দুঃস্বপ্নের রাত
সোমনাথ যখন ট্রেন থেকে নামল তখন পড়ন্ত বেলা। ছোটো পাহড়ি স্টেশন। প্রায় চার হাজার ফুট উঁচুতে ঢালু পাহাড়ের গায়ে গুল্ম-জাতীয় ঘন সবুজের পরিবেশে ছবির মতো স্টেশনটি। সোমনাথ মুগ্ধ দৃষ্টিতে চারদিকে চোখ বোলাল, বাংলার সমতল শ্যামলভূমি আর এখানকার রুক্ষ পাহাড়ের আরণ্যক শ্যামলতার মধ্যে আকাশ-পাতাল প্রভেদ। গুল্ম ছাড়াও কিছু দূরে পাইন বনের সবুজ রেখা দেখা যাচ্ছে, মাইলের পর মাইল চলে গেছে এই রেখা, পাইনের ঘন সন্নিবেশ।
সোমনাথ সুটকেসটা নিয়ে স্টেশনের বাইরে এল। মি ওয়াঞ্চু চিঠিতে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে স্টেশন থেকে বেরুলেই বাসস্ট্যান্ড, কয়েক মিনিটের মধ্যেই বাস ছাড়বে। কনডাক্টরকে ও যেন বলে চৌরাস্তার মোড়ে নামবে, সেখান থেকে উত্তর দিকে যে রাস্তাটা চলে গেছে সেটা ধরে নাকবরাবর মিনিট পনেরো হাঁটলেই ডান হাতি একটা বড়ো দোতলা বাড়ি চোখে পড়বে। বাড়িটা কিন্তু ঠিক রাস্তার ওপর নয়, উত্তরমুখো যে রাস্তাটার কথা আগে বলা হয়েছে, সেটা থেকে একটা পথ ডাইনে বেঁকে ওই বাড়িটার সামনে গিয়ে শেষ হয়েছে। মি ওয়াঞ্চু ভালো করে ম্যাপ এঁকে বাড়িটার অবস্থান বুঝিয়ে দিয়েছেন, কোনো অসুবিধে হবে না। বিছানাপত্র তিনি নিতে মানা করেছেন। তাই সোমনাথ ছোটো একটা সুটকেসে কিছু জামাকাপড় ভরে বেরিয়ে পড়েছে। সঙ্গে নিয়েছে একটা রিভলভার আর একটা তিন ব্যাটারির টর্চ! বাইরে গেলেই এগুলি ওর নিত্যসঙ্গী।
বাসে উঠে কোনার দিকে একটা সিটে ও আয়েশ করে বসল। এখনও যতটুকু বেলা আছে, বাইরের প্রাকৃতিক দৃশ্য, অরণ্য আর পাহাড়ের অনন্ত সৌন্দর্য ও দু-চোখ ভরে দেখবে। বাস ছাড়ল, পাহাড়ি পথ সাপের মতো এঁকে-বেঁকে গিয়েছে, পথ কোথাও দুস্তর চড়াই আবার কোথাও উতরাই। পথের দু-পাশে পাহাড় ঢালু হয়ে খাদে নেমেছে, দূর থেকে মনে হয় যেন একই আকারের ঘন ঝোপঝাড় সমস্ত ঢালু জায়গায় সবুজের প্রলেপ লেপে দিয়েছে। একটা খরস্রোতা নদী অনেক তলা দিয়ে বয়ে গেছে, মনে হচ্ছে যেন একটা সরু রেখা চলে গেছে।
সোমনাথ আজ তিন বছর ধরে মোদী অ্যান্ড রুস্তমজি সলিসিটার ফার্মের একজন লিগাল অফিসার। একজন বলা হল, কারণ, ওই ফার্মের আরও অনেক লিগাল অফিসার আছেন। খুব বড়ো ফার্ম, গোটা দেশ জুড়ে ওদের কাজকর্ম চলে, হেড অফিস কোলাবায়। একটি বিখ্যাত ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর এ জায়গাটা খুব পছন্দ, রাসায়নিক কারখানার পক্ষে আদর্শ জায়গা। মি ওয়াঞ্চু এখানকার প্রচুর জমির মালিক, কয়েক একর জমি বিক্রি করতে তাঁর আপত্তি নেই, তাই সেই ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান মোদী অ্যান্ড রুস্তমজির ওপর এই লেনদেনের ভার দিয়েছেন। সোমনাথ যদিও কলকাতা অফিসের কর্মচারী, কিন্তু সম্প্রতি ফার্মের হয়ে এই বড়ো চুক্তি সাফল্যের সঙ্গে সম্পাদন করার পর হেড অফিসের বড়োকর্তারা ওর কাজে খুব প্রীত হয়ে এই লেনদেনের ব্যাপারটাও ওর হাতে দিয়েছেন। অবশ্য তাঁরা জানতেন কাজটা খুব সহজ হবে না, কানাঘুঁসোয় তাঁরা একথাও শুনেছিলেন যে মি ওয়াঞ্চু ভীষণ খামখেয়ালি মানুষ এবং তাঁকে জড়িয়ে নানারকম অদ্ভুত কাহিনি গড়ে উঠেছে। যা হোক, সোমনাথ এ কাজটার ভার পেয়ে খুশিই হয়েছিল। তার কাছ থেকে চিঠি পেয়ে মি ওয়াঞ্চু লেনদেনের বিস্তারিত আলোচনার জন্য কাগজপত্র নিয়ে তাকে এখানে আসতে চিঠি লিখেছিলেন, তাঁর আতিথ্য গ্রহণেরও অনুরোধ জানিয়েছিলেন।
ক্রমে সন্ধ্যা নেমে এল। সবুজ বনানীর অন্ধকারের ছায়ায় অস্পষ্ট হয়ে একটা কালো রূপ নিল। সোমনাথ ওর পাশে বসা একটি দেহাতি লোককে প্রশ্ন করল, চৌরাস্তা আর কতদূর? সে উত্তরে জানাল যে প্রায় এসে পড়েছে, এবার যেখানে বাস থামবে তার পরের স্টপেজই হল চৌরাস্তার মোড়। তারপর সে নিজেই কৌতূহলী হয়ে সোমনাথের গন্তব্যস্থল জিজ্ঞেস করল। সোমনাথ তাকে বুঝিয়ে দিতেই সে কেমন যেন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকাল তারপর বলল, বাবুজি, আপনি বিদেশি মানুষ বলেই বলছি, আমি এ অঞ্চলের লোক, এখানেই চুল পাকিয়ে ফেললাম, ও বাড়ির বড়ো বদনাম আছে, আপনি একা হুট করে ওখানে রাত্রিবাস করবেন না।
