঠা ছাড়া আর কিছুই করবার নেই।
* * *
ইভান ইলিচের অসুস্থতার তৃতীয় মাসে দেখা গেল যে স্ত্রী-পুত্র কন্যা বন্ধু-বান্ধব ডাক্তার চাকর এমনকি তিনি নিজেও ভাবতে শুরু করেছেন যে অচিরেই তিনি পদ খালি করে দেবেন কি না। অন্তত অন্যান্য লোক তার উপস্থিতির অস্বস্তি থেকে রেখাই পাবে আর নিজে তিনি দুঃসহ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবেন কি না। কেমন করে এই পরিবর্তন এল তা বলা অসম্ভব। ক্রমে ক্রমে অলক্ষ্যে ব্যাপারটি ঘটে গেছে। অপর লোক সম্পর্কে তার নিজেরও এই একটিমাত্র কৌতূহলই ছিল।
ক্রমে ক্রমে ঘুম কমে আসে। তাকে আফিম খেতে দেওয়া হয়! মরফিয়া ইনজেকশনও করা হল। কিন্তু দুটোর কোনটাতেই কোন উপশম হল না। তন্দ্রালু অবস্থায় প্রথমে তিনি ঝিমু ঝিমু ভাব অনুভব করলেন। তাতে সামান্য আরাম পেলেন বটে, কিন্তু সে নেহাৎ নতুন অভিজ্ঞতা বলে। পরে এই ব্যবস্থা ব্যথার মত, এমনি কি তার চাইতেও বেশি বিরক্তিকর মনে হত।
ডাক্তারের নির্দেশে তার জন্য বিশেষ পথ্য তৈরি করা হল। কিন্তু সে পথ্যও ক্রমেই বিস্বাদ ও বিরক্তিকর লাগত।
তার মল-মূত্রের জন্যও বিশেষ বন্দোবস্ত করতে হয়! কিন্তু এই বিশেষ ব্যবস্থার অপরিচ্ছন্নতা, অশোভনতা, গন্ধ আর অপর একজনকে এই ব্যাপারে অংশ গ্রহণ করতে হচ্ছে এই অনুভূতির দরুন প্রতিবারেই ব্যাপারটা তার কাছে বিরক্তিকর মনে হত।
তবু এই নেহাৎ অস্বস্তিকর ব্যাপারের মধ্য দিয়েই ইভান ইলিচ স্বস্তি অনুভব করতেন। বাটলারের তরুণ সহকারী গেরাসিম সব সময় ঘরে ঢুকে এই সব নোংরা বাইরে নিয়ে যেত। এই চাষীর ছেলেটি বেশ পরিচ্ছন্ন আর শহুরে খাবার খেয়ে বেশ তাগড়াই চেহারা করে তুলেছে। তাছাড়া সব সময়েই সে হাসিখুশি। প্রথম প্রথম রুশ চাষীর পরিচ্ছন্ন পোশাক পরা ছেলেটিকে মল-মূত্র পরিষ্কার করার মত ঘৃণার কাজ করতে দেখে ইভান ইলিচ বিব্রত বোধ করতেন!
একবার কমোডে পায়খানায় গিয়ে তিনি এত দুর্বল বোধ করেন যে পাতলুন তুলে দেবার শক্তি পর্যন্ত ছিল না। ধপ করে একটা নরম আরাম কেদারায় বসে পড়ে সন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে নিজের নগ্ন বিশীর্ণ পেশী-জাগা উরুর দিকে চেয়ে থাকেন।
কোমরে পাটের পরিচ্ছন্ন এপ্রন জড়িয়ে পা টিপে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে আসে গেরাসিম। তার ভারি বুটজুতোয় আলকাতরা আর টাটকা শীতের বাতাসের গন্ধ। ছাপানো শাটের হাতা দুটো সবল তরুণ বাহুর উপর গুটানো। রুগ্ন প্রভুর মনোভাবের কথা বিবেচনা করেই সে তার দিকে ফিরে চাইল না। যৌবনদীপ্ত মুখের স্বতোৎসারিত আনন্দ চাপা দিয়ে সরাসরি সে কমোডের দিকে এগিয়ে যায়।
দুর্বল কণ্ঠে ইভান ইলিচ ডাক দেন, গেরাসিম।
গেরাসিমের শঙ্কা হয়, কোন গুরুতর অন্যায় করেছে বুঝি। চট করে সদয় সরল কচি মুখখানা ঘুরিয়ে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে প্রভুর দিকে। সবে কচি কোমল দাড়ির রেখা পড়েছে সেই মুখে।
–আজ্ঞে স্যার।
–কাজটা তোমার ভাল লাগে না নিশ্চয়ই। আমায় ক্ষমা কর। বড় অসহায় আমি।
–সেকি স্যার! সুদীপ্ত চোখে চকচকে দাঁত বার করে গেরাসিম।–এ আর কষ্ট কি? আপনার যে অসুখ করেছে স্যার!
