শুক্লপক্ষ
দু’পা সামনে ছড়িয়ে তার ওপর মুখ রেখে কুকুরটা শুয়ে ছিল। ওরা যখন হল গেট থেকে বেরোল, ওদের জুতোর তলার খসখস আওয়াজে কুকুরটা চোখ মেলে পিটপিট করে চাইল। এক মুহূর্ত কী যেন ভেবে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। ততক্ষণে ওরা হলের সামনের ঘাসে ছেয়ে যাওয়া শুঁড়িপথে পা রেখেছে। কুকুরটা শরীর টানটান করে আলস্য ভেঙে ধীরেসুস্থে ওদের পিছু নিল। জহির প্রথমে দেখল কুকুরটাকে। কয়েকবার ‘হুস হাস’ জাতীয় শব্দ করে হাত নেড়ে তাড়িয়ে দিতে চাইল। কুকুরটা আগ্রহ নিয়ে জহিরের কাণ্ড দেখল, কিন্তু নড়ল না। ওরা যখন চলতে শুরু করল, লেজ নেড়ে নেড়ে কুকুরটা আবার ওদের পিছু নিল। কিছুদূর গিয়ে জহির আবার ‘হুস! হুস যাহ!’ করে উঠল। নাইম বিরক্ত হয়ে বলল, ‘আহা, কুকুরটা তোর কী ক্ষতি করল? নিরীহ প্রাণীটার পেছনে লাগলি কেন, জহির?’ বারেক ওর স্বভাবসুলভ হো হো করে হেসে উঠল, যেন মস্ত কোন হাসির কৌতুক বলা হয়েছে। বারেকের হাসি এবার নাইমের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল, নাইম থেকে জহির। ওরা তিনজনেই হাসছে। অকারণ হাসি। অবোধ কুকুরটা নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে মানুষের কর্মকাণ্ড দেখছে আর বিভ্রান্ত না হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।
শরতের রাত। পরিচ্ছন্ন আকাশে বিশাল চাঁদ। রূপালী জ্যোৎস্নায় ঝলমল করছে প্রকৃতি। এমন সব রাতে ওরা তিনজন হল ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। ঘুমন্ত ক্যাম্পাসের শূন্য পথে হেঁটে বেড়ায়। কখনও স্টেডিয়ামের পাশে, কখনও আমীর আলী হলের মাঠে, আবার কখনও স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে পা ঝুলিয়ে বসে থাকে। ঝড়ের মত ছুটে আসা নিশাচর ট্রেনের আচমকা হুইসেলের শব্দে পার্শ্ববর্তী সোহরাওয়ার্দী হলের ছেলেরা যখন পাশ ফিরে শোয়, ওরা তখন বিপজ্জনকভাবে লাফিয়ে উঠে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ায়। ছুটে আসা দ্রুতগামী ট্রেনটা ওদের চোখেমুখে বাতাসের ঝাপটা মেরে শহরের স্টেশনের দিকে হারিয়ে গেলে ওরা ওটাকে অভিশাপ দিতে দিতে আবার পা ঝুলিয়ে বসে যায়। এভাবে কাটিয়ে দেয় রাত। ওদের অবাক লাগে, একটু রাত বাড়লেই সমস্ত ক্যাম্পাস ঘুমিয়ে পড়ে। রাতের ক্যাম্পাসের এই অপার্থিব সৌন্দর্যের কথা কেউ জানেই না! এই সৌন্দর্য না দেখেই একজন শিক্ষার্থী কেবল ডিগ্রী হাতে ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যায়। আহা!
হাঁটতে হাঁটতে ওরা সোহরাওয়ার্দী হলের সামনে চলে এল। নাইম বলল, ‘চল, আজ সোহরাওয়ার্দীর পুকুরপাড়ে বসি।’
ওরা তিনজন পুকুরপাড়ের সিমেন্টের পাকা বেঞ্চিতে বসে। কুকুরটা ওদের সামান্য দূরত্বে ঘাসের ওপর শুয়ে পড়ে। জহির শিস বাজিয়ে একটা গান ধরার চেষ্টা করে। নাইম বেঞ্চির ওপর আঙুল দিয়ে তবলা বাজায়। হঠাৎ বারেক বলল, ‘চল, আজ পুকুরে নেমে বসে থাকি। দেখ, পুকুরের জলে কী মায়াবী জ্যোৎস্না। চল, গায়ে মাখি!’
