পিতা পুত্রকে – ১১

এগারো

ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দেবার জন্য মহকুমার সব স্কুলের পরীক্ষার্থীদের যেতে হলো মাদারীপুর। সেখানে তো হোটেল ছিল না, মাদারীপুর শহর হলেও, আধা গ্রাম। বরিশাল ও ফরিদপুরের সমান প্রভাব এই মহকুমা শহরে, লোকেদের কথাবার্তায় বরিশালী টান। আমাদের গ্রামের আনন্দ সেন মহাশয় মাদারীপুরে সুদক্ষ মোক্তার, স্কুল পাস করা ডাক্তারের মতো, কলেজ পাস করা উকিলেল নিচে। গণেশপুরের পরীক্ষার্থীদের বেশিরভাগই তাঁর গৃহে আতিথ্য পেত। বেশ বড় একটা বাইরের ঘরে প্রকাণ্ড সতরঞ্চি, তার উপর সাদা চাদর পেতে দেওয়া হয়েছিল, আমরা চারটি পরীক্ষার্থী সেখানে সাদরে আশ্রিত হয়েছিলাম। পরীক্ষায় বসতে হতো দশটা থেকে পাঁচটা, অন্নদা সেন মশাইয়ের বাড়িতে ফিরে আসতেই জলখাবার, রাত্রিতে তাঁদের রান্নাঘরের বারান্দায় পরিবারের পুরুষদের সঙ্গে আহার।

মাদারীপুর যেতে হলো গণেশপুর থেকে নৌকায় সুরেশ্বর, সেখান থেকে স্টিমার। গণেশপুর ছেড়ে ‘দূর দেশে’ যাবার অভিজ্ঞতা আমার তিনবার হয়ে গেছে। মামার বিয়ের সময় মার সঙ্গে কলকাতা, তখন আমি নিতান্তই বালক, তার কোনো স্মৃতি নেই মনের পর্দায়। বিজনকাকার বিয়েতে ঢাকা গিয়েছিলাম, তার আবছা স্মৃতি রয়ে গেছে একটি পরম সুন্দরী বালিকাকে ঘিরে। অষ্টম ক্লাসে পড়ার সময় নাক-ভর্তি পলিপাশ অপারেশন করার জন্য বাবা নিয়ে গিয়েছিলেন ঢাকা, অপারেশন মোটেই ভালো হয়নি, ঢাকা মেডিক্যাল স্কুলে ইএনটি সার্জন ছিল না। আমার নাক থেকে রক্ত ঝরে জামা ভেসে গিয়েছিল, তাতে বাবা খুব কেঁদেছিল, এটা আমার মনে আছে। আরও দুটো স্মৃতি রয়ে গেছে মনে। আমার রাঙ্গা ঠাকুমার বাবা ঢাকা শহরে, রমনা পেরিয়ে ‘উয়ারী’ পল্লিতে বাড়ি করেন, আমরা বাপ ছেলে সেখানে আতিথ্য পেয়েছিলাম। এই মহাশয় ‘বৈদ্যরা ব্রাহ্মণের চেয়ে জাতিতে বড়’ এই ‘শাস্ত্রীয় সত্য’ প্রমাণ করে কয়েকখানা কিতাব ও প্রবন্ধ লিখেছিলেন তিনি নিজের পদবি বদলে দিয়েছিলেন ‘শর্মা’-তে— তিনি ছিলেন দাসশর্মা। আমার পিতৃদেবকে অনেক বুঝিয়েও ‘সেনশর্মা’ বা ‘সেনগুপ্তশর্মাতে’ উত্তীর্ণ করতে পারেননি। তিনি বাড়ির সব পুজো, দুর্গাপুজো পর্যন্ত নিজে করতেন, ‘পুরোহিত দর্পণ’ ছিল তাঁর কণ্ঠস্থ। তাঁর নিজেদের পুত্রদের নিয়ে হতাশার কথা আমার মতো কিশোরকে ও অনেকক্ষণ ধরে বলে যেতেন, বলা শেষ হলে প্রশ্ন করতেন, “বুঝেছ আমার দুর্ভাগ্য?” আমি ভয়ে ভয়ে বলতাম ‘বুঝেছি’ তিনি তৎক্ষণাৎ জোর গলায় বলে উঠতেন, ‘ছাই বুঝেছ’। তাঁর মাথার বিরাট টিকি দু’তিনবার লাফ দিত।