সোমনাথ বিস্মিত হয়ে লোকটির ওকথার কারণ জিজ্ঞেস করল। লোকটি জবাবে বলল যে সে নিজের চোখে অবশ্য কিছু দেখেনি, তবে এ অঞ্চলে কেউ রাত্রে ওই বাড়ির পাশ দিয়ে হাঁটে না। কারণটা সে অবশ্য খুলে বলল না আর তা জানবার সময়ও সোমনাথের ছিল না, যেহেতু বাস ঠিক সেই সময় চৌরাস্তার মোড়ে এসে থেমেছে। ও দেহাতি লোকটিকে তার সাবধানবাণীর জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে চটপট নেমে পড়ল। বাসের রাস্তাটা হল পুব-পশ্চিমে, ওকে এখন উত্তর দিকে যেতে হবে। শুক্লপক্ষ, চাঁদ উঠেছে, সব কিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, সোমনাথের কোনো অসুবিধে হল না। রাস্তাটা অপ্রশস্ত, পাথর আর কাঁকরে ভরতি, বেশি লোক চলাচল নেই বলেই মনে হয়। মি ওয়াঞ্চুর কথামতো মিনিট পনেরো হাঁটার পর ও থমকে দাঁড়াল। হ্যাঁ, ডান দিকে একটা সরু পথ চলে গেছে, আর সেই পথের শেষে একটা দোতলা বাড়ি দেখা যাচ্ছে। ঝলমল চাঁদের আলোয় বাড়িটাকে ভূতুড়ে বাড়ি বলে মনে করা অন্যায় হবে না।
সোমনাথ স্থির হয়ে দাঁড়াল, কেন জানি না, ওর গা ছমছম করে উঠল। বুড়ো দেহাতি লোকটি ওকথা বলল কেন? পরক্ষণেই ও মনে মনে হেসে উঠল। দুর ছাই, যতসব কুসংস্কার। সোমনাথের বুদ্ধিই শুধু তীক্ষ্ন ছিল না, সাহস ও শক্তিতেও সাধারণের সঙ্গে ওর ব্যবধান ছিল যথেষ্ট। কলেজ জীবনে ও অপরাজিত মুষ্টিযোদ্ধা হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিল, আজকাল শিকারের দিকে ঝুঁকেছে, বয়সও ওর বেশি নয়, মাত্র আঠাশ বছর।
সুটকেসটাকে শক্ত মুঠোয় চেপে ধরে ও বড়ো বড়ো পা ফেলে ডান দিকের পথ ধরল। কাছে এসেই বুঝতে পারল বাড়িটা উঁচু পাঁচিলে ঘেরা, পাঁচিল দু-মানুষ উঁচু তো হবেই, বেশিও হতে পারে। পথটা একটা প্রকাণ্ড গেটের সামনে গিয়ে শেষ হয়েছে। সোমনাথ সুটকেসটা মাটিতে নামিয়ে রেখে টর্চ ফেলে দেখতে লাগল। লোহার গেট, রং চটে গেছে, মরচে পড়েছে, দেখে মনে হয় যেন মোগল আমলের, কিন্তু এখনও বেশ মজবুত। ভেতর থেকে তালাবন্ধ। গেটের ওপর থেকে তালাবন্ধ। গেটের ওপর থেকে তলা পর্যন্ত সারি সারি চওড়া লোহার পাত! তার ফাঁক দিয়ে সোমনাথ দেখল, বাড়িটা গেট থেকেও বেশ কিছুটা ভেতরে, কোনো আলোর রেখা চোখে পড়ে না। ও কী করবে ভাবছে, এমন সময় চোখে পড়ল গেটের ডান দিকে একটা উঁচু কাঠের ফ্রেম, আর সেটা থেকে পেতলের একটা বিরাট ঘণ্টা ঝুলছে, অনেকটা গির্জের ঘণ্টার মতো। ঘণ্টার সঙ্গে একটা দড়ি বাঁধা আর দড়িটা হাতের নাগালের মধ্যেই। সোমনাথ সেই দড়িটা ধরে টান দিতেই চারদিকের জমাট অন্ধকার ও গাঢ় স্তব্ধতা ছাপিয়ে গুরুগম্ভীর স্বরে ঘণ্টা বেজে উঠল ঢং ঢং ঢং। কী আশ্চর্য! সঙ্গেসঙ্গে বাড়ির সামনের দরজাটা খুলে গেল আর কেউ যেন একটা আলো হাতে এগিয়ে আসছে। কাছে আসতেই সোমনাথ দেখল, একটি পাহাড়ি লোক, বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছে। লণ্ঠনটা সে সোমনাথের মুখের ওপর তুলে ধরে তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে তাকে দেখল, তারপর গেটের লোহার শেকলটা খুলে একটা পাল্লা ফাঁক করে ওকে ইঙ্গিতে ভেতরে আসতে বলল।
যখন লোকটি আলো তুলে ধরেছিল তখনই সোমনাথ তাকে দেখে নিয়েছিল। মুখে বার্ধক্যের ছাপ, গলার চামড়া ঝুলে পড়েছে, চোখ দুটি গর্তে ঢোকা কিন্তু যেন একটু বেশিরকম উজ্জ্বল, অন্ধকারে হঠাৎ যেন বেড়ালের চোখ বলে মনে হয়। ঠিক এই সময় খুব কাছ থেকে একটা হিংস্র জন্তুর চাপা গর্জন সোমনাথের কানে এল। ও তাড়াতাড়ি গেটের মধ্যে ঢুকে পড়ল। গেট বন্ধ করে লোকটি ওকে তার অনুসরণ করতে ইঙ্গিত করল। গেটে তালা পড়তেই সোমনাথের মনে হল ও যেন একটা জেলখানার মধ্যে ঢুকছে, আর পালাবার পথ নেই। একটা অহেতুক অস্বস্তিতে ওর মন ভরে গেল।
লোকটির পিছু পিছু সোমনাথ এগিয়ে চলল। চাঁদের আলোয় চারদিকে ও একবার চোখ বুলিয়ে নিল। বিরাট জমি নিয়ে বাড়িটা, অযত্ন আর অবহেলায় ইতস্তত বুনো গাছগাছড়ায় ভরে গেছে, শেয়াল কিংবা ওই জাতীয় বন্য জন্তুজানোয়ার থাকা বিচিত্র নয়। লোকটি ওকে দোতলার একটি ঘরে নিয়ে এল। সোমনাথের মনে হল তার ব্যবহারের জন্যই বোধ হয় ঘরটি অতি সম্প্রতি পরিষ্কার করা হয়েছে। দেয়ালের কোনায় ‘ঝুল’ আর ঘরের অবস্থা দেখেই তা মনে হয়। ঘরটি অবশ্য বেশ বড়ো। সোমনাথ ঘরের চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে সুটকেসটাকে মাটিতে রাখল, তারপর লোকটিকে হিন্দিতে জিজ্ঞেস করল তার মনিবের সঙ্গে কখন দেখা হবে। উত্তরে লোকটি হাঁ করল আর সোমনাথ সভয়ে দু-পা পিছিয়ে গেল। লোকটির জিভ অর্ধেকটা নেই, যেন কেউ কেটে নিয়েছে। হাত-পা নেড়ে ইঙ্গিতে কিছু বলবার বা বোঝাবার চেষ্টার কারণ এতক্ষণে ওর কাছে স্বচ্ছ হয়ে গেল।
লোকটি ঘর ছেড়ে চলে যেতেই সোমনাথ ওর জন্য পাতা বিছানার ওপর ধপাস করে বসে পড়ল। সব কিছু মিলিয়ে পরিবেশটা ওর কাছে মোটেই সুখকর মনে হচ্ছে না, কোথায় ও এসে পড়ল! এখান থেকে যে বেরুবার উপায় নেই তা যেন ও মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছে। মিনিট কয়েক বসে থাকার পর ও জামাকাপড় ছেড়ে ফেলল। বাথরুমে এক ড্রাম ঠান্ডা জল ছিল, ওই লোকটিই নিশ্চয় তার জন্য তুলে রেখেছে। দুটো পুরো রাত ওকে ট্রেনে কাটাতে হয়েছে, ধুলো বালিতে শরীর যেন কিচ কিচ করছে। ঠান্ডা জল গায়ে পড়তেই আরামে দু-চোখ বুজে এল। খুব ভালো করে স্নান করে যখন ও বেরুল তখন সব ক্লান্তি, অবসাদ এমনকী অহেতুক একটা উদবেগ, যা ওর মনকে পীড়া দিচ্ছিল, সব যেন ভোজবাজির মতো উবে গেছে। পাহাড়ি লোকটা আবার ওর সামনে এসে দাঁড়াল, ইঙ্গিতে ওকে তার অনুসরণ করতে বলল।
সোমনাথ লোকটির পেছন পেছন চলল। লোকটির হাতে একটা বড়ো মোমবাতি, সেই আলোতে সে পথ দেখিয়ে চলেছে। প্রকাণ্ড বাড়ি, বড়ো বড়ো ঘর বারান্দা কিন্তু লোকজনের সাড়া নেই। সোমনাথ অবাক হয়ে ভাবে এত বড়ো বাড়িতে একা একা বাস করাও তো দুঃস্বপ্ন। সোমনাথের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল দোতলায় দক্ষিণ সারির মাঝামাঝি একটি ঘরে আর লোকটি ওকে নিয়ে প্রবেশ করল একতলার উত্তর প্রান্তের একটি ঘরে। বিরাট ঘর, চারদিকে আলমারি, বইয়ে ঠাসা। ঘরটা আবছা অন্ধকার, শুধু পশ্চিম দিকের কিছু জায়গা বেশ উজ্জ্বল, সেখানে প্রকাণ্ড একটা টেবিলের ওপর বাতিদানিতে প্রায় এক হাত লম্বা, সরু বাঁশের মতো মোটা পাঁচটি মোমবাতি জ্বলছে। বাড়িতে যে বিজলি আলো নেই তা অবশ্য সোমনাথ আগেই টের পেয়েছিল। দেওয়াল ঘেঁষে একটা গদি মোড়া চেয়ারে একজন ভদ্রলোক বসে আছেন। তিনিই নিশ্চয়ই মি ওয়াঞ্চু। সোমনাথ ভদ্রলোকের দিকে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল।
তিনি একটা মোটা বইয়ের ওপর ঝুঁকে ছিলেন, পায়ের শব্দে মুখ তুলে তাকালেন আর সঙ্গেসঙ্গে সোমনাথ যেন একটা ইলেকট্রিক শক খেল। ভদ্রলোক ওর দিকে তাকিয়ে আছেন, মুখে যেন একটু কৌতুকের আভাস। তাঁর চোখ দুটি সোমনাথের মুখের ওপর দৃষ্টি বুলোচ্ছে, কিন্তু অদ্ভুত সে-দৃষ্টি। সোমনাথের মনে হল ওর বুদ্ধি যেন লোপ পেয়ে যাচ্ছে।
ভদ্রলোকের দৃষ্টি দু-রকম, পার্থক্যটা এতই প্রকট যে মনে হয় না একই মানুষের দুটো চোখ। ডান দিকের চোখের দৃষ্টিতে শান্ত, স্নিগ্ধ ভাব ফুটে উঠেছে আর বাঁ-দিকের চোখটা একটু লালচে, ত্রূর, হিংস্র, নেকড়ের মতো সে-চোখের দৃষ্টি, তাকাতে ভয় করে। সোমনাথের অস্বাচ্ছন্দ্য ভদ্রলোক বোধ হয় বুঝতে পারলেন, তিনি মুখে একটু হাসি টেনে ওকে বসতে বললেন। সোমনাথ তাঁর মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসল, মাঝখানে সেক্রেটারিয়েট টেবিলটাই যা ব্যবধান। দু-চারটে মামুলি কথাবার্তা হল।
সোমনাথ আরো লক্ষ করল ভদ্রলোকের চওড়া কাঁধ, বলিষ্ঠ পেশল বাহু, বয়স চল্লিশ পঁয়তাল্লিশের বেশি হবে না। ভদ্রলোক একটা সিল্কের পায়জামা আর একটা সিল্কের চিত্তির-বিচিত্তির শার্ট পরেছিলেন। বুকের বোতামটা খোলা, সেই ফাঁক দিয়ে ঘন কালো লোম উঁকি মারছিল, ভদ্রলোকের হাতেও বড়ো বড়ো লোম। এককথায় বলিষ্ঠ লোমশ পুরুষ। তাদের কথাবার্তার ফাঁকে সেই পাহাড়ি আবার এসে দাঁড়াল। ভদ্রলোক অর্থাৎ মি ওয়াঞ্চু বললেন, ‘চলুন, ডিনার রেডি।’ সোমনাথ হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল মোটে আটটা বাজে। মি ওয়াঞ্চু সেটা লক্ষ করে মৃদু হেসে বললেন, ‘আর্লি টু শ্লিপ অ্যান্ড আর্লি টু রাইজ, এ প্রবাদটা আমি মেনে চলি।’ তিনি উঠে দাঁড়ালেন আর সোমনাথ আরেকবার চমকে উঠল। মি ওয়াঞ্চু বামন, লম্বায় চার ফুট কয়েক ইঞ্চি মাত্র। খাটো চেহারা অথচ চওড়া বুক পিঠ ও দীর্ঘ বাহু, শুধু যে বেমানান তাই নয়, দৃষ্টিকটুও বটে।
খাবার আয়োজন হয়েছিল ভালোই। জুঁই ফুলের মতো সাদা মিহি চালের ভাত, শিককাবাব, হরিণের মাংস আর মটর পনির। কিন্তু এ শুধু সোমনাথের জন্যই, মি ওয়াঞ্চুর জন্য আলাদা ব্যবস্থা। তাঁর জন্য একটা বড়ো কাচের প্লেটে পুরু থকথকে মাংস, সমস্ত প্লেটটা জুড়ে একটা বড়ো মাংসের চাক, লাল টকটক করছে। সোমনাথের বিস্মিত দৃষ্টির উত্তরে মি ওয়াঞ্চু জানালেন যে রাত্রে তিনি মাংস ছাড়া আর কিছু খান না। সোমনাথের কিন্তু অত বড়ো মাংসের একটা চাক দেখে কেমন গা ঘিন ঘিন করে উঠল। তা ছাড়া ওটা অত লালই-বা কেন! মি ওয়াঞ্চু কিন্তু নিপুণ হাতে ছুরি দিয়ে মাংসের চাকটাকে খণ্ড খণ্ড করে কেটে কাঁটা দিয়ে গেঁথে পরম তৃপ্তির সঙ্গে টপাটপ মুখে পুরতে লাগলেন।
খাওয়া শেষ হলে ওরা আবার মি ওয়াঞ্চুর লাইব্রেরি ঘরে ফিরে এল। পাহাড়ি লোকটি কফি দিয়ে গেল। আরও কিছুক্ষণ আলাপ আলোচনার পর মি ওয়াঞ্চুই ওকে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে বললেন, ট্রেনজার্নিতে ওর শরীরের ওপর দিয়ে কম ধকল যায়নি। মি ওয়াঞ্চুর হাতের কাছে একটা দড়ি ঝুলছিল, তিনি সেটা ধরে টান দিতেই মাথার ওপর একটা ঘণ্টা বেজে উঠল। সোমনাথ মনে মনে ভাবল, এখানে দেখছি সব ঝোলানো ঘণ্টার ব্যাপার। ঘণ্টার শব্দ শুনে পাহাড়ি লোকটি এসে দাঁড়াল, মি ওয়াঞ্চুকে শুভরাত্রি জানিয়ে সোমনাথ লোকটির পেছন পেছন ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
সোমনাথের অত তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ার ইচ্ছে ছিল না, তাই ও একটা ইংরেজি রহস্য উপন্যাস খুলে বসল। বলা বাহুল্যও, ওর ঘরেও মোমবাতি জ্বলছিল। কিছুক্ষণ পড়ার পর ওর হাই উঠতে লাগল, দু-রাত্রি ট্রেনে ভালো ঘুম হয়নি, চোখ যেন বুজে আসছে। সোমনাথ উঠে পড়ল। সুটকেস থেকে টর্চটা বের করল তারপর কী মনে করে রিভলভারটাও বের করল। টর্চটা শিয়রে আর রিভলভারটা বালিশের তলায় রেখে ও মোমবাতি ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিল, তারপর বিছানায় শুয়ে পড়ল। গ্রীষ্মকাল, জানালাগুলি সব খোলা, ফুর ফুর করে হাওয়া আসছে। ঘরের মধ্যে প্রায় গোটা ছয়েক জানালা, একটা জানালা প্রায় এক দরজা সমান। জানালাটা দু-ভাগে ভাগ করা, ওপরে দু-পাট, নীচে দু-পাট, কিন্তু একসঙ্গে বন্ধ করা যায় আবার খোলাও যায়। অন্য জানালাগুলির মতো এতে কাঠের গরাদ নেই তাই ওপর নীচ খুলে দিলে দরজার মতো ফাঁক হয়ে লোক যাতায়াতের পথ করে দেয়। এটা দিয়েই দোতলার বারান্দায় যেতে হয়, বোধ হয় প্রত্যেক ঘরেই এই একই ব্যবস্থা। ঢালা বারান্দা, বেশ চওড়া, অনেকটা অর্ধ গোলাকার, এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত রামধনুর মতো চলে গেছে। সোমনাথ সব জানালাগুলিই খুলে দিয়েছিল। গরমের সময় হলেও চারদিকে খোলামেলা বলে রাত্রে চমৎকার হাওয়া, শোবার সঙ্গেসঙ্গেই ওর নাক ডাকতে শুরু করল।
গভীর রাতে আচমকা সোমনাথের ঘুম ভেঙে গেল। অজানা পরিবেশে প্রথমে ও কিছুই ঠাওর করতে পারল না। ঘোরটা কেটে যেতেই একটা বিচ্ছিরি গন্ধ ওর নাকে এসে লাগল। গন্ধটা আসছে বারান্দায় যাবার জানালার দিক থেকে। ও হাত বাড়িয়ে টর্চটা তুলে নিল তারপর বোতাম টিপল। উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে পড়তেই ওর মনে হল চকিতে যেন একটা ছায়ামূর্তি অদৃশ্য হয়ে গেল। এত তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা ঘটে গেল যে সোমনাথ হকচকিয়ে গেল। ওই মুহূর্তের মধ্যেও ওপর মনে হল যেটা মিলিয়ে গেল সেটা আর কিছু নয়, ধূসর রঙের বড়ো কুকুর জাতীয় একটা প্রাণী। বাড়িতে পোষা কুকুর থাকলে ও নিশ্চয়ই টের পেত! ওটা এল কোত্থেকে! একতলায় সব বন্ধ, দোতলায় অত উঁচুতে কোনো বন্যপ্রাণীর পক্ষে মাটি থেকে লাফিয়ে ওঠা শুধু অসম্ভবই নয়, অবাস্তব। বারান্দায় যাবার ওপর নীচ দুটো জানালাই বন্ধ করে ও আবার শুয়ে পড়ল। অদ্ভুত জীবটির সম্বন্ধে নানা চিন্তা করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল ও।
সোমনাথের ঘুম যখন ভাঙল তখন বাইরের রোদ ঘরের মধ্যে এসে ঢুকেছে। ও তাড়াতাড়ি হাত-মুখ ধুয়ে নীচে নেমে এল। মি ওয়াঞ্চু বোধ হয় অনেক আগেই উঠেছিলেন, তাঁর পোশাক দেখে মনে হয় প্রাতঃভ্রমণ সেরে সবে ফিরেছেন। সোমনাথকে তিনি হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন রাত্রে ভালো ঘুম হয়েছিল কি না। সোমনাথ ঘাড় নেড়ে সায় দিল, তারপর একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল অ্যালসেশিয়ান কুকুরটা রাত্রে কোথায় থাকে? ওর মনে হয়েছিল ওটা ওই জাতীয় কুকুর ছাড়া আর কিছু নয়। মি ওয়াঞ্চু কিন্তু ওর কথা শুনে একটু অবাক হয়েই ওর মুখের দিকে তাকালেন, তারপর বললেন, কোনো কুকুর তো এ বাড়িতে নেই। সোমনাথ তাড়াতাড়ি বলল যে তারই ভুল হয়েছিল।
ব্রেফাস্ট সেরে সোমনাথ কাগজপত্র নিয়ে বসল। মি ওয়াঞ্চু তাঁর দলিলপত্র বের করে কী ধরনের লেনদেনে তিনি সম্মত তা প্রাঞ্জল ভাষায় বুঝিয়ে দিলেন। সোমনাথের বুঝতে কষ্ট হল না যে আইনের ওপর ভদ্রলোকের যথেষ্ট দখল আছে, বুদ্ধিও প্রখর।
একটা জিনিস কিন্তু ও লক্ষ না করে পারল না, কাল রাত্রে মি ওয়াঞ্চুকে দেখে ওর মনে যে একটা কিন্তু কিন্তু ভাব জেগেছিল আজ সকালে তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলে সে-ভাবটা আর ওর মনে জাগছে না। হাসিখুশি, আমুদে ভদ্রলোক বলেই মনে হচ্ছে, অতিথিবৎসল তো বটেই। আজ দিনের বেলা মি ওয়াঞ্চুর সঙ্গে গতকাল রাত্রে দেখা ভদ্রলোকের যেন আকাশ-পাতাল প্রভেদ।
বেলা ঠিক সাড়ে এগারোটায় মধ্যাহ্নভোজনের ডাক পড়ল। পাহাড়ি লোকটির হাতের রান্না কিন্তু অপূর্ব, জানেও অনেকরকম রান্না। দুপুরের মেনু ছিল মোগলাই-পোলাও, মাংসের কোপ্তা, মাছের ফ্রাই আর কাচের বাটি ভরতি জমানো দুধ, তার মধ্যে কিসমিস ও পেস্তা-বাদাম ছড়ানো। এবেলা কিন্তু মি ওয়াঞ্চু সোমনাথের সঙ্গে একই খাবার খেলেন, গতরাত্রের মতো কোনো বিশেষ ব্যবস্থার ধার দিয়েও গেলেন না। খেতে খেতে তিনি অনেক গল্প করলেন, হাসির কথা বললেন, নিজেও প্রাণ খুলে হাসলেন। ভদ্রলোক যে শুধু শিক্ষিতই নন, অসাধারণ পণ্ডিত তা সোমনাথ তাঁর সঙ্গে নানা প্রসঙ্গ আলোচনা করেই টের পেয়েছিল, তাঁর লাইব্রেরিতে যে কী ধরনের বই নেই সেটাই হল ভাবনার বিষয়। বিকলাঙ্গ না হলেও দৈহিক খর্বতার জন্য তিনি বাইরের জগৎ থেকে নিজেকে একেবারে সরিয়ে নিয়েছেন। এখানে একা ওই পাহাড়ি অনুচরের সেবায় আর বইয়ের মধ্যে তিনি বেশ নিরুপদ্রবে জীবনযাপন করছেন। কোনো ক্ষোভ নেই, খেদ নেই, বরং ভালোই আছেন। পূর্বপুরুষরা প্রচুর সম্পত্তির মালিক ছিলেন, আজও যা আছে তা কুড়িয়ে কাড়িয়েও কুড়ি বাইশ লাখ টাকার কম হবে না।
দুপুরে আর কোনো কাজ হল না। মি ওয়াঞ্চু অনেক রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করেন তাই সারাটা দুপুর তিনি ঘুমোন। সোমনাথও তার নির্দিষ্ট ঘরে টান টান হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। দিবানিদ্রার অভ্যেস ওর নেই কিন্তু শোবার সঙ্গেসঙ্গেই ও ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম ভাঙল একেবারে বিকেলে। মি ওয়াঞ্চু তখনও তাঁর ঘর থেকে বেরোননি। সোমনাথকে উঠতে দেখে পাহাড়ি লোকটি টি-পটে চা আর কড়া করে ভাজা পুরু একটা ডিমের অমলেট ওর ঘরে দিয়ে গেল। সোমনাথের চা-তেষ্টা পেয়েছিল, ও খুশিমনে পেয়ালায় চা ঢেলে চুমুক দিল। দামি চা, সুন্দর ফ্লেভার। ডিমের অমলেটটা ছুরি দিয়ে কাটতে বেশ বেগ পেতে হল, বোধ হয় চার পাঁচটা ডিম দিয়ে অমলেটটা বানানো হয়েছে।
চা-পর্ব সেরে ও বেরিয়ে পড়ল। দিনের বেলা গেটটা খোলাই থাকে। এদিকটা খুব নির্জন, একজন লোকও ওর চোখে পড়ল না। পথের দু-ধারে এবং চারদিকে ঘন জঙ্গল, হিংস্র জন্তুজানোয়ারের আদর্শ লীলাভূমি।
সন্ধের মুখে ও বেরিয়ে ফিরে এল। নিজের ঘরে এসে জামাকাপড় বদলে ও লাইব্রেরি ঘরের দিকে পা বাড়াল। আর এক দফা বৈষয়িক আলোচনা করে কাজটা ও এগিয়ে রাখতে চায়।
গতকাল রাত্রের মতো আজও মি ওয়াঞ্চুর লাইব্রেরিতে মোমবাতির আলো, বাতিদানের পাঁচটি মোটা মোটা মোম, নিশ্চয়ই অর্ডার দিয়ে তৈরি। সোমনাথ এগিয়ে গেল। মি ওয়াঞ্চু কিছু একটা করছিলেন, ওর পায়ের শব্দে মুখ তুলে তাকালেন আর সোমনাথ গতকালের মতো আবার যেন একটা শক খেল। দু-চোখের দৃষ্টিতে এক অদ্ভুত পার্থক্য, দিনের বেলা বোঝাই যায় না। মুখের ডান দিকের আদল আর বাঁ-দিকের আদল সম্পূর্ণ ভিন্ন, যেন দু-জন আলাদা মানুষের অর্ধেক অংশ জোড়া দিয়ে একটা মুখ গড়ে উঠেছে। একজন শান্ত সৌম্য মানুষের ডান দিকের অংশ আর একজন নিষ্ঠুর মানুষের বাঁ-দিকের অংশের সমন্বয়ে যে বিচিত্র ভয়াল মুখের ছবি মানসপটে ভেসে ওঠে, ওয়াঞ্চুর মুখের দিকে তাকিয়ে সোমনাথের ঠিক সেই অনুভূতি হল।
মি ওয়াঞ্চুর ঠোঁটের বাঁ-কোল ঘেঁষে একটা হাসির ঝিলিক খেলে গেল, বাঁ-গালটা সামান্য কেঁপে উঠল। সোমনাথ অনেকটা বিমূঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে রইল। কী নিষ্ঠুর চাপা-হাসি। নিজেকে সামলে নিয়ে ও তার উদ্দেশ্য জ্ঞাপন করল, মি ওয়াঞ্চু অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলে উঠলেন যে তিনি এখন ব্যস্ত, সময় হবে না। সোমনাথ মনে মনে একটু আহত হয়েই ফিরে এল। দিনের বেলার অমায়িক ব্যবহারের সঙ্গে ভদ্রলোকের এখনকার রূঢ় আচরণের মধ্যে কোনো সামঞ্জস্য ও খুঁজে পাচ্ছে না।
রাত্রে খাবার টেবিলে আবার ওদের দেখা হল। কালকের মতো আজও মি ওয়াঞ্চুর জন্য সেই একই বিশেষ ব্যবস্থা, প্লেট ভরতি মাংসের বিরাট খণ্ড, আর সোমনাথের জন্য ভাত, কী-একটা শাকের তরকারি আর মাংসের স্টু। মি ওয়াঞ্চু ছুরি দিয়ে চাকটাকে নিপুণভাবে টুকরো টুকরো করে কেটে কাঁটায় গেঁথে মুখে পুরছেন, তাঁর চোখে-মুখে একটা তৃপ্তির ভাব ফুটে উঠেছে। হঠাৎ তিনি মুখ তুলে সোমনাথের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনি সব দরজা জানলা খুলে শোবেন, এখানে চোরডাকাতের ভয় নেই।’ সোমনাথের কেমন যেন খটকা লাগল। কাল রাত্রে ও যে ওই ঘটনার পর বারান্দায় যাবার জানলাটা বন্ধ করে শুয়েছিল, তা ভদ্রলোক জানলেন কী করে? তবে কি তিনি রাত্রে বারান্দা দিয়ে ওর ঘরের দিকে এসেছিলেন! ও আরও লক্ষ করল যে ভদ্রলোক খাওয়া বন্ধ করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। ও মুখে বলল, ‘আচ্ছা।’
নিজের ঘরে এসে একটা সিগারেট ধরিয়ে ও চিন্তা করতে লাগল। নানা উদ্ভট কল্পনা ওর মাথায় এসে জড়ো হচ্ছে, কিন্তু তার কোনো যুক্তিসংগত সমাধান ও যেন খুঁজে পাচ্ছে না। দুপুরে টানা ঘুম দেওয়ায় ওর ঘুমও আসছিল না, অসমাপ্ত বইটা নিয়ে ও একটা চেয়ার টেনে বসল। কতক্ষণ পড়েছিল খেয়াল নেই, হঠাৎ হাতঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই ও দেখল দশটা বেজে গেছে। ও এবার বই বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল, ওর মাথায় একটা প্ল্যান এসেছে। আজ রাতে ও ঘুমুবে না, সমস্ত ব্যাপারটার একটা ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত ও যেন স্বস্তি পাচ্ছে না। বারান্দার জানলাটা খুলে দিয়ে ও ফুঁ দিয়ে মোমবাতি নিভিয়ে দিল। রিভলভারটা হাতে নিয়ে ওই জানলার ঠিক উলটো দিকের দেয়াল ঘেঁষে চেয়ারাটায় পা তুলে ও বসল। তারপর শুরু হল নীরব প্রতীক্ষা।
প্রথম ঘণ্টায় কিছুই হল না। দ্বিতীয় ঘণ্টায় সোমনাথের ঢুলুনি এল, হাই উঠতে লাগল। তৃতীয় ঘণ্টায় ও যেন আর চোখ খুলে চাইতে পারছে না। আবার চমকে জেগে উঠছে। এই ঘুম-জাগরণের মধ্যে হঠাৎ একটা বোঁটকা গন্ধে ও সজাগ হয়ে উঠল।
ঘরের মধ্যে চাঁদের আলো এসে পড়েছে, তবে ঘরটা খুব বড়ো তাই শুধু খানিকটা জায়গা আলোয় ভরে গেছে। সেই আলো-আঁধারিতে ওর মনে হল যেন একটা ছায়া-প্রাণী বিছানার দিকে এগুচ্ছে। ও বাঁ-হাতে টর্চটা ধরে ডান হাতে রিভলভারটা তুলে নিল, তারপর টর্চের বোতাম টিপল। টর্চের উজ্জ্বল আলোয় যা ওর চোখে পড়ল তাতে অসমসাহসী ব্যক্তিরও বুক হিম হয়ে যাবে। একটা নেকড়ে সামনের দুটো থাবা বিছানার ওপর তুলে দাঁড়িয়েছে। আলো জ্বালতেই নেকড়েটা ওর দিকে মুখ ফেরাল। কী হিংস্র মুখ! জিভ আর দাঁত বের করে ওটা যেন মুখ খিঁচিয়ে উঠল, দুই চোখে ক্রূর দৃষ্টি। সঙ্গেসঙ্গে সোমনাথের রিভলভার গর্জে উঠল আর নেকড়েটা একটা চাপা গর্জন করে বারান্দার দিকে ছুটে গেল। সোমনাথ কয়েক মুহূর্ত নিশ্চল হয়ে বসে রইল। ও বিছানায় ঘুমিয়ে থাকলে নেকড়েটা নিশ্চয় ওর টুঁটি কামড়ে শেষ করে দিত। গুলিটা কি ওর গায়ে লেগেছে? যেমন আর্তনাদ করে ওটা ছুটে গেল, তাতে মনে হয় ওটা আহত হয়েছে। আহত পশু ভীষণ হিংস্র হয়ে ওঠে। সোমনাথ রিভলভারটা হাতে নিয়ে সন্তর্পণে বারান্দার দিকে এগুলো। বারান্দার এদিক-ওদিক তাকিয়ে ও জন্তুটাকে আর দেখতে পেল না। জানলাটা বন্ধ করে ও চিন্তিত মুখে বিছানায় এসে বসল। ওর গুলির শব্দে কেউ জেগে উঠল না, এটা ওর কাছে আশ্চর্য বলেই মনে হল। তবে বাড়িটা এত বড়ো, একটা ঘরের সঙ্গে অন্য ঘরের ব্যবধান এত বেশি যে গুলির শব্দ অন্য প্রান্তে না পৌঁছোলেও বিস্মিত হবার কিছু নেই। কিন্তু নেকড়েটা এল কোত্থেকে! পুরোনো বাড়ি, কোনো ভাঙাচোরা দরজা বা পথ থাকা বিচিত্র নয়। ও আবার শুয়ে পড়ল।
সোমনাথের ঘুম ভাঙল বেশ বেলায়। হাত মুখ ধুয়ে ও নীচে নেমে এল। মি ওয়াঞ্চু ওকে দেখে হাসিমুখে বলে উঠলেন, ‘কী ব্যাপার! রাত্রে ভালো ঘুম হয়নি?’
সোমনাথ তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকাল, শান্ত, স্নিগ্ধ হাসি, কোনোরকম কপটতার আভাসমাত্র নেই। ও বলল, ‘না, কাল রাত্রে ভালো ঘুম হয়নি।’
মি ওয়াঞ্চু বললেন, ‘নতুন জায়গায় প্রথম প্রথম ঘুমের একটু অসুবিধে হয়, দুপুরে ঘুমিয়ে নেবেন।’
ব্রেকফাস্ট সেরে ওরা আবার কাগজপত্র নিয়ে বসল; কেমনভাবে ও কী শর্তে দলিল তৈরি হবে সেটা আজই পাকাপাকি করে ও একটা খসড়া তৈরি করবে। খসড়াটা মি ওয়াঞ্চুকে দিয়ে কাল সকালের মধ্যেই অনুমোদন করিয়ে ও বেলা আড়াইটেয় বেরিয়ে পড়বে। সেই হাঁটা পথে চৌরাস্তার মোড়ে গিয়ে ওকে স্টেশনগামী বাস ধরতে হবে। রাত আটটায় ট্রেন, কিন্তু ওটাই স্টেশনে যাবার শেষ বাস, সোমনাথ আগেই খবর নিয়েছিল বাস সাড়ে তিনটেয় চৌরাস্তার মোড়ে পৌঁছায়, একটু আগেই ও বেরুতে চায়। ওই বাসটাই আবার বিকেলের গাড়ির যাত্রী নিয়ে ফিরে যায়। সোমনাথ ওই ফিরতি বাসেই এখানে এসেছিল। ওর রিটার্ন টিকিট কাটা আছে, চিন্তার কোনো কারণ নেই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, এখানকার কাজ চুকিয়ে পালাতে পারলে ও যেন বাঁচে।
আলোচনা ও কাজের ফাঁকে মি ওয়াঞ্চু একটা আইনের বইয়ের খোঁজে উঠে দাঁড়ালেন। তিনি যখন হেঁটে হেঁটে আলমারিগুলি দেখছিলেন তখন সোমনাতের নজরে পড়ল যে তিনি সামান্য খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছেন, ডান পায়ের গোড়ালির কাছে একটা ব্যান্ডেজ। মি ওয়াঞ্চুর হঠাৎ খেয়াল হল সোমনাথ তাঁর পায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি বললেন, ‘একেই বলে দুর্ভোগ। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি গোড়ালি দিয়ে রক্ত পড়ছে, যেন ছুঁচোলো দাঁত দিয়ে কেউ কামড়েছে। ছুঁচো-টুঁচো হবে বোধ হয়, বেড়ালেও নখ দিয়ে আঁচড়াতে পারে। একটা এ টি এস দিতে পারলে ভালো হত। সোমনাথের মনে হল নেকড়ের কথাটা বলে, কিন্তু বলি বলি করেও কি ভেবে কথাটা আর বলা হল না। মি ওয়াঞ্চু হয়তো কথাটা হেসেই উড়িয়ে দেবেন।
মধ্যাহ্নভোজনের পর মি ওয়াঞ্চু সোমনাথকে পাঁচ মিনিটের জন্য তাঁর লাইব্রেরিতে আহ্বান করলেন। দু-জনে মুখোমুখি বসার পর মি ওয়াঞ্চু তাঁর রিভলভিং চেয়ারে হেলান দিয়ে চেয়ারটাকে ডাইনে বাঁয়ে ঘোরাতে ঘোরাতে বললেন, ‘মি মুখার্জি, আপনার সঙ্গে পরিচয় হয়ে, কথাবার্তা বলে, আমি খুব আনন্দ পেয়েছি। বুঝতেই তো পারছেন, বাইরের জগতের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নেই বললেই চলে। আজ কত বছর পরে যে একজন বাইরের লোকের সান্নিধ্যসুখ অনুভব করলাম তা হিসেব করে বলতে পারব না। আমি হয়তো আপনাকে যথেষ্ট সুখস্বাচ্ছন্দ্য দিতে পার নি, এখানে আপনার অসুবিধেও হয়েছে অনেক, আশা করি আপনি আমার অক্ষমতাকে নিজ গুণে ক্ষমা করবেন।’
সোমনাথ অপ্রস্তুত বোধ করল, বলে উঠল, ‘না মি ওয়াঞ্চু, আপনার আতিথেয়তা সম্বন্ধে এতটুকু অভিযোগ আমার নেই। খাওয়া-দাওয়া, যত্ন কোনো কিছুর ত্রুটি আপনি রাখেননি। ইউ আর এ পারফেক্ট হোস্ট।’
মি ওয়াঞ্চু মৃদু হাসলেন, তারপর ড্রয়ার থেকে সুন্দর কারুকার্য করা কাঠের একটা ছোটো বাক্স বের করে বললেন, ‘আর হয়তো আমাদের দেখা হবে না। আমাদের এই পরিচয়টুকু অক্ষয় রাখার উদ্দেশ্যে আমি আপনাকে সামান্য একটা সুভেনির দিতে চাই। আপনি এটা নিলে আমি খুশি হব।’
তিনি কাঠের বাক্সের ডালাটা খুলে সোমনাথের দিকে এগিয়ে দিলেন। বাক্সের ভেতর একটা দামি সোনার ঘড়ি। সোমনাথ বলে উঠল, ‘এ যে অনেক দামি।’
মি ওয়াঞ্চু বাক্সটা তার হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন, ‘আপনার বন্ধুত্ব আমার নিঃসঙ্গ জীবনে আরও অনেক বেশি দামি মি মুখার্জি, আশা করি আপনিও আমাকে মনে রাখবেন, এ ঘড়িটাই আমার কথা আপনাকে মনে করিয়ে দেবে।’ সোমনাথ অভিভূত হল।
দুপুরে ঘুমের পর সোমনাথ আবার বেড়াতে বেরুল। হাঁটতে হাঁটতে ও চৌরাস্তার মোড়ে এল। স্টেশন থেকে বাসটা ফিরে এই পথ দিয়েই যাবে। সন্ধে নেমে আসায় ও আর বাসের জন্য অপেক্ষা করল না, চারদিকে যা জঙ্গল, বাঘ, ভালুক বেরুনো অসম্ভব নয়।
বাড়ি ফিরে আজ আর ও মি ওয়াঞ্চুর সঙ্গে দেখা করার জন্য লাইব্রেরির দিকে গেল না, গত দু-সন্ধ্যায় ভদ্রলোকের সান্নিধ্যে ওর অভিজ্ঞতা মোটেই প্রীতিকর হয়নি। ও তার ঘরে গিয়ে ফাইলটা খুলে বসল, খুঁটিনাটি বিষয় আলাদা কাগজে নোট করে নেওয়া দরকার, কলকাতায় ফিরে ফার্মের বড়োকর্তাদের কাছে একটা বিস্তারিত রিপোর্ট পেশ করতে হবে।
রাত্রে খাবার টেবিলে মি ওয়াঞ্চুর সঙ্গে আবার দেখা হল। ভদ্রলোকের মুখটা যেন চিন্তান্বিত, কুটিল চোখটি যেন একটা মতলব আঁটছে। হঠাৎ মুখ তুলে অনেকটা বিদ্রূপের কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘আজও বারান্দার জানলাটা বন্ধ করে শোবেন নাকি?’
সোমনাথের মনে হল ভদ্রলোক যেন ওকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন, ও ফস করে বলে ফেলল, ‘খুলেই শোব।’ মি ওয়াঞ্চুর চোখের দৃষ্টিটা যেন একটু নরম হয়ে এল। তিনি বললেন, ‘ভয় পাবার কিছু নেই, আমি বলেছি না, এখানে চোর ডাকাতের ভয় নেই।’
খাওয়া শেষ হলে মি ওয়াঞ্চু বললেন, ‘আজ আমি নিজের হাতে আপনাকে কফি বানিয়ে খাওয়াব, স্পেশাল কফি।’ পাহাড়ি লোকটি কফির সাজসরঞ্জাম গুছিয়ে টেবিলের ওপর রাখল। মি ওয়াঞ্চু নানারকম হিসেব করে কফি বানালেন। সোমনাথ অবশ্য ওর দিকে এগিয়ে দেওয়া কাপে চুমুক দিয়ে কোনো বৈশিষ্ট্য বুঝতে পারল না। মি ওয়াঞ্চু তাঁর কাপটা সামান্য তুলে সোমনাথের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনার নিরাপদ রাত্রি প্রার্থনা করছি।’
ঘরে ফিরে এসে সোমনাথ চিন্তা করতে লাগল। মি ওয়াঞ্চু বারান্দায় যাবার জানালাটা খুলে রাখার এত পক্ষপাতী কেন? কী তাঁর উদ্দেশ্য হতে পারে। ও অবসর সময় সমস্ত বাড়িটা তন্নতন্ন করে খুঁজেছে; কিন্তু কোনো নেকড়ে কেন, একটা কুকুরেরও দেখা পায়নি। অবশ্য জঙ্গল থেকে হিংস্র প্রাণীর লোহার গেটের গরাদের মধ্য দিয়ে বাড়ির সীমানার মধ্যে ঢুকে পড়া মোটেই অস্বাভাবিক নয়।
কী মনে করে সোমনাথ গতকাল রাত্রে যেখানে চেয়ারটা রেখেছিল আজ তার উত্তর কোণে সেটাকে সরিয়ে নিল। দুপুরে ও ঘুমিয়েছিল তবু আজ যেন খুব তাড়াতাড়ি ঘুম আসছে, কিছুতেই চোখ খুলে রাখতে পারছে না। সোমনাথ ঘুম কাটাবার জন্য ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগল। গোটা রাত সামনে পড়ে আছে, এখনই ঘুম এলে তো মুশকিল। আজ ও নেকড়েটাকে গুলি করে মারবেই।
হঠাৎ একটা সন্দেহ ওর মনে দোলা দিয়ে উঠল। কফির মধ্যে ঘুমের ওষুধ মেশানো ছিল না তো! চিন্তাটা মাথায় আসতেই ওর মনে পড়ল কফিটা কেমন যেন বিস্বাদ লেগেছিল, ওটা বানাবার সময় মি ওয়াঞ্চুর পক্ষে চট করে কিছু মিশিয়ে দেওয়া মোটেই অসম্ভব ছিল না। সেইজন্যেই কি তিনি নিজের পেয়ালায় চুমুক দেবার আগে ওর নিরাপদ রাত্রি কামনা করেছিলেন! এখন সোমনাথের মনে হচ্ছে তাঁর কণ্ঠস্বরে যেন একটা ব্যঙ্গের সুর ছিল। মুখের হাসিটাও ভদ্রলোকের কেমন যেন অদ্ভুত লেগেছিল। রাগে সোমনাথের মুখ লাল হয়ে উঠল, এ কী ধরনের রসিকতা! তাকে নেকড়ে দিয়ে খাইয়ে মি ওয়াঞ্চুর কী লাভ হবে! বরং ও ফিরে গিয়ে যে রিপোর্ট দাখিল করবে তার ওপরই জমি বিক্রয় সংক্রান্ত চুক্তিপত্রের চূড়ান্ত ফলাফল নির্ভর করছে। তাতে মি ওয়াঞ্চুর লাভ বই ক্ষতি নেই।
কিন্তু এখন ও কী করবে! বারান্দায় যাবার জানলাটা বন্ধ করে দেবে! পরক্ষণেই মি ওয়াঞ্চুর ওই চ্যালেঞ্জ ওর মনে পড়ল। না, ও হার স্বীকার করবে না। ও অসমাপ্ত বইটা নিয়ে বসল। কিছুক্ষণ পর আবার হাই উঠতে লাগল। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে ও দেখল মোটে রাত দশটা। সারারাত জেগে বসে থাকা অসম্ভব, কফির সঙ্গে নিশ্চয় ঘুমের ওষুধ মেশানো ছিল।
সোমনাথ ঘরের চারদিকে তাকাল। একটা জানালার পাশে দেওয়াল ঘেঁষে সাবেকি আমলের প্রকাণ্ড একটা কাঠের আলমারি, যেমন লম্বা তেমন চওড়া। সোমনাথের মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। আলমারির মাথায় একজন অনায়াসে গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকতে পারে। নেকড়ের হাত থেকে রক্ষা পাবার বেশ নিরাপদ জায়গা। সোমনাথ আর দ্বিরুক্তি করল না। বিছানার চাদর আর বালিশটা আলমারির মাথায় ছুড়ে দিয়ে, টর্চ ও রিভলভারটা নিয়ে জানালায় ভর দিয়ে সেখানে উঠে পড়ল। ও এই ঘরে থাকবে বলে ঘরটা পরিষ্কার করে রাখা হয়েছিল, আলমারির মাথাটাও ঝাড়া হয়েছিল তাই রক্ষে, নইলে বহুদিনের অব্যবহারে যে পরিমাণ ধুলোর স্তর জমা উচিত তার ওপর পুরো একটা রাত কাটানোর কথা ভাবতেই সোমনাথের গা ঘিন ঘিন করে উঠল। বালিশে মাথা ঠেকাবার সঙ্গেসঙ্গে গাঢ় ঘুম ওকে আচ্ছন্ন করে ফেলল।
বোধ হয় প্রচণ্ড প্রাণশক্তির দরুন আর ভীষণ একটা উৎকণ্ঠা নিয়ে ঘুমোবার ফলেই গভীর রাতে ওর ঘুম ভেঙে গেল। সমস্ত ঘর একটা বোঁটকা গন্ধে ভরে গেছে। একটা হিংস্র চাপা গর্জনে ও চমকে উঠল। চাঁদের আলোয় সোমনাথ দেখল নেকড়েটা ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। ঘরে ওকে খুঁজে না পেয়ে ওটা খেপে গেছে মনে হচ্ছে। সোমনাথ রিভালভারটা দৃঢ় মুষ্টিতে চেপে ধরল তারপর টর্চের আলো নেকড়ের ওপর ফেলল। মুখে আলো পড়তেই নেকড়েটা মুখ তুলে আলমারির মাথার ওপর তাকাল। সোমনাথের স্পষ্ট মনে হল জানোয়ারটার মুখে যেন একটা দারুণ বিস্ময়ের চিহ্ন ফুটে উঠেছে। সোমনাথ লক্ষ্য ঠিক করে ট্রিগার টিপল। সঙ্গেসঙ্গে একটা তীক্ষ্ন আর্তনাদ করে নেকড়েটা বারান্দার দিকে ছুটে গেল। সোমনাথের মনে হল যেন যন্ত্রণায় হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ওটা বারান্দা থেকে এক লাফ মারল, কারণ নীচে ভারী কিছু একটা পড়ার শব্দ কানে এল ওর।
সোমনাথ আলমারির মাথা থেকে নীচে নেমে এসে তাড়াতাড়ি জানলাটা বন্ধ করে দিল। নেকড়েটা যে গুরুতর আহত হয়েছে সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আকাশ হঠাৎ কালো মেঘে ছেয়ে গেল, বাইরেটা ঘুটঘুটে অন্ধকার।
ভোরবেলা দরজায় ঘন ঘন করাঘাত হতেই সোমনাথের ঘুম ভেঙে গেল। তাড়াতাড়ি দরজা খুলতেই পাহাড়ি লোকটা আঁউ আঁউ করে ওকে কী যেন বলতে চাইল। সে কী বলতে চায় সোমনাথ তার এক বর্ণও বুঝতে পারল না। লোকটি তখন ওর হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে চলল। একতলায় নেমে সদর দরজা দিয়ে লোকটি বাইরে বেরিয়ে এল, তারপর প্রায় ছুটেই চলল। বাড়িটার পশ্চিম দিকে, সোমনাথের ঘর লাগোয়া বারান্দার ঠিক তলায় এসে লোকটি থামল, তারপর আঙুল দিয়ে মাটিতে-পড়ে-থাকা বস্তুটির ওপর ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করল।
সোমনাথ ভীষণ চমকে উঠল। মাটিতে পড়ে আছেন মি ওয়াঞ্চু, মনে হয় যেন উঁচু থেকে পড়ে যাওয়ায় ঘাড় ভেঙে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। আরও একটা জিনিস নজরে পড়ল সোমনাথের। মি ওয়াঞ্চুর ঘাড়ে একটা ক্ষত, ঘাড় ঘেঁষে একটা গুলি চলে গেলে যেমন ক্ষতের সৃষ্টি হয়, অনেকটা তেমন। রক্ত শুকিয়ে আছে। হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে রইল সোমনাথ। সমস্ত ব্যাপারটা ওর বুদ্ধির অগম্য।