১৪
বইপাড়াতে এ-সময় লোকজন তেমন থাকে না। আজ যেন আরো নির্জন। নীলু একা-একা কিছুক্ষণ হাঁটল। তার খুব ঘাম হচ্ছে। বারবার সবুজ রুমালটি বের করতে হচ্ছে। চারটা দশ বাজে। চিঠিতে লিখেছে সে চারটার মধ্যেই আসবে, কিন্তু আশেপাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। নীলু অবশ্যি কারো মুখের দিকে তাকাতেও পারছে না। কাউকে তাকাতে দেখলেই বুকের মধ্যে ধক করে উঠছে।
নীলু একটা বইয়ের দোকানে ঢুকে পড়ল। গল্পের বই তার তেমন ভালো লাগে না। ভালো লাগে বিলুর। বিলুর জন্যে একটা কিছু কিনলে হয়। কিন্তু কী কিনবে? সবই হয়তো ওর পড়া। ঐ দিন শীর্ষেন্দুর কী-একটা বইয়ের কথা বলছিল। নামটা মনে নেই।
‘আচ্ছা, আপনাদের কাছে শীর্ষেন্দুর কোনো বই আছে?’
‘জ্বি-না। আমরা বিদেশি বই রাখি না।’
নীলু অন্য একটা ঘরে ঢুকল। শুধু-শুধু দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। সে একটা কবিতার বই কিনে ফেলল। অপরিচিত কবি, তবে প্রচ্ছদটি সুন্দর। একটি মেয়ের ছবি। সুন্দর ছবি। নামটি সুন্দর—’প্রেম নেই’। কেমন অদ্ভুত নাম। ’প্রেম নেই’ আবার কী? প্রেম থাকবে না কেন?
দাড়িঅলা এক জন রোগা ভদ্রলোক তখন থেকেই তার দিকে তাকাচ্ছে। লোকটির কাঁধে একটি ব্যাগ। এই কি সে। নীলুর মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল। নীলু বইয়ের দাম দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে এল। তার পেছনে ফেরারও সাহস নেই। পেছনে ফিরলেই সে হয়তো দেখবে বুড়ো দাড়িঅলা গুটিগুটি আসছে।
না, লোকটি আসছে না। নীলুর মনে হল, ভয়ানক মোটা এবং বেঁটে একজন কে যেন তাকে অনুসরণ করছে। তার দিকে তাকাচ্ছে না, কিন্তু আসছে তার পিছুপিছু। নীলুর তৃষ্ণা পেয়ে গেল। বড্ড টেনশান। বাড়ি ফিরে গেলে কেমন হয়? কিন্তু বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে না। নীলু ঘড়ি দেখল, পাঁচটা পাঁচ। তার মানে কি যে সে আসবে না? কথা ছিল নীলু থাকবে ঠিক এক ঘন্টা।
সে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। ভালোই হয়েছে। দেখা না-হওয়াটাই বোধহয় ভালো। দেখা হবার মধ্যে একটা আশাভঙ্গের ব্যাপার আছে। না-দেখার রহস্যময়তাটাই না হয় থাকুক। নীলু ক্লান্ত ভঙ্গিতে হাঁটতে শুরু করল।
‘নীল।’
নীলু দাঁড়িয়ে পড়ল।
‘একটু দেরি হয়ে গেল। তুমি ভালো আছ নীলু?’
চকচকে লাল টাই-পরা যে-ছেলেটি হাসছে, সে কে? লম্বা স্বাস্থ্যবান একটি তরুণ। ঝলমল করছে। তার লাল টাই উড়ছে। বাতাসে মিষ্টি ঘ্রাণ আসছে। সেন্টের গন্ধ। পুরুষ মানুষের গা থেকে আসা সেন্টের গন্ধ নীলুর পছন্দ নয়। কিন্তু আজ এত ভালো লাগছে কেন?
‘চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছ কেন? কিছু বল।’
‘আপনি বলেছিলেন আপনি বুড়ো।’
‘আমরা সবাই কিছু-কিছু মিথ্যা বলি। আমাকে নীলু নামের একটি মেয়ে লিখেছিল, সে দেখতে কুৎসিত।’
লোকটি হাসছে হা হা করে। এত সুন্দর করেও মানুষ হাসতে পারে। নীলুর এক ধরনের কষ্ট হতে লাগল। মনে হতে লাগল সমস্তটাই একটা সুন্দর স্বপ্ন, খুবই ক্ষণস্থায়ী। যেন এক্ষুণি স্বপ্ন ভেঙে যাবে। নীলু দেখবে সে জেগে উঠেছে, পাশের বিছানায় বিলু ঘুমাচ্ছে মশারি না-ফেলে। কিন্তু সে-রকম কিছু হল না। ছেলেটি হাসিমুখে বলল, ‘কোথাও বসে এক কাপ চা খেলে কেমন হয়? খাবে?’
নীলু মাথা নাড়ল—সে খাবে।
‘তুমি কিন্তু সবুজ রুমালটি ব্যাগে ভরে ফেলছ। আমি যেতে ঠিক সাহস পাচ্ছি না।’
নীলু অস্বাভাবিক ব্যস্ত হয়ে রুমাল বের করতে গেল। একটা লিপস্টিক, একটা ছোট চিরুনি, কিছু খুচরো পয়সা গড়িয়ে পড়ল নিচে। ছেলেটি হাসিমুখে সেগুলি কুড়োচ্ছে। নীলু মনে-মনে বলল—যেন এটা স্বপ্ন না হয়। আর স্বপ্ন হলেও যেন স্বপ্নটা অনেকক্ষণ থাকে। নীলুর খুব কান্না পেতে লাগল।
নিউ মার্কেটের ভেতর চা খাওয়ার তেমন ভালো জায়গা নেই। ওরা বলাকা বিল্ডিংয়ের দোতলায় গেল। চমৎকার জায়গা! অন্ধকার-অন্ধকার চারদিক। পরিচ্ছন্ন টেবিল। সুন্দর একটি মিউজিক হচ্ছে।
‘চায়ের সঙ্গে কিছু খাবে নীলু?’
‘নাহ্।’
‘এরা ভালো সমুচা করে। সমুচা দিতে বলি? আমার খিদে পেয়েছে। কি, বলব?’
‘বলুন।’
ছেলেটি হাসল। নীলুর খুব ইচ্ছা করছিল, জিজ্ঞেস করে—হাসছ কেন তুমি? আমি কি হাস্যকর কিছু করেছি? কিন্তু নীলু কিছু বলল না। ছেলেটি হাসতে-হাসতে বলল, ‘আসলে আমি বিজ্ঞাপনটা মজা করবার জন্যে দিয়েছিলাম, কেউ জবাব দেবে ভাবি নি।’
‘আমি ছাড়া কেউ কি লিখেছিল?’
‘তা লিখেছে। মনে হচ্ছে এ-দেশের মেয়েদের কাজকর্ম বিশেষ নেই। সুযোগ পেলেই ওরা চিঠি লেখে। এই কথা বললাম বলে তুমি আবার রাগ করলে না তো?’
‘নাহ্!’
গুড। আমি কিন্তু শুধু তোমার চিঠির জবাব দিয়েছি। অন্য কারোর চিঠির জবাব দিই নি। আমার কথা বিশ্বাস করছ তো?’
‘করছি।’
বেয়ারা চায়ের পট দিয়ে গেল। ছেলেটি বলল, ‘দাও, আমি চা বানিয়ে দিচ্ছি। ঘরে বানাবে মেয়েরা, কিন্তু বাইরে পুরুষেরা—এ-ই নিয়ম।’
নীলু লক্ষ করল, ছেলেটি তার কাপে তিন চামচ চিনি দিয়েছে। নীলু এক বার লিখেছে সে চায়ে তিন চামচ চিনি খায়। ছেলেটি সেটা মনে রেখেছে। কী আশ্চর্য!
