১০০
১১ ডিসেম্বরে জেনারেল নিয়াজি ঢাকার সেনানিবাসের সদর দপ্তর থেকে বের হলেন। বাইরে রোদ উঠেছে। সেনাসদরের ভেতরে একটা মাটির নিচে একটা গোপন আশ্রয়ঘর বানানো হয়েছে। তার ভেতরে তিনি এত দিন ছিলেন। মদ খেয়েছেন, কান্নাকাটি করেছেন। কিন্তু বাইরে রোদ দেখেই তার মনটা ভালো, বুকটা সাহসী হয়ে উঠল। রাওয়ালপিন্ডি থেকে জেনারেল গুল হাসান তাঁদের তারবার্তা পাঠিয়েছেন, উত্তর দিক থেকে হলুদ আর দক্ষিণ দিক থেকে সাদা বন্ধুরা আসছে। অল্প কয়েক ঘণ্টা ঢাকাকে ধরে রাখো। এটা তাকে সাহসী করে তুলেছে। বিভিন্ন রেডিওর মাধ্যমে তিনি নিজের কানে শুনেছেন, আমেরিকা সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরের দিকে যাত্রা শুরু করিয়ে দিয়েছে। আর কোনো চিন্তা নেই। তাঁর জিপ যাচ্ছে ঢাকা ক্যান্টমেন্টের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের দিকে। তিনি গান ধরেছেন : দমাদম মাস্ত কালান্দর
আলি দা পয়লা নাম্বার ও লাল মেরি…
হাসপাতালে যাচ্ছেন তিনি আহত সৈনিকদের দেখতে। বিভিন্ন জায়গা থেকে আহত সেনাদের অনেকেই এখানে এসেছে। চিকিৎসা নিচ্ছে। তাদের দেখতে যাওয়া তাঁর কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। তার সঙ্গে আছে তার তথ্য কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিক।
নিয়াজি তাঁর রসিকতার বোধ ফিরে পেয়েছেন। তিনি বললেন, সিদ্দিক!
স্যার।
তুমি কি ওই জোকটা শুনেছ?
না বললে বুঝব কেমনে কোন জোকটার কথা বলছেন?
এক বাঙালি নারী এক পাঞ্জাবি সৈনিকের সঙ্গে বিছানায় গেছে। বাঙালি মেয়েটি বলল, হাঁটুটা সরান। পাঞ্জাবি বলল, হাঁটু না। ওইটাই যাবে। হা হা হা।
স্যার ক্যান ইউ সে ইয়োর জোকস ইন ইংলিশ। আওয়ার শফার ইজ লাফিং স্যার…
ওয়েল। দ্য নেক্সট ওয়ান উইল বি ইন ইংলিশ দেন…অ্যান ইন্ডিয়ান সোলজার আসকড আ ক্যামেল কিপার, হোয়াট ডু ইউ ডু হোয়েন ইউ ফিল দ্য আর্জ ফর সেক্স…।
ঢাকা একটা গরিব শহর। এখানে কিছুই নেই। শুধু এই ক্যান্টনমেন্টে কিছু গাছপালা, বাগান ছাড়া। নিয়াজি বললেন। হাসপাতালের সামনে এসে গাড়ি থামল। সৈনিকেরা অ্যাটেনশন হলো। তাদের প্রধান এসেছেন। বুট ঠুকে সালাম দেওয়া শুরু হলো।
ভেতরে আহত অফিসারদের দেখতে গেলেন তিনি। গুলির আঘাতে অনেকেরই অবস্থা খারাপ। কারও হাত নেই। কারও পা নেই। এক সৈনিক তার বউ আর বাচ্চার ছবি দেখছে। নিয়াজিকে দেখে সে কাঁদতে আরম্ভ করল।
হাসপাতালের ওয়ার্ড থেকে ডেটলের গন্ধ নাকে নিয়ে তারা বেরোচ্ছেন। তাকে ঘিরে ধরলেন নার্সরা। তরুণী নার্সদের সাদা পোশাক, সাদা টুপি দেখে নিয়াজির রসবোধ উথলে উঠল।
তিনি সিদ্দিক সালিককে বললেন, সিদ্দিক গাড়িতে উঠে আমাকে মনে করিয়ে দিয়ো। আমি আরেকটা জোক শোনাব। ইয়েস, সিস্টারস, তোমরা কি কিছু বলবে?
জি জনাব। আমরা খুব ভয়ে আছি। আতঙ্কে আছি। বাইরে কামানের গর্জন শোনা যাচ্ছে। মুক্তিরা আসছে। আমাদের জান, মান, ইজ্জত কিছুই তো থাকবে না।
আরে না না। একদম মনোবল হারাবে না। চীন আসছে। আমেরিকা আসছে। ভারতীয়রা কাপুরুষ। তারা ইঁদুরের গর্তে লুকাবে।
কিন্তু যদি আসে তখন আমাদের কে বাঁচাবে? ওদের হাতে ইজ্জত হারানোর চেয়ে মৃত্যুই কি উত্তম নয়?
ও মৃত্যু নিয়ে চিন্তা কোরো না। যদি মুক্তি আসেই তার আগেই আমরাই তোমাদের মেরে ফেলব। ততগুলো গুলি এখনো আমাদের হাতে আছে।
.
তিনি দমাদম মাস্ত কালান্দার গাইতে গাইতে গাড়িতে উঠলেন। এবার তিনি যাবেন এয়ারপোর্টে। ওখানে বিমানবিধ্বংসী কামান নিয়ে সদাসতর্ক আছে। কয়েকজন সৈনিক। তিনি তাদের কাছে গেলেন। বললেন, তোমাদের দৃষ্টি কোথায়?
তারা বলল, আকাশে।
না। শুধু আকাশে তাকালে হবে না। মাটিতেও তাকাতে হবে। কারণ শত্রু শুধু আকাশ দিয়ে আসতে পারে তা-ই নয়। তারা তো স্থলপথেও আসতে পারে। শোনো, তোমাদের কাছে নিজেদের অস্ত্র আছে তো। সেটাও রেডি রেখো। এমন তো হতে পারে, হাতাহাতি লড়াই। বুঝতে পেরেছ?
ইয়েস স্যার।
ভয় পেয়ো না। চীনারা আসবে। তারা প্যারাট্রুপার নামাবে। জাহাজ রওনা দিয়ে দিয়েছে। আমেরিকান সৈন্যরা আসছে। আর দুটো দিন।
তাঁরা গাড়িতে ওঠার জন্য এয়ারপোর্টের রাস্তার দিকে হাঁটতে লাগলেন।
এয়ারপোর্টে ভিড় করে আছেন বিদেশি সাংবাদিকেরা। এঁদের মধ্যে একটা সাদা লোক গায়ে একটা কমলা রঙের জামা পরে হাতে একটা মাইক্রোফোন। ধরে আছেন। নিয়াজিকে দেখেই তিনি দৌড়ে এলেন। আরও সাংবাদিকেরা ছুটে এলেন তাঁর পিছু পিছু।
নিয়াজি বললেন, সিদ্দিক!
ইয়েস স্যার।
আমার কি এই সুযোগ নেওয়া উচিত নয়? এরা আমাদের সম্পর্কে অনেক মিথ্যা রটনা ছড়িয়েছে। ওদের কিছু সত্য জানানো কি উচিত নয়?
ইয়েস স্যার।
তিনি সাংবাদিকদের উদ্দেশে হাত নাড়লেন। হ্যালো জেন্টলমেন…
একজন সাংবাদিক বললেন, ইন্ডিয়া বলছে তারা ঢাকার প্রবেশদ্বারে চলে এসেছে। আসলে তারা কত দূর?
আমি তো কোনো ইন্ডিয়ান সৈন্য দেখতে পাচ্ছি না। আপনি দেখেছেন? তাহলে নিজে যান আর গজ ফিতা দিয়ে মেপে দেখুন তারা ঢাকা থেকে কত দূরে!
আপনার পরের পরিকল্পনা কী? সারেন্ডার করছেন?
প্রশ্নই আসে না। আমি আমার শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই করব।
আপনি কি ইন্ডিয়ানদের হাতে ঢাকার পতন রোধ করতে পারবেন?
ঢাকার পতন? অসম্ভব। সেটা যদি হয় আমার লাশের ওপর দিয়ে হতে হবে। আমি বেঁচে থাকতে ইন্ডিয়ানদের ঢাকার আশপাশে ভিড়তে দেব না!
তিনি দৌড়ে গাড়িতে উঠলেন। গাড়িতে উঠে বললেন, তোমাকে কি একটা নার্স জোক বলতে পারি। একজন সৈনিক গুলি খেয়ে অচেতন। একটা নার্স তাকে সেবা করছে। লোকটার কম্বল তাঁবু হয়ে যেতে লাগল…
তিনি সেনা সদর দপ্তরের মাটির নিচে তার আশ্রয়ে গিয়ে ঢুকলেন।
সেনা সদর দপ্তর থেকে, গভর্নরের দপ্তর থেকে যোগাযোগ করা হলো চীনা উপদূতাবাস আর আমেরিকান কনসুলেটের সঙ্গে। তোমরা নাকি আমাদের পাশে এসে যুদ্ধ করবে? কত দূর আছে তোমাদের সৈনিকেরা? দুই দূতাবাসের কূটনৈতিকেরা বলল, আমরা এই ধরনের কথা তোমাদের মুখ ছাড়া আর। কোথাও শুনিনি।
ঢাকা থেকে পিন্ডিতে আধঘণ্টা পরপর ফোন করা হলো। আমাদের বন্ধুরা কখন আসছে?
খুব তাড়াতাড়ি।
এক দিন যায়। দুই দিন যায়। চীনারা আসে না। আমেরিকা আসে না।
আবার ফোন। খুব তাড়াতাড়িটা কত তাড়াতাড়ি?
আর ছত্রিশ ঘণ্টা।
কত ছত্রিশ ঘণ্টা গেল। কই কেউ তো আসে না।
ব্যাঙ্গমা বলে, আসলে চীন সিদ্ধান্ত নিয়া রাখছিল তারা এই যুদ্ধে জড়াইব না।
ব্যাঙ্গমি বলে, হ। তারা জাতিসংঘে বড় বড় কথা বইলা নিন্দা করা ছাড়া আর কিছুই করতে রাজি আছিল না।
কিসিঞ্জার হুয়াং হুয়াকে যুদ্ধে জড়ানোর যে আহ্বান জানাইছিলেন, তার। জবাবে হুয়াং হুয়া হেইগকে পিকিং থাইকা আসা বার্তা পইড়া শোনান। চীন বলে, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ আবার বৈঠক ডাকুক। আমরা জোর কইরা যুদ্ধবিরতি করাইতে চাই। সৈন্য প্রত্যাহার করাইতে হইব। হেইগ কইলেন, তোমাদের কিসিঞ্জার অনুরোধ করছে সৈন্য পাঠাইতে, তোমরা এইটা কী কও? হেইগ বলে, আমারে পিকিং যা বার্তা পাঠাইছে তার বাইরে আমি কী কমু। মানে বুঝেন না? বোকা নাকি। আমরা রাশিয়ার লগে যুদ্ধ করুম না।
.
চীনারা কথা বলতে পছন্দ করে প্রবাদ দিয়ে। হুয়াং হুয়া বলেন, যদি পুবে আলো না ফোটে, নিশ্চয়ই পশ্চিমে আলো আসছে, যদি দক্ষিণে আঁধার আসে, নিশ্চয়ই উত্তরে আলো ফুটছে।
.
ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমি বলাবলি করে, এটার কারণ কী? শ্রীনাথ রাঘবন তাঁর বই ১৯৭১: গ্লোবাল হিস্ট্রি অব দ্য ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ-এ এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছেন। কেন চীন যুদ্ধে জড়াল না! তার হিসাবে রাঘবন। বলছেন :
১. ১৯৬৯ সালে চীনের পিপলস রিপাবলিক আর্মিতে মাও সে তুংয়ের নিজের ক্ষমতা পাকা করার লড়াই শুরু হয়। ১৯৬৮ ও ১৯৬৯ সালে চীন-সোভিয়েত যুদ্ধের পর মার্শাল লিন বিয়াও, ভাইস চেয়ারম্যান, ১০ লাখ সৈনিক, ৪০০০ যুদ্ধবিমান, ৬০০ যুদ্ধজাহাজ সমবেত করেন। মাও দেখলেন, এত বড় ঘটনার হুকুম কেবল তিনিই দিতে পারেন। তার মানে লিন তাঁকে মানছেন না। লিন এবং অনুসারীদের মাও বলেন আত্মসমালোচনা করতে। ১৯৭১ সালের মে মাসে কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় লিন অনুপস্থিত থাকেন। জুলাই মাসে চৌ এন লাইয়ের কাছে মাও লিনের বিরুদ্ধে অনেক কথা বলেন। আগস্ট, সেপ্টেম্বর ১৯৭১-এ মাও দক্ষিণ চীনে সফর করে লিনের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান ঘোষণা করতে থাকেন। লিনের ছেলে, বিমানবাহিনীর এক কর্তা, মাওকে খুন করার একটা ছেলেমানুষি পরিকল্পনা করে ব্যর্থ হন। লিন পালিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে উড়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা নেন। তাঁর প্লেন যখন মঙ্গোলিয়ার ওপরে, চৌ এন লাই বলেন, প্লেনটা উড়িয়ে দেব কি না। মাও বলেন, বৃষ্টিকে পড়তেই হয়, বালিকাদের বিয়ে করতেই হয়, এই ধরনের ঘটনা ঘটবেই, তাদের যেতে দাও। কিন্তু লিনের প্লেন মঙ্গোলিয়াতেই ভেঙে পড়ে। সম্ভবত তেল ফুরিয়ে গিয়েছিল। এরপর মাও সেনাবাহিনী থেকে লিনের সহযোগীদের ধরে ধরে বিচার করতে শুরু করেন। এই অবস্থায় তাদের রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করার অবকাশই ছিল না।
আর একটা কারণ চীন ভারতকে সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে পুরোপুরি ঠেলে দিতে চায়নি। হুয়াং হুয়ার সঙ্গে হেইগের আলাপের আগের দিন ইন্দিরা গান্ধী চৌ এন লাইকে চিঠি পাঠান। তিনি লেখেন, আমরা চীনের বন্ধুত্ব চাই। আপনি কি আপনার সঙ্গে ইয়াহিয়াকে বোঝাতে পারেন না যে বাঙালিদের অধিকার তাদের দিতে হবে?
তিন নম্বর কারণ : চীন মনে করেছে, যা-ই হোক না কেন, বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঠেকানো যেত না। সপ্তম নৌবহর তাদের ভরসা দেয়নি। তারা। দেখেছে, তাকে ঘিরে রেখেছে সোভিয়েত যুদ্ধতরি।
গ্যারি জে ব্যাস তাঁর বই ব্লাড টেলিগ্রাম-এ বলেছেন, চীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে যুদ্ধে যেতে রাজি ছিল না। লাখ লাখ সোভিয়েত সৈন্য চীনে ঢুকে পড়ছে, এটা তারা কল্পনাও করতে পারছিল না।
হাসান ফেরদৌস মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত বন্ধুরা বইয়ে জানিয়েছেন, চীন সোভিয়েত সীমান্তে চীনা সেনা ছিল ১২ ডিভিশন, সোভিয়েত সৈন্য ছিল ৯০ ডিভিশন।
শ্রীনাথ রাঘবন আরও দুটো কারণ অনুমান করেছেন, চীনের যুদ্ধে না যাওয়া নিয়ে। এক. চীন তো যেকোনো জাতীয় মুক্তি আন্দালনকে সমর্থন করতে প্রকাশ্যে অঙ্গীকারবদ্ধ। চীন বিভিন্ন দেশে যেসব বিদ্রোহ বা মুক্তি আন্দোলনকে সমর্থন করে, তার চেয়ে বাঙালিদের সংগ্রাম অনেক বেশি। জনসমর্থিত ছিল। চীন বাঙালিদের মধ্যে তার যে অবস্থান ছিল, তা নষ্ট করতে চায়নি। তারা ভুলে যায়নি যে, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আওয়ামী লীগের নেতা, পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে প্রথম চীন সফর করেছিলেন। তাঁর সঙ্গে এসেছিলেন তরুণ শেখ মুজিব–সে ১৯৫৬ সালের কথা। চৌ এন লাই ঢাকা সফরে এলে তাকে যে সংবর্ধনা দেওয়া হয়, তার নেতা ছিলেন শেখ মুজিব, তিনি যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তা চৌ এন লাইয়ের ভুলে যাওয়ার কথা নয়। তার ওপরে মওলানা ভাসানী পিকিংপন্থী, আরও একটা পিকিংপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি আছে, ইয়াহিয়া খানের সৈন্যদের নৃশংস আক্রমণের শিকার তারাও হয়েছে।
.
ব্যাঙ্গমা বলে, শেখ মুজিব ১৯৫২ সালে প্রথম চীন যান। বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে। সেইখানে তিনি ভাষণ দিছিলেন বাংলায়। চীনারা তার ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করে। সেইটা জয় বাংলা পত্রিকায় ৯ জুলাই ১৯৭১ আবার ছাপায়া দেওয়া হয়।
ব্যাঙ্গমি বলে, আর মওলানা ভাসানী ইন্ডিয়াতে যাওয়ার আগে-পরে মাও সে তুংরে বড় বড় চিঠি লেখছিলেন বাংলাদেশকে সমর্থন দেওনের অনুরোধ কইরা।
.
সুতরাং চীন মার্চের পরেই সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা এই সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান চায়, সামরিক সমাধান নয়।
১০১
মুজিবনগরে খন্দকার মোশতাক আর তার মন্ত্রণালয়ের অব্যাহতিপ্রাপ্ত সচিব ব্লু আয়েড বয় মাহবুবুল আলম চাষীর ষড়যন্ত্র শেষ হয় না।
মোশতাক দাঁত খিলান করতে করতে ভাবতে লাগলেন, এইটা কোনো কথা! তাজউদ্দীনের মতো একটা লোক প্রধানমন্ত্রী। আর তাঁর নেতৃত্বে মুজিবনগর সরকার একটা যুদ্ধ কইরা বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে চলে গেল! আর এত দিন ধরে শেখ মুজিবের সঙ্গে থেকে, জেল খেটে, শেখ মুজিবের সিনিয়র হওয়া সত্ত্বেও তিনি, মোশতাক কিছুই করতে পারলেন না। এখন শেখ মুজিব যদি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে আসেন, তাঁর সামনে মোশতাক দাঁড়াবেন কী করে? বলবেনটা কী? তাজউদ্দীন তো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ফুলের মালা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন। দুই নম্বর হলো : ইন্ডিয়া আর রাশিয়ার সমর্থন অংশগ্রহণ নিয়ে দেশ স্বাধীন হবে? তিনি বেঁচে থাকতে কমিউনিস্ট আর হিন্দুদের সহযোগিতা নিতে হচ্ছে। আমেরিকার মধ্যস্থতার মাধ্যমে জিনিসটা করা গেলে কি তাঁর নিজের এক জীবনের আদর্শ ও মতবাদের প্রতি ন্যায়বিচার করা হতো না!
তিনি ডাকলেন মাহবুবুল আলম চাষীকে। আমেরিকার কানেকশন কী হলো? তারা কি মধ্যস্থতা করে যুদ্ধ বন্ধ করে মুজিবকে মুক্ত করে তার হাতে ক্ষমতা দিয়ে দিতে পারে না?
মাহবুবুল আলম কলকাতার কনসুলেটের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। তাঁরা একটা প্রস্তাব খাড়া করলেন। মাহবুব ছুটলেন সৈয়দ নজরুল ইসলামের কাছে। প্রস্তাবটা হলো, বাংলাদেশ সরকার বলছে, যদি এই মুহূর্তেই শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্ত করে দেওয়া হয়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ যুদ্ধবিরতিতে যাবে।
সৈয়দ নজরুল বললেন, কী ব্যাপার মাহবুব?
স্যার আপনাকে একটা বিবৃতিতে সাইন করতে হবে।
কী বিবৃতি। সাথে কলম তো নাই। কলম আমার কাছে আছে স্যার।
বিবৃতিটা কী?
বঙ্গবন্ধুর নিঃশর্ত মুক্তি। তা যদি হয় তাহলে আমরা যুদ্ধবিরতি করব। বাকিটা বঙ্গবন্ধু নিজে ঠিক করবেন। আমরা তাঁর নির্দেশ মোতাবেক স্বাধীনতা অর্জন করব। সব দিক থেকে ভালো হবে।
সৈয়দ নজরুল বললেন, যুদ্ধ হচ্ছে যৌথ কমান্ডে। আমি কী করে বলি আমি যুদ্ধবিরতি করব। রাখেন দেখি বিবৃতিটা।
সৈয়দ নজরুল বিবৃতিটা নিয়ে নিজে উঠে গেলেন তাজউদ্দীনের কাছে। এটা দেখেই তাজউদ্দীনের চোখমুখ লাল হয়ে গেল!
কই পেলেন এই স্টেটমেন্ট?
মাহবুবুল আলম চাষীর কাছে।
সর্বনাশা উদ্যোগ। এটা থামাতে হবে। দেশ শত্রুমুক্ত হওয়া এখন সময়ের ব্যাপারমাত্র।
চাষী তো সপ্তম নৌবহরের কথা বলে।
আমার সঙ্গে দিল্লির যোগাযোগ আছে। ইন্দিরা গান্ধী এসবে ভীত নন।
ঠিক আছে। আমি মাহবুবুল আলম চাষীকে থামাব।
হ্যাঁ। মোশতাক সাহেব এবং চাষী–এদের ওপরে নজর রাখতে হবে।
১০২
গভর্নর ডাক্তার মালিক জরুরি সভা ডেকেছেন। তাঁর মন্ত্রীরা আছেন, পুলিশের আইজি, তাঁর প্রধান সচিব, সামরিক উপদেষ্টা জেনারেল রাও ফরমান আলী খান। তারা অপেক্ষা করছেন জেনারেল নিয়াজির জন্য।
নিয়াজি এলেন দরবার হলে। তাকে খুবই চিন্তিত দেখাচ্ছে।
তিনি আশা করেছিলেন চীন আর আমেরিকা থেকে সৈন্য আসবে। তারা যুদ্ধে যোগ দেবে।
কিন্তু সেই সাহায্য আসার কোনো নাম নেই। ঢাকা রক্ষার মতো তাঁর হাতে কোনো ফোর্স নেই। পুলিশ, রাজাকার, ইঞ্জিনিয়ার কোর, ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্স, আলবদর মিলিয়ে কুড়িয়ে-কাড়িয়ে ৫০০০ জন হয়। এদের হাতে অস্ত্র নেই। অস্ত্র থাকলে গোলা নেই। একজনকে রিকোয়েললেস রাইফেল দেওয়া হয়েছে। সে গুলি ভরতে গিয়ে দেখল, গুলি ভিন্ন অস্ত্রের। একজনকে এলএমজি দেওয়া হয়েছে। সে দেখল, এটা আসলে অকেজো। মর্টারের বোমা আছে, কিন্তু কোনো সাইট নেই। নিয়াজি ব্রিগেডিয়ার বকরকে বলেছেন, একটা ব্রিগেড ঢাকার বাইরে থেকে ঢাকায় আনতে। বকর কুমিল্লায় ব্রিগেডিয়ার আতিফকে বললেন, ঢাকায় চলে আসো, চিফের অর্ডার। আতিফ আসে নাই। নিয়াজি বললেন, আতিফ আসতে চায় না কেন? বকর বলল, ঢাকায় এসে মরতে চায় না সে। ভৈরব থেকে মেজর জেনারেল কাজিকে আসতে বলা হলো। তিনি বললেন, নদী পার হতে পারছি না। যমুনার অপর পার থেকে মেজর জেনারেল নজর হোসেনকে একটা ব্রিগেড সৈন্য পাঠানোর জন্য বার্তা পাঠানো হলো। এক ব্রিগেড সৈন্যকে তিনি ছাড়লেন। কিন্তু তারা নদী পার হবে কী করে?
মেজর জেনারেল জামশেদকে ডাকলেন নিয়াজি। দেখো, যেকোনো জায়গা থেকে একটা ব্রিগেড আনতেই হবে।
জামশেদ জামালপুর, ময়মনসিংহকে বললেন, ঢাকায় সৈন্য পাঠাও।
ব্রিগেডিয়ার কাদির একমাত্র লোক যিনি কথা শুনলেন। ঢাকার দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। কিন্তু রাস্তায় মুক্তিবাহিনী তাকে বন্দী করেছে।
এই সময় ব্রিগেডিয়ার বকর পরামর্শ দিলেন, ঢাকায় আমরা স্ট্রিটফাইট করব।
তখন আরেকজন বললেন, ঢাকার রাস্তায় বের হলে বাঙালি সাধারণ মানুষই পিটিয়ে ভর্তা করে ফেলবে।
মেজর জেনারেল রহিম ছিলেন চাঁদপুরে। সেখান থেকে পালিয়ে আসার সময় আহত হন। এসে আশ্রয় নেন গভর্নর ভবনে। রাও ফরমান আলীর পাশের রুমে। তাকে দেখতে গেলেন নিয়াজি।
নিয়াজি তাঁকে বললেন, ঢাকা আমরা রক্ষা করতে পারব তো? কী বলো।
রহিম বললেন, না। একমাত্র উপায় হলো যুদ্ধবিরতি করা। জামশেদ। খান, রাও ফরমান আলীও ছিলেন। তাঁদের সবার মত দাঁড়াল, মুক্তিবাহিনীর হাতে পড়ে সবাই মিলে মারা পড়ার কোনো মানে হয় না। রাওয়ালপিন্ডিকে তারবার্তা পাঠাতে হবে।
নিয়াজি বললেন রাওকে, এখান থেকে বার্তা পাঠাও।
রাও বললেন, না। হেডকোয়ার্টার থেকে পাঠান। চিফ সেক্রেটারি মোজাফফর এসে বললেন, এটা কোনো ব্যাপার না। এখান থেকে পাঠানো যা, ওখান থেকে পাঠানো তা।
মোজাফফর যুদ্ধবিরতির বার্তা মুসাবিদা করলেন। নিয়াজি চলে এসেছেন সেখান থেকে। যুদ্ধবিরতির কথা বলার দায়িত্ব তিনি নেবেন না।
সেই প্রস্তাব রাওয়ালপিন্ডিতে গেছে। উত্তর আসেনি।
এখন গভর্নর তাদের ডেকেছেন। এ অবস্থায় করণীয় কী জানতে।
.
গভর্নর ঢাকার সব গুরুত্বপূর্ণ লোককে নিয়ে বৈঠক করছেন, এই খবর ভারতের গোয়েন্দারা পাঠিয়ে দিল ভারতের কাছে। জেনারেল জ্যাকবের কাছে সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্সের প্রধান কর্নেল পি সি ভল্ল ছুটে এসেছেন। জরুরি খবর। ঢাকার গভর্নর হাই অফিশিয়ালদের নিয়ে বৈঠক করবেন।
তখন বাজে সাড়ে ৯টা। বৈঠক বসার কথা ১১টায়। জেনারেল জ্যাকব সঙ্গে সঙ্গে জানালেন ইস্টার্ন জোনের বিমানবাহিনীর সিনিয়র স্টাফ অফিসার এয়ার ভাইস মার্শাল দেবরকে। তিনি তখন শিলংয়ে। শিলংয়েই তাদের বিমানবাহিনী হেডকোয়ার্টার। জরুরি বার্তা। ১১টার মধ্যে ঢাকায় সার্কিট হাউসে বোমা ফেলতে হবে। ওখানে হাই লেভেল বৈঠক বসবে।
একই বার্তা মুক্তিবাহিনী পাঠাল র-কে। র জানাল ইন্দিরা গান্ধীকে। ইন্দিরা গান্ধী ফোন করলেন বিমানবাহিনীর প্রধানকে। পি সি লাল। তোমার সামনে সুবর্ণ সুযোগ। গভর্নর তাঁর নীতিনির্ধারকদের নিয়ে বসতে যাচ্ছে ঢাকায়। কী করবে করো।
বিমানবাহিনীর ইন্টেলিজেন্স অফিসার ছুটল অপারেশন রুমে। উইং কমান্ডার বিস্ময়কে জানাল হেডকোয়ার্টারের আদেশ।
১১টার মধ্যে ঢাকায় সার্কিট হাউসে বোমা ফেলতে হবে।
বিস্ময় ঘড়ি দেখলেন। এখন বাজে ১০টা। ঢাকা যেতে লাগবে ২১ মিনিট। প্লেন রেডি করতে হবে। রকেট ভরতে হবে।
তিনি চিফ অপারেটিং অফিসারকে নির্দেশ দিলেন, চারটা মিগ ২১ লোড করো। প্রতিটায় ৩২টা করে উচ্চক্ষমতার বিস্ফোরক ভরো।
বিস্ময় বললেন, সার্কিট হাউস কোনটা?
একটা টুরিস্ট ম্যাপ আনা হলো ঢাকার। সার্কিট হাউস চিহ্নিত করা হলো। বিস্ময় তিনজন পাইলটকে ডেকে নিলেন। তাঁদের দেখালেন, এই হলো সার্কিট হাউস। আমরা ১১টার মধ্যে সেখানে যাচ্ছি আর অ্যাটাক করছি।
তারা দৌড়ে প্লেনে উঠলেন।
সিঁড়ি দিয়ে উঠে দেখলেন দরজায় একটা কার্ড ঝুলছে। সার্কিট হাউস নয়, গভর্নর ভবন।
ওকে। আগে ঢাকা যাই। তিনি ম্যাপ বের করে গভর্নর ভবনটা দেখে নিলেন। ওকে। এটা আরও স্পষ্ট।
বাকি তিনজন পাইলটকে বলা হয়নি। রেডিওতে বলতে পারেন, কিন্তু সবাই শুনে ফেলবে। আগে ঢাকা যাই। তারপর বলব। ওই তিনটা মিগ তো তাকে অনুসরণই করবে।
চারটা মিগ আকাশে উড়ে গেল।
.
ডা. মালিক বললেন, নিয়াজি সাব। পিন্ডি থেকে কোনো খবর এল?
না।
চীন-আমেরিকা থেকে কোনো আশা?
বুলশিট।
তাহলে আমরা কী করব?
নিয়াজি বললেন, আপনি গভর্নর। আপনি যা বলবেন। আপনি বললে, লড়ব। আপনি না বললে বসে থাকব।
উইং কমান্ডার বিস্ময় ঢাকার কাছে এসেছেন। সামনে তাঁর মিগ। তাঁর একটু পেছনে দুপাশে দুইটা। তার পেছনে একটা। একটা ঘুড়ির আকার নিয়েছে চার মিগ।
বিস্ময় বললেন, আমরা সার্কিট হাউস নয়, গভর্নর ভবনে অ্যাটাক করছি। আমাকে ফলো করো।
তারা গভর্নর ভবনের চারপাশে চক্কর মারলেন একবার। বিস্ময় বললেন, আমাদের বাঁ দিকে সেন্টারে যে গম্বুজওয়ালা সুন্দর ভবনটা দেখা যাচ্ছে, ওইটা আমাদের টার্গেট। নেক্সট টার্নের পর আমরা টার্গেটের দিকে যাব।
চারটা মিগ নেমে আসছে। এত নিচে যে মতিঝিলের উঁচু ভবনের জানালা থেকে পাইলটদের স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
তাঁরা ডিআইটির দিকের রাজপথ ধরে গভর্নর ভবনের কাছে গিয়ে রকেট চার্জ করতে লাগলেন।
.
ড. মালিকের মনে হলো, কেয়ামত নেমে এসেছে-ভয়াবহ বিস্ফোরণের শব্দ আর প্রচণ্ড ঝাঁকুনি, যেন আকাশ ভেঙে পড়ছে। তার ভবনের নিচে সুড়ঙ্গ আছে। তিনি দৌড়ে সেখানে আশ্রয় নিলেন। মন্ত্রীরা তার পিছু নিল কেউ কেউ। মিলিটারিরা কেউ কেউ ভবনের বাইরে এসে গাছের নিচে দাঁড়ালেন।
রাও ফরমান আলী বললেন, আবার আসছে। সবাই শুয়ে পড়ুন।
অনেক অফিসার সভাকক্ষের টেবিলের নিচে গিয়ে বসলেন।
কেয়ামত বেশিক্ষণ দীর্ঘস্থায়ী হলো না। গভর্নর হাউসের গম্বুজ আর লাইব্রেরি গুঁড়িয়ে দিয়ে মিগগুলো চলে গেল।
আগুন জ্বলছে।
ডা. মালিক কাঁপতে লাগলেন। নিচের সুড়ঙ্গে বসেই তিনি পদত্যাগপত্র লিখলেন। অন্য অফিসার ও মন্ত্রীরাও পদত্যাগপত্র লিখলেন।
কাঁপতে কাঁপতে তিনি তাঁর কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিলেন, এই পদত্যাগপত্র পিন্ডিতে পাঠাও।
তারপর কপিটা নিয়ে বাইরে এসে ড্রাইভারকে বললেন, গাড়িতে সাদা পতাকা লাগাও। তার পরিবারও এসে গাড়িতে বসল।
তাঁকে অনুসরণ করলেন মন্ত্রীরা, উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। সবাই পদত্যাগ করেছেন।
তাঁরা চললেন শাহবাগে, ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে। সেটা রেডক্রস এলাকা। নিরপেক্ষ জোন। গেটে পদত্যাগপত্র দেখিয়ে তারা ভেতরে ঢুকলেন। ঢাকায় আর কোনো সরকার রইল না।
.
রাও ফরমান আলী তখনো গভর্নর হাউসে। তিনি মালিক সরকারের উপদেষ্টা। এখন কোনো সরকার নেই। এখন তিনি কী করবেন?
তিনি তার ড্রয়ার থেকে বুদ্ধিজীবীদের তালিকা বের করলেন। একবার দেখে নিলেন। সব ঠিক আছে। তিনি ডাকলেন মেজর জেনারেল জামশেদকে। বললেন, আলবদরদের দিয়ে বাকি কাজটা করিয়ে নাও। আমার কথা তো এখন আর কেউ শুনবে না।
জামশেদ বললেন, কাজ ঠিকমতো এগোচ্ছে। ১০ ডিসেম্বর রাত থেকেই শুরু হচ্ছে। জামায়াতের নেতাদের সহযোগিতা খুব মূল্যবান। আলবদরগুলো সাচ্চা সৈনিক। তারা কাজটা করছে সুচারুভাবে। দ্যাখো, এতগুলো লোক নাই হয়ে গেল, কোথাও টু শব্দটি নাই। অথচ ঢাকা গিজগিজ করছে বিদেশি সাংবাদিকে।
জামশেদ চলে গেলেন।
জামায়াতের নেতাদের সঙ্গে রাও ফরমান আলীর কথা হলো। তাদের তিনি বললেন, মেজর জেনারেল জামশেদ বাকি কাজটুকু দেখভাল করবে। কোনো সাপোর্ট লাগলে তাকে বলবে। আমি আর গভর্নরের সঙ্গে থাকছি না। হেডকোয়ার্টারে আমার কিছু জরুরি কাজ আছে।
ওরা বলল, কাফের কতল করার কাজে আমাদের ইমানই আমাদের বড় শক্তি। তারপরও কিছু লাগলে নিশ্চয়ই বলব। ইসলামের শত্রুদের নিশ্চিহ্ন না করে আমাদের ক্ষান্তি নাই।
১০৩
কাদালেপা মাইক্রোবাসগুলো ডিসেম্বরের শেষ দিনগুলোতে ছুটছে। মুখোশ পরা একদল হিংস্র মানুষ তার আরোহী। তাদের পরনে কালো পোশাক। কারও-বা সাদা পোশাক। তাদের মাথায় কানঢাকা মাংকি টুপি। তারা বাংলায় কথা বলে। প্রত্যেকের হাতে অটোমেটিক আগ্নেয়াস্ত্র।
তারা একটা তালিকা ধরে এগোচ্ছে। তাতে পাকিস্তানের শত্রুদের নাম আর তাদের ঠিকানা দেওয়া আছে। এই শত্রুরা কেবল পাকিস্তানের শত্রু নয়, তারা ইসলামের শত্রু। তারা নামে মুসলমান। কিন্তু কেউবা আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত। কেউবা কমিউনিস্ট। প্রত্যেকেরই একটা দোষ অভিন্ন, প্রত্যেকেই ইন্ডিয়ার দালাল। পাকিস্তানকে ভাঙতে চায়। মুক্তিদের সাহায্য, সহযোগিতা করে। তাদের বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। আলবদরদের নেতারা বলেছেন, আলবদর মানেই হলো একটা বিশ্বাস। একটা টর্নেডো। সেই টর্নেডো এখন বয়ে যাবে এই কাফেরগুলোর ওপর দিয়ে।
১০ ডিসেম্বর পিলখানায় আসেন জেনারেল রাও ফরমান আলী খান, মেজর জেনারেল জামশেদ খান। নিয়াজির কাছ থেকে অর্ডার পেয়েই তারা কাজে নেমেছেন।
তারা তত্ত্বাবধান করতে আসেন, সবকিছু ঠিক আছে কি না। রাও ফরমান দেখেন, অনেকগুলো কাদালেপা মাইক্রোবাস।
আজ রাত থেকেই তাহলে শুরু হচ্ছে অপারেশন? রাও জানতে চান।
জামশেদ বলেন, আজ থেকে শুরু হবে। প্রথমে সাংবাদিকদের ধরা হবে। তারপর আস্তে আস্তে অন্য বুদ্ধিজীবীদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া হবে ১৪-তে। তোমার তালিকা ঠিক আছে তো?
রাও বললেন, এত দিন ধরে আমি বাঙালিদের সঙ্গে মিশছি। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছি। ঠিক না থেকেই পারে না।
.
১০ ডিসেম্বর রাত ১২টা।
ইত্তেফাক-এর বার্তা সম্পাদক শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, মুজিব যাকে ডাকেন লাল মিয়া বলে, সেই সিরাজুদ্দীন হোসেন কাগজের কাজ সেরে। এসেছেন। খেয়েদেয়ে ঘুমুতে যাবেন, অমনি দরজায় কিসের যেন শব্দ হলো। ভয়ে ভয়ে দরজা খুললেন। দেখলেন, একটা কুকুর শীতে এসে দরজার কপাটে গা ঘষছে।
সিরাজুদ্দীন বললেন, একটা কুকুরকে ভয় পেলাম।
তারপর ঘুমুতে গেলেন। শুভানুধ্যায়ীরা তাঁকে পরামর্শ দিয়েছেন, বাসায় থাকবেন না। এতগুলো ছেলেমেয়ে পুষ্যিদের রেখে তিনি একা কোথায় যাবেন? কোথায় থাকবেন?
রাত তিনটার সময় ঠিক পাশের ফ্ল্যাটে থাকা বাড়িওয়ালা ডাক্তার সাহেব বললেন, শাহীন শাহীন, দরজা খোলো।
দরজায় তখন প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা চলছে। তার ছেলে শাহীনের নাম ধরে কে ডাকছে? সিরাজুদ্দীন উঠলেন। তিনি লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরা।
বাড়ির সামনে লাল গাড়ি, কাদালেপা। মুখোশধারী মাংকি টুপিরা আগ্নেয়াস্ত্র হাতে লোকগুলো বলল, সিরাজুদ্দীন হোসেন নাম তো?
হ্যাঁ।
একটু যেতে হবে।
আমি পাঞ্জাবি পরে নিই।
না, লাগবে না। যেখানে যাবেন সেখানে গরম কাপড় আছে। একটা গামছা হবে বাড়িতে?
ছেলেদের কেউ একজন গামছা এনে দিলেন। ৪২ বছর বয়স্ক সিরাজুদ্দীন তাঁর নাবালক ছেলেগুলোর দিকে তাকালেন। স্ত্রীর দিকে তাকালেন। তিনি চলে গেলে এদের কী হবে?
সিরাজুদ্দীন হোসেনের স্ত্রী কাঁদছেন। ছোট ছোট ছেলেরা কাঁদছে। আটজন ছেলে তার।
তাঁকে মাইক্রোবাসে তুলল আততায়ীরা। রাত তখন তিনটা কি সাড়ে তিনটা। সেই যে সিরাজুদ্দীন হোসেন গেলেন। আর ফিরলেন না।
১১ তারিখ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলল তালিকা ধরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে আলবদরদের বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক পেশাজীবীদের ডেকে নেওয়া। এই তালিকা অতি দীর্ঘ। বাংলার শ্রেষ্ঠ মানুষদের ধরে নিয়ে গেল ঘাতকেরা। সিরাজুদ্দীন হোসেন ছিলেন ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞের প্রথম শিকার। এরপর নজমুল হক, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, নিজামুদ্দীন আহমেদ, সেলিনা পারভীন, মুনীর চৌধুরী, শহীদুল্লা কায়সার, আনোয়ার পাশা, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, রাশীদুল হাসান, ডা. আলীম চৌধুরী, ডা. ফজলে রাব্বি…বাংলার শ্রেষ্ঠ মানুষগুলো।
মুনীর চৌধুরীর মতো শিক্ষক, নাট্যকার আর কোথায় পাবে বাংলাদেশ?
কোথায় পাবে আনোয়ার পাশার মতো কবি, কথাসাহিত্যিককে?
শহীদুল্লা কায়সারের মতো বড় মাপের সাংবাদিক, সাহিত্যিক তো আর জন্ম নেবে না।
তাঁরা পড়ে রইলেন চোখ বাঁধা, হাত পেছনে বাঁধা অবস্থায় মোহাম্মদপুর, মিরপুরের বিলের পানিতে। গুলিবিদ্ধ…শহীদ…
১০৪
৩ ডিসেম্বরে লাহোরের উত্তর দিকে বাঙালি ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্টকে নিয়োজিত করা হয়। তাদের চালচলন, মনোভাব বিষয়ে সন্দেহ করলেন জেনারেল শের বাহাদুর। তিনি পাকিস্তানের চিফ অব জেনারেল স্টাফ জেনারেল গুল হাসানকে জানালেন, এই বাঙালি রেজিমেন্টকে সীমান্তে রাখা ঠিক হচ্ছে না। গুল বললেন, ওদের ফেরত পাঠান।
ওরা ওখান থেকেও তো পালিয়ে যেতে পারে?
ওদের পাহারা দিয়ে রাখা যাবে।
বাঙালিদের আর যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরিয়ে নেওয়া হয়নি।
গোটা ব্যাটালিয়ন যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতীয়দের সঙ্গে যোগ দিল। তাদের সহকর্মীরা বাঙালিরা দেশ শত্রুমুক্ত করার জন্য একই কাজ করেছে, ভারতে গেছে, যৌথ কমান্ড গঠন করেছে, আর তারা ভারতীয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারে না।
.
১৪ ডিসেম্বর গভর্নর ভবন থেকে বেরিয়ে নিয়াজি গেলেন তাঁর হেডকোয়ার্টারে। প্রেসিডেন্টকে তারবার্তা পাঠালেন। আর কোনো উপায় নেই। প্রেসিডেন্ট ভবনের টেলিপ্রিন্টারে একের পর এক বার্তা আসছে। নিয়াজির বার্তা। পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা খারাপ। ঢাকা ডিফেন্ড করার মতো। সৈন্য নেই। অস্ত্র ও রসদ নেই। স্থানীয় মানুষ বৈরী। জীবন ও সম্পদ রক্ষার কোনো উপায় নেই। যুদ্ধবিরতি একমাত্র উপায়। এরপরে একে একে তারবার্তা আসতে লাগল গভর্নরের পদত্যাগের, পূর্ব পাকিস্তানের মন্ত্রিসভার পদত্যাগের, সেক্রেটারিদের পদত্যাগের…
সেই টেলিগ্রাম বার্তার প্রিন্ট নিয়ে একান্ত সচিব প্রেসিডেন্টের দরজায় গেলেন।
পরিচারককে বললেন, ভেতরে কি যাওয়া যাবে?
.
ইয়াহিয়া মদের পিপে নিয়ে বসলেন। তিনি মদ খাচ্ছেন। আজকের মদটা খুব ভালো। ব্লাক ডগ। এটা খেতে হয় কোনো রকমের বরফ ছাড়া। এখন একটু নুরজাহানের গান শুনতে পারলে ভালো লাগত। নুরজাহানকে কি ডাকা হবে? নাকি ডাকব তারানাকে? নাকি ব্ল্যাক বিউটিকে!
এই সময় তাঁর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার জেনারেল পীরজাদা, চিফ অব স্টাফ জেনারেল হামিদ, চিফ অব জেনারেল স্টাফ গুল হাসান একত্র হয়েছেন। তাদের হাতে ঢাকা থেকে আসা পদত্যাগপত্র আর নিয়াজির এসওএস বার্তা। তাঁরা ঢুকে পড়লেন প্রেসিডেন্টের খাসকামরায়।
এসো হামিদ, এসো গুল, এসো পীরজাদা। একা একা পান করে দুঃখী মানুষ। আমি দুঃখী নই।
পীরজাদা বললেন, পরিস্থিতি খুবই সিরিয়াস। ঢাকার পতন ঘটে যাচ্ছে। আপনার নির্দেশ দরকার।
ইয়াহিয়া বললেন, নিয়াজিকে জানিয়ে দাও, তার নিজের যা মনে হয় তা-ই করুক। উত্তরের বন্ধু, দক্ষিণের বন্ধু কেউ আসবে না। সে যা সিদ্ধান্ত নেবে, তাতেই আমি রাজি…
পীরজাদা বললেন, আপনি তাদের ছেড়ে এসেছেন ২৫ মার্চ। তারা একা একা যুদ্ধ করেছে। তাদের খোঁজ আমরা কেউ নিইনি। তারা সৈন্য চেয়েছে। দিইনি। অস্ত্র চেয়েছে। আমাদের কাছে অস্ত্র নেই।
গুল বললেন, আমাদের ভালো করে একটা চিঠি দেওয়া উচিত ইস্টার্ন কমান্ডকে। আর মালিকের পাছায় একটা লাথি মারা উচিত।
ইয়াহিয়া বললেন, বুড়া মানুষ। ভুলে যাও।
পীরজাদা একটা বার্তা মুসাবিদা করলেন। একটুখানি হুইস্কি পেটে পড়লে তার লেখাটা আসে ভালো। সেটা টাইপ করে ইয়াহিয়াকে দেখানো হলো।
গভর্নরের বার্তার প্রসঙ্গে। তোমরা বিরূপ পরিস্থিতিতে বীরোচিত যুদ্ধ করেছ। জাতি তোমাদের নিয়ে গর্বিত। পৃথিবী মুগ্ধ। মানুষের পক্ষে যা করা সম্ভব আমি একটা সমাধানের চেষ্টায় তা করেছি। তোমরা এখন এমন অবস্থায় পৌঁছেছ যেখানে আর কোনো প্রতিরোধ গড়া মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। এতে কোনো লাভও হবে না। তা শুধু প্রাণহানি আর ধ্বংস ডেকে আনবে। এখন তোমরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নাও যাতে সশস্ত্র বাহিনী, পশ্চিম পাকিস্তানি এবং আমাদের অনুগত মানুষদের সবার প্রাণ রক্ষা পায়। এরই মধ্যে আমি জাতিসংঘের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি, যাতে তারা ভারতীয় বাহিনীকে বলে পূর্ব পাকিস্তানে হামলা বন্ধ করতে, আর সশস্ত্র বাহিনী ও অন্য লোকদের নিরাপত্তা বিধান করে, যারা দুষ্কৃতকারীদের টার্গেট।
ইয়াহিয়া বার্তাটা দেখলেন। মদে তার নেশা ধরেছে, হাত কাঁপছে। তিনি বললেন, পূর্ব পাকিস্তান গোল্লায় যাক। আমাদের মানুষগুলোকে বাঁচাও। রেকর্ড প্লেয়ারে একটা গান ছেড়ে দাও। গজল…ম্যাডাম নুরির গজল…
.
নিয়াজি, রাও ফরমান আলী আর জামশেদ রহিম ঢাকার হেডকোয়ার্টারের ভূগর্ভস্থ নিরাপদ কক্ষে বসে এই টেলিগ্রামের মানে খুঁজতে লাগলেন! প্রেসিডেন্ট কী বললেন? আত্মসমর্পণ করতে বললেন নাকি না! এদিকে মাথার ওপর আবাবিল পাখির ঢিলের মতো হাজার হাজার লিফলেট নেমে আসছে। পাকিস্তানি সৈন্য ও অফিসাররা, মিলিটারির প্রতি এটা মিলিটারির আহ্বান। সারেন্ডার করো। জেনেভা কনভেনশন অনুসারে তোমাদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা দেওয়া হবে।
নিয়াজি বললেন, চলো, আমরা চীনের কূটনীতিকদের কাছে যাই। রাও ফরমান বললেন, ইন্ডিয়া চীনকে একটা পয়সা পাত্তা দেবে না।
বিকেল চারটায় নিয়াজি আর রাও রওনা হলেন তেজগাও-কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্ট হেডকোয়ার্টার থেকে মতিঝিল আদমজী কোর্ট ভবনের দিকে। আমেরিকার কনসুলেট অফিস।
তারা দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলেন।
হার্বার্ট স্পিভাক সেখানে ছিলেন।
নিয়াজি বললেন, আপনি আমাদের বন্ধু। আমেরিকা পাকিস্তানের অকৃত্রিম বন্ধু। দুঃসময়ের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু।
স্পিভাক বললেন, বলুন আমি আপনাদের কীভাবে সাহায্য করতে পারি?
আপনি জাতিসংঘের মাধ্যমে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার ব্যবস্থা করুন।
স্পিভাক করুণ মুখে হাসলেন। বললেন, বসুন। আমেরিকা, চীন, রাশিয়া প্রাণপণে ১০ দিন ধরে চেষ্টা করছে যুদ্ধবিরতির। আমাদের প্রেসিডেন্ট, আমাদের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা, আমাদের জাতিসংঘ প্রতিনিধি পুরো স্টেট ডিপার্টমেন্ট পারছে না। আমি এখান থেকে জাতিসংঘে কী করতে পারব? আপনারা জাতিসংঘের কাছে যান।
আপনি বুঝতে পারছেন না পরিস্থিতি ভয়াবহ। ঢাকায় রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ হবে। ভারতীয়রা বোমা মেরে পুরো ঢাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত করবে। মানুষের জীবন রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য।
স্পিভাক বললেন, আপনারা যুদ্ধ শুরু করেছিলেন কেন? এটা তো একজন বোকাও জানে যে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাধলে আপনারা পারবেন না। পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, এটা তো এক বছর আগে থেকে সবারই জানা।
আমরা আপনার কাছে সাহায্য চাই।
আমেরিকা আপনাদের কোনো রকমের সাহায্য করতে পারবে না। আমি একটা কাজই করতে পারি। আমাদের যোগাযোগ করার যন্ত্র আছে। আপনার বার্তা আমি ভারতীয়দের কাছে পাঠাতে পারি। মনে রাখবেন, এটা হলো শুধু একটা যন্ত্রের ব্যবহার। আমরা কমিউনিকেশন টুল। আমরা যোগাযোগকারী নই। আমরা মধ্যস্থতাকারীও নই। আমার সরকার সেই এখতিয়ার আমাকে দেয়নি।
রাও ফরমান আর নিয়াজি বসে বার্তা তৈরি করলেন। এর আগে রাও যে বার্তা তৈরি করেছিলেন, এটা সে রকমেরই। গভর্নর মালিকের বার্তায় পূর্ব পাকিস্তানের শাসনভার আওয়ামী লীগের হাতে তুলে দেওয়ার কথা ছিল। এটাতে তা নেই। সব পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্য, নাগরিক, সমর্থকদের নিরাপত্তা সাপেক্ষে যুদ্ধবিরতি ছিল বার্তার মূল কথা।
নিয়াজি সই করলেন। রাও সই করলেন। বার্তাটা স্পিভাকের হাতে তুলে দিয়ে তাঁরা চলে এলেন হেডকোয়ার্টারে।
স্পিভাক আমেরিকান কূটনীতিক। তিনি বার্তা সরাসরি ভারতের কাছে পাঠাতে পারেনই না। তিনি পাঠালেন ওয়াশিংটনে। পাঠালেন রাওয়ালপিন্ডিতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডের কাছে।
রাওয়ালপিন্ডিতে ফারল্যান্ড বার্তার কপি পাঠালেন ইয়াহিয়ার কাছে। এটাতে কি প্রেসিডেন্টের সম্মতি আছে? প্রেসিডেন্ট অফিসে ছিলেন না। তিনি তাঁর বিনোদনের জলসায় বসে মদ্যপান করছেন। তাঁর প্রমোদসঙ্গিনীরা তার মাথার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। তাদের দিকে তাকানোর মতো জোরও তিনি পাচ্ছেন না। মিসেস শামীম বিদায় নিয়ে যাচ্ছে অস্ট্রিয়ার রাষ্ট্রদূত হয়ে। ব্ল্যাক বিউটি। তার সম্মানে পার্টি।
বার্তা নিয়ে মিলিটারি সেক্রেটারি ইসহাক ঢুকে গেলেন সেই পার্টিতে।
কী চাও? ইয়াহিয়া বললেন। মদের গেলাস থেকে একঝলক মদ তাঁর শার্টে পড়ে গেল।
নিয়াজি আর রাও এটা পাঠিয়েছেন আমেরিকানদের কাছে। ইন্ডিয়ানদের পাঠানো হচ্ছে।
কী বিষয়ে?
ইস্ট পাকিস্তানে সিজ ফায়ার।
ইস্ট পাকিস্তান? সেটা আবার কী? আমি কী করতে পারি? ইস্ট পাকিস্তান নিয়ে আমার কিছু বলার নেই।
তিনি গুনগুন করে গান গাইতে লাগলেন। তাঁর চোখের দৃষ্টি পৃথিবীর বাইরে। তিনি এই জগতে বিরাজ করছেন না।
১০৫
ভুট্টো নিজেকে ভাবছেন একজন হিরো।
নিউইয়র্কের হোটেলের রুমে আয়নায় নিজেকে দেখে নিলেন। সাদা শার্ট। কালো কোট। কালো টাই। মাথার সামনে টাক। সেটা তাকে একটু বিদ্বান বলে চিহ্নিত করছে, মন্দ না। এই চেহারা আর অনলবর্ষী বক্তৃতা দিয়ে তিনি জনতাকে বশ করেন আর পটিয়ে ফেলেন নারীদের। তিনি আজকে একটা শো। করবেন। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে একটা অনলবর্ষী ভাষণ দেবেন। কী বলবেন, একবার রিহার্সাল করা দরকার। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি। একটা ভাষণ দিয়ে নিলেন। নিজের পারফরম্যান্সে নিজেই মুগ্ধ হয়ে তিনি হোটেলকক্ষ থেকে বের হলেন।
তিনি লিফটে এলেন। ১৫ ডিসেম্বরের শীতে নিউইয়র্কে ম্যানহাটানের রাস্তাগুলোর ম্যানহোল থেকে ধোয়া উঠছে। মাঠগুলোয় তুষার দেখা যাচ্ছে। পাকিস্তান দূতাবাস থেকে আসা গাড়ি এবং অফিসাররা তাঁকে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে পৌঁছে দিলেন। তাঁকে বরণ করে নিলেন জাতিসংঘে পাকিস্তানের প্রতিনিধি। সবাই ধোপদুরস্ত পোশাকে তরবারির মতো ঝকঝক করছে। সবাই পরেছে কালো কোট, কালো টাই। তাদের দলটাকে সত্যি ভালো দেখাচ্ছে।
তিনি নিরাপত্তা পরিষদের সভাকক্ষে গিয়ে বসলেন। দর্শক গ্যালারিতে পাকিস্তানের কিছুসংখ্যক ছাত্র উপস্থিতি। তারা ভুট্টোর শো দেখতে এসেছেন।
পোল্যান্ড নিরাপত্তা পরিষদে নতুন প্রস্তাব এনেছে। নিঃসন্দেহে এটা এসেছে সোভিয়েতদের কাছ থেকে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং উদ্বিগ্ন নন। তবে কৌতূহলী। তাদের নীতি হলো, যথাসম্ভব জাতিসংঘের কার্যক্রমকে বিলম্বিত করে দেওয়া। আর দু-এক দিনের মধ্যেই পাকিস্তানি বাহিনী পূর্ব কমান্ডে আত্মসমর্পণ করবে। কাজেই পোল্যান্ডের প্রস্তাব যদি গৃহীতও হয়, তবু ভারত তা মানবে না। শেষ আঘাত ভয়ংকর শক্তিতে হানবে পূর্ব সেক্টরে, ঢাকায় হার মানাবে পাকিস্তানি বাহিনীকে। ইন্দিরা গান্ধীর এই পরিকল্পনা শরণ জানেন।
ইন্দিরা গান্ধী ডি পি ধরকে পাঠিয়েছেন মস্কোতে। সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সি কোসিগিনকে একটা চিঠি দিয়ে। কোসিগিন তখন অশ্বথপাতার মতো থরথর করে কাঁপছেন। তিনি বললেন, ভারতের অভিযানের অবস্থা কী? যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। ইন্দিরা গান্ধী নিক্সনকেও চিঠি লিখেছেন। তিনি কূটনৈতিকভাবে যা করার করছেন, কিন্তু তিনি তাঁর প্ল্যান জানেন। দু এক দিনের মধ্যেই বাংলাদেশকে মুক্ত করে ফেলতে হবে। দ্রুত। ভারত সব মাধ্যমে সবাইকে এই একটা বার্তা দিচ্ছে, এই লড়াই বাংলাদেশের, ভারত মোটেও নিজের সাম্রাজ্য বিস্তার করছে না, পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে চায় না, পশ্চিম পাকিস্তানে কোনো ভূমিই সে দখল করবে না, আজাদ কাশ্মীর দখল করে নেওয়ার কোনো ইচ্ছা তার নেই।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে পোল্যান্ডের প্রস্তাব হলো, এখনই যুদ্ধবিরতি। যে সৈন্য যেখানে আছে, সেখানে সে অবস্থাতেই স্থির হয়ে যাবে। শেখ মুজিবের হাতে পুবের ক্ষমতা দেওয়া হবে। আর পাকিস্তান পুব থেকে। তার সব সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন এই প্রস্তাবে ভেটো না-ও দিতে পারে। নিক্সন, কিসিঞ্জার সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছেন। সোভিয়েত-আমেরিকা সম্পর্ক চিরদিনের জন্য নষ্ট হয়ে যাবে বলে হুমকি দিয়েছেন।
ভুট্টো এলেন জাতিসংঘ দপ্তরে। তিনি নিরাপত্তা পরিষদে একটা বিবৃতি দিতে চান।
তিনি ফ্লোর নিলেন। বলতে শুরু করলেন : জাতিসংঘ ব্যর্থ। এই নিরাপত্তা পরিষদ ব্যর্থ। চার দিন ধরে আমি এই বিতর্কে অংশ নিচ্ছি। গতকাল দেড় ঘণ্টা ধরে শুধু এই আলোচনা হয়েছে যে আজ কি অধিবেশন সাড়ে নয়টায় শুরু হবে, নাকি সকালের নাশতা, রাতের ঘুমের জন্য ১১টায় শুরু হবে?
গোটা অধিবেশনের একটাই লক্ষ্য। বিলম্বিত করা। যাতে ঢাকার পতন ঘটে।
ঢাকার পতন ঘটলে কী এসে যাবে? সারা পূর্ব পাকিস্তানের পতন ঘটলে কী এসে যাবে? সারা পাকিস্তানের পতন ঘটলেই-বা কী এসে যায়? আমরা নতুন পাকিস্তান গড়ে তুলব।
তাঁর সঙ্গে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি আগাশাহি। আরও ৬ জন। সবার মুখ পাথরের মতো শক্ত, মেঘলা আকাশের মতো থমথমে।
ভুট্টো বলেন, আমরা হাজার বছর ধরে লড়ব। ভারত আজ তার সামরিক সফলতায় পাগল হয়ে গেছে। এ হচ্ছে কেবল শুরু। আজ পাকিস্তানে আমরা গিনিপিগ। কাল অন্যরাও গিনিপিগ হবে। আপনারা চান আমরা পা চাটি। আমরা পা চাটব না। আমি ইঁদুর নই। আমার জীবনে। আমি কখনো ইঁদুরের কাজ করিনি। আমাকে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছিল। আমি সাহসের সঙ্গে তা প্রতিরোধ করেছি। আমি নত হব না। আমি এই নিরাপত্তা পরিষদ ছেড়ে চলে যাচ্ছি। আমি নিজেকে অপমানিত মনে করছি। আমার দেশকে অপমানিত করা হয়েছে মনে করছি। আমি আগ্রাসনকে বৈধতা দেবার অংশ হতে পারি না। আমরা ফিরে যাব এবং লড়াই করব। আমার দেশ আমাকে চাইছে। আপনি আপনার নিরাপত্তা পরিষদ নিয়ে থাকুন।
ভুট্টো পোল্যান্ডের কাগজ ছিঁড়ে ফেলেন। রাগে কাপেন। চোখের পানি ফেলেন। তারপর তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে তিনি পরিষদ কক্ষ ত্যাগ করেন।
গ্যালারিতে পাকিস্তানি ছাত্ররা হাততালি দিয়ে ওঠে: ভুট্টো কামাল কর দিয়া।
.
ব্যাঙ্গমা বলল, ভুট্টোর আসল উদ্দেশ্য পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণরে নিজের দাপট দেখানো। তিনি দেশের সেনাবাহিনীর অপমান বন্ধ করার থাইকা নিজের ক্ষমতার পথ প্রশস্ত করার দিকেই নজর দিতেছেন।
ব্যাঙ্গমি বলল, আর ভুট্টো যদি পোল্যান্ডের প্রস্তাব পাস হইতে দিতেন, একই ফল ঘটত, যা ১৬ তারিখে ঘটব, মুজিব বাংলাদেশে ক্ষমতা পাইতেন, পাকিস্তানি সৈন্যরা পূর্ব বাংলা ছাড়ত। আর বাংলাদেশ স্বাধীন ও শত্রুমুক্ত হইয়া যাইত। পাকিস্তানি সৈন্য ও জনতা কইত, এইটা ভুট্টো করাইছেন। এখন তিনি কইতে পারবেন, আমি আত্মসমর্পণের লজ্জার অংশ না।
.
ভুট্টো কাগজ ছিঁড়ে ফেললে ভারতীয়রা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। যাক। ভারত যা চায়, ভুট্টো তা-ই করলেন। যুদ্ধবিরতি হচ্ছে না। আত্মসমর্পণ করছে পাকিস্তানিরা।
১০৬
জেনারেল মানেকশর কাছে পৌঁছে গেল নিয়াজির বার্তা। তিনি জবাব পাঠালেন। ওকে, আমরা যুদ্ধবিরতিতে যাচ্ছি। সদিচ্ছার প্রমাণ হিসেবে ১৫ ডিসেম্বর বিকেল ৫টা থেকে ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টা পর্যন্ত সব ধরনের হামলা বন্ধ থাকবে।
চুক্তি যা করার করবে ইস্টার্ন কমান্ড। আমরা রেডিও লিংক দিয়ে দিচ্ছি। ইস্টার্ন কমান্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করো। মনে রেখো, ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টার মধ্যে যদি রাজি না হও, তাহলে একযোগে আক্রমণ করা হবে।
.
ঢাকা চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে মুক্তিবাহিনী। হাজারে হাজারে। মিত্রবাহিনী আসছে। তাদের সঙ্গে ভারী অস্ত্র, অনেক রসদ, অনেক গোলাবারুদ। তাদের। আসতে সময় লাগছে। মুক্তিবাহিনীর ভারতে ট্রেনিংপ্রাপ্তরা ছাড়াও স্থানীয়ভাবে ট্রেনিং পাওয়া, কখনো ভারতে না যাওয়া এবং শত্রুদের অস্ত্র কেড়ে নেওয়া হাজার হাজার যোদ্ধা খালি পায়ে, নৌকায়, সাইকেলে, রিকশায়, গাড়ি করে, বাসে চড়ে, ট্রাকে চড়ে ঢাকার দিকে আসছে। এর মধ্যে ২ নম্বর সেক্টর থেকে ট্রেনিং ও অস্ত্র নিয়ে আসা আরবান গেরিলারা আছে ঢাকার ভেতরেই।
.
১৫ ডিসেম্বরে মেজর গান্ধর্ব নাগরা রাত কাটাচ্ছেন টাঙ্গাইল সার্কিট হাউসে। রাত ১১টা। কাদের সিদ্দিকী টাঙ্গাইলের জেলা পরিষদ ভবনে অফিস বানিয়ে কাজ করছেন। নাগরার ফোন এল তার কাছে। বারো হাজার সৈনিকের নাশতা লাগবে। এটা কি এখন থেকে ৪-৫ ঘণ্টার মধ্যে জোগাড় করে দেওয়া যাবে?
কাদের সিদ্দিকী বললেন, টাঙ্গাইল আমার এলাকা। আপনি এখানে আছেন। আমিও আছি। টাঙ্গাইলে বসে যদি কয়েক হাজারজনের নাশতা না দিতে পারি, কী পারব তাহলে? মেনু বলুন।
রুটি-হালুয়া। চা হলে ভালো হতো। কিন্তু সৈন্যরা ঢাকার কাছে। এত দূর চা নিয়ে যাবেন কী করে?
কাদের সিদ্দিকী অর্ডার দিলেন। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে প্রত্যেক গ্রামে প্রত্যেক মহল্লায় যে সংগ্রাম কমিটি করতে বলেছিলেন, তা সেই মার্চ থেকে অনেক কাজে লেগেছে। এইবারও লাগল। কাদের সিদ্দিকীর বাহিনীর কর্নেল ফজলু, কর্নেল নিয়ত আলী, ক্যাপ্টেন খোরশেদ, মোয়াজ্জেম লেগে পড়লেন দুই শ মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে। কুড়ি হাজার রুটি, কুড়ি হাজার পরোটা, ত্রিশ হাজার পাউরুটির স্লাইস, দশ ডেকচি ডাল, দশ ডেকচি খাসির মাংস, দশ হাঁড়ি সবজি তৈরি হলো ৬ ঘণ্টা ধরে।
ভোর ছয়টায় দুটো হেলিকপ্টার এল। নাশতা উঠল অর্ধেক একটাতে। আরেকটায় জেনারেল নাগরা, কাদের সিদ্দিকী উঠলেন।
আধঘণ্টার মধ্যে তারা প্রথমে নামলেন গাজীপুর মৌচাক স্কাউট ক্যাম্পে। ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার ছুটে এলেন। এটা তাঁর সদর দপ্তর। তিনি বললেন, খবর শুনেছ? নিয়াজি সম্ভবত আত্মসমর্পণ করবে।
ক্লেয়ারকে নিয়ে তারা আবার উঠলেন হেলিকপ্টারে। আরেকটা হেলিকপ্টার নাশতা আনা-নেওয়া করছে টাঙ্গাইল থেকে।
তারা সাভার মিরপুর রোডের ওপরে হেলিকপ্টার নামালেন। এখানে আছেন ব্রিগেডিয়ার সান সিং। তিনি এলেন। বললেন, সারা রাত ভয়াবহ যুদ্ধ হয়েছে।
সান সিংয়ের কমান্ডে যৌথ বাহিনী মিরপুরের দিকে দুই কলামে রাস্তার দুই ধার দিয়ে ঢাকার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
কাদের সিদ্দিকী, নাগরা, ক্লেয়ার, সান সিংও যাচ্ছেন। আধা মাইল দূরে আরেকটা সেতুর কাছে যেতেই দেখা গেল, মুক্তিযোদ্ধারা দৌড়ে দৌড়ে আসছে। তারা বলল, তারা অনেক আগেই এখানে পৌঁছে গেছে।
কীভাবে পারলে? নাগরা বললেন। তোমরা তো আমাদের সাথেই ছিলে?
ওরা হাসল। বলল, আমরা মুক্তিযোদ্ধা। আমরা তো আগে আগেই যাব। এটা আমাদের চেনা জায়গা।
সান সিং হুকুম করলেন, সোলসার্জ, কুইক মার্চ। সামনে শত্রু নেই। দ্রুত চলো।
সকাল আটটার মধ্যে তারা হেমায়েতপুর সেতুর ওপরে পৌঁছালেন। মেজর জেনারেল নাগরা দুরবিন দিয়ে দেখতে লাগলেন ঢাকা। ঢাকার স্কাইলাইন খালি চোখেই দেখা যাচ্ছে। দুরবিনে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আর্কিটেক্ট লুই কানের নকশা করা জাতীয় সংসদ ভবনের চূড়া।
নাগরা গাড়ির বনেটে কাগজ রাখলেন। কলম বের করে তিনি নিয়াজির উদ্দেশে লিখতে লাগলেন :
প্রিয় আবদুল্লাহ,
আমরা এসে গেছি। আমি এখন মিরপুরে। তুমি আমার কামানের ব্যারেলের রেঞ্জের মধ্যে। অযথা রক্তক্ষয় কোরো না। আত্মসমর্পণ করো। তোমাদের জেনেভা কনভেনশন অনুসারে মর্যাদা ও নিরাপত্তা দেওয়া হবে। তুমি কি আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে তোমার কোনো অফিসারকে পাঠাবে?
তোমারই মেজর জেনারেল নাগরা
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১
সকাল ৮টা ৩০।
.
দুটো গাড়ি নিয়ে ৬ জন যাচ্ছে মিরপুর থেকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের দিকে। চারজন ভারতীয়, দুজন মুক্তি। তাদের সঙ্গে সাদা পতাকা নেই। সাদা শার্ট ছিঁড়ে দুটো সাদা পতাকা বানিয়ে গাড়ির সঙ্গে বাঁধা হলো।
তারা ঢুকে গেল ক্যান্টনমেন্টে। সেনাসদরে গেল। চিঠি দেখাল। বলল, এই চিঠি জেনারেল নিয়াজির কাছে পৌঁছে দাও।
তখন সকাল নয়টা। নিয়াজি, জামশেদ, রাও, রিয়ার অ্যাডমিরাল শরিফ হেডকোয়ার্টারেই আছেন। সারা রাত ঘুমাননি।
চিঠি নিয়ে ব্যাটম্যান গেল তাদের কাছে।
রাও ফরমান বললেন, এই লোক কি ভারতীয়দের পক্ষ থেকে দেনদরবার করতে এসেছে?
নিয়াজি চুপ করে থাকলেন।
রাও ফরমান বললেন, আপনার কাছে কি কোনো রিজার্ভ আছে?
নিয়াজি নীরব।
শরিফ পাঞ্জাবিতে বললেন, কুচ পাল্লে হ্যায়? থলেতে কি কিছু আছে? নিয়াজি তাকালেন জামশেদের দিকে। জামশেদ ভাবলেন, কিছু কাদালেপা মাইক্রোবাস আর আলবদর আছে। তারা বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করছে। এটা তো রাও ফরমান আলীও জানেন, নিয়াজিও জানেন। এর বাইরে তো আর কিছু নেই।
জামশেদ না-সূচক মাথা নাড়লেন।
রাও ফরমান আর শরিফ একসাথে বলে উঠলেন, তাইলে আর কী! নাগরাকে ডেকে এনে জামাই আদর করুন।
নিয়াজি বললেন, জামশেদ। যাও। নাগরাকে নিয়ে এসো।
সামরিক ওয়্যারলেসগুলো সচল হয়ে উঠল। ক্যান্টনমেন্ট মিরপুর রোডে ইন্ডিয়ানরা ঢুকবে। কেউ হামলা কোরো না।
জামশেদ বার্তা বাহকদের বললেন, তোমরা যাও। আমরা আসছি।
সারেন্ডার করছ?
আমরা সিজ ফায়ার করব। নাগরাকে রিসিভ করতে আমি যাব।
মেজর জেনারেলের ব্যাজ দেখে ওরা আশ্বস্ত হলো। ওদের মনে ফুর্তি। সারেন্ডার হতে যাচ্ছে।
ওরা দুই জিপ তীব্র বেগে ছুটিয়ে মিরপুরের দিকে ছুটল। বাতাসে সামনের জিপের সাদা পতাকা খুলে গেছে, তারা টের পায়নি।
মিরপুরের কাছে যেতেই মিত্রবাহিনী গুলি ছুঁড়ে বসল।
নিজেদের গুলিতে মারা গেল দুজন। আহত দুজন।
তাদের হেলিকপ্টারে করে হাসপাতালে পাঠানো হলো।
পেছনের গাড়ির বাহকেরা জানাল, মেজর জেনারেল জামশেদ আসছেন।
.
মেজর জেনারেল জামশেদ আরও কয়েকজন অফিসার একটা মার্সিডিজ বেঞ্জ আর দুটো জিপ নিয়ে চলে এলেন মিরপুরে। নিজেদের বেল্ট, ক্যাপ খুলে দিলেন নাগরার হাতে। অস্ত্র তুলে দিলেন।
নাগরা, ক্লেয়ার, কাদের সিদ্দিকী তাদের সঙ্গে চলে এলেন ক্যান্টনমেন্ট হেডকোয়ার্টারে।
নিয়াজির রুমে বসলেন।
নিয়াজি এলেন। স্যালুট করলেন। সবার সঙ্গে হাত মেলালেন। হাত বাড়ালেন কাদের সিদ্দিকীর দিকে। কাদের সিদ্দিকী হাত ফিরিয়ে নিলেন। বললেন, আমি কোনো খুনির সঙ্গে হাত মেলাই না।
ব্রিগেডিয়ার বকর ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। দুপুরে লাঞ্চ করতে আসবেন। জেনারেল জ্যাকব। ভালো খাবার দরকার। হেডকোয়ার্টারের রুমগুলো সব নোংরা। পরিষ্কার করা দরকার। মেহমানরা আসছেন। কী লজ্জা! কত দিন। এগুলো ঝাড়ু দেওয়া হয় না। এখানে-ওখানে ম্যাপ পড়ে আছে। তিনি সব। গোছগাছ করলেন। দুপুরের খাবারের মেনু কী হবে জিজ্ঞেস করলেন।
কাদের সিদ্দিকী বললেন, আত্মসমর্পণ হতে হবে রেসকোর্স ময়দানে। নাগরাকে তিনি বিশেষভাবে বললেন, আমি একটু টাঙ্গাইল ঘুরে আসব। এখুনি বের হব। বিকেলের আগেই পৌঁছাব। আপনি রেসকোর্সের ব্যাপারটা এনশিওর করবেন। কাদের সিদ্দিকী বিদায় নিলেন।
.
নাগরা আর নিয়াজি পূর্বপরিচিত। পুরোনো দোস্ত।
নিয়াজি কৌতুক বলতে শুরু করলেন। সবই অশ্লীল কৌতুক। একজন সৈনিক মরুভূমিতে গেছে যুদ্ধ করতে। সে একটা উটের রাখালকে বলল, সেক্স উঠলে তোমরা কী করো। রাখাল উট দেখিয়ে দিল…
১০৭
জেনারেল জ্যাকব কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে তাদের হেডকোয়ার্টারে। সকালবেলা তিনি নাশতা করছিলেন মাংস আর নানরুটি। মাংসে ঝাল বেশি হওয়ায় তাঁকে পানি খেতে হলো। নাশতাটা ভালো হলো না। চায়ের কাপে বেশি করে দুধ ঢেলে নিয়ে তিনি মুখে দিচ্ছেন। এই সময় ফোন বেজে উঠল। তিনি উঠে গিয়ে ফোন ধরলেন।
জ্যাক-ফোনের ওপার থেকে আওয়াজ এল।
ইয়েস স্যার।
সকালের নাশতা কেমন হয়েছে?
ভালো না।
গুড। পেট খালি রাখো।
কেন স্যার?
দুপুরে নিয়াজির সঙ্গে লাঞ্চ করতে হবে।
এটা কি রসিকতা নাকি অফিশিয়াল অর্ডার।
অফিশিয়াল অর্ডার। সে তোমাকে ইনভাইট করেছে।
আচ্ছা আমি যাচ্ছি। কিন্তু সারেন্ডারের ডকুমেন্ট আমি যে একটা বানিয়েছি, এটা কি আপনারা দেখেছেন?
না। তুমি নিজের মতো করে করো। জ্যাক, একটা কথা বলি, বেশি জোরাজুরি কোরো না। শুধু একটা পয়েন্ট, সিজ ফায়ারেই রাজি হয়ে যেয়ো না। ওরা অস্ত্রসমর্পণ করবে।
ওকে। আমি একটা ডিড করেছি। সেটা আমি অরোরাকে দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।
জ্যাকব যৌথ বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে গেলেন। পথে দেখা পেলেন মিসেস অরোরার। তিনি বললেন, আত্মসমর্পণ দেখতে আমি ঢাকা যাচ্ছি। আমি আমার হাজব্যান্ডের পাশে বসব।
ঢাকা এখনো নিরাপদ নয়।
তাহলে আমি আমার স্বামীকে ছাড়ব কেন?
জ্যাকব জেনারেল অরোরার কাছে গেলেন। আত্মসমর্পণের ড্রাফট দেখালেন। অরোরা বললেন, ঠিক আছে।
জ্যাকব উঠলেন। আরও কিছু কাজ বাকি। দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের নিতে হবে। নিউইয়র্ক টাইমস-এর সিডনি শনবার্গ বলে রেখেছেন সেই ৩ ডিসেম্বরে। তাঁকে যেন আত্মসমর্পণে নিয়ে যাওয়া হয়। সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশের প্রধান সেনাপতি এম এ জি ওসমানী এবং উপ-সেনাপতি এ কে খন্দকারকে নিতে হবে। আত্মসমর্পণ হবে যৌথ বাহিনীর কাছে, ভারতীয় কমান্ডের কাছে নয়।
জ্যাকব হেলিকপ্টারে উঠে পড়লেন। যশোরে গিয়ে জ্বালানি ভরতে হলো। দুপুরের মধ্যে তিনি পৌঁছে গেলেন ঢাকা এয়ারপোর্টে। তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে ব্রিগেডিয়ার বকর সিদ্দিকী উপস্থিত আছেন।
জ্যাকব নেমে প্রথমে জেনারেল অরোরাসহ কলকাতা থেকে জেনারেল ও সাংবাদিকদের নিয়ে আসা হেলিকপ্টারগুলোর অবতরণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যাপারটা দেখলেন। তারপর তাঁরা চললেন নিয়াজির অফিসের দিকে।
পথে মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা তাদের গতিরোধ করে।
জ্যাকব বলেন, আজ বিকেলে সারেন্ডার হবে।
তারা বলে, আমরা হেডকোয়ার্টার দখল করব। নিয়াজিকে হত্যা করব।
জ্যাকব বলেন, খবরদার। যুদ্ধের নিয়ম এটা না। রক্তপাতহীন সারেন্ডার হবে। তোমাদের সরকার ক্ষমতা নেবে। তারা বিচারের ব্যবস্থা করবে। সবাইকে ডিসিপ্লিন মানতে বলো। সবাইকে… গো… ডু ইট…
১০৮
জেনারেল ওসমানীকে তাজউদ্দীন বলে রেখেছেন, যেকোনো সময় আত্মসমর্পণের ঘোষণা আসবে। আপনি কোথাও যাবেন না। আপনি আপনার সদর দপ্তরে থাকুন।
ওসমানী চুপ মেরে গেলেন। তারপর বললেন, সারেন্ডারের অনুষ্ঠানে কি মানেকশ যাবে?
না। ইস্টার্ন কমান্ডার লে. জেনারেল অরোরা যাবেন।
তাহলে আমি কী করে যাব? আমার উপপ্রধান যেতে পারেন।
আপনি যাবেন, কারণ যৌথ কমান্ডের প্রধান আপনি আর অরোরা সাহেব।
আচ্ছা। আমি তাহলে প্রথমে যাব সিলেটে। হজরত শাহজালালের দরগা জিয়ারত করতে।
তাজউদ্দীন অসহায় বোধ করতে লাগলেন। সারাটা যুদ্ধে ওসমানী তার রুমে থাকতে ভালোবাসতেন। তিনি যুদ্ধকৌশল নিয়ে বই লিখেছেন। সৈয়দ নজরুল সাহেব বলেছিলেন, যুদ্ধের মধ্যে এই বই কে পড়বে? এটা বই লেখার সময়?
ওসমানী তাঁর এডিসি শেখ কামাল, কর্নেল রব, ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার উজ্জ্বল গুপ্তকে নিয়ে হেলিকপ্টারে উঠলেন। সিলেট যাচ্ছেন।
কিন্তু পথে পাকিস্তানি বাহিনী গুলি ছুঁড়ে বসল। গুলি হেলিকপ্টারের তেলের ট্যাংকি ফুটো করে দিল। সেই তেল হেলিকপ্টারের ভেতরেই পড়ছে। ওসমানী তার জ্যাকেট খুলে সেটা দিয়ে ফুটাটা চেপে ধরতে গেলেন। গরম তেল হাত পুড়িয়ে ফেলল।
সঙ্গে ছিলেন কর্নেল রব সাহেব। তাঁর পায়ে গুলি লেগেছে। ব্রিগেডিয়ার উজ্জ্বলের কবজি ফুটো হয়ে যায়। শেখ কামাল অক্ষত থেকে যান।
পাইলট বললেন, আমাদের অবতরণ করতে হবে। এইভাবে চলা রিস্কি। আমরা জানি না হেলিকপ্টারের আর কী ক্ষতি হয়েছে।
হেলিকপ্টার এক পাশে কাত হয়ে গেল। আবার সোজা হলো। সোজা নিচে নামতে লাগল।
ওসমানী বললেন, ওই মাঠের মধ্যে ল্যান্ড করো। ওই মাঠে।
পাইলট স্কোয়াড্রন লিডার আলম বললেন, স্যার। অধীর হবেন না। পাখা ঠিক আছে। কাজেই আমরা ঠিকঠাক ল্যান্ড করতে পারব।
তারা মিত্রবাহিনীর একটা ঘাটির কাছে অবতরণ করলেন। মিত্রবাহিনীর লোকেরা এসে তাদের সালাম করল। মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা ওসমানী এবং বিশেষ করে শেখ কামালকে দেখে খুশি হলো খুব। তারা বলল, আমরা যোগাযোগ করছি। আরেকটা হেলিকপ্টার আনিয়ে দিচ্ছি।
টাইগার ওসমানী বললেন, আমি আর হেলিকপ্টারে উঠব না। আমাকে শিলং এয়ারপোর্টে পৌঁছে দাও। আমি প্লেনে ঢাকা যাব।
শেখ কামাল বললেন, স্যার। চলেন যাই। পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করছে। দেশ শত্রুমুক্ত হচ্ছে। এইটা একটা ঐতিহাসিক ঘটনা। এটার সাক্ষী হতে পারা বিরল সৌভাগ্যের ব্যাপার। আপনি আমাদের প্রধান সেনাপতি। আপনি থাকবেন না, এটা হয় না!
বাবা, আমি আর জীবনেও হেলিকপ্টারে উঠব না বাবা! তুমি যদি যেতে চাও যাও।
.
মুজিবনগর সরকার পাগলের মতো এ কে খন্দকারকে খুঁজছে। তিনিও অফিসে নেই। তিনি তখন কলকাতা নিউমার্কেটে। গলায় বাঁধার জন্য মাফলার খুঁজছেন। ইদানীং বেশ ঠান্ডা পড়েছে। আর শার্টের সঙ্গে মাফলার পরলে তাকে সুন্দর দেখায়।
মুজিবনগর সরকারের লোকেরা, গোয়েন্দারা, বিএসএফের লোকেরা নিউমার্কেট চষে তাকে ধরে গাড়িতে তুলে সোজা নিয়ে এল থিয়েটার রোডের অফিসে। তাজউদ্দীনের সঙ্গে দেখা করে দ্রুত একসঙ্গে দুপুরের খাবার খেলেন তিনি।
তারপর তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলো দমদমে। তুলে দেওয়া হলো হেলিকপ্টারে।
ফারুক আজিজ খান আর নুরুল ইসলাম শিশু তাঁদের বিদায় জানাতে এসেছেন। তাদের হেলিকপ্টার শূন্যে মিলিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত তারা আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
জগজিৎ সিং অরোরা হেলিকপ্টারে উঠেছেন। তার স্ত্রীও তাঁর পাশে বসেছেন। অরোরার সঙ্গে মোটা কালো নিবের স্থায়ী কালির কলম। এটা তিনি নিউমার্কেট থেকে কিনে আনিয়েছেন। এরই মধ্যে জ্যাকবের বানানো আত্মসমর্পণের চুক্তিপত্র দিল্লি থেকে অনুমোদিত হয়ে এসেছে। সেটার অনেকগুলো কপি করা হলো এবং সঙ্গে নেওয়া হলো।
জ্যাকবের সঙ্গে কথা হয়েছে। জ্যাকব ঢাকায় লাঞ্চ করছেন।
১০৯
জ্যাকবের সামনে নিয়াজি। পাশে জেনারেল রাও ফরমান আলী, মেজর জেনারেল জামশেদ, রিয়ার অ্যাডমিরাল শরিফ, এয়ার কমোডর ইমাম। তাদের পাশে নাগরা। ঠিক বাঁ পাশে দাঁড়িয়ে আছেন ভারতীয় কর্নেল খারা।
জ্যাকব আত্মসমর্পণের কাগজটা বের করলেন। এই হলো চুক্তিপত্র।
সবাই চুপ করে আছে।
জ্যাকব টেবিলে কাগজ রাখলেন। সেটা কেউ পড়ছে না।
জ্যাকব বললেন, কর্নেল খারা। এটা পড়ে শোনাও।
খারা পড়তে লাগলেন :
পূর্ব রণাঙ্গনে ভারতীয় ও বাংলাদেশ বাহিনীর জেনারেল অফিসার কমান্ডিং ইন চিফ, লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ড বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানের সকল সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে আত্মসমর্পণে সম্মত হলো। পাকিস্তানের সেনা, নৌ, বিমানবাহিনীসহ সব আধা সামরিক ও বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষেত্রে এই আত্মসমর্পণ প্রযোজ্য হবে। এই বাহিনীগুলো যে যেখানে আছে, সেখান থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কর্তৃত্বাধীন নিয়মিত সবচেয়ে নিকটস্থ সেনাদের কাছে অস্ত্রসমর্পণ ও আত্মসমর্পণ করবে।
এই দলিল স্বাক্ষরের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ড লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরার নির্দেশের অধীন হবে। নির্দেশ না মানলে তা আত্মসমর্পণের শর্তের লঙ্ঘন বলে গণ্য হবে এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে যুদ্ধের স্বীকৃত আইন ও রীতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আত্মসমর্পণের শর্তাবলির অর্থ অথবা ব্যাখ্যা নিয়ে কোনো সংশয় দেখা দিলে, লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার সিদ্ধান্তই হবে চূড়ান্ত।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা আত্মসমর্পণকারী সেনাদের জেনেভা কনভেনশনের বিধি অনুযায়ী প্রাপ্য মর্যাদা ও সম্মান দেওয়ার অঙ্গীকার ঘোষণা করছেন এবং আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানি সামরিক ও আধা সামরিক ব্যক্তিদের নিরাপত্তা ও সুবিধার অঙ্গীকার করছেন। লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার অধীন বাহিনীগুলোর মাধ্যমে বিদেশি নাগরিক, সংখ্যালঘু জাতিসত্তা ও জন্মসূত্রে পশ্চিম পাকিস্তানি ব্যক্তিদের সুরক্ষাও দেওয়া হবে।
(জগজিৎ সিং অরোরা)
লেফটেন্যান্ট জেনারেল
জেনারেল অফিসার কমান্ডিং ইন চিফ
পূর্ব রণাঙ্গনে ভারত ও বাংলাদেশ যৌথ বাহিনী
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১
(আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি)
লেফটেন্যান্ট জেনারেল
সামরিক আইন প্রশাসক অঞ্চল বি
অধিনায়ক পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড (পাকিস্তান)
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১
রাও বললেন, বাংলাদেশ বাহিনী কেন? এটা তো আমরা মানি না।
জ্যাকব বললেন, এটা মানানোর জন্যই তো যুদ্ধ। আপনারা না মানলে আমি বাংলাদেশ বাহিনীকে ছেড়ে দেব। আপনারা কি চান মুক্তিবাহিনী হেডকোয়ার্টারে ঢুকে পড়ুক? তারা ঢুকতে চাইছে। আমি তাদের ধমক দিয়ে এসেছি।
নিয়াজি বললেন, কথাটা তো আত্মসমর্পণ নয়। যুদ্ধবিরতি।
জ্যাকব বললেন, এটা দিল্লি থেকে পাঠানো হয়েছে। আপনাদের মানতে হলে এর প্রত্যেকটা অক্ষর মানতে হবে। অসম্মানের কিছু নেই। আমিও সোলজার আপনিও সোলজার। জেনেভা কনভেনশন অনুসারে মর্যাদা পাবেন।
নিয়াজি চুপ করে রইলেন।
তারপর বললেন, এখনো আমার ৩০ হাজার সৈন্য আছে। আমি যুদ্ধ করব। (মিথ্যা কথা। কুড়িয়ে বাড়িয়ে কয়েক হাজারও হয় না। তাও তাদের হাতে অস্ত্রশস্ত্র নেই)।
জ্যাকব বললেন, বাইরে রাস্তায় ১৫ হাজার মুক্তি দাঁড়িয়ে আছে। কাদের সিদ্দিকীর দল তৈরি। তারা ভারতে ট্রেনিংপ্রাপ্ত নয়। তারা বিপজ্জনক।
সৈন্যরা আমাদের চারপাশ ঘিরে রেখেছে। আমরা প্রথমে শুরু করব এয়ার অ্যাটাক। ওকে। আপনি যদি বলেন যুদ্ধের মাধ্যমে সমাধান করবেন, আমরা তা-ই করব। আমরা এখন চলে যাব। মুক্তিবাহিনী সদর দপ্তরে ঢুকবে। তারা দাউদকান্দি থেকে এসেছে, তারা টঙ্গী দিয়ে ঢুকেছে, তারা ভৈরব দিয়ে এসেছে, তারা সাভার দিয়ে এসেছে। তারা বুড়িগঙ্গা দিয়ে আসছে। হাজার হাজার। মুক্তি…
সবাই চুপ।
আমি আধা ঘণ্টা সময় দিলাম। সিদ্ধান্ত নিন। আপনাদের সবার পরিবার আছে। সন্তানেরা আছে। ভেবে বলুন।
আধা ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। কেউ কোনো কথা বলছে না।
জ্যাকব বললেন, আপনারা চুপ করে আছেন। তার মানে আপনারা আমাদের ডিড মেনে নিচ্ছেন। ডিল ফাইনাল।
জ্যাকব কাগজ তুলে নিলেন।
নিয়াজি বললেন, আমাদের নিরাপত্তার কী হবে?
ভারতীয় সৈন্যরা আপনাদের প্রহরা দেবে। তার আগপর্যন্ত আপনারা আপনাদের পারসোনাল অস্ত্র নিজেদের কাছে রাখবেন।
নিয়াজির দুচোখ দিয়ে জল গড়াতে লাগল।
বাকি পাকিস্তানি জেনারেলরাও কাঁদতে লাগলেন।
বকর এসে বললেন, দুপুরের খাবার রেডি। চলুন মেসে যাই।