সুদক্ষ সবল হাতে অভ্যস্ত কাজটি সেরে পা টিপে টিপে সে বেরিয়ে যায়। মিনিট পাঁচেক পরে আবারও পা টিপে ঘরে ঢেকে গেরাসিম।
সদ্য ধোয়া পাত্রটি যথাস্থানে বসিয়ে দেবার পর ইভান ইলিচ আবারও তাকে ডাক দেন, গেরাসিম, আমায় একটু সাহায্য করে যাও। গেরাসিম তার কাছে এগিয়ে যায়।–আমায় তুলে ধর। উঠতে বড় কষ্ট হচ্ছে আর দিমিত্রিকেও পাঠিয়েছি এক জায়গায়।
সবল হাতে সুকৌশলে কিন্তু সন্তর্পণে প্রভুকে ধরে গেরাসিম। ঠিক যেভাবে সে ঘরে ঢুকেছিল তেমনি সন্তর্পণে। তারপর তাকে দাঁড় করিয়ে এক হাতে ধরে রেখে অপর হাতে পাতলুন টেনে তুলে দেয়। আবারও তাকে বসিয়ে দিত গেরাসিম, কিন্তু তিনি সোফার কাছে নিয়ে যেতে বলেন। বিনা আয়াসে কোন চাপ না দিয়ে সে তাকে প্রায় উঁচু করে সোফার কাছে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দেয়।
–ধন্যবাদ। কেমন সহজে সুন্দরভাবে কাজটুকু করে দিলে!
আবারও গেরাসিমের মুখে হাসি ফোটে এবং সে বেরিয়ে যাবার জন্য পেছন ফেরে। কিন্তু ইভান ইলিচ তার উপস্থিতিতে এমন আরাম বোধ করেছেন যে তাকে যেতে দেবার ইচ্ছা ছিল না।
–আর একটা কথা শোন–চেয়ারটা এগিয়ে দাও। না না, ঐটা…আমার পায়ের তলায় দাও। পা দুটো ভোলা থাকলে ভাল লাগে।
–চেয়ারখানা তুলে এনে যথাস্থানে পেতে দেয় গেরাসিম এবং ইভান ইলিচের পা দুখানা ধরে চেয়ারের উপর তুলে দেয়। ইভান ইলিচের মনে হল যেন গেরাসিম পা দুটো তুলে রাখবার সময় বেশ ভাল লেগেছে।
–পা দুটো বেশ খানিকটা উঁচু থাকলে ভাল লাগে। কুশনটা এনে পায়ের তলায় দিয়ে দাও না।
প্রভুর আদেশ পালন করে গেরাসিম। আবারও পা তুলে ধরে সে কুশনটা পেতে দেয়। গেরাসিম পা তুলে রাখার সময় আবারও ভাল লাগে ইভান ইলিচের। পা দুখানা সে ছেড়ে দেবার পর কেমন অস্বস্তি লাগছে মনে হল।
–এখন আর তোমার বিশেষ কোন কাজ আছে গেরাসিম?
–না স্যার! ভদ্রলোকদের সঙ্গে কেমন করে কথা বলতে হয় গেরাসিম ইতিমধ্যেই তা শহুরে লোকের কাছ থেকে শিখে নিয়েছে।
–কি কি কাজ বাকি আছে?
–কি কি করতে হবে? কালকের জন্য চেলা কাঠ কাটা ছাড়া সব কাজই করে ফেলেছি।
–তাহলে আমার পা দুটো আরও একটু উঁচু করে ধরে রাখ। পারবে তো?
–নিশ্চয়ই পারব। পারব না কেন?
প্রভুর পা দুখানা আরও খানিকটা উঁচু করে ধরে রাখে গেরাসিম। ইভান ইলিচের মনে হল যেন এই অবস্থায় তিনি আর কোন ব্যথাই অনুভব করছেন না।
–কাঠ কাটার কি হবে?
–তার জন্য ভাববেন না স্যার। অনেক সময় রয়েছে তো!
ইভান ইলিচ তখন গেরাসিমকে বসে-বসে পা ধরে রাখতে বলেন। তারপর তার সঙ্গে গল্প জুড়ে দেন। কথাটা অদ্ভুত শোনালেও গেরাসিম পা তুলে রাখার সময় সত্যিই ভাল লেগেছে ইভান ইলিচের।
এরপর মাঝে মাঝে গেরাসিমকে ডেকে তিনি কাঁধের উপর পা তুলে রাখতে বলতেন। তার সঙ্গে গল্প করতেও ভাল লাগত। গেরাসিম এত সহজে, এমন সরলভাবে স্বেচ্ছায় কাজটি করত যে তার সদাশয়তা ইভান ইলিচের হৃদয় স্পর্শ করত। অপরের স্বাস্থ্য বল ও জীবনীশক্তি তিনি দেখতে পারতেন না। কিন্তু গেরাসিমের বল ও জীবনীশক্তি তাকে ক্ষুণ্ণ না করে বরং শান্তিই দিত।
যে কোন কারণেই হোক, সবাই ধরে নিয়েছে যি তিনি মৃত্যুপথযাত্রী নন, শুধু অসুস্থ হয়েছেন মাত্র এবং যদি বিশ্রামে থেকে ঠিক মত চিকিৎসা করান তো অচিরেই সুফল পাওয়া যাবে। এই মিথ্যা প্রবঞ্চনা ইভান ইলিচকে সব চাইতে বেশি মানসিক পীড়া দিত। তিনি অবশ্য জানতেন যে ওরা যা-ই করুক না কেন কিছুই হবে না। শুধু দুঃসহ যন্ত্রণা বেড়ে যাবে আর তার পরিণাম মৃত্যু। সত্যই এই প্রবঞ্চনা তাকে ব্যথিত করত। সবাই যা জানে, তিনি নিজেও যে-কথা বোঝেন, প্রকাশ্যে কেউ তা স্বীকার করতে চায় না। বরং উলটে তার সঙ্কটাপন্ন অবস্থা সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলে। এবং চায়–শুধু চায় কেন, জোর করে তাকে দিয়েও এই মিথ্যাকথা বলাতে চায়। আসন্ন মৃত্যুর প্রাক্কালে তার সম্পর্কে এই মিথ্যাচারণ এবং জীবনের বিভীষিকাময় পবিত্র সমাপ্তিকে সাধারণ দেখা-সাক্ষাৎ, পর্দা আর খাবার টেবিলের সুখাদ্য মাছের পর্যায়ে অবনমিত করার অপচেষ্টা ইভান ইলিচকে দুঃসহ মনস্তাপ দিত।
