ভূতুড়ে পুতুল
শেখর চৌধুরীর সঙ্গে প্রথম আলাপেই আমি তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম। গায়ের রং রোদে পোড়া তামাটে, লম্বায় প্রায় ছ-ফুট, বলিষ্ঠ চেহারা। চোখে-মুখে একটা আত্মপ্রত্যয়ের ছাপ। এমন একজন মানুষ হঠাৎ চোখে পড়ে না।
আমারই এক বন্ধু ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। আমি একজন লেখক একথা শুনে তিনি কৌতূহলের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়েছিলেন, তারপর মৃদু কৌতুকের সুরে বলেছিলেন, ‘আপনারা যেসব রোমাঞ্চকর ঘটনা কল্পনা করেন, অনেক ক্ষেত্রেই আসল ঘটনা তার চাইতে আরও বেশি রোমাঞ্চকর, আপনাদের কল্পনার জগতের বাইরে।’
আমরা একটা অভিজাত রেস্তোরাঁয় বসে গল্প করছিলাম। আমাদের সামনে বড়ো বড়ো কাচের প্লেটে সাজানো রয়েছে ফ্রায়েড রাইস, চিলি চিকেন আর সুইট অ্যান্ড সাওয়ার প্রন। আমার বন্ধুই আমাদের দু-জনকে এখানে নেমন্তন্ন করেছিলেন। আমাদের দু-জনের পরিচয় করিয়ে দেওয়াই ছিল তার উদ্দেশ্য। অবিশ্যি আরও একটা উদ্দেশ্য ছিল, সেটা হল শেখর চৌধুরীকে তার ব্যবসায়ের অংশীদার হতে রাজি করানো। আমার ওপর ভার পড়েছিল ভদ্রলোককে যাচাই করা। কিন্তু আগেই বলেছি, প্রথম দর্শনেই ভদ্রলোকের প্রতি আমি আকৃষ্ট হয়েছিলাম।
‘সেকথা এক-শোবার,’ আমি এক চামচ ফ্রায়েড-রাইস মুখে পুরে চিবুতে চিবুতে বললাম, ‘ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন, বিজ্ঞজন একথাই বলে গেছেন।’
শেখর চৌধুরী আমার জবাবে বোধ হয় খুশি হলেন, কাঁটা দিয়ে একখণ্ড চিলি-চিকেন মুখে পুরে আয়েশ করে চিবুতে চিবুতে বললেন, ‘শুনবেন তবে একটা কাহিনি, আমার জীবনেই ঘটেছিল।’
‘নিশ্চয়ই,’ একটা নতুন কিছু শোনার আশায় আমি উদগ্রীব হলাম।
‘আমার বয়স কত মনে হয়?’ আচমকা প্রশ্ন করলেন শেখর চৌধুরী।
তাঁর মেদহীন চেহারার দিকে আরেকবার চোখ বুলিয়ে আমি বললাম, ‘চল্লিশ বেয়াল্লিশের বেশি হবে বলে মনে হয় না।’
‘পঞ্চাশ চলছে,’ একসঙ্গে কয়েক টুকরো প্রন মুখে পুরলেন শেখর চৌধুরী, ‘শরীরটা মজবুত বলে বোঝা যায় না। তবে আমি যা কাজ করতাম তাতে শক্তি আর সাহস দুটোরই দরকার ছিল।’ আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম।
‘তখন আমার বয়স বত্রিশ,’ তিনি শুরু করলেন, ‘নিজের শক্তি সম্বন্ধে বড়াই করছি না, তবে একবার একটা ষাঁড়ের শিং চেপে ধরে এমনভাবে ঘুরিয়ে দিয়েছিলাম যে ষাঁড়টা মাটিতে কাত হয়ে পড়েছিল। তার আগে ওটা বেশ কিছু মানুষকে গুঁতিয়ে জখম করেছিল। আরেকবার, তিনি একটু হাসলেন, ‘একটা চিতাবাঘের গলা এমনভাবে আঁকড়ে ধরেছিলাম যে, শেষ পর্যন্ত সেটা দম বন্ধ হয়ে মারা গিয়েছিল। হতভাগা আমাকে আক্রমণ করেছিল।
‘যাক সেকথা, আসামের এক জঙ্গলে সরকার থেকে ইজারা নিয়ে গাছ কাটার জন্য আমি এক তাঁবু ফেলেছিলাম। সেই কাজের জন্য আমাকে ওই জঙ্গলের আশেপাশে বাস করে এমন আদিবাসী মানুষদের সাহায্য নিতে হয়েছিল। জঙ্গলেই ওদের জীবন, ওখানকার সব কিছু নখদর্পণে তাই আমারও সুবিধে হয়েছিল। মানুষগুলি ছিল সরল, বিশ্বাসী কিন্তু কুসংস্কারে ভরপুর। আমি কাজের জন্য একজন আদিবাসী ছোকরাকে নিজের কাছে রেখেছিলাম। সে আমার রান্নাবান্না, ব্যক্তিগত সব কাজ করত। আমার এমন ন্যাওটা হয়ে গিয়েছিল ছেলেটা যে আমার জন্য প্রাণ দিতেও প্রস্তুত ছিল। আসলে আমার শক্তির একটা প্রমাণ পেয়েই ও অমন অনুগত হয়ে উঠেছিল। ওইসব মানুষের কাছে শক্তিমানের মর্যাদা আছে, তাকে বোধ হয় তারা সবচেয়ে বেশি সম্মান করে।
‘ওই উপজাতিদের একজন সর্দার ছিল। গাছ কাটার লোকের জন্য তার ওপরেই আমাকে নির্ভর করতে হয়েছিল কারণ উপজাতিরা তাদের সর্দারের হুকুম ছাড়া আমার কাজে হাতই লাগাবে না। সর্দারের প্রতি তাদের আনুগত্যের একটা শৃঙ্খলাবোধের পরিচয় আমি পেয়েছিলাম যা সভ্যজগতে সবসময় দেখা যায় না।
‘ওই সর্দারের নির্দেশমতোই গাছ কাটার কাজ চলছিল। লোকটা নিজেও সেজন্য দিনমজুরি নিচ্ছিল কিন্তু শুধুমাত্র নির্দেশ দেওয়া ছাড়া কোনো কাজই সে করত না। লোকটা ছিল অত্যন্ত বদমেজাজি আর রূঢ়ভাষী। কার্যসিদ্ধির জন্য তার অনেক বেয়াদবি আমাকে সইতে হচ্ছিল ফলে তার উদ্ধত ভাবটা বেড়েই চলেছিল। প্রচণ্ড নেশাও করত লোকটা।
‘তারপর একদিন সামান্য কারণে আমার কাজের ছোকরাটিকে সে এমন মারল যে ছেলেটা প্রায় আধমরা হয়ে গেল। তার অপরাধ সর্দারের হুকুমমতো সে আমার ভাঁড়ার থেকে তাকে একটা বিলিতি সুরার বোতল দেয়নি। আগেই বলেছি, ও ছিল আমার খুব অনুগত আর বিশ্বস্ত। এই ঘটনায় আমি আর ধৈর্য রাখতে পারলাম না, সর্দারকে তার লোকজনের সামনেই পিটুনি দিলাম। এখানে বলে রাখা ভালো, সেও ছিল শক্তিমান, পাথর কুঁদে গড়া মূর্তির মতো চেহারা।
‘লোকটা রাগে অন্ধ হয়ে তার অনুচরদের কাজ বন্ধ করার হুকুম দিল, একথাও বলল যে, সে এমন প্রতিশোধ নেবে যা আমি সারাজীবন ভুলতে পারব না। আমি সেই হুমকিতে তোয়াক্কা না করে বললাম যদি সে কাজ বন্ধ করে দেয় তবে সবার সামনেই তাকে আমি ফাঁসি দেব। সত্যি সত্যিই আমি একটা গাছের উঁচু ডালে দড়ির ফাঁস লাগিয়ে তার দিকে এগিয়ে গেলাম। তাকে ভয় দেখানোই ছিল আমার উদ্দেশ্য আর তাতে কাজও হল। লোকটা সত্যিই ভয় পেল, তারপর সবাইকে কাজে হাত লাগাতে বলল।
‘এই ঘটনার পর কয়েকদিন কেটে গেছে। আমার ছোকরাটি একদিন চুপি চুপি আমাকে জানাল সর্দার আমার ওপর প্রতিশোধ নেবার জন্য মতলব আঁটছে, সেই উদ্দেশ্যে ওদের যে পুরোহিত তার সঙ্গে সে পরামর্শ করেছে। ছেলেটির আত্মীয়স্বজন ওই সর্দারের পল্লিতেই থাকত, তাই সময় পেলেই সে চলে যেত তাদের সঙ্গে দেখা করবার জন্য। সেখানেই সে কথাটা শুনেছে। তার মা তাকে চুপি চুপি কথাটা বলেছে, বলেছে কথাটা যেন ফাঁস না হয়, তবে সর্দার তাদের রক্ষে রাখবে না।
‘ওদের পুরোহিতকে আমি দেখেছি। এক চিমসে বুড়ো, নাকটা বাঁকানো, চোখ দুটো যেন সবসময় লাল। তবে তার নাকি অলৌকিক ক্ষমতা আছে। একটা ঢিবির ওপর ওই আদিবাসীদের একটা পুরোনো মন্দির আছে, সেই মন্দিরে ওদের বিগ্রহ আমি দেখেছি। ভয়াবহ এক মূর্তি কালো পাথরের, তা কত বছর আগের কেউ ঠিক বলতে পারে না। ওই পুরোহিত হচ্ছে মন্দিরের পূজারি, সর্দার পর্যন্ত তাকে সমীহ করে চলে এমন তার দাপট। ভালোর চাইতে মন্দ কাজেই নাকি তার কেরামতি বেশি, যেমন কারো বিরুদ্ধে মৃত্যুবাণ ছুড়ে তার জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনা, মন্ত্রবলে কাউকে পঙ্গু করে দেওয়া, এই ধরনের কাজে সে নাকি সিদ্ধহস্ত, সাক্ষাৎ শয়তান। আমি অবিশ্যি ওসব বিশ্বাস করিনি, তাই ছেলেটার কথা হেসে উড়িয়ে দিলাম।
