বঙ্কিমচন্দ্র

বঙ্কিমচন্দ্র

বঙ্কিম প্রসঙ্গের আরম্ভে, নর, নারায়ণ, নরোত্তম ও সর্ব্বশেষে দেবী সরস্বতীকে নমস্কার করিয়া জয়োচ্চারণ* করি। ইহার কারণ, বঙ্কিম যে জীবনব্যাপী তপস্যা করিয়াছিলেন তাহাতে এই চারি দেবতারই উপাসনা ছিল। এই জন্যই আজ তাঁহাকে বিশেষ করিয়া স্মরণ করি। আজ আমরা তাঁহার প্রাণের মর্ম্মটি বুঝিতে চেষ্টা করিব। তিনি যে ভাষার মন্দির গড়িয়াছিলেন, তাহার কারুশিল্পের বিশ্লেষণ আজ করিব না, সেই মন্দিরের মধ্যে তিনি নিজের প্রাণ উৎসর্গ করিয়া যে দেবতার প্রাণ—প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন তাহারই আরতি করিব।

[* এখানে মূল সংস্কৃত শ্লোকটির অর্থ রক্ষা করি নাই—তজ্জন্য পণ্ডিতগণ যেন ক্ষুণ্ণ না হন—গ্রন্থকার]

বঙ্কিমের সাহিত্য-সাধনার প্রেরণা যোগাইয়াছিল, প্রত্যক্ষভাবে—স্বজাতি, স্বদেশ ও স্ব-সমাজ, এবং পরোক্ষভাবে—মানবের অদৃষ্ট ও মনুষ্যত্বের আদর্শ-সন্ধান। যে—জ্ঞান তত্ত্ব মাত্র, যে-ধর্ম্ম শুষ্ক তর্ক মাত্র, এবং যে-কাব্য আর্ট মাত্র, বঙ্কিম তাহাকে বরণ করেন নাই—বুঝিতেন না বলিয়া নয়, তিনি তাহা চান নাই, তাঁহার প্রাণ নিষেধ করিয়াছিল। যে-ধর্ম্ম মানুষের সত্যকার প্রকৃতি বা চরিত্রগত স্বধৰ্ম্ম, যাহা জীবনের সর্ব্ববিধ প্রয়াসের মধ্যে সার্থক হইতে চায়—যে ধৰ্ম্ম জ্ঞান, ভক্তি, প্রেম ও কর্ম্মের সঙ্গতি রক্ষা করিয়া, পূর্ণ মনুষ্যত্ব-সাধনের উপায়, বঙ্কিম তাহাকেই বরণ করিয়াছিলেন। আবার যে-দেশ, যে-জাতি ও যে-কুলে তিনি জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন—সেই দেশের ইতিহাস, সেই জাতির সাধনা, সেই সমাজের ধর্ম্মকে উদ্ধার করাও তাঁহার জীবনের ব্রত ছিল, নিজের মহতী প্রতিভা তিনি তদর্থে উৎসর্গ করিয়াছিলেন। তিনি সরস্বতীকে সেবায় প্রসন্ন করিয়া শ্রেষ্ঠ বর লাভ করিয়াছিলেন, অথচ নর, নারায়ণ ও নরোত্তমকে কদাপি বিস্মৃত হন নাই।

আজ সমাজ, ধৰ্ম্ম, নীতি কিছুরই জন্য আমাদের চিন্তা নাই; শিক্ষিত বাঙালী এ বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন। আত্মরক্ষার জন্য যে চিন্তাশক্তি ও হৃদয়-বলের প্রয়োজন তাহা অতিশয় ক্ষীণ হইয়া আসিয়াছে; অন্ন ও স্বাস্থ্য—এই দুইটি প্রাথমিক প্রয়োজন-সাধনেও আমরা পূর্ব্বাপেক্ষা নিরুপায়। উচ্চচিন্তার পরিধি অতিশয় সঙ্কীর্ণ হইয়া পড়িয়াছে; সাহিত্যের নামে যাহা করিতেছি তাহা দুর্ব্বলচিত্ত অশিক্ষিতের আত্মপ্রসাদ মাত্র; রাজনীতির সঙ্গে স্বধর্ম্মের যোগসাধন করিতে পারি নাই—ঘোর অচৈতন্য অবস্থায় বৃথা হাত-পা ছুঁড়িতেছি। সকল চিন্তা ও সকল কর্ম্মের মূলে যে আত্মজ্ঞান, ধর্ম্মবল ও পৌরুষের প্রয়োজন তাহারই একান্ত অভাব হইয়াছে। আমরা জাতীয় সাধনার ধারা হারাইয়াছি, ইতিহাস ভুলিয়াছি,-দেড়শত বৎসর পূর্ব্বেও যে সহস্র বৎসরের ইতিহাস আছে, তাহার মধ্যে আমাদের জাতীয় প্রকৃতির পরিচয় কিরূপ, উত্থান ও পতনের কোন্ নিয়ম বা হেতু রহিয়াছে, কীৰ্ত্তি বা অপকীর্ত্তির পরিমাণ কি, এক কথায় আমরা কি ও কে, তাহা একেবারে ভুলিয়াছি। এজন্য আমরা স্বধর্ম্মভ্রষ্ট হইয়াছি, এবং বিদেশী জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিচ্ছিন্ন বাক্য-সমষ্টির তাড়নায়, প্রতি দশ বৎসর, পলকে প্রলয় জ্ঞান করিয়া প্রবল মন্বন্তরমুখে ভাসিয়া চলিয়াছি। তাই আজ বঙ্কিমের যুগ ও বঙ্কিমকে জানিতে ইচ্ছা হয়। বঙ্কিমের চরিত্রে ও প্রতিভায় সেই যুগের বাঙালী হিন্দুর আত্মজাগরণের প্রয়াস ফুটিয়া উঠিয়াছিল। মৃতকল্প জাতির সুপ্ত প্রাণ-শক্তি ও অধ্যবসায় এই যুগন্ধর ব্যক্তিকেই বিশেষ করিয়া আশ্রয় করিয়াছিল। বাঙালী যদি কখনো আত্মপ্রবুদ্ধ হয়, তবে যতই দিন যাইবে ততই বঙ্কিম-প্রতিভার এই দিকটার প্রতি তাহার শ্রদ্ধা উত্তরোত্তর বাড়িবে, বঙ্কিমকে সে ভাল করিয়া বুঝিবার জন্য চেষ্টিত হইবে—কেবল সাহিত্যস্রষ্টা বঙ্কিমকে নয়, খাঁটি দেশ—প্রেমিক, আধুনিক বাঙালী জাতির ঋষিকল্প শিক্ষাগুরু, দৈবী প্রতিভার অধিকারী বঙ্কিমকে চিনিয়া লইবে।

সে যুগে পশ্চিমের সঙ্গে হঠাৎ ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ফলে—ইংরেজী দর্শন, বিজ্ঞান, সাহিত্য ও ইতিহাসের প্রচণ্ড প্রভাবে বিস্মিত ও সচকিত বাঙালী-সন্তানের যে নবজাগরণ ও ভাবান্তর উপস্থিত হইল, তাহার ফলে সে ‘স্বনুষ্ঠিত পরধর্মের প্রতি অবশে আকৃষ্ট হইয়া পড়িল। সেই আধ্যাত্মিক সঙ্কটে সত্যপিপাসু শিক্ষিত বাঙালীর অনেকেই সহজলব্ধ পন্থায় গা ভাসাইবার উপক্রম করিলেন। চুপ করিয়া থাকিবার সময় সে নয়, স্ব-সমাজ ও স্বধর্ম্মের নিদারুণ অধোগতি তখন চাক্ষুষ হইয়া উঠিয়াছে। সত্যসন্ধ চিন্তাশীল পুরুষের মনে তখন একটা প্রবল কর্তব্যের তাগিদ আসিয়াছে। য়ুরোপীয় যুক্তিবাদ, বিজ্ঞানের নির্ভীক তথ্যসমুচ্চয়, এবং তাহারি আলোকে এক অভিনব মানব-ধর্ম্মের আদর্শ প্রাচীন বিশ্বাসের মূল পর্যন্ত বিচলিত করিয়া তুলিল। বিশ্বাস বলিতেছি এই জন্য যে, তখন চিন্তাশক্তি লোপ পাইয়াছে, বিচারবুদ্ধি অন্ধসংস্কারে পরিণত হইয়াছে, জাতীয় সাধনার অন্তর্নিহিত তত্ত্বগুলির সঙ্গে জ্ঞানবৃত্তি বা প্রাণবৃত্তি কোনটারই আর জীবন্ত যোগ ছিল না। এজন্য এই বীৰ্য্যবান পরধর্ম্মের সংক্ষিপ্ত মুক্তিপন্থাই উদার, প্রশস্ত ও সুগম বলিয়া মনে হইল। জাতির পক্ষে ইহাই হইল কঠিন সঙ্কট। তথাপি সে ভালই হইল—এইরূপ সঙ্কটেরই প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সঙ্কটকে কল্যাণে পরিণত করিবার মত মনীষা ও হৃদয়বলের প্রয়োজন। বঙ্কিমের মধ্যে আমরা সেই দুর্লভ প্রতিভার পরিচয় পাই। বঙ্কিম য়ুরোপীয় সভ্যতা ও সাধনার ধারা শ্রদ্ধার সহিত বিচার করিয়াছিলেন। এই প্রভাবের প্রত্যক্ষ প্রমাণ তাঁহার যাবতীয় রচনা ও সাহিত্যসৃষ্টির আদর্শে পরিস্ফুট হইয়া রহিয়াছে। কিন্তু সেই প্রভাবে প্রভাবান্বিত হইলেও,* তিনি তাহাকে যতটুকু সত্য বলিয়া মানিয়াছিলেন ঠিক ততটুকুই হিন্দুর সাধনা ও সভ্যতারও অন্তর্ভুক্ত করিয়া দেখিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। ইহাই বঙ্কিম-প্রতিভার বৈশিষ্ট্য, এই জন্যই য়ুরোপীয় শিক্ষা-দীক্ষা অন্তরায় না হইয়া, তাঁহার মধ্য দিয়া, এবং বিশেষ করিয়া তাঁহার দ্বারাই, স্বধর্ম্ম, স্বসমাজ ও স্বজাতির কল্যাণপ্রসূ হইয়াছিল।

[*“তবে ইহাও আমাকে বলিতে হইতেছে যে, যে ব্যক্তি পাশ্চাত্ত্য সাহিত্য, বিজ্ঞান এবং দর্শন অবগত হইয়াছে, সকল সময়েই সে যে প্রাচীনদিগের অনুগামী হইতে পারিবে, এমন সম্ভাবনা নাই। আমিও সর্ব্বত্র তাঁহাদের অনুগামী হইতে পারি নাই। যাঁহারা বিবেচনা করেন, এদেশীয় পূর্ব্বপণ্ডিতেরা যাহা বলিয়াছেন তাহা সকলই ঠিক এবং পাশ্চাত্ত্যগণ জাগতিক তত্ত্বসম্বন্ধে যাহা বলেন তাহা সকলই ভুল, তাঁহাদিগের সঙ্গে আমার কিছুমাত্র সহানুভূতি নাই।” বঙ্কিমচন্দ্ৰকৃত ‘শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতার অনুবাদ ও টীকার ভূমিকা।]

বঙ্কিমকে বুঝিতে হইলে তাঁহাকে কেবল জ্ঞানী চিন্তাবীর হিসাবে পরীক্ষা করিলে চলিবে না। জ্ঞানের সাধনা বা সত্যের প্রতিষ্ঠায় আরও অনেকে জীবন উৎসর্গ করিয়াছেন, জাতির মুক্তিপথ-নির্দেশে তাঁহাদের সহায়তা শ্রদ্ধার সহিত স্মরণ করিয়া, আমরা সেই যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালীর চরিত কীৰ্ত্তন করিব। রমেশচন্দ্র দত্ত বাংলা—সাহিত্যের ইতিহাস-প্রসঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রকে “The greatest man of the Nineteenth Century’ বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। বঙ্কিমের সেই greatness-এর অর্থ কি? বঙ্কিম কেবলমাত্র চিন্তাবীর বা সত্যপরায়ণ সমাজসংস্কারক ছিলেন না—আরও বড় ছিলেন। দেশপ্রেমের প্রেরণাযুক্ত এক অপূর্ব্ব প্রতিভায় তিনি সে-যুগে স্বধৰ্ম্ম ও পরধর্ম্মের বিরোধ নিষ্পত্তি করিয়াছিলেন। তাঁহার চিন্তায় শুধুই বিশ্লেষণী শক্তি নয়, সৃজনী শক্তি ছিল। মৃতপ্রায় বৃক্ষকাণ্ড উৎপাটন করিয়া তাহার স্থানে সুদৃশ্য ও সুদৃঢ় লৌহস্তম্ভ স্থাপন করিবার বুদ্ধি তাঁহার ছিল না—সেই মৃত বৃক্ষের মূলে তাহারই জন্মমৃত্তিকা হইতে রসসঞ্চার করাইয়া তাহার বৃক্ষত্ব সম্পাদন করিবার প্রতিভা একমাত্র বঙ্কিমচন্দ্রেরই ছিল। ‘Our greatest thoughts come from the heart’–এই রহস্যময় চিত্তবৃত্তি, হৃদয়ের গভীর গহনের অনুভূতি না থাকিলে, কেহ সৃষ্টি করিতে পারে না। এইজন্য বঙ্কিম কবি; কিন্তু কবিত্বের অপেক্ষা বড় ছিল তাঁহার যে শক্তি—তাঁহার কবি-কল্পনা যে শক্তির একটা অংশমাত্র, একটা সাধনপ্রণালী মাত্র—আমি সেই শক্তির কথাই বলিতেছি। তিনি প্রকৃত জীবনের সমস্যা, পরিপূর্ণ জীবনের আদর্শ, জ্ঞান, ভক্তি, প্রেম, কর্ম্ম—সর্ব্ববৃত্তির সামঞ্জস্য—মূলক একটি সত্যের সন্ধান করিয়াছিলেন, এবং তাহাকে নিছক জ্ঞান বা ধ্যানের মধ্যে নয়, জীবনের সমগ্র বাস্তবতার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করিতে চাহিয়াছিলেন। এই সত্যের সন্ধানই তাঁহার ধর্ম্মতত্ত্ব।* হিন্দুধর্ম্মের প্রতি তাঁহার যে প্রীতি, তাহার কারণ তিনি তাহার নিগূঢ় তত্ত্বসকলের উদারতায় মুগ্ধ হইয়াছিলেন। প্রাণের সত্যকার পিপাসা, গভীর শ্রদ্ধা ও নিরন্তর যুক্তি-বিচারের সংযম তাঁহার অভীষ্টসিদ্ধির প্রাণপণ প্রয়াসকে মহিমান্বিত করিয়াছে। **