সেই ঢাকা শহরের এক টুকরো সোনার স্মৃতি সারা জীবন আমার মনে লেগে রয়েছে। বর্ষা সন্ধ্যার মেঘলা আকাশে এক ছটা লাল আবিরের মতো।

একটি মেয়ের সঙ্গে আমার ‘ভাব’ হয়েছিল।

তার নাম ভুলে গেছি। সে আমার চেয়ে বছরখানেকের ছোট ছিল। শুধু মনে আছে তার মা পরমা সুন্দরী ছিলেন, মেয়েটি ছিল কাঞ্চন বর্ণ, বড় বড় চোখ, মাথায় এক ঝাঁক ঝাঁকড়া চুল, মুখে সব সময় হাসির হিল্লোল।

তারা নিশ্চয়ই যোগেশচন্দ্র দাসশর্মা মশাইদের আত্মীয় ছিলেন, থাকতেন রমনায়, বড় একটা মাঠ ও মন্দির পেরিয়ে পৌঁছতে হতো তাদের বাড়ি। আমি ক’বার তাদের বাড়ি গেছি মনে নেই, শুধু মনে আছে, গেলে আমাদের আলাদা করা যেত না, কত কী সব কী যে কথা বলেছি ঈশ্বর জানেন, কিন্তু খুব মনে আছে তাকে বলেছিলাম, এই, জান, আমি তোমাকে ভালোবাসি, জবাবে সে বড় বড় চোখ দুটি আমার চোখে রেখে বলেছিল, আমিও ভালোবাসি তোমাকে।

এই নাম ভুলে যাওয়া মেয়েটি আমার জীবনে প্রথম প্ৰেম।

নামহীন বনফুলের মতো আমার জীবন-জঙ্গলে সে অমর।

প্রেমে পড়া, ভালোবাসা আমার পক্ষে খুব সহজ ছিল। সেই উমেশবাবুর বৈষ্ণব পদাবলী আমার মনকে নরম-গরম করে দিয়েছিল। জীবনে আমি অনেক নারীকে ভালোবেসেছি, পেয়েছি অনেক নারীর ভালোবাসা, তাদের প্রত্যেকের প্রভাব চিহ্নিত হয়ে রয়েছে তিনকুড়িদশের ইতিহাসে। পুত্র, তোমাকে তাদের কথা বলব, তাদের বাদ দিলে আমার জীবনের অনেকখানি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ডালপালা কেটে নিলে বৃক্ষের কাণ্ডটা যেমন প্রবল হয়েও দুর্বল হয়ে পড়ে।

ভালো পড়ুয়াদের খাতির একটু বেশি জোটে। স্কুলে ‘ভালো ছাত্র’ এই সুনাম অন্নদা সেন মহাশয়ের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছেছিল। অন্নদাবাবু নিজে আমাকে বলেছিলেন, “তোমাকে কিন্তু ডিস্ট্রিক্ট স্কলারশিপ পেতে হবে।”

তাঁর একটি মেয়ে, বয়স আমার মতো হবে, পনেরো পা-দেওয়া, আমাদের রাত্রির আহারের সময় উপস্থিত থাকত। সরল, সুশ্রী, খোলা মন, ঈষৎ প্রগলভ মেয়ে, শোভনা। শোভনা আমাকে একদিন বাড়ির ভিতর নিয়ে গেল। তাঁর মা’র সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে।

আমার পিতামহ রজনীকান্ত বিখ্যাত ব্যক্তি, পিতা দুর্জয়সিংহ শান্ত নিবিড় পুকুরের মতো গভীর, সুস্থির, নিঃসঙ্গ স্কুল মাস্টার।

সেকালের সমাজে এই টিকেট নিয়ে অনেকের বাড়িতেই প্রবেশ করা যেত।

শিক্ষকদের সম্মান ছিল গ্রামীণ সমাজে প্রচুর। পণ্ডিত ব্রাহ্মণদের মতোই।

শোভনার মাকে প্রণাম করতে তিনি একটা কাঠের হাতহীন চেয়ারে বসতে বললেন আমাকে।

মা, বোন, ভাইদের— তখন আমার দুটি ভাই— খবর নিলেন। বাবা সুস্থ আছেন কি না জিজ্ঞাসা করলেন। শোভনা একটা প্লেটে করে নাড়ু ও মোওয়া এনে দিল। বলল, “এগুলো সব খেতে হবে।” আমি বাধ্য ছেলে, সবগুলো খেয়ে নিলাম।

শোভনা মাকে বলল, “ছেলেটি ভালোই, কী বলো মা? বেশ কথা শোনে।” বলেই খিলখিল করে হেসে উঠল। আমি ভীষণ সংকুচিত হয়ে গেলাম।

শোভনা বলল, “পড়াশোনায় ভালো ছেলেরা সাধারণত বোকা—বোকা হয়ে থাকে। তোমাকে দেখে তা তো মনে হচ্ছে না।”

মা ধমকে উঠলেন, “কী সব বলছিস, খুকি! ও কী ভাববে?” আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, “এই মেয়েটা ভীষণ বাজে বকে। যাকে যা বলতে নেই, তাকে তাই বলে বসে। কিছু মনে করে বলে না কিন্তু।”

শোভনা বলল, “ক্লাসে ফেল করা মেয়ের মুখের কথার কোনো মানে হয় নাকি?”

মা বললেন, “ও কিন্তু আবার বাজে কথা বলছে। প্রথম বিভাগে নাইন থেকে টেনে উঠেছে। আসছে বছর ম্যাট্রিক দেবে।”

এবার আমি বললাম, “তারপর?”

শোভনা বলল, “তারপর দুটো পথ খোলা। একটা পথ নিয়ে যায় কলেজে, ইউনিভার্সিটিতে। অন্য পথ শ্বশুর বাড়ি।”

শোভনা আমাকে ‘তুমি’ বা ‘তুই’ একটা সম্বোধনও করেনি।

আমি প্রশ্ন করে বসলাম, “তুমি কোন্ রাস্তা নেবে?”

শোভনা বলল, “গাঁয়ের ছেলেরা মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে শেখে না। ‘তুমি’ বলছ কেন? ‘আপনি’ বলবে।”

আমি বললাম, “আমি তোমার এক ক্লাস উপরে পাড়ি। তুমি আমাকে আপনি বলবে, আমি তোমাকে বলব তুমি।”

“ওরে বাবা! এক মুহূর্তে দাদা হতে চাইছে!” চেঁচিয়ে উঠল শোভনা, সঙ্গে সঙ্গে হেসে গড়িয়ে পড়ল।

চারদিন পরীক্ষা চলছিল আমাদের। চারদিনই শোভনার সঙ্গে সন্ধেবেলায় গল্প হতো। আমাদের সম্বোধন স্বাভাবিক সরলতায় প্রথম থেকেই ‘তুমি’তে ধার্য হয়েছিল। শোভনা কথাবার্তায় সপ্রতিভ, আমিই বরং লাজুক। শোভনার ভাষায় ‘গ্রামের ছেলে’!

পরীক্ষা শেষ হলে আমি গণেশপুরে ফিরে গেলাম। রিকশা চেপে স্টিমার স্টেশনে যেতে হবে। শোভনা রাস্তায় এসে আমাকে বিদায় দিল।

বলল, “মনে থাকবে আমাকে?”

আমি বললাম, “গ্রামের ছেলেরা সহজে কাউকে ভোলে না।”

“তুমি কবে যাচ্ছ কলকাতা?”

“পাস তো করি।”

শোভনা হেসে উঠল, “পাস করা নিয়েও সন্দেহ! লোকে বলে তুমি তুখোড় পড়ুয়া।”

আমি বললাম, “ভালো পাস না করলে আমার কলেজে পড়া হবে না।”

বিস্মিত হয়ে শোভনা বলল, “কেন?”

“কলেজে পড়ার খরচ বাবা নাও যোগাতে পারেন।”

শোভনা আবার হেসে উঠল, “ভগবানকে ডেকো, হবেই হবে।” তখুনি মিহি গলায় গেয়ে উঠল শোভনা : “নিশিদিন/ভরসা রাখিস, ওরে মন, হবেই হবে/ যদি পণ করে থাকিস/ সে পণ তোমার রবেই রবে।”

আমি বললাম, “তুমি যে গাইতে পার তা তো জানতাম না।”

শোভনা বলল, “যাবার আগে জানিয়ে দিলাম, আরও অনেক গুণ আছে, ধৈর্য ও সময় থাকলে ক্রমে ক্রমে জানতে পারবে। পূজার সময় গ্রামে আসছ তো?”

“নিশ্চয়ই।”

“আমরাও যাব। তখন আবার দেখা হবে।”

আমরা দুজনে দুজনের চোখে চোখ রাখলাম। চারটি চোখেই জল।

পনেরো বছরের বুক কত সহজেই ভরা নদী হয়ে ওঠে। পনেরো বছরের আঁখি কত সহজে শিশিরভেজা সবুজ পাতার মতো কাঁপে ।

আমি হঠাৎ আবিষ্কার করলাম শোভনার চুলে একগুচ্ছ করবী। ওপরে তাকিয়ে দেখতে পেলাম আকাশ ঘন নীল।

পনেরো বছরের গ্রাম বাংলার ছেলেটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে উঠল :

“অলকে তার একটি গুছি করবী ফুল রক্তরুচি,
নয়ন করে কী ফুল চয়ন নীল গগনে দূরে দূরে।”

“বাপরে বাপ!” চমকে উঠল শোভনা, “তুমি এসব কবিতা শিখলে কী করে?”

আমি বললাম, “এটা একটা গান, কলের গানে শুনেছি।”

“কলের গান! ও! গ্রামোফোন!” শোভনা হেসে ভেঙে পড়ল। “ওঃ একেবারে গেঁয়ো ছেলে তুমি।”

আমি তখন রিকশায় বসে পড়েছি। বললাম, “চলি তাহলে শহুরে মেয়ে!”

শোভনা আমার জীবনের প্রথম মেয়ে বন্ধু। বেশিদিন বাঁচেনি সেই বন্ধুত্ব। শোভনাই বাঁচেনি বেশিদিন। শোভনা দীর্ঘজীবী হলেও আমাদের বন্ধুত্বের আয়ু নিশ্চয় দীর্ঘ হতে পারত না।

পঞ্চান্ন বছর আগে ছেলে-মেয়েদের বন্ধুত্ব নিষিদ্ধ ছিল। এইটুকু আমার চেয়ে শোভনা ভালো জানত।

তিন মাসের মধ্যে পরীক্ষার ফল বের হয়ে গেল। আমি ডিস্ট্রিক্ট স্কলারশিপ পেলাম না। তিনটি বিষয়ে ‘লেটার’ পেলাম— ইংরেজি, বাংলা, সংস্কৃত। গণিতে পেলাম ৬১ নম্বর।

উচ্ছ্বসিত প্রশংসা দিল না কেউ আমাকে। স্কুলে হেডমাস্টার ছিলেন না। অন্য শিক্ষকগণ খুশি হলেন, সঙ্গে সঙ্গে জিলার প্রথম না হতে পারার জন্যে দুঃখিত। মা খুশি হলেন নিশ্চয়ই, কিন্তু তিনটে বিষয়ে ‘লেটার’ পাওয়ার মাহাত্ম্য বুঝতে পেরেছেন তা মনে হলো না। জ্যেঠামশাই এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। শরিকদের পরিবারে গুরুজনদের মুখে হাসি ফুটল না।

কয়েকদিন পরে পিতৃদেবের পোস্টকার্ড এল। মাকে লেখা। “শ্রীমান ম্যাট্রিকুলেশনে ভালোই ফল করিয়াছে। এইবার তাহাকে কলিকাতায় গিয়া কলেজে পড়িতে হইবে। যাইবার পথে আমার কাছে কয়েকদিন থাকিয়া যাইবে, ইহাই স্থির করিয়াছি। সুরেশ্বর হইতে স্টিমার মেঘনা ও ভৈরবী নদী পথে খুলনা আইসে। শ্রীমান তাহাতেই আসিবে।”

আমার কাকামনি তখন কলকাতায়, বেকার। তিনি খুব বাহবা দিয়ে চিঠি লিখলেন আমাকে। “তুমি আমাদের বংশের সবচেয়ে ভালো ফল লাভ করিয়া ম্যাট্রিকুলেশন পাস করিয়াছ। তোমাকে বুকে জড়াইয়া ধরিতে ইচ্ছা হইতেছে।”

উমেশবাবু দুঃখ পেয়েছিলেন অঙ্কে ‘লেটার’ না পাওয়াতে কিন্তু সে দুঃখে ভার ছিল না। তিনি বলেছিলেন, তোমাকে বৈষ্ণব পদাবলী শিখিয়েছি। রস, রূপ, গন্ধে ভরে উঠবে তোমার জীবন। জীবন মধুময়, পৃথিবী সুন্দর, পবন সুগন্ধ, কৃষ্ণপ্রেম যে পেয়েছে তার বৈভবের অভাব নেই।

আজ মনু গেহ গেহ করি মানলু
আজ মনু দেহ ভেল দেহা।
আজু তিহি মোহে অনুকূল হো অল
টুটল সবহুঁ সন্দেহা।

“তোমার জীবন অনুকূল হোক। তুমি যেখানেই থাক, ‘মতি রহু তুয়া পরসঙ্গ।” উমেশ মাস্টার স্রোতের বুকে তৃণের মতো ভেসে অতীত হয়ে যাবে, কত কিছু ঘটনা ঘটবে তোমার জীবনে, সুখের পরে দুঃখ আসবে, রৌদ্রের পরে প্রভঞ্জন, শুধু মনে রেখো: “জাতি জীবন ধন তুমি।”

বিষাদ মেঘ ঘনিয়ে এল গণেশপুরের একটা প্রাচীন বাড়ির ‘দক্ষিণের ঘরে।” পুত্র গ্রামের পাঠ শেষ করে যাচ্ছে কলকাতা, কলেজে পড়বে, মানুষ হবে, সেই বিষাদ মেঘে ঘনঘন বিদ্যুতের ঝিলিক : এই বিয়োগের সতরঞ্চি আশা, উত্তেজনা, স্বপ্নের সুতোয় বোনা। আমার চোখে সবকিছু নতুন। নতুন করে দেখছি আমি পদ্মানদীর ছলছল ঢেউ, বকপাখিগুলোকে মনে হচ্ছে সুদূর হাতছানি, তৃণ-লতা-বৃক্ষরাজির নিবিড় সবুজের অশ্রুস্নিগ্ধ স্পর্শ লাগছে আমার শরীরে। ডালিম গাছটা তার অসংখ্য লাল ফুলগুলো প্রজাপতির ডানার মতো রঙের দাপটে তুলে ধরেছে আমার সামনে। ভবিষ্যতের ইশারা জানাচ্ছে পনেরো বছরের একটি ছেলেকে। এত পাখির এত কূজন এর আগে কানে বাজেনি আমার, বাতাস কোমল পরশ দিয়ে যাচ্ছে এক তরুণ দেহে, আকাশ কোন দিগন্ত থেকে অজানা ভবিষ্যতের দিকে হাতছানি দিচ্ছে। মালতী, কামিনী, যুঁই, স্থলপদ্ম, গন্ধরাজ, গাঁদা, কচুরিপানা, শাপলা যতকিছু ফুটত আমাদের বাগানে, জঙ্গলে, পুকুরে, পথের ধারে! তাদের সকলের মন্ত্রহীন বাগ্ময়তার মধ্যে আমি চরে বেড়াচ্ছি। সঙ্গে সঙ্গে প্রতি মুহূর্ত বুক ফেটে কান্না আসছে, যখন দেখছি মা’র বিষণ্ন মুখ, আমার এক-আত্মা বোন মধুর মুখ ও চলাফেরা, দু’ভাই কানু ও ভানুর ব্যথাতুর চোখ। পনেরো বছর বয়সে আমি অনেক পাকা হয়ে গেছি, পাঁচ বছর মা’র সঙ্গে হাত মিলিয়ে সংসার চালিয়েছি, পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব যেন আমারও কাঁধের ওপর এসে গেছে। এখন মাকে সবকিছু একা সামলাতে হবে। জ্যেঠামশাই অভিভাবক হিসেবে সবকিছু দেখবেন নিশ্চয়, তবু মা’র সঙ্গে বসে বসে সংসার চালাবার দৈনন্দিন অনেক ‘সমস্যা’ আমি আলোচনা করেছি। আমি বুঝতে পারছি মা-মধু-কানু-ভানু-সবাই অদূর ভবিষ্যতে গণেশপুর ছেড়ে চলে যাবে, মাকে একা একা গ্রামে বেশিদিন রাখা চলবে না। মধু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়া শেষ করে তিন বছর বাড়িতে পড়ছে, ওকে স্কুল কলেজে পড়াতে হবে। আমার গণেশপুর ছাড়া আর একটি ভদ্র পরিািবরের গ্রাম ছেড়ে শহরবাসের সূচনা এ কথাটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে, সবাইকে যে “শীঘ্রই” খুলনা অথবা কলকাতা যেতে হবে তা নিয়ে রোজ আমাদের মা ছেলেমেয়েদের মধ্যে উত্তপ্ত উৎসাহিত আলোচনা।

কানু বলে রেখেছে, দাদা, আমরা যখন কলকাতা যাব, খাটগুলো সব নিয়ে যাব কিন্তু! আমরা ওর কথা শুনে হেসেছি, কিন্তু এত বড় একটা ব্যবহারিক ঘোষণার মধ্যে হাসির কী আছে কানু তা একেবারেই বুঝতে পারছে না।

বাবা খুলনা পর্যন্ত যাবার ভাড়া পাঠিয়েছিলেন। মা তাঁর বহুকষ্টে জমানো তহবিল থেকে পুরো দুটো টাকা বাড়তি খরচার জন্য দিলেন। একটা টিনের বাক্সে ধুতি, তিনটে শার্ট, দুটো গেঞ্জি, একখানা গামছা, একখানা পাঞ্জাবী গুছিয়ে দিলেন মা।

মা’র চরণধূলি আর আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে, সব গুরুজনদের প্রণাম করে নারায়ণ ঘর, দুর্গা মণ্ডপ, কালীপূজার ঘরে প্রণত হয়ে আমি এক বসন্ত প্রভাবে গণেশপুরের পদ্মা নদীতীরে নৌকায় চেপে বসলাম। জ্যেঠামশাইয়ের সঙ্গে কানু, মধু, ভানুও এল আমাকে তুলে দিতে। নৌকাতে আরও তিনজন যাত্রী ছিল, জ্যেঠামশাই তাদের বারবার করে অনুরোধ করল, আমার উপর তারা যেন নজর রাখে।

জীবনের দ্বিতীয়ার্ধে আমি প্রায় সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়িয়েছি। কিন্তু সেই আমার জীবনের প্রথম ঐতিহাসিক যাত্রার সঙ্গে কোনো যাত্রার তুলনা হতে পারেনি। একটি নিতান্ত সাধারণ স্বল্পবিত্ত বাঙালি পরিবারের পনেরো বছরের ছেলের জীবনে অ্যাডভেঞ্চার বলে কিছু ছিল না। আমাদের প্রথম ও শেষ মন্ত্র ছিল আত্মরক্ষা। আমি ড্যানিয়েল ডুফোর ‘রবিনসন ক্রুশো’ পড়েছিলাম। সেই দুঃসাহসী ইংরেজ সমুদ্রের অলঙ্ঘনীয় আহ্বানে আত্মীয়-স্বজনের উপদেশ অগ্রাহ্য করে জাহাজে চেপে বেরিয়ে পড়েছিল, ভীষণ প্রভঞ্জন, পাহাড় প্ৰমাণ সমুদ্রের ঢেউ, বার বার জাহাজডুবি, লোকজনহীন আফ্রিকার দ্বীপে বছরের পর বছর কাটিয়েছিল। সেই অসম দুঃসাহসিক ভ্রমণ কাহিনি পড়ে বারে বারে দেহ রোমাঞ্চিত, মন ভীতচকিত হয়েছে আমার। আমি পরাধীন দেশের সবেমাত্র স্কুল পাস করা তরুণ, বাবা আমার দরিদ্র স্কুল মাস্টার। মা’র বছরে চারখানার বেশি শাড়ি জোটে না, অনেক আত্মীয়-স্বজন আমার পিতার সামান্য রোজগারের উপর নির্ভরশীল। আমি গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় যাচ্ছি যেমন যায় সব ভদ্রঘরের ছেলেরাই, ভবিষ্যতের ডাকে। পরিষ্কার নয় সে ডাক আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই পড়াশুনার পর কী আমি হব—শিক্ষক, না ডাক্তার, না উকিল! কলেজে পড়তে পারব কিনা তাও নিশ্চিত নয়, যদিও মনে মনে দৃঢ় বিশ্বাস আমার বাবা ব্যবস্থা করবেনই। আমার যাত্রার মধ্যে নাটক নেই, কাহিনি নেই, শুধু আছে তরুণ বুকের দুরুদুরু ভয় মাখা স্বপ্ন, আর ছেড়ে আসা মা-ভাইবোনদের জন্য ব্যথা। সঙ্গে রয়েছে পনেরো বছরের জীবনের বাড়তি প্রাপ্তি— উমেশবাবুর মুখে উচ্চারিত বৈষ্ণব পদাবলী, ঢাকার রমনার সেই (এখন) নাম ভুলে যাওয়া মেয়েটির বড় বড় চোখের চাহনি, শোভনার সপ্রতিভ হাসির ফোয়ারা। রয়ে গেছে, আমার লুকানো একেবারে একতরফা প্রেম, খুড়তুতো দিদি গৌরীর মধুর স্মৃতি।

আমি পিছুটান মানুষ নই, অতীত মন্থন নয় আমার স্বভাব। যে যায় সে যায়: জীবন চলে, চলে, চলে : ‘চরৈবেতি’, বলেছেন উপনিষদের ঋষি। সুদূর, তুমি সুদূর, আমাকে পেছনে টেনো না, আমার কাছে তুমি অশান্ত নীরব অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, ‘তরঙ্গ উঠে প্ৰাণে, দিগন্তে কাহার পানে/ ইঙ্গিতের ভাষায় কাঁদে, নাহি নাহি কথা।’ গণেশপুর কোনোদিনও আমার মন থেকে নিশ্চিহ্ন হবে না আমি জানতাম। পরিণত বয়সে দেখেছি যে সব পর্দায় সবচেয়ে পরিষ্কারভাবে গাঁথা রয়েছে, স্মৃতি ছায়াছবির মনের গণেশপুর তার মধ্যে প্রথম। কিন্তু গণেশপুর কখনো আমাকে পিছু ডাকেনি। দুবার আমি ফিরে এসেছি গণেশপুরে, পূজার সময়, দুবারই মনে হয়েছে আমি শেষ ত্রিশের গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছি, যেখানে জীবনের প্রবাহ প্রবল, যেখানে পৃথিবী এসে মিশেছে, ক্ষণি ধারায় বা স্রোতধারায়, আমার মতো এক যুবকের জীবনেও। ইতিহাস উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল সেই সময়, ভারতবর্ষে সুভাষ বসুর নেতৃত্ব নিয়ে কংগ্রেসে বিরাট আলোড়ন, অবস্থিত নেতাদের মনে বিরাট আতঙ্ক। বহু মানুষের স্নায়ুতে সংগ্রামের নতুন প্রবাহ ধাক্কা দিচ্ছে ইউরোপের রাজনৈতিক ঘটনাবলি। হিটলার আমাদের কমবেশি প্রিয়, কেননা তিনি সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ ফরাসি শক্তির শত্রু। গণেশপুরে এসব প্রবল ঘটনাপ্রবাহের সামান্য উত্তাপ আমি অনুভব করেছি। জেনেছি ভাইসরয় লর্ড লিনলিথগো, তাঁর তালগাছসম উঁচু শরীর ও বিরাট নাসিকা নিয়ে একমনে ভারতের গাভীকূলের সেবা করে যাচ্ছেন, গো-পালনই তাঁর মতে ভারতকে সবল করবে, স্বরাজের অনিশ্চিত সীমানার দিকে ধীরে আস্তে নিয়ে যাবে।

এই ইতিহাসের চৌমাথায় যখন ভারত ও পৃথিবী পৌঁছাচ্ছে, একটি বাঙালি তরুণ অথবা প্রথম প্রবাহের যুবক, তার মাতৃভূমি, পনেরো বছরের মাতৃ-আশ্রয় গণেশপুর গ্রাম ত্যাগ করে চলল কলকাতার উদ্দেশ্যে, ‘আমার অনেক পথ পাড়ি দিবার আছে, আছে অনেক অঙ্গীকার পালনের অপেক্ষায়’– কিন্তু পদ্মায় নদী একটুও বাড়ন্ত উচ্ছ্বাস দেখাল না। প্রকৃতি দেখাল না এতটুকুও বেশি চাঞ্চল্য। আমার বুকের স্বপ্ন ও আশা ভেসে গেল চোখের নোনা জলে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *