দ্বিতীয় অধ্যায় – পশুচারণের অর্থনীতি (খ্রীঃ পূঃ ১৫০০-খ্রীঃ পূঃ ১০০০)
নগরাশ্রয়ী যে অর্থনৈতিক জীবন ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম ও পশ্চিমাংশে খ্রীঃ পূঃ ২৩০০ থেকে প্রায় ছয়শ’ বছর ধরে বিরাজ করছিল পুরাতাত্ত্বিকদের বিচারে, খ্রীঃ পূঃ ১৭৫০ নাগাদ তার অবসান ঘটে। এই সভ্যতার ধ্বংসের ফলে কেবলমাত্র হরপ্পা সভ্যতার নগরগুলি যে বিলুপ্ত হ’ল তাই নয়, অর্থনৈতিক জীবনযাত্রায় যেন কিছুটা আকস্মিকভাবেই নগরের ভূমিকা একেবারে গৌণ হয়ে পড়ল। হরপ্পা সভ্যতার আমলে সুশৃঙ্খল, বহুবিস্তৃত ও সমৃদ্ধ শহর প্রধান অর্থনীতির যে ধারাবাহিক পরিচয় পাওয়া যায়, তাতে এক দীর্ঘ ছেদ ঘটেছিল। ১৭৫০ খ্রীঃ পূঃ নাগাদ হরপ্পা সভ্যতার ধ্বংসের পর প্রায় হাজার বছর ভারত উপমহাদেশে কোথাও শহরের দেখা পাওয়া দুষ্কর। হরপ্পা যুগের নগরকেন্দ্রিক অর্থনীতি কার্যত বাতিল হয়ে যাবার পর যে নতুন অর্থনৈতিক জীবনযাত্রা তার স্থানে দেখা দিল, তা প্রাচীন ভারতীয় অর্থনীতির ইতিহাসে একটি স্বতন্ত্র পর্বের মর্যাদা পেতে পারে।
নগর বিমুখ নতুন অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের গতিপ্রকৃতি ও চরিত্র বুঝতে গেলে প্রয়োজনীয় তথ্যের জন্য বৈদিক সাহিত্যের উপর নির্ভর করা দরকার। বৈদিক সাহিত্য কেবলমাত্র ভারতের প্রাচীনতম সাহিত্যকীর্তি নয়, বৈদিক সাহিত্যের আদি পর্বের রচনা ঋগ্বেদ সমগ্র ইন্দো-ইওরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীতেও সবচেয়ে পুরাতন সাহিত্যকীৰ্ত্তি। বৈদিক সাহিত্যের দুটি প্রধান ভাগ আছে: (১) ঋগ্বেদ, যা বৈদিক সাহিত্যের আদিতম যুগ, ও (২) পরবর্তী বৈদিক সাহিত্য—এর মধ্যে ঋগ্বেদ ছাড়া বাকী তিনটি বৈদিক সংহিতা, সাম, যজুঃ ও অথর্ব অন্তর্ভুক্ত এবং ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ গ্রন্থগুলিও এই পর্যায়ের অন্তর্গত। সাধারণভাবে বিশ্বাস করা হয় যে বৈদিক সাহিত্যের স্রষ্টা ছিলেন আর্যরা। কিন্তু এটা খেয়াল রাখা অত্যন্ত জরুরী যে বৈদিক ও ধ্রুপদী সংস্কৃত ভাষায় আর্য শব্দটি কখনওই জাতিবাচক কথা হিসেবে ব্যবহৃত হয় নি। সাধারণ অর্থে আধুনিক কালে ‘ভদ্রলোক’ বলতে যে ধারণা হয়, আর্য কথাটি মোটামুটি অনুরূপ ব্যবহার করা হত। আর্য বলতে ভাষাতাত্ত্বিকরা একটি ভাষা গোষ্ঠীকেও চিহ্নিত করেন। এই ভাষা গোষ্ঠী ইন্দো-ইওরোপীয় নামেও পরিচিত। এই ভাষার মধ্যে পড়ে সংস্কৃত, ইরাণীয়, গ্রীক, ল্যাটিন, জার্মান ভাষা ও এই ভাষাগুলি থেকে পরবর্তীকালে উদ্ভূত বিভিন্ন ভাষা। অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতকে ভাষা ও জাতিকে সমার্থক হিসেবে বিচার করার ভ্রান্ত প্রবণতা থেকেই আর্য শব্দটি জাতি অর্থে ধরা হয়েছিল। বর্তমানে এই মত ভুল বলে পরিত্যক্ত হয়েছে; এবং আর্য কথাটি নিছক ভাষাগোষ্ঠীকে বোঝানোর জন্যই ব্যবহার শ্রেয়। কিন্তু যেহেতু আর্য শব্দটি দীর্ঘদিন ধরে এক ধরনের মানবগোষ্ঠীকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে, তাই আর্য শব্দটির ব্যবহার পণ্ডিতমহলে এখনও পরিত্যক্ত হয় নি। তবে আর্য কথাটিকে আধুনিক পণ্ডিতরা সচরাচর বিভিন্ন আর্যভাষা ব্যবহারকারী জনগোষ্ঠীরূপে বিচার করেন।
ইন্দো-ইওরোপীয় তথা আর্য বা আর্যভাষা ব্যবহারী জনগোষ্ঠীর আদি বাসস্থান কোথায় ছিল, এই নিয়ে দীর্ঘদিনের বিতর্ক আছে। ইন্দো-ইওরোপীয় ভাষার প্রাচীনতম সাহিত্য ঋগ্বেদ যেহেতু ভারতেরও সবচেয়ে পুরাতন সাহিত্য, তাই কিছু পণ্ডিত মনে করতেন যে ভারতীয় উপমহাদেশই ছিল আর্যভাষা ব্যবহারকারীদের আদি নিবাস। কিন্তু এই মত ভাষাতাত্ত্বিক বিচারে ও ঐতিহাসিক সাক্ষ্যের ভিত্তিতে এখন আর গ্রাহ্য নয়। ইন্দো-ইওরোপীয়দের সম্ভাব্য আদিনিবাস হিসাবে হাঙ্গেরী ও পামির মালভূমি অঞ্চলকেও চিহ্নিত করা হয়েছিল; এই মত দুটিও অবশ্য পণ্ডিত মহলে যথেষ্ট সমর্থন পায়নি। তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের নিরিখে ব্ৰাণ্ডেনস্টাইন প্রমাণ করতে প্রয়াসী হয়েছেন যে ইন্দো-ইওরোপীয় ভাষা ব্যবহারী জনগোষ্ঠীর প্রাচীনতম বসতি ছিল বর্তমান সোভিয়েট রাশিয়ার অন্তর্গত কিরঘিজ তৃণভূমি অঞ্চলে। এই মতটিই সম্প্রতি অধিকাংশ পণ্ডিতের কাছে গ্রহণীয়। কিরঘিজের আদি বসতি থেকে ইন্দো-ইওরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর লোকেরা দুই দিকে চলে গিয়েছিল–- (১) এশিয়া মাইনর পেরিয়ে ইওরোপে ও (২) পশ্চিমদিকে ইরাণে। দ্বিতীয় দলটি ইরাণে কিছু সময় থাকার পর আবার দ্বিধাবিভক্ত হয়: একটি গোষ্ঠী ইরাণ থেকে আফগানিস্তান হয়ে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত পেরিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে আসে এবং অবশিষ্ট অংশ ইরাণেই রয়ে যায়।
