সতেরো
আমাদের সংবিধানে একুশ বছর না হলে কোনো নাগরিক প্রাপ্তবয়স্ক হতে পারত না, পরে এই বয়সের সীমারেখাকে নামিয়ে আঠারো বছর করা হয়। করা হয় মার্কিন দেশের ষাট দশকের প্রান্তিক বছরগুলোতে ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুব-আন্দোলনের প্রভাবে। তখন মার্কিন দেশের যুবকদের আঠারো বছর হলেই সরকারি দাপটে ভিয়েতনামে অন্তত দু-একবছর লড়াই করতে হতো। ছেলেরা দাবি করল, আঠারো বছর বয়সে যদি আমরা দেশের জন্য মরবার অধিকার না চেয়েও পেতে পারি, তাহলে সে বয়সে ভোটের অধিকার পাব না কেন? লিনডন জনসন তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট, আঠারো বছরে প্রাপ্তবয়স্ক মার্কিন ছেলেমেয়েরা ভোটের অধিকার পেয়ে গেল ১৯৬৮ সালে। তাদের ভোটে রিচার্ড নিকসন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন। নির্বাচন সংগ্রামে তাঁর সবচেয়ে বড় প্রতিজ্ঞা ছিল, “ভিয়েতনাম যুদ্ধ শেষ করে আমি ঘরের ছেলেদের ঘরে ফিরিয়ে আনব।” অনুরূপ প্রতিজ্ঞা ১৯৫২ সালে আইসেনহাওয়ারকে প্রেসিডেন্ট হয়ে ওয়াশিংটন ডিসিতে পেনসিলভেনিয়া অ্যাভিনিউর হোয়াইট হাউসে প্রবেশের অধিকার দিয়েছিল।
পনেরো বছরে যে গ্রাম্য ছেলেটি প্রথম কলকাতায় পদার্পণ করল, তখনও তাকে তরুণই বলতে হয়। খুলনা শহর ছাড়বার আগে তার পিতৃদেব তার কাপড়ের এক কোনার মধ্যে দশ টাকার একটা নোট বেঁধে দিয়েছিলেন। তাছাড়া তার সঙ্গে একটা টাকা ও কিছু খুচরো পয়সা ছিল। কলকাতার বীডন স্ট্রিটে ২৯ নম্বর বাড়ি তার গন্তব্যস্থল। পিতৃদেব তাঁর ভাই সূর্যকান্তকে চিঠি লিখেছিলেন, শিয়ালদা স্টেশনে কেউ এসে যেন এই তরুণকে অজানা-অচেনা শহরে বাড়ি নিয়ে যায়।
ট্রেনের থার্ড ক্লাসে গায়ে-গায়ে ভিড় তখন অনেক বেশি ছিল। নিম্নতম শ্রেণিতে তখনও সিট রিজার্ভেশন চালু হয়নি। যাত্রীদের অনেকে মালপত্র ছাড়াও তরিতরকারি, জাল দিয়ে বাঁধা ধামা ভরতি মোরগ-মুরগি সঙ্গে নিয়ে আসত মাত্র পাঁচ ঘণ্টার পথ পেরিয়ে কলকাতায় বিক্রী করতে। জানলার ধারে সিট পেয়ে আমি বিস্ময় ও আনন্দের সঙ্গে ধাবমান বনানী, গ্রাম, শহরের পিছুহটা গতি দেখে, বাবার কথা ভেবে, মনে একরাশ ভয় নিয়ে কখন যে হঠাৎ শিয়ালদা পৌছে গেলাম। হুড়োহুড়ি করে লোকেরা নামতে লাগল। কুলিদের আক্রমণে কামরাটা একরকম রণস্থলে পরিণত হলো। আমি অপেক্ষা করাই বিবেচনার কাজ মনে করলাম। কয়েক মিনিটে পুরো কামরাটা খালি হয়ে গেল। একটা কুলি আমার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে দেখতে পেলাম।
“বাবু, কুলি লাগবে না?”