নিজের সম্পর্কে লোকজনের এই জাতীয় মন্তব্য শুনবার সময় বহুবার অতিকষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি বলেন নিঃ আর মিথ্যে কথা বল না। তুমি জান– আমিও বুঝি যে আমি মরতে চলেছি। কাজেই এ সম্পর্কে আর মিথ্যেকথা না হয় না-ই বললে। অবশ্য এই কথা বলার মত মনোবলও তার ছিল না।
চারপাশের লোকজন তার এই বিভীষিকাময় মর্মান্তিক মৃত্যুযাত্রাকে যেন একটা আকস্মিক অস্বস্তিকর প্রায় অশিষ্ট ঘটনার পর্যায়ে এনে ফেলেছে। এ যেন লোকের পক্ষে বিচ্ছিরি গন্ধ ছড়িয়ে বৈঠকখানায় ঢোকার মত ঘটনা। আজীবন তিনি নিজে যে শিষ্টাচারের সেবা করে এসেছেন, তারাও ঠিক সেই শিষ্টাচার-সম্মত পদ্ধতিতেই কাজটি করছে। বেশ বুঝতে পারছেন, কেউ তার জন্য সমবেদনা বোধ করে না। কারণ তার এই অবস্থা কারও কাম্য নয়। শুধু গেরাসিমই উপলব্ধি করে এবং তার প্রতি করুণা করে। কাজেই একমাত্র তার সান্নিধ্যেই স্বস্তিবোধ করেন ইভান ইলিচ। গেরাসিম তার পা দুটো ধরে রাখত (মাঝে মাঝে সারা রাতও রেখেছে) এবং বিছানায় যেতে অস্বীকার করে বলত; আপনি ব্যস্ত হবেন না ইভান ইলিচ, পরে আমি ঘুমোবার ঢের ঢের সময় পাব। কিংবা পরিচিতের ভঙ্গীতে আচমকা সে বলে উঠত : আপনি অসুস্থ না হলে আলাদা কথা ছিল, কিন্তু এই অবস্থায় একটু কষ্ট করতে আপত্তি করব কেন? তখন সত্যিই তিনি পরম স্বস্তি বোধ করতেন। একমাত্র গেরাসিমই মিথ্যাকথা বলে না। হালচাল দেখে বোঝা যায়, একমাত্র সে-ই তার প্রকৃত অবস্থা উপলব্ধি করেছে এবং সে-কথা গোপন করার কোন আবশ্যকতা বোধ করে না, বরং বিশীর্ণ দুর্বল প্রভুর জন্য দুঃখবোধ করে। একদিন ইভান ইলিচ যখন তাকে চলে যেতে বলেন গেরাসিম সরাসরি বলে বসে : আমাদের সবাইকেই একদিন মরতে হবে, কাজেই সামান্য কষ্ট করতে আপত্তি করব কেন? তার মানে সে বলতে চাইছিল : মুমূর্ষ একটা লোকের জন্য একাজ করছে বলে এটা সে বোঝ বলে গণ্য করে না এবং আশা করে যে তার কাল এলেও অপরে তার জন্য এটুকু করবে।
এই মিথ্যাচার ছাড়া, কিংবা হয়তো এর জন্যই একটা জিনিস ইভান ইলিচকে সব চাইতে বেশি ব্যথা দিত : করুণার জন্য যখন তিনি কাঙাল হয়ে ওঠেন, কেউ তখন তার প্রতি দরদ বা সমবেদনা দেখায় না। একটানা কিছুক্ষণ কষ্ট ভোগের পর তিনি চাইতেন যে কেউ তার প্রতি রুগ্ন শিশুর মত সমবেদনা দেখাক। অথচ মুখ ফুটে কথাটা বলতে সঙ্কোচ বোধ করতেন। সাধ হত, কেউ তার গায়ে হাত বুলিয়ে দিক সান্ত্বনা দিক। তিনি জানতেন যে তিনি একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী আর তার দাড়িতেও পাক ধরেছে, কাজেই যা তিনি চাইছেন. তা পূরণ হবার নয়। তবু সাধ হত। কিন্তু তিনি যা চান গেরাসিমের মনোভাবের সঙ্গে তার খানিকটা মিল আছে। সুতরাং তার মনোভাবে সান্ত্বনা পেতেন। কাঁদতে ইচ্ছে করত ইভান ইলিচের। ইচ্ছে হত কেউ তাকে আদর করুক…চোখের জল ফেলুক তার জন্য। তারপর তার সহকর্মী শেবক হয়তো ঘরে ঢুকত। কান্না বন্ধ করে, আদর পাবার আশা ছেড়ে সঙ্গে সঙ্গে ইভান ইলিচ কঠোর গম্ভীর হয়ে পড়তেন এবং অভ্যাসবশে আপীল আদালতের কোন রায় সম্পর্কে মতামত ব্যক্ত করে নিজের অভিমত সত্য বলে প্রতিপন্ন করতে চাইতেন। চারপাশের এবং নিজের অন্তরের এই মিথ্যাচার তার শেষের দিন কটি বিষিয়ে তোলে।
***
ভোর হয়েছে। ইভান ইলিচ বুঝতে পারেন যে ভোর হয়েছে। কেননা গেরাসিম চলে গেছে আর বেয়ারা পেতর এসে মোম নিভিয়ে জানালার একটা পর্দা টেনে দিয়ে সন্তর্পণে ঘরের জিনিস-পত্তর গোছগাছ করছে। সকাল হোক কি সন্ধ্যা, হোক শুক্রবার তোক কি রবিবার হোক ইভান ইলিচের কাছে সবই আজ সমান। সেই নিরবচ্ছিন্ন দুঃসহ খামচে ধরার মত ব্যথাটা পলকের জন্যও কমে না। স্পষ্ট বোঝ যাচ্ছে, জীবনের দীপ ম্লান হয়ে আসছে কিন্তু নিভে যায়নি এখনও। এগিয়ে আসছে জীবনের পরম সত্য সেই চির-বিভীষিকাময় চির-ঘৃণাহ মৃত্যু। তবু চারিদিকে সর্বক্ষণ মিথ্যার বেড়াজাল। এ অবস্থায় দিন-ক্ষণ সপ্তাহের মূল্য কি?