উপরের আলোচনা থেকে এইটুকু সম্ভবত আন্দাজ করা সম্ভব যে ভারতে আগমনের আগে ইন্দো-ইওরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর লোকেরা ইতস্তত বিচরণশীল যাযাবর জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত ছিল। কিরঘিজ তৃণাঞ্চলে তাদের আদিতম বাসভূমি ছিল, এই মত মানলে অনুমান করা চলে যে পশুচারণই ছিল এই যাযাবর গোষ্ঠী বা গোষ্ঠীগুলির প্রধান জীবিকা। ভারতে তারা কবে আসে ও ঋগ্বেদের সঠিক রচনাকাল কি, তা নির্দেশ করা কঠিন এবং দুই বিষয়েই বিদ্বৎসমাজে মতপার্থক্য ব্যাপক। আঃ ১৪০০ খ্রীঃ পূঃ-তে পশ্চিম এশিয়ার বোঘাজ-কোই থেকে পাওয়া একটি লেখ থেকে চারজন দেবতার নাম জানা যায়, যাঁরা ঋগ্বেদেও বিশেষ পরিচিত। এঁরা হলেন: ইন-দা-রা (ইন্দ্র), অ-রু-ণ বা উ-রু-ব-ন (বরুণ), না-স-অত্-তি-ই-ইয় (নাসত্য), মিথ্-র (মিত্র)। এছাড়া প্রায় সমকালীন আরও একটি লেখতে কয়েকটি সংখ্যাবাচক শব্দ পাওয়া যায়, যাদের সঙ্গে বৈদিক সংস্কৃতে ব্যবহৃত কয়েকটি অনুরূপ সংখ্যাবাচক শব্দের সাদৃশ্য প্রকট, যেমন ঐক (এক), তের (তৃ) পন্জ (পঞ্চ), সত্ত (সপ্ত) প্রভৃতি। এই প্রমাণগুলির ভিত্তিতে সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব যে আর্যভাষীরা সম্ভবতঃ খ্রীঃ পূঃ ১৫০০ বা তার কিছু আগে-পরে ভারত উপমহাদেশে পৌঁছেছিলেন। অনেককাল আগে ফ্রিডরিশ মাক্সম্যূলর বৈদিক সাহিত্যে যে কালানুক্রম দেখিয়েছিলেন, তা নিম্নরূপ: বৈদিক সাহিত্যের নবীনতম অংশ উপনিষদ সম্ভবতঃ বুদ্ধের সময় থেকে খুব বেশী ব্যবধানে উদ্ভূত হয়নি। ফলে বুদ্ধের আবিভার্ব যদি খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতকে ঘটে থাকে, তা হলে প্রধান উপনিষদগুলি তার প্রায় সমসাময়িক, অথাৎ ৮০০-৬০০ খ্রীঃ পূঃ, ম্যাক্সমূলরের বিচারে বৈদিক সাহিত্যের প্রত্যেকটি স্তরের মধ্যে অন্ততঃ দুইশ বছরের ব্যবধান আছে। সেইমত উপনিষদের পূর্ববর্তী ব্রাহ্মণ ও আরণ্যক সাহিত্যের কাল নির্ণয় হল ১০০০-৮০০ খ্রীঃ পূঃ, এবং প্রাচীনতম ঋগ্বেদের সময় সাব্যস্ত হ’ল ১২০০-১০০০ খ্রীঃ পূঃ।
ঋগ্বেদের বর্তমান যে রূপের সঙ্গে আমরা পরিচিত, তা দশটি ‘মণ্ডলে’ বিভক্ত। প্রতিটি মণ্ডলে আছে বহু সূক্ত যাতে বিভিন্ন দেবতার উদ্দেশে প্রাচীন বৈদিক ঋষিদের ওব ও প্রার্থনা বিধৃত। ভারতের প্রাচীনতম গ্রন্থ ও প্রাচীনতম বেদ হিসেবে সাহিত্যিক মূল্য ছাড়াও ধর্মীয় পুস্তক হিসেবে ঋগ্বেদের বিশেষ মর্যাদা আছে। ভারতীয় ধর্ম ও দর্শনের নানা চিন্তার ও ধ্যানধারণার বীজ ও প্রথম প্রকাশ ঋগ্বেদের সূক্তেই নিহিত। কিন্তু বিশেষ লক্ষ্যণীয় বিষয় এই যে ঋগ্বেদের বেশীরভাগ সূক্তে উচ্চারিত প্রার্থনায় নিতান্ত ঐহিক বস্তু পাবার অভিলাষ ব্যক্ত হয়েছে; অতীন্দ্রিয় পারমার্থিক আধ্যাত্মিকতার ছাপ সেখানে অল্পই। ফলে ঋগ্বেদের সূক্তগুলি সমকালীন জীবনযাত্রার বস্তুগত ভিত্তি সম্বন্ধে আমাদের অবহিত করে। তবে পণ্ডিতদের বিচারে ঋগ্বেদের দশটি মণ্ডলের মধ্যে প্রথম ও দশম মণ্ডল প্রক্ষিপ্ত, অর্থাৎ এই দুই মণ্ডল পরবর্তীকালের সংযোজন। ফলে ঋগ্বেদের এই দুই মণ্ডলের সাক্ষ্য বাদ দিয়ে ঋগ্বেদের তথ্য ব্যবহার করাই যুক্তিযুক্ত।
॥ ২ ॥
আগেই বলা হয়েছে আঃ ১৫০০ খ্রীঃ পূঃ-তে যে বহিরাগত জনগোষ্ঠী ইরাণ থেকে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চল দিয়ে ভারত উপমহাদেশে এল, তারা সম্ভবত ভ্রাম্যমান যাযাবর জীবনে অভ্যস্ত ছিল। ঋগ্বেদের ভিত্তিতে প্রমাণ করা যায় যে এই যাযাবর গোষ্ঠী ঘোড়ার ব্যবহারে দক্ষ হওয়ায় তাদের ভ্রাম্যমান জীবন ছিল গতিময়। বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে, ভারতের ইতিহাসে খ্রীঃ পূঃ ১৫০০-র আগে ঘোড়ার ব্যবহারের নিশ্চিত প্রমাণ নেই; অব্যবহিত আগের পর্বে অর্থাৎ হরপ্পা সভ্যতার শহর কেন্দ্রিক অর্থনৈতিক জীবনে ঘোড়ার উপস্থিতি ছিল না।
উপমহাদেশের কোন অঞ্চলে এই জনগোষ্ঠীর বসতি গড়ে উঠল, তা ঠিক করা বিশেষ জরুরী; কারণ অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ অনেকাংশে ভৌগোলিক পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হয়। ঋগ্বেদের বর্ণনায় বহু নদীর নাম আছে; এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল সিন্ধু ও সরস্বতী। এই নদী দুটি ঋগ্বেদে ‘অম্বিতমা’ ও নদীতমা’ আখ্যায় ভূষিত; কারণ তারা সমুদ্রগামিনী নদী, এছাড়া সিন্ধুর পশ্চিম ও পূর্বদিকের উপনদীগুলিও ঋগ্বেদে বারবার উল্লিখিত। সিন্ধুর পশ্চিম দিকের উপনদীগুলির মধ্যে ক্ৰমু (আধুনিক কুররম) কুভা (আধুনিক কাবুল), মেহৎনু গুরুত্বপূর্ণ (পশ্চিম দিকের উপনদীগুলির অধিকাংশই বর্তমানে আফগানিস্তানের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত)। সিন্ধুর পূর্বদিকের উপনদীগুলির মধ্যে বিতস্তা (ঝিলম), বিপাশা (বিয়াস), অসিক্নী (চন্দ্রভাগা বা চেনাব), পরুষ্ণী বা ইরাবতী (রাভি) ও শতদ্রু (সাটলেজ)-এর নাম করা যায়। সিন্ধুর মতই অপর প্রধান নদী ছিল সরস্বতী। ভৌগোলিক ও পুরাতাত্ত্বিকদের গবেষণায় এখন প্রমাণ করা সম্ভব যে প্রাচীন সরস্বতী নদী (যা বর্তমানে একেবারে শুষ্ক) তার একটি খাত বেয়ে সিন্ধুর সঙ্গে মিলত, অপর একটি খাত সরাসরি সমুদ্রে (আরব সাগরে) গিয়ে পড়ত। এই কারণেই সিন্ধুর অন্যতম উপনদী হওয়া সত্ত্বেও সরস্বতীকে সমুদ্রগামিনী নদী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। সিন্ধু, সরস্বতী ও সিন্ধুর নানা উপনদীর কথা ঋগ্বেদে বারবার বলা হলেও, আশ্চর্যের বিষয়, উত্তর ভারতের দুই প্রধান নদী গঙ্গা ও যমুনার কথা গোটা ঋগ্বেদে মাত্র একবার উল্লিখিত। সেই উল্লেখও করা হয়েছে প্রক্ষিপ্ত দশম মণ্ডলের নদীসূক্তে (১০.