আমি আমার সদ্য জানা হিন্দিতে জবাব দিলাম, “অবশ্য লাগেঙ্গা।”
কুলি সশ্রদ্ধায় আমার টিনের বাক্স, সতরঞ্চিতে বাঁধা বিছানা অনায়াসে মাথায় তুলে নিল।
বলল, “চলে এসো বাবু।”
আমি নিচে নামলে, কুলি জানতে চাইলে আমার গন্তব্যস্থান কোথায়? বাহন কি ট্যাক্সি না রিকশা?
আমি বললাম, “বীডন স্ট্রিড, রিকশা।”
হনহন করে এগিয়ে চলল লোকটা। আমি তার মুখ দেখিনি ভালো করে। শুধু দেখেছি মোটা লম্বা, খাটো শরীর, মাথা কামানো। তার গতির সঙ্গে স্টেশনের ভিড় ও কোলাহল কাটিয়ে পা রেখে চলা বুঝতে পারলাম সম্ভব হচ্ছে না। আমাকে নিয়ে যাবার জন্য একজন কারুর আসার কথা। কে আসবে আমার জানা নেই। কুলিটা আমাকে যে দরজা দিয়ে স্টেশনের বাইরে নিয়ে গেল সেখানে পরিচিত কোনো লোক নজরে পড়ল না। আমিও নজরে পড়লাম না কারুর। লোকটা হনহন করে আমাকে একদল লড়াকু বাজপাখি অর্থাৎ রিকশাওয়ালাদের মধ্যে নিয়ে গেল। তাদের মধ্যে একজন বেশ পেটমোটা রিকশাওয়ালা আমার টিনের বাক্স ও সতরঞ্চি মোড়া বিছানা প্রায় কেড়ে নিজের গাড়িতে রেখে হুকুম করল, “গাড়িতে বসো।”
কুলি এক টাকা মজুরি চাইতে তার ওপর ক্ষেপে উঠল রিকশাওয়ালা, “ইয়ার্কি পেয়েছ! দেহাত থেকে আসা বাচ্চা একটা ছেলের ওপর দিনেদুপুরে ডাকাতি!” এবার আমাকে, “দিয়ে দাও ভায়া ওকে আট আনা।” আমি পকেট থেকে আটআনা বার করে কুলির হাতে দিতেই সে ধাবমান হলো। রিকশাওয়ালা তখনও রেগে রয়েছে। “ছয় আনার বেশি পাওনা ছিল না বেটার। যতসব ডাকু বদমাস এসে ভিড় করেছে ইস্টিশানে।”
এখন আমি লোকটাকে জেনে গিয়েছি। বেঁটে মোটাসোটা দৃঢ় শরীর। খুব ছোট করে ছাঁটা চুল, মুখে বসন্তের দাগ। কপালের ডান দিকে একটা বড় কাটা দাগ। গভীর ক্ষত শুকিয়ে যেমন হয়। পুরু কালো ওষ্ঠাধর, কিন্তু দাঁতগুলো খুবই সাদা। মোটা মাংসল গাল, ছোট ছোট চোখ, ভ্রূ নেই। থুতনিও নেই।
“কোথা যাবে ভাইয়া?” দুহাতে রিকশার দুটো হাতল তুলে নিয়ে প্রশ্ন করল লোকটা।
“২৯ নম্বর বীডন স্ট্রিট।”
“ওটা কোন পাড়ায় আছে?”
আমি তখন বেশ ভড়কে গেছি। কলকাতায় যে অনেকগুলো পাড়া রয়েছে তা জানা নেই আমার।
রিকশাওয়ালা জানতে চাইল, “শ্যামবাজার? মানিকতলা? রাধাবাজার? বৌবাজার?”
আমি এবার জোর দিয়ে বললাম, “না। ২৯ নম্বর বীডন স্ট্রিট।”
লোকটা আমার মুখটা বেশ ভালো করে দেখে নিল। তারপর ছুট লাগাল। খুলনা শহরে সাইকেল রিকশা, ঢাকায়ও আমি সাইকেল রিকশায় চড়েছি। মানুষ-টানা গাড়িতে চড়ার অভিজ্ঞতা আমার এই প্রথম। বহু রকমের যানবাহন—ট্রাম, মোটরগাড়ি, লরি, ঠেলাগাড়ি, বাস সবকিছুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলল মানুষ-টানা দুই চাকার গাড়ি। চলল একটা প্রশস্ত কুৎসিত শহরে ছিন্নভিন্ন রাস্তার বুক চিরে, যার সংখ্যাহীন মানুষের মধ্যে একটাও আমার পরিচিত নয়। মানুষগুলো যেন হন্যে হয়ে যে যার কাজে ছুটছে। কাজ না থাকলেও ছুটছে।
রিকশাওয়ালা অনেক পথ অতিক্রম করে হাজির হলো যে পাড়ায় সেখানে অধিকাংশ মানুষই নেপালি। আমার মুখের চেহারা দেখে সে নিশ্চয়ই আমাকে নেপালি সাব্যস্ত করে নিয়েছিল। আমি হাউমাউ প্রতিবাদ করে তাকে জানালাম, নেপালি আমি নই, নিছক গ্রামের বাঙালি, সদ্যমাত্র হাজির হয়েছি কলকাতা শহরে, তার উপর একান্ত নির্ভরশীল আমার গন্তব্যস্থান। ২৯ নম্বর বীডন স্ট্রিটে। সে লোকটা কয়েকজন লোকের সঙ্গে কথাবার্তা বলে বীডন স্ট্রিটের দিশারা নিয়ে নিল, এবং আরও কিছুক্ষণ দৌড়ে, হেঁটে, আবার দৌড়ে, আবার হেঁটে, শেষ পর্যন্ত একতলা যে বাড়িটার সামনে আমাকে পৌছে দিল, তার গায়ে দেখলাম ২৯, রাস্তাটা যে বীডন স্ট্রিট তা আমি আগেই পড়ে নিয়েছিলাম।
দরজায় কড়া নাড়তে বেশ একদল লোক বেরিয়ে এলেন। তাদের মধ্যে দেখতে পেলাম কাকামণি, কাকিমা, দিদি, খুড়তুতো ভাই বাদল। বহুদিনের পুরোনো অনেকটা অচেনা মুখের পিসিমা, তার পুত্র দাদামণি। সবাই আমাকে দেখে হৈ হৈ করে উঠলেন। জানা গেল দাদামণি আমাকে তুলে আনবার জন্য শিয়ালদা স্টেশনে মেন গেটে অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু রিকশাওয়ালা একপাশের গেট দিয়ে বার করে আমাকে হাজির করেছিল নেপালি পাড়ায়। বেশ কিছু কথা কাটাকাটি হবার পরে কাকামণির হাত থেকে পারিশ্রমিক নিয়ে রিকশাওয়ালা বিদায় হলো। গণেশপুরের পনেরো বছরের একটি ছেলে মাত্র দিনকয়েক খুলনা শহরে পিতার সঙ্গে বাস করে প্রথম পদার্পণ করল রাজধানী কলকাতার এক জলজ্যান্ত পাড়ার বসত বাড়িতে।
এই বাড়িটার কথা আমি বলে নিই। একতলা লম্বা বাড়ি, পর পর চারখানা ঘর। এই চারখানা ঘরে বাস করেন আমার চার আত্মীয় পরিবার। প্রথম একখানা ঘরে গণেশপুর গ্রামের বাড়ির শরিক জ্যেঠামশাইয়ের তিন ছেলে, তিনি নিজে এবং তাঁর এক কন্যা, যাকে আমি বলতাম ছোটদি। দ্বিতীয় ঘরে আমার কাকার সারা পরিবার অর্থাৎ নিজে, কাকিমা ও পাঁচ ভাইবোন। তৃতীয় ঘরে একা বাস করেন আমার খুড়তুতো পিসিমা। যাঁর স্বামী অমলেন্দু দাশগুপ্ত অনুশীলন দলের কট্টর বিপ্লবী ছিলেন। মুক্তি পাবার পরে ‘রাজবন্দী’ নামে সমাদৃত একটি পুস্তকে দেউলীতে রাজবন্দী শিবিরে বিপ্লবীদের উপর ইংরেজ সরকার যে সব সদয় ব্যবহার করতেন তার মর্মস্পর্শী বিবরণ দিয়েছিলেন। পঞ্চম ঘরটিতে বাস করেন আমার পিসিমা, পিসতুতো ভাই ‘দাদামণি’, আমার দুই যমজ পিসতুতো দিদি, অনু ও রেণু। অনুদি ও রেণুদির সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল সুমধুর। দুজনেই বেথুনে পড়ত, সংগীতে ও নৃত্যে পারদর্শী ছিল। এদের দুজনের জীবনও নাটকীয় ও ঘটনাবহুল। কিন্তু সেসব নাটক এই পিতৃপরিচয়ে স্থান পাবে না।
কাকিমার কথায় আমি স্নান করে নিলাম। খোলা উঠোনে বিরাট এক চৌবাচ্চা। নল একটাই, কিন্তু জলের সরবরাহ অবিঘ্নিত, অতএব চৌবাচ্চা সব সময়েই প্রায় ভরপুর। চৌবাচ্চার পাশে ছোট্ট একটা বারান্দাতে কাকিমার রান্নাঘর, ওখানে পিঁড়ি বা আসন পেতে সবার খাবার ব্যবস্থা। খেতে বসে আমার হঠাৎ মনে পড়ে গেল যে খুলনা ছাড়বার আগে বাবা একটা পুরো দশ টাকার নোট আমার ধুতির কাছার কোণে বেঁধে দিয়েছিলেন। আমি হুস করে লাফিয়ে উঠে চৌবাচ্চার কাছে ছুটে যেতে যেতে বললাম, “হায়, হায়, আমার দশটা টাকা বোধহয় ভিজে গলে গেছে।” কাকামণি নিজে এগিয়ে এসে কাছার কোনার শক্ত গেরো সাবধানে খুলে অর্ধেকেরও বেশি ভেজা নোটখানা বার করলেন। তাকে সযত্নে শুকোতে দেওয়া হলো। এ নিয়ে সারা বাড়িতে হাসাহাসি, ব্যঙ্গ তো হলোই, সঙ্গে সঙ্গে অনেক সদয় মন্তব্য করলেন, “পড়াশোনায় ভালো ছেলেদের বৈষয়িক ব্যাপারে খেয়াল থাকে না।”
আমাদের ঘরখানা বেশ বড়সড় ছিল। তার এক কোণে দেওয়াল ঘেঁষে তৈরি হলো আমার বাসস্থান। দেওয়ালের গায়ে বইপত্র সাজিয়ে রাখা হলো। দেওয়ালে দুটো পেরেক পুঁতে দড়ি টানিয়ে তৈরি হলো জামা কাপড় রাখবার ‘আলনা’। রাত্রিতে পরপর সবাই আমরা এক বিরাট ঢালা বিছানায় শুয়ে পড়তাম। আমার পাশে শুত বাদল, গলাগলি খুড়তুতো ভাই, আমার চেয়ে এগারো মাসের ছোট। মুশকিল হতো পড়া নিয়ে। ঘরে ও সারা বাড়িতে পড়ার জায়গা ছিল না। সকাল পাঁচটায় উঠে আমি বইপত্র নিয়ে ছাতে চলে যেতাম। অন্তত দু’ঘণ্টা নির্বিঘ্নে মনোযোগে পড়াশোনার সুযোগ হতো। পরে আমার খুড়তুতো পিসিমা, যিনি কর্পোরেশন স্কুলে পড়াতেন এবং যাঁর স্বামী তখনও জেলে, কাজে যাবার সময়, তাঁর ঘরের চাবি দিয়ে যেতেন। এতে আমার পড়াশোনার সুবিধে আরও অনেক বেড়ে গেল।