প্রত্যভিজ্ঞা দর্শন / প্রত্যভিজ্ঞাদর্শন / প্রত্যভিজ্ঞা-দর্শন
প্রত্যভিজ্ঞামতাবলম্বীরাও ভক্তবৎসল মহেশ্বরকেই জগদীশ্বর বলিয়া থাকেন এবং তুরী তন্তু প্রভৃতি জড়াত্মক বস্তু সকলকে পটাদি কার্য্যের কারণ না বলিয়া একমাত্র পরমেশ্বরকেউ জগৎ কার্য্যের কারণরূপে নির্দ্দেশ করেন। যেমন তপঃপ্রভাবশালী তাপসগণ ইস্টক ও চূর্ণ প্রভৃতি লৌকিককারণসাপেক্ষ না হইয়া স্বেচ্ছাক্রমে নিবিড় অরণ্যে অট্টালিকা নির্ম্মান এবং স্ত্রীসংসর্গ ব্যতিরেকেই মানস পুত্রাদি উৎপাদিন করিয়া থাকেন, সেইরূপ জগদীশ্বর মহাদেব জগম্নির্ম্মাণবিষয়ে জড়াত্মক জগম্নির্ম্মান করতেছেন, পরমেশ্বর ব্যতীত আর কেহই কোন কার্য্যের কারণ নহে। যদি পটাদি কার্য্যের তুরীতন্তুপ্রভৃতি জড় বস্তু কারণ হইত, তবে কখনই তুরীতন্তুপ্রভৃতি না থাকিলে কেবল যোগীদিগের ইচ্ছাদ্বারা পটাদি কার্য্য হইত না; যেহেতু কারণ না থাকিলে কখনই কার্য্য হয় না এইরূপ নিয়ম আছে; কিন্তু যখন তুরী ও তন্তু প্রভৃতি না থাকিলেও যোগীদিগের ইচ্ছাবশতঃ পটাদি কার্য্য সম্পন্ন হইতেছে, তখন পটাদি কার্য্যের প্রতি তুরীপ্রভৃতি যে বাস্তবিক কারণ নহে তাহা আর বলিবার অপেক্ষা কি। এই জগম্নির্মাণ বিষয়ে জগদীশ্বর অন্য কোন ব্যক্তি কর্ত্তৃক নিয়োজিত নহেন এবং অন্য কোন বস্তুর সহায়তাও অবলম্বন করেন না, এজন্যে তাঁহাকে স্বতন্ত্র বলা যায়। যেমন স্বচ্ছ দর্পণে বদনাদির প্রতিবিম্ব পড়িলে বদনাদি দৃষ্টিগোচর হয়, সেইরূপ জগদীশ্বরে বস্তুসকলের প্রতিবিম্ব পড়িলে বস্তু সকলের প্রকাশ হয়, এজন্য ঈশ্বরকে জগদ্দর্শনদর্পণ বলিয়া নির্দ্দেশ করিলেও করা যাইতে পারে। এবং যেমত বহুরূপী ব্যক্তিরা স্বেচ্ছাক্রমে কখন নৃপতি, কখন ভিক্ষুক, কখন স্ত্রী, কখন কুমার, কখন বা বৃদ্ধ প্রভৃতির রূপ ধারণ করিয়া থাকে, সেইরূপ ভগবান মহেশ্বরও স্থাবর জঙ্গমাদি নানারূপে অবস্থান করিতে ইচ্ছা করিয়া স্থাবর ও জঙ্গমাত্মক জগৎ নির্ম্মাণ করিতেছেন এবং ঐ ঐ রূপে অবস্থানও করিতেছেন। এজন্য এই জগৎ যে ঈশ্বরাত্মক তাহার আর সন্দেহ কি। পরমেশ্বর আনন্দস্বরূপ ও প্রমাতা অর্থাৎ জ্ঞাতা, এবং জ্ঞানস্বরূপ; সুতরাং অস্মদাদির ঘটপটাদিবিষয়ক যে যে জ্ঞান হইতেছে, সে সকলই পরমেশ্বর স্বরূপ।
যদি সকলবস্তুবিষয়ক সকল জ্ঞানই এক মাত্র ঈশ্বর স্বরূপ হয়, তবে ঘটজ্ঞানের সহিত পটজ্ঞানের ভেদ কি রইল? এইরূপ আপত্তি, বিবেচনা করিলে, উত্থাপিত হইতে পারে না। বাস্তবিক সকলবস্তুবিষয়ক জ্ঞানের ভেদ না থাকিলেও ঘট পটাদি বিষয়ের ভেদ লইয়া ঘটজ্ঞান হইতে পটজ্ঞান ভিন্ন এইরূপ ব্যবহার হইবার বাধা কি। দেখ, কুণ্ডল ও কটকাদিরূপে পরিণত সুবর্ণের বাস্তবিক ভেদ না থাকলেও কুণ্ডল ও কটকাদিরূপ উপাধির ভেদে কুণ্ডল হইতে কটকালঙ্কার ভিন্ন এইরূপ সর্ব্বজনসিদ্ধ ব্যবহার হইয়া থাকে।
এই মতে মুক্তিস্বরূপ পরাপরসিদ্ধির উপায় এক মাত্র প্রত্যভিজ্ঞা। অন্য মতের ন্যায় এই মতে পূজা, ধ্যান, জপ, যাগ ও যোগাদির অনুষ্ঠানের আবশ্যকতা নাই, প্রত্যভিজ্ঞা দ্বারাই সমুদায় সিদ্ধ হইতে পারে। “স এবেশ্বরো হহম্” এইরূপ পরমেশ্বরের সহিত জীবাত্মার অভেদ জ্ঞানকে প্রত্যভিজ্ঞা কহে। যেমন, খর্ব্বাকৃতি ব্যক্তিকে বামন কহে—এইরূপ পূর্ব্ব উপদিষ্ট ব্যক্তির, খর্ব্বাকৃতি পুরুষ দৃষ্টিগোচর হইলে, ‘ সোহয়ং বামনঃ’ (সেই এই বামন) এই রূপ যে জ্ঞান হয়, তাহাকে এতম্মতাবলম্বী ব্যক্তিদিগের প্রত্যভিজ্ঞা শব্দ দ্বারা নির্দ্দেশ করা নিতান্ত অমূলক বা স্বকপোলরচিত নহে। এইরূপ নিঃসংশয় প্রত্যভিজ্ঞা শাস্ত্রান্তরদ্বারা সমুৎপন্ন হইবার সম্ভাবনা নাই, এজন্য এই শাস্ত্র যে শাস্ত্রান্তর অপেক্ষা আদরণীয় এবং শ্রেয়স্কর তাহা আর বলিবার অপেক্ষা কি।
এই মতে জীবাত্মার সহিত পরমাত্মার ভেদ নাই, অর্থাৎ জীবাত্মাই পরমাত্মা—পরমাত্মাই জীবাত্মা; তবে যে পরস্পরের ভেদ জ্ঞান হইয়া থাকে তাহা ভ্রম মাত্র। জীবাত্মার সহিত পরমাত্মার যে অভেদ আছে তাহা অনুমান সিদ্ধ। অনুমান প্রণালী এইরূপ, যে ব্যক্তির জ্ঞান ও ক্রিয়াশক্তি আছে সে পরমেশ্বর, যাহার জ্ঞান ও ক্রিয়াশক্তি নাই সে পরমেশ্বর নহে, যেমত গৃহাদি। দেখ যখন জীবাত্মার ঐ ঐ শক্তি দৃষ্ট হইতেছে, তখন জীবাত্মা যে ঈশ্বর হইতে অভিন্ন তাহার আর সন্দেহ কি।
এ স্থলে কেহ কেহ এই রূপ আপত্তি করিয়া থাকেন যে, যদি জীবের ঈশ্বরতাই থাকে, তবে ঐ ঈশ্বরতাস্বরূপ শিবত্ব প্রাপ্তির নিমিত্ত আত্মপ্রত্যভিজ্ঞার প্রয়োজন কি? যেমত জনসংযোগাদি হইলে মৃত্তিকায় পতিত বীজ, জ্ঞাতই হউক বা অজ্ঞাতই হউক, অঙ্কুরোৎপাদন করিয়া থাকে, সেইরূপ জ্ঞাত হউক বা না হউক, বাস্তবিক যদি জীবের ইশ্বরতা থাকে, তবে ঈশ্বরের ন্যায় জীব জগম্নির্ম্মাণাদি করিতে না পারে কেন? এইরূপ আপত্তি আপাততঃ উত্থাপিত হইতে পারে বটে, কিন্তু বিবেচনা করিলে এ আপত্তি এককালেই ছিন্নমূল হইয়া যাইবে। দেখ কোন কোন স্থলে কারণ থাকিলেই কার্য্য হইয়া থাকে, আর কোন কোন স্থলে কারণ জ্ঞান হইলেও কার্য্য হয়, যতক্ষণ তাহার জ্ঞান না হয়, ততক্ষণ সে কারণ দ্বারা কার্য্য নিষ্পন্ন হয় না; যেমত এই গৃহে পিশাচ আছে এইরূপ না জানিলে তদ্গৃহস্থিত পিশাচ হইতে ভীরু ব্যক্তির কোন ভয় জন্মে না, কিন্তু ঐ রূপ জ্ঞান হইলেই ভীরু ব্যক্তির কোন ভয় জন্মে, সেই রূপ জীবের ইশ্বরতা থাকলেও উহা জ্ঞান হইলে ঈশ্বরের ন্যায় জীবের কার্য্যকরণে ক্ষমতা জন্মে না। কিঞ্চ, যেমন অপরিমিত ধন থাকিলেও উহার অজ্ঞানাবস্থায় প্রীতি জন্মে না, কিন্তু আমার অপরিমিত ধন আছে—এইরূপ জ্ঞান হইলে অসীম আনন্দ হইয়া থাকে, সেইরূপ আমিই ঈশ্বর এই প্রকার জীবের ঈশ্বরতা জ্ঞান হইলে এক অসাধারণ চমৎকার প্রীতি জন্মে, এজন্য আত্মপ্রত্যভিজ্ঞা যে অবশ্য কর্ত্তব্য সন্দেহ কি।
এই মতে পরমাত্মা স্বতঃপ্রকাশমান অর্থাৎ পরমাত্মা আপনিই প্রকাশ পাইতেছেন। যেমত আলোকসংযোগাদি না হইলে গৃহস্থিত ঘটপাটাদি বস্তুর প্রকাশ হয় না, সেরূপ পরমেশ্বরের প্রকাশে কোন কারণ অপেক্ষা করে না, তিনি সর্ব্বত্র সর্ব্বদা প্রকাশমান রহিয়াছেন। এস্থলে কেহ কেহ এরূপ আপত্তি করিয়া থাকেন যে, জীবাত্মা ও পরমাত্মার পরস্পর অভেদ আছে এবং পরমাত্মা সর্ব্বদা পরমাত্মরূপে সর্ব্বত্র প্রকাশমান আছেন, এরূপ স্বীকার করিলে জীবাত্মাও পরমাত্মরূপে সর্ব্বদা প্রকাশমান আছেন স্বীকার করিতে হইবে, নতুবা কখনই জীবাত্মা ও পরমাত্মার পরস্পর অভেদ থাকিতে পারে না; কারণ যে বস্তুর অভেদ যে বস্তুতে থাকে, সে বস্তুর প্রকাশ কালে অবশ্যই সে বস্তুর প্রকাশ হয় এরূপ নিয়ম আছে। কিন্তু পরমাত্মরূপে জীবাত্মার যে সর্বদা প্রকাশ হইতেছে ইহা স্বীকার করা যাইতে পারে না, কারণ তাহা হইলে জীবাত্মার ঐ রূপ প্রকাশের নিমিত্ত প্রত্যভিজ্ঞাদর্শনপ্রদর্শনের আবশ্যকতা কি? জীবাত্মার ঐ রূপ প্রকাশ ত সিদ্ধই আছে, সিদ্ধ বিষয় সাধনে কখনই কোন ব্যক্তির প্রবৃত্তি জন্মে না। এরূপ আপত্তি উত্থাপন করিলে এই মাত্র বক্তব্য, যেমন কোন কামাতুরা কামিনী, ঐ বাটীতে এক সুরসিক নায়ক আছে, উহার অতি মধুর স্বর, অনুপম রূপ লাবণ্য ও সহাস্য বদন, এইরূপ উপদেশ পাইয়া সেই বাটীতে সেই নায়কের নিকট গিয়া তাহাকে দর্শন করিয়াও, যত ক্ষণ তাহার ঐ সমস্ত গুণ দৃষ্টিগোচর না করে, তত ক্ষণ আহ্লাদিতা হয় না এবং তদীয় শরীরে সম্পূর্ণ সাত্বিক ভাবের আবির্ভাব হয় না, সেই রূপ পরমাত্মরূপে জীবের প্রকাশ হইলেও যতদিন পর্য্যন্ত, ঈশ্বরের ঈশ্বরতাদি গুণ আমাতেও আছে—এইরূপ অনুসন্ধান না হয়, তত দিনে পূর্ণভাবপ্রাপ্তি হইবার সম্ভাবনা নাই; কি যখন গুরুবাক্য শ্রবণ করিয়া, সর্ব্বজ্ঞত্বাদিরূপ ঈশ্বরের ধর্ম্ম আমাতেও আছে, এরূপ জ্ঞান উদয় হয়, তখন পূর্ণভাবের আবির্ভাব হইতে থাকে; অতএব ঐ পূর্ণতা লাভের নিমিত্ত প্রত্যভিজ্ঞা দর্শন অবশ্যাপেক্ষণীয় সন্দেহ নাই।