৭৫)। অতএব এমত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব যে ঋগ্বেদে উল্লিখিত জনগোষ্ঠী (বা জনগোষ্ঠীগুলি) সিন্ধু ও তার উপনদীগুলির দ্বারা বিধৌত অঞ্চল যতটা সম্যকভাবে জানতেন, তার তুলনায় পূর্ব দিকে গাঙ্গেয় উপত্যকা ও গঙ্গা-যমুনা দোয়াবের সঙ্গে তাঁদের পরিচয় নিতান্ত ক্ষীণ। অর্থাৎ আফগানিস্তান, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চল, পাকিস্তান ও ভারতের অন্তর্গত পঞ্জাবের দুই অংশ, হরিয়ানা, নিম্নসিন্ধু উপত্যকার অংশ ও রাজস্থানের কিছুটা অংশ নিয়ে ঋগ্বেদের পরিমণ্ডল গঠিত। এই সীমার ভিতরে ঋগ্বেদে উল্লিখিত শ্রেষ্ঠ ভূখণ্ডের নাম ‘সপ্তসিন্ধব’। ‘দেবনির্মিতদেশ’ বলে প্রসিদ্ধ এই সপ্তসিন্ধব অঞ্চলের মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব অনুধাবন করা কঠিন নয়। সপ্তসিন্ধু বা সাতটি নদী বিধৌত অঞ্চলই সপ্তসিন্ধব। এই সাতটি নদী ছিল সিন্ধু, তার পূর্বদিকস্থ পাঁচটি উপনদী এবং সরস্বতী। প্রাচীন সপ্তসিন্ধব অঞ্চলের অনেকাংশই বর্তমান পাঞ্জাব ও নিম্নসিন্ধু অঞ্চলে অবস্থিত। এই ভূখণ্ডের নানা জায়গায় প্রাক-বৈদিক হরপ্পা সভ্যতার নগরাশ্রয়ী অর্থনীতির (২৩০০-১৭৫০ খ্রীঃ পূঃ) পরিচয় পাওয়া যায়।
॥ ৩ ॥
কিন্তু সমগ্র ঋগ্বেদে নগরের উল্লেখ যে নিতান্ত সামান্য তাই নয়, নগরের প্রতি তীব্র অনীহাও ঋগ্বেদের বহু সূক্তে উচ্চারিত। কিভাবে ‘কৃষ্ণত্বাচ’ (যাদের গাত্রবর্ণ কালো), অনাস (যাদের নাক তীক্ষ্ণ নয়), ‘মৃধ্রবাচ’ (যাদের ভাষা অবোধ্য), ‘দাস’ বা ‘দস্যু’ জাতীয় গোষ্ঠীর লোকের পুর বা নগর ধ্বংস করা হয়েছে, তার অজস্র বর্ণনা ঋগ্বেদে আছে। ঋগ্বেদে ইন্দ্র মহা বীর ও রণনেতা রূপে কীৰ্ত্তিত; তিনিই দাস ও দস্যুদের বিরুদ্ধে জয় সুনিশ্চিত করেন। তিনি ‘পুরন্দর’ নামে ও আখ্যাত, কারণ তিনি পুর বা নগর ধ্বংস করেন। প্রাক-ঋগ্বেদ পর্বে পাঞ্জাব এবং সিন্ধু অববাহিকায় অবস্থিত পুরগুলি প্রধানতঃ হরপ্পীয়দেরই কীর্ত্তি। ফলে ঐ নগরগুলি যে ইন্দো ইওরোপীয়দের অনুপ্রবেশ ও অভিযানের দ্বারা উপদ্রুত হয়েছিল, এ অনুমান অযৌক্তিক নয়। তাই স্যার মর্টিমার হুইলার প্রচ্ছন্নভাবে হরপ্পা সভ্যতার পতনের সম্ভাব্য কারণগুলির মধ্যে ইন্দো-ইওরোপীয়দের অনুপ্রবেশের প্রতি ইঙ্গিত করেছিলেন। হুইলারের এই ধারণার সমর্থনে সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ হাজির করা কঠিন; কিন্তু এটুকু অনুমান অসঙ্গত হবে না যে যাযাবর জীবনে অভ্যস্ত জনগোষ্ঠীর পক্ষে নগরের স্থায়ী ও নিশ্চিত জীবনযাত্রার প্রতি তীব্র বিরাগ থাকা স্বাভাবিক। সেই কারণে ঋগ্বেদে ‘পুর’ বা নগরের ধ্বংস হবার বর্ণনা প্রচুর পরিমাণে আছে—সে পুর বা নগর যাদেরই হোক না কেন।
যাযাবর বৃত্তি যেমন স্থায়ী বসতির সঙ্গে সহজে খাপ খাওয়াতে পারে না, তা অন্যদিকে স্থায়ী অর্থনৈতিক জীবনের তুলনায় পশুচারণেই বেশী অভ্যস্ত থাকে। যাযাবর জীবনের এই দিকটিও ঋগ্বেদে প্রকট। ইন্দো-ইওরোপীয়রা যে কেবলমাত্র নগরাশ্রয়ী অর্থনৈতিক জীবনের বিরোধী ছিল তা নয়, সমগ্র ঋগ্বেদে গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতির চেয়ে পশুচারণ ও পশু সম্পদের গুরুত্ব নির্দ্বিধায় স্বীকৃত। কৃষিকাজের উল্লেখ ঋগ্বেদে অনুপস্থিত নয়, কিন্তু কৃষির সম্বন্ধে উল্লেখ পশুচারণের তুলনায় সংখ্যায় নগণ্য। পশু সম্পদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী মূল্যবান হয়ে দেখা দিয়েছিল গবাদি পশু ও অশ্ব। আগেই বলা হয়েছে, ভারতীয় উপমহাদেশে অশ্বের ব্যবহার সূচনা করার কৃতিত্ব ইন্দো-ইওরোপীয়দেরই প্রাপ্য।
ঋগ্বেদে ‘গো’ অর্থাৎ গবাদি পশুকে ‘রয়ি’ বা সম্পদ বলা হয়েছে। গো’ ও ‘রয়ি’ প্রায় সমার্থক শব্দ রূপেই ঋগ্বেদে ব্যবহৃত। তা হলে বোঝা যাচ্ছে, ঋগ্বেদের কালে প্রধান সামাজিক ধনসম্বল ছিল গো সম্পদ; সেক্ষেত্রে পশুপালনই হয়ে উঠবে জীবনধারণের প্রধান উপায়। অতএব বলতে দ্বিধা নেই যে হরপ্পার নগরাশ্রয়ী জীবনের যে উত্তরসূরীর উদ্ভব ঘটল, সেখানে হরপ্পা সভ্যতার সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী অর্থনৈতিক অবস্থা-ব্যবস্থার প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। নাগরিক অর্থনীতি তো প্রত্যাখ্যাত হ’লই, উপরন্তু গ্রামকেন্দ্রিক কৃষি অর্থনীতিও যথেষ্ট গুরুত্ব পেল না। বরং কৃষি অর্থনীতির চেয়ে পশুচারণই জীবিকা হিসেবে প্রাধান্য লাভ করল। এই কারণেই ঋগ্বেদে ধনী ব্যক্তির সমার্থক শব্দটি ‘গোমৎ’, যার আক্ষরিক অর্থ গোসম্পদের অধিকারী ব্যক্তি। কন্যাসন্তানের প্রতিশব্দ ‘দুহিতৃ’ (যা আজও ব্যবহৃত) কথাটিতেও গোসম্পদের ব্যঞ্জনা লক্ষ্যণীয়, অর্থাৎ যিনি গাভী দোহন করেন। রামশরণ শর্মা দেখিয়েছেন যে সমগ্র ঋগ্বেদে ‘গো’ শব্দটি কম করেও ১৭৬ বার উল্লিখিত। গোসম্পদের গুরুত্ব এবং অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপে পশুচারণের প্রাধান্য সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ নেই।
ঋগ্বেদের সূক্তগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিতান্ত পার্থিব প্রার্থনায় মুখর। এই পার্থিব আকাঙক্ষার মধ্যেও সর্বপ্রধান ছিল পশুসম্পদ লাভের বাসনা, যে পশু সম্পদের মধ্যে আবার গবাদি পশু ও ঘোড়াই শ্রেষ্ঠ। তাই সোম দেবতার উদ্দেশে বচিত সূক্তে বলা হয়, “হে সোম! তুমি সুবর্ণ ও ধন, জন, বিতরণ করতে করতে ক্ষরিত হও। তুমি গোধন ও খাদ্যদ্রব্য আনয়ন কর” (৯-৬৩-১৮)। ঐ সোমের উদ্দেশেই অন্যত্র উচ্চারিত হয়েছে অনুরূপ আর একটি প্রার্থনা: “আমাদের অনেক গোধন এবং বেগবান অনেক অশ্ব বিতরণ কর” (৯-৬-৪৪)। আর একটি প্রার্থনাতেও প্রায় একই সুর: “হে সোমরস! আমাদের শতশত গো ধন এবং সহস্র ঘোটক এবং নানা প্রকার সম্পত্তি এনে দাও” (৯-৬৭-৭)। এই শ্লোকে ব্যবহৃত ‘রয়ি’ বা সম্পদ কথাটি গোধনের সমার্থক। গোধন নিছক কাঙিক্ষত বস্তু ছাড়াও লুণ্ঠনের উপযোগী বলেও বিবেচিত হতে থাকে। তাই ঋগ্বেদে বহু যুদ্ধের বর্ণনায় গোধন লুণ্ঠনের অদম্য বাসনার কথা স্পষ্টই দেখা যায়। ঋগ্বেদে যুদ্ধের সমার্থক শব্দ ‘গবিষ্টি’, শব্দটির আক্ষরিক অর্থ গোসম্পদের জন্য ইষ্টি বা প্রার্থনা। গবিষ্টি কথাটি যে সমাজে যুদ্ধের সমার্থক হয়ে উঠেছে, সেখানে পশু তথা গোসম্পদের প্রয়োজন এতটাই বেশী যে তা লুণ্ঠনযোগ্য সম্পদের মধ্যেও প্রধান। এমন সমাজ যে মূলত পশুচারণের উপরই নির্ভরশীল থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। সোমের প্রতি কেবলমাত্র গোসম্পদ এনে দেবার জন্য প্রার্থনাই জানানো হয় না, তাঁকে স্তুতি করে বলা হয়েছে যে তিনি “বীর, ইনি যুদ্ধের সময় অগ্রগামী, ইনি গাভী কোথা এ জিজ্ঞাসা করেন, অর্থাৎ গাভী জয় করে আনেন” (৯-৮৯-৩)। “হে সোম! তুমি শোধিত হয়ে ইন্দ্রের সাথে একরথে আরোহণপূর্বক বিস্তর গাভী আনয়ন কর” (৯-৮৭-৯)—এই বর্ণনায় যুদ্ধক্ষেত্র থেকে গোসম্পদ লুণ্ঠন করার দৃশ্যটি স্পষ্ট। এই বর্ণনায় সোমের সঙ্গে ইন্দ্রও যুক্ত, কারণ যুদ্ধে তিনিই শ্রেষ্ঠ বীর। লক্ষ্য করার মত বিষয় যে জমি দখল জাতীয় কোনও বর্ণনা যুদ্ধের বা লুণ্ঠনের প্রসঙ্গে ঋগ্বেদে বিরল।
এই যুগের জীবনযাত্রার পরিচয় প্রায় সবটাই ঋগ্বেদের বর্ণনার উপর আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে। সামান্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে হরিয়ানার ভগবানপুর (কুরুক্ষেত্র জেলা), দাধেরী (লুধিয়ানা জেলা), কাঠাপালান এবং নগ্গর (জলন্ধর জেলা) ও মাণ্ডা (জম্মু)-তে। প্রত্নক্ষেত্রগুলি থেকে আবিষ্কৃত নিদর্শনগুলির কাল নির্দ্ধারিত হয়েছে আঃ ১৫০০-১০০০ খ্রীঃ পূঃ, অর্থাৎ ঋগ্বেদের প্রায় সমকালীন। এর কোনওটিতেই খাদ্যশস্যের অস্তিত্ব দেখা যায় না, লোহার ব্যবহারের সন্ধানও নেই। হরপ্পা সংস্কৃতির পরবর্তী পর্যায়ের মৃৎপাত্র ও ধূসর মৃৎপাত্র পাওয়া গিয়েছে। ভগবানপুরে উদ্ধার করা হয়েছে প্রচুর পরিমাণে গবাদি পশু, ছাগল ও ভেড়ার অস্থি। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনও সমকালীন সমাজে কৃষির তুলনায় পশুচারণের অর্থনীতির প্রাধান্যের প্রতিই ইঙ্গিত দেয়।
ঋগ্বেদের ভৗগোলিক পরিচয় থেকে বোঝা যায় যে, পশুচারণের উপর নির্ভরশীল ও অনেকটাই যাযাবর জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত ইন্দো-ইওরোপীয় জনগোষ্ঠী তাদের অস্তিত্ব বজায় রেখেছিল এমন এক অঞ্চলে, যা নদীমাতৃক এবং নদীর তীরবর্তী অঞ্চল কৃষির পক্ষে বিশেষ অনুকূল। সিন্ধু উপত্যকা, নিম্ন সিন্ধু অঞ্চল ও পাঞ্জাবে কৃষিকর্মের পক্ষে যে সুবিধাজনক ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশ ছিল, এতে সন্দেহ নেই। ইন্দো-ইওরোপীয়দের আসার আগে এই অঞ্চলে হরপ্পীয়রা কৃষিসমৃদ্ধ অর্থনীতি গড়ে তুলেছিলেন। ঋগ্বেদে, পশুচারণের তুলনায় কম হলেও, কৃষির কিছু কিছু পরিচয় পাওয়া যায়। ইন্দো-ইওরোপীয়রা যদি ভারতে আসার পর তাঁদের পূর্বসূরী অর্থাৎ তথাকথিত ‘প্রাগার্য’দের কাছ থেকে কৃষিকর্মের পদ্ধতি জেনে থাকেন, তাতে অবাক হবার নেই। রামশরণ শর্মা দেখিয়েছেন, ঋগ্বেদে কৃষির প্রসঙ্গ একুশবার এসেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্রপতির উদ্দেশে নিবেদিত একটি সূক্ত (৪-৫৭)। ক্ষেত্রপতি বলতে কৃষির অধিষ্ঠাতা দেবতাকে বোঝানো হয়েছে। ‘…বলীবর্দগণ সুখে বহন করুক, মনুষ্যগণ সুখে কার্য করুক, লাঙ্গল সুখে কর্ষণ করুক…হে শুন! হে সীর! তোমরা আমাদের এ স্তুতি সেবা কর, তোমরা দ্যুলোকে যে জলপ্রাপ্ত হয়েছে, তা দিয়ে পৃথিবীকে সিক্ত কর। হে সৌভাগ্যবতী সীতা! …তুমি আমাদের সুন্দর ধনপ্রদান কর ও সুন্দর ফল প্রদান কর। ইন্দ্র সীতাকে গ্রহণ করুন, পৃষা তাঁকে পরিচালিত করুন, তিনি জলবতী হয়ে বৎসরের পর বৎসর শস্য দোহন করুন। ফাল সকল ভূমি কর্ষণ করুক, রক্ষকগণ বলীবর্দের সাথে সুখে গমন করুক, পর্জন্য মধুর জলদ্বারা পৃথিবী সিক্ত করুন। হে শুনসীর! আমাদের সুখ প্রদান কর।” ‘ক্ষেত্র’ কথাটি ঋগ্বেদে আবাদী জমি অর্থেই প্রযুক্ত। ‘শুনাসীর’ বলতে বোঝায় কৃষির দুই অপরিহার্য উপকরণ—লাঙ্গল ও লাঙ্গলের ফলা; সীতার অর্থ লাঙ্গল দিয়ে কর্ষিত জমিতে রেখা। লাঙ্গল চালিয়ে জমি চাষ করার কথা যেমন আছে, তেমনই আছে ‘দাত্র’ বা ‘সৃণী’ অর্থাৎ দা বা কাস্তে দিয়ে পাকা ফসল কাটার বর্ণনা। শস্য ঝাড়াই বাছাই করার বর্ণনাও পাওয়া যায়। তবে রামশরণ শর্মার মতে এই তথ্যগুলি বেশীরভাগই ঋগ্বেদের প্রথম ও দশম মণ্ডলের অন্তর্ভুক্ত; অতএব ঐগুলি পরবর্তীকালের প্রক্ষেপণ এবং এর উপরে নির্ভর করে কৃষি অর্থনীতির অস্তিত্ব বিষয়ে নিশ্চিত মতামত দেওয়া কঠিন। বিপাশ ও শুতুদ্রী, দুই নদীকে বিশ্বামিত্র স্তুতি করেছেন যে তাঁরা ক্ষেত্রকে উর্বর করে তোলেন (৩-৩৩-৪)। উর্বর নদীতীরস্থ অঞ্চল যে কৃষি ও স্থায়ী বসতি গড়ে তোলার পক্ষে সহায়ক, এই বোধ সম্ভবতঃ ধীরে ধীরে সমকালীন মানুষের মধ্যে সঞ্জাত হচ্ছিল। খুব সামান্য পরিমাণে হলেও কৃষির জন্য প্রয়োজনীয় জলসেচ ব্যবস্থার উল্লেখ ঋগ্বেদে আছে। ‘কুল্যা’ (৩-৪৫-৩) শব্দটি কৃত্রিম জলপ্রণালীকে বোঝাত; ‘খনিত্রিমা আপঃ’ (৭-৪৯-২) বা খনন করে যে জল পাওয়া যায়—এই বর্ণনার মধ্যে সেচ ব্যবস্থার প্রতি ইঙ্গিত খুঁজে পাওয়া সম্ভব। কৃষির উল্লেখ থাকলেও অস্বীকার করার উপায় নেই, কৃষির গুরুত্ব এই সময়ে কোনও মতেই পশুচারণের চেয়ে বেশী নয়; গোসম্পদই ছিল সর্বপ্রধান সামাজিক ধনসম্বল। হরপ্পা সভ্যতার আমল থেকে ঋগ্বেদের কালে অর্থনীতিতে যে বড় মাপের রদবদল ঘটেছে এবং ঋগ্বেদের অর্থনীতি যে তুলনায় অনেকটাই পশ্চাদমুখী, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
॥ ৪ ॥
গোসম্পদ যে সমাজে প্রধান ধনসম্বল যেখানে শিল্পী ও কারিগরদের বিকাশের সূযোগ অল্পই; কারণ পশুচারণকারী জনগোষ্ঠী কৃষিজাত উদ্বৃত্ত উৎপাদনে অক্ষম। আর ঐ উদ্বৃত্ত না থাকলে কোনও পেশায় সর্বক্ষণের জন্য নিযুক্ত হবার মত অনুকূল পরিবেশ কারিগরদের সামনে থাকা দুঃসাধ্য। আদি বৈদিক সমাজও এর ব্যতিক্রম নয়। কারিগরী বা কুটির শিল্প ঋগ্বেদে নিয়মিতভাবে উল্লিখিত হয় নি। তবে ঋগ্বেদে ক্বচিৎ কখনও শিল্পের কথা পাওয়া যায়।
ঋগ্বেদে উল্লিখিত কারিগরীবৃত্তিগুলির মধ্যে অন্যতম হল দারুশিল্প। সমাজে কাঠের তৈরী আসবাব ও নানা তৈজসপত্রের ব্যবহার দারু শিল্পীর অস্তিত্বকে প্রয়োজনীয় করে তুলেছিল। ঋগ্বেদে কাঠের কারিগর ‘তক্ষক’ নামে আখ্যাত। গাছ কেটে প্রয়োজনীয় কাঠ পাওয়া সম্ভব; ঐ কাঠই ‘তক্ষক’ বা দারুশিল্পীর কাজের মূল কাঁচামাল। ঋগ্বেদে ‘বৃক্ষচ্ছেদক’ (১-১৩০-৪)-এর যে উল্লেখ পাওয়া যায়, তিনি নিয়মিত গাছ কাটার কাজে যুক্ত ছিলেন। তক্ষকের অন্যতম প্রধান কাজ ছিল যানবাহন বিশেষত রথের চাকা তৈরী করা। এখানে মনে রাখা দকার যে ইন্দো-ইওরোপীয়রাই ভারত উপমহাদেশে প্রথম অশ্ব ও অশ্ববাহিত রথের প্রচলন শুরু করেছিলেন। রথ কেবলমাত্র যাতায়াত ও যুদ্ধের কারণে প্রয়োজনীয় ছিল না; রথ চালনা ঋগ্বেদে অন্যতম মুখ্য ক্রীড়া ও বিনোদনের উপকরণও বটে। রথের নির্মাতাকে সাধারণত ‘রথকার’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। তাঁর কারিগরী দক্ষতা বোধ হয় সাধারণ দারুশিল্পীর চেয়ে কিছু বেশীই ছিল; তাই তিনি ঋগ্বেদে ‘রথকার’ বলে চিহ্নিত ও তাঁকে সাধারণ তক্ষক থেকে পৃথক করা হয়েছে। ঋগ্বেদে “ক্ষিপ্র পদযুক্ত, অশ্ববিশিষ্ট হিরন্ময় রথের” কথাও আছে (৮-৫-৩৫); তবে সোনা দিয়ে রথ তৈরীর করার মত কারিগরী দক্ষতা ও সোনার রথের প্রতি আকর্ষণ তৎকালীন সমাজে ছিল কি না, এ বিষয়ে সন্দেহ থেকে যায়।
পশুচারণে অভ্যস্ত সমাজে পশুচর্মের ব্যবহার অস্বাভাবিক নয়। ঋগ্বেদে চর্মকার বা চামড়ার কারিগর ‘চৰ্ম্মম্ণা’ (৮. ৫. ৩৮.) বলে অভিহিত। চর্মকারের তৈরী করা নানা জিনিসের মধ্যে অন্যতম ছিল চামড়ার পাত্র বা থলি। রথ চালনার জন্য অশ্বের বল্গ ও চাবুক তৈরীর করার ব্যাপারে চর্মকারের প্রয়োজন অনুভূত হত (৬. ৭৫. ১১; ১. ১২১. ৯; ৬. ৪৭. ২৬.)।
যে কারিগরী বৃত্তিটি এই আমলে কিছুটা প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল, তা হল বস্ত্রশিল্প। ‘বসন’ বা ‘বস্ত্র’ শব্দ ঋগ্বেদে পোষাক অর্থেই প্রযুক্ত। পরিধেয় বস্ত্র সাধারণত দুই ধরনের ছিল: ‘বাসস্’ বা নিম্নাঙ্গের পোষাক ও ‘অধিবাস’ বা ঊর্দ্ধাঙ্গের পোষাক। মাপসই ও বোনা বস্ত্র ‘অত্ক’ নামে পরিচিত ছিল। ‘দ্রাপী’ নামে যে পরিধেয়টির কথা ঋগ্বেদে অনেকবারই পাওয়া যায়, তা বোধ হয় মাথায় আচ্ছাদনসহ ঢিলেঢালা কোনও পোষাক। নর্ত্তকীরা যে সূচের কাজ করা পোষাক পরতেন, তার নাম ‘পেশস্’ (১. ৯২. ৪; ২. ৩. ৬.)। বিবাহের সময় নববধূ যে পোষাক পরতেন তাকে বলা হয়েছে ‘বাধূয়’। পুরুষ ও নারীর পোষাকে কতটা তফাৎ ছিল, ঋগ্বেদে তা স্পষ্টভাবে বলা নেই। কাপড় কি দিয়ে তৈরী হত, তাও নিশ্চিত ভাবে জানা যায় না। কার্পাস বা সুতোর সরাসরি উল্লেখ ঋগ্বেদে নেই। এমনটা অনুমান করা অসঙ্গত নয় যে সূতীবস্ত্র বিশেষ তৈরী হত না। তবে কোনও কোনও পণ্ডিত মনে করেন, যে নগরাশ্রয়ী হরপ্পা সভ্যতায় যখন কার্পাস ও সূতীবস্ত্রের ব্যবহার জানা ছিল, তখন ঋগ্বেদের আমলের মানুষের ক্ষেত্রেও তার প্রচলন বোধ হয় ছিল। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে ঋগ্বেদের সবচেয়ে অর্বাচীন দশম মণ্ডলেও মেষলোম দিয়েই কাপড় তৈরীর কথা বলা হয়েছে (১০. ২৬. ৬)। সেক্ষেত্রে সন্দেহ থাকতেই পারে যে পশুচারণকারী মানুষ ঋগ্বেদের কালে বোধ হয় কার্পাস ফলাতে জানত না। অবশ্য বস্ত্র বয়নের ক্ষেত্রে টানা সুতো ও পোড়েনের সুতোর উল্লেখ ঋগ্বেদে একটি রূপকাশ্রয়ী বর্ণনায় পাওয়া যাবে। টানা সুতো ‘তন্তু’ ও পোড়েনের সুতো ‘ওতু’ নামে পরিচিত ছিল (৬. ৯. ১০.)। ঐ সূক্তেই বলা আছে যে ‘তন্তু’ ও ‘ওতু’ ব্যবহারের সম্যক জ্ঞান কেবলমাত্র অগ্নি বৈশ্বানরেরই করায়ত্ত।
অলঙ্কারের প্রতি ঋগ্বেদের মানুষের আগ্রহ নিতান্ত কম ছিল না। ‘কর্ণশোভন’ নামে কানের যে গহনার কথা জানা যায় (৮. ৭৮. ৩), তা বোধ হয় পুরুষরা পরতেন। ‘হিরণ্যকর্ণ’ (১. ১২২. ১৪) শব্দটি সম্ভবত কানে সোনার অলঙ্কার ব্যবহার করার ইঙ্গিত দেয়। বিবাহের সময় বধূ যে অলঙ্কার পরতেন তার মধ্যে ‘কুরীর’ (১০. ৮৫. ৮.) ও ‘ন্যোচনী’-র উল্লেখ করা চলে (১০. ৮৫. ৬)। যদিও মনে রাখা দরকার যে এই দুই অলঙ্কারের কথা আছে ঋগ্বেদের প্রক্ষিপ্ত অংশে, দশম মণ্ডলে। ‘খাদি’ (১. ১৬৬. ৯; ৭. ৫৬. ১৩.) নামক গোলাকৃতি গহনাটি সম্ভবত নুপূর হিসেবে ও বাহুতে পরিধান করার রেওয়াজ ছিল। ঋগ্বেদে ‘নিষ্ক’ একটি সুপরিচিত অলঙ্কার, যা হার হিসেবে সম্ভবত গলায় পরা হত। গলার হারে ‘মণি’ (১. ১২২. ১৪) বা কোনও মূল্যবান রত্ন লাগানো হত; তবে এই মূল্যবান রত্ন কি বস্তু বা কি উপাদানে তৈরী তা বলা কঠিন। অলঙ্কার শিল্পীরা বোধ হয় তাঁদের বৃত্তির কারণে সমাজে কিছুটা পরিচিতি লাভ করেছিলেন।
অলঙ্কার শিল্পে ধাতু হিসেবে সোনা নিশ্চয়ই ব্যবহৃত হত; কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে ধাতুর ব্যবহার ব্যাপক ছিল না। ঋগ্বেদে উল্লিখিত ধাতুগুলির মধ্যে ‘অয়স’ শব্দটিকে অনেকেই লোহার সমার্থক বলে মনে করেন। ‘অয়স’ কথাটি ঋগ্বেদে লোহার অর্থে ধরা যাবে কি না, এ নিয়ে বিতর্ক আছে। ‘অয়স’ বা ‘লোহিতায়স’ কথাকে তামা বা কাসা অর্থে গ্রহণ করাই শ্রেয়। কারণ প্রাচীন ভারতে লোহা ব্যবহারের চাক্ষুষ ও সন্দেহাতীত প্রমাণ খ্রীঃ পূঃ ৮৫০-এর আগে পাওয়া যায় না। তাছাড়া পশুচারণভিত্তিক জীবনযাত্রায় লোহার ব্যবহার ব্যাপক ও নিয়মিত হবে, এমনটি আশা করা যায় না। বৃক্ষচ্ছেদনের জন্য কুড়াল, কৃষির জন্য লাঙ্গলের ফলা ও কাস্তে প্রভৃতি প্রয়োজনীয় উপকরণগুলি সম্ভবত তামা দিয়ে তৈরী হত। ঋগ্বেদে ‘কর্মার’ (৯. ১১২. ২) বলে আখ্যাত কারিগর বোধ হয় আধুনিক কর্মকার বা কামারের পূর্বসূরী। তবে আধুনিক কামারের মত তিনি লোহা ব্যবহারে বোধ হয় অভ্যস্ত ছিলেন না। ঋগ্বেদে তাঁকে ‘বাণ’ প্রস্তুতকারক কারিগর হিসেবেও বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। লোহার তীরের ব্যবহার ঋগ্বেদের আমলে প্রচলিত থাকার সম্ভাবনা নিতান্তই ক্ষীণ। ধাতুকে গলাবার কাজ যে কারিগর করতেন, তিনি ‘দ্রাবিণ’ (৬. ৩. ৪) অর্থাৎ ধাতুকে দ্রবীভূত করায় দক্ষ বলে আখ্যাত। এর থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে ধাতু গলানো ও পরিস্রুত ধাতু দিয়ে উপকরণ তৈরির কাজে দুই পৃথক ধরনের কারিগর যুক্ত ছিলেন। সেদিক দিয়ে বিচার করলে এখানে কারিগরী ক্ষেত্রে কর্মবিভাজনের ক্ষীণ অভাস চোখে পড়ে।
॥ ৫ ॥
ঋগ্বেদে বর্ণিত অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের ক্ষেত্রে ধনোৎপাদন বিষয়ে কিছু আলোচনা করা হল। কৃষি বা কারিগরী কোনও ক্ষেত্রেই উৎপাদন যথেষ্ট হত বলে মনে হয় না। উৎপাদকের আশু প্রয়োজন মিটিয়ে উদ্বৃত্ত উৎপাদন ভোগ্যপণ্য হিসেবে বাজারে বিনিময়ের যোগ্যতা পায়। কিন্তু পশুপালনভিত্তিক অর্থনৈতিক জীবনে বাণিজ্যের বিশেষ সুযোগ ও গুরুত্ব না থাকারই কথা। ঋগ্বেদে বাণিজ্য সংক্রান্ত তথ্যও মুষ্টিমেয়। সেই স্বল্প তথ্য এখন বিচার করা যাক।।
ধনার্থী বণিক ব্যবসায়ের জন্য নানা অঞ্চলে পাড়ি দিচ্ছেন, এই জাতীয় বর্ণনা ঋগ্বেদে পাওয়া যাবে (১. ৫৬. ২)। বণিকদের তরফে ‘শতধন’ লাভ করার প্রবণতাও একেবারে অজানা ছিল না (৩. ১৮. ৩)। অনেকক্ষেত্রেই তাঁদের দূর দেশে যাতায়াত করতে হত। দূর দেশে বাণিজ্য করতে গেলে যে সংকট ও বিপদের আশঙ্কা থেকেই যায়, সে কথা চিন্তা করে ঋগ্বেদের মানুষ তা থেকে মুক্তি পাবার উদ্দেশ্যে অনেকগুলি প্রার্থনামন্ত্র রচনা করেছিলেন। “হে পুষা! আঘাতকারী, অপহরণকারী ও দুষ্টাচারী যে কেউ আমাদের (বিপরীত পথ) দেখিয়ে দেয়, তাকে পথ হতে দূর করে দাও। সেই মার্গ প্রতিবন্ধক তস্কর কুটিলাচারীকে পথ হতে দূরে তাড়িয়ে দাও” (১. ৪২. ২-৩)। দূর দূরান্তরে যাতায়াত কালেও পথে দস্যু তস্করের উপদ্রবের ইঙ্গিত এই বর্ণনায় পাওয়া যাবে। ঐ পুষার উদ্দেশেই নিবেদিত আর একটি প্রার্থনায় বলা হয়েছে “বিঘ্নকারী শত্রুদের অতিক্রম করে আমাদের নিয়ে যাও, সুখগম্য শোভনীয় পথ দ্বারা আমাদের নিয়ে যাও” (১. ৪২. ৭)। ঋগ্বেদে ‘পণি’ বলতে সম্ভবত বণিকদেরই বোঝানো হয়েছে। তাঁদের বিত্তের কথাও এই গ্রন্থে বলা আছে। তবে ঋগ্বেদের সূক্ত রচয়িতারা পণিদের প্রতি অত্যন্ত বিরূপ, তাঁদেরকে বহুসময় আর্যবর্ণভূক্ত জনগোষ্ঠীর শত্রু, দাস বা দস্যুবর্ণের মানুষ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এঁরা সম্ভবত প্রাক-বৈদিক আমল থেকেই কিছু কিছু ব্যবসা করতেন; সেই কারণেই বোধহয় তাঁরা দাস বা দস্যু পর্যায়ভুক্ত ও ঋগ্বেদের ঋষিদের চক্ষুশূল।