–চা খাবেন স্যার?
ইভান ইলিচ ভাবেন, ও সব জিনিস গোছ-গাছ করতে চায় আর ভাবে যে ভদ্রলোকদের সকালবেলা চা খাওয়া উচিত। মুখে বলেন, না।
–ঐ সোফাটায় উঠে বসবেন স্যার?
আবার তিনি ভাবেন, ঘরটা ও গোছগাছ করতে চায় কিন্তু আমি বাধা দিচ্ছি। আমি যেন নোংরামি আর বিশৃঙখলার প্রতীক। তবু মুখে বলেন, দরকার নেই, আমায় একলা থাকতে দাও।
লোকটি তখন ঘরের মধ্যে ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে চলাফেরা করে। ইভান ইলিচ হাতখানা বাড়িয়ে দেন। অমনিই সাহায্যের জন্য ছুটে আসে পেতর।
–-কি চাই স্যার?
–ঘড়িটা। হাতের কাছেই ছিল ঘড়িটা। সেটা তুলে নিয়ে পেতর প্রভুর হাতে দেয়।
–সাড়ে আটটা! ওরা উঠেছে?
–না স্যার। স্কুলে যাবেন বলে ভাদিমির ইনিচ (পুত্র) উঠেছেন মাত্র। প্রাসকভিয়া ফেদরভনা বলেছেন, আপনি ডাকলে যেন তার ঘুম ভাঙানো হয়। ডাকব স্যার?
–দরকার নেই। মনে মনে ভাবেন : তার চাইতে বরং একটু চা খেলে হয়তো ভাল হয়। বলেন, হ্যাঁ, একটু চা-ই নিয়ে এস।
পেতর দরজা অবধি যায়। কিন্তু একলা থাকতে ভয়-ভয় করে ইভান ইলিচের।-কি করেই বা ওকে রাখা যায়? ঠিক হয়েছে, ওষুধ খেতে হবে। ডেকে বলেন, আমার ওষুধটা দাও তো পেতর। মনে মনে ভাবেন : খাব না কেন? এখনও হয়তো কিছুটা উপকার করতে পারে। এক চামচ ওষুধ নিয়ে তিনি গিলে ফেলেন। কিন্তু ওষুধের পরিচিত বিচ্ছিরি স্বাদ অনুভব করে পরক্ষণেই ভাবেন : না, কোন উপকার হবে না। সব বাজে, সব আত্মপ্রবঞ্চনা। না, আর এর উপর আস্থা রাখা যায় না। কিন্তু ব্যথাটা…ব্যথাটা হচ্ছে কেন? পলকের জন্যও এর হাত থেকে যদি রেহাই পেতাম! সঙ্গে সঙ্গে তিনি ঝাঁকিয়ে ওঠেন। অমনিই পেতর ফিরে তাকায়।– ঠিক আছে! যাও, চা-টা নিয়ে এস।
পেতর বেরিয়ে যায়। মারাত্মক যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছিলেন তিনি। তবু একলা থাকার সময় তার জন্য কঁকালেন না। কঁকালেন মানসিক যন্ত্রণায়। দিন নেই, রাত্রি নেই, সদাসর্বক্ষণ ক্লান্তিহীন একই অবস্থা। ভবিতব্য যদি চটপট এগিয়ে আসত। কোন্ ভবিতব্য এগিয়ে আসবে? মৃত্যু-তিমিরাবরণ?… না না! মৃত্যুর চাইতে অপর যে কোন কিছু শ্রেয়।
পেতর চা নিয়ে এলে আচমকা তিনি বিভ্রান্তের মত তার দিকে তাকান। যেন বুঝতে পারেননি সে কে ও কি। প্রভুর এই চাহনিতে পেতরও খানিকটা বিমূঢ় হয়ে পড়ে। তার বিব্রত ভাবে ইভান ইলিচের হুঁশ হয়।
–ওঃ, চা, ঠিক আছে, রেখে দাও। হাতমুখ ধুয়ে আমায় একটা পরিচ্ছন্ন শার্ট পরতে সাহায্য কর তো!
ইভান ইলিচ হাত-মুখ ধুতে আরম্ভ করেন। জিরিয়ে জিরিয়ে প্রথমে তিনি হাত ধুয়ে নেন, তারপর মুখ ধুলেন। দাঁত পরিষ্কার করে এবং চুল আঁচড়ে তিনি আয়নায় মুখ দেখেন। মুখের চেহারা দেখে আঁতকে ওঠেন। বিশেষ করে বিবর্ণ কপালে ঝুলে-পড়া শিথিল চুলগুলোই তাকে আতঙ্কিত করে তোলে।
তিনি বুঝতে পারলেন যে শার্ট বদলাবার সময় নিজের কৃশ চেহারার দিকে তাকালে আরও ভড়কে যাবেন; তাই সেদিকে চাইলেন না। জামা বদলানো হয়ে গেল। একটা ড্রেসিং-গাউন গায়ে জড়িয়ে তিনি চা খাবার জন্য আরাম কেদারায় বসে পড়লেন। পলকের জন্য বেশ ভাল লাগল। কিন্তু চা খেতে শুরু করবার সঙ্গে সঙ্গে আবার সেই বিচ্ছিরি স্বাদটা অনুভব করলেন–ব্যথাটাও লাগে। অতিকষ্টে তিনি চা খাওয়া শেষ করলেন এবং পেতরকে বিদায় করে পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লেন।
সব সময় একই অবস্থা। কখনও আশার ঝিলিক দেখা যায়, আবার পরক্ষণেই হতাশার সমুদ্র ফুঁসে ওঠে। ব্যথা সব সময়েই আছে। সব সময় বেদনার অনুভূতি, সর্বদা হতাশা–সব সময় একই অবস্থা। একলা থাকবার সময় আর কাউকে ডাকার প্রবল ইচ্ছা হত। কিন্তু এও তার জানা ছিল যে অপর কেউ এলে অবস্থা আরও খারাপ হবে।
–বোধশক্তি লোপ করার জন্য আর এক মাত্রা মরফিয়া আবশ্যক। এবার ডাক্তারকে অন্য কোন ওষুধের ব্যবস্থা করার কথা বলতে হবে। এভাবে বেঁচে থাকা অসম্ভব–সত্যি অসম্ভব।
এই ভাবে ঘণ্টাছয়েক কেটে যায়। এইবার দরজায় একটা ঘণ্টার শব্দ শোনা গেল। ডাক্তার এল কি? সত্যিই তাই। হাসি-খুশি মুখে নধরকান্তি সহৃদয় ডাক্তার ঘরে ঢুকলেন। তার প্রসন্ন দৃষ্টি যেন বলতে চাইছে : ভড়কে গেছেন তো, দাঁড়ান এখুনি সব ঠিক করে দিচ্ছি। ডাক্তার জানেন যে তার এই মুখ-ব্যঞ্জনা এই রোগীর কাছে অচল। কিন্তু এ ভঙ্গী তিনি বরাবরের জন্য গ্রহণ করেছেন, কখনও তা পরিহার করা সম্ভব নয়। লোকজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য কোন লোক যদি সকালবেলা ফ্রক কোট পরে তো তার যেমন পোশাক বদলানো হয় না, ডাক্তারের অবস্থাও সেইরকম।
ডাক্তার বেশ জোরে জোরে হাত রগড়ান।
–ওঃ, কি বেজায় ঠাণ্ডা! বাইরে কনকনে তুষার পড়ছে! আগে একটু গরম হয়ে নেওয়া যাক।
ডাক্তারের কথার ভাবে মনে হয় যেন সে গরম হতে পারলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
–আচ্ছা, এখন বলুন কেমন আছেন?
ইভান ইলিচের মনে হল যেন ডাক্তার বলতে চাইছিল : হ্যাঁ, আমাদের ব্যাপারটা কেমন চলছে? ডাক্তারও বুঝতে পারলেন, যে এ কথায় কোন কাজ হবে না। তাই বললেন, রাতটা কেমন কেটেছে বলুন।
ইভান ইলিচ তার মুখের দিকে চেয়ে বলতে চাইছিলেন : মিথ্যা কথা বলতে লজ্জা করে না? কিন্তু ডাক্তার এই প্রশ্ন বুঝতে চান না। তাই বললেন, আগের মতই দুঃসহ। ব্যথা কমেও না আর ছেড়েও যায় না। যদি অপর কোন…
–হাঁ, রোগীদের ঐ এক কথা। এইবার, খানিকটা গরম হওয়া গেছে দেখছি। প্রাসকভিয়া ফেরভনার মত হুঁশিয়ার মহিলাও আমার মেজাজের প্রশংসা করেন। আসুন, এবার স্বাগতম জানানো যাক। রোগীর হাত চেপে ধরেন ডাক্তার।
তারপর দিলদরিয়া ভাব ত্যাগ করে গম্ভীর মুখে তিনি রোগীকে পরীক্ষা করতে থাকেন। প্রথমে নাড়ী দেখেন, তারপর জ্বর পরীক্ষা করেন…তারপর নানাভাবে শব্দ করে রোগীর এটা-সেটা পরীক্ষা করে দেখেন।
ইভান ইলিচ ভালমত জানেন যে এই সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পূর্ণ অর্থহীন– নিছক ভড়ং। তবু ডাক্তার যখন হাঁটু ভেঙে বসে তার উপর ঝুঁকে কান লাগিয়ে প্রথমে তার বুক তারপর পেট পরীক্ষা করেন এবং অর্থপূর্ণ গম্ভীর মুখে তার উপর হরেক রকম জিমনাস্টিকের ভাবভঙ্গী দেখান ইভান ইলিচ তখন চুপ করেই ছিলেন। আদালতেও এমনি নীরবে তিনি উকিলদের সওয়াল শুনেছেন। যদিও তিনি ভাল মতই জানতেন যে তারা মিথ্যেকথা বলছে এবং কেন বলছে সে-কথা।
সোফার উপর হাঁটু ভেঙে ডাক্তার তার পরীক্ষা শেষ করবার আগেই দরজায় প্রাসকভিয়া ফেদরভনার রেশমি পোশাকের খসখসানি শোনা যায়।-ডাক্তার আসার সংবাদ যথাসময়ে তাকে না দেবার জন্য পেতরকে ধমকাচ্ছিলেন তিনি।
ভেতরে ঢুকে প্রথমেই তিনি স্বামীকে চুমু খান এবং সঙ্গে সঙ্গে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে অনেক আগেই তিনি উঠেছেন কিন্তু সামান্য ত্রুটির জন্য ডাক্তার আসার সময় উপস্থিত থাকতে পারেননি।
স্ত্রীর দিকে চেয়ে ইভান ইলিচ তার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে দেখেন। তার শুভ্রতা, তার নধর কান্তি, তার হাত ও ঘাড়ের পরিচ্ছন্নতা, চিকন চুল আর তার উজ্জ্বল চোখের দীপ্তির সঙ্গে তিনি নিজের অবস্থা তুলনা করেন। সর্বান্তকরণে স্ত্রীকে ঘৃণা করেন তিনি। এই ঘৃণার জন্য তার স্পর্শেও বিরক্ত বোধ করেন।
ইভান ইলিচের অসুখ এবং তার নিজের সম্পর্কে প্রাসকভিয়ার মনোভাব এখনও আগের মত আছে। ডাক্তার যেমন রোগী সম্পর্কে অপরিবর্তনীয় এক মনোভাব অবলম্বন করেছেন এবং এখন আর সেই মনোভাব পরিহার করতে পারছেন না, ইভান ইলিচের অসুখ সম্পর্কে প্রাসকভিয়ার মনোভাবও সেই ধরনের। তার ধারণা : করণীয় একটা কিছু তিনি করছেন না এবং সেজন্য তিনি নিজেই দায়ী। এই ত্রুটির জন্য মোলায়েমভাবে স্বামীকে তিনি ভর্ৎসনাও করতেন।
–জানেন, উনি আমার কথা শোনেন না আর যথাসময়ে ওষুধও খান না। এমনভাবে শুয়ে থাকেন যা ওর পক্ষে নিশ্চয়ই অনিষ্টকরপা দুটো উঁচু করে রাখেন।
গেরাসিম কি ভাবে পা দুটো ধরে রাখে এরপর তিনি তার বর্ণনা দেন।
ডাক্তার খানিকটা অবজ্ঞাভরা করুণার হাসি হাসেন। সে হাসির অর্থ : কি করা যাবে বলুন, রোগীদের অমন দুচারটে নির্বোধ খেয়াল থাকে, কিন্তু তার জন্য ওরা ক্ষমার যোগ্য।
পরীক্ষা শেষ করে ডাক্তার ঘড়ির দিকে তাকান। প্রাসকভিয়া ফেদরভনা তখন ইভান ইলিচকে জানান যে তার ইচ্ছা অনুসারেই কাজ হবে, তবু আজ তিনি বিখ্যাত এক বিশেষজ্ঞকে ডেকে পাঠিয়েছেন। তিনি এসে পরীক্ষা করে তাদের বর্তমান চিকিৎসক মিখাইল দানিভিচের সঙ্গে পরামর্শ করবেন।
— দোহাই তোমার, আপত্তি করি না। আমার নিজের জন্যই এতসব করছি। খোঁচা দিয়েই বলেন প্রাসকভিয়া। তিনি বুঝিয়ে দিতে চান যে স্বামীর জন্যই তিনি এতসব করছেন, শুধু তার মুখ বন্ধ করার জন্য কথাটা বললেন। ভুরু কুঁচকে চুপ করে থাকেন ইভান ইলিচ। বেশ বুঝতে পারেন যে এমন মিথ্যা প্রবঞ্চনার বেড়াজাল তাকে ঘিরে ধরেছে যে কোনভাবে এর হাত থেকে ত্রাণ পাবার উপায় নেই।
স্বামীর জন্য প্রাসকভিয়া যা করছিলেন তার সব কিছুই আসলে তার নিজের জন্য। আর নিজের জন্য প্রকৃতপক্ষে যা করছেন সে কথাটা এমন অদ্ভুতভাবে বললেন যাতে স্বামী তার বিপরীত অর্থ করে বসেন।
সাড়ে এগারটার সময় প্রখ্যাত বিশেষজ্ঞ আসেন। আবারও নানাভাবে শব্দ করে পরীক্ষা চলে। রোগীর সামনে এবং পাশের ঘরে মূত্রাশয় আর এপেনডিকস্ নিয়ে শাস্ত্রীয় আলোচনা করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদও করা হয় কিছু কিছু। এমন ভারিক্কি চালে আলোচনা করা হয় যাতে রোগীর জীবন-মৃত্যুর সমস্যার পরিবর্তে প্রশ্নটি মূত্রাশয় আর এপেনডিসের গলদের সমস্যা হয়ে ওঠে এবং মিখাইল দানিলভিচ আর বিশেষজ্ঞ এই প্রত্যঙ্গ-দুটির বেয়াড়াপনার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রস্তুত হন।
গম্ভীর মুখে প্রখ্যাত বিশেষজ্ঞ বিদায় নেন। তবে তার মুখে হতাশার ভাব ছিল। আশাভরা কাতর দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে সসঙ্কোচে ইভান ইলিচ জিজ্ঞাসা করেছিলেন, সেরে উঠবার কোন আশা আছে কি না। উত্তরে বিশেষজ্ঞ জানান, হলপ করে বলা চলে না, তবে আশাও যে নেই এমন নয়। ইভান ইলিচ এমন করুণ দৃষ্টিতে ডাক্তারের দিকে চেয়েছিলেন যে তাই দেখে ডাক্তারকে ফি দেবার জন্য বেরিয়ে যাবার সময় প্রাসকভিয়া ফেদরভনার চোখেও জল এল।
ডাক্তারের ভরসায় যে আশার আলো জ্বলেছিল তা দীর্ঘস্থায়ী হল না। সেই ঘর, সেই ছবি, সেই পর্দা, সেই দেয়ালে লাগানো কাগজ আর ওষুধের বোতল সর্বোপরি সেই বেদনা আগের মতই রয়ে গেল। ইভান ইলিচ আবারও কঁকাতে শুরু করলেন। ডাক্তার তার চামড়ার তলায় একটা ইনজেকশন দিলেন। একটু বাদেই তিনি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লেন।
গোধূলির সময় তার ঘোর কেটে যায়। তখন তার খাবার দেওয়া হল। কোনক্রমে তিনি কয়েক টুকরো মাংস আর চা গিললেন। তারপর আবার সাবেক অবস্থা দেখা দেয়। তখন রাত হয়ে এসেছে।
খাবার পর রাত সাতটার সময় সান্ধ্য পোশাক পরে প্রাসকভিয়া ফেদরভনা ঘরে এলেন। তার কাঁচুলি-পরা পরিস্ফীত স্তনযুগল পীনোন্নত। মুখমণ্ডলে পাউডারের দাগও ছিল। সকালবেলা স্বামীকে তিনি জানিয়ে ছিলেন যে সন্ধ্যাবেলা তারা সবাই থিয়েটারে যাবেন। অভিনেত্রী সারা বারনহার্ড শহরে এসেছে, তাই তারা আগাম একটা বক্স রিজার্ভ করে রেখেছিলেন। বক্সটা নেবার কথা ইভান ইলিচ নিজেই বলেছিলেন। এখন সে কথা তিনি ভুলে গেছেন; তাই স্ত্রীর প্রসাধন তাকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। অথচ নিজেই তিনি বক্স রিজার্ভ করার জন্য পীড়াপীড়ি করেছিলেন এবং এর মধ্যে শিক্ষণীয় আর নির্দোষ আনন্দের জিনিস আছে বলে ছেলে-মেয়েদেরও নিয়ে যেতে বলেছিলেন-সহসা কথাটা মনে পড়ায় বিরক্তিটা চেপে যান।
আত্মপ্রসাদ নিয়েই ঘরে ঢোকেন প্রাসকভিয়া ফেদরভনা, তবু তার মধ্যে একটা অপরাধীর মত ভাব ছিল। স্বামীর পাশে বসে তিনি কুশলবাদ জিজ্ঞাসা করেন। ইভান ইলিচ স্পষ্টই বুঝতে পারলেন, এ নিছক লৌকিকতা–তার রোগ সম্পর্কে জানবার প্রকৃত আগ্রহ প্রাসকভিয়ার নেই। প্রাসকভিয়া ফেদরভনার ধারণা, জানবার কিছুই নেই। তাই শেষ অবধি তিনি আসল কথা পাড়লেন। বললেন : কোনক্রমেই তার যাবার ইচ্ছে ছিল না… তবে বক্সটা নেহাৎ রিজার্ভ করা হয়ে গেছে, আর হেলেন এবং তাদের মেয়ে যাচ্ছে, আর সঙ্গে পেত্রিশচেভও থাকবে (তদন্তকারী ম্যাজিস্ট্রেট-কন্যার প্রণয়ী), তাই না গিয়ে পারছেন না; কারণ ওদের তো আর একলা যেতে দেওয়া চলে না! তবু ইভান ইলিচের পাশে কিছুক্ষণ বসতে পারলেই তিনি খুশী হতেন। যাই হোক, তার অনুপস্থিতিতে ডাক্তারের নির্দেশ যাতে পালন। করা হয় তার জন্যও তিনি হুঁশিয়ার করে দিয়ে যান।
–ওঃ, ফেদর পেত্রোভিচ (প্রণয়ী) ভেতরে আসতে চায়। আসবে? কি গো?
–আসুক।
সান্ধ্য বেশবাসে সজ্জিত মেয়েটি ঘরে ঢোকে। তার যৌবনদীপ্ত পেলব দেহ লাবণ্য স্বাস্থ্য ও শক্তির জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। আর এই দেহই ইভান ইলিচের যত ক্লেশের কারণ। ভাব-ভঙ্গীতে স্পষ্টই বোঝা যায় যে মেয়েটি প্রেমে পড়েছে আর রোগ ক্লেশ এবং মৃত্যুকে ঘৃণা করে; কেননা এরা তার সুখের পরিপন্থী।
ফেদর পেত্রোভিচও ঢোকে। তারও পরনে সান্ধ্য পোশাক। যুবকটির চুল কায়দা করে আঁচড়ানো। শিরাল গলায় আঁটসাট শক্ত কলার। সাদা শার্টের বুক অনেকটা নেমে এসেছে। সরু কাল ট্রাউজারের পা দুটো আঁটসাট ভাবে উরুর সঙ্গে জড়ানো। তার একহাতে সাদা দস্তানা। অপেরায় যাবার টুপিটি হাতে ধরে রেখেছে।
নতুন উর্দি আর হাতে দস্তানা পরে স্কুলের ছাত্রটিও তার পিছু পিছু অলক্ষ্যে ঘরে ঢোকে। পুত্রের চোখের নিচে গভীর কাল রেখা। এর অর্থ ইভান ইলিচের অজানা নয়।
ছেলের দিকে চাইলে বরাবর তার দুঃখ হত। তার এখনকার সশঙ্কিত ভীরু চাহনি আরও বিভীষিকাময়। ইভান ইলিচের মনে হল যেন গেরাসিম ছাড়া একমাত্র ভাগ্যই তার অবস্থা বোঝে এবং তার জন্য সমবেদনা বোধ করে।
সবাই বসে আবারও তার শরীরিক অবস্থার খোঁজখবর জিজ্ঞাসা করে। তারপর কিছুক্ষণ সবাই চুপ করে থাকে। লিসা তখন মায়ের কাছে অপেরা-গ্লাসের খোঁজ জিজ্ঞাসা করে। তারপর কে সেটা নিয়েছিল এবং কোথায় রেখেছিল তাই নিয়ে মা-মেয়ের মধ্যে কিছুটা বাদানুবাদ হয়। ফলে একটা অপ্রীতিকর অবস্থা দেখা দেয়।
ফেদর পেত্রোভিচ তখন ইভান ইলিচকে জিজ্ঞাসা করে যে সারা বার্ণহার্ডকে কখনও তিনি দেখেছেন কি না। ইভান ইলিচ প্রথমে প্রশ্নটার অর্থ ধরতে পারেন নি। তারপর বলেন, না, তুমি দেখেছ কখন?
–হ্যাঁ।
একখানি ফরাসি নাটকের নাম করে পেত্রোভিচ।
সারা বার্ণহার্ড ভাল অভিনয় করেছে এমনি খানকয়েক নাটকের নাম করেন প্রাসকভিয়া ফেদরভনা। কন্যা মায়ের কথার প্রতিবাদ জানায়। এরপর তার অভিনয়ের দক্ষতা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। এমনি আলোচনা বারংবার হয়ে থাকে আর তার প্রকৃতিও একই ধরনের।
এই আলোচনার মধ্যে আড়চোখে ইভান ইলিচের দিকে চেয়ে নীরব হয়ে যায় ফেদর পেত্রোভিচ। আর সকলেও তখন তার দিকে চেয়ে চুপ করে। ভাস্বর চোখে সরাসরি সুমুখে চেয়েছিলেন তিনি। স্পষ্টই বোঝা যায় যে রেগেছেন। এই ত্রুটি সংশোধন করা দরকার অথচ তার কোন সম্ভাবনা ছিল না। নীরবতা ভাঙতে হবে, কিন্তু কিছুক্ষণ সে সাহস কারও হল না। সবাই ভয় পেল, কারণ তাতে যে ভব্য প্রতারণার ফন্দি স্পষ্ট হয়ে উঠবে এবং আসল সত্য কথাটা সকলের কাছে ধরা পড়বে। কিন্তু লিসাই ভরসা করে নীরবতা ভাঙে। তবে সবাই যে-কথাটা চাপা দেবার চেষ্টা করছিল, লিসার এই সাহসে তা ধরা পড়ে যায়।
বাবার দেওয়া ঘড়ির দিকে চেয়ে আর ফেদর পেত্রোভিচের উদ্দেশ্যে মুচকি হেসে সে বলে, যদি যেতে হয় তো সময় হয়ে গেছে। এই মুচকি হাসির অর্থ শুধু তারা দুজনেই জানে। পোশাক খসখস করে সে উঠে পড়ে।
সবাই তখন একে একে উঠে দাঁড়ায় এবং ইভান ইলিচের কাছে বিদায় নিয়ে চলে যায়।
ওরা চলে গেলে ইভান ইলিচ যেন কতকটা স্বস্তি বোধ করেন। ওদের সঙ্গে সঙ্গে মিথ্যা ভানও শেষ হয়েছে। কিন্তু ব্যথাটা আগের মতই রয়ে গেল যে! একই ধরনের ব্যথা, একই বিভীষিকা সব কিছু একঘেঁয়ে করে তোলে। বাড়েও না, আবার কমেও না। মোটামুটি বলতে গেলে তার অবস্থার আরও অবনতি ঘটেছে।
আবার মিনিটের পর মিনিট, ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে যায়। সব কিছু একই রকম থাকে– কোনটারই বিরাম নেই। এবং এর অনিবার্য পরিণতি ক্রমান্বয়ে দুঃসহ হয়ে ওঠে।
–হ্যাঁ, গেরাসিমকে পাঠিয়ে দাও। পেতরের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন তিনি।
***