[* “মনুষ্যের কতকগুলি শক্তি আছে। আপনি তাহার বৃত্তি নাম দিয়াছেন। সেইগুলির অনুশীলন, প্রস্ফুরণ ও চরিতার্থতাই মনুষ্যত্ব। তাহাই মনুষ্যের ধর্ম্ম। সেই অনুশীলনের সীমা পরস্পরের সহিত বৃত্তিগুলির সামঞ্জস্য। তাহাই সুখ। এই সকল বৃত্তির উপযুক্ত অনুশীলন হইলে ইহারা সকলেই ঈশ্বরমুখী হয়। সেই অবস্থাই ভক্তি।” অনুশীলন, অষ্টাবিংশ অধ্যায় (উপসংহার)
“বৃত্তি নিকৃষ্ট হউক বা উৎকৃষ্ট হউক, উচ্ছেদমাত্রই অধৰ্ম্ম। লম্পট বা পেটুক অধাৰ্ম্মিক ; কেন না, তাহারা আর সকল বৃত্তির প্রতি অমনোযোগী হইয়া ওই একটির অনুশীলনে নিযুক্ত। যোগীরাও অধার্ম্মিক; কেন না তাঁহারাও আর সকল বৃত্তির প্রতি অমনোযোগী হইয়া দুই একটির সমধিক অনুশীলন করেন। …..
“আর, আমি কোনো বৃত্তিকেই নিকৃষ্ট বা অনিষ্টকর বলিতে সম্মত নহি। জগদীশ্বর আমাদিগকে নিকৃষ্ট কিছুই দেন নাই। আমাদের সকল বৃত্তিগুলিই মঙ্গলময়। যখন তাহাতে অমঙ্গল হয় সে আমাদেরই দোষে। নিখিল বিশ্বের সর্ব্বাংশই মনুষ্যের সকল বৃত্তিগুলিরই অনুকূল, প্রকৃতি আমাদের সকল বৃত্তিগুলিরই সহায়। তাই যুগপরম্পরায় মনুষ্যজাতির মোটের উপর উন্নতিই হইয়াছে। যে বৈজ্ঞানিক নাস্তিক ধর্ম্মকে উপহাস করিয়া বিজ্ঞানই এই উন্নতির কারণ বলেন, তিনি জানেন না, বিজ্ঞানও এই ধর্ম্মের এক অংশ, তিনিও একজন ধর্মের আচার্য্য।” অনুশীলন, ষষ্ঠ অধ্যায়।

** “তিন চারি হাজার বৎসর পূর্ব্বে ভারতবর্ষের জন্য যে বিধি সংস্থাপিত হইয়াছিল আজিকার দিনে ঠিক সেইগুলি অক্ষরে অক্ষরে মিলাইয়া চালাইতে পারা যায় না। সেই ঋষিরা যদি আজ ভারতবর্ষে বর্ত্তমান থাকিতেন, তবে তাঁহারাই বলিতেন, ‘না, তাহা চলিবে না। আমাদিগের বিধিগুলির সর্ব্বাঙ্গ বজায় রাখিয়া এখন যদি চল, তবে আমাদিগের প্রচারিত ধর্ম্মের মর্ম্মের বিপরীতাচরণ করা হইবে।’ হিন্দুধর্ম্মের সেই মর্ম্মভাগ অমর, চিরদিন চলিবে, মনুষ্যের হিতসাধন করিবে, কেন না মানব-প্রকৃতিতে তাহার ভিত্তি। তবে বিশেষ বিধিসকল সকল ধৰ্ম্মেই সময়োচিত হয়। তাহা কালভেদে পরিহার্য্য ও পরিবর্ত্তনীয়।” অনুশীলন, পঞ্চম অধ্যায়।]

আমি বঙ্কিমের সৃজনী শক্তির কথা বলিয়াছি। সকল সৃষ্টির মূলেই আছে একটি সমগ্র-দৃষ্টি। এক খণ্ড বস্তু হইতে আর একটা বৃহত্তর খণ্ডবস্তুতে উপনীত হওয়াই সৃষ্টির লক্ষণ নয়। যাহা খন্ড ও বিচ্ছিন্ন তাহাকেই এমন একটি আলোকে উদ্ভাসিত করা যে, তাহারই মধ্যে সৰ্ব্বসামঞ্জস্য লক্ষিত হইবে—ইহাই সৃষ্টিশক্তি। কবিরা particular-কে universal-এর গৌরব দান করেন। শ্রেষ্ঠ কবির personality যতই সুনির্দ্দিষ্ট, তাহার মধ্যে impersonal দিকটি পরিস্ফুট হইয়া থাকে। ইহাই অঘটনঘটনপটীয়সী প্রতিভা। বঙ্কিমের প্রতিভায় আমরা ইহাই লক্ষ্য করি। যাহা সৰ্ব্বকালাতীত, যাহা নিত্য ও শাশ্বত, তাহাকে তিনি কখনও ভুল করেন নাই, কিন্তু তাহাকে দেশকালের ইতিহাসের মধ্যে মূর্ত্তি ধরিতে দেখিয়াছিলেন। ধৰ্ম্মকে তিনি মানুষের সত্যকার জীবন হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া একটি তত্ত্বরূপে উপলব্ধি করিয়া পরে তাহাকে মানুষের উপর চাপাইবার চেষ্টা করেন নাই। মানুষের বাস্তব প্রকৃতির মধ্য দিয়াই যে মনুষ্যত্ব বিকাশের পথ খুঁজিতেছে, তাহাকেই তিনি সত্যকার ধর্ম বলিয়া বুঝিয়াছিলেন। হিন্দুজাতির ইতিহাসে, এই ধর্ম্মের বিশিষ্ট ধারাকে তিনি কোনও একটি যুগ বা দূর অতীতের একটি উৎসের মধ্যেই সম্পূর্ণ হইতে দেখেন নাই—তাহার সমগ্র ইতিহাসের মধ্য দিয়া তিনি সেই ধারাটিকে অনুসরণ করিয়াছিলেন, সেই বহুবিচিত্র প্রকাশ-ভঙ্গীর মধ্যে তাহার মূল প্রেরণাটিকে বুঝিয়া লইয়াছিলেন। এজন্য হিন্দু-ধর্ম্মের অন্তর্গত কোনও একটি তত্ত্বকে তিনি সত্য বলিয়া অপর সকলকে পরিহার করেন নাই। সুদীর্ঘ কালের বিস্তারের মধ্যে একটা জাতির জীবন তাহার সকল চেষ্টা ও প্রবৃত্তির রঙে ও রূপে, যে চাক্ষুষ দেহ ধারণ করিয়াছে তাহার হৃদস্পন্দন তিনি অনুভব করিয়াছিলেন। তিনি তাহার প্রাণের মধ্যে প্রবেশ করিয়া যেখানে তাহার হৃদয়ের সহস্রদল একটি বৃত্তে বিধৃত হইয়া আছে—সেই বৃত্তমূলটিকে আবিষ্কার করিয়াছিলেন। সেইখানে পৌঁছিতে না পারিলে সামঞ্জস্য বোধ হয় না, বিরোধ ঘুচে না। এমনি করিয়া বিশেষকে ধরিতে পারিলে নির্ব্বিশেষের উপলব্ধি হয়। ইহাই প্রতিভার কাজ, ইহার জন্য শ্রেষ্ঠ কবি-প্রতিভার প্রয়োজন। এই জন্যই এক অর্থে কবিও ঋষি, ঋষিও কবি। এই সমগ্র দৃষ্টিই সৃষ্টিশক্তি। বঙ্কিম এই দৃষ্টির দ্বারা হিন্দুর বিশিষ্ট সাধনাকে আবিষ্কার করিয়াছিলেন—সৃষ্টি করিয়াছিলেন। Particular-কে এমনি করিয়া দেখিতে জানিলে তাহার মধ্যে Universal আপনিই প্রতিফলিত হয়। এই যোগসাধন কেবল যুক্তিতর্কের দ্বারা হয় না। মানুষ যে শুধুই জ্ঞানসাধনের যন্ত্র নয়—অতীতের ঐতিহ্য ও বর্তমানের পারিপার্শ্বিকের প্রভাবে তাহার প্রাণের একটি বিশিষ্ট রূপ আছে, তাহা তিনি ভুলিয়া যান নাই, অথচ তাহারই মধ্যে সার্ব্বজনীন মনুষ্যত্বের বীজ রহিয়াছে, ইহাও তিনি সব দিক দিয়া ভাল করিয়া বুঝিয়াছিলেন। এই বুদ্ধির মূলে ছিল তাঁহার প্রবল দেশাত্মবোধ, পরে এই বুদ্ধি হিন্দুশাস্ত্রের মর্মোদ্ধারকালে আরও দৃঢ় হইয়াছিল। যাহা দেশে, কালে ও পাত্রে খণ্ডরূপে দেখা দেয়, তাহাকেই অখণ্ডরূপে উপলব্ধি করা শ্রেষ্ঠ মনীষার লক্ষণ। আবার, অখণ্ডকে উপলব্ধি করিয়াও খণ্ডের মধ্যেই রসাস্বাদন করা অধিকতর শক্তির প্রমাণ—জ্ঞান তখন শাখাপল্লবেই শেষ হয় নাই, পুষ্পিত হইয়াছে,—এই Concrete, Particular-এর প্রীতিই সকল সৃষ্টির মূলে। কি সাহিত্যে, কি সমাজে, কি রাষ্ট্রে, বাস্তবের সহিত এই সহানুভূতি যাহার নাই, যে বাস্তবের রসরূপের পরিচয় পায় নাই, কেবল তত্ত্বসন্ধান করিয়াছে, সে কিছু সৃষ্টি করিতে পারে না। তাহার মন্ত্র যত উৎকৃষ্ট হউক, সে মন্ত্র প্রাণদ হয় না। কথাটা অবান্তর নয়। যে দেশাত্মবোধ বঙ্কিমের প্রতিভাকে সঞ্জীবিত করিয়াছে, তাহার মধ্যে যদি এই গভীর অনুভূতি ও দৃষ্টিশক্তি না থাকিত, তাহা হইলে স্বধর্ম্মের সঙ্গে পরধর্ম্মের বিরোধে তিনি সাৰ্ব্বজনীন ও শাশ্বতকে হারাইয়া স্বধর্ম্মকেও হারাইতেন, তাহাকে উদ্ধার করিতে পারিতেন না।

এই দেশাত্মবোধ তাঁহার প্রতিভার মূল উৎস। এ-মন্ত্রে কেহ তাঁহাকে দীক্ষিত করে নাই,—ইহা শিক্ষালব্ধ নয়, সহজাত মনীষার মত ইহা যেন তাঁহার প্রাক্তন সম্পদ। জাগ্রতে-স্বপনে, ধ্যানে-জ্ঞানে এক মুহূর্ত্ত তিনি ইহা হইতে মুক্ত হইতে পারেন নাই। জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চায়, ধর্ম্মতত্ত্বের বিচারে, সাহিত্যসৃষ্টির অপূর্ব্ব উন্মাদনায়-যৌবনের স্বপ্নে, প্রৌঢ়ের কর্ম্মজিজ্ঞাসায়, বার্দ্ধক্যের স্মৃতি-কল্পনায়—এই দেশপ্রেম তাঁহাকে অভিভূত করিয়াছিল, দেশের নামে তিনি আত্মহারা হইতেন। অত বড় গম্ভীর প্রকৃতিও দেশের কথায় বালকের মত অধীর হইয়া উঠিত-ক্ষোভে, লজ্জায়, হর্ষে, শোকে, ক্রোধে ও গর্ব্বে আত্মসংযম হারাইত। এই দেশ কোনও মনঃকল্পিত দেবতা নয়—যেন সাকার বিগ্রহ; এ প্রেম যেন রক্তের ধর্ম—ব্যক্তিগত সম্পর্কের নিবিড় চেতনা। কত ভাবে, কত প্রসঙ্গে, যে তিনি এই গভীর চেতনা ব্যক্ত করিয়াছেন তাহার সংখ্যা নাই। কিন্তু সকল ভাবের মধ্যে যে ভাবটি তাঁহার হৃদয়ে আমরণ জাগরূক ছিল, তাহার দৃষ্টান্তস্বরূপ কমলাকান্তের ‘একটি গীত’ হইতে এখানে কিঞ্চিৎ উদ্ধৃত না করিয়া পারিলাম না। সত্যকার অনুভূতি এবং তাহারই প্রকাশ-বেদনা যদি সাহিত্যসৃষ্টির কারণ হয়, এবং সে প্রকাশভঙ্গি অনবদ্য হইলে যদি তাহা সাহিত্য হয়, তবে কাব্যের মধ্যেই কবির অন্তরতম প্রকৃতির পূর্ণ পরিচয় পাওয়া যায়। সেই পরিচয় এই পংক্তিগুলিতে আমরা পাইতেছি—

“আর বঙ্গভূমি! তুমিই বা কেন মণিমাণিক্য হইলে না, তোমায় কেন আমি হার করিয়া কণ্ঠে পরিতে পারিলাম না? তোমায় সুবর্ণের আসনে বসাইয়া, হৃদয়ে দোলাইয়া দেশে দেশে দেখাইতাম। ইউরোপে, আমেরিকায়, মিসরে, চীনে দেখিত, তুমি আমার কি উজ্জ্বল মণি।……

“সম্পূর্ণ অসহ্য সুখের লক্ষণ শারীরিক চাঞ্চল্য, মানসিক অস্থৈর্য্য। এ সুখ কোথায় রাখিব, লইয়া কি করিব, আমি কোথায় যাইব? এ সুখের ভার লইয়া কোথায় ফেলিব? এ সুখের ভার লইয়া আমি দেশে দেশে ফিরিব; এ সুখ একস্থানে ধরে না। এ জগৎ সংসার এ সুখে পুরাইব। সংসার এ সুখের সাগরে ভাসাইব।….. “এ সুখে কমলাকান্তের অধিকার নাই—এ সুখে বাঙালীর অধিকার নাই। গোপীর দুঃখ, বিধাতা গোপীকে নারী করিয়াছেন কেন,—আমাদের দুঃখ বিধাতা আমাদের নারী করেন নাই কেন—তাহা হইলে এ মুখ দেখাইতে হইত না।

তোমায় যখন পড়ে মনে
আমি চাই বৃন্দাবন পানে,
আলুইলে কেশ নাহি বাঁধি।

“এই কথা সুখ-দুঃখের সীমারেখা। যাহার নষ্ট সুখের স্মৃতি জাগরিত হইলে সুখের নিদর্শন এখনও দেখিতে পায়, সে এখনও সুখী—তাহার সুখ একেবারে লুপ্ত হয় নাই। যাহার সুখ গিয়াছে, সুখের নিদর্শন গিয়াছে—বঁধু গিয়াছে, বৃন্দাবনও গিয়াছে, এখন আর চাহিবার স্থান নাই—সেই দুঃখী, অনন্ত দুঃখে দুঃখী।

“আমার এই বঙ্গদেশে সুখের স্মৃতি আছে, নিদর্শন কই? দেবপালদেব, লক্ষ্মণ সেন, জয়দেব, শ্রীহর্ষ,—প্রয়াগ পর্য্যন্ত রাজ্য, ভারতের অধীশ্বর নাম, গৌড়ী রীতি, এ সকলের স্মৃতি আছে, কিন্তু নিদর্শন কই? সুখ মনে পড়িল, কিন্তু চাহিব কোন্ দিকে? সে গৌড় কই? সে যে কেবল যবনলাঞ্ছিত ভগ্নাবশেষ। আর্য্য রাজধানীর চিহ্ন কই? আর্য্যের ইতিহাস কই? জীবনচরিত কই? কীৰ্ত্তি কই? কীর্ত্তিস্তম্ভ কই? সমরক্ষেত্র কই? সুখ গিয়াছে—সুখচিহ্নও গিয়াছে, বঁধু গিয়াছে বৃন্দাবনও গিয়াছে—চাহিব কোন্ দিকে?”

এ স্বদেশপ্রীতি আমাদের আধুনিক কালের Nationalism নয়। বিজাতি প্রভুর নিকট স্বরাজের অধিকার সাব্যস্ত করিবার জন্য, সেই বিজাতির অনুকরণে কতকগুলি ছেঁদো বুলি আওড়ান নয়। যে দেশপ্রেমে দেশের সঙ্গে পরিচয় নাই, দেশের ইতিহাস, অতীত কীর্ত্তির অনুশীলন নাই, নিজের বংশপরিচয় নাই, জাতির বিশিষ্ট সাধনার ধারাকে নিজের জীবনে উপলব্ধি করিবার চেষ্টা নাই—ইহা সেই স্বরাজ-কামনা হইতে স্বতন্ত্র। বঙ্কিমের দেশপ্রীতি ছিল যেন দেহেরই ক্ষুধা—মার্জিত শিক্ষিত বুদ্ধিবৃত্তি নয়—একেবারে রক্তমাংসের সহজ-সংস্কার। এই দেশপ্রীতির দ্বারাই তিনি আধ্যাত্মিক ক্ষুধার নিবৃত্তি করিয়াছিলেন। মনুষ্যত্ত্ব-ধর্মের বিচারে তিনি যে শেষ সিদ্ধান্তে উপনীত হইলেন, তাহারও একটি প্রধান অর্থ হইল এই স্বদেশপ্রীতি।* ‘গীতার ব্যাখ্যা’, ‘অনুশীলন’, ‘ধৰ্ম্মতত্ত্ব’—সর্ব্বত্র উদার যুক্তিবিচারের ফাঁকে ফাঁকে তাঁহার হৃদয়ের এই শিখা স্ফুরিত হইতেছে; এই প্রাণের প্রেরণাই যেন সর্ব্বসমস্যার মধ্য দিয়া তাঁহার পথটিকে সুগম করিয়া দিয়াছে। মনে হয় সত্যই— ‘Our best thoughts come from the heart’.

[* “যে আক্রমণকারী তাহা হইতে আত্মরক্ষা করিব, কিন্তু তাহার প্রতি প্রীতিশূন্য হইব কেন? পর সমাজের অনিষ্টসাধন করিয়া আমার সমাজের ইষ্টসাধন করিব না, এবং আমার অনিষ্টসাধন করিয়া কাহারেও আপনার সমাজের ইষ্টসাধন করিতে দিব না। ইহাই যথার্থ সমদর্শন, এবং ইহাই জাগতিক প্রীতি ও দেশ-প্রীতির সামঞ্জস্য।…. আমি তোমাকে যে দেশপ্রীতি বুঝাইলাম তাহা ইয়ুরোপীয় patriotism নহে। ইয়ুরোপীয় patriotism একটা ঘোরতর পৈশাচিক পাপ। ইয়ুরোপীয় partriotism-ধর্ম্মের তাৎপর্য এই যে, পর-সমাজের কাড়িয়া ঘরের সমাজে আনিব, স্বদেশের শ্রীবৃদ্ধি করিব, কিন্তু অন্য সমস্ত জাতির সর্ব্বনাশ করিয়া তাহা করিতে হইবে। জগদীশ্বর ভারতবর্ষে যেন ভারতবর্ষীয়দের কপালে এরূপ দেশ—বাৎসল্য-ধৰ্ম্ম না লিখেন।…..
“মানুষের সকল বৃত্তিগুলি অনুশীলিত হইয়া যখন ঈশ্বরানুবর্তিনী হইবে, মনের সেই অবস্থাই ভক্তি। এই ভক্তির ফল জাগতিক প্রীতি। এই জাগতিক প্রীতির সঙ্গে আত্মপ্রীতি, স্বজনপ্রীতি, এবং স্বদেশপ্রীতির প্রকৃত পক্ষে কোন বিরোধ নাই।….. আত্মরক্ষা হইতে স্বজন—রক্ষা গুরুতর ধর্ম্ম, স্বজন-রক্ষা হইতে দেশ-রক্ষা গুরুতর ধর্ম্ম। যখন ঈশ্বরে ভক্তি এবং সৰ্ব্বলোকে প্রীতি এক, তখন বলা যাইতে পারে যে, ঈশ্বরে ভক্তি ভিন্ন, দেশপ্রীতি সর্বাপেক্ষা গুরুতর ধর্ম্ম।……
“ভারতবর্ষীয়দিগের ঈশ্বরে ভক্তি ও সর্ব্বলোকে সমদৃষ্টি ছিল। কিন্তু তাঁহার দেশপ্রীতি সেই সাৰ্ব্বলৌকিক প্রীতিতে ডুবাইয়া দিয়াছিলেন। ইহা প্রীতিবৃত্তির সামঞ্জস্যযুক্ত অনুশীলন নহে। দেশপ্রীতি ও সার্ব্বলোকিক প্রীতি উভয়ের অনুশীলন ও পরস্পর সামঞ্জস্য চাই। তাহা ঘটিলে ভবিষ্যতে ভারতবর্ষ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতির আসন গ্রহণ করিতে পারিবে।” ‘অনুশীলন’ চতুৰ্ব্বিংশ অধ্যায় (স্বদেশপ্রীতি)।]

প্রথম হইতে শেষ পর্য্যন্ত বঙ্কিম পথ খুঁজিয়াছিলেন, পথ প্রস্তুত করিয়াছিলেন। কবি হইয়াও কাব্যকলাই তাঁহার মুখ্য ভাবনা ছিল না। তিনি সারাজীবন সমগ্র জাতির জীবনপথের পাথেয় সংগ্রহের চিন্তায় ব্যাপৃত ছিলেন। জাতির জীবনে যে যুগান্তরের সমস্যা বিরাট হইয়া দেখা দিয়াছিল তাহারই স্পন্দনে তাঁহার সারাচিত্ত ব্যাকুল হইয়া উঠিয়াছিল। জাতির জাতিত্ব বজায় রাখিয়া এই নবযুগের প্রতিষ্ঠাই ছিল তাঁহার একমাত্র সাধনা। আত্মনিহিত শক্তির প্রেরণায় বাংলা ভাষার প্রতি তাঁহার দৃষ্টি পড়িল। যে নূতন জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রচণ্ড আক্রমণে প্রাচীন সামাজের ভিত্তি দুলিতে আরম্ভ করিয়াছিল, তাহাকে অবিলম্বে ধারণ করিয়া আত্মসাৎ করিবার জন্য উপযুক্ত ভাষা নির্ম্মাণ করিতে হইবে— ‘বঙ্গদর্শনের প্রথম সূচনায় সেই অভিপ্রায়ই ব্যক্ত হইয়াছে। নিজ ভাষার ভিতর দিয়া পরিচয় না হইলে কোন বিদ্যাই জাতির পক্ষে স্বাস্থ্যকর হয় না-নিজ ভাষার ভিতর দিয়াই তাহাকে আত্মসাৎ করা সম্ভব। এই ভাষার সাহায্যে যে সাহিত্য তিনি গড়িয়াছিলেন, নিছক সৌন্দৰ্য্যপিপাসা চরিতার্থ করাই তাহার উদ্দেশ্য ছিল না। তিনি জাতির মধ্যে চিন্তাশীলতা, রসবোধ, ইতিহাস-বিজ্ঞানের আলোচনা প্রসারিত করিবার জন্যই বঙ্গভারতীর উদ্বোধন করিয়াছিলেন,—তাঁহার উদ্দেশ্য ছিল ধর্ম্মসংস্থাপন ও চিত্তশুদ্ধি। কৃষ্ণচরিত্রে তিনি যে আদর্শ-মানবের চরিত্র কীর্ত্তন করিয়াছেন, ‘ধৰ্ম্মতত্ত্ব’ ও অন্যান্য প্রবন্ধে তিনি যে মানব-ধর্ম্মের ব্যাখ্যা করিয়াছেন—সেই আদর্শ-মানবতার মন্ত্রে দেশবাসীকে দীক্ষিত করিবার জন্যই এই সাহিত্য-যজ্ঞে সকলকে আহ্বান করিয়াছিলেন। ভারতী তাঁহার লীলা-সহচরী ছিল না—এই যজ্ঞেরই দেবতা ছিল। রবীন্দ্রনাথ লিখিয়াছেন, ‘সাহিত্যের মধ্যে দুইশ্রেণীর যোগী দেখা যায়, জ্ঞানযোগী ও কর্ম্মযোগী। বঙ্কিম সাহিত্যের কর্ম্মযোগী ছিলেন।’ বঙ্কিম সম্বন্ধে এই কথাটি বিশেষ করিয়া মনে রাখা উচিত। তিনি যদি সাহিত্যসৃষ্টির আনন্দেই বিভোর থাকিতেন তবে আপনার সাধনা লইয়া আপনিই থাকিতেন, অপরকে এমন করিয়া যোগ দিতে আহ্বান করিতেন না। যে সকল বিষয়ে তাঁহার বিশেষ অধিকার ছিল না, অপরকে উৎসাহিত করিবার জন্য, নিজের প্রতিভাকে ক্ষুণ্ণ করিয়া, তিনি সে সকলের বোঝা বহিয়াছেন। বিজ্ঞান ও ইতিহাস, এবং বিশেষ করিয়া ইতিহাস-উদ্ধারের জন্য তাঁহার সেই ব্যাকুলতা যখন লক্ষ্য করি, তখন দেশের কল্যাণ কামনায় তাঁহার এই আত্মাহুতির পরিচয়ে স্তম্ভিতে হইতে হয়। আত্মাহুতি নয় ত কি? এত বড় কবি হইয়াও কাব্যরচনায় ভ্রূক্ষেপ নাই—উপন্যাস অপেক্ষা বাঙালীর ইতিহাস গড়িবার জন্য কি ব্যাকুল বাসনা! ইতিহাস না জানিলে বাঙালী যে মানুষ হইবে না।

“বাঙ্গালার ইতিহাস চাই।…নহিলে বাঙ্গালী কখনও মানুষ হইবে না… বাঙ্গালার ইতিহাস চাই। নহিলে বাঙ্গালার ভরসা নাই। কে লিখিবে?

“তুমি লিখিবে, আমি লিখিব, সকলেই লিখিবে। যে বাঙ্গালী তাহাকেই লিখিতে হইবে। মা যদি মরিয়া যান, তবে মার গল্প করিতে কত আনন্দ। আর এই আমাদিগের সর্বসাধারণের মা জন্মভূমি বাঙ্গালা দেশ, ইহার গল্প করিতে কি আমাদের আনন্দ নাই?…”

“ইয়ুরোপ সভ্য কতদিন? পঞ্চদশ শতাব্দীতে অর্থাৎ চারিশত বৎসর পূর্ব্বে ইয়ুরোপ আমাদিগের অপেক্ষাও অসভ্য ছিল। একটি ঘটনায় ইয়ুরোপ সভ্য হইয়া গেল। অকস্মাৎ বিস্মৃত অপরিজ্ঞাত গ্রীক সাহিত্য ইউরোপ ফিরিয়া পাইল; ফিরিয়া পাইয়া, যেমন বর্ষার জলে শীর্ণা স্রোতস্বতী কূলপরিপ্লাবিনী হয়, যেমন মুমূর্ষু রোগী দৈব ঔষধে যৌবনের বল প্রাপ্ত হয়, ইয়ুরোপের অকস্মাৎ সেইরূপ অভ্যুদয় হইল। আজ পেত্রার্ক, কার্ল লুথার, আজ গেলিলিও, কাল বেকন,—ইয়ুরোপের এইরূপ অকস্মাৎ সৌভাগ্যোচ্ছ্বাস হইল। আমাদিগেরও একবার সেই দিন হইয়াছিল। অকস্মাৎ নবদ্বীপে চৈতন্যচন্দ্রোদয়; তারপর রূপ-সনাতন প্রভৃতি অসংখ্য কবি, ধৰ্ম্মতত্ত্ববিৎ পণ্ডিত। এদিকে দর্শনে রঘুনাথ শিরোমণি, গদাধর, জগদীশ; স্মৃতিতে রঘুনন্দন, এবং তৎপরগামিগণ। আবার বাংলা কাব্যের জলোচ্ছ্বাস। বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস চৈতন্যের পূর্ব্বগামী। কিন্তু তাহার পরে চৈতন্যের পরবর্তিনী যে বাঙ্গালা কৃষ্ণবিষয়িণী কবিতা, তাহা অপরিমেয়, তেজস্বিনী, জগতে অতুলনীয়! সে কোথা হইতে?

“আমাদের এই Renaissance কোথা হইতে? কোথা হইতে সহসা এই জাতির মানসিক উদ্দীপ্তি হইল? এ রোশনাইয়ে কে কে মশাল ধরিয়াছিল? ধৰ্ম্মবেত্তা কে? শাস্ত্রবেত্তা কে? দর্শনবেত্তা কে? ন্যায়বেত্তা কে? কে কবে জন্মিয়াছিল? কে কি লিখিয়াছিল? কাহার জীবন-চরিত কি? কাহার লেখার কি ফল? এ আলোক নিবিল কেন? নিবিল বুঝি মোগলের শাসনে। সকল কথা প্রমাণ কর।….”*

[* ‘বিবিধ প্রবন্ধ’, দ্বিতীয় খণ্ড [‘বাঙ্গালার ইতিহাস সম্বন্ধে কয়েকটি কথা’]

হায় বঙ্কিম! তুমি কি ‘স্বপ্নই দেখিয়াছিলে—দিবাস্বপ্নই বটে! আজিকার দিনে বাঙালীর জীবনে যে বান ডাকিয়াছে তাহা কি বঙ্কিমেরও কল্পনার অগোচর ছিল! আজ আবার যে Renaissance আসিয়াছে—সে রোশনাইয়ে কাহারা মশাল ধরিয়াছে? ন্যুট হামসুন, গোর্কি, যোহান বোয়ের! মেটারলিঙ্কীয় কাব্যবাদ, নব্য জ্যার্মনির চিন্তাধারা, ‘পীত-নাট্য’ প্রভৃতির গবেষণায় বাঙালীর ললাট উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছে। শ্মশান-ভূমির পচ্যমান আবর্জ্জনায় আলেয়ার দীপ্তি দেখা যাইতেছে! কিন্তু যাহা বলিতেছিলাম। বঙ্কিম সাহিত্যের ধ্যানযোগী ছিলেন না, কৰ্ম্মযোগী ছিলেন, এই কথা মনে না রাখিয়া আজ যখন আমরা তাঁহার উপন্যাসগুলিরই বিচার করি, আর কোনও সম্পর্কে তাঁহার নাম পর্য্যন্ত উচ্চারণ করি না, তখন শুধু মূর্খতা নয়—গুরুতর পাতকের ভাগী হই।

বঙ্কিম বলিয়াছিলেন, “কাব্যের মুখ্য উদ্দেশ্য নীতিজ্ঞান নহে, কিন্তু নীতিজ্ঞানের যে উদ্দেশ্য কাব্যেরও সেই উদ্দেশ্য—অর্থাৎ চিত্তশুদ্ধি।”* কিন্তু চিত্তশুদ্ধি না হইলেও কাব্যের রসাস্বাদন সম্ভব। অথবা কাব্যের রসাস্বাদন সময়ে সেই মুহূর্ত্তের জন্যও চিত্তশুদ্ধি ঘটে। এই জন্যই —Music hath charms to soothe a savage breast।’ আসল কথা, খাঁটি কাব্যের উদ্দেশ্য নীতিজ্ঞান ত নহেই, কাব্যের কোনও লৌকিক উদ্দেশ্য নাই; তথাপি উৎকৃষ্ট কাব্য পাঠ করার ফলে চিত্তশুদ্ধি হয়; বরং যে কাব্য যত খাঁটি, অর্থাৎ যাহা যত উদ্দেশ্যহীন, স্বাধীন, লীলাময়—তাহার দ্বারা তত উৎকৃষ্ট রসের উদ্বোধন হয়, তাহাতেই চিত্তশুদ্ধি হয়। কিন্তু তাহা স্থায়ী নয়, ক্ষণিক। এজন্য বঙ্কিম স্বতন্ত্র কাব্যনীতি স্বীকার করেন নাই। তিনি কুকাব্য ও সুকাব্য ভেদ করিয়াছেন এবং বলিয়াছেন “যাহারা কুকাব্য প্রণয়ন করিয়া পরের চিত্ত কলুষিত করিতে চেষ্টা করে তাহারা তস্করদিগের ন্যায় মনুষ্যজাতির শত্রু, এবং তাহাদিগকে তস্করদিগের ন্যায় শারীরিক দণ্ডের দ্বারা দণ্ডিত করা বিধেয়।”*** তথাপি, সমাজনীতির বিরোধী হইলেই কাব্য যে কুকাব্য হয়, এমন কথা তিনি বলেন নাই। এক স্থানে কৃষ্ণের ব্রজলীলাকীর্ত্তনসম্বন্ধে তিনি বলিতেছেন, “যে এই ব্রজলীলার প্রকৃত তাৎপর্য্য বুঝিয়াছে, এবং যাহার চিত্ত শুদ্ধ হইয়াছে, তাহার পক্ষে ইহার ফল সুফল।” অর্থাৎ প্রকৃত রসিক না হইলে এইরূপ কাব্য তাহার পক্ষে অনিষ্টকর। এখানে চিত্তশুদ্ধির অর্থ রস-জ্ঞান। তাহা হইলে কথাটা দাঁড়ায় এইরূপ। কাব্যের কোনও উদ্দেশ্য নাই; কারণ কাব্যরচনার মূলে যে প্রেরণা আছে তাহা কোনও উদ্দেশ্য নয়—সেটা কবিচিত্তের স্বতঃস্ফূর্ত্ত লীলা। তথাপি, তাহার ফলে, কবির কোনও উদ্দেশ্য ব্যতিরেকেই, পাঠক—চিত্তে রস সঞ্চার হয়। যেখানে রসের উদ্রেক না হইয়া একটা কু বা সু প্রবৃত্তির উত্তেজনা হয়, সেখানে পাঠকই দায়ী—কাব্যের ফলাফল পাঠকের চিত্তবৃত্তির উৎকর্ষ বা অপকর্ষের উপর নির্ভর করে। কিন্তু যেখানে লেখকই দায়ী, অর্থাৎ, যে-লেখার মধ্যে একটা সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য ফুটিয়া ওঠে, এবং সে উদ্দেশ্য কুপ্রবৃত্তির উত্তেজনা—বঙ্কিম তাহাকেই কুকাব্য বলিতেছেন। বলা উচিত—কুৎসিত অ-কাব্য। সবল সুস্থ স্বতঃস্ফূর্ত্ত রস-কল্পনায় যাহার জন্ম হয় নাই, তাহার ফলে রসোদ্রেক হইতে পারে না। এজন্য রসবিচারে এ সকল রচনার স্থান নাই। যেমন সদুদ্দেশ্যপূর্ণ অকাব্য পাঠে নীতিজ্ঞানী অরসিক ব্যক্তির হৃদয় প্রফুল্ল হয়, তেমনি অসৎ উদ্দেশ্যপূর্ণ অ-কাব্য পাঠ করিয়া নীতিহীন অরসিক ব্যক্তির সুখ হয়। এ সকল রচনা-সম্বন্ধে বঙ্কিমের শাসন-ব্যবস্থাই সমীচীন। বলা বাহুল্য, এ আলোচনায় আমি যাহা বলিলাম তাহার সবটাই বঙ্কিমের কথা নয়। বঙ্কিম সুকাব্য ও কুকাব্য-ভেদ মানিতেন, এবং কাব্যের উদ্দেশ্যও স্বীকার করিতেন। **** তিনি পূর্ণ-মনুষ্যত্বের আদর্শ-সন্ধানে ব্যস্ত ছিলেন, তাঁহার ধ্যান ছিল ধর্ম্ম; এ ধর্ম্মের লক্ষ্য মানুষের মনুষ্যত্ব-সাধন। একথা পূৰ্ব্বে বলিয়াছি। তাই বঙ্কিমের উপন্যাসে আদর্শবাদ প্রবল। যাহাকে আমরা সাহিত্যের Realism বলি, সেই Realism-এর প্রেরণায় তিনি অল্পই লিখিয়াছেন। সর্ব্বত্র তিনি একটা বড় ভাব ও বৃহৎ আদর্শ ফুটাইতে চেষ্টা করিয়াছেন। সাহিত্যকে খাঁটি শিল্পকলার আদর্শে কল্পনা না করিয়াও তিনি যাহা সৃষ্টি করিয়াছেন, তাহা কাব্যাংশেও কি মহৎ, কত সুন্দর ও মহিমময়!

[** ‘উত্তরচরিত’-সমালোচনা দ্রষ্টব্য-বিবিধ প্রবন্ধ, প্রথম খণ্ড।

*** ‘অনুশীলন’, সপ্তবিংশ অধ্যায়।

**** “তবে এ বিষয়ে সতর্ক হওয়া উচিত। চিত্তরঞ্জিনী বৃত্তির অনুচিত অনুশীলন ও স্ফূর্ত্তিতে আর কতকগুলি কার্য্যকারিণী বৃত্তি দুৰ্ব্বল হইয়া পড়ে। এই জন্য সচরাচর লোকের বিশ্বাস যে কবিরা কাব্য ভিন্ন অন্যান্য বিষয়ে অকর্ম্মণ্য হয়। এ কথার যাথার্থ্য এই পৰ্য্যন্ত যে, যাহারা চিত্তরঞ্জিনী বৃত্তির অনূচিত অনুশীলন করে, অন্য বৃত্তিগুলির সহিত সামঞ্জস্য রক্ষা করিবার চেষ্টা পায় না, অথবা ‘আমি প্রতিভাশালী, আমাকে কাব্যরচনা ভিন্ন আর কিছুই করিতে নাই’ এই ভাবিয়া যাঁহারা ফুলিয়া বসিয়া থাকেন তাঁহারাই অকর্ম্মণ্য হইয়া পড়েন। …… বিজ্ঞান ও ধর্ম্মোপদেশ মনুষ্যত্বের জন্য যেরূপ প্রয়োজনীয়, কাব্যও সেইরূপ। যিনি তিনের মধ্যে একটিকে প্রাধান্য দিতে চাহেন, তিনি মনুষ্যত্ব বা ধর্ম্মের যথার্থ মৰ্ম্ম বুঝেন নাই।” ‘অনুশীলন’, সপ্তবিংশতি অধ্যায় [‘চিত্তরঞ্জিনী বৃত্তি’]।]

তাঁহার প্রথম উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’তে সাহিত্যিক প্রেরণা ছাড়া আর কিছু ছিল না। ‘দুর্গেশনন্দিনী’ বাংলা ভাষার প্রথম রোমান্স-ইংরেজী রোমান্সের বাঁধা আদর্শে রচিত। ‘মৃণালিনী’, ‘যুগলাঙ্গুরীয়’, ‘রাধারাণী’ও এই একই আদর্শে রচিত। কেবল, ‘মৃণালিনী’র কল্পনা-মূলে স্বদেশপ্রেম সৰ্ব্বপ্রথম দেখা দিয়াছে। দ্বিতীয় উপন্যাস ‘কপালকুণ্ডলা’ একখানি উৎকৃষ্ট কাব্য। তারপর সমাজ-সমস্যা ও চরিত্রনীতির প্রেরণায় চতুর্থ উপন্যাস ‘বিষবৃক্ষ’; ‘চন্দ্রশেখর’ ও ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ এই একই প্রেরণার ফল। ‘আনন্দমঠ’ ও ‘রাজসিংহে’ দেশাত্মবোধ, ‘দেবী চৌধুরাণী’ ও ‘সীতারামে’ ধর্ম্মসমস্যা, ‘রজনী’তে মনস্তত্ত্ব এবং ‘ইন্দিরা’য় শুধু গল্প-রচনার আনন্দ আছে। খাঁটি উপন্যাস, অর্থাৎ যেগুলিতে সমাজনৈতিক বা ধৰ্ম্মনৈতিক কোনও অভিপ্রায় নাই, সেগুলির সংখ্যা খুবই কম, এবং তাহার মধ্যে ‘কপালকুণ্ডলা’ই উৎকৃষ্ট কাব্য হইয়াছে। যেগুলিতে স্বদেশ, সমাজ, ধর্ম্ম বা নীতির প্রেরণা আছে, সেইগুলিতেই স্থানে স্থানে বঙ্কিমের কল্পনার চরম স্ফূৰ্ত্তি হইয়াছে; চরিত্রের মহিমা ও ঘটনাসন্নিবেশের চাতুর্য্যে সেগুলি নাটকীয় সৌন্দর্য্যে মণ্ডিত হইয়াছে। সমস্যার আওতায় বহুস্থানে গুরুতর ত্রুটি ঘটিলেও বঙ্কিমের যাহা কিছু শক্তি, তাহা যেন এই সমস্যার সংঘাতেই উপলাহত ইস্পাত ফলকের মত স্ফুলিঙ্গবৃষ্টি করিয়াছে! অথচ এই ব্যক্তিই ভারতীর অতুলন স্নেহ-হাস্য উপেক্ষা করিয়া, বেদীর নীচে না বসিয়া-মন্দির-রক্ষায় তৎপর হইয়াছিল। চিত্তশুদ্ধি ও মনুষ্যত্ব আগে, কাব্য পরে—এ কথা বলিবার বঙ্কিমের কি প্রয়োজন ছিল? এ ভাবনা তাঁহার কেন? -কি জন্য? বঙ্কিম সম্বন্ধে সেই কথাটাই ভাবিবার সময় আসিয়াছে।

তথাপি বঙ্কিমের উপন্যাসের চেয়ে বঙ্কিম বড়। তিনি শুধু সাহিত্যস্রষ্টা শিল্পী নহেন— নব্য বঙ্গসাহিত্যের প্রতিষ্ঠাতা। যে গুণে তাহা সম্ভব হইয়াছিল তাহা এই যে, তিনি যত বড় শিল্পী ছিলেন তার চেয়ে বড় ছিল তাঁহার পৌরুষ। তাঁহার গ্রন্থাবলী পাঠ করিতে করিতে সর্ব্বাগ্রে এবং সর্ব্বদাই মনে হয়—Ecce Homo! Behold the Man! “The first and last word in literature as in life is character,”—এই character আমাদের সাহিত্যে এত বড় আর কাহারও ছিল না। সজ্ঞান আদর্শনিষ্ঠা, নিজের প্রতি গভীর বিশ্বাস, সুস্পষ্ট ও বলিষ্ঠ চিন্তাশক্তি, এবং সর্ব্বশেষে সমাজের কল্যাণের জন্য আপনাকে উৎসর্গ করিবার নিয়ত আকাঙ্ক্ষা—এই সকল গুণ একত্র হইলে জীবনে যে সত্য আচরিত হয়, সাহিত্যেও সেইরূপ সত্যের প্রতিষ্ঠা হয়, সেই সত্যের জোরেই সাহিত্য বড় হয় ও বাঁচিয়া থাকে। সাহিত্য-রচনায় আত্মবিস্মৃত শিল্পী যে আনন্দ-মুক্তির আস্বাদ পায়, বঙ্কিমের তাহাতে লোভ ছিল না; সে বিষয়ে এতখানি শক্তি থাকা সত্ত্বেও তিনি নিজের সেই মুক্তির পরিবর্তে জাতির চিত্তশুদ্ধি চাহিয়াছিলেন। যে মনুষ্যত্বের বিকাশ হইলে, জাতির জীবনে উৎকৃষ্ট সাহিত্য আপনি সম্ভব হয়, বঙ্কিম সেই আদর্শের প্রতিষ্ঠায় তাঁহার সকল শক্তি নিয়োগ করিয়াছিলেন। সুপ্রসিদ্ধ ইংরেজ লেখক জন মর্লির সাহিত্য-সাধনার পরিচয় দিয়া একজন সমালোচক বলিয়াছেন—“ Literature, in a word, was with John Morley not so much an end in itself as a means to a farther end, which was social, not individual. “বঙ্কিমের মত একজন সাহিত্যস্রষ্টার পক্ষেও এ কথা খাটে, ইহাই বঙ্কিম-প্রতিভার গৌরব।

বঙ্কিম যাহা চাহিয়াছিলেন তাহা হয় নাই। আমরা বঙ্কিমকে ভাল করিয়া বুঝি নাই, এমন কি ইতিমধ্যেই তাঁহাকে ভুলিতে বসিয়াছি। আমরা তাঁহার উপন্যাসই পড়ি—হয় ত’ তাহাও আর পড়ি না—পড়িয়া Literary Aesthetics-এর সূত্র ধরিয়া তাহার দোষগুণ বিচার করি; হয় ত ‘ভালো লাগে না’, বলিয়া এই সাহিত্যিক উন্নতির যুগে নাসিকা কুঞ্চিত করিয়া সূক্ষ্ম ও মার্জিত রুচির পরিচয় দিই। বঙ্কিম যাহা চাহিয়াছিলেন তাহা হয় নাই; যেটুকু মোড় ফিরিতেছিল, অৰ্দ্ধপথেই তাহা ঘুরিয়া গিয়াছে। তিনি যে ধর্ম্মের উপর মনুষ্যত্ব এবং মনুষ্যত্বের প্রয়োজনে সাহিত্যের প্রতিষ্ঠা করিতে চাহিয়াছিলেন, তাহাকে দূর করিয়া আমরা এখন সর্ব্ববন্ধনমুক্ত হইয়া সাহিত্যের কামলোকে বিচরণ করিতেছি—জাতিহিসাবেও ভব-বন্ধন-মুক্ত হইতে বোধ হয় আর বেশি বিলম্ব নাই। আমরা উচ্চাঙ্গের সাহিত্য আলোচনা করি—সৃষ্টি করিতে পারি না; বিশুদ্ধ আর্ট-তত্ত্বের রোমন্থন করি—কিন্তু জীবনে শক্তি সঞ্চার হইবে কিসে সে ভাবনা ভাবি না। জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিব্যক্তির মূলে যে জ্ঞান, ভক্তি ও কর্মসাধনার প্রয়োজন আছে তাহা আমাদের নিকট এতই তুচ্ছ, এবং সাহিত্যের আদর্শ এতই উচ্চ যে, যে-বস্তু সাহিত্যও নয়—যাহার পঙ্কিল উচ্ছ্বাসে জাতীয় জীবনের অধঃপাত সূচিত হইতেছে, তাহার সমালোচনাও আর্টের দিক দিয়াই করিতে হইবে, ধৰ্ম্ম বা সমাজনীতির কথা সেখানেও চলিব না! যদি সাহিত্যহিসাবে আলোচনার যোগ্য হয়—আলোচনা কর, না হয়, কোন আলোচনাই করিও না—ইহাই dilettante—দিগের অভিমত! যেন সাহিত্যের আদর্শই জীবনের একমাত্র আদর্শ, আর যাহা কিছু—তাহার পক্ষ হইতে কোন বিষয়েই কিছু বলিবার নাই। তাই এ দুর্দ্দিনে বিশেষ করিয়া বঙ্কিমকেই স্মরণ করি।

(বৈশাখ, ১৩৩৫)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বঙ্কিমচন্দ্র

বঙ্কিমচন্দ্র

যেকালে বঙ্কিমের নবীনা প্রতিভা লক্ষ্মীরূপে সুধাভাণ্ড হস্তে লইয়া বাংলাদেশের সম্মুখে আবির্ভূত হইলেন তখনকার প্রাচীন লোকেরা বঙ্কিমের রচনাকে সসম্মান আনন্দের সহিত অভ্যর্থনা করেন নাই।

সেদিন বঙ্কিমকে বিস্তর উপহাস গ্লানি সহ্য করিতে হইয়াছিল। তাঁহার উপর একদল লোকের সুতীব্র বিদ্বেষ ছিল, এবং ক্ষুদ্র যে লেখকসম্প্রদায় তাঁহার অনুকরণের বৃথা চেষ্টা করিত তাহারাই আপন ঋণ গোপন করিবার প্রয়াসে তাঁহাকে সর্বাপেক্ষা অধিক গালি দিত।

আবার এখনকার যে নূতন পাঠক ও লেখক-সম্প্রদায় উদ্‌ভূত হইয়াছেন তাঁহারাও বঙ্কিমের পরিপূর্ণ প্রভাব হৃদয়ের মধ্যে অনুভব করিবার অবকাশ পান নাই তাঁহারা বঙ্কিমের গঠিত সাহিত্যভূমিতেই একেবারে ভূমিষ্ঠ হইয়াছেন, বঙ্কিমের নিকট যে তাঁহারা কতরূপে কতভাবে ঋণী তাহার হিসাব বিচ্ছিন্ন করিয়া লইয়া তাঁহারা দেখিতে পাইতেছেন না।

কিন্তু বর্তমান লেখকের সৌভাগ্যক্রমে আমাদের সহিত যখন বঙ্কিমের প্রথম সাক্ষাৎকার হয় তখন সাহিত্যপ্রভৃতিসম্বন্ধে কোনোরূপ পূর্বসংস্কার আমাদের মনে বদ্ধমূল হইয়া যায় নাই এবং বর্তমান কালের নূতন ভাবপ্রবাহও আমাদের নিকট অপরিচিত অনভ্যস্ত ছিল। তখন বঙ্গসাহিত্যেরও যেমন প্রাতঃসন্ধ্যা উপস্থিত আমাদেরও সেইরূপ বয়ঃসন্ধিকাল। বঙ্কিম বঙ্গসাহিত্যে প্রভাতের সূর্যোদয় বিকাশ করিলেন, আমাদের হৃৎপদ্ম সেই প্রথম উদ্‌ঘাটিত হইল।

পূর্বে কী ছিল এবং পরে কী পাইলাম তাহা দুই কালের সন্ধিস্থলে দাঁড়াইয়া আমরা এক মুহূর্তেই অনুভব করিতে পারিলাম। কোথায় গেল সেই অন্ধকার,সেই একাকার, সেই সুপ্তি, কোথায় গেল সেই বিজয়-বসন্ত, সেই গোলেবকাগুলি, সেই-সব বালক-ভুলানো কথা– কোথা হইতে আসিল এত আলোক, এত আশা, এত সংগীত, এত বৈচিত্র্য। বঙ্গদর্শন যেন তখন আষাঢ়ের প্রথম বর্ষার মতো “সমাগতো রাজবদুন্নত-ধ্বনিঃ’। এবং মুষলধারে ভাববর্ষণে বঙ্গসাহিত্যের পূর্ববাহিনী পশ্চিমবাহিনী সমস্ত নদী-নির্ঝরিণী অকস্মাৎ পরিপূর্ণতা প্রাপ্ত হইয়া যৌবনের আনন্দবেগে ধাবিত হইতে লাগিল। কত কাব্য নাটক উপন্যাস কত প্রবন্ধ কত সমালোচনা কত মাসিকপত্র কত সংবাদপত্র বঙ্গভূমিকে জাগ্রত প্রভাতকলরবে মুখরিত করিয়া তুলিল। বঙ্গভাষা সহসা বাল্যকাল হইতে যৌবনে উপনীত হইল।

আমরা কিশোরকালের বঙ্গসাহিত্যের মধ্যে ভাবের সেই নবসমাগমের মহোৎসব দেখিয়াছিলাম; সমস্ত দেশ ব্যাপ্ত করিয়া যে-একটি আশার আনন্দ নূতন হিল্লোলিত হইয়াছিল তাহা অনুভব করিয়াছিলাম– সেইজন্য আজ মধ্যে মধ্যে নৈরাশ্য উপস্থিত হয়। মনে হয় সেদিন হৃদয়ে যে অপরিমেয় আশার সঞ্চার হইয়াছিল তদনুরূপ ফল লাভ করিতে পারি নাই। সে জীবনের বেগ আর নাই। কিন্তু এ নৈরাশ্য অনেকটা অমূলক। প্রথম-সমাগমের প্রবল উচ্ছ্বাস কখনো স্থায়ী হইতে পারে না। সেই নব আনন্দ নবীন আশার স্মৃতির সহিত বর্তমানের তুলনা করাই অন্যায়। বিবাহের প্রথম দিনে যে রাগিণীতে বংশীধ্বনি হয় সে রাগিণী চিরদিনের নহে। সেদিন কেবল অবিমিশ্র আনন্দ এবং আশা, তাহার পর হইতে বিচিত্র কর্তব্য, মিশ্রিত দুঃখসুখ, ক্ষুদ্র বাধাবিঘ্ন, আবর্তিত বিরহমিলন– তাহার পর হইতে গভীর গম্ভীর ভাবে নানা পথ বাহিয়া নানা শোকতাপ অতিক্রম করিয়া সংসারপথে অগ্রসর হইতে হইবে, প্রতিদিন আর সে নহবত বাজিবে না। তথাপি সেই একদিনের উৎসবের স্মৃতি কঠোর কর্তব্যপথে চিরদিন আনন্দ সঞ্চার করে।

বঙ্কিমচন্দ্র স্বহস্তে বঙ্গভাষার সহিত যেদিন নবযৌবনপ্রাপ্ত ভাবের পরিণয় সাধন করাইয়াছিলেন সেইদিনের সর্বব্যাপী প্রফুল্লতা এবং আনন্দ-উৎসব আমাদের মনে আছে। সেদিন আর নাই। আজ নানা লেখা নানা মত নানা আলোচনা আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে– আজ কোনোদিন-বা ভাবের স্রোত মন্দ হইয়া আসে কোনোদিন- বা অপেক্ষাকৃত পরিপুষ্ট হইয়া উঠে।

এইরূপই হইয়া থাকে এবং এইরূপই হওয়া আবশ্যক। কিন্তু কাহার প্রসাদে এরূপ হওয়া সম্ভব হইল সে কথা স্মরণ করিতে হইবে। আমরা আত্মাভিমানে সর্বদাই তাহা ভুলিয়া যাই।

ভুলিয়া যে যাই তাহার প্রথম প্রমাণ, রামমোহন রায়কে আমাদের বর্তমান বঙ্গদেশের নির্মাণকর্তা বলিয়া আমরা জানি না। কী রাজনীতি, কী বিদ্যাশিক্ষা, কী সমাজ, কী ভাষা– আধুনিক বঙ্গদেশে এমন কিছুই নাই রামমোহন রায় স্বহস্তে যাহার সূত্রপাত করিয়া যান নাই। এমন-কি, আজ প্রাচীন শাস্ত্রালোচনার প্রতি, দেশের যে এক নূতন উৎসাহ দেখা যাইতেছে রামমোহন রায় তাহারও পথপ্রদর্শক। যখন নব শিক্ষাভিমানে স্বভাবতই পুরাতন শাস্ত্রের প্রতি অবজ্ঞা জন্মিবার সম্ভাবনা, তখন রামমোহন রায় সাধারণের অনধিগম্য বিস্মৃতপ্রায় বেদ-পুরাণ-তন্ত্র হইতে সারোদ্ধার করিয়া প্রাচীন শাস্ত্রের গৌরব উজ্জ্বল রাখিয়াছিলেন।

বঙ্গদেশ অদ্য সেই রামমোহন রায়ের নিকট কিছুতেই হৃদয়ের সহিত কৃতজ্ঞতা স্বীকার করিতে চাহে না।

রামমোহন বঙ্গসাহিত্যকে গ্রানিট-স্তরের উপর স্থাপন করিয়া নিমজ্জনদশা হইতে উন্নত করিয়া তুলিয়াছিলেন, বঙ্কিমচন্দ্র তাহারই উপর প্রতিভার প্রবাহ ঢালিয়া স্তরবদ্ধ পলিমৃত্তিকা ক্ষেপণ করিয়া গিয়াছেন। আজ বাংলা ভাষা কেবল দৃঢ় বাসযোগ্য নহে, উর্বরা শস্যশ্যামলা হইয়া উঠিয়াছে। বাসভূমি যথার্থ মাতৃভূমি হইয়াছে। এখন আমাদের মনের খাদ্য প্রায় ঘরের দ্বারেই ফলিয়া উঠিতেছে।

মাতৃভাষার বন্ধ্যদশা ঘুচাইয়া যিনি তাহাকে এমন গৌরবশালিনী করিয়া তুলিয়াছেন তিনি বাঙালির যে কী মহৎ কী চিরস্থায়ী উপকার করিয়াছেন সে কথা যদি কাহাকেও বুঝাইবার আবশ্যক হয় তবে তদপেক্ষা দুর্ভাগ্য আর কিছুই নাই। তৎপূর্বে বাংলাকে কেহ শ্রদ্ধাসহকারে দেখিত না। সংস্কৃত পণ্ডিতেরা তাহাকে গ্রাম্য এবং ইংরেজি পণ্ডিতেরা বর্বর জ্ঞান করিতেন। বাংলা ভাষায় যে কীর্তি উপার্জন করা যাইতে পারে সে কথা তাঁহাদের স্বপ্নের অগোচর ছিল। এইজন্য কেবল স্ত্রীলোক ও বালকদের জন্য অনুগ্রহপূর্বক দেশীয় ভাষায় তাঁহারা সরল পাঠ্য-পুস্তক রচনা করিতেন। সেই-সকল পুস্তকের সরলতা ও পাঠযোগ্যতা সম্বন্ধে যাঁহাদের জানিবার ইচ্ছা আছে তাঁহারা রেভারেণ্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়-রচিত পূর্বতন এন্ট্রেন্স-পাঠ্য বাংলা গ্রন্থে দন্তস্ফুট করিবার চেষ্টা করিয়া দেখিবেন। অসম্মানিত বঙ্গভাষাও তখন অত্যন্ত দীন মলিন ভাবে কালযাপন করিত। তাহার মধ্যে যে কতটা সৌন্দর্য কতটা মহিমা প্রচ্ছন্ন ছিল তাহা তাহার দারিদ্র্য ভেদ করিয়া স্ফূর্তি পাইত না। যেখানে মাতৃভাষার এত অবহেলা সেখানে মানবজীবনের শুষ্কতা শূন্যতা দৈন্য কেহই দূর করিতে পারে না।

এমন সময়ে তখনকার শিক্ষিতশ্রেষ্ঠ বঙ্কিমচন্দ্র আপনার সমস্ত শিক্ষা সমস্ত অনুরাগ সমস্ত প্রতিভা উপহার লইয়া সেই সংকুচিতা বঙ্গভাষার চরণে সমর্পণ করিলেন; তখনকার কালে কী যে অসামান্য কাজ করিলেন তাহা তাঁহারই প্রসাদে আজিকার দিনে আমরা সম্পূর্ণ অনুমান করিতে পারি না।

তখন তাঁহার অপেক্ষা অনেক অল্পশিক্ষিত প্রতিভাহীন ব্যক্তি ইংরাজিতে দুই ছত্র লিখিয়া অভিমানে স্ফীত হইয়া উঠিতেন। ইংরাজি সমুদ্রে তাঁহারা যে কাঠবিড়ালির মতো বালির বাঁধ নির্মাণ করিতেছেন সেটুকু বুঝিবার শক্তিও তাঁহাদের ছিল না।

বঙ্কিমচন্দ্র যে সেই অভিমান সেই খ্যাতির সম্ভাবনা অকাতরে পরিত্যাগ করিয়া তখনকার বিদ্বজ্জনের অবজ্ঞাত বিষয়ে আপনার সমস্ত শক্তি নিয়োগ করিলেন ইহা অপেক্ষা বীরত্বের পরিচয় আর কী হইতে পারে! সম্পূর্ণ ক্ষমতাসত্ত্বেও আপন সমযোগ্য লোকের উৎসাহ এবং তাঁহাদের নিকট প্রতিপত্তির প্রলোভন পরিত্যাগ করিয়া একটি অপরীক্ষিত অনাদৃত অন্ধকার পথে আপন নবীন জীবনের সমস্ত আশা-উদ্যম-ক্ষমতাকে প্রেরণ করা কত বিশ্বাস এবং কত সাহসের বলে হয় তাহার পরিমাণ করা সহজ নহে।

কেবল তাহাই নহে। তিনি আপনার শিক্ষাগর্বে বঙ্গভাষার প্রতি অনুগ্রহ প্রকাশ করিলেন না, একেবারেই শ্রদ্ধা প্রকাশ করিলেন। যত-কিছু আশা আকাঙক্ষা সৌন্দর্য-প্রেম মহত্ত্বভক্তি স্বদেশানুরাগ, শিক্ষিত পরিণত বুদ্ধির যত-কিছু শিক্ষালব্ধ চিন্তাজাত ধনরত্ন সমস্তই অকুণ্ঠিতভাবে বঙ্গভাষার হস্তে অর্পণ করিলেন। পরম সৌভাগ্য-গর্বে সেই অনাদর-মলিন ভাষার মুখে সহসা অপূর্ব লক্ষ্মীশ্রী প্রস্ফুটিত হইয়া উঠিল।

তখন, পূর্বে যাঁহারা অবহেলা করিয়াছিলেন তাঁহারা বঙ্গভাষার যৌবনসৌন্দর্যে আকৃষ্ট হইয়া একে একে নিকটবর্তী হইতে লাগিলেন। বঙ্গসাহিত্য প্রতিদিন গৌরবে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিতে লাগিল।

বঙ্কিম যে গুরুতর ভার লইয়াছিলেন তাহা অন্য কাহারো পক্ষে দুঃসাধ্য হইত। প্রথমত, তখন বঙ্গভাষা যে অবস্থায় ছিল তাহাকে যে শিক্ষিত ব্যক্তির সকলপ্রকার ভাবপ্রকাশে নিযুক্ত করা যাইতে পারে ইহা বিশ্বাস ও আবিষ্কার করা বিশেষ ক্ষমতার কার্য। দ্বিতীয়ত, যেখানে সাহিত্যের মধ্যে কোনো আদর্শ নাই, যেখানে পাঠক অসামান্য উৎকর্ষের প্রত্যাশাই করে না, যেখানে লেখক অবহেলাভরে লেখে এবং পাঠক অনুগ্রহের সহিত পাঠ করে, যেখানে অল্প ভালো লিখিলেই বাহবা পাওয়া যায় এবং মন্দ লিখিলেও কেহ নিন্দা করা বাহুল্য বিবেচনা করে, সেখানে কেবল আপনার অন্তরস্থিত উন্নত আদর্শকে সর্বদা সম্মুখে বর্তমান রাখিয়া সামান্য পরিশ্রমে সুলভখ্যাতিলাভের প্রলোভন সম্বরণ করিয়া অশ্রান্ত যত্নে অপ্রতিহত উদ্যমে দুর্গম পরিপূর্ণতার পথে অগ্রসর হওয়া অসাধারণ মাহাত্ম্যের কর্ম। চতুর্দিকব্যাপী উৎসাহহীন জীবনহীন জড়ত্বের মতো এমন গুরুভার আর কিছুই নেই; তাহার নিয়তপ্রবল ভারাকর্ষণ-শক্তি অতিক্রম করিয়া উঠা যে কত নিরলস চেষ্টা ও বলের কর্ম তাহা এখনকার সাহিত্যব্যবসায়ীরাও কতকটা বুঝিতে পারেন, তখন যে আরো কত কঠিন ছিল তাহা কষ্টে অনুমান করিতে হয়। সর্বত্রই যখন শৈথিল্য এবং সে-শৈথিল্য যখন নিন্দিত হয় না তখন আপনাকে নিয়মব্রতে বন্ধ করা মহাসত্ত্বলোকের দ্বারাই সম্ভব।

বঙ্কিম আপনার অন্তরের সেই আদর্শ অবলম্বন করিয়া প্রতিভাবলে যে কার্য করিলেন তাহা অত্যাশ্চর্য। বঙ্গদর্শনের পূর্ববর্তী এবং তাহার পরবর্তী বঙ্গসাহিত্যের মধ্যে যে উচ্চনীচতা তাহা অপরিমিত। দার্জিলিং হইতে যাঁহারা, কাঞ্চনজঙ্ঘার শিখরমালা দেখিয়াছেন তাঁহারা জানেন সেই অভ্রভেদী শৈলসম্রাটের উদয়রবিরশ্মি-সমুজ্জ্বল তুষারকিরীট চতুর্দিকের নিস্তব্ধ গিরি পারিষদবর্গের কত ঊর্ধ্বে সমুত্থিত হইয়াছে। বঙ্কিমচন্দ্রের পরবর্তী বঙ্গসাহিত্য সেইরূপ আকস্মিক অত্যুন্নতি লাভ করিয়াছে; একবার সেইটি নিরীক্ষণ এবং পরিমাণ করিয়া দেখিলেই বঙ্কিমের প্রতিভার প্রভূত বল সহজে অনুমান করা যাইবে।

বঙ্কিম নিজে বঙ্গভাষাকে যে শ্রদ্ধা অর্পণ করিয়াছেন অন্যেও তাহাকে সেইরূপ শ্রদ্ধা করিবে ইহাই তিনি প্রত্যাশা করিতেন। পূর্ব-অভ্যাসবশত সাহিত্যের সহিত যদি কেহ ছেলেখেলা করিতে আসিত তবে বঙ্কিম তাহার প্রতি এমন দণ্ড বিধান করিতেন যে দ্বিতীয়বার সেরূপ স্পর্ধা দেখাইতে সে আর সাহস করিত না।

তখন সময় আরো কঠিন ছিল। বঙ্কিম নিজে দেশব্যাপী একটি ভাবের আন্দোলন উপস্থিত করিয়াছিলেন। সেই আন্দোলনের প্রভাবে কত চিত্ত চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছিল, এবং আপন ক্ষমতার সীমা উপলব্ধি করিতে না পারিয়া কত লোক যে এক লম্ফে লেখক হইবার চেষ্টা করিয়াছিল তাহার সংখ্যা নাই। লেখার প্রয়াস জাগিয়া উঠিয়াছে অথচ লেখার উচ্চ আদর্শ তখনো দাঁড়াইয়া যায় নাই। সেই সময় সব্যসাচী বঙ্কিম এক হস্ত গঠনকার্যে এক হস্ত নিবারণকার্যে নিযুক্ত রাখিয়াছিএলন। এক দিকে অগ্নি জ্বালাইয়া রাখিতেছিলেন আর-এক দিকে ধূম এবং ভস্মরাশি দূর করিবার ভার নিজেই লইয়াছিলেন।

রচনা এবং সমালোচনা এই উভয়কার্যের ভার বঙ্কিম একাকী গ্রহণ করাতেই বঙ্গসাহিত্য এত সত্বর এমন দ্রুত পরিণতি লাভ করিতে সক্ষম হইয়াছিল।

এই দুষ্কর ব্রতানুষ্ঠানের যে ফল তাহাও তাঁহাকে ভোগ করিতে হইয়াছিল। মনে আছে, বঙ্গদর্শনে যখন তিনি সমালোচক-পদে আসীন ছিলেন তখন তাঁহার ক্ষুদ্র শত্রুর সংখ্যা অল্প ছিল না। শত শত অযোগ্য লোক তাঁহাকে ঈর্ষা করিত এবং তাঁহার শ্রেষ্ঠত্ব অপ্রমাণ করিবার চেষ্টা করিতে ছাড়িত না।

কণ্টক যতই ক্ষুদ্র হউক তাহার বিদ্ধ করিবার ক্ষমতা আছে এবং কল্পনাপ্রবণ লেখকদিগের বেদনাবোধও সাধারণের অপেক্ষা কিছু অধিক। ছোটো ছোটো দংশনগুলি যে বঙ্কিমকে লাগিত না, তাহা নহে, কিন্তু কিছুতেই তিনি কর্তব্যে পরাঙ্‌মুখ হন নাই। তাঁহার অজেয় বল, কর্তব্যের প্রতি নিষ্ঠা এবং নিজের প্রতি বিশ্বাস ছিল। তখন জানিতেন, বর্তমানের কোনো উপদ্রব তাঁহার মহিমাকে আচ্ছন্ন করিতে পারিবে না, সমস্ত ক্ষুদ্র শত্রুর ব্যূহ হইতে তিনি অনায়াসে নিষ্ক্রমণ করিতে পারিবেন। এইজন্য চিরকাল তিনি অম্লানমুখে বীরদর্পে অগ্রসর হইয়াছেন, কোনোদিন তাঁহাকে রথবেগ খর্ব করিতে হয় নাই।

সাহিত্যের মধ্যেও দুই শ্রেণীর যোগী দেখা যায়, ধ্যানযোগী এবং কর্মযোগী। ধ্যানযোগী একান্তমনে বিরলে ভাবের চর্চা করেন,তাঁহার রচনাগুলি সংসারী লোকের পক্ষে যেন উপরি-পাওনা, যেন যথালাভের মতো।

কিন্তু বঙ্কিম সাহিত্যে কর্মযোগী ছিলেন। তাঁহার প্রতিভা আপনাতে আপনি স্থিরভাবে পর্যাপ্ত ছিল না। সাহিত্যের যেখানে যাহা-কিছু অভাব ছিল সর্বত্রই তিনি আপনার বিপুল বল এবং আনন্দ লইয়া ধাবমান হইতেন। কী কাব্য, কী বিজ্ঞান, কী ইতিহাস, কী ধর্মতত্ত্ব যেখানে যখনই তাঁহাকে আবশ্যক হইত সেখানে তখনই তিনি সম্পূর্ণ প্রস্তুত হইয়া দেখা দিতেন। নবীন বঙ্গসাহিত্যের মধ্যে সকল বিষয়েই আদর্শ স্থাপন করিয়া যাওয়া তাঁহার উদ্দেশ্য ছিল। বিপন্ন বঙ্গভাষা আর্তস্বরে যেখানেই তাঁহাকে আহ্বান করিয়াছে সেখানেই তিনি প্রসন্ন চতুর্ভূজ মূর্তিতে দর্শন দিয়াছেন।

কিন্তু তিনি যে কেবল অভয় দিতেন, সান্ত্বনা দিতেন, অভাব পূর্ণ করিতেন তাহা নহে, তিনি দর্পহারীও ছিলেন। এখন যাঁহারা বঙ্গসাহিত্যের সারথ্য স্বীকার করিতে চান তাঁহারা দিনে নিশীথে বঙ্গদেশকে অত্যুক্তিপূর্ণ স্তুতিবাক্যে নিয়ত প্রসন্ন রাখিতে চেষ্টা করেন, কিন্তু বঙ্কিমের বাণী কেবল স্তুতিবাদিনী ছিল না, খড়গধারিণীও ছিল। বঙ্গদেশ যদি অসাড় প্রাণহীন না হইত তবে “কৃষ্ণচরিত্রে’ বর্তমান পতিত হিন্দুসমাজ ও বিকৃত হিন্দুধর্মের উপর যে অস্ত্রাঘাত আছে সে আঘাতে বেদনাবোধ এবং কথঞ্চিৎ চেতনা লাভ করিত। বঙ্কিমের ন্যায় তেজস্বী প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তি ব্যতীত আর কেহই লোকাচার-দেশাচারের বিরুদ্ধে এরূপ নির্ভীক স্পষ্ট উচ্চারণে আপন মত প্রকাশ করিতে সাহস করিত না। এমন-কি, বঙ্কিম প্রাচীন হিন্দু-শাস্ত্রের প্রতি ঐতিহাসিক বিচার প্রয়োগ করিয়া তাহার সার এবং অসার ভাগ পৃথক্‌করণ, তাহার প্রামাণ্য এবং অপ্রামাণ্য অংশের বিশ্লেষণ এবং নিঃসংকোচে করিয়াছেন যে এখনকার দিনে তাহার তুলনা পাওয়া কঠিন।

বিশেষত দুই শত্রুর মাঝখান দিয়া তাঁহাকে পথ কাটিয়া চলিতে হইয়াছে। এক দিকে যাঁহারা অবতার মানেন না তাঁহারা শ্রীকৃষ্ণের প্রতি দেবত্বারোপে বিপক্ষ হইয়া দাঁড়ান। অন্য দিকে যাঁহারা শাস্ত্রের প্রত্যেক অক্ষর এবং লোকাচারের প্রত্যেক প্রথাকে অভ্রান্ত বলিয়া জ্ঞান করেন তাঁহারাও, বিচারের লৌহাস্ত্র দ্বারা শাস্ত্রের মধ্য হইতে কাটিয়া কাটিয়া কুঁদিয়া কুঁদিয়া মহত্তম মনুষ্যের আদর্শ অনুসারে দেবতা-গঠনকার্যে বড়ো প্রসন্ন হন নাই। এরূপ অবস্থায় অন্য কেহ হইলে কোনো এক পক্ষকে সর্বতোভাবে আপন দলে পাইতে ইচ্ছা করিতেন। কিন্তু সাহিত্যমহারথী বঙ্কিম দক্ষিণে বামে উভয় পক্ষের প্রতিই তীক্ষ্ণ শরচালন করিয়া অকুণ্ঠিতভাবে অগ্রসর হইয়াছেন– তাঁহার নিজের প্রতিভা কেবল তাঁহার একমাত্র সহায় ছিল। তিনি যাহা বিশ্বাস করিয়াছেন তাহা স্পষ্ট ব্যক্ত করিয়াছেন– বাক্‌চাতুরী দ্বারা আপনাকে বা অন্যকে বঞ্চনা করেন নাই।

কল্পনা এবং কাল্পনিকতা দুইয়ের মধ্যে একটা মস্ত প্রভেদ আছে। যথার্থ কল্পনা, যুক্তি সংযম এবং সত্যের দ্বারা সুনির্দিষ্ট আকারবদ্ধ– কাল্পনিকতার মধ্যে সত্যের ভান আছে মাত্র, কিন্তু তাহা অদ্ভুত আতিশয্যে অসংগতরূপে স্ফীতকায়। তাহার মধ্যে যেটুকু আলোকের লেশ আছে ধূমের অংশ তাহার শতগুণ। যাহাদের ক্ষমতা অল্প তাহারা সাহিত্যে প্রায় এই প্রধূমিত কাল্পনিকতার আশ্রয় লইয়া থাকে– কারণ, ইহা দেখিতে প্রকাণ্ড কিন্তু প্রকৃতপক্ষে অত্যন্ত লঘু। এক শ্রেণীর পাঠকেরা এইরূপ ভূরিপরিমাণ কৃত্রিম কাল্পনিকতার নৈপুণ্যে মুগ্ধ ও অভিভূত হইয়া পড়েন এবং দুর্ভাগ্যক্রমে বাংলায় সেই শ্রেণীর পাঠক বিরল নহে।

এইরূপ অপরিমিত অসংযত কল্পনার দেশে বঙ্কিমের ন্যয় আদর্শ আমাদের পক্ষে অত্যন্ত মূল্যবান। “কৃষ্ণচরিত্রে’ উদ্দাম ভাবের আবেগে তাঁহার কল্পনা কোথাও উচ্চৃঙ্খল হইয়া ছুটিয়া যায় নাই। প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত সর্বত্রই তিনি পদে পদে আত্মসম্বরণপূর্বক যুক্তির সুনির্দিষ্ট পথ অবলম্বন করিয়া চলিয়াছেন। যাহা লিখিয়াছেন তাহাতে তাঁহার প্রতিভা প্রকাশ পাইয়াছে, যাহা লিখেন নাই তাহাতেও তাঁহার অল্প ক্ষমতা প্রকাশ পায় নাই।

বিশেষত বিষয়টি এমন যে, ইহা কোনো সাধারণ বাঙালি লেখকের হস্তে পড়িলে তিনি এই সুযোগে বিস্তর হরি হরি, মরি মরি, হায় হায়, অশ্রুপাত ও প্রবল অঙ্গভঙ্গি করিতেন এবং কল্পনার উচ্ছ্বাস, ভাবের আবেগ এবং হৃদয়াতিশয্য প্রকাশ করিবার এমন অনুকূল অবসর কখনোই ছাড়িতেন না; সুবিচারিত তর্ক দ্বারা, সুকঠিন সত্যনির্ণয়ের স্পৃহা দ্বারা পদে পদে আপন লেখনীকে বাধা দিতেন না। সর্বজনগম্য সরল পথ ছাড়িয়া দিয়া সূক্ষ্মবুদ্ধি দ্বারা স্বকপোলকল্পিত একটা নূতন আবিষ্কারকেই সর্বপ্রাধান্য দিয়া তাহাকেই বাক্‌প্রাচুর্যে এবং কল্পনাকুহকে সমাচ্ছন্ন করিয়া তুলিতেন, এবং নিজের বিশ্বাস ও ভাষাকে যথাসাধ্য টানিয়া বুনিয়া আশেপাশে দীর্ঘ করিয়া অধিকপরিমাণে লোককে আপন মতের জালে আকর্ষণ করিতে চেষ্টা করিতেন।

বস্তুত আমাদের শাস্ত্র হইতে ইতিহাস উদ্ধারের দুরূহ ভার কেবল বঙ্কিম লইতে পারিতেন। এক দিকে হিন্দুশাস্ত্রের প্রকৃত মর্ম গ্রহণে ইউরোপীয়গণের অক্ষমতা, অন্য দিকে শাস্ত্রগত প্রমাণের নিরপেক্ষ বিচার সম্বন্ধে হিন্দুদের সংকোচ; এক দিকে রীতিমত পরিচয়ের অভাব, অন্য দিকে অতিপরিচয়জনিত অভ্যাস ও সংস্কারের অন্ধতা; যথার্থ ইতিহাসটিকে এই উভয়সংকটের মাঝখান হইতে উদ্ধার করিতে হইবে। দেশানুরাগের সাহায্যে শাস্ত্রের অন্তরে প্রবেশ করিতে হইবে এবং সত্যানুরাগের সাহায্যে তাহার অমূলক অংশ পরিত্যাগ করিতে হইবে। যে বল্‌গার ইঙ্গিতে লেখনীকে বেগ দিতে হইবে, সেই বল্‌গার আকর্ষণে তাহাকে সর্বদা সংযত করিতে হইবে। এই-সকল ক্ষমতাসামঞ্জস্য বঙ্কিমের ছিল। সেইজন্য মৃত্যুর অনতিপূর্বে তিনি যখন প্রাচীন বেদ পুরাণ সংগ্রহ করিয়া প্রস্তুত হইয়া বসিয়াছিলেন তখন বঙ্গসাহিত্যের বড়ো আশার কারণ ছিল, কিন্তু মৃত্যু সে আশা সফল হইতে দিল না, এবং আমাদের ভাগ্যে যাহা অসম্পন্ন রহিয়া গেল তাহা যে কবে সমাধা হইবে কেহই বলিতে পারে না।

বঙ্কিম এই-যে সর্বপ্রকার আতিশয্য এবং অসংগতি হইতে আপনাকে রক্ষা করিয়া গিয়াছেন ইহা তাঁহার প্রতিভার প্রকৃতিগত। যে-কেহ তাঁহার রচনা পড়িয়াছেন সকলেই জানেন বঙ্কিম হাস্যরসে সুরসিক ছিলেন। যে পরিষ্কার যুক্তির আলোকের দ্বারা সমস্ত আতিশয্য ও অসংগতি প্রকাশ হইয়া পড়ে হাস্যরস সেই কিরণেরই একটি রশ্মি। কতদূর পর্যন্ত গেলে একটি ব্যাপার হাস্যজনক হইয়া উঠে তাহা সকলে অনুভব করিতে পারে না, কিন্তু যাঁহারা হাস্যরসরসিক তাঁহাদের অন্তঃকরণে একটি বোধশক্তি আছে যদ্দারা তাঁহারা সকল সময়ে নিজের না হইলেও অপরের কথাবার্তা আচারব্যবহার এবং চরিত্রের মধ্যে সুসংগতির সূক্ষ্ম সীমাটুকু সহজে নির্ণয় করিতে পারেন।

নির্মল শুভ্র সংযত হাস্য বঙ্কিমই সর্বপ্রথমে বঙ্গসাহিত্যে আনয়ন করেন। তৎপূর্বে বঙ্গসাহিত্যে হাস্যরসকে অন্য রসের সহিত এক পঙ্‌ক্তিতে বসিতে দেওয়া হইত না। সে নিম্নাসনে বসিয়া শ্রাব্য অশ্রাব্য ভাষায় ভাঁড়ামি করিয়া সভাজনের মনোরঞ্জন করিত। আদিরসেরই সহিত যেন তাহার কোনো-একটি সর্ব-উপদ্রবসহ বিশেষ কুটুম্বিতার সম্পর্ক ছিল এবং ঐ রসটাকেই সর্বপ্রকারে পীড়ন ও আন্দোলন করিয়া তাহার অধিকাংশ পরিহাস-বিদ্রূপ প্রকাশ পাইত। এই প্রগল্‌ভ বিদূষকটি যতই প্রিয়পাত্র থাক্‌ কখনো সম্মানের অধিকারী ছিল না। যেখানে গম্ভীরভাবে কোনো বিষয়ের আলোচনা হইত সেখানে হাস্যের চপলতা সর্বপ্রযত্নে পরিহার করা হইত।

বঙ্কিম সর্বপ্রথমে হাস্যরসকে সাহিত্যের উচ্চশ্রেণীতে উন্নীত করেন। তিনিই প্রথম দেখাইয়া দেন যে, কেবল প্রহসনের সীমার মধ্যে হাস্যরস বদ্ধ নহে; উজ্জ্বল শুভ্র হাস্য সকল বিষয়কেই আলোকিত করিয়া তুলিতে পারে। তিনিই প্রথম দৃষ্টান্তের দ্বারা প্রমাণ করাইয়া দেন যে, এই হাস্যজ্যোতির সংস্পর্শে কোনো বিষয়ের গভীরতার গৌরব হ্রাস হয় না, কেবল তাহার সৌন্দর্য এবং রমণীয়তার বৃদ্ধি হয়, তাহার সর্বাংশের প্রাণ এবং গতি যেন সুস্পষ্টরূপে দীপ্যমান হইয়া উঠে। যে বঙ্কিম বঙ্গসাহিত্যের গভীরতা হইতে অশ্রুর উৎস উন্মুক্ত করিয়াছেন সেই বঙ্কিম আনন্দের উদয়শিখর হইতে নবজাগ্রত বঙ্গসাহিত্যের উপর হাস্যের আলোক বিকীর্ণ করিয়া দিয়াছেন।

কেবল সুসংগতি নহে, সুরুচি এবং শিষ্টতার সীমা নির্ণয় করিতেও একটি স্বাভাবিক সূক্ষ্ম বোধশক্তির আবশ্যক। মাঝে মাঝে অনেক বলিষ্ঠ প্রতিভার মধ্যে সেই বোধশক্তির অভাব দেখা যায়। কিন্তু বঙ্কিমের প্রতিভায় বল এবং সৌকুমার্যের একটি সুন্দর সংমিশ্রণ ছিল। নারীজাতির প্রতি যথার্থ বীরপুরুষের মনে যেরূপ একটি সসম্ভ্রম সম্মানের ভাব থাকে তেমনি সুরুচি এবং শীলতার প্রতি বঙ্কিমের বলিষ্ঠবুদ্ধির একটি বীরোচিত প্রীতিপূর্ণ শ্রদ্ধা ছিল। বঙ্কিমের রচনা তাহার সাক্ষ্য। বর্তমান লেখক যেদিন প্রথম বঙ্কিমকে দেখিয়াছিল, সেদিন একটি ঘটনা ঘটে যাহাতে বঙ্কিমের এই স্বাভাবিক সুরুচিপ্রিয়তার প্রমাণ পাওয়া যায়।

সেদিন লেখকের আত্মীয় পূজ্যপাদ শ্রীযুক্ত শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর মহোদয়ের নিমন্ত্রণে তাঁহাদের মরকতকুঞ্জে কলেজ-রিয়্যুনিয়ন নামক মিলনসভা বসিয়াছিল। ঠিক কতদিনের কথা স্মরণ নাই, কিন্তু আমি তখন বালক ছিলাম। সেদিন সেখানে আমার অপরিচিত বহুতর যশস্বী লোকের সমাগম হইয়াছিল। সেই বুধমণ্ডলীর মধ্যে একটি ঋজু দীর্ঘকায় উজ্জ্বলকৌতুকপ্রফুল্লমুখ গুম্ফধারী প্রৌঢ় পুরুষ চাপকানপরিহিত বক্ষের উপর দুই হস্ত আবদ্ধ করিয়া দাঁড়াইয়া ছিলেন। দেখিবামাত্রই যেন তাঁহাকে সকলের হইতে স্বতন্ত্র এবং আত্মসমাহিত বলিয়া বোধ হইল। আর সকলে জনতার অংশ, কেবল তিনি যেন একাকী একজন। সেদিন আর-কাহারো পরিচয় জানিবার জন্য আমার কোনোরূপ প্রয়াস জন্মে নাই, কিন্তু তাঁহাকে দেখিয়া তৎক্ষণাৎ আমি এবং আমার একটি আত্মীয় সঙ্গী একসঙ্গেই কৌতূহলী হইয়া উঠিলাম। সন্ধান লইয়া জানিলাম তিনিই আমাদের বহুদিনের অভিলষিতদর্শন লোকবিশ্রুত বঙ্কিমবাবু। মনে আছে, প্রথম দর্শনেই তাঁহার মুখশ্রীতে প্রতিভার প্রখরতা এবং বলিষ্ঠতা এবং সর্বলোক হইতে তাঁহার একটি সুদূর স্বাতন্ত্র্যভাব আমার মনে অঙ্কিত হইয়া গিয়াছিল। তাহার পর অনেক বার তাঁহার সাক্ষাৎলাভ করিয়াছি, তাঁহার নিকট অনেক উৎসাহ এবং উপদেশ প্রাপ্ত হইয়াছি, এবং তাঁহার মুখশ্রী স্নেহের কোমলহাস্যে অত্যন্ত কমনীয় হইতে দেখিয়াছি, কিন্তু প্রথম দর্শনে সেই-যে তাঁহার মুখে উদ্যত খড়ে্‌গর ন্যায় একটি উজ্জ্বল সুতীক্ষ্ণ প্রবলতা দেখিতে পাইয়াছিলাম, তাহা আজ পর্যন্ত বিস্মৃত হই নাই।

সেই উৎসব উপলক্ষে একটি ঘরে একজন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত দেশানুরাগমূলক স্বরচিত সংস্কৃত শ্লোক পাঠ এবং তাহার ব্যাখ্যা করিতেছিলেন। বঙ্কিম এক প্রান্তে দাঁড়াইয়া শুনিতেছিলেন। পণ্ডিতমহাশয় সহসা একটি শ্লোকে পতিত ভারতসন্তানকে লক্ষ্য করিয়া একটা অত্যন্ত সেকেলে পণ্ডিতি রসিকতা প্রয়োগ করিলেন, সে রস কিঞ্চিৎ বীভৎস হইয়া উঠিল। বঙ্কিম তৎক্ষণাৎ একান্ত সংকুচিত হইয়া দক্ষিণ-করতলে মুখের নিম্নার্ধ ঢাকিয়া পার্শ্ববর্তী দ্বার দিয়া দ্রুতবেগে অন্য ঘরে পলায়ন করিলেন।

বঙ্কিমের সেই সসংকোচ পলায়নদৃশ্যটি অদ্যাবধি আমার মনে মুদ্রাঙ্কিত হইয়া আছে।

বিবেচনা করিয়া দেখিতে হইবে, ঈশ্বর গুপ্ত যখন সাহিত্যগুরু ছিলেন বঙ্কিম তখন তাঁহার শিষ্যশ্রেণীর মধ্যে গণ্য ছিলেন। সে সময়কার সাহিত্য অন্য যে-কোনো প্রকার শিক্ষা দিতে সমর্থ হউক ঠিক সুরুচি শিক্ষার উপযোগী ছিল না। সে সময়কার অসংযত বাকযুদ্ধ এবং আন্দোলনের মধ্যে দীক্ষিত ও বর্ধিত হইয়া ইতরতার প্রতি বিদ্বেষ, সুরুচির প্রতি শ্রদ্ধা এবং শ্লীলতা সম্বন্ধে অক্ষুণ্ন বেদনাবোধ রক্ষা করা কী যে আশ্চর্য ব্যাপার তাহা সকলেই বুঝিতে পারিবেন। দীনবন্ধুও বঙ্কিমের সমসাময়িক এবং তাঁহার বান্ধব ছিলেন, কিন্তু তাঁহার লেখায় অন্য ক্ষমতা প্রকাশ হইলেও তাহাতে বঙ্কিমের প্রতিভার এই ব্রাহ্মণোচিত শুচিতা দেখা যায় না। তাঁহার রচনা হইতে ঈশ্বর গুপ্তের সময়ের ছাপ কালক্রমে ধৌত হইতে পারে নাই।

আমাদের মধ্যে যাঁহারা সাহিত্যব্যবসায়ী তাঁহারা বঙ্কিমের কাছে যে কী চিরঋণে আবদ্ধ তাহা যেন কোনো কালে বিস্মৃত না হন। একদিন আমাদের বঙ্গভাষা কেবল একতারা যন্ত্রের মতো এক তারে বাঁধা ছিল, কেবল সহজ সুরে ধর্ম সংকীর্তন করিবার উপযোগী ছিল; বঙ্কিম স্বহস্তে তাহাতে এক-একটি করিয়া তার চড়াইয়া আজ তাহাকে বীণাযন্ত্রে পরিণত করিয়া তুলিয়াছেন। পূর্বে যাহাতে কেবল স্থানীয় গ্রাম্য সুর বাজিত তাহা আজ বিশ্বসভায় শুনাইবার উপযুক্ত ধ্রুবপদ অঙ্গের কলাবতী রাগিণী আলাপ করিবার যোগ্য হইয়া উঠিয়াছে। সেই তাঁহার স্বহস্তসম্পূর্ণ স্নেহপালিত ক্রোড়সঙ্গিনী বঙ্গভাষা আজ বঙ্কিমের জন্য অন্তরের সহিত রোদন করিয়া উঠিয়াছে। কিন্তু তিনি এই শোকোচ্ছ্বাসের অতীত শান্তিধামে দুষ্কর জীবনযজ্ঞের অবসানে নির্বিকার নিরাময় বিশ্রাম লাভ করিয়াছেন। মৃত্যুর পরে তাঁহার মুখে একটি কোমল প্রসন্নতা, একটি সর্বদুঃখতাপহীন গভীর প্রশান্তি উদ্‌ভাসিত হইয়া উঠিয়াছিল– যেন জীবনের মধ্যাহ্নরৌদ্রদগ্ধ কঠিন সংসারতল হইতে মৃত্যু তাঁহাকে স্নেহসুশীতল জননীক্রোড়ে তুলিয়া লইয়াছেন। আজ আমাদের বিলাপ-পরিতাপ তাঁহাকে স্পর্শ করিতেছে না, আমাদের ভক্তি-উপহার গ্রহণ করিবার জন্য সেই প্রতিভাজ্যোতির্ময় সৌম্য প্রসন্নমূর্তি এখানে উপস্থিত নাই। আমাদের এই শোক এই ভক্তি কেবল আমাদেরই কল্যাণের জন্য। বঙ্কিম সাহিত্যক্ষেত্রে যে আদর্শ স্থাপন করিয়া গিয়াছেন এই শোকে এই ভক্তিতে সেই আদর্শপ্রতিমা আমাদের অন্তরে উজ্জ্বল এবং স্থায়ীরূপে প্রতিষ্ঠিত হউক। প্রস্তরের মূর্তি স্থাপনের অর্থ এবং সামর্থ্য আমাদের যদি না থাকে, তবে একবার তাঁহার মহত্ত্ব সর্বতোভাবে মনের মধ্যে উপলব্ধি করিয়া তাঁহাকে আমাদের বঙ্গহৃদয়ের স্মরণস্তম্ভে স্থায়ী করিয়া রাখি। ইংরাজ এবং ইংরাজের আইন চিরস্থায়ী নহে; রাজনৈতিক ধর্মনৈতিক সমাজনৈতিক মতামত সহস্রবার পরিবর্তিত হইতে পারে; যে-সকল ঘটনা যে-সকল অনুষ্ঠান আজ সর্বপ্রধান বলিয়া বোধ হইতেছে এবং যাহার উন্মাদনার কোলাহলে সমাজের খ্যাতিহীন শব্দহীন কর্তব্যগুলিকে নগণ্য বলিয়া ধারণা হইতেছে, কাল তাহার স্মৃতিমাত্র চিহ্নমাত্র অবশিষ্ট থাকিতে না পারে; কিন্তু যিনি আমাদের মাতৃভাষাকে সর্বপ্রকার ভাবপ্রকাশের অনুকূল করিয়া গিয়াছেন তিনি এই হতভাগ্য-দরিদ্র দেশকে একটি অমূল্য চিরসম্পদ দান করিয়াছেন। তিনি স্থায়ী জাতীয় উন্নতির একমাত্র মূল উপায় স্থাপন করিয়া গিয়াছেন। তিনিই আমাদের নিকট যথার্থ শোকের মধ্যে সান্ত্বনা, অবনতির মধ্যে আশা, শ্রান্তির মধ্যে উৎসাহ এবং দারিদ্র্যের শূন্যতার মধ্যে চির-সৌন্দর্যের অক্ষয় আকর উদ্‌ঘাটিত করিয়া দিয়াছেন। আমাদিগের মধ্যে যাহা-কিছু অমর এবং আমাদিগকে যাহা-কিছু অমর করিবে সেই-সকল মহাশক্তিকে ধারণ করিবার পোষণ করিবার প্রকাশ করিবার এবং সর্বত্র প্রচার করিবার একমাত্র উপায় যে মাতৃভাষা তাহাকেই তিনি বলবতী এবং মহীয়সী করিয়াছেন।

রচনাবিশেষের সমালোচনা ভ্রান্ত হইতে পারে– আমাদিগের নিকট যাহা প্রশংসিত কালক্রমে শিক্ষা রুচি এবং অবস্থার পরিবর্তনে আমাদের উত্তরপুরুষের নিকট তাহা নিন্দিত এবং উপেক্ষিত হইতে পারে; কিন্তু বঙ্কিম বঙ্গভাষার ক্ষমতা এবং বঙ্গসাহিত্যের সমৃদ্ধি বৃদ্ধি করিয়া দিয়াছেন, তিনি ভগীরথের ন্যায় সাধনা করিয়া বঙ্গসাহিত্যে ভাবমন্দাকিনীর অবতারণ করিয়াছেন এবং সেই পুণ্যস্রোতস্পর্শে জড়ত্বশাপ মোচন করিয়া আমাদের প্রাচীন ভস্মরাশিকে সঞ্জীবিত করিয়া তুলিয়াছেন। ইহা কেবল সাময়িক মত নহে, এ কথা কোনো বিশেষ তর্ক বা রুচির উপর নির্ভর করিতেছে না, ইহা একটি ঐতিহাসিক সত্য।

এই কথা স্মরণে মুদ্রিত করিয়া সেই বাংলা লেখকদিগের গুরু, বাংলা পাঠকদিগের সুহৃদ, এবং সুজলা সুফলা মলয়জশীতলা বঙ্গভূমির মাতৃবৎসল প্রতিভাশালী সন্তানের নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করি, যিনি জীবনের সায়াহ্ন আসিবার পূর্বেই, নূতন অবকাশে নূতন উদ্যমে নূতন কার্যে হস্তক্ষেপ করিবার প্রারম্ভেই, আপনার অপরিম্লান প্রতিভারশ্মি সংহরণ করিয়া বঙ্গসাহিত্যাকাশ ক্ষীণতর জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর হস্তে সমর্পণপূর্বক গত শতাব্দীর বর্ষশেষের পশ্চিমদিগন্তসীমায় অকালে অস্তমিত হইলেন।

বৈশাখ, ১৩০১

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *