নেকড়ার পুটলি
এক, দো, তিন!!
কয়লা খাদের মুখে অনুসেটার ঘণ্টা বাজালে, এক, দো, তিন।
ঠং ঠং ঠংl… ঘণ্টার অদ্ভুত আওয়াজ এক, দো, তিন বলবার সঙ্গে সঙ্গে গম গম ঝন ঝন করে চানকের গহ্বরের স্তরে স্তরে প্রতিধ্বনিত হলো।
পাতালপুরীর অন্ধ-গহ্বর থেকে যেন মরণের ডাক এলো, আয়! আয়! আয়!
এ যেন এক অশরীরী শব্দমুখর হাতছানি।
রেজিং বাবু রামলোচন পোদ্দার চানকের মুখে আগে এসে দাঁড়াল।
তিনটি ঘণ্টার মানে মানুষ এবারে খাদে চানকের সাহায্যে নামবে তারই সংকেত।
চানকের রেলিং ঘেরা খাঁচার মত দাঁড়াবার জায়গায় শংকর, রেজিং বাবু, সুব্রত, রতন মাঝি ও আরো দুই জন সর্দার গ্যাসল্যাম্প নিয়ে প্রবেশ করল।
অন্ধকার গহ্বর পথে ঘড়ি ঘড় শব্দে চানক নামতে শুরু করল।
বাইরের রৌদ্রতপ্ত পৃথিবী যেন সহসা সামনে থেকে ধুয়ে মুছে একাকার হয়ে গেল।
উপরের সুন্দর পৃথিবী যেন খাদের এই বীভৎস অন্ধকারের সঙ্গে আড়ি করে দিয়ে দূরে সরে গেছে।
সকলে এসে খাদের মধ্যে নামল।
কঠিন স্তব্ধ অন্ধকার। কালো কয়লার দেওয়ালে দেওয়ালে যেন মিশে এক হয়ে গেছে।
মৌন আঁধারে, মধ্যে শীতটা যেন আরো জমাট বেঁধে উঠেছে। সর্দার তিনজন গ্যাসল্যাম্প হাতে এগিয়ে চলল পথ প্ৰদৰ্শক হয়ে, অন্য সকলে চলল। পিছু পিছু। সম্মুখে ও আশপাশে কালো কয়লার দেওয়ালে সামান্য যেটুকু আলো গ্যাসল্যাম্প থেকে বেরিয়ে পড়েছে, তা ছাড়া চারিদিকে কঠিন মৌন অন্ধকার যেন কী এক ভৌতিক বিভীষিকায় হাঁ করে গিলতে আসছে। সকলের পায়ের শব্দ অন্ধকারের বুকে শুধু যেন জীবনের একমাত্র সাড়া তুলেছে। এবং মাঝে মাঝে দু একটা কথার টুকরো তার কাটা কাটা শব্দ।
সহসা রতন মাঝি এক জায়গায় এসে দাঁড়াল।
১৩নং কাঁথিতে যাবার মেন গ্যালারী এইটাই না হে মাঝি? প্রশ্ন করলেন বিমলবাবু।
আজ্ঞে বাবু—
চালটা এখানে একটু খারাপ আছে না?
আজ্ঞে।
এখানে একটু সাবধানে আসবেন ম্যানেজারবাবু। এ পাশের লোকেশনটার কি ভয়ঙ্কর অবস্থা দেখেছেন স্যার? শংকর নীরবে পথ চলতে লাগল। বিমলবাবুর কথার কোন জবাব দিল না।
পথের মধ্যে জল জমে আছে। সেই জল আশে পাশে দেওয়ালের গা বেয়ে চুয়ে চুয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরছে। জলের মধ্য দিয়ে হাঁটার দরুন জলের শাপ শপি শব্দ হতে লাগল।
আরো খানিকটা এগিয়ে মাঝি একটা সরু সুড়ঙ্গ পথের সামনে দাঁড়িয়ে গেল, সামনেই গ্যাস ল্যাম্পের ত্ৰিয়মান আলোয় এক অপ্রশস্ত গুহাপথ যেন হাঁ করে মৃত্যু-ক্ষুধায় ওৎ পেতে আছে।
এই ১৩ নম্বর কাঁথি সাব। রতন মাঝি বললে।
হাতের গ্যাস ল্যাম্পটা আরো একটু উঁচু করে সুড়ঙ্গ পথের দিকে মাঝি পা বাড়াল, যাইয়ে সাব।
সুড়ঙ্গ পথে বেশীদূর অগ্রসর হওয়া গেল না। প্রকাণ্ড একটা কয়লার চাংড়া ধ্বসে পড়ে পথটা বন্ধ করে দিয়েছে। এবং সেই চাংড়ার তলা থেকে একটা সাঁওতাল যুবকের দেহের অৰ্দ্ধেকটা বের হয়ে আছে। বুক পিঠ এক হয়ে গেছে। কান ও মুখের ভিতর দিয়ে এক ঝলক রক্ত বের হয়ে এসে কালো কয়লা ঢালা পথের ওপরে কালো হয়ে জমাট বেঁধে আছে। পাশেই একটা লোহার গাইতি পড়ে আছে।
সকলে স্তব্ধ হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে গেল। কারও মুখে টু শব্দটি পর্যন্ত নেই।
শুধু এক সময় শংকরের বুকখানা কাঁপয়ে একটা বড় রকমের দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এল।
প্রথমেই কথা বললেন বিমলবাবু, Rightly served. কথাটা যেন একটা তীক্ষ্ণ ছুরির ফলার মতই সকলের অন্তরে গিয়ে বিঁধল।
বেটারা নিশ্চয়ই চুরি করে রাত্ৰে কয়লা তুলতে এসেছিল। কথাটা বললেন রেজিং বাবু রামলোচন পোদ্দার।
কিন্তু কোন পথে কেমন করে ওরা এল বলুন তো? প্রশ্ন করলেন সুব্রত, চানকে তো চাবী দেওয়াই ছিল।
ভূতুড়ে মশাই। সব ভূতুড়ে কাণ্ড কারখানা। বললে তো আমার কথা আপনারা বিশ্বাস করবেন না মশাই। ভূতের কখনও চাবির দরকার হয়? এখন দেখুন। চানকে চাবি দেওয়া রইল, অথচ এরা দিব্যি খাদের মধ্যে এসে ঢুকল এবং মারা গেল। বিমলবাবু বললেন।
হুঁ চলুন। এবারে ফেরা যাক। আর এখানে থেকে কী হবে? চল মাঝি, শংকর বললে।
সকলে আবার ফিরে চলল। সুব্রত সকলের পিছনে চিন্তাকুল মনে অগ্রসর হলো। সহসা অন্ধকারে পায়ে কী ঠেকতে তাড়াতাড়ি নীচু হয়ে দেখতেই কী যেন অন্ধকারে পথের ওপরে হাতে ঠেকাল। সুব্রত নিঃশব্দে সেটা হাতে তুলে নিয়ে আবার পথ চলতে লাগল।
বস্তুটা কাপড়ের পুঁটলি।
সুব্রত পুঁটলিটা জামার পকেটে ভরে নিল।
সকলে এসে আবার চানকের মুখে উপস্থিত হলো।
অনুসেটার আবার ঘণ্টা বাজিয়ে সকলকে চানকের সাহায্যে খাদের উপরে তুলে নিল।
সেদিনকার মত খাদের কাজ বন্ধ রাখবার আদেশ দিয়ে শংকর বাংলোয় ফিরে এল।
এক রাতের মধ্যে এতগুলো পর পর মৃত্যু শংকরকে যেন দিশেহারা করে দিয়েছে।
কী এখন সে করবে?
কোন পথে কাজ শুরু করবে? ধাংলোয় ফিরে খনির কর্তা সুধাময় চৌধুরীর কাছে একটা জরুরী তার করে দিল।