‘বেশ কিছুদিন কেটে গেল। আমার গাছ কাটার কাজ নির্বিঘ্নেই চলছিল। সরকারি লোক এসে যেসব গাছে চিহ্ন দিয়ে যায় শুধু সেগুলিই কাটতে হবে, তবে এদিক-ওদিক যে হয় না এমন নয়। তা ছাড়া আজকাল সাধুপুরুষ আর কে আছে বলুন? সর্বস্তরে দুর্নীতির পাহাড় জমে গেছে, টাকা দিয়ে সব কিছুই কেনা যায়, মায় মানুষের বিবেক। ব্যতিক্রম যে নেই তা আমি বলছি না, তবে তা অসংখ্যের তুলনায় এতই নগণ্য যে তুলনা না করাই ভালো।’
শেখর চৌধুরী কাচের গেলাসটা তুলে ঠান্ডা বিয়ারে লম্বা এক চুমুক দিলেন, তারপর কিছুক্ষণ নিঃশব্দে আহারে মন দিলেন। আমার কিন্তু মনে হল তাঁর ভেতরে যেন তোলপাড় চলছে, অতীত স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি অতীতে ফিরে গেছেন। খাওয়া শেষ করে ন্যাপকিন দিয়ে তিনি মুখ মুছলেন, তারপর এক চুমুকে ঠান্ডা পানীয় নিঃশেষ করে বললেন, সেদিন ছিল অমাবস্যা। সেরাতের কথা আমি ভুলব না। বনের প্রান্তে আমার তাঁবু। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। বিকেল থেকেই মেঘ জমেছিল, সন্ধের পর নামল তুমুল বৃষ্টি। ঘণ্টাখানেকের পর থেমে গেল। বেশ শীত শীত করছিল। রাত্রে খাওয়ার পাট চুকলে আমি ক্যাম্প-খাটে কম্বল মুড়ি দিয়ে আরাম করে শুয়ে পড়লাম। ছোকরাটা আমার পাশেই একটা ক্যানভাসের ওপর ঘুমোত। ওর ছিল কুকুরের মতো সজাগ ইন্দ্রিয়, রাত্রে তাঁবুর আশেপাশে একটু শব্দ হলেই ও জেগে উঠত। একদিক দিয়ে আমার সুবিধেই হয়েছিল কারণ আমার ঘুম আবার গভীর। রাত্রে কেউ যদি ক্যাম্প-খাট সুদ্ধু আমাকে তুলে নিয়ে যায় তবু বোধ হয় আমার ঘুম ভাঙবে না।
‘বালিশে মাথা ঠেকাবার প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ তীব্র যন্ত্রণায় আমি চিৎকার করে বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে পড়লাম। বুকের বাঁ-দিকটা জ্বলে যাচ্ছে। যেন কেউ জ্বলন্ত অঙ্গার চেপে ধরেছে আমার বুকে। সেই জ্বালা আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। আমার চিৎকারে ছোকরাটাও জেগে উঠেছিল। আলো জ্বালিয়ে দেখলাম আমার বুকের বাঁ-দিকে আগুনে পোড়ার মতো একটা ক্ষত। অথচ তাঁবুর মুখ যেমন বন্ধ ছিল তেমনই আছে। কেউ তাঁবুর ভেতর ঢুকেছিল এমন কোনো প্রমাণ নেই। তা ছাড়া আমার কাজের ছেলেটির সজাগ ইন্দ্রিয়ের অনুভূতি এড়িয়ে তাঁবুর ভেতর ঢুকবে এমন সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
‘ছেলেটির নাম টিক্কা! আমার বুকের ক্ষত দেখে ওর চোখে-মুখে কেমন যেন একটা ভয়ের চিহ্ন ফুটে উঠল, পরমুহূর্তে ও ছুটে তাঁবুর বাইরে চলে গেল। কিছুক্ষণ পরেই ও ফিরে এল, হাতে কিছু বুনো লতাপাতা। সেগুলো থেঁতো করে ও আমার ক্ষতের ওপর প্রলেপ লাগিয়ে দিল। একটা ঠান্ডা অনুভূতিতে জ্বলুনি অনেকটা কমে গেল, আরাম পেলাম।
‘কোনো বিষাক্ত পোকামাকড়ের কামড় তাও নয়। আমি মশারির ভেতর শুই, শোবার আগে টর্চ জ্বালিয়ে ভেতরটা দেখে নিই। তা ছাড়া কীটের দংশনের কোনো চিহ্ন নেই। একটা রুপোর টাকার মতো গোল হয়ে ক্ষতটা সৃষ্টি হয়েছে, টকটকে লাল।
‘পরদিন সকালে একটা জিনিস লক্ষ করলাম। সর্দার আড়চোখে আমাকে লক্ষ করছে। আমার চোখে চোখ পড়লেই ও চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল। তবে কী ওই লোকটাই প্রতিহিংসার বশে কিছু করেছে! কিন্তু তাঁবুতে কারো ঢোকবার সামান্য প্রমাণও ছিল না। যাতায়াতের পর্দার মুখটা ভেতর থেকে যেমন আঁটো করা ছিল ওই ঘটনার পর তার এতটুকু হেরফের আমার চোখে পড়েনি।
‘সেদিন রাত্রে টিক্কা আমাকে একটা খবর দিল। দুপুরবেলা ও বাড়ি গিয়েছিল সেখানেই ওর মা-র কাছে শুনেছে, কথাটা যেন পাঁচকান না হয় তাও বলে দিয়েছে ওর মা। জানাজানি হলেই ওদের ওপর নেমে আসবে চরম আঘাত।
‘খবরটা হল, সর্দার নাকি অমাবস্যার আগের দিন পুরোহিতকে দুটো মুরগি উপহার দিয়েছিল, সেইসঙ্গে চাল-ডাল আর তরিতরকারি। পুরোহিতের বাড়িতে তাদের কথাবার্তা দৈবাৎই একজন শুনে ফেলেছে। সে টিক্কার বাবার জ্ঞাতিভাই, আবার গাছ কাটার কাজে আমার কাছে দিনমজুরি খাটে। আমাকে সাবধান করে দেবার জন্যেই সে টিক্কার মাকে চুপি চুপি কথাটা বলেছে যাতে টিক্কা আমাকে জানায়।
‘পুরোহিত নাকি সর্দারকে কথা দিয়েছিল আমাকে দগ্ধে দগ্ধে মারবে। তার জন্য চাই একটা পুতুল। পুতুলটাকে মন্দিরে বিগ্রহের সামনে রেখে সে মন্ত্রের জোরে তার মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করবে। ওটা হবে আমার দ্বিতীয় সত্তা, ওটাকে যা করা হবে তার রেশ আমাকেও স্পর্শ করবে। অমাবস্যার রাতে বিগ্রহের সামনে আগুন জ্বালিয়ে মন্ত্র পড়বে পুরোহিত, তারপর একটা লোহা সেই আগুনে গরম করে সর্দারকে আদেশ করবে পুতুলের গায়ে ছ্যাঁকা দিতে। তাতে আমার শরীরের সেই জায়গাও দগ্ধ হবে। এভাপে প্রতি অমাবস্যায় আমার শরীরের নানা অংশ পুড়িয়ে শেষে গরম লোহা আমার চোখে চেপে ধরে আমাকে অন্ধ করে ফেলা হবে।’
আমার অজান্তেই আমি শিউরে উঠেছিলাম। তা লক্ষ করে শেখর চৌধুরী মৃদু হেসে বললেন, ‘কেমন বুঝছেন?’ তারপর নতুন একটা বিয়ারের বোতল খুলে গেলাস কানায় কানায় ভরলেন। গোটা দুই ‘আইস কিউব’ গেলাসে ফেলে ফেনিল সোনালি সেই পানীয় তৃপ্তির সঙ্গে পান করলেন।
আমাদের খাওয়াও শেষ হয়ে গিয়েছিল। আমি ঘোর আপত্তি করা সত্ত্বেও বন্ধু আরেক প্রস্থ খাবার অর্ডার দিল।
‘পুরোহিতের অলৌকিক ক্ষমতার কথা আমি আগেই শুনেছিলাম কিন্তু জংলি মানুষের অন্ধ বিশ্বাস আর কুসংস্কার মনে করে তাতে কান দিইনি। এবারও তা উড়িয়ে দিলাম। আমি শহুরে, শিক্ষিত মানুষ, এসব বুজরুকিতে বিশ্বাস করা আমার সাজে না।
‘টিক্কা কিন্তু ক্ষুণ্ণ হল। ওর মনোভাবেই তা বুঝতে পারলাম। আমি যে ওর কথায় গুরুত্ব দিলাম না সেটা ওর পছন্দ হল না। ও আমাকে অনেক করে বোঝাবার চেষ্টা করল, ওই পুরোহিতের অলৌকিক ক্ষমতা সম্বন্ধে কয়েকটা রোমহর্ষক ঘটনাও বলল, কিন্তু আমি বিচলিত হলাম না।
‘আমি অবিশ্যি শহরে গিয়ে ডাক্তারের কাছে আমার ক্ষতটা দেখিয়েছিলাম। ডাক্তারবাবু ওটাকে কোনো বিষাক্ত কীটের দংশন বলেই সন্দেহ করেছিলেন। তিনি আমাকে ইঞ্জেকশন দিয়েছিলেন, ঘায়ে লাগাবার জন্য মলমও দিয়েছিলেন একটা। কিন্তু টিক্কার সেই বুনো পাতার প্রলেপ যে আমাকে তাৎক্ষণিক আরাম দিয়েছিল সেটা আমি অস্বীকার করব না। ওই আদিবাসীরা বুনো লতাপাতার এমন সব ওষুধ জানে যা আমাদের চিকিৎসাশাস্ত্রে এখনও অজ্ঞাত।
‘দিন কাটতে লাগল, আমিও ঘটনা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। দিন পঁচিশেক পরে টিক্কার মধ্যে আমি একটা অস্থিরতা লক্ষ করলাম। কী ব্যাপার জিজ্ঞেস করায় ও প্রথমে মুখ খুলতে চাইল না, কিন্তু আমি ধমক দেওয়ায় শেষ পর্যন্ত বলল যে, সর্দার পুরোহিতকে দুটো মুরগি আর একটা ছাগলছানা উপহার দিয়েছে। তখনই আমার মনে পড়ল কয়েকদিন পরেই অমাবস্যা। টিক্কা আমার কথা ভেবেই অস্থির হয়ে পড়েছে এটা বুঝতে আমার কষ্ট হল না। আমি ওকে আশ্বাস দিয়ে বললাম পুরোহিত আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আগের বার যেটা ঘটেছিল সেটা একটা কাকতালীয় ঘটনা, তার সঙ্গে পুরোহিতের অলৌকিক ক্ষমতার কোনো যোগাযোগ নেই। টিক্কার মুখ দেখে মনে হল না যে, সে আশ্বস্ত হয়েছে।
‘যা হোক আরও কয়েকটা দিন কেটে গেল। সেদিন যে অমাবস্যা আমার খেয়ালই ছিল না। যথারীতি সারাদিন খাটুনির পর রাত্রে খাওয়াদাওয়া সেরে আমি শুয়ে পড়লাম। টিক্কা তখন একটা আলোর সামনে বসে কিছু বুনো গাছগাছড়ার পাতা নিয়ে থেতো করছিল। আমি ভাবলাম বোধ হয় ওর শরীরে কোনো ঘা হয়েছে।
‘ঘুমিয়েই পড়েছিলাম, গাঢ় ঘুম। কিন্তু সেই ঘুমের মধ্যেই প্রচণ্ড জ্বলুনিতে আমি চিৎকার করে উঠলাম, মশারি তুলে লাফিয়ে পড়লাম মাটিতে। বুকের ডান দিকটা জ্বলে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে কেউ জ্বলন্ত কিছু আমার বুকে চেপে ধরেছে। অসহ্য যন্ত্রণায় আমি একটানে গায়ের জামাটা ছিঁড়ে ফেললাম। বুকের ডান দিকে রুপোর টাকার মতো একটা লাল দগদগে পোড়া চিহ্ন। টিক্কা যেন প্রস্তুতই ছিল, এক খাবলা থিতানো পাতা আমার ক্ষতের ওপর চেপে ধরল, টস টস করে গড়িয়ে পড়তে লাগল পাতার রস, একটা ঠান্ডা অনুভূতিতে অনেকটা আরাম পেলাম। পরে শুনেছিলাম টিক্কা নাকি ঘুমোয়নি, এমন একটা কিছু ঘটবে এই আশঙ্কায় আগে থেকেই বুনো পাতার প্রলেপ বানিয়ে তৈরি হয়ে বসে ছিল।
‘গতবার ডাক্তার সংক্রামক না হবার জন্য যে বড়ি আমাকে খেতে দিয়েছিলেন, তার কয়েকটা তখনও পড়ে ছিল। আমি সেই বড়িও খেলাম।
‘সাহেব যদি আমার কথা বিশ্বাস করতেন, সর্দারকে শাস্তি দিতেন, তবে আজ সাহেবকে এ কষ্ট পেতে হত না।’ টিক্কা অনেকটা অনুযোগের কণ্ঠেই বলল।
‘এবার কিন্তু আমার মানসিক দৃঢ়তায় চিড় ধরল— তবে কি পুরোহিতের সত্যিই অলৌকিক ক্ষমতা আছে! একটা পুতুলের মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করে তার জ্বালাযন্ত্রণা আমার মধ্যে চালান করার ক্ষমতা সে রাখে! যদি সত্যিই সে অমন ক্ষমতার অধিকারী হয় তবে আমার নিস্তার নেই। আমাকে দগ্ধে দগ্ধে পুড়িয়ে মারবে। কীভাবে এই মহাসংকট থেকে উদ্ধার পেতে পারি! ওই পুতুলটা আমি যদি কেড়ে নিই তবে নতুন একটা পুতুল ওরা জোগাড় করবে। আমি যদি এখান থেকে পালিয়ে যাই তবু কী নিস্তার পাব! যেখানেই আমি থাকি না কেন, পুরোহিতের অলৌকিক ক্ষমতা ওই পুতুলের মধ্য দিয়ে আমাকে ধাওয়া করবে। সর্দারকে কবজা করলেও পুরোহিতকে আমি বাধ্য করতে পারব না। আমার একমাত্র উপায় হচ্ছে পুতুলটা হস্তগত করা এবং সেইসঙ্গে পুরোহিত যাতে তার অলৌকিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে না পারে তার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া। কিন্তু তা কী করে সম্ভব! একমাত্র পথ হচ্ছে পুরোহিতকে এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া। আমি সভ্য, শিক্ষিত মানুষ, কিন্তু নিজের প্রাণের তাগিদে ওই মুহূর্তে ওই চিন্তাটাই আমার কাছে বড়ো হয়ে দেখা দিল। প্রত্যেক অমাবস্যার রাত্রে যদি অমন ঘটনা ঘটতে থাকে তবে আমি তো মরবই, আর যতদিন না মরি তিলে তিলে মরণ যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে আমাকে। দু-চোখে আগুন ছ্যাঁকার কথা মনে করে আমি শিউরে উঠলাম।
‘টিক্কাকে আমি কিছু বললাম না, শুধু বললাম একদিন আমাকে ওদের মন্দিরে নিয়ে যেতে হবে। ও সানন্দে সায় দিল। সারারাত আর ঘুম হল না।
‘পরদিন সকালে অসুস্থ শরীর নিয়েও আমি কাজে বেরুলাম। আমার চোখে-মুখে নিশ্চয়ই কালো ছাপ পড়েছিল। সর্দার আমাকে লক্ষ করেছিল। আমার চেহারা দেখে তার চোখে-মুখে যে একটা পৈশাচিক উল্লাসের চিহ্ন ফুটে উঠল তা আমার দৃষ্টি এড়াল না। রাগে আমার গা জ্বলে যাচ্ছিল কিন্তু ঠোঁট কামড়ানো ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না আমার।
‘এবার আমি সাবধান হলাম। প্রতিটি দিনের হিসেব রাখতে লাগলাম। এর মধ্যে যে টিলার ওপর আদিবাসীদের মন্দির সে-জায়গাটাও ঘুরে এলাম। এমন একটা জায়গা আমি খুঁজছিলাম যেখান থেকে পুরোহিতের অলৌকিক কাণ্ডকারখানা সবই আমি দেখতে পাব অথচ ওদের নজরে পড়ব না। প্রয়োজনে আমি ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ব, তাই জায়গাটা দূরে হলেও চলবে না। টিক্কাও আমার সঙ্গে থাকবে কারণ ওর মতো বিশ্বস্ত অনুচর আর পাব না, তা ছাড়া কে জানে হয়তো চরম মুহূর্তে ওই ছেলেটাই আমার প্রধান সহায় হয়ে দাঁড়াবে।
‘ক্রমে আরেক অমাবস্যা এসে গেল। এই একমাসে, আমার শরীর-স্বাস্থ্য আগের মতোই সতেজ হয়ে উঠেছে, আমি নিজেও যত্ন নিয়েছি শরীরের, মনে মনে প্রস্তুত করেছি নিজেকে।
‘অমাবস্যার রাত এল। সকাল থেকেই টিক্কা সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাচ্ছিল। ও বোধ হয় বুঝতে পেরেছিল আমি কিছু করতে যাচ্ছি কিন্তু ভরসা করে জিজ্ঞেস করতে পারছিল না, কী আমার উদ্দেশ্য।
‘সন্ধেবেলা আমরা তাড়াতাড়ি খাওয়া সারলাম। টিক্কাকে নিয়ে আমি বেরিয়ে পড়লাম, সঙ্গে আমার রিভলভারটা নিতে ভুললাম না।
‘যে জায়গাটা আমি বেছেছিলাম সেটা একটা ঝোপ, মন্দিরের চাতালের পাশেই। ওটার আড়াল থেকে মন্দিরের ভেতর সব কিছু দেখা যায়।
‘ক্রমে রাত গভীর হল। একসময় দূরে আলো দেখতে পেলাম— মশালের আলো। কিছুক্ষণ পরেই সর্দারের সঙ্গে পুরোহিত এসে হাজির হল ওখানে। মন্দিরের সামনে মশালটা রাখল সর্দার। মশালের আগুনে জায়গাটা আলোকিত হয়ে উঠল। পুরোহিতকে ভয়ংকর দেখাচ্ছিল। শীর্ণ চেহারা, বয়সের ভারে ঝুঁকে পড়েছে, দুই চোখ কোটর থেকে যেন জ্বলজ্বল করছে, মুখে রংবেরঙের উল্কি, কৌপিনের মতো কিছু একটা পরেছে, সারা গায়েও উল্কি।
পুরোহিতের নির্দেশে সর্দার মন্দিরের ভেতর গিয়ে আগুন জ্বালাল। ঝোপের আড়াল থেকে বিগ্রহকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। বীভৎস এক মূর্তি। কালো পাথরের অনেকটা ছাগলের মতো মুখ, দুটো শিংও আছে, ভাঁটার মতো চোখ, শরীর কিন্তু মানুষের মতো, সরু সরু দুটো পা।
‘পুরোহিত মন্দিরের ভেতর গিয়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করল তারপর পূজা শুরু করল। একসময় পূজা শেষ করে সে বাইরে চত্বরে এসে দাঁড়াল। সর্দার প্রস্তুত হয়েই ছিল, একটা কালো মুরগি পুরোহিতের হাতে ধরিয়ে দিল। পুরোহিত এক মোচড়ে ওটার ঘাড় মটকে দাঁতের কামড়ে গলাটা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল। আমার মতো সাহসী মানুষও শিউরে উঠলাম। মুরগির গলা থেকে নেমে আসা কাঁচা টাটকা রক্ত পান করল পুরোহিত, তার কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল লাল রক্তের ধারা, তখন তাকে রাক্ষসের মতোই দেখাচ্ছিল। মুরগির দেহটাকে সে মন্দিরের ভেতর বিগ্রহের সামনে ছুড়ে দিল, আর মুন্ডুটা একটা বড়ো চৌকো পাথরের ওপর বসিয়ে দুলে দুলে দুর্বোধ্য ভাষায় সুর করে কী সব বলতে লাগল। আমার মনে হল সে মন্ত্র উচ্চারণ করছে। মাঝে মাঝে একটা পাত্র থেকে কিছু পান করছিল, আমি বুঝতে পারলাম কারণবারি।
‘রাত ক্রমেই গভীর হচ্ছে। টিক্কার দিকে তাকিয়ে দেখলাম ভয়ে ওর মুখ শুকিয়ে আমসি। আরও কিছুক্ষণ এভাবে কেটে গেল। তারপর পুরোহিত তার ঝোলা থেকে বার করল একটা মাটির পুতুল। আমার সমস্ত শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। টিক্কার মুখ দিয়ে অস্ফুট একটা শব্দ বেরোতেই আমি ওর মুখ চেপে ধরলাম।
‘পুরোহিত পুতুলটা ওই পাথরের ওপর মুরগির মুন্ডুটার পাশে রাখল। আবার শুরু হল মন্ত্র পড়া, সেইসঙ্গে উদ্দাম নৃত্য। ওই বুড়ো হাড়ে যে এত ভেলকি দেখাতে পারে তা নিজের চোখে না দেখলে আমি বিশ্বাস করতাম না। তারপর একসময় মন্ত্রপাঠ শেষ হল। ঝোলা থেকে এবার সে বার করল একটা লৌহশলাকা। সেটা মশালের আগুনে গরম করতে করতে আবার সে বলতে লাগল মন্ত্র। আমি ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছি; রিভলভারটাও বাগিয়ে ধরেছি। বলে রাখা ভালো, আমার হাতের নিশানা ছিল অব্যর্থ, এখনও বলে বলে লক্ষ্যভেদ করতে পারি।
‘আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম লোহাটা লাল গনগনে হয়ে উঠেছে। সর্দার পুরোহিতের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। এবার লোহাটা সর্দারের হাতে দিল পুরোহিত। এক-পা এক-পা করে পুতুলটার দিকে এগোচ্ছিল সর্দার, ডান হাতটা বাড়িয়ে ধরেছে। পুতুলটার কাছাকাছি হওয়ামাত্র আমি ওর হাত লক্ষ করে গুলি করলাম আর তীব্র এক চিৎকার করে সর্দার হাত চেপে বসে পড়ল মাটিতে। তপ্ত লোহাটা মাটিতে লুটোচ্ছে।
‘আমি ছুটে গেলাম। সর্দারকে দু-হাতে শূন্যে তুলে এক আছাড় মারলাম আর লোহাটা ছুড়ে দিলাম অনেক দূরে। তারপর ফিরে দাঁড়ালাম পুরোহিতের দিকে। আমার চোখ-মুখ তখন বোধ হয় খুব হিংস্র হয়ে উঠেছিল। পুরোহিতের চোখে দেখলাম আতঙ্কের ছায়া। আমি তার দিকে এক পা এগোচ্ছি আর সে এক পা পেছোচ্ছে। হয়তো গলা টিপেই তাকে আমি মেরে ফেলতাম কিন্তু তার আগেই অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটে গেল। পুরোহিত হঠাৎ ডান হাত দিয়ে বুকের বাঁ-দিকটা চেপে একটা চিৎকার করে উঠল। তার মুখ যন্ত্রণায় বেঁকে গেছে, দু-চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে, তারপরই সে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। আর নড়ল না।
‘আমি কয়েক মুহূর্ত তার নিষ্পন্দ দেহের দিকে তাকিয়ে রইলাম তারপর এগিয়ে তার বুকে হাত দিলাম। না, বুক ওঠানামা করছে না। আমি নাকের কাছে কান পাতলাম, নিশ্বাস পড়ছে না। লোকটা আতঙ্কেই হার্ট ফেল করে মারা গেছে।
‘আমি সর্দারের দিকে এগিয়ে গেলাম। সে উঠে বসে সমস্ত দৃশ্যটা দেখেছিল। ভয়ে তার মুখ বিবর্ণ, দু-চোখ বিস্ফারিত। হয়তো লোকটা ভাবছিল, যে পুরোহিতের অত অলৌকিক ক্ষমতা তাকে আমি শুধু দৃষ্টি দিয়ে মেরে ফেললাম, আমার ক্ষমতা না জানি কত। টিক্কাও অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়েছিল। তারপরই সর্দার আমার পায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কাতর কণ্ঠে আমার কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাইতে লাগল। বিগ্রহের সামনে শপথ করে বলল চিরকাল আমার দাস হয়ে থাকবে, আর কখনো আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করবে না।
‘আমি তাকে আদেশ করলাম পুরোহিতকে দাহ করার ব্যবস্থা করতে। সর্দার বলল তখুনি সে লোকজন নিয়ে এসে কাজটা সেরে ফেলবে। আমি তাকে সাবধান করে দিলাম সেই রাতের ঘটনা সে যেন কাউকে না বলে, তবে তার অপরাধের জন্য পুলিশ ধরলে আমি বাঁচাতে পারব না। ওই কথায় কাজ হল, সর্দার দিব্যি করে বলল ওই রাতের ঘটনা আর কেউ জানবে না।’
আমরা একটা কেবিনে বসে ছিলাম। শেখর চৌধুরী হঠাৎ একটা কাণ্ড করে বসলেন। উঠে দাঁড়িয়ে গায়ের জামাটা খুলে ফেললেন, তারপর গেঞ্জিটা গুটিয়ে ওপরে তুললেন। আমি আঁতকে উঠলাম। বুকের দু-পাশে দুটো বিচ্ছিরি ক্ষতের চিহ্ন, যেন আগুনে ঝলসে গেছে। রুপোর টাকার মতো দুটো গোল পোড়া দাগ।
ভদ্রলোক গেঞ্জিটা টেনে দিয়ে জামাটা আবার গায়ে দিলেন।
‘আর সেই পুতুলটা?’ আমি না বলে পারলাম না।
‘সেটা আমি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলাম,’ গেলাসে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে তিনি মুচকি হেসে বললেন, সেই ঘটনার স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে ওটা আমি কাচের আলমারিতে যত্ন করে সাজিয়ে রেখেছি। আসুন না একদিন গরিবের কুটিরে, নিজের চোখেই দেখে যাবেন।’