কুয়োকাটার জেলে আবুল হাশেমের করোটিতে যে-কোনো অবসরে একটি চমৎকার রঙিন মাছ সাদা পাখনা মেলে ভেসে বেড়ায়। ছাই রঙের শরীরে রূপালি বুটি–কী অপরূপ ভঙ্গি—মুখের দু’পাশে লাল রঙের দুটি দাঁড়া। তখন হাশেমের মাথায় সাগরের ঢেউ–ঢেউয়ের মাথায় মাছ। নাচতে নাচতে ছুটে আসছে তটরেখায়–সৈকতের কাছাকাছি এখন আকাশজুড়ে লাল মেঘ–সূর্য নরম আলো ছড়িয়ে ড়ুবে যাচ্ছে। তখন রঙিন মাছ হাশেমের স্বপ্নের মধ্যে লাল দাঁড়া বিস্তৃত করে। আঁকিবুকি রেখায় ভরে যায় করোটি। আবুল হাশেমের ভাবনা গাঢ় হয়। ভাবে, জীবনের এই একাকিত্বের শূন্যতা প্রকৃতি ভরিয়ে দেয় বলেই ওর স্বপ্নে এমন রঙিন মাছের আনাগোনা। ওর অবসরের কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই। গভীর সমুদ্রে ট্রলারে বসে মাছভর্তি জাল টানার মুহূর্তেও ও ক্ষণিকের জন্য অবসরে চলে যেতে পারে। আনমনে নিজেকে গভীর উপলব্ধির মধ্যে ছেড়ে দিতে পারাটাই ওর অবসর। মহাজনকে মাছের হিসাব বুঝিয়ে দেওয়ার ফাঁকেও ও অবসর ভোগ করে। জাল মেলে দিয়ে ঘরে ফেরার সময়টাতো ওর সবটুকু অবসর। ওর মনে হয় ওর একাকিত্বই অবসর। এবং তাকে কেন্দ্র করে রঙিন মাছের খেলা। এ খেলা এক অদৃশ্য সুতোর খেলা–নিজের সঙ্গে নিজের এক্কাদোক্কা। একজন জেলের এমন জীবন হবার কথা নয়, তবু হয়েছে। কারণ মাছ ধরা ওর পেশা নয়, নেশা–সাগর ওর রক্তের হাতছানি। জীবন তো ওর ধানি জমিতে বাঁধা আছে, বছরের খোরাক হয়ে যায় সে জমি থেকে। তবু মাটি ওর বন্ধন নয়, বন্ধন সাগর। এই বন্ধন নাড়ির পরতে পরতে–কোথায় এর শুরু, কোথায় শেষ তা বলতে পারে না। শুধু অনুভব করে, এই না বুঝে ওঠাটাই ওর কাছে খেলা।
আবুল হাশেম এই সাগরের কাছাকাছি থাকার জীবনের জন্য নির্জন অবসরে ওর পূর্ব পুরুষের কাছে কৃতজ্ঞতা জানায়। জানানোর ভঙ্গিটি দারুণ। কারণ তখন ও শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে–যেহেতু সেই কথাটি ওর মুখের নয়, কথাটি চৈতন্যের–তখন ও অন্য মানুষ হয়ে যায় এবং পরিষ্কার ভাষায় বলে, তোমার কাছে আমার ঋণ শোধ করবার নয়। এও ওর কাছে সেই অদৃশ্য সুতোর খেলা। টানানো সুতোর ওপর উঠে আসে সেই মানুষটি, যার কাছে ও কৃতজ্ঞ, যে শ্বশুরের সম্পত্তির লোভে ঘরজামাই হয়ে রাঙাবালি থেকে এই কুয়োকাটায় চলে এসেছিল। লোকটি কোনোদিন সম্পত্তির মালিক হতে পারেনি–শ্বশুর তাকে বিশ্বাস করেনি। মৃত্যুর আগে সব সম্পত্তি একমাত্র মেয়ের নামে লিখে দিয়েছিল। সব সম্পত্তির মালিক বউ থাকলেও, এ নিয়ে মাথা ঘামায়নি ও। ধরে নিয়েছিল যেহেতু সে নিজের স্ত্রীর আলিক, অতএব তার সম্পত্তিরও মালিক, এই বোধেই সে রগরগে থাকত–সম্পত্তির ভোগদখলদারিতে সিদ্ধহস্ত ছিল। বউ তার দাবড়ানোর চোটে কোনোদিন মুখ খুলতে পারেনি। আবুল হাশেমের বাবা ছিল বাপের একমাত্র ছেলে। সেই সূত্রে মায়ের সম্পত্তির উত্তরাধিকার হয়েছিল। এখন সে সম্পত্তি আবুল হাশেমের দখলে।
ওর বাপ-দাদা ওকে যে জীবনযাপনের সুযোগ দিয়েছে, সে সুযোগ নিয়ে এখন ওর রাতদিনের খুনসুটি–আবুল হাশেম উদ্দেশ্যহীন হাঁটতে থাকে–নিশিপাওয়া লোকের মতো সে হাঁটা। কখনো কেউ ওর পাশ দিয়ে যাবার সময় সালাম দিলে ও উত্তর দেয় না, অর্থাৎ শুনতে পায় না–অর্থাৎ আনমনা থাকে বলে খেয়াল করে না। ভাবনা ওকে বধির করে ফেলে।
জংলা পথটুকু পেরিয়ে এখানে দাঁড়ালে স্পষ্ট দেখা যায় সাগরের পানি তোলপাড় করে। হাশেম নিজেও বুঝতে পারে না যে এই পানির তোলপাড় দেখতে ও এখানে আসে কি না। তোলপাড়ের ভেতরে একটা গম্ভীর ডাক আছে, একটা গাঢ় ছায়া আছে কিংবা কঠিন শব্দ আছে। সবকিছুই হাশেমের নিজস্ব। কত বছর ধরেই তো এভাবেই চলে যাচ্ছে। ও হেঁটে আসে, দু’হাতে গাছের ডাল সরায়। উঁচু ঢিবির ওপর বসে। বসলে দেখতে পায় পানির তোলপাড় কালচে সবুজ হয়ে যায়–দূর থেকে ছুটে এসে গড়িয়ে যাওয়াটা মনে হয় এক ধরনের পাগলামি–যে পাগলামি বুকের ভেতর অনবরত দপদপায়। তখন চরাচরে জ্যোৎস্না–গোল চাদ মাথার ওপর নেমে আসে–শূন্য প্রান্তর বিস্তৃত হতে থাকে–তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গোল চাদ বাড়ে–যেন এত বড় চাঁদ পৃথিবীর কোথাও আর হয় না। ঘোর পূর্ণিমা আবুল হাশেমের আচ্ছন্নতা বাড়িয়ে দেয়। ও দিগন্তে চোখ ফেললে দেখতে পায় নিরল শূন্যতা। পেছনে তাকালে গাছের মাথাগুলো জমাট বেঁধে থাকে, সে মাথায় অন্ধকার–অন্ধকারের মধ্যে মানুষের গুঞ্জন। সে গুঞ্জন ভেদ করে উঠে আসতে থাকে রঙিন মাছ। আঁক-বাঁধা মাছের সারি বিন্দুর মতো স্থির হয়ে যায় পূর্ণিমায়–ভরা যুবতী চাদের কাছে–সে চাদ আবুল হাশেমের বিচিত্র শব্দভরা করোটির ভেতর রঙিন মাছসহ প্রবেশ করে। মুহূর্তে ওর চেতনার চরাচর আলোকিত হয়ে যায়।
আবুল হাশেম সৈকতে নেমে আসে। সেখানে হাটুজল, সে জলে লবণ নেই, সেখানে মিঠে-পানির মাছের নির্বাস। সৈকতে টুকরো টুকরো জলাশয়–অজস্র, অসংখ্য। ওর পেছনে হাজার হাজার মোষের সারি, ওরা ঘরে ফিরছে। খুরের চাপে বালুর মধ্যে ছোট ছোট গর্ত হচ্ছে। আবুল হাশেম বালকের মতো সেই গর্তগুলো পা দিয়ে ভরিয়ে দেওয়ার খেলায় মাতে। জোয়ার আসে। এখন জোয়ারের সময়। এ সময়েই ছাই রঙের মাছ আবুল হাশেমকে সোনালি দিগন্তে নিয়ে যায়। ও তখন জেলে থাকে না–একজন রূপকথার রাজকুমার হয়। ওর ট্র্যাকের বিড়ি উঠে আসে ঠোঁটে। দিয়াশলাইর বারুদ জ্বলে ওঠে। মোষের পায়ের গর্তগুলো সব মুছে দেয় ও ভাবে, এখনই আমার যৌবনের সময়। সব গর্ত মুছে গিয়ে সমান হয়ে যাক দিনগুলো। মোষ ঘরে ফিরলে আমরা মোষ দুইয়ে মাটির পাতিলে ঘন দই বানাবো। তারপর দইয়ের ভাঁড় নিয়ে চলে যাব হাটে। সেই দই নীলগঞ্জ নদী দিয়ে চলে যাবে দূরে–অনেক দূরের মানুষের কাছে। সেই সব মানুষেরা জানবে না, একজন স্বাপ্নিক আবুল হাশেম মোষের ঘন দুধের দই বানিয়ে বেসাতি করে–তার দই শুধুই দই নয়–তা শুধু গলনালী বেয়ে পেটে যায় না, সেটা মগজেও পৌঁছে। সেই দই খেলে মানুষ স্বপ্ন দেখে, স্বাপ্নিক হয়ে ওঠে। ও সব মানুষের ভেতর স্বপ্নের ছড়াছড়ি দেখতে চায়–স্বপ্ন দেখতে শিখলে মানুষ দুঃখ ভোলে।
ভাবতে ভাবতে অন্ধকারে হেসে ওঠে আবুল হাশেম। না, ঠিক অন্ধকার নয়, বিশাল গোল চাঁদের দিগন্ত জোড়া পূর্ণিমা থাকলে অন্ধকার হয় কী করে? হওয়া উচিত নয়। হওয়া ঠিক নয়। তবু হয়। কারণ অন্ধকার তো শুধু নিজের মন নয়, অন্ধকার প্রকৃতিতেও। ওর বামের বিশাল সমুদ্রটি অন্ধকার–ভীষণ, ভয়াল। ওর মনে হয় ওখানে পূর্ণিমার আলো পৌঁছায়নি, হয়তো কখনোই পৌঁছায় না। সেজন্য কখনো অকস্মাৎ ওটা বিশাল ভয়ংকর হয়ে ওঠে। আবুল হাশেমের ডানে বনরাজি–সেখানে গাছের ছায়া–ছায়ার ঘনত্ব আছে–সেই ঘনত্ব হাঙরের পাখনার মতো ত্রিকোণাকৃতি, সেখানে আবুল হাশেম ইচ্ছে করলেই যেতে পারে না। ওর ভয় লাগে–ভয়ে বুক কুঁকড়ে যায়। এছাড়া ওর সামনে এবং পেছনে আলো–অপরূপ আলো–কুয়াকাটার পূর্ণিমার এই আলোটুকু একদম ওর একার। এই আলো বুকে নিয়ে ওর বয়স এখন বাহাত্তর। লোকে বলে, বাহাত্তরে বুড়া। ওরা ওর নাম প্রায় ভুলেই গেছে। তাতে ওর কোনো দুঃখ নেই। ও ভাবে, নামে কী এসে যায়। মানুষ ওকে চিনলেইতো হয়। মানুষের সঙ্গেই তো মানুষের সব যোগাযোগ–নামের কথা ভেবে মানুষকে কি দূরে ঠেলে রাখা যায়?
হাটের দিন এলেই ওর চিত্ত চঞ্চল হয়ে ওঠে। হাটের দিনে ও মানুষের গায়ের গন্ধ পায়। সে ঘ্রাণ ওর মগ্ন চৈতন্য আলোকিত করে। আবুল হাশেম বিচিত্র পসরা নিয়ে বসে থাকা দোকানির সঙ্গে অন্তরঙ্গ হবার চেষ্টা করে। জিনিস কিনুক আর না কিনুক, সবার কাছে ও যায়। দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে কথা বলে, কিছু উপদেশ দেয় কিংবা ব্যক্তিগত কথাবার্তা বলে, কোথাও বা কথা বলার ফুরসত হয় না। দোকানি ব্যস্ত থাকে। আবুল হাশেমের মন খারাপ হয় না। চোখাচোখি হলেও মনে করে অনেক কথা হয়েছে। এই সব মানুষেরা সাগর এবং গাছের মতো। অন্ধকার এবং ছায়া আছে ওদের। বাড়তি আকর্ষণ ঘ্রাণ। সেটা অনেক মানুষ এক জায়গায় হলে টের পাওয়া যায়। নইলে সে ঘ্রাণ ঘন হয় না। ঘন না হলে তা আবুল হাশেমের ইন্দ্রিয় স্পর্শ করে না। মানুষকে ও বড়োমাপেই দেখে। মানুষকে ও মাছি বানায় না–মাছি বানাতে খারাপ লাগে–মানুষের অন্ধকার ও দূরে রেখে দেয়–মানুষের ছায়াটুকু কাছে রাখে–খুব কাছে, একদম বুকের কাছাকাছি।
হাটের দিন এলেই মানুষের মাথার ওপর দিয়ে ঢেউ বয়ে যেতে দেখে। এই দেখা ওর বাড়তি আনন্দ। সবকিছুর ভেতরে থেকে পালিয়ে যাওয়ার আনন্দ। নিজের এইসব অনুভবগুলো আবুল হাশেমের কাছে ভীষণ দামী।
একদিন চৈতালি হাটে জমজমাট কবিগান বসেছিল। সেদিন গায়েনের সঙ্গে ধুয়া ধরে নেচেছিল। বলেছিল, ‘বাহাত্তরে বুড়া মুই, গায়েন তুই মোর পরানের সই।’ কেন এমন একটি কথা ওর মনে হয়েছিল ও তা জানে না। ওর বয়স বাহাত্তর না আরো বেশি নাকি আরো কম সেটাও ওর জানা নেই। ও পরে অনেক ভেবে দেখেছে যে ওর নিজের কবি হওয়ার বাসনা হয়েছিল। ওর ভেতরে কোনো কামনা জন্মালে রঙিন মাছটা প্রবল হয়ে ওঠে। তখন ও নিজেকে স্থির রাখতে পারে না। একটা কিছু করতে না পারার তাড়নায় ওর শরীর কাঁপতে থাকে। সে কাঁপুনি দৃষ্টিগ্রাহ্য নয়, অদৃশ্য। যাহোক সেই থেকে ও লোকের মুখে মুখে বাহাত্তুরে বুড়া হয়ে গেল। ক্ষতি কি? না, কোনো ক্ষতি নেই। ওর ভালোই লাগে। লোকে ওর নাম ভুলে যাওয়ার অর্থ তো ওর আর একটা জন্ম। আবুল হাশেম নতুন জন্মের চিন্তায় আনমনা হয়ে যায়।
ওর তো এখন সেই নতুন জন্মের রেশ চলছে। ও নিজে একটা নাটাইয়ের সুতো ধরে রেখেছে–নাটাইটা গড়াচ্ছে–আর সুতো ছড়িয়ে যাচ্ছে, কী চমৎকার রঙিন সুতো। সেই সুতো ওর জন্য নকশা বানায়–সেই নকশায় পা রাখলে ওর স্বপ্ন প্রবল হয়ে ওঠে। কয়েক বছর আগে এক গহীন অন্ধকার রাতে প্রবল জলোচ্ছ্বাসে ওর এক জীবনের সবকিছু ধুয়েমুছে গেছে। তারপর আবার শুরু–আবার স্বপ্নের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাওয়া। এখন কি ওর সময় হয়েছে এই নতুন জীবন গড়বে, যাকে মানুষ নির্মাণ বলে? মেন ঘর গড়া যায়–যে গড়া বস্তু দিয়ে কিংবা মানুষ দিয়ে? ঘরের ভিটি বাঁধা হয়, বেড়া লাগানো হয়, ছনের চাল ওঠে–চাল ছেয়ে দেয় ঘরামি আরো কিছু মানুষ লাগে ঘর গড়তে–অন্তত একজন মানুষ–তারপর মানুষ বাড়ে এক থেকে দুই–দুই থেকে পাঁচ। জন্মের বেড়ে ওঠা তো এমনই। ওই বেড়ে ওঠায় গড়ার আনন্দ থাকে, সুখের কাপন থাকে।
তখন ওর রাহনুমের কথা মনে হয়। ভাবে, এখন কাথার নিচে রাহানুম ঘুমিয়ে আছে হয়তো। নিঃশ্বাসে ওর বুক কাঁপছে, মৃদু ওঠানামা। ওর নাকের বাঁশি ফুলছে আর কমছে। ঠোঁটজোড়ায় অদ্ভুত টান, জিভ দিয়ে চাটলে চমৎকার ভিজে থাকে। ওর নিমীলিত চোখের পাতায় গভীর কালো রেখা–যখন চোখজোড়া খোলা থাকে, চোখের তারায় ভাষা ফুটে ওঠে, ওহ! আবুল হাশেম বড়ো বেশি নিঃশব্দে নিজেকে শাসন করে। ডান পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে বালু খুঁচিয়ে বলে, যেভাবেই হোক আমি ওর বাবা। কারণ ও আমাকে বাবা ডাকে।
প্রচণ্ড রকমের ধমক দেয় নিজেকে। তাহলে এই বয়সে মানুষের সবকিছু কি ফুরিয়ে যাবে? কেন? কেন একটা ভাঁড় হয়ে এমন নারকীয় জীবনযাপন? কেউ না কেউতো আমার হবে, কেউ না কেউতো আমার পাশে থাকবে।
ও হাঁটতে হাঁটতে অনেকদূর চলে এসেছে। এখন ওর পরিচিত টিবিটা আর দেখা যাচ্ছে না। চারদিকে কেবলই পূর্ণিমা। বিশাল চাদ ওর মাথার ওপর নড়ছে। ও জানে না কোথায় যাচ্ছে? জানে না ঘরে না ফিরলে রাহানুম আর সুখদীপ ভাববে কি না। দুটো মানুষকে নিয়ে ও আবার একটা নতুন সংসার গড়েছে। ওদের কথা ভাবতে না চাইলেও ভাবতে হয়। আর ওরাতো ওর কথা ভাববেই। ওদের যে আর কেউ নেই। তাই ওকে ওদের ভীষণ প্রয়োজন। শুধু প্রয়োজন? আর কিছু না? শুধু প্রয়োজন দিয়ে কি ঘর হয়? ভালোবাসা ছাড়া? এই সব ভাবতে গেলে ওর কষ্ট বেড়ে ওঠে। ওর এখন এই সংসারের কোনোকিছু ভাবতে ভালো লাগছে না। ও শুধুই একটা স্বপ্ন দেখতে চায়। জোয়ারের জলে ওর পা। ভিজে যাচ্ছে। ভেজা বালুতে পা দেবে যাচ্ছে। আর রঙিন মাছটা ওর পা বেয়ে উপরে উঠছে, উঠছে। এখন ওটা ঊরুতে এসে স্থির হয়েছে। আবুল হাশেমের দৌড়তে ইচ্ছে করে। দৌড়ে অনেকদূরে চলে যায় ও। যৌবনে বৌয়ের সঙ্গে ওর এমন একটা খেলা জমে উঠত। বৌয়ের ডান উরুতে একটা বড়ো লাল জড়ল ছিল। সেই একটি জায়গায় মুখ নেমে যেত ওর, যেমন খাবারের চাড়িতে নেমে আসে মোষের মুখ। জড়লটা যেন যম–হরণ করে নিত আবুল হাশেমের হৃৎপিণ্ড। অদ্ভুতভাবে স্তব্ধ হয়ে যেত ও, নিঃসাড় হয়ে আসত শরীর।
সেই খেলাটা এখন ওর মাথায় ভর করেছে। এই বালিয়াড়ির মধ্যে ও একটা লাল জড়ল খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু সেই সময়টাতো এখন ওর চারপাশে নেই–সেই বয়সটা নেই–সেই মাদকতাময় শিহরণও নেই। ও অল্পক্ষণে ক্লান্ত হয়ে যায়। মনে হয় চারপাশে গোঙানির শব্দ। সেই শব্দ হাতের মুঠিতে নিয়ে আজরাইল আসছে। ওহ, কেমন যেন লাগছে।
চারদিকে অজস্র লাল কাঁকড়া, শরীরে লাল কাঁকড়ার দংশন। আবুল হাশেমের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। ও আর সামনে এগুতে পারে না। ফিরতে থাকে নিজের ঘরের দিকে। ঘর? ঘরটা কি ভুল ঘর? রাহালুমের বাবা ডাক কি ভুল? কিংবা সুখদীপের দাদা ডাক? এতক্ষণে আবুল হাশেমের বুকে হাঁফ ধরে। ওর আর হাঁটতে ইচ্ছে করে না। রাত কত জানে না। কোথাও কোনো মানুষ নেই। কেবল সমুদ্রের গর্জন। যে গর্জন একবার উন্মত্ত হয়ে ভাসিয়ে দিয়েছিল কুয়োকাটার জনপদ।
কষ্ট ঘটনা কখনো কখনো নষ্ট ঘটনা হয়ে যায়–যে ঘটনা মনে করলে বুক তোলপাড় করে, মাথা ঘুরিয়ে ওঠে। ওই ঘটনা করোটিতে গেঁথে থাকে–সাগরে নোঙর ফেলে গেঁথে রাখা নৌকার মতো। ঢেউয়ে বা বাতাসে কেবলই দোলে। স্মৃতিও তেমন–সুযোগ পেলেই দুলে ওঠে। এই মুহূর্তে ও প্রাণপণে সেই ঘটনাটা ভুলে যেতে চেষ্টা করে।
ও মনে করে ও এখন কুয়োকাটা থেকে আলিপুর বাজারের দিকে হেঁটে যাচ্ছে–যখন দু’পাশে সবুজ ধানক্ষেত কিংবা কেটে নেওয়া ধান গাছের নাড়া হা-হা শূন্যতা সৃষ্টি করে ভৌতিক হাসি হাসে তখন আবুল হাশেম ভীষণ বিষণ্ণ হয়ে যায়। ও রাস্তার পাশে পা ছড়িয়ে বসে থাকে। সামনের জলাভূমিতে ব্যাঙ লাফায়। সেখান থেকে এক ধরনের শব্দ আসে। না, ঝিঁঝির ডাক নয়, কিসের ও জানে না। যেন এই শব্দটা ও কোনোদিন শোনেনি। অথচ মনে হয় চেনা–প্রতিদিনের শোনা। তবু সেই শব্দটা অজানাই থেকে যায়। আবুল হাশেম আনমনা হবার চেষ্টা করে। ওর চারপাশে অসংখ্য জোনাকি জ্বলে। হাজার হাজার আলোর বিন্দু জ্বলে আর নেতে, জ্বলে আর নেভে। ও শুনতে পায় যে ওকে দেখে লোকে বলছে, আহা বেচারা। বলে, আহা বেচারার কেউ নেই। বেচারার কি যে কষ্ট! কষ্ট কী? কষ্ট কি জোনাকির আলো? নাকি ঝিঁঝির ডাক? আবুল হাশেম চিৎপাত ঘাসের ওপর শুয়ে পড়ে।
ও দেখে আকাশ–দিগন্ত এবং কতগুলো নকশা জ্যোৎস্নায় ঝকমক করছে। ওর সামনে সবকিছু মুছে যায়–ঊরু থেকে স্ত্রীর লাল জড়লের চিহ্নও। যৌবনে এই জড়লটা দুজনের খুব প্রিয় বিষয় ছিল। নানা কথা হতো ওটা নিয়ে। আবুল হাশেমকে মণিমালা বলত, মুই যদি কোনোদিন হারাইয়া যাই তহন এই জড়ল দেইখ্যা মোরে বিছরাইয়া লইও।
ক্যা, তুমি হারাইয়া যাবা ক্যা?
হারাইয়া যামু ক্যা? ধর একটা বড় বইন্যা হইলো। সবকিছু ভাইস্যা গেল।
পাগল, তোমারে আমি ভাসতে দিমু না। বোহের লগে বাইন্দা রাখমু। মোরা কেউ হারাইয়া যামু না, কেউ না।
কথা বলতে বলতে আবেগে ছলছল করে উঠত আবুল হাশেমের চোখ। মণিমালা আঁচল দিয়ে ওর চোখ মুছিয়ে দিত। তারপর নিজের চোখও মুছত। দুজনের আবেগ থিতিয়ে গেলে মণিমালা খুব নিচুস্বরে বলত, বইন্যার কি ঠিক আছে? সাগরের কূলের মানু আমরা। বইন্যাতো মোগরে ভাসাইতেই পারে।
আর বইন্যার কথা না।
আবুল হাশেম প্রবল চুমুতে ওর ঠোঁটজোড়া বন্ধ করে দিত। মণিমালা তলিয়ে যেত সেই বন্যার তোড়ে। তারপর কখন দুজনে ঘুমিয়ে পড়ত টেরও পেত না।
কিন্তু তারপরতো বন্যা ঠিকই মণিমালাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। কই খুঁজে পাওয়া তো আর হলো না। কোথায় ছিল ওর লাল জড়ল? একটা চিহ্ন নিয়েও কেন মণিমালা অপরিচিতের সঙ্গে মিশে গেল? কেন তাকে আলাদা করে খুঁজে পাওয়া হলো না? ঘাসের ওপর দু’হাত ছড়িয়ে রেখে আবুল হাশেম আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।
পাশ দিয়ে একটা কুকুর হেঁটে যায়। কুয়োকাটার পূর্ণিমা আবুল হাশেমের চোখে কুকুরটিকে মানুষ করে দিলে ও কুকুরের লেজ ধরে টান দেয়। কুকুরটি বন্ধুর মতো ওর পাশে শুয়ে পড়ে। লেজ নাড়ে। জিভ বের। করে রাখলে ওর জিভ থেকে টপটপ করে লালা ঝরে। কুকুরটি একসময়ে আবুল হাশেমের গায়ের ওপর পা উঠিয়ে দেয়। এক সময়ে ওর মাথাটা আবুল হাশেমের পেটের ওপর রাখে। আবুল হাশেমের মেদহীন শরীর। নিঃশ্বাসে পাঁজরের হাড় ওঠে আর নামে। এক সময়ে ও কুকুরের মাথায় হাত রাখে। ওর ঘুম পায়। না, ঠিক ঘুম নয়, তন্দ্রা। কোনো এক গভীর শব্দ বারবার ওর চেতনাকে ছিন্নভিন্ন করে। ওই শব্দটা আর্তনাদ হয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে। তখন কুকুরটা লাফিয়ে উঠে ঘেউ-ঘেউ শব্দ করে ছুটে যায় বেশ খানিকটা দূরে। আবার ফিরে আসে–আবার যায়। ও হয়তো কোনো একটা খেলা পেয়েছে সেই খেলায় ও আনন্দ পাচ্ছে। আহ আনন্দ! আনন্দ কি কুকুরের ঘেউ ঘেউ? আবুল হাশেম উঠে বসে। সেদিন ওর আর আলিপুর বাজারে যাওয়া হয়নি। এভাবেই ওর অনেক কাজ নষ্ট হয়–ও নিজেকে টালমাটাল অবস্থায় নিয়ে যায় এবং সবশেষে এক নিঃশব্দ পৃথিবীতে ক্রমাগত হামাগুড়ি দিতে থাকে। ওর যন্ত্রণা হয়, চামড়া পুড়ে যায় এবং এক ধরনের বোবা আতঙ্ক ওর করোটিতে পরিব্যাপ্ত হয়।
ঠিক এখন এই মুহূর্তে ও ঘরে ফিরতে চায়। হ্যাঁ ঘর। এখন ওর একটি ঘর আছে। সাগরে মাছ ধরে ঘরে ফিরে আসার মতো ঘর আছে। কেউ কেউ ওর অপেক্ষায় থাকে। তবে বাবা, মা, ভাইবোন নিয়ে ঘর নয়। যৌবনে যেমন একদিন একটি ভিন্ন মানুষকে নিয়ে, যে মানুষের গর্ভে সন্ত নি উৎপাদন করা যায়, তেমন মানুষ নিয়ে যে ঘর গড়ে তুলেছিল, সে ঘর এটি নয়। এই ঘর অন্য এক ঘর–এটিও তো গড়ে তোলা। তিনজন মানুষের একত্র অবস্থান কি ঘর? গড়ে তুললেই কি ঘর হয়? মানুষে মানুষে আত্মিক সম্পর্ক জন্মায়, হয়তো জন্মায়, হয়তো জন্মায় না। তবু একত্র বসবাসের মধ্য দিয়ে এক ধরনের মায়া জন্মায়–সেটা হয়তো খুব গভীরভাবে নাড়ির পরতে বাধার মতো করে বাঁধে না কিন্তু শূন্যস্থানকে ভরিয়ে মানুষের ক্লান্তি কমিয়ে দেয়। ক্লান্তি? এই মুহূর্তে ক্লান্তির ভারে পা কেমন নুয়ে আসছে। এই জংলা পথটুকু পেরিয়ে ঘরে পৌছুতে কতদিন লাগবে। কতকাল?
আবুল হাশেমের আর উঠতে ইচ্ছে করে না। সাগরের জোয়ার আসছে–মৃদু গর্জনধ্বনি ওর কানে সংগীতের মতো ভেসে আসছে। যেন মণিমালার কোলজোড়া প্রথম সন্তান। ও গুনগুনিয়ে গান গেয়ে মেয়েকে ঘুম পাড়াচ্ছে। প্রথম সন্তানে কি খুশি ছিল ও! চকচক করত ওর দৃষ্টি। নাকি মাতৃত্বের প্রকাশটাই অমনি–এতদিনেও আবুল হাশেমের কাছে এই বোধটা পরিষ্কার নয়। জোয়ারের কলতান শুনতে শুনতে ও নিশি-পাওয়া মানুষের মতো উঠে দাঁড়ায়। চারপাশে তাকিয়ে দেখে কুকুরটা নেই। কখন চলে গেছে ও টেরই পায়নি। ও আচ্ছন্নের মতো হাঁটতে শুরু করে।
তখন আবুল হাশেম দেখতে পায় সুখদীপ দৌড়তে দৌড়তে আসছে। চিৎকার করছে, দাদা, দাদা গো–আবুল হাশেমের বুক ধুকপুক করে, আহা, ওই সাত বছরের বালক জানে না যে আবুল হাশেম ওর কেউ নয়। ও কত গভীর স্বরে ডাকে। যেন ওর সঙ্গে জন্মজন্মান্তরের সম্পর্ক। কোনোদিন বুঝি এ নাড়ির বন্ধন ছিন্ন হবে না। ওদের উঠোনে জ্যোৎস্না বিছিয়ে থাকলে সুখদীপ আবুল হাশেমের কোল দখল করে বসে। বলে, দাদা এউক্কা গল্প কয়েন?
গল্প? কী গল্প কমু?
যা আমনহের ইচ্ছা।
আবুল হাশেম বুঝে পায় না যে কি গল্প বলবে। কত গল্প তো সুখদীপকে বলা হয়েছে। রাজা, রানি, রাজকুমার, রাজকন্যা, দৈত্য-দানব থেকে শুরু করে হাতি-ঘোড়া, ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমী, সেপাই-লস্কর সব শেষ। এমনকি সমুদ্রের গল্প, মাছ ধরার গল্পও করা হয়েছে। শুধু সুখদীপের নিজের গল্পটি বলা হয়নি। ওকে বলা দরকার। কবে? কখন? কেমন করে? সুখদীপ কি এই গল্প রূপকথা শোনার মতো আগ্রহ নিয়ে শুনবে? না কি শুনতে চাইবে না? কেমন করে বললে ওর শুনতে ভালো লাগবে? এটাই বুঝি হবে ওর জীবনের শ্রেষ্ঠ গল্প শোনা? ও মাথা ঝাঁকিয়ে ওঠে। নিজেই নিজেকে বলে, আমি জানি না। আজো সুখদীপ দৌড়ে এসে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে ওকে। পেছনে রাহানুম। ওরা ঘুমোয়নি। ওরা ওর জন্য অপেক্ষা করেছে। তারপর খুঁজতে বেরিয়েছে। রাহামের ছায়াটা দু’পাশের গাছ-গাছালির সঙ্গে মিশে যায়। রাহানুম নারী। নারীর ছায়ায় ঘ্রাণ আছে। আবুল হাশেমের অনুভূতি গাঢ় হতে থাকে। একদিন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে আনমনে হাঁটতে হাঁটতে আবুল হাশেম অজস্র ঝরাপাতা মাড়িয়ে গিয়েছিল। বর্ষার জলে সে পাতাগুলো নরম হয়েছিল। এখন নরম কোনোকিছু স্পর্শ করলে ওর শরীরে শিহরণ জাগে। ও ভুলে যায় ওর বয়সের কথা। ও সেদিন ভেবেছিল বর্ষার জলে ভিজে থাকা ঝরাপাতা নারী। নারী ভাবতেই ওর সমুদ্রের কথা মনে হয়। ওর কাছে সমুদ্র নারী। যার গর্ভ থেকে ওর জাল ভরে রূপোলি মাছ উঠে আসে। নারী ছাড়া কে আর এমন উজাড় করে দেয় নিজেকে? সৈকতের ভেজা বালুও ওর কাছে নারী। পায়ে জড়িয়ে থাকে প্রবল মমতায় কিংবা প্রিয়তমা হয়ে হেঁটে হেঁটে অনেকদূরে চলে যাবার মন্ত্রণা দেয়। স্বপ্নের ঘোরে হেঁটে চলে যায়, পেছনের কিছুই মনে থাকে না। নারী ছাড়া কে এমন দিগ্বিদিক পাগল করা ডাক দেবে? এতকিছুর মধ্যে ও একা, একজন মানুষ, যার পৌরুষ আছে, ক্ষমতা আছে এবং শক্তি আছে। তাই আবুল হাশেম নিজের বয়সের কথা ভুলে যায়।
বয়সের কথা ভুলে যাওয়ার মধ্যে প্রচণ্ড সুখ আছে। ওর কাছে তা এক ধরনের নতুন জন্ম। আবুল হাশেমের মনে হয় ও প্রতি মুহূর্তে নতুন। জন্মের স্বাদ অনুভব করে। ওর নারীকে নিয়ে ভাবনায়ও এমন বোধ কাজ করে। যে-কোনো কিছুকে নারী ভাবা এবং তার সংলগ্ন হওয়া মানে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার। যেমন করে সুখদীপকে হাজার রকমের গল্প শোনায়, গল্প বলার হাজার টং বের করে তেমন করে নিজের সঙ্গে এই প্রতিদিনের সখ্য। ফলে আবুল হাশেমের মন-মাতানো দিনযাপন। ও সুখদীপের মাথাটা আঁকড়ে ধরে বলে, দাদা তুমি ঘুমাও নাই?
ঘুমামু ক্যা? আমনহে যে ঘরে নাই? আমনহে ঘরে না থাকলে মোর ঘুম আয় না।
ততক্ষণে রাহানুম কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। ওকে কেমন ভিন্ন নারী মনে হয়। মনে হয় না যে অনেককাল আগে এই মেয়েটির সঙ্গে ওর দেখা হয়েছিল। মেয়েটি ওকে বাবা ডেকে ওর আশ্রয়ে নিজের দুঃখ ভুলেছে। নতুন করে বাঁচতে শিখেছে। এখন কি মেয়েটির মনে কোনো দুঃখ আছে? ও কি প্রতি মুহূর্তে নুতন জন্মের স্বাদ অনুভব করে? পালিয়ে যেতে চায় কোথাও? অনেকদূরে? আর কারো কাছে? হয়তো না। মেয়েটি সরল। ও গভীর করে কিছু ভাবে না। বড় কোনো আকাভক্ষাও নেই? না কি ওর সামনে কোনো সুযোগ নেই? সুযোগ এলে ও হয়তো তা কাজে লাগাবে। রাহানুমের কণ্ঠস্বর বড়ো সুন্দর। সেই কষ্ঠে আজ অভিযোগ, বাবো, আমনহে যে ক্যা এইরকম করেন?
কি হরি?
ক্যা পাগলামি?
তোমাগো কষ্ট অয়।
রাহানুম চুপ করে থাকে।
কতা কও না ক্যা মা, মুই তোমাগো জ্বালা দি?
জালা দিবেন ক্যা? জালা তো আমনহের। আমনহের তো অনেক জ্বালা। এই বয়সী মানহের পরিবার না থাকলে কি যে কষ্ট অয়!
আবুল হাশেম মনে মনে বিড়বিড় করে, কষ্ট কী? তিনজন মানুষ একত্র থাকলে আবার কষ্ট কী? অন্ধকারে রাত গাঢ় হয়। অন্ধকারে মমতা বাড়ে, অন্ধকারে মমতা ছিন্নভিন্ন হয়। রাস্তার দুপাশে অসংখ্য নারকেল গাছ। নারকেল গাছের পাতার ফাঁকে আকাশ একটা রেখার মতো। বর্ষায় গাছ-গাছালি স্নিগ্ধ হয়ে ওঠে। কী নরম, কী সতেজ, কী সবুজ! এই সবের মধ্যে রাহনুমের উপস্থিতি বড়ো বেশি তীব্র।
সুখদীপের হাত ধরে আবুল হাশেম সামনে হাঁটে, পেছনে রাহানুম। ও একরোখা মেয়ে, রাগ বেশি। পান থেকে চুন খসলে রেগে যায়, বকাবকি করে। আবুল হাশেম চুপচাপ শোনে। কখনো রাহালুমের সঙ্গে কোনো বিরোধে যায় না। ও মহাজনের বাড়িতে ধান ভেনে বছরের খোরাক জোগাড় করার চেষ্টা করে। পারতপক্ষে আবুল হাশেমের কাছে। হাত পাতে না। সুখদীপকে ওরা দুজনেই দেখে। ও দুজনেরই। কিছুদূর গিয়ে আবুল হাশেম পেছন ফিরে দাঁড়ায়। রাহানুম খানিকটা পিছিয়ে পড়েছে। সুখদীপ চেঁচিয়ে ডাকে, মা তরতরি আও?
আবুল হাশেমও দাঁড়িয়ে পড়ে। বেশ খানিকটা দূর থেকে রাহাম এগিয়ে আসছে। যত এগিয়ে আসছে আবুল হাশেমের চোখে ও তত অস্পষ্ট হয়ে উঠছে। কেন এমন হয়? কেন মাঝে মাঝে চোখের সামনে থেকে সবকিছু মুছে যেতে থাকে, জেগে ওঠে ভিন্ন অবয়ব–যার কাছে আবুল হাশেম কিছুতেই যেতে পারে না–তখন সেই রঙিন মাছটা আবুল হাশেমের মগজ আলোকিত করে দেয়। সেই আলোকিত মুহূর্তে রাহানুম আবুল হাশেমের কাছে এসে দাঁড়ায়। ওর হৃদয় তোলপাড় করে ওঠে, কি রে তোর হারাদিন খাডনি গেছে? আঁটতে খারাপ লাগছে মা?
না বাবো, না, আইজগো পুন্নিমা খুব সুন্দর। জানো বাবো, এত বড় গোল চান মুই আর দেহি নাই।
এইডা দেইখ্যা মুই পাগল অইয়া যাই।
আবুল হাশেম হা-হা করে হাসে। হাসি ছড়িয়ে যায় খোলা প্রান্তরে। দমকে দমকে হাসির রেশ বাড়তে থাকে। হাসতে থাকে রাহানুম এবং সুখদীপও। ওরা খানিকটা অবাক হয়ে আবুল হাশেমের এই প্রবল হাসি শোনে। ওরা বুঝতে পারে না যে আবুল হাশেম নিজেকে মেলে দিতে চাইছে এই খোলা প্রান্তরে। ও চায় যতদূর চোখে দেখা যায় ততদূর ছড়িয়ে যাক ওর হাসি–কিংবা যেটুকু চোখে দেখা যায় না, সেখানেও পৌঁছে যাক ওর হাসি।
একসময় সুখদীপ আবুল হাশেমের হাত ধরে টান দিয়ে বলে, এইর লাইগ্যা তো মানে আমনহেরে পাগলা বুড়া কয়।
আবুল হাশেমের যে হাসি প্রায় থেমে এসেছিল সেটা আবার প্রবল হয়ে ওঠে–হাসির তোড়ে হেঁচকি ওঠে ওর। আসলে ঠিক হেঁচকি নয়, একটা টান, যেটার রেশ ফুরোয় না।
তখন অন্য দুজন মানুষ ভয় পায়। হাসিও যে ভয়ের হতে পারে ওরা দুজনে তা অনুভব করে। সুখদীপ রাহনুমকে জড়িয়ে ধরে। রাহানুম। আবুল হাশেমের হাত চেপে ধরে বলে, অত আইস্যে না, বাবো।
আবুল হাশেম রাহামের মাথায় হাত রেখে থমকে দাঁড়িয়ে বলে, ক্যা, হাসুম না ক্যা?
জানো না যত হাসি অত কান্না, কইয়া গেছে রাম সন্না।
কান্দনের আর বাহি কি? কান্দনতো মোর ফুরাইয়্যা গেছে। মুই আর কাম না।
এহন মোগ হপ্পন দেহনের সময় না বাবো?
হ্যাঁ, সত্য কথা।
বড়ো একটা শ্বাস ফেলে আবুল হাশেম কথাটা বলে।
শ্বাস ফেললা ক্যা, বাবো?
রাহানুমের কণ্ঠ বড়ো বেশি আন্তরিক। আবুল হাশেমের কোনো জবাব নেই। দীর্ঘশ্বাস তো ও ফেলতে চায়নি, দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। ওর কিসের দুঃখ? ওতো দুঃখ কাটিয়ে ওঠার জন্য কতকিছু আপন করেছে। এই একা একা ঘুরে বেড়ানোটা তার একটা অংশ। তবে কেন, কিসের জন্য দীর্ঘশ্বাস। পূর্ণিমার গোল চাঁদও তো ওর আপন করে নেওয়া জিনিসের অংশ–মানুষ এবং প্রকৃতিকে ও সমানভাবে আপন করতে পেরেছে–সেইসব কিছুতে নিজের স্বস্তি খুঁজেছে, ভালো লাগা জড়িয়েছে। তবু গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে গেলে দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে বুক। ভেঙে। সমুদ্রের ওপর অভিমান হয়। কেন? কেন এই অর্থহীন মন খারাপ?
অনেকদিন আগে তো জীবনের বড়ো একটা অংশ চুকেবুকে গেছে–এই চুকে যাওয়ার ফলে ওর নতুন যাত্রা শুরু হয়েছে। মানুষের নতুন যাত্রা যতই দুঃখের ভেতর থেকে শুরু হোক না কেন যাত্রা তো আনন্দ। নতুন পথের আনন্দ, নতুন আলোর আনন্দ। ক্লান্তি মনে করলেই ক্লান্তি। ক্লান্তিকে বেশিদিন বয়ে বেড়ানো যায় না–ওটা আপন থেকে ঝরে পড়ে। না ঝরলে কি বেঁচে থাকা সহজ হতো? সেই চুকেবুকে যাওয়ার দিনটি বুকে চেপে বসলে দীর্ঘশ্বাস আসে। অথচ এখন এমনও তো হতে পারে যে বিশাল একটা ঝড় উঠলে মধ্য সমুদ্রে হারিয়ে যেতে পারে ওর ট্রলার? তখন কি ও আবার কোনো চরে ভেসে উঠবে? দেখবে আর একটি নতুন জীবন ওর অপেক্ষায়? না, আর না।
কিন্তু কেন নয়? জীবনের কি শেষ আছে? শুরু করলেইতো হয়। শুরু করাটাইতো নতুনত্ব। এর জন্য কি বয়স লাগে? না, লাগে না। যত বয়সই হোক না কেন আমি স্বপ্ন দেখব। আমি আলোকিত করব জীবন। তখন সেই রঙিন মাছটা ভেসে আসে আবুল হাশেমের করোটিতে। বঙ্গোপসাগর নয়, কুয়োকাটার পূর্ণিমা যদি একটা দিগন্ত-বিথারী সমুদ্র হয় তবে একটা রঙিন মাছ সেই সমুদ্রে থাকবে। সেটা আবুল হাশেমের একার, আর কারো নয়। সেই মাছ শত কোটি হয়ে আবুল হাশেমের জাল ভরে দেবে, ঘর ভরে দেবে। ট্রলার গড়ে দেবে। ওহ্ একটা নতুন ট্রলার। ভাবতে ভাবতে আবুল হাশেম যুবক হয়ে ওঠে। যুবক বয়স থেকেই। একটা নুতন ট্রলারের স্বপ্ন ছিল ওর, যে স্বপ্ন কোনোদিন পূরণ হয়নি। ও জানে এখন আর হবার নয়। তবু সেই রঙিন করোটিতে কেলিবিলাসে মেতে উঠলে ও সমস্ত অনুভব নিয়ে চাঙা হয়ে ওঠে। শরীরের নতুন। পুলক, যেন প্রবল খরতাপে ভেজা বালুর ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া দূরের বিন্দুর দিকে তাকিয়ে, যেখানে তাকালে মনে হয় আকাশের সঙ্গে সাগরের আলিঙ্গন। এইসব ভাবনায় আবুল হাশেমের চিত্ত চঞ্চল হয়ে ওঠে। ওর। ভারি আনন্দ হয়। ইচ্ছে করে দৌড়ে উঠোনটা এক পাক ঘুরে আসতে।
ততক্ষণে ওরা বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছে। ঝকঝকে তকতকে নিকোনো উঠোন। রাহানুম ভিটেবাটি ছিমছাম করে রাখতে ভালোবাসে। বারান্দায় হোগলার মাদুর পাতা। সুখদীপ দৌড়ে গিয়ে মাদুরের ওপর গড়িয়ে পড়ে, ডিগবাজি খায়। আবুল হাশেম নিজেকে বলে, আমি তো এখন সুখদীপ হয়ে গেছি। একদম ওর মতো, ওর বয়সী। তখন সুখদীপ দৌড়ে এসে আবুল হাশেমের হাত ধরে বলে, দাদা, গপ্পো–
ধমকে ওঠে রাহানুম, কেবল গপ্পো? বাবো ভাত খাইবে না?
সুখদীপ রাহনুমকে ভেংচি কাটে। তারপর দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে, মোরও খিদা লাগছে।
হো-হহা করে হেসে ওঠে আবুল হাশেম, যেন জীবনের এমন মজা ও আর কখনো পায়নি।
রাহানুম হাসে না। ওর রাগ হয়। সুখদীপকে এক ধাক্কায় সরিয়ে দিয়ে ও দপদপিয়ে ঘরে চলে যায়। ঘরে কুপি জ্বালানো ছিল। উঠোনে দাঁড়িয়ে খোলা দরজা দিয়ে আবুল হাশেম দেখতে পায় ঘরে কুপির শিখা কাঁপছে। একটু পর কুপির শিখা আড়াল করে দাঁড়ায় রাহানুম। ওকে একটা বিশাল ঢেউয়ের মতো মনে হয়–সমুদ্র ক্ষেপে গেল যে ঢেউ উন্মত্তের মতো ছুটে আসে, ভাসিয়ে দিয়ে চলে যায় পুরো জনপদ। চিহ্ন থাকে না বাড়িঘর, ছোট গাছ কিংবা মানুষের। রাহানুম ভাতের হাঁড়ি, বাসনকোসন নাড়াচাড়া করছে। টুংটাং শব্দ আসছে কখনো কখনো। এখন খেতে হবে, ঘুমুতে হবে, একটি পুরা রাত্রি পার করতে হবে। ঘুমের মধ্যে নিঃশব্দ মৃত্যু না ঘটে গেলে কিংবা প্রবল জলোচ্ছ্বাস তিরিশ ফুট উঁচু হয়ে সাগর থেকে ছুটে না এলে, কোনো তোলপাড়ে সবকিছু তছনছ না হয়ে গেলে আবুল হাশেমের জীবনে আর একটি দিনের সূর্য উঠবে। ভাবতে ভাবতে ও সুখদীপকে নিয়ে পুকুরের পাড়ে আসে। সুখদীপ দৌড়ে ঘাটলায় নামে। ঝপঝপিয়ে মুখে পানি দেয়। ভিজে যায় গলা, বুক। অল্পক্ষণ পানি নিয়ে মাতামাতি করে ও। দু’হাতে পানি নিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে দেয়। তারপর এক দৌড়ে ঘরের বারান্দায় গিয়ে ওঠে।
আবুল হাশেমের মনে হয় ও একটা উড়ুক্কু মাছ। এই গতি বোধহয় শৈশবেই থাকে, যত দিন যায় গতি কমতে থাকে। আবুল হাশেমের এই বয়সে কোথাও গতি নেই। ওর গতি এখন স্বপ্নে। ওর জীবনে এখন এক উজ্জ্বল স্বপ্নের সময়। স্বপ্নের ভেতরে ও দ্রুতবেগে মাইল মাইল পথ হেঁটে যায়–দুরন্ত গতিতে ট্রলার ছোটায়। ক্লান্তিহীন। ক্ষান্তিহীন।
ও পুকুরের ঘাটলায় বসে দুহাতে পা পরিষ্কার করে। আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে বালু জমে আছে। প্রায় হাঁটু পর্যন্ত সৈকতের বালু উঠে এসেছে। বালু তাড়াতে ও বড়ো বেশি নিমগ্ন হয়ে পড়ে। শরীর শিরশির করছে। মনে হয় যেন জিভের নিচেও বালুর পরত জমেছে। ওর মগ্ন চৈতন্যে একটা ডাক ভেসে আসে। ও উপেক্ষা করে। এখন কোনো ডাক শুনতে চায় না। তবু শব্দটা ওর ভেতরে প্রবেশ করে। ও বুঝতে পারে রাহানুম বারান্দা থেকে বাবা, বাবা করে চিৎকার করছে। স্থবির হয়ে আসে আবুল হাশেমের শরীর। ও কি রাহামের বাবা? কেমন করে? যে পদ্ধতিতে একজন মানুষ আর একজন মানুষের বাবা হয় সে পদ্ধতিতে ওর এবং রাহানুমের জীবনে অনুপস্থিত। ওর চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে করে, আমি বাবা নই। আমার কেউ নেই। কিন্তু ওর গলা দিয়ে শব্দ বের হয় না। ও বোঝে ওর কোনো কিছু বলা হবে না। জীবনটা এমন–এমন জটিল সম্পর্কে নিগড়ে বাঁধা–এর থেকে মুক্তি নেই। আবুল হাশেম ইচ্ছে করলেই চেঁচাতে পারে না। এমন করেই মেনে নিতে হয় বন্দিত্ব। নিজের কাছ থেকে কোথাও কি পালানোর উপায় আছে? পানির ভেতর আবুল হাশেমের দু’হাত থেমে থাকে। মনে হয় পানির স্পর্শও সুখকর নয়–তা জটিল এবং যন্ত্রণাকর।
এক সময়ে রাহালুমের কণ্ঠ তীব্র হয়ে ওঠে। ও চেঁচিয়ে ডাকছে। হয়তো ভেবেছে যে আবুল হাশেম শুনতে পাচ্ছে না। হয়তো আবুল হাশেম বধির হয়ে গেছে। যেমন বধির হয়ে গিয়েছিল সেই প্রলয়ঙ্করী জলোচ্ছ্বাসের পর–যখন ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল শরীরের যাবতীয় শিরা-উপশিরা–বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল মগজ এবং দু’চোখ থেকে বিলুপ্ত হয়েছিল স্বপ্ন। আজ আবুল হাশেমের জীবনে আবার স্বপ্ন উজ্জ্বল হয়েছে। কিন্তু সে স্বপ্ন শুধুই মগজের–ধুলোমাটির নয়–যে ধুলোমাটির মধ্যে প্রতিদিনের জীবন বাড়তে থাকে। আবুল হাশেম দ্রুত হাত পা প্রক্ষালন করে। লুঙ্গি হাঁটুর ওপরে ওঠানো। দু’হাতে মুখে পানি ছিটায়। ঊরু ভিজে যায়। নাকের ভেতর পানি যায়। চোখ জ্বালা করে। মিঠে পানির স্পর্শ, তবু আবুল হাশেমের চামড়ায় সে স্পর্শে নোনা স্পর্শ। ও কিছুতেই নোনা-স্পর্শ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারে না যেন নাকের পাশ দিয়ে খলখলিয়ে বয়ে যাচ্ছে নোনা পানির স্রোত–মাথার ওপর দিয়ে–পায়ের নিচেও–নোনা জল স্পর্শ করে ভূমি–নষ্ট হয়ে যায় ভূমির উর্বরতা। আবুল হাশেম এখন তেমন এক পতিত জমি–যে জমির ফসল নষ্ট করেছে সাগরের লবণাক্ততা। ও ঘাটলা থেকে উঠে আসে। একগুচ্ছ ঘাসে পা মুছে নেয় এবং ঘাড় নিচু করে লুঙিতে মুখ মোছে। ওর। শরীরে জলের চিহ্ন রাখতে চায় না। কিন্তু মুছবে কী করে? নোনা জলতো ধুয়ে-মুছে নিয়ে গেছে জীবনের সব ফসল।
আবুল হাশেম দ্রুত পায়ে ঘরে আসে। সুখদীপের সানকিতে বড়ো একটা মাছ। ও মাছের কাঁটা বাছে। ফকফকে সাদা ভাত লাল সানকিটায়–আবুল হাশেম অন্ধের মতো তাকায়। ভাতকে ভাত মনে হয় না। ওগুলো কি কাঁকড়ার গুঁড়ি গুঁড়ি বাচ্চা? লুঙ্গি দিয়ে হেঁকে তুললে হাজার হাজার উঠে আসে। ও হোগলার ওপর বসে নিজের সানকি টেনে নেয়। এক নিমগ্ন ঘোরে ও ভাত খেতে থাকে–পেট ভরে ভাত খায়।
রাহানুম ওর থালায় মাছ তুলে দেয়, শাক ভাজি দেয়, খেসারির ডাল দেয়, তিন-চার চামচ ভাত বেশি দেয়–তবু আবুল হাশেম না করে না। খেতেই থাকে। সুখদীপ এবং রাহানুম যে অবাক হয়ে ওর দিকে তাকায় সেটা ও খেয়াল করে না। ওর কেবলই মনে হয় ও যেন কতকাল খায়নি। সেই জলোচ্ছ্বাসের পর প্রচণ্ড খিদে নিয়ে অনবরত দৌড়ে বেড়াত চরের মধ্যে। কোথাও কোনো খাবার ছিল না। তীব্র বিবমিষায় মাথা চক্কর দিয়ে উঠলে ও দু’হাতে পেট চেপে মাটিতে গড়াত। ভিজে মাটিতে মাখামাখি শরীর–কী অসহ্য যন্ত্রণায় কেটেছিল কটা দিন।
বাবো, আর এক চামুচ ভাত দিমু?
আবুল হাশেম রাহামের কণ্ঠ শুনতে পায় না। তখন তো চরের মধ্যে কেবল আর্তনাদ ছিল–ছিল মানুষের আহাজারি। কোনো পাখির ডাক না, পানির কলকল না–প্রচণ্ড এক ভৌতিক নিস্তব্ধতা অকস্মাৎ মানুষের সব আর্তনাদ ভাসিয়ে নিয়ে যায়। মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে সবাই–স্বজন হারানোর বেদনা বরফের মতো জমাট হয়ে ছিল। ওহ্ সেই কটা দিন! সেই কটা দিন! আবুল হাশেমের কণ্ঠে অস্ফুট ধ্বনি। চোখ গোলাকার বর্তুল, অথচ বিস্ফারিত। আদিম গুহা থেকে বেরিয়ে আসা বুনো জন্তুর মতো হয়ে যায় আবুল হাশেম।
রাহানুম বিস্মিত হয়ে ডাকে, বাবো, ও বাবো? কি অইছে?
রাহামের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে আবুল হাশেম। সেই মুখটা বালুর ওপর আঁকাবাঁকা রেখা হয়ে যায়, যে রেখাগুলো অজস্র কাঁকড়ার চলে যাওয়ার পদচিহ্ন। তখন ওর কেউ ছিল না, কেউ না। স্ত্রী, ছয় ছেলেমেয়ে, বাবা-মা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, কেউ না। বিরাট প্রান্ত র ছিল ওর জন্য উন্মুক্ত, ও ছিল সেই প্রান্তরের অধীশ্বর–তারপর থেকে খোলা প্রান্তরে একা একা ঘুরে বেড়ানো ওর অভ্যেস হয়ে গেল। হা-হা করে হেসে উঠতে চায় ও। কিন্তু পরক্ষণে বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকে রাহানুমের মুখের দিকে। ওর খাওয়া শেষ। ও এখন হাত দেবে। রাহানুম পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়। আবুল হাশেম সানকি ভরে পানি ঢালে তারপর সেখানে হাত ডোবায়। ধুয়ে যায় ডাল, তরকারির ঝোল, ভাতের চিহ্ন।
ও নিঃশব্দে উঠে আসে। বারান্দার হোগলার ওপর বসে বিড়ি ধরায়। শুনতে পায় সুখদীপ হাসছে। রাহানুম ওকে ধমকাচ্ছে। হাসতে নিষেধ করছে। বলছে, বেশি হাসি ভালো না। রাহামের এই এক অভ্যেস। হাসি শুনলে ও ভয় পায়। মনে করে হাসলেই সামনে বিপদ। আবুল হাশেম বিড়বিড়িয়ে বলে, জানি না, জানি। ক্যান হাসি শুনলে তোর এমন লাগে। কিন্তু সুখদীপের এখন হাসার বয়স, ও হাসবেই। শৈশবেইতো মানুষ না বুঝে হাসে, তারপর কি আর পারে? কিন্তু না, এটা বোধহয় সত্যি নয়, সেই খোলা প্রান্তরে একা হয়ে যাবার পর তো আবুল হাশেম অকারণেও হাসতে শিখেছে। তখনতো ওর শৈশব ছিল না। কৈশোরও। একেবারে ভরা মধ্যবয়স। সেই যে শুরু। এখনো হা-হা করে হাসলে বুকটা খোলা প্রান্তরে ছুটে যাওয়া বাতাসের মতো শোঁ-শোঁ শব্দময় হয়ে যায়। তখন রঙিন মাছ ভেসে আসে, বুদ্বুদ ওঠে, গাছের পাতারা সবুজ হয়, জংলাভূমির ঝরা পাতাগুলো পায়ের নিচে মচমচ করে। নাকের কাছে বুনোফুলের গন্ধ তীব্র হয়। গভীর সমুদ্রে গেলে গাঙচিলেরা ট্রলারের ওপর দিয়ে উড়ে যায়। ওদের ছায়া পড়ে শরীরে। চারদিকের অথৈ নীলে সেই শব্দময় হাসির থৈ-থৈ নৃত্য কলকল শব্দে বয়।
এক সময়ে ও অনুভব করে সুখদীপের হাসি আর নেই। ও খেয়েদেয়ে শুয়েছে। রাহানুম খাচ্ছে, নয়তো বাসনকোসন গুছিয়ে রাখছে। তারপর একবার ওর কাছে আসবে। বলবে, বাবো, ঘুমাইবেন না? এমন পূর্ণিমা রাতে আবুল হাশেমের ঘুম আসে না, আসতে চায় না। আর যদি আসেই তবে আবুল হাশেম এই বারান্দায় হোগলার ওপর ঘুমিয়ে যাবে। কোনো কিছু তখন ওর আর মনে থাকবে না। দু’চোখ জুড়ে ঘনিয়ে থাকবে অন্ধকার। পৃর্ণিমার বিপরীতে যে অন্ধকার থাকে তার নামইতো অমাবস্যা। অমাবস্যা ও সহ্য করতে পারে না। এইতো ক’বছর আগে অমাবস্যার রাতে সমুদ্র ফুলে-ফেঁপে উঠেছিল। কী ভীষণ অন্ধকার ছিল সেদিন।
সন্ধ্যা থেকে টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল। গোয়ালে গরুগুলো চাড়িতে মুখ দেয়নি। ব্যাকুল স্বরে ডেকেছিল কেবল। ঘরে-বাইরে ছুটোছুটি করেছিল আবুল হাশেমের পঞ্চান্ন বছরের স্ত্রী মণিমালা। ওর বাবার এক পীর সাহেব এই নাম রেখেছিল। পীর সাহেব ওর বাবাকে বলেছিলেন, মাইয়া যা কয় হুনবেন। মাইয়ার মধ্যে জ্যোতি আছে।
জ্যোতি নয়, মণিমালার ছিল ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। সুখ-দুঃখের অনেক কিছুই আগে থেকে আঁচ করতে পারত। আবুল হাশেমের কাছে এসে বারবার বলছিল, আইজ একডা কিছু ঘটবে।
মার ক্যাবল অলুক্ষণে কতা।
চেঁচিয়ে ওঠে বড়ো ছেলে আজফার। আবুল হাশেমের বুক ভয়ে কাঁপে। ও চেনে ওর স্ত্রীকে, বিশ্বাসও করে। মণিমালা যখন বলছে তখন একটা কিছু ঘটবেই।
রাত যত বাড়ে, ঝড়ের দাপট বাড়ে। বাতাসে নারকেল গাছের মাথা ভেঙে পড়ে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে দু’হাত দূরের কিছুই চোখে পড়ে না। কনকনে বাতাসের জোর ঝাপটা এসে চামড়া ফাটিয়ে দিয়ে যায় যেন। চিনচিন করে ওঠে গাল-ঠোঁট। মণিমালা আজফারকে ডেকে বলে, গরুগুলোর বাঁধন খুইল্যা দে। হাঁস-মুরগির খোঁয়াড় খুইল্যা দে।
আজফার দৌড়ে উঠোনে নামে। বড়ো বড়ো ফোঁটায় বৃষ্টি পড়ছে। বাতাসের জোর ধাক্কা বাড়ছে। বৃষ্টির সূঁচালো ফোঁটা তীরের মতো ঢুকে যায় শরীরে। গোয়ালে ও স্থির দাঁড়াতে পারে না। বাতাস ওকে উড়িয়ে নিতে চায়। একবার এদিকে একবার ওদিকে পড়ে যেতে চায়। কখনো বেড়ার সঙ্গে ধাক্কা খায়। অন্ধকারে গরুর দড়ি খুঁজে পেতে কষ্ট হচ্ছে। অস্থির গরুগুলো লাথি দিচ্ছে। বারান্দা থেকে বাবা ওকে ডাকছে। নিরুপায় ব্যর্থতায় আজফার হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। একটি গরুর দড়িও খুলতে পারে না আজফার। আবুল হাশেমের ব্যাকুল কণ্ঠ বাতাস ছিড়েখুঁড়ে ওর কাছে ছুটে আসে, ও বাবা তুই ঘরে আয়, ও বাবা আজফার। শোনা যায় মণিমালারও কণ্ঠ। দুজনেই ব্যাকুল হয়ে ওকে ডাকছে। আজফার গরু রেখে দৌড়ে ঘরে ফেরে। তখন ওর বুক ফেটে যায়। ও বুঝতে পারে খুঁটি উপড়ে না গেলে গরুগুলো বাঁধা অবস্থায় মরে যাবে। খুঁটি খুলে দিতে পারলে গরুগুলো ভাসতে ভাসতে কোথাও না কোথাও গিয়ে হয়তো বেঁচে যেতে পারত, নাও পারত। কিন্তু এখনতো ওই গোয়াল ঘরে ওগুলোর মৃত্যু নিশ্চিত। ওর মাথা এলোমেলো হয়ে গেলে ও একটা সুরাও পড়তে পারে না। ব্যাকুল হয়ে শক্ত হাতে বারান্দার খুঁটি চেপে ধরে। তখন শুনতে পায় প্রবল গর্জনে এগিয়ে আসছে সমুদ্র। আকাশে চাঁদ নেই। আকাশে ঘন কালো মেঘ–অন্ধকারে তা দেখা যায় না। একসময়ে আজফার চিৎকার করে ওঠে, বাবো, কেয়ামত, কেয়ামত। আইজ কেয়ামতের রাইত বাবা।
আজফারের কথা শুনে আবুল হাশেমের চৈতন্যে কেয়ামত শব্দ তোলপাড় করে ওঠে। তাইতো, কেয়ামত কি এমন? এমন ভয়াবহ, এমন সর্বগ্রাসী! সেদিন কি এমন ঘুটঘুটে অন্ধকার থাকবে? না, বিশ্বাসতো এমন যে সেদিন মাথার এক হাত ওপরে সূর্য নেমে আসবে। তাহলে? তাহলে কেয়ামত কেমন?
শুনতে পায় ঘরের ভেতর মণিমালা চিৎকার করে কাঁদছে। দরুদ পড়ছে। ও দ্রুতপায়ে ঘরে ঢোকে। বুঝতে পারে মণিমালা ছোট মেয়ে দুটোকে কোলের মধ্যে নিয়ে চৌকির ওপর বসে আছে। আবুল হাশেম আযান দেয়।
আশেপাশের বাড়ি থেকে কয়েকজন দৌড়ে এসে উঠেছে ওদের বারান্দায়। ওদের গায়ে ভিজে কাপড় সপসপ করছে। ওদের ব্যাকুল প্রশ্ন, কি অইবে মিয়াবাই?
আল্লার নাম ল।
আবুল হাশেমের গলা কেঁপে যায়। আজফার তীব্র কণ্ঠে বলে ওঠে, সাগর ফুইলা উঠছে। আল্লার নাম লইলে কি বাঁচন যায়?
মৃত্যুচিন্তায় হতবিহ্বল মানুষগুলো হাহাকার করে ওঠে। কপাল চাপড়ায়। এমন সর্বনাশ ওরা আগে কখনো দেখেনি বলে বিলাপ করে। ততক্ষণে উঠোনে জমে ওঠে ভিড়–আরো নারী-পুরুষ ছুটে এসেছে আশ্রয়ের আশায়। আবুল হাশেম আযান দিতেই থাকে। চিৎকার করতে করতে ওর গলা ভেঙে যায়। সেই সঙ্গে যুক্ত হয় মানুষের কোলাহল এবং আর্তনাদ। আর সময় নেই। প্রবল বেগে ছুটে আসছে জলোচ্ছ্বাস। কানের তালু ফেটে যেতে চায় সেই শব্দে।
ওহ খোদা!
ঘরের ভেতর মণিমালা আবার আর্তনাদ করে, যে কণ্ঠ নীরব হয়ে গিয়েছিল সে কণ্ঠে এখন মরণধ্বনি–ও ছুটে দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। ছোট মেয়েটি কোলে, বড়োটি মায়ের কোমর জড়িয়ে ধরে আছে। আবুল হাশেম মণিমালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।
মণিমালা দু’হাত দিয়ে স্বামীর হাত জড়িয়ে ধরে, এই জনমে আপনের লগে আর দেহা অইবো না।
আবুল হাশেমের বুক কেঁপে ওঠে। শরীরও কাঁপে থরথর করে। স্ত্রীকে কোনো সান্ত্বনা দিতে পারে না। স্ত্রীর হাত জড়িয়ে ধরেই বলে, লাইলাহা ইল্লা আন্তা ছোবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জোয়ালিমিন।
তারপর এক গভীর হিমশীতল স্পর্শে ভেসে যায় চরাচর। কে কোথায় চলে যায় আবুল হাশেম তা আর জানে না। মণিমালা শক্ত মুঠিতে চেপে রেখেছিল। কেমন করে বিচ্ছিন্ন হলো ওরা? আবুল হাশেম জানে না। জানার কথা চিন্তা করতে চাইলেই ওর মগজে একটি শব্দ স্থির হয়ে থাকে, কেয়ামত। সে রাতকে ও কেয়ামত ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে না। ও কাউকে খুঁজে পায়নি। সাগর ওদের কতদূর ভাসিয়ে নিয়ে গেছে? কোনো নতুন চরে রেখে এসেছে ওদের লাশ? সে লাশ কি শকুনে খেয়েছে? ভাবলে বুকের ব্যথা তীব্র হয়–একজন মানুষকেও খুঁজে পেল না ও। এমন সাজানো-গোছানো সংসার ভেসে সাফ হয়ে গেল। ভিটে ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। অস্থির হয়ে ওঠা গরুগুলোও কোথায় যে ভেসে গেল? কিন্তু খুঁজে পেল ভিন্ন দুজন মানুষ–একজন রাহানুম। অন্যজনের নাম ওরা জানত না। রাহানুম নাম রাখল সুখদীপ।
ওদের না পেলে হয়তো অন্যরকম হতো জীবন। হয়তো পাগল হয়ে যেত। পথে পথে ঘুরে বেড়াত–ন্যাংটো, নোংরা খুঁটে-খাওয়া হয়ে যেত এতদিন। যেমন মতি পাগলা ঘুরে বেড়ায় পথেঘাটে, বাজারে। ভাবলে শিউরে ওঠে শরীর। ওহ্ বেঁচে থাকার ওই পতন থেকে ওকে বাঁচিয়ে দিয়েছে রাহানুম আর সুখদীপ। ওদের পেয়ে ও একটা দায়িত্ব পেয়েছে, দায়িত্ব পেয়ে ওর কাজ বেড়েছে। কাজ ওর শোক কমিয়েছে। তাই ওর হৃদয় শান্ত হয়েছে, স্থিত হয়েছে। ও মানুষের মতো বেঁচে থাকার যোগ্যতা ফিরে পেয়েছে। ও রাহানুম আর সুখদীপের কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে ওঠে। বোঝে মানুষই পারে মানুষকে মানুষ রাখতে।
মাঝে মাঝে রাহানুম বলে, বাবা আমনেরে না পাইলে মোগ কি অইতো? মোরা কই যাইতাম? সুখদীপ ওই সাগরের ধারে মইরা থাকত। আর মুই ভিখ করতাম।
আবুল হাশেম গভীর চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলেছিল, তোমারে মুই বাঁচাইছিলাম, আর সুখদীপরে তুমি। আর সুখদীপ আমাগো দুইজনরে বাঁচায়ে দিছে। নইলে মোরা পাগল হইয়া যাইতাম।
রাহামের দৃষ্টি কৃতজ্ঞতার ভারে চকচক করে ওঠে। তারপর মাথা নেড়ে বলে, হ ঠিক। আমরা হকলে হক্কলের লাইগা। হলে সমান।
আবুল হাশেম অনেক ভেবেছে, প্রয়োজন কি বন্ধন টিকিয়ে রাখে? তাহলে ওরা কি আমৃত্যু এভাবে দিন কাটাতে পারবে? কেউ কাউকে কখনো ছেড়ে যাবে না? ভাবতে ভাবতে ওর একটা বিড়ি ফুরিয়ে যায়। ও সেই আগুন থেকে আর একটা বিড়ি ধরায়। তখন রাহানুম বাসনকোসন গুছিয়ে রেখে কাছে এসে দাঁড়ায়, বাবো স্বরে লন? ঘুমাইবেন না?
ঘরে গরম লাগে। এহানে থাহি। তুমি ঘুমাও।
রাহানুম চলে যায়। ঘরের দরজা বন্ধ করে। একটু পরে নিভে যায় কুপির আলো। চারদিক সুনসান। আবুল হাশেমের কানে অস্পষ্ট গোঙানির ধ্বনি ভেসে আসে। আবুল হাশেম জানে এই মুহূর্তে ওই শব্দের। কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। ওটা চৈতন্যের ভেতরের শব্দ। ও ভাবনা ঘুরিয়ে নেয়। বুঝতে পারে রাহানুম শুয়ে পড়েছে। একটু পর ওর ঘুম গাঢ় হয়ে যাবে। এই শব্দময় পৃথিবী থেকে ও দূরে চলে যাবে। কেমন করে শুয়েছে রাহনুম? চিৎ হয়ে না কাৎ হয়ে? নাকি উপুড় হয়ে? নিঃশ্বাসে ওর বুক উঠছে আর নামছে। অন্ধকারে ওর চোখের পাতা স্তব্ধ। সেদিনও বালুর ওপর চোখ বুজে পড়েছিল রাহানুম। না, সেটা ঘুমুনোর জন্য শুয়ে থাকা ছিল না। ঘুমুনোর ভঙ্গি অমন হয় না। ক্ষীণ নিঃশ্বাসের কারণে ওর কোনো স্পন্দন বোঝা যাচ্ছিল না। ও ছিল মৃতবৎ। শুয়ে থাকার যে ভঙ্গি নিপ্রাণ থাকে, সেখানে ভঙ্গিটা প্রধান হয় না। প্রধান হয় বাস্তববোধ, তার কার্যকারিতা। সেদিন রাহনুমের শরীর সবটুকু কার্যকারিতা হারিয়েছিল।
আবুল হাশেম জোরসে বিড়িতে টান দেয়। উঠোনে বেলগাছের ছায়া পড়েছে। সেই ছায়ায় আঁকাবাঁকা সুন্দর একটা ছবি ফুটে উঠেছে উঠোনের ওপর। সেই ছায়ার দিকে তাকিয়ে ছবিটা রাহানুম হয়ে যায় আবুল হাশেমের দৃষ্টির সামনে। এমন একটা ছবি সেদিন জ্ঞান ফেরার পর আবুল হাশেম দেখেছিল। ওর পাশেই এমন ছবির মতো পড়েছিল রাহানুম। ও কোন এলাকা থেকে ভেসে এসেছিল আবুল হাশেম জানে না। চুলগুলো মুখের ওপর লেপ্টে ছিল। নগ্ন শরীর। আবুল হাশেম চমকে উঠে আত্মস্থ হয়ে দেখেছিল, ও এক তীক্ষধার যুবতী। নিঃসাড়, নিস্পন্দ শরীর। কাছে-ধারে কেউ আর কোথাও নেই। সাগর শান্ত, কোনো ঝড় নেই, বাতাস নেই, বৃষ্টির ফোঁটা নেই, মেঘ নেই। ও ভেবেছিল এমন। শান্ত, স্নিগ্ধ প্রকৃতির মাঝেই জীবন শুরু হয়।
ও উঠে হাঁটতে থাকে। হেঁটে হেঁটে চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। দেখতে পায় ঘর-সংসারের অনেক ছোটখাটো জিনিস বালুর মধ্যে গেঁথে আছে। ও একটা শাড়ি কুড়িয়ে এনে ঢেকে দেয় রাহনুমকে। ভেবেছে, ও মৃত। চারদিকে মানুষজন উল্টেপাল্টে পড়ে আছে। কে মৃত, কে জ্ঞান-হারানো বোঝা যায় না। তবে ও কেন রাহামের জন্য মমতা বোধ করল? ও যদি মরেই থাকে তবে কিসের লজ্জা? লজ্জা ঢাকারই বা দরকার কী? এত এক কঠিন সময়–চারদিকে বিপর্যস্ত জীবন। এ জীবনে হাহাকার, ক্রন্দন–তবু সবকিছু ছাড়িয়ে মানুষের জন্য মানুষের মমতা। মানুষইতো পারে মানুষের লজ্জা ঢেকে দিয়ে তাকে বড়ো করে তুলতে। ও শাড়ি দিয়ে ঢেকে দেওয়া রাহালুমের দিকে তাকানোর সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভেতর ঝড় বয়ে যায়। আসলে রাহানুম উপলক্ষ মাত্র, ওর বুকের ভেতর তীব্রভাবে গেঁথে আছে মণিমালা। ওর ব্যাকুল দৃষ্টি মণিমালাকে খুঁজছে। ও কোনোকিছু অবলম্বন করে মণিমালার শোক সামলাতে চাইছে, নিজেকে শক্ত করতে চাইছে। কিন্তু পারছে কই? চারদিকে তাকিয়ে অনুভব করতে চায় যে মণিমালা কি কোথাও এমন উলঙ্গ হয়ে পড়ে আছে? শকুনে খুবলে খাচ্ছে মণিমালাকে? না কি ওর মতো কেউ ঢেকে দিচ্ছে মণিমালার লজ্জা? ভাবতেই ড়ুকরে কেঁদে ওঠে ও।
অনেকক্ষণ হাঁটুতে মাথা গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে শান্ত হয়। সাগরের গর্জন ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই এ বেলাভূমিতে। কোথাও পাখির ডাকও নেই। ও আকাশের দিকে তাকায়, ঝকঝকে নীল আকাশ, পরিষ্কার দিন। ওর বুক ভেঙে আসে, হাঁটু ভেঙে আসে। খিদেয় ওর পেট জ্বলে, পিপাসায় বুক শুকিয়ে যায়। তারপরও যতটুকু শক্তি ও প্রাণপণ চেষ্টায় যতদূর যেতে পারে ততদূর গিয়ে মণিমালাকে খোঁজে, ছেলেমেয়েদের খোঁজে, না কেউ কোথাও নেই, কারো কোনো চিহ্নও নেই–ওদের কারো একটি জামা, একটি লুঙ্গি অথবা একটি মৃত গরু কিংবা খোয়াড়ের সবচেয়ে বড়ো হাঁসটি। নিজের ভুল হতে পারে ভেবে যারা উপুড় হয়ে আছে তাদের উল্টে দেখে। হতাশ হয়, ক্লান্ত হয়। বুকে হাঁফ ধরে। বুক চেপে গেলে নিঃশ্বাস ফেলতে কষ্ট হয়। ও একটু একটু করে ডাঙার দিকে এগোয়। গাছের ডালে আটকে আছে মানুষ, ঝুলছে। হাত ছড়িয়ে আছে দুদিকে, পায়ে বিশাল ক্ষত। ভয়ে শিউরে ওঠে আবুল হাশেম। দ্রুত চোখ বন্ধ করে। কিন্তু কতবার চোখ বন্ধ করবে ও? সামনেই খেজুর কাঁটায় বিধে আছে তিনটে শিশু–যেন কোচ দিয়ে গেঁথে তোলা মাছ। আরো দৃশ্য আছে–বীভৎস, ভয়াবহ। কিন্তু এইসব দৃশ্য আবুল হাশেম দেখতে চায় না, ওর হৃদয় পীড়িত হয়–পীড়িত হয়ে জ্বলতে থাকে এবং ওর ভেতরে আর একটি জলোচ্ছ্বাস বেড়ে ওঠে–সে বেড়ে ওঠায় গড়াতে থাকে ওর মনোভূমি, ওলটপালট হয়ে যায়–ও বদলাতে থাকে, যেমন বদলায় সাপের খোলস।
আবুল হাশেম নিজেকে নিজের ভেতর ধরে রাখতে পারে না। টের পায় ক্ষয়ে যাচ্ছে, ক্ষয়ে যাচ্ছে পুরনো আবুল হাশেম। ও আবার সমুদ্রের দিকে হাঁটতে থাকে। ও বুঝতে পারে না যে ও কোথায় এসেছে। এখন ও পুবে যাবে না পশ্চিমে? পুবে আছে কি ও বাড়ি-ঘর? না কি পশ্চিমে? একটি ভাঙা ট্রলারের ওপর ও এসে বসে।মাথা কেমন করছে। ট্রলারের গায়ে হেলান দেয়। দেখতে পায় জোয়ার আসছে।
এক সময়ে এই দিন ফুরিয়ে যাবে, রাত আসবে। তখন? না, ভয় পায় না ও। সেইসব দৃশ্যগুলো ওকে এখন আর ভীত করে রাখছে না। ও এইসব দৃশ্য বাস্তব বলে ধরে নিয়েছে। বোঝে বুকের ভেতর ভয়ের কিছু নেই। বুকের ভেতরের ক্ষয়ে যাওয়া ওর ভয় রোধ করেছে। ও ভাঙা ট্রলারে বসে থেকে পাখির ডাক শোনার চেষ্টা করে। কিন্তু না, দু’চারজন মানুষের আর্তনাদ ওর কান ভরে দেয়। এতক্ষণে ও খেয়াল করেনি যে যারা বালুর মধ্যে উপুড় হয়ে চিৎ হয়ে পড়েছিল তারা কেউ কেউ নড়েচড়ে উঠছে–তারা জ্ঞান ফিরে পেয়েছে। এতক্ষণ ওরা মুমূর্ষ ছিল। জ্ঞান ফিরে পেয়ে ওরা আর্তনাদ করছে। ওহ কী নিদারুণ সেই শব্দ। এতক্ষণ ও শব্দ শোনার জন্য ব্যাকুল ছিল। কিন্তু সে তো এমন ভয়াবহ শব্দ নয়। যে শব্দ আনন্দের নয়–সান্ত্বনার নয়–অনুপ্রেরণার নয় সে শব্দ ওকে নিষ্পেষণ করতে থাকে। শব্দ যেন আকাশ-পাতাল ফুড়ে বেরিয়ে আসছে। মানুষের হৃদয়ে কি এমন হাহাকার জমে থাকে? আগে কখনো। তো এমন শব্দ শোনেনি আবুল হাশেম। বিলাপ শুনতে শুনতে ওর শরীর অবশ হয়ে গেলে ও আবার জ্ঞান হারায়। চোখের সামনে বিলুপ্ত হয় এক সকালের এই পরিচিত জায়গাটি।
বিকেলের দিকে জ্ঞান ফিরলে দেখতে পায় ওর পায়ের কাছে রাহানুম, গুটিসুটি বসে আছে–আলুথালু চুল–উদ্ভ্রান্ত চাউনি। আবুল হাশেম ধড়মড়িয়ে উঠে বসে, ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে। রাহানুম কেন ওর কাছে এসে বসে আছে তা ও বুঝতে পারে না। যে শাড়িটি কুড়িয়ে এনে আবুল হাশেম ওকে মৃত মনে করে ঢেকে দিয়েছিল সেই শাড়িটি পরে আছে। ও কোনদিকে তাকিয়ে আছে বোঝা যায় না। যদিও আবুল হাশেমের নিজের খুব অবসন্ন লাগছিল, তবুও ওর চেতনা ছিল প্রখর। কিন্তু রাহানুমকে দেখে ওর মনে হচ্ছিল ও সুস্থ নয়, অপ্রকৃতিস্থ। ও মৃদু স্বরে ডাকে, মা, মাগো?
সাড়া নেই। ঘুরেও তাকায় না। দূর সাগরের দিকে তাকিয়ে আছে, মনে হয় ও ভেতরে ভেতরে কোনো একটা কিছুর প্রস্তুতি নিচ্ছে। ও ভাঙবে, গড়বে কিংবা ইস্পাতের মতো কঠিন হবে–এই ভাঙচুরের সময় বড়ো কঠিন সময়। মানুষ যখন কঠিন সময় পার হয় তখন পারিপার্শ্বিকের সবকিছু ভুলে যায়–ওর সামনে বড়ো কিছুই প্রবল হয়ে ওঠে, সেটা সমুদ্র কিংবা আকাশ। আবুল হাশেমের ইচ্ছে করে রাহানুমকে ধরে প্রবলভাবে নাড়িয়ে দিতে। দেখতে চায় মেয়েটি কি মাটির সঙ্গে গেঁথে শিলা হয়ে গেছে না কি ওর মধ্যে প্রাণ আছে? কিন্তু কিছুই করা হয় না। কিছু করতে ভয় পায় ও। আবুল হাশেম বুঝতে পারে রাহানুম আছে বলে ওর অবসন্নতা কেটে যাচ্ছে। ওর ভালো লাগছে–এবং বুকের। ভেতর পাখির ডাক শোনার যে ব্যাকুলতা ছিল তেমন একটি শিস বাড়ছে। ওর ভালো লাগছে।
ও আস্তে আস্তে আবার জিজ্ঞেস করে, তোমার নাম কী মাগো?
রাহানুম জবাব দেয় না। শুধু ওর দিকে তাকায়। আবুল হাশেম ভাবে, এই ট্রলারটিকে মেয়েটি হয়তো একটি আশ্রয় ভেবেছে–একটি ঘর কিংবা গাছের ছায়া। তখন ও বিড়বিড় করে কী যেন বলে আবুল হাশেম বুঝতে পারে না। কিন্তু ওর বিস্ময়ের ঘোর কাটে না। এই মরা মেয়েটি বেঁচে আছে? কিন্তু ওর কণ্ঠে আর্তনাদ নেই কেন? ও বিলাপ করছে না কেন? বিলাপের কথা মনে করতেই ওর বুকটা আবার কেমন হয়ে যায়। ও দুর্বল কণ্ঠে রাহানুমকে বলে, তোমার বাড়ি কোমনে মাগো?
রাহানুম এবারও উত্তর দেয় না। ও কিছুই মনে করতে পারছে না। ও বারবার হাত বাড়ায়, তারপর শূন্য হাত ফিরিয়ে আনে নিজের কোলের ওপর। আবুল হাশেমের ভেতরে ভেতরে জেদ বাড়ে। মেয়েটি কথা বলছে না কেন? কথা বলবে না কেন? ও ওকে আবার একই প্রশ্ন করে। ও তেমনি নির্বিকার। আর কোনো কথা হয় না। ও ট্রলারের ওপর থেকে নেমে পড়ে। খানিকটুকু সামনে হেঁটে আসে। কিন্তু রাহানুমকে ছেড়ে বেশিদূর যেতে পারে না। ফিরে এসে ট্রলারের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। নিরুপায় ক্ষোভ নিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকে। এখন ভাটি। সরসরিয়ে নেমে যাচ্ছে জল। আবুল হাশেমের মাথা আস্তে আস্তে পরিষ্কার হচ্ছে। ঘোর কেটে যাচ্ছে। ও পরিস্থিতি বুঝতে চাইছে। এখন কী করবে ভেবে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। মেয়েটি বারবার হাত বাড়ায় কেন? ও কাকে খোজে? কোন গ্রামের মেয়ে। বাবা কে? স্বামী কি ছিল? কিন্তু ওকে প্রশ্ন করে কী লাভ? ওতো উত্তর দেয় না। আহা বেচারি। ভাবতেই আবুল হাশেম নিজের পরিবারের চিন্তায় ব্যাকুল হয়ে ওঠে। তখন ওর কান্না পায়। ও শব্দ ক করে কেঁদে ওঠে।
কান্নার শব্দে রাহানুম আবুল হাশেমের দিকে ফিরে তাকায়। ওর দৃষ্টি চঞ্চল হয়ে উঠেছে। এতক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকা মানুষটি যেন আপন নিয়মে ফিরে এসেছে। আবুল হাশেম অনুভব করে যে ওর চোখের ভাষা পড়া যাচ্ছে। আবুল হাশেমের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেই ও মাথা নাড়ায়। বিড়বিড়িয়ে বলে, না, মনু না, কাঁদে না। গেদু মোর, কাঁদে না।
আবুল হাশেম কেঁদে কেটে লুঙ্গি দিয়ে চোখ মোছে। তখন রাহানুম। আস্তে আস্তে বলে, কান্দেন ক্যান?
তুমি কান্দ ক্যান?
মোর গেদু? মোর গেদু কোমর্নে? ও মাগো–
রাহানুম এতক্ষণে তারস্বরে চিৎকার করে। বিলাপ করে, ও মোর গেদুরে তুই অহন কোমনে? বানের সময় তুইতো মোর বুকের মইদ্যে ছিলি। ওহ্ হোরে ..
রাহানুমের কান্নার একটা ঢঙ আছে। সেটা অনেকক্ষণ রেশ জাগিয়ে রাখে। সেই শব্দে বিভিন্ন রকম ওঠানামা আছে। আবুল হাশেম কান পেতে শোনে। এই শোনার অভিজ্ঞতা ওর একদম নতুন। ও কখনো এমন শব্দের কান্না শোনেনি। এমন ঘটনাতো ওর জীবনে ঘটেও নি। ও কী করে জানবে যে কান্নার এমন হাজার রকম শব্দ আছে। নিজের কান্নাতো এমন কান পেতে শোনা যায় না। শোনা গেলে বুঝতে পারত কান্নার ওঠানামা কীভাবে হৃদয়কে স্পর্শ করে। সে শব্দ অনুসরণ করে নিজের দিকে তাকালে বুকটা হু-হু করে ওঠে। মণিমালা কোথায়? ও কি কোথাও বসে এমন করে কাঁদছে? মণিমালার বিলাপ আবুল হাশেমকে কখনো শুনতে হয়নি। ও কি সেজন্য ভাগ্যবান? হ্যাঁ, ভাগ্যবান, ভীষণ ভাগ্যবান। তাই এই কান্না ও শুনতে চায় না। রাহানুম কাঁদতেই থাকে। ও এই কান্নার শব্দ থেকে দূরে চলে যাবার জন্য উঠে হাঁটতে থাকে। দ্রুত পায়েই হাঁটে। তখন রাহানুম চিৎকার করে ওর পিছে ছুটে আসে, ও বাবা আমনহে কোমনে যান? মুই আমনহের লগে যামু?
আবুল হাশেম থমকে যায়। স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে থাকে। কে ওকে এমন ব্যাকুল স্বরে বাবা বলে ডাকছে? মেয়েটি তো ওর আত্মজা নয়। তবে ও কে? কে ও? এ কেমন সম্পর্ক মানুষের মধ্যে? কী করে গড়ে ওঠে? আবুল হাশেম স্নেহের ব্যাকুলতায় রাহামের হাত ধরে। ততক্ষণে ওর ফোঁসফোসানি কমেছে। হেঁচকি ওঠা বন্ধ হয়ে আসছে। দৃষ্টি শান্ত, স্পষ্ট। এতক্ষণে ওকে স্বাভাবিক মানবী মনে হচ্ছে।
আবুল হাশেম ওর চোখে চোখ রেখে বলে, মাগো, মুইওতো জানি যে মুই কই যামু? লও, তুমি মোর লগে লও।
তখন সূর্য পশ্চিমে, লাল আভায় লাল হয়ে গেছে দিগন্ত। ভাটির টান শেষ হয়নি। দুজনে কোনো কিছু স্থির করতে না পেরে পশ্চিমমুখো হাঁটতে থাকে। ভাবে যেদিকে আলো সেদিকেই হয়তো ঘর থাকে–মানুষ থাকে, লোকালয় থাকে। কতদূর যেতে হবে? ক্ষুধায়, ক্লান্তিতে পা চলে না। তবু ওরা থামবে না বলেই ঠিক করে। কতদূর হেঁটেছে জানে না–কতদূর যাবে জানে না। বিকেল প্রায় শেষ, সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই করছে। প্রশান্ত সাগরে দিনের শেষ আভা। ওরা দেখতে প্রায় খানিকটা দূরে আরো একটা ভাঙা ট্রলার উল্টে আছে। রাহানুম আবুল হাশেমের মুখের দিকে তাকায়, বাবো, আর আঁটতে পারমু না।
আবুল হাশেম ক্লান্ত কণ্ঠে বলে, মুইও আর আঁটতে পারি না। পাও চলে না।
মোরা ওই ট্রলারটার ধারে বমু।
চলেন ওইহানে যাই।
রাহানুম উৎসাহী কণ্ঠে কথা বলে। ওর ভেতরে জোর ফিরে এসেছে। বাঁচার তাগাদা প্রবল হচ্ছে। এখন ওর একটি আশ্রয় দরকার। ও একজন বাবা পেয়েছে, এখন একটি ঘর পেলে ও হয়তো টিকে যাবে। টিকে যাওয়া ছাড়া এই মুহূর্তে ওর অন্য চিন্তা নেই। আবুল হাশেম বুঝতে পারে বয়সের তারুণ্য ওর ভেতরে দ্রুত শক্তি সঞ্চারিত করেছে। তাই বালুর ওপর দিয়ে বেশ শক্ত পায়ে হেঁটে যাচ্ছে রাহানুম। আবুল হাশেম বেশ খানিকটা পিছিয়ে পড়েছে। ধকলের ক্লান্তি ও কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারছে না।
দুজনে ভাঙা ট্রলারের কাছাকাছি আসতেই শুনতে পায় শিশুর কান্না। কী করে সম্ভব? চমকে ওঠে রাহানুম। ওর শরীর কেঁপে ওঠে। থমকে দাঁড়িয়ে আবুল হাশেমের মুখের দিকে তাকায়। মুহূর্ত মাত্র। তারপর সেই কান্না লক্ষ্য করে ছুট লাগায়। কিছুদূর ছুটে এসে রাহানুম থেমে যায়। দেখতে পায় ছোটার ফলে ওর স্তন থেকে দুধ ঝরছে, ভিজে গেছে শাড়ি। এই দৃশ্য ওকে আরো ব্যাকুল করে তোলে। ও ছুটতে ছুটতে ভাঙা ট্রলারটার কাছে এসে দাঁড়ায়। শিশুটি ট্রলারের নিচে বসে আছে। হয়তো বছর দুয়েক বয়স হবে। কীভাবে বেঁচে গেল ও? রাহানুম শিশুটির সামনে হুমড়ি খেয়ে বসতে বসতে ভাবে, আল্লাহ বুঝি এমনই দয়ার সাগর। ওর মনে হয় শুধু ওরই জন্য এই শিশুটি এখানে বেঁচে আছে। এই অলৌকিকতা কোনো হিসাবের মধ্যে পড়ে না। কৃতজ্ঞতায় ও অভিভূত হয়ে যায়। ওর বুকের ভেতরের তোলপাড় প্রবল জলোচ্ছ্বাসের চাইতেও বিশাল হয়ে ওঠে। ও ক্ষিপ্র হাতে শিশুটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে। আদরে আদরে ওকে পিষ্ট করে। তিন মাস আগে ও মা হয়েছিল, ওর প্রথম সন্তান।
শিশুটি পাগলের মতো ওর বুকে মুখ ঘষে। রাহানুম বুঝতে পারে ওর স্তন নির্গমন চায়, যেটুকু তরল পদার্থ ঝরেছে সেটুকুই যথেষ্ট নয়, আরো ঝরবে, আরো। শিশুটি অস্থির হয়ে উঠেছে। ও আশ্রয় চায়, খাবার চায়। যদিও কান্না ছাড়া এখন ওর আর কোনো ভাষা নেই, তবুও এখন কান্না বন্ধ। ও একবার দুহাতে রাহামের গলা জড়িয়ে ধরে। একবার কাঁধ খামচে দেয়, আর একবার গালে গাল ঘষে। ও কী করবে বুঝতে পারছে না। ওর ক্ষুদ্র হাত রাহামের শরীরের কোনো একটি জায়গায় পৌঁছতে চায়, কারণ ও মায়ের স্তন পান করেছে। ও জানে যে স্বাদ কী। যে স্বাদের জন্য ওর জিহ্বা তীক্ষ হয়ে উঠেছে। কিন্তু ঈপ্সিত জিনিস ও পাচ্ছে না। কেউ ওকে সাহায্য করছে না। কোনো কিছু করতে না পেরে শিশুটি আবার ভঁা করে কেঁদে ফেলে। ওর চিৎকারে রাহামের শ্রবণশক্তি যেন বধির হয়ে যায়। নিজেকে অপরাধী মনে হয়। কেন এই মানব শিশুকে অকারণ কষ্ট দেওয়া? ও শিশুটিকে কাঁধের ওপর ফেলে পিঠ চাপড়ে দিতে চাইলে শিশুটি প্রতিবাদ করে। হাত-পাত ছুঁড়ে চিৎকার করে কোল থেকে নেমে যেতে চায়।
তখন রাহানুম ট্রলারের ভাঙা কাঠের গায়ে হেলান দিয়ে বসে পা ছড়িয়ে দেয়। শিশুটি ওর কোলে। বেশ খানিকটা তফাৎ থেকে আবুল হাশেম এগিয়ে আসছে। ও রাহামের মতো ছুটতে পারেনি। ছুটলে বুকে হাঁফ ধরে, বয়স ওকে জাপটে ধরেছে। রাহানুম বুঝতে পারে যে আবুল হাশেম এগিয়ে আসছে, কিন্তু ও পুরো একজন মানুষকে দেখতে পায় না। চারদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। রাহানুম বুকের কাপড় সরিয়ে শিশুটির মুখে নিজের স্তন তুলে দেয়। ওহ্ কী আনন্দ! কী আশ্চর্য সুন্দর সন্ধ্যার এই নেমে আসা। রাহানুম দু’চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে। অনেকদূরে বনভূমির মাথায় যে অন্ধকার নেমেছে তা অস্পষ্ট নয়, গাঢ়–তবু সেখানে আলো দেখতে পায় রাহানুম। পাতার ফাঁক দিয়ে চুইয়ে পড়ছে। আলো, প্রশাখার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয় আলো–কাণ্ডের ভেতর দিয়ে শেকড়ে পৌঁছে যায় সে আলো। রাহানুম চোখ বুজতে পারে না–চোখের পাতা পড়ে না। ওর মাথায় স্বপ্ন ঘনিয়ে ওঠে–সে স্বপ্নের ভেতর দিয়ে আলোর নদী বয়ে যায়। ও বুঝে যায় এই মহাপ্রলয়ের পর জীবনের এইটুকু সুখ ওর পাওনা ছিল।
আবুল হাশেম ধীরে পায়ে এগিয়ে এসে দেখতে পায় এক অলৌকিক স্বর্গীয় দৃশ্য। রাহালুমের উন্মুক্ত বুকে এক মানব শিশু। শিশুটিকে নিয়ে ও মগ্ন হয়ে আছে। ওর কোনোদিকে খেয়াল নেই। এই পৃথিবী ওর কাছে। অবলুপ্ত হয়েছে, গতরাতের জলোচ্ছ্বাস এখন আর ওর জীবনে মহাপ্রলয় নয়। ও জানে ও একজন মানবী–ও প্রকৃতি–শিশুদের বাঁচিয়ে রাখা ওর ধর্ম।
এই দৃশ্য দেখে আবুল হাশেমের বুক ভরে যায়, প্রচণ্ড তৃপ্তি ওকে আচ্ছন্ন করে। ওদের প্রথম সন্তান হবার পর মণিমালাকেও এমনই লাগছিল–প্রকৃতির মতো জীবনদায়িনী, যাদের ক্রোড়স্পর্শ না পেলে বন্ধ হয়ে যেত মানবজাতির ধারাবাহিকতা। এখন অন্ধকার বলে রাহানুমের মুখটা পরিষ্কার দেখা যায় না, তবু সে মুখে জ্যোতি আছে, আবুল হাশেমের এটা অনুভব। তখন মণিমালাকে দেখতে ওর ভালো লাগত, নতুন মনে হতো, কেমন জানি অন্যরকম। মণিমালার চেহারায় আলোর জ্যোতি খেলত। মণিমালা লজ্জা পেয়ে বলত, এমন করে তাকিয়ে থাহেন ক্যা?
আবুল হাশেম মাথা নেড়ে বলত, কী জানি ক্যা।
উত্তরটা ওর নিজের কাছেও পরিষ্কার ছিল না। আবুল হাশেমের অন্যমনস্ক মাথা নাড়া দেখে মণিমালা ছেলেকে শাড়ির আঁচলের নিচে আড়াল করে বলত, আমনেহ তাকায়ে থাকলে পোলাডার যদি কিছু অয়?
ওই কথা শুনে লজ্জায় কুঁকড়ে যেত আবুল হাশেম। অপরাধীর মতো দ্রুত সরে যেত মা ও ছেলের সামনে থেকে। এই কথা মনে করেই ও ভাঙা ট্রলারের উল্টোদিকে চলে যায়। ওর তাকিয়ে থাকা দিয়ে ও কারো ক্ষতি করতে চায় না, আর কোনো ওলটপালট নয়। এখন এক দারুণ সময়। প্রত্যেকেই নতুন জীবনের সূচনায় দাঁড়িয়ে আছে। আবুল হাশেমের করোটিতে বানের পানি পলিমাটি ফেলে। যেন বলছে, শুভযাত্রা হোক, শুভযাত্রা। এই সময়, এই অন্ধকার ওর ভালোই লাগছে।
উল্টো দিকে আসতেই দেখে ট্রলারের ফাঁকে একজোড়া নারকেল আটকে আছে। ও খুশি হয়ে যায়। এখন ওদের কিছু খাবার দরকার, নইলে শক্তি ফুরিয়ে আসছে। ও ট্রলারের গায়ে পিটিয়ে নারকেল ভাঙে। দাঁত দিয়ে কামড়িয়ে কয়েক টুকরো বের করে। ট্রলারের ওপর থেকে রাহামের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়, ল মা খা।
কি যে ভোখ লাগছিল মাগো। আমনহে না থাকলে কে মোরে খান দিত বাবো?
রাহানুমের কৃতজ্ঞ কণ্ঠ শুনে আবুল হাশেমের বুক জুড়িয়ে যায়। কোনো জবাব দেয় না। একটু পরপর নারকেলের টুকরো রাহামের হাতে তুলে দেয়। রাহানুম কুটকুট শব্দে নারকেল চিবোয়। দুজনে। অনেকক্ষণ ধরে একজোড়া নারকেল খেয়ে ফেলে।
পেটপুরে খেয়ে শিশুটি ওর নতুন মার কোলে ঘুমিয়ে আছে। ওর জন্য নিরাপদ, নিশ্চিত আশ্রয়। ট্রলারের পাটাতনে আবুল হাশেম চিৎপাত শুয়ে থাকে। চোখে ঘুম নেই। মাথার ওপর তারাভরা আকাশ। অসংখ্য জ্বলজ্বলে তারা ভোরের শিউলির মতো ছড়িয়ে আছে। সেই শৈশবে শিউলি-কুড়োনোর দিন ছিল ওর জীবনে, স্মৃতির ভেতরে তারার মতো ফুটে আছে তা। সেই দিনগুলো কখনো মিথ্যে হয়ে যায় না, সময়ের ভাঁজে ভাঁজে ড়ুবে থাকে। সময়ের ভাজ পড়ে সময়ের ওপর–এভাবেইতো এগিয়ে যায় জীবন
ও খুব কোমল কণ্ঠে রাহামকে ডাকে, রাহনুম? মাগো? সাড়া নেই। হয়তো ট্রলারের গায়ে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেছে। রাহামের কাছ থেকে ওর কথা শুনতে চেয়েছিল আবুল হাশেম। কেমন সময় ওর জীবনের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে তা জানার বড় সাধ হয়। কিন্তু না, ওর ঘুম আর ভাঙাতে চায় না। ও অবাক হয় এই ভেবে যে এই মেয়েটি কত সহজে ওর কাছাকাছি চলে এসেছে–কত সহজে একটি শিশুর মা হয়েছে। সবইতো সেই জীবনের ধারাবাহিকতা যে জীবনের কোনোকিছু হারিয়ে যায় না। স্মৃতির ভাজে জড়িয়ে থাকে সেইসব দিন। শুধু প্রয়োজন মানুষকে বদলে দেয় খানিকটুকু।
আবুল হাশেম ঘুমহীন চোখে দেখে আকাশে নক্ষত্র, নক্ষত্রপুঞ্জ ছায়াপথ, অজবীথি, এক মহাবিশ্ব। এইসব নিয়ে এতদিনের জীবন হারিয়ে আর এক জীবন গড়ে ওঠে। এইসব দিয়ে মানুষ, মানুষ থেকে। মানুষের ভেতর চলে যায়।
এভাবেই তিনজন মানুষের ঘর-সংসার আবার গড়ে ওঠে।