নাইম আঙুল বাজানো থামিয়ে বলল, ‘খারাপ বলিসনি। এই রাতে পুকুরে না নামলে রীতিমত অন্যায় হবে। কিন্তু কাপড় আনতে রুমে যাবে কে?’
‘কাপড়ের জন্য ভাবছিস কেন? কাপড় খুলেই নেমে পড়ব। এত রাতে দেখবে কে?’ বলে হেসে উঠল বারেক। হেসে ফেলল নাইমও।
এতক্ষণে মুখ খুলল জহির, ‘কী সব বলছিস বেহায়ার মত! তা ছাড়া এত রাতে আমরা কেউ পুকুরে নামছি না।’
‘আমরা বলছিস কেন? বল আমি নামছি না। তোর না নামাই ভাল রে। পানিতে হঠাৎ জলবুড়ি ঠ্যাঙ টেনে ধরবে।’ বলে বারেক আবার হো হো করে হেসে উঠল। কুকুরটা বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিল। বারেকের বিশ্রী হাসির শব্দে ঘুম ভেঙে দুইবার ঘেউঘেউ করে প্রতিবাদ জানিয়ে আবার পায়ের ওপর মুখ নামিয়ে আনল।
‘চল, রুমে গিয়ে কাপড়চোপড় নিয়ে আসি। এমন চমৎকার একটা রাতে পুকুরে নামার লোভ সামলাতে পারছি না।’ নাইম উঠে দাঁড়াতেই জহির খপ করে ওর কব্জি চেপে ধরল। এভাবে আচমকা আঁকড়ে ধরায় নাইম ভয় পেয়ে এক রকম লাফিয়ে উঠল। রাতের বেলা মানুষ কেবল ভয় পেতে পছন্দ করে। অহেতুক লাফিয়ে ওঠে। আর হঠাৎ খপ করে কেউ কব্জি চেপে ধরলে তো কথাই নেই।
জহির কঠিন গলায় ঘোষণা করল, ‘আমরা কেউ পানিতে নামছি না।’
‘কিন্তু কেন? তুই বরাবর ভিতুর ডিম। তুই চোখ বন্ধ করে বসে মনে মনে এক দুই গুনতে থাক, আমরা কাপড় খুলে নেমে পড়ি।’ বারেকের গলায় ঝাঁজ।
‘আমার ভয়ের একটা কারণ আছে,’ প্রায় শোনা যায় না এমন গলায় বলল জহির।
‘তাই নাকি? তোর চমৎকার গল্পটা নাহয় পানিতে গলা ডুবিয়ে শুনব।’ একদলা থুতু ফেলল বারেক।
নাইম এতক্ষণে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে বলল, ‘ব্যাপারটা কী বল তো!’
জহির ইতস্তত করছে। ‘গল্প নাহয় পরে শুনলি, তবে এখন পানিতে নামিস না।’
‘তুই যেভাবে মিনমিন করছিস তাতে এদিকে নয়, তোকে পশ্চিম পাড়ায় মেয়েদের হলের দিকে থাকতে হত। একটা চামচিকা দেখলেও সবাই গলা জড়িয়ে ধরে চিৎকার করতে পারতি।’ চরম বিরক্তি বারেকের গলায়।
ওরা কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। নীরবতা ভাঙল বারেক, ‘নামলাম আমি। তোরা বসে থাক।’
‘খবরদার নামবি না!’ হাহাকার করে উঠল জহিরের গলা।
এবার বিরক্তি চেপে রাখতে পারল না নাইমও, ‘ব্যাপারটা বলবি তো!’
‘আমার সাথে ছোটবেলায় একটা ঘটনা ঘটেছিল। আমি আসলে বলতে চাইছিলাম না, নিচের দিকে তাকিয়ে বলল জহির।
‘বলতে তো তোকে হবেই। এবং এখনই!’ ফোঁস ফোঁস করে উঠল বারেক।
এখন ওরা ভাঙা ঘাটলায় বসে আছে। অকৃপণ চাঁদ তার অফুরন্ত জ্যোৎস্নায় ভিজিয়ে দিচ্ছে ওদের। অনেকক্ষণ ঝিম মেরে বসে থেকে মুখ খুলল জহির। চাঁদের আলোয় ওর গলা বড় রহস্যময় শোনাল। ক্ষণিকের জন্য বারেকও অবাক হলো ওর রহস্যময় গলা শুনে।
‘তখন আমি স্কুলে পড়ি। এখন যেমন দেখছিস আমায়, তখন ছিলাম ঠিক তার উল্টো। বাউণ্ডুলে আর খেপাটে ধরনের। একবার আব্বার সাথে তুমুল ঝগড়া হলো। আব্বার একটা অভ্যাস ছিল, সামান্য কিছুতেই বলতেন, ‘আমার বাড়িতে জায়গা হবে না। বাড়ি ছেড়ে চলে যাও।’
‘সেবার একটু বেশিই জেদ করেছিলাম। ভাবলাম বাড়ি ছেড়ে গিয়ে আব্বাকে একটু বোঝাই। কিন্তু যাব কোথায়? খাব কী? হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি এল। তখন আমাদের এলাকার মসজিদে একটা তাবলীগ জামাত এসেছে। এদের সম্পর্কে ধারণা আছে?’
‘হুঁ, আছে। তুই বল।’ কপাল কুঁচকে বলল বারেক। ওর ক্রুদ্ধ চাহনি দেখে মনে হলো না ও গল্প শুনে মজা পাচ্ছে। জহির ওকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে আবার শুরু করল।
‘ঠাণ্ডা মাথায় বুদ্ধিটা পাকা করে ফেললাম। তাবলীগ জামাতের সাথে চলে যাব। দু’দিন থাকলেই আব্বার কিছু জ্ঞানলাভ হবে। এক সকালে তাঁরা তল্পিতল্পা গোছাতে শুরু করলে আমি তাঁদের সঙ্গে জুটে পড়লাম। তোরা জেনে থাকবি, তাঁরা একটা মসজিদে তিন দিন থাকে। তিন দিন থেকে দীনের দাওয়াত দিয়ে অন্য মসজিদে চলে যায়। তো আমরা যে মসজিদটায় তিন দিনের জন্য উঠলাম তার সম্পর্কে কিছু বলা প্রয়োজন।
‘আধপাকা দীর্ঘ রাস্তাটার দু’পাশে নিচু ধানখেত। রাস্তা থেকে কিছুটা দূরে একপাশের ধানখেতের মধ্যে হঠাৎ একটা ঝোপের মত। আধপাকা রাস্তা থেকে একটা সরু কাঁচা পথ ধানখেতের মধ্য দিয়ে চলে গেছে ঝোপ পর্যন্ত। তল্পিতল্পা নিয়ে আমরা কাঁচা রাস্তায় নেমে পড়লাম। ঝোপের মত জায়গাটার কাছাকাছি আসতেই চোখে পড়ল বহু পুরনো এক মসজিদ। মসজিদের পাশে বাঁধানো লম্বা একটা কবরস্থান। যখন মসজিদের কাছে পৌছলাম, দেখলাম পাশের ওটা আসলে কবরস্থান নয়, ঈদের নামাজের জায়গা। ঝকঝকে পরিষ্কার ঈদগাহ। মসজিদের চারপাশে জায়গা কম। সামনে বড় একটা পুকুর। বলে নেয়া ভাল, এমন পুকুর আমার জীবনে দেখিনি। কাচের মত স্বচ্ছ টলটলে জল। হালকা নীলাভ জলে পুকুরের পাড় ছুঁইছুঁই। মসজিদের দরজা বরাবর বহু পুরনো একটা ঘাটলা। সেই ঘাটলার শেষ ধাপটা পর্যন্ত পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট দেখা যায়। আমি তখনও সুইমিংপুল দেখিনি। তাই অবাক হয়ে ভাবছিলাম এমন স্বচ্ছ পানি কীভাবে হয়! এখন আমার মনে হয় ওটা ছিল প্রকৃতির তৈরি একটা সুবিশাল সুইমিংপুল, যা পৃথিবীর সবচেয়ে স্বাদু পানি দিয়ে পূর্ণ করা হয়েছিল। চমৎকার সেই পুকুরপাড়ে ঘাটলায় বসেই আমার চোখ জুড়িয়ে গেল। নিমিষে মুছে গেল দিনের ক্লান্তি। পুকুরের দু’পাশে ঘন বাঁশবন। বিশাল বাঁশের আগা পুকুরের জলে মাথা ডুবিয়ে আছে। যেন তৃপ্তি ভরে তৃষ্ণা মেটাচ্ছে। পুকুরের অন্য পাশটায় কিছু বুনো গাছগাছালি। তার মধ্যে একটা বয়স্ক হিজল গাছ। হিজল গাছটাও পানি ছুঁইছুঁই অবস্থায় পুকুরের ওপর শুয়ে আছে। গাছের নিচের দিকের দু’-একটা ডাল বাতাসের ভারে নুয়ে কখনও-কখনও আলতো করে পানি ছুঁয়ে দিচ্ছে। সব মিলিয়ে এমন একটা ছবি-মনে হলো এই ছবির দিকে তাকিয়ে আমি বহুকাল কাটিয়ে দিতে পারব।
‘আমি মসজিদের চারপাশটা ঘুরে দেখতে লাগলাম। মসজিদের ডানপাশে সেই ঈদগাহ মাঠ, আর বাম পাশে অরক্ষিত কবরের সারি। প্রায় কবরের মাঝেই বৃত্তাকার গর্ত খোঁড়া। বাইরে রান্না করার জন্য যেমন চুলা খোঁড়া হয় তেমন। কবরস্থানের পাশ দিয়ে প্রায় হারিয়ে যাওয়া একটা রাস্তা ধরে কিছুদূর সামনে জঙ্গলের মধ্যে টয়লেট। রাস্তার চেহারা দেখেই বুঝলাম বহুকাল এতে কেউ পা রাখেনি। মসজিদের সাথে টিনের ছাপরা দেয়া এক চিলতে বারান্দা। চারপাশটা দেখে নিয়ে বারান্দায় বসতে না বসতেই হঠাৎ আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। থামার লক্ষণ নেই। এই বৃষ্টিতে ভিজে কিছুক্ষণ পর রোগা মত লিকলিকে একটা লোক হাজির হলো। কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ‘ইমাম সাব অসুস্থ। আপনেরা নামাজ পইরা নিয়েন।’ এতটুকু বলে সে আমাদের হাতে মসজিদের চাবি দিয়ে বৃষ্টির মধ্যে হারিয়ে গেল।
‘পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে কেমন যেন লাগল। সারা দিনে ওই ঠ্যাঙার মত মানুষটা ছাড়া আর কারও দেখা পেলাম না। যাই হোক, আমরা ক্লান্ত ছিলাম, তাই সিদ্ধান্ত হলো আগে গোসল করে বিশ্রাম নেব। গোসলের কথা বলতেই আমার মন ভাল হয়ে গেল। দৌড়ে গিয়ে পুকুরে নামলাম। আহ, তোদের বলেছিলাম পানির রঙ, কিন্তু এর স্পর্শও যে অপূর্ব তখন টের পেলাম। পানির মধ্যে মাছ ছুটোছুটি করছে, আমরা তা স্পষ্ট দেখছি। পানিতে অনেক দাপাদাপি করলাম। যখন ডুব দিয়ে গভীরে গেলাম, তখন দেখলাম পানির তলায় নিজের হাত-পা সব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। পুকুরের পানিতে সাধারণত এমন হয় না। তাই ব্যাপারটায় কেমন ভয় ভয় লাগল। পানির গভীরে আর গেলাম না সেবার। কিন্তু ওপরে ভেসে ভেসে বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে মাখলাম।
‘এভাবে কেটে গেল পরের দিনও। এর মধ্যে দ্বিতীয় কোন মানুষ মসজিদের আশপাশে দেখিনি। আমাদের দলে লোক ছিল ছ’জন, আমি সহ সাত। ওই ছ’জনের মধ্যে হঠাৎ অসন্তোষ দেখা দিল…’
‘এই, থাম!’ জহিরকে হাত তুলে থামাল বারেক। ‘তুই যে দলটার কথা বলছিস তাতে মাত্র ছ’জন লোক হয় কী করে?’ বারেকের কথা শুনে বোঝা গেল এতক্ষণ খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল।
‘হ্যাঁ, হয়তো বেশি থাকার কথা। কিন্তু তারা ছ’জন ছিল। আমি কী করব?’ হাত নেড়ে এমনভাবে বলল জহির, যেন বোঝাতে চাইল আসলেই ওর কিছু করার ছিল না।
নাইম তাড়া দিল, ‘তুই আগে বাড়…’
জহির আবার শুরু করল…
‘হ্যাঁ, যা বলছিলাম। দলের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিল। তাদের নিয়ম হলো নতুন কোথাও যাওয়ার আগে একজন সেখানকার খোঁজখবর নেয়। কিন্তু এখানে এসে দেখা গেল নানান প্রতিবন্ধকতা। পুরো দলটার হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা ছাড়া উপায় ছিল না। এভাবে তৃতীয় দিনে এসে পৌছলাম। আগামীকাল সকালে দলটা অন্যত্র যাত্রা করবে। আর আমি চলে যাব বাড়ি। কেননা ইতিমধ্যে মশার কামড় আর টয়লেট সমস্যায় আমার জেদ পুরোপুরি উবে গেছে। সেদিন আমি একাকী এলাকাটা ঘুরে এলাম। সন্ধ্যায় যখন ফিরলাম তখন তাদের মধ্যে ছোটখাটো একটা ঝগড়া হয়ে গেছে। থমথমে ভাব। মাগরিবের নামাজের পর সবাই যে যার মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল। আমি পুকুরপাড়ে গিয়ে বসে রইলাম। ধীরে ধীরে রাত বাড়ছে। আমি ঘাটলায় বসে একমনে পানির দিকে তাকিয়ে আছি। আকাশে শুক্লপক্ষের চাঁদ। স্বচ্ছ পানিতে তলিয়ে যাওয়া পাকা ঘাটের ওপর চাঁদের আলো রূপালি ঢেউয়ের সৃষ্টি করছে। ঘাটের একপাশ থেকে দুলতে দুলতে অন্য পাশে চলে যাচ্ছে সেই ঢেউ। আমি তাকিয়ে আছি চৈতন্য হারিয়ে।
‘“চলেন, একটা গোসল দেই।”
‘চমকে পেছন ফিরে দেখি আমাদের একজন সদস্য। বয়সে আমার কিছু বড়।
‘“এমন চমৎকার পানি! কাল সকালে তো চলেই যাব। তাছাড়া শরীরটাও কেমন ম্যাজম্যাজ করছে,” সে ব্যাখ্যা করল।
‘আসলে আমার মন এমন কিছুই চাইছিল। তাই রাজি হয়ে গেলাম। তাছাড়া সেদিন ছিল প্রচণ্ড গরম। ভাদ্র মাসের গরম যাকে বলে। ঘাটলায় কাপড়চোপড় রেখে আমরা নেমে পড়লাম। আহ, কী শান্তি! আমাদের দেখাদেখি আরও দু’জন মুরুব্বি ধরনের লোক নেমে গেল। আমি ভাবলাম, দিনের আলোয় তো পানির তলায় দেখা যায়; এখন ডুব দিয়ে দেখি চাঁদের আলোয় কতটা দেখা যায়। অবশ্য বেশি দেখতে পাওয়ার কথা নয়। তবু আমি লম্বা দম নিয়ে পানির গভীরে ডুব দিলাম।’
এ পর্যন্ত বলে জহির থামল। চারদিকে সুনসান নীরবতা। ওরা দু’জন তন্ময় হয়ে জহিরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। জহির লম্বা দম নিয়ে আবার শুরু করল। মনে হলো ও যেন সেদিনের মত গভীরে ডুব দিচ্ছে।
‘ডুব দিয়ে যখন পানির গভীরে গেলাম আমার বিস্ময়ের সীমা রইল না। পানির তলায় তাকিয়ে মনে হলো পুরো পুকুরটা যেন কাঁচের তৈরি। আমি সমস্তটা দেখতে পাচ্ছি দিনের চেয়েও স্পষ্ট! পানির মধ্যে ডুবে থাকা বাঁশের আগা, পানির উপরের হিজলগাছ, একটু দূরে যারা গোসল করছে তাদের হাত, পা, দূরের শাপলা গাছের মূল, এমনকী পুকুরের তলার ঝিকমিকে বালুরাশি। চাঁদের আলো এসে পড়ছে সেই বালুর পিঠে। পানির দোলায় বালুরাশি নড়ছে আর ঝিকমিক করছে। আমি কতক্ষণ এভাবে ছিলাম জানি না। হঠাৎ হুঁশ হলো। আমি এতক্ষণ পানির নিচে কীভাবে! এমন সময় শুনতে পেলাম বাচ্চা কণ্ঠের একটা কান্নার আওয়াজ। ঠিক তাই। প্রথম ভেবেছিলাম বুঝি পানির ওপর থেকে শব্দ আসছে। সাথে সাথে মনে হলো তা সম্ভব নয়। পরে আবিষ্কার করলাম শব্দটা পানির তলায় একপাশ থেকে আসছে।
‘তখন আমার এই বোধ ছিল না যে পুকুরের তলায় একটা বাচ্চা কীভাবে আসবে, আর কীভাবেই বা কাঁদবে। আমি কান্নার উৎসের দিকে এগোলাম। দু’পাশের পানি কেটে একটু সামনে যেতেই দেখলাম ওকে।
এক বছর বয়সী উলঙ্গ এক শিশু। পুকুরের তলায় উপুড় হয়ে বসে আমার দিকে পেছন ফিরে কাঁদছে। আমি ওর কাছাকাছি যেতেই ও হামাগুড়ি দিয়ে সামনে ছুটল। তখনও কাঁদছে বাচ্চাটা। আমি স্থান-কাল ভুলে ওর পেছনে ছুটলাম। কতক্ষণ ছুটলাম মনে নেই। ছুটতে ছুটতে মনে হলো বহুদূর চলে এসেছি; কিন্তু পথ শেষ হয় না। ক্লান্ত হয়ে গেলাম। তবু ছুটলাম আমি। আর প্রাণপণ চেষ্টা করলাম বাচ্চাটাকে চোখে চোখে রাখতে। কিন্তু একসময় ঠিকই হারিয়ে ফেললাম। ওকে হারিয়ে ফেলে উদ্ভ্রান্তের মত হয়ে গেলাম। এতক্ষণে আমার খেয়াল হলো দম ফুরিয়ে আসছে, আমি পানির তলায়! ক্লান্তিতে আমার চোখ বুজে এল। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।
‘যখন ঘুম ভাঙল দেখলাম হ্যাজাকের তীব্র আলো। আমি মসজিদের বারান্দায় শুয়ে আছি। চারদিকে লোকজন ছুটোছুটি করছে, চিৎকার-চেঁচামেচি করছে। এত আলো, এত মানুষ দেখে ক্লান্তিতে আমি আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।
‘পরবর্তীতে জেনেছি, আমি ডুব দেয়ার সময় কেউ একজন লক্ষ করেছিল। লোকটা প্রথমে আমার দমের তারিফ করছিল। কিন্তু অনেক সময় পরেও যখন দেখল উঠছি না তখন ভয় পেয়ে সে অন্যদের ডাকল। প্রথমত সবাই ডুবাডুবি করে খুঁজল। না পেয়ে এলাকার লোকজন জড় করল। অনেক লোক মিলে পুকুর চষে ফেলল, কিন্তু আমার পাত্তা নেই। ততক্ষণে বড় মাছ ধরা জাল নিয়ে জেলে এসে গেছে। ওরা অনেকবার টান দিয়ে আমায় তুলল। আশ্চর্য ব্যাপার, আমার পেটে কোন পানি ছিল না।
‘ওদিকে আমাদের বাড়িতে খবর গেলে আব্বা সহ লোকজন ছুটে এল। আসলে আমার আব্বা শুরু থেকেই জানতেন আমি এখানে আছি। কিন্তু তিনি চাচ্ছিলেন আমি যেন নিজের থেকেই ঠিক হয়ে বাড়ি ফিরে আসি। সে রাতেই আব্বা আমায় নিয়ে বাড়ি ফিরলেন।
‘বাড়ি ফেরার পর ভয়াবহ জ্বর পেয়ে বসল আমায়। বিছানায় পড়ে রইলাম অনেকদিন। হুঁশে-বেহুঁশে কেবল একটা ব্যাপার ঘটে। সেদিনের বাচ্চাটাকে দেখতে পাই। আবার মাঝে মাঝে দূর থেকে ভেসে আসে কচি কণ্ঠের পরিচিত কান্নার আওয়াজ। এভাবে কতদিন ছিলাম মনে নেই। একসময় সুস্থ হয়ে উঠলাম। এতদিনে ক্ষণিকের জন্যও সেই অদ্ভুত পুকুরের কথা আমি ভুলিনি। সেই আশ্চর্য পুকুর আমায় প্রবল আকর্ষণে টানছিল। ওখানে কিছু একটা ব্যাপার আছে। আমায় জানতে হবে ওটার সব ঘটনা 1
‘একদিন আব্বাকে নিয়ে গেলাম ওই এলাকায়। একজন বয়স্ক লোকের কাছে শুনলাম সব ঘটনা। ওই মসজিদে অনেককাল আগে একজন ইমাম ছিলেন, যিনি তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে মসজিদের পাশেই একটা ছাউনি দিয়ে থাকতেন। ইমাম সাহেবের স্ত্রী যখন সন্তানসম্ভবা তখন হঠাৎ করে এক সন্ধ্যায় তার ওপর খারাপ আছর পড়ল। অল্প বয়সী মেয়ের মাথা পুরোপুরি আউলা হয়ে গেল। গায়ে মাথায় কাপড় রাখে না, অশ্রাব্য গালিগালাজ করে। ইমাম বেচারা পড়লেন মহা মুসিবতে। স্ত্রীকে ঘরের মধ্যে বেঁধে রাখেন। এরই মধ্যে তাদের ছাউনি ঘর আলোকিত করে একটা ফুটফুটে মেয়ে জন্ম নিল। মেয়ে জন্ম নেয়ার পর ইমাম সাহেবের স্ত্রী পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে গেল। ইমাম সাহেবও নিশ্চিন্ত হলেন। তাঁর সংসারে সুখ যেন উপচে পড়ে। মেয়েটা যখন হামাগুড়ি দিতে শুরু করল একরাতে স্ত্রীর কান্নার শব্দে ইমাম সাহেব লাফিয়ে উঠলেন। দেখলেন তাঁর আদরের মেয়ে নেই! বেচারা ইমাম সাহেব পাগলের মত হয়ে গেলেন। চারদিকে খুঁজলেন। কোথাও বাচ্চা নেই। এমন মুহূর্তে হঠাৎ তাঁর স্ত্রী পানিতে ঝাঁপ দিল। এতক্ষণে ইমাম সাহেব বুঝতে পারলেন, স্ত্রীই তাঁর মেয়েকে পানিতে ফেলেছে।
‘ইতিমধ্যে লোকজন জড় হয়েছে। জাল টান দেয়া হলো। ইমাম সাহেবের স্ত্রীকে পাওয়া গেল-মৃত। বাচ্চাটার কোন হদিস পাওয়া গেল না। ইমাম সাহেব বেচারা অর্ধ- উন্মাদ হয়ে এলাকা ছেড়ে চলে গেলেন। সেই থেকে ভরা পূর্ণিমারাতে পুকুর পাড়ে একটা বাচ্চার কান্নার শব্দ পাওয়া যায়। পরবর্তীতে অন্য কোন ইমাম ওখানে স্থায়ী হতে পারেননি।’
নাইম দীর্ঘক্ষণ চেপে রাখা নিঃশ্বাসটা আস্তে করে ছাড়ল। ওরা তিনজন চুপচাপ বসে আছে। কারও মুখে কোন কথা নেই। যেন কোন কালে ছিলও না। সহসা জহির বলল, ‘আমি মাঝে মধ্যে সেই কান্না শুনতে পাই।’
‘মানে? তুই এখনও শুনতে পাস?’ বারেক নিশ্চিত হতে চাইল।
‘হ্যাঁ, এখনও। প্রথম শুনি যখন আমার বৃদ্ধ দাদা পানিতে ডুবে মারা যান। শেষ বয়সে তেমন হাঁটাচলা করতে পারতেন না; কিছুটা মাথা খারাপের মত হয়ে গিয়েছিল। তাঁকে গোসল করিয়ে দিতে হত। আমার ছোটচাচা কাজটা করতেন। কেউ গোসল করিয়ে দিলে দাদার তৃপ্তি হত না। তিনি বলতেন, ‘পুহইরে নাইম্মা গোসল দিতে পারলে শইলডায় আরাম অইত। এই, ছালেক, এট্টু নামাইয়া দে না, বাজান!’ এভাবে চাচার কান ঝালাপালা করে দিতেন। একসময় ছোটচাচা আমাদের বাড়ির অগভীর পুকুরে দাদাকে নামিয়ে দিতেন। ইচ্ছেমত কাদাপানি খেয়ে দাদার পেট ভরে গেলে তাঁকে তোলা হত। এরপর কিছুদিন তিনি ঠাণ্ডা থাকতেন। আবার শুরু হত, ‘পুহইরে নাইম্মা গোসল দিতে পারলে শইলডায় আরাম অইত।’ এরপর আবার তাঁকে পুকুরে ছেড়ে দেয়া। ব্যাপারটা আমার কাছে অমানবিক লাগত। কিন্তু আমার দাদা এতেই শান্তি পেতেন।
‘একরাতে সেই কান্নার শব্দে আমার ঘুম ভাঙল। বিছানায় জড়সড় হয়ে জেগে জেগে আমি সেই শব্দ শুনলাম অনেকক্ষণ। কিন্তু দিনের আলোয় সব ভুলে গেলাম। সেদিন সকালেই ক’দিনের জন্য খালাবাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম। দুপুরের দিকে আমাকে খবর দিয়ে আনা হলো, দাদা নেই! পুকুরে নামানোর কয়েক মিনিটের মধ্যে তাঁর মৃত্যু।
‘এরপর আমাদের পাশের বাড়িতে তিনটা বাচ্চা পানিতে ডুবে মারা গেল। সেবারও আগের রাতে আমি সেই কান্নার শব্দ শুনলাম। এভাবে আরও একবার। এরপর আমি বুঝতে পারলাম আমার চারপাশে পানিতে ডুবে মরার ব্যাপারটা আমি কীভাবে যেন আগে থেকেই টের পেয়ে যাই।’
‘দাঁড়া, এখন নিশ্চয়ই বলবি আজও তুই তেমন কিছু শুনতে পেয়েছিস?’ কিছুটা ব্যঙ্গ করে বলল বারেক।
জহির মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে রইল। অনেক সময় পর মুখ খুলল ও, ‘ঠিকই বলেছিস। গতরাতে আমি সেই কান্না শুনতে পেয়েছি।’
চারপাশে হুট করে অসহ্য নীরবতা নেমে এল। কিছু রাতজাগা পতঙ্গ ডাকছিল, সেগুলো হঠাৎ একসাথে থেমে গেল। যেন ওরাও অবাক হয়েছে জহিরের কথা শুনে; এখন ভয়ে ভয়ে অপেক্ষা করছে পরবর্তী ঘটনার জন্য। ঘাটলার পাশেই একটা কদম গাছে কিছু বাদুড় ঝুলছিল, সেগুলো ডানা ঝাপটে উড়ে গেল। অসহ্য নীরবতা ভাঙল কুকুরটা। দুইবার করুণ সুরে ডেকে উঠল। নাইমের দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইল। হঠাৎ বারেক উঠে দাঁড়াল; দেখে নাইম আর জহির দু’জনেই ভয় পেল। ওরা বারেককে চেনে। এবার ও পুকুরের পানিতে নামার জন্য আগের চেয়েও বেশি বেঁকে বসবে। ওকে ফেরানোর উপায় নেই। ওরা দু’জন ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে রইল। দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভেঙে ওদের দু’জনকে অবাক করে দিয়ে বারেক বলল, ‘অনেক রাত হয়েছে। চল, রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ি।
নাফিস অলি