এই আমলের ব্যবসা বাণিজ্য সংক্রান্ত অন্যতম বিতর্কিত বিষয় হল ঋগ্বেদের মানুষ সমুদ্রবাণিজ্যে অংশ নিতেন কি না। ‘সমুদ্র’ কথাটি ঋগ্বেদে বহুবার এসেছে। শত দাঁড়যুক্ত জলযান বা ‘শতারিত্র নৌ’-এর উল্লেখও অজানা ছিল না (১. ১১৬. ৩.)। “ধনলাভেচ্ছু ব্যক্তি” যে “সমুদ্রের মধ্যে গমনের জন্য সমুদ্রকে স্তুতি করে”, এই বর্ণনাও ঋগ্বেদে মিলবে (৪. ৫০. ৬)। এই উল্লেখ থেকে বণিকদের সমুদ্র যাত্রার সম্ভাবনা কিছুটা মানতেই হয়। তবে বহু বিশেষজ্ঞ, বিশেষত আর্থার ব্যারিডেল কীথ মনে করেন ঋগ্বেদে ব্যবহৃত ‘সমুদ্র’ কথাটি আসলে নিম্ন সিন্ধু উপত্যকায় বা একেবারে সিন্ধুর মোহানায় বিশাল ও বিস্তীর্ণ জলরাশিকেই বোঝায়। ‘সমুদ্র’ তাঁর মতে সাগরের সমার্থক নয়। কিন্তু ম্যাক্সম্যূলর, লাসেন ও জিমার কীথের মতের বিরোধী; তাঁরা ঋগ্বেদের আমলে সমুদ্র বাণিজ্যের সপক্ষেই রায় দিয়েছেন। এখানে বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে ঋগ্বেদে সরস্বতী ও সিন্ধুকে সমুদ্রগামী বলে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, অর্থাৎ এই উক্তিতে নদী ও সমুদ্রের পার্থক্য পরিষ্কার। অতএব ঋগ্বেদের ঋষিরা নদীর মোহানা ও প্রকৃত সাগরকে আলাদা করতে পারেন নি, কীথের এই মন্তব্য মানা মুশকিল। সমুদ্র হয়তো ঋগ্বেদের আমলে অপরিচিত ছিল কি না; কিন্তু বাণিজ্যিক কারণে নিয়মিত ভাবে সমুদ্রে চলাচল জানা ছিল, পণ্ডিতদের এই দাবীটিও অযৌক্তিক। সমুদ্রে পাড়ি দেবার পক্ষে উপযুক্ত জলযানের বর্ণনা ঋগ্বেদে অনুপস্থিত। একশত দাঁড়যুক্ত বড় জলযানের উল্লেখ আছে, কিন্তু হাল, মাস্তুল প্রভৃতি কথার প্রতিশব্দ ঋগ্বেদে পাওয়া যাবে না। সবচেয়ে বড় কথা এই যে ঋগ্বেদের আমলে এত পরিমাণ উৎপাদনই বোধ হয় হত না, যা দিয়ে দূরদেশে সমুদ্রবাণিজ্য সম্ভব ছিল। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা অনুচিত হবে না যে ঋগ্বেদে বিনিময়ের মাধ্যম ছিল গো-ধন।‘নিষ্ক’ কথাটিকে এ. ডি. পুসলকার ধাতব মুদ্রা অর্থে বুঝতে চেয়েছেন; কিন্তু সেই মুদ্রার ধাতব মান, ওজন কিছুই জানা নেই। একথা ঠিকই যে অনেক পরের আমলে ‘নিষ্ক’ কথাটি স্বর্ণমুদ্রা অর্থে প্রযুক্ত; কিন্তু সেই একই অর্থে ঋগ্বেদেও কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে, এমত ধারণা পোষণ করার কোনও কারণ নেই। যে অর্থনৈতিক অবস্থায় গো-ধন বিনিময়ের প্রধান মাধ্যম, যেখানে পশুচারণের অর্থনীতিরই জয়জয়কার, সেখানে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ধাতব মুদ্রার অস্তিত্ব কল্পনা করার পিছনে খুব জোরালো যুক্তি থাকা কঠিন।
॥ ৬ ॥
ঋগ্বেদ থেকে অর্থনৈতিক জীবনের যে ছবি পাওয়া যায়, তা কোনওক্রমেই সর্বভারতীয় নয়। পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান অঞ্চলের অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের মধ্যেই এই আলোচনা সীমাবদ্ধ। এই অর্থনৈতিক জীবন যে পশুচারণকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছিল, তা বুঝতে কোনও অসুবিধে হয় না। তবে কৃষির গুরুত্ব সম্বন্ধে ঋগ্বেদে সচেতনতা বোধ হয় ক্রমবর্দ্ধমান; তাই ঋগ্বেদের অন্তত শেষপর্বে পশুচারণ থেকে কৃষিপ্রধান অর্থনৈতিক জীবনযাত্রায় রূপান্তরের লক্ষণগুলি প্রকট হচ্ছিল।
এই রকম আর্থিক অবস্থা-ব্যবস্থা স্থায়ী কৃষিজীবী আর্থ-সামাজিক জীবনের তুলনায় নিঃসন্দেহে কম জটিল। ঋগ্বেদের অধিকাংশ সূক্তেই প্রধান সামাজিক ধনসম্বল গো-সম্পদ একটি জনগোষ্ঠীর সার্বিক সম্পত্তি বলে প্রতিভাত। অর্থাৎ গো-ধনের উপর ব্যক্তিগত মালিকানার চেয়ে গোষ্ঠী বা কৌমগত মালিকানার ধারণাই বেশী জোরালো। ঋগ্বেদের দুই একটি সূক্তে কৃষিজমির উপর ব্যক্তিগত মালিকানার ক্ষীণ আভাস থাকলেও তা কখনওই সমগ্র সমাজ জীবনকে প্রভাবিত করে নি। প্রকৃতপক্ষে গোচারণভূমি কৃষিক্ষেত্রের তুলনায় বেশী গুরুত্বপূর্ণ ও গোচারণভূমি সম্ভবত সমগ্র গোষ্ঠীরই মালিকানাধীন ছিল। গোচারণভূমির উপর ব্যক্তিগত মালিকানার অস্তিত্ব নিতান্ত বিরল ও ব্যতিক্রমী ঘটনা। কৃষিক্ষেত্রের উপর জনগোষ্ঠীর যৌথ মালিকানা থাকারই বেশী সম্ভাবনা। উৎপাদনের উপকরণ ও প্রধান সামাজিক ধনসম্বলের উপর যৌথ মালিকানার প্রচলন ও ব্যক্তিগত মালিকানার বিরলতা থাকলে অনুমান করতে বাধা নেই যে সেই সমাজে আর্থিক বৈষম্য অপেক্ষাকৃত কম থাকবে। তার ফলে আর্থিক তারতম্যের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সামাজিক বৈষম্য ও বিভাজন অপেক্ষাকৃত কম থাকার সম্ভাবনা। এইজন্যেই ঋগ্বেদে চতুর্বর্ণ প্রথার উপস্থিতি প্রায় নেই বলেই মনে হয়। ঋগ্বেদের প্রক্ষিপ্ত অংশ দশম মণ্ডলের বিখ্যাত ‘পুরুষসূক্তে’ ব্রাহ্মণ, রাজন্য (ক্ষত্রিয় নয়), বৈশ্য ও শূদ্র এই চার বর্ণের উৎপত্তির কথা বলা আছে। কিন্তু ঋগ্বেদের পুঙ্খনাপুঙ্খ আলোচনা থেকে স্পষ্টই প্রতীয়মান যে ঐ সময়ে সামাজিক ভাগ মাত্র দুটি: আর্যবর্ণ ও দাস বা দস্যু বর্ণ। বর্ণ কথাটি সামাজিক বিভাগের বদলে আক্ষরিকভাবে গাত্রবর্ণ বোঝাতেই ব্যবহৃত। বিবাহের উপর বিধিনিষেধ, খাওয়া ও পানের ক্ষেত্রে নানা বিধিনিষেধ, পুরুষানুক্রমিক বৃত্তি অনুসরণ করার আবশ্যিকতা ও জন্ম দিয়ে সামাজিক অবস্থান নির্ণয় করা—যেগুলি ভারতীয় জাতিবর্ণ প্রথার প্রধান বৈশিষ্ট্য—ঋগ্বেদে অনুপস্থিত। ঋগ্বেদের এক সূক্তের রচয়িতা জানাচ্ছেন যে তাঁর পিতা চিকিৎসক বা ‘ভিষক’ ও মাতা ‘উপলপ্রক্ষিণী’ (শস্য মাড়াই করার কাজে যুক্ত)। অর্থাৎ একই পরিবারভুক্ত তিন ব্যক্তি তিনটি আলাদা কাজে যুক্ত ছিলেন। এই অবস্থা পরিণত জাতিবর্ণ ব্যবস্থায় অত্যন্ত বিরল।
