১০
মগনলালপর্বের পরেও একই রাত্রে যে আরও কিছু ঘটতে পারে সেটা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। অথচ লুম্বিনী হোটেলে ফেরার পর আরও দুটো এমন ঘটনা ঘটল, যার ফলে এই বিশেষ দিনটা আমার জীবনে চিরকালের মতো একটা লাল-তারিখ মার্কা দিন হয়ে রইল।
হোটেলে ফিরে রিসেপশনের বেঞ্চিতে হরিনাথ চক্রবর্তীকে বসে থাকতে দেখে রীতিমত অবাক হলাম। এত রাত্রে কী ব্যাপার? বললেন প্রায় এক ঘণ্টা, মানে সাড়ে দশটা থেকে, ভদ্রলোক অপেক্ষা করছেন আমাদের জন্য, বিশেষ দরকার।
‘আসুন আমাদের ঘরে,’ বলল ফেলুদা।
ঠাণ্ডা মানুষটার মধ্যে বেশ একটা চাপা উদ্বেগের ভাব লক্ষ করছিলাম।
‘কী ব্যাপার বলুন তো?’ ঘরে এসে ভদ্রলোককে সোফায় বসিয়ে প্রশ্ন করল ফেলুদা।
ভদ্রলোক একটুক্ষণ সময় নিয়ে যেন তাঁর চিন্তাগুলোকে গুছিয়ে নিলেন। তারপর বললেন, ‘হিমাদ্রি এইভাবে চলে যাওয়াতে সব যেন কেমন গণ্ডগোল হয়ে গিয়েছিল। আর সত্যি বলতে কী, এও মনে হচ্ছিল যে, তাকে যখন আর ফিরিয়ে আনা যাবে না, তখন এত কথা বলেই বা লাভ কী?’
‘কীসের কথা বলছেন আপনি?’
‘বছর তিনেক আগে,’ একটু দম নিয়ে বললেন হরিনাথবাবু, ‘হিমাদ্রি এখানে একটা চোরা কারবারের ব্যাপার ধরিয়ে দিয়েছিল। গাঁজা চরস ইত্যাদি গোপনে চালান যাচ্ছিল এখান থেকে। হিমাদ্রি ছিল ভয়ানক রেকলেস অ্যাডভেঞ্চার-প্রিয় ছেলে। নিজের জীবনের কোনও তোয়াক্কা করত না। স্মাগলিং যে হচ্ছে সেটা শোনা যাচ্ছিল, কিন্তু ঘাঁটিটা কোথায় জানা যাচ্ছিল না। আপনাকে আগেই বলেছি যে হিমাদ্রিকে হেলিকপটরে নেপালের উত্তর-দক্ষিণ দুদিকেই যেতে হত। একবার উত্তরে গিয়ে সে নিজেই অনুসন্ধান করে জানতে পারে যে ঘাঁটিটা হচ্ছে হেলাম্বুর কাছে একটা শেরপাদের গ্রামে। সে পুলিশকে খবর দেয়। ফলে দলটা ধরা পড়ে।’
ভদ্রলোক একটু থামলেন। ফেলুদা বলল, ‘আপনার কি ধারণা ইদানীং সে এই ধরনের আরেকটা চোরা কারবারের সন্ধান পেয়েছিল?’
‘আমাকে সে কিছু বলেনি,’ বললেন হরিনাথবাবু, ‘তবে ও মারা যাবার দিন পাঁচেক আগে থেকে দুই বন্ধুতে উত্তেজিত হয়ে আলোচনা করতে দেখেছি। তার কিছু কিছু কথা আমার কানেও এসেছিল। আমি ওকে বলেছিলাম, তুই এসব গোলমালের মধ্যে আর যাস না। এসব গ্যাঙ বড় সাংঘাতিক হয়; এদের দয়ামায়া বলে কিছু নেই। ও আমার কথায় কান দেয়নি।’
ফেলুদা গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল।
‘ওরা যে নির্মম হয় সেটা তো অনীকেন্দ্র সোমের খুন থেকেই বুঝতে পারছি।’
‘আমার বিশ্বাস হিমু টেট্যানাসে না মরলে ওকেও হয়তো এরাই মেরে ফেলত।’
‘এটা কেন বলছেন?’
ভদ্রলোক পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ বার করে ফেলুদার হাতে দিলেন। খাতার পাতা থেকে ছেঁড়া কাগজ। তাতে লাল কালি দিয়ে দেবনাগরীতে লেখা এক লাইন কথা।
‘এটা ছিল হিমুর একটা প্যান্টের পকেটে। ও মারা যাবার পর আমার চাকর পেয়ে আমাকে দেয়।’
‘নেপালি ভাষা বলে মনে হচ্ছে?’ ফেলুদা বলল।
‘হ্যাঁ। ওর মোটামুটি বাংলা হচ্ছে—তোমার বাড় বড্ড বেড়েছে।’
ফেলুদা কাগজটা ফেরত দিয়ে একটা শুকনো হাসি হেসে বলল, ‘সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, জাল ওষুধের চোরা কারবার বন্ধ করতে গিয়ে আপনার পুত্রকে সেই জাল ওষুধের ইনজেকশনেই মরতে হল!’
‘আপনি তা হলে বিশ্বাস করেন যে ইনজেকশনে ভেজাল ছিল?’
‘আমার তো তাই বিশ্বাস। সেটা ঠিক কি না সেটা কাল জানতে পারব বলে আশা করছি।’
ডাঃ দিবাকরকে যে ওষুধ টেস্ট করতে বলা হয়েছে সেটা ফেলুদা হরিনাথবাবুকে বলল। ভদ্রলোক উঠে পড়লেন।
‘জানি না এসব তথ্য জেনে আপনার কোনও লাভ হল কি না,’ দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন হরিনাথ চক্রবর্তী।
‘আমার মনের কিছু অস্পষ্ট ধারণা খানিকটা স্পষ্ট হল।’ বলল ফেলুদা। ‘তদন্তের ব্যাপারে সেটা একটা মস্ত লাভ।’
হরিনাথবাবু যাবার সঙ্গে সঙ্গে লালমোহনবাবুও গুডনাইট করে চলে গেলেন তাঁর ঘরে।
আমি শুয়ে পড়লাম, যদিও ফেলুদার হাবভাবে মনে হচ্ছে বেড-সাইড ল্যাম্প এখন জ্বলবে কিছুক্ষণ।
আজকের রাতটা কী অদ্ভুত ভাবে গেল, হিমাদ্রিবাবুর চোরা কারবারিদের ধরিয়ে দেওয়া, মগনলাল কী সাংঘাতিক লোক, কী বেপরোয়াভাবে ফেলুদাকে শাসিয়ে দিল—এইসব ভাবতে ভাবতে চোখের পাতা দুটো বুজে এসেছে, এমন সময় হঠাৎ দরজার বেলটা বেজে উঠল।
সোয়া বারো। এই সময় আবার কে এল?
উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখি তাজ্জব ব্যাপার।
লালমোহনবাবু। বাঁ হাতে এক টুকরো কাগজ, ডান হাতে জপযন্ত্র। মুখের হাসিটাকে লামা-স্মাইল ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। এরকম অমায়িক, স্নিগ্ধ হাসি আজকের দিনে চট করে কোনও সেয়ানা শহুরে লোকের মুখে দেখা যায় না।
‘হুম্ হুম্ হুম্!’
তিনবার হুম্ শব্দটা উচ্চারণ করে জপযন্ত্র ঘোরাতে ঘোরাতে ভদ্রলোক ঢুকে এলেন ঘরের ভেতর।
ফেলুদা খাটে উঠে বসেছে। আমি ভদ্রলোকের হাত থেকে কাগজের টুকরোটা নিয়ে নিয়েছি। তাতে লাল কালি দিয়ে ইংরাজিতে লেখা—‘ইউ হ্যাভ বিন ওয়ার্নড।’ অর্থাৎ তোমাদের সাবধান করে দেওয়া হচ্ছে। ঠিক এই লাল কালিই দেখেছি একটু আগে একটা নেপালি ভাষায় লেখা হুমকিতে।
‘কোথায় ছিল এটা?’ ফেলুদার হাতে কাগজটা চালান দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম ভদ্রলোককে। লালমোহনবাবু তাঁর জহরকোটের ডান পকেটে দুটো চাপড় মেরে বুঝিয়ে দিলেন। ভদ্রলোক এই কোটটা পরেই বেরিয়েছিলেন সকালে। মনে পড়ল স্বয়ম্ভুনাথে বলেছিলেন বাঁদরে ওর পকেট ধরে টান দিয়েছিল।
‘ও-ম্ম্ম্ম্!’
টেনে দম নিয়ে পুরো দমটা ছেড়ে শব্দটা উচ্চারণ করলেন ভদ্রলোক চেয়ারে বসতে বসতে।
‘ও-ম্ মণি পদ্মে হুম্—হুম্—হুম্কি।’
হুম্কি তো বটেই, কিন্তু এ কী দশা লালমোহনবাবুর! অথচ মুখে সেই হাসিটা রয়েই গেছে।
আমি ফেলুদার দিকে চাইলাম। ও ঠোঁট নেড়ে বুঝিয়ে দিল—‘পাউন্ড-শিলিং-পেন্স।’
এল এস ডি।
শুগার কিউব!
মগনলাল নিজের হাতেই চিনি দিয়েছিল আমাদের চায়ে। আমাদের দু’জনের যখন কিছুই হচ্ছে না, তখন শুধু লালমোহনবাবুর চায়েই দিয়েছিল ওই বিশেষ একটি কিউব। আঙ্কলকে নিয়ে রসিকতা করাটা দেখছি মগনলাল চরিত্রের একটা বিশেষ দিক। কী শয়তান লোকটা!
‘ওঁ—ম্ম্ম্ম্মণিপদ্মে হুম্কি!’ আবার বললেন ভদ্রলোক। পরমুহূর্তেই হঠাৎ হাসিটা চলে গিয়ে একটা বিরক্তির ভাব দেখা দিল চাহনিতে। দৃষ্টি ফেলুদার দিকে। ফেলুদা একদৃষ্টে লক্ষ করে যাচ্ছে ভদ্রলোককে।
‘খুলিটা খুলে ফেলুন!’ ধমকের সুরে বললেন ভদ্রলোক—‘বলছে খুলি, অথচ খোলার নামটি নেই। হ্যাঃ!’
ফেলুদা চাপা গলায় বলল, ‘স্কাউন্ড্রেল’। বুঝলাম সেটা মগনলালকে উদ্দেশ করে বলা হচ্ছে।
জপযন্ত্র এখন থেমে আছে। আস্তে আস্তে বিরক্ত ভাবটা চলে গিয়ে লালমোহনবাবুর চোখ ফেলুদার উপর থেকে সরে গিয়ে চলে গেছে খাটের পাশে জলভরা গেলাসটার দিকে।
চোখের দৃষ্টি ক্রমশ তীক্ষ থেকে তীক্ষ্ণতর হয়ে এল।
আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। ঘরে পিন ড্রপ সাইলেন্স। লালমোহনবাবু চেয়ে আছেন গেলাসটার দিকে; মনে হচ্ছে গেলাসটা হয়তো বা ওঁর মন্ত্রের জোরে টেবিল থেকে শূন্যে উঠে পড়বে।
‘অহোহো!’ বললেন লালমোহনবাবু। তীক্ষ্ণতা চলে গিয়ে একটা ঢুলু-ঢুলু ভাব চোখে, সেই সঙ্গে তারিফের হাসি। ‘অহোহো ভিবজিওর! অহো! অহো!—তপেশ, দেখেছ রং?’
আমি থতমত খেয়ে কিছু বলার খুঁজে পাচ্ছি না। অথচ লালমোহনবাবু ছাড়বেন না। ভিবজিওর মানে হচ্ছে ভায়োলেট, ইন্ডিগো, ব্লু, গ্রীন, ইয়েলো, অরেঞ্জ, রেড। অর্থাৎ গেলাসের জলে রামধনুর রং দেখছেন তিনি।
‘তপেশ ভাই, দেখেছ রং? ভিবজিওর ভাইব্রেট করছে, দেখেছ?’
কথার মাঝে মাঝে যখন ফাঁক পড়ছে আর লালমোহনবাবু শুধু চুপ করে চেয়ে আছেন সামনের দিকে, সেই সময়টা আমার তন্দ্রার মতো আসছে। আবার কথা শুরু হলেই ঘুমটা ভেঙে যাচ্ছে। একবার তার অবস্থা থেকে ‘মাইস!’ বলে একটা চিৎকারে লাফিয়ে উঠে দেখি লালমোহনবাবু ভীষণ সোজা হয়ে বসে ওঁর সামনে মেঝের দিকে চেয়ে আছেন।
‘মাইস!’ আবার বললেন ভদ্রলোক। তারপর বিড়বিড়ানি শুরু হল কিছুক্ষণ—‘টেরামাইস, টেট্রমাইস, সুবামাইস, ক্লোরোমাইস, কমপ্রোমাইস…কিল-বিল করে ঘুরে বেড়াচ্ছে সব!—আমার সঙ্গে ইয়ার্কি?’
শেষের কথাটা বেদম জোরে বলে লালমোহনবাবু হঠাৎ সোফা ছেড়ে উঠে কার্পেটে মোড়া মেঝেতে পায়ের গোড়ালি দিয়ে ঘা দিতে শুরু করলেন—যেন প্রত্যেকটা ইঁদুরকে পিষে পিষে মারছেন। —‘আবার পেখম ধরা হয়েছে! এদিক নেই ওদিক আছে!’
এইভাবে চলল মিনিট তিনেক। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে না—সারা ঘর ঘুরে ঘুরে এই কাণ্ড। আশা করি আমাদের ঠিক নীচের ঘরে কোনও গেস্ট নেই!
‘ব্যস্, খতম।’
লালমোহনবাবু বসে পড়লেন।
‘ঝ্যাক্’ আবার বললেন ভদ্রলোক।—‘অল টিকটিকিজ খতম।’
কোন ফাঁকে যে ইঁদুর টিকটিকি হয়ে গেল সেটা বোঝা গেল না।
‘খতম্! অ্যান্টিবায়োটিকটিকিজ—খতম্।’
এতটা এনার্জি খরচ করার ফলেই বোধহয় লালমোহনবাবুর মধ্যে এবার একটা ঝিমধরা ভাব এসে গেল। তার সঙ্গে সেই আলাভোলা হাসি।
‘ওম্ম্ম্ মোমোমোমোমো—ওম্ম্ম্!’
এর পরে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। যখন উঠলাম, তখন পুবের জানালা দিয়ে রোদ এসে ঘর একেবারে আলোয় আলো। ফেলুদা চানটান করে দাড়িটাড়ি কামিয়ে রেডি, সবেমাত্র কাকে যেন ফোন করে রিসিভারটা নামিয়ে রাখল।
‘উঠে পড় তোপসে, কাজ আছে। আজ সকালেই বাটরার সঙ্গে একবার দেখা করা দরকার। তার অবস্থাটা যে খুব নিরাপদ নয় সেটা তাকে জানানো দরকার।
‘ফোনটা কাকে করলে?’
‘পুলিশ স্টেশন। ভেরি গুড নিউজ। দুই সরকারে সমঝোতা হয়ে গেছে।’
‘এ তো দারুণ খবর!’
‘হ্যাঁ। কিন্তু তার আগে আমি নিজে একটা ফোন করেছিলাম, সেটার খবরটা খুব ভাল না।’
‘কেন? কাকে করেছিলে ফোন?’
‘ডঃ দিবাকর। উনি নাকি আজ ভোরে একটা জরুরি কল পেয়ে চলে গেছেন, এখনও ফেরেননি। ব্যাপারটা মোটেই ভাল লাগছে না।’
‘কেন ফেলুদা?’
‘মনে হয় উনি আমাদের হয়ে ওষুধ পরীক্ষা করে দেখছিলেন, সেটা চোরাকারবারি দল পছন্দ করেনি। অবিশ্যি এটা আমার অনুমান। দেখি, ঘণ্টাখানেক পরে আরেকটা ফোন করে দেখব। তাতেও না হলে ডিসপেনসারিতে চলে যাব।’
লালমোহনবাবুর ব্যাপারটা কতক্ষণ চলেছিল সেটা না জিজ্ঞেস করে পারলাম না।
‘উনি গেছেন ঘণ্টা খানেক হল,’ বলল ফেলুদা, ‘পরের দিকটা একেবারে মহানির্বাণের অবস্থা। কোনও উৎপাত করেননি। আসলে এল এস ডি-র প্রভাব সাত আট ঘণ্টার কমে যায় না।’
‘তুমি অল অ্যালং জেগে ছিলে?’
‘উপায় কী? কখন কী করে বসে তার তো ঠিক নেই। ভাগ্য ভাল ভদ্রলোকের কোনও খারাপ এফেক্ট হয়নি।’
‘এখন একদম নরম্যাল?’
‘পুরোপুরি নয়। যাবার সময় বলে গেলেন আমার মগজের নাকি তিন ভাগ স্থল, একভাগ জল। সেটা কমপ্লিমেন্ট হল কি না ঠিক বুঝলাম না। তবে খোশ মেজাজে আছেন। কোনও ডেঞ্জার নেই।’