‘চায়ে এত চিনি খাওয়া কিন্তু ভালো না।’
নীলু কিছু বলল না।
‘এর পর থেকে চিনি কম খাবে।’
নীলু ঘাড় নাড়ল।
তারা সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে রইল। নীলু একবার বলল, ‘সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে, উঠি?’ ছেলেটি বলল, ‘আরেকটু বস, আমি বাসায় পৌঁছে দেব, আমার সঙ্গে গাড়ি আছে।’
নীলু আর কিছু বলল না।
‘একটু দেরি হলে তোমাকে আবার বাসায় বকবে না তো?’
‘নাহ্, বকবে না। আমি মাঝে-মাঝে অনেক রাত করে বাসায় ফিরি।’
‘সেটা ঠিক না নীলু। শহর বড় হচ্ছে, ক্রাইম বাড়ছে। ঠিক না?’
‘হ্যাঁ, ঠিক।’
‘ঐ দিন কী হল জান—আমার পরিচিত এক মহিলার কান থেকে টেনে দুল নিয়ে গেছে, রক্তারক্তি কাণ্ড!
‘আমি বাইরে গেলে গয়নাটয়না পরি না।’
‘না-পরাই উচিত। আচ্ছা নীলু, তুমি কি আজ তোমার বাবার সঙ্গে আমাকে আলাপ করিয়ে দেবে?’
‘আপনি যদি চান, দেব।’
‘আমি নিশ্চয়ই চাই। তুমি কি চাও?’
‘চাই’ বলতে গিয়ে নীলুর চোখ ভিজে ঠল। ছেলেটিকে এখন কত-না পরিচিত মনে হচ্ছে! সে যদি এখন হাত বাড়িয়ে নীলুর হাত স্পর্শ করে, তাহলে কেমন লাগবে নীলুর? ভালোই লাগবে। কিন্তু ছেলেটি অত্যন্ত ভদ্র। সে এমন কিছুই করবে না।
‘নীলু, আমি তোমার জন্যে একটা পহার এনেছিলাম। কিন্তু তার আগে বল, তুমি কী এনেছ? তুমি বলেছিলে লাল টাই আনবে। ভুলে গেছ, না?’
‘না, ভুলব কেন?’
‘আমি তোমার জন্যেই লাল টাই পরে এসেছি। যদিও লাল রং আমার পছন্দ নয়। আমার পছন্দ হচ্ছে নীল।’
‘নীল আমারও পছন্দ।’
‘তবে হাল্কা নীল, কড়া নীল নয়।’
নীলু এই প্রথম অল্প হাসল। হাল্কা নীল তার নিজেরও পছন্দ। ছেলেটি হাসতে-হাসতে বলল, ‘আমার সবচে অপছন্দ হচ্ছে সবুজ রং। কিন্তু দেখ, আজ সবুজ রংটাও খারাপ লাগছে না।
তারা উঠে দাঁড়াল সাড়ে আটটার দিকে। হেঁটে-হেঁটে এল নি মার্কেটের গেটে। ছোট্ট একটা হোণ্ডা সিভিক সেখানে পার্ক করা। ছেলেটি ঘড়ি দেখে বলল, ‘রাত কি বেশি হয়ে গেল নীলু?’
‘না, বেশি হয় নি।’
‘তোমার বাবা দুশ্চিন্তা না-করলে হয়। আমি চাই না আমার জন্যে কে বকা খাক। অবশ্যি এক-আধ দিন বকা খেলে কিছু যায় আসে না, কি বল?
নীলু হাসল। ছেলেটিও হাসল। মার্জিত হাসি।
‘সরাসরি বাসায় যাবে, নাকি যাবার আগে আইসক্রীম খাবে? ধানমণ্ডিতে একটা ভালো আইসক্রীমের দোকান দিয়েছে।’
‘আজ আর যাব না।‘
‘ঠিক আছে, চল বাসায় পৌঁছে দিই।’
ছেলেটি নীলুকে তাদের গেটের কাছে নামিয়ে দিল। নীলুর খুব ইচ্ছে করছিল তাকে বসতে বলে, কিন্তু তার বড্ড লজ্জা করল। বিলু নানান প্রশ্ন শুরু করবে।