এই অপেক্ষাকৃত সরলতর প্রায় কৌমগোষ্ঠীসুলভ সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংগঠনে রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপও গোষ্ঠীর দ্বারা পরিচালিত। ঋগ্বেদে ‘রাজা’র উল্লেখ বহুবার আছে। তবে রাজার পরিচয় প্রায় সর্বত্রই কোনও গোষ্ঠী বা কৌমের দলপতি হিসেবে, একটি অঞ্চলের সার্বভৌম নরপতি রূপে নয়। ঋগ্বেদের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ রাজা সুদাসও তৃৎসু-ভরত গোষ্ঠীর নেতারূপে আখ্যাত। এইভাবেই ভরত, পুরু, দ্রুহ্য, অনু, শিব, পখ্ত, বিশানিন প্রভৃতি কৌমের নাম জানা যায়। চিরাচরিত রাজকীয় প্রতাপ ও প্রশাসনিক ক্ষমতার পরিচয় নেই। অন্যদিকে দেখা যাবে যে রাজার কাজকর্ম অনেকাংশে ‘সভা’, ‘সমিতি’ ও ‘বিদথ’ নামক সর্বসাধারণের সম্মিলিত তিনটি প্রতিষ্ঠান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই কথাগুলি বলার উদ্দেশ্য হল, ঋগ্বেদে যে রাজায় পরিচয় পাই, তিনি মূলতঃ কৌম গোষ্ঠীর নেতা, যিনি যুদ্ধের সময় তাঁর গোষ্ঠীর নেতৃত্ব দেন। যেহেতু তাঁর ক্রিয়াকলাপ ‘সভা’ ‘সমিতি’ ও ‘বিদথ’, এই তিনটি প্রতিষ্ঠান দ্বারা অনেকাংশে নিয়ন্ত্রিত এবং যেহেতু আলোচ্য যুগের অর্থনীতিতে পশুচারণের মারফৎ উদ্বৃত্ত উৎপাদনের সম্ভাবনা প্রায় অনুপস্থিত, তাই এমতাবস্থায় রাজার পক্ষে নিয়মিত কর সংগ্রহ ও রাজস্ব ব্যবস্থা চালু রাখাও অসম্ভব। রাজা গোষ্ঠীপ্রধান হিসেবে নিঃসন্দেহে যুদ্ধে লুণ্ঠিত সম্পদের (বিশেষত গো-ধন) উপর অন্যদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত বেশী অংশ দাবী করতে পারেন, কিন্তু যথার্থ রাজস্ব ব্যবস্থার মাধ্যমে উৎপাদনের নির্দিষ্ট অংশ কর হিসেবে আদায় করার ঘটনা পশুচারণভিত্তিক অর্থনীতিতে বিরল। অনুমান করা অসঙ্গত নয় যে সামাজিক ধনসম্বল ও লুণ্ঠিত সম্পদের একাংশ রাজা নিজের জন্য রেখে বাকী অংশ কৌমের মধ্যে দানের মাধ্যমে বণ্টন করতেন। ঋগ্বেদের ‘দানস্তুতি’গুলিতে বিভিন্ন রাজার দ্বারা কৌমের উদ্দেশে দানের কথা উল্লিখিত। রেড ইণ্ডিয়ান গোষ্ঠীগুলির দলপতিরা যে ‘পটলাচ’ বা বিশাল ভোজের আয়োজন করেন, তার উদ্দেশ্য ও প্রক্রিয়া প্রায় একই রকম। ভোজ অনুষ্ঠানের মারফৎ দলপতির দ্বারা সামাজিক ধনসম্বল ও লুণ্ঠিত সম্পদ কৌমের সদস্যদের মধ্যে প্রায় সমবণ্টিত হয়। যে দলপতি ভোজসভায় যতবেশী দান ও এমনকি অপচয় করেন, তাঁর মর্যাদা তত বেশী। ঋগ্বেদের সামাজিক ধনসম্বল বণ্টনের ক্ষেত্রে ‘পটলাচ’-এর দৃষ্টান্ত হয়তো অপ্রাসঙ্গিক হবে না।
সম্পদ বণ্টনের বর্ণনা ঋগ্বেদের নানা সূক্তে ছড়িয়ে আছে। কখনও বলা হয়েছে সবিতর বা সবিতৃ (=সূর্য) যা দেন, তা ‘বিদথ’-তে উপস্থিত লোকের মধ্যে বণ্টিত হয়। অন্যত্র দেখা যায় যে ‘বিদথ’-তে সম্পদ বণ্টনের অধিকারী দেবতা হলেন অগ্নি। বণ্টন কথাটির প্রতিশব্দ দুটি ‘ভক্ত’ ও ‘ভাগ’; শব্দ দুটি ঋগ্বেদে প্রযুক্ত হয়েছে যথাক্রমে ৩৪ বার ও ৫৮ বার। ইন্দ্র যে গো-ধন কৌমের সদস্যদের মধ্যে বণ্টন করছেন, এমন বর্ণনাও ঋগ্বেদে মিলবে (৮. ৯৭. ২.)। কেবল যে গো-ধনই বণ্টনের উপযুক্ত বস্তু তাই নয়, ঋগ্বেদে ‘ক্ষেত্র’ বা আবাদী জমিও যে ইন্দ্রের দ্বারা বণ্টিত হচ্ছে এ বর্ণনাও আছে (১. ১০০. ১৮.)। এর থেকে সিদ্ধান্ত করা চলে যে কৃষি উৎপাদন ও বণ্টন তথা ভোগের ক্ষেত্রে কৌম সংগঠনের প্রাধান্য ব্যক্তিগত মালিকানার তুলনায় বেশী। ঋগ্বেদে ব্যবহৃত ‘ভাজ’ কথাটি যেমন বণ্টনের আভাস দেয়, তেমনই অন্যদিকে তা অন্ন বা খাদ্য অর্থেও প্রযুক্ত। অর্থাৎ অন্ন বা খাদ্য কৌম সমাজে বণ্টিত হবার রেওয়াজ ছিল। ঠিক একইভাবে ‘পরিবিষ’ শব্দটি একই সঙ্গে খাদ্য ও বণ্টিত খাদ্য দুই অর্থেই ব্যবহার করা হয়েছে। ঋগ্বেদে জনগোষ্ঠী বা কৌম ‘বিশ্’ বা ‘জন’ নামে আখ্যাত; কৌম প্রধান হিসেবে রাজার উপাধি ছিল ‘বিশ্পতি’ বা ‘জনপতি’। কৌমের সদস্যরা উৎপাদন, লুণ্ঠন ও আহরণ দ্বারা যে সম্পদ সংগ্রহ করতেন, তা আবার ‘বিশপতি বা জনপতি’ অর্থাৎ রাজার মারফৎ সামগ্রিকভাবে বিশ্-এর মধ্যেই ভাগ করা হত। ঋগ্বেদের দানস্তুতিগুলিতে অবশ্যই এই ইঙ্গিত আছে যে সম্পন্ন দাতার উদ্ভব সমাজে ঘটেছে। এই সম্পন্ন দাতা অনেকক্ষেত্রেই রাজা স্বয়ং; তাঁর সম্পদ কৌমের বা ‘বিশে’র-সাধারণ মানুষের সম্পদের তুলনায় নিঃসন্দেহে বেশী। পূর্ণ সমানাধিকারের উদাহরণ ঋগ্বেদে নিশ্চয়ই নেই; কিন্তু সমাজে উদ্বৃত্ত উৎপাদন ও ঐ উদ্বৃত্ত রাজস্বরূপে আহরণের ঘটনাও নেই। তাই ঋগ্বেদের রাজা পশুচারণের উপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর প্রধান হিসেবে ‘গোপতি’ আখ্যায় অভিহিত; তিনি তখনও ‘ভূপতি’ বা ‘মহীপতি’ হয়ে